১.৫৬-৬০ মাকে টেনে তুলল তছি পাগলনি

১.৫৬

গভীর রাতে মাকে টেনে তুলল তছি পাগলনি। ওমা, ওডো তো। ওডো।

ছাপড়া ঘরের ভিতরে গাঢ় অন্ধকার। এই অন্ধকারে পাশাপাশি শুয়েছিল তিনজন মানুষ। তছি তছির মা আর আবদুলের ছোটছেলে বারেক। বারেক একেবারে দাদী ন্যাওটা। দিনেরবেলা যেখানে থাকুক না থাকুক সন্ধ্যা হলে দাদীর আঁচল আর ছাড়ে না। রাতের খাওয়া দাওয়া সব দাদীর হাতে। পেশাব পায়খানা ধরলে তাও করাতে হবে দাদীর। আর ঘুম তো আছেই। দাদীর বিছানায় শুয়ে তার বুকের কাছে মুখ গুঁজে না। দিলে ঘুমই হয় না বারেকের।

এদিকে সন্ধ্যার পর থেকে নাতিটা তার লগে লগে থাকে বলে, দিনের আলো নিভে যাওয়ার পর থেকে তছির মাও বারেকের জন্য আকুল হয়ে যায়। বারেককে এক পলক না দেখলে অস্থির লাগে। বারেক একরাত কাছে না থাকলে ঘুম হয় না। বাড়ির পুবের ভিটার ছাপড়াঘরের মেঝেতে একপাশে পাগল মেয়ে অন্যপাশে নাতি না থাকলে অসহায় লাগে। মনে হয় কী যেন নাই, কী যেন নাই।

গিরস্তের সংসারে বউ শাশুড়ির ঝগড়া তো আছেই। কোনও কোনওদিন আবদুলের বউ আর তার শাশুড়ির ঝগড়া হলে, শাশুড়িকে জব্দ করবার জন্য রাতেরবেলা ছোট ছেলেটাকে নিজের কাছে আটকে রাখে আবদুলের বউ। মায়ের হাতে ভাত পানি ভয়ে ভয়ে খায় ছেলে কিন্তু শোয়ার সময় লাগে গণ্ডগোল। ছেলে কিছুতেই অন্য ভাই বোনের লগে মা বাবার পাশে শোবে না। প্রথমে ঘ্যান ঘ্যান করবে, আমি দাদীর কাছে যামু। ওমা, আমি দাদীর কাছে যামু। তারপর আরম্ভ করবে কান্না। শাশুড়ির ওপরকার জেদ তখন ছেলের ওপর ঝাড়ে আবদুলের বউ। গুমগুম করে কিল মারে ছেলের পিঠে। দাঁতে দাঁত চেপে বকাবাজি করে ছেলেকে। চুপ কর গোলামের পো। চুপ কর। দাদীর কাছে যাইবো! তুই কি তর দাদীর পেডে পয়দা অইছস না আমার পেডে! দাদীর কাছে হুইলে ঘুম আহে আমার কাছে আইবো না ক্যা?

ছেলে তারপর গুঙিয়ে গুঙিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদে। মারের ভয়ে আর কথা বলে। রাত গম্ভীর হয়, ছেলের আর ঘুম আসে না। মা বাবা ভাই বোনের পাশে শুয়ে উসপিস উসপিস করে সে, এপাশ ওপাশ করে আর থেকে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

ওদিকে তছির পাশে শুয়ে তার মায়েরও একই অবস্থা। ঘুম আসে না। কী রকম যে ছটফট ছটফট করে! মায়ের এই অবস্থা দেখে তছি পাগলনিরও মন খারাপ হয়। মাকে বুঝ দেওয়ার জন্য বলে, তুমি এমুন কইরো না মা। আটু সবুর করো, আটু রাইত অউক বারেকরে আমি আইন্না দিমুনে।

মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কেমতে আনবি? ঐ গোলামের ঝিয়ে কি পোলাডারে ছাড়বো?

ছাড়বো। তুমি দেইক্কোনে।

গভীর রাতে তছি তারপর ছাপড়াঘরের ঝাঁপ খুলে বেরয়। পা টিপে টিপে এসে দাঁড়ায় আবদুলের ঘরের সামনে। নরম হাতে বেডায় টোকা দিয়ে ফিসফিস করে ডাকে, বারেক, ও বারেক ঘুমাইছস বাজান, ঘুমাইছস?

বারেকও তার দাদী আর পাগল ফুফুর মতো জেগে থাকে। ফুফুর গলা শুনেই বিছানা থেকে মাথা তুলে ঘরের ভিতরটা দেখে। ফুফুর মতন ফিসফিস করে বলে, না ঘুমাই নাই ফুফু।

তাইলে বাইর অ। কেঐ যেন উদিস না পায়।

আইচ্ছা।

ছেলে তারপর পা টিপে টিপে ঝাপের কাছে যায়। যেন আওয়াজ না হয় এমন ভঙ্গিতে ঝাঁপ একটুখানি ফাঁক করে নিজের শিশু শরীর সেই ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দেয়। বাইরে বের হবার লগে লগে পাগল ফুফু তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। আঁচলে জড়িয়ে বুকে করে নিয়ে যায় নিজেদের ঘরের দিকে। দাদীর বুকে নাতিকে পৌঁছে দেওয়ার পর যেন শান্তি তছির।

রাত দুপুরে পাগল ননদিনী এসে যে বেডায় টোকা দিয়ে তার ছেলেকে ডাকছে, ছেলে যে ঝাঁপ গলিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে এসবই টের পায় আবদুলের বউ। তখন সে আর কোনও কথা বলে না। মানুষের জন্য মানুষের এই টান, মায়া মমতার এই খেলাটা তার ভাল লাগে। শাশুড়ির লগে ঝগড়াঝাটির কথা ভুলে যায়। ছেলে বেরিয়ে গেছে বলে আলগা হয়ে আছে ঝাঁপ। উঠে যত্ন করে সেই ঝাঁপ লাগায় সে। তারপর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে।

নাতিকে রাতেরবেলা নিজের কাছে রাখতে রাখতে তছির মায়ের এমন এক অভ্যাস হয়েছে, ঘুমিয়ে থাকলে বারেক ডাকলে তো মনে হয়ই বারেক ডাকছে, তছি ডাকলেও মনে হয় বারেকই ডাকছে। আজ রাতেও তাই হল। তছির ডাকে ধরফর করে উঠল সে! কিন্তু জড়িয়ে ধরল বারেককে। কী অইছে মিয়াভাই? ডাক পারো ক্যা? পেশাব করবা?

বারেক ঘুমে কাদা। সে কোনও সাড়া দিল না। অন্যপাশ থেকে তছি বলল, বারেকে তোমারে ডাক দেয় নাই। আমি ডাকদিছি।

ক্যা?

কথার কাম আছে।

তছির মা হাই তুলল। রাইত-দোফরে কীয়ের কথা? বিয়ানে কইচ।

বিয়ানে কওন যাইবো না। অহনঐ কমু!

ইস কুয়ারা।

কথাটা বলেই ভয় পেলে গেল তছির মা। রাত দুপুরে পাগল মেয়ের লগে রাগ করা ঠিক হবে না। কী না কী করে ফেলে। হয়তো চিইক্কর (চিৎকার) শুরু করল, হয়তো একহাতে মুঠি করে ধরল মায়ের চুল। হয়তো কিল থাবড় মারল মাকে, খামছি দিয়ে ছাল চামড়া তুলে ফেলল।

ভয়ে ভয়ে তছির মা তারপর বলল, আইচ্ছা ক।

এক বেডা আমারে নষ্ট করতে চাইছিলো।

কথাটা শুনে আঁতকে উঠল তছির মা। চোখে লেগে থাকা ঘুম পলকে উধাও হয়ে গেল। চাপা ভয়ার্ত গলায় বলল, কচ কী? কবে?

আইজঐ।

কোনহানে? সীতারামপুর। মুরলিভাজা কিনতে গিয়া?

না। আমি সীতারামপুর যাই নাই। আমি গেছিলাম কোলাপাড়া।

 কার লগে গেছিলি?

ঘটনা খুলে বলল তছি। রুস্তম রিকশাআলা কীভাবে তাকে রিকশায় তুলেছে, কীভাবে কোলাপাড়া বাজার থেকে কিনে এনেছে মুরুলিভাজা, কীভাবে নিয়ে গেছে খালপারের নির্জন ছাড়াবাড়িতে, কীভাবে দখল নিতে চেয়েছে তছির শরীরে আর কীভাবে তছি তাকে গামছার ফাঁসে আটকে শায়েস্তা করেছে, সব বলল। শেষ পর্যন্ত লোকটার যে চেতন ছিল না, বিঘত পরিমাণ জিভ বেরিয়ে এসেছিল মুখ থেকে এবং তছি তাকে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে খালের পানিতে এসব শুনে গলা শুকিয়ে গেল তছির মায়ের। ঢোক গিলে কোনও রকম সে বলল, বেডায় মইরা যায় নাই তো? মাইরা হালাচ নাই তো বেডারে?

তছি নির্বিকার গলায় বলল, কইতে পারি না। আমার তহন কান্দন আইছিলো। কানতে কানতে সড়কে উটছি। দৌড়াইতে দৌড়াইতে বাইতে আইছি। বাইত্তে আইয়া দেকলা না কেথা মুড়াদা (কাঁথা মুড়ি দিয়ে) হুইয়া পড়লাম। তুমি ভাত খাইতে ডাকলা, উটলাম না। দোফইরা ভাত খাই নাই, রাইতকার ভাত খাই নাই। হুইয়াঐ রইলাম। কোন মরার মুরলি যে গোলামের পোয় খাওয়াইলো, আমার দিহি আর খিদা লাগে না। আর এই যে এতক্ষুণ হুইয়া রইলাম, ঘুম কইলাম আহে নাই আমার। এমতেঐ হুইয়া রইলাম।

তছির মা বলল, আমি এই হগল চিন্তা করতাছি না। আমি চিন্তা করতাছি অন্যকথা।

 কী কথা?

 বেডা যুদি মইরা গিয়া থাকে তাইলে তো সব্বনাশ অইবো।

 কীয়ের সব্বনাশ?

বাইত্তে দারগা পুলিশ আইবো। দারগা পুলিশ আইয়া ধইরা লইয়া যাইবো তরে। জেলে দিবো তরে, ফাঁসিতে দিবো।

একথায় তছি একেবারে দিশাহারা হয়ে গেল। ভয়ে আতংকে কুঁকড়ে গেল। কও কী?

হ। মানুষ খুন করলে ফাঁসিতে দেয়।

হায় হায় আমি তো এইডা বুজি নাই। ওমা, মা তয় আমি অহন কী করুম? দারগা পুলিশে আইয়া যুদি ধইরা লইয়া যায় আমারে? যুদি ফাঁসিতে দেয়?

যেন এই রাত দুপুরেই দারোগা পুলিশ এসে দাঁড়িয়েছে বাড়ির উঠানে, কোন ঘরে লুকিয়ে আছে তছি, জানার চেষ্টা করতাছে। এখুনি যেন ঝাঁপ সরিয়ে এই ঘরে ঢুকবে তারা, তছিকে ধরবে, এরকম আতংকিত অবস্থা হল তছির। অতিরিক্ত ভয় পাওয়া শিশু যেভাবে মায়ের বুকে মুখ লুকায়, মাকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে কুঁকড়ে মুকড়ে যায়, তছি তেমন শিশু হয়ে গেল, মায়ের বুকে মুখ লুকাল। শরীর তখন থরথর করে কাঁপছে তার। গলা বন্ধ হয়ে আসছে। তবু ফিসফিস করে বলল, আমারে কোনওহানে হামলাইয়া (লুকিয়ে) থোও মা। কোনওহানে হামলাইয়া থোও। এমুন জাগায় হামলাও, দারগা পুলিশ আইয়া য্যান বিচড়াইয়া না পায় আমারে। আমার য্যান ফাঁসিতে না দেয়। মাগো, মরণরে বহুত ডরাই আমি।

অসহায় মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে তছির মা তখন স্থির হয়ে আছে। এই মেয়েকে সে কোথায় লুকিয়ে রাখবে!

.

১.৫৭

হামিদা বলল, কীরে তুই তর বাপের লগে কথা কচ না?

উঠানের কোণে দাঁড়িয়ে ছাই দিয়ে দাঁত মাজছে নূরজাহান। খানিক আগে ঘুম থেকে উঠেই রান্নাচালায় ছুটে গেছে। চুলা থেকে নাড়ার ছাই তুলে বাঁহাতের তালুতে নিয়েছে। এখন উঠানের কোণে দাঁড়িয়ে সেই ছাই ডানহাতের এক আঙুলে ছুঁইয়ে চুঁইয়ে দাঁত মাজছে। নূরজাহানের চারপাশে ঝকমক ঝকমক করতাছে শীত সকালের রোদ। গাছগাছালির ডালপালা চকেমাঠে জমে থাকা কুয়াশা কাটতে শুরু করেছে।

মায়ের কথা শুনে পিরিক করে থুতু ফেলল নূরজাহান। কথা বলল না।

ঘরের পুবকোণে, বাড়ির নামার দিকে কদু উসসির আঁকা (লাউ সিমের মাচান)। লতার গোড়ার কাছে হাতদুয়ের লম্বা আর হাতখানেক চওড়া একখান গর্ত। পানির ঠিলা এনে সেই গর্তটার সামনে রেখেছে হামিদা। এখন ঠিলা কাত করে একটু একটু করে পানি ঢালছে গর্তে। কদু উসসির শিকড় ধীরে শুষে নিচ্ছে পানি। একবারে পানি ঢেলে গর্ত ভরে দিলে অতিরিক্ত পানির চাপে পচন ধরে যেতে পারে শিকড় বাকড়ে। এইজন্য এভাবে পানি দিতে হচ্ছে গোড়ায়। একবার কিছুটা পানি ঢেলে অপেক্ষা করতে হচ্ছে কখন মাটির তলায় চলে যায় পানি, কখন চুমুকে চুমুকে পানি শেষ করে আবার হাঁ করবে কদু উসসির শিকড়।

নূরজাহান কথা বলছে না দেখে চোখ তুলে মেয়ের দিকে তাকাল হামিদা। কথা কচ ক্যা?

নূরজাহান আনমনা গলায় বলল, কী কমু?

জিগাইলাম যে তার বাপের লগে কথা কচ না ক্যা?

ক্যা কথা কই না জানো না তুমি?

 থাবড় দিছে দেইক্কা!

নূরজাহান কথা বলল না। উদাস হয়ে চকের দিকে তাকিয়ে রইল।

হামিদা বলল, পোলাপানে দোষ করলে মা বাপে তাগো মারবো না?

নুরজাহান বলল, কী দোষ করছিলাম আমি।

মাওলানা সাবরে গাইল দিছস। রাজাকার কইছস।

কীর লেইগা কইছি জানো?

প্রথমবারের ঢেলে দেওয়া পানি শুষে নিয়েছে মাটি। ধীরে ধীরে মাটির তলায় মিলিয়ে যাচ্ছে পানি, এই দৃশ্য তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল হামিদা আর কথা বলছিল না। পানি মিলিয়ে যেতেই গর্তের মুখে আবার কাত করল ঠিলা। তুই কইলে সেন্না (তো) জানুম!

হোনতে চাইছো?

এই যে চাইতাছি। ক।

দাঁত মাজতে মাজতে উদাস হয়ে গেল নূরজাহান। অহন আর কইয়া কী অইবো!

কী আবার অইবো! হুনুম।

হোননের কাম নাই। মাইর যহন খাইছিই, আর কমু ক্যা?

গভীর অভিমানে যে বুক ভরে আছে মেয়ের হামিদা তা বুঝলো। বুঝে মন কেমন করে উঠল তার। মায়াবি গলায় বলল, ক আমারে। আমি তর বাপরে কমুনে। আমি কইলাম বুঝছি মাওলানা সাবে আগে তরে কিছু কইছে, নাইলে আতকা তুই তারে এই হগল কচ নাই।

নূরজাহান আবার থুতু ফেলল। আমারে কয় নাই, কইছে বাবারে।

কী কইছে?

 দউবরা।

কথাটা বুঝতে পারল না হামিদা। বলল, কী, কী কইছে?

কইছে তুই দউবরার মাইয়া না! বাবার নাম কেঐ খারাপ কইরা কইলে আমার শইল জইল্লা যায়। তাও আমি কিছু কইতাম না। যহন আমারে অনেক আবল তাবল কথা কইছে তহন আমি তারে পচা মলবি কইছি। রাজাকার কইছি।

তর এই হগল কথার লেইগা মাওলানা সাবে তর বাপরে কী আপমান করছে তুই জানচ?

কী করছে।

হোনলে তর মায়া লাগবো।

আগের মতো অভিমানের গলায় নূরজাহান বলল, এমুন বাপের লেইগা আমার মায়া লাগে না।

একখান থাবড় মারছে দেইক্কা এত খারাপ হইয়া গেল বাপে?

আমারে কিছু না জিগাইয়া, কিছু না হুইন্না মারলো ক্যা? আগে বেবাক কথা আমারে জিগাইতো, বেবাক কথা হুইন্না যুদি দেখতে আমি দোষ করছি, একটা ক্যা দশটা থাবড় মারলেও আমি চেততাম না। কথা নাই বার্তা নাই বাইত্তে আইয়া থাবড় মারল আমারে!

ঠিলার শেষ পানি গর্তে ঢেলে উঠে দাঁড়াল হামিদা। খালি ঠিলা হাতে নূরজাহানের সামনে এসে দাঁড়াল। অমুন সমায় মাথা ঠিক থাকে না মাইনষের।

নূরজাহান কথা বলল না, থুতু ফেলল।

 হামিদা বলল, মাওলানা সাবে তর বাপরে বহুত অপমান করতাছে।

কী অপমান?

রস বেচতে গেছিলো তার বাইত্তে, রসের দাম তো দেয় নাই, তর কথা কইয়া বকাবাজি করতাছে তারবাদে গর্দানে ধাক্কা দিয়া বাড়ির নামায় হালায় দিছে। তরে থাবড় দেওনের পর এই হগল কথা কইয়া তর বাপে বহুত কানছে।

মায়ের কথা শুনে দাঁত মাজতে ভুলে গেল নূরজাহান, চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেল, শ্বাস ফেলতে ভুলে গেল। বাপকে গালাগাল করেছে মান্নান মাওলানা সেই গালাগাল পরিষ্কার শুনতে পেল সে। ঘেটি ধাক্কা দিয়ে কীভাবে বাড়ির নামায় ফেলে দিয়েছে সেই দৃশ্য চোখে দেখতে পেল। দেখে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল নূরজাহানের, চোখ জ্বলতে লাগল। নূরজাহানের ইচ্ছা হল এখনই মান্নান মাওলানার বাড়িতে ছুটে যায়। গিয়ে হাতের থাবায় মুঠ করে ধরে তার দাঁড়ি। একহাতে দাঁড়ি ধরে অন্যহাতে ঠাস ঠাস করে একটার পর একটা থাবড় মারে তার গালে। তারপর প্রচণ্ড জোড়ে এক লাথি মারে তার কোকসা বরাবর। সেই লাথথি খেয়ে হুমড়ি খেয়ে সে যেন গিয়ে পড়ে বাড়ির নামায়। যেখানে পড়েছিল দবির গাছি।

কিন্তু নূরজাহান মেয়ে। মেয়েরা কী পারে এমন করে কোনও পুরুষকে মারতে!

বুকফাটা ক্রোধে, দাঁতে দাঁত চেপে নূরজাহান বলল, আমি যে ক্যান মাইয়া অইয়া জন্মাইছি! আমি যে কেন পোলা অই নাই!

.

১.৫৮

কাম করবেন না বাজান?

মুখ ঘুরিয়ে লোকটার দিকে তাকাল বদর। উদাস, নির্বিকার চোখে খানিক তাকিয়ে রইল তারপর আগের ভঙ্গিতে চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল। কথা বলল না।

 দক্ষিণ মেদিনীমণ্ডলের মাঝ বরাবর, সড়কের নামায় চক। সেই চকে উদাস হয়ে বসেছিল বদর। পায়ের কাছে উপুড় করে রাখা তার য়োড়া। য়োড়ার দিকে তার মন নাই। য়োড়ার দিকে সে একবারও তাকায়নি। সে তাকিয়ে ছিল আকাশের দিকে। চোখে মুখে আশ্চর্য এক উদাসীনতা। আকাশের দিকে তাকিয়ে কী দেখছিল বদর কী দেখছিল না, বদর ছাড়া কেউ তা জানে না।

বেশ খানিকটা বেলা হয়েছে। শীত সকালের কুয়াশা কেটেছে অনেক আগে। রোদ এখন দারাস সাপের মতো তেজাল। দুনিয়াদারি ভেসে যাওয়া এই রোদ তোয়াক্কা না করে নিঃশব্দে কাজ করে যাচ্ছে মাটিয়ালরা। সড়কের মুখে দাঁড়িয়ে তাদের কাজ তদারক করতাছে হেকমত। আলী আমজাদ সাইটে নাই বলে ছাতাটা সে নিজের মাথায় ধরে রেখেছে।

আড়চোখে একবার হেকমতকে দেখল লোকটা তারপর আবার বলল, কাম করবেন না?

এবার আর লোকটার দিকে তাকাল না বদর। আকাশের দিকে যেমন তাকিয়ে ছিল তেমন তাকিয়ে থেকেই শান্ত গলায় বলল, না।

 ক্যা?

চোরেরা এই হগল কাম করে না। তারা খালি চুরি করে।

বদরের কথা বুঝতে পারল না লোকটা। অবাক গলায় বলল, জ্বে!

হ। হারাদিন ঘুমায় চোরেরা, হারারাইত চুরি করে। শইল্লে তেল মাইক্কা, লুঙ্গি কাছা দিয়া খন্তি হাতে লইয়া যায় গিরস্ত বাড়িতে। পিড়া খুইদ্দা গিরস্তঘরে সিং (সিধ) দেয়। দিনের বেলা চোরেগো কোনও কাম থাকে না। আমারও নাই।

ভাঙাচোরা শরীরের বয়স্ক লোকটা এবার থতমত খেল। মাজায় তার গামছার মতো করে বাঁধা খয়েরি রঙের পুরানা কালের একখান চাদর। গায়ে ছেঁড়া হাতাআলা গেঞ্জি। হাতে গোড়া, মাথায় সাপের মতো কুণ্ডলি পাকান নাড়ার বিড়া। মুখের দাঁড়িমোচ ধুলায় ধূসর। কন্ট্রাক্টর সাহেব সাইটে নাই দেখে কাজে ফাঁকি দিয়ে বদরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে। আমোদ ফুর্তিতে ভরপুর বদর কাজ না করে চকে বসে আছে কেন জানার ভারি কৌতূহল হয়েছিল তার। অসুখ বিসুখ করেনি তো বদরের।

কন্ট্রাক্টর সাহেবের তুলনায় লেবার সরদার হেকমতও কম কঠিন লোক না। দশদিকে চোখ তার। হেকমতের সামনে কাজে ফাঁকি দেওয়া খুবই কঠিন। ফাঁকি হেকমতের চোখে পড়বেই। তবু ঝুঁকি লোকটা নিয়েছে। দূর থেকে বসে থাকা বদরকে দেখে বুকের ভিতরে আশ্চর্য এক মমত্ববোধ জেগে উঠেছিল তার। বদরের কাছে না এসে পারেনি। হেকমতের হাতে ধরা পড়লে পড়বে। কন্ট্রাক্টর সাহেবের মতো নির্দয় মানুষ না হেকমত। ধরা পড়লে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেবে না। হাত পায়ে ধরে অনুনয় বিনয় করলে মাফ করে দিবে। বদরের জন্যে না হয় হেকমতের হাত পায়ে ধরবে সে!

কিন্তু বদর এসব কী বলছে! এসব কথার অর্থ কী? চোরদের কাজ থাকে না বলে তার কেন কাজ থাকবে না! 

হাতে ধরা য়োড়া চকের ঘাসে নামিয়ে রাখল লোকটা। কনটেকদার সাব, হেকমত সবার কথা ভুলে বদরের পাশে বসল, নরম গলায় বলল, আপনের কথা কিছু বোঝলাম না বাজান।

মুখ ফিরিয়ে আবার লোকটার দিকে তাকাল বদর। চোখে অচেনা দৃষ্টি। আনমনা গলায় বলল, আপনে জানি কেডা?

লোকটা আবার থতমত খেল। বদরের চোখের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, আপনে আমারে চিনেন না?

চিনা চিনা লাগে! তয় মনে করতে পারছি না।

ক্যা?

কইতে পারি না।

চদরি বাইত্তে আরও অনেক মাইট্টালের লগে আপনেও থাকেন আমিও থাকি। একলগে রাইন্দা খাই, একলগে হুই। সুখদুঃখের কত পাচাইল আপনে আমি পাড়ি, আর আপনে আমারে চিনতাছেন না বাজান! কী অইছে আপনের?

কী যে অইছে কইতে পারি না।

কয়দিন ধইরা দেহি রাইত্রে ঘুমান না। উইট্টা বইয়া থাকেন। বিড়ি টানেন আর একলা একলা কথা কন। এমুন হাকিহুকি কইরা কন, কী কন হুনা যায় না। বোজতে পারি না। আমি যহন এহেনে কামে আইলাম তহন দেহি শইল্লে আপনের বেদম ফুর্তি। তিন জুয়ানের কাম করেন একলা। কনটেকদার সাবে এহেনে পাড়ায় আপনেরে, ওহেনে পাড়ায়। কয়দিন ধইরা দেহি আপনে আর অমুন নাই। আথকা কেমুন বদলাইয়া গেছেন। কাম করেন তো করেন না, কোনও মিহি যান তো যান না। খাইতেও দেহি না আগের লাহান। আপনের কী অইছে বাজান? মনে দুক্কু পাইছেন?

এসব কথায় চোখ ছলছল করে উঠল বদরের। লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল সে।

লোকটা এবার বদরের কাঁধে হাত দিল। আমারে আপনে কন বাজান কী অইছে আপনের? আমারে যুদি আপনে না চিন্না থাকেন তয় কই আমি কে! আমার নাম আদিলউদ্দিন। বাড়ি কামারগাও।

মুখ নত করে চোখের পানি সামলাল বদর। হ অহন চিনছি। যান, আপনে কামে যান।

কামে তো যামুঐ। আপনের কথাডা হুইন্না যাই।

আমার কথা হুইন্না আর কী করবেন! চোরের কথা কেঐ হোনে!

কীয়ের চোর? কীর লেইগা নিজেরে বারাবারে চোর কইতাছেন?

আমি কই না! আমারে কয় মাইনষে!

কোন মাইনষে চোর কয় আপনেরে?

 কনটেকদার সাবে।

আলী আমজাদের কথা শুনে চমকাল আদিলউদ্দিন। কাঁচাপাকা ভুরু কুঁচকে গেল। কনটেকদার সাবে! ক্যা, চোর কইছে ক্যা?

আমি বলে চা মিষ্টি আইন্না পয়সা চুরি করি! আমি বলে রুটি কেলা আইন্না পয়সা চুরি করি। কন, আমি বলে চোর!

কথা বলতে বলতে আবার চোখ ছলছল করে উঠল বদরের। গলা বুজে এল। জড়ান গলায় সে বলল, আমি ভাল বংশের পোলা। পেডের দায়ে মাইট্টাল অইছি। তয়। মাইট্টালগিরি আমার ভাল্লাগে না। কনটেকদার সাবে আমারে এইমিহি ওইমিহি পাড়ায়, চা সিরকেট আনায়, কেলা রুটি আনায়, মিষ্টি আনায়, হেই কাম করতে আমার ভাল্লাগে। পয়সা চুরির লোভে আমি হেই কাম করি না। আমি চোর না। আমার মনে কোনও পাপ নাই। আপনে কন, চোর যদি অমু তাইলে এই কষ্টের কাম করতে আইছি ক্যা! তাইলে তো হারাদিন ঘুমাইতাম, হারারাইত চুরি করতাম। একদিন চুরি কইরা একমাস বইয়া খাইতাম। চোরে কোনওদিন এত কষ্ট করে! কন, আমি বলে চোর!

কথা শেষ করবার আগেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল বদর। হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। বদরের কথা শুনে, বদরের কান্না দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল আদিলউদ্দিন। কাজের কথা ভুলে সেও বসে রইল বদরের পাশে।

.

১.৫৯

হাজামবাড়ির বড়ছেলে আবদুল বাড়ি ফিরল সন্ধ্যাবেলা। পরনে চেক লুঙ্গি আর ফুলহাতা আকাশি রঙের শার্ট। শার্টের ওপর খাকি রঙের মোটা একখান চাদর। চাদরটা গায়ে দেয়নি সে। মাফলারের মতো ভাঁজ করে গলার দুইপাশে ঝুলিয়ে রেখেছে। একহাতে ছোট্ট একখান চটের ব্যাগ। এই ব্যাগে লেপ তোশকের কাজ করবার সুই সুতা, কেঁচি, দুই এক টুকরা সালু কাপড়।

আবদুলের ঝাকড়া চুলে তুলার আঁশ লেগে আছে। পা ধুলায় ধূসর। পা দেখে বোঝা যায় বহুদূর পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে সে। হাঁটার তালে ছিল বলে শরীর ফুটা করে বের হচ্ছিল গরম ভাপ। শীত টের পায়নি। ফলে চাদর গায়ে দেবার দরকার হয়নি।

আবদুলের স্বভাব হচ্ছে বাড়ি ঢুকেই পোলাপানের মতন মাকে ডাকা। কোথাও থেকে ফিরবার পর সে যেন আর বয়স্ক থাকে না পোলাপান হয়ে যায়। কোথায় গিয়েছিল, কী করল, কী দেখল সব মাকে না বলা পর্যন্ত শান্তি নাই।

বিয়ার পর পর এই দেখে খুব হাসাহাসি করত আবদুলের বউ। স্বামীর লগে ঠাট্টা মশকরা করত। আজকাল আর করে না। দিনে দিনে মানিয়ে গেছে। আজকাল বাড়ি ফিরে মাকে আবদুল না ডাকলে আবদুলের বউরই যেন উসপিস উসপিস লাগে। স্বামীকে মনে করিয়ে দেয়, কী, বাইত্তে আইয়া তোমার মারে দিহি আইজ ডাকলা না!

আজ তেমন কিছুর দরকার হল না। আবদুল যখন বাড়িতে এসে উঠল ঠিক তখনই ঘাটপার থেকে উঠে এল আবদুলের বউ। কাঁখে ছোট মেয়ে। মেয়েটা আজ অবেলায় পায়খানা করেছে। পেট খারাপ হয়েছে। ঘাটে নিয়ে মেয়েকে ধুয়ে পাকলে আনল। আবদুলের বউ। সন্ধ্যার হিম শীতল পানি শরীরে ছোঁয়াবার ফলে বিরক্ত হয়েছে মেয়ে। মায়ের কাঁখে বসে ঙো ঙো করে কাঁদছিল। বাড়িতে উঠে দুইবার মাত্র মাকে ডেকেছে আবদুল, মা ওমা, তারপরই বউর কোলে ছোট মেয়েকে কাঁদতে দেখে মায়ের কথা ভুলে গেছে। ব্যস্ত হয়ে বউর দিকে তাকিয়েছে। কী অইছে? মাইয়াডা কান্দে ক্যা?

বউ নরম গলায় বলল, হোচাইছি (শৌচ কর্ম) দেইক্কা। পেট নামাইছে।

কও কী! আথকা পেট নামাইলো?

কুনসুম কী মুখে দিছে কে জানে। হারাদিন চোক্কে চোক্কে রাখন যায়! আমার কাম কাইজ থাকে না!

আবদুল আর কথা বলল না। দুইহাত বাড়িয়ে বউর কোল থেকে মেয়েটাকে নিল। আহো মা, আমার কুলে আহো।

বাপের কোলে গিয়ে কান্না থামাল মেয়ে।

হাতের ব্যাগ বউর হাতে দিয়ে আবদুল বলল, মায় কো? মারে দিহি দেহি না। বাইত্তে নাই।

বউ বলল, আছে। ঘরে আছে।

কী করে?

কেমতে কমু! মনে অয় তোমার বইনের লগে কথা কয়।

আবদুল একটু চমকাল। কী কথা? তছির পাগলামি বাড়ছেনি?

কইতে পারি না। তয় হাদিন আজ বাইত্তে আছিলো। ঘর থিকা বাইর অয় নাই।

ক্যা?

কী জানি!

আবদুল আর বউর দিকে তাকাল না, মা বোন যে ঘরে থাকে সেই ঘরের দুয়ারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ঘরের ভিতর উঁকি মেরে ডাকল, মা ওমা, কো তুমি?

ঘরে কুপি জ্বলছে। কুপির সামনে আনমনা ভঙ্গিতে বসে আছে আবদুলের মা। পাশে কাথা মুড়া দিয়ে শুয়ে আছে তছি। আবদুলের ডাক শুনে একটুও নড়ল না। যেন গভীর ঘুমে ডুবে আছে। সকালের আগে এই ঘুম ভাঙবে না।

মায়ের দিকে তাকিয়ে আবদুল বলল, এমতে বইয়া রইছো ক্যা মা?

 মা ম্লান কাণ্ঠে বলল, কী করুম?

আমি ডাক দিলাম হোনো নাই।

 হুনছি।

তয় দিহি বাইর অইলা না!

এমতেঐ।

তছি হুইয়া রইছে ক্যা?

কী জানি।

হুনলাম আইজ হারাদিন ঘরথনে বাইর অয় নাই। ক্যা? শইল খারাপ? জ্বরজ্বারি আইলোনি?

না। এমতেঐ।

পাগলামি বাড়ছে?

না। একদোম চুপচাপ আছে। হারাদিন ধইরা হুইয়া রইছে। বিচনা থিকা ওডে নাই, কথা কয় নাই, খায় নাই।

না খাইয়া থাকন ভাল না। এই রকম চুপচাপ থাকনও এক রকমের পাগলামি। রাইত্রে উড়াইয়া ভাত খাওয়াইয়ো।

আইচ্ছা।

মেয়ে কোলে দুয়ারের সামনে বসল আবদুল। আমি আইজ গেছিলাম সমশপুর। একখান লেপ আর একখান তোশক বানাইলাম। বড় গিরস্তবাড়ি। রিডামাছ দিয়া ভাত খাওয়াইলো। মজুরি পাইছি একশো কুড়ি টেকা।

আবদুলের মা নরম গলায় বলল, ভাল।

এবার হঠাৎ করেই উত্তেজিত হল আবদুল। ওমা, তোমারে তো আসল কথাডাই কই নাই। কোলাপাড়ার ঐমিহি একখান কাম অইছে।

কী কাম বাজান?

বালের কচুড়িপেনার মইদ্যে একখান লাচ পাওয়া গেছে। জুয়ানমর্দ এক বেডার লাচ। গলায় গামছার গিট্ট দেওয়া। কারা জানি মাইরা খালে হালায় দিছে বেডারে। বেডার নাম রুস্তম। রিশকা বায়।

আবদুলের কথা শুনে ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল মা। কথা বলতে ভুলে গেল।

আবদুল বলল, দুইন্নাইডা যে কী অইছে! মানুষ আর মানুষ নাই। মাইনষের জান গেছে কুত্তা বিলাইয়ের জান অইয়া। মাইনষের জানের কোনও দাম নাই। দুই চাইর পাঁচ টেকার লেইগা মাইনষের জান যায় গা। সামাইন ইট্টু অন্যায়ের লেইগা জান যায় গা।

আবদুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কও তো এই যে বেডাডা মইরা গেল, বেডারে যে এমতে মাইরা হালাইলো, বেডার বউ পোলাপানডি তহন কেমুন করবো! কী খাইবো, কেমতে বাইচ্চা থাকবো? যারা বেডারে মারলো তারা এই হগল কথা একবারও চিন্তা করলো না। মানুষ মানুষরে মাইরা হালায় কেমতে এইডাঐত্তো আমি বুজি না! ওমা, কেমতে মানুষরে মানুষ মাইরা হালায়? যহন একজন মানুষ আরেকজন মানুষরে মারে, তহন যে মারে তার মনে ইট্টু রহম অয় না? ইট্টু দয়ামায়া অয় না?

আবদুলের মা কোনও কথা বলে না, পাথর হয়ে থাকে। চোখের দৃষ্টি স্থির, মুখখান যেন জীবিত মানুষের মুখ না। মুখখানা যেন মৃত মানুষের।

মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আরও কথা হয়তো বলত আবদুল, কোলে বসা মেয়ে ঙো ঙো করে বলল, মার কাছে যামু। বাবা, মার কাছে যামু।

উঠে দাঁড়াল আবদুল। আইচ্ছা লও।

তারপর উঠানের দিকে পা বাড়িয়ে মাকে বলল, তছিরে উডাও মা। উড়াইয়া ভাত পানি খাওয়াও।

মা তবু কথা বলল না।

.

১.৬০

গভীর রাতে ঘুমের ভিতর দবির গাছি টের পেল তার ঘাড়ের কাছে কে হাত বুলাচ্ছে। আশ্চর্য রকম মায়া মমতা মাখা নরম কোমল ছোট্ট হাতখানি। একবার ঘাড়ের এইদিকে যায় হাত, একবার ওই দিকে।

দবিরের ঘুম ভেঙে গেল।

ঘর ভর্তি অন্ধকার। দবির শুয়ে আছে মেঝেতে। পিঠের তলায় হোগলা, হোগলার তলায় পুরু করে বিছানো নাড়া। গায়ে আছে মোটা কাঁথা। ফলে রাত দুপুরের শীত যতই পড়ুক না কেন টের পাওয়া যায় না।

কিন্তু কে এমন করে হাত বুলাচ্ছে দবিরের ঘাড়ে!

এটা হামিদার হাত না। হামিদার হাত শক্ত, খরখরা। বহুদিন ধরে সংসারকর্ম করা হাত।

তাহলে!

তারপরই দবির শুনতে পেল মৃদু ফোঁসফোঁস একটা শব্দও হচ্ছে। ঘাড়ে যে হাত বুলাচ্ছে সেই মানুষটাই করতাছে শব্দটা। যেন বা গভীর কোনও কষ্ট বেদনায় কাঁদছে কেউ। কিন্তু কাঁদছে যে এটা কাউকে বোঝাতে চায় না। অতিকষ্টে চেপে রাখতে চাইছে কান্না, পারছে না। মৃদু একটা শব্দ হচ্ছেই।

দবির বুঝে গেল তার ঘাড়ে কার হাত! কে এমন করে কাঁদছে পাশে বসে!

ডানহাত ঘাড়ের দিকে তুলে আস্তে করে হাতখান ধরল সে। মায়াবি গলায় বলল, কী অইছে গো মা! কান্দো ক্যা!

বাবার যে ঘুম ভেঙে গেছে নূরজাহান তা বুঝতে পারেনি। বাবা তার হাত ধরার ফলে, কথা বলবার ফলে চেপে রাখা কান্না আর চাপতে পারল না সে। বুকের ভিতর আটকে থাকা সব কান্না বেরিয়ে এল। শব্দ করে কেঁদে উঠল নূরজাহান।

থতমত খেয়ে বিছানায় উঠে বসল, দবির। দুইহাতে জড়িয়ে ধরল মেয়েকে। দিশাহারা গলায় বলল, কী অইছে মা, কী অইছে! এমুন কইরা কানতাছো ক্যা?

নূরজাহান কথা বলতে পারল না। বাবার বুকের কাছে মুখ গুঁজে ঙো ঙো করে কাঁদতে লাগল।

হামিদা শুয়েছিল চৌকির ওপর। কান্নার শব্দে হঠাৎ করেই ঘুম ভাঙল তার। ধরফর করে বিছানায় উঠে বসল। কী অইছে, আঃ কে কান্দে

দবির শান্ত গলায় বলল, নূরজাহান।

ক্যা?

কইতে পারি না।

কুনসুম উটলো নূরজাহান? কুনসুম গেল তোমার ওহেনে?

কী জানি! ঘুমের মইদ্যে উদিস পাইলাম আমার গরদানে কে হাইততাইতাছে আর নিঃসাড়ে কানতাছে। বোজলাম নূরজাহান। তারবাদে উটছি।

আবার মেয়ের দিকে মন দিল দবির। কী অইছে ক আমারে। কানতাছস ক্যা?

নূরজাহান তবু কথা বলে না, নূরজাহান তবু কাঁদে।

মেয়ের মাথায় পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে দবির বলল, আমি থাবড় মারছিলাম দেইক্কা কানতাছো মা! হেইডা তো ম্যালাদিন অইলো! এতদিন পরের কান্দন আইজ কানতাছে! এই রাত দোফরে হেই দুক্কে আইজ কানতাছো?

নূরজাহান কাঁদতে কাঁদতে বলল, না।

তয়?

আমি আগে হুনি নাই, আইজ হুনছি।

কী হোনছো তুমি? কী হোনছো মা?

মাওলানা সাবের কথা।

কী করছে মাওলানা সাবে?

তোমার বকাবাজি করতাছে, তোমার গরদানে ধাক্কা দিছে। আমার লেইগা বহুত অপমান কাছে তোমারে।

দবির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কী করুম মা! তকদিরে অপমান লেখা আছিলো, অইছি।

আমার লেইগা, বেবাক আমার লেইগা অইছে।

দবির কথা বলল না।

চৌকিতে বসা হামিদা বুঝে গেল বাপের অপমানের কথা শুনে ঘুমাতে পারেনি নূরজাহান। মায়ের পাশ থেকে উঠে বাপের কাছে চলে গেছে। মানুষটার ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বাড়ির নামায় ফেলে দিয়েছিল মান্নান মাওলানা, এই জন্যে তার ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল নূরজাহান। বাড়িতে এসে হামিদাকে কথাগুলি বলার পর স্বামীর অপমানের দৃশ্যটা যেমন করে চোখের ওপর দেখতে পেয়েছিল হামিদা, যে দৃশ্য দেখে বুক ফেটে গিয়েছিল তার, চোখ ফেটে গিয়েছিল, স্বামীর মাথা বুকে জড়িয়ে ধরে যেমন করে কেঁদেছিল সে, নূরজাহানেরও বুঝি তাই হয়েছে। বাবার ঘাড়ে ধাক্কা দিয়েছেন মান্নান মাওলানা, নিশ্চয় ঘাড়ে খুব ব্যথা পেয়েছে বাবা, এই ভেবে নিশিরাতে উঠে তার ঘাড়ে এমন করে হাত বুলাচ্ছিল সে। সেই ফাঁকে বাবার অপমানের দৃশ্য চোখে দেখে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে। বাপ মায়ের জন্য অতিরিক্ত টান থাকলে, অতিরিক্ত মায়া মমতা থাকলে এমনই তো হয় সন্তানের! বাইরে থেকে যা-ই মনে হোক ভিতরে ভিতরে নূরজাহান খুব নরম মনের মেয়ে। মানুষের জন্য তীব্র মায়া মমতা তার।

তারপরই আর একটা কথা মনে হল হামিদার। মান্নান মাওলানার বাড়ি থেকে অপমান হয়ে আসার পর, নূরজাহানকে থাবড় মারার পর বাবা মেয়ের মধ্যে যে অভিমান জমেছিল আজ এই রাতদুপুরে তা ভেঙে যাচ্ছে। মেয়ের চোখের পানিতে, বাপের আদরে সোহাগে বরফের মতো জমে ওঠা অভিমান গলে যাচ্ছে। এক সংসারের তিনজন মানুষের দুইজনই যদি নিজেদের মান অভিমান নিয়ে থাকে, কেউ কথা বলে না কারও লগে, সেটা হয় বেকায়দার সংসার। তৃতীয় মানুষটা থাকে কষ্টে। সে পড়ে যায় দুইজনের মাঝখানে।

এইদিক যেতে পারে সে, না ওইদিক। হামিদা ছিল সেই অবস্থায়। আজ সেটা ভেঙে গেল। এখন বাপ মেয়ে যত ইচ্ছা আদর আল্লাদ করুক, যত ইচ্ছা রাগ দুঃখ করুক হামিদার কী! সে এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে।

কাঁথা মুড়া দিয়ে হামিদা তারপর শুয়ে পড়ল। তবে কান খাড়া করে রাখল বাপ মেয়ের দিকে। কী কথা বলে তারা, কেমন করে দূর হয় দুইজন মানুষের অভিমান, জানতে ইচ্ছা করে তার!

ততক্ষণে কান্না থেমে গেছে নূরজাহানের। অনেকক্ষণ গুঙিয়ে গুঙিয়ে কান্নার পর কান্না থামলেও তার রেশ থাকে। থেকে থেকে হেচকি মতন ওঠে। এখন তেমন উঠছে নূরজাহানের। গলা আছে রুদ্ধ হয়ে। তবু জড়ান অস্পষ্ট গলায় কথা বলছে সে। ও বাবা, মাওলানা সাবে বহুত জোরে ধাক্কা দিছে তোমার গরদানে? তুমি খুব দুক্কু পাইছো, না? দেহি কোন জাগায় ধাক্কা দিছে।

বাবার ঘাড়ের কাছে আবার হাত বুলায় নূরজাহান। আমি বুজি নাই, আমি কিছু বুজি নাই বাবা! কোনওদিন দেহি নাই তুমি আমার শইল্লে হাত উডাইছো! রস বেইচ্চা বাইত্তে আইয়া কথা নাই বার্তা নাই থাবড় মারলা আমারে। শইল্লে দুক্কু পাইলাম কি পাইলাম না উদিস পাইলাম না। মনডা কেমুন জানি অইয়া গেল।

মেয়ের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল দবির। কোনও কোনও মাইর আছে শইল্লে লাগলেও শইল্লে তা লাগে না, লাগে মনে। মাওলানা সাবে যে ধাক্কাডা দিছে ধাক্কাডা গরদানে লাগে নাই আমার, লাগছে মনে। এর লেইগাঐ বাইত্তে আইয়া থাবড়ডা তরে মারলাম। অতজোরে একখান থাবড় খাইয়াও তুই কানলি না। আমার মিহি চাইয়া রইলি। তারপর চুপচাপ বাইতথন বাইর অইয়া গেলি। আমি বোজলাম থাবড় তর শইল্লে লাগে নাই, লাগছে মনে। শইল্লের মাইর দুই একদিনের মইদ্যে ভুইল্লা যায় মাইনষে। মনের মাইর ভোলে না।

একটু থেমে দবির বলল, মাওলানা সাবরে তুই রাজাকার কইছিলি ক্যা?

আবার একখান হেচকি তুলল নূরজাহান। তোমার লেইগা।

দবির খুবই অবাক হল। আমার লেইগা?

হ।

ঘটনা খুলে বলল নূরজাহান। শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল দবির। বাপের নাম বিকৃত করে বলেছে বলে এমন জাঁদরেল লোক মান্নান মাওলানার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিল নূরজাহান! সারা গ্রাম যার ভয়ে কাঁপে, যাকে তোয়াজ করে, যার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস নাই কারও, এতটুকু একটা মেয়ে দাঁড়িয়েছে তার মুখামুখি! তাও এই সামান্য কারণে। যে কথা গ্রামের সাহসী মানুষরা পর্যন্ত এখন আর বলার সাহস পায় না, গ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা পর্যন্ত চেপে রাখে যে কথা, নির্ধিধায় সেইকথা বলে দিয়েছে। এই সাহস মেয়েটা পেল কোথায়!

তারপরই ভয় পেয়ে গেল দবির। বুকটা হিম হয়ে এল তার। মেয়েমানুষের এত সাহস ভাল না। তাও নূরজাহানের মতো কিশোরী মেয়ের, যেখানে সেখানে ঘুরে বেডানো মেয়ের। মান্নান মাওলানা যে ধরনের লোক, মেয়েটার কী না কী ক্ষতি করে দেয়! বয়স যাই হোক, গায়ে এখনও শুয়োরের মতন শক্তি তার। লজ্জা শরম কিছুই নাই। মান্নান মাওলানা পারে না এমন কাজ দুনিয়াতে নাই। গ্রামের কোন নির্জনে পেয়ে চেপে ধরবে নূরজাহানের মুখ। নিজে না পারলে লাগিয়ে দেবে ছেলেকে। সর্বনাশ হয়ে যাবে মেয়েটার।

এসব ভেবে নিজের অজান্তেই মেয়েকে বুকের কাছে চেপে ধরল দবির। ভয়ার্ত গলায় বলল, এইডা তুই ভাল করচ নাই মা, এইডা তুই ভাল করচ নাই।

দবির গাছির হঠাৎ উত্তেজনায় নূরজাহান অবাক হল। কান্নার আর একটা হেচকি তুলল। তারপর রাগ অভিমানের গলায় বলল, ভাল করুম না ক্যা? আমার সামনে আমার বাপের নাম খারাপ কইরা কইবো ক্যা? আতাহার দাদার সামনে তার বাপরে তুমি যদি কও মননাইন্না, হেয় তোমারে ছাইড়া দিবো!

দবির কাতর গলায় বলল, অরা আর আমরা এক না মা

এক না ক্যা! অগ বাপ বাপ, আর আমগো বাপ বাপ না!

মেয়ের রাগটা বুঝল দবির, অভিমানটা বুঝল। বুঝেও অন্যভাবে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করল মেয়েকে। মেয়ের মাথায় পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, এই দুইন্নাইতে যাগো যত জাগাজমিন, যাগো যত টেকা পয়সা, তাগো তত জোর। জোর তারা দেহায় গরিব মাইনষের লগে, গরিব মাইনষের উপরে। নিজেগো লাহান জাগাজমিনআলা মাইনষের লগে, টেকা পয়সাআলা মাইনষের লগে দেহাইতে পারে না। মাওলানা সাবের জাগাজমিনের আকাল নাই, টেকা পয়সার আকাল নাই। একপোলা থাকে জাপানে। মাসে লাক লাক টেকা পাড়ায়। আরেক পোলা অইলো গুণ্ডাপাণ্ডা, ডাকাইত। দুইন্নাইর কেরে ডরায় না। এর লেইগা মান্নান মাওলানার জোরের কমতি নাই। এই জোরডাই হেয় আমগ লাহান গরিব মাইনষের লগে দেহায়। তয় জোরের উপরে দিয়াও তো জোর আছে। খাইগো বাড়ির মাইনষের সামনে কইলাম মান্নান মাওলানা আবার মিচাবিলাই (ভেজা বিড়াল) হইয়া থাকে। খাইগো টেকা পয়সা জাগাজমিন মান্নান মাওলানার থিকা অনেক বেশি। তারা মান্নান মাওলানারে গনায় ধরে মা।

নূরজাহান ঝাঁঝাল গলায় বলল, গনায় আমিও ধরতাম না যদি আল্লায় খালি আমারে পোলা বানাইতো।

দবির হাসল। পোলা বানাইলেতোঐত্তো অইতো না। জাগাজমিন, টেকা পয়সাও থাকন লাগতো।

না থাকলেও অইতো। পোলা অইলে শইল্লে বেশি শক্তি থাকতো আমার। যে কোনও মাইনষের লগে মারামারি করনের ক্ষমতা থাকতো। জাগাজমিন, টেকা পয়সার জোর আমি শইল দিয়া ঠেকাইতাম। কাশেম কাকারে যেমতে ইচ্ছা অমনে মারছে। মাওলানা সাবে। কাশেম কাকার জাগায় আমি অইলে মাইর খাইতাম না। মইরা গেলে যাইতাম তাও মাওলানা সাবরে মাইর দিয়া দিতাম। তোমার জাগায়ও যুদি আমি অইতাম বাবা, মাওলানা সাবের বাইত্তে খাড়াইয়া রসের দাম তার কাছে থিকা আদায় কইরা আনতাম। আমার গরদানে ধাক্কা দিলে আমিও তার গরদানে ধাক্কা দিতাম। বেবাক কথা হোননের পর আমার খালি একটাই দুক্কু লাগছে বাবা, আল্লায় আমারে পোলা বানাইলো না ক্যা! আল্লায় আমারে মাইয়া বানাইলো ক্যা!

মেয়ের মাথায় পিঠে আবার হাত বুলাতে লাগল দবির। নরম মায়াবি গলায় বলল, এই হগল দুক্কু করণ ভাল না মা। আল্লায় যা করে মাইনষের ভালর লেইগাই করে।

একটু থেমে বলল, অহন থিকা বাইতথন তুই ইট্টু কম বাইর অবি মা। একলা একলা যেহেনে ওহেনে যাবি না। মাওলানা সাবের লগে দেহা অইলেও তার মিহি চাবি না। তার লগে কথা কবি না। খবরদার তারে কোনওদিন আর গাইলইল দিচ না। রাজাকার কইচ না। তাইলে কইলাম সব্বনাশ অইয়া যাইবো। তাইলে কইলাম আর বাচন নাই। এইবার খালি রসের দামডা গেছে, গাইল খাইছি, গরদানে ধাক্কা খাইছি, আবার যুদি মাওলানা সাবরে তুই কিছু কচ তাইলে আমারে হেয় জানে মাইরা হালাইবো। তর যে কোন সর্বনাশ করবো তুই চিন্তাও করতে পারবি না! সাবদান মা, সাবদান। আমারে মারিচ না, নিজের সব্বনাশ করিচ না।

নূরজাহান কথা বলল না। কান্নার রেশ কেটে গেছে তার, বন্ধ হয়েছে হেচকি। চৌকিতে শুয়ে আছে মা, খানিক আগে কথা বলছিল, এখন জেগে আছে না ঘুমিয়ে কে জানে। নূরজাহানের মনে এখন ঘুরপাক খাচ্ছে বাবার কথাগুলি। আজকের এইরাত দুপুরের আগে কখনও এমন অনুনয়ের স্বরে নূরজাহানের লগে কথা বলেনি বাবা। এমন কাতর হয়নি বেঁচে থাকার জন্য, এমন কাতর হয়নি মেয়ের সর্বনাশ ঠেকাতে।

মান্নান মাওলানার ওপর জমে থাকা রাগ ক্রোধ তারপর পানি হয়ে গেল নূরজাহানের। রাগ ক্রোধের জায়গায় জমে উঠল গভীর এক দুঃখ বেদনা। দীর্ঘ একখান শ্বাস ফেলে নূরজাহান বলল, আল্লার দুইন্নাইডা জানি কেমুন বাবা! দুইন্নাইর মানুষটি জানি কেমুন! কেঐ খালি মারে, কেঐ খালি মাইর খায়। তয় তোমার কথাডি আমি মনে রাখুম বাবা। মাওলানা সাবের মিহি কোনও দিন চক্কু উড়াইয়া চামু না। ভাল মন্দ কিছুই কোনওদিন তারে আর কমু না।

দবির কথা বলবার আগেই চৌকির ওপর পাশ ফিরল হামিদা। ঘুমজড়ান গলায় স্বামীকে বলল, এলা হুইয়া পড়ো। রাইত বিয়ান অইয়া আইলো। ইট্টু বাদেই তো আবার উঠবা!

দবির বলল, তোমার ঘুম তুমি ঘুমাও আমার ঘুম আইতাছে না। আমি মাইয়াডার লগে কথা কই।

আর কী কথা! বেবাকঐত্তে কইছো!

তারপর নূরজাহানকে ডাকল হামিদা। তুই উট্টা আয়। আইয়া হুইয়া পড়।

নূরজাহানও একই কথা বলল। তুমি ঘুমাও।

তারপর দবিরকে বলল, তোমারে একখান কথা জিগাই বাবা। রাজাকার কয় কারে?

দবির হাসল। তুই জান না? না জাইন্না মাওলানা সাবরে কইলি কেমতে?

মাইনষের কাছে হুনছি মওলানা সাবে রাজাকার। হুইন্না বুজছি রাজাকার জিনিসটা খারাপ। এর লেইগাঐ কইছি।

আসলেঐ রাজাকাররা খারাপ। তর জন্মের আগে এই দেশটা বাংলাদেশ আছিলো, আছিল অন্য একখান দেশ। হেই দেশের নাম পাকিস্তান। তয় পাকিস্তান আছিলো আবার দুইখান। পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তান। বাংলাদেশটা আছিলো পূৰ্ব্ব পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তান আছিল ম্যালা দূরে, হিন্দুস্তান ছাড়াইয়া। ঐ অত দূর থিকা আইয়া পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমগো শাসন করত, আমগো দেশের মাইনষের ওপরে অইত্যাচার করতো আর আমগো দেশের ধন সম্পদ টেকা পয়সা বেবাক লইয়া যাইতো। অগো ভাষা অইলো উরদু আর আমগো বাংলা। একবার আমগো ভাষাড়াও কাইরা নিতে চাইছিলো অরা। পারে নাই। ঢাকার রাস্তায় গুল্লি কইরা মানুষ মারছিলো। এই হগল দেইক্কা একাত্তোর সালে স্বাধীনতা যুইদ্ধের ডাক দিছিলো শেকসাবে, শেক মজিবর রহমান সাবে। পাকিস্তানীগো লগে বাঙ্গালীর যুইদ্ধ লাইগা গেছিলো। তিরিশলাক বাঙ্গালী শহীদ অইছিলো হেই যুইদ্ধে। নয়মাস চলছিলো যুইদ্ধ, তারপর দেশ স্বাদীন অইলো। বাংলাদেশ অইলো। স্বাধীন করনের লেইগা যারা যুইদ্ধ করতাছে তারা অইলো মুক্তিযোদ্ধা। আর যারা স্বাধীনতা চায় নাই, বাঙ্গালী অইয়াও পাকিস্তানীগো পক্ষে আছিলো, বাঙ্গালীগো মারছে, মুক্তিযোদ্ধাগো মারছে, মা বইনের ইজ্জত নষ্ট করতাছে, তারা অইলো রাজাকার। যুইদ্ধের সময় মাওলানা সাবে এই কাম করছে।

নূরজাহান বলল, বুজছি। তাইলে তো মাওলানা সাবে রাজাকারঐ।

হ। তয় অহন আর কেঐ তারে রাজাকার কয় না।

ক্যা?

ডরে। রাজাকারগো অহন ম্যালা জোর। মাওলানা সাবরে দেইক্কা বোজচ না?

হ বুজি। ও বাবা, মাওলানা সাবের লাহান রাজাকার কি বাংলাদেশে আরও আছে।

আছে, ম্যালা রাজাকার আছে। দেশটার মইদ্যে অহনও যে অশান্তি এই হগল অশান্তি করতাছে রাজাকাররা।

এত রাজাকার বাইচ্চা থাকলো কেমতে? দেশ যহন স্বাদীন অইলো, মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারগো মারে নাই।

বেবাকরে মারতে পারে নাই। ম্যালা রাজাকার এইমিহি ঐমিহি পলাইয়া গেছিলো গা। পাঁচ ছয় বচ্ছর পর ধীরেসুস্তে ফিরত আইছে। আইয়া আবার আগের লাহান জোর পাইয়া গেছে।

কেমতে।

এই হগল তুই বুজবি না মা। রাজনীতির প্যাঁচ।

ও বাবা, স্বাধীনতার পর মান্নান মাওলানাও পলাইছিলো?

হ।

কই?

হেইডা কইতে পারি না।

ফিরত আইছে কবে?

ম্যালাদিন বাদে। তহন মুক্তিযোদ্ধারা তারে ধরে নাই ক্যা? মাইরা হালায় নাই ক্যা?

ততদিনে মুক্তিযোদ্ধাগো জোর কইম্মা গেছে। রাজাকারগো জোর অইয়া গেছে। বেশি। কেমতে মারবো?

নূরজাহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইস মান্নান মাওলানারে যুদি মাইরা হালাইতো, মান্নান মাওলানা যুদি না থাকতো তাইলে আমগো গেরামডা ঠাণ্ডা থাকতো। বহুত ভাল থাকতো গেরামডা।

দবির উদাস গলায় বলল, মাওলানা সাবের লাহান কোনও রাজাকারই যুদি না থাকতো তাইলে পুরা দেশটাই ঠাণ্ডা থাকতো। বহুত ভাল থাকতে দেশটা।

ঠিক তখনই শীতরাত্রির গভীর নির্জনতা ভেঙে কোন গৃহস্থবাড়ির মাটির খোয়াড়ে বসে বাগ দিল একটা মোরগ। সেই বাগ ছড়িয়ে গেল চারদিকে। তারপরই যেন জেগে উঠল গ্রাম গৃহস্থের প্রতিটির বাড়ির খোয়াড়বন্দি মোরগ। যে যার মতো করে গলা খুলল, বাগ দিতে লাগল। মোরগদের নিয়মই এই, একজন গলা খুললে, একজনের সাড়া পেলে সবাই সাড়া দেয়। শিয়ালদের মতো।

মোরগের বাগ শুনে নূরজাহান একটু চঞ্চল হল। হাঃ হায় রাইত পোয়াইয়া গেলনি? ও বাবা, ঘুমাইবা না তুমি?

দবির মৃদু হাসল। নাগো মা, আর ঘুমাণের টাইম নাই। অহনঐ বাইর অওন লাগবো।

চৌকির ওপর কাঁথা মুড়া দিয়ে তখন বেড়োরে ঘুমাচ্ছে হামিদা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *