৩.২ বাবায় অহনতরি আইতাছে না

ওমা, বাবায় অহনতরি আইতাছে না ক্যা? রাইত অইয়া গেল তো!

চকির কোণে পা ঝুলিয়ে বসে আছে নূরজাহান। পা দোলনার মতন দোলাচ্ছে। কথার তালে দুলুনিটা একটু বাড়ল।

হামিদা মেয়ের দিকে তাকাল না। সে বসে আছে কপাটে ঢেলান দিয়া। ঘরগিরস্তির টুমটামের (আসবাবপত্র) পাশে সাঁ সাঁ করে জ্বলছে পিতলের কুপি। সন্ধ্যা হওয়ার লগে লগে কুপি জ্বেলে গাছার উপর রেখেছে। কুপির আলোর খানিকটা গিয়া পড়ছে হামিদার মুখের একপাশে। সেই আলোয় মুখটা চিন্তিত দেখাচ্ছে।

নূরজাহান তীক্ষ্ণচোখে মায়ের মুখের দিকে তাকাল। কথা কও না ক্যা মা? কী চিন্তা করো?

এবার মেয়ের দিকে তাকাল হামিদা। কিছু চিন্তা করি না।

তয় আমার কথার জব দেও।

কোন কথার জব দিমু?

ওই যে কইলাম, বাবায় অহনতরি আইতাছে না ক্যা?

এই কথার আমি কী জব দিমু? আমি জানি কীর লেইগা আইতাছে না তর বাপে?

মেয়ের পা দোলানি খেয়াল করল হামিদা। এই অভ্যাস একদমই পছন্দ করে না সে। গম্ভীর গলায় বলল, ওই ছেমড়ি, পাও ঝুলাইছ না।

পাও ঝুলাইলে কী অয়?

এইডা বদঅব্যাস! ডাঙ্গর মাইয়ার এইরকম বদঅব্যাস ভাল না। জামাইবাড়ি গেলে হৌর হরি কইবো, এই মাইয়া আদাব লেহাজ জানে না! বেদ্দপ।

চকিতে বইয়া পাও ঝুলাইলে মানুষ বেদপ অইয়া যায়?

হ যায়! পাও ঝুলান বন্ধ কর।

নূরজাহান অসহায় গলায় বলল, এমনে বইলে আমি পাও না ঝুলাইয়া পারি না মা। পাও দুইখান এমতে এমতেই ঝুলতে থাকে। আমি উদিস পাই না।

মেয়ের চালাকিটা বুঝল হামিদা। কঠিন গলায় বলল, আমার লগে ফাইজলামি করিছ না নূরজাহান। উদিস না পাইলে উদিস কইলাম পাওয়াইয়া দিমু।

নূরজাহান হাসল। কেমতে পাওয়াইবা?

পাও ঝুলাইলে লাডি দিয়া পাওয়ে বাড়ি দিমু।

লাডি পাইবা কই? আমগো ঘরে তো লাডি নাই।

মেয়ের কথার লগে হামিদাও সমানে তাল দিতে লাগল। লাডি জোগাড় করন বহুত সোজা। রানঘরের ওই মিহি থিকা চলা লইয়া আমু। যেই চলা কুত্তাডারে ফিক্কা মারছিলাম, ওইডা দিয়া তর পাওয়ে বাড়ি দিমু।

হেইডা আর অহন পারতাছো না।

ক্যা, অহন পারুম না ক্যা?

তুমি অহন চলা আনতে রানঘর মিহি গেলেই পাও ঝুলান থামাই দিমু আমি। পাও ঝুলান থামাইলে তো আর পায়ে বাড়ি দিতে পারবা না।

এইবার হামিদা বিরক্ত হল। অইছে, এত প্যাচাইল পারিচ না। পাও ঝুলান থামা।

মায়ের কথা শুনল না নূরজাহান। আগের মতনই পা দোলাতে দোলাতে বলল, চেষ্টা করতাছি, তাও থামাইতে পারতাছি না মা। কী করুম, কও?

চোখ গরম করে মেয়ের দিকে তাকাল হামিদা। গম্ভীর গলায় বলল, দেখ নূরজাহান, কথা না হোনলে সত্যঐ তর পায় বাড়ি দিমু। ফিরি ফিক্কা মারুম পায়।

নূরজাহান হি হি করে হাসল। মারো, মারো দেহি ফিরি ফিক্কা।

নিজে যে পিঁড়িতে বসে আছে সেই পিঁড়িটাই টেনে বের করতে চাইল হামিদা, সেই পিঁড়িটাই ছুঁড়ে মারতে চাইল মেয়েকে। তার আগেই পা দোলানো বন্ধ করল নূরজাহান। চট করে পা তুলল চকির ওপর। চকির ওপাশে, জানালার কাছে চলে গেল।

জানালাটা খোলা।

জানালার বাইরে থইথই করছে বর্ষার পানি। সন্ধ্যাবেলার চাঁদ এখন আর আগের জায়গায় নাই। আকাশের বেশ কিছুটা উপরে উঠে আসছে। ফুটফুটে জ্যোৎস্না পড়ছে। বর্ষার পানিতে। মৃদু মোলায়েম হাওয়া বইছে। সেই হাওয়ায় জ্যোৎস্নামাখা বর্ষার পানি ঝিলমিল ঝিলমিল করছে। কইফফার ছাড়ার নিবিড় গাছপালা আর ঝোঁপঝাড়ের তলার দিকে পৌঁছাতে পারে নাই চাঁদের আলো। মাথার দিকটায় লেগে আছে। কীরকম নিঝুম লাগছে ওদিকটা। নূরজাহান সেই নিঝুমতার দিকে তাকিয়ে রইল। মনের ভিতর তার ফিরে এল বসির ঘটককে বাড়িতে দেখার পরের সেই অনুভূতি। বিয়ার সমন্দ লইয়ানি আইলো ঘটকায়? পোলা কোন গেরামের? করে কী? দেখতে কেমুন? লাম্বাচুড়া, নাকি বাইট্টা?

ওদিকে মেয়েকে জানালার দিকে সরে যেতে দেখেই থেমে গিয়েছিল হামিদা। শরীরের তলা থেকে পিঁড়িটা আর বের করে নাই। এখন সেও নূরজাহানের মতনই নিঝুম হয়েছে। উদাস চোখে খোলা দরজা দিয়া উঠানের দিকে তাকিয়ে আছে। কুপির আলো দরজা ছাড়িয়ে বাইরের দিকে তেমন আগাতে পারে নাই। চৌকাঠ পেরিয়েই থেমে গেছে। ছনছার দিকটা আবছা আলোআঁধারি মাখা। গেরুয়া রঙের উঠান সাদা হয়েছে চাঁদের আলোয়। হঠাৎ করে বাড়িতে আসা কুকুরটা পাহারাদারের ভঙ্গিতে বসে আছে ছনছায়। মুখটা উঠানের দিকে, লেজ ঘর বরাবর। মুখের কাছটায় পড়েছে চাঁদের আলো, লেজের দিকটা অন্ধকার।

হামিদা একবার কুকুরটার দিকে তাকাল। তারপর রান্নাচালা ছাড়িয়ে ছনের ঘরের ওদিকে তাকাল। আম কদমের গাছগুলি, হিজল বউন্নার গাছগুলি ছাড়িয়ে ওপাশের ধইনচা খেতের দিকটায় জ্যোৎস্না আর অন্ধকারের খেলা। হাওয়া বইছে ঝিরঝির করে। ক ক করে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল একটা রাতপাখি। অনেকক্ষণ পর নিজের ভিতরকার সেই উত্তেজনা আবার টের পেল হামিদা। কোন মতলবে আইছে ঘটকায়? নূরজাহানের লেইগা সমন্দ আনছেনি? হেই কথা কওনের লেইগাঐ কি গাছিরে লইয়া গেছে বাজারে? বাইত্তে বইয়া সমন্দর কথা কইলে অসুবিদা আছিলো কী? মা-মাইয়ায় হুইন্না হালাইবো? হোনলে কী অইছে? মাইয়া ডাঙ্গর অইলে বিয়া তো অইবোই, বাইত্তে ঘটক তো আইবোই! হেইডা হোনন না-হেননের কী আছে?

না ঘটকার পোর মতলবটা হামিদা বোজতেই পারছে না। গাছিই বা এতক্ষণ বাজারে করে কী? ঘটকার কথা কি ফুরায় নাই? বিয়ার সমন্দ আনলে হেই কথা কইতে কতক্ষুন। লাগে?

এসময় আস্তে করে মা’কে ডাকল নূরজাহান। মা।

উঠানের দিক থেকে চোখ ফিরাল না হামিদা। বলল, কী অইছে?

আমার খিদা লাগছে। ভাত দেও।

আর ইট্টু সবুর কর। তর বাপে আহুক। দুইজনরে একলগেঐ দিমু নে।

বাবায় আইবো কুনসুম?

এলা আইয়া পড়বো।

এত দেরি করতাছে ক্যা?

এ কথার জবাব দিল না হামিদা।

নূরজাহান আবার ডাকল। মা।

এবার হামিদা একটু চেতল। কী অইছে, এত মা মা করতাছস ক্যা? কইলাম না তোর বাপে আইলে ভাত দিমু।

নূরজাহান সরল গলায় বলল, আমি তোমার কাছে ভাত চাই নাই?

তয়?

একহান কথা কমু।

কী?

কাইল বিয়ানে আমারে কাজির মউলকা বানাইয়া দিয়ো। আমার কাজির মউলকা খাওনের ইচ্ছা অইতাছে।

এবার খুবই রুক্ষ গলায় মুখ ঝামটাল হামিদা। ইস, কাজির মউলকা খাওনের ইচ্ছা অইতাছে। মাগির মোখে খালি খাওনের কথা। খালি পটি পটি (মজার মজার) খাওন! কাজি পাতি নাই। মউলকা বানাইতে পারুম না।

মিছাকথা কও ক্যা? ঠিল্লা ভরা দিহি কাজির চাউল। আমি দেখছি না!

দেখলে দেখছস। আমি বানাইতে পারুম না।

হামিদার ভঙ্গিতেই মুখ ঝামটাল নূরজাহান। তুমি কেমুন মা? একহান খালি মাইয়া তোমার, হেই মাইয়ারে ইট্ট মউলকা বানাইয়া খাওয়াইতে চাও না?

চুপ কর মাগি। প্যাচাইল পারলে থোতা ভাইঙ্গা হালামু।

নূরজাহান কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই কইফফার ছাড়ার ওদিককার হিজল ডুমুরের ঝোপে ওয়াক ওয়াক করে ডেকে উঠল কানিবক দুইটা। সাবধানি ভঙ্গিতে ডানা ঝাঁপটাল। সেই শব্দে জানালা দিয়া বাড়িটার দিকে তাকাল নূরজাহান। চাঁদের আলোয় দেখতে পেল ছাড়া বাড়িটার ঝোঁপঝাড়ের আড়াল থেকে ধীরে ধীরে সাঁতরে আসছে একজন মানুষ। দুপুরের পর যেভাবে বাড়িটার আড়াল থেকে হঠাৎ করেই বের হয়ে আসছিল ল্যাংড়া বসিরের কোষানাও এখনও যেন ঠিক সেভাবেই বের হয়ে আসছে সাঁতার কাটা মানুষটা। মাথায় কী যেন একটা প্যাচানো।

নূরজাহান খুবই উত্তেজিত হল। দিশাহারা গলায় মা’কে ডাকল। মা ওমা, দেইক্কা যাও, কে জানি আমগো বাড়ি মিহি হাতড়াইয়া আইতাছে।

কচ কী?

হ। তাড়াতাড়ি আহো, দেইক্কা যাও।

মেয়ের মতনই উত্তেজিত হল হামিদা। পা না ধুয়ে কখনও চকিতে ওঠে না সে। এখন পা ধোয়ার কথা মনে হল না। লাফ দিয়া চকিতে উঠল। জানালার কাছে এসে মেয়ের কাঁধে হাত দিয়া দাঁড়াল। সত্যঐ তো কে জানি হাতড়াইয়া আইতাছে! কে? কেডা আহে এই বাড়ি মিহি? এত রাইত্রে হাতড়াইয়া হাতড়াইয়া কেডা আহে?

.

কইফফার ছাড়ার ওদিকটায় এসে দবিরের মনে হল কাঁদতে কাঁদতে চোখ দুইটা ফুলে গেছে। বেশ কয়েকদিনের না কামানো গালে, বর্ষার পানি সরে যাওয়ার পর মাঠঘাট খেতখোলায় যেভাবে গজিয়ে ওঠে দূর্বাঘাস সেভাবে গজিয়েছে দাড়িমোচ। চোখের পানিতে চটচটা হয়ে আছে সেই দাড়িমোচ। মুখটা ভাল কইরা না ধুইলে মাইয়া আর মাইয়ার মায় বুইজ্জা যাইবো আমি কাইন্দা ভাসাইছি। তহন জোরাজুরি শুরু করবো। নূরজাহান দুইহাত দা (দিয়ে) গলা প্যাঁচাইয়া ধইরা জিগাইবো, কী অইছে বাবা, কও আমারে। কানছো ক্যা? এত কান্দনের কী অইছে? মাইয়ারে আমি হাছাকথা কমু কেমতে?

তারবাদে আছে মাইয়ার মায়। মাইয়ায় ঘুমাইয়া যাওনের পর মাইয়ার মা’য় ধরবো। কও তো নূরজাহানের বাপ অইছে কী? কাইন্দা কাইট্টা মুখচুখ ফুলাইয়া হালাইছো। ঘটকায় কী কইছে তোমারে? নূরজাহানের লেইগা কার সমন্দ আনছে? ঘটনা কী?

মাইয়ার মা’রেই বা হাছাকথাডা আমি কেমতে কমু? কইলে তো হেয় খালি আমার লাহান কাইন্দা ভাসাইবো না, কানতে কানতে পাগল অইয়া যাইবো। হের কান্দাকাটি দেইখা নূরজাহান বুইজ্জা যাইবো কী জানি কী ঘইট্টা গেছে সংসারে। মাইয়াডা আমার বিরাট একটা চিন্তার মইদ্যে পইড়া যাইবো। তারবাদে যহন অর কানেও যাইবো যে ঘটকায় অর লেইগা মাওলানা হুজুরের সমন্দ আনছে তহন মাইয়াডাও তো কান্দাকাটি শুরু করবো। পয়লা পয়লা কানবো, তারবাদে ডরাইবো। ডরে ডরে অসুকবিসুক অইয়া যাইবো। হুজুরের মোখে ছ্যাপ দিয়া যেমুন ডরাইছিল অমুন ডরে আবার মরবো। এই হগল কিছুই বুজতে দেওন যাইবো না নূরজাহান আর হামিদারে। তাগো দুইজনের লগে বিরাট একহান চালাকি করন লাগবো। ঘটকারে লইয়া চালাকি করন লাগবো, কান্দাকাটি আর মাওয়ার বাজার থিকা হাতড়াইয়া বাইত্তে আহন, বেক কিছু লইয়াঐ চালাকি করন লাগবো। মিছাকথার পর মিছাকথা কওন লাগবো। ভোলার লাহান মন খারাপ কইরা থাকলে অইবো না। উলটা পথ ধরতে অইবো। পয়লা মাইয়া আর মাইয়ার মা’রে ঠিক রাখন লাগবো, তারবাদে অন্যকথা।

কইফফার ছাড়ার ওদিকটায় এসে পারের দিকে একটু এগিয়ে গেল দবির। পায়ের তলায় মাটি পেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল। চাঁদের আলো তেরছা হয়ে পড়েছে এদিকটায়। ছাড়া বাড়ির কাছটায় জ্যোৎস্না পুরোপুরি পৌঁছাতে পারে নাই। কিছুটা জায়গা আবছা মতন অন্ধকার। সেই অন্ধকারে গলা পানিতে দাঁড়িয়ে আঁজলা ভরে পানি তুলে তুলে চোখ মুখ ভাল করে ধুতে লাগল দবির। বেশ কিছুক্ষণ ধরে কাজটা সে করল। এই ফাঁকে একটু জিরিয়ে নেওয়াও হল। এতটা দূর সতরে আসার ক্লান্তিটা কাটাবার চেষ্টা করল। তারপর বাড়ির দিকে মাত্র সাঁতার দিয়েছে, রাতদিন ছানা পাহারা দেওয়া কানিবক দুইটা ওয়াক। ওয়াক করে ডেকে উঠল। সাবধানি ভঙ্গিতে ডানা ঝাঁপটাল। পাখনার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ছানাগুলি চিঁ চিঁ করে উঠল। মা-বাবার লগে তারাও ভয় পেয়েছে, তারাও সাবধানি হওয়ার চেষ্টা করছে।

ছাড়া বাড়ি পেরিয়ে আসতে আসতে দবিরের মনে হল, আমার আর হামিদার জীবনডাও তো এই বক দুইহানের লাহান। পাখনার তলায় রাইখা বড় করছি মাইয়াডারে। কোনহানদা (কোনখান দিয়ে) কোন শত্রু আইয়া ক্ষতি করে মাইয়ার এর লেইগা সাবদানে থাকছি সব সমায়। তারবাদেও শত্রুর হাত থিকা বাঁচাইতে পারতাছি না মাইয়াডারে। মাওলানা হুজুরের লাহান বিরাট এক শত্রু আইয়া খাড়াইছে আমগো বাসার সামনে। হুজুর তো মানুষ না। হুজুর অইলো দাঁড়াইস সাপ। ধীরে ধীরে, ধীরে ধীরে সে আউন্নাইতাছে। তারে ঠেকান বড় কঠিন। কাছাকাছি আইয়া সে খালি একহান ঠোকর দিব। কানিবকের বাচ্চার লাহান এক ঠোকরে গিল্লা খাইবো নূরজাহানরে। আমি আর হামিদা চাইয়া চাইয়া দেহুম। কিছু করনের থাকবো না আমগো! বকপক্ষীর লাহান ওয়াক ওয়াক কইরা কান্দুম।

এসব ভেবে আবার কান্না পেল দবিরের। জোর করে কান্না আটকে রাখল। না, কান্দাকাটি আর করন যাইবো না। শক্ত থাকতে অইবো। বিরাট শক্ত। লোহা কাঠের লাহান শক্ত।

ততক্ষণে সাতরাতে সাতরাতে বাড়ির একেবারে সীমানায় এসে পড়েছে দবির। এদিক থেকে পরিষ্কার দেখা যায় বড়ঘরের জানালা। সেই জানালায় এখন মা-মেয়ে দুইজনের মুখ। তাদের পিছনে কুপির আলো, সামনে চাঁদের আলো। তবু পরিষ্কার দেখা যায় না মা মেয়ের মুখ। বোঝা যায় মানুষ দুইটি উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে এদিকে। একজন মানুষ এত রাতে সাঁতরে সাঁতরে আসছে বাড়ির দিকে, সংসারের অতিচেনা মানুষটা, তবু সেই মানুষটাকে তারা চিনতে পারছে না। কী করে চিনবে? এইভাবে, এতটা রাত করে সাঁতরে সাঁতরে কখনও কি বাড়ি ফিরেছে সে?

তারপরই দবিরের মনে হল, আইচ্ছা, বাইত্তে তো পুরুষপোলা কেঐ নাই। খালি মা আর মাইয়া। এই যে আমি হাতড়াইয়া হাতড়াইয়া বাইত্তে যাইতাছি, অরা তো আমারে চিনতে পারতাছে না। তয় তো অরা ডরাইতাছে। মনে করতাছে কে না কে আইতাছে বাইত্তে। চোর ডাকাইতও অইতে পারে। এইডা কি ঠিক অইতাছে? আমি কি দূর থিকাই আজ দিমু, নূরজাহান রে, মা, মাগো, ডরাইচ না মা। আমি দবির, দবিরগাছি, তর বাপ। আমিঐ হাতরাইয়া আইছি। ডরাইচ না।

না, আওয়াজ দবির দেয় না। আজ দুপুর থেকে ঘটে যাওয়া পুরা ব্যাপারটা নিয়ে সে একটা রহস্য তৈরি করতে চায়। মনের ভিতরকার দুঃখ কষ্ট চেপে মজাদার একটা পরিবেশ তৈরি করতে চায়। মা-মেয়ে কাউকে কিছুই বুঝতে দিতে চায় না। এভাবে সাতরে সাঁতরে বাড়ি এসে সে একটা চমক দিবে। তারপর ঘটকাকে নিয়া বানাবে হাসির গল্প, ঠাট্টা মশকরার গল্প। সেই গল্প শুনে মা-মেয়ে যেন হাসতে হাসতে মরে।

তয় কী গল্প?

দবির গল্প খোঁজে, মনে মনে গল্প বানায় আর সাঁতরে আসে নিজ বাড়ির দিকে। বাড়ির সীমানায় এসে যখন পায়ের তলায় মাটি পেয়েছে, পানি ভেঙে হেঁটে হেঁটে উঠবে বাড়ির উঠানে, তখন দুইটা কাণ্ড ঘটল। হামিদা ভয়ার্ত ভঙ্গিতে দৌড়ে নামল চকি থেকে। চোখের পলকে দরজা বন্ধ করে কাঠের ভারী ডাসা তুলে দিল আর ছনছায় পাহারাদারের ভঙ্গিতে বসে থাকা কুকুরটা লাফিয়ে উঠে শত্রু ঠেকাবার ভঙ্গিতে তেড়ে গেল দবিরের দিকে। লগে প্রচণ্ড খেউক্কানি। ঘেউ ঘেউ।

কুকুর দেখে ভড়কে গেল দবির। আরে, আমার বাইত্তে কুত্তা আইলো কই থিকা? এইডা তো বিরাট পাজি কুত্তা। আমারে তো বাইত্তে উটতে দিব না।

বাস্তবিকই, কুকুরটা তখন মারমুখো ভঙ্গিতে দবিরকে ঠেকাবার চেষ্টা করছে। কিছুতেই বাড়িতে উঠতে দিবে না। দবির পানিতে আর কুকুরটা ডাঙায়, একেবারে মুখোমুখি। ভঙ্গিটা এমন, আঙিনায় পা দিলেই কুকুরটা দবিরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। খেউক্কানির লগে এমন মুখ খিচানি দিচ্ছে, চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছে ভয়ংকর দাঁত।

দবির ভয় পেয়ে গেল। খাইছে আমারে। এই শালার পো শালায় তো আমারে বাইত্তে উটতে দিব না। আমার তো অহন নূরজাহানরে না ডাইক্কা উপায় নাই। চালাকিডা তো করন যাইবো না।

দবির তারপর তার সেই চেনা মায়াবী গলায় মেয়েকে ডাকতে লাগল। নুরজাহান, মা, মাগো। আমি মা, আমি। আমিঐ হাতড়াইয়া আইছি। দুয়ার খোলা মা, দুয়ার খোলো। আর এই কুত্তার হাত থিকা আমারে বাঁচাও মা।

.

হামিদা দাঁড়িয়ে আছে দরজার ডাসায় পিঠ চেপে।

ভঙ্গিটা এমন, যেন চাইলেই জোর করে কেউ বাইরে থেকে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকতে না পারে। ঢুকতে হলে বহু চেষ্টাচরিত্র করতে হবে। ওরকম চেষ্টাচরিত্র শুরু হলে নুরজাহানও এসে মায়ের লগে শরীরের সর্বশক্তি দিয়া দরজায় পিঠ চেপে ধরবে। সাঁতরে সঁতরে আসা লোক দেখা গেছে একজন। একজন লোকের গায়ে যত জোরই থাক, একার চেষ্টায় দরজার এই ডাসা ভাঙা খুবই কঠিন হবে। কোনওরকমে যদি ভেঙে ফেলেও, মা-মেয়ে দুইজনের শক্তির কাছে পেরে উঠা সহজ হবে না। দুইজন প্রাণপণে দুইহাতে চেপে রাখবে দরজা। সেই ফাঁকে ছাড়বে গলা ফাটানো চিৎকার। কে কোনহানে আছো আউন্নাও। আমগো। বাইত্তে ডাকাইত আইছে।

বাড়ির পুব উত্তর দক্ষিণে কাছাকাছি কোনও বাড়ি নাই। পশ্চিম দিককার পুকুরের ওপারে আছে মাঝিবাড়ি। আর কেউ শুনুক না শুনুক মাঝিবাড়ির লোকজনরা সেই চিৎকার শুনবে। মাঝিরা সাহসী লোক। বাড়িতে জুয়ান মর্দ পুরুষপোলা অনেক। তারা বেবাকতে এক লগে ঝাইক্কইর দিয়া (ঝক দিয়ে) বাইর অইবো। হাতে লাডি সড়কি থাকবো বেবাকতেরঐ, জুতি আর কুরবানি দেওনের ছুরি থাকবো। একলা একজন ডাকাইত মাঝিবাড়ির এত মাইনষের লগে জুত করতে পারবো না। কোনমিহি দা হাতর দিব নে! দিকপাশ না পাইলে ধইনচা খেতের ভিতরে গিয়া হান্দাইবো। তন্নতন্ন কইরা বিচড়াইয়াও ডাকাইতের পোরে আর বিচড়াইয়া পাওন যাইবো না।

তারপরও হামিদার মুখচোখ ভয়ে চুন হয়েছে। নূরজাহান ভয়ার্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে চকির ওপর। দৌড়ে নেমে মায়ের লগে গিয়া যে সেও পিঠ দিবে দরজায় সে কথা মনে নাই।

বাইরে সামনে খেউক্কাচ্ছে কুকুরটা। কুকুরের খেউক্কানি ছাপিয়ে তারপর শোনা গেল দবিরের গলা। নূরজাহান, মা, মাগো। আমি মা, আমি…

বাবার কথা শুনে লাফ দিয়া চকি থেকে নামল নূরজাহান। দিশাহারা গলায় বলল, বাবায় তো মা, বাবায় তো। দুয়ার খোলো।

ততক্ষণে হামিদার কানেও গেছে দবির গাছির গলা। আমিঐ হাতড়াইয়া আইছি। দুয়ার খোলো মা, দুয়ার খোলো। আর এই কুত্তার হাত থিকা আমারে বাঁচাও।

হামিদা পিঠ আলগা করবার আগেই মা’কে আবার তাড়া দিল নূরজাহান। কী অইলো? দুয়ার খোলো না ক্যা? বাবার গলা তুমি চিনতে পারতাছো না?

এবার দরজা থেকে পিঠ সরাল হামিদা। চটপটা হাতে দরজা খুলল। গাছা থেকে থাবা দিয়া কুপিটা নিল নূরজাহান। প্রায় লাফ দিয়া পড়ল উঠানে। দৌড়ে গেল পুবদিকার ঝিঙ্গা কহির (চিচিঙ্গা) ঝকার সামনে। সেখানে হাঁটু পানিতে লুঙ্গি কাছা মেরে দাঁড়িয়ে আছে। দবির। নীল শার্ট শক্ত করে বাধা মাথায়। কুকুরটা ডাঙায় দাঁড়িয়ে আছে দবিরের একেবারে মুখামুখি। দবির যেদিক দিয়া বাড়িতে উঠতে চায় কুকুরটা সেইদিকে গিয়াই তার মুখামুখি দাঁড়াচ্ছে। কিছুতেই বাড়িতে উঠতে দিবে না তাকে। এমন সুরে খেউক্কাচ্ছে আর দাঁত খিচানি দিচ্ছে, বাড়িতে উঠলে আর রক্ষা নাই। প্রাণপণে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

নূরজাহানের পিছু পিছু হামিদাও দৌড়ে আসছে উঠানে। চাঁদের আলোয় ফকফক করছে চারদিক। বর্ষার পানিতে ধইনচা খেত আর বাড়ির গাছপালায় ঝিম ধরে আছে যে নির্জনতা, কুকুরটার খেউক্কানিতে সেই নির্জনতা হারিকেনের চিমনির মতন ভেঙে পড়ছে।

নূরজাহানকে দেখে দবির বলল, আমগো বাইত্তে কুত্তা আইলো কই থিকা? এইডা তো বিরাট পাজি কুত্তা। আমার বাইত্তে আমারেঐ উটতে দেয় না।

কেমতে উটতে দিবো? কুত্তায় তোমারে চিনে নি?

তারপরই কুকুরটাকে তাড়া দিল সে। এই সর সর! এইডা আমার বাবায়। সর, সর। বাবারে বাইত্তে উটতে দে। সর।

নূরজাহানের তাড়া খেয়ে একটু সরে গেল কুকুরটা কিন্তু খেউক্কানি থামাল না। দূরে দাঁড়িয়েই আগের মতন সমানে খেউক্কাতে লাগল। সেই ফাঁকে পানি ভেঙে উঠানে উঠল দবির। কুকুরটা একবার তার দিকে তেড়ে আসতে চাইল। নূরজাহান আবার কুকুরটাকে তাড়া দিল। এই থামলি? কইলাম না আমার বাবায় আইছে। চোপ চোপ।

নূরজাহানের তাড়া খেয়ে আবার কিছুটা দূর দৌড়ে গেল কুকুরটা।

হামিদা এতক্ষণ ধরে তাকিয়ে তাকিয়ে স্বামীকে দেখছিল। এবার কথা বলল সে। তোমার এই দশা ক্যা? কইথনে হাতড়াইয়া আইলা?

প্রথমে মাথায় প্যাঁচিয়ে রাখা শার্টটা খুলল দবির। খুলে হামিদার হাতে দিল। আগে এইডা ধরো। তারবাদে কইতাছি। দেহো তো শার্টের কোনাকানছি ভিজছে নি?

হামিদা হাতিয়ে হাতিয়ে শার্টটা দেখল। না ভিজে নাই।

তয় ভাল। বহুত চেষ্টা করছি শাটটারে লইয়া।

যাতে না ভিজে?

হ।

লুঙ্গির কাছা খুলে নীচের অংশটা দুই-তিন মোচড়ে চিপড়ে নিল দবির।

কুকুরটার খেউক্কানি কিছুটা কমেছে ততক্ষণে। সে তার বুদ্ধি বিবেচনা দিয়া বুঝে গেছে মানুষটা শত্রু না। এই বাড়িরই। সুতরাং তার খেউক্কানির দরকার নাই। শরীরের ভঙ্গি স্বাভাবিক করে সে তিনজন মানুষের পায়ের কাছে ঘুরঘুর করছে। আদর ভালবাসার কুঁই কুঁই শব্দ করছে।

হামিদা যে প্রশ্নটা করেছিল নূরজাহান এবার ঠিক সেই প্রশ্নটাই করল দবিরকে। তোমার অইছে কী বাবা? হাতড়াইয়া বাইত্তে আইলা ক্যা? ঘটকায় না বলে তোমারে বাইত্তে দিয়া যায়?

হ, হেই কথাইত্তে আছিলো।

তয়?

মাওয়ার বাজারে চা মিষ্টি খাইয়া মেলা দিছি। ঘটকার কোষাড়া অইলো পুরান। বন্নিছাড়ার ওই মিহি আইয়া তলি খুইল্লা গেল।

কী?

আরে হ। কথা নাই বারতা নাই, কোষার তলি খুইল্লা ভোগলা (বড় ছিদ্র) অইয়া গেল। এমুন ভোগলা, ভর ভরাইয়া পানি ওডে। আমি আর ঘটকায় দুইজনে মিল্লা এইচ্চা (সেচে) হারতে পারি না। চোক্কের নিমিষে (পলকে) কোষা ডুইব্বা গেল। তার আগেঐ বুদ্ধি কইরা আমি একহান কাম করছিলাম, শাটহান খুইল্লা মাথায় বানছি, লুঙ্গিহান শক্ত কইরা কাছা দিছি। ঘটকায় আর ফইজু হাতড়াইয়া উঠছে হালদার বাইত্তে। ল্যাংড়া পাও লইয়া হাতড়াইতে বহুত কষ্ট অইছে ঘটকার। আমারেও কইছিলো ওই বাইত্তে উটতে। আমি উডি নাই। আমি বাড়ি মিহি হাতর দিছি।

তীক্ষ্ণচোখে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল হামিদা। চাঁদের আলোয় চারদিক ফকফক করলেও মানুষের চোখের দৃষ্টি পুরাপুরি দেখা যায় না, বোঝা যায় না। দবিরের দৃষ্টিও পুরাপুরি বুঝতে পারছিল না সে। তবে দবিরের কথা কেন যেন বিশ্বাস হল না তার। মনে হল সত্যকথা দবির বলছে না। ঘটনা এরকম না। ঘটনা অন্যরকম। কীরকম, সেটা সে অনুমান করতে পারছে না।

লুঙ্গি চিপড়ে আবার ঠিকঠাক মতন পরছে দবির। পরতে পরতে একটু যেন বেশিরকম আমুদে গলায় বলল, কইফফার ছাড়ার ওই মিহি আইয়াই তগো মা-মাইয়ারে আমি জানালার সামনে খাড়াইয়া থাকতে দেখছি। বাইরে চান্দের আলো, ঘরে কুপির আলো। বোজলাম, তরা চিন্তা করতাছস, এত রাইত্রে হাতড়াইয়া হাতড়াইয়া কেডা আইতাছে আমগো বাড়ি মিহি। একবার চাইলাম চিল্লাইয়া চিল্লাইয়া কই, নূরজাহান রে, ডরাইচ না মা। আমিঐ। হাতড়াইয়া আইতাছি। কইলাম না, তগো ইট্টু ডর দেহানের লেইগা। দেহি আমারে এমনে হাতড়াইয়া আইতে দেইক্কা কেমুন করচ তরা।

নূরজাহান বলল, আমরা বিরাট ডরান ডরাইছি বাবা। মায় তো ফাল দিয়া গিয়া দুয়ার দিছে। দুয়ারে ডাসা লাগাইয়া পিঠ দিয়া চাইপ্পা ধরছে। ডরে মুকচুক হুগাইয়া গেছে। আর আমি তো ডরে চকি থিকা নামতেঐ পারি নাই।

তয় তগো বাঁচাইয়া দিছে কুত্তাডায়। এইডার খেউক্কানিতে উপায় না দেইক্কা আমি তরে ডাক দিছি। নাইলে বাইত্তে উইট্টা তগো আইজ বিরাট ডর দেহাইতাম। খিক খিক।

দবিরের হাসি দেখে নূরজাহানও হাসল। হামিদা গম্ভীর। স্বামীর একটানা এত কথা বলা, এই হাসি কোনওটাই তার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। কী হয়েছে কী দবিরের আজ? এমন করছে কেন লোকটা?

দবির তখন কুকুরটার দিকে তাকিয়েছে। তয় এই শালার পো শালার কারবার তো বুজলাম না। এইডা আইলো কই থিকা?

নূরজাহান বলল, কইতে পারি না। তুমি ঘটকার লগে বাইর অইলা, ধইনচা খেতের ভিতরে থিকা টাবুর টুবুর করতে করতে কুত্তা আইয়া বাইত্তে উটলো। মা’য় চলা লইয়া

এমুন দৌড়ানি দিল, বাইত্তে থিকা বাইরই অইলো না। এমুন আহ্লাদ জুইড়া দিল, য্যান আমগো বাইত্তে বহুতদিন ধইরা আছে। মা’র লগে আমার লগে বিরাট খাতির অইয়া গেছে। তোমারে চিনতে পারে নাই দেইখা এমুন করছে।

তয় এইডা আইলো কই থিকা? কোন বাড়ির কুত্তা?

হেইডা কইতে পারি না।

যে বাড়ির কুত্তাঐ হউক, এইডা একহান কুত্তাঐ। সাই (বিরাট) পাজি। আমগো বাইত্তে আইয়া উটছে, এইডা একহান কামের কাম অইছে। দেখ থাকেনি বাইত্তে, না কয়দিন বাদে আবার অন্য কোনওমিহি ম্যালা দেয়।

না হেইডা মনে অয় দিব না। মনে হয় আমগো বাইত্তে থাকবো। আমি মনে মনে কুত্তাডার একহান নাম ঠিক করছি।

কী নাম?

ভাদাইম্মা (বাউন্ডুলে)।

ভাদাইম্মা? এইডা কেমুন নাম অইলো?

এইডা তো ভাদাইম্মা পদেরঐ কুত্তা। কইত থিকা কই আইয়া পড়ছে। আবার একদিন কইত থিকা কই যাইবো গা। অর লেইগা ভাদাইম্মা নাম ঠিক।

এই এতক্ষণে প্রথম কথা বলল হামিদা। তোমরা কি উডানে খাড়াইয়া খাড়াইয়াই রাইত কাবার করবা, নাকি ঘরে যাইবা? ভাতপানি খাওন লাগবো না?

হামিদার কথা শুনে ব্যস্ত হল দবির। হ হ লও। ঘরে লও। ভাত দেও। বহুত খিদা লাগছে। হাতড়াইলে দুইন্নাইর খিদা লাগে। বাপ রে, যেই হাতড়ান হাতড়াইছি।

হামিদা আরেকবার তীক্ষ্ণচোখে দবিরের মুখের দিকে তাকাল। চাঁদ আর কুপির আলোয় মুখটা দেখতে পেল, চোখ পরিষ্কার দেখতে পেল না। মনের মধ্যে সন্দেহটা তার রয়েই গেল। আসলেই কি ঘটকার কোষানাওয়ের তলি ভোগলা হয়ে গেছে? আসলেই কি কোষা ডুইব্বা গেছে দেইখা হাতড়াইয়া বাইত্তে আইছে গাছি, নাকি ঘটনা অন্য? আর কীরলেইগা ঘটকায় গাছিরে বাজারে ডাইক্কা নিল? কী কথা কওনের লেইগা নিল? গাছি তো হেই হগল কথার কিছুই কইলো না! তয় কি নূরজাহানের বিয়ার সমঐ আনছে? ভাল সমন্দ? হেই সমন্দ গাছির পছন্দ অইছে দেইক্কাঐ কি এমুন আমদে আছে সে? নূরজাহানের সামনে কি এই হগল প্যাচাইল পাড়তে চাইতাছে না? পরে পাড়বো? নূরজাহান ঘুমাইয়া যাওনের পর?

হামিদা মনে মনে অপেক্ষা করতে লাগল।

.

রান্নাচালায় বসে কুড়ুক কুড়ক করে তামাক টানছে দবির।

এখনও ভোরের আলো ঠিক মতন ফোটে নাই। পদ্মার ঘোলা পানির মতন আলো ছড়িয়ে আছে চারদিকে। গাছপালায় লেগে আছে অন্ধকার। শ্রাবণমাসের আকাশ একটু একটু করে পরিষ্কার হচ্ছে। আকাশের ভাবগতিক দেখে বোঝা যায় আজকের দিনটাও আগের দিনগুলির মতনই হবে। এই মেঘ, এই রোদ। হঠাৎ খা খা রোদ, হঠাৎই কোদাইল্লা বৃষ্টি। ধইনচাখেতের ওদিককার অন্ধকার একদমই কাটে নাই। বাঁশঝাড়, আম কদম আর হিজল বউন্নাগাছের পাতাদের ঘুম মাত্র ভাঙতে শুরু করেছে। ছনের ঘরের চালায় দুইটা কাক এসে বসছে। মাত্র গলা খুলতে শুরু করছে তারা। প্রায় নিজের সমান হয়ে উঠেছে এমন। একটা মাত্র ছানা নিয়া শালিক পাখিটা আমগাছের খোড়ল থেকে মাত্র নেমেছে উঠানে। বাচ্চাটা চিড়িক চিড়িক করে ডাকছে আর মায়ের পিছন পিছন ছুটছে। পুকুরের ওপারকার ডুমুরঝোঁপ থেকে এইমাত্র উড়ে এল দোয়েল পাখিটা। বাঁশঝাড়ের ওদিককার আবছা আলো আঁধারিতে এখন খাবার খুঁজবে আর পিরিক পিরিক করে লেজ নাচাবে। ঝিঙাকফির আঁকার তলার অন্ধকার এখনও কাটে নাই। আকাশ থেকে নামতে শুরু করা আলোয় বর্ষার পানি একটু একটু ধরছে পানির রং। কইফফার ছাড়ার ঝোঁপঝাড় নীরব। কানিবকের ছানাদের ঘুম ভাঙে নাই।

এত সকালে দবিরের কেন ঘুম ভেঙেছে?

কোন ফাঁকে বড়ঘরের দুয়ার খুলে হুঁকা আর তামাক টিকা নিয়া সে চলে গেছে রান্নাচালায়। এত সকালে এমন মনোযোগ দিয়া তামাক টানছে কেন?

নূরজাহান এখনও গভীর ঘুমে। হামিদার ঘুম ভেঙেছে। ঘুম ভেঙেছে দবিরের তামাক টানার শব্দে। স্বামী যে কোন ফাঁকে পাশ থেকে উঠে গেছে, তামাকের টুমটাম নিয়া দুয়ার খুলে বের হয়ে গেছে, উদিস পায় নাই। এখন ঘুমের ভিতর থেকে উদিস পেল, বাইরে, রান্নাচালার দিকে গুড় গুড়ক একটানা শব্দ উঠছে।

ঘুম ভাঙার পর শুয়ে থাকার অভ্যাস নাই হামিদার। লগে লগেই উঠল সে। নূরজাহানের উঠতে এখনও অনেক দেরি। এই একটা সুযোগ পাওয়া গেছে স্বামীর লগে কথা বলার। ভেবেছিল কাল রাতে বলবে। নূরজাহান ঘুমিয়ে যাওয়ার পর স্বামীর বুকে হাত বুলাতে বুলাতে ফিসফিসা গলায় জানতে চাইবে, ঘটকায় ক্যান তোমারে এত আহ্লাদ কইরা মাওয়ার বাজারে লইয়া গেল? চা রসোগোল্লা খাওয়াইলো কী মনে কইরা? মাইয়া ডাঙ্গর অইছে। ঘটকায় কি অর লেইগা সমন্দ আনছে? কেমুন সমন্দ? পোলায় করে কী? বাড়ি কোন গেরামে? আর তুমি যে হাতড়াইয়া আইলা, আসলেই কি ঘটকার নাওয়ের তলি খুইল্লা গেছিলো, নাকি ঘটনা অন্য?

এসবের কিছুই জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পায় নাই হামিদা। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে নূরজাহান চট করে চলে গেছে তার জায়গায়। সে শোয় জানালা ঘেঁষে। তারপর। হামিদা, তারপর দবির। ঘরে একটাই বড় চকি। তিনজন মানুষ হাত পা মেলেই শুতে পারে। জায়গার অভাব হয় না। তারপরও বর্ষাকাল বলেই এক চকিতেই শোয় তিনজন। খরালিকাল হলে শুত না। খরালিকালে ঘরের মেঝে থাকে খটখটে শুকনা। হোগলা পাইতা। ল্যাড়ল্যাড়া বালিশ শিথানে দিলেই বেভোর (বেঘোর) ঘুম। বর্ষাকালে মেঝেতে শোয়া যায় না। মেঝের মাটি থাকে স্যাঁতস্যাতা। চারদিকে বর্ষার পানি। বাড়িঘরের তলায় এসেও দাঁড়ায় সেই পানি। উপরের দিকে ঠেলে ঠেলে উঠতে থাকে। পুরাপুরি উঠতে পারে না ঠিকই তবে ঘরবাড়ির মাটি স্যাঁতস্যাঁতে করে দেয়। হোগলা বিছিয়ে সেই মাটিতে শোয়া যায় না। হোগলা ভিজা যায়, বালিশ ভিজা যায়। আর বুকে পিঠে চেপে বসে ঠান্ডা। সর্দি কাশি ছেড়ে যেতেই চায় না। পুরা বর্ষাকাল খুকুর খুকুর কাশি লেগে থাকে। কফের রং হয় পোলাপানের বিষ্ঠার মতন।

কালরাতে দবিরের লগে একটা কথাও বলা হয় নাই। যা যা ভেবেছিল তার কিছুই জানা হয় নাই। চৌকিতে উঠে মাত্র সটান হয়ে শুয়েছে গাছি, তারপরই তার আর কোনও খবর নাই। ঘোঙর ঘোঙর করে নাক ডাকতে শুরু করেছে। স্বামী মেয়ে শুয়ে পড়ার পরও টুকটাক কিছু কাজ হামিদার থাকে। সেসব শেষ করে কুপি নিভিয়ে বাপ মেয়ের মাঝখানে শুয়েছে ঠিকই, শুয়ে স্বামীর বুকে হাতও দিছে, তয় গাছির কোনও খবর নাই। হতাশ হয়ে হামিদাও একসময় ঘুমিয়ে পড়েছে।

এখন এসব কথার লগে আরেকটা কথাও মনে পড়ল হামিদার। নূরজাহান কাইল কাজির মউলকা খাইতে চাইছিল। একহান মাত্র মাইয়া। ডাঙ্গর হইয়া গেছে। বাড়িতে আসা যাওয়া শুরু করছে ঘটক। কবে বিয়াশাদি অইয়া যাইবো। কোন গেরামে কার বাড়ির বউ অইয়া। যাইবো। হেই বাড়ির মানুষজন কেমুন অইবো কে কইবো! ইচ্ছা করলেই কাজির মউলকা। মাইয়াডা আর খাইতে পারবো কি না কে কইবো! বাপের বাড়িত থিকা সাধ আহ্লাদ মিটাইয়া না যাইতে পারলে হেই সাধ আহ্লাদ জিন্দেগিতেও হয়তো আর পূরণ অইবো না। দেই মাইয়াডারে কহেকখান কাজির মউলকা বানাইয়া। কয়ডা বেশি কইরা বানাইলে মাইয়ার বাপেও খাইতে পারবো নে। আমিও এক-দুইহান খাইলে বিয়ানে আর কিছু খাওন লাগবো না।

প্রথমে পাটাপুতা নিয়া রান্নাচালায় রেখে এল হামিদা।

সেই ফাঁকে আড়চোখে একবার দবিরের দিকে তাকাল। দবির তার দিকে তাকালই না। কীরকম উদাস, কীরকম মনমরা ভঙ্গিতে তামাক টেনে যাচ্ছে। হুঁকায় তামাক আছে বলে মনে হয় না। তবু টেনে যাচ্ছে। ধুমা বের হচ্ছে ঠিকই তয় তামাকের গন্ধ আর পাওয়া যাচ্ছে না। তামাক পুড়ে অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।

তবু কেন এভাবে হুঁকা টানছে গাছি?

এমন উদাস, এমন মনমরা হয়ে আছে কেন?

কী হয়েছে?

কালরাতে সাঁতরে বাড়ি ফেরার পরও যে মানুষটার এত উৎসাহ, এত আমোদ প্রমোদ দেখা গেল আজ সকালবেলা তার এই অবস্থা কেন?

হামিদা যে তাকে আড়চোখে দেখল, খেয়াল করল এটা তরি দেখল না দবির। হামিদার দিকে সে তাকালই না। বাঁশঝাড়ের ওদিক দিয়া ধইনচাখেতের মাথার উপরকার আকাশের দিকে তাকিয়ে তামাক টানছে। কুকুরটা খুবই আপনভঙ্গিতে বসে আছে তার পায়ের কাছে। দবির হামিদার দিকে তাকাল না ঠিকই, কুকুরটা তাকাল। পলকের জন্য হামিদাকে দেখে আবার আগের মতনই মুখ ঘুরাল অন্যদিকে।

হামিদা আবার বড়ঘরে এল। কাজির ঠিলা থেকে আধসের পরিমাণ কাজির চাউল তুলল একটা খাদায়। কাজিরচাউল পানিতে খাদার অর্ধেকটার বেশি ভরে গেল। ওই নিয়ে রান্নাচালায় এল। খোলাটা চুলার পাড়েই আছে। মাটির খোলা। এই জিনিস চুরি করতে আসবে না কোনও চোর।

নূরজাহান তখনও আগের মতনই ঘুমাচ্ছে। মুখটা বন্ধ জানালার দিকে।

কাজির মউলকার লগে ফালি ফালি করে কেটে দিতে হয় পিঁয়াজ, খাড়াখাড়ি চারফালি করে দিতে হয় কাঁচামরিচ। কেউ কেউ কাঁচামরিচ দেয় কুচি কুচি করে। নূরজাহান কুচি কুচি করে দেওয়া পিঁয়াজ কাঁচা মরিচ দেওয়া কাজির মউলকাই পছন্দ করে। ওসব জিনিস চুলার পারে রাখা থাকে না। ওই জিনিস নিতে আরেকবার বড়ঘরে এল হামিদা।

দবির গাছির অবস্থা তখনও আগের মতনই।

এতক্ষণে আর একটু ফরসা হয়েছে চারদিক। ভোরবেলার আলো এখন কাজির চাউলের লগে খাদায় উঠে আসা পানির মতন।

সবকিছু গুছিয়ে হামিদা তারপর কাজির চাউল বাটতে বসল। আশ্চর্য ব্যাপার দবির তখনও ফিরা তাকায় নাই স্ত্রীর দিকে।

চাউল বাটতে বাটতে দবিরের দিকে তাকাল হামিদা। আচমকা বলল, কী অইছে। তোমার?

দবির চমকাল। ধইনচাখেতের উপরকার আকাশ থেকে চোখ ফিরাল হামিদার দিকে। তামাক টানা বন্ধ হল। কী অইবো? কিছু হয় নাই?

মিছাকথা কইয়ো না।

কীয়ের মিছাকথা?

কিছু না অইলে এত বিয়ানে ঘুম থিকা উঠছে ক্যা?

ঘুম ভাইঙ্গা গেছে।

এত বিয়ানে ঘুম ভাঙলো ক্যা?

এইডা কেমুন কথা কও? ঘুম ভাঙতে পারে না?

হ পারে। তয় ওইডা শীতের দিনে। শীতের দিকে এত বিয়ানে উইট্টা তুমি রস পাড়তে যাও। অন্য দিনে এত বিয়ানে তোমার কোনওদিন ঘুম ভাঙ্গে না।

আইজ ভাঙছে।

কীর লেইগা ভাঙছে?

হেইডা কেমতে কমু। ঘুম ভাঙ্গনের লগে লগে উটতে চাই নাই। অনেকক্ষুন হুইয়া রইছিলাম। তারবাদে এমনু তামুকের নিশা ধরল, উইট্টা গেলাম।

দবির একটু হাসির চেষ্টা করল, হাসিটা তেমন ফুটল না। কথা ঘুরাবার চেষ্টা করল। তুমি আথকা কাজি বাটতে বইলা ক্যা?

তোমার মাইয়ায় মউলকা খাইতে চাইছে।

তাইনি?

হ।

তয় বানাও মউলকা। মাইয়ায় খাইবোনে, আমিও খামুনে। কাজির মউলকা আমারও বহুত সাদ লাগে।

ওইডা আমি আগেঐ চিন্তা করছি। আইজ বিয়ানে বেবাকতেই আমরা মউলকা খামু। তয় তোমার অইছে কী হেইডা কও। আমার কাছে কিছু ছুপায়ো না।

কী ছুপামু তোমার কাছে, কও?

আসলে কী অইছে হেইডা কও।

কইলাম তো কিছু অয় নাই।

তামাক সাজাতে ব্যস্ত হল দবির। মালসা থেকে পরিমাণ মতন তামাক নিয়া কলকিতে ঠেসে দেওয়ার আগে জ্বলে প্রায় শেষ হয়ে আসা টিকাটা মাটিতে ফেলল। কলকিতে তামাক দেওয়ার পর সেই জ্বলন্ত টিকা কায়দা করে কলকিতে দিয়া গুড়ক গুড়ক করে টানতে লাগল। কয়েক টানের মাথায় তামাকের নেশা ধরানো একটা গন্ধ ছুটল। সেই গন্ধে মন। চনমন করে উঠল দবিরের, মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল।

হামিদা বলল, ঘটকায় তোমারে মাওয়ার বাজারে ডাইক্কা নিছিলো ক্যা?

দবির জানে এই প্রশ্নটা উঠবেই। কালরাতে সঁতরে আসার বানোয়াট গল্প বলে, খিদার কথা বলে, দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে হামিদার এসব প্রশ্ন সে এড়াতে পেরেছে। এখন আর এড়াবার পথ নাই।

মনে মনে বহু রকমের মিথ্যা কথা বলবার জন্য তৈরি হয়ে গেল সে। সাঁতরে বাড়ি আসার পর যেমন চটপটা হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ করে আবার তেমন হল। বোঝো নাই ঘটকায় কীর লেইগা আমারে এমুন খাতি কইরা বাজারে লইয়া গেল? কীর লেইগা চা মিষ্টি আর সিকরেটের পর সিকরেট খাওয়াইলো?

বুজছি।

কী বুজছো কও তো?

নূরজাহানের লেইগা সমন্দ আনছে।

হ।

কেমুন সমন্দ?

সমন্দ খারাপ না। তয়…

তয় কী?

আমার মনে অয় হেই সমন্দ তোমার পছন্দ অইবো না।

ক্যা, অইবো না ক্যা? পোলা ভাল না?

পোলা ভালই।

তয়?

দোজবর।

 কাজির চাউল বাটতে বাটতে চমকাল হামিদা। দোজবর?

হ।

সতিন আছে?

না। সতিন নাই। সতিন মইরা গেছে।

পোলাপান আছে না?

আছে।

তয় পোলার বস ম্যালা অইবো।

হ হেইডা অইবো।

পোলায় করে কী?

গিরস্তি করে।

পোলাপান কয়ডা?

তিনপোলা দুই মাইয়া। বড় পোলাড়া মইরা গেছে।

অবস্থা কেমুন?

বিরাট অবস্থা, বিরাট। জাগাজমিন আছে ম্যালা। মাইয়াগো বিয়াশাদি দিয়া হালাইছে।

বাড়ি কোন গেরামে?

দবির হামিদার দিকে তাকাল। এইহানে ঘটকার পোয় একহান চালাকি করছে।

কেমুন চালাকি?

পোলা যে কোন গেরামের হেইডা কয় নাই।

ক্যা?

বুজলাম না।

তুমি জাননের চেষ্টা করো নাই?

ম্যালা চেষ্টা করছি। কাম অয় নাই। কয়, গাছিদাদা, আগে আপনে রাজি হন, তারবাদে আমি আপনেরে বেক কথা কমু।

এইডা কেমুন কথা? পোলা না দেইক্কা, তার বেবাক কিছু না জাইন্না কেউ মাইয়া বিয়া দিতে রাজি অয়নি?

হ। আমিও ঘটকারে ওই কথাই কইছি।

তারপর অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করল হামিদা। তোমার কী মতলব?

কীয়ের মতলব?

যেই পোলার পাঁচহান পোলাপান, দুই মাইয়ার বিয়া দিয়া হালাইছে, বুঝাই যায় হেই পোলার ম্যালা বস। তোমার মতন বস অইবো…

আমার থিকা বড়ও অইতে পারে।

হ। তয় অমুন পোলার লগে তুমি কি তোমার মাইয়া বিয়া দিবা?

তামাক টানা থামিয়ে আবার হামিদার দিকে তাকাল দবির। তোমার কী মনে অয়?

আমার যেইডাঐ মনে হোক, তুমি তোমার কথা কও।

না, আমি আগে তোমার হুনুম।

কাজিরচাউল অনেকখানি বাটা হয়ে গেছে। সেই বাটা চাউল পাটা থেকে কাচিয়ে কাচিয়ে অন্য একটা খাদায় রাখল হামিদা। তারপর বাকি চাউলটুকু পাটায় নিয়া বাটতে বাটতে বলল, মইরা গেলেও দিমু না। আমার মাইয়ার যদি জিন্দেগিতেও বিয়া না অয় তাও দিমু না। দরকার অইলে হারাজীবন আবিয়াত থাকবো, তাও অমুন বুইড়ার কাছে বিয়া দিমু না।

দবির গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তবে মুখের এমন একটা ভঙ্গি করল যেন সেও হামিদার লগে একমত। বলল, ঠিক, একদোম ঠিক। আমিও হেইডাই কই। সারাজীবন আবিয়াত থাকলেও অমুন পোলার কাছে নূরজাহানরে বিয়া দিমু না। ওই বেডার মাইয়ার ঘরের নাতিনরাই অইবো আমার নূরজাহানের বসসি।

শেষ দুইমুঠ চাউল বাটতে বাটতে হামিদা খুবই চেতল। ঘটকার পো ঘটকায় আমার মাইয়ার লেইগা এইরকম সমন্দ আনলো কেমনে? ওরে তুমি জুতাদা দুইডা বাড়ি দেও নাই ক্যা?

দবির ম্লান মুখে হাসল। আমি যদি বড় গিরস্ত অইতাম তয় ঘটকার পো ঘটকারে ঠিকঐ জুতার বাড়ি মারতাম। তখন অয় এইরকম সমন্দ লইয়া আমার কাছে আহনের সাহস পাইতো না। আমরা গরিব মানুষ, নূরজাহান গরিব গাছির মাইয়া, এর লেইগা শালার পো শালায় সাহসটা পাইছে। অনেক গরিব মানুষ আবার আছেও, পাঁচ-দশখান পোলাপান আছে, বড় গিরস্ত, বেডার বস অইবো সইত্তর-আশি, তাও ষোলো বইচ্ছইরা মাইয়া বিয়া দিয়া দেয়। কী করবো কও। মাইয়ার জীবন তো বাঁচাইতে অইবো।

হেইডা বুজলাম। তয় মাইয়ার জীবনে কোনও সাধ আহ্লাদ থাকবো না। ওই বুইড়া বেডায় মাইয়ার সাধ আহ্লাদ মিটাইবো কেমতে?

হেইডা কেঐ ভাবে না। ভাবে খালি ভাত কাপড়ের কথা। মাইয়া য্যান খাইয়া পইরা বাঁইচ্চা থাকে, খালি ওইডাই চিন্তা করে।

আমরা ওইডা চিন্তা করুম না। আমগো ছোট্ট একহান বাড়ি আছে, দশগন্ডা জমিন আছে। একহান মাত্র মাইয়া। কিছু টেকাপয়সাও মাইয়ার লেইগা জমাইছি, এই হগল। বেবাক দিয়া দিমু মাইয়ারে। দরকার অইলে জামাইরে ঘরজামাই রাখুম। দরকার অইলে একওক্ত খাওয়াইয়া রাখুম মাইয়ারে, দরকার অইলে না খাওয়াইয়া রাখুম, তাও বুইড়া ধুইরার কাছে মাইয়া বিয়া দিমু না।

দবির তামাক টানতে টানতে আবার উদাস হয়ে গেল। মনে মনে বলল, নূরজাহানের মা গো, এই হগল মিছাকথা হুইন্নাঐ তুমি এমুন কথা কইতাছো? যুদি আসল কথা হোনো তয় তো দাপড়াইয়া মইরা যাইবা। আসল কথা আমি তোমারে কইঐ নাই। ওইডা হোনলে। তুমি দাপড়াইয়া মরবা, কাইন্দা মরবা। আমার মতন মুলাম মানুষও হেই কথা সইজ্জ করতে পারি নাই। হেই কথা হুইন্না ঘটকার নাওয়ে উঠতে আমার ঘিন্না লাগছে। নৌকার তলিমলির কথা হাছাকথা না, মিছাকথা। আমি ওই কথা হুইন্না অর নাওয়েই উডি নাই। মাওয়ার বাজার থিকা এই মেদিনমণ্ডল তরি পুরাডা রাস্তা হাতড়াইয়া আইছি। তোমরা। ডরাইবা দেইখা আসল কথা কই নাই। তোমার মাইয়ার বিয়ার লেইগা কার সমন্দ আনছে ঘটকায় হোনবা? ওই বান্দরডার। ওই শুয়োরের পোর। শুয়োরের পোর নাম অইলো মান্নান। আবদুল মান্নান। নামের লগে মাওলানা কথাডাও আছে। ওর মতন শুয়োরের নামের লগে মাওলানার মতন পাক পবিত্র কথাটা কওন উচিত না। এর লেইগা আমি কইতাছি না।

মনে মনে এসব কথা বলে দবির আরও উদাস হয়।

আকাশ তখন আরও ফরসা হয়েছে। বাঁশঝাড়, আম কদমের গাছ, হিজল বউন্নার গাছ থেকে ধীরে ধীরে কাটছে অন্ধকার। ধইনচাখেতের ভিতরকার অন্ধকার সরিয়ে ঢুকতে শুরু করেছে আকাশ থেকে নেমে আসা আলো। দবিরের উঠান পালানে কাক চরছে, শালিক চরছে। দোয়েল পাখিটা আলো দেখে ফিরে গেছে পুকুরের ওপারকার ডুমুরঝোপে। কইফফার ছাড়ার ওদিকে কানিবক দুইটা ব্যস্ত হয়েছে ছানাদের আহার জোটাতে। একটা উড়ে যাচ্ছে আহার আনতে, আরেকটা পাহারা দিচ্ছে। আহার নিয়া ফিরে আসার পর অন্যটা উড়াল দিচ্ছে একই কাজে। দুইটা অবোধ পাখি কী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ছানাদেরকে বাঁচাবার জন্য।

দবির মনে মনে বলল, আর আমি? আর হামিদা? আমরা দুইজনও তো চেষ্টা করছি আমগো একটা মাত্র সন্তানরে ওই বদমাইশটার হাত থিকা বাঁচাইতে। বদমাইশটা তো ক্ষুধার্ত দাঁড়াইস সাপ। ধীরে ধীরে আগাইতাছে আমগো বাসার দিকে। ছোবল দেওনের সব পথ সে তৈয়ার কইরা ফালাইছে। এখন শুধু ছোবলটা দিবো।

দবির কী করে ঠেকাবে সেই ছোবল? হামিদা কী করে ঠেকাবে?

পিছন থেকে দবির গাছির গলা জড়িয়ে ধরে নূরজাহান বলল, ও বাবা, আইজ আমার একখান কথা তোমার হোননই লাগবো।

দবির আগের জায়গায়ই বসে আছে। এখন আর তামাক টানছে না। তামাক টিকার মালশা রাখা আছে পাশে। হুঁকা দাঁড় করিয়ে রাখা রান্নাচালার খুঁটির লগে। খুঁটিটা বাশের। একটু পুরানা, একটু নড়বড়া। তবু কায়দা করে সেই খুঁটির সঙ্গে হুঁকা দাঁড় করিয়েছে দবির। একটুখানি ধাক্কা বা মাটির মৃদু কাঁপনেই গড়িয়ে পড়বে হুঁকা। নূরজাহান খেয়াল করে নাই। চার-পাঁচখান কাজির মউলকা খেয়ে পেট মন দুইটাই ভরে গেছে। ভারী একটা আমুদে ভাব আসছে শরীরে। এই অবস্থায় বাবাকে জড়িয়ে ধরেছে। ফলে হুঁকা দাঁড় করিয়ে রাখা খুঁটিটায় একটু ধাক্কা লাগল। হুঁকা গড়িয়ে পড়ল রান্নাচালার মাটিতে। কলকিটা বসানোই ছিল কার মাথায়। সেই কলকিসহ দুই-তিনখান গড়ান খেল হুঁকা, তারপর স্থির হল ঠিকই তবে কার পানি বুরুক বুরুক করে পড়তে লাগল। কাজির তীব্র গন্ধের লগে হুঁকার পানির গন্ধ মিলেমিশা অদ্ভুত একটা গন্ধ ছুটল চারদিকে।

হাতের পাঞ্জা সাপের ফণার মতন করে খাদা চেঁছে শেষ কাজিবাটাটুকু খোলায় দিয়েছে হামিদা। খোলাটা চিতনা। মাটির তৈরি ঠিকই তবে অনেকটাই লোহার তাওয়ার মতন। পুরানা ভাতের হাঁড়ি কায়দা করে ভেঙে চিতনা খোলাটা নিজেই বানিয়ে নিয়েছিল হামিদা। এই ধরনের খোলায় মউলকা, চিতইপিঠা এসব ভাজতে খুব সুবিধা।

এখন চিড়বিড়ায়া উঠছে সকালবেলার রোদ। সেই কোন ভোরে উঠে কাজি বাটতে বসেছিল হামিদা। বাটা শেষ করে খাদায় রেখে কাজির পানি মিশিয়েছিল। ওদিকে চুলায় জ্বলে গেছে আগুন, ভোলা বসে গেছে তিনমাথার চুলায়। নারকেলের আইচা দিয়া তৈরি করা হাতায় করে তপ্ত খোলায় ঢালা হয়েছে কাজিবাটা। চকচকা বড় একখান ঝিনুকের একটা পিঠ বহুবছর ধরে মউলকা বানাবার কাজে ব্যবহার করে হামিদা। সেই ঝিনুক দিয়া তারপর খোলার কাজিবাটা উঠান লেপার মতন করে লেপে দিয়েছে। অতি দ্রুত হাতে করা কাজ তাতেও মিশে ছিল গভীর যত্ন। ফলে পলকেই চড়চড় করে ভাজা হল মউলকা। পিয়াজ কাঁচা মরিচের কুচি একটু কাঁচা কাঁচা, মউলকা পুরাপুরি ভাজা। দারুণ একখান গন্ধ ছড়িয়ে ছিল চারদিকে!

এসব কাজের ফাঁকে ফাঁকেই চলছিল নূরজাহানের বিয়ের কথাবার্তা।

টিনের পাতলা খুন্তি দিয়া মাত্র প্রথম মউলকা তুলে পুরানা কুলায় রেখেছে হামিদা, ঘুমভাঙা চোখে নূরজাহান এসে দাঁড়াল বড়ঘরের দরজায়। ওই অতটা দূর থেকেই দেখতে পেল প্রথম মউলকা খোলা থেকে নামছে। আর দিকপাশ তাকায় নাই, ছুঁইটা আসছে রান্নাচালায়। প্রায় থাবা দিয়া নিছে মউলকা।

হামিদা তার স্বভাব মতন খ্যাচ খ্যাচ করে উঠল। দেখছো, দেখছো নি করে কী? ঘুম থিকা উইট্টা হাতমুখ না ধইয়া, দাঁতৰ্দোত না মাইজ্জাঐ মউলকা ধরলো? এই ছেমড়ি তো দুইন্নাইর গিদর (গিধর, শুকুর)।

নূরজাহান মউলকায় কামড় দিয়া হি হি করে হাসল। হাতমুখ পরে ধুমু। দাঁত মাজুম পরে।

ক্যা, পরে ক্যা? বাহি (বাসি) মুখে কেউ কিছু মুখে দেয়?

কাজির জিনিস বাহিমুখেঐ খাইতে অয়।

হামিদা পরের মউলকা খোলায় দিচ্ছে, নূরজাহান দুইহাতে মউলকা ধরে কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে। মুখে কচর কচর শব্দ আর গভীর তৃপ্তি। মেয়ের এই মুখ খেয়াল করবার সময় নাই হামিদার। সে আছে তার কাজে।

দবির খেয়াল করল।

অনেকক্ষণ তামাক টেনে, মেয়ের মা’র লগে নানান পদের কথা বলে এখন সে আবার আগের মতন চুপচাপ, উদাস। ভোরের সেই কাজির পানির মতন আলো কেটে গিয়ে। কখন রোদ উঠল, কখন কাজিবাটা শেষ করে মউলকা ভাজতে শুরু করল হামিদা, কখন। ঘুমভাঙা নূরজাহান ছুটে এল রান্নাঘরে কিছুই আসলে চোখে পড়ে নাই তার। সে আছে তার নিজের মধ্যে। মাওয়ার বাজার থেকে সাঁতরে এসে দুনিয়ার ক্লান্তি ছিল শরীরে। ভাতপানি খেয়ে শুয়ে পড়েছিল ঠিকই, নাকও ডাকাতে শুরু করেছিল তবে সেই নাক ডাকানো আসল ডাকানো না। মেয়ের মা’কে বুঝ দেওয়া, দেখো গো নূরজাহানের মা, হুইয়া পড়নের লগে লগেঐ ঘুমাইয়া গেলাম। এতাহানি জাগা হাতড়াইয়া শইল্লের আর কিছু নাই।

আসলে একফোঁটা ঘুমও কালরাতে ঘুমায় নাই দবির। চেষ্টা করেছে, ঘুম আসে নাই। মনের মধ্যে সারারাত উথাল পাথাল করেছে ল্যাংড়া বসিরের কথা, মান্নান মাওলানার কথা। শেষতরি এই রাস্তা ধরল শালার পো শালায়! আমার মাইয়ার উপরে শোধটা হেয় এইভাবে লইবো? ঘরের বউ কইরা? তাও পোলার বউ করলে নাইলে একহান কথা আছিলো! নিজের বউঐ করতে চায় আমার এতড়ু মাইয়াডারে! আর একবার যুদি কারবার হেয় করতে পারে, তয় আমার নূরজাহানের কী অইবো? মাইয়াডা বাঁচবো কেমতে? অরে নানানপদের অইত্যাচার কইরা মারবো! মুখে ছ্যাপ দেওনের শোদহান লইবো না?

এইডা গেল একটা দিক, আরেকদিকে আমার নূরজাহানের জীবনের সাদআহ্লাদ, জামাইর কাছে মাইয়ারা যা চায় তার কী পাইবো ওই বুইড়া খাডাসের কাছ থিকা! খালি শাড়ি আর গয়না, জাগা সম্পত্তি থাকলেই কি মাইয়ারা খুশি অয়? আরও কিছু চায় না তারা?

একদিকে ঘুমের ভান করে নাক ডাকাচ্ছে দবির, আরেকদিকে মনের ভিতর চলছে। এইসব ভাবনা। হাতের কাজ শেষ করে হামিদা এসে শুয়েছে বাপমেয়ের মাঝখানে। মেয়ে গভীর ঘুমে, বাপও নাক ডাকাচ্ছে, তারপরও স্বামীর বুকে হাত রেখেছে হামিদা। হাত বুলাতে বুলাতে ফিসফিস করে স্বামীকে ডেকেছে। ঘুমাইলা? ও নূরজাহানের বাপ, ঘুমাইলা?

দবির শুনল সবই, মেয়ের মায়ের হাতের ছোঁয়ায় অন্যান্য দিনের মতনই আরামটা লাগল। শরীরে তয় সেই আরামে বুকের ভিতর থেকে ঠেলে উঠতে চাইল অতিকষ্টের এক কান্না। দুইজন মানুষের কত মায়া মমতার ফল, কত আদর সোহাগের ফল একটি মাত্র মেয়ে। সেই মেয়ের কপালে এত বড় বড় বিপদ কেন লিখে দিলেন আল্লাহপাক! মান্নান মাওলানার মুখে ছ্যাপ ছিটায়া দিয়া একটা গুনাহ না হয় করে ফেলেছিল নাদান মেয়েটি। সেই গুনার। ফল আর কত ভাবে ভোগ করবে মেয়ে? পাখির মতন উড়ে বেড়ানো মেয়েটার তো বাড়ি থেকে বের হওয়াই বন্ধ হয়ে গেছে। বনের পাখি হয়ে গেছে খাঁচার পাখি। তারপরও তার গুনাহ মাফ হয় না!

মেয়ের মায়ের হাতের ছোঁয়ায় যখন উথলে উঠতে চাইল কান্না, যেন ঘুমের ঘোরেই পাশ ফিরছে দবির, এমন করে পাশ ফিরল। আসলে কান্না সামাল দিল। তারপর আবার সেই আগের মতনই নাক ডাকানো।

হামিদা বুঝল, এই ঘুম এখন আর ভাঙবে না গাছির। থাক, ঘুমাক। ল্যাংড়া বসির কেমন সমন্দ আনল সেকথা শোনার অনেক সময় আছে।

হামিদা তারপর নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছে।

স্ত্রীকন্যার গভীর ঘুম রাতভর টের পেয়েছে দবির। দু’জন ঘুমন্ত মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দে বুঝেছে এই ঘুম সকালের আগে ভাঙবে না। তাদের পাশে শুয়ে যে একজন মানুষ ঘুমের ভান করে পড়ে আছে, মনের ভিতর যে তার চলছে অতিকষ্টের এক কায়কারবার এক আল্লাহমাবুদ ছাড়া কেউ তা টের পাচ্ছে না।

এই করে করে রাতটা দবির কাটিয়েছে।

খাইগোবাড়ির মাইক থেকে যখন ভেসে আসছে ফজরের আজান, সেই শব্দে তারপর উঠেছে সে। হুঁকা তামাকের মালশা হাতে ঘর থেকে বের হয়েছে। ছনছায় শুয়ে ছিল কুকুরটা। দবিরকে দেখে খেউক্কানি দিল। তার পিছন পিছন হেঁটে গেল রান্নাচালা তরি। দবির বসল তামাক সাজাতে, কুকুরটা অদূরে, উঠানের কোণে বসে লেজটা দিয়া রাখল দবিরের দিকে। মাথা চক বরাবর। যেন কঠিন এক পাহারাদার সে। এই বাড়ির দিকে চোর ডাকাত বালা মুসিবত কোনও কিছুই আসতে দিবে না। সব ঠেকায়া রাখবো।

তামাক সাজাতে সাজাতে কুকুরটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে দবির বলেছিল, যেই বিপদ এই বাড়িমিহি আইতাছে, ভাদাইম্মারে, বাজান, হেই বিপদ তুই আমি কেঐ ঠেকাইতে পারুম না। মান্নান মাওলানা মানুষ না। ওই শালার পো শালায় অইলো ইবলিস। ইবলিস শয়তান। অরে ঠেকাইতে পারে একমাত্র আল্লাহমাবুদে।

তারপর ধীরে ধীরে আলো ফুটল। হামিদা উঠে তার কাজকাম শুরু করল, রাতের কথাগুলি দিনের ফুটে ওঠা আলোয় জানতে চাইল। দবির অবিরাম মিথ্যাকথা বলে গেল। একটা মনই দুইটা ভাগ হয়ে গেল তার। একমন মিথ্যা বলে, মেয়ের মা’কে প্রবোধ দেয় আর অন্যমন হায় হায় করে, না না করে। নূরজাহানের মা গো, আমি যা কইতাছি বেবাক মিছাকথা। বেবাক। একটাও হাছাকথা না। ঘটকায় যার লেইগা তোমার মাইয়ার সমন্দ আনছে হেই শালার পো শালার নাম মান্নান মাওলানা।

হয়তো কথাবার্তা আরও কিছু হত দুইজনের, নূরজাহান এসে মউলকা মুখে দেওয়ার পর কথাবার্তা অন্যদিকে ঘুরে গেল। হাতমুখ ধধায়া নিয়া মা-মেয়ে লেগে গেল আর সেই ফাঁকে দবির আবার গেল উদাস হয়ে।

নূরজাহানকে দেখেই কুকুরটা উঠে দাঁড়িয়েছিল। কুকুরদের চিরকালীন কায়দায় শরীর একবার টানা দিল তারপর নূরজাহানের অদূরে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়াতে লাগল। মুখটা আদুরে ভঙ্গিতে নূরজাহানের দিকে ফিরানো। ভঙ্গিটা এমন, যেন নূরজাহানকে বলছে, তুমি একলা খাইতাছো ক্যা? আমারেও ইট্টু দেও। বিয়ান অইছে, আমারও তো খিদা লাগছে!

কুকুরটার দিকে ফিরাও তাকাল না নূরজাহান। মউলকা খেতে খেতে মা’র লগে তর্কাতর্কি লাগায়া দিল। কাজির জিনিস মুখ না ধুইয়া খাওন ভাল। কাজিতে যা গন্দ, হারাদিন মুখ থিকা হেই গন্দ যায় না। এর লেইগা কাজি খাইয়া ছাই আর নাইলে কয়লার গুঁড়া দিয়া দাঁত মাজন লাগে। অনেকক্ষুন ধইরা দাঁত মাজলে তয় গন্দ কমে। আমপাতা প্যাঁচাইয়া দাঁতে ঘসলেও গন্দ কমে।

হামিদা মুখঝামটা দিয়া বলল, এত প্যাচাইল পারবি না মাগি। খাইতাছস খা।

মেয়ে আসার পর এই প্রথম কথা বলল দবির। তাও মেয়েকে না, মেয়ের মা’কে বলল, এমুন করতাছো ক্যা মাইয়াডার লগে? ও খাউক না অর মতন।

হামিদা দবিরের দিকে তাকাল। অরে আমি খাইতে না করছি? কইছি হাতমুখ ধুইয়া খা।

অহন খাউক। পরে ধুইবো নে।

ততক্ষণে পরের মউলকাটা তৈরি। নূরজাহান সেটাও দুইহাতে ধরে কামড় দিয়েছে।

এসময় কুকুরটা একটা খেউক্কানি দিল। কুকুরটার দিকে তাকাল নূরজাহান। হাসিমুখে বলল, কী রে ভাদাইম্মা, খেউক্কাছ ক্যা? খিদা লাগছে?

ভাদাইম্মা আবার খেউক্কানি দিল।

আর খেউকান লাগবে না। বুজছি তরও খিদা লাগছে।

নিজের মউলকা থেকে একটুখানি ছিঁড়ে ভাদাইম্মার দিকে ছুঁড়ে দিল নূরজাহান। ভাদাইম্মা। ঝাঁপিয়ে পড়ে টুকরাটা মুখে দিল। দিয়ে চাবাতে চাবাতে কৃতজ্ঞ চোখে নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে রইল।

এভাবে নূরজাহান যতক্ষণ খেল, কুকুরটাকেও দিল একইভাবে। চার-পাঁচখান মউলকা খেয়ে পরিতৃপ্ত মুখে নূরজাহান চলে গেল ঘাটপারে। যাওয়ার আগে আমগাছের একটু পরিষ্কার ধরনের দুইটা পাতা ছিঁড়ল। সেই পাতা একত্রে প্যাঁচায়া দাঁতনের মতন করল। তারপর দাঁতে ঘষতে ঘষতে ঘাটপারের দিকে চলে গেল। ভাদাইম্মাও গেল তার পিছন পিছন। কাল বিকালে কোথা থেকে যে এল কুকুরটা। এসেই বাড়ির মেয়েটার বাধুক হয়ে গেল। যেন এই বাড়ি তার বহুদিনের পরিচিত। যেন বাড়ির মেয়েটা তার খুবই আপন।

নূরজাহান দাঁত মেজে, হাতমুখ ধুয়ে ফিরা আসার ফাঁকে তিনটা মউলকা খেয়েছে দবির। হামিদা ভেজে দিয়েছে আর সে খেয়েছে। একটাও কথা বলে নাই। চার নম্বর মউলকাটা। দেওয়ার সময় শুধু বলছে, আর খামু না।

হামিদা অবাক। ক্যা?

পেড ভইরা গেছে।

কও কী?

হ।

মাইয়ায় খাইলো পাঁচহান মউলকা আর তুমি তিনডা? তিনডায় পেড ভইরা গেল?

হ ভরছে। অহন যেই কয়ডা হয় তুমি খাও।

পুরানা একটা ঠিলা থাকে রান্নাচালায়। পানি ভরাই থাকে। বর্ষার পানিই। তবে একটুকরা ফিটকারি ঠিলায় সবসময় ফেলে রাখে হামিদা। তাতে পানিটা পরিষ্কার থাকে। ফিটকারির গুণে পানির ভাসমান ময়লা গুড়াগাড়ি সব গিয়া জমে তলায়। আর ঠিলার মুখে ছোট্ট একটা সরা উলটা করে বসিয়ে রাখে। বাইরের ধুলা ময়লা কিছুই ঢুকতে পারে না ঠিলায়।

অ্যালুমিনিয়ামের যে মগে বছরের প্রথম দিনকার রস খায় নূরজাহান সেই মগটা ঠিলার পাশে। ঠিলা কাত করে আধামগ পানি খেল দবির। এখন আবার তামাকের নেশা ধরছে। এখনই তামাক সাজাবে কি সাজাবে না ভাবছে, নূরজাহান পিছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরল। তারপর ওই কথা, ওই কাণ্ড!

মেয়ের কথা পাত্তা দিল না হামিদা, হুঁকা গড়ায়া পড়ছে, হুঁকার পানি সব পড়ে যাচ্ছে দেখে মহা বিরক্ত হল। দাঁত মুখ খিচায়া বলল, ইস, এই মাগি যা অইছে। এমুন আজদাহা। মাগি জামাই বাইত্তে গিয়া টিকবো কেমতে? মাগির কাম কাইজ তো…

হামিদার কথা শেষ হওয়ার আগেই দবির বলল, অইছে। সব সময় মাইয়াডারে বকাবাজি কইরো না।

নূরজাহানকে ছেড়ে এবার দবিরকে ধরল হামিদা। তোমার আহ্লাদে আহ্লাদে এমুন অইছে মাইয়াডা। ডাঙ্গর মাইয়ার চলন বলন এমুন অইবো ক্যা? মরদা বেডাগো মতন আপরাইয়া দাপড়াইয়া চলে। মাইয়াগো চলন বলন অইবো নরম সরম। অর চলন বলন তো নরম সরম না।

দবির কথা বলবার আগেই নূরজাহান বলল, মা, তোমার মউলকা পুইড়া গেল। তাড়াতাড়ি উড়াও।

আসলে মায়ের মন অন্যদিকে ঘুরাবার জন্যই কথাটা বলল নূরজাহান।

একথায় কাজ হল। হামিদা মন দিল খোলার দিকে। শেষ মউলকাটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলল। আগের একখান মউলকা পড়ে আছে কুলায়। তারপাশে শেষটা রাখল। এই দুইটা তার ভাগের। চুলা থেকে খোলা নামিয়ে, সবকিছু গুছগাছ করে মউলকায় কামড় দিল সে। হুঁকার পানি তখনও বুরুক বুরুক করে পড়ছে।

নূরজাহান বলল, তুমি চিন্তা কইরো না বাবা। যোক্কার পানি আমি ভইরা দিতাছি। আর এই পানিডা পইড়া ভাল অইছে। দেখছো পানি কেমুন হইলদা অইয়া গেছে। এই পানি এমতেই বদলানো উচিত।

দবির না, হামিদা বলল, অইছে বুজছি। অহন বাপরে কী কবি হেইডা ক। তোর তো এক কথার লগে পাঁচপদের কথা।

দবিরের গলা জড়িয়ে ধরে শিশুর মতন দোল খেতে খেতে নূরজাহান বলল, না, অহন পাঁচপদের কথা না। অহন কথা একপদেরঐ।

তয় কচ না ক্যা?

তোমারে কমু না। কমু বাবারে।

তারেঐ ক। আমিও হুনি।

আইচ্ছা হোনো। তয় তুমি কইলাম বাগড়া দিবা না।

কাঁধের দিকে একটা হাত দিয়া গভীর মমতায় মেয়ের পিঠটা ধরল দবির। না না, বাগড়া দিবো না। তুই ক। কী কবি ক মা।

আগেঐ কইলাম কইছি আমার কথা তোমার হোনন লাগবো।

হুনুম নে। তুই ক।

সত্যঐ হোনবা?

সত্যঐ হুনুম।

নূরজাহান একটু থেমে বলল, আমি আইজ বাইত থন বাইর অইতে চাই।

মুখের মউলকা শেষ করে আবার মউলকায় কামড় দিতে যাবে হামিদা, তার আগেই থেমে গেল। দবির কথা বলবার আগেই বলল, কী? কী করবি?

বাইত থন বাইর অমু।

কই যাবি?

মরনি আম্মাগো বাইত।

না না। বাইত থন বাইর অইতে পারবি না। বিয়াশাদি না দিয়া এই বাড়িত থন তরে আমি আর বাইর করুম না।

নূরজাহান কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, এইডা কোনও কথা অইলো? আইজ আষ্ট-দশ মাস বাইত থন বাইর অই না। শীতের দিন গেল, খরালি গেল, বইষ্যাকালের মাঝামাঝি সমায় অহন, এতদিন বাড়িতে। কোনওহানে বাইর অইতে পারি না। মনে অয় আমি একখান পাখি। আমারে তোমরা খাঁচায় আটকাইয়া রাখছে।

হামিদা গম্ভীর গলায় বলল, তর এই অবস্তার লেইগা তুইঐ দায়ী।

আরে হেইডা তো কত আগের কথা। হেইডা তো মিট্টাঐ গেছে। অহন কি আর আমার কোনও অসুবিদা আছে? হুজুরে তো আমারে মাপঐ কইরা দিছে।

দবির মনে মনে বলল, না রে মা, না। মাপ তরে হেয় করে নাই। যেইডা করছে হেইডা অইলো শয়তানি। খাড়া শয়তানি। শয়তানি কইরা মাইনষেরে বুজাইছে নাদান মাইয়া একহান ভুল কইরা হালাইছে। আল্লাহপাকে কইছে নাদানরে মাপ কইরা দিয়ো। আমি অরে মাপ কইরা দিলাম। এই হগল কইয়া হেয় আছিলো অন্যতালে। মোতাহারের মায় না। মরলে কোন তাল ধরতো কে জানে। হেয় মরছে দেইক্কা বিয়ার তাল ধরছে। মোতাহারের মা বানাইতে চাইতাছে তরে।

হামিদা বলল, যা ইচ্ছা করুক। আমি তরে বাইত থনে বাইর অইতে দিমু না। দবিরের গলা ধরে একটা ঝাঁকানি দিল নূরজাহান। কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, তুমি কথা কও না ক্যা বাবা? এই বাইত্তে থাকতে থাকতে আমি পাগল অইয়া যাইতাছি। আমারে ইট্ট বাইত থনে বাইর অইতে দেও। তুমি নিজে গিয়া আমারে মরনি আম্মার বাইত্তে দিয়াহো। বিয়ালে তুমি গিয়া লইয়াইয়ো। ওই বাইত থনে আমি আর কোনওহানে যামু না। কতদিন। মরনি আম্মারে আমি দেহি না। গেরামের কোনও মাইনষেরে দেহি না। আর কেঐরে দেহনের আমার কাম নাই। আমি খালি ইট্টু মরনি আম্মারে দেহুম। বাবা, ও বাবা। মা রে বুজাও। আমারে বাড়িত থনে বাইর অইতে দেও।

মেয়ের পিঠ থেকে হাত সরিয়ে আনল দবির। তারপর উঠে দাঁড়াল। ল।

আচমকা এভাবে রাজি হয়ে গেছে দবির, নূরজাহান তো থতমত খেলই, তারচেয়ে অনেক বেশি থতমত খেল হামিদা। হাতে শেষ মউলকাটা ধরা, সেই অবস্থায় দবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কও কী তুমি? ও নূরজাহানের বাপ, আরে কও কী তুমি? মাইয়া কইলো আর তুমি রাজি অইয়া গেলা?

দবির গম্ভীর গলায় বলল, হ, অইলাম। মরনি বুজির বাইত্তে গেলে অসুবিদা কী? তোমার মনে নাই হুজুরের মুখে ছ্যাপ দেওনের পর মরনি বুজি অরে কেমতে হামলাইয়া রাখছিল। মরনি বুজি বহুত ভাল মানুষ। হের বাইত্তে গেলে আমার মাইয়ার কোনও ক্ষতি অইবো না।

নূরজাহানের হাত ধরল দবির। ল মা, ল।

নূরজাহান একটা লাফ দিল। যেন জীবনে এত আনন্দিত কোনওদিন হয় নাই। দবিরের হাত ধরে লাফাতে লাফাতে গিয়া কোষানাওয়ে চড়ল। তাদের পিছন পিছন দৌড়ে গেল কুকুরটা। সে আর নাওয়ে চড়ল না। পারে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে লাগল।

বর্ষার পানিতে রোদ পড়ে ভারী মনোরম একটা পরিবেশ চারদিকে। আম কদম, হিজল বউন্না আর বাঁশঝাড় স্তব্ধ হয়ে আছে শ্রাবণ দিনের রোদে। কইফফার ছাড়ায় এইমাত্র বাবা কানিবক ঠোঁটে করে দুইটা চেলামাছ নিয়া বাসায় ফিরেছে। এখন আদর করে ছানাদের খাওয়াবে। এই ফাঁকে মা কানিবক যাবে খাবার আনতে। সে না ফিরা তরি বাপ বসে বসে পাহারা দিবে।

মানুষের লগে পাখিদের বিস্তর ফারাক, আবার বিস্তর মিলও। পাখিরা ওড়ে, কখনও কখনও মানুষও ওড়ে। এই এখন যেমন নূরজাহান উড়ছে। বসে আছে কোষানাওয়ে, বাপ নৌকা বাইছে, তবে মনে মনে উড়ছে নূরজাহান। ওদিকে বাপ মেয়ের কাণ্ড দেখে রান্নাচালায় পাথর হয়ে আছে হামিদা। শেষ মউলকার অর্ধেকখানি তখনও হাতে।

.

পাটাতন ঘরের দরজার সামনে আসনপিড়ি করে বসেছে মজনু।

পরনে নীল ডোরাকাটা লুঙ্গি। খালি গায়ে গলার কাছে মাফলারের মতন ফেলে রেখেছে পুরানা গামছা। সামনে একটা জলচৌকি। জলচৌকিটা রেখেছে কপাটের লগে ঠেস দিয়া যাতে হঠাৎ ছুটে আসা বাতাসে কপাট নড়াচড়ার সুযোগ না পায়।

জলচৌকির উপর মুখ বানানোর (গোঁফ দাড়ি কামানোর) জিনিসপত্র রেখেছে মজনু। টিনের ছোট সাইজের বাটিতে অর্ধেক ক্ষয় হওয়া লাক্স সাবান, অ্যালুমিনিয়ামের মগে আধামগ পানি। সামনে কপাটের লগে ঢেলান দিয়া দাঁড় করাইছে একটা হাত আয়না। এই আয়নাটা বহুকালের পুরানা। লাল রঙের বিঘত পরিমাণ লম্বা আর বিঘতের সামান্য কম পরিমাণ চওড়া কাঠের ফ্রেমে আটকানো আয়না। সেই আয়নার আবার কায়দার অন্ত নাই। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নাই এটা আয়না। দুইহাতে টেনে খুললে দেখা যায়। কাঠের একদিকে মুখ দেখার আয়না বসানো, অন্যদিকটা, মাটিতে বা যে কোনও জায়গায় আয়না যাতে স্থির হয়ে থাকতে পারে সেই ব্যবস্থা। আজকাল এই ধরনের আয়না আর দেখা যায় না।

কবে, কত কত বছর আগে কালীরখিলের গলুইয়া থেকে দুইআনা দিয়া কিনা আনছিল মরনি। দিন চলে গেছে, জিনিসটা রয়ে গেছে।

মজনুর হাতে সস্তা ধরনের একটা সেভিংব্রাশ। প্রথমে মগের পানিতে ব্রাশটা একটু ভিজিয়ে বাটিতে রাখা সাবানেব্রাশ ঘসল সে। সেই ঘসায় লাক্স সাবানে ফেনা হল ভালরকম। বাটির খানিকটা ভরে গেল ফেনায় আর ব্রাশে তো সাবান যতটা লাগার লাগলই। ব্রাশটা তারপর গালে গলায় ঘসতে লাগল মজনু। দেখতে দেখতে সাদা ফেনায় মাখামাখি হয়ে গেল মুখ। জলচৌকির একপাশে পাতলা কাগজের মোড়কের ভিতর নতুন একখান ব্লেড, অল্পদামি একটা রেজার। মুখে ফেনা মাখা শেষ করে অতিযত্নে ব্লেড খুলল মজনু, রেজার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুলল। ব্লেড বসালো সাবধানে। আবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বন্ধ করল রেজার। এখন সব রেডি। মুখ একটু নিচু করে আয়নার দিকে তাকাল মজনু, বাঁ দিক থেকে রেজার টানতে লাগল।

মরনি বসে আছে দরজার অদূরে তক্তায়। বসে অপলক চোখে মজনুকে দেখছে। মুখটা পুরাপুরি দেখা যাচ্ছে না ছেলের, দেখা যাচ্ছে পিঠ। ঢাকার টাউনে থাকতে থাকতে, দিনরাত দোকানে বসে খলিফাগিরি করতে করতে ফরসা হয়ে গেছে মজনু। দেশগ্রামের মতন খোলা রোদ হাওয়া পায় না। আর দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই গায়ে আছে শার্ট গেঞ্জি, খালি গা গোসলের সময় ছাড়া হয়ই না। এই অবস্থায় ফরসা তো হবেই। চাপাপড়া ঘাসও তো কিছুদিন পর সবুজ রং হারিয়ে ম্যাড়ম্যাড়া সাদা রং ধরে।

তবে মজনুর রংটা ম্যাড়ম্যাড়া না। পিঠ দেখে মনে হচ্ছে দুধের লগে কাঁচা হলুদ বাটা মিশালে যে রং হবে অবিকল সেই রং মজনুর পিঠের। বুক পিঠের তুলনায় মুখ একটু কম সাদা, কনুয়ের কাছ থেকে বাকি হাত একটু কম সাদা। অর্থাৎ এই জায়গাগুলি খোলা থাকে। রোদ হাওয়া কখনও কখনও একটু আধটু লাগে।

মাথার চুল সুন্দর ছেলেটির! এবার বাড়ি আসার পর যেন আরও বড় লাগছে তাকে। হঠাৎ করে যেন পুরুষ হয়ে গেছে। এই যে এখন মুখ কামাচ্ছে, দেখতে ভাল লাগছে।

মুগ্ধ হয়ে ছেলেকে দেখতে দেখতে মরনি হঠাৎ একটু চমকাল। হায় হায় এইডা আমি কী করতাছি? আমি মজনুর খালা অইলেও আসলে অইলাম মা। খালি পেট থিকা অরে আমি জন্ম দেই নাই, আর তো সবই করছি। ও তো আমারই পোলা। আপনা পোলারে মা বাপে। নজর কইরা দেখলে, তারে সোন্দর কইলে, মনে মনে কইলেও বদনজর লাগে পোলার শইল্লে। হায় হায় ওইরকম নজর লাগলে আমার পোলার তো ক্ষতি হইবো।

মজনুর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল মরনি।

আয়নার ভিতর থেকে ব্যাপারটা খেয়াল করল মজনু। গালে গলায় রেজার টানা বন্ধ করে মরনির দিকে তাকাল। কী অইলো খালা?

মরনি আগের মতনই অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, কী অইবো?

আমি দেখলাম তুমি আমার মিহি চাইয়া রইছো, তারবাদে আথকা মুখ ঘুরাইয়া ফালাইলা?

মরনি মজনুর দিকে তাকাল। তুই দেখলি কেমতে? তুই না মুখ বানাইতাছস?

তারবাদেও দেখছি।

কেমতে দেখলি হেইডা কচ না ক্যা?

আয়নার ভিতরে থিকা দেখছি।

বুজছি। আগে তর কাম শেষ কর তারবাদে কমু নে।

না অহনঐ কও।

অহন কইলে তর মুখ বানাইতে দেরি অইবো। মুখে সাপানের ফেনা হুগাইয়া যাইবো।

না যাইবো না। তুমি কথা কইবা আর হেই ফাঁকে আমি সেপ করুম।

না হেইডা করন যাইবো না বাজান।

ক্যান করন যাইবো না?

আথকা হাইসা হুইসা ফালাইলে বেলেডে মুখ কাইট্টা যাইবো।

আরে না। তুমি কও।

মরনি হাসল। তোর মুখ বানান দেইখা, তর শইল দেইখা তরে মনে অইলো তুই জুয়ান মর্দ অইয়া গেছস। সোন্দরও অইছস। আপনা পোলা সোন্দর অইলে মা’র হেইডা দেখতে অয় না। দেখলে নজর লাগে। আর মুখ দিয়া পোলার সোন্দর অসোন্দরের কথা কইলে লাগে মুখ। তরে দেখতে দেখতে এই হগল মনে অইতাছিল আমার। এর লেইগা তর দিক থিকা মুখ ফিরাইয়া নিছি।

রেজার নামিয়ে আবার খালার দিকে তাকাল মজনু। যাতে আমার উপরে তোমার নজর লাগে?

হ বাজান।

তার অর্থ অইলো, তোমার চোক্ষে আমি সোন্দর?

মরনি হাসল। আল্লার রহমতে।

তয় একহান কাম করো খালা, আমার কপালে একহান কালা টিপ দিয়া দেও।

ক্যান?

কালা টিপ দিলে নজর লাগবো না।

এত বড় পোলার কপালে কালা টিপ দেওন যায় না। ছোটকালে রোজঐ তর কপালে আমি কালা টিপ দিছি।

একবার শেভ করে ফেলেছে মজনু। দ্বিতীয় বার করবার জন্য আবার আগের কায়দায় ব্রাশে সাবান মাখাল, গ্লাসে রাখা পানিতে রেজার চুবিয়ে চুবিয়ে পরিষ্কার করল, আবার শেভ করতে লাগল।

মরনি অবাক। আবার করতাছস ক্যা?

সেপ দুইবারঐ করতে অয়।

ক্যা?

একবারে গোড়া থিকা দাড়িমোচ কাড়ে না। গোড়াগাড়ি থাইকা যায়। এর লেইগা দুইবার করতে হয়।

বুজছি। তয় সাবধানে বাজান। গাল গোল কাইট্টা হালাইছ না।

আরে না। আমি সেপ করি অনেকদিন অইয়া গেছে। পয়লা পয়লা দুই-চাইরবার ইকটু ইকটু কাটছে। অহন আর কাটে না। শিখা ফালাইছি।

তারবাদেও আমার খুব ডর করে বাজান।

ডরের কিছু নাই।

আবার হাতের কাজ থামিয়ে মরনির দিকে তাকাল মজনু। খালু মুখ বানাইতো না?

হ বানাইতো। তয় তর লাহান এমতে না।

তয় কেমতে?

আষ্ট-দশদিন পর মাওয়ার বাজারে যাইতো। নিতাই নামে একটা নাপতা আছিলো, নিতাই তার মুখ বানাইয়া দিতো।

হ আগের দিনের মাইনষে তো ওমতেই মুখ বানাইতো। নাপিত দিয়া। নিজেরা করতো।

হ।

আষ্ট-দশ দিনে দাড়িমোচ বড় অইয়া যাইতো না?

হ। ম্যালা বড় অইতো। মনে অইতো মুখে দুবলা অইছে। আমগো মতন বাড়ির পুরুষপোলারা মুখ বানাইতে বাজারে যাইতো। দুই পয়সা, এক আনা লাগতো মুখ বানাইতে। যারা ধনী মানুষ, ধর খাইগোবাড়ির মানুষরা, তারা কইলাম বাজারে গিয়া, খোলা জাগায় জলচকিতে বইয়া মুখ বানাইতো না। নাপতারা বাইত্তে আইয়া তাগো মুখ বানাইয়া দিয়া যাইতো।

ততক্ষণে মজনুর কাজ শেষ। গালে গলায় কানের লতিতে, নাকের কাছটায় সাবানের ফেনাফোনা লাইগা আছে। গলায় ঝুলানো গামছায় মুখটা ভাল করে মুছল সে। একদম সাফ সুতরা হয়ে গেল। আহা, মুখটা যে এখন কী সুন্দর দেখাচ্ছে ছেলেটার। এইরকম মুখের দিক থেকে চোখ ফিরানো যায় না।

মরনি তবু চোখ ফিরিয়ে রাখল। মনে মনে বলল, আল্লা মাপ কইরো। আল্লা মাপ কইরো। পোলার উপরে য্যান আমার নজর না লাগে!

মজনু তখন রেজার গ্লাসের পানিতে ধুয়ে ব্লেড খুলছে। কাগজের মোড়কটা রাখা আছে আগের জায়গায়। অতিযত্নে ব্লেড মোড়কে ভরল। গ্লাসের পানি ছুঁড়ে ফেলল উঠানের দিকে। আয়না বন্ধ করে রাখল। তার আগে ব্রাশ ধুয়েছিল মগের পানিতে। সাবান বাটিতেই আছে। সেটা বাটি থেকে তুলে গামছায় সুন্দর করে মুছল। তারপর খালার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। সবকাম শেষ। খালা, আমারে কেমুন লাগতাছে?

মরনিও হাসল। মাশাল্লা। আমার পোলায় বিরাট ডাঙ্গর অইয়া গেছে।

মজনুর সাবান রাখার বাটি আর পানির মগ হাতে নিল সে। ব্লেডখোলা রেজার আর ব্রাশের দিকে হাত বাড়াল। দে।

মজনু অবাক। এইডি দিয়া কী করবা?

ভাল কইরা ধুইয়া লইয়াহি।

খালি মগ আর বাড়ি ধুইলেই অয়। রেজার ব্যারাস তো আমিঐ ধুইছি।

ধোওয়া ভাল অয় নাই। দে আমি ভাল কইরা ধুইয়া আনি।

বাড়ির চারদিকে বর্ষার পানি। পুব আর দক্ষিণের ভিটির ঘরের মাঝখানে, পুব দক্ষিণ কোণে বড়ইগাছটার গোড়ায় এখন ঘাটলা। হাত চারেক লম্বা, আর দেড়হাত পরিমাণ চওড়া, ভারী একখান তক্তা ফেলে ঘাটলা হয়েছে। সেই ঘাটলায় গিয়া চট করেই জিনিসগুলি ধুইয়া আনল মরনি। মজনু তখনও আগের জায়গায় বসে আছে। জিনিসগুলি এনে মজনুর হাতে দিল সে। মজনু এবার উঠল। ঘরের ভিতর দিকে গিয়া জায়গা মতন সব রেখে ঘর থেকে বের হল। উঠানে দাঁড়িয়ে দুইহাত দুইদিকে ছড়ায়া শরীর টানা দিয়া আরামের একটা শব্দ করল।

ছেলের দিকে একবার তাকিয়ে রান্নাচালার দিকে মেলা দিল মরনি। একটু গিয়াই আবার ফিরা আসল। ইকটু নুরুগো ঐমিহি যা বাজান। পুরুষপোলা কেঐরে ডাইক্কা লইয়ায়।

মজনু অবাক। ক্যা, পুরুষপোলা ডাকতে অইবো ক্যা? কী অইছে?

কিছু অয় নাই। একহান কুঁকড়া জবো করন লাগবো।

কুঁকড়া জবো করন লাগবো?

হ।

ক্যা? আথকা কুঁকড়া জবো করবা ক্যা?

 তর লেইগা? তরে আইজ মোরগ পোলাও খাওয়ামু।

কও কী?

হ। সেন্টুর দোকান থিকা ঘি আনাইয়া রাখছি। একটা কুঁকড়াও বাইচ্ছা রাখছি। ওইডারে আইজ জবো করুম।

পোলাওর চাউল আনাইছো কার দোকান থিকা?

রমেশের দোকান থিকা। দিনাজপুরের কালীজিরা চাউল। যা ঘেরান। যা বাজান যা, কেঐরে ডাইকা লইয়া আয়। কুঁকড়া জবো কইরা দে। জবো করনের পর ফইর মইর পয়পরিষ্কার করতে সময় লাগবো। অহন না করলে দেরি অইয়া যাইবো রান বাড়ন শেষ অইতে।

আরে না, বেশি দেরি অইবো না। দোফরে আমি আইজ দেরি কইরাই খামু। বিয়ানে এত বড় বড় তিনডা ভাপা পিডা খাওয়াইছো। বিয়ালের আগে খিদাই লাগবে না।

যহন খিদা লাগে তহনঐ খাইচ। আমি আমার কাম শুরু করি।

সব জেনে বুঝেও খালার লগে তারপর একটা মজা করল মজনু। অন্য কেঐরে ডাক দেওনের কাম কী? লও তুমি আমিঐ কুঁকড়া জবো কইরা হালাই।

মরনি আঁতকে উঠল। তোবা, তোবা। মাইয়াছেইলারা কোনও কিছু জবো করতে পারে।

ক্যা?

মাইয়াছেইলারা কোনও কিছু জবো করলে হেই জিনিস হালাল অয় না।

কে কইছে তোমারে?

আমি জানি। ছোডকাল থিকা দেইখা আইতাছি। মাইয়াছেইলাগো অনেক অসুবিধা। অনেক কামঐ তারা করতে পারে না। নিষুদ আছে।

আমি এইসব জানি।

তয় আবার কচ ক্যা?

কইলাম আর কী? খালা, একহান কথা কও তো আমারে। ধরো কোনও একহান গেরামে কোনও পুরুষপোলা নাই। খালি মাইয়াছেইলা। ধরো তাগো আথকা কুঁকড়া জবো করন লাগতাছে। তহন তারা কী করবো?

এতকিছু বাজান আমি কইতে পারুম না।

দুইজন মাইয়াছেইলায় কি দুই মিহি দিয়া ধইরা কুঁকড়া জবো করতে পারবো না?

না পারবো না।

ক্যা?

নিয়ম নাই।

নিয়ম থাকবো না ক্যা? দুইজন পুরুষপোলায় যেই কাম পারবো দুইজন মাইয়াছেইলায় হেই কাম পারবো না ক্যা?

পারবো না। এইডা আল্লার নিষুদ।

একটু থামল মরনি। এত প্যাচাইল পারিচ না। যা, কেঐরে ডাইকা আন।

খাড়াও যাইতাছি।

যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে মজনু বলল, ও খালা, তোমার ওই কুঁকড়াডা কো?

কোনডা রে বাজান?

ওই যে চিলের মুখ থিকা না ধুরকাউয়ার (দাঁড়কাক) মুখ থিকা জানি আমগো উডানে পড়ছিল। তুমি লাইল্লা পাইল্লা ডাঙ্গর করছিলা…

আর কইচ না বাজান। চইত মাসের দোরবেলা বাড়ির নামা থিকা মোরগটারে হিয়ালে লইয়া গেল।

কও কী?

হ।

আহা রে! ওইডা একহান সাই (দারুণ) কুঁকড়া আছিলো।

হ রে বাজান। ভাল কুঁকড়া আছিলো। কুঁকড়াডার কথা আমার খুব মনে অয়। চিলের মুখ থিকা যেমতে আইয়া পড়ছিলো আমগো বাইত্তে, ঠিক অমতেই আবার হিয়ালে লইয়া গেল। কই থিকা আইলো কই গেল গা!

মরনির একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। খালার দীর্ঘশ্বাসের শব্দে তার দিকে ফিরে তাকাল মজনু। তোমার মন এত মুলাম খালা। একহান কুঁকড়ার লেইগাও তোমার মন কান্দে।

মরনি কথা বলল না। অন্যমনস্ক হয়ে গেছে।

এই অবস্থা কাটাবার জন্যই কথা ঘুরাল মজনু। খালা, একহান কথা কও তো?

কী কথা?

আমি দেখতে কার লাহান অইছি? মা’র লাহান না বাবার লাহান?

মরনি কথা বলবার আগেই তাদের বাড়ির ঘাটে এসে লাগল দবির গাছির কোষানাও।

.

দবির গাছির কোষানাও ঘাটে লাগছে কি লাগে নাই পাগলের মতন একটা লাফ দিল নূরজাহান। লাফ দিয়া ঘাটের তক্তার উপর নামল। মরনি আর মজনু দাঁড়িয়ে আছে বড়ঘরের সামনে। মজনুকে খেয়ালই করল না নূরজাহান। অনেকক্ষণ না দেখা মা’কে হঠাৎকরে দেখলে যেমন করে। দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে অবোধ শিশু ঠিক সেই ভঙ্গিতে মরনিকে এসে জড়িয়ে ধরল। আম্মা, ও আম্মা! আহা রে, কতদিন পর আপনেরে দেখলাম। আপনেরে একটু প্যাচাইয়া ধরলাম।

মরনির অবস্থাও অবোধ শিশুর মায়ের মতন। সেও এমন করে জড়িয়ে ধরেছে নূরজাহানকে, পারলে কোলে তুলে ফেলে। পারছে না বলে একহাতে নূরজাহানকে জড়িয়ে। ধরে অন্য হাতটা গভীর মমতায় বুলিয়ে দিচ্ছে তার মাথায় পিঠে। হ রে মা, তরেও আমি বহুতদিন বাদে দেখলাম। আমার সোনা, কত বড় অইয়া গেছস তুই!

মজনু তখন তাকিয়ে তাকিয়ে নূরজাহানকে দেখছে। মুখটা হাসিহাসি হয়ে আছে তার। নূরজাহানের ঘটনা সে সবই শুনেছে। সবই জানা। তারপর থেকে নূরজাহান যে আর বাড়ি থেকে বের হয় না, বাপ মায়ে যে তাকে আর বাড়ি থেকে বের হতে দেয় না এইসব খবর সবই সে রাখে। এর মধ্যে তিনবার বাড়ি আসছে। কোনও কোনওবার ইচ্ছা করছে যায় একটু নুরজাহানদের বাড়িতে। তাকে একটু দেখে আসে। একটু কথা বলে আসে তার লগে। কোথা দিয়া কেটে গেছে সময়। কোন ফাঁকে ফিরা যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ফিরা গেছে খলিফাগিরির কাজে। নূরজাহানের লগে আর দেখাই হয় নাই।

একবছরও পুরা হয় নাই এর মধ্যেই যেন অনেকখানি বড় হয়ে গেছে নূরজাহান। আগের সেই চঞ্চলতা কিছুটা যেন কমেছেও। যদিও নৌকা থেকে যেভাবে লাফ দিয়া নামল, যেভাবে দৌড়াইয়া আইসা জড়ায়া ধরল মরনিকে এরকম ভঙ্গি তার আগেও ছিল। তবু যেন কোথায় সূক্ষ্ম একটা বদল।

বড়ইগাছের গোড়ার লগে কোষানাওটা ততক্ষণে বেঁধেছে দবির। মাজার কাছে লুঙ্গির লগে গিঁট দিয়া বাধা পুরানা গামছাখান। নৌকা বাঁধা শেষ করে গামছা মাজা থেকে খুলল। খুলে মুখ গলা মুছল। তারপর সেই গামছা একদিককার কাঁধে ফেলে হাসিমুখে এসে দাঁড়াল। মানুষ তিনজনের কাছাকাছি। নূরজাহান ব্যস্ত হয়েছে মরনিকে নিয়া, সে ব্যস্ত হল মজনুকে। নিয়া। কী গো বাজান, তুমি দ্যাশে আইছছা কবে?

মজনু আনন্দিত মুখে বলল, এইত্তো গাছিমামা, পশশু বিয়ালে আইছি।

থাকবানি দুই-চাইরদিন?

হ মামা থাকুম, আরও চাইর-পাঁচদিন থাকুম।

ভাল আছো তো?

হ মামা, আছি। ভাল আছি।

মরনিকে ছেড়ে নূরজাহান তখন মজনুর দিকে তাকিয়েছে। হঠাই কাইজ্জাকিত্তনের গলায় বলল, এই মজনুদাদা, তুমি এত খারাপ হইছো কেমতে?

মজনু থতমত খেল। খারাপ অইছি? কী খারাপ অইছি?

আমার এতবড় একহান বিপদ গেল আর তুমি একবারও আমার খবর লইলা না?

মজনু একটা হাঁপ ছাড়ল। ও এই কথা!

হ, তয় কী কথা? এর মইধ্যে তুমি দ্যাশে আহো নাই? আমি নাইলে বাইত থিকা বাইর অইতে পারি না, তোমার দশা কি আমার লাহান? আম্মায় কি তোমার হাত পাও বাইন্দা থুইছিলো? তুমি একবার আমগো বাইত্তে যাইতে পারতা না?

মজনু হাসল। হ পারতাম।

তয় যাও নাই ক্যা?

সমায় পাই নাই।

নূরজাহান মুখ ভেংচে বলল, ইস সমায় পাই নাই! কী আমার জজ বালিস্টার রে!

মরনিকেও একই রকম কথা বলল সে। মজনুদাদায় নাইলে ঢাকার টাউনে থাকে, আম্মা আপনে? আপনে তো দ্যাশেই থাকেন। আপনেও তো একবার আমার সমবাত লইতে যাইতে পারতেন। আমি বাঁইচ্চা আছি না মইরা গেছি আপনে আমার সমবাত লইবেন না?

কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল নূরজাহান। আমি আপনেগো আপনা মনে করলে কী অইবো, আপনেরা আমারে আপনা মনে করেন না!

মেয়ের কান্না দেখে আর কথা শুনে দবিরের বুকটা তোলপাড় করে উঠল। কাল বিকাল থেকে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা মনে পড়ল। নূরজাহানকে নিয়া হঠাৎ করেই নৌকায় চড়েছিল। এতটা পথ যেন একটা ঘোরের মধ্যে নৌকা বাইয়া আসছে। শ্রাবণ মাসের রোদ আজ সকালবেলাই চড়চড়ায়া উঠছে। বর্ষার পানি আর ধইনচা খেতের আড়াল আবডাল থেকে, চকের জলঘাস আর কচুরিপানায় রোদ পড়ে ঠিকরে উঠছিল। সেই ঠিকরানো রোদে কী ত্যাজ! গরমে ঘামে নাইয়া গেছে দবির। নূরজাহান বসেছিল নৌকার মাঝখানকার পাটাতনে। পরনের শাড়ি দিয়া মাথা ঢেকেছিল এমনভাবে যেন রোদ মাথায় না লাগে। তাও কম ঘামা ঘামে নাই মেয়েটা। দবির ঘেমেছে নৌকা বাইতে বাইতে আর নূরজাহান ঘেমেছে রোদ মাথায় বসে থাকতে থাকতে।

এক নায়ের দুইজন মানুষ ছিল দুইরকম ঘোরে। একজনের মনে বেদম ফুর্তি। এতদিন পর বাড়ি থেকে বের হয়েছে। মরনি আম্মাকে একটু দেখতে পাবে, তার লগে একটু কথা বলতে পারবে। তখনও সে জানে না মজনুদাদায়ও আছে বাড়িতে। তা হলে মনের ভিতরে হয়তো অন্য রকমের একটা দোলাও লাগত।

আর দবির গাছির ঘোরটা ছিল অন্যরকম।

ল্যাংড়া বসিরের মুখে ওসব কথা শোনার পর থেকে বুকে চেপে বসেছিল হাজার মন ওজনের পাথর। মেয়ে, মেয়ের মা কেউ সেই পাথরের কথা জানে না। আজ সকালে মেয়ে যখন বলল সে বাড়ি থেকে বের হতে চায়, মরনি আম্মার বাড়ি যেতে চায় তখন হঠাৎ করেই দবিরের মনে হল এই তো একজন মানুষ পাওয়া গেছে যাকে মন খুলে বলা যাবে কথাটা। হয়তো সেই সেদিনকার মতন মাওলানা মান্নানের হাত থেকে, চোখ থেকে মেয়েকে সে বুকের আড়ালে লুকিয়ে রাখবে। আরেকবার বাঁচিয়ে দিবে তার মেয়েটাকে।

তখনই ঘোরটা দবিরের তৈরি হয়েছিল।

সে আর কোনওদিকে তাকায় নাই। হামিদা যে মেয়ে নিয়া বাড়ি থেকে বের হওয়া পছন্দ করবে না, একবারও ভাবে নাই সেই কথা। মেয়ে নিয়া নৌকায় চড়েছে। শরীরের যাবতীয় শক্তি দিয়া বইঠা বাইয়া আসছে। বইঠা বাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মনে হয়েছে মৃত্যুর আগ তরি এই বইঠা সে ছাড়বে না। মেয়ে নিয়া নৌকা বাইয়া চলে যাবে এমন এক দেশে যে দেশে মান্নান মাওলানা নাই। যে দেশে তার এইটুকু মেয়ের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য জঘন্য কোনও পথ ধরবে না মেয়ের বাপের চেয়ে পনেরো-ষোলো বছরের বড় কোনও মানুষ!

মানুষ!

মান্নান মাওলানা মানুষ!

নূরজাহানের কান্না দেখে মজনু গেছে স্তব্ধ হয়ে, মরনি গেছে দিশেহারা হয়ে। দুইহাতে নূরজাহানের মাথা বুকে জড়িয়ে ধরে মরনি তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল। ওরে আমার সোনা রে! কান্দে না মা, কান্দে না। আমার অসুবিদার কথা আমি তরে কেমতে বুজামু মা? আমি একলা মানুষ। মজনু ছাড়া আর কেউ নাই সংসারে। মজনু থাকে ঢাকায়। বাইত্তে আমি একলা। এই বাড়ি হালাইয়া কেমতে আমি বাইত থিকা বাইর অই, ক? কেমতে তরে দেখতে যাই, ক? খালি বাড়ি হালাইয়া কোনওমিহি যাওন যায়? তয় মা, আমার কইলাম তর কথা খুব মনে অয়। রোজ মনে অয়। যেমতে আমার মজনুর কথা মনে হয়, ওমতেই আমার তর কথাও মনে অয়। মায় কি পোলা মাইয়া কেঐরে ভুইল্লা থাকতে পারে, ক?

নূরজাহান শিশুর মতন নাক টানল। গভীর অভিমানে, কান্নাভাঙা গলায় বলল, এই হগল কথা আমি বুঝি! আইজ আমি আইছি দেইখা আপনে এই হগল কথা কইতাছেন।

আরে না রে পাগল! আমি আমার মনের কথাই তরে কইলাম।

মজনুও সান্ত্বনা দিতে চাইল নূরজাহানকে। হ রে নূরজাহান, খালার মনের কথা আমি জানি। আমি যেই কয়বার বাইত্তে আইছি, খালায় তর কথা আমারে কইছে।

নূরজাহান চোখ মুছল। তুমি কথা কইয়ো না। তোমার উপরে আমার বেশি রাগ।

দবির টের পেল যেন কত আপন দুইজন মানুষের কাছে বহু বহুদিন পর ফিরা আসছে তার মেয়ে। যেন এই দুইজন মানুষের উপর বিশাল অধিকার তার।

আহা এইরকম এক বাড়িতে যদি জীবনটা কাটাতে পারত তার মেয়ে! যদি মরনির মতন একজন শাশুড়ি হত তার, যদি মজনুর মতন স্বামী হত!

মরনি তখন কথা ঘুরিয়েছে। নূরজাহানের গালে লেগে থাকা চোখের পানি ডানহাতে মুছে দিতে দিতে বলল, মাগো, তুই কইলাম আইজ সারাদিন আমগো বাইত্তে থাকবি।

লগে লগে কান্না অভিমান সব ভুলে গেল নূরজাহান। উচ্ছল গলায় বলল, আমি তো থাকতেঐ চাই।

তয় থাক। অসুবিদা কী?

বাবারে কন।

তর বাবায় তো হোনছে। সামনে ত্তো খাড়াইয়া রইছে। কী গাছিদাদা, হোনেন নাই?

দবির বলল, হুনছি।

মজনু বলল, একলা খালি নূরজাহানরে থাকতে কইতাছো ক্যা খালা? গাছিমামারেও কও।

হ কইতাছি। গাছিদাদা, আপনেও থাকেন। দোফরে খাইয়াদাইয়া তারবাদে যাইবেন।

না না আমার থাকনের কাম নাই। নূরজাহান থাউক। বিয়ালে আইয়া লইয়া যামু নে।

বাপের লগে তাল দিল নূরজাহান। হ বাবায় যাউকগা আম্মা। আমি থাকি।

মজনু বলল, না, গাছিমামায়ও থাকুক।

মজনুর কথা শুনে ভিতরে ভিতরে খুশি হল দবির। মনে মনে বলল, হ থাকনঐ ভাল। ওই বদমাইশটার কথা মরনি বুজিরে কইতে অইবো। অহনঐ ত্তো কওন যাইতাছে না। কইতে অইবো এমুন কায়দায়, নূরজাহানের কানে য্যান কথা না যায়, মজনুর কানে য্যান না যায়। কথা কওনের ওই ফাঁকটা পাওন লাগবো। হারাদিন থাকলে ফাঁক পাওয়া যাইবোঐ।

মরনি তখন মজনুর দিকে তাকিয়েছে। তর গাছিমামারে লইয়া কুঁকড়া জবো কইরা হালা বাজান।

মোরগ জবাইয়ের কথা শুনে দবির হা হা করে উঠল। আরে না, কুঁকড়া জবো করন লাগবো না। শাক ভাত যা হয় তাই খামু নে।

মজনু হাসল। আরে না মামা। আইজ আর শাক ভাত না। আপনেগো কপাল ভাল। খালায় আইজ পোলাও মোরগ রানবো। আপনেরা আহনের আগে থিকাই আমারে কইতাছে নূরা মামাগো ওইমিহি থিকা কেঐরে ডাইক্কা আইন্না মোরগহান জবো কইরা দিতে।

দবির কথা বলবার আগেই নূরজাহান বলল, পোলাও মোরগ না খাইলেও আমার কোনও অসুবিদা নাই। আমি হারাদিন আম্মার কাছে থাকতে পারুম এইডাঐ আমার আনন্দ।

দবির বলল, তয় আমারও একহান মতলব আছে।

মরনি বলল, আপনের আবার কী মতলব গাছিদাদা?

তোমার লগে কথা আছে।

অহন কইবেন?

আরে না। পরে কমু নে। অহন তামুক খাওনের ব্যবস্থা করি।

তামুকের ব্যবস্থা কই থিকা করবেন? আমার ঘরে তো উক্কা নাই?

জোগাড় করুম নে।

বুজছি, নূরাগগা ওইমিহি থিকা আনবোনে।

হ।

মজনুর দিকে তাকাল দবির। তয় লও বাজান মোরকহান জব কইরা হালাই।

লন।

মরনি বলল, মোরগ ধরতে অইবো। খাড়া বাজান, একমুঠ খুদ দিতাছি। উডানে ছিটাইয়া কুঁকড়াডি দৌড়াইয়া আইবো। হেই ফাঁকে থাবাদা ধরতে অইবো।

আরে ওই কায়দা আমি জানি। তুমি আগে খুদ ছিডাও আর আমারে দেহাই দেও কোনডা জবো করতে অইবো। দেইখখানে কেমতে আমি ধরি।

কথা বলতে বলতে নূরজাহানের দিকে তাকিয়েছে মজনু, তাকিয়ে দেখে নূরজাহান অদ্ভুত এক চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এরকম চোখে নূরজাহানকে কোনওদিন তার দিকে তাকাতে দেখে নাই মজনু। নূরজাহানের চোখে কী ছিল কে জানে, বুকের খুব ভিতরে আশ্চর্য এক শিহরন লাগল তার।

.

বুজি গো, তোমারে একহান কথা কইতে চাই।

খানিক আগে খাওয়াদাওয়া শেষ করেছে মরনি। মজনু আর দবির মিলে মোরগ জবাই করে দেয়ার পর সেই মোরগের ফইর ছাড়াতে দিয়েছিল নূরজাহানকে। তুই ফইর বাইচ্ছা হালা মা, আমি মোশলা বাটি। তর ফইর বাছা অইতে অইতে আমার মোশলা বাটা অইয়া যাইবো। তারবাদে আমি মোরগ বানামু নে। আর কোনও কাম তর করন লাগবো না।

বাড়িতে এই ধরনের কাজ করতে দিলে নূরজাহান নানান পদের তালবাহানা করে। কাজ করতে তার ভাল্লাগে না। এই নিয়া হামিদার কী বকাবাজি! মেয়ের গালে ঠোকনাটা চটকানাটা মারে, বেশি রাগলে গুম গুম করে কিলও মারে পিঠে। মার খেলে কাজে ফাঁকি দেওয়ার অছিলা পায় নূরজাহান। চিৎকার কান্নাকাটি করে, গাল ফুলিয়ে বাঁশঝাড়টার দিকে গিয়া বসে থাকে। রান্নাচালার দিকে, বড়ঘরের দিকে আর আসেই না। খাওয়ার সময় হলে দবির তাকে আদর আহ্লাদ করে, পিঠ মাথা দোয়াতে দোয়াতে (আদর স্নেহের ভঙ্গিতে হাত বুলানো) ঘরে নিয়া যায়। বাপ মেয়ের ভাতের থাল সামনে দিয়া হামিদা থাকে গম্ভীর হয়ে। নূরজাহানের মুখ তখনও গোমড়া। দবির আগের মতনই মাথায় পিঠে হাত বুলায়। খাও মা, খাও। ভাত সামনে লইয়া বইয়া থাকন ভাল না। আল্লায় গুনা দেয়।

নূরজাহান তবু থালের দিকে তাকায় না। ভাত মুখে দেয় না।

হামিদা মুখঝামটা দিয়া বলে, ইস, গোলামের ঝির কুয়ারা কত? ওই, তাড়াতাড়ি ভাত মুখে দে, নাইলে অহন পিছা দা পিডামু! কামকাইজ করন লাগবো না? জামাই বাইত্তে গিয়া কোনও কাম না পারলে তো মুখে গু উড়াইয়া দিবো।

হামিদাকে ধমক দেয় দবির। এই তুমি চুপ করো। এত বকবা না মাইয়াডারে।

তারপর আবার মেয়ের মাথায় পিঠে হাত বুলায়। খাও মা, খাও। এই নেও আমি তোমারে খাওয়াইয়া দিতাছি।

নিজের থালের দিকে না তাকিয়ে মেয়ের থালের ভাত তরকারি মাখায় দবির। একহাতে মেয়ের থুতনি ধরে অন্যহাতে ভাত তুলে দেয় মুখে। হাঁ করো মা, হাঁ করো।

মেয়ের লগে লগে নিজের অজান্তে নিজেও হাঁ করে ফেলে দবির।

হামিদার চোখেমুখে তখন দুনিয়ার বিরক্তি। বাপ মেয়ের এইসব আহ্লাদ সব সময় তার ভাল্লাগে না। তার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা। ঘরসংসারের কাম কিচ্ছু হিগতাছে না নূরজাহান। জামাই বাইত্তে গিয়া উপায় অইবো কী মাইয়ার? হৌর হরি, দেওর ননদগ খোডা (খোটা) খাইয়া মরবো না? জামাই কইবো কী?

সেই নূরজাহান আজ মরনির পাশে বসে এত সুন্দর করে মোরগের ফইর ছাড়াল! মেয়ের কাজ দেখে দবির মুগ্ধ। মোরগ জবাই করে দিয়াই সে চলে গিয়েছিল নুরুদের সীমানায়। একটা হুঁকা আর অল্প একটু তামাক যদি জোগাড় করা যায়!

নুরুর বাবা ভাসান মাঝি খানিক আগে বিল থেকে ফিরেছে। তামাকের নেশায় পাগল। হওয়া মানুষ। বিলে গিয়েছিল গোরুর ঘাস তুলতে। নৌকার ডরা ভরে ঘাস নিয়া ফিরাই সেই ঘাস আথালে বাঁধা গোরুগুলির সামনে ভুর করে রাখতে রাখতে ছোটমেয়ে সাহিদাকে চিৎকার করে বলেছে, তাড়াতাড়ি তামুক হাজা।

লুঙ্গির কাছা খোলার কথাও মনে হয় নাই, আথালে বাধা গোরুগুলি মুখের সামনে বিলের তাজা ঘাস পেয়ে যেভাবে হামলে পড়েছিল ঠিক সেইভাবে ভাসান মাঝিও হামলে পড়েছিল হুঁকার ওপর। দবির গিয়া দেখে বড়ঘরের ছেমায় বসে করুক করুক করে তামাক টানছে ভাসান মাঝি। টানার ভঙ্গি এমন, কতক্ষণ চলবে এই টানা, আল্লাহ মালুম!

এই ধরনের গিরস্তবাড়িতে একটার বেশি হুঁকা থাকে না। ওই এক হুঁকায়ই বাড়ির যাদের যাদের তামাক টানার সবাই টানে। ভাসান মাঝি এখন যে কায়দায় টানা শুরু করেছে এই অবস্থায় তার কাছে হুঁকা দবির কেমনে চায়?

দবিরকে দেখে তামাক টানার ফাঁকে ভাসান মাঝি বলল, খবর কী গাছি? আছো কেমুন?

দবির তার স্বভাবসুলভ হাসিমুখে বলল, ভালঐ আছি দাদা।

কী মনে কইরা আইলা?

আইছি দাদা মরনি বুজির কাছে।

হেইডা বুজছি। তয় আমার সীমানায়…

কথা শেষ করল না ভাসান মাঝি, তামাক টানতে লাগল।

দবির বলল, আইছিলাম দাদা উক্কাডা নিতে। তয় আপনে টানতাছেন, নিমু কেমতে?

হ। উক্কা পাইবা না। এককাম করো, তামুক যতাহানি লাগে লইয়া যাও। টিক্কাও লইয়া যাও যেই কয়ডা লাগে।

উক্কা না থাকলে তামুক টিক্কাদা কী করুম?

বুদ্দি হিগাইয়া দেই। রহামাইন্না গেছে দিগলি। ফিরতে সন্দা অইয়া যাইবো। অগো উক্কা নেও গা।

শুনে দবির মহাখুশি। এইডা ভাল বুদ্দি দিছেন দাদা।

আইচায় (নারকেলের মালা) করে অনেকখানি তামাক আর বেশ কয়েকটা টিকা ভাসান মাঝির কাছ থেকে নিয়েছে দবির। নিয়া গেছে রহমানদের সীমানায়। রহমানের মা’র কাছ থেকে হুঁকা নিয়া তামাক সাজায়া মজনুদের বড়ঘরের সামনের তক্তার উপর বসে টানতে শুরু করেছে। টানতে টানতে দেখে মেয়ে তার মজনুদের রান্নাচালায় বসে কী সুন্দর করে মোরগের ফইর ছাড়াচ্ছে। পাটাপুতায় ঘসর ঘসর করে হলুদ বাটছে মরনি, নূরজাহান সেদিকে তাকিয়েও দেখছে না। মন দিয়া হাতের কাজ সারছে। মরনি যখন বলল, তুই খালি ফইর ছাড়া, মোরগ আমি বানামু নে। শুনে নূরজাহান বলল, ক্যা, আমি মোরগ বানাইতে পারি না? এই মোরগ আপনের আর ধরতে অইবো না আম্মা, মোরগও আমি বানাইতাছি।

ফইর ছাড়িয়ে অতি নিপুণ হাতে মোরগের ছাল ছাড়াল নূরজাহান। ধারালো বঁটি এক পা দিয়া চেপে ধরে দুইহাতে মোরগের রান পাখনা আলাদা করল। বুক পেট ফেঁড়ে নাড়ি আর কলিজা গিলা বের করল। গিলার ভিতর সকাল থেকে খাওয়া খুদকুঁড়া জমে শক্ত হয়ে আছে। সেই জিনিস বের করল। দেখতে দেখতে মাটির খাদা ভরে উঠল বানানো মোরগের টুকরা টাকরা মাংসে।

মাংস ধুতে যাওয়ার আগে কুলায় করে ফইরগুলি ফেলে এল পায়খানার ওদিককার ছাইগাদায়। ধোয়া মাংসের খাদার পাশে তখন শুধু মোরগের ছাল, পা দুইখান আর ডানার মাথার দিককার অংশ দুইটা। যত সুন্দর করে, যত নিখুঁত করেই পরিষ্কার করা হোক না কেন, মোরগ মুরগি বানানোর পর এইসব অংশে ফইরের গোড়াগাড়ি থেকেই যায়। পায়ের হাড়ে সাপের ছুলুমের (খোলস) মতন চামড়াটা থেকেই যায়। এই জিনিস পরিষ্কারের পথ অন্য। লোহার হাতা খুন্তির মাথায় চুল ঝুলিয়ে চুলার আগুনে ধরলে ফইরের গোড়াগাড়ি পুড়ে পরিষ্কার হয়। বোটকা একটা গন্ধ অবশ্য ছোটে। তাতে কী? ছালটা তো রান্নার উপযোগী হল।

ঠ্যাং পাখনাও আগুনে পোড়াতে হয়। হাত দিয়া ধরে বেশ কায়দা করে চুলার আগুনে মোরগের ঠ্যাং পাখনা পোড়াল নূরজাহান। একের পর এক এত নিখুঁত ভঙ্গিতে করে গেল কাজগুলি, দবির তো অবাকই, মরনিও অবাক! আরে, আমার মা’য় দেহি বেবাক কাম পারে! এই হগল কাম তুমি কবে হিগলা মা?

নূরজাহান হাসিমুখে বলল, হিগি নাই তো?

তয়?

মা’রে করতে দেখছি না!

দেইক্কা দেইক্কা হিগছো?

হ। আর মোরগ বানানো সোজা আছে। রান্দন মনে অয় আরও সোজা। আপনে কইলে মোরগ আমি রাইন্দাও দিতে পারি।

শুনে দবির ভয় পেয়ে গেল। না না, খবরদার! বুজি, অরে তুমি মোরগ রানতে দিয়েন। কোনওদিন রান্দে নাই। রান্দন ভাল অইবো না। নুনকাট্টা হইয়া যাইবো, তেল মোশলা ব্যাশকম অইয়া যাইবো। এত কষ্টের জিনিস মুখে দিতে না পারলে…

নূরজাহান বাপের দিকে তাকিয়ে হাসল। তুমি খালি খালি ডরাইতাছো বাবা। কিছু অইবো না। মা’রে আমি রানতে দেখছি। আমার রান খারাপ অইবো না।

না মা, না। রানতে অইলে আমগো বাইত্তে একদিন রানদিছ। আমি খাইয়া দেখুম নে। এই বাইত্তে না।

মজনু হাঁটাহাঁটি করছিল উঠানে। নূরজাহানের মোরগ বানানো সে খেয়াল করে দেখেছে। খালার লগে নূরজাহানের কথাবার্তা, গাছিমামার লগে কথাবার্তা সবই শুনছে, শুনেই নূরজাহানের পক্ষে চলে গেল। আপনে অরে না করতাছেন ক্যা গাছিমামা? আমার মনে অয় ও ভালই রানতে পারবো।

দবির মজনুর দিকে তাকাল। না রে বাজান। রানতে বইয়া দেহা গেল বেবাক ছ্যাড়াভ্যাড়া কইরা হালাইছে। খাওনডাই নষ্ট।

আরে না। কাম করতে না দিলে আপনে বুজবেন কেমনে কামডা ও পারে। খলিফাসাবেও পয়লা পয়লা কাম করতে দিত না আমারে। হাত দিয়া ধইরা ধইরা বেবাক কাম হিগাইছে। ঠিকঐ, তয় মিশিনে বইতে দেয় না। মিশিন আমারে চালাইতে দেয় না। কয় সুঁই ভাইঙ্গা। হালাবি। আমি কই, না ভাঙ্গুম না খলিফাসাব। আপনে আমারে বইতে দেন। মিশিন চালাইতে দেন। হেয় দিবো না। খালি আমারে দিয়া হাতের কাম করায়। সুঁইয়ের মইধ্যে সুতা ভইরা আমি শাটের বুতাম আছে না, ওই বুতাম লাগানের ঘরডি সিলাই। বহুতদিন করলাম এই কাম। এইডা কোনও কাম অইলো কন। আমার আর ভাল্লাগে না। একদিন গেলাম চেইত্তা। আইজ আমি মিশিনে বমুঐ। যুদি মিশিনের সুই ভাইঙ্গা হালাই তয় সুইয়ের দাম আপনে আমার বেতন থিকা কাইট্টা রাইখেন। তাও খলিফাসাবে তেড়িবেড়ি করে। দোকানের অন্য কর্মচারীরা আমার পক্ষে। তারা কইলো, হ খলিফাসাব, পুঁই ভাঙ্গলে অর বেতন থিকা সুঁইয়ের দাম কাইট্টা রাইখেন। শ্যাষ পইর্যন্ত খলিফাসাবে রাজি অইলো। আমি বিসমিল্লা বইলা মিশিনে বইলাম। কীয়ের সুঁই ভাঙ্গা, পাকা খলিফার মতন মিশিন চালাইলাম। খলিফাসাবে বিরাট খুশি। অহন আমি অন্য কর্মচারীগো থিকা বহুত বেশি ভাল কাম করি।

নূরজাহান মুগ্ধ হয়ে মজনুর কথা শুনছিল। মরনিও শুনছিল। শোনার ফাঁকে ফাঁকে হলুদ আদা রসুন, জিরা ধইন্না সবই বেটে ফেলেছে। হাতের কাছে তেল ঘিয়ের বোতল বয়াম, বাটিতে রাখা কয়েকটা তেজপাতা, এলাচ লবঙ্গ দারচিনি। এখন শুধু রান্না বসানোই বাকি। নূরজাহান মোরগ রানতে চাইছে আর ওই নিয়া দবিরের আপত্তি, মজনু আছে নূরজাহানের পক্ষে, সব মিলিয়ে বেশ একটা আমোদ ফুর্তির পরিবেশ। এই অবস্থায় মরনি করে কী? দিমুনি মোরগটা আইজ নূরজাহানরে রানতে? আমি তো সামনে আছি। দেহি না কেমুন পারে? ভুল অইলে আমি ঠিক কইরা দিমু নে! আমার মজনু যহন মিশিনে বইয়া সুঁই ভাঙ্গে নাই, নূরজাহানও রানতে বইয়া খারাপ রানবো না।

মরনি ঠিক করল মোরগটা নূরজাহানকে দিয়াই রান্না করাবে। তার আগে নূরজাহানের একটা পরীক্ষা নিবে।

বাটা মশলা টিনের একটা থালে সাজিয়ে রেখেছে। অ্যালুমিনিয়ামের জগে একজগ পানি। পোলাওর চিনিগুড়া চাউল রাখা আছে কালো রঙের খাদায়। ভারী সুন্দর গন্ধ আসছে সেই চাউল থেকে। ঘাটপারে গিয়া চট করে চাউল ধুইয়া আনল মরনি। এসেই নূরজাহানকে বলল, মোরগ আইজ তুইঐ রানবি।

মরনির কথা শুনে তামাক টানতে ভুলে গেল দবির। হাঁ করে মরনির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মজনু হাসিমুখে বলল, হ খালা, অরে দিয়াঐ রানধাও। দেহি কেমুন রানধে।

নূরজাহান বেশ একটা অহংকার নিয়া বলল, ভালঐ রানধুম আল্লার রহমতে।

মরনি বলল, তয় আমি যা যা জিগাই হেইডার জব দে।

জিগান।

মোরগ রানতে অইলে পয়লা কী করতে হয়?

মোরগের ফইর মইর ছাড়াইয়া, মোরগ বানাইয়া গোস্তডি ভাল কইরা ধুইতে অয়।

হ। হেইডা তুই করছস। তারবাদে?

মজনু বলল, রানধনের কথা ক। করবি কেমতে?

কড়াই পয়লা চুলায় দিমু। কড়াই গরম অইলে পরিমাণ মতন তেল দিমু। তেল গরম অইলে দিমু পাঁচপদের মোশলা। হলুদ মরিচ আদা রসুন ধইন্না জিরা।

নূরজাহান মশলার নাম বলছিল আর মজনু কড় গুনছিল। গোনা শেষ করে হাসিমুখে বলল, মোশলা অইলো ছয়পদের।

নূরজাহান লাজুক হাসল। হ ছয়পদের।

মরনি বলল, ঠিক আছে। লগে আর কী দিবি?

পিঁয়াইজ। ওই যে আপনে পিঁয়াইজ কুচি কুচি কইরা কাটছেন ওই পিঁয়াইজ দিমু। পিঁয়াইজ আর তেল মোশলা কষাইয়া তারবাদে মোরগের গোস্ত দিয়া দিমু কড়াইতে। দিয়া হাতা দিয়া একটু নাড়াচাড়া কইরা হরা দিয়া ঢাইক্কা দিমু। এইভাবে কতক্ষুন পর দেহা যাইবো গোস্ত থিকা পানি বাইর অইয়া গোস্ত সিদ্দ হইতে থাকবো। মাঝে মাঝে হরা উড়াইয়া দেখতে অইবো গোস্ত সিদ্দ অইতাছে কি না? তারবাদে একসমায় দেহা যাইবো গোস্ত থিকা যেই পানি বাইর অইছিল হেই পানি হুগাইয়া গোস্ত কষাইন্না অইয়া গেছে। অনেক মাইনষে এই কষাইন্না গোস্তঐ খায়। তয় পোলাওর লগে কষাইন্না গোস্ত খাইতে আরাম লাগে না। সুরাঅলা (ঝোল দেয়া) গোস্ত খাইতে ভাল্লাগে। লগে গোলালু দিলে হেই গোলালু খাইতেও ভাল্লাগে। এর লেইগা গোস্ত কষাইন্না অইয়া গেলে পরিমাণ মতন পানি দিয়া, গোলালু দিয়া আবার ঢাইক্কা দিতে অয়।

মরনি অবাক হয়ে নূরজাহানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। দূরে হুঁকা হাতে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে দবির। তার মাথায় কিছু ঢুকছেই না। তার মনে তখন অনেকগুলি প্রশ্ন। আমার মাইয়ায় এতকিছু হিগলো কবে? কার কাছে হিগলো? যেই মাইয়ায় কোনওদিন রান্নঘরে যায় না হেই মাইয়ায় এতকিছু জানলো কেমতে? অ্যাঁ?

মজনু বলল, আমার মনে অয় এই তরি যা যা কইছস বেবাকঐ ঠিক আছে। তয় বড় বড় দুইহান ভুল এরমইধ্যেঐ তুই কইরা হালাইছস নূরজাহান। ভুলডি অইলো…

মজনুর কথা শেষ হওয়ার আগেই নূরজাহান বলল, কোনও ভুল আমি করি নাই। তুমি তো নুনের কথা কইবা? নুন দিতে হয় পরে। যুদি গোস্ত খালি কইন্না খাইতে হয় তয় নুনডা মোশলা দেওনের লগে লগে দিলেঐ অয়। সুরাঅলা গোস্ত খাইলে নুন দিতে হয় পরে।

আর ওই যে গরম মোশলা?

এবার নূরজাহান লাজুক হাসল। হ, এই জাগায় ভুল ইট্টু অইছে। গরম মেশল্লাও তেল মোশল্লার লগে আগেঐ দিতে অয়।

মরনি মুগ্ধগলায় বলল, আর কিছু লাগবো না। আমার মায় ভালঐ মোরগ রানতে পারবো। রান মা, তুইঐ আইজ রান।

দবির আমতা গলায় বলল, এইডা ঠিক অইবো বুজি?

ঠিকঐ অইবো। আমি আছি না অর লগে! রানধুক না।

মজনু বলল, তয় আর পোলাওডা বাদ দিতাছো ক্যা? পোলাও ও রানধুক। আইজ অর হাতের রানধাই খাই। পোলাও কেমতে রানধে হেই পরীক্ষাড়াও লও।

নূরজাহান আগের চেয়েও অহংকারের গলায় বলল, পরীক্ষা লওন লাগবো না। পোলাও ভালঐ রানধুম। মা’রে রানতে দেখছি না।

দবির তখন আর কথা বলছে না। আবার তামাক টানতে শুরু করেছে। কাল দুপুরের পর থেকে বুকের ওপর চাপা ধরে আছে যে পাথর সেই পাথর এখনও আছে। তবে তার ওজন যেন একটু কম। নূরজাহানকে নিয়া এই বাড়িতে আসার পর, মরনি বুজি আর মজনু এই দুইজন মানুষকে পেয়ে, মোরগ জবাই, দুপুরে পোলাও মোরগের আয়োজন আর নূরজাহানের এইসব কৃতিত্ব, সব মিলিয়ে বুকে চাপা পাথর পানিতে ধীরে ধীরে ওজন হারাচ্ছে।

তারপর মোরগ পোলাও রান্না হয়েছে। নূরজাহান আর মরনি মিলেমিশেই করেছে। মূলকাজগুলি করেছে নূরজাহান, মরনি বসে থেকেছে তার সামনে। টুকটাক সাহায্য করেছে, এটা ওটা দেখিয়ে দিয়েছে, এগিয়ে দিয়েছে। একটা সময়ে ঘি মশলার গন্ধে ভরে গেছে। চারদিক। দু-তিনটা কাক এসে নেমেছিল উঠানে, একটা শালিক নেমেছিল। মোরগ মুরগিগুলি চরছিল এদিক ওদিক। কোনও কোনওটা রান্নাচালার কাছে, মরনি নূরজাহানের পায়ের কাছে চলে আসছিল খাদ্যের আশায়। কাকগুলি তালে ছিল যদি ঠোকরে ঠাকরে তুলে নেওয়া যায় কিছু। নিরীহ ধরনের শালিক পাখিটাও ছিল তার তালে। যদি সেও পায় কিছু। এইসব পাখপাখালির পেট যেন কখনোই পুরাপুরি ভরে না। কখনোই যেন খিদা মিটে না তাদের। মুখের কাছে চব্বিশঘণ্টা খাবার পেলে চব্বিশঘণ্টাই খাবে।

রান্নাবান্না শেষ হওয়ার পর মরনি আর নূরজাহান দুইজনে মিলে হাঁড়ি পাতিল নিয়া রেখেছে বড়ঘরে। মরনি সেই ফাঁকে তাড়া দিয়েছে মজনুকে। যা বাজান, তাড়াতাড়ি নাইয়া আয়। তর নাওয়া অইলে আমি নাইতে যামু। দোফর বইয়া যাইতাছে।

লুঙ্গি গামছা নিয়া ঘাটপারে রওনা দিয়েছে মজনু, হঠাৎ যেন মনে পড়েছে দবির গাছির কথা। দবির তখনও ছনছায় বসা। এখন আর তামাক টানছে না। হুঁকা রেখে দিয়েছে টিনের বেড়ার লগে ঠেকনা দিয়া।

মজনু বলল, আপনে নাইবেন না গাছিমামা?

না রে বাজান।

ক্যা? ও বুজছি। লুঙ্গি নাই। আমি লুঙ্গি দিমু নে। আহেন আমার লগে, নাইয়া হালাই।

না বাজান, বাইত্তে গিয়া নামু নে।

তয় তো নূরজাহানও নাইবো না। আপনেগ দুইজনের একঐ সমস্যা।

মরনি বলল, আমার কাপড়ও তো নূরজাহান ফিনতে পারে। কী রে নূরজাহান, ফিনবি?

আম্মা, আমিও বাইত্তে গিয়াঐ নামু নে।

বিয়াল অইয়া যাইবা না?

অউক। অসুবিদা নাই।

এই নিয়া আর কোনও কথা হয় নাই। মজনু চলে গিয়েছিল ঘাটপার। বর্ষার পানিতে দুপুরবেলায় রোদ তখন দেশ গ্রামের দুরন্ত কিশোরের মতন ঝাঁপিয়ে পড়েছে বর্ষার পানিতে। সেই পানিতে সাঁতার কেটে, ডুবাডুবি করে গোসল সারল মজনু। নূরজাহান তখন ঘাটপারে গিয়া দাঁড়িয়েছে। মজনু ডুবাডুবি করছে, ঘাটপারে রেখে গেছে প্লাস্টিকের গোলাপি রঙের সাবানের কেসে অর্ধেক ক্ষয় হওয়া লাইফবয় সাবান। ঘাটপারে বসে সেই সাবান দিয়া ভাল করে হাতমুখ ধুয়েছে, শাড়ির আঁচলে হাতমুখ মুছে বড়ঘরটায় এসে ঢুকেছে এমন ভঙ্গিতে, যেন এটা মজনুদের বাড়ি না, যেন এটা তার নিজেদের বাড়ি। দুপুর বয়ে গেলে মা যেমন করে তাড়া দেয় তাকে ঠিক সেই কায়দায় মরনিকে তাড়া দিয়েছে। নাইতে যান না আম্মা? তাড়াতাড়ি যান।

পুরানা শাড়ি গামছা হাতে তৈরিই ছিল মরনি। নূরজাহানের তাড়া খেয়ে বলল, হ রে মা, যাইতাছি।

দবিরকেও একই ভঙ্গিতে বলল নূরজাহান। তুমি বইয়া রইছো ক্যা? মুখহাত ধুইয়াহো।

দবিরও মরনির মতন বলল, যাইতাছি।

ঘাটপারে যেতে যেতে দবিরের মনে হয়েছিল, এই বাড়িতে যেন বিয়া হয়ে গেছে তার মেয়ের। অনেকদিন পর যেন মেয়ে জামাই বাড়িতে আসছে সে। এজন্য পোলাও মোরগ বেঁধেছে মেয়ে। সংসার পুরাটাই এখন মেয়ের হাতে। রান্নাবান্না শেষ করে জামাই শাশুড়িকে গোসলের তাড়া দিয়েছে সে, বাপকে দিয়েছে। যার যা কাজ এখন সেই কাজে তাদেরকে পাঠিয়ে নিজে ঢুকেছে ঘরে। তিনজন মানুষ তাদের কাজ সেরে এসে দেখবে খাবার সাজিয়ে বসে আছে মেয়ে। এখন খেতে বসলেই হয়।

বাস্তবিকই বড়ঘরে ঢুকে সেই দৃশ্য দেখতে পেল দবির।

পাটাতনের উপর পুরানা একটা ছপ (মাদুর) বিছিয়েছে নূরজাহান। ছপের সামনে টিনের দুইখান সুন্দর থাল, অ্যালুমিনিয়ামের দুইখান গ্লাস। সে বসে আছে হাঁড়ি পাতিলের সামনে। সামনে পোলাওয়ের জন্য একটা বড়সাইজের গামলা, মোরগের জন্য মাঝারি সাইজের গামলা। পোলাও বাড়ার বড় চামচ রাখা আছে গামলায়, মোরগের গামলায়ও ওই মাপেরই আরেকটা চামচ। অর্থাৎ সবই রেডি। দবির আর মজনু ছপে এসে বসলেই হাঁড়ি থেকে খাবার বের করে সামনে দিবে। যে যার ইচ্ছা মতন তুলে খাবে। দরকার হলে সেও তুলে দিবে।

এই দৃশ্য দেখে সবচাইতে অবাক হয়েছিল মরনি।

ঘাটপারে গিয়া সেও নেমে গিয়েছিল পানিতে। অন্যান্যদিন একটু সময় নিয়া গোসল সারে। আজ আর সেই সময় হয় নাই। চার-পাঁচ ডুবে গোসল সেরে, চটপটা হাতে শাড়ি বদলেছে। ভিজা শাড়ি গামছা কোনওরকমে ঘাটপারে তক্তার উপর কয়েকটা খচা দিয়াই ধুইয়া ফালাইছে। উঠানের তারে সেই শাড়ি গামছা মেলে ঘরে ঢুকেই দেখে এই দৃশ্য। তার হাতের কাজ প্রায় সবই সেরে রেখেছে নূরজাহান। এখন হাড়ি পাতিলের সামনে বসে আছে। এমন ভঙ্গিতে যেন সেই বাড়ির গিন্নি।

লগে লগে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল মরনির। নূরজাহানের যদি বিয়া হয় তার মজনুর সঙ্গে তা হলে মজনু যখন বাড়ি আসবে তখনকার প্রতিটা দুপুর আর রাতের খাবারের দৃশ্যটা তো এমনই হবে।

মুখে এই অনুভূতির কথা আনা যায় না।

মরনি মুগ্ধগলায় বলল, আরে, আমার মায় দেহি বেবাক কামঐ আউন্নাইয়া রাখছে। তয় দুইহান থাল দিছো ক্যা মা? তুমি খাইবা না?

আমি আপনের লগে খামু আম্মা। তারা দুইজন আগে খাউক।

তয় ঠিক আছে মা। তয় কইড়া হালাও।

দবির আর মজনু আসনসিঁড়ি করে বসেছে ছপে। দুইজনেই অ্যালুমিনিয়ামের জগ থেকে সামান্য পানি নিয়া থাল ধুয়েছে। ধুয়ে থালের পানি দরজা দিয়া ছুঁড়ে ফেলেছে উঠানে। যদিও ধোয়া পরিষ্কার থাল, তবু গিরস্তবাড়ির লোক খেতে বসে এই কায়দায় থাল একবার ধোয়।

নূরজাহান যেন বহুবার করেছে এই কাজ এমন পাকা হাতে পোলাও মোরগ বেড়ে দিয়েছে। তুলে তুলে দিয়েছে দবির আর মজনুর পাতে। দবিরের চেয়ে মজনুর পাতে দিচ্ছিল বেশি। দেখে মরনি বলেছে, খালি মজনুরে দেছ ক্যা মা, তর বাপরেও দে।

বাবায় লইয়া খাইবো নে।

মজনু খুবই বুদ্ধিমান ছেলে। বলল, গাছিমামারে তুমি উঠাইয়া দেও খালা। নূরজাহান মনে অয় শরম পাইতাছে।

কীয়ের শরম।

অন্য বাইত্তে আইয়া হেই বাড়ির খাওনদাওন বাপের পাতে উঠাইয়া দিতে অর শরম করনের কথা।

হ বাজান এইডা ঠিকঐ কইছস।

দবিরের পাতে খাবার তারপর মরনিই তুলে দিয়েছে। একটু যেন বেশি বেশিই দিয়েছে। দবির নানারকম কাকুতি মিনতি করে তাকে থামিয়েছে। এত না বুজি, এত না। এত খাইতে পারুম না।

খান গাছিদাদা, খান।

দবির খাচ্ছিল ঠিকই তবে চোখের ভিতরে তার খেলা করছিল সেই স্বপ্ন। যদি এই বাড়ির বউ হত নূরজাহান! লগে লগে মনে পড়েছে সেই জালেমের কথা। মান্নান মাওলানা। বুকে চেপে থাকা ভারী পাথর নড়েচড়ে উঠেছে। গোপনে নষ্ট হয়েছে খাওয়ার রুচি। তবে রান্নাটা হয়েছিল চমৎকার। এত স্বাদের খাবার বহুকাল মুখে দেয় নাই দবির।

এই রান্না কি নূরজাহানের জন্য হয়েছে? সে হাত লাগিয়েছিল বলে? নাকি মরনি বুজির রান্নার গুণই এমন!

খাওয়াদাওয়া শেষ করে আবার তামাক নিয়া ছনছায় গিয়া বসছে দবির। মরনি আর নূরজাহান সেই ফাঁকে খেয়ে নিয়েছে। খাওয়ার পর গিরস্তবাড়ির বউঝিদের কিছু কাজ থাকে। ধোয়া পাকলার কাজ। মরনির লগে হাত লাগিয়ে সেই কাজ শেষ করেছে নূরজাহান। ঘাটপারে গিয়া সেই কাজ সেরে এই তো এখন ওই যে ওই, বাড়ির পশ্চিম দক্ষিণ দিককার আমগাছের তলায় গিয়া দাঁড়ায়া আছে। লগে আছে মজনু। দুইজনে হাসিমুখে গল্পগুজব করছে।

ঘরের ভিতর পানের ডাবর নিয়া বসেছে মরনি। এখন আর কোনও কাজ নাই। এখন আয়েশ করবার সময়। মরনিকে ওভাবে বসতে দেখে হুঁকা হাতে তার সামনে উঠে আসছে দবির। তারপর ওই কথা। বুজি গো, আপনেরে একহান কথা কইতে চাই।

ডাবরের ভিতর থেকে আধখান পান নিছে মরনি।

তিন-চারদিন আগে মাওয়ার বাজার থেকে দুইগন্ডা পান আনিয়েছিল। সেই পানের শেষ দুইখানা আছে। মজনু কাল বাজারে গেলে আবার দুইগন্ডা আনাবে। তবে ডাবরের ভিতর থাকতে থাকতে শেষদিকে এসে পানপাতা শুকিয়ে যায়। আগের মতন তাজা থাকে না। তবু স্বাদ কমে না পানের। সুপারি খয়ের চুন দিয়া, ভাত পানি খাওয়ার পর আধখান পান পুঁটলি করে মুখে দিলেই দুনিয়ার শান্তি। চাবাতে চাবাতে মনে হয়, আহা জিন্দেগিডা যুদি খালি পান মুখে দিয়া কাড়াইয়া দেওন যাইতো! পান চাবাইতে চাবাইতে মইরা যাইতে পারলে মরণডাও বড় শান্তির অইতো!

মরনি এখন ধীর শান্ত ভঙ্গিতে আধখান পানের উপর রেখেছে ছোরতা (সুপরি কাটার কাঁচির মতো এক ধরনের যন্ত্র) দিয়া কুচি কুচি করে কাটা এক চিমটি সুপারি। খয়েরটা নরমই ছিল। দিনে দিনে মুশুরি দানার মতন শক্ত হয়ে গেছে। ওরকম তিন-চারটা দানা সুপারির পাশে রাখল। একটুখানি চুন আঙুলের আগায় নিয়া মাখায়া দিল পানে। তারপর পুঁটলি করে মুখে দিল। আঙুলের আগায় আবার নিল একটুখানি চুন। এই চুন এখন আঙুলেই থাকবে। পান চাবাতে চাবাতে, থেকে থেকে একটুখানি জিভে ছোঁয়াবে। তাতে পানের স্বাদ আরও বাড়বে।

দবির এসে বসেছে মুখামুখি। হাতে হুঁকা। মরনি মনে করেছে দবিরও বুঝি পানের আশায়ই আসছে। খাওয়াদাওয়ার পর পান তামাক দুইটাই একলগে খায় কোনও কোনও গিরস্তে। মুখে পান দিয়ে খানিক চাবায়া, পানের স্বাদ নিয়া টান দেয় তামাকে। দুইটা নেশা মিলেমিশে বেদম শান্তি তখন।

নিজে যে পানের অর্ধেকটা নিয়েছে সেই পানের বাকি অর্ধেক দবিরের জন্য মনে মনে ঠিক করে রেখেছে মরনি। দবির সামনে এসে বসার পর মাত্র জিজ্ঞাসা করবে, পান দিমুনি গাছিদাদা? তখনই দবিরের ওই কথা।

মরনি চোখ তুলে দবিরের দিকে তাকাল। পান চাবাতে চাবাতে জড়ানো গলায় বলল, কন।

তারপরই খেয়াল করল দবিরের মুখে দুশ্চিন্তা খেলা করছে। চোখ যেন একটু বেশি গর্তে ঢুকে গেছে। মুখটা টাকিমাছের পেটের মতন ফ্যাকাশে। আরে, দোফরের অনেক আগে বাপ মাইয়ায় আইলো এই বাইত্তে। তহন তো খ্যাল করি নাই গাছিদাদার মুখহান এমুন হুগনা হুগনা, চক্ষু দুইহান গদে হাইন্দা গেছে। খাইতে বহনের সময়ও তো দেহি নাই। এতক্ষুন ধইরা সামনে বইয়া পোলাও মোরগ খাইলো, তহন ক্যান গাছিদাদার এই মুখহান আমার চোক্ষে পড়ে নাই! এই মুখচোখ তো আথকা অয় নাই। আথকা এমুন মুখচোখ অয় না মাইনষের। এইরকম মুখচোখ অইতে সময় লাগে। তয় কি দুই একদিন আগে থিকাই কোনও চিন্তার মইধ্যে পড়ছে গাছিদাদায়?

কী চিন্তা?

কী হইছে গাছিদাদার?

দবিরকে পান সাধার কথা ভুলে গেল মরনি। এমনকী নিজের মুখে দেওয়া পান চাবাতে ভুলে গেল। কপালের চামড়ায় দুই-তিনটা ভাজ পড়ল তার। কোনওরকমে বলল, কী কথা গাছিদাদা? কী অইছে?

যে উত্তেজনা নিয়া কথা শুরু করেছিল দবির, নিজের ভিতর থেকেই সেই উত্তেজনা কিছুটা সামাল দিল। হুঁকায় কয়েকটা টান দিয়া নাকমুখ দিয়া ধুমা ছাড়তে ছাড়তে একেবারে অন্যদিক থেকে শুরু করল কথা। নূরজাহানের লেইগা একহান সমন্দ আইছে।

শুনে মরনি থতমত খেয়ে গেল। সমন্দ আইছে?

হ।

আরে এইডা তো ভালকথা। মাইয়া ডাঙ্গর অইছে, তার বিয়ার সমন্দ আইছে এইডা তো বিরাট আনন্দের কথা।

মরনি হাসিহাসি মুখে মুখের পানে কয়েকটা চাবান দিল। পানের রস গিলে অতি শান্তির গলায় বলল, এত আনন্দের কথা, আর আপনে কইলেন এমুন কইরা, য্যান বিরাট চিন্তার কিছু ঘইট্টা গেছে। মুখহান হুগাইয়া গেছে, চক্ষু হাইন্দা গেছে গদে। এমুন অইছে ক্যা গাছিদাদা? হ আমি এইডা বুজি, আপনে মাইয়াডারে জান দিয়া আদর করেন। মাইয়া অহনও তেমুন ডাঙ্গর হয় নাই। চৌদ্দ-পোনরো বছর বস। অহনঐ মাইয়ার সমন্দ আইছে, বিয়া অইয়া গেলে মাইয়া যাইবো গা জামাইবাড়ি, এই হগল ভাইব্বা আপনের চেহারা এমুন হুট্টা (শুকিয়ে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া) অইয়া গেছে।

দবির আবার হুঁকায় কয়েকটা টান দিল। হাতের তালু দিয়া টান দেওয়া জায়গাটা নিজের অজান্তেই মুছল। মরনির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, না গো বইন, এর লেইগা চেহারা এমুন অয় নাই আমার। চিন্তার বিরাট কারণ আছে।

কী কারণ? পোলা পছন্দ অয় নাই? কোন গেরামের পোলা? করে কী? সমন্দ আনলো কে?

একলগে এতগুলি প্রশ্ন, কোনটার জবাব আগে দিবে দবির!

দবির আবার হুঁকায় টান দিল। খাওয়ার পর থেকে তামাক টানছে, কলকিতে তামাক পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। এখন টানে টানে শুধু তামাকের গন্ধ আসে, আর ধুমা। নেশা নাই। এই হুঁকা টানা না-টানা সমান।

হুঁকাটা বেড়ার লগে দাঁড় করিয়ে রাখল দবির। দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

মরনি বুঝল কিছু একটা চিন্তার ঘটনা ঘটেছে।

কী?

ঘটনা কী?

যে আধখান পান দবিরকে দিবে ভেবেছিল সেই পানটুকু সাজিয়ে ফেলল মরনি। সুপারি খয়ের চুন পরিমাণ মতন দিয়া পানটা পুঁটলি করে দবিরের দিকে বাড়িয়ে দিল। নেন গাছিদাদা, পান খান। পান খাইতে খাইতে কন আমারে কী অইছে?

দবির পান নিয়া মুখে দিল। চাবাতে চাবাতে চিন্তিত চোখে উঠান ছাড়িয়ে আর একটু দূরের দিকে তাকাল। এখনও আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে নূরজাহান আর মজনু। আগের মতনই কথাবার্তা বলছে। কী কথায় নূরজাহান খিলখিল করে হাসছে! এই এতটা দূর থেকেও নূরজাহানের হাসির শব্দটা পেল দবির। সেই শব্দে বুকের খুব ভিতরে একটা দুঃখের হাওয়া কাঁপন ধরায়া দিয়া গেল। মান্নান মাওলানার ঘরে গেলে মাইয়াডা কি এই আমোদের হাসিডা জিন্দেগিতে আর কোনওদিন হাসতে পারবো? এই হাসি কি থাকবো মাইয়াডার?

মরনি বলল, কন গাছিদাদা, বেক কথা আমারে কন।

বাইরের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে মরনির দিকে তাকাল দবির। হ আপনেরে কমু দেইক্কাই এই বাইত্তে আইছি। আমার তো আর কওনের মানুষ নাই। তয় বুজি, নূরজাহানের কানে য্যান কথা না যায়।

ক্যা, গেলে অসুবিদা কী? মাইয়া ডাঙ্গর অইছে, তার বিয়ার সমন্দ আইবো, এই কথা মাইয়ায় জানবো না? আইজকাইলকার মাইয়ারা কি আর আমগো মতন। আমগো সমায়ে মা-বাপে যেহেনে বিয়া ঠিক করছে ওহেনেই বিয়া অইছে। আমরা মুখ দিয়া আওজ দেই নাই। আইজকাইল কি আর হেইদিন আছে? মাইয়ারা তো নিজেগো পছন্দ অপছন্দের। কথাও সোজাসুজি মা-বাপরে কইয়া দেয়। জামাই পছন্দ অইলেও কয়, না অইলেও কয়।

এই সমন্দ বুজি ওই পদের না।

তয় কোন পদের?

মুখের পানে চাবান দিল দবির। ওই পদের সমন্দ অইলে তো মাইয়ার মা’রেই আমি কইতাম। মাইয়ার মায় কইতো মাইয়ারে। সমডা ওই পদের না।

তয় কোন পদের? ভাবিছাবরে আপনে সমর কথা কন নাই?

না।

ক্যা?

হেই হগল কথা কইতেঐ আমি আপনের বাইত্তে আইছিলাম বুজি। নূরজাহান আইতে চাইলো, এর লেইগা অরেও লইয়াইছি।

পানের ডাবর কোল থেকে নামিয়ে একপাশে রাখল মরনি। নড়েচড়ে বসল। ঘটনা আমারে কন তো গাছিদাদা। আমি ইকটু হুনি।

কাল দুপুরের পর থেকে ঘটে যাওয়া পুরা ঘটনা মরনিকে খুলে বলল দবির। বসির তার বাড়িতে এল, তাকে নিয়া গেল মাওয়ার বাজারে, সেন্টুর দোকানে বসে রসগোল্লা আর চা সিগ্রেট খাওয়াল তারপর বলল পাত্রের কথা। তারপর কেমন করে, কীভাবে চক সাঁতরে অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছে দবির, কীভাবে মেয়ে আর মেয়ের মায়ের কাছে চেপে রেখেছে। সবকথা, কীভাবে রাত কেটেছে, সবকথা বলে হঠাৎ করেই থেমে গেল।

মরনি তখন উঠানের মাটির মতন অনড় স্তব্ধ হয়ে আছে। মুখের পান কোন ফাঁকে ছোবা হয়ে গেছে, দাঁতের ফাঁকে, জিভের আড়ালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে পান সুপারি খয়ের আর চুনের স্বাদ। সেই স্বাদ মরনি টের পাচ্ছে না।

কী করে পাবে? সে কি আর মানুষের আবেগ অনুভূতির মধ্যে আছে। সে তো গেছে মাটির মতন বোধহীন হয়ে! তার মুখও তো গেছে টাকিমাছের পেটের মতন ফ্যাকাশে হয়ে। তার চোখও তো কয়েক পলকে ঢুকে গেছে অনেকখানি খোড়লে।

এই অবস্থা কাটাতে সময় লাগল মরনির। কোনওরকমে বলল, এইডি আপনে কী কইলেন গাছিদাদা? কী হোনলাম আমি?

গভীর কষ্টের গলায় দবির বলল, হ বইন। এইডাই ঘটনা। হুজুরের লেইগা আমার মাইয়ার সমন্দ আনছে বইচ্ছা।

এইডা বইচ্ছার দোষ না। এইডা ওই বদমাইশটার দোষ। ও ওই বইচ্ছারে পাডাইছে।

হেইডা আমি বুজছি বইন।

মরনি হাহাকারের গলায় বলল, গোলামের পোয় মানুষ না। গোলামের পোয় খবিস। নূরজাহান অর মুখে ছ্যাপ দিছিল, দেশগেরামের মাইনষে কইয়া বইলা অর হাত থিকা নূরজাহানরে বাঁচাইছিল। ও কইছিল নাদান মাইয়া ভুল কইরা হালাইছে, অরে আমি মাপ কইরা দিলাম…

মরনির কথা শেষ হওয়ার আগেই দবির বলল, মাপ তো শালার পো শালায় করে নাই। অর মনের মইদ্যে ওইডা রইয়া গেছে। নূরজাহানের উপরে শোদ লওনের লেইগা বউ মরনের পর এই পথ বাইর করছে শুয়োরের পোয়।

হ এইডাই করছে।

তয় আমি অহন কী করুম বুজি? অর হাত থিকা মাইয়াডারে বাঁচামু কেমতে? মাইয়ার মায় আর মাইয়ায় এই কথা হোনলে কাইন্দা কাইট্টা বিনাস করবো। তাগো আমি মানামু কেমতে?

মরনি বিরাট ভরসার গলায় বলল, খাড়ন দাদা, খাড়ন। এত ভাইঙ্গা পইড়েন না। দেশে মানুষ আছে না? ও যা কইবো হেইডাঐ অইবোনি? আপনের মাইয়া আপনে বিয়া না দিলে ও কি জোর কইরা আপনের মাইয়ারে বিয়া করতে পারবো?

না হেইডা পারবো না। তয় যন্ত্রণা করবো, বিরাট যন্ত্রণা করবো। যত রকম ভাবে পারে আমারে অইত্যাচার করবো। অর লগে কি আমি পারুম? অর টেকার জোর আছে, শইল্লের জোর আছে। আতাহার অইলো মস্তান, অগো লগে আমি পারুম কেমতে, বুজি?

হ এইডাও কথা। তয় পথ বাইর করতে অইবো। পথ একহান বাইর করতে অইবো।

কী পথ বুজি? আমার মাথায় কিছু আহে না। কার কাছে যামু, কারে কমু, হুজুরের হাত থিকা আমার মাইয়াডারে বাঁচান। আগের বার তুমি মাইয়াডারে বাঁচাইছিলা, এইবার অরে কে বাঁচাইবো?

কথা বলতে বলতে গলা ধরে এল দবিরের। বুকের ভিতর চাপা পড়া কান্না ঠেলে উঠতে চাইল। চোখ চাইল ফেটে যেতে। এই চোখ লুকাবার জন্য অন্যদিকে তাকাল দবির। মুখের ভিতর কত স্বাদের পান, সেই পানের কথা মনে নাই দবিরের।

মরনি বলল, আগেরবার কইলাম আমি অরে একলা বাঁচাই নাই। অরে বাঁচাইছিল দেলরা বুজি, এনামুল।

হ বেবাকতে মিল্লাঐ বাঁচাইছে। তয় ওইটাইমে তুমি অরে কেঁতার (কাঁথা) নীচেহামলাইয়ানা রাখলে আতাহাররা অরে ধইরা লইয়া যাইতো। কী দিয়া যে কী করতে আমার মাইয়াডারে…। পরে দেলরা বুজি, এনামুল তাগো কথায় হুজুরে থাইম্মা গেছিলো। আর কোনও ক্ষতি আমগো করে নাই। বুজি, কাইল রাইত থিকা আমি খালি চিন্তা করছি, এই কথা কওনের লেইগা কার কাছে যামু আমি। কার বুদ্ধি লমু? কে আমারে ভাল বুদ্ধি দিবো, কে আমার মাইয়াডারে বাঁচাইতে চাইবো। বুজি গো, পয়লাই আমার মনে হইছে তোমার কথা। এর লেইগাঐ আমি তোমার কাছে আইছি। মাইয়াডারে লগে লইয়াইছি অন্য একহান কারণে…

কী কারণে গাছিদাদা?

বইচ্ছার মুখে হুজুরের কথা হোননের পর থিকা আমার খালি মনে অয় মাইয়াডারে চব্বিশঘণ্টা আমি আমার চোক্কে চোক্কে রাখি। এক পলকের লেইগা চোক্কের আঐল (আড়াল) অইলেই মাইয়াডারে আমার মান্নান মাওলানা চিলের লাহান ছো দিয়া লইয়া যাইবো। বাড়ির উড়ান থিকা চিলে আর নাইলে ধুরকাউয়ায় যেমতে ছোঁ মাইরা লইয়া যায়। মুরগির ছাও অমতে য্যান ছোঁ মাইরা লইয়া যাইবো আমার নূরজাহানরে।

দবিরের কথা শুনে বুকটা হু হু করে উঠল মরনির। আহা রে, মাইয়াডারে লইয়া কোন বিপাকে পড়ছে গাছিদাদায়। সে এমুন নরম নিরীহ মানুষ, আর তার কপালেই ঘটতাছে। কত রকমের বিপদ। না, এই বিপদ ঘটতে দেওন যাইবো না। এই বিপদ থিকা যেতেই অউক বাঁচাইতে অইবো নূরজাহানরে! কিছুতেই মান্নান মাওলানার লগে বিয়া অইতে পারে না নূরজাহানের। দাদার বসি বুইড়ার লগে বিয়া অইলে জিন্দেগিতে সুখশান্তি কিছু পাইবো না মাইয়াডা। আর মুখে ছাপ দেওনের কথা মনে রাখবো শুয়োরের পোয়। ও তো নূরজাহানরে সুখশান্তি দেওনর লেইগা বিয়া করতে চায় না। ও তো বিয়া করতে চায় শোদ লওনের লেইগা। শুয়োরের পোয় তো মানুষ না। অর মুখে এক অন্তরে আরেক। না এইডা কিছুতেই অইতে দেওন যাইবো না।

মরনি স্থির চোখে দবিরের দিকে তাকাল। আপনে ঘাবড়াইয়েন না দাদা। আমার কথা হোনেন।

দবিরও তাকাল মরনির দিকে। কও বুজি, কও।

আপনে দেলরা বুজির কাছে যান। দেলরা বুজির বইনপোয় মজ্জিদ (মসজিদ) বানাইতাছে মিয়াগো ছাড়াবাইত্তে। হেই মজ্জিদের ইমাম অইবো মান্নান মাওলানা।

হ এইডা পুরান কথা। এইডা জানি।

জানবেন না ক্যা? আমি যেইডা কই, হেইডা হোনেন। দেলরা বুজিরে গিয়া বেক কথা কন। তারা মানুষ ভাল। দেলরা বুজিরে বুঝাইয়া কইলে হেয় কইবোনে তার বইনপোরে। বইনপোয় যদি মাওলানা সাবরে কয়, হুজুর, এইসব বাদ দেন। নূরজাহানের মিহি চক্ষু তুইল্লা চাইয়েন না। নাতিনের বসসি মাইয়া আপনের বউ অইতে পারে না। বিয়া করতে অয় অন্য জাগায় করেন। তয় দেখবেন মান্নান মাওলানা থাইম্মা গেছে। আপনেরে আর কোনও বিপাকে হালানের চেষ্টা করবো না।

মরনির কথা শুনে বুকে চাপা পাথর অনেকখানিই নেমে গেল দবিরের। ফ্যাকাশে মুখ উজ্জ্বল হল। গর্তে ঢুকে যাওয়া চোখে খেলে গেল শ্রাবণমাসের দুপুরবেলার রোদ। কাল সন্ধ্যার পর থেকে এই প্রথম আমুদে গলায় কথা বলল দবির। এইত্তো ভাল বুদ্ধি বাইর করছো বুজি। এইডা অইলো আসল বুদ্ধি। দেলরা বুজিরে ধরলেঐ কাম অইয়া যাইবো। আল্লাহ আল্লাহ, রহম করো আল্লাহ। রহম করো।

.

নূরজাহান এমন খিলখিল করে হাসছে, হাসিটা যে কী সুন্দর মেয়েটির, মজনু মুগ্ধ হয়ে গেল। কী বলেছিল সে-কথা ভুলে নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে রইল।

খাওয়াদাওয়া শেষ করে, মরনি আম্মার লগে হাত লাগিয়ে খাওয়াদাওয়ার পরের কাজকর্ম শেষ করে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পশ্চিম-দক্ষিণ দিককার আমগাছটার তলায় এসে দাঁড়িয়েছে নূরজাহান। মজনু আগে থেকেই অলস ভঙ্গিতে ঘুরঘুর করছিল এই দিকটায়। দবির আর মরনি বসেছে পান তামাক নিয়া। আমগাছটার গোড়ার কাছে এসে স্থির হয়ে আছে বর্ষাকালের পানি। দুই-চারটা কুটাকাটা, আমের শুকনা পাতা পড়ে আছে পানিতে। কিছু ঘাস বিচালি আছে, সেচিশাকের ছোট্ট একটা চাক আছে। তারপর থেকে শুরু হয়েছে চক। চক মানে ধইনচাখেত। কোথাও কোথাও ফাঁকা জমি। সেইসব জমিতে মাথা তুলে আছে দল আড়ালি (এক প্রকারের ঘাস। গোরুছাগলের খাদ্য)। কচুরি আছে কোথাও কোথাও, খাইল্লা (কাশের চেয়ে মোটা এক ধরনের জলজ উদ্ভিদ) জন্মেছে নিবিড় হয়ে। শুধু ধানটাই নাই কোথাও।

বর্ষাকালে আগে এই চক ভরা থাকত আমন আউশ ধান। পাটও থাকত। পাট চাষ তো দেশ থেকে উঠেই গেছে। আমন আউশের চাষও আজকাল আর হয় না। এখন হয় ইরি। আমন আউশের চেয়ে ফলন দুই-তিনগুণ বেশি। ইরি চাষে পড়তা ভাল। পড়তা ভাল পড়লে সেই চাষই তো করবে দেশগ্রামের গিরস্তে।

তাই করছে। ফলে বর্ষার আগে আগেই চক খালি। আগাছা কুগাছায় চক ভরে থাকে। গিরস্তরা সেইদিকে তাকিয়েও দেখে না।

আর বিক্রমপুর এলাকার সেই গরিবি দিন কি আর আছে? এখন বিক্রমপুর হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনী এলাকা। টাকার আকাল নাই একেকজন মানুষের। কত গরিব মানুষ কুট্টি কুট্টি (কোটি কোটি) টেকার মালিক অইয়া গেছে। টেকার গরমে মাডিতে পাও পড়ে না। দশ টেকার ইলশামাছ পঞ্চাশ টেকা দিয়া কিনে। মাওয়ার বাজারে গিয়া গরিব মাইনষে আইজকাইল বাজারঐ করতে পারে না। টেকাআলারা বেবাক কিন্না লইয়া যায়। এই অবস্থায় খেতখোলায় ধান অইলো কী অইলো না ওই হগল লইয়া চিন্তা করে কেডা? বাইত্তে থাকে চউড়ারা। অরাঐ চাষবাস করে, ওরাঐ খায়। আর নাইলে দবিরের মতন দুই-চাইরজন গরিব গুরবা যারা আছে তাগো কাছে বর্গা দিয়া দেয়।

তয় হিসাবকিতাবের ব্যাপারে বিক্রমপুইরারা বিরাট ওস্তাদ। একহান পয়সাও এদিক ওদিক অইতে দিবো না।

চকের দিকে তাকিয়ে এসব কথা ভাবছিল মজনু। নূরজাহান এসে তার সামনে দাঁড়াবার পর বলল, নূরজাহান, তুই আমারে আবডাল কইরা খাড়ো।

শুনে কথা নাই বার্তা নাই নূরজাহানের ওই খিলখিল হাসি। নূরজাহানকে হাসতে দেখে প্রথমে অবাক হয়েছে মজনু। কী রে, এমতে হাসতাছস ক্যা?

নূরজাহানের হাসি তবু থামে নাই। আর একটু যেন বেড়েছে। সেই হাসি দেখে কোন ফাঁকে যেন অবাক হওয়ার ভাব চলে গেছে মজনুর, সে গেছে মুগ্ধ হয়ে।

হাসলে এত সুন্দর দেখায় নূরজাহানকে? কই আজকের আগে তো কখনও নূরজাহানের হাসি এত সুন্দর লাগে নাই তার! নূরজাহান হঠাৎ করে বড় হয়ে গেছে। শ্যামলা মুখখানি আগের চেয়ে হয়েছে অনেক মিষ্টি। চিকনচাকন গড়নখানির দিকে তাকালে যে কারও ভাল লাগবে মেয়েটিকে। মাথার চুল ঘনকালো, লম্বা। ডাগর চোখের দিকে তাকালে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করে। মুখের দিকে তাকালে চোখ ফিরাতে ইচ্ছা করে না।

কবে এত সুন্দর হয়ে গেল নূরজাহান!

কোন ফাঁকে!

নূরজাহান হাসতে হাসতেই বলল, এমুন কইরা চাইয়া রইছো ক্যা?

নূরজাহানের হাসিতে যে মায়াজাল তৈরি হয়েছিল, যে ঘোর লেগেছিল মজনুর চোখে, সেই ঘোর একটু যেন কাটল। কোনওরকমে বলল, তরে দেকতাছি। তরে।

মুখের একটা মজাদার ভঙ্গি করল নূরজাহান। ইস আমারে দেখতাছে! আমারে কি আইজ পয়লা দেখলা তুমি?

আইজ মনে অইলো পয়লাই দেকলাম।

নূরজাহানের হাসি থামল। পয়লা না অইলেও বহুত দিন বাদে দেখলা।

হ। তুই তো অহন আর বাইত থিকাঐ বাইর অচ না।

একথায় নূরজাহান একেবারে মুখিয়ে উঠল। এই হগল প্যাচাইল উডাইলে অহন কইলাম কাইজ্জা লাগবে।

কাইজ্জা লাগবো ক্যা?

তুমি জানো না আমি কীর লেইগা বাইত থিকা বাইর অই না?

জানি।

তয়?

তয় কী?

তুমি আমারে দেকতে যাও নাই ক্যা? আমগো বাড়ি তুমি চিনো না?

আরে আমি তো থাকি ঢাকায়।

তুমি যে ঢাকায় থাকো হেইডা আমি জানি না?

জানবি না ক্যা?

এত কিছু জাননের পর তুমি আমারে দেকতে যাও নাই ক্যা, হেইডা কও।

ক্যান যে যাই নাই, কইতে পারি না।

নূরজাহান ঠোঁট উলটে, মুখ ভেংচে বলল, ইস ঢং। ক্যান যাই নাই কইতে পারি না।

মজনু হাসল। তোর মুখ ভেঙ্গানি আমার খুব ভাল্লাগে। খাড়া, আমারে আবডাল কইরা খাড়া।

আমগাছতলায় এসে প্রথমেই এই কথাটা বলেছিল মজনু। শুনেই খিলখিল হাসি শুরু হয়েছিল নূরজাহানের। সেই হাসির অর্থ না বুঝে, কারণ জানতে না চেয়ে মুগ্ধ হয়েছিল মজনু। এখন অনেকক্ষণ পর আবার সেই কথাটা বলল।

এবারও হাসল নূরজাহান, তবে আগের মতন খিলখিল শব্দটা করল না।

মজনু বলল, আমার এই কথাডা হোনলেঐ তুই হাছস ক্যা? বিষয়ডা কী?

নূরজাহান হাসতে হাসতে বলল, তুমি কি মাইয়াছেইলা যে তোমারে আবডাল কইরা খাড়ামু?

আমি তোর কথাডা বোজলামঐ না।

আবডাল করতে কয় তো মাইয়াছেইলারে।

মজনু তবু কথাটা বুঝল না। হাঁ করে নূরজাহানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

মজনুর এই ভঙ্গি দেখে নূরজাহান আবার হাসল। এমুন ভ্যাবলার লাহান চাইয়া রইলা ক্যা? মুখহান হাঁ হইয়া রইছে। ওই যে দেহো ভোমা ভোমা মাছি উড়তাছে। এই হগল মাছি থাকে পায়খানায়। মুখ বন্ধ করো নাইলে মুখে হাইন্দা যাইবো।

বলেই আবার খিলখিল হাসি।

মজনু মুখ বন্ধ করল। তয় তুই যে কী কইতাছস কিছুই আমি বুজতাছি না।

আরে ভোলা (বোকা), তোমারে আবডাল কইরা খাড়াইতে কইছো ওইডা হুইন্না হাসতাছি।

এইডা হুইন্না হাসনের কী অইলো?

কইলাম না আবডাল করতে কয় মাইয়াছেইলারে। তুমি তো আর মাইয়াছেইলা না।

এই কথাড়াই আমি বুজি নাই।

এবার আর হাসল না নূরজাহান। তবে হাসিটা চেপে রাখল। মাইয়াছেইলারা আবডালে বইয়া ওইকাম করে। তুমি কি ওইকাম করবা?

ওইকাম আবার কোন কাম?

তুমি আসলেই একহান ভোলা। আরে পেশাব করে, পেশাব। তুমি কি এহেনে পেশাব করবা? এর লেইগা আমি তোমারে আবডাল কইরা খাড়ামু?

মজনু খুবই লজ্জা পেল। যাহ। তর সামনে আমি পেশাব করুম নি? পেশাব চাপলে আমি অন্য কোনও মিহি গিয়া কইরা আমু। তরে বুজতেও দিমু না।

তয় আমারে আবডাল কইরা খাড়াইতে কইলা ক্যা?

সিকরেট খামু?

কথাটা বুঝতে পারল না নূরজাহান। বলল, কী খাইবা?

সিকরেট, সিকরেট।

নূরজাহান আকাশ থেকে পড়ল। তুমি সিকরেট খাও?

হ খাই তো।

কবে থিকা?

বেশিদিন অয় নাই। দশ-পোনরো দিন অইবো। তয় বেশি খাই না। দিনে তিনডা খাই। বিয়ানে নাস্তা করনের পর একহান, দোফরে ভাত খাওনের পর একহান আর রাইত্রে ভাত খাওনের পর একহান।

হিগলা কই?

খলিফা দোকানে যারা কাম করে তারা বেবাকতেই সিকরেট খায়। তাগো দেহাদেহি হিগছি।

আইজ বিয়ানে খাইছো?

হ খাইছি।

আম্মায় দেহে নাই?

হেয় কেমতে দেকবো? নাস্তা খাইয়া নুরামামাগো ওইমিহি গেছি গা। চুপ্পে চুপ্পে খাইছি। অহন বিরাট নিশা ধরছে। অহন এহেনে খাড়াইয়াঐ খাইতে চাইতাছি। ওই যে দেখ ঘরে খালায় আর গাছিমামায় পান তামুক খাইতাছে। তারা যাতে আতকা দেইখা না হালায় এর লেইগা তরে কইলাম আমারে আবডাল কইরা খাড়াইতে।

আরে আমি তো এইডা বুজি নাই। আমি বুজছি তুমি পেশাব করবা।

ধুরো পাগল।

তয় ধরাও সিকরেট। আমি তোমারে আবডাল কইরা খাড়োই।

মজনুকে আড়াল করে দাঁড়াল নূরজাহান। মজনুর পরনে লুঙ্গি আর ফুলহাতা চেকের শার্ট। শার্টের হাতা কনুয়ের অনেকখানি উপরে, একেবারে বগল তরি গুটানো। বাঁহাতের ওরকম ভাঁজের ভিতর থেকে প্রায় চেপটে যাওয়া একটা সিগ্রেট বের করল সে। ডানহাতের ভাজ থেকে বের করল ম্যাচ।

এরকম জায়গায় সিগ্রেট ম্যাচ রাখা যায় কল্পনাও করে নাই নূরজাহান। সে খুবই অবাক হল। এহেনে ম্যাচ সিকরেট রাখছো ক্যা?

তয় কই রাখুম?

শাডের জেব আছে, জেবে রাখতে দোষ কী?

খালায় দেইক্কা হালাইবো।

বুজছি। তয় আমি তোমারে যত আবডাল কইরাঐ খাড়োই তাও কইলাম আমার বাপে আর তোমার খালায় বুইজ্জা যাইবো তুমি বিড়ি সিকরেট খাইতাছো।

কেমতে বুজবো?

ওই যে আগে একবার কইলাম না তুমি অইলা ভোন্দা। আসলেই তুমি ভোন্দা।

মজনু বোকার মতন হাসল। এইবার বুজছি।

তুমি বুজছো ঘোড়ার আন্ডা।

ঘোড়ার আন্ডা না, আসলডাই বুজছি।

কী বুজছো কও তো?

এহেনে খাড়াইয়া সিকরেট ধরাইলে সিকরেটের ধুমা ওই ঘর থিকাও দেহা যাইবো। খালায় আর দবিরমামায় বুইজ্জা যাইবো আমি বিড়ি সিকরেট খাইতাছি।

এইত্তো বুজছো।

তয় ল, অন্য মিহি যাই।

কোন মিহি যাইবা?

উত্তর মিহি যাই। রহমান মামাগো ওই মিহি অহন কেঐ থাকবো না। মন্নাফ মামারা ঘর দুয়ার ভাইঙ্গা চন্দ্রের বাইত্তে গেছে গা। তাগো সীমানা পুরা খালি। ওই মিহি গিয়া সিকরেট টানি আর তর লগে কথা কই।

কী কথা কইবা আমার লগে?

বহুত কথা আছে।

তয় লও।

ওরা তারপর মন্নাফ হাওলাদারদের সীমানায় এল। এদিকটা একেবারেই ফাঁকা পড়ে আছে। চার শরিকের বাড়ির এই এক শরিক বড় বাড়ি কিনেছে ওই তো বহ্নিছাড়ার পুবপাশে। ঘর দুয়ার ভাইঙ্গা নিয়া তুলছে ওই বাড়িতে। ছেলেরা কেউ থাকে জাপানে কেউ আমেরিকায়। নতুন বাড়িতে বিশাল দোতালা ঘর তুলেছে। তিনখান পাটাতন ঘর, চাপকল, বিরাট উঠান বাড়িতে। সব মিলিয়ে এলাহি কারবার। টাকার শক্তি বেড়ে গেলে যা হয় আর কী। দেশে যে ছেলেরা আছে তারাও কেউ ইসলামপুরে কাপড়ের কারবার করে, কেউ করে রমনা ভবনে। গাউছিয়া মার্কেটে দোকান আছে একজনের। মন্নাফ হাওলাদার মেম্বার ছিলেন। মেম্বার সাবের এখন বিরাট অবস্থা।

মজনুর পিছন পিছন মন্নাফ হাওলাদারের সীমানায় এল নূরজাহান। ঘরগুলি ভেঙে নিয়ে গেছে তবে মাটির উঁচু ভিটি এখনও রয়ে গেছে। খামের গর্তটর্ত রয়ে গেছে। চার-পাঁচখান ঘর ছিল গায়ে গা লাগিয়ে। উঁচু ভিটিগুলির ফাঁকে ফাঁকে সরু রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়া উত্তর দিককার বাড়ির ঘাট বরাবর এসে দাঁড়াল ওরা। বিকাল প্রায় হয়ে গেছে। এদিকটায় দাঁড়ালে মুখ বরাবর ছোট মেন্দাবাড়ি। এই বাড়িটাকে পুরানবাড়িও বলে। পুরানবাড়ি ছাড়িয়ে ছেউলার বাড়ি। সেই বাড়ির গা ঘেঁষে মাওয়ার দিক থেকে হালট এসে মিশেছে। খাইগোবাড়িতে।

হালট এখন ডুবে আছে পানিতে। পুরানবাড়ির তালগাছটায় অজস্র বাবুই পাখির বাসা। পাখিগুলি সারাদিন ওড়াউড়ি করে গাছটার মাথায়। এখনও করছে।

নূরজাহান সেই গাছটার দিকে তাকাল। আর সেই ফাঁকে একেবারেই বড়দের কায়দায় প্রথমে দুই ঠোঁটের মাঝখানে সিগ্রেট গুঁজল মজনু, হাওয়া বাতাস কিছু নাই তাও ম্যাচের কাঠি জ্বেলে দুইহাতে হাওয়া বাঁচিয়ে একেবারে পাকা সিগ্রেটখোরদের ভঙ্গিতে সিগ্রেট ধরাল। বড় করে সিগ্রেটে টান দিল। নাকমুখ দিয়া গলগল করে ধুমা ছাড়ল।

নূরজাহান মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে মজনুর দিকে। জীবনে কাউকে সিগ্রেট ধরাতে দেখে, সিগ্রেট খেতে দেখে এত ভাল লাগে নাই তার।

সিগ্রেটে আরেকটা টান দিয়া মজনু বলল, তর লগে আমার অনেক কথা আছে নূরজাহান।

মুগ্ধচোখে মজনুর দিকে তাকিয়েই আছে নূরজাহান।

চোখ ফিরাতেই পারছে না। মজনুর সিগ্রেট ধরানো, সিগ্রেটে টান দিয়া নাকমুখ দিয়া ধুমা ছাড়া, সবকিছু এত ভাল লাগছে! কথা যেন কানেই গেল না।

মজনুর মুখে একটুখানি রোদ পড়েছে। ফরসা সুন্দর মুখ সেই রোদে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, শার্ট লুঙ্গি পরা হঠাৎ করে বড় হয়ে যাওয়া ছেলেটিকে আজকের আগে এত ভাল কোনওদিনও লাগে নাই। আগে কাছাকাছি এলে গা থেকে আসত বাচ্চাছেলের গন্ধ। আজ আসছে পুরুষ পুরুষ গন্ধ। এই গন্ধে ভিতরে ভিতরে দিশাহারা হচ্ছে নূরজাহান। শরীরের অনেক ভিতরে কোথায় যেন কী একটা ঘটছে।

নূরজাহান আনমনা গলায় বলল, তুমি কী জানি কইলা?

মজনু চকের দিকে তাকিয়ে বলল, কইলাম, তর লগে আমার কথা আছে।

কী কথা?

কইলে তুই আবার চেইত্তা যাবি না তো?

নূরজাহান চোখ পাকাল। অসব্য কথা কইলে চেতুম।

মজনু সিগ্রেটে টান দিল। পুরো ছেমড়ি। আমি তর লগে কোনওদিন অসব্য কথা কইছি?

না।

তয়?

আইজ যুদি কও?

ক্যান তর মনে অইলো আমি অসব্য কথা কমু? আমি কি ওই পদের পোলা?

আগে ওইপদের আছিলা না। অহন টাউনে থাকো, ডাঙ্গর অইছো, অহন কইতে পারো।

মজনু হাসল। না। ডাঙ্গর অইলেও অসব্য অই নাই। তয় খলিফা দোকানে কাম করা ছেমড়ারা ইকটু অসব্য অয়। নানান পদের কথাবার্তা কয়, নানান পদের অসব্য কামকাইজ করে। আমি ওই পদের না।

মুখের মিষ্টি একটা ভঙ্গি করল নূরজাহান। হেইডা আমি জানি।

তয় কইলি ক্যা?

কইয়া দেখলাম তুমি কী কও।

তুই বহুত চালাক।

মজনু আবার সিগ্রেটে টান দিল। চকের দিকে ধুমা ছাড়ল।

আজ আকাশের কোথাও মেঘ নাই। নীল সাদার মিশেল দেওয়া আকাশ রোদে ভেসে যাচ্ছে। বাতাস আসছে এদিক ওদিক থেকে। চকেমাঠে কোথাও কোনও মানুষ নাই। বিলেরবাড়ির ওদিক দিয়া দক্ষিণ থেকে উত্তরে যায় বাদাম দেওয়া একটা নৌকা। চারদিক নিথর, নিস্তব্ধ। এই নিস্তব্ধতার মধ্যে কোথায় যেন একটা কাক ডাকে। পুরানবাড়ির তালগাছে ওড়াউড়ি করছে বাবুইপাখিরা। মৃদু হাওয়ায় দুলছে তাদের বাসা।

মজনুর পেটের কাছটায় মৃদু একটা ধাক্কা দিল নূরজাহান। কী অইলো? কী কইবা কও না ক্যা?

নূরজাহানের দিকে মুখ ফিরালো মজনু। কইতে ডর করে!

ডর করে?

হ।

ক্যা?

কথার মইদ্যে ডর আছে।

আমি তোমার কথা কিছুই বুজতাছি না।

মজনু সিগ্রেটে টান দিয়া বলল, কেমতে যে তরে বুজাই।

তারপর আনমনা হয়ে কী ভাবল। হাতের সিগ্রেট কোন ফাঁকে গোড়ার দিকে চলে আসছে। ফুক ফুক করে শেষ দুটা টান সিগ্রেটে সে দিল। টোকা মেরে বাড়ির নামার দিককার পানিতে সিগ্রেটের গোড়া ফেলে কীরকম চটপটা হয়ে গেল। নূরজাহানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই অনেক বড় অইয়া গেছছ নূরজাহান। অনেক সোন্দর অইয়া গেছছ।

একটু যেন লজ্জা পেল নূরজাহান। মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল, যাহ্।

হ। তরে আইজ খুব ভাল্লাগলো।

এই কথাই কইতে চাইতাছিলা?

না আরও কথা আছে।

কইয়া হালাও।

তরে খুব ভাল্লাগে।

একবার তো কইলা।

হ কইছি। এই এক কথা মনে অইতাছে অনেকবার কই। বারে বারে কই।

মজনুর মুখের দিকে তাকাতে চাইল নূরজাহান, পারল না। আশ্চর্য এক লজ্জা পেয়ে বসেছে তাকে। খানিক আগে শরীরের অনেক ভিতরে নতুন ধরনের অনুভূতি টের পাচ্ছিল, সেই অচেনা অনুভূতি আবার আচ্ছন্ন করল তাকে। পায়ের বুড়া আঙুলে মাটি খুঁটতে লাগল সে।

মজনু বলল, তর মুখোন বহুত সোন্দর। চক্ষু দুইখান সোন্দর। মাথার চুল অনেক ঘন, অনেক লম্বা। তুই যখন হাসতেছিলি, আমার মনে অইলো সেই হাসিতে শাওন মাসের গরম কইম্মা যাইতাছে। আমার মনডা কেমুন জানি কইরা উঠলো তরে হাসতে দেইখা। তখন আমগো বাড়ির উপরে দিয়া মেঘের একখান টুকরা ভাইসা যাইতাছিল, বাড়িডা। আন্ধার অইয়া যাইতাছিল। তর হাসিতে সেই আন্ধার কাইট্টা গেল। চাইরমিহি (চারদিক) ফকফক কইরা উঠলো। তুই আমগো বাইত্তে আহনের পর থিকা আড়চোখে আমি খালি তরে দেখছি। খালার লগে বইয়া তুই মোরগ পোলাও রানলি, বাইড়া বুইড়া খাওয়াইলি। খালায় আর গাছিমামায় যাতে না দেখতে পায় এমুন কইরা আমি খালি তরে দেখছি।

একপলক মজনুর দিকে তাকিয়েই পায়ের দিকে চোখ নামাল নূরজাহান। ক্যা, এমুন কইরা আমারে দেখছো ক্যা?

কইতে পারি না। দেখতে খালি মন চাইছে।

আথকা মন চাইলো ক্যা?

আথকা চায় নাই। মনে অয় আগে থিকাই চাইছে।

এবার রাগী মুখ করে মজনুর দিকে তাকাল নূরজাহান। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, ইস, আগে থিকাই চাইছে। আগে থিকা চাইলে আমার খবর লও নাই ক্যা? আমার যে এতবড় বিপদ গেল, তুমি হেনো নাই? বাইত্তে তো ঠিকঐ আইছো, আমার খবর লইছো?

ওইডা ভুল অইয়া গেছে!

হ অহন ভুল অইয়া গেছে।

হাত বাড়িয়ে নূরজাহানের একটা হাত ধরল মজনু। এমুন ভুল আর কোনওদিন অইবো না।

মজনু হাত ধরার পর শরীরের ভিতরকার সেই অনুভূতি শিরায় শিরায় ছড়িয়ে গেল নূরজাহানের। শরীরের রক্ত যেন জোয়াইরা পানির মতন ছুটতে শুরু করল। চোখ মুখ হয়ে গেল নাড়ার আগুনের মতন উষ্ণ। দম বন্ধ হয়ে এল। ছটফটা ভঙ্গিতে হাতটা ছাড়িয়ে নিল সে।

মজনু একটু লজ্জা পেল।

হাত ছাড়িয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করবার চেষ্টা করল নূরজাহান। মজনুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ওমুন ভুল করনের সুযুগ তুমি আর পাইবা কই মজনুদাদা? ওই বান্দরডার মুখে কি আমি আর কোনওদিন ছ্যাপ ছিড়াইয়া দিমু?

মজনু হাসল। না হেইডা না। আমি কইতে চাইলাম অহন থিকা যহনঐ বাইত্তে আমু, যেদিন আমু হেদিন তর লগে গিয়া দেখা করুম। তর লেইগা সুনু পাউডার কিন্না আনুম, লিবিস্টিক কিন্না আনুম। সদরঘাটে সোন্দর সোন্দর চুড়ি পাওয়া যায়, চুড়ি কিন্না আনুম।

শাড়ি আনবা না?

বলেই সেই খিলখিল হাসি।

নূরজাহানকে হাসতে দেখে মজনুও হাসল। আনুম, শাড়িও একদিন আনুম। খলিফা কামে বেতন অইছে আমার। দিনে দিনে বেতন আরও বাড়বে। তহন শাড়িও তর লেইগা আনুম। তারবাদে বেতনে খলিফা কাম আর করুম না। খালায় কইছে খেতখোলা বেইচ্চা টেকা দিব আমারে। সদরঘাটে আমি খলিফা দোকান দিমু। এক দোকান থিকা তিনদোকান অইবো। দশ-পোনরোজন কর্মচারী অইবো দোকানে। তহন আমি মিশিনে বমু না। আমি হমু টেইলাইর মাস্টার। গলায় ঝুলবো কাঁপোড় মাপনের ফিতা। আমি খালি কাঁপোড় কাইট্টা দিমু। কর্মচারীরা হেই কাঁপোড় সিলাইয়া কাস্টমারের শাট বানাইবো, ফুলপেন বানাইবো। পায়জামা পাঞ্জাবি বানাইবো। মাইয়াগো ছেলোয়ার কামিজ ফরক সব বানাইবো। দিনে। দিনে খলিফা হিসাবে বিরাট নাম অইবো আমার। বিরাট ধনী অইয়া যামু আমি।

কথা বলতে বলতে গলার স্বর বদলে গেছে মজনুর, চোখ গেছে স্বপ্নময় হয়ে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে নূরজাহানও যেন দেখতে পেল মজনুর দেখা স্বপ্ন। আগের লাজলজ্জা উধাও হয়ে গেল। মুগ্ধচোখে মজনুর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল সে।

মজনুও তাকাল নূরজাহানের দিকে। স্নিগ্ধগলায় বলল, তহন তরে মাসে মাসে শাড়ি কিন্না দিমু।

নূরজাহান হাসল। আমারে তুমি পাইবা কই? আমি কি তোমার লেইগা বইয়া থাকুম? আমার বিয়া অইবো না? জামাই বাড়িত যামু না আমি?

না।

কী?

জামাই বাড়ি তুই যাবি না।

আমার বিয়া অইবো না?

অইবো!

তয়?

মজনু কথা বলল না।

মজনুর চোখের দিকে তাকিয়ে নূরজাহান বলল, তয় কি তোমগো বাড়িডাই আমার জামাই বাড়ি অইবো? তুমি আমারে বিয়া করবা? এর লেইগাই শাড়ি কিন্না দেওনের কথা কইতাছো? তয় এত ঘুরাইয়া প্যাঁচাইয়া কথা কও ক্যা? ওই যে হেই রকম,

আসল কথার ধারে নাই
লও পুকুরপারে যাই।

কথাগুলি বলার পর নূরজাহানের মনে হল আগের সেই লাজলজ্জা যেন নাই তার। যেন মজনুর লগে অনেকদিন হল তার বিয়া হয়ে গেছে। সে যেন মজনুর অনেক দিনকার পুরানা বউ। পুরানা বউদের জামাইর কাছে যেমন লজ্জা শরম থাকে না, তারও যেন হয়েছে সেই অবস্থা।

তবে মজনু খুব লজ্জা পাচ্ছে। নূরজাহানের মুখে ওইসব কথা শুনে আড়ষ্ট হয়ে গেছে। কথা তো বলতেই পারছে না, নূরজাহানের দিকে তাকাতেও পারছে না। লাজুক মুখ করে চকের দিকে তাকিয়ে আছে।

এসময় মজনুদের সীমানা থেকে দবিরগাছির গলা ভেসে এল। নূরজাহান, ও নূরজাহান। কই গো মা? বিয়াল হইয়া গেছে, লও বাইত্তে যাই।

বাবার গলা শুনে মজনুকে একটা ধাক্কা দিল নূরজাহান। কী কইতে চাইলা হেই কথা আর কইলা না মজনুদাদা। অহন কইলেও আমার আর হোননের টাইম নাই। বাবায় ডাকতাছে। আমি গেলাম।

মজনু স্নিগ্ধ হাসিমাখা গলায় বলল, যা কওনের আমি কইলাম তরে কইয়া হালাইছি। যা না কইছি হেইডা তুই বুইজ্জা লইছ।

ঘোড়ার আন্ডা বুজুম।

বলেই মজনুদের সীমানার দিকে দৌড় দিল নূরজাহান।

মজনু বলল, একখান কথা হুইন্না যা নূরজাহান। আগে তুই আমারে আপনে কইরা কইতি। আইজ তুমি কইরা কইছস। আমি বহুত খুশি অইছি।

নূরজাহান কথা বলল না। হেসে দৌড় দিল।

বাড়ি ফিরার সময় শরীর আর মনের অনেক ভিতর থেকে গভীর একটা আনন্দ ফেটে বের হতে চাইছিল নূরজাহানের। পাছার চারটে বসে বইঠা বাইছে দবির। বইঠার চাড়ে চাড়ে আগাচ্ছে কোষানাও। পদ্মার দিক থেকে আসছে বিকালবেলার হাওয়া। পানির যেখানে ঘাস আর জলজ আগাছা নাই, স্বচ্ছ পানি যেখানে, সেই পানিতে হাওয়ায় হাওয়ায় উঠছে মৃদু ঢেউ। গৃহস্থ বাড়ির গাছপালা আর বর্ষার পানিতে মাথা উঁচু ঘাস আগাছা, ধইনচাখেত উথাল পাথাল করছে পদ্মানদীর পাগল হাওয়ায়।

নূরজাহানের মন যেমন ফেটে পড়তে চাইছে গভীর আনন্দে, মজনুর মুখখানি যেমন লেগে আছে চোখে আর তার স্বপ্নমাখা কথা যেমন তোলপাড় করছে হৃদয়ে ঠিক এরকম না হলেও অন্যরকম এক আনন্দ খেলা করছে দবির গাছির মনে। মরনিবুজি পথ দেখিয়ে দিয়েছে। মেন্দাবাড়ির দেলরাবুজির কাছে গিয়া সবকথা খুলে বললে দেলরাবুজি বলবেন এনামুলকে। এনামুল বলবে মান্নান মাওলানাকে। তা হলে মিটে গেল সব। বেঁচে গেল নুরজাহান।

একদিকে বাপ আরেকদিকে মেয়ে, এক নৌকায় বসা দুইজন মানুষ দুইরকম আনন্দ নিয়া বাড়ির দিকে ফিরছে। শ্রাবণদিনের সূর্য তখন গুটিয়ে নিচ্ছে তার আলো। দিনভর বিষয়কর্মে ব্যস্ত থাকা পাখিরা দিনশেষের আলো পাখায় ভেঙে ফিরছে যে যার গাছে। দূরের বিলপ্রান্তর থেকে ধীরে ধীরে আগাচ্ছে কুয়াশার মতন অন্ধকার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *