২.৫ কী রে আবদুল

কী রে আবদুল, কী চিন্তা করচ?

দেলোয়ারাদের পালানের এক কোণে বসে পাতলা সাদা একটুকরা কাপড় মোমের আগুনে পুড়ে ছাই করছে আবদুল। তার সামনে জলচৌকি আর পিড়ি। আবদুল বসে আছে পিঁড়িতে। জলচৌকি আর পিঁড়ির মাঝখানে তাজা এক টুকুরা কলাপাতা। একপাশে জ্বলছে। চারভাগের তিনভাগ পুড়ে শেষ হওয়া চিকন একখান মোম। মোমের আগুনে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে পাতলা কাপড়ের টুকরাটা ধরে রেখেছে আবদুল। পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে টুকুরা তবু খেয়াল করছে না। যদিও ছাইটাই সে কলাপাতায় জমিয়ে রাখবে, ছাইটাই তার দরকার। অবশ্য চিকন একটুকুরা পাতলা কাপড়ও দরকার। সেটা সে আগেই যত্ন করে রেখে দিয়েছে।

কিন্তু মুসলমানির কাজে এসে আজ এমন অন্যমনস্ক হয়ে আছে কেন আবদুল?

অদূরে দাঁড়িয়ে আবদুলের কাজ দেখছিল মোতালেব। মোমের আগুনে কাপড়ের টুকরা পোড়ানো দেখতে দেখতে তার অন্যমনস্কতাও দেখে ফেলল। দেখেই প্রশ্নটা করল।

মোতালেবের কথায় আবদুল একটু চমকাল, তারপর ম্লান হাসল। না কী চিন্তা করুম!

হ কী জানি চিন্তা করচ। তোর মোক দেইক্কা বোজতাছি।

কিছু চিন্তা করি না।

করিচ না। এই হগল কামের সমায় অন্যচিন্তা করলে বিপদ ঘইটা যাইবো। বেশি কাইট্টা কুইট্টা হালাইলে পোলাড়া মরবো। তারবাদে যুদি পোলার মা-বাপে থানায় গিয়া কয় তর লেইগা তাগো পোলা মরছে, তর নামে কেস অইয়া যাইবো। থানার দারোগা পুলিশ আইয়া ধইরা লইয়া যাইবো তরে, জেল ফাঁসি অইয়া যাইবো। কারণ এইডাও এক রকমের খুন।

শুনে সেদিন মায়ের মুখে রুস্তম রিকশাআলার খুনের কথা শুনে প্রথমেই যেমন বুক হিম হয়েছিল আবদুলের এখনও তেমন হল। আসলে তছির কথা ভেবেই অন্যমনস্ক হয়েছিল সে। সেদিনের পর থেকে মনটা ভাল নাই। যখন তখন মনে পড়ে তার বোন একজন লোককে খুন করেছে। যখন তখন সেই খুনের জের ধরে পুলিশ আসবে বাড়িতে। কাঁথার আড়ালে লুকিয়ে থাকা পাগল বোনটাকে ধরে নিয়ে যাবে। তারপর জেল, ফাঁসি।

এখন মোতালেবের কথা শুনে মনে হল ঠিক কথাই বলছে মোতালেব। এক খুনের কথা ভেবে অন্যমনস্ক হয়ে থাকা আবদুল যদি মুসলমানি করতে গিয়ে পরিমাণের চেয়ে বেশি কেটে ফেলে বাদলার অঙ্গ তা হলে তো সেও হয়ে গেল বোনের মতো আরেক খুনি। বোনটা না হয় পাগল, পাগলে কী না করে, আবদুল তো পাগল না। আবদুল সুস্থ মাথার ধীর স্থির মানুষ।

আবদুল তারপর গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। না, এরকম অন্যমনস্ক থেকে কাজটা সে করতে পারে না। তা ছাড়া এটা হচ্ছে ধর্মের কাজ। দুনিয়াদারির দারোগা পুলিশের চেয়েও বড় একজন দারোগা পুলিশ বসে আছেন সাত আশমানের উপর। সবদিকে চোখ তাঁর। ধর্মের কাজে কেউ গাফিলতি করছে দেখলে সেই মানুষের উপর গজব নাজেল করবেন। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করবেন সেই মানুষকে।

না না এমুন কাজ আবদুল করতে পারে না। তার মনে যা আছে তা মনেই থাকুক। যে পবিত্র কাজে সে এসেছে সেই কাজ সুন্দরভাবে শেষ হোক।

আবদুল দৃঢ় গলায় বলল, সব ঠিক আছে। কোনও চিন্তা কইরেন না মোতালেবকাকা।

শুনে খুশি হল মোতালেব। তয় আনুম বাদলারে?

হ আনেন।

তুই রেডি?

হ একদোম রেডি।

বাড়ির পোলাপানরা এইদিকে আজ বিকালে কেউ ভিড়তে পারছে না মোতালেবের ভয়ে। বাড়িতে আগেই মোতালেব রাষ্ট্র করে দিয়েছে, এদিকটায় যেন কেউ না আসে। মুসলমানির কাজ পোলাপানদের দেখা উচিত না। কাজটা ভয়ের। যে কেউ ভয় পেতে পারে। সুতরাং যে যার পোলাপান আগলে রাখার চেষ্টা করছে।

তারপরও ঘরদুয়ারের আনাচ কানাচ থেকে উঁকি মারছে কেউ কেউ। বাড়ির বউঝিরাও কেউ কেউ করছে কাজটা। যেই মোতালেব তাদের দিকে তাকাচ্ছে অমনি চট করে মুখ সরিয়ে নিচ্ছে আড়ালে।

রাবি এতক্ষণ ছিল নিমতলার চুলার পারে। খাজুইরা মিঠাই, নারকেল দুধ আর ভেঁকিছাটা চিকন চাউল দিয়ে ক্ষীর বেঁধেছে। দেলোয়ারাও ছিলেন তার সঙ্গে। বাড়িতে মুসলমানি হলে নানান পদের নাড়ু আসে আত্মীয় বাড়ি থেকে। রাবির তো আর তেমন কোনও আত্মীয়স্বজন নাই। নাড়ু নিয়ে আসবে কে! এজন্য দেলোয়ারা নিজেই আজ প্রায় সারাদিন বসে বাদলার জন্য তিল মুড়ি কাউন আর নারকেলের নাড়ু বানিয়েছেন। খানিক আগে হাতের কাজ শেষ করে নাড়ু মোয়া নিয়ে ঢুকেছেন বড়ঘরে। রাবিও তার ক্ষীরের হাঁড়ি নিয়ে গেছে। দুইজনেই তারা এখন বড়ঘরে ওইসব জিনিসের তদারক করছে। বারান্দার চৌকিতে বসে আছে। মতলা। তার সামনে নতুন লুঙ্গি আর নতুন সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পরা বাদলা দাঁড়িয়ে। ডর ভয় কিচ্ছু যেন নাই ছেলেটির। অতি উৎসাহে মুসলমানির জন্য অপেক্ষা করছে।

এসময় মোতালেব এসে ঢুকল ঘরে। ল রে বাদলা।

বাদলা উৎসাহী গলায় বলল, লন।

খাটালে বসা দেলোয়ারা বললেন, ওই রাবি, তুই এইমিহি থাকিচ না। তুই বাইর বাড়ি মিহি যা গা। মোসলমানি হওনের পর আমি তরে ডাক দিমু নে।

কেন দেলোয়ারা তাকে চলে যেতে বলছেন বুঝতে পারল না রাবি। বলল, ক্যা, পোলার মোসলমানির সামনে আমি থাকুম না?

না। মোসলমানির সমায় দুকু পাইয়া পোলায় যহন কানবো হেই কান্দনডা তর অন্তরে গিয়া লাগবো। হেই কান্দনডা মা-বাপের হোনন উচিত না।

কথাটা মোতালেবও বলল, হ। বুজি ঠিকঐ কইছে। তুই আর মতলা বাইর বাড়ি মিহি যা গা।

মতলা বলল, না আমার যাওনের কাম নাই। আমি আপনের লগে থাকুম নে।

ক্যা?

আপনে একলা তো পাও দুইহান ফাঁক কইরা ধরবেন। আমি পিছে থিকা চকু ধইরা রাখুম নে।

ডর করবো না তর?

না, কীয়ের ডর? আর যুদি ডর করে তয় চকু বুইজ্জা থাকুম।

মতলার কাঁধে চাপড় দিল মোতালেব। এমতে ম্যারা অইলে কী অইবো, তর তো বেড়া সাহস আছে। ল।

বাদলাকে নিয়ে তিনজন মানুষ ঘর থেকে বেরুল। বাদলাকে বেরুতে দেখে রাবি দ্রুত পায়ে চলে গেল বারবাড়ির দিকে।

পালানে এসে বাদলাকে কোলে নিয়ে আবদুলের জলচৌকিতে বসল মোতালেব। বাদলার। লুঙ্গি তুলে দুই ঠ্যাঙের ফাঁক দিয়ে দুইহাত ঢুকিয়ে এত শক্ত করে ধরল বাদলাকে, ছেলের নড়াচড়ার শক্তি রইল না।

মতলা দাঁড়িয়ে ছিল পিছনে। আবদুল জেনে গেছে ছেলের চোখ ধরবে বাপ। সে মতলাকে ইশারা করল চোখ ধরতে। মোতালেবের ঘাড়ের দুইপাশ দিয়ে দুইহাত এনে বাদলার চোখ চেপে ধরল সে।

মোতালেব তখন ছেলে ভুলানো কথা বলছে বাদলার সঙ্গে। ওই বাদলা, তর মনে আছে। হেদিন গোরস্থানের পুকঐরে কী মাছ পাইছিলাম আমরা?

বাদলা বলল, হ মনে আছে।

ক তো।

কই পাইছিলাম আষ্টহান, দুইহান গজার টাকি, আর…

কথা শেষ করবার আগে বাদলা টের পেল তার পেচ্ছাবের জায়গার মাথার দিককার চামড়া টেনে ধরেছে আবদুল। কিন্তু সে কোনও ব্যথা পাচ্ছে না। এজন্য ব্যাপারটা সে পাত্তা দিল না। মোতালেবের কথার রেশ ধরে বলল, বিরাট বিরাট রয়না পাইছিলাম ছয়হান….

ঠিক তখনই বাঁশের চেঁাচ দিয়ে ঘঁাচ করে আবদুলের কাজটা আবদুল সেরে ফেলল। বাদলা উঃ করে সামান্য একটু শব্দ করল।

মোতালেব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল ব্যাপারটা। তার পিছনে দাঁড়ানো মতলাও দেখছে।

কাটাকাটির কাজ সেরে কাপড় পোড় ছাই জায়গা মতো লাগাতেই বাদলা মোচড় দিয়ে উঠল। উঁহু রে উঁহু রে। জ্বলতাছে, জ্বলতাছে।

মোতালেব বলল, কাম অইয়া গেছে। অহন ইট্টু জ্বলবোঐ।

ছাইটা জায়গা মতন লাগাবার পর আবদুল তখন যে পাতলা কাপড়ের টুকরা রেখে দিয়েছিল সেটা দিয়ে জায়গাটা বেঁধে দিচ্ছে বাদলার। কয়েক মুহূর্ত মাত্র, কাজ শেষ হয়ে গেল। আবদুল হাসিমুখে বলল, যান, অহন ঘরে লইয়া যান।

ওই অবস্থায়ই বাদলাকে ঘরে নিয়ে এল মোতালেব। এনে বারান্দার চৌকিতে শোয়াইয়া দিল। বাদলার সামনে তখন অনেক লোক। দেলোয়ারা মতলা মোতালেবের বউ। বারবাড়ির দিক থেকে পাগলের মতো ছুটে এল রাবি। এসে ছেলের উপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। দুক্কু পাইছো বাজান? অ্য, দুকু পাইছো?

যেন বিশাল একখান গর্বের কাজ শেষ করেছে বাদলা এমন গলায় হাসিমুখে বলল, আরে না। ইট্টুও দুকু পাই নাই। খালি একহান পিঁপড়ার কামড়ের লাহান। ইট্টুহানি জ্বলছে।

বড় একখান মুড়ির মোয়া বাদলার হাতে ধরিয়ে দিলেন দেলোয়ারা। ভাল অইছে। অহন মোয়া খা।

মোতালেব ততক্ষণে আয়েশ করে বসেছে বাদলার পাশে। মুখে পরিতৃপ্তির ভাব। রাবির দিকে তাকিয়ে খুবই আন্তরিক গলায় বলল, দে রে রাবি, ক্ষীর দে। ইট্টু বেশি কইরা দেইচ। কাম শেষ অইছে, অহন আরাম কইরা ক্ষীরডা খাই।

গাবদা গোবদা একটা রেকাবিতে মোতালেবকে বেশ খানিকটা ক্ষীর এনে দিল রাবি। রেকাবিটা হাতে ধরে খেতে শুরু করল মোতালেব। খেতে খেতে বাদলার দিকে তাকাল। তর মোসলমানি দেইক্কা আইজ অন্য একহান ঘটনার কথা মনে পড়ল।

মুড়ির মোয়ায় কামড় দিয়ে বাদলা বলল, কী?

আমগোবাড়ির একজন মানুষ কইলাম নিজের মোসলমানি নিজেঐ কইরালাইছিল।

শুনে বাদলা তো অবাক হলই, রাবি মতলা আর বাদলাকে দেখতে আসা বাড়ির অন্যান্য পোলাপানও অবাক। কেউ কোনও কথা বলবার আগেই খাটালের পালঙ্কে বসা দেলোয়ারা হাসলেন। হ হাবজা দাদায়।

বারান্দা থেকে মোতালেবও হাসল। আপনের তাইলে মনে আছে বুজি?

দেলোয়ারা বললেন, থাকবো না? এমুন একহান ঘটনা কেঐ ভেলতে পারে?

বাদলা বলল, ক্যা, এমুন কাম হেয় কীর লেইগা করছিল?

বাদলার আচরণে বোঝাই যাচ্ছে না খানিক আগে মুসলমানি হয়েছে তার। মুড়ির মোয়া খেতে খেতে কথা বলছে এমন ভঙ্গিতে যেন কিছুই হয়নি। যেন নিত্যদিনের মতো স্বাভাবিক আছে সে, সেভাবেই কথা বলছে।

এক খাবলা ক্ষীর মুখে দিয়ে মোতালেব বলল, বাপ চাচাগো উপরে রাগ কইরা।

কন কী?

হ। বারো-চৌদ্দ বছর বস্ হইয়া গেছে তার কেঐ মোসলমানি করায় না। ওইদিকে। তার থিকা বসসে ছোড ফুবাতো ভাই মন্নাফদাদা দলিলদাদা তাগো বেবাকতের মোসলমানি অইয়া গেছে, এর লেইগা একদিন রাগ কইরা সন্ধ্যার পর পর তাগো পুবের ঘরের কেফিনে বইয়া বেলেড দিয়া নিজের মোসলমানি নিজে কইরালাইছে। আমার বাপ চাচাগো এক ফুবু থাকতো ওইঘরে, তারে বেবাকতে কইতো হাইজ্যা বুড়ি, হাবজাদাদায় নিজের মোসলমানি নিজে কইরা হাইজ্যাবুড়ির একহান কাপড় দিয়া জাগাড়া চাইপপা ধইরা রাখছিল। রক্তে হেই কাপড় ভিজ্জা গেছিলো।

বাদলা গভীর আগ্রহের গলায় বলল, তারবাদে?

ক্ষীর প্রায় শেষ করে মোতালেব বলল, তারবাদে আর কী? বাইত্তে চিকরাচিকরি পইড়া গেল। দুই-চাইর দিন পর আবার সব ঠিকঠাকও অইয়া গেল।

খাটাল থেকে দেলোয়ারা বললেন, আমগো বাড়ির পোলাপানের মইদ্যে হাবজাদাদায় অইলো সবার বড়। হের যহন যা মন চাইতো করতো। কেঐর কথা হোনতো না। হারাদিন খালি ঘুডুর ঘুডুর করতো। এইডা বানায়, ওইডা বানায়। এই করতে করতে মিস্তিরি অইয়া গেল। এমুন নামকরা বাপের বড়পোলা, অইলো কাঠ মিস্তিরি!

দেলোয়ারার কথা শুনে কেউ আর কোনও কথা বলল না।

ওদিকে কলাপাতায় জড়িয়ে বাদলার শরীরের সেই অংশটুকু পায়খানা ঘরের ওদিককার ঝোঁপ জঙ্গলে তখন ফেলে দিচ্ছিল আবদুল। আর মনে মনে কাজটি ভালভাবে শেষ করবার জন্য আল্লাহপাকের দরবারে শোকরগুজার করছিল।

.

তুমি খাইবা না?

চোখ তুলে আলফুর দিকে একবার তাকাল কুট্টি। তারপর মাথা নিচু করে বলল, পরে খামুনে।

মুখের ভাত গিলে আলফু বলল, পরে কুনসুম?

আপনে খাইয়া গেলে।

ক্যা?

এমতেঐ।

আগে তো আমার লগে বইয়াঐ খাইতা। কয়দিন ধইরা দেকতাছি লগে বইয়া খাও না। আমারে খাওয়াইয়াদাওয়াইয়া তারবাদে খাও।

হ।

কীর লেইগা?

অমতে খাইতে ভাল্লাগে।

আলফু কুট্টির দিকে তাকাল। কুপির আলোয় কুট্টির মুখোন পাকা ডালিমের মতন লজ্জারাঙা দেখাচ্ছে। দেখে ভাল লাগল আলফুর। বলল, আমি বুজছি।

কী বোজছেন কন তো!

স্বামীর খাওনের পর বউরা যেমতে খায় তুমি কয়দিন ধইরা ওমতে খাও।

লগে লগে আলফুকে সাবধান করল কুট্টি। ঠোঁটে আঙুল তুলে ফিসফিস করে বলল, আস্তে কথা কন। বুজানে কইলাম জাগনা।

আমার মনে হয় না জাগনা। জাগনা থাকলে আওজ পাইতাম না?

আওজ নাও করতে পারে। বুড়ি বহুত ট্যাটনা। এই বসেও কানে ভাল হোনে। আপনেরে খাইতে দিয়া কী কথা কই আমি, চুপ কইরা হেই কথা হোনে। মাঝে মাঝে আমারে আবার জিগায় আলফুর লগে কীয়ের এত কথা কচ।

তহন তুমি কী কও?

আমি চেইত্তা যাই। কী কমু? আলফু আমার ভাতার নি যে হের লগে আমি রঙ্গরসের কথা কমু! আমারে চেততে দেকলে ডরায় যায় বড়বুজানে। মনে করে চেইত্তা থাকলে আমি হের কামকাইজ করুম না। হাইগা মুইত্তা বিচনা নাশ করবো, ধুমু পাকলামু না।

থালে ভাত তরকারি মাখতে মাখতে হাসল আলফু। অহন যে তুমি এত জোরে কথা কইতাছো এইডা হোনতাছে না বড়বুজানে?

আলফুকে হাসতে দেখে কুট্টিও হাসল। তারপর গলা নিচু করে বলল, আমারও মনে অয়। জাগনা নাই বুজানে। ঘুমাইয়া পড়ছে। কোনও কোনওদিন খাওনের লগে লগেঐ ঘুমাইয়া যায়।

আইজ ঘুমাইছে নি দেখবা?

ক্যা?

হেয় ঘুমাইয়া পড়লে নিশ্চিন্ত মনে তোমার লগে কথা কইতাম।

কী কথা?

অনেক কথা আছে। হেদিনের পর থিকা কইতে চাই, কওয়াই হয় না।

একথা শুনে কুট্টির মন উত্তেজনায় ভরে গেল। শরীরের পরতে পরতে আচমকাই লাগল আশ্চর্য এক শিহরন। মনে মনে সে বলল, হেদিন না, আমি তো তার অনেকদিন আগে থিকাঐ অনেক কথা আপনেরে কইতে চাই। কইতে পারি না। শরম করে।

মনের শরম এখন কুট্টির চোখেমুখেও ছিল। তবু আলফুর কথা মতো উঠল সে। পাটাতনে যেন শব্দ না হয় এমন পা টিপে টিপে খাটালের পালঙ্কের কাছে গিয়েই ফিরে এল। নিজের পিঁড়িতে বসতে বসতে হাসিমুখে বলল, বুজান ঘুমাইয়া গেছে। ব্যাপোর (বেঘোর) ঘুমে অহন।

আলফু হাঁপ ছাড়ল। তয় নিশ্চিন্ত মনে কই।

কন।

আমি যে দ্যাশে গেলাম না এইডা লইয়া দিহি তুমি আর কোনও কথা কইলা না?

কী কমু?

তুমি ব্যাজার অইছো না খুশি?

আপনের কী মনে অয়?

মনে অয় খুশি অইছো।

হ। বহুত খুশি অইছি।

আলফুর পাতে একটু ভাত তুলে দিল কুট্টি, গজার মাছের সালুন তুলে দিল।

আলফু হাত তুলে বলল, আর দিয়ো না। খাইতে পারুম না।

পারবেন। এতবড় জ্বর থিকা উটছেন, কয়দিন ঠিক লাহান না খাইলে শইল ভাল অইবো না।

শইল ভাল অইয়া গেছে। পুরাপুরি ভাল। তুমি যেমতে আদরযত্ন করছে, অত আদর যত্নের পর শইল ভাল না অইয়া পারে!

তারবাদেও তো দ্যাশে যাইতে চাইলেন। কইলেন মাসেকহানি জিরাইয়া আইবেন।

আলফু আচমকা বলল, কোন জিরান জিরাইতে চাইছিলাম তুমি বোজো নাই?

শুনে লজ্জায় মরে গেল কুট্টি। শরীরের ভিতর কেমন করতে লাগল তার। সে কোনও কথা বলল না।

আলফু বলল, আমি জানি তুমি আমার কথা বোজছে। বোজবা না ক্যা? তুমি তো ডাঙ্গর মাইয়া। বিয়াও অইছিলো। না বোজনের কথা না। তয় বুইজ্জা থাকলেও যে এই হগল কথার জব তুমি দিবা না হেইডা আমি বুজি। বিয়াতো অউক আর আবিয়াতো, মাইয়া মাইনষের বুক ফাডে তো মুখ ফোড়ে না।

কুট্টি মনে মনে বলল, ঠিক কথা, একদম ঠিক কথা।

মুখে কিছু বলল না। মাথা নিচু করে বসে রইল।

আলফু বলল, তুমি আমারে লইয়া মনে মনে যা চিন্তা করছো, আমিও অহন হেইডাঐ চিন্তা করি। আমগো দুইজনের মন কী চায় আমরা দুইজনেঐ হেইডা জানি। তয় কেমতে কী করুম হেইডা বোজতাছি না।

মাথা নিচু করেই কুট্টি বলল, কী করতে চান?

চাই তো সবঐ করতে। তয় তোমার নাইলে সংসার নাই আমার যে আছে।

বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বিড়ালটা ঘুরঘুর করছিল আলফুর পাতের কাছে। খেতে খেতে দুই একটা মাছের কাঁটা, একটুখানি মাখা ভাত বিড়ালটাকে দিচ্ছিল আলফু। মাথা নিচু করেই দৃশ্যটা দেখছিল কুট্টি। কিন্তু আলফুর সংসারের কথা শুনে চোখ তুলে তার দিকে তাকাল তারপর আবার মাথা নিচু করল। আমি তো আপনের সংসার ভাঙতে কই নাই। আমি তো আপনেরে কই নাই আমারে আপনে বিয়া করেন।

আলফু বলল, না তুমি কও নাই কিছু। কইতাছি আমি। আমি তোমার মনডা বুজছি। তুমিও আমার মনডা বুজার চেষ্টা কইরো। যেই চিন্তা কইরা আমার দ্যাশে যাওনের কথা হুইন্না তুমি মন খারাপ করছিলা হেই চিন্তা কইরাঐ দ্যাশে আমি যাই নাই। তয় সাফ কথা তোমারে আমি কই, এমতে থাকতে আমি আর পারছি না। আমার ভাল্লাগে না।

কুট্টি মনে মনে বলল, আমিও থাকতে পারতাছি না। আমারও ভাল্লাগে না।

ভাত খাওয়া শেষ করে থালে হাত ধুতে ধুতে আলফু অস্থির গলায় বলল, রাইত্রে আমার একদোম ঘুম আহে না। খালি ছটফট ছটফট করি। ঘরের ওইমিহি তুমি হুইয়া থাকো, এইমিহি আমি, মদ্যিহানে বন্ধদুয়ার। আমার মনে অয় দুয়ার আমি ভাইঙ্গা হালাই। তোমার কাছে যাইগা, আর নাইলে তোমারে লইয়াহি আমার কাছে।

আলফুর কথা শুনে মনের ভিতরকার লজ্জাশরম কোথায় যে কেমন করে উধাও হয়ে গেল। কুট্টির। চোখ তুলে আলফুর দিকে তাকাল সে। অপলক চোখে তাকিয়ে থেকে ধীর শান্ত গলায় বলল, আমারও এমুন হয়। আমারও রাইত্রে ঘুম আহে না। আমিও ছটফট ছটফট করি। আমার খালি মনে অয় দুয়ার খুইল্লা আমি আপনের কাছে আইয়া পড়ি। আপনের মাথায় বুকে হাত দোয়াইয়া (বুলিয়ে দেয়া অর্থে) দেই। আপনেরে ঘুম পাড়াইয়া, আপনের বুকের সামনে মুখ দিয়া আমিও ঘুমাইয়া পড়ি।

তয় তুমি তা কর নাই ক্যান! ক্যান আহো নাই আমার কাছে! দুয়ারের ওইপাশে হুইয়া রাইত ভইরা মনে মনে আমি যে তোমারে খালি ডাক পাড়ি, তুমি হোনো নাই ক্যান? তোমার অন্তরের ভিতর থিকা আমার ডাক তুমি হোনো নাই ক্যান?

হুনছি। আপনের ডাক আমি হুনছি। আপনের মনের বেবাক কথা আমি হুনছি। আপনে যেমতে হোনছেন আমারডা, যেমতে বোজছেন, ঠিক অমতেঐ আপনেরডাও হুনছি আমি, আপনেরডাও বুজছি।

তয় ক্যান আহো নাই আমার কাছে? ক্যান আমার মাথায় বুকে হাত দোয়াইয়া আমারে ঘুম পাড়াইয়া দেও নাই! ক্যান নিজে হুইয়া থাকো নাই আমার বুকের কাছে?

গভীর মায়াবী গলায় কুট্টি বলল, আইজ থিকা থাকুম। আইজ থিকা আমার নিজের বইলা আর কিছু রইলো না। আইজ থিকা আমার নিজের বেবাক কিছু আমি আপনেরে দিয়া দিলাম। এই ধরেন আমার হাত।

কুট্টি তার ডানহাতটা আলফুর দিকে বাড়িয়ে দিল।

কুট্টির চোখের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতন তার হাতটা দুইহাতে ধরল আলফু।

কুপির আলোয় মানুষ দুইটিকে তখন দেবদেবীর মতন লাগছিল।

.

আপনি যেন কে?

কাঁধের ভার মসজিদের বারান্দার কোণে নামিয়ে আজিজ গাওয়াল হাসিমুখে বলল, আপনে আমারে চিনেন নাই হুজুর?

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব তখনও তাকিয়ে আছেন আজিজের দিকে। বয়সি চোখে মানুষকে চিনতে না পারার দৃষ্টি। আমতা গলায় বললেন, চেনা চেনা লাগছে, ঠিক মনে করতে পারছি না। বয়স হয়ে গেলে মানুষের দৃষ্টি এবং স্মৃতি দুটোই দুর্বল হয়ে যায়। আজ তো দেখছি কথাও একটু এলোমেলো হচ্ছে। বলা উচিত ছিল চেনা চেনা লাগছে ঠিক চিনে উঠতে পারছি না, বললাম ঠিক মনে করতে পারছি না।

আজিজ বিগলিত গলায় বলল, তাতে কোনও অসুবিদা নাই হুজুর। আমার লাহান। মানুষরে চিননের লেইগা চিন্তাভাবনা কইরা সময় নষ্ট করনের কাম নাই আপনের। আমি নিজেই নিজের পরিচয় দিতাছি। আমি আজিজ, আজিজ গাওয়াল।

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব স্নিগ্ধ মুখে হাসলেন। এবার চিনেছি বাবা। মান্নান মাওলানা সাহেব আপনার মায়ের জানাজা পড়াতে চাননি, আমি গিয়ে পড়িয়েছিলাম। সেই আজিজ না আপনি?

জে হুজুর, জে। এইত্তো চিনছেন।

আসলে আমার শরীরটা বোধহয় আজ খারাপ বাবা। অথবা বেশি ক্লান্ত হয়েছি। দুপুরবেলা একটু পড়াশুনা করেছিলাম। এই ধরুন ঘণ্টাখানেক। তাতেই ক্লান্ত হয়ে গেলাম। বয়স হয়ে গেলে অল্পতেই মানুষ বড় ক্লান্ত হয়।

আপনের বয়েস কত অইলো হুজুর?

ষাট-বাষট্টি তো হবেই।

এইডা আর কী এমুন বয়েস।

মসজিদের বারান্দা ছাড়িয়ে পুবদিকে কয়েক কদম খোলা জায়গা। তারপর বাঁধানো ঘাটলার পুকুর। নামাজি মানুষদের জন্য ঘাটলা তৈরি করা হয়েছে মসজিদের বারান্দা বরাবর। পানির দিকে নেমে যাওয়া সিঁড়িগুলি বেশ পরিষ্কার। পুকুরের পানিটাও খুবই স্বচ্ছ, টলটলা। বিকালবেলার রোদ পুকুরের অর্ধেক পানিতে পড়েছে, বাকি অর্ধেক ছায়াময়। ফলে একই পুকুরের পানি রোদ ছায়ায় দুইরকম দেখাচ্ছে। পদ্মা মেঘনার মতো। যেখানে এসে মিলিত হয়েছে এই দুই নদী সেখানটায় গেলে দেখা যায় পদ্মার পানি ঘোলা, রাগী ধরনের। মেঘনারটা কালচে, স্নিগ্ধ।

খানিক আগে আছরের নামাজ শেষ করেছেন মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব। নামাজিরা চলে যাওয়ার পরও নিত্যদিনের মতো কিছুক্ষণ ছিল সোনামিয়া। সে চলে যাওয়ার পর পরই তিনি ভেবেছিলেন ঘাটলায় গিয়ে থাকবেন। তখনই ভার কাঁধে এল আজিজ গাওয়াল। আজিজকে নিয়ে ঘাটলায় গিয়ে বসতে পারেন তিনি। আজিজের যদি কোনও কথা থাকে বসে বসে শোনবেন।

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব আজিজের মুখের দিকে তাকালেন। কী মনে করে এলেন বাবা?

আগের মতনই বিগলিত গলায় আজিজ বলল, আপনেরে কিছু কথা কইতে চাই হুজুর। কিছু অন্যাই স্বীকার করতে চাই আপনের কাছে।

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব চমকালেন। কী করেছেন আপনি?

অনেক কিছু করছি হুজুর। অনেক অন্যাই, অনেক গুণা করছি। হেই হগল কথা আপনের কাছে কইতে চাই। গাওয়াল করতে গেছিলাম কোলাপাড়া মিহি। বড় সড়ক ধইরা গেলে এতক্ষুনে বাইত্তে যাইতাম গা। ওই মিহি না গিয়া আইছি আপনের কাছে। আপনের হুজুর ইট্ট সমায় অইবো আমার কথা হোননের?

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব অমায়িক গলায় বললেন, নিশ্চয় হবে, নিশ্চয়। আসুন ঘাটলায় গিয়ে বসি। বসে বসে শুনি আপনার কথা।

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেবের পিছন পিছন ঘাটলায় এল আজিজ। বেঞ্চে পিঠ ঠেকিয়ে বসলেন মহিউদ্দিন সাহেব। আজিজকে বললেন, বসুন বাবা, বসুন।

মুখামুখি বেঞ্চটায় বসল না আজিজ, বসল হুজুরের পায়ের কাছে।

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব বিব্রত হলেন। ওকী, ওখানে বসলেন কেন? উঠুন, ওই বেঞ্চটায় বসুন।

না হুজুর, আপনের সমান জাগায় বহুম না।

কেন, কী অসুবিধা?

আমার ভাল্লাগবো না হুজুর। আপনের পায়ের সামনেঐ ভাল্লাগতাছে।

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব আবার স্নিগ্ধমুখে হাসলেন। মায়ের মৃত্যুর দিন আপনাকে যেমন দেখেছি, সেই আপনি আর আজকের আপনি যেন এক নন বাবা। আপনি মনে হয় অনেক বদলেছেন।

কেমুন বদলাইছি কইতে পারবেন হুজুর?

কিছুটা বোধহয় পারবো।

কন তো।

আগে আপনি কথা খুব কম বলতেন, চুপচাপ ধরনের ছিলেন। আজ একেবারেই অন্যরকম। বেশ কথা বলছেন, বেশ চটপটে হয়েছেন।

ঠিকই ধরছেন হুজুর। আসলেই আমি অনেক বদলাইছি। তয় আরও বদলাইতে চাই, একদোম বদলাইতে চাই। ছুলুম (খোলস) বদলাইয়া সাপে যেমুন নতুন সাপ অইয়া যায়, হেমুন নিজের সবাব চালচলন কথাবার্তা বদলাইয়া আমি একজন নতুন মানুষ অইয়া যাইতে চাই হুজুর। একদোম নতুন মানুষ।

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব তীক্ষ্ণচোখে আজিজের মুখের দিকে তাকালেন। আপনি কি খুব বড় কোনও গুণাহ করেছেন?

আজিজ অকপটে বলল, হ হুজুর করছি। একটা তো বহুত বড় গুণা করছি। হেইডা মাইনষেরে দেহাইয়াঐ করছি। আর মনে মনে করছি অনেক গুণা, হেইডি খালি আমিঐ জানি, কেঐরে কই নাই, কে জানে না।

একটু থেমে চিন্তিত গলায় বলল, তয় আপনে বোজলেন কেমতে? কেমতে আমারে। জিগাইলেন আমি কোনও বড় গুণা করছি নি?

ওই যে আপনি বদলে যাওয়ার কথা বললেন, ওকথা শুনে। বড় ধরনের গুণাহ করা কোনও কোনও মানুষ এইভাবে বদলায় কিংবা বদলে যাওয়ার কথা ভাবে। এই ধরনের চিন্তা থেকেই একশো একটা খুন করার পরও পির আউলিয়া হয়ে যায় কোনও কোনও মানুষ। তবে এই সবই হয় আল্লাহপাকের ইশারায়।

হ আল্লার ইশারা ছাড়া গাছের পাতাও লড়ে না।

একটু চুপ করে থেকে মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব বললেন, এবার বলুন বাবা, কী বলতে চান।

কোনডা আগে কমু? মা’র কথা না মাইয়ার কথা?

আপনার মন কোনটা আগে বলতে চায়?

মা’র কথা কইতে চাই আগে।

আপনার মা সম্পর্কে কিছু কিছু কথা আমি জানি। ওসব বলবেন না। মৃত মানুষ সম্পর্কে খারাপ কথা বলতে হয় না। অন্যকিছু বলতে চাইলে বলুন।

আপনে যা জানেন, আমার মা ছনুবুড়ির ওই হগল কথা গেরামের বেবাকতেঐ জানে। আমার মায় কূটনি আছিলো, চুন্নি আছিলো। পেডের ভাত জোগানের লেইগা ঠাইট না ঠাইট মিছাকথা কইতো, এইত্তো আছিলো আমার মা’র দোষ। তয় মা’র এই হগল দোষের লেইগা মা’য় দায়ী আছিলো না। দায়ী আমি। উপযুক্ত পোলা অইয়া বউর ডরে মা’রে আমি। তিনওক্ত খাওন দেই নাই। নিজের বউ পোলাপানরে লইয়া পেড ভইরা ভাত খাইছি, মা’র কথা চিন্তাও করি নাই। মা’র মিহি ফিরাও চাই নাই। মা’য় খাইলো কি খাইলো না, বাইত্তে আছে না কোনওহানে গেছে, মা’র শইলডা ভাল না মন্দ, মা’র ফিন্দনের কাপড় আছে না নাই, বাপ না থাকলে উপযুক্ত পোলার কাম অইলো এই হগল দেহন, আমি হুজুর কোনও দেহি নাই।

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, এটা আপনি সত্যি বড় অন্যায় করেছেন। গহিত অন্যায় করেছেন। এটা ঠিক শেষ জীবনে আপনার মায়ের যে পরিণতি সেজন্য আপনি দায়ী। পবিত্র কোরান মজিদে বলা হয়েছে তাহাকে ছাড়া অন্য কাহারও উপাসনা করিতে ও মাতাপিতার সহিত সদ্ব্যবহার করিতে তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়াছেন। তোমার জীবদ্দশায় উহাদের একজন বা দুইজনই বার্ধক্যে পৌঁছাইলেও তাহাদেরকে ‘উহ্ আহ্’ বলিয়ো না, আর উহাদের অবজ্ঞা করিয়ো না, উহাদের সহিত সম্মান করিয়া নরমভাবে কথা বলিবে। দরদের সহিত বিনয়ের ডানা নামাইবে, আর বলিবে, হে আমার প্রতিপালক! উহাদের ওপর দয়া করো যেইভাবে ছেলেবেলায় উহারা আমাকে লালন পালন করিয়াছিলেন।

আমি তো মানুষকে তাহার পিতামাতার সহিত ভাল ব্যবহারের নির্দেশ দিয়াছি। কষ্টের পর কষ্ট করিয়া জননী সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে, আর তাহার দুধ ছাড়াতে ছাড়াতে দুই বৎসর কাটে। তাই আমার ওপর ও তোমার পিতামাতার ওপর কৃতজ্ঞ হও। আমার কাছেই। তো প্রত্যাবর্তন।

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেবের কথা শুনে বুকের ভিতর উথালপাথাল করে উঠল আজিজের। সেদিন দুপুরে মাঠপারের হিজলতলায় বসে তোতার সঙ্গে কথা বলতে বলতে একসময় যেমন বুক ঠেলে উঠেছিল গভীর কষ্টের কান্না তেমন কান্না এখনও চোখের দিকে ঠেলে উঠল। জোর করে কান্নাটা আজিজ আটকে রাখল। কয়েক মুহূর্ত মাথা নিচু করে বসে রইল, নিজেকে সামলাল। তারপর মুখ তুলে হুজুরের দিকে তাকাল। আমার মনডা পাপে ভরা হুজুর, লোভে ভরা। মা’র মিহি ফিরা না চাওনের কারণও লোভ। সংসারে এতডি পোলাপান, বউ। অবস্থা যে আমার বহুত খারাপ তা না, জাগা সম্পত্তি ধানপান গিরস্তালি আর গাওয়াল কইরা আল্লায় আমারে মন্দ রাখে নাই। তিনওক্ত খাওনডা ভালঐ জোড়ে। তারবাদেও মনের লোভে আমার মনে অইছে, মা’য় একজন বাড়তি মানুষ, হের মিহি চাইয়া আমার লাভ কী! হেয় খাইলো না, না খাইলো, ফিনলো না, না ফিনলো, মরলো না বাঁচলো, আমার কী!

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অন্যায়, বড় অন্যায়।

এইসবের থিকাও বড় অন্যাই মা’রে লইয়া আমি করছি হুজুর। মরণের সময় পানির তিয়াস লাগছিল মা’র। হাতের সামনে পানি না পাইয়া পাইছিলো মাইট্টা তেল। তেলডা আমি কিন্না আনছিলাম বড়ঘরের খামে দেওনের লেইগা। হেই তেল খাইয়া, মাইত্তে হালাইয়া বিনাশ করলো মায়, এইডা দেইক্কা আমার কী মনে অইলো জানেন হুজুর?

জানি।

আজিজ চমকাল। আপনে জানেন হুজুর? কেমতে জানলেন? আমি তো কেঐরে কই নাই। আমার মনের কথা আপনে কেমতে জানলেন?

অনুমানে! আপনার কথা শুনে এতক্ষণ ধরে আপনাকে যতটা বুঝেছি তাতে অনুমান করা যায় এই ধরনের ক্ষেত্রে কী মনে হতে পারে আপনার।

ইট্টু কন তো হুজুর, ইট্টু মিলাইয়া দেহি আমার মনে যা আছিলো হেইডা আপনে কইতে পারেননি!

আজিজের চোখের দিকে তাকিয়ে মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব বললেন, আপনার মনে হয়েছিল, মা মরেছে ভাল হয়েছে। একটা যন্ত্রণা শেষ হল কিন্তু আমার মেটে তেলটা কেন নষ্ট করে মরল!

হুজুরের কথা শুনে কেঁপে উঠল আজিজের। হতভম্বের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে।

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব বললেন, কী, আমার অনুমান কিছুটা কি ঠিক? কিছুটা কি মিলেছে আপনার চিন্তাভাবনার সঙ্গে?

আজিজ কোনওরকমে বলল, কিছু না হুজুর, পুরাডাঐ মিলছে। একদোম মিলা গেছে। আপনে যে হুজুর বহুত কামেলদার মানুষ এইডা আমি আইজকা পুরাপুরি বোজলাম।

না না এভাবে বলবেন না। আমি খুবই সামান্য একজন মানুষ। অতি নগণ্য একজন। মানুষ।

নিজেরে আপনে যা মনে হয় কন হুজুর, আপনে কী মানুষ হেইডা আমি বুজছি। তয় মাইট্টাতেল ছাড়া মা’রে লইয়া আরেকহান কথাও আমার মনে অইছিল হুজুর। হেইডা আরও বড় অন্যাই। হেইডা কমু হুজুর?

না বলতে হবে না। সেটাও আমি অনুমান করতে পারি।

আমি বুজছি, আপনে সত্যঐ পারেন। কন হুজুর, কন। আমার মনের ভিতরে বইসা থাকা পাপের কথাডা কন।

আপনি নিশ্চয় আপনার মায়ের দাফন কাফনের খরচা ইত্যাদি নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছিলেন।

এবারও আগের মতোই হতভম্ব হল আজিজ। ঠিক হুজুর, একদোম ঠিক। ওইডা আমি চিন্তা করছিলাম।

তারপর হুজুরের পায়ের দিকে এগিয়ে এসে বলল, আমি আপনের পাও দুইহান ইট্টু ধরি হুজুর? ইট্টু ছেলাম করি আপনেরে?

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব তটস্থ হলেন। পা টেনে নিয়ে বললেন, আরে না না, কেন? ওসব করবেন না। একদম না।

আজিজ আবার সরে গেল। তয় ঠিক আছে।

একটু থেমে বলল, এইবার আপনে বোজেন হুজুর, কেমুন বেইমান পোলা আমি। যেই মায় দশমাস দশদিন গরভে রাইক্কা জন্ম দিল, বুকের দুদ খাওয়াইয়া ডাঙ্গর করলো, সামর্থ্য থাকনের পরও হেই মায়ের পোলায় মা’র কাফোনের কাঁপোড় কিনতে চায় না। মনে মনে চায় মান্নান মাওলানায় যেই ফতোয়া দিছিলো হেই ফতোয়া হোননঐ ভাল আছিলো। মা’র লাচ সড়কখোলায় হালাইয়া দেওনঐ ভাল আছিলো।

অথচ আল্লাহপাক পবিত্র কোরান মজিদে বলেছেন আমি মানুষকে তাহার মাতাপিতার। সহিত ভাল ব্যবহারের নির্দেশ দিয়াছি। কষ্ট করিয়া তাহার জননী তাহাকে গর্ভে ধারণ। করিয়াছে, কষ্ট করিয়া তাহাকে প্রসব করিয়াছে আর ত্রিশ মাস কষ্ট করিয়া তাহাকে বহিয়াছে তাহার দুধ ছাড়ানো পর্যন্ত, ক্রমে সে সমর্থ হয় আর চল্লিশ বৎসরে পৌঁছাইবার পর বলে, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে শক্তি দাও যাহাতে আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতে পারি, আমাকে ও আমার পিতামাতাকে তুমি যে অনুগ্রহ করিয়াছ তাহার জন্য, আর যাহাতে আমি সকাজ করিতে পারি যাহা তুমি পছন্দ করো, আমার সন্তান সন্ততিদের সৎকর্ম পরায়ণ করো, আমি তোমারই দিকে মুখ ফিরাইলাম ও আত্মসমর্পণ করিলাম।’

আজিজ চুপ করে বসে রইল। কথা বলল না।

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব বললেন, আজ আপনি যেভাবে মায়ের কথা অনুভব করছেন, তিনি বেঁচে থাকতে যদি এই অনুভবটা আপনার হত তা হলে তিনি কিছুটা হলেও মনে শান্তি নিয়ে যেতে পারতেন।

আজিজ হতাশ গলায় বলল, কী জানি! মায় বাঁইচ্চা থাকলে মা’রে লইয়া এইরকম চিন্তা আমার মনে আইতো কি না কে কইবো। তয় মা’র দাফোন কাফোনের খরচাড়া আমি কইলাম অন্য আরেক মিহি দিয়া পোষাইয়া হালাইছি হুজুর।

সেই ঘটনাও আমি জানি। শুনেছি।

কে কইছে আপনেরে?

অনেকেই বলেছে যে আপনি আপনার সাতদিন বয়সি মেয়ের দাফন করেননি। কথা কাপড়ে প্যাচিয়ে জঙ্গলে ফেলে দিয়েছেন।

হ হুজুর, এইডাও আমার একহান বড় গুণা। এই হগল কইতেঐ আইজ আমি আপনের কাছে আইছি।

অথচ নিয়ম হচ্ছে মাতৃগর্ভ হতে ভূমিষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অথবা কিছুক্ষণ পর নবজাতকের মৃত্যু হলে তাকেও যথারীতি গোসল, কাফন, নামাজে জানাজা ও দাফন করতে হবে। তার নামও রাখতে হবে। আপনার মেয়েটি তো সাতদিন জীবিত ছিল। তার নিশ্চয় নামও রাখেননি?

না, তয় খুকি বইলা ডাকতো অর মায়।

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব একটু চুপ করে রইলেন তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বাবা, কাজগুলো খুবই খারাপ করেছেন আপনি। এখন শুধু একটাই কাজ করতে হবে আপনাকে। তওবা করে মন সাফ করতে হবে আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে মাপ চাইতে হবে। পবিত্র কোরান মজিদে পাকপরোয়ারদিগার বলেছেন ‘আর যাহারা অসৎকাজ। করে তাহারা পরে তওবা করিলে ও বিশ্বাস করিলে তোমার প্রতিপালক তো ক্ষমা করেন, দয়া করেন। তিনি তাঁহার দাসদের অনুশোচনা গ্রহণ করেন ও পাপ মোচন করেন; আর তোমরা যা করো তিনি তা জানেন। যাহারা অজ্ঞতাবশত খারাপ কাজ করে তাহারা পরে তওবা করিলে ও নিজেদের সংশোধন করিলে তাহাদের জন্য তোমার প্রতিপালক অবশ্যই। ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’

আজিজ দূরাগত উদাস গলায় বলল, মা কী জিনিস এইডার একহান প্রমাণ আছে দামলার ঐদিককার মাইজপাড়া গেরামে। বাপ-মা মইরা যাওনের পর এক হিন্দুবাবু বাপ-মা’র নামে একহান মন্দির বানাইলো। বানানের সময় মিস্তিরিগো উঁচার দিকে একহান মাপ দেহাইয়া কইলো ওইতরি অইলো আমার বাপের নামে, বাপের ঋণ শোধ করনের লেইগা, তারপর থিকা যত উঁচা সম্ভব করবা মন্দির, শেষতরি যত উঁচা অইবো মন্দির ওইডা অইলো আমার মা’র নামে, মা’র ঋণ শোধ করনের লেইগা। কিন্তু বাপের সীমানা পইর্যন্ত উঁচা হওনের পর যেই মা’র নামে আরেকটু উঁচা অইলো মন্দির অমতেঐ ভাইঙ্গা পড়লো। যতবার উডায় মিস্তিরিরা ততবারই ভাইঙ্গা পড়ে। পরে বাবু বুঝলো ভগবানের ইশারায় এইটা হইতাছে। সে বোকা। সে জানে না যে মায়ের ঋণ কোনওদিন শোধ অয় না। সে আর ওই মন্দির ধরলো না। বাপের নামে যতনি উঁচা অইছিলো মন্দির ওহেনেঐ থাইম্মা থাকলো। বহুত বছর আগের ঘটনা। মন্দিরহান অহনও আছে। উপরের দিকটা ভাঙ্গা।

শেষদিকে গলা ধরে এল আজিজের।

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। বুঝেছি বাবা, আমি সব বুঝেছি। মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে এল। যান বাড়ি যান। আপনার মনে যে অনুশোচনা হয়েছে এই অনুশোচনাই আপনাকে পথ দেখাবে। তওবা করুন, পবিত্র মনে নামাজ পড়তে শুরু করুন, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান, তিনি নিশ্চয় ক্ষমা করবেন।

তখন নিঃশব্দে আজিজ গাওয়ালের চোখ বেয়ে নেমেছে কান্নাধারা। চারদিকের চকমাঠ থেকে উধাও হতে থাকা দিনের শেষ আলোয় মানুষটিকে পৃথিবীর সবচাইতে অসহায় মানুষ মনে হচ্ছিল।

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব এগিয়ে এসে তার মাথায় মায়াবী একখানা হাত রাখলেন। গভীর মমত্বের গলায় বললেন, এই কান্নাটা আল্লাহর কাছে কাঁদবেন। আপনার মনের সব কালিমা মুছে দিতে পারেন একমাত্র আল্লাহপাক। তিনিই রহমানুর রাহিম। তিনিই পথ দেখাবেন।

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেবের হাতখান ধরে হু হু করে কাঁদতে লাগল আজিজ।

.

হামেদ বলল, ওমা, রাইত অইয়া গেল, বাবায় দেহি অহনতরি আহে না।

সাতদিনের মেয়েটা মারা যাওয়ার পর বছরখানেক বয়সের ছেলেটাকে আবার কোলে ফিরিয়ে এনেছে বানেছা। সন্ধ্যা বসে যাওয়ার পর সেই ছেলেটাকে আজ বুকের দুধ দিচ্ছিল। গলায় বুকে পিঠে পেটে বেশ ঘামাচি হয়েছে ছেলের। কুপির আলোয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘামাচি মারছিল। পিঠের দিককার ঘামাচি মারতে পারছিল না, গলা বুক আর পেটের দিককারগুলি মারছিল।

সন্ধ্যার পর পোলাপানরা সব ঘরে ঢুকে গেছে। মায়ের চারপাশ ঘিরে বসে আছে সবাই। আজিজ এখনও গাওয়াল সেরে ফিরেনি বলে দরজাটা খোলা। বাইরের উঠান অন্ধকারে থইথই করছে।

ছেলের কথা শুনে চোখ তুলে বানেছা একবার উঠানের দিকে তাকাল। হ বুজতাছি না ক্যান আহে না অহনতরি।

নাদের বলল, গেছে কই?

বানেছা কথা বলবার আগেই পরি বলল, তুই জান না গাওয়ালে গেছে?

জানুম না ক্যা?

তয়?

তয় কোনমিহি গেছে হেইডা জিগাইছি।

হামেদ বলল, বাবায় কি মারে কইয়া যায় আইজ কোনমিহি যাইবো?

বানেছা বলল, হ কইয়া যায়।

নাদের বলল, আইজ কোনমিহি গেছে?

দিগলি যাওনের কথা। গাওয়াল করতে করতে ভাঙ্গারির দোকানে যাইবো, গিয়া পুরানা মালছামান বেচবো, বেইচ্চা নতুন মালছামান লইবো তারবাদে গাওয়াল করতে করতে বাইত্তে আইবো।

জরি বলল, তয় অহনতরি আহে না ক্যা? বাবায় তো কোনওদিন রাইত করে না, হাজের আগে আগে বাইত্তে আইয়া পড়ে।

জরির ছোট একটা ছেলে বানেছার। নাম বদরুল, বাড়ির সবাই বদু বলে ডাকে। কথায় কথায় নাকিকান্না কাঁদবার স্বভাব। সেই ছেলে সন্ধ্যার পর থেকেই ঘ্যানঘ্যান করছে। তার দিকে তাকিয়ে বানেছা বলল, এই গোলামের পোয় এমুন করতাছে ক্যা?

পরি বলল, অর মনে অয় খিদা লাগছে।

মাত্র হাজ অইছে অহনঐ খিদা!

নাদের বলল, আমরা তো এই সমায়েঐ ভাত খাই।

হামেদ পরি সবাই বলল কথাটা।

বানেছা লজ্জা পেল। আসলেই তো সন্ধ্যা হওয়ার লগে লগেই পোলাপান নিয়া রাতের ভাত খেয়ে শুয়ে পড়ে তারা। আজ কেন সেটা বানেছার মনে নাই?

ব্যাপারটা বুঝল পরি। নাদেরের দিকে তাকিয়ে বলল, বিয়ালের মইদ্যেই তো বাইত্তে আইয়া পড়ে বাবায়। আইয়া সন্দার পর আমগো লগে বইয়া ভাতপানি খায়। আইজ বাবায় অহনতরি আহে নাই দেইক্কা মা’র মনে অয় মনে নাই যে সন্দা অইয়া গেছে। সন্দা না রাইতঐ অইয়া গেছে।

মেয়ের কথা শুনে হাসল বানেছা। হ ঠিক কথা কইছচ! এর লেইগা আমি উদিস পাই নাই যে রাইত হইয়া গেছে, তগো খিদা লাইগ্যা গেছে।

জরি বলল, তয় ভাত দিয়া দেও। বদু কানতাছে।

হামেদ বলল, বাবায় আহনের আগেঐ খাইয়া হালামু!

নাদের বলল, বাবায় কুনসুম না কুনসুম আহে হের লেইগা বইয়া থাকুমনি!

বানেছা বুঝল পোলাপানের ভালই ক্ষুধা লেগেছে। স্বামীর জন্য আর অপেক্ষা না করে ভাত বাড়তে বসে যাওয়া উচিত। তারা খেতে খেতে যদি এসে পড়ে তো ভাল না হলে যখন। আসবে তখন তার ভাতটা বেড়ে দিবে বানেছা।

কিন্তু এত দেরি আজ সে করছে কেন?

সঙ্গে নতুন মালসামানের ভার, লুঙ্গির ভিতরে মাজার কাইতানের সঙ্গে বাঁধা টাকার তহবিল এসব নিয়ে রাত বিরাত করে ফিরছে, পথে যদি চোর ডাকাতে ধরে! অনেকদিন জেল খেটে মুকসেইদ্দা চোরাও তো ফিরেছে গ্রামে। মানুষটা কি এসব জানে না? সে তো খুব সাবধানি লোক, টাকাপয়সার ব্যাপারে খুবই হিসাবি। সে তা হলে আজ এমন বেহিসাবির মতো আচরণ করছে কেন? কোথায় আটকা পড়ল? কতদূর চলে গিয়েছিল, কতদূর থেকে ফিরছে! দিঘলি বাজারে তো সপ্তাহ দশদিনে একবার করে যাচ্ছে, বহুদিন ধরে যাচ্ছে, কই কোনওদিন তো রাত করে ফিরে নাই! আজ কী হল?

এসব ভাবতে ভাবতে কোলের ছেলেটিকে মেঝেতে পেতে রাখা হোগলায় শুইয়ে ভাতের হাঁড়িপাতিলা রাখার দিকটায় চলে গেল বানেছা, ভাত বাড়তে বসল। পোলাপানরা যে যার মতো থাল নিয়ে বসল, পানির জগ গেলাস নিয়ে বসল।

পোলাপান আর স্বামীর ভাত বেড়ে দিয়ে নিজের ভাতটাও নেয় বানেছা। একসঙ্গেই খায় সবাই। আজ নিজের ভাত বানেছা নিল না। পোলাপানেরটা বেড়ে দিয়ে উদাস হয়ে বসে রইল। দেখে হামেদ বলল, তুমি খাইবা না মা?

হামেদের কথা শুনে নাদের পরি আর জরি তাকাল বানেছার দিকে। বানেছা খেতে বসেনি দেখে অবাকই হল।

বানেছা বলল, না আমি অহন খামু না।

নাদের বলল, তয় কুনসুম খাইবা?

পরি বলল, বাবায় আইলে।

ক্যা?

রাইত্রের ভাত আমরা বেবাকতে একলগে খাই। আইজ বাবায় নাই দেইক্কা খাইতে ইচ্ছা করতাছে না মা’র।

বানেছার দিকে তাকাল পরি। না মা?

বানেছা কথা বলল না। মেয়ের বুদ্ধি দেখে অবাক হল। ঠিক কথাই বলছে পরি। স্বামীর কারণেই খেতে ইচ্ছা করছে না তার। ক্ষুধাই লাগছে না। আজিজের জন্য যে তার মনে ভালরকম টান, বহুদিন পর আজ সেই টান গভীর ভাবে উপলব্ধি করছে।

কিন্তু পরি ওইটুকু মেয়ে, সে এতকিছু বুঝছে কী করে! মায়ের মনের ভিতরটা যেন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে মেয়ে। খানিক আগে বলল রাত যে হয়ে গেছে, বাবায় ফেরিনি বলে মা তা টের পাচ্ছে না। এখন বলল, বাবার জন্য খেতে ইচ্ছা করছে না মায়ের। কী করে এসব বুঝতে পারছে?

নাকি মেয়েমানুষ হয়ে জন্মালে এমনই হয়! শিশুবয়সেই মেয়েরা জেনে যায় সংসারের অনেক কিছু। ছেলেরা যতটা না জানে বোঝে মেয়েরা জানে তার চেয়ে অনেক বেশি। কেউ শিখিয়েও হয়তো দেয় না তবু কেমন কেমন করে যেন জেনে যায়, টের পেয়ে যায়।

নাদের বলল, বাবারে ছাড়া কোনওদিন রাইত্রের ভাত খাই নাই। আইজ পয়লা।

হামেদ বলল, তয় বাবায় কোনওদিন এমুনও করে না। আইজ করল ক্যা? কই গেলো গা?

জরি ভাতের লোকমা মুখে দিয়ে চাবাতে চাবাতে জড়ানো গলায় বলল, ভাঙ্গারির দোকান থিকা বাইর অইয়া মনে হয় দূরে কোনওহানে গেছে।

পরি বলল, অইতে পারে।

বদু ছেলেটা এখনও ঠিকঠাক মতো ভাত মাখতে পারে না, ঠিকঠাক মতো লোকমা দিতে পারে না। থালের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ভাত। এখনও পড়ছিল। দেখে পরি বলল, একহান কাম করো মা। বদুরে খাওয়াইয়া দেও।

ক্যা?

ও তো ঠিক লাহান খাইতে পারে না। আর তুমিও তো আজাইরা আছো।

বানেছা বিরক্ত হল। আমারে আজাইরা থাকতে দেখলে তর ভাল্লাগে না? আমি পারুম না। যেমতে খাইতাছে খাউক।

সালুন দিয়ে ভাত খাওয়া শেষ করে ডাল নিয়েছে হামেদ। পরিমাণে একটু বেশিই নিয়েছে। ভাত পড়ে গেছে ডালের তলায়। পাঁচ আঙুলে চেঁছে চেঁছে ডালের তলা থেকে ভাত উদ্ধার করে কয়েকবার খেল সে তারপর থাল তুলে ডালে চুমুক দিল। সুরুৎ করে বড় রকমের একখান টান দিয়ে শেষ করল ডাল। হাসিমুখে পরির দিকে তাকাল। বাবায় আহে নাই দেইক্কা মা’র মন মিজাজ ভাল না পরি। মা’র লগে বেশি কথা কইচ না। কথা কইলে মাইর গুতা খাবি।

পরি কথা বলল না। ভাত খেতে লাগল।

নাদের তার খাওয়া শেষ করে এনেছে। ডাল দিয়েই শেষ ভাতটা খায় সে। তবে হামেদের মতো অতখানি ডাল নিয়ে, ভাত ডুবিয়ে খাওয়ার অভ্যেস নাই। অল্প ডাল নিয়ে শুকনা শুকনা মাখা ভাত খেতে তার ভাল লাগে। সেভাবেই খাওয়া শেষ করল। থালায় হাত ধুতে ধুতে বলল, আমরা ভাত খাওনও শেষ করলাম তাও দেহি বাবায় আহে না। গেলো গা কই?

জরি বলল, আইজ রাইত্রে যুদি না আহে?

মেয়েকে ধমক দিল বানেছা। চুপ কর মাগি। খালি অলইক্কা কথা। বাইত্তে আইবো না। যাইবো কই তর বাপে? বাইত ছাড়া হেয় কোনওদিন কোনওহানে থাকছে?

মায়ের ধমকে সবাই চুপসে গেল। আর কোনও কথা না বলে যে যার মতো খাওয়া শেষ করল, তারপর বিছানায় গিয়ে বসল কেউ, কেউ শুয়ে পড়ল।

দরজাটা তখনও খোলা।

নাদেরকে হামেদ বলল, ওই দাদা, দুয়ার খোলা থাকবো?

নাদের কথা বলবার আগেই বানেছা বলল, হ তর বাপে না আহনতরি খোলা থাকবো।

তারপর দ্রুত হাতে পোলাপানের জুডা থালবাসন গুছাতে লাগল।

কোলের ছেলেটির নাম নাজিম। এই নামে কেউ তাকে ডাকে না। ডাকে নাজু। মায়ের বুকের দুধ খেয়ে অনেকক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে সে। বদুকে তার পাশে শোয়াইয়া দিল পরি। তারপর বড় চার ভাইবোন তারা মেঝেতে পাতা হোগলার বিছানায় বসে খোলা দরজা দিয়ে অন্ধকার উঠানের দিকে তাকিয়ে রইল।

হাতের কাজ সারতে সারতে বানেছা তখন কান পেতে রেখেছে বাইরের উঠানের দিকে। এই বুঝি পুবদিককার ভাঙন ঠেলে ভার কাঁধে উঠানে এল মানুষটা! এই বুঝি তার পায়ের শব্দ পাওয়া গেল! এই বুঝি পাওয়া গেল তার দূরপথ অতিক্রম করে আসার ক্লান্তিকর শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ।

না কিছুই পাওয়া যায় না। মানুষটা ফিরে না। বাইরে ঝিঁঝির শব্দ।

হামেদ বলল, ওই দাদা, এমতে বইয়া থাকবিনি?

নাদের বলল, তয় কী করুম?

এমতে বইয়া থাকলে আমার ঘুম আইবো।

পরি বলল, ঘুম আইলেও জাইগ্না থাকবি।

ক্যা?

মায় যে কইল বাবায় না আহনতরি দুয়ার আটকান যাইবো না।

জরি বোকার মতো বলল, বাবায় যুদি হারারাইত না আহে তয় হারারাইত দুয়ার খোলা থাকবো? হারারাইত আমরা জাইগ্যা বইয়া থাকুম? হারারাইত ঘুমামু না?

জরির কথা শুনেও না শোনার ভান করল বানেছা।

বোনকে ধমক দিল পরি। চুপ কর। মায় না তরে কইলো অলইক্কা কথা কবি না।

বোনের ধমকে ভয়ে ভয়ে একবার মায়ের মুখের দিকে তাকাল জরি। কুপির আলোয় উদাস চিন্তিত হয়ে আছে মায়ের মুখ। কিছুদিন আগে বিশাল পেট ছিল তার, শরীর ছিল ভারী। বোনটা হওয়ার পরই চেহারা ঘুরে গেছে। পাতলা পোতলা দেখায় আজকাল। বোনটা মরে যাওয়ার পর যেন চেহারাও সুন্দর হয়ে গেছে। শরীর চেহারায় স্বস্তির ছাপ। বোনটা মরে যেন রেহাই দিয়ে গেছে তাকে।

বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে হামেদ বলল, ওই দাদা, কিচ্ছা ক। বইয়া বইয়া কিচ্ছা হুনি। তয় আর ঘুম আইবো না। বাবায় যহন ইচ্ছা আহুক, জাইগ্না থাকুম নে।

পরি জরিও বলল। হ দাদা, ক। কিচ্ছা ক।

নাদের বলল, কীয়ের কিচ্ছা কমু?

হামেদ বলল, উই যে মা’র যেদিন আহুজ পড়লো হেদিন সড়কপারের ইজলতলায় বইয়া যেই হগল কিচ্ছা কইছিলি ওই পদের কিচ্ছা ক।

ওইডি তো কিচ্ছা না, সত্যকথা।

তয় সত্যকথাঐ ক।

ভূত প্রেতের গল্প করতে বেজায় উৎসাহ নাদেরের। সত্য অসত্য মিলিয়ে এসব গল্প সে ভালই বলে।

এখন রাত, দরজা খোলা, বাইরে গা ছমছমা অন্ধকার। এই অবস্থায় ওসব গল্প বলা কি ঠিক হবে।

কথাটা সে বলল।

শুনে হামেদ আর পরি জরি সবাই বলল, না আমরা ডরামু না। এতডি মানুষ ঘরে, ডরামু। ক্যা? মায় আছে না?

বানেছা তখনও একই জায়গায় বসে আছে। পোলাপানের কথা শুনেও শুনছে না।

নাদের একবার মায়ের দিকে তাকাল তারপর বলল, তয় কউপটাহারের ঘটনাডা কই।

হামেদ বলল, ক।

মেদিনমণ্ডল থিকা বিলের উপরে দিয়া যে হালটখান গেছে হেই হালট দিয়া কান্দিপাড়া মিহি গেলে মাঝবরাবইর হাতের ডাইনমিহি অইলো কউপটাহার। কউপটাহার অইলো একহান ডেঙ্গা। অহন তো হুগাইয়া ধানখেত অইয়া গেছে। আগিলা দিনে আছিলো বিরাট ডেঙ্গা। ডেঙ্গার খাই (গভীরতা) কত কেঐ কইতে পারতো না, এক্কেরে পাত্তালে গিয়া ঠেকছে।

নাজুর পাশে শোয়া বদু আধো গলায় বলল, পাত্তাল কোনহানে দাদা?

পরি তাকে একটা ধমক দিল। তুই চিনবি না। চুপ কর।

হামেদ বলল, হ দাদায় কিচ্ছা কওনের সমায় কেঐ কোনও কথা কবি না।

তারপর নাদেরের দিকে তাকাল। ক দাদা, ক।

নাদের বলল, কউপটাহারে আছিলো তামা পিতলের থাল বাসন জগ গেলাস ভোল বাডি হাতা চামিচ, তামার বিরাট বিরাট ডেগ, ডেগের ঢাকনা, লাম্বা লম্বা হাতা।

শুনে জরি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। বলল, ডেঙ্গার মইদ্যে এই হগল আছিলো কোনহানে। কোনবাড়ির জিনিস? কেডা রাকছিলো?

নাদের রাগ করল না। হাসিমুখে বলল, আরে বলদি (বলদের স্ত্রীলিঙ্গ) কোনও বাড়ির জিনিস না। কেঐ রাখে নাই। ঐডি অইলো গাইবি (গায়েবি) জিনিস। ডেঙ্গার পানির তলে থাকতো।

মাইনষে তাঐলে দেকতো কেমতে?

হোন, হেইডাঐত্তো কইতাছি।

আইচ্ছা ক।

নাদের একবার অন্ধকার উঠানের দিকে তাকাল। তারপর বলল, উপটাহারের চাইরমিহির যে-কোনও বাইত্তে বিয়াশাদি মোসলমানি জিয়াফত মেজবানি অইলে বাড়ির মাইনষে গিয়া কউপটাহারের সামনে খাড়ইতো, খাড়ইয়া কইতো, এতডি থাল, এতডি কলসি জগ গেলাস, এতডি ডেগ, অর্থাৎ মেজবানির বাইত্তে শয়ে শয়ে মাইনষেরে একলগে বহাইয়া খাওয়ানের লেইগা যা যা লাগে কউপটাহারের পানির মিহি চাইয়া কইয়াইতো, পরদিন বিয়ানে গিয়া দেখতে যা যা কইছে ঠিক অতডি জিনিসঐ কউপটাহারের পারে। মাইনষে মাথায় কইরা, কান্দে কইরা জিনিসটি বাইত্তে লইয়াইতো। কামকাইজ শেষ অওনের পর আবার রাইক্কাইতো কউপটাহারের পারে। জিনিসটি আপনা আপনি পাইনতে নাইম্যা যাইতো।

বদু বলল, কেমতে উটতো আর কেমতে নামতো দাদা? ঘড়ি বাড়ির আত পাও আছে নি?

হামেদ বলল, তুই চুপ কর। তুই এই হগল বুজবি না। দাদা, তুই ক।

নাদের একটু নড়েচড়ে বসল। একবার কান্দিপাড়ার এক বাইত্তে মেজবানি। কউপটাহার থিকা ডেগ থাল বাসন যা যা লাগে বেক লইয়া গেছে। কামকাইজ সাইরা আবার ফিরতও দিয়া গেছে। তয় জিনিস তো আর পাইনতে নামে না। কী বিষয়? কেঐ কিছু বোজতে পারে না।

একদিন যায়।

দুইদিন যায়।

তিনদিন যায়।

না জিনিস তো পাইনতে নামে না। বাড়ির এক মুরব্বি বুইজ্জা গেল লিশ্চই কোনও গন্ডগোল অইছে। বাড়ির বেবাকতেরে হেয় জিগাইতে লাগলো, কউপটাহারের জিনিস কেঐ কিছু হামলাইয়া রাখছেনি। রাকলে স্বীকার করো, বাইর কইরা দেও। নাইলে আমগো বংশ নিরবংশ অইয়া যাইবো।

বাড়ির ছোডপোলার বউয়ের আহুজ পড়বো। মুরব্বির কথা হুইন্না হেয় কইলো, হ আমি একহান চামিচ হামলাইয়া রাকছি।

মুরব্বি কইলো, সব্বনাশ করছচ। তাড়াতাড়ি বাইর কইরা দে। অহনঐ থুইয়াহি কউপটাহারের পারে।

চামিচটা বাইর কইরা দিল বউ। মুরব্বি গিয়া রাখল কউপটাহারের পারে। তহন আস্তে আস্তে বেবাক জিনিস নাইম্মা গেল পাইনতে। তারপর থিকা কোনওদিন কেঐ গিয়া চাইলে জিনিস আর উটতো না।

হামেদ বলল, আর ওই বউডার কোনও শাস্তি অয় নাই?

অইছে। পোলাপান অইয়া সাতদিন পর মইরা গেছে। বাঁচে নাই।

একথা শুনে স্বামীর জন্য উৎকণ্ঠায় বসে থাকা বানেছার বুকটা কেমন তোলপাড় করে উঠল। পলকের জন্য স্বামীর কথা ভুলে গেল সে, মনে পড়ল সাতদিন বয়সে চলে যাওয়া মেয়েটির কথা। এতগুলি দিন গর্ভের অন্ধকারে কত না যত্নে মায়া মমতায় বানেছা তাকে আগলে রেখেছিল। কত না কষ্টে বেদনায় নাড়ি ছিঁড়ে তাকে বের করল পৃথিবীর আলো হাওয়ায়। তারপরও থাকল না মেয়েটি। নাভিতে পচন ধরল। দেড়দিন ধরে শুধুই ওঁয়াও ওঁয়াও করল ব্যথা বেদনায়, তারপর খিচুনি উঠতে উঠতে মরল।

ওইটুকু মেয়ের মরণে কিছুই যেন হল না সংসারে। কেউ একটু কাঁদল না, কেউ ফিরে তাকাল না। আজিজ যেন খুশিই হল। যাক একটা যন্ত্রণা গেছে। দাফন কাফন পর্যন্ত করল না। কথা কাপড়ে প্যাচিয়ে কোথাকার কোন জঙ্গলে ফেলে দিয়ে এল।

নয় মাস দশদিন গর্ভের আড়ালে এত যত্নে মায়ায় রাখা মানুষটিকে এত অবহেলায় কেমন করে ফেলে দিতে পারল মেয়ের বাপ? মা হয়ে বানেছাই বা কেন তাকে বলল না, জঙ্গলে হালাইয়ো না আমার মাইয়াডারে। দাফোন কাফোন করো। জঙ্গলে হালাইলে আমার বুকের ধন শিয়াল খাডাসে খাইবো।

নিশ্চয় শেয়াল খাটাসেই খেয়েছে সেই মেয়ে। পৃথিবীর কোথাও তার এখন আর কোনও চিহ্ন নাই।

একদিকে স্বামীর না ফিরা আরেকদিকে মেয়ের শোক উথলে ওঠা, বানেছার চোখ ফেটে যেতে চাইল। পোলাপানদের সামনে কাঁদতেও চাইল না সে, হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়াল। নাদেরকে বলল, রাইত অনেক অইছে। দুয়ারডা লাগাই দে। দিয়া তরা বড় চাইর ভাইবইন। চকিতে হো। বদু নাজুর লগে আমি হুইতাছি মাইত্তে। তয় আমি জাইগ্নাঐ থাকুম নে। তর বাপে আইলে দুয়ার খুইল্লা দিমুনে।

মায়ের কথা মতোই কাজ করল নাদের। দরজা বন্ধ করে চৌকিতে উঠে গেল।

ছোট দুই ছেলের পাশে হোগলার বিছানায় শোয়ার আগে ম্যাচটা বালিশের তলায় রাখল। বানেছা, তারপর কুপি নিভাল। স্বামী ফিরলে চট করেই যেন ম্যাচ বের করতে পারে কুপি জ্বালাতে পারে।

কিন্তু আজিজ ফিরল না।

.

দুপুরের রান্না শেষ করে হাড়ি পাতিল বড়ঘরের বারান্দায়, জায়গামতো রেখে, দরজা আবজাইয়া পুকুরঘাটে গোসল করতে গিয়েছিল কুট্টি। গোসল সেরে শুকনা শাড়ি ছায়া ব্লাউজ পরে, ভিজা কাপড়চোপড় চিপড়ে হাতে নিয়েছে, নিয়ে দ্রুত পায়ে উঠানের দিকে ফিরছিল, চালতাতলার থেকে পা টিপে টিপে এসে পিছন থেকে দুইহাতে তাকে জড়িয়ে ধরল আলফু।

প্রথমে কুট্টি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল তারপর ছটফট করে উঠল। হায় হায় করেন কী! ছাড়েন, ছাড়েন।

কুট্টির পিঠের উপরদিকটায় মুখটা একটুখানি ঘষে দিয়ে আলফু বলল, না ছাড়ুম না।

আলফুর মুখের ঘষায় কুট্টির সারা শরীর তখন কাঁটা দিয়ে উঠছে। অদ্ভুত ধরনের অবশ করা ভাব ছড়িয়ে গেছে শরীরে। ইচ্ছা করছিল এভাবে যতক্ষণ ইচ্ছা আলফু তাকে জড়িয়ে ধরে রাখুক। শুধু পিঠে না শরীরের যেখানে যেখানে ইচ্ছা হাত বুলিয়ে মুখ ঘষে বা অন্যকিছু করে আদর করে দিক। কিন্তু মুখে মেয়েদের চিরকালীন ঢংটুকুও সে করল। জোর করে আলফুকে ছাড়াতে চাইল। বলল, ছাড়েন, কেঐ দেইক্কা হালাইবো।

দুরন্ত প্রেমিকের গলায় আলফু বলল, কে দেখবো? কেঐ নাই দেহনের। এই বাইত্তে খালি তুমি আর আমি।

বড়বুজানেও আছে।

হেয় বিছনায় থাকা মানুষ। হেয় দেখবো কেমতে। যহন দেহনের তহনঐ দেহে না, দেহন তো দূরের কথা উদিস পায় না যে তার পালঙ্কের সামনের পাটাতনে শোয়া যুবতী মাইয়াডা যে রাইত দোফরে উইট্টা দুয়ার খোলে। মনের মাইনষের কাছে গিয়া তার লগে হুইয়া থাকে। বিয়াইন্না রাইত্রে উইট্টা আবার ফিরা যায় নিজের বিছনায়।

মুখ ঘুরিয়ে আলফুর ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়াল কুট্টি। চুপ করেন। ইস লজ্জাশরম নাই।

কীয়ের লজ্জাশরম? তোমার কাছে আমার আর লজ্জাশরম কী! আমার কাছেই বা তোমার লজ্জাশরম কী! আমরা দুইজন মানুষ মিলা অহন একজন।

তাও আমার শরম করে।

কুট্টির ঠোঁটে গভীর করে একটা চুমু খেল আলফু। কীয়ের শরম? এহেনে তোমারে কে দেখতাছে!

কুট্টির শরীরে তখন আগুন জ্বলছে। তবু কোনওরকমে সে বলল, মাইনষে না দেহুক অন্য জিনিসে তো দেখতাছে আমগো।

কথাটা বুঝল না আলফু। বলল, অন্য জিনিস আবার কী?

কুট্টি হাসল। বাড়ির কাউয়া শালিক, গাছ, গাছের পাতা, চৈতালি বাতাস বইতাছে, হেই বাতাস। মাথার উপরের আশমান, এই হগল জিনিসে দেখতাছে না আপনে আমারে প্যাচাইয়া ধইরা রাখছেন!

ও এই হগল জিনিসে দেখতাছে! আইচ্ছা দেহুক।

তয় দোফরবেলা পিরিতি এমুন উথাল দিয়া উটলো ক্যা?

তোমারে দেইক্কা।

আমারে কই থিকা দেকলেন?

চাউলতাতলা থিকা।

চাউলতাতলায় আইলেন কুনসুম?

অনেকক্ষুন আগে আইছি।

কন কী? আমি দিহি উদিস পাইলাম না।

গেছিলাম আজিজ গাওয়ালের বাইত্তে। ওই বাইত্তে একহান কাম অইছে।

কী কাম?

হেইডা পরে কমুনে। আগে নিজের কথাহান কইয়া লই।

আইচ্ছা কন।

বাইত্তে আইয়া তোমারে বিচড়াইলাম। বড়ঘরের দুয়ার আবজাইন্না দেইখা বুজলাম তুমি নাইতে গেছ। তোমার নাওন দেহনের লেইগা চুল্পে চুপ্পে আইয়া চাউলতাতলায় খাড়ই রইছি।

কুট্টি মজার মুখ ভঙ্গি করে বলল, ইস।

কুট্টির গালে দুইবার মুখ ঘষল আলফু। হ। বিশ্বাস করো।

আলফুর শ্বাসের সঙ্গে আসছিল বিড়ির গন্ধ সেই গন্ধ আর মুখের ধারালো দাড়িমোচের ঘষায় শরীর কাঁটা দিচ্ছিল কুট্টির। অস্থিরতা বাড়ছিল। তবু গলার জোর কমাল না সে। বলল, আমারে আবার নতুন কইরা দেহনের কী অইলো? হেদিন থিকা তো রোজ রাইত্রেঐ দেকতাছেন।

না রাইত্রে দেহা যায় না। বারিন্দায় ঘুটঘুইট্টা আন্ধার। তোমার শইল্লের কিছু দেহা যায় না।

বুজা তো যায়?

তা যায়। ওই মজা এক, দেহনের মজা আরেক।

অইছে। অহন ছাড়েন। আমি গিয়া ভাত বাড়ি আপনে নাইয়া ধুইয়া আহেন।

আলফু শিশুর মতো জেদি গলায় বলল, না।

তয় কী করবেন? এমতে পাচাই ধইরা খাড়ঐ থাকবেন?

না।

তয়?

তোমারে পাতালি কুলে কইরা চাউলতাতলায় লইয়া যামু।

তারবাদে?

তারবাদে যা অওনের অইবো।

এবার কুট্টি ছটফট করে উঠল। এই না, না। দিনদোফরে এই হগল অইবো না।

আমার ইচ্ছা করতাছে।

না। আমি নাইয়াইছি।

তাতে কী অইছে। আমার লেইগা নাইলে আরেকবার নাইবা।

একবার না, আপনের লেইগা আমি দশবারও নাইতে পারি, তয় দিনদোফরে গাছতলায় এইডা ঠিক অইবো না।

ক্যা?

কওন যায় না, কে কোন হানদা এই বাইত্তে আইবো। কার চোক্কে পইড়া যামু। একবার যুদি কেঐ বুইজ্জা যায় তয় কইলাম বেবাকঐ গেলো।

তারপর কুট্টিও চট করে আলফুর গালে একটা চুমু খেল। একবার আপনেরে যহন আমি পাইছি, এই জীবনে আপনেরে আর হারাইতে চাই না। আমার সবকিছু আপনের। যহন যেমতে ইচ্ছা চাইবেন আমি আপনেরে বেক কিছু দিয়া দিমু। তয় সবঐ করতে হইবো সাবধানে। রাইতে তো আমি আপনের কাছে থাকি। অসুবিদা কী?

চট করেই কুট্টিকে ছেড়ে দিল আলফু। ঠিকঐ কইছো। কোনও কিছু লইয়াঐ বাড়াবাড়ি ভাল না। তয় আমার কইলাম দোষ আছে একহান।

কী দোষ?

আমি কইলাম অনেক কিছু বোজতে চাই না। বহুত বাড়াবাড়ি করি।

হ আগে বুজি নাই, অহন বুজি।

বোজছো যহন তহন আমারে কইলাম শাসনে রাইখো।

কেমতে?

আমি যা চামু তাতেঐ লগে লগে রাজি অইয়ো না।

তয় কী করুম?

আগে চিন্তা করবা যে কামডা ঠিক হইবো কি না।

যদি ঠিক অয় করবা আর না অইলে লগে লগে আমারে ফিরাইবা।

অহন যেমুন ফিরাইলাম?

হ।

কুট্টি হাসল। আইচ্ছা।

একটু থেমে বলল, তয় আমিও তো কোনও কোনও সময় আপনের লাহান করতে পারি।

কেমুন?

আমিও অবুজ অইয়া যাইতে পারি, বাড়াবাড়ি করতে পারি।

এবার আলফু হাসল। তহন আমি তোমারে ফিরামু।

তয় আগে ফিরান নাই ক্যা?

আগে কবে?

ওই যে জ্বরের রাইত্রে। ক্যান ওদিন নাইলে তারপরে কোনওদিন আমারে কইতেন তুমি যা চাও হেইডা সম্ভব না। দ্যাশে আমার বউ আছে, ডাঙ্গর ডাঙ্গর পোলাপান আছে।

আমি কইলেঐ তুমি ফিরতা?

কইতে পারি না।

জানি, ফিরতা না। অহন যুদি আমি কই মনের কথা মনেঐ তুমি চাইপ্পা রাখো নাই ক্যান? আমারে কইছো ক্যান? আর আমার দ্যাশে যাওনের কথা হুইন্না মন খারাপ করছো। ক্যান। আমি যহন গেলাম না, তহন এত খুশি অইলা ক্যান? তারবাদেও কহেকদিন চুপচাপ রইলা। এক রাইত্রে আমারে ভাত দিয়া নিজের হাতখান বাড়াইয়া দিলা। রাইত্রে চইলা আইলা আমার বিছনায়। তারবাদে আইজ কও এই কথা, আমি তোমারে ফিরাই নাই ক্যান! আরে ক্যান ফিরামু? তুমি যেমতে চাইছো আমারে আমিও তো ওমতে চাইছি তোমারে!

আলফুর চোখের দিকে তাকিয়ে গভীর মায়াবী গলায় কুট্টি বলল, হারাজীবন এমতে চাইবেন তো?

চামু। যতদিন বাইচ্চা আছি এমতেঐ চামু তোমারে। তুমি আমারে যেই সুক দিছো এই সুক জিন্দেগিতে পাই নাই আমি। বউ আমার আছে কিন্তু এমুন সুক হেয় আমারে দিতে পারে নাই।

আমারেও পারে নাই নয়নের বাপে। আপনের লগে না থাকলে আমি কোনওদিন। বোজতামঐ না জিনিসটা এত সুকের। ওই সুক একবার পাইয়া মইরা গেলেও সুক। দুইন্নাইতে আর কিছু চাওনের থাকে না।

আসলে দুনিয়ার বেবাক কাম অয় আল্লার ইশারায়। আল্লায় যহন চাইছে তোমার আমার মিল অউক তহনঐ অইছে।

এই মিলডা য্যান আল্লায় জনম ভইরা রাখে।

রাখবো। লিশ্চই রাখবো।

আচমকা কুট্টি বলল, এইবার কন আইজ্জাদার বাইত্তে কী অইছে।

এক ভাবনা থেকে চট করেই আরেক ভাবনায় এল আলফু। হেয় তো পাঁচদিন ধইরা বাইত্তে আহে না।

কী?

হ। পাঁচদিন আগে গাওয়ালে গেছে অহনতরি আহে না। ভাবিছাবে কাইন্দা কাইট্টা অস্থির। পোলাপানডিও বাবা গো, বাবা গো কইরা কান্দে।

কন কী?

হ।

গাওয়াল করতে গেছিলো কই?

দিগলির ঐমিহি।

তয় ঐমিহি বিচড়াইতে পাডাইতো কাঔরে?

আইজ দুই পোলারে পাডাইছে। নাদের আর হামেদ গেছে।

অতডু অতড় পোলারা গিয়া কী খবর লইবো?

হেইডাঐত্তো কথা।

আইজ্জাদার আততিয় স্বজনগ খবর দেয় নাই?

দিছে। ভাবিছাবের ভাই বেরাদারগো, বইনজামাই আততিয় স্বজন বেবাকতেরেঐ জানাইছে। বেবাকতেঐ বিচড়াইতাছে। এই গেরামের মানুষজনও যে যেই মিহি যাইতাছে। হেই মিহিঐ বিচড়াইতাছে।

কুট্টি উদাস হল, চিন্তিত হল। মানুষ একবার হারাইয়া গেলে হেয় যুদি নিজে থিকা ফিরত না আহে তয় তারে আর বিচড়াইয়া বাইর করন যায় না। পাওয়া যায় না।

আলফু ভুরু কুঁচকাল। এই কথা কইলা ক্যা?

কইলাম আলাকাকার বাপের কথা চিন্তা কইরা। চল্লিশ-পাচ্চল্লিশ বচ্ছর আগে বাড়িত থিকা ইমামতির কামে গেল চানপুরের মতলব না কোন জাগায় জানি। আর কোনওদিন ফিরত আইলো না। হারাজীবন ধইরা দাদি তার লেইগা বইয়া রইলো। চাইরডা পোলাপান লইয়া কত কষ্ট করলো।

ঠিক কইছো! আইজ্জাদায়ও যুদি এমুন করে? যুদি আর কোনওদিন ফিরত না আহে।

আকথা কইয়েন না। আল্লায় য্যান অমুন কাম না করে। ভাবীছাবে মানুষ ভাল না। ছনুফুপুরে বহুত জ্বালাইছে, তারবাদেও আইজ্জাদায় যুদি ফিরত না আহে তয় এতডি পোলাপান লইয়া তার উপায় হইবো কী?

হ, ঠিকঐ। আমগো বেবাকতের উচিত আইজ্জাদারে বিচড়াইয়া বাইর করন। তয় আমার মনে অয় কোনও কামে হেয় আইটকা পড়ছে, দুই-চাইর দিন বাদে ফিরত আইবো।

আল্লায় য্যান তাই করে।

আলফুর চোখের দিকে তাকিয়ে কুট্টি বলল, আপনে কোনওদিন এমুন করবেন না তো?

আলফু অবাক। কেমুন?

কোনও কামের কথা কইয়া আমারে ছাইড়া যাইবেন আর ফিরত আইবেন না।

তোমার মনে অয় এমুন কাম আমি করতে পারি?

মাইনষের মনের কথা কওন যায় না।

তয় এই কথাডা তো তোমারেও আমি কইতে পারি। তুমিও তো আমারে ছাইড়া যাইতে পারো। আর ফিরত নাও আইতে পারো আমার কাছে।

হেইডা কেমতে অইবো?

ক্যান? অইতে পারে না?

অইতে পারে না। আমার যাওনের জাগা নাই। বহুতদিন আগে সতিনের সংসার থিকা ফিরত আইছি। মা-বাপে জাগা দেয় নাই বাইত্তে। মিয়াবাইত্তে আইয়া ঝিয়ের কাম লইছি। আততিয় স্বজন কেঐ কোনহানে নাই যে আমারে একওক্ত খাওন দিবো। এমুন মানুষ যাইবো কই!

কুট্টি যখন এভাবে কথা বলে আলফুর মন আশ্চর্য মমতায় ভরে যায়। ইচ্ছা করে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে আদর করে দেয়।

এখনও করল। কিন্তু জড়িয়ে কুট্টিকে সে ধরল না।

কুট্টি বলল, আপনের দশা আমার লাহান না। আপনের যাওনের জাগা আছে। চরে আপনের দ্যাশ আছে, সংসার বউ পোলাপান আছে। একবার হেই চরে গিয়া আপনে যুদি আর ফিরত না আহেন, আমি কেমতে গিয়া আপনেরে বিচড়াইয়া আনুম? আর কোন মোকে বিচড়ামু? আমি তো আপনের বিয়া করা বউ না। আমার তো আপনের উপরে কোনও দাবি নাই। আপনে আমার মনের মানুষ এইডা অন্য মাইনষে বোজবো না। মাইনষে বোজতে চাইবো আপনের লগে আমার বিয়া অইছেনি। কবুল কইরা, কাবিন কইরা আপনে আমারে বিয়া করছেন নি।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কুট্টি। কইতে পারি না কপালে আমার কী আছে? কোন কান্দন হারাজীবন ধইরা আপনের লেইগা আমার কান্দন লাগে। কপালডা আমার ছোট্টকাল থিকাঐ খারাপ। গরিব মা-বাপের ঘরে জন্মাইছি, এমুন একহান দিনও যায় নাই যেদিন তিনওক্ত খাওন পাইছি। কোনও কোনও সমায় দুই-তিনদিনও না খাইয়া রইছি। সংসারের অভাব দেইক্কাঐ সতিন আছে জাইন্নাও আধা বইসা নয়নের বাপের কাছে বিয়া বইলাম। ওহেনেও টিকতে পারলাম না। আমার সব থিকা সুকের দিন অহন এই বাইত্তে। মাজারো বুজানে দুই-চাইর দিন বাইত্তে থাকলে ইট্টু ঝামেলা অয়, কামকাইজ বেশি করতে অয়, দৌড়ের উপরে থাকতে অয়, হেয় না থাকলে পুরা বাড়িঐ আমার। যহন যা মনে চায় খাই। ইচ্ছা অইলে কাম করি না অইলে করি না। অভাব ছিল খালি একহান জিনিসের। একজন মনের মানুষ, তার আদর সোহাগ। হেইডাও আমি পাইতাছি আপনের কাছ থিকা। অহন আমার কোনও দুকু নাই, কোনও কিছুর কোনও আকাল নাই। সুকে আমি এক্কেরে ডুইব্বাছি। এই সুক কতদিন সইবো এইডাঐ কথা।

কুট্টির কথা শুনতে শুনতে আবার সেই প্রথম দিককার আবেগটা ফিরে এল আলফুর। কিন্তু দুইহাতে কুট্টিকে সে জড়িয়ে ধরল না। একহাতে কাছে টেনে অন্যহাতে তার চিবুকটা তুলে ধরল। হৃদয়ের গভীর থেকে বলল, আমি তোমারে কোনওদিন ছাইড়া যামু না। যতদিন বাইচ্চা থাকি, যেহেনেঐ থাকি, তোমারে লইয়াঐ থাকুম। রাইতভর তোমারে প্যাচাইয়া ধইরা ঘুমামু, দিনভর কামকাইজ করুম আর ফাঁকে ফাঁকে দেহুম তোমার মুখ। এক লগে বইয়া ভাত খামু দুইজনে, সুক দুর্কের কথা কমু। এই জীবন তোমারে ছাড়া আমি কাটামু না।

আলফুর কথায় আবেগে বুক ভরে গেল কুট্টির। ইচ্ছা করল দুইহাতে আলফুর গলা জড়িয়ে ধরে বলে, আপনে যেমতে চান আমিও অমতেঐ চাই সব। আমিও আপনেরে ছাড়া আমার এই জীবনডা আর কাটাইতে চাই না।

একথা না বলে কুট্টি বলল অন্যকথা। কেমতে আমারে লইয়া জীবনডা আপনে কাটাইবেন? চরে যে আপনের বউ পোলাপান আছে, সংসার আছে?

আলফু বলল, তাগো লইয়াও চিন্তা আমার আছে। তয় হেই চিন্তার কথা আইজ তোমারে কমু না। কমু আরেকদিন। তয় আইজ খালি এডু কই, তোমার লেইগা আমি সব ছাড়তে পারুম।

না না হেইডা আপনে করবেন না।

ক্যা?

তারা তো কোনও দোষ করে নাই! তাগো আপনে কীর লেইগা কষ্ট দিবেন! আপনে তাগো চিন্তা না করলে মানুষটি যাইবো কই? পোলাপানডির উপায় অইবো কী?

সবদিক চিন্তা কইরাঐ পথ আমি বাইর করুম। কেঐরে কষ্ট দিমু না। সোন্দরভাবে করুম কামড়া। তয় শেষ কথা অইলা তুমি। যেই আদর সোহাগ মায়া মমতা তোমার কাছ থিকা আমি পাইছি, এইডা আমি হারাইতে চাই না। এইডা আমার জীবনের সবথিকা বড় সম্পদ। এই সম্পদ আমি বুক দিয়া আলগাইয়া রাখুম।

আলফুর কথা শুনে মন ভরে গেল কুট্টির। শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল সেই প্রথমদিন চালতাতলার আধো অন্ধকারে বসা আলফুকে দেখে যেমন করে কাঁটা দিয়েছিল ঠিক তেমন করে। খানিক আগে আলফুর যা ইচ্ছা করেছিল, কুট্টি টের পেল এখন তার শরীর জুড়ে, মন জুড়ে সেই ইচ্ছা। এখন দিন না রাত্রি বুঝতেই চাইল না সে, আবার গোসল করতে হবে কি হবে না, বুঝতে চাইল না। আচমকা কেউ এসে পড়বে কি না, একবারও মনে হল না। একহাতে ধরা চিপড়ানো শাড়ি ছায়া ব্লাউজ আস্তে করে মাটিতে ছেড়ে দিয়ে দুইহাতে গভীর করে আলফুর গলা জড়িয়ে ধরে কুট্টি বলল, আমারে পাতালি কুলে লন।

আলফু অবাক হল কিন্তু করল কাজটা।

আলফুর কোলে উঠে দুইহাতে তার গলা জড়িয়ে মুখটা আদুরে ভঙ্গিতে তার মুখে ঘষতে ঘষতে কুট্টি বলল, চাউলতাতলায় লইয়া যান আমারে।

আলফু ততক্ষণে বুঝে গেছে কী চায় কুট্টি। তবু বলল, কীর লেইগা?

কুট্টি আধো গলায় বলল, আপনে যা চান আমিও তাই চাই।

শুনে আলফুর শরীরের ভিতর জেগে উঠল দুর্দান্ত এক কামার্ত পুরুষ। কুট্টিকে নিয়ে। চালতাতলায় এল সে। আলফু প্রায়ই এখানটায় বসে জিরায়, বিড়ি খায়। কিছু খড়নাড়া ফেলা আছে। সেই খড়নাড়ার উপর কুট্টিকে শোয়াইয়া দিয়া তার ভিতর একটু একটু করে ডুবে যেতে লাগল আলফু। গোঙাতে গোঙাতে কুট্টি শুধু কোনওরকমে বলল, আপনে আমারে ছাইড়া যাইয়েন না, কোনওদিনও ছাইড়া যাইয়েন না।

তখন ঠাকুরবাড়ির ওদিক দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে কোনও বয়াতি ধরনের মাটিয়াল গলা ছেড়ে রূপবানের গান গাইছিল,

শোন তাজেল গো,
মন না জেনে প্রেমে মইজো না
মন না জেনে প্রেমে মইজো না
মন না জেনে
এ প্রেমে মইজো না।

এই গান শুনে ওই অবস্থায়ও কুট্টির বুকটা একটু কেঁপে উঠল।

.

ভাঙ্গারি কাকায় বহুত ভাল মানুষ, না রে দাদা?

নাদের কথা বলল না। ভাঙ্গারির দোকান থেকে বের হবার পর থেকেই কেমন গম্ভীর, কেমন চিন্তিত হয়ে আছে। হামেদের পাশাপাশি হাঁটছে ঠিকই, সঙ্গে যে হামেদ আছে সে-কথা যেন মনেই নাই।

এখন হামেদের কথা শুনেও তার দিকে তাকাল না নাদের। কথাও বলল না। হামেদ নিজের ভাল লাগায় ডুবে আছে। গদগদ গলায় বলল, এত্ত বড় বড় দুইহান কইরা রসোগোল্লা খাওয়াইলো। আর এত্ত সাদ রসোগোল্লার। এত্ত সাদের, এত্তবড় রসোগোল্লা। আমি কোনওদিন খাই নাই। দুইহান খাইয়া পেট একদোম ভইরা গেছে। রাইত্রের আগে। আর ভাত খাওন লাগবো না।

নাদের তবু কথা বলল না। দ্রুত হাঁটার স্বভাব তার। হামেদ কখনও ভাইয়ের লগে হেঁটে পারে না। নাদের হাঁটলে হামেদ সব সময়ই পিছনে পড়ে। পিছন থেকে সব সময় দৌড়ে এসে ধরতে হয় ভাইকে।

এখন তেমন হচ্ছে না।

দিঘলি বাজারের ভাঙ্গারির দোকান থেকে বের হয়ে আগের হাঁটাটা যেন ভুলেই গেছে নাদের। অথচ সকালবেলা বাড়ি থেকে বের হয়ে হাঁটছিল তুফানের মতো। সারাটা পথই ভাইয়ের পিছন পিছন দৌড়ে আসতে হয়েছে হামেদকে। আর এখন হাঁটছে ভাইয়ের পাশাপাশি।

নাদেরের এইসব ব্যাপার নিয়ে যেন কোনও আগ্রহই নেই হামেদের। সে মুগ্ধ হয়ে আছে ভাঙ্গারি কাকার ব্যবহারে, বড় বড় দুইখান রসোগোল্লার স্বাদে। হাঁটতে হাঁটতে বলল, আমরা তো রসোগোল্লা আমিত্তি বালুসা এই হগল খাই বচ্ছরে একদিন। গলুইয়ার দিন। গলুইয়ার দিন বাবায় আমগো বেবাকতেরে লইয়া কালিরখিলের মাডে যায়, মাডির দুয়েকহান ঘোড়ামেড়া কিন্না দেয়। তারবাদে গান্দির দোকান থিকা রসোগোল্লা আমিত্তি আর বালুসা কিন্না নতুন একহান মাডির হাড়িতে কইরা বাইত্তে লইয়াহে। হাড়ির মোকহান গান্দির দোকানের মাইনষে বাঁশকাগজ আর চিকন রসি দিয়া এমতে বাইন্দা দেয়, হাতে ঝুলাইয়াঐ হাড়িডা বাইত্তে লইয়াহে বাবায়। তারবাদে মা’র হাতে দেয়। তয় মায় কইলাম রাইত্রে হেদিন ভাতপানি রান্দে না। জের থিকা মুড়ি ঢাইল্লা দেয় বেবাকতের থালে তারবাদে একহান কইরা আমিত্তি একহান বালুসা আর একহান কইরা রসোগোল্লা। ইস হেই রাইতটা যে আমার কী আমোদে কাডে রে দাদা! বহুত আরাম লাগে মিষ্টি খাইয়া।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা তখন ঘোড়দৌড়ের খালের কাছে চলে এসেছে। খালের উপর কাঠের পুরনা পুল। পুলে উঠতে উঠতে নাদের বলল, এই হগল আমি জানি। এই হগল। প্যাচাইল আমার লগে অহন পারি না।

ক্যা রে দাদা? তর মন খারাপ?

পুল পেরুতে পেরুতে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাল নাদের। তর খারাপ না?

দুপুর ঢলে গেছে কিছুক্ষণ আগে। চারদিকে চৈত্রমাসের ঘোরতর রোদ। একটুখানি হাওয়া নাই গাছপালায়। খালের পানি মাটি গাছপালা শস্যের চকমাঠ খা খা করছে। গরমে ঘামে দুই ভাইই অতিষ্ঠ। কিন্তু এতবড় দুইখান রসোগোল্লার স্বাদ মুখে লেগে থাকার ফলে এইসব রোদঘাম গায়েই লাগছিল না হামেদের। অন্যকোনও কিছু আর মনেই ছিল না। কী কাজে মেদিনীমণ্ডল থেকে পাঁচ-ছয় মাইলের দূর দিঘলির বাজারে এসেছিল তারা, কতক্ষণ থেকে আবার ফিরে যাচ্ছে, কিছুই যেন মনে নাই। বোধহয় এজন্যই বলল, ক্যা, মন খারাপ অইবো ক্যা?

বাবার লেইগা?

এবার চট করেই ব্যাপারটা মনে পড়ল হামেদের। তাই তো, বাবার খোঁজেই তো তারা আজ দিঘলি বাজারে এসেছিল ভাঙ্গারিকাকার দোকানে। আজ পাঁচদিন গাওয়ালে বেরিয়ে বাড়ি ফিরছে না বাবা। কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না। গ্রামের কারও সঙ্গে কোথাও বাবার দেখাও হয়নি। দেশগ্রাম থেকে মানুষটা যেন একদমই উধাও হয়ে গেছে।

পাঁচদিন ধরে বাবার পথ চেয়ে চেয়ে মা আজ সকালে তাদের দুই ভাইকে পাঠিয়েছিল দিঘলি বাজারে। কিন্তু ভাঙ্গারিকাকাও বাবার কোনও হদিশ দিতে পারল না। বলল, পাঁচদিন আগে আইছিলো। পুরানা মাল দিয়া নতুন মাল নিল, কিছু টেকা পাইতো হেইডা নিল, তারবাদে দোফরের আগে আগেঐত্তো বাড়ি মিহি মেলা দিল। আর তো আমার এহেনে। আহে নাই।

শুনে নাদের-হামেদ যখন খুবই হতাশ তখনই দুইখান করে বড় সাইজের রসগোল্লা এনে খাওয়াল দুইজনকে। নানারকম বুঝ দিয়ে ফিরত পাঠাল। মনে হয় কোনও কামে। গিয়া আটকা পড়ছে। তোমার মা’রে কইয়ো চিন্তাভাবনা য্যান না করে। দুই-চাইর দিন পর। লিশ্চই ফিরত আইবো। ফিরত না আইয়া যাইবো কই, কও!

লোকটির নাম রতন পাল। বহুদিন ধরে ভাঙ্গারির ব্যাবসা করে বলে নাম পড়ে গেছে রতন ভাঙ্গারি। মুখে মধুমাখা রতন ভাঙ্গারির। কথা বলে এত সুন্দর করে, খারাপ কথাও শুনতে ভাল লাগে। বাচ্চা ছেলে দুইটার বাপ যে পাঁচদিন ধরে বাড়ি ফিরে না, লোক যে তার কাছ থেকেই মালছামান নিয়ে বহুবছর ধরে গাওয়াল করে, সব শুনেও তার চেহারায় বিন্দুমাত্র উৎকণ্ঠা দেখা গেল না। খুবই মধুর ভঙ্গিতে হাসিহাসি মুখ করে এমনভাবে সান্ত্বনা। দিল, যেন পাঁচদিন কেন পাঁচ বছরও কারও জন্য বাড়ি না ফিরা কোনও ব্যাপারই না। তার আচরণে মুগ্ধ হয়েই বোধহয় বাবার কথা ভুলে গিয়েছিল হামেদ। এখন নাদেরের কথায় মনে পড়ল।

তারপরও ভাঙ্গারিকাকার কথার রেশ ধরে রাখল হামেদ। বলল, বাবার লেইগা মনডা আমার খারাপ ঠিকই, তয় বেশি খারাপ না।

পুল থেকে নেমে খানিকদূর এগিয়েছে ওরা। এখানটায় রাস্তার দুইপাশে কিছু ঝোঁপজঙ্গল, গাছপালা। বেশ ছায়া আছে। যদিও হাওয়া বলতে গেলে নেইই তবু রোদের তেজ তেমন টের পাওয়া যাচ্ছে না। কাছাকাছি কোথাও থেকে থেকে ডাকছে একটা ঘুঘুপাখি। সেই ডাকে কীরকম এক নির্জনতা যেন নেমেছে চারদিকে।

হামেদের কথা শুনে দাঁড়াল নাদের। বলল, বেশি খারাপ না ক্যা?

ভাঙ্গারিকাকায় যে কইলো কোনও কামে আটকা পড়ছে। লিশ্চই আইয়া পড়বো।

যুদি না আহে?

শুনে ভয় পেয়ে গেল হামেদ। মুখ শুকিয়ে গেল। আইবো না তয় যাইবো কই?

বয়, ইট্ট জিরাই। জিরাইতে জিরাইতে কথা কই।

দুই ভাই পথের ধারের জামগাছতলায় বসল। গাছটার পিছনে আর দুইপাশে ঝোঁপজঙ্গল, সামনে সবুজ ঘাস। গাছের ছায়ায় আরামদায়ক হয়ে আছে ঘাসগুলি। বসার পর ভাল লাগল হামেদের। বলল, এইবার ক ভাই। বাইত্তে না আইয়া বাবায় যাইবো কই?

নাদের চিন্তিত গলায় বলল, বাবারে কেঐ মাইরাও হালাইতে পারে।

কী?

হ।

কেডা মারবো বাবারে? ক্যান মারবো?

টেকাপয়সার লেইগা।

কীয়ের টেকাপয়সা?

ওই যে ভাঙ্গারিকাকায় কইলো, মাল বেচইন্না টেকা আর নতুন মালছামান লইয়া হের দোকান থিকা ওইদিন বাইর অইছে বাবায়।

এমুন তো সব সমায়ঐ বাইর অয়!

হ অয়। তয় বিপদটা মনে অয় ঐদিনঐ অইছে।

কেমতে?

মনে কর এমুন জঙ্গইল্লা কোনও নিটাল জাগা দিয়া ভার কান্দে লইয়া হাইট্টা যাইতাছিল বাবায়, জঙ্গলে পলাইয়া আছিলো চাইর-পাঁচজন ডাকাইত। বাবারে একলা পাইয়া রামদাও লইয়া সামনে আইয়া খাড়ইছে। বাবায় তো কিরপিন মানুষ। মনে অয় টেকাপয়সা আর মালছামান দিতে চায় নাই। এর লেইগা ডাকাইতরা হের কল্লাডা এক কোবে নামাইয়া। দিছে। দিয়া কল্লাডা আর শইলডা গুইজ্জা রাকছে কচুরি পেনাআলা কোনও পুকঐরের কেদার তলে। তারবাদে টেকাপয়সা মালছামান লইয়া গেছে গা।

শুনে ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল হামেদের। ঘট করে একটা টোক গিলল। হায় হায় কচ কী?

নাদেরের গলা তখন ধরে আসছে। ভাঙা গলায় বলল, হ। আমার মনে অয় এমুনঐ অইছে। নাইলে বাবায় যাইবো গা কই?

যুদি এমুন অইয়া থাকে তয় তো বাবায় আর ফিরত আইবো না, না?

কেমতে আইবো? মইরা গেলে মানুষ আর ফিরত আহে?

তয় বাবার লগে আমগো আর দেহা অইবো না?

বাইচ্চা থাকলে সেন্না অইবো!

হামেদ কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, বাবায় না থাকলে গাওয়াল করবো কেডা? খেতে ধান বোনবো কেডা? রুজি করবো কেডা? আমরা খামু কী?

অনেকক্ষণ ধরেই চোখ ভরেছিল নাদেরের। এবার গাল বেয়ে কান্না নামল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, কইতে পারি না। আমি কিছু কইতে পারি না। আমার অহন বাবা গো বাবা গো কইরা চিইক্কর পাইড়া কানতে ইচ্ছা করতাছে।

ভাইকে কাঁদতে দেখে হামেদও কেঁদে ফেলল। তয় অহন বাইত্তে গিয়া কী কবি মা’রে? ডাকাইতে যে বাবার কল্লা কাইট্টা হালাইছে এইডা কবি?

নাদের চোখ মুছে বলল, আরে না।

তয়?

আমরা তো জানি না যে এমুন অইছে। আমি আন্তা করছি।

হামেদ নাক টেনে বলল, তয় মা’রে গিয়া কবি কী?

ভাঙ্গারিকাকায় যা যা কইছে হেইডাঐ কমু।

এই হগল হুইন্না কি মায় বুজবো? মায় তো চিইক্কর পাইড়া কানবো নে।

কানলে অহন কী করুম ক?

দুই ভাই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। রাস্তার ওপাশের খোলা মাঠে চৈতালি ঘূর্ণি ওঠে। সেদিকে তাকিয়ে হামেদ বলল, ওই দেক বানাডুলি আইতাছে দাদা। এমুন নিটাল জাগায় বইয়া থাকনের কাম নাই। ল জাইগা।

হ, ল।

নাদের উঠল।

হাঁটতে হাঁটতে হামেদ বলল, ওই দাদা, আমার অহন খালি একহান কথা মনে অয়।

কী কথা?

মনে অয় আমরা এত ছোড অইয়া রইলাম ক্যা? আমরা আরও ডাঙ্গর, জুয়ানমর্দ অইলাম না ক্যা?

অইলে কী হইতো?

বাবার কামডি আমরা করতে পারতাম। তুই গাওয়াল করতি, বদু আর নাজুরে লইয়া আমি খেতখোলা চুইতাম (চাষ করা অর্থে)। পরি আর জরি করতে মা’র কামডি। রান বাড়ন বেবাক কিছু। তয় তো খাওনের আকাল অইতো না। অহন তো অইবো। অহন তো না খাইয়া মরণ লাগবো।

নাদের কথা বলল না। চুপচাপ হাঁটতে লাগল।

হামেদ বলল, ওই দাদা, আর যুদি এমুন না অইয়া থাকে?

কেমুন?

ধর ডাকাইতে বাবার কল্লাডা কাডে নাই। বাবায় বাইচ্চা আছে। কয়দিন বাদে ফিরত আইলো?

তয় তো কোনও কথা নাই। আমার কথা অইলো বাবায় এতদিন থাকবো কই?

মনে কর কোনও আত্মীয় বাইত্তে গিয়া বেড়াইতাছে।

কেঐরে কিছু না কইয়া বেড়াইতে হেয় যাইবো ক্যা? মাইনষে কি এমতে বেড়াইতে যায়?

হামেদ চিন্তিত গলায় বলল, হ এইডাও তো কথা। বাবায় তো কোনওদিন এমুন করে নাই।

নাদের হতাশ গলায় বলল, তুই যাঐ কচ, আমার মনে অয় বাইচ্চা নাই বাবায়। বাবারে ডাকাইতেঐ মারছে। আগে ডাকাইতের গেরাম আছিল ছিন্নগড়ের ঐমিহি বাজপুর, অহন অনেক গেরামে ডাকাইত আছে। কোন গেরামের উপরে দিয়া গাওয়াল কইরা বাড়ি মিহি যাইতাছিল বাবায়, কোন গেরামের ডাকাইতে তারে মারছে কে কইবো! আমরা কোনওদিন

জানতেও পারুম না কেমতে কী অইছিলো। আহা রে, আহা!

নাদেরের হাহাকারে বুকটা আবার তোলপাড় করতে লাগল হামেদের।

.

ছেলেদের মুখে রতন ভাঙ্গারির কথা শুনে উঠানে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগল বানেছা। হায় হায় কয় কী? কয় কী রে? তয় তো হেয় আর বাইচ্চা নাই। ডাকাইতেঐ খাইছে হেরে। হায় হায় এইডা কেমুন সব্বনাশ অইলো আমার! এতডি পোলাপান লইয়া আমি অহন কেমুন করুম! পোলাপানগো খাওয়ামু কী! কেমতে বাঁচাইয়া রাখুম!

একবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বানেছা, একবার উঠে বসে। দুই হাতে পাগলের মতো বুক চাপড়ায়।

বানেছার আকুলিবিকুলি দেখে পোলাপানরাও কাঁদে। ছোটভাই নাজুকে কোন ফাঁকে কোলে নিয়েছে পরি। বদু দাঁড়িয়ে আছে জরির গা ঘেঁষে। নাদের আর হামেদ এতদূর পথ হেঁটে এসে ক্লান্ত। ঢেঁকিঘরের ওটার সামনে বসে আছে দুই ভাই। মাথা নিচু করে কাঁদছে তারা।

এসময় রাবি আর বাদলা এল ছুটতে ছুটতে।

বাদলার পরনে মুসলমানির দিনকার সেই লুঙ্গিটা। গায়ে আর কিছু নাই। মুসলমানির পর এই কয়েকদিনে সে যেন আরও বড় হয়ে গেছে। এই বাড়িতে এসেই চলে গেল নাদের-হামেদের কাছে আর রাবি এসে জড়িয়ে ধরল উঠানে আছাড়ি পিছাড়ি করে কাদা বানেছাকে। এমুন কইরেন না ভাবিছাব, এমুন কইরেন না। আল্লারে ডাক পারেন, আল্লায় রহম করব।

বানেছা বিলাপ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, হেয় যেদিন থিকা আহে না হেদিন থিকা দিনরাইত চব্বিশ ঘণ্টা আমি খালি আল্লারে ডাক পাড়ি। পোলাপান ঘুমাইয়া থাকে, আমার ঘুম আহে না। আমি ঘুমাইতে পারি না। মনে মনে খালি আল্লারে ডাক পাড়ি, কই, আল্লা আমার মানুষটারে তুমি ফিরাইয়া আনো। আমি তোমার নামে একহান মুরগি সতকা (সদগা) দিমু। আল্লায় তো আমার কথা হোনে না রে বইন। হেয় তো ফিরত আহে না।

আবার কান্না বাড়ে বানেছার। ফিরত আইবো কেমতে? বাইচ্চা থাকলে তো আইবো? বাইচ্চা হেয় নাই। হেরে ডাকাইতেঐ খাইছে। টেকাপয়সা মালছামান রাইক্কা হেরে মাইরা এমুন হানে হালাই দিছে দুইন্নাইর কেঐ বিচড়াইয়া পাইবো না।

বানেছাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে রাবি। অলইক্কা কথা কইয়েন না ভাবিছাব, অলইক্কা কথা কইয়েন না। কিছু অয় নাই হের। হেয় বাইচ্চা আছে।

বাইচ্চা থাকলে বাইত্তে আহে না ক্যা? কই গিয়া পলাই রইছে? কোনওদিন তো এমুন করে নাই হেয়। হায় হায় রে, কোন গজব নাজিল অইলো আমার সংসারে! মাইয়াডারে দাফোন না করনের পাপে ধরল? হেই পাপে শেষ অইলো নাদেরের বাপে! হায় হায় এইডা কী অইলো! কী অইলো!

জরির পাশে দাঁড়ানো বদু কাঁদতে কাঁদতে বলল, মায় এমুন করে ক্যা? মা’রে এমুন করতে দেইক্কা আমারও তো কান্দন আহে।

জরি চোখ মুছতে মুছতে বলল, মায় কান্দে বাবার লেইগা। আমরা বেবাকতেঐ কানতাছি বাবার লেইগা।

বাবারে মাইরা হালাইছে কারা?

মায় তো কয় ডাকাইতে।

দাদারা কী কয়?

অরা কিছু কয় না।

পরির কোলে তখন নাজু শব্দ করে কাঁদতে শুরু করেছে। বাড়ির সবার কান্নাকাটির অর্থ বুঝতে পারছে না। সে কাঁদছে সবাইকে কাঁদতে দেখে।

অন্য সময় হলে ভাইকে থামাবার চেষ্টা করত পরি। এখন করছে না। এখন তার চোখেও পানি। বুকটা কেমন করছে বাবার জন্য। জন্মের পর থেকে দেখে আসা মানুষটা হঠাৎ কোথায় চলে গেল! যদি সত্যি সত্যি ডাকাতে তাকে মেরে ফেলে থাকে তা হলে আর কোনওদিনও ফিরে আসবে না। জীবনে কোনওদিনও বাবার সঙ্গে পরির আর দেখা হবে না।

এসব ভেবে পরির কান্না আরও গম্ভীর হচ্ছিল। মনে পড়ল খুকি মারা যাওয়ার পর নূরজাহানদের বাড়ি গিয়ে বাবাকে নিয়ে অনেক কথা নূরজাহানকে সে বলেছিল। খুকির দাফন কাফন করেনি দেখে বাবার ওপর রাগ করেছিল। সেসব কথাই নূরজাহানকে বলেছিল।

এখন ওসব কথা ভেবে মন কেমন করতে লাগল। যদিও বাবা কোনওদিন জানতে পারবে না, তবু তো পরি তাকে ছোট করেছে নূরজাহানের কাছে। নিজের বাপের বদনাম করেছে অন্যের কাছে। এটা কি ঠিক হয়েছে?

এসব কথা যতই মনে পড়ছিল ততই ভিতর থেকে কান্নার স্রোত ঠেলে উঠছিল পরির চোখে। মুখ নিচু করে রাখার ফলে চোখের টপটপ করে ঝরছিল উঠানের মাটিতে।

বানেছার চোখের পানি ফুরায়া আসছে, বিলাপ করতে করতে ক্লান্ত হয়েছে সে। এখন ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। পাশে বসে দুই হাতে খুবই আন্তরিক ভঙ্গিতে তাকে জড়িয়ে রেখেছে রাবি।

বানেছা কান্নাকাতর অসহায় গলায় বলল, আসলে তার কোনও দোষ নাই। হেয় বড় ভাল মানুষ। বেবাক দোষ আমার। এই সংসারে অলক্কি লাগনের মূলে অইলাম আমি। এতডি পোলাপান অইছে আমার লেইগাঐ। হেয় বহুত চেষ্টা করছে, আমি হের কথা হুনি নাই। আর হেয় যেই ডরান ডরায় আমারে! আমি যা কই হেইডাঐ হোনে। আমার উপরে দিয়া কোনও কথা কোনওদিনও কয় নাই। তার কথা হোনলে আমার ভাল অইতো। আমি মানুষ ভাল না। আমি বহুত বজ্জাত মানুষ। আমিঐ নষ্টের নারদ। আমার লেইগা আইজ এই দশা অইলো সংসারের। আমার লেইগাঐ মানুষটার আইজ এই দশা। আমার লেইগা। মরছে হেয়।

বানেছা আবার কাঁদতে লাগল। অন্নাই কি খালি আমি হের লগে করছি, সবথিকা বড় অন্নাই তো করছি আমার হরির লগে। হরি অইলো মা’র লাহান, হেই মা’রে আমি একওক্ত খাওন। দেই নাই। একদিন, খুকি তহন পেড়ে, বিয়ানবেলা পোলাপান লইয়া বউয়া খাইতাছিলাম, কত নিয়ারা (অনুনয়) হরি আমারে করলো, আমার পোলাপানরে করলো, আমি হেরে একমুঠ বউয়া খাইতে দেই নাই। উলটা মাগিমুগি কইয়া কত বকলাম। আমার হরি কুটনি। অইছিলো আমার লেইগা। চুন্নি অইছিলো পেডের দায়ে। হেইডাও আমার লেইগাঐ। আমার ডরে নাদেরের বাপে এই হগল লইয়া কথা কয় নাই। দুই-চাইরদিন হরিরে আমি মারছিও। দেইক্কাও হেই মাইর দেহে নাই নাদেরের বাপে। ছেমায় বইয়া অন্যমিহি চাইয়া। চাইয়া বিড়ি টানছে। কোনও কোনও সমায় দুক্কে চক্ক পুচছে, আমি দেকছি। তাও আমারে কিছু কয় নাই। অহন আমার মনে অয়, আমিও তো একদিন হরি অমু। নাদের হামেদ বদু নাজুর বউ আইবো সংসারে। আমি আমার হরির লগে যা করছি, আমার পোলার বউরা যুদি আমার লগে অমুন করে? যুদি আমারে তারা মারে আর আমার পোলারা চাইয়া চাইয়া দেহে, আমার মনডা তহন কেমুন লাগবো?

বানেছা আবার বুক চাপড়ায়, আবার বিলাপ করে। হায় হায় রে, কী কাম আমি আমার হরির লগে করছি। এত অন্নাই করছি তার লগে, আমার মাইর খাইয়া কানতে কানতে বাইত থিকা বাইর অইয়া গেছে, তয় কোনওদিন আমারে আর তার পোলারে, নাতিনাতকুড়রে কোনও অদিশাপ দেয় নাই। সাত আছমানের উপরে বইয়া আল্লায় এই হগল কাম দেকছে, তহন কোনও গজব আমার উপরে নাজিল করে নাই। বহুদিন পর অহন করলো। হেই গজবে নাদেরের বাপে গেলো। আল্লাগো আল্লা, আমার পাপের শাস্তি তুমি আমারে এমতে দিলা? এতডি এন্দাগেন্দা লইয়া আমি অহন কী করুম? খাওয়ামু কী অগো? বাঁচাইয়া রাখুম কেমতে? অন্নাই আমি করছিলাম শাস্তি তুমি আমারে দিতা। আমারে উড়াইয়া নিতা? নাদেরের বাপরে নিলা ক্যা? হেয় তো কোনও অন্নাই করে নাই। হেয় বহুত ভাল মানুষ আছিলো। হেরে তুমি এই শাস্তিডা ক্যান দিলা আল্লা, ক্যান দিলা?

মায়ের কথা শুনে পরির এলোমেলো হয়ে গেল। নিজেকে যেন সে আর চিনতে পারল না। নাজুকে কোল থেকে নামিয়ে দুইহাতে চোখ মুছে খুবই মারমুখী ভঙ্গিতে উঠানের মাটিতে ছেড়ে পেছড়ে বসে থাকা বানেছার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চিৎকার করে বলল, কীর লেইগা এমুন করছো তুমি? দাদি তোমার কাছে কী অন্নাই করছিলো যে দাদির লগে তুমি এমুন করছো? দাদি কি তোমারডা খাইতো না তার পোলারডা খাইতো? হরির কাছে বউ তো মাইয়ার লাহান। তুমি তারে যহন তহন মারছো। অহন যুদি আমি তোমারে মারি তোমার কেমুন লাগবো? আঁ, কেমুন লাগবো তোমার?

পরির আচরণে কান্না ভুলে হতভম্ব হল বানেছা। অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল মেয়ের মুখের দিকে। তাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকা রাবির অবস্থাও একই রকম। সেও তাকিয়ে আছে পরির দিকে। ঢেঁকিঘরের ওটায় বসা নাদের-হামেদ কান্না ভুলে তাকিয়েছে পরির দিকে, বাদলাও তাকিয়েছে, জরি-বদু এমনকী অবুঝ নাজুও।

পরি কোনও কিছুই খেয়াল করল না, কোনও দিকেই তাকাল না। নাক ফুলিয়ে তেজালো গলায় চিৎকার করে বলল, আমার বাপে কিরপিন অইছিলো তোমার লেইগা। খুকির দাফোন কাফোন অয় নাই তোমার লেইগা। সংসারে বেডারা যা কয় তা অয়, আমগো সংসারে। বাবার কথার কোনও দাম আছিলো না। তুমি যা কইছো তাঐ অইছে। বাবার কথায় সংসার। চললে এই দশা আইজ অয় না। তুমি চাইলে এতডি ভাইবইনও আমগো অইতো না। তুমি। মনে করো আমি ছোড় মানুষ, আমি এই হগল কই ক্যা? ছোড অইলেও আমি সব জানি। নূরজাহান বুজি বেক কিছু আমারে হিগায় দিছে।

দাঁতে দাঁত চেপে পরি বলল, তুমি একটা বদ মাইয়াছেইলা। তোমার লেইগা বাবায় মরছে। এতডি ভাইবইন যুদি আমরা না অইতাম তয় গাওয়াল করন লাগতো না বাবার। খেতখোলা চুইয়া, গিরস্তালি কইরাঐ সংসার ভাল চলতো। গাওয়াল না করতে অইলে, গেরামে গেরামে ভার কান্দে লইয়া দৌড়াইতে অইলে ডাকাইতে বাবারে পাইতো কই? মারতো কেমতে? বাবায় মরছে তোমার লেইগা। তুমি একটা বদ মাইয়াছেইলা, শয়তান। মাইয়াছেইলা। তুমি মানুষ না, তুমি পেতনি।

বানেছাকে ছেড়ে রাবি তখন হাছড় পাছড় করে উঠেছে। উঠে দুইহাতে জড়িয়ে ধরেছে পরিকে। হায় হায় তুই আতকা এমুন শুরু করলি ক্যা মা? এই অবস্থায় মা’র লগে কেঐ এমুন করে? চুপ কর মা, চুপ কর।

রাগে ক্রোধে পরি তখন ফোঁস ফোঁস করে হাঁপাচ্ছে। কোন ফাঁকে নতুন করে কান্নাও আসছে, কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল তার। তবু বলল, বাবায় মরছে এই মাগির লেইগা। আমরা এতিম অইছি এই মাগির লেইগা। আমগো এতিম কইরা অহন ঢংগের কান্দন কান্দে মাগি।

পরির মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে থামাবার চেষ্টা করল রাবি। এমুন করিচ না মা, এমুন কথা কইচ না। মা’র লগে কে এমুন করে না। বিপদের দিনে ধৈর্য ধরতে অয়। আল্লার নাম ল।

বানেছা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, না কউক। কইতে দে অরে। যা মনে লয় কউক। সত্য কথাই তো কয়। আমিঐত্তো বেবাক সব্বনাশের মূল। পোলাপানের কথা নি, কয়দিন পর যহন ভাত দিতে না পারুম পোলাপানরে তহন অগো আতের মাইরও খাওন লাগবো। গুণার শাস্তি জনমভর এইভাবেঐ আল্লায় আমারে দিব।

এতক্ষণ ধরে এই বাড়িতে আছে, একটা কথাও বাদলা বলেনি। এখন পরিবেশ ঠান্ডা হওয়ার পর বলল, আইজ্জা কাকারে ডাকাইতেঐ মারছে না হেয় অহনও বাইচ্চা রইছে, না কী অইছে তার এইডা তো কেঐ কইতে পারে না। আগে তো জানন উচিত আসলে কী অইছে।

নাদের বলল, হেইডা আমরা কেমতে জানুম?

একহান কাম করলেঐ জানোন যাইবো। জিন ডাক দেওন লাগবো। জিনে আইয়া বেবাক কিছু কইয়া দিবো।

শুনে এই অবস্থায়ও বানেছা উৎসাহী হয়ে উঠল। নাদের-হামেদের দিকে তাকিয়ে বলল, তয় অহনঐ ফকির বাইত্তে যা বাজানরা। আমি বাদলারে দিয়া এইমিহি সব জোগাড় করি। তরা গিয়া ফকিরকে ডাইক্কা লইয়ায়। আইজঐ জিন ডাক দেই।

জিন ডাকার কথায় হঠাৎ করেই আশার সঞ্চার হল মানুষগুলির মধ্যে। সাড়া পড়ল। নাদের-হামেদ খুবই উৎসাহের সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। সকালবেলা দিঘলি গেছে, এতদূর হেঁটে গিয়ে এতদূর থেকে ফিরা আসছে, তার ওপর বাবাকে নিয়ে কান্নাকাটি, সব ভুলে গেল তারা। দুইজন একত্রে বলল, আইচ্ছা যাইতাছি।

তারপর দৌড়ে নেমে গেল ভাঙনের দিকে।

বাদলা তখন রাবিকে বলছে, ওমা, আমি আইজ রাইত্রে এই বাইত্তে থাকুম। জিন ডাক দেওন দেহুম।

রাবি নরম গলায় বলল, আইচ্ছা থাকিচ।

.

এখন নাদের হাঁটছে তার স্বভাব মতন।

হামেদ কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারছে না ভাইর সঙ্গে। নাদের হাঁটছে, তার সঙ্গে তাল রাখার জন্য হামেদ ছুটছে।

রোদ নরম হতে শুরু করেছে। দিন ফুরিয়ে এল। চারদিককার চকমাঠ গ্রাম গাছপালা মানুষের ঘরবাড়ি আর ঢাকা থেকে উঁচু হয়ে আসা ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক সবখানেই দিনশেষের রোদ ফুরাতে বসেছে।

নাদেরের পিছন পিছন চকপাথালে হামেদ ছুটছিল দোগাছি বরাবর। দোগাছি গ্রামে ঢোকার মুখে সেজাল খাঁ ফকিরের বাড়ি। তিনি গত হয়েছেন কয়েক বছর হল। তার উপর ছিল জিনের আছড়। তিনটা জিন সারাক্ষণ থাকত তাঁর সঙ্গে। নিদানে পড়া মানুষ সেজাল। খা ফকিরকে ডেকে রাতের আঁধারে নিজঘরে জিন ডাকিয়ে মুশকিলের আছান চাইত। জিনেরা পথ বাতলে দিয়ে যেত।

সেজাল খাঁ ফকির গত হওয়ার পর তাঁর ছেলে মেয়ে স্ত্রী কেউ পায়নি জিন, পেয়েছে পাশের বাড়ির আক্কাস মাঝি। আক্কাস এই গ্রামের লোক না, কালিরখিলের ওদিককার বেলদার বাড়ির লোক। খরালিকালে ঘোড়া বাইতো। নিজেদের রোগা ঘোড়াগুলির পিঠে চাপিয়ে হাটবাজারে মাল বইত, আর বর্ষাকালে বাইতো কেরায়া নৌকা। লঞ্চঘাট থেকে, হাটবাজার থেকে লোকজন পৌঁছাত যার যার বাড়িতে। কখনও কখনও নাইওরি আনা নেওয়ার কাজও করত।

এই আক্কাস একসময় সেজাল খাঁ-র মুরিদ হয়ে গেল। যুবক বয়স। বিয়াশাদি করে নাই। সংসার মা বাপ ভাই বোন ঘোড়া আর নৌকা বাওয়া বাদ দিয়ে সারাক্ষণ ফকিরের সঙ্গে। ফকির যেখানেই জিন ডাক দিতে যায়, ছায়ার মতো তার লগে আছে আক্কাস। গানের গলাটা ভাল। জিন ডাক দেবার সময়কার গানগুলি খুবই ভাল গায়। অতি নরম বিনয়ী ভালমানুষ। জিন ডাক দেওয়ার কাজ না থাকলেও ফকিরের লগে লগেই থাকে। বাড়ির কাজকাম সব করে দেয়। সেজাল খ ফকির তো তাকে পছন্দ করতই, লগের তিনটা জিনও খুবই পছন্দ করত আক্কাসকে। এই কারণেই ফকির বলেছিলেন, আমি মইরা যাওনের পর বাবারা তো আর অন্য কেঐর কাছে যাইতে চাইবে না, তরেঐ দিয়া যামু তাগো। ডাক দেওনের নিয়ম কানুন মন্ত্র বেবাক হিগাইয়া দিয়া যামু।

ফকির করেছেনও তাই।

মরণ ঘনিয়ে আসার আগে আগেই আক্কাসকে দিয়ে গেছেন জিন। এখন আক্কাসই ডাকাডাকির কাজটা করে। সেজাল খাঁ ফকিরের রোজগারটা তারই হয়।

মরণের কয়েক বছর আগে অবশ্য আরেকটা কাজ আক্কাসের জন্য করেছিলেন ফকির। পাশের বাড়িটা সেজাল খাঁ ফকিরের এক জ্ঞাতির। সেই জ্ঞাতিবাড়ির তিন শরিকের মাজারো শরিকের এতিম এক মেয়ে ছিল, নাম বকুলি, বকুলির লগে আক্কাসের বিয়া দিয়া দিলেন। আক্কাস হয়ে গেল সেই বাড়ির ঘরজামাই। ফলে সারাক্ষণ সেজাল খাঁ ফকিরের বাড়িতে আর পড়ে থাকতে হয় না তাঁর। বকুলির আদরে সোহাগে শ্বশুরবাড়িতেই থাকে। দরকার হলে বারবাড়ির দিকে গিয়ে ফকির তাকে গলা ছেড়ে ডাক দেয়, পলকে আক্কাস এসে হাজির। ফকির মারা যাওয়ার পর তার ঘরের জিনের আসন তুলে নিজের ঘরে নিয়া আসছে। আক্কাস। সকাল সন্ধ্যা আগরবাতি মোমবাতি জ্বালায় সেখানে। জবা ফুল বাতাসা আর আধা গেলাস কাঁচা দুধ রাখে আসনে। যখন ইচ্ছা জিন তিনটা এখন আক্কাসের ঘরেই আসা।–যাওয়া করে। দুধ বাতাসা খেয়ে যায়। কাঠের তৈরি বড় জলচৌকি সাইজের আসনে যখন তখন এসে বসে থাকে, আক্কাস ছাড়া কেউ তাদের দেখতে পায় না বুঝতেও পারে না, তারা আছে, না নাই।

সেজাল খা ফকির মারা যাওয়ার পর চুল দাড়িমোচ আর পোশাক একেবারেই ফকিরের মতো করে ফেলেছে আক্কাস। গেরুয়া রঙের ফতুয়া আর লুঙ্গি, গরমকাল নাই, শীতকাল নাই কাঁধে খয়েরি রঙের পুরানা চাদর। ফকিরের মতন ঘনঘন বিড়ি খাওয়াটাও রপ্ত করেছে। অর্থাৎ সবকিছু মিলিয়ে আক্কাসই এখন সেজাল খাঁ ফকির। মরে গিয়েও সেজাল খা যেন এখনও বেঁচে আছে আক্কাসের মধ্যে।

আক্কাসকে লোকে ডাকে ফকির সাব’। সেজাল খাঁ ফকির বেঁচে থাকতে জিন ডাকার আসরে দিতে হত পাঁচ টাকা। এখন পঁচিশ টাকা। বেশি দিলে আপত্তি নাই। কম দিলে হাজার ডাকলেও জিন আসবে না। কাজ হবে না। গান গাইতে গাইতে গলা ছিঁড়ে ফেললে ঘরের চালায় এসে বসে থাকবে জিন, কম টাকার আসরে নামবে না। শব্দও করবে চালায়, জানান দিবে, আমরা আছি কিন্তু নামব না।

এসব কথা দেশগ্রামের সব মানুষই জানে।

হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা পিছনে পড়েছিল হামেদ। দৌড় দিয়ে এসে ভাইকে ধরল। ক্লান্ত গলায় বলল, ওই দাদা, এতো জোরে আডচ ক্যা? আমি তর লগে আইট্টা পারি না! আউজকার দিনে কী আডাডা আটছি, দিগলি গেছি আইছি, আবার অহন যাইতাছি দোকাছি, আমার পাও দুইহান ভাইঙ্গা আহে দাদা। আস্তে হাঁট।

ভাইয়ের কথা শুনে মায়া লাগল নাদেরের। দাঁড়াল। তুই তো একলা দিগলি যাচ নাই, আমিও তো গেছি।

হামেদ হাসল। তুই বড়। আমি কি তর লাহান নি?

তয় তাড়াতাড়ি না গেলে ফকির সাবরে যুদি না পাই!

আমার মনে অয় পামু। আইজ আমার যা যা মনে অইছে সবঐ অইছে।

কেমুন? দিগলি যাওনের সমায় তুই একবার কইলি গিয়া যুদি ভাঙ্গারিকাকারে না পাই তয় এতাহানি জাগা আইট্টা আইয়া লাভ কী অইলো? আমি কইলাম, তুই চিন্তা করি না। দেকবি ভাঙ্গারিকাকায় দোকানে আছে।

হ।

অহনও দেকবি ফকির সাবে বাইত্তে আছে।

তয় তো ভালঐ।

নাদেরের লগে পা চালিয়ে খানিকদূর হাঁটল হামেদ। ওই দাদা, সেজাল খাঁ ফকিরে জিন পাইছিলো কেমতে হেই ঘডনাডা তুই জানচ?

হ জানুম না ক্যা?

তয় ইট্টু ক। কথা হোনতে হোনতে আড়নের কষ্ট উদিস পামু না।

নাদের একবার ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাল। এই হগল বহুতদিন আগের কথা। সেজাল খাঁ ফকির তহন পোলাপান। আমার থিকা পাঁচ-ছয় বচ্ছরের বড় অইবো। বিয়াশাদি করে নাই। বাপ চাচা ভাই বেরাদরগো লগে গিরস্তালি করে। ওই যে বিলের বাড়িডা আর গোরস্তান দেহচ ওই মিহি ম্যালা জমিন আছিলো তাগো।

বুজছি। তারবাদে?

হেই বচ্ছর এমুন ফাল্গুন চইত মাস, সেজাল খা ফকিরগো বাইত্তে বসন্ত উটছে। বসন্তে দুইজন মইরাও গেছে। খালি সেজাল খাঁ-রঐ ওডে নাই। আবার বিলের জমিনে হেই বচ্ছর বাঙ্গি বুনছে ফকিররা। বেদম বাঙ্গি অইছে খেতে। বেইনের (বেতফল) লাহান। পদ্মার হেইপার থিকা ছিপনাও লইয়া বাঙ্গি চোররা আহে। গাঙ্গের পারে নাও থুইয়া বিলে আইয়া ছালায় ভইরা বাঙ্গি চুরি কইরা, নৌকা ভইরা লইয়া যায়। রাইত্রে বিলে গিয়া খেত পাহারা না দিলে রক্ষা নাই। তয় ফকির বাড়ির বেবাকতের তো বসন্ত উটছে, কে যাইবো খেত পাহারা দিতে। আর একজনে তো রাইত ভইরা বিলে গিয়া বইয়া থাকতে পারবো না। যাইতে হয় তিন-চাইরজনে মিলা। সবমিহিঐ ঝামেলা।

একটু থামল নাদের। তারপর বলল, এক রাইতে ম্যাটম্যাইট্টা জোছনা উটছে। বাড়ির উডানে বাইর অইয়া সেজাল খাঁ ফকিরের মনে অইলো বিয়ান অইয়া গেছে। কয়দিন ধইরা কেঐ বাঙ্গি খেত পাহারা দিতে যায় না। খেতে কি বাঙ্গি আছে না বেবাকঐ চোরে লইয়া গেছে ইট্ট দেইক্কাহি। হেয় গেছে বিলে।

হামেদ বলল, আমার মনে অয় তহন বিয়ান অয় নাই। তহন রাইত দোফর।

নাদের অবাক হল। কেমতে বুজলি?

ওই যে জোছনা রাইত্রের কথা কইলি! ম্যাটম্যাইট্টা জোছনা আছিলো।

হ ঠিকঐ কইছচ। তহন রাইত দোফর।

আইচ্ছা ক। তারবাদে?

সেজাল খাঁ একলা একলা গেছে বিলে। গিয়া অবাক। চাইরমিহি এমুন নিটাল, একজন মানুষও নাই কোনওহানে। থাকবো কেমতে, তহন তো রাইত দোফর। তয় মনের মইধ্যে কেন জানি ডর ভয়ও নাই ফকিরের। বাইত্তে এমুন বসন্ত উটছে বেবাকতের, দুইজন মরছে। এই অবস্থায় মাইনষের কি আর উসজ্ঞান থাকে?

হ।

এমুন সমায় ফকিরে হাঁটতে হাঁটতে আইয়া পড়ছে গোরস্তান বায়ে রাইখা তাগো খেত বরাবইর। আইয়া দেহে একজন যাইতাছে।

হামেদ অবাক হল, কেডা যাইতাছে?

নাদের তাকে একটা ধমক দিল। আগে হোনঐ।

আইচ্ছা ক।

একজন যাইতাছে, ফকিরে তারে পিছে থিকা দেকতাছে। তয় তার পাও দেহা যায় না। দেহা যায় খালি চুল। সাত-আষ্টহাত লম্বা অইবো চুল। হেয় য্যান চুলের উপরে ভর দিয়াঐ হাঁটতাছে।

কয় কী?

হ। এমুন দেইক্কা সেজাল খাঁ ফকিরের মনে অইলো হেয় লিশ্চই বড় কোনও কামেল দরবেশ অইবো। এই দরবেশরে ধরতে পারলে কাম অইবো। বসন্ত ভাল অইয়া যাইবো বাড়ির মাইনষের। আর কেঐ মরবো না। এই চিন্তা কইরা দিকপাশ আর চাইলো না সেজাল খাঁ ফকিরে। পিছ থিকা দৌড়াইয়া গিয়া প্যাচাইয়া ধরলো তারে। লগে লগে এমুন একহান ঝাড়া হেয় দিলো, ফকির তিন-চাইর কানি জমিনের হেই পারে গিয়া পড়লো। তয় দুকু পাইলো না ইট্টুও। উইট্টা দৌড়াইয়া গিয়া আবার আগের লাহান প্যাচাইয়া ধরলো। এইবারও ঝাড়া খাইলো, এইবারও গিয়া পড়লো তিন-চাইর কানি জমিনের হেইপারে। এইভাবে তিনবার।

একটু থামল নাদের।

হামেদ বলল, তারবাদে?

শেষবারের বার ঝাড়া হেয় আর মারলো না। ফকিরের মিহি মুখ ফিরাইলো। ওরে নাদান, কী চাচ?

ফকির সাবে কথা কইবো কী, তার চেহারা দেইক্কা টাস্কি লাইগ্যা গেল। এমুন নূরানি চেহারা, য্যান পুন্নিমার চান। হেয় আবার কইলো, ক কী চাচ? ফকির সাবে কাইন্দা। দিলো। বাবা, আমার বেবাক গেছে। বাইত্তে বসন্ত। আপনে দয়া না করলে বেবাকতে মরবো। হেয় কইলো, ঘর দুয়ার সাফ সুতরা কইরা রাখিস। কাইল হাজের বেলায় তগো বাইত্তে যামু।

ফকির সাবে বাইত্তে আইয়া এইকথা কেঐরে কইলো না। তয় নিজের ঘরহান সাফ সুতরা কইরা রাকলো। হাজের পর হেরা আইলো। সাতজন। চোকে দেহা যায় না কেঐরে, খালি উদিস পাওয়া যায়, কথা হুনা যায়। কইলো, তর ঘরে আসন দিচ। আমরা তর কাছে আমু। তয় এই বাইত থিকা বসন্তে আরেকজন যাইবো, তারবাদে সব ভাল অইয়া। যাইবো। ফকির সাবে জিগাইলো, বাবা আপনেরা কারা? কইলো, জিন। ডাকিনী যুগিনী। হুইন্না ফকির সাবে ডরাইয়া গেল। হেরা কইলো, ডরাইচ না। এমতে এমতে ডাক দিবি, আমরা আমু। আইয়া নিদান থিকা উদ্দার করুম। এইভাবে জিনডিরে পাইছিলোে সেজাল। খ ফকিরে।

হামেদ বলল, আর ওই যে কইছিলো আরেকজন যাইবো, হেইডার অর্থ কী? বসন্তে আরেকজন মরছিলো?

হ। ফকিরের ছোডভাই মরলো দুইদিন পর। তারবাদে বেবাকতে সাইরা উটলো।

অহনও কি সাতজন জিনঐ আছে?

না। আছে চাইরজন।

অন্য তিনজন কো?

ফকিরে বাইচ্চা থাকতে আসামের আরেক ফকিররে তিনহান জিন দিয়া দিছিলো। হেই তিনডা আছিলো সাই পাজি। ইট্টু এদিক ওদিক অইলেঐ ফকিররে বেদম মাইর দিতো। একবার বাড়ির তেতইল গাছ থিকা হালাই দিছিলো।

আর আসামের হেই ফকির সেজাল খাঁ-রে কী দিছিলো?

বাওন্ন জোড়া বান হিগাইছিলো, বানের ফিরানি হিগাইছিলো।

ওই হগলও কি আক্কাস ফকিররে দিয়া গেছে সেজাল খাঁ ফকিরে?

কইতে পারি না।

ততক্ষণে আক্কাস ফকিরের বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে ওরা। রোদ নেই। চোত মাসের শেষ বিকালে কোনও কোনওদিন একটা হাওয়া বইতে শুরু করে চকেমাঠে। সেই হাওয়াটা আজ বইছে। ফকির বাড়ির উঠানে উঠতে উঠতে সেই হাওয়ার পরশে নাদেরের। কী হল কে জানে, হামেদের মন ফুরফুরা হয়ে গেল। মনে হল ফকির সাবকে অবশ্যই বাড়িতে পাওয়া যাবে। আজ রাতেই জিনেরা তাদের ঘরে এসে বলে যাবে, ডাকাতে মারেনি। আজিজ গাওয়ালকে। সে বেঁচেই আছে। যে কোনওদিন মালছামান কাঁধে বাড়ি ফিরে আসবে।

আক্কাস ফকিরের উঠানে ফকিরের পোলাপানরা বউয়াছি খেলছিল, বড়ঘরের দরজায় বসে হারিকেনের চিমনি পরিষ্কার করছে বকুলি, নাদের-হামেদের দিকে ফিরেও তাকাল না কেউ।

নাদের গলা খাকারি দিল। বকুলি তাকাল তাদের দিকে।

নাদের বিনীত গলায় বলল, ফকির সাবে আছে?

আছে। আসনে বাত্তি দেয়।

ইট্টু ডাক দিবেন।

দিতাছি।

বকুলি ডাকল। হোনছেন, আপনের কাছে মানুষ আইছে।

বেরিয়ে এল আক্কাস। পরনে লুঙ্গি আর গেরুয়া পাঞ্জাবি। মুখে দাড়ি মোচ, মাথায় বাবরি চুল। চুল দাড়ি সবই তেল চকচকা।

নাদের-হামেদের দিকে তাকিয়ে বলল, কই থিকা আইছো?

নাদের বলল, মেদিনমণ্ডল থিকা। আমার বাপের নাম আজিজ গাওয়াল।

নামটা শুনে উৎফুল হল আক্কাস। বুজছি, বুজছি। গাওয়ালের তো বলে পাঁচ-সাতদিন ধইরা খবর নাই। আসন দিবা?

হ। এর লেইগাঐ আইছি।

আইজঐ দিবা?

হ।

বেক ঠিকঠাক আছে?

হ ব্যবস্থা কইরাঐ আপনের কাছে আইছি।

তয় লও। অহনঐ মেলা দেই।

লন।

আক্কাস বকুলির দিকে তাকাল। আমার চাইদ্দইরহান দেও।

হারিকেনের চিমনি মোছা রেখে ঘরে ঢুকে স্বামীর চাদর নিয়ে এল বকুলি। চাদর যত্ন করে কাঁধে ফেলে আক্কাস বলল, লও মেলা দেই।

.

আমার এই আসরে আইসো দয়ালচান
আমার এই আসরে আইসো মুর্শিদচান!

আক্কাস ফকিরের লগে গলা মিলাচ্ছে নাদের হামেদ বাদলা। চৌকির ওপর পরি জরি বদু নাজুকে নিয়ে বসে আছে বানেছা। নাজু ঘুমিয়ে পড়েছে মায়ের কোলে। বদু পরির কোল ঘেঁষে বসে আছে। জরি বসে আছে মা-বোনের গা ঘেঁষে।

মেঝেতে হোগলার উপর বোয়া সাদা চাদর বিছানো হয়েছে। তার উপর পশ্চিমমুখী হয়ে বসেছে আক্কাস ফকির। তার পিছনে দূরত্ব রেখে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছে নাদের হামেদ বাদলা। তাদের পিছনে বন্ধ দরজা।

আক্কাস ফকিরের সামনে জলচৌকির উপর আসন। আসনে কয়েকটা লাল রঙের জবাফুল, তার পাশে অ্যালুমিনিয়ামে বাটিতে আখিগুড়ের ছোট সাইজের বাতাসা, কাঁচের গ্লাসে গলা তরি ভরা কাঁচাদুধ আর এক গ্লাস পানি। তার পাশে টিনের চাউল ভরা মগে একথোকা আগরবাতি জ্বলছে। চারটা চিকন চিকন মোমবাতি জ্বলছে জলচৌকির চারপাশে। এসবের মাঝমধ্যিখানে দুইখান দশ আর একখান পাঁচটাকার নোট ভাঁজ করে রাখা।

আসরে বসার আগেই ঘরের কুপিবাতি সব নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন শুধু মোমের আলো। সেই আলোয় গভীর রাতের ঘরখানি গা ছমছমা হয়ে আছে।

নাদের হামেদকে ফকিরবাড়ি পাঠিয়ে বাদলাকে বানেছা পাঠিয়েছিল মাওয়ার বাজারে। আগরবাতি মোমবাতি বাতাসা আর দুধ আনতে গিয়ে মালেক দরবেশের বাড়ি থেকে জবাফুলগুলিও জোগাড় করে এনেছিল বাদলা। খুবই কাজের ছেলে। চট করেই আসন গুছাবার কাজগুলি করে ফেলেছিল। বানেছার শরীর মন কোনওটাই চলছিল না বলে ফকির সাহেবের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাটা করে দিয়ে গিয়েছিল রাবি। ঘোপায় দুইখান কইমাছ জিয়ানো ছিল। পিয়াজ মশলা দিয়ে সুন্দর করে রান্না করে দিয়ে গেছে সেই মাছ। ঢেঁকিছাটা আলা চাউলের (আতপচালের) ভাত রান্না করে দিয়ে গেছে। মাছ তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়ার পর দুধভাত খাওয়ার স্বভাব ফকির সাবের। ঘন দুধের লগে একদলা খাজুরা মিঠাই আর সামান্য ভাত এই না হলে তার খাওয়া শেষ হয় না। সেই ব্যবস্থাও রাবিই করে গিয়েছিল। প্রথমেই পোলাপানদের খাওয়াইয়া নিজে কোনওরকমে কয়েক লোকমা মুখে দিয়ে ফকির সাহেবকে খেতে দিয়েছিল বানেছা। তারপর দরোজা বন্ধ করে গুছগাছ করে বসেছে।

বাইরে তখন বেশ রাত। অন্ধকারে থইথই করছে চারদিক। নিজেদের নিয়মে ডেকে যাচ্ছে ঝিঁঝিপোকারা। গাছের পাতায় কখনও কখনও একটুখানি হাওয়ার শব্দ। ডানায় মৃদুশব্দ তুলে আকাশ পাথালে উড়ে যাচ্ছিল দুই-একটি বাদুড়।

ফকির তখন ধ্যানীভঙ্গিতে বসেছে আসনের সামনে। বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছে। ঘরের ভিতর শব্দ নাই। এমন চুপচাপ, সবাই যেন শ্বাসও ফেলছে শব্দ বাঁচিয়ে।

অনেকক্ষণ পর মন্ত্রপড়া শেষ করল ফকির। নিয়মমতো সাবধান করল সবাইকে। জানো ঐত্তো মাহাজনরা হাকিকি হুনতে পারে না, হাসাহাসি হুনলে একমিনিটও থাকব না। আর যুদি কেঐ পাদপোদ দেয় তয় কইলাম আর রক্ষা নাই। কামের কাম তো অইবোঐ না, আমার উপরে দিয়া আজাব যাইবো।

শুনে সবাই সাবধান হল কিন্তু কেউ কোনও কথা বলল না।

ফকির তখন প্রথমে গুনগুনাইয়া তারপর ভোলা গলায় দরুদ পড়তে লাগল। তার লগে গলা মিলাল নাদের হামেদ বাদলা। চৌকিতে বসা বানেছাও নিচু গলায় গুনগুন করছিল। মোমের আলোয় ঘরের ভিতর তৈরি হয়েছে ভৌতিক অবস্থা।

দরুদ পড়া শেষ করে বিড়বিড় করে আবার মন্ত্র পড়ে ফকির। টুকটুক করে পাঁচখান টোকা দেয় জলচৌকির আসনে। তারপর ধরে মুর্শিদি।

সেই মুর্শিদিই চলছে এখন।

মুর্শিদি শেষ হওয়ার পর আবার সব চুপচাপ। বিড়বিড় করে আবার মন্ত্র পড়ে ফকির, আবার পাঁচখান টোকা দেয় আসনে। মুখ ঘুরিয়ে হামেদের দিকে তাকায়। ওই ছেমড়া তুই বলে বহুত ভাল গান করছ?

জিন ডাক দিতে বসে আচমকা এইরকম প্রশ্ন, হামেদ থতমত খেল। কে কইছে আপনেরে?

হুনছি।

বাদলা বলল, ঠিকঐ হোনছেন। সত্যঐ ও বহুত ভাল গান গায়।

তয় অহন একহান গা। ভাল গান অইলে মাহাজনরা তাড়াতাড়ি আহে।

চৌকিতে বসা বানেছা বলল, গাও বাজান, গাও।

নাদের কনুই দিয়ে গুতা দিল। গাচ না ক্যা?

হামেদ আর দেরি করল না। গলা ছেড়ে গান ধরল,

আমারে সাজাইয়া দিয়ো নওসারও সাজন
হইলে পরে মাগো আমার বিয়ারও লগন
কাঁচা বাঁশের পালকি করে মাগো আমারে নিয়ো!

জিন ডাকার আসরের লগে গানটা মানানসই কিনা কেউ ভাবল না। তবে গান শেষ হওয়ার পর আক্কাস ফকির মুগ্ধ গলায় বলল, গলাহান খুব ভাল রে তর। এমুন কঠিন গানডা বহুত সোন্দর কইরা গাইলি। এইডা আব্দুল আলিমের নামকরা গান। গানের অর্থ জানচ?

হামেদ বলল, না।

তর জাননের কথাও না। অনেক বড় মাইনষেও জানে না।

বাদলা উৎসাহী গলায় বলল, আপনে জানেন ফকির সাব?

নাদের বলল, কী কচ বেড়া? ফকির সাব জানে না এমুন কথা আছে নি?

তয় অর্থডা আমগো কন।

অর্থ অইলো মরণ। নওসা অর্থ অইলো জামাই। বিয়ার জামাই। আর এই গানের মইধ্যে বিয়া অইলো মরণ। পোলায় মারে কইতাছে মরণের সমায় অইলে নাওয়াইয়া ধোয়াইয়া কাফোন ফিন্দাইয়া, আতর গোলাপ মাখাইয়া সাজাইয়া দিয়ো আমারে। আর কাঁচা বাঁশের পালকি অইলো লাচ টাননের খাট। যেই খাটে কইরা লাচ লইয়া যায় গোরস্থানে।

ফকিরের কথা শুনে চৌকি বসা বানেছার বুক তোলপাড় করে উঠল। যদি ডাকাতে সত্যি সত্যি মেরে ফেলে থাকে মানুষটাকে, যদি কচুরিপানাআলা পুকুরে, কাদার তলায় খুঁজে রেখে থাকে তার দেহ, যদি সত্যি তেমন হয়ে থাকে তা হলে কী দুর্ভাগ্য তার, মরণের পর কবরটাও পেল না। কাফন জানাজা কিছু পেল না। দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে তার খাট গোরস্থানমুখী বয়ে নিল না কেউ।

কেন এমন হল মানুষটার!

চট করেই তারপর সাতদিন বয়সের মেয়েটার কথা মনে পড়ল বানেছার। সামর্থ্য থাকার পরও, বাপ হয়েও মেয়ের দাফনকাফন করেনি আজিজ খরচের ভয়ে। এই অন্যায়ের প্রতিশোধই কি আল্লাহ আজিজের উপর নিল? প্রতিশোধ নেয়ার সময় আল্লাহ কি মনে মনে বলল, দেখ যে টাকার মায়ায় মেয়ের দাফনকাফন করিস নাই তুই, তারচেয়ে অনেক অনেকগুণ বেশি টাকা তোর তহবিল থেকে নিয়ে নিচ্ছে ডাকাতরা, সঙ্গে নিচ্ছে অনেক অনেক টাকা দামের মালছামান। মরা মেয়ের দাফন করিস নাই তুই, আমিও ডাকাতের হাতে তোকে মারলাম, আমিও তোর নসিবে গোর রাখলাম না। পুকুরের পানির পচা কাদার তলায় তোর লাশ থাকবে। জঙ্গলে ফেলা তোর মেয়েকে যেমন খেয়েছে শেয়াল খাটাসে, কাদার তলায় তর লাশ খাবে কচ্ছপ আর শামুক ঝিনুকে। আমার প্রতিশোধের নিয়মই এমন।

আসনে জ্বলা মোমের আলো চৌকি তরি পৌঁছায়নি। এদিকটা আবছায়া হয়ে আছে। কেউ কারও মুখ দেখতে পায় না। এই অবস্থায় স্বামীর কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে গাল বেয়ে নেমেছে কান্না, বানেছা টের পায়নি।

রাত তখন অনেকটাই গভীর। বাইরে ঝিঁঝিপোকারা ডেকেই যাচ্ছে। চেঁকিঘরের পিছন দিককার গাছে একটা কাক একবার একটু শব্দ করেছে। ঠাকুরবাড়ির দেবদারু গাছে খানিক আগে বাগ দিয়েছে কোড়ল পাখিটা। পরির কোলের কাছে শুয়ে কখন ঘুমিয়ে গেছে বদু।

আক্কাস ফকির আবার ধরেছে গান,

তোমায় কোন বনে যাইয়া লাগুর পাবো
দয়াল রে আমার।
কোন বনে যাইয়া লাগুর পাবো!

নাদের হামেদ বাদলাও আগের মতনই গলা মিলাচ্ছে।

গান গাইতে গাইতে একসময় পর পর তিনবার জলচৌকির আসনে পাঁচটা করে টোকা দিল আক্কাস ফকির। ফুঁ দিয়ে মোমবাতিগুলি নিভিয়ে দিল। ঘর ভরে গেল অন্ধকারে। ঘরের মানুষগুলির রক্ত চলাচল দ্রুত হল। ফকির টের পেয়ে গেছে মহাজনরা বাড়ির কাছাকাছি চলে আসছেন। আলোর সামান্য রেখা দেখলেও বাড়িমুখী হবেন না। তাঁরা চান গভীর অন্ধকার। অন্ধকারে প্রথমে ঘরের চালায় এসে বসবেন। তারপর হাওয়ার মতন করে ঢুকবেন ঘরে। সেই সময় ঘরের চালে বেড়ায় ধামধুম শব্দ হবে। ঘরে ঢুকে তাঁরা বসবেন জলচৌকির আসনে আর নয়তো ফকিরের পিঠে। তারা ঘরে ঢোকার লগে লগে পিঠ পেতে দিবে ফকির, একজন দুইজন তার পিঠে বসার লগে লগেই সেই ওজনে। জ্ঞান হারাবে ফকির। কিন্তু শরীর কিছুতেই নুইয়ে পড়বে না মেঝেতে। ওই অবস্থায়ই থাকবে। মহাজনরা চলে যাওয়ার পর, আলো জ্বালাবার পর দেখা যাবে সেজদার ভঙ্গিতে উপুড় হয়ে আছে ফকির তবে অজ্ঞান। তখন আসনে রাখা গ্লাসের পানিটার কয়েক ছিটা দিতে হবে তার গায়ে। তাতে জ্ঞান ফিরে পাবে সে। উঠে বসবে।

এসব নিয়ম দেশগ্রামের সবাই জানে।

এই কারণেই মোমবাতি নিভাবার লগে লগে নাদেরের এখন অন্য কিছু মনে না পড়ে পড়ছিল মহাজনরা চলে যাওয়ার পরের অবস্থাটা। ফকিরের সেজদার ভঙ্গিতে পড়ে থাকা দেহটা যেন সে দেখতে পাচ্ছিল।

ফকির তখন গাইছে,

নিদানকালে একবার দেখা দিয়ো
দয়াল রে আমার।

টিনের চালে ধামধুম শব্দ হল। ভূমিকম্পের মতন কেঁপে উঠল ঘর। বিশাল শক্তিশালী, অতিকায় কোনও প্রাণী যেন আজিজ গাওয়ালের পৈতৃকসূত্রে পাওয়া বহুকালের পুরানা চৌচালা ঘরের ঢেউটিনের বেড়া ভেঙে হুড়মুড় করে ঢুকে গেল ঘরের ভিতর। সেই শব্দ আর অন্ধকার মিলেমিশে এমন এক শ্বাসরুদ্ধকর, ভয়ার্ত পরিবেশ তৈরি হল, প্রতিটি মানুষ ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। চৌকির উপর বসা জরি একহাতে চেপে ধরল পরির হাত। পরি বসল মায়ের গা ঘেঁষে। আর নাদের হামেদ বাদলা আরও ঘন হল।

তখন অলৌকিক স্বরে সালাম দিল জিনেরা। পরপর তিনবার, তিন রকম স্বরে। বোঝা। গেল তারা তিনজন আসছেন। আর সেই সালামের শব্দে তাদের মুখ থেকে আসছিল। দারচিনি লং আর এলাচের গন্ধ। ঘরের পরিবেশ পবিত্র হয়ে যাচ্ছিল।

একজন খুনখুনা নাকিস্বরে বলল, কঁন্যা, ও কঁন্যা, কী চাঁও মা? চাঁও কী?

বানেছা বুঝল তাকে ডাকছেন মহাজনরা। জানতে চাইছেন কী চায় সে। কী জন্য ডেকেছে তাদেরকে!

বানেছা কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, কী কমু বাবারা, আপনেরা তো বেবাকঐ জানেন। নাদেরের বাপে গাওয়ালে গিয়া আর ফিরত আহে নাই। তার সম্বাত আমরা কিছু জানি না। বাইচ্চা আছে না মইরা গেছে কইতে পারি না।

অন্য একটি গলা ফ্যাসফ্যাসা স্বরে বলল, আল্লাহ বলো, আল্লাহ বলো।

অর্থাৎ আল্লার নাম নিতে বলছে। সঙ্গে শিসের মতন শব্দে দীর্ঘ একটা ফু। সেই ফুয়ের সঙ্গে ভেসে আসে দারচিনি আর লং এলাচের গন্ধ।

কিন্তু মহাজনরা কথা বলছেন না কেন? বলছেন না কেন আজিজ গাওয়াল বেঁচে আছে না ডাকাতরা সত্যি সত্যি তাকে মেরে ফেলেছে। কেন চুপ করে আছেন তারা!

তখনই বানেছার মুখে এসে পড়ে কার যেন এক গোছা চুলের পরশ! দুইবার, তিনবার। সেই পরশে কেঁপে ওঠে বানেছা। তা হলে বড় মহাজনও আজ আসছেন। তিনি হচ্ছেন জটাধারী। কোনও কথা বলেন না, শব্দ করেন না। ভাল সংবাদ থাকলে জটা বুলিয়ে দেন নিদানে পড়া মানুষের গায়ে।

বানেছাকে দিচ্ছেন।

তার মানে কী? সুসংবাদ আছে বানেছার? আজিজ গাওয়াল তা হলে মরে নাই? বেঁচে আছে। যখনই হোক ফিরে আসবে। এসব ভেবে প্রবল উত্তেজনায় বুক ফেটে যেতে চাইল বানেছার।

প্রথম কণ্ঠ তখন বলল, কঁন্যা, হাঁত পাঁতো। হাঁত পাঁতো।

অন্ধকারে নিজের ডানহাত সামনের দিকে মেলে দিল বানেছা। সঙ্গে সঙ্গে তার হাতে এসে পড়ল ছোট্ট সুগন্ধি গাছের শিকড়।

ফ্যাসফ্যাসা কণ্ঠ বলল, কাঁলো জীবের দুঁধ আর জোঁড়পুঁষ্প, বোঁঝলা, গৃঁহন কঁরবা, গৃঁহন। বুঁঝলা?

বানেছা বলল, বুঝছি বাবা, বুজছি। বরকির দুধের লগে জোড়াফুল আর এই অষইদ মিশাইয়া খামু।

প্রথম কণ্ঠ বলল, আল্লাহ বলো, আল্লাহ বলো।

অর্থাৎ বানেছা ঠিক বুঝেছে।

মহাজনরা আসার পর থেকেই নাদেরের মনে হচ্ছিল তাদের কথাবার্তা সে বুঝতে পারছে। বাবা বেঁচে আছে না মরে গেছে পরিষ্কার করে তারা কিছু বলছে না। সাহস করে সে। এখন জিজ্ঞাসা করে ফেলল, বাবায় বাইচ্চা আছে না মইরা গেছে বুজলাম না বাবারা? বাইচ্চা থাকলে বাইত্তে আইবো কবে?

বানেছা বলল, তর বোজনের কাম নাই। আমি বুজছি।

ফ্যাসফ্যাসা কণ্ঠ বলল, দুঁষ্ট বাঁলক। আল্লাহ বঁলো।

প্রথম কণ্ঠ বলল, যাঁই কঁন্যা, যাঁই বাঁলকরা। আঁসসালামাইকুম।

টিনের চাল বেড়ায় আবার সেই শব্দ। ঘরের ভৌতিক পরিবেশ পলকে কেটে গেল।

বানেছা বলল, নাদের ম্যাচটা তর কাছে না?

হ মা।

কুপি আঙ্গা।

নাদের কুপি জ্বালাল। কুপির আলোয় আড়মোড় ভাঙল সবাই, নড়েচড়ে উঠল। নাজুকে চৌকির ওপর শোয়াইয়া দিয়া নেমে এল বানেছা। তার দেখাদেখি পরি আর জরিও নামল। হামেদ বাদলা সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। শুধু ফকির সেজদার ভঙ্গিতে অজ্ঞান হয়ে আছে। আসনের সামনে।

বাদলা এগিয়ে গিয়ে আসন থেকে পানির গ্লাস নিয়ে কয়েক ছিটা পানি দিল ফকিরের গায়ে। সঙ্গে সঙ্গে জিনদের মতন ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল ফকির, সোজা হয়ে বসল। যেন গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠল। তারপর পকেট থেকে বগলা সিগ্রেটের প্যাকেট বের করে সিগ্রেট ধরাল। সিগ্রেটে বড় করে টান দিয়ে আসনের টাকাটা যত্ন করে বুকপকেটে রাখল।

দুই মেয়েকে নিয়ে বানেছা তখন বাইরে গেছে কাজ সারতে। বেগ আছে নাদের হামেদ বাদলারও। উঠানের কোণেই কাজ সেরে ফেলল তারা।

কিন্তু হামেদের মন পড়ে আছে বাতাসার দিকে। কখন বাতাসা বিলি হবে, কখন চুষে চুষে বাতাসা খাবে।

কথাটা নাদেরকে সে বললও। ওই দাদা, ঘুম আইতাছে তো! বাতাসা দে।

নাদের বাতাসা নিয়ে সবাইকে দিল। নিজেও মুখে পুরল দুইখান।

ফকির বলল, আসনের ফুল বিয়ানবেলা পুকঐরে হালাইয়া দিয়ো। আর দুধ গরম কইরা খাইয়া হালাইয়ো।

তারপর বানেছার দিকে তাকাল। মাহাজনগো কথাবার্তা আপনে বোজছেন তো ভাবিছাব?

বানেছা গদগদ গলায় বলল, বুজছি। আইজ বড় মাহাজনেও আইছিলো। নাদেরের বাপের কথা হুইন্না যহনঐ আমার মোখে জট ছোঁয়াইছে তহনঐ বুজছি হেয় বাইচ্চা আছে। বরকির দুদ জোড়াফুল আর যেই অষইদ দিছে হেই অষইদ খাইলে হেয় বাইত্তে আইয়া পড়বো।

হ। তয় কাইলঐ খাইয়া হালাইয়েন।

আইচ্ছা।

নাদেরের দিকে তাকাল ফকির। একহান বালিশ দেরে ছেমড়া। ঘুমাই।

চৌকির উপর থেকে পরিষ্কার একখান বালিশ ফকিরকে দিল নাদের।

.

দুপুরের ভাত খেয়ে চৌকিতে একটু কাত হয়েছে মরনি, পাটাতন ঘরের দরজা আবজানো, সেই দরজার বাইরে, উঠানের দিক থেকে কে ডাকল, বইন আছোনি? বইন!

গলাটা চিনতে পারল না মরনি। ধড়ফড় করে উঠে বসল। কাপড়চোপড় গুছাতে গুছাতে বলল, কেডা?

আমি আদিলউদ্দিন।

মানুষটাকে চিনতে পারল মরনি। এই বাড়িতেই তাকে একদিন, বেশ কিছুদিন আগে আশ্রয় দিয়েছে সে। এই বাড়িরই দক্ষিণের ভিটির ঘরটায় থাকে। কখন এসে ঢোকে ঘরে, কখন বেরিয়ে যায়, মরনি টের পায় না। কাজ করে মাটিয়ালের, গোড়াটাও মরনিই দিয়েছে, তবু কয়েকমাস আগের সেই প্রথম দিনের পর মানুষটির সঙ্গে তার আর দেখা হয়নি।

আজ কী মনে করে এল সে?

আবজানো দরজা পুরাপুরি খুলে মরনি বলল, কই থিকা আইলেন?

আদিলউদ্দিনের পরনে ধোয়া পুরানা লুঙ্গি, গায়ে গামছা চাদরের মতো জড়ানো, মাথায় টুপি। এই কয়েকমাসে বয়স যেন কয়েক বছর বেড়ে গেছে। কাঁচাপাকা দাড়িমোচের মুখ ভাঙাচোরা। চোখের কোলে গাঢ় হয়ে পড়েছে কালি। শরীরও রোগা। মনে হয় সামান্য ধাক্কাতেই মাত্র হাঁটতে শিখা শিশুর মতো টালমাটাল হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে।

মরনিকে দেখে ক্লিষ্টমুখে হাসল আদিলউদ্দিন। কেমুন আছো বইন?

আমি তো ভাল আছি। আপনে আছেন কেমুন?

আছি। আল্লায় রাকছে এক রকম।

কী মনে কইরা আইছেন?

ইট্টু কথার কাম আছে। মাস দেড়-দুই আগে একরাইতে বাইত্তে আইয়া মনে করছিলাম তোমারে ডাক দিমু, তোমার লগে কথা কমু, তোমার ঘরের দুয়ারের সামনে আইয়া খাড়ইছি, খালি ডাকহান দিমু, হুনি তোমার ঘরে কে জানি কান্দে। কারা জানি কথা কয়। এর লেইগা। তোমারে আর ডাক দিলাম না।

মরনি চিন্তিত হল। কবের কথা?

ওই যে যেদিন নূরজাহান মাওলানা সাবরে…

আদিলউদ্দিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই মরনি বলল, বুজছি বুজছি। আর কওন লাগবো না। নূরজাহানঐ কানতাছিল। অরে আমি জাগা দিছিলাম। অর মা-বাপে আইছিলো অরে নিতে।

আদিলউদ্দিন মুগ্ধ গলায় বলল, বহুত ভালকাম করছো বইন, বহুত ভালকাম করছো। বিপদে পড়া মাইনষেরে আশ্রয় দিলে হাসরের দিন আল্লায়ও তোমারে বেহেশতে আশ্রয় দিবো।

একটু থেমে বলল, বিপদে পড়া তিনজন মাইনষেরে তুমি এই তরি আশ্রয় দিছো। মা মরা পোলাডারে যেই বাপে হালায় দিল, হেই পোলাডারে বুকে তুইল্লা আনলা। লাইল্লা পাইল্লা ডাঙ্গর করলা। খলিফা কামে ঢাকা পাডাইলা। এর থিকা বড় আশ্রয় আর কী অয় মানুষের! তারবাদে পেডের পোলার থিকা তারে বেশি মহব্বত করো, এই মহব্বতও তো বড় একহান আশ্রয়।

মজনুর কথা ওঠায় মরনি আনমনা হয়ে গেল। উদাস চোখে দক্ষিণের ঘরের চালের উপর দিয়ে চোতমাসের রোদভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।

আদিলউদ্দিন বলল, যেই বাপে পোলারে হালাই দিছিলো, একদিন আবার হেই বাপরেও তুমি আশ্রয় দিলা। এই যে আমি অহন মাইট্টালের কাম কইরা বাইচ্চা রইছি, এইডাও তোমার লেইগাঐ।

এবার কথা বলল মরনি। এমতে কইয়েন না। আপনে আমার মজনুর বাপ। আমার বইনজামাই। একদিন বহুত অন্নাই আপনে আমার মজনুর লগে করছেন। আপনের উপরে আমার বহুত রাগ। তারপরও রাগটা আমি ধইরা রাখি নাই।

তুমি মানুষটা বড় ভাল বইন। এর লেইগাঐ রাগহান ধইরা রাখো নাই। রাখলে আমারে দেহনের লগে লগে পিছাদা পিডাইয়া খেদাইয়া দিতা।

মরনি লজ্জা পেল। থাউক এই হগল কথা কইয়েন না।

আদিলউদ্দিন বলল, নূরজাহানরে আশ্রয় দিয়াও বহুত বড় কাম তুমি করছিলা বইন। নাইলে সব্বনাশ অইয়া যাইতো মাইয়াডার। এই কামের ফল তুমি হাসরের দিন পাইবা।

এতক্ষণে মরনির মনে হল সে দাঁড়িয়ে আছে পাটাতনের উপর আর মানুষটা তার মুখামুখি উঠানে। ভাগ্যের ফেরে আজ সে মাটিয়াল কিন্তু মরনির বোনজামাই তো! মজনুর বাপ তো! যত রাগই তার ওপর থাক মরনির, অসম্মান তো তাকে সে করতে পারে না।

মরনি ব্যস্ত হল। আহেন ঘরে আহেন, বাইরে খাড়ই রইলেন ক্যা?

আদিলউদ্দিন একটু দ্বিধা করল, বিব্রত হল। তোমার ঘরে আহুম?

হ আইবেন না ক্যা?

এমন আন্তরিক গলায় কথাটা মরনি বলল, আদিলউদ্দিনের চোখ ছলছল করে উঠল। বিনয়ী ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল সে।

মরনি বলল, বহেন বহেন। কন দিহি কী কথার কাম আছে আমার লগে।

পানিতে চোখ ভরে গেছে আদিলউদ্দিনের। গামছার খুঁটে চোখ মুছতে লাগল সে।

মরনি বলল, কী অইলো? কান্দেন ক্যা?

আদিলউদ্দিন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চোকে পানি আইলো বইন। এই যে তুমি আমারে ঘরে ডাইক্কা বহাইলা, এতে আমি বোজলাম, আমার উপরে রাগটা তোমার আর নাই। এর লেইগা চোক্কে পানি আইলো।

থাউক কাইন্দেন না। দুফইরা ভাত খাইছেন?

হ বইন খাইছি।

কই খান, কেমতে খান?

পবনদের সঙ্গে রান্না করে খাওয়ার কথা বলল আদিলউদ্দিন। আজ যে মাটিয়ালের কাজ সে করেনি, আজ যে তার রান্নার কাজ ছিল সব গুছিয়ে বলল মরনিকে।

শুনে মরনি বলল। কী মানুষের জীবন কী অইয়া গেছে।

এইডা আমার কপালের দোষ। পাপের শাস্তি। যেই অন্নাই আমি আমার পোলাডার লগে করছিলাম হেই অন্নাইয়ের শাস্তি আল্লায় আমারে দিতাছে। তয় আমি অহন আর দুঃখু করি না। পাঁচওক্ত নমজ পইড়া আল্লারে কই, দরকার অইলে আমারে তুমি আরও শাস্তি দেও, শাস্তি দিয়া মাইরা হালাও, তাও আমার মজনুরে ভাল রাইখো৷ সুখে রাইখো আল্লাহ মাবুদ।

পরের ঘরের পোলাপানগো লেইগা দোয়া করেন না?

না।

ক্যা? অরাও তো আপনের ঘরে জন্মাইছে!

যেই পোলাপান বাপের শইল্লে হাত উডায়, বাড়িত থিকা পিডাইয়া বাইর কইরা দেয় বাপরে, হেই পোলাপানের লেইগা দোয়া আহে না বইন। অনেক সমায় চিন্তা করছি, পোলাপান মানুষ, না বুইজ্জা অন্নাই করছিল। আমি অগো মাফ কইরা দেই। মাফ আমি মনে মনে কইরাও দিছি, তাও অগো লেইগা আমার দোয়া আহে না। অগো কথা আমার মনেও আহে না। মনে আহে খালি মজনুর কথা, মজনুর মা’র কথা। তোমার কথাও মনে আহে বইন। তোমগো বেবাকতের লেইগা আমি দোয়া করি। যেই জীবন আমি একদিন ভুইল্লা গেছিলাম, আইজকাইল মনে অয় হেইডা আমার আসল জীবন আছিলো। হেই জীবনডার মইদ্যেই য্যান আমি আবার ফিরত গেছি।

একটু থেমে আদিলউদ্দিন বলল, মজনুর মায় মরণের পর, মজনুরে লইয়া তুমি আইয়া পড়নের পর যেই জীবনডা আমি পাইলাম হেই জীবনডার কথা ভুলেও আমার মনে পড়ে না। বইন। হেই জীবনডারে আমার নিজের জীবন মনে অয় না।

আদিলউদ্দিনের কথা শুনতে শুনতে মানুষটার জন্য অদ্ভুত এক মমতায় মন ভরে গেল মরনির। বহু বহুকাল পরে হলেও নিজের জীবনের ভুলটা বুঝতে পেরেছে সে। সেই ভুলের মাশুল দিচ্ছে মজনু আর মজনুর মা’র জন্য দোয়া করে, মজনুকে কোলে পিঠে করে যে মানুষ করেছে তার জন্য দোয়া করে। ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হওয়া মানুষকে আল্লাহপাকও ক্ষমা করেন। আর মরনি আল্লাহর তৈরি সামান্য একজন মানুষ, সে কেন পারবে না সেই মানুষকে ক্ষমা করতে!

মরনি মায়াবী গলায় বলল, থাউক ওই হগল কথা আর চিন্তা কইরেন না। চিন্তা কইরা মনে কষ্ট পাইয়েন না। অহন কন কামকাইজ ঠিকঠাক লাহান করতে পারতাছেন নি, খাওন দাওন, নাওন ধোওন, ঘুম বেবাক ঠিকঠাক লাহান অয়নি?

অয় বইন, সবই ঠিকঠাক মতন অয়। তয় রাইত দোরে কোনও কোনও সমায় ঘুমড়া ভাইঙ্গা যায়। তহন যে কত কথা মনে অয়!

কী কথা?

মজনুর কথা মনে অয়, তোমার বইনের কথা মনে অয়। আর মনে অয় মরণের কথা!

বয়স অইলে মরণের কথা বেবাক মাইনষেরঐ মনে অয়।

কয়দিন ধইরা রোজ রাইত্রেঐ মনে অয়। আর তোমার বইনরে স্বপ্নে দেহি।

কন কী? এতদিন আগে মরছে বইনে, তারে স্বপ্নে দেহেন?

হ। একদোম পরিষ্কার দেহি।

কিছু কয় হেয়?

হ।

কী কয়?

কয় এতদিন ধইরা আমারে ছাইড়া আপনে আছেন কেমতে? আমার কথা আপনের মনে পড়ে না? আমার লেইগা মনডা আপনের কান্দে না? আমার তো কান্দে। আমার তো খালি আপনের লেইগা মনডা কান্দে।

শুনে মরনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমার থিকাও নরম মনের মানুষ আছিলো আমার বইনে। বহুত টান আছিলো আপনের লেইগা। মরণের পর মতো বচ্ছরেও মনে অয় হেই টানডা যায় নাই। এর লেইগাঐ মতো ঘনঘন তারে আপনে স্বপ্নে দেহেন।

মনে অয়। আবার মনে অয়, আমার মউত বুঝি ঘনাইয়া আইছে। এর লেইগা তোমার বইনে আমারে ডাক পারে।

আরে না। আল্লায় আপনেরে আরও বহুতদিন হায়াত দরাজ করবো। অহন কন, কী কথার কাম আছে?

তার আগে কও তুমি আমার কথাডা রাকবা। তুমি আমার কথাডা হালাইবা না।

মরনি হাসিমুখে বলল, আগে কন। হুইন্না লই।

কোমরের কাছ থেকে নীল রঙের ময়লা মতন ছোট্ট একখান থুতি বের করল আদিলউদ্দিন। মুখটা চিকন রশি দিয়ে যত্ন করে বাঁধা। থুতির মুখ খুলে পঞ্চাশ একশো দশ বিশ আর পাঁচ টাকার একগাদা নোট বের করল। টাকাটা বাড়িয়ে দিল মরনির দিকে। টেকাডি ধরো বইন।

টাকা দেখে অবাক হয়েছে মরনি। বলল, কীয়ের টেকা?

হালাল টেকাঐ। মাইট্টালগিরি কইরা রুজি করছি। দুই হাজার থিকা পঞ্চাচ টেকা কম আছে।

এই টেকা আমারে দিতাছেন ক্যা?

তোমারে দিতাছি না, দিতাছি মজনুরে। কোনওদিন তো পোলাডার লেইগা কিছু করতে পারি নাই, আইজ কাইল মনে অয় কোনদিন রাইত্রে তোমার ঐ ঘরে হুইয়া ঘুমের তালে মইরা যামু, নাইলে মাডি ভরা গোড়া মাথায় লইয়া আছাড় খাইয়া পইড়া জানডা যাইবো, কোঁচড়ে টেকাডি থাকবো কিন্তু পোলারে দেওয়া অইবো না, এর লেইগা এই টেকাডি তোমার কাছে রাকতে আইছি বইন। টেকাডি তুমি রাখো। মজনুরে দিয়ো৷ দিয়া কইয়ো এক পোড়া কপাইল্লা বাপের ঘরে ও জন্মাইছিলো, বাপে অরে কিছু দিতে পারে নাই। না মায়া মহব্বত, না জাগা জমিন। তয় শইল্লের রক্ত দিয়া, জান পরান দিয়া রুজি করা শেষ সম্বল কয়ডা টেকা অরে দিয়া গেছে। এই টেকায় অনেক বরকত দিবো আল্লায়। ও যুদি কোনওদিন কায়কারবার শুরু করে, যুদি খলিফা দোকান দেয়, এই কয়হান টেকা ও য্যান কামে লাগায়। তাইলে মরণের পরও আমার মনডা শান্তি পাইবো বইন।

টাকাগুলি মরনির কোলের উপর রেখে দুইহাতে মরনির ডানহাতটা জড়িয়ে ধরল আদিলউদ্দিন। অনেকক্ষণ ধরেই বুক ঠেলে উঠছিল গভীর কষ্টের কান্না, সেই কান্না এখন আর ধরে রাখতে পারল না। কাঁদতে কাঁদতে জড়ানো গলায় বলল, আমার এই কথা তুমি রাইখো বইন। আর আমারে মাফ কইরা দিয়ো। মজনুরে কইয়ো অর পোড়া কপাইল্লা বাপটার উপরে য্যান রাগ না রাখে। বাপটারে য্যান মাপ কইরা দেয়।

আদিলউদ্দিনের কান্না দেখে মরনিরও তখন চোখ বেয়ে নেমেছে কান্না। কাঁদতে কাঁদতে কোনওরকমে সে বলল, আপনের জীবনডা এমুন অইলো ক্যান দুলাভাই? মজনু আর আমার জীবনডা এমুন অইলো ক্যান?

আদিলউদ্দিন জবাব দিতে পারল না। দুইজন মানুষের হৃদয় ভাঙা কান্নায় প্রকৃতি স্তব্ধ হয়ে ছিল।

.

গাওয়ালের কোনও খবর পাওয়া গেল না?

রাতের ভাত খেয়ে খোলা দরজার সামনে বসে তামাক খাচ্ছে দবির। অদূরে মেঝেতে পাতা হোগলার বিছানায় পা লম্বা বসে আছে হামিদা। সারাদিন সন্ধ্যার পরের সবকাজ সেরে এই সময়টা সে একদম আজার। খানিক আগে স্বামী কন্যাকে ভাত খাওয়াইয়া নিজে খাইছে। তারপর থালবাসন গুছিয়ে গা ছেড়ে বসছে। তামাক সাজাইয়া টানতে বসছে দবির আর নূরজাহান উঠে গেছে চৌকিতে। এখন মা-বাবার দিকে পেছন ফিরে শুয়ে আছে। কুপির আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না তাকে। ঘুমিয়ে পড়েছে কি না বোঝা যাচ্ছে না।

আজকাল আগের মতো শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ে না নূরজাহান। অনেকক্ষণ জেগে থাকে।

আগে সারাদিন টো টো করতো গ্রামে। এই বাড়ি যেত, ওই বাড়ি যেত। যখন তখন চকপাথালে ছুট লাগাত, একদৌড়ে চলে যেত সড়কপারে। ফলে ছুটাছুটির ক্লান্তিতে শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম। সারারাত হুশ থাকত না।

এখন সেইদিন নাই নূরজাহানের। এখন সে খাঁচার পাখি। চব্বিশ ঘণ্টা এই বাড়ির মধ্যে। এই ঘর রান্নাচালা ঘাটপার লাকড়িখড়ি রাখার ঘর আর বাঁশঝাড়তলার ওদিককার পেশাব পায়খানার ঘের, এই হচ্ছে নূরজাহানের দুনিয়া।

বাড়ি থেকে বেরুবার নামার মুখেই শুরু হয়েছে শস্যের মাঠ, চক। খানিকদূর দিয়ে মাটি ভরাট হয়ে আগাচ্ছে মহাসড়ক, কোনও কোনও উদাস দুপুর আর শেষ বিকালে বাড়ি থেকে নামার ওই মুখটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় নূরজাহান। বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে চকমাঠের দিকে। শস্যের মাঠ, মাঠের উপরকার আকাশ আর সড়কের দিকে তাকিয়ে নিজের জন্য দুঃখে মন কাঁদে। খোলা আকাশের তলায় পড়ে থাকা এই মাঠচক, সড়কপার, মেদিনীমণ্ডল গ্রামখানি, গ্রামের প্রতিটি বাড়িই একদিন তার ছিল। যখন যেখানে ইচ্ছা চলে যেত। মাঠচক আর সড়কপারে, গ্রামের মেঠোপথ এবাড়ি ওবাড়ি। জ্ঞাতি আত্মীয় না হয়েও কত আপন মানুষ গ্রাম জুড়ে। মানুষের কত আদর স্নেহ ভালবাসা, শাসন আর সোহাগ ছিল। একটিমাত্র ঘটনা এইসব থেকে সরিয়ে এনেছে নূরজাহানকে। এখন তার জীবন বন্দি মানুষের জীবন। বেদের খাঁচায় আটকে থাকা ডাহুক ঘুঘুপাখির জীবন।

আজ সন্ধ্যার পর চৌকিতে শুয়ে এসবই ভাবছিল নূরজাহান। তখনই কথাটা বলল হামিদা।

শুনে তামাক টানা বন্ধ করে দবির বলল, না। কোনও খবর পাওয়া যায় নাই। দেশ গেরামের বেবাকতেঐ হোনছে আজিজ গাওয়াল নিরুদ্দিশ অইয়া গেছে। চিনা জানা যে যেই মিহি যায় হেই মিহিঐ গাওয়ালের কথা জিগায়। কেঐ কোনও সমবাত দিতে পারে না। হাজামবাড়ির আবদুলের লগে আইজ বাজারে আমার দেহা অইছিলো। বহুত দুকু করলো গাওয়ালরে লইয়া। অগো বাড়ি আর গাওয়ালের বাড়ি তো একলগেঐ, মইদ্যে খালি একহান পুকঐর। এইবাড়ি থিকা কথা কইলে ওইবাড়ি থিকা হুনা যায়। অরা বলে হোনে, রাইত ভইরা বউডা বিলাপ কইরা কান্দে।

হামিদা বলল, কানবো না? এমুন জুয়ানমর্দ মানুষটা নিরুদ্দিশ অইয়া গেল, এতডি পোলাপান লইয়া বউডা বাঁচবো কেমতে?

হ।

আবার তামাক টানতে লাগল দবির।

নূরজাহান তখন চোখের ভিতর দেখতে পাচ্ছে আজিজ গাওয়ালকে, তার বাড়িঘর উঠান পালান। যেন বিকালের মুখে নূরজাহান গেছে সেই বাড়িতে। বাড়ির নামার দিকে গোল্লাছুট খেলছে নাদের-হামেদরা। বড়ঘরের ওটার একধাপ উপরে বসেছে বানেছা, তার বুক বরাবর একধাপ নীচে বসেছে পরি। খাটো ধরনের ঘনদাঁতের কালো কাকুই দিয়ে মেয়ের চুল আঁচড়ে দিচ্ছে বানেছা। দুই-একটা উকুন আটকে যাচ্ছে কাকুইয়ের দাঁতে, ঝাড়ুর এক। টুকরা চিকন শলা রাখা আছে হাতের কাছে, সেই শলা দিয়ে উকুন বের করে একহাতের বুড়া আঙুলের নখে রেখে অন্যহাতের নখ দিয়ে পুটুস করে মারছে। কোলের ছেলেটা সেই ফাঁকে এসে মায়ের বুকের দুধের জন্য ঘেঙটি (ঘ্যানঘ্যান অর্থে) পাড়ছে। বানেছা ফিরেও তাকাচ্ছে না তার দিকে। দূরে, চেঁকিঘরের সামনে পিঁড়িতে বসে আপনমনে তামাক টানছে আজিজ গাওয়াল।

আহা এই সুখী চেহারা এখন আর নাই সেই বাড়িতে। কয়েক মাসের মধ্যে কত ঘটনা। ঘটে গেছে গাওয়াল বাড়িতে। মাইট্টাতেল খাইয়া মরল ছনুবুড়ি, বানেছার একটা মেয়ে। হল, নাভিতে পচন ধরে সাত দিনের মাথায় মরল সেই মেয়ে। খরচ বাঁচাতে মেয়ের দাফন কাফনও করল না গাওয়ালে। তারপর নিজে গাওয়ালে বেরিয়ে উধাও হয়ে গেল না। ডাকাতের হাতে মরল সেই হদিশও কেউ পাচ্ছে না।

আহা রে মানুষের জীবন! কখন যে কী থেকে কী হয়ে যায় আল্লাহ মাবুদ ছাড়া কেউ বলতে পারে না।

নূরজাহানের জীবনই যে এমন হবে নূরজাহান কি ভুলেও কখনও তা ভেবেছে! কোন কুক্ষণে সেদিন সে ছুটে গিয়েছিল সড়কপারে, দেশগ্রামের এতলোকে দেখছিল মাকুন্দাকে, এতলোকে টের পাচ্ছিল আসল ঘটনা কী ঘটেছে, কেউ ওই নিয়ে কোনও কথা বলল না, কাণ্ডটা ঘটাল নূরজাহান। সেই কাণ্ডের মাসুল দিতে দবির-হামিদাকে কতই না অনুনয় বিনয়ের মাশুল দিতে হয়েছে মান্নান মাওলানা আর আতাহারের কাছে, কত না হাতে পায়ে ধরতে হয়েছে তাদের। নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে নূরজাহানকে আশ্রয় দিয়ে বাঁচিয়েছিল মরনি। ভয়ে আতঙ্কে জ্বরে পুড়ে মরতে বসেছিল নূরজাহান।

তারপর বন্দিজীবন।

এই বাড়ি হয়ে গেছে জেলখানা। বাড়ির চারদিকে আকাশসমান উঁচু হয়ে আছে লোহার গরাদ। সেই গরাদের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যাবার উপায় নাই নূরজাহানের। দুই হাতে দুই গরাদ ধরে তার মাঝখানে মুখ রেখে অসহায় চোখে বাইরের দুনিয়া দেখা ছাড়া নূরজাহানের আর কিছু করার নাই।

তামাক খাওয়া শেষ করে কাটা বেড়ার লগে ঝুলিয়ে রেখেছে দবির। হামিদা বলল, রাইত ম্যালা অইলো। দুয়ার লাগানো, ঘুমাইয়া পড়ি।

দবির বলল, ধূর কীয়ের রাইত অইছে! চইত মাইস্যা গরম। আটু খোলা থাউক দুয়ার। হাওয়া বাতাস আহুক।

হাওয়া বাতাস কইত থিকা আইবো? থাকলে তো?

হ। ইট্টুও হাওয়া বাতাস নাই। তাও দুয়ার খোলা থাকলে আরাম লাগে।

যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমন গলায় দবির বলল, গাওয়ালের লেইগা জিন ডাক দিছিলো বাইতে।

হামিদা উদগ্রীব হল। কী কইলো জিনে?।

হেরা তো খোলসা কইরা কিছু কয় না, ইশারা ইঙ্গিতে বলে বুজাইছে, বাইচ্চা আছে গাওয়ালে। অষইদ দিয়া গেছে। খাইতে কইছে বানেছারে। নিয়ম মতন খাইলে কাম অইবো।

ফিরত আইবো গাওয়ালে?

হোনলাম তো।

এইডা তোমারে কে কইলো?

দেলরা বুজিগো বাড়ির বাদলা। বাদলার লগে দেহা অইছিলো পুরানবাড়ির সামনে।

হামিদা দয়ালু গলায় বলল, আল্লায় য্যান তাই করে। গাওয়ালে য্যান ফিরত আহে।

খোলা দরজা দিয়ে অন্ধকার উঠানের দিকে তাকাল দবির। তয় গাওয়াল নিরুদ্দিশ অইয়া যাওনের পর থিকা আমার খালি তোতার বাপের কথা মনে অয়। এমুন পরহেজগার মানুষ, এই যে নিরুদ্দিশ অইলো, আর কোনদিন ফিরত আইলো না। জীবনডা ভর ধরণীখালায় হের লেইগা পথ চাইয়া রইলো।

হ গো, ঠিকঐ কইছো।

গাওয়ালেও যুদি এমুন করে? আর ফিরত না আহে?

এমুন কথা কইয়ো না। বাঁইচ্চা থাকলে ফিরত না আইয়া যাইবো কই?

মাইনষের অনেক যাওনের জাগা থাকে, জানো। একজন মানুষ যুদি ইচ্ছা করে যেহেনে ইচ্ছা ওহেনে যাইবো গা, যাইতে পারে।

বউ পোলাপান, সংসার?

এই হগলের মায়া কাডাইতে অয়। মায়ার বানহান (বন্ধনখানি) না কাডাইতে পারলে বিবাগী অইতে পারে না কেঐ। মাইনষের মনডা বহুত ঝামেলার, বোজলা না? কোনও কোনও মাইনষের আথকা মনে অইলো, ধুত্তরি, ঘোড়ারআন্ডা সংসার পোলাপান বউঝি দিয়া কী করুম, এই জীবন আমার ভাল্লাগে না। আমি এই সংসারে থাকুম না। যাইগা যেই মিহি দুই চকু যায়। মনের মইদ্যে একবার এই টান উটলে সংসারের মায়া কাটাইতে পারে মাইনষে। বিবাগী অইতে পারে। কত মানুষ আছে না বেবাক কিছু হালাইয়া বচ্ছরের পর বচ্ছর মাজার মোজারে পইড়া থাকে। সংসার বউ পোলাপান হালাইয়া নিরুদ্দিশে গিয়া নতুন কইরা বিয়াশাদি কইরা সংসার পাতে। আগের জীবনের কথা ভুইল্লা যায়।

হামিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হ, মানুষ বহুত আজব পদের। কুনসুম যে মনের মইদ্যে কী টান দিবো, কী কাম যে তহন কইরা বইবো, হেয় নিজে তো জানেঐ না, এক আল্লাহ মাবুদ ছাড়া কেউ জানে না।

মুখ উঁচু করে চৌকিতে শোয়া নূরজাহানের দিকে তাকাল হামিদা। আমাগো মাইয়াডার কথা চিন্তা করো। যেই কামডা করছিলো, ওই কামডা কি অর করনের কথা! অলক্কিতে না টানলে এমুন কাম কেঐ করে! ওই একহান কামের লেইগা অর জীবনডা কেমুন বদলাইয়া গেল।

দবির মন খারাপ করা গলায় বলল, হ। মাইয়াডার কথা চিন্তা করলে আমার খালি মালেক দরবেশ সাবের কথা মনে অয়। দরবেশ সাবে কইতো, দুনিয়া ভইরা আল্লায় খালি জেলখানা বানাইয়া থুইছে। নানান পদের জেলখানা। কোনও জেলখানা দারোগা পুলিশের, কোনও জেলখানা সমাজ পনচাইতের, কোনও জেলখানা মা বাপ জ্ঞাতিগুষ্ঠির শাসনের, আর কোনও জেলখানা অইলো মাইনষের নিজের মনের ভিতরের জেলখানা। তুমি যুদি খুন খারাপি কইরা, চুরি ডাকাতি কইরা ধরা পড়ো, তয় দারোগা পুলিশের জেলখানায় যাইবা। সমাজের মাইনষের লগে যুদি কোনও অন্নাই কর, তয় সমাজ পনচাইত তোমারে একঘইরা করবো, এইডা অইলো আরেকপদের জেল। নূরজাহানের লগে আমরা যেইডা করতাছি হেইডা অইলো শাসনের জেলখানা। অর ভালর লেইগাঐ অরে আমরা আটকাইয়া থুইছি।

এই জেলখানাডা আমি মনে করি ভাল। মাইয়া মাইনষের এমুন জেলখানায় থাকনঐ ভাল। তয় আর বেশি তেড়িবেড়ি করতে পারে না।

ঠিকঐ কইছো। তয় এই হগল ছাড়াও আরেকহান জেলখানা আছে, দরবেশ সাবে কইতো, হেইডাঐ বলে আসল জেলখানা। নিজের মনের ভিতরের জেলখানা। কোনও মানুষ হয়তো এমুন কোনও অন্নাই কাম, পাপকাম করছে, যেইডা হেয় নিজে ছাড়া অন্য কেঐ জানে না, এমুন কোনও কোনও মানুষ আটকা পড়ে নিজের মনের জেলখানায়। হেই জেলখানার ভিতরে বইয়া তার মনডা খালি কান্দে। কাইন্দা কাইন্দা কয়, আমি এইডা কী করছি, ক্যান করছি! মনের জেলখানার গারদে মাথা কুইট্টা মরে। ওই জেল থিকা আল্লাহ মাবুদ ছাড়া কেউ তারে ছাইড়া দিতে পারে না।

হামিদা বলল, বুজছি। অহন ওডো, দুয়ার লাগাও। আমার ঘুম আইতাছে।

দবির উঠে দাঁড়াল।

চৌকির ওপর তখনও জেগে আছে নূরজাহান। মা-বাবার সব কথাই সে শুনেছে। শুনে নিজের জন্য এত দুঃখ হয়েছে! বুক ঠেলে উঠেছে কান্না। নিঃশব্দে তখন কাঁদছিল নূরজাহান। চোখের পানিতে বালিশ ভিজে যাচ্ছিল তার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *