৩.৭ কোন বাড়ির পোলা

আপনেরে চিনলাম না বাজান। কোন বাড়ির পোলা আপনে?

পোলাটার বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ বছর। মাথায় বাবরি ধরনের তেলতেলা চুল। মুখে দাড়িমোচ। গায়ের রং কালো। তবে চেহারায় মিষ্টতা আছে। লম্বায় দবিরের মতনই। হবে। একহারা গড়ন। পরনে ঢোলাঢালা খাকি প্যান্ট আর ফুলহাতা খয়েরি রঙের গেঞ্জি। গলায় গেরুয়া রঙের পুরানা মাফলার। পায়ে টায়ারের স্যান্ডেল। সবই অতি পুরানা, অতি ময়লা।

দবিরের কথায় হাসল সে। কেমনে চিনবেন? আমি এই গেরামের পোলা না।

তয়?

আমগো বাড়ি হইল মালখানগর। মালখানগরের নাম হুনছেন না? ওই যে বোসের বাড়ি আছে! বোসরা আছিল মালখানগরের জমিদার। এতবড় বাড়ি আছিল তাগো, একখান বাড়ির মইদ্যে বাওন্নখান গল্লি (গলি)। বাড়ির পুবপাশে বিরাট দিঘি, বিরাট বান্ধাইন্না ঘাটলা। উত্তর দিকে আরেকখান দিঘি। উনিশ শো ছয়তিরিশ সালে মহাত্মা গান্ধী আইছিলেন মালখানগর গ্রামে। আমি হেই গেরামের পোলা। বোসের বাড়ির উত্তর মিহি যেই দিঘি আছে হেই দিঘির পুবপারে আমগো বাড়ি।

দবিরের কপালে দুই-তিনটা ভাঁজ পড়ল। আপনে হিন্দু?

আরে ধুরো। হিন্দু অমু ক্যা? মোসলমান, মোসলমান। আমার নাম হইল রব্বান। রব্বান শিকদার। মালখানগরে অহন কি আর আগের লাহান হিন্দু আছেনি? যেই দুই-চার ঘর আছে তারা হইল গরিব। দুইন্নাইর গরিব। নাপিত সাহা কামার, এই পদের। বোসের বাড়ি কি অহন আর বোসের বাড়ি আছে। মোসলমানরা দখল মখল কইরা লইছে। তয় আমগো গেরাম বিক্রমপুরের অনেক গেরামের মতনঐ ধনী গেরাম। বিরাট বিরাট ধনী আছে। ঢাকায় কায়কারবার করে। গেরামে সাই সাই দালান কোঠা উডাইছে। গেরামড়া বহুত সোন্দর। যেই দুই-চাইর ঘর গরিব মানুষ আছে তাগো মইদ্যে আমি একজন। তয় আমগো আততীয় স্বজনরা পয়সাআলা। জাগা সম্পত্তি বাড়িঘর, ঢাকার টাউনে কায়কারবার করে, চাকরি বাকরি করে। মালখানগরের সিকদারগোও নাম আছে। খালি আমারঐ কিছু নাই। মা বাপ ভাই বইন কেউ নাই। অনাথ এতিম। একটা চাচা আছে, হেই চাচার সংসারে মানুষ অইছি।

দবির বুঝল রব্বান একটু গল্পবাজ টাইপের। এককথার জবাবে অনেক কথা বলে। তবে বলে খুব সুন্দর করে। কথার ফাঁকে ফাঁকে হাসে। হাসিটা সুন্দর। কথা আর হাসি যার সুন্দর মানুষ তাকে সহজেই পছন্দ করে। দবিরও রব্বানকে খুব পছন্দ করল। হাসিমুখে বলল, মালখানগর থিকা আপনে বাজান এতদূর আইছেন ক্যা? কই মালখানগর, কই মেদিনমণ্ডল?

রব্বান তার স্বভাব মতন হাসল। হ মালখানগর থিকা আপনেগো গেরাম বিরাট দূর। তাও আইছি। আইছি কাকা পেডের দায়ে। গেরামে কোনও কাম কাইজ নাই। আমার চাচায় গেছে বুড়া হইয়া। পোলাপানে অহন সংসার দেহে। খেতখোলা চোয়। ধানপান মন্দ অয় না। আমিও তাগো লগে খেতখোলার কাম করতাম। তয় ধান পান উডনের পর তারা। যে যার মতন সংসারের ধান রাইক্কা, কিছু বেইচ্চা টেকা পয়সা ভাগ কইরা লয়। আমি যে কামলার লাহান খাডি আমারে চাইর আনা পয়সাও দেয় না। চাইলে বকাবাজ্জি করে। লুঙ্গি পিরন কিননের টেকাডাও দেয় না। খালি থাকন খাওন। তাও আমি থাকি এমুন একখান। ঘরে, ওইডা ঘরের কোনও জাতঐ না। লাকড়ি খড়ি, দুই-তিনডা বরকি আর আমি। বাড়ির পোলা অইয়াও থাকি বাড়ির কামলার লাহান।

চাচা কি আপন চাচা?

হ। একদোম আপন। আমার বাপের বড়ভাই।

বড়ভাই?

হ। আমার বাপে অল্প বসে মইরা গেছে। বাপের আগে মরছে মা’য়। আমার জন্মের সময়। তারবাদে বাপে আর বিয়াশাদি করে নাই। অসুইক্কা মানুষ আছিল। মা’য় মরনের দুই-তিন বছর পর হেয় মরলো। আমি কাকার পোলাপানের লগে বড় হইলাম।

আপনের বাপ চাচারা দুই ভাইঐ।

হ। আমার কোনও ফুবু নাই। মা’র দিকে মামা খালারা আছে। মা’য় মরণের পর তারা কেঐ আমার খোঁজখবর লয় নাই। আমার নানার বাড়ি হইল বহর গেরামে। তারাও গরিব। আর পোলা জন্ম দেওনের সময় তাগো বাড়ির মাইয়া মইরা গেছে, পোলাডা অইলো অলইক্কা (অলক্ষুনে)। হেই পোলারে কে দেকতে আইবো? কে নিবো? চাচায় চাচি হালাইতে পারে। নাই দেইক্কা রাখছিলো। বাইত্তে তো কুত্তা বিলাইও পালে মাইনষে। আমারেও অমতেঐ পালছে। উটতে বইতে লাত্তিগুতা, বকাবাজ্জি। চাকরের লাহান সংসারের বেবাক কাম করাইতো ছোডকাল থিকা। বড়কালে অইয়া গেলাম কামলা।

দবিরের দিকে তাকাল রব্বান। আর সইজ্য অইতাছিল না কাকা, বুজলেন। এর লেইগা বাইত থিকা বাইর অইয়া আইয়া পড়ছি।

দবির চিন্তিত গলায় বলল, বেবাকঐ বুজলাম, তয় একখান কথা বুজলাম না বাজান?

রব্বান মাথা চুলকাল। কোনডা বোজেন নাই কন তো কাকা? জাগাসম্পত্তির কথা, বাড়িঘরের কথা। খাড়ন খাড়ন আপনের কিছু কইতে অইবো না, আমিঐ কইতাছি। আমার বাপ আর চাচায় দুইভাই, তাগো বাপের সম্পত্তির মালিক আমার বাপে আর চাচায়। আমি বাপের একমাত্র পোলা। আমার বাপের ভাগের সম্পত্তি পুরাডা একলা আমার পাওনের কথা। কারণ দাদার সম্পত্তির অর্ধেকের মালিক তো আমার বাপে, আরেক অর্ধেকের মালিক চাচায়। বড় অইয়া এইডা আমি বুজছি। বুইজ্জা একদিন কথাডা উডাইছিলাম। হুইন্না আমার চাচায় খুবই মনে কষ্ট পাইলো। কইলো, বুজছিলাম এই কথা তুই একদিন উডাইবি। তয় আর কোনওদিন উডাইচ না। তরে যে লাইল্লা পাইল্লা বড় করছি, তর পিছে এতদিনে আমার যে খরচা অইছে, তাতে তুই অহন আর ভাগে কিছু পাবি না। থাক আমার সংসারে। আমি তরে হালামু না। আমার পাঁচ পোলা, তিন মাইয়া। তারা তরে আপন ভাইঐ মনে করে। তয় তুই জাগা সম্পত্তির দাবি করছস হোনলে বেবাকতে রাগ করবো। তরে বাইত থিকা বাইর তো করবোই, মাইর ধইরও করতে পারে।

এইডা কোনও কথা হইলো?

আমিও কই, এইডা কোনও কথা হইলো! দেশে বিচার সালিশ আছে না, আইন আছে না? আমি দেশগেরামের মাতবরগো কাছে বিচার দিতে পারি। চেরম্যান মেম্বরের কাছে বিচার দিতে পারি। কোট কাঁচারিতে গিয়া কেস করতে পারি। তয় আপনে কইবেন এই হগল করি নাই ক্যা? করি নাই কাকা ডরে। চাচার সইজ্জা পোলাড়া অতি পাজি। আমারে একদোম জব কইরা হালাইবো। জানের থিকা জাগাসম্পত্তি বেশি অইলোনি, কন? আগে তো জানে বাঁচতে অইবো, নাকি! জানে বাচনের ডরে আমি কেঐরে কিছু কই নাই। কামলার লাহান ওই বাইত্তে পইড়া আছিলাম। চাচায় কইলো, না না চাচারে আমি একদিন। কইলাম, আমার বিয়ার বস অইতাছে, বিয়াশাদি করলে বউ লইয়া খামু কী? চাচায় কইলো, ক্যা, অহন যেমতে খাচ অমতেই খাবি। তুই আমগো খেতখোলায় কামলা দিবি আর তর বউ বাড়ির কাম করবো। হোনলেন কথা? আমি তো কামলা আছি। বউডা অইবো বান্দি। এই হগল হোনতে হোনতে আর পারলাম না কাকা। দিলাম ছাইড়া চাচার সংসার। বাড়ি থিকা কেঐরে কিছু না কইয়া আমার দুই-চাইরহান কাপড় চোপড় যা আছিল, একখান ছিড়া ব্যাগ আছিল, হেই ব্যাগ লইয়া এই মিহি আইয়া পড়ছি। হুনছি এই মিহি বিরাট সড়ক অইতাছে। কামের আকাল নাই। কামকাইজ কইরা নিজের জীবন নিজেই চালামু। ওই মালখানগর মিহি ইহজিন্দেগিতে আর যামু না।

হাঁটতে হাঁটতে জাহিদ খাঁ-র বাড়ি বরাবর সড়কে উঠল দবির আর রব্বান। আজ ফাল্গুনমাসের প্রথম শুক্রবার। এনামুল সাহেবের মসজিদে আজই প্রথম নামাজ হল। জুম্মার নামাজ। মাইকে আজান দিলেন মান্নান মাওলানা। পাড়ার এই বাড়ি ওই বাড়ি থেকে নামাজি মানুষরা এল জুম্মা পড়তে। এনামুল সাহেব ঢাকা থেকে আসছেন কাল বিকালে। মসজিদে জুম্মার নামাজ হবে তারপর মুসল্লিদের মেজবানি খাওয়াবেন তিনি। মুসল্লিদের সঙ্গে গ্রামের গরিব মিসকিনরাও খাবে। তাঁর আত্মীয় স্বজনরাও অনেকে এসেছে। দেলোয়ারার মেয়ে মাফিন আসছে জামাই নিয়া। এনামুলের বউ পারভিন আসছে, দেলোয়ারা আসছে। এনামুলের ভাইবোনরা প্রায় সবাই আসছে, আসে নাই শুধু মাজারো ভাই। এনামুলের মা। আসতে পারেন নাই। তিনি হাঁটাচলা করতে পারেন না। শরীরের ওজন এত বেড়েছে, দুই পা শরীরের উপরের অংশের ভার রাখতে পারে না। তিনি আছেন বিছানায় পড়ে। মন্নাফ হাওলাদারের ছেলেরা আসছে বউ বাচ্চাকাচ্চা নিয়া। দুইটা ষাঁড় গোরু জবাই করা হয়েছে। লগে বালাম চাউলের ভাত, ডাল আর অবশেষে ঘন দুধের ফিরনি। বাড়ির পালানে শামিয়ানা টাঙিয়ে, মাটিতে দস্তরখান বিছিয়ে খেতে দেওয়া হয়েছে মুসল্লিদের। জুম্মা শেষ করে সবাই আসছে দেলোয়ারাদের পালানে। মোতালেব আর মান্নান মাওলানা জুম্মা শেষ করে মুসল্লিদের নিয়া আসছে খেতে। গোরুর তেলতেলা সুরা গোস্তর লগে বালাম চাউলের ভাত, তারপর ডাল, তারপর ওইরকম ফিরনি, খেয়ে এনামুলের যে কী তারিফ শুরু করল সবাই। একদিকে পাড়ায় একখান এত সুন্দর মসজিদ করেছে এনামুল, চাইছিল চল্লিশ দিনে, পারে নাই। দুই মাস লাগল। তাও মাত্র দুই মাসে মসজিদের কাজ শেষ করে, যেদিন প্রথম জামাত হল মসজিদে সেই দিনই মেজবানি, বিরাট ব্যাপার!

এনামুল হাসিহাসি মুখে মুসল্লিদের খাওয়াদাওয়ার তদারক তো করছিলই, গরিব মিসকিন যারা আসছে তাদের দিকেও নজর রাখছিল। দবিরকে একবার জিজ্ঞাসা করেছে, খাইতাছেন ঠিক মতন?

দবির কথা বলবার আগেই আলফুকে বলল, ওই আলফু, গাছিরে আরেকটু গোস্ত দে।

আলফু তার কথা মতনই কাজ করল। দবির খাওয়াদাওয়ায় খুব একটা ওস্তাদ না। তবে রান্না আজ এত ভাল হয়েছে, গোস্তটা যা মুলাম হইছে, দবিরের মতন সবাই খেয়ে মুগ্ধ। মান্নান মাওলানা দূর থেকে একবার দবিরের দিকে তাকিয়েছিল। মুখটা গম্ভীর। দবিরকে মসজিদে ঢোকার সময়ও একবার দেখেছে সে। দবির জুম্মা পড়তে আসছে দেখেও মুখটা গম্ভীরই ছিল তাঁর।

এই মেজবানিতেই রব্বানকে দেখল দবির। তার পাশে বসেই খাচ্ছিল। জুয়ান বয়সের পোলা, তবে খাওয়াদাওয়ায় তেমন জুয়ানকি বোঝা গেল না। তেমন বেশি খেল না। দবিরের মতনই। খাতিমদাররা একবারে হাতের গামলা থেকে একটা টিনের থালায় করে যতটা ভাত তুলে দিল, ভাত ওই অতটাই। একহাতা সুরা গোস্ত দিল তারপর দিল ডাল। সব শেষে ফিরনি। ওই একবার করে। যা দিল তাই খেল রব্বান। কোনওটাই পরের বার আর চাইল না।

তখন থেকেই রব্বানকে খেয়াল করছিল দবির। মেজবানি খেয়ে ফিরার সময় দেখে তার লগে লগে হাঁটা দিছে। হাঁটতে হাঁটতেই কথাবার্তা শুরু করেছিল। এত কথার পর এখন অন্য কথাটা জিজ্ঞাসা করল দবির। আপনেরে বাজান কে দাওত দিছিল?

রব্বান অবাক। কে দাওত দিবো? কেঐ দেয় নাই। আমারে চিনে কে যে দাওত দিবো? আমি তো এই গেরামে অচেনা। আততীয় স্বজন চিনা পরিচিত মানুষ একজনও নাই। আইছি কাম বিচড়াইতে। কাম একখান পাইছিও। তয় লই নাই। কী কাম হোনবেন? কামলার কাম। এক্কেরে কামলার কাম। গোড়ায় কইরা সড়কের কামের ইটা বালি টানন লাগবো। রোজ অইলো ষাইট টেকা। কামডা আমার পছন্দ অয় নাই। তাও একদিন করছি। আইজ তিনদিন অইলো এই গেরামে আইছি। পয়লা দিন আইতে আইতে বিয়ান অইয়া গেছে। মাওয়ার বাজারে এক হইটালে ভাত খাইছি। কয়ডা টেকা আছিল জেবে। ওইডা দিয়াঐ খাইছি। রাইত্রে মাওয়ার বাজারে, একখান মুদি দোকানের সামনে ব্যাগ। মাথায় দিয়া হুইয়া রইছিলাম। পরদিন বিয়ানে গেছি সড়কের কামের ওহেনে। কনটেকদার সাবের ম্যানাজাররে ধরলাম। কাম করতে চাই সাব। কয় লাইগ্যা যাও। ইটা বালি টানো। ষাইট টেকা রোজ। ব্যাগহান কনটেকদার সাবের সিমিট রাখার ঘরে রাইক্কা বিসমিল্লা বইলা ইটার বোঝা উডাইলাম মাথায়। বিয়ানে দেহি গরদান আর সিধা করতে পারি না। এমুন কাম তো জিন্দেগিতে করি নাই। করছি খেতখোলার কাম। হ ওইডিও কামলার কাম, তয় এত কঠিন কাম না। পরদিন কইলাম, ম্যানাজার সাব, এই কাম আমি পারুম না। আমি মালখানগর হাই ইসকুলে কেলাস সেভেনতরি পড়ছি। আপনে আমারে লেবার সর্দারের কাম দেন। সর্দারের এসিসটেন বানাইয়া দেন। দেয় নাই, বুজলেন কাকা, দেয় নাই। আমিও রাগ কইরা আর কামে গেলাম না। জেবের পয়সা খরচা কইরা হইটালে ভাত খাই। থাকি ওই যে ওই বাড়িডায় ছাপরা মাপরা ওডাইয়া মাইট্টাল লেবাররা যেমতে থাকে…

ঠাকুরবাড়িটা দেখাল রব্বান।

দবির বলল, ওহেনে আপনের চিনা পরিচিত কেঐ আছে?

আছিল না। একদিন কাম কইরা দুই-চাইরজনরে চিনছি। তারা থাকতে দিছে। আর অহন তো শীতের দিন না। গাছতলায় হুইয়া থাকলেও অসুবিদা নাই। মকবুল নামে একজন আছে, হেয় আমারে তার লগে থাকতে দিছে। তয় বেডার সবাব ভাল না কাকা। রাইত্রে শইল্লে হাত দেয়। বদ উদ্দিশ্য। কাইল রাইত্রে আর অর লগে থাকি নাই। ব্যাগ রাখছি। একজনের ছাপরায় আর নিজে হুইয়া রইছি গাছতলায়। আইজ বিয়ানে হোনলাম গেরামের নতুন মজজিদে জুম্মা হইবো, তারবাদে মেজবানি। জুম্মা পড়তে পারলাম না শইল নাপাক দেইক্কা। নাই ধুই নাই তো! এর লেইগা চকে খাড়ইয়া রইছিলাম। যেই জুম্মা শেষ অইছে, মেজবানি আরম্ব অইছে, গিয়া খাইতে বইয়া গেছি।

দবিরের মুখের দিকে তাকাল রব্বান। তার মিঠা হাসিটা হাসল। এই হইল কাকা আমার হিসটোরি।

রব্বানের কাকা ডাকটা ভাল লাগছিল দবিরের। এরকম করে কেউ কখনও ডাকে নাই। রব্বানকেও ভাল লাগছিল। কত সহজ সরল পোলা। পেডে কোনও কথা রাখে না। বেবাক কইয়া দেয়। চিন পরিচয় অইয়া সারল না, জিন্দেগির বেবাক কথা কইয়া দিল।

এসব ভাবতে ভাবতে সড়কের দিকে তাকাচ্ছে দবির। মাটির কাজ প্রায় ফেরিঘাট তরি গেছে। আর দিন দশ-পনেরোর মধ্যে ওইদিককার মাটির কাজ শেষ হবে। এইদিক থেকে ইট বিছানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। কোলাপাড়ার ওইদিক তরি কার্পেটিংও হয়ে গেছে। একলগে তিন রকমের কাজ চলছে। রিকশা তো অনেক আগে থেকেই আসছে গ্রামে, এখন ট্রাকও আসছে। ট্রাককে ট্রাক মালামাল আসছে কন্ট্রাকটরদের। চইত বৈশাখ মাসের মধ্যে পুরা কাজ শেষ হবে সড়কের। ঢাকা থেকে বাস ট্রাক গাড়ি বেবি টেক্সি বেবাক আসবে এইদিকে। মাওয়ায় রেডি আছে কয়েকটা ফেরি। লঞ্চ আছে এপার ওপার করার। ছোট ছোট স্পিডবোটও আছে। দোকানপাট ম্যালা হয়ে গেছে কুমারভোগ চৌরাস্তার ওখান থেকে ফেরিঘাটের দিক তরি। চৌরাস্তার সোজাটা চলে গেছে পদ্মার পারে। ওদিকটায় চর পড়ে শুধু বালি আর বালি। বামদিককার রাস্তা চলে গেছে লৌহজংয়ের দিকে আর ডানদিকে তো মাওয়া ফেরিঘাট। গেরাম আর গেরাম থাকলো না, টাউন অইয়া গেলো। বিজলিও আইসা পড়ছে মাওয়া তরি। পল্লিবিদ্যুৎ। টাকাআলা লোকরা বাড়িতেও নিচ্ছে বিজলি। সন্ধ্যার পর টিমটিমা কেরোসিন কুপির আলো কমতে শুরু করছে। এখন আছে শুধু দবিরের মতন গরিব মানুষের বাড়িতে। টাকাআলা লোকের বাড়িতে বিজলি। এনামুল সাব তাঁর বাড়িতে নিছেন, মসজিদে নিছেন। এখন গ্রামের টাকাআলা লোকের বাড়িতে টেলিভিশন, ফ্রিজ চলে। গেরাম অহন টাউন। কয়দিন পর রাস্তা চালু হইলে কায়কারবারও বাড়ব মাওয়ার ওইদিককার কারবারিগো। মাওয়া তরি বাসে কইরা মানুষ আসবো, তারপর ফেরিতে কইরা। পদ্মা পার হইয়া ওই পারে গিয়া যার যেই মিহি বাড়ি ওই মিহি যাইবো গা। কেউ যাইবো খুলনা যশোর, কেউ ফরিদপুর বরিশাল। ওইপারের রাস্তার কামও শেষ হইয়া আইলো। কামের কাম করলো একখান এরশাদ সাব। আর কিছু করুক আর না করুক রাস্তাঘাট ম্যালা বানাইয়া দিল দেশে। অহন শুনা যাইতাছে চৌরাস্তা থিকা সোজা বরাবইর যেই একটুখানি রাস্তা পদ্মা তরি গেছে ওইদিকে ভবিষ্যতে পদ্মা বিরিজ হইব। বিরিজ হইয়া গেলে ফেরিফুরির আর দরকার হইবো না। লঞ্চ মঞ্চে কে উটবো। যাগো মাওয়া তরি আহনের। কাম তারা মাওয়া তরি আইবো, যারা খুলনা যশোর যাইবো, ফরিদপুর বরিশাল যাইবো তারা বাসে গাড়িতে কইরা সোজা যাইবো গা বিরিজ পার হইয়া।

হজরতদের বাড়ি ছাড়িয়ে রাস্তার ওপর কতগুলি পিচের ড্রাম রাখা। খানে খানে ভুর দিয়া রাখা কার্পেটিং করায় গুঁড়া পাথর, মোটাদানার বালি, সাধারণ বালিও আছে। আর ইটের পাঁজা তো আছেই। কয়দিন আগে কোলাপাড়ার ওইদিকে গিয়েছিল দবির। সেখানে দেখে আসছে পিচপাথর মিকচার হচ্ছে বিশাল গাড়ির মতন একটা মেশিনে। মিকচার হওয়ার পর মেশিনই জিনিসটা ঢেলে দিচ্ছে রাস্তায়, লোকজন ধুমাইয়া কাজ করছে। রাস্তার ধারে পিচের ড্রামের তলায় লাকড়ির আগুন দিয়া পিচ গলানো হচ্ছে। রোলার আছে বেশ কয়েকটা। নানান পদের রোলার। ছোট মাঝারি বড়। এলাহি কারবার।

রব্বান বলল, কী চিন্তা করেন কাকা?

দবির হাসিমুখে রব্বানের দিকে তাকাল। না কিছু না। আপনে যান বাজান। আপনে তো যাইবেন ঠাকুরবাড়ি। ওই বাড়ি তো পিছে হালাইয়া আইলাম।

অসুবিদা নাই। আমি বেকার মানুষ। এমুন খাওন খাইছি, অহন ইট্টু হাঁটন ভাল। তয় আরাম লাগবো। লন আপনেরে আউগ্নাইয়া দিয়াহি। আপনের বাড়িডাও চিন্না আহি। আপনেগো গেরামেই যখন থাকন লাগবো, চিন পরিচয় যহন অইলো, বাড়িডা চিন্না রাখি। আর আপনের নামডা আমি জানি না। তয় সাবের কথায় বুজছি, আপনে গাছি। রসের। কারবার করেন।

হ বাজান। শীতের দিনে করি। অন্যদিনে ইট্টু খেতখোলা আছে ওইডি করি। ছোড সংসার। আপনের কাকি আর আমার একখান মাত্র মাইয়া নূরজাহান। পুরাপুরি বিয়ার লাইক (লায়েক) অয় নাই। বেবাক মিলাইয়া আল্লায় ভালই রাকছে। তয় আপনেরে লইয়া ইট্টু চিন্তায় পড়ছি।

রব্বান অবাক। আমারে লইয়া চিন্তায় পড়ছেন? কন কী? ক্যা? আমি আবার কী করলাম?

না ওই যে কইলেন কামকাইজও করতাছেন না, থাকনের জাগাও নাই।

হ। তয় কামের ব্যবস্তা আমি কইরা হালামু কাকা। কনটেকদারে যুদি সর্দারের এসিসটেনের কাম না দেয় তয় লেবারের কাম করুম। টেকা রুজি করন লাগবো না! নইলে খামু কী? বাঁচুম কেমতে?

হেইডা ঠিক আছে! তয় থাকন?

থাকুম নে কেঐর লগে বন্দবস্ত কইরা। আমারে লইয়া আপনে চিন্তা কইরেন না কাকা। আপনেরে দেইখা আপনের লগে বইয়া খাইতে খাইতে মনে অইলো আপনে মানুষ ভাল। কথা কইয়াও মনে অইলো। এই যে অহন কইলেন আমারে লইয়া চিন্তায় পড়ছেন এইডা হুইন্না আরও ভাল লাগল। আইজকাইল কেঐ কেঐরে লইয়া চিন্তা করে না কাকা। দুনিয়ার বেবাক মানুষ স্বার্থবাজ অইয়া গেছে। যে যারে লইয়া চিন্তা করে। অন্যরে লইয়া চিন্তা করে না। নাইলে আপন চাচায় আমার লগে কী করলো হোনলেন না! চাচাতো ভাইগো ডরে বাড়ি ছাড়লাম। নাইলে বাপের সম্পিত্তি যা পাইতাম হেতেই আমার জিন্দেগি রাজার হালে চইলা যাইতো। নিজের ভাগের জমি চুইতাম, ঘরবাড়ি করতাম, বিয়াশাদি করতাম। ভাল গিরস্তের জীবন অইতো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রব্বান। হইল না। কী করুম? কপালের ফের। তয় আমি মনে করি কাকা, জাগাজমিন ঘরবাড়ির থিকা মাইনষের জান অনেক বড়। জান বাঁচান। ফরজ। আমি ফরজ কামডা করছি। জান বাঁচানের লেইগা বেবাক ছাইড়া আইয়া পড়ছি। কোনওদিন তাগো মুখ আমি আর দেখতে চাই না।

রব্বানের জন্য খুবই মায়া লাগছে দবিরের। ইচ্ছা করছে বাড়িতে নিয়া যায় পোলাটারে। বাঁশঝাড়ের ওদিককার লাকড়ি খড়ি রাখার ঘরটায় তারে থাকতে দেয়। যেই কয়দিন কাম কাইজ না অইলো, দবিরই কষ্টমষ্ট কইরা খাওয়াইলা। তিনজন মানুষের লগে একজন মানুষ। খাইতেই পারে। চাউল ইকটু বেশি লাগবো, তরকারি ইকটু বেশি লাগবে। আর কী!

তবে এসব ভাবনা রব্বানকে টের পেতে দিল না দবির। বাড়ির কাছাকাছি এসে আঙুল তুলে নিজের বাড়িটা দেখাল। উই যে টেকটা দেখতাছেন বাজান, ইজল বউন্না ডুমইরের জঙ্গডা দেখতাছেন তারপর কদমগাছ আর বাঁশঝাড়আলা বাড়ি আমার।

রব্বান হাসিমুখে বলল, বুজছি বুজছি। তয় আপনে বাইত্তে যান কাকা। আমি যাই বাজার মিহি। কনটেকদার সাবের ম্যানাজারের লগে কথা কইয়া দেহি কী কয়? কাইল থিকা কামে লাগনঐ লাগবো। নাইলে উপায় নাই।

রব্বান দ্রুত বাজারের দিকে হাঁটতে লাগল। দবির কয়েক পলক দাঁড়িয়ে তাকে দেখল তারপর মনের ভিতর গোপন একটা ইচ্ছা নিয়া বাড়ির দিকে পা বাড়াল।

.

নূরজাহান ঘুমাইছে?

হামিদা বসে আছে দবিরের বিছানায়। মেঝেতে এখন আর নাড়ার উপর হোগলা, হোগলার উপর মোটা কাঁথা বিছিয়ে শুতে হয় না। খালি হোগলা। হোগলার মাথার দিকে বালিশ নিয়া শুয়া পড়লেই ঘুমাইয়া যায় দবির। হামিদা আর নূরজাহান আগের মতনই চকিতে। নূরজাহান জানালার ওদিকটায়, হামিদা মেঝের দিকে।

।আজ রাতের খাওয়াদাওয়া হয়েছে অনেক আগে। মা-মেয়ে খেয়েছে ঠিকঠাক মতনই, শুধু দবির তেমন খেতে পারে নাই। দুপুরে এনামুল সাবের বাড়িতে মেজবানি খেয়ে সেই যে পেট ভরে আছে, পেটে টানই পড়ছে না, ক্ষুধা লাগছেই না। তবু একটুখানি ভাত দবির খেয়েছে। তারপর থেকে খোলা দরজার সামনে বসে তামাক খাচ্ছে। নূরজাহান তার সেই পুরানা কায়দায়, শাড়িতে মুখ ঢেকে, জানালার দিকে মুখ দিয়া শুইয়া পড়ছে। শোয়ার আগে জানালা বন্ধ করছে। দবির হামিদা চায় জানালা খোলা থাকুক, রাতের ঝিরঝিরা বাতাসটা ঘরে ঢুকুক। নূরজাহান চায় না। সে ডরায়। রাতে আথকা ঘুম ভেঙে গেলে, এই জানালা দিয়া তাকালে ছাড়াবাড়ির হিজল ডুমুর বউন্নার গাছগুলি দেখা যায়। অন্ধকার রাত হলে তো কথাই নাই, জ্যোৎস্না রাত হলেও গাছগুলি আর ঝোঁপজঙ্গল কেমন ভুতুড়ে মনে হয়।

হামিদা অবশ্য রোজই একবার বলে, তুই যহন ডরাচ তয় আমি জিনালার সামনে হুই। তুই আমার জাগায় হে।

না মাইয়া তার জাগাঐ হুইবো। জানালা বন্ধই রাখবো।

আজও তাই করেছে।

শুয়ে পড়ার কতক্ষণ পর নূরজাহান ঘুমায় এটা কখনও ঠিক মতন বুঝতে পারে না দবির। বুঝতে পারে হামিদা। এইজন্য হামিদাকে অনেক সময়ই কথাটা জিজ্ঞাসা করে। যদি নূরজাহানকে নিয়া কোনও কথা বলার থাকে, আবার সেই কথা এমন কথা, নূরজাহানকে তারা শুনাতে চায় না তখন রাতেরবেলা নূরজাহান শুয়ে পড়ার পর অনেকক্ষণ ধরে তামাক টানে দবির তারপর একসময় জানতে চায় নূরজাহান ঘুমিয়েছে কিনা। আর দবিরকে যে রাতে এইভাবে দুয়ার খোলা রেখে তামাক টানতে দেখে হামিদা, সে বুঝে যায় আইজ মাইয়ারে লইয়া কোনও কথা আছে।

দবিরের সেই নমুনা দেখেই চকিতে এখনও ওঠে নাই হামিদা। স্বামীর হোগলার বিছানায় বসে আছে। এখন দবিরের কথা শুনে একবার চকির দিকে তাকাল। তাদের দিকে পিছন ফিরে শুয়ে থাকা নূরজাহানকে দেখল তারপর বলল, হ ঘুমাইয়া গেছে। যা কওনের কইতে পারো।

মুখ থেকে হুঁকা নামাল দবির। কুপির আলোয় হামিদার মুখের দিকে তাকাল। না, ওই শালার পো শালায় তো আমারে খালি ঘুরাইতাছে আর টেকা খাইতাছে।

কার কথা কও? কে টেকা খাইতাছে?

আরে ওই রমিজ্জা শালায়। ঘটকায়।

বুজছি, বুজছি।

এই তরি একহাজার একশো টেকা দিছি শালার পো শালারে। পছন্দ মতন একখান পোলা আনতে পারল না নূরজাহানের লেইগা। যেইডি আনে হেইডি অইলো ওই যে দেলরা বুজির বাইত্তে থাকে মতলা, রাবির জামাই, বাদলার বাপ, ওই পদের। এক্কেরে ফকির মিসকিন। ওইরকম সমন্দ আমি করুম না।

না হেইডা করবা ক্যা? আমার মাইয়া ইট্টু কালাকোলা, তয় চেহারা সুরত ভাল, শইল সাস্ত ভাল। অরে অমুন ম্যাড়া ধরার কাছে বিয়া দিবা ক্যা?

দবির আবার হুঁকায় কয়েকটা টান দিল। আরে হের লেইগাঐ তো দিতাছি না। এই তরি দোজবর সমন্দ আনছে দুইডা। একটা আনছে, বেডার বস অইবো আমার থিকাও বেশি।

না না এই হগল সমন্দ অইবো না।

তয় মাইয়া তো বিয়া দেওন লাগবো, নাকি? ওই শুয়োরের পোর হাত থিকা তো এনামুল। সাবে বাঁচাইয়া দিছে। দিয়া কইছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভাব মাইয়া বিয়া দিয়া দেও। হেইদিনে পর আইজ তার লগে দেহা অইলো। হেয় মজজিদ বানাইয়া বেবাক কাম শেষ করল আর আমি মাইয়াডার বিয়ার কোনও ভাওঐ করতে পারলাম না। আইজ তার মুখের মিহি শরমে আমি চাই নাই। তয় হেয় একবার আমার সামনে আইছে, আমি ঠিক লাহান খাইতাছি কিনা জিগাইছে। তহন আরও ডর করছে। এই না জিগায়, গাছি, মাইয়ার বিয়ার কী করলা? আল্লার রহমত যে জিগায় নায়। মেজবানি লইয়া ব্যস্ত আছিল দেইখা মনে অয় তার মনে আছিল না। জিগাইলে আমি বিরাট শরম পাইতাম।

শরম পাইবা ক্যা? তারে কইতা, চেষ্টা করতাছি। ঘটক লাগাইছি।

হ হেইডা তো কইতাম। তয় বিয়া মাইয়াডার আইটকা রইল ক্যা? আউন্নায়ঐ না।

এইডা আমিও চিন্তা করতাছি। ওই শুয়োরের পোয় আবার আমার মাইয়ার বিয়া বন্দ কইরা রাখলোনি?

অইতে পারে। শালায় তো কুফরি কালাম (এক ধরনের বদদোয়া) জানে। কুফরি কালাম দিয়া মাইনষের অনেক ক্ষতি করন যায়। এইডা আমার অনেক আগে একদিন মনে অইছিল। এর লেইগা গেছিলাম খাইগোবাড়ির হুজুরের কাছে। হুজুররে বেককিছু ভাইঙ্গা কইলে হেয় ববস্তা নিতে পারতো। আমগো বরাত খারাপ। হুজুর নিজেই তো চইলা গেলো!

হামিদা চমকাল। চইলা গেলো? কও কী তুমি? হুজুরে মইরা গেছেনি?

হ। গলায় ক্যান্সার অইছিল হেইডা তো তুমি হোনছোঐ। ঢাকার হাসপাতালে আছিল, ওহেন থিকা দেশে গেছিলো গা। যাওনের কয়দিন বাদেই আল্লায় তারে উড়াইয়া নিছে।

আহা রে!

নতুন করে তামাক সাজিয়ে আবার টানতে লাগল দবির। বাইরে অন্ধকার রাত ঝিমঝিম করছে। বাঁশঝাড়ে শনশন করে বইছে ফাগুন হাওয়া। ঝিঁঝি ডাকছে, দূরে ডাকছে একটা রাতপাখি। পুকুর পারের ওদিকটায় জোনাকপোকা উড়ছে। তাদের মোলায়েম আলো বিন্দু বিন্দু জ্বলছে।

হামিদা বলল, শুয়োরের পোয় যুদি আমার মাইয়ার বিয়া বন্দ কইরা রাখে, যুদি এমুন ববস্তা করে যে বচ্ছরের পর বছর যাইবোগা আমার মাইয়ার বিয়া অইবো না তয় তো আর কোনও উপায় থাকবো না। বাইধ্য অইয়া অর কাছেঐ মাইয়া বিয়া দেওন লাগবো।

এইডাঐ আমি চিন্তা করতাছি।

দবির অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে তামাক টানতে লাগল। কিছুক্ষণ টেনে আবার হামিদার দিকে তাকাল। তোমারে আইজ দুইহান কথা কমু। মন দিয়া হোনবা।

হামিদা একটু আগায়া আসলো। আইচ্ছা কও।

যেদিন আমি খাইগো বাড়ির হুজুরের কাছে গেছিলাম হেদিন ফিরনের সময় গেছিলাম মরনি বুজির বাইত্তে। নানানপদের কথার ফাঁকে, নূরজাহানের বিয়ার কথা কইতে কইতে এক ফাঁকে বুজিরে জিগাইলাম, আমি তো আমার মাইয়া বিয়া দেওনের চেষ্টা করতাছি বইন, তুমি তোমার মজনুরে বিয়া করাইবা না? ইটটু চালাকি কইরা কথাডা আমি উডাইছিলাম। আমার মনের মইদ্যে আছিল, মরনি বুজি আমার মাইয়াডারে এত আদর করে, এই কথা হুইন্না মনে অয়। কইবো, আপনের মাইয়া আমারে দেন গাছিদাদা। আমার মজনুর লগে অরে বহুত মানায়। আমার একখান পোলা আছে, পোলার বউ অইলে একটা মাইয়াও পামু। বুজি এই হগল কথার ধার দিয়াও গেলো না। কইলো, না মজনুরে অহন বিয়া করামু না গাছিদাদা। আমার পোলার বিয়ার বস অয় নাই। অরে বিয়া করামু আরও তিন-চাইর বচ্ছর পর।

হুইন্না তোমার মনে বহুত দুকু অইছে, না?

হ। বহুত দুক্কু অইছে।

দুক্কুর কাম নাই। তারা হালদার আর আমরা হইলাম গাছি। হালদার বাড়ির পোলার লেইগা গাছির মাইয়া তারা নিবো না। তুমি দুকু পাইছো খালি খালি।

হ পরে আমি এইডা বুজছি। তয় নূরজাহানের লগে মজনুরে বহুত মানাইতো। আর ওই। বাড়ির বউ অইয়া গেলে মাইয়াডা আমার বিরাট সুখে থাকতো।

হেইডা থাকতো। মরনি বুজি মানুষ ভাল। এমতেঐ নূরজাহানরে অনেক আদর করে। পোলার বউ অইয়া গেলে আরও বেশি আদর করতো। মাইয়াডাও আমগো চোক্কের সামনে। থাকতো। যহন ইচ্ছা এই বাইত্তে আইতে পারতো, তুমি আর আমি যহন ইচ্ছা দৌড়াইয়া গিয়া মাইয়াডারে দেইক্কাতে পারতাম। অহন বিয়া অইলে কোন গেরামে অইবো, আমগো গেরাম থিকা কত দূরে অইবো জামাইবাড়ি, দুই-চাইর বচ্ছরেও মাইয়াডার লগে দেহা। অইবো না। মাইয়াডারে ছাইড়া থাকতে কইলজাড়া পুইড়া যাইবো আমার।

তামাক টানা রেখে আবার হামিদার মুখের দিকে তাকাল দবির। তোমার কইলজা যাতে না পোড়ে হেই বস্তা আমি কইলাম করতে পারি।

হামিদা অবাক। কেমতে?

মাইয়া বিয়া দিয়া ঘরজামাই রাখলাম।

অমুন জামাই পাইবা কই?

চেষ্টা করলে মনে অয় পাওয়া যাইবো।

হেমুন কোনও সমবাত পাইছোনি? ঘটকায় হেমুন পোলা আনছে?

আরে না।

তয়?

আমি নিজেঐ অমুন একখান পোলা পাইছি।

হাছাঐ?

তয় মিছানি? মাইয়ার বিয়া লইয়া আমি তোমার লগে মিছাকথা কমু?

হামিদা অস্থির হল। কই পাইলা? কবে পাইলা?

আইজই পাইছি। এনামুল সাবের মেজবানি খাইতে গিয়া।

কও কী?

হ। হোনো ঘটনা।

দবির তারপর রব্বানের কথা বলল হামিদাকে। রব্বান যেভাবে যা বলেছে সব বলল। সে দেখতে কেমন, কথাবার্তা আচার ব্যবহার কেমন, বলল। তাকে কাকা কাকা করেছে তাও বলল। বলল এমন মায়াবী গলায়, শুনে হামিদার মনও রব্বানের জন্য গভীর মমতায় ভরে গেল। বলল, হুইন্না পোলাডার লেইগা মায়া লাগতাছে।

দবির বলল, দেখলেও তোমার মায়া লাগবো। কথাবার্তা হোনলে মায়া লাগবে।

তয় পোলাডা তো এক্কেরেঐ এতিম। বাপ মা ভাইবইন তো নাই। জাগা সম্পিত্তি বাড়িঘর থাকতেও নাই।

হ এইডা অইলো আসল সমস্যা।

হামিদা চিন্তিত গলায় বলল, এমুন পোলার কাছে মাইয়া বিয়া দিবা?

না না, মাইয়া বিয়া দিমু এমুন কথা আমি কই নাই। রব্বানরে দেইখা অর লগে কথাবার্তা কইয়া আমার মনে অইছে যে পোলাডার দুইন্নাইতে কেঐ নাই, আমারও একখান মাত্র মাইয়া। এত আদর কইরা পালছি। হেই মাইয়া কই না কই বিয়া দিমু? তারবাদে মাইয়া ছাইড়া কেমতে থাকুম এই হগল চিন্তা কইরা কথাডা তোমারে কইলাম।

তোমার কথা আমি বুজছি।

এই পোলার কাছে বিয়া দিলে কিছু সুবিদাও আছে।

কেমুন সুবিদা?

থাকবো তো আমগো বাইত্তে। বিয়ার টেকা পয়সা খরচাপাতি তেমুন লাগবো না। অন্য জাগায় মাইয়া বিয়া দিতে গেলে যেই কয়টেকা আমি জমাইছি হেতে তো কিছুই অইবো না। এনামুল সাবে নাইলে কিছু টেকা দিল। আর দিবো কেডা? পরে দেহা গেল জমিনডু বেচতে অইলো মাইয়ার বিয়ার লেইগা। বুড়া বসসে যহন গাছ ঝুরতে পারুম না তহন না খাইয়া মরণ লাগবো।

হ কথা ঠিক। তয় চিন্তা করো।

আমার চিন্তা আমি করছি। অহন চিন্তা করবা তুমি। তুমি যুদি মনে করো হ এই সমন্দ করন যায় তয় আমি রব্বানের লগে কথাবার্তির ববস্তা করুম। রব্বান কইলাম আমারে কইছে ও আর কোনওদিন মালখানগর যাইবো না। অর জানের ডর আছে। বিয়াশাদি কইরা এই মিহিঐ থাইক্কা যাইবো।

তারবাদেও কথাবার্তি ও যা কইছে বেবাক ঠিক আছে কি না, নাকি মিছাকথা কইছে এই হগল খোঁজখবর লওন লাগবো না?

দবির হুঁকা নামায়া রাইখা হাসল। আরে ওই হগল তো অনেক পরের কথা। আগে সমন্দ করবা কিনা হেইডা চিন্তা করো। রব্বানরে দেহো তারবাদে সেন্না ওই হগল।

হ। তয় পোলাডারে ডাকাও, দেহি ইট্টু।

ডাকামুনে। কাইল থিকা মনে অয় সড়কের কামে লাগবো। ডাইক্কা আনুমনে! কামে না লাগলেও বিচড়াইয়া বাইর করতে পারুম। ঠাকুরবাড়ির ওইমিহি থাকে। মকবুল নামে এক মাইট্টালের নাম কইছিল। তার কাছে গেলেই পামুনে।

হামিদা হাই তুলল। দেইখা দবির বুঝল ঘুম আসতাছে তার। উইঠা দুয়ার বন্ধ করল সে। হামিদা উইঠা গেল চকিতে, দবির ফুঁ দিয়া কুপি নিভাইয়া হোগলার বিছানায় শুইয়া পড়ল।

.

কাল রাতে মা বাবার বেবাক কথাই শুনছে নূরজাহান।

তারা মনে করছিল নূরজাহান ঘুমায়া গেছে। আসলে সে ঘুমায় নাই। কয়েকদিন ধরে ঘুমটা আগের মতন শুইয়া পড়লেই আসে না। অনেক আবল তাবল কথা মনে। হয়। বেবাকই বিয়াশাদির কথা। আর বিয়াশাদির কথা মনে হইলেই মনে হয় একজন মানুষের কথা। মজনু। মজনুর মুখটা চোখের সামনে ভাইসা ওঠে। তার কথা বলার ভঙ্গি, হাটাচলা, তাকানো আর ওই যে পলাইয়া পলাইয়া সিগ্রেট খাওয়া, সব মনে পড়ে। নিজে সামনে বইসা বাড়ির বউর মতন মজনুরে পোলাও মোরগ বাইড়া খাওয়াইছিল, এইসবও মনে পড়ে। মনের খুব ভিতরে মজনুরে নিয়া একটা স্বপ্নও তৈরি হইছিল। যুদি মজনুর লগে তার বিয়া হয়! বিয়া হইলে কুট্টি যেমুন পাগল হইছিল আলফুর জন্য সেও তেমুন পাগল হইব মজনুর জন্য। কুট্টি তো তার আলফুরে পাইয়া গেছে। বিয়া হইয়া গেছে। অহন পোলাপানও হইবো। মনের মানুষরে লইয়া যা যা ভাবছে সব হইয়া গেছে কুট্টির।

আর নূরজাহানের?

এতদিনকার স্বপ্নটা কাইল রাইতে শেষ হইয়া গেছে। রমিজ ঘটকের কাছে বাপরে দৌড় পাড়তে দেইখা নূরজাহান একদিন ভাবছিল রমিজরে মরনি আম্মার কাছে ক্যান পাড়ায় না বাবায়? মজনুর লগে তার বিয়ার সমন্দ লইয়া রমিজ যুদি একবার মরনি আম্মার কাছে যায় তয়ঐত্তো কাম অইয়া যায়।

না, ভুল। ভুল চিন্তা করছিল নূরজাহান। তার মনে যা আছিল, দবির-হামিদার মনেও তা আছিল। তারাও চাইছে মজনুর লগে বিয়া হউক নূরজাহানের। বাবায় নানান পদের কথার ফাঁকে কথাডা উডাইছিলো। মরনি আম্মায় হেই কথার ধার দিয়াও যায় নাই। মজনুরে বলে অহন বিয়াই করাইবো না। করাইবো তিন-চাইর বচ্ছর পর। তয় তিন-চাইর বচ্ছর পরও যুদি নূরজাহানরেই বাড়ির বউ কইরা নিতে চাইতো, তয় কি তিন-চাইর বচ্ছর নূরজাহানের মা বাপে মজনুর লেইগা বইয়া থাকতো না?

থাকতো! কথাবার্তা পাকা অইয়া গেলে, দেশগেরামে কত মাইয়া এইভাবে বইয়া থাকে! তখন তো আর কোনও ঝামেলাও থাকে না! বিয়া ঠিক অইয়া রইছে এমুন মাইয়ার পিছেও তো কেউ লাগতে আহে না। মান্নান মাওলানার মুখ বন্ধ হইয়া যাইতো। এনামুল সাবেও কিছু মনে করতো না। সব দিক ঠিক রাখন যাইতো।

রাতটা নূরজাহান এইসব ভাইবা আর ঘুমাইতে পারে নাই। মনটা খুব খারাপ হইছে। মরনি আম্মায় এত আদর করে তারে, দুইবার দুইভাবে তারে বাঁচাইলো আর এত কিছুর পর একবারও চিন্তা করলো না নূরজাহানরে পোলার বউ করন যায়! মজনুর লগে এমন কোনও কথাও আইজ তরি নূরজাহানের হয় নাই যে সে মজনুরে ভালবাসে, তারে বিয়া করতে চায়। মজনুও কোনওদিন এমন কিছু বলে নাই। সবই মনে মনে। মজনুর মনে। কী আছে নূরজাহান পুরাপুরি বোঝেও নাই। সে বুঝছে শুধু তার নিজের মনটা। তার মন মজনুরে চায়। মজনুর মন তারে চায় কি না পুরাপুরি বুঝতে পারে নাই। যা দুই একটু আভাস পাইছে কথাবার্তায় তাতে পুরাপুরি বুঝা যায় না কিছুই।

এই অবস্থায় কী করার আছে নূরজাহানের! এত বেহায়া তো সে না যে মজনুরে কোনও না কোনওভাবে খবর দিয়া নিজের মনের কথা জানাইবো! মজনু জাইনা ধরবো মরনি আম্মারে। খালা, আমি নূরজাহানরে বিয়া করুম। তুমি গাছিমামার লগে কথা কও।

নূরজাহানের তারপর পরির কথা মনে হইছে। আজিজ গাওয়ালের মাইয়া পরি। নূরজাহান কি পরির কাছে যাইবো? পরি লেখাপড়া জানে। পরিরে দিয়া কি মজনুরে একটা পত্র লেখাইবো? পত্রে জানাইবো নিজের মনের কথা! পত্র লেখলে সেই পত্র কারে দিয়া। পাঠাইবো ঢাকায় মজনুর কাছে!

তারবাদে দেহা গেল নূরজাহান যা ভাবছে ঘটনা তেমুন না। মজনুদাদার চিন্তাও মরনি আম্মার মতন। নূরজাহানরে বিয়া করবো এমুন চিন্তা সে করেই নাই।

ছি ছি! তয় শরমে এক্কেরে মইরা যাইবো নূরজাহান। জিন্দেগিতে মজনুরে আর এই মুখ দেহাইতে পারবো না। পরিরে দিয়া পত্র লেখাইলে পরি হইয়া থাকলে সাক্ষী। পরির সামনে গিয়াও তো তারবাদে খাড়ইতে পারবো না নূরজাহান।

সবকিছু মিলায়া নূরজাহানের মনটা এলোমেলো হয়ে গেল। মজনুর চেয়েও কেন যে মরনি আম্মার ওপর অদ্ভুত এক অভিমান হল তার। মায়ের ওপর যেমন অভিমান হয় কোনও কোনও ছেলেমেয়ের, মরনি আম্মার ওপর নূরজাহানের অভিমানটা তেমন। আধা। ঘুমে আধা জাগরণে রাতটা তার কাটল। সকাল থেকে মনমরা ভঙ্গিতে, উদাস ভঙ্গিতে নিজের কাজগুলি করল, সংসারের টুকটাক কাজ করল দুই একটা। দবির না, হামিদা তাকে খেয়াল করল। রান্নাচালায় বসে দুপুরের রান্না করতে করতে মেয়ের দিকে তাকাল। হামিদা। তাকিয়ে দেখে উঠানে দাঁড়ায়া হিজল বউন্নার টেকটার দিকে উদাস চোখে তাকায়া আছে। দবির বাড়িতে নাই। দশগন্ডা জমিনে ইরির চাষ শুরু হইছে। সে গেছে সেই কাজে। ভাদাইম্মা বসে আছে রান্নাচালার অদূরে।

হামিদা নূরজাহানকে ডাকল। নূরজাহান, এই মিহি আয়।

নূরজাহান আসল। কী?

কী অইছে তর?

কো কী অইছে?

বিয়ান থিকা দেকতাছি মনমরা।

কীয়ের মনমরা।

হ। আমি তর মুক দেকলে বুজি। মুখটা হুগনা। মনে অয় কী জানি চিন্তা করতাছস?

না কিছুই চিন্তা করি না।

তয়?

তয় আবার কী? রাইত্রে ঘুমড়া ভাল অয় নাই।

ক্যা?

কইতে পারি না।

হামিদা তীক্ষ্ণচোখে মেয়ের মুখের দিকে তাকাল। তর বাপের আর আমার কথাবার্তা হোনছসনি?

নূরজাহানও মায়ের মুখের দিকে তাকাল। তারপর মিছাকথা বলতে শুরু করল। কোন কথা?

তর বাপে আর আমি তো কাইল রাইতে বহুত প্যাচাইল পারছি।

কুনসুম?

তুই হুইয়া পড়নের পর।

আমি হুনি নাই।

তয় যে কইলি রাইত্রে ঘুম অয় নাই।

একদোম অয় নাই হেই কথা কই নাই। হইছে। তয় ভাল না। বাবারে দেকলাম খোলা দুয়ারের সামনে বইয়া তামুক খাইতাছে আর তুমি বইয়া রইছো বাবার বিচনায়। তারবাদে আমি ঘুমাইয়া গেছিলাম। ঘুমড়া ভাঙছে রাইত দোফরে। তহন আমার লগে হুইয়া তুমি বেভোর ঘুম। মোগলায় হুইয়া বাবায় নাক ডাকতাছে। আমার আর ঘুম আহে নাই।

হামিদার তারপরও সন্দেহ গেল না। তার মনে হল নূরজাহান তাদের কথা শুনেছে। ওইসব শুনেছে বলেই মনমরা হয়ে আছে।

তারপরই মনে মনে একটা ধাক্কা খেল হামিদা। তয় কি নূরজাহান মজনুরে পছন্দ। করে? সে চাইছিল মজনুর লগে তার বিয়া হউক? দবিরের মুখে মরনি বুজির কথা শুইনা মন ভাইঙ্গা গেছে মাইয়াডার! এমুন যুদি হয় তয় তো মাইয়াডা মনে মনে হারাজীবন কষ্ট পাইবো। সংসার করবো একজনের, ভাববো আরেকজনের কথা। যে-কোনও দুঃখ বেদনায়। মনে অইবো, আহা এই জামাইর জাগায় যুদি ওই জামাই হইতো তয় এই দুঃখ বেদনা আমার হইতো না। সে আমার মনে দুঃখ দিতো না। আমারে সুখে রাখতো। আমার মন বুইঝা চলতো।

হামিদারও তারপর মন খারাপ হল। আল্লায় আমার মাইয়াডার কপাল এমুন করছে ক্যা? এই বসে এতকিছু ক্যান ঘটতাছে অর জীবনে! এই বসেই যহন এতকিছু ঘটতাছে, বাকি জীবন তো পইড়া রইছে। আরও কী না কী যে আছে অর জীবনে!

নূরজাহান তখন হাঁটতে হাঁটতে বাঁশঝাড়তলার ওদিকটায় যাচ্ছে। তাকে ওইদিকে যেতে দেখে ভাদাইম্মা লাফ দিয়া উঠল। লেজ নাড়তে নাড়তে নূরজাহানের পিছন পিছন চলল। অন্যান্য দিন ভাদাইম্মার লগে নানান পদের মজা করে নূরজাহান, খেলা করে। আজ সেইসবের কিছুই সে করছে না। আনমনা ভঙ্গিতে হাঁটছে। বাঁশের বনে আর গাছগাছালির পাতায় পাতায় ফাগুন মাসের রোদ হাওয়া খেলা করছে। মাঝিবাড়ির দক্ষিণ দিককার নামায়, চকের মুখে একটা শিমুলগাছ। সেই গাছে ফুল ফুটেছে। শিমুল ফুলে লাল হয়ে আছে গাছটা। তাকালে মনের ভিতরটা কেমন করে ওঠে।

বাঁশঝাড়তলায় এসে শিমুল গাছটার দিকে তাকায়া রইল নূরজাহান। মজনু মরনির কথার। লগে লগে তার মনে আসল কালরাতে বাবার মুখে শোনা রব্বান নামের মানুষটার কথা। রব্বানের লগে নূরজাহানরে বিয়া দিয়া তারে এই বাড়িতে রাইখা দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করছে। দবির-হামিদা। ঘরজামাই। যদি রব্বানের লগেই শেষতরি বিয়া হয় নূরজাহানের তয় আর শ্বশুরবাড়ি বইলা কিছু এই জীবনে হইলো না তার। যেই বাড়িতে জন্ম সেই বাড়িতেই কাটবো জিন্দেগি। মজনুর লগে বিয়া হইলে মরনি আম্মার বাড়ি হইত জামাইবাড়ি। সেইটা না হইলে অন্য কোনও বাড়িতে, অন্য কোনও গেরামে বিয়া হইলে কেমুন হইতো জামাইবাড়ি, সেই বাড়ির মানুষজন, ঘর দুয়ার, হৌর হরি দেওর ননদ। আর জামাই!

বিয়ার কথাবার্তা হওয়ার পর থেকেই এইসব যখন তখন ভাবে নূরজাহান। কয়েকদিন ধরে শুধুই ভাবছে মজনুর কথা। কুট্টি আলফুর ঘটনা জানার পর থেকে মজনু যেন মনের আরও অনেকখানি জুড়ে বসেছিল। কত স্বপ্ন কতভাবে তারপর থেকে দেখছেনূরজাহান। কালরাতে সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে। আজ স্বপ্নভাঙা মন নিয়া এখন এই দুপুরবেলা বাশঝাড়তলায় দাঁড়ায়া মাঝিবাড়ির শিমুল ফুলে ভরা গাছটার দিকে তাকায়া আছে নূরজাহান। মজনু-মরনির কথা ভুলে তার এখন মনে পড়ছে রব্বান নামের মানুষটার কথা। কেমন দেখতে সে? বাবায় যে বলল মায়াবী চেহারা, কথাবার্তা সোন্দর, হাসি সুন্দর। জামাই হিসাবে নূরজাহানের কি ভাল লাগবো তারে? অনাথ এতিম মানুষ। দুনিয়াতে কেউ নাই। তার লগে বিয়া হইলে কোনওদিন জামাইর দিককার কোনও বাড়িতে নাঐর যাইতে পারবো না নূরজাহান। এই গেরামের মইধ্যেই, এই বাড়ির মইধ্যেই জিন্দেগি কাটবো।

নূরজাহান একটা নিয়াস ছাড়ল। আর সেদিন বিকালের মুখে মুখেই রব্বানের লগে তার দেখা হয়ে গেল।

.

এইডা কি গাছিকাকার বাড়ি না?

নূরজাহান দাঁড়ায়া আছে ছাড়াবাড়িটার দিকে মুখ করে। ফাগুন মাসের বিকাল হয়ে আসা রোদে ঝকমক ঝকমক করছে গিরস্তবাড়ির উঠান পালান, গাছগাছালি আর চকমাঠ। হাওয়া আছে। হাওয়ায় ঠান্ডা ভাব নাই। বেশ গরম। চকেমাঠে ইরি ধানের চারা গোড়ায় পানি পাইয়া ধীরে ধীরে সবুজ হচ্ছে। পদ্মা থেকে পাম্প দিয়া পানি আনা হচ্ছে গ্রামে। এক খেত থেকে আরেক খেতে পানি নেওয়ার জন্য নালা কাটা হয়েছে। খেতের পর খেত ভরে গেছে পদ্মার পানিতে। রোদ হাওয়ায় সবুজ ইরিমাঠ ঝিমঝিম করে।

নূরজাহান তাকায়া ছিল চকের দিকে, তবে দেখছিল না কিছুই। মনের মধ্যে ওই সেই অভিমান। মজনু, মরনি আম্মা। এত আপন তাদের দুইজনরে ভাবছে নূরজাহান আর তারা ভাবল না তার কথা!

এই সময় ছাড়াবাড়ির পাশ দিয়া হাঁইটা আসল লোকটা। নূরজাহানদের বাড়িতে ওঠার মুখে দাঁড়ায়া জিজ্ঞাসা করল কথাটা। লগে লগে তারে চিনতে পারল নূরজাহান। দবির যেমন যেমন বলছে চেহারা সুরত তেমনই। মাথায় বাবরি চুল, মুখে দাড়িমোচ ভরা, পরনে। ময়লা সাদা শার্ট আর খাকি ফুলপ্যান্ট, পায়ে টায়ারের স্যান্ডেল। মুখটা হাসিহাসি।

নূরজাহান কথা বলবার আগেই সে বলল, আমার নাম রব্বান। রব্বান শিকদার। কাইলঐ গাছিকাকার লগে চিন পরিচয়। বাড়িডা সেয়ই আমারে চিনায়া দিছে। সড়কের কামে লাগনের কথা আছিলো আইজ। লাগি নাই। এর লেইগা মনে করলাম কাকার লগে ইট্টু দেহা কইরা যাই। কাকায় নাই বাইত্তে? আপনে…। আরে ধুরো, তোমারে আপনে কমু ক্যা? তুমি তো আমার থিকা ম্যালা ছোড। তোমারে তুমি কইরা কই। আমি তোমারে চিনছি। তুমি কাকার মাইয়া। একমাত্র মাইয়া। তোমার নামও আমি জানি। কাকায় কইছে। নূরজাহান। আমি ইট্টু লেখাপড়া জানি। তোমার নামের অর্থডা কইতে পারি। নূর অর্থ হইল আলো, আর জাহান হইল দুনিয়া। দুইডা মিল্লা তোমার নামের অর্থ হইল দুনিয়ার আলো। বিরাট ভাল নাম।

বলেই হাসল রব্বান। সেই ফাঁকে নূরজাহান খেয়াল করল রব্বানের হাসি খুব সুন্দর। মোচ দাড়িতে মুক ঢাইকা আছে, তাও চেহারাডা বুঝা যায়। ভালই। দবির ঠিকঐ কইছে, কথায় চেহারায় মায়া মায়া ভাব আছে। কথা একটু বেশি কয়। তয় শোনতে খারাপ লাগে না।

নূরজাহান কথা বলবার আগেই ঘর থেকে বাইর হইয়া আসল হামিদা। অচেনা একজন মানুষকে বাড়ির সামনে দাঁড়ায়া থাকতে দেখে ব্যস্ত হয়ে মাথায় ঘোমটা দিল।

নূরজাহান বলল, বাবার কাছে আইছে মা।

মুখে প্রায় আইসা পড়ছিল, কাইল রাইতে বাবায় যার কথা কইছে এইডাই সেয়। বলল না ধরা পড়ার ভয়ে। বললেই হামিদা বুঝে যাবে দুপুরবেলা তার লগে মিছাকথা কইছে নূরজাহান। কালরাতে মা-বাবার বেবাক কথাই সে শুনছে।

হামিদা কথা বলবার আগেই রব্বান তার স্বভাব মতন হাসিমুখে বলল, আমি মালখানগরের রব্বান কাকি। গাছিকাকার লগে…

হামিদা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেল, একটু ব্যস্ত হল। সেই ফাঁকে রব্বানকে খেয়াল করে দেখল। তারপর বলল, আহেন বাজান, বাইত্তে আহেন। আপনের কাকায় আপনের কথা আমারে কাইল কইছে। নূরজাহানরে কয় নাই। নূরজাহান জানে না। এর লেইগা আপনেরে চিনে নাই। আহেন, আহেন। নূরজাহান, জলচকিডা আন। বইতে দে।

রব্বান হাসিমুখে বাড়িতে উঠল। আপনেও তো দেহি কাকার লাহানঐ কাকি? নাম হুইন্নাঐ আপন কইরা লইলেন! আমি তো আমার মা’রে দেহি নাই, আমার জন্মের পর পরঐ মইরা গেছে। দেখছি চাচিরে। তয় হেই চাচি আদর কারে কয় জানে না। খালি ধমকাইতো! কিলওঁতা মারতো। মা’র আদরডা আমি কোনওদিন পাই নাই। আপনেরে দেইক্কা মনে অইলো, আমার মা’য় মনে অয় আপনের লাহানঐ আছিল। বাপে মনে অয় আছিল গাছিকাকার লাহান। দুইজনেরঐ মন ভরা মায়া।

নূরজাহান ততক্ষণে জলচৌকি নিয়া আসছে। বড়ঘরের ছেমায় রাখছে জলচৌকি। সে কথা বলল না। হামিদা বলল, বহেন বাজান, বহেন।

রব্বান বসতে বসতে বলল, কাকায় কো?

ইরিখেতে গেছে। হারাদিন খেতে আছিল। বিয়ান থিকা খেতের পানি, ধানচারা ঠিক আছে কি না দেখছে। দোফরে বাইত্তে আইয়া ভাতপানি খাইয়া ইট্টু জিরাইছে তারবাদে আবার গেছে। আপনে বহেন। অহনঐ আইয়া পড়বো। ও নূরজাহান, মুড়ি মিডাই দে। আমি এককাপ চা বানাই।

রব্বান বলল, না না কাকি কিছু লাগবে না। আপনে বহেন, আপনের লগে কথাবার্তি কই।

হেইডা কন। তয় মুড়ি মিডাই খাইতে খাইতে কন। আমি চা না বানাইলাম, নূরজাহান বানাইবোনে। আমার মাইয়া কামের আছে। রান্দনবাড়ন খুব সোন্দর।

নূরজাহান দাঁড়ায়া আছে বড়ঘরের কপাট ধইরা। হামিদার কথা শুনে একটু যেন শরম পাইল। মাথা নিচা কইরা খাড়ায়া রইল। মুড়ি মিঠাই দিব কি দিব না বুঝতে পারছে না। হামিদা বলছে দিতে, রব্বান বলছে, দেওনের কাম নাই। কোনটা করব নূরজাহান?

হামিদার কথা শুনে রব্বান মুগ্ধচোখে তাকাইছে নূরজাহানের দিকে। ফাগুন দিনের বিকালবেলার রোদ আছে উঠানে। সেই রোদের আভা গিয়া পড়ছে নূরজাহানের মুখে। তাতে ভারী সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। রব্বানের বুকে একখান দোলা লাগল।

হামিদা তাকাল নূরজাহানের দিকে। কী রে, মুড়ি মিডাই দিলি না?

নূরজাহান কোনওরকমে বলল, সেয় যে না করতাছে।

আরে সেয় তো না করবো। তর দেওন তুই দে। তারবাদে চা বানাইতে যা।

রিকাবিতে করে মুড়ি আর নারকেল দিয়া তৈরি করা খাজুড়া মিঠাই এনে রব্বানের হাতে দিল নূরজাহান। যদিও ঘটনা সে জানে, তবে বুঝতে দিচ্ছিল না হামিদাকে, তবু শরম করছিল তার। রব্বানের মুখের দিকে যেন তাকাতে পারছিল না।

রিকাবি হাতে নিয়া রব্বান আড়চোখে একবার নূরজাহানকে দেখল।

মুড়ি মিঠাই খেতে খেতে হামিদার দিকে তাকাল রব্বান। বহেন কাকি, বহেন। আমার কাছে শরম পাইয়েন না। আমি আপনের ছেলের মতন। ছেলের কাছে মা’র আবার শরম কীয়ের। আমারে একহান ফিরি দেন আর আপনে বহেন এই জলচকিতে। তারবাদে মায়ে পুতে কথাবার্তি কই! কাকায় আহুক, তার লগে দেহা কইরা তারবাদে যামু নে।

না না বাজান, আপনে জলচকিতেই বহেন। আমি ফিরি আইন্না বইতাছি।

ভাদাইম্মা ছিল বাঁশঝাড়তলার দিকে। বাড়িতে অচেনা মানুষের গলা পেয়ে ছুঁইটা আসছে। আইসা রব্বানরে দেইখা দুই-তিনখান ঘেউ দিছে। হামিদা তারে দিছে ধমক। খেউক্কাই না। আমগো চিন পরিচিত মানুষ।

নূরজাহান তখন চা বানাতে গেছে রান্নাচালায়। মনের ভিতর তার অদ্ভুত এক অনুভূতি। এই মানুষটা যুদি তার জামাই হয়! এই বাড়িতেই যুদি থাকে! মানুষটারে কি তার ভাল লাগবে! মানুষটার কি ভাল লাগবো তারে!

রব্বান যখন চা খাচ্ছে তখন দবির আসলো। খেতখোলার কাজে হাত পায়ে প্যাককাদা লাইগা আছে। আনমনা ভঙ্গিতে বাড়িতে উঠছিল, রব্বানকে উঠানে বসে থাকতে দেখে অবাক। হাসিমুখে বলল, আপনে কুনসুম আইলেন বাজান?

রব্বান চায়ের কাপ হাতে উঠে দাঁড়াল। আইছি তো অনেকক্ষুন হইল কাকা। কাকি মুড়ি মিডাই চা বেবাক খাওয়াইছে। আপনের লেইগা দেরি করতাছিলাম আর আপনেগো। কথা চিন্তা করছিলাম। আপনে যেমুন ভাল মানুষ, কাকিও আপনের মতন ভাল মানুষ। নূরজাহানের লগে তেমুন কথা হয় নাই। দেখছি তারে। তয় এইডা আমি সাফ সাফ বুজছি, মা-বাপ ভাল হইলে মাইয়া ভাল না হইয়া পারে না। আপনেরা তিনজনেই ভাল মানুষ।

দবির আগের মতনই হাসিমুখে বলল, ইট্টু বহেন বাজান, আমি হাত-পাও ধুইয়াহি।

তারপর হামিদার দিকে তাকাল। নূরজাহানের মা, আমার লেইগা তামুক সাজাও।

হামিদা বলল, চা খাইবা না? তোমার লেইগাও তো চা রাকছে নূরজাহানে।

তয় দেও। আগে চা দেও। তারবাদে তামুক।

দবির ঘাটপারের দিকে চলে গেল।

নূরজাহান এদিকটায় নাই। রান্নাচালায় বসে চা বানাইছে, সেই চা হামিদা নিয়া দিছে রব্বানরে। নূরজাহান তারপর চলে গেছে বাঁশঝাড়তলার দিকে। পিছন পিছন গেছে ভাদাইম্মা। নূরজাহান যেদিকে যায় সেও যায় সেইদিকে। নূরজাহান যায় আগে আগে, পিছন পিছন লেজ নাড়তে নাড়তে যায় ভাদাইম্মা।

তবে বাঁশঝাড়তলার দিকে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যান্য দিনের মতন ভাদাইম্মাকে নিয়া ছুটাছুটি হইচই করছে না নূরজাহান। আজ সকাল থেকেই সে গম্ভীর। এখন রব্বানকে দেখে আরও গম্ভীর হয়েছে।

ঘাটপার থেকে উঠানে এসে দবির দেখে জলচকি ছেড়ে ফিরিতে বসেছে রব্বান। হামিদা চলে গেছে রান্নাচালায় দবিরের চা গরম করতে। দবিরকে দেখে রব্বান হাসিমুখে বলল, আপনে জলচকিতে বহেন কাকা। বইয়া চা তামুক খান। আমি আর ইট্টু বহি, তারবাদে যামু নে।

গামছায় হাতমুখ মুছতে মুছতে জলচকিতে বসল দবির। হামিদা চা এনে দিল। চায়ে চুমুক দিয়া বলল, কামে লাগছেন নি বাজান?

হামিদার হাতে নিজের খালি চায়ের কাপ দিয়া রব্বান বলল, না কাকা লাগি নাই। যেই কাম চাই ওইডা অরা আমারে দিবো না। ম্যানাজারের নিজের লোক আছে। তাগো দেয় ভাল কাম আর তাগো কাছ থিকা ম্যানাজারে কমিশন খায়। আমি একবার কইতে চাইলাম, দিমু নে, আমিও কমিশন দিমু নে। তয় কইতে সাহস পাই নাই। কইলে দেহা গেল হিতে বিপরীত হইল।

তয় অহন কী করবেন?

ওই কাম করুম। গোড়ায় কইরা ইটা বালি টানুম।

ভারী কাম তো? পারবেন?

পারতে অইবো। নাইলে খামু কী? তয় আমার মনে হয় কী কাকা, দুই-চাইরদিন কষ্টমষ্ট কইরা করতে পারলে অব্বাস অইয়া যাইবো। অন্য মাইনষে পারলে আমি পারুম না ক্যা? তাগো শরিলও শরিল, আমার শরিলও শরিল।

দবির কথা বলল না। রান্নাচালায় দবিরের জন্য তামাক সাজাতে ব্যস্ত হামিদা। তবে কান পাইতা রাখছে উঠানের দিকে। আড়চোখে রব্বানকে দেখছে আর তার কথা শুনছে।

বিকালের রোদ এখন গাছপালার মাথায় আর ঘরের চালে উঠতে শুরু করেছে। চকেমাঠে পড়ে থাকা রোদ ধীরে ধীরে মোলায়েম হচ্ছে। চারদিকে ঝিরঝির করে বইছে হাওয়া। পাখপাখালি ডাকছে গাছে গাছে। গরম ভাবটা কমতে শুরু করেছে।

দবির বলল, তয় থাকনের ব্যবস্তা কী করলেন? ঠাকুর বাইত্তে আছেন? ওই যে মকবুল না কি ওই বেডার লগে?

ওই বাইত্তে আছি। তয় ওই বেডার লগে না। আপনেরে কইছি না বেডার সবাব ভাল না। আমি অহন থাকি অন্য একটা ছাপরায়। রাড়িখালের ওই দিককার মাইটাল অরা। মানুষটি ভাল।

একটু থামল রব্বান। তারপর বলল, কী আর করুম কন কাকা? এই জীবনডাই আমি আস্তে আস্তে মাইন্না লইতাছি। তয় বিপাকে পড়ম রাস্তার কাম শেষ অইয়া গেলে! তহন যামু কই? কাম পামু কই? খামু কী? তহন মনে অয় দেশগেরামে আর থাকন যাইবো না। ঢাকার টাউন মিহি মেলা দেওন লাগবো। ঢাকার টাউনে গিয়া জোগালুর কাম করুম আর নাইলে রিশকা চালামু। তয় কথা ওই একটাঐ, মালখানগর মিহি আর কোনওদিন যামু না। মইরা গেলেও যামু না!

দবির কথা বলল না। চায়ে শেষ চুমুক দিয়া রান্নাচালার দিকে তাকাল। হামিদা দ্রুত পায়ে আইসা কাপটা আগে নিল তারপর হুঁকা ধরাইয়া দিল দবিরের হাতে। দবির আনমনা ভঙ্গিতে তামাক টানতে লাগল।

বিকাল শেষ হয়ে আসার লগে লগে উঠল রব্বান। তয় আমি অহন যাই কাকা। হাজ অইয়াইলো। দোয়া রাইখেন। কাইল থিকা আল্লার নাম লইয়া কামে লাইগ্যা যামু। রাড়িখালের অগো লগেঐ থাকুম, অগো লগেঐ খামু। খরচা কম। টেকা পয়সা ভালই জমান যাইবো।

হামিদা দাঁড়িয়ে ছিল রান্নাচালার ওদিকটায়। তার দিকে তাকাল রব্বান। যাইগো কাকি! দোয়া রাইখেন।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে দেখে বাঁশঝাড়তলার ওদিক থেকে ফিরা আসছে নূরজাহান। লগে ভাদাইম্মা আছে। সে যখন উঠানের দিকে আসছে, রব্বান তখন বাড়ি থেকে নামছে। মুখ ঘুরিয়ে সে একবার নূরজাহানের দিকে তাকাল। কথা বলল না।

পশ্চিম আকাশে ডিঙ্গি নৌকার মতন একটুখানি চাঁদ দেখা যাচ্ছে।

.

রব্বানরে কেমুন দেখলা?

আজ রাতে খাওয়াদাওয়ার পর আর ঘরে তামাক নিয়া বসে নাই দবির। নূরজাহান শুয়ে পড়ার পর তামাক সাজায়া হুঁকা হাতে উঠানে আইসা বসছে। হামিদা তখনও টুকটাক কাজ করছে ঘরে। দবিরকে উঠানে গিয়া বসতে দেখে বুঝতে পারছে, কথা আছে। নূরজাহান শুয়ে পড়েছে ঠিকই, মনে হয় ঘুমায় নাই। এইজন্য দবির গেছে উঠানে। আর এখন ফাল্গুন মাইসা রাইত। ঘরের থেকে উঠানে আরাম বেশি। অন্ধকার জোনাক পোকা জ্বলে চারদিকে, দুয়ারের সামনে জ্বলছে কুপি, হাওয়ায় শিমুল ফুলের মৃদু গন্ধ। উঠানে অনেক রাত তরি বইসা থাকতে আরাম লাগে।

দবির শুধু আরামের জন্য উঠানে আসে নাই, আসছে হামিদার লগে রব্বানরে নিয়া কথা বলার জন্য। হামিদাও সেইটা বুঝছে। বুইঝা হাতের কাজ শেষ কইরা স্বামীর পাশে আইসা দাঁড়াইছে। দবির ফিরি নিয়া বসছে। হামিদাকে দেখে তামাক টানা থামায়া কথাটা জিজ্ঞাসা করল।

হামিদা বলল, না পোলা ভাল। আমার পছন্দ হইছে।

ঘরজামাই করবানি এই পোলা?

আমার আপিত্তি নাই।

একবার দেইখাঐ এত পছন্দ কইরা হালাইলা?

ভাল মানুষ এক পলক দেকলেঐ চিনো যায়। পোলাডার মুকহান দেকলেঐ মায়া লাগে। কথা হুনলে মায়া লাগে। আদব লেহাজ জানা পোলা। তোমারে দেইক্কা জলচকি ছাইড়া দিল। আমারে কাকি কাকি করল। কথা কয় কী সোন্দর কইরা। না পোলা ভাল। এমুন পোলার কাছে যে কেঐ মাইয়া বিয়া দিতে চাইবো। খালি একহান জিনিসঐ খারাপ। মুখের দাড়িমোচ।

ওইডা কোনও বিষয় না। দাড়িমোচ কামাইতে কতক্ষুন লাগে। দুলালের সেলুনে গেলেই অইলো।

দবির কয়েকটান তামাক খেল। তোমার মাইয়ার মতলব কিছু বুজলানি?

কেমতে বুজুম? ও তো রব্বানের লগে কথাবার্তি কয় নাই।

দেখছে তো?

হ দেখছে। পয়লা ও ওই দেখছে।

মাইয়ার মুক দেইখা বুজা যায় নাই পোলাডারে অর ভাল লাগল না মন্দ।

আমার মনে অয় মন্দ লাগে নাই।

কেমতে বুজলা?

আমার মাইয়ারে আমি চিনি। তোমার আমার যারে ভাল লাগবো, পছন্দ অইবো তারে অরও ভাল লাগবো, অরও পছন্দ অইবো। তুমি আমি দুইজনেঐ মরনি বুজির পোলা মজনুরে পছন্দ করছিলাম, তোমার মাইয়াও করছিল।

কেমতে বুজলা? মজনুরে লইয়া তোমারে কিছু কইছে?

না কয় নাই। তয় আমি বুজছি। মাইয়ার মন মায় বেবাকতের আগে বোজে।

আবার কয়েক টান তামাক খেল দবির। তয় অহন কইলাম তুমি আমি চাইলে নূরজাহানের বিয়ার কামডা সাইরা হালাইতে পারি। আল্লায় মনে অয় আমগো মিহি মুখ তুইল্লা চাইছে। নিজে থিকাই একটা পোলারে পাডাইয়া দিছে আমগো কাছে। এমুন পোলা যার দুইন্নাইতে কেউ নাই, কিছু নাই। নূরজাহানের লগে বিয়া অইলে আমরা ছাড়া অর আর কেঐ থাকবো না। পোলাও পছন্দসই। দেখবা কেউ কইবো না নূরজাহানরে খারাপ পোলার লগে বিয়া দিছি।

হ হেইডা কেঐ কইবো না।

তয় তোমার মতামতটা দেও।

রান্নাচালা থেকে একটা ফিরি আইনা দবিরের পাশে বসল হামিদা। আগে তোমার মতামত দেও। তোমার মত কী হেইডা কও।

আমার অমত নাই। রব্বানরে আমার পছন্দ অইছে। নূরজাহানের লগে রব্বানের বিয়া অইলে ভাল অয়।

আমারও হেইডাঐ মত। তয় একহান কথা আছে।

কী?

রব্বান যা কইছে হেই হগল বেবাক কথা ঠিক কিনা এইডা ইট্টু যাচাই করন দরকার। মালখানগরে কেঐরে পাডাইয়া আর নাইলে তুমি নিজে গিয়া ইট্টু খোঁজখবর লও। যুদি অর বেবাক কথা ঠিক অয় তয় বিয়া অইতে পারে।

তার আগে তো আরও কাম আছে।

কী কাম?

রব্বানের লগে কথা কওন লাগবো না? আমরা যা চিন্তা করতাছি, ও যুদি ওইরকম চিন্তা না কইরা থাকে তয় তো কোনও লাব নাই। আগে অর মতামত জানতে অইবো না? নূরজাহানরে আমরা অর কাছে বিয়া দিতে চাই, আমগো বাইত্তে অরে ঘরজামাই কইরা রাখতে চাই, এতে ও রাজি কিনা হেইডা জানন দরকার না?

হ জানন দরকার। অনেক পোলা আছে ঘরজামাই থাকতে চায় না। রব্বান যুদি ওই পদের অয় তয় তো ভেজাল।

ঠিক কইছো। এই কামডা কারে দিয়া করাইবা? আমি নিজে তো আর রব্বানরে কইতে পারি না, বাজান, আপনেরে তো আমি আর আপনের কাকি বহুত পছন্দ করছি। আমগো মাইয়াডা আপনের কাছে বিয়া দিয়া আপনেরে আমগো বাইত্তেঐ রাইক্কা দিতে চাই। আপনের মত কী?

না এইডা বহুত শরমের কথা। নিজের মাইয়ার বিয়ার পোরোসতাব এইভাবে কোনও পোলারে দেওন যায় না। দিলে পোলায় মনে করবো মাইয়ার কী না কী খুইত (খুঁত) আছে।

হুঁকায় আবার কয়েকটা টান দিল দবির। তোমার ভাইরে খবর দিবানি?

আউয়াল দাদারে?

হ। সে আইসা দুই চাইরদিন থাকলো আমগো বাইত্তে। একমাত্র ভাগনির বিয়ার কথাবার্তা পাকা করল। তারবাদে নিজে মালখানগর গিয়া খোঁজখবর লইলো রব্বান যা যা কইছে বেবাক ঠিক আছে কি না! নাকি বেবাকঐ মিছাকথা?

হামিদা একটু চিন্তিত হল। আমার ভাইয়ে গিরস্তি করা মানুষ। তার সংসারে কত কাম। এতকিছু হালাইয়া সে আইসা এই হগল করতে পারবো বইলা আমার মনে অয় না।

সে ছাড়া আমগো আর আপনা মানুষ আছে কেডা?

হেইডাও ঠিক। এক কাম করো, তুমি নিজে যাও মালখানগর। শিকদার বাড়ি বিচড়াইয়া বাইর কইরা নিজে বেবাক সমবাত লইয়াহো। যুদি দেহে রব্বানের কথা ঠিক আছে তারবাদে অন্য কেঐরে দিয়া বিয়ার পোরোসতাব দেও।

এইডা খারাপ কও নাই। খোঁজখবর লইয়া যুদি দেহি সব ঠিক আছে তয় পোবোসতাব দেওনের মানুষের আকাল অইবো না। হাজামবাড়ির আবদুলরে দিয়া দেওয়ান যাইবো, গাওয়ালরে দিয়া দেওয়ান যাইবো। আলফু আছে, অরে দিয়াও রব্বানরে কওয়ান যাইবো।

তারপর দবির একদম লাফায়া উঠল। আরে, এত ভেজালের কাম কী? মানুষ তো হাতে একজন আছে। তারে দিয়াঐত্তো বেবাক কাম করাইতে পারি। মালখানগর পাডাইয়া বেবাক খোঁজখবর লইতে পারি, বিয়ার পোরোসতাবও দেওয়াইতে পারি।

কে, কারে দিয়া এইডি করাইবা?

আরে রমিজ ঘটক। অরে তো আমি টেকা দিছি। আরও কিছু টেকা দিলে ও নিজে ফাল দিয়া এই কামে নাইমা যাইবো। এইডি ঘটকাগোঐ কাম।

হামিদাও উৎসাহী হল। হ ঠিক কথা কইছো। ঘটকারে দিয়া খুব সহজে বেবাক কাম করাইয়া হালাইতে পারো।

তয় কাইলঐ ঘটকার লগে কথা কই?

কও। ময়মুরব্বিরা কইছে শুভ কাজে দেরি করতে নাই। দেরি কইরো না।

তামাক শেষ করে ঘরের দিকে ফিরবে দবির হামিদা, হামিদার একটা হাত ধরল দবির। তোমার মাইয়ার লগে কি তুমি ইট্টু কথা কইবা।

কী কথা?

রব্বানের লগে বিয়াতে অর মত আছে কি না?

এইডা জিগানের কিছু নাই। আমরা যেহেনে ভাল মনে করুম ওহেনেই মাইয়ার বিয়া দিমু। আমরা যেহেনে রাজি ওহেনে মাইয়ারও রাজি অওন লাগবো। ও জানে না অরে লইয়া কেমুন পেরেসানির মইদ্যে আমরা আছি। অহন যত তাড়াতাড়ি অরে বিয়া দিতে পারি তত তাড়াতাড়ি আমরা বাঁইচা যাই। এনামুল সাবের কথা মতন কাম না করতে পারলে আবার যুদি কোনও বিপদ আপদ অয় তয় আর মরণ ছাড়া গতি নাই। তুমি অরে লইয়া কোনও চিন্তা কইরো না। কাইল বিয়ানেই রমিজ ঘটকার কাছে যাও। তারে দিয়া কাম করাও। এইডা বহুত ভাল বুদ্ধি বাইর করছো। মাইয়ার বাপ অইয়া তুমি নিজে মালখানগর গেলে হেইডা ভাল দেহা যাইবো না। দেশগেরামের মাইনষে নানান পদের কথা কইবো।

ঠিকই কইছো। আমি কাইল বিয়ানেই ঘটকার বাইত্তে যাইতাছি।

.

রমিজকে পাওয়া গেল জশিলদা বাজারে।

সকালবেলা বাজারে আইসা ছেলের দোকান খুলছে সে। রমিজের ছেলে হারুন কিছুদিন আগে বিয়া করছে। বিয়ার পর সকালবেলা উঠতে তার দেরি হয়। রমিজের অভ্যাস হইল সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা। ফজরের আজানের পর সে আর শুইয়া থাকতে পারে না। এইজন্য সকালবেলা হারুন বউর লগে ঘুমায় আর রমিজ বাজারে আইসা পোলার মুদিদোকান খোলে। হারুন গোসল মোসল সাইরা নাস্তাপানি খাইয়া দশটার দিকে বাজারে আইসা দেখে সাইদ বাট্টা (বউনি) তো বাবায় করছেঐ। বেচা বিক্রিও ভাল। ক্যাশবাক্সে টাকাপয়সা ভালই জমছে।

হারুন আইসা দোকানে বসার পর বাড়ি যায় রমিজ। গিয়া নাস্তাপানি খায়। আর যেদিন ঘটকালির কামে কোথাও যাইতে হয় সেইদিন বাজারেই নাস্তা করে। দোকানে বইসা মোস্তফার চায়ের দোকান থেকে দুইখান পরোটা, একটুখানি সুজির হালুয়া আর গোরুর খাঁটি দুধের এক গেলাস চা। খাইয়া দাইয়া, একখান কেঁচি সিগ্রেট ধরাইয়া ঘটকালির কামে মেলা দেয়।

আজ দবির তারে বাড়িতে না পাইয়া যখন বাজারে আসছে, দবিররে দেইখা মুখটা একটু কালা করল রমিজ। দোকানে গাহেক নাই। একলা চুপচাপ বইসা আছে রমিজ। দুইদিকে মাথা নাইড়া বলল, না গাছি, তোমার মাইয়ার কপাল ভাল না। দোজবর, বুইড়া ধুইড়া ছাড়া তো জামাঐ পাই না। মান্নান মাওলানা তোমার মাইয়ার মনে অয় বিয়া বন্দ কইরা রাকছে। নাইলে এত চেষ্টা আমি করতাছি, কাম অইতাছে না ক্যা? আমার ঘটকালি জীবনে তো এমুন কেস আর দেহি নাই। আইজ শ দুয়েক দিয়া যাও। সাতঘইরার এক পোলার খবর পাইছি। হারুন দোকানে আইলেঐ ওই পোলার খোঁজে মেলা দিমু।

দোকানের সামনে কাঠের একটা বেঞ্চ পাতা। বেঞ্চের দুইপাশ দিয়া দুইখান হাত দশেক লম্বা মাঝারি মাপের মোটা পুরানা বাঁশ খাড়া কইরা দোকানের ঝপ উপরের দিকে উঠানো। দবির বেঞ্চে বইসা হাসল। না ঘটক, সাতঘইরা তোমার যাওন লাগবে না।

রমিজ অবাক। ক্যা? মাইয়া বিয়া দিবা না? নাকি বিয়া ঠিক কইরা হালাইছো?

না না ঠিক করি নাই। ঠিক করনের লেইগাঐ তোমার কাছে আইছি। বাইত্তে না পাইয়া দোকানে আইলাম।

রমিজ উদগ্রীব হল। বিষয়ডা কী কও তো?

হারুনের দোকান বরাবর ওইপাশে মোস্তফার চায়ের দোকান। দবির সেইদিকে তাকায়া বলল, দুইকাপ চা পাড়াও এইমিহি।

মোস্তফার কর্মচারী রমজান বলল, আনতাছি।

রমিজের তখন অন্য কোনওদিকে খেয়াল নাই। খালি মনে হইতাছে একটা কাম হাতছাড়া হইয়া গেল। গাছিরে ম্যালাদিন ধইরা ঘুরাইয়া, টালটি পালটি কইরা টেকা খাওনের বন্দবস্তডা নষ্ট অইয়া গেল। কামের কাম কিছুই না কইরা, পোলা দেহনের কথা কইয়া, আবল তাবল পোলার খোঁজখবর দিয়া টেকা খাওয়ার কামডা ভালই চলছিল। ওইডা গেল।

দবির বলল, ঘটকালির কাম তুমিই করবা। পোলাড়া খালি আমার দেহা। টেকা পয়সা কিছু তোমারে আমি দিমু। আমি মানুষ ঠকাই না। যে যেই কাম কইরা যা পাওনের হেইডু। তারে আমি দেই।

দবিরের কথায় হারিয়ে যাওয়া ভরসা ফিরা আসল রমিজের। মুখে হাসি ফুটল। তয় ঘটনা কইয়া হালাও। দেরি করতাছো ক্যা?

রমজান দুই গেলাস চা নিয়া আসল। রমিজ আর দবিরের হাতে ধরাইয়া দিয়া যেইভাবে আসছিল সেইভাবে পা চালায়া ফিরা গেল। রমিজ উত্তেজনায় বিরাট একটা চুমুক দিল চায়ে। লুইস করে একটা শব্দ হল।

দবিরও তার চায়ে চুমুক দিল। তারপর রব্বানের কথা পুরাটা খুলে বলল। রমিজ চা খেতে খেতে শুনল। চা শেষ করে কেঁচি সিগ্রেট ধরাল। এখনও সকালের নাস্তা করা হয় নাই। খালি পেটে চা, লগে সিগ্রেটে, গ্যাসট্রিকের সমস্যা আছে, ওইসব মনেই রাখল না। কিছুক্ষণ পর বুক গলা জ্বলবে, পেটে বায়ু জমবে, ভাবলই না। মন দিয়া দবিরের কথা শুনল। শুইনা খুশি। ভাল পোলা তো?

হ পোলা ভাল। আমগো পছন্দ অইছে। মাইয়ার মায়ও পোলা দেখছে।

তয় আমার অহন কী করন লাগবো?

রব্বানের লগে কথা কইবা।

অর্থাৎ ঘটকালি?

হ। সাফ ঘটকালি। চৌদ্দো গুষ্টির খবর লইবা। মালখানগর যাইবা। শিকদারবাড়ির পোলা। রব্বান যা যা কইছে বেবাক ঠিক আছে কি না, বাপ দাদার নাম অর্থাৎ…

বুজছি বুজছি। আর কওন লাগবো না। আমি জানি অহন কেমতে কী করতে অইবো।

তয় আইজ থিকাই কামে লাগো। রব্বানরে বিচড়াইয়া বাইর করতে একমিনিটও লাগবো না তোমার। আগে অর লগে কথাবার্তা কইয়া তারবাদে দুইয়েক দিনের মইদ্যে মালখানগর যাও।

রমিজ চায়ে চুমুক দিয়া চিন্তিত গলায় বলল, হেইডা নাইলে গেলাম। তয় তুমি যেমতে যা কইলা, চাচায় আর চাচাতো ভাইরা জাগাসম্পিত্তির বিষয়ে রব্বানের উপরে যেমুন চেতা, রব্বান জানের ডরে পলাইয়া আইছে, আর জিন্দেগিতে ওই মিহি যাইবো না। এই অবস্থায় ওই গেরামে রব্বানের চাচা আর চাচাতো ভাইগো কাছে তার সমবাত লইতে যাওন ঠিক অইবো কি না বুজতাছি না। গেলে না আবার ঘেটি ধাক্কা খাই। লাখিগুতাও খাইতে পারি, গোরুর লাডি দিয়া চকে হালাইয়া পিডাইতেও পারে।

দবিরও চায়ে চুমুক দিল, চিন্তিত হল। এইডা কথা খারাপ কও নাই। তয় পোলার বাপ দাদার জাত বংশের খবরাখবর না লইয়া মাইয়া বিয়া দেই কেমতে? রব্বান যা কইছে ওইডা বিশ্বাস কইরা বিয়া দিলাম, পরে দেহা গেল বেবাক মিছাকথা।

না না, সমবাত না লইয়া আথকা একজনরে পছন্দ অইলো আর মাইয়া বিয়া দিয়া দিবা, ঘটক অইয়াও এই কথা আমি কমু না। আছে, খবরাখবর লওনের অন্যপথ আমার জানা আছে।

কেমুন কও তো?

মালখানগর আমি যামু। গেরামের মানুষজনের লগে কথা কইয়া শিকদার বংশের খবর লমু। রব্বান রব্বানের বাপের খবর লমু। গেরামের মাইনষে বেবাকতে বেবাকতের খবর রাখে। রব্বান হাছা কইছে না মিছা কইছে পাঁচ মিনিটে আমি জাইন্না হালামু।

দবির হাসল। ভাল বুদ্ধি।

আরে মিয়া বুদ্ধি ভাল না অইলে ঘটক অওন যায়নি। তয় ওই শিকদার বাইত্তেও আমি যামু। রব্বানের চাচা, চাচতো ভাই বেবাকতের লগে আমি কথা কমু। এমুন কায়দা কইরা তাগো পেট থিকা রব্বানের কথা বাইর করুম তারা উদিসও পাইবো না। তিন দিন সময় নিলাম। আইজ কাইল পশশু। আইজ রব্বানরে বিচড়াইয়া বাইর কইরা অর লগে কথা সারুম। কাইল বিয়ানে উইট্টা মেলা দিমু মালখানগর। ফজরের আয়জানের লগে লগে মেলা দিলে…। না না তিনদিনে অইবো না গাছি। মালখানগর যাইতে একদিন লাগবো, আইতে একদিন লাগবো। মাঝখানে একটা দিন যাইবো খবরাখবর লইতে। আগে পিছে দুইদিন, মাঝখানে তিনদিন। মোট পাঁচদিন। পাঁচদিনের দিন বিয়ালে তোমার বাইত্তে আইয়া তোমারে ফাইনাল কথা জানামু।

একটু থামল রমিজ। চায়ে শেষ চুমুক দিল। বুকপকেট থেকে কেঁচি সিগ্রেটের প্যাকেট বের করে দবিরকে একটা সিগ্রেট দিল, নিজে একটা ধরাল। একমুখ ধুমা ছাইড়া বলল, তয় গাছি টেকা লাগবো আড়াই হাজার।

দবির চমকাল। আড়াই হাজার? কও কী?

হ। এর কমে হইবো না। কামডা বিরাট কষ্টের। মালখানগর হাইট্টা যাওন আহন, জানডা বাইর অইয়া যাইবো। তারবাদে জানের ডর আছে। শিকদাররা কোনওরকমে যুদি কিছু বোঝে তয় আমার জান লইয়া টান দিবো। জান লইয়া টান দিবো মাইনি মাইরা হালাইবো আমারে হেইডা কইতাছি না। ঘেটিমেটি ধাক্কা দিল, অপমান করল, এই হগল আর কী!

এই হগল তারা ক্যান করবো আমি বুজতাছি না। আর তুমিঐ তো কইলা বহুত চালাকি কইরা কামডা তুমি করবা! আর তুমি তো রব্বানের জাগাজমিন উদ্ধার করতে তাগো ওইমিহি যাইতাছে না। তারা তোমার উপরে চেতবো ক্যা?

রমিজ বুঝল সে ধরা খেয়ে যাচ্ছে। সে যেইরকম ধাউর জিনিস, মালখানগরের শিকদাররা তার চুলের আগাও ছুঁইবো না। যে-কোনও বাড়িতে ঢোকার অনেক তরিকা তার জানা। কথা বাইর করার তরিকা জানা। ঘটকরা কথা বেইচ্চা খাউন্না মানুষ। তাগো লগে চালাকিতে গিরস্তরা পারেনি।

সিগ্রেটে বড় করে টান দিয়া রমিজ বলল, হেইডা ঠিকঐ আছে। অপমান তারা আমারে করতে পারবো না। ওই হগল আমি মেনেজ করুম। তয় যাওন আহনের কষ্ট। রাইতে থাকনের কষ্ট। খাওন দাওনের খরচা। গাছি, আড়াইয়ের নীচে অইবো না।

দবির শুরু করল দেড় থেকে। না ঘটক, দেড় পাইবা। কামডা কইরা দেও।

না না, দেড় মেড়ে অইবো না।

দেড় কম না। চিন্তা কইরা দেহো। মালখানগর যাওন আহন, থাকন খাওন বড়জোর তিনশো খরচা। বাকি বারোশো তোমার কামের।

না না দেড়ে অইবো না গাছি। আড়াইঐ লাগবো।

শেষতরি দুইয়ে রাজি হইল রমিজ। আজই কাজ শুরু করবে সে। প্রথমে রব্বানকে খুঁইজা বাইর কইরা তার খবরাখবর, মতামত লইবো। মতামত লইয়া আইবো গাছির। বাইত্তে। একহাজার এডভান্স নিবো। নিয়া কাইল মেলা দিব মালখানগর। পাঁচদিনের দিন বিয়ালবেলা গাছির বাইত্তে আইয়া বেবাক খবর দিবো। হেদিন নিবো বাকি একহাজার। আর বিয়া যদি রব্বানের লগে নূরজাহানের হয় তয় একখান নতুন লুঙ্গি আর একখান। সিল্কের পাঞ্জাবি দিতে হইবো রমিজরে। কিসসা খতম।

রমিজের লগে এইভাবে কিসসা খতম করে বাড়ি ফিরল দবির। জশিলদিয়া থেকে চক পাড়ি দিয়া মেদিনীমণ্ডল আসতে আসতে দেখে মাথার উপর শেষ ফাল্গুনের বিশাল ঝকঝকা আকাশ। মাইল মাইল চকমাঠ সবুজ হয়ে আছে ইরির তরতাজা চাড়ায়। ইরি চকের ফাঁক ফোকর দিয়া নালা ধরে বইছে পানির ধারা। এক খেত থেকে আরেক খেতে যাচ্ছে পানি। গুমগুম গুমগুম করে চলছে পাম্প মেশিন। দুই-চারজন গিরস্ত লোক এইদিক ওইদিকে তদারক করছে ধান পানির। বিলের বাড়ির উঁচু শিমুলগাছটায় যেন আগুন লেগে গেছে, এত ফুল ফুটেছে। রোদে ভেসে যাওয়া আল্লাহপাকের এই সুন্দর দুনিয়ার দিকে তাকায়া দবির মনে মনে বলল, হে আল্লাহ, হে পাকপরওয়ারদিগার, আমার মনোবাঞ্চা তুমি পূরণ করো মাবুদ। আমার নূরজাহানরে পছন্দ মতন জামাই দেও। তারে সুখে শান্তিতে রাখো। তুমি। যা চাও তাই তো হয়। তোমার ইশারা ছাড়া গাছের পাতা লড়ে না। তুমি ইশারা করো। রব্বান যা যা কইছে বেবাক কথা য্যান সত্য হয়। রব্বানের লগে য্যান আমার নূরজাহানের বিয়া অয়। তুমি রহম করো মাবুদ, তুমি রহম করো।

.

ওই মিয়া, তোমার নাম রব্বান?

রমিজের হাতে কেঁচি সিগ্রেট জ্বলছে। মুখে একটা পানও আছে। ডাইন হাতের বুইড়া লউংয়ের পরের লউংয়ে এক চিমটি চুনা লাগানো। কথার ফাঁকে লউং থেকে একটুখানি চুনা দাঁতে লাগাল। পান চাবাতে চাবাতে সিগ্রেটে টান দিল। তার পরনে নীল লুঙ্গি আর হলুদের কাছাকাছি রঙের সিল্কের পুরানা পাঞ্জাবি।

এখন দুপুরের শেষভাগ। রব্বান বসে আছে ঠাকুরবাড়ির মাইট্টালরা যেখানে থাকে সেখানে, আমগাছতলার ঘাসে। তার চারপাশে নৌকার ছইয়ের মতন অনেকগুলি ছই। ছইয়ের উপর পাতলা সাদা পলিথিন, আকাশি রঙের পলিথিন। এইগুলি মাইট্টাল কামলাদের থাকার ঘর। শীতকাল গেছে, তখন ছইয়ের উপর পলিথিন দেওয়ার দরকার হয় নাই। এখন দিতে হইতাছে বৃষ্টির হাত থিকা বাঁচার জন্য। বৃষ্টির তো কোনও ঠিকঠিকানা নাই। যে-কোনওদিন দিনে আর নাইলে রাইত্রে দুই-চাইর ছিটা নামলেই হইল। ঘুমের তেরোটা বাজবো। এইজন্য শীত শেষ হওয়ার লগে লগে ছইয়ের উপরে পলিথিন লাগাইছে মাইট্টাল কামলারা, জোগালুরা।

সকাল থেকে আজ কাজে লাগছে রব্বান। কামলার কাজ। গোড়া ভরতি কইরা ইটা বালি সুরকি রাস্তায় নিয়া ফালাইছে। তার লগে আছে রাড়িখালের দল। তয় দুপুর তরি কাজ করার পর ঘেটি টনটনাইতাছে। দুপুরে একঘণ্টার ছুটি আছে নাওয়া ধোওয়া খাওন দাওনের। সেই ছুটিতে আইসা নাওন ধোওনের কাজটা রব্বান করে নাই। লাভ কী? নাইয়া ধুইয়া তো ওই কামেই যাওন লাগবো। শইল্লে তো মাটিমুটি ভরবোই। তার থিকা বিয়ালে কাম সাইরা একবারে নাইয়া হালাইলেই হইল।

খাওয়াদাওয়া শেষ কইরা এই মতলব লইয়া সে বইসা আছে। বিড়ি সিগ্রেট পান তামাক কোনওটার অভ্যাস নাই। শুধু তিনবেলা ভাতটা হইলেই হইল। আর একটু চা। চায়ের একখান নেশা রব্বানের আছে। সকালে নাস্তা খাওনের পর, দুপুরে ভাত খাওনের পর আর বিকালে এককাপ কইরা চা খাইলে তার শইল্লে বেদম ফুর্তি আসে। এখন ভাত পানি খাওনের পর তার খুব চা খাইতে ইচ্ছা করতাছিল। ইট্টু পরঐ কামে গিয়া লাগতে হইব। কামের ওইখানে চা পাওয়া যায়। দেশগ্রামের কয়েকটা পোলাপান হাতে বিরাট ফেলাস (ফ্লাস্ক) আর একহান বালতিতে চায়ের কাপ লইয়া ঘোরে। কাপটি অতি ছোট। পোলাপানের খেলনাপাতির মতন। হেই কাপের এককাপ চা’র দাম আটআনা। তিন চুমুকও অয় না। দুই চুমুকেই কাপ ফিনিশ। আর এমুন পচা চা, ফেলাসের বাইক্কা (বাসি) গন্দ আর চিনিতে ভরা। খাইলে চা মনে অয় না, মনে অয় চিনি গোলা গরম পানির শরবত। মাইট্টাল কামলারা অনেকে ফুটাংগিরি (ফুটানি) মাইরা ওই চাঐ ফুরুক ফুরুক কইরা খায়। রব্বানও বিয়ানে এককাপ খাইছে। খাইয়া দুনিয়ার বিরক্ত। ইস এর থিকা ঘোড়ার মুত খাওন ভাল।

দুপুরের ছুটিতে আইসা নাইতে ধুইতে হয় নাই দেইখা হাতে একটু সময় রব্বানের ছিল। তাড়াতাড়ি ভাতপানি খাইয়া ভাবছে বাজার মিহি মেলা দিব। আগে ফাসকেলাস এককাপ চা খাইবো সেন্টুর দোকানে তারবাদে আবার গিয়া কামে লাগবো। এই মতলব কইরা উঠি উঠি করছে, লোকটা পান চাবাতে চাবাতে সামনে আইসা খাড়াইলো।

কথা শুইনা রব্বান তার মুখের দিকে তাকালো। তারপর উইঠা দাঁড়াইল। জে কাকা। আমি রব্বান। রব্বান শিকদার। বাড়ি মালখানগর। আপনে আমারে চিনলেন কেমতে? এহেনে তো আমারে কেঐ চিনে না! না না, দুই-চাইরজনে চিনে। যাগো লগে থাকি তারা কহেকজনে চিনে আর চিনে গাছিকাকায়, কাকি আর তার মাইয়ায়। কী জানি নাম মাইয়াডার? মনে অইছে, মনে অইছে। নূরজাহান। দুনিয়ার আলো।

রমিজ পিরিক করে পানের পিক ফেলল, সিগ্রেটে টান দিয়া বলল, তোমারে বিচড়াইতে গেছিলাম কামের ওই মিহি। হোনলাম খাইতে আইছো ঠাকুর বাইত্তে। এর লেইগা আইলাম। এহেনে আইয়া কহেকজনরে জিগাইছি তোমার কথা। কেঐ চিনে না। শেষমেশ বুড়া এক বেডা দেহাইয়া দিল। উই যে আমগাছতলে বইয়া রইছে ওই ছেমড়ার নাম রব্বান।

রব্বান তীক্ষ্ণচোখে রমিজের দিকে তাকাল। তয় আপনেরে তো চিনলাম না কাকা? আপনে কেডা? কী মনে কইরা আমারে বিচড়াইতে আইছেন? বাড়ি কই আপনেগো? এই গেরামে?

আরে না মিয়া। আমগো বাড়ি কান্দিপাড়া। আমার নাম রমিজ। রমিজ ঘটক।

ঘটক? আপনে ঘটকালি করেন?

ঘটকালি না করলে ঘটক অয় কেমতে মিয়া?

রব্বান তার মধুমাখা হাসিটা হাসল। হ ঠিকঐ কইছেন। যে যেই কাম করে তার নামের লগে হেই কামড়াও জড়ায়া যায়। যেমন নাপতালি করলে অয় নাপিত, মাছ ধরনের কাম করলে অয় জাউলা। কাপড় বুনলে অয় জোলা নাইলে তাতি।

তুমি তো দেহি মিয়া কথার ওস্তাদ!

হ কাকা, কথা কইতে আমার বহুত ভাল লাগে। কথা কইয়া আমি বহুত আরাম পাই। লন হাঁটা দেই। আমার কামের মিহি যাওন লাগবো। আটতে আটতে কথা কমু নে।

লও।

আবার পিরিক করে পানের পিক ফেলল রমিজ। সিগ্রেটে ফুক ফুক করে শেষ দুইটা টান দিয়া রাস্তার ধারে ফালাইয়া দিল। কথাবার্তি হুইন্না মনে অইল তুমি বুদ্ধিমান পোলা। তয় অহন আন্তাজ করো তো, তোমার কথা আমি কার কাছে হোনলাম, ঘটক অইয়া কীর লেইগা তোমারে বিচড়াইতে আইলাম?

রব্বান হাসল। আমি পুরাপুরি কইতে পারুম। ইট্টুও বেমিল হইব না। আপনে আমার কথা হেনেছেন গাছিকাকার কাছে।

ঠিকঐ কইছো। তয় পরেরডাও কও।

মনে হয় গাছিকাকার কাছে আমার বেবাক কথা হুইন্না আপনে আমার লেইগা বিয়ার পোরোসতাব লইয়া আইছেন।

এইডাও ঠিক। তয় কও দিহি কার মাইয়ার লেইগা পোরোসতাব আনছি?

কইতে পারুম কইলাম।

কও। আমি তো হোনতে চাই।

গাছিকাকার মাইয়া। নূরজাহান। দুনিয়ার আলো।

রমিজ মুখের ভিতরকার পানে খচর মচর কইরা দুই-তিনটা চাবান দিল। ঠিক, একদোম ঠিক। তুমি চালাক আছো? বেবাকঐ বুইজ্জা হালাইছো। তয় শেষ কথাডাও কও।

শেষ কথা জানি কোনডা কাকা?

আরে মিয়া, এইডা তো আবার বলদার মতন জিগাইলা।

ও বুজছি বুজছি। নূরজাহানের লগে গাছিকাকায় যুদি আমার সমন্দ করতে চায়, হেই সমন্দে আমি রাজি কি না! রাজি থাকলে…

ওইডি পরের কথা। আগে পয়লাডা কও।

হ।

রাজি কি না?

রমিজের মুখের দিকে তাকায়া তার সুন্দর হাসিটা হাসল রব্বান। নূরজাহান মাইয়া মন্দ না। এক বাপের এক মাইয়া। গাছিকাকায় আর কাকি মানুষ ভাল। তাগো মাইয়াও ভাল। হইবো।

হ মাইয়া ভাল। বহুত ভাল। এক বাপের এক মাইয়া বিয়া করলে জামাই পায় পোলার আদর। ওই আদরডা গাছির ফিমিলিতে তুমি পাইবা।

পয়লা কথাডা যুদি হোনতে চান তয় কই কাকা। ইট্টু শরম করতাছে কইতে, তাও কই।

অন্যদিকে তাকিয়ে লাজুক গলায় রব্বান বলল, আমি রাজি কাকা।

আলহামদুলিল্লাহ।

খুশির চোটে মুখের পানে ঘচর ঘচর করে আবার কয়েকটা চাবান দিল রমিজ, আবার একটা সিগ্রেট ধরাইলো। খাইবানি একখান সিকরেট? অব্বাস আছে?

না কাকা। পান তামুক বিড়ি সিকরেট কোনওডার অব্বাস নাই। অব্বাসের মইদ্যে আছে ইট্টু বেশি কথা কওন। কিচ্ছা মিচ্ছা কওন। তাও পাইছি আমার বাপের কাছ থিকা। আমার বাপের নাম হইল আশ্রাবউলাহ শিকদার। তার কথা আমার মনে নাই। আমি ডাঙ্গর অওনের আগেঐ মইরা গেছে। তার আছিল কিচ্ছা কওনের অব্বাস। বহুত গল্পবাজ মানুষ আছিল। তয় আছিল ভাল মানুষ। আমার লাহান।

হজরতদের বাড়ির ওইদিককার সড়কে উঠে রমিজ বলল, অহন অন্যকথা কও।

বিয়ায় কী চাই হেই হগল কথা?

হ।

কী চামু কন? আপনে তো কাকা আমার খবর বেবাকঐ পাইছেন গাছিকাকার কাছে। বাপের জাগাসম্পিত্তি থাকতেও আমি অহন পথের ফকির। রাস্তার কামে কামলা দিতাছি। তয় এই কামলাগিরি আমি করতে চাই না কাকা। আমার একখান নিশা আছে চায়ের। চা আমি নিজে বহুত ভাল বানাই। এই যে নতুন এতবড় সড়ক অইতাছে এই সড়কের ধারে, বাজার বোজারে যুদি ছোট্ট একহান চা-র দোকান দিতে পারি, এই ধরেন পোনরো-বিশ হাজার টেকা খরচা কইরা চা-র দোকান দিতে পারি তয় আরামছে জিন্দেগিডা কাড়াইতে পারি। চায়ের দোকান চালান হইল হালকা পাতলা কাম। রুজিও করন যাইবো ভাল। এইডা যুদি গাছিকাকায় আমারে কইরা দেয়?

রমিজ পান চাবাল, সিগ্রেটে টান দিল। মনে করো এইডা তোমার অইয়া গেছে।

আলহামদুলিল্লাহ।

তয় থাকবা কই? তোমার তো থাকনের জাগা নাই।

রমিজের মুখের দিকে তাকায়া হাসল রব্বান। কাকা, এইডা তো আমি রাজি।

এইডা কোনডা?

আমি বুজছি, বুইজ্জাও বুজতে চাইছেন না আপনে। সোজা কইরা কই। নূরজাহানরে বিয়া কইরা গাছিকাকার বাইত্তে ঘরজামাই থাকতে আমার কোনও আপিত্তি নাই। অইলো?

রমিজ মহাখুশি। যেভাবে যা ভাবছে তার থেকেও সহজ ভাবে সবকিছু হইয়া গেল। ভাবছিল টাকা পয়সা আরও বেশি চাইব রব্বান। চলিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকা লইয়া টান দিব গাছির। সেইটা মাত্র পোনরো-বিশ হাজারের উপরে দিয়া যাইতাছে। গাছির কপাল কপাল।

তবে নিজের ভিতরকার এইসব উচ্ছ্বাস রব্বানকে বুঝতে দিল না রমিজ। ঘটকালির প্যাঁচটা নিজের মধ্যে রাইখা দিল। বলল, তোমার লগে কথা কইয়াঐ গাছির বাইত্তে যাইতাছি আমি। তুমি যা যা কইলা বেবাকঐ তারে আমি কইতাছি। তোমার কথা হোনলাম অহন তাগো কথা হুইন্না তারবাদে ফয়সালা করুম। তয় সাবধান বাজান, এই হগল লইয়া কেঐর লগে কথা কইয়ো না। দেশগেরামের মানুষ ভাল না। ভেজাল ভেজাল লাগাইয়া দিব।

আরে এইডা আপনে কন কী কাকা? এই হগল আমি বুজি। আমার পেডে বোমা মারলেও কথা বাইর হইব না। আপনে আপনের ঘটকালি চালায়া যান। গাছিকাকায় রাজি অইলে, অর্থাৎ আমার যা যা কথা এই হগলে রাজি হইলে আপনেরা যেদিনঐ বিয়া ঠিক করবেন ওদিনঐ বিয়া কইরা হালামু। তয় ইট্টু তাড়াতাড়ি করলে ভাল হয় কাকা।

রমিজ মুখ ঘুরায়া রব্বানের দিকে তাকাল। ক্যা?

এই কামলাগিরি করতে ভাল্লাগতাছে না। ঘেটি বেদনা করে।

বুজছি বুজছি। হ যত তাড়াতাড়ি অয় ববস্তা আমি করতাছি। তয় আমার যে আরেকখান। বড়কাম বাকি আছে?

আবার কোন কাম বাকি রইল কাকা?

বোজো নাই?

কয়েক পলক কিছু ভাবল রব্বান তারপর বলল, বুজছি বুজছি। গাছিকাকারে আমি যা যা কইছি, অর্থাৎ বাড়িঘর বাপদাদার ঠিকানা, জাগা সম্পিত্তির ব্যাপার, চাচার সংসার, জানের ডর এই হগল ঠিক আছে কি না হেইডা আপনে যাচাই করবেন?

রমিজ মুগ্ধ। তুমি মিয়া বিরাট বুদ্ধিমান পোলা। ক কইলে কইলকাত্তা বোজো। হ এইডা আমি কইতে চাইছি। কাইল আমি মালখানগর যাইতে চাই। তোমার কথা মতন। বেবাক মিলাইয়া দেইক্কাহি।

রব্বান মাথা নাড়ল। হেইডা আপনে যাইতে পারেন। তয় আমার কথার এদিক ওদিক কিছু পাইবেন না। অযথা এতদূর হাঁইট্টা গিয়া কষ্ট কইরা আইবেন। আমি মিছাকথা কউন্না পোলা না।

রমিজ তীক্ষ্ণচোখে রব্বানের মুখের দিকে তাকাল। তয় আমার লগে সমঝোতা করো।

জে।

হ। আমি গেলাম না মালখানগর। গাছিরে কমু, হ গেছিলাম। রব্বান যা যা কইছে বেবাক একদোম ঠিক। ইট্টুও মিছা না। চকু বুইজ্জা মাইয়া বিয়া দিয়া দেও।

করেন, এইভাবে করেন।

তয় আমার ফায়দা?

ফায়দা আদায় করবেন গাছিকাকার কাছ থিকা।

হেইডা তো করুমঐ। ঘটকরা তো মিয়া দুই মিহি থিকাঐ মাল কামায়। তুমি আমার লেইগা কী করবা হেইডা কও? আমারে দিবা কতো?

আপনেঐ কন।

রমিজ কোনও কিছু ভাবল না। বলল, পাঁচ দিবা, পাঁচ।

পাঁচ কী?

হাজার হাজার।

রব্বান যেন আকাশ থেকে পড়ল। কন কী কাকা? পাঁচ হাজার?

হ মিয়া। পাঁচঐ দেওন লাগবো। তয় তুমি তো তোমার জেবে থিকা দিবা না, দিবা গাছির কাছ থিকা লইয়া। তরিকাড়া হিগাইয়া দেই…

হিগান লাগবো না। আমি বুজছি। চা-র দোকানের ওহেন থিকা ইধার কা মাল উধার করতে হইব। দোকান দিতে পোনরো-বিশ হাজার না কইয়া কইতে হইবো বিশ-পঁচিশ হাজার, নাকি?

কারেট। তয় টেকাডা তুমি আগে নগদ হাতে লইয়া লইবা। গাছির হাতে টেকা থাকলে আমার দিকটা সামাল দিতে তোমার অসুবিদা হইব। দেহা গেল গাছি নিজেঐ নিজের হাতে টেকা খরচা কইরা দোকান সাজাইয়া তোমারে বহাইয়া দিল।

ওইডা আপনেঐ গাছিকাকার লগে ভাইঙ্গা লইয়েন। তয় কাকা পাঁচ না, কাম করতে হইবো তিনে। গাছিকাকায় আপনেরে কী দিবো না দিবো আমি জানি না, আমি দিমু তিন। আর বিয়ার খরচাপাতি, আমার কাপড় জামা, জুতা আংটি ঘড়ি বেবাকঐ কইলাম তাগো। আমার জেবে চাইরআনাও নাই। আমি কইলাম এক পয়সাও খরচা করতে পারুম না। পারলে দুই-চাইর দিনের মইদ্যে গাছিকাকার বাইত্তে আমারে ঢুকাইয়া দেন। আমার থাকন। খাওনের বিরাট অসুবিদা অইতাছে, ইটা বালি টানতে টানতে ঘেটি বেদনা করতাছে। এই আজাব থিকা আমারে বাঁচান।

রমিজ সিগ্রেট ফালাইয়া রব্বানের দিকে তাকাল। হোনো মিয়া, বেবাকঐ আমি কইরা। দিতাছি। একটা সপ্তাহ টাইম দেও। আইজ সমবার, আগামী সমবার গাছির বাইত্তে তোমারে উড়াইয়া দিমু। এই কয়ডা দিন কষ্ট মষ্ট কইরা থাকো। একদিন কাম করবা, হেই পয়সা। দিয়া দুইদিন চলবা। এইভাবে সাতটা দিন পার করো। তারবাদে দেখবা আরাম কারে কয়। আর ফাইনাল কথা হইল পাঁচ আর তিনের মাঝখানে যেইডা আছে ওইডা আমারে দিবা। চাইর হাজার। কবে দিবা, কেমতে দিবা হেইডা কও।

বিয়ার বাজার সদাই করনের সময় দুই দিমু, বাকি দুই দিমু বিয়ার দশদিন পর। ওই ববস্তাও আপনেরঐ করন লাগবো। গাছিকাকারে কইবেন পোলারে হাজার আষ্টেক টেকা দেও গাছি। পোলায় তার জামা কাপড় জুতা ঘড়ি কিনুক। ওইডা দিলে ওহেন থিকা দুই আপনেরে দিয়া দিমু নে। তারবাদে দিন দশেক পর দোকানের নাম কইরা লমুনে হাজার দশেক। ওহেন থিকা দিমুনে দুই। কেস ডিসমিস।

রমিজ খুশি হইল। এইডাঐ ফাইনাল। আমি অহনঐ গাছির বাড়ি যাইতাছি।

রমিজ চলে যাওয়ার পর রব্বানের আর ইচ্ছা করল না রাস্তার কাজে যায়। আবার গিয়া ইটা বালুর বোঝা উঠায় মাথায়। এখন কাজে না গেলে অর্ধেক বেলার পয়সা পাবে। সন্ধ্যার দিকে গিয়া পয়সাটা নিয়া আসবে। জেবে কিছু পয়সা আছে, আর আজকের কাজের অর্ধেক বেলায় পাবে তিরিশ টাকা, সব মিলাইয়া ছয়-সাতটা দিন কাইটা যাইব। তারপর থেকেই তো আরামের জীবন। নূরজাহানের মতন বউ, গাছিকাকার মতন শ্বশুর, কাকির মতন শাশুড়ি। ওই বাড়িতে থাকন, খাওন।

রব্বান পা চালায়া মাওয়ার বাজারের দিকে মেলা দিল। এখন সেন্টুর দোকানে গিয়া ফাসকেলাস এককাপ চা খাইব।

.

আগে আমারে এক গেলাস পানি দেন গো ভাবিছাব। পান খাইছি তো, কুলি (কুলকুচি) কইরা লই। তারবাদে কথাবার্তি কইতাছি। এহ হগল কথা কইতে অয় মুখ পয়পরিষ্কার কইরা।

হামিদা দৌড়ায়া গেল রমিজের জন্য পানি আনতে। দবির দাঁড়ায়া ছিল উঠানে। রমিজ ঘটক তার দিকে তাকায়া বলল, বাইত্তে একটা চাপকল বহাও গাছি। মাইয়া বিয়াশাদি দিবা, মাইনষেরে কি ওই পচা পুকইরের পানি খাওয়াইবানি?

দবির হাসিমুখে বলল, ঠিলার পাইনতে ফিটকারি দিয়া রাখি। পানির নিগরা (ময়লা, তলানি) বেবাকঐ নীচে পইড়া যায়। ঠিলার পানিতে ময়লা থাকে না।

তাও বাইত্তে আইজকাইল একখান চাপকল থাকন দরকার।

হামিদা ততক্ষণে একটা কাঁচের গেলাসে পানি নিয়া আসছে। সেই পানি দিয়া রমিজ তার দুই দিককার তুবড়ানো গাল ফুলাইয়া, মুখের ভিতর কুলকুল কুলকুল আওজ কইরা ফুরুক কইরা কুলির পানি ফালাইল দবিরের বাড়ির নামার দিকে। দুই-তিনবার করল কাজটা। তারপর গেলাস গাছির হাতে ফিরত দিয়া পকেট থেকে ময়লা রুমাল বাইর কইরা মুখ মুছল। হামিদা একটা জলচকি আর ফিরি আইনা রাখছে উঠানে। দবির বলল, বহো ঘটক, বহো।

রমিজ বেশ একটা ভাব ধরে জলচকিতে বসল। বিয়াল অইয়া গেছে। আগে মুড়ি মিডাই খাওয়াও গাছি, তারবাদে চা দেও এককাপ ফাসকেলাস কইরা।

দবির ফিরিতে বসল। এইডা আর কওন লাগবো না। তোমার ভাবিছাবে দিতাছে।

মাইয়া কো? নূরজাহান?

বাঁশঝাড়তলার মিহি গেল। একটা কুত্তা আছে, ওইডার লগে খেলতাছে।

হ মাইয়া ইট্ট দূরে থাকনঐ ভাল। এই ফাঁকে কামের কথা সাইরা হালাই।

রিকাবিতে করে মুড়ি মিঠাই আইনা রমিজের হাত দিল হামিদা। মিঠাইডা খাইয়া দেহেন ঘটকদাদা। আমি নিজ হাতে বানাইছি। নাইরকল দেওয়া আছে। তিলের মিডাইও আছে। তয় ওইডা আপনেরে দিলাম না। ওইডার থিকা এইডা ভাল। স্বাদ বেশি।

হেইডা আমি বুজছি। তয় ভাবিছাব আপনেও বহেন। রব্বানের লগে কী কথা হইল, হোনেন। আরে পোলাডা তো আপনেগো সুনাম গাইতে গাইতে মইরা গেল। কয় গাছিকাকায় যেমন ভাল মানুষ কাকিও তেমুন ভাল মানুষ। তাগো মাইয়া ভাল না অয় কেমতে?

হামিদা বসল বড়ঘরের ওটায়। পোলায় মত দিছে?

একমুঠ মুড়ি মুখে দিল রমিজ, এককামড় মিঠাই মুখে দিল। দিয়া দুই-তিনটা চাবান দিয়া বলল, মিঠাইটা ভাবিছাব সত্যই ভাল। এত ভাল মিঠাই জিন্দেগিতে কম খাইছি।

দবির বলল, তোমার ভাবি মিঠাই বহুত ভাল বানায়।

একটু থেমে বলল, অহন কও দেহি রব্বানের লগে কথা কী হইল? রাজি?

রাজি মাইনি? রাজির উপরে রাজি। কোনও আপিত্তি নাই। নূরজাহানরে বিয়া কইরা ঘরজামাই থাকবো। দাবিদাওয়াও তেমুন কিছু নাই। জামাইরে ঘড়ি আংটি কাপড়চোপড় ওইডা তো দিতে অয়ঐ, ওইডা দিবা।

এইডা না কইলেও দিমু।

তয় আসল কথাডা অইলো রাস্তার ওই কামলার কাম পোলাডায় করতে চায় না। কোনওদিন করে নাই তো। ঘেটি বেদনা করে। ভাল ঘরের পোলা তো, বুজলা না। তার মুখ দেইক্কা তো আমার মায়া লাগছে। তারবাদে রাস্তার কাম তো একদিন শেষ হইব। তহন করবো কী?

এইডা আমিও চিন্তা করছি। ঘরজামাই থাকলে আমরা যেমতে চলি অমতেই চলবো। খেত যেডু আছে আমার লগে চুইবো।

এইত্তো একটা বলদার মতন কথা কইলা। ওডু জমিন চুইয়া জিন্দেগি চলেনি? ভবিষ্যতে পোলাপান অইবো, সংসার বড় অইবো। পয়লা থিকাঐ ভাল একখান কিছু ছেমড়ার করন উচিত না?

দবির না, হামিদা বলল, লেইজ্য কথা। পয়লা থিকাঐ একটা কিছু করন উচিত।

এইত্তো ভাবিছাবে বুজছে। তুমি মিয়া খালি ওডু জমিনের ইরি দিয়া চলতে পারোনি? শীতের দিনে রসের কারবার না করলে উদিস পাইতা কত ধানে কত চাউল। সংসার চলে কেমতে? আমি খালি ঘটকালি দিয়া চলতে পারিনি? পোলার দোকান না থাকলে তো না খাইয়া থাকন লাগতো। সংসার চলতো না।

নূরজাহান তখন দৌড়াইতে দৌড়াইতে উঠানের দিকে আসছে। পিছন পিছন আছে ভাদাইম্মা। উঠানে যে রমিজ ঘটক বইসা আছে এইটা সে বোঝে নাই। তাকে দেইখা থমকাইয়া গেল।

রমিজ একবার নূরজাহানের দিকে তাকাল। তারপর মুড়ি মিঠাই চাবাতে চাবাতে দবিরের দিকে তাকাল। মাইয়ার সামনে কথাবার্তি কওন ঠিক অইবো?

দবির না, হামিদা বলল, আইজকাইল এই হগল কোনও বিষয় না ঘটকদাদা। আপনে কন। তারপর নূরজাহানকে বলল, ওই নূরজাহান, দুই কাপ চা বানা। চা য্যান ভাল অয়। যা তাড়াতাড়ি বানা। দেরি করি না।

নূরজাহান কথা বলল না। যেরকম চঞ্চল পায়ে দৌড়ায়া আসছিল সেই পা এখন ধীর, নরম। ওইরকম ভঙ্গিতে মায়ের পাশ দিয়া ঘরে ঢুকল সে, চায়ের জিনিসপত্র নিয়া রান্নাচালায় গিয়া চুলা জ্বালাল। চায়ের পানি বসাল চুলায়, তবে কানটা পাইতা রাখল উঠানের দিকে। রব্বানের লগে যে তার বিয়াশাদির কথা হইতাছে এইসব সে জানে। রমিজ ঘটক যে ওই কাজেই আসছে, রব্বানের লগে কথাবার্তা কইয়া আসছে এইসব বুঝতে তার বাকি নাই। সে তাকায়া রইল চুলার আগুনের দিকে, তয় কানটা বড়ঘরের সামনে বসা তিনজন মানুষের দিকে। কে কী বলে সবই সে শুনব,

দবির বলল, তোমার কথা আমি বুজছি ঘটক। রব্বান এই বিষয়ে কী কইলো অহন হেইডা কও দিহি। নগদ টেকা পয়সা চাইছেনি?

মুড়ি মিঠাই চাবাতে চাবাতে জড়ানো গলায় রমিজ বলল, হেইডা তো কিছু চাইছে। তয় এমুন কিছু না। বিয়ার লেইগা ঘড়ি আংটি জামা কাপড়ের লেইগা নদগ দশ বারো হাজার আর…।

একটু থামল রমিজ। দবির আর হামিদা উৎকণ্ঠিত হল।

দবির বলল, আর?

আর বিশ-পঁচিশ হাজার টেকা চাইছে একটা চা-র দোকান দেওনের লেইগা। কামলা কোমলার কাম পোলায় আর করবো না হেইডা তো আগেঐ কইলাম। পোলায় চা খুব ভাল বানায়। এতবড় সড়ক অইতাছে, এই সড়কের ধারে তোমার বাড়ি বরাবইর বিশ-পঁচিশ হাজার টেকা খরচা কইরা যুদি একহান চা-র দোকান দিয়া বইতে পারে তয় কায়কারবার ভাল করতে পারবো। দিনে দিনে উন্নতি হইব।

দবির তাকাল হামিদার দিকে, হামিদা তাকাল দবিরের দিকে। কেউ কোনও কথা বলল না।

রমিজ বলল, আমি মনে করি এইডা এমুন বড় কোনও ব্যাপার না। বেবাক কিছু মিল্লা পনচাশ থিকা ষাইট হাজার টেকায় তোমার মাইয়ার বিয়াশাদির কাম অইয়া যাইবো।

দবির বলল, আরে না মিয়া। জামাই বাইত্তে থাকবো, বাইত্তে কিছু আলগা খরচা আছে না? বাঁশঝাড়তলার ঘরডা ঠিকঠাক করন লাগবো, পায়খানাটা ঠিকঠাক করন লাগবো। তুমি একহান চাপকলের কথা কইলা, একটা চাপকল বহানের কাম। সইত্তর-আশি হাজার লাইগ্যা যাইবোনে।

তোমার একটা মাত্র মাইয়া, এডু খরচা করবা না? তয় ঘরবাড়ি ঠিকঠাক করন, চাপকল, চা-র দোকান যাই করবা হেইডি তো তোমার মাইয়ারঐ থাকবো। বাড়িঘরের কাম তো তুমিই করবা। জামাইর বিয়ার জিনিসপত্র আর চা-র দোকান দেওনের টেকা তার হাতে দিবা সে তার লাহান কইরা হালাইবো। ঘরজামাই অইলো বাড়ির পোলার লাহান। ও তো আর তোমার কোনও জিনিস লইয়া পলাইয়া যাইতাছে না।

বুজলাম সবঐ। তয় টেকা তো ম্যালা।

হামিদা বলল, অইলো। এই হগল দেহা যাইবো নে। অহন আপনে আপনের আসল কাম করেন। মালখানগর যান।

আরে হেইডা তো আমি কাইলঐ যাইতাছি। কাইল হইল মঙ্গলবার। মঙ্গল বুঁদ বিষুদ এই তিনদিন লাইগ্যা যাইবো মালখানগরের কামে। বিষুদবার বিয়ালে বাইত্তে আমু। আইয়া জিরামু। পরদিন শুক্কুরবার বাদ জুম্মা তোমগো বাইত্তে মালখানগরের খবর লইয়া আমু। ইনশাল্লাহ ভাল খবরঐ আনুম দেইখোনে। আমি ঘটকালি করি বহুত বচ্ছর ধইরা। মাইনষের আওজেঐ কোনডা হাচা কোনডা মিছা বুইজ্জা যাই। রব্বানের লগে কথা কইয়া যা বোজনের আমি বুজছি। আরও ভাল মতন বোজনের লেইগা মালখানগর যাইতাছি। আইজ একহাজার দেও গাছি। আল্লাহ আল্লাহ কইরা বেবাক ঠিকঠাক থাকলে শুক্কুরবার বাকি একহাজার দিয়ো। আর বিয়ার দিন আমার ওই লুঙ্গি আর সিল্কের পাঞ্জাবি, বুজলা না?

রমিজ কেলানো একখানা হাসি দিল।

নূরজাহান দুইহাতে দুইকাপ চা নিয়া আসল। একটা কাপ দবিরের হাতে দিয়া রমিজের দিকে খালি হাতটা বাড়াল। রিকাবিডা দেন।

রিকাবির মুড়ি মিঠাই কোন ফাঁকে খালি হয়ে গেছে খেয়ালই নাই রমিজের। সে আছে নিজের ধান্দায়। যেভাবে যা চাইছে তাই হচ্ছে। বহুদিন এত সহজভাবে এতগুলি টাকা ঘটকালির কাজে রুজি হয় নাই। ভিতরে ভিতরে আনন্দে সে একেবারে শিমুল ফুলের মতন ফাইটা পড়তাছে।

রিকাবিটা নূরজাহানের হাতে দিয়া চায়ের কাপ নিল। নিয়াই চুমুক দিল। দিয়া খুবই আমোদের একখান আওজ করল। আরে, মায় তো বিরাট ভাল চা বানাইছে। আমগো বাজারের মোস্তফাও তো এত ভাল চা বানায় না। রব্বান কইলো সে চা খুব ভাল বানায়। এর লেইগা চা-র দোকান দিতে চাইতাছে। হোনো মা আল্লাহ আল্লাহ কইরা বিয়াড়া যুদি হইয়া যায়, তয় জামাইরে তুমি এমুন চা বানাইতে হিগাইয়া দিয়ো। তয় দেখবা তোমার জামাইর চা-র দোকান বিরাট চালু হইয়া যাইবো।

নূরজাহান শরম পাইল। মাথা নিচা কইরা রিকাবি হাতে বড়ঘরে ঢুইকা গেল।

.

সন্ধ্যারাতে একটুখানি চাঁদের আলো আছে। সেই আলোয় উঠানে পায়চারি করতে করতে দবির বলল, টেকা পয়সার কথা হুইন্ন তুমি যে ঘটকারে কইলা, অইলো দেহা যাইবো নে। আপনে আগে মালখানগর গিয়া খোঁজ খবর লইয়াহেন। এইডা কইলা ক্যা? আমার মনে অইতাছে এই পোলার লগেই নূরজাহানের বিয়া অইবো। আমার কাছে তো এত টেকা পয়সা নাই, বিয়া ঠিক অইয়া গেলে কেমতে কী করবা?

হামিদা রান্নাচালার সামনে বইসা আছে। নূরজাহান আছে বড়ঘরে। ঘরের খোলা দরজার সামনে কুপি জ্বলছে। এখনও রাতের খাওয়া দাওয়া হয় নাই। একবার বড়ঘরের দিকে তাকাল হামিদা। তারপর বলল, আমি তোমারে কিছু টেকা দিতে পারুম।

দবির অবাক। কও কী?

হ।

কেমতে দিবা? তুমি টেকা পাইবা কই? আমার যা রুজি রোজগার ওহেন থিকা তো দুই চাইর টেকাও জমান সম্ভবপর না।

ওহেন থিকা জমাই নাই।

তয়।

শুক্রবার ঘটকায় যুদি আল্লাহ আল্লাহ কইরা ভাল সমবাত লইয়াহে তয় শনিবার। পয়সা যামু আমি। আমগো বাইত্তে। বাপের সম্পিত্তির কিছু আমি পাই। তয় হেইডা এক্কেরেঐ কম। বাপের সম্পিত্তি দিয়া কিছুই অয় নাই আমার ভাইয়ের। হেয় নিজে রুজি। রোজগার কইরা কিছু জাগা সম্পিত্তি করছে। তয় আমার বাপের যেডু আছে ওই হগল তো আমি আর আনতে যামু না। ভাইর লগে ওই হগল লইয়া কাইজ্জা কিত্তনও করুম না। গিয়া ভাল মতন কমু, আমার মাইয়াডার বিয়া দাদা। বাপের সম্পিত্তির থিকা আপনে যা ভাল মনে করেন হেইডাঐ আমারে দেন। তয় আমি মাইয়াডা পার করতে পারি। যুদি বাপের সম্পিত্তি আইজ নাও পাইতাম তাও তো বড়ভাই হিসাবে ভাগনিরে আপনে কিছু দিতেন। ওই হিসাবেই দেন।

দবিরের ইচ্ছা হল ছুঁইটা গিয়া হামিদার হাত দুইটা জড়াইয়া ধরে। আমার মাইয়াডার লেইগা এত মায়া তোমার? এতকিছু ভাবছো মাইয়ার বিয়ার লেইগা! তুমি যে আমার মাইয়াডার লেইগা জান দিয়া দেও হেইডা আমি বুজছিলাম ও যেদিন ওই শুয়োরের পোর। মুখে ছ্যাপ দিছিল। তারবাদে আবার বুজলাম আইজ। তয় এইডা আমগো কপাল। মাইয়াডার লেইগা এমুন একখান পোলা পাইতাছি। ঘরজামাই থাকবো। আমার মাইয়া থাকবো আমার বাইত্তে। জিন্দেগিতে চোখের আঐল অইবো না।

আবেগটা কষ্ট কইরা চাইপা রাখল দবির। হাঁটতে হাঁটতে হামিদার সামনে আসল। রান্নাচালার মাটিতেই বসল। যুদি কিছু পাও তয় আর কোনও অসুবিদা হইব না। ঘরে যা জমাইছি, এনামুল সাবে দিবনে কিছু, অইয়া যাইবো। মনে অয় আল্লায় কোনওহানে আইকাইবো না।

আমারও মনে অয় বেবাক ঠিকঠাক মতনঐ অইবো। অসুবিদা অইবো না।

তয় অহন অন্য চিন্তাডি করি।

আর কী চিন্তা?

মাইয়ার লগে ইট্ট কথা কইবানি?

তুমি কইতে কও?

হ কই।

আইচ্ছা তয় কমু নে।

কী কইবা?

এইত্তো তর লেইগা রব্বানরে দেখছি আমরা। পোলাডারে আমরা দুইজনে পছন্দ করছি। ঘরজামাই থাকবো। এই হগল কমু নে।

হ কও। দেহো ও কিছু কয়নি?

আমার মনে অয় না কিছু কইবো। আমগো মতঐ অর মত এইডা আমি জানি।

তয় বিয়ার দিন তারিখ করবা কবে?

দশ-পোনরো দিন পরে।

হামিদা অবাক। ক্যা? এত দেরি করবা ক্যা?

মাইয়ার বিয়া দিবা, সমায় ইট্টু লাগবো না।

এইডা তো অমুন বিয়া না যে চলন (লোকজন নিয়া বর আসা অর্থে) আইবো বাইত্তে, তারবাদে মাইয়া আনতে যাওন লাগবো, বাদগুস্তি (বউভাতের পর বরকনে চলে আসে কনের বাড়িতে। তারপর যেদিন বরকনে আবার বরের বাড়ি যায় সেদিন বরপক্ষের লোকজন আসে তাদেরকে নিতে। সেদিন তাদেরকে ঘটা করে খাওয়াতে হয়) খাওয়ান। লাগবো। এই বিয়া তো একবাড়ির মইদ্যে। রব্বান আইয়া ওই ঘরে উটবো। বড়ঘর থিকা উডান পার হইয়া বউ সাইজ্জা মাইয়া যাইবো ওই ঘরে। এইত্তো। চিন্তা কইরা দেহে বহুত পদের খরচা এই বিয়াতে নাই।

দবির বুঝদারের মতন বলল, হেইডা ঠিক আছে। তারবাদেও তো কিছু মানুষজনরে দাওত দেওন লাগবো।

বেশি মানুষ কো? কারে দাওত দিবা? গাওয়ালবাড়ি হাজামবাড়ি, মরনি বুজি, আলফু। আমগো এই দিকে মাঝিবাড়ি। ঘটকায় থাকবো। পয়সা থিকা আমার ভাই ভাইর পোলারা আইলে নাইলে আর পাঁচ-ছয়জন। বেবাক মিলা বিশ-তিরিশজন মানুষ। দুইডা ছোড ছোড খাসি জব করবা, ভাত ডাইল আর সেন্টুর দোকানের দই। বিয়া যুদি মাইয়ার অন্য জাগায় অইতো তয় তো মুরব্বিআনা কাপড়ঐ (বরের বাড়ির বয়স্ক মহিলাদেরকে শাড়ি দেওয়ার প্রথা) দেওন লাগতো কতডি কে জানে। আল্লায় তো তোমার খরচা বাঁচায় দিতাছে। তুমি তো একসময় ভাবছিলা দরকার অইলে খেত বেইচ্চা মাইয়ার বিয়া দিবা।

হ হেইডা একসময় চিন্তা করছি।

তয় অহন এত চিন্তা কইরো না। আল্লায় যা করে ভালর লেইগাঐ করে। শুক্কুরবার বাদ জুম্মা ঘটকায় আইয়া সুখবর দিলে তারপরের শুক্কুরবারঐ মাইয়ার বিয়া দিয়া দিমু। একদিনও দেরি করুম না।

এই কয়দিনে ঘরডা ঠিক করন যাইবো?

যাইবো না ক্যা? ওই ঘরের তেমুন কোনও কাম নাই। নন্দ মিস্তিরিরে কাইল খবর দেও। পশশু থিকা ঘরের কাম লাগায়া দেও। ঘর ঠিকঠাক করুক, আর একহান চকি বানাইয়া দেউক। জানলা দুইডায় নতুন শিকমিক লাগাইয়া জানলা আর দুয়ারের কপাটে রং কইরা দেউক।

রং করনের কাম কী? আলকাতরা দেউক।

না না আলকাতরা না। কালা রং বিয়াশাদির মইদ্যে ব্যবহার করতে অয় না। কালা রং খারাপ।

দবির হাসল। খাসি যে জব করবা, খাসি তো কালা।

আরে ওই কালা আর ঘরের কালা এক কথা না।

চাপকলের কামও কি লাগায়া দিমু?

লাগায়া দেও। আবদুলরে কও তোশক বালিশ এই হগল বানাইয়া দেউক। নন্দ মিস্তিরি ঘরের কাম শেষ কইরা পায়খানাডা ঠিকঠাক কইরা দিব। আর পুকঐরের ঘাটটা ঠিকঠাক কইরা দেউক।

শুক্কুরবার দিনডা যাউক, তারবাদে করি।

ক্যা?

ঘটকায় মালখানগর থিকা আহুক।

কাম কাইজ তুমি সাইরা হালাও। আমার মনে যা কয় হেইডাঐ অয়। তুমি দেইখো বেবাক কথা ঠিক পাইবা। রব্বানের লগেঐ আমার নূরজাহানের বিয়া অইবো। তুমি কাইল থিকাই কামে লাগো। মরনি বুজিরে আর দেলরা বুজিরে কইয়ো শুক্কুরবারের পর। দেলরা

বুজি য্যান এনামুল সাবরে জানায়। দেহো হেয় কত টেকা দেয়।

ঠিক আছে, ঠিক আছে। তয় আরেকখান কাম করুমনি! রব্বানের তো ওই কামলা কাম ভাল লাগতাছে না। থাকে গাছতলায় আর নাইলে ওই ঠাকুরবাড়ির ছইয়ের নীচে। খাওন দাওনেরও ঠিক নাই। অরে এই বাইত্তে লইয়ামুনি?

এইডা আমিও চিন্তা করতাছি। শুক্কুরবারের পর অরে এই বাইত্তে লইয়াহো। আর কামলা দেওনের কাম নাই অর। এর লেইগাঐ কইলাম ঘরডা ঠিক করো। কয়দিন ভাল ভালাই খাইয়া শইলডা ঠিক করুক। আরামে ঘুমাউক। জামাইজনের চেহারা সুরত ভাল না অইলে মাইনষে কইবো কী? আর বিয়ার আগে য্যান দাড়িমোচ হালাইয়া দেয়।

বড়ঘরের দুয়ারে দাঁড়ায়া নূরজাহান হামিদাকে ডাকল। ও মা, ঘরে আহো না? ভাতপানি দিবা না আমারে? আমার খিদা লাগছে। ঘুমও আইতাছে।

হামিদা উঠল। আইতাছি।

.

দবিরের বাড়ির আজ অন্য চেহারা।

রাবির পোলা বাদলা, গাওয়াল বাড়ির নাদের হামেদ পরি, হাজামবাড়ির আলালদ্দি বারেক এই পোলাপানের দল বাড়িটা খুব সুন্দর কইরা সাজাইছে। মাঝিবাড়ি থেকে কলাগাছ এনে, কইফফার ছাড়া থেকে কলাগাছ এনে বাড়ির নামার দিকে উঠানের এদিক ওদিক পুঁতেছে। বাঁশঝাড় থেকে কয়েকটা বাঁশ কেটেও পুঁতেছে। মাওয়ার বাজার থেকে সুতলি আর নানা রঙের ঘুড্ডির কাগজ কিনা আইনা নিশানের মতন বানাইয়া সুতলির লগে আঠা দিয়া লাগাইয়া পোঁতা কলাগাছের লগে, বাঁশের লগে টানা দিয়া ভারী সুন্দর একটা পরিবেশ তৈরি করছে। দূর থেকে দেখলেই মনে হয় বিয়াবাড়ি। পোলাপানের শখ ছিল। কাজির পাগলা বাজার থেকে মাইক ভাড়া করে আনবে। মাইকে গান বাজনা হবে দিন রাইত। খরচের ডরে গাছি সেইটা করতে পারে নাই।

লোকজন আসছে মন্দ না। মরনি আসছে সকালবেলাই, গাওয়াল বাড়ির লোকজন। আসছে, হাজামবাড়ির আবদুল আসছে বউ পোলাপান নিয়া। শুধু আসতে পারে নাই আবদুলের মা। সে তো আছে তছি পাগলনিরে নিয়া। আলফু আসছে। কুট্টি আসতে পারে নাই দেইখা খুবই হায়আপশোস করছে। কয়দিন আগে তার একটা পোলা হইছে। অতটু পোলা লইয়া বিয়া খাইতে আসন যায় না। বাদলা তো আছেই, রাবি মতলাও আছে। পুকুরের ওপারকার মাঝিবাড়ির লোকজনরা আছে, রমিজ ঘটক আছে। পয়সা থেকে নূরজাহানের মামা আউয়াল আসতে পারে নাই। তার জ্বর। তবে সে তার বড় পোলা ফজলরে পাঠাইছে। ভাগনির জন্য দশআনা ওজনের সোনার একখান চেন পাঠাইছে। মরনি দিছে একটা নাকফুল। পুরানা নাকফুল। তয় কাজির পাগলার সোনারু পরিতোষের কাছ থেকে বোয়াইয়া আনছে। দেখতে নতুন মনে হয়। হামিদার একজোড়া কানের দুল আছিল। সেই দুলও পরিতোষের কাছ থেকে বোয়াইয়া আনাইছে দবির। সেইটার চেহারাও নতুন। আজিজ গাওয়াল দিয়ে মাঝারি সাইজের পিতলের একটা কলসি। আবদুল তোশক। বালিশ বানাইয়া দিছে সেইগুলির দাম নেয় নাই। ওইটাই তার উপহার। আলফু দিছে একশো টাকা, রাবি যে রাবি সেও দিছে পঞ্চাশ টাকা। মাঝিবাড়ির বেবাকতে মিল্লা দিছে। পাঁচশো টাকা। আর এনামুল সাবে দিছে পাঁচ হাজার টাকা।

সব থেকে বড়কাজটা করেছে হামিদা।

রমিজ তার কথা মতন শুক্কুরবার বাদ জুমা দবির গাছির বাড়িতে আইসা হাজির। মুখে কেলানো হাসি। বাড়িতে উইঠাই হইহই করা গলায় বলল, কী গাছি, কইছিলাম না, আমার আন্তাজ কোওদিন ভুল অয় না। এতদিন ধইরা ঘটকালি করি, তিরিশ-চল্লিশ বচ্ছর হইব, অভিজ্ঞতার একটা দাম আছে না মিয়া। রব্বান যা যা কইছে, ঘটনা তার থিকাও বেশি। ও তো কম কইরাঐ কইছে। আমি পুরা মালখানগরডা ঘুরছি। যারে পাইছি তারে শিকদার বাড়ির আশ্রাবউল্লা শিকদারের পোলা রব্বানের ব্যাপারে জিগাইছি। আরে মিয়া তার ঘটনা তো বেবাকতে জানে। চাচায় অরে পালছে ঠিকঐ তারবাদে যেই বেইমানিডা করছে, সাইজ্জা পোলাডারে লাগাইয়া দিছিল রব্বানের পিছনে। তয় রব্বানরে মালখানগরের বেবাকতে বিরাট ভাল জানে। যারে জিগাই হেয়ই কয় বহুত ভাল পোলা রব্বান। চরিত্রবান, কোনও বদনিশা নাই। আহা আপনা চাচায় অরে কী ঠকানডা ঠকাইলো। তয় আল্লায় যুদি কেঐরে না ঠকায় মাইনষে ঠকাইয়া কী করবো, কও। আল্লার মাইর দুনিয়ার বাইর। আল্লায় কোনদিক দিয়া রব্বানের চাচা আর চাচতো ভাইগো মাইর দিয়া দিব অরা উদিসও পাইবো না।

হামিদার দিকে তাকাল রমিজ। ভাবিছাব, মুড়ি আর ওই নাইরকলের মিডাই খাওয়ান। তারবাদে চা দিতে কন মাইয়ারে। আল্লায় অর কপালডা বহুত ভাল দিছে। বহুত ভাল জামাই পাইতাছে।

জলচকিতে বইসা বাড়ির চাইরদিকে তাকাতে লাগল রমিজ। নন্দ মিস্তিরি ঘরের কাজ ধরছে দুইদিন হইল। চালে বেড়ায় নতুন ঢেউটিন লাগাইছে, জানলার শিক কপাট, একখান মাত্র দরজায় নতুন কপাট সব লাগাইয়া ঘর একদম ফিটফাট। এখন ঘরের সামনে অল্পবয়সি একজন জোগানদার লইয়া চকি বানাইতাছে নন্দ। চকির কাম শেষ কইরা জানলার কপাট দুয়ারের কপাট রং করব। তারবাদে ধরব পায়খানার কাজ। পায়খানার ওইদিকটায় বাঁশঝাড়তলার একপাশে চাপকল বসানের কামও শুরু করছে ওসমান মিস্তিরি। তিনজন লোক পাইপ বসানো নিয়া ব্যস্ত।

হামিদা মুড়ি মিঠাই দেওয়ার পর, খাইতে খাইতে রমিজ বলল, গাছি, আমি আহনের আগেঐ দিহি বেবাক কাম লাগায়া দিছো। ঘটনাক কী?

দবির ঘরের ওটায় বসে তামাক টানছিল। বলল, বিয়া দুইদিন আগে পরে মাইয়ার তো হইবই, এর লেইগা কামকাইজ লাগায়া দিলাম। অন্য জাগায় মাইয়ার বিয়া দিতে হইলেও তো বাইত্তে আরেকখান ঘর লাগে, এর লেইগা ঘরডা ঠিকঠাক করলাম। মাইয়া মাইয়ার জামাই আইলে থাকবো কই! আর তুমি কওনের পর চাপকলডা বহাইতাছি। এইডা ঠিক কইছো, বাইত্তে একহান চাপকল আইজকাইল লাগে। পুকইরের পানি খাওন যায় না। পেডের বেবাক অসুকের মূলে হইল পানি। খারাপ পানি থিকা পেডের অসুক বিসুক হয়।

রমিজ মুড়ি মিঠাই চাবাতে চাবাতে বলল, হ।

নূরজাহান তখন চা বানাতে গেছে রান্নাচালায়। বিয়ার কথাবার্তা হওয়ার পর থেকে সে বেশ চুপচাপ হয়ে গেছে। আগের মতন দৌড়াদৌড়ি, ভাদাইম্মার লগে খেলা, মজা কোনওটাই নাই। চালচলন ধীর হইয়া গেছে। মুখটা কেমন একটু উদাস।

মেয়ের চেহারা দেখে দবির হামিদাকে বলেছিল, ঘটনা কী? তোমার মাইয়ার মুকহান এমুন ব্যাজার ক্যা? জামাই পছন্দ হইতাছে না?

কথাটা নূরজাহানকে জিগাইছিল হামিদা। কী রে? বিয়ার কথা হওনের পর থিকা এমুন ব্যাজার অইয়া রইছস ক্যা?

নূরজাহান শান্ত গলায় বলেছে, তয় কী করুম? নাচুম?

না, নাচতে তরে আমি কই নাই। মুখ দেইখা তর বাপে আমারে জিগাইতে কইলো দেইখা আমি জিগাইলাম। রব্বানরে তর পছন্দ অয় নাই?

হেইডা আমি তোমারে কইছি?

না কছ নাই।

তয়?

তয় মুখ ব্যাজার ক্যা? এমতেঐ। মা, বাবারে তুমি কইয়া দিয়ো, তোমগো পছন্দই আমার পছন্দ। আমি বুজছি আমারে লইয়া বহুত চিন্তায় আছো তোমরা। যত তাড়াতাড়ি আমার বিয়া অয় তত তাড়াতাড়ি তোমরা বাঁইচা যাও। এর লেইগা তোমরা যা করতাছো ভালই করতাছো, আমারে লইয়া চিন্তা কইরো না। আমি ঠিকই আছি। কোনও সমস্যা নাই আমার।

এইসব শুক্রবারের আগের ঘটনা। তারপর রমিজ আসল, সব খবরাখবরই ভাল দিল। দবির-হামিদা যা আশা করেছিল তার থেকে ভাল। শুইনা দবির তামাক টানতে টানতে গভীর আনন্দে ফেটে যাচ্ছিল। হামিদার মুখটাও খুশিতে ঝলমল ঝলমল করছে।

রমিজ মুড়ি মিঠাই খাইতে খাইতে বলল, কও গাছি, অহন কেমতে কী করবা? বিয়ার দিন তারিখ করতে চাও কবে?

দবির না, কথা বলল হামিদা। আগামি শুক্রবারই করতে চাই। বেককিছু যহন ঠিক আছে তহন আর দেরি করুম ক্যা?

আলহামদুলিল্লাহ। ভাল কথা। কইরা হালান।

দবিরের দিকে তাকাল রমিজ। গাছি, বুদ্ধি কইরা বাড়ির কাম লাগায়া ভাল করছে। ভাবিছাবের কথাঐ ঠিক। দেরি কইরো না। আগামী শুক্কুরবার বিয়ার দিন তারিক করো। আমি অহনঐ রব্বানরে গিয়া বেবাক কথা কইতাছি। আর দেরি করন ঠিকও হইবো না। কে কোনহানদা ভাঙ্গানি দিবো, রব্বানের মন বিগড়াইয়া দিবো, কে কইবো? দেশগেরামে বদ মাইনষের আকাল নাই। নূরজাহানের লগে রব্বানের বিয়া হইতাছে হুইন্না হয়তো মান্নান মাওলানার লগে নূরজাহান যা করছিল হেই ঘটনা কইয়া দিল। রব্বানরে বুজাইলো, এই মাইয়া বিয়া কইরো না মিয়া। মাইয়া সাই পাজি। তোমার জান খাইয়া হালাইবো।

হামিদা বলল, না না দেরি আমরা করুম না। আগামী শুক্রবারই বিয়া। আপনে যহন। ভাল খবর লইয়া আইছেন তয় আর দেরি করুম ক্যা?

দবির তামাক খাওয়া শেষ করে একটা ফিরি নিয়া রমিজের সামনে আইসা বসল। আমগো দিক থিকা বেবাক ঠিক আছে। তুমি অহন রব্বানরে গিয়া কও, ও ইচ্ছা করলে পশুদিন থিকাঐ আমগো বাইত্তে আইয়া থাকতে পারে। কাউলকার মইদ্যে ঘর আর চকির কাম শেষ হইয়া যাইবো। ও আইয়া ওই ঘরে উটতে পারে। আমি টেকা দিলাম তার পরদিন গিয়া বিয়ার বাজার বোজার করলো। লগে আমি লোক দিমু নে। অর নিজের জিনিসপত্র, মাইয়ার বিয়ার শাড়ি ছায়া বেলাউজ সেন্ডেল এই হগলও কিন্না আনলো অর পছন্দ মতন। দরকার অইলে তুমি লগে গেলা।

রমিজ উৎসাহী গলায় বলল, হ যামু নে। অসুবিদা কী?

মনে মনে বলল, আরে যাওন তো আমার লাগবোঐ। আমার স্বার্থ আছে না? দুই হাজার পাওন লাগবো না? আইজ পামু গাছির একহাজার। দুই-তিনদিন পর পামু রব্বানের দুই হাজার। দশদিন পর পামু বাকি দুই হাজার। হেদিন পাইছি এক হাজার। দশদিনের মইদ্যে সব মিলাইয়া ছয় হাজার টেকার কাম। য্যানত্যান কথা!

হামিদা বলল, তয় রব্বানরে আপনে কইবেন পশশু আমগো বাইত্তে আইয়া উডনের আগে দুলালের সেলুনে গিয়া য্যান খেরি করে। মাথার বাবরি চুল য্যান না থাকে, মুখের দাড়িমোচ য্যান না থাকে। পয়পরিষ্কার অইয়া য্যান বাইত্তে আহে। জামাইজন দাড়িআলা অইলে, বাবরিচুলের অইলে মাইনষে কী কইবো!

নূরজাহান চা নিয়া আসছে। সেদিনকার মতন বাপ আর ঘটকের হাতে চায়ের কাপ ধরায়া দিয়া চলে গেল। বিয়ার কথাবার্তা হওয়ার পর থেকে বাড়িতে কোনও লোক দেখলেই মাথায় ঘোমটা দেয় নূরজাহান। এখনও তার মাথায় ঘোমটা। বাড়িতে কাঠ মিস্তিরি, চাপকলের মিস্তিররা কাজ করছে, তাদের দেখলেও ঘোমটা দেয় মাথায়। মাইয়াটা রাতারাতি কেমুন জানি বদলাইয়া গেল। দূর থেকে, কাছ থেকে নূরজাহানকে দেখে বুকের ভিতরটা কেমন করে দবিরের। আহা রে, দুইদিন পর মাইয়াডা আমার পর হইয়া যাইবো। থাকবো আমার বাড়িতেঐ, তয় হইয়া যাইবো আরেকজন মাইনষের। এক সংসারের মানুষ হইয়াও আসলে হইয়া যাইবো অন্য সংসারের মানুষ।

নূরজাহানের বিয়ার কথা হওয়ার পর থেকে দবিরের মুখোন কেমুন ব্যাজার ব্যাজার। শুধু আনন্দে ফাইটা পড়া মুখ হামিদার। সে আছে বিষম আনন্দে। মাইয়ার বিয়া দিতে পারতাছে পছন্দসই পোলার কাছে, এই বাড়িতেই থাকবো মাইয়া, এইটাই তার আনন্দ। এই এইদিকে যাইতাছে সে, এই ওইদিকে যাইতাছে। দবিরের লগে নানান পরামর্শ, মিস্তিরিগো কাজকামের তদারক বেবাক করতাছে দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া।

রমিজ ঘটক চা খাইয়া, তার বাকি একহাজার টাকা জেবে গুইজ্জা কেঁচি সিগ্রেট টানতে টানতে রব্বানের খোঁজে চইলা যাওয়ার পর হামিদা বলল, তয় আমি কাইল পয়সা যাই।

দবিরের হাতে তখনও চায়ের কাপ। চায়ে চুমুক দিয়া বলল, যাও। কাইল গেলে পশ্‌শুঐত্তো আইয়া পড়তে হইবো।

হ আইয়া পড়ম। কাইল ফয়জরের আয়জানের লগে লগে মেলা দিমু।

দেও, দেহো কাম অয়নি।

অইবোনে আল্লার রহমতে। তুমি চিন্তা কইরো না।

.

সেদিন রবিবার। দুপুরের দিকে ফিরা আসল হামিদা। বোরখা পইরা গেছিল, বোরখা পইরাই ফিরা আসল। মুখটা খুশিতে ঝলমল করছে। দবির তখন রান্নাচালায় বইসা তামাক টানছে। নন্দ মিস্তিরি ঘরের কাজ শেষ কইরা পায়খানার কাজ ধরছে। চাপকল বসানো হইয়া গেছে। ইট সিমেন্ট সুরকি দিয়া কলের চারপাশে বড় সাইজের একটা কলতলাও বানাইয়া দিছে চাপকল মিস্তিরিরা। দবির গাছির বাড়িটা এখন নতুন নতুন লাগছে।

হামিদা আইসা বাড়ি দেইখা খুশি। বড়ঘরে ঢুকে বোরখা খুলেছে। নূরজাহান দুপুরের ভাত খাইয়া শুইয়া আছে তার মতন আঁচলে মুখ ঢাইকা। দবির আইসা ঢুকল। কী খবর কী? আউয়াল দাদায় কী কইলো?

হামিদা হাসিমুখে বলল, টেকা দিছে।

দবির একটা লাফ দিল। দিছে?

হ। আমি তোমারে কইছিলাম না, আমার ভাইয়ে আমারে ঠকাইবো না। আমার হিসাবে আমি যা পামু তার থিকা ইট্টু বেশিই দিছে।

কত?

বাইশ হাজার।

কথাটা যেন বিশ্বাস হল না দবিরের। বাইশ হাজার?

হ।

কও কী?

তয় আমি কি তোমার লগে মিছাকথা কইনি?

আল্লাহ আল্লাহ। আল্লায় বিরাট রহম করছে। অহন আর আমার কোনও চিন্তা নাই। ইচ্ছা মতন মাইয়াডার বিয়া দিতে পারুম। রব্বান যা যা চাইছে বেবাক দিতে পারুম।

সেদিন বিকাল শেষ হয়ে আসার আগেই রব্বান আইসা উঠল দবির গাছির বাড়িতে। লগে রমিজ ঘটক আছে। রব্বানের পরনে আজ খয়েরি রঙের প্যান্ট আর সাদা শার্ট। পায়ে টায়ারের স্যান্ডেলটা আছে। তবে পরনের জামাকাপড় পয়পরিষ্কার। মাথায় বাবরি চুল নাই, মুখে দাড়িমোচ নাই। কালোকোলো মুখোন ফরসা লাগছে। বাবরি চুল ছাটাবার ফলে দেখতে ভাল লাগছে।

রব্বানকে দেইখা নূরজাহান মাথায় ঘোমটা দিয়া বড়ঘরে গিয়া ঢুকল। দবির হামিদা দাঁড়ায়া ছিল উঠানে। রমিজ বলল, হাজ অইয়াইলো। আইজ আমি আর দেরি করুম না। গাছি, তোমার জামাই তোমারে বুজাইয়া দিয়া গেলাম। কাইল বিয়ানে আমু। টেকা পয়সা রেডি রাইখো। রব্বানরে লইয়া দিঘলি যামু বিয়ার বাজার করতে। রব্বানের তো কোনও গার্জিয়ান নাই। এর লেইগা আমিই হইলাম অর গার্জিয়ান।

দবির বলল, কোনও অসুবিদা নাই ঘটক। তুমি আইয়ো।

রব্বানরে বলল, যাও বাজান, ওই ঘরে যাও। তোমার ব্যাগবোগ রাইখা লুঙ্গিমুঙ্গি পরো। হাতমুখ ধুইয়া চা পানি খাও। পরে ভাত খাইয়োনে।

রব্বান লাজুক গলায় বলল, আইচ্ছা কাকা।

সেই রাতে অদ্ভুত একটা দৃশ্য চোখে পড়ল রব্বানের। সে রাতের খাওয়া সারছে নতুন ঘরে বইসা। হামিদা তার খাবার দাবার আইনা দিছে, সামনে বসাইয়া খাওয়াইছে। মুরগি ভুনা আর মুশরি ডাইল। হামিদার রান্না ভাল। খাইয়া আরাম পাইছে রব্বান। নতুন ঘরে নতুন চৌকি পাতা। চৌকিতে পুরানা কাঁথা বালিশের বিছানা। নতুন বিছানা হবে বিয়ার রাতে। খাইয়াদাইয়া শুইয়া পড়ছে রব্বান। এতদিন গাছতলায় আর নয়তো মাইট্টাল কামলাগো ছইয়ের নীচে শুইছে, ভাল ঘুম এক রাইতেও ঘুমাইতে পারে নাই। দুয়ার বন্ধ কইরা, উঠানের দিককার জানালা আর মাথার দিককার জানালা খোলা রাইখা। শুইছে, চোখ মাত্র লাইগা আসছে, হঠাৎ শোনে উঠানের দিকে কে জানি কানতাছে। মাইয়ালোকের কণ্ঠ। আস্তে কইরা মাথা তুইলা জানালা দিয়া চাইছে। চাইয়া দেখে উঠান। ভরা ফকফকা জ্যোৎস্না। সেই জ্যোৎস্নায় গাছিকাকা আর কাকি হোগলা বিছাইয়া বইসা রইছে, গাছিকাকার কুলে বইসা একদম শিশু বাচ্চার মতন কইরা তার গলা প্যাঁচাইয়া। ধইরা কানতাছে নূরজাহান। শুধু একটা কথাই তার শুনা যাইতাছে, বাবাগো বাবা, ও বাবা, বাবা। আর কিছু না। অনেকক্ষণ ধইরা এইভাবে কানল নূরজাহান। ওইদিকে হামিদা মাইয়ার পিঠে হাত বুলায় আর চক্ষু পোছে, দবির মাইয়ার মাথায় হাত বুলায় আর চক্ষু পোছে। অনেকক্ষণ ধইরা এই দৃশ্যটা দেখল রব্বান। দেইখা বুকটা কীরকম তোলপাড় করল তার। এত আরামের বিছানায়ও অনেকটা রাত তরি ঘুম আসল না তার। বুকটা ভার হইয়া রইল।

তার পরদিন থেকে কথা মতন আগাইল সবকিছু। রমিজরে নিয়া বারো হাজার টাকা পকেটে নিয়া রব্বান গেল দিঘলি বাজার। নিজের জিনিসপত্র কিনল, নূরজাহানের শাড়ি ছায়া ব্লাউজ স্যান্ডেল লগে অল্প দামি একখান সুটকেস কিনল, হিসাবের গরমিল কইরা। রমিজরে বুঝাইয়া দিল তার দুই হাজার। সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরা জিনিসপত্র সব দিল হামিদার হাতে। জিনিসপত্র পছন্দ অপছন্দের কোনও কারণ নাই। সুটকেস খুইলা প্রত্যেকটা জিনিসই দবির হামিদা দেখল, নূরজাহানরে দেখাল তার বিয়ার লাল রঙের লায়লনের শাড়িটা, ছায়া ব্লাউজ, বাটার স্যান্ডেল। নূরজাহান কোনও কথা বলল না।

বিয়ার আগের দিন থেকে শুরু হইয়া গেল বাড়ি সাজানের কাজ। বাদলা নাদের আলালদ্দিরা শুরু কইরা দিল সাজানের কাজ। পরদিন ফজরের আজানের লগে লগে শহিদ মিন্টুদের বাড়ির পাশের বাড়ির মজ্জেম মাতবর দুইজন লোক লইয়া আইসা খাসি দুইখান জবাই করল। খাসি কিনতে হাটে যাইতে হয় নাই দবিরের। কুমারভোগের এক লোকের চাইরখান খাসির দুইখান কিন্না আনছে তিনহাজার টাকা দিয়া। মজ্জেম মাতবর হইতাছে মেজবানি রান্ধনের ওস্তাদ। কাইল বিকালে আইসা মোশলা বাইট্টা দিয়া গেছে রাবি আর আবদুলের বউ। পিঁয়াজ বাইট্টা দিয়া গেছে। বাজার সদাই বেবাকঐ কইরা রাখছে দবির। জুম্মার নামাজের আগে আগে রান্নাবান্না শেষ। নামাজের পর পর সরা পড়ালেন আমিন মুনশি। কাবিননামায় সই দিল রব্বান, টিপসই দিল নুরজাহান। কাবিন হইল দশ হাজার এক টাকা। উসিল আধাআধি। পাঁচ হাজার। নূরজাহানের উকিল বাপ হইছে আজিজ গাওয়াল, সাক্ষী আবদুল আর আলফু। রব্বানের দিক থেকে রমিজ ঘটক নিজে আর মাঝিবাড়ির ওহাব। সরা পড়ানের পর শুরু হল খাওয়াদাওয়া। আকাশে মেঘ বৃষ্টির চিহ্ন নাই দেইখা শামিয়ানা টাঙাইতে হয় নাই। উঠানে হোগলা বিছাইয়া খাওনের ব্যাবস্থা। নূরজাহান বউ সাইজ্জা বইসা আছে বড়ঘরের চকিতে। লাল শাড়িটায় তাকে খুব মানাইছে। কাইল থেকে কাঁচা হলুদ মাখা ছিল শরীরে। সকালবেলা গোসল করার পর শরীরের রং হইছে হলুদ বর্ণ। একই অবস্থা রব্বানেরও। তারেও কাঁচা হলুদ মাখাইয়া দিছিল বাদলা আর নাদের। সেও গোসল করছে সকালবেলা। গোসল কইরা সাদা পায়জামা আর হালকা হলুদ রঙের সিল্কের পাঞ্জাবি পরছে, মাথায় সাদা টুপি। হাতে ঘড়ি, আঙুলে আংটি। চকির যেদিকটায় পা নামাইব সেইখানে বাটার নতুন স্যান্ডেল।

রব্বানরেও দেখতে ভাল লাগছে। তার লগে আছে বাদলা আলালদ্দি, নাদের হামেদ। দুলাভাই দুলাভাই কইরা ভালই রঙ্গরস তারা রব্বানের লগে করছে।

নূরজাহানের লগে আছে মরনি, বানেছা, আবদুলের বউ। মরনি আম্মার দেওয়া নাকফুল পরছে নূরজাহান, হামিদার কানের দুলজোড়া পরছে, মামাতো ভাই ফজল নিয়া আসছে দশ আনা ওজনের চেন, সেইটা পরছে গলায়। মাথায় খোঁপা বাইন্ধা দিছে বানেছা, হাতভরতি চুড়ি। খুব সুন্দর লাগছে নূরজাহানকে। তবে মেয়েটির মুখে কোথায় যেন সূক্ষ্ম একটা বিষণ্ণতার ছায়া। মরনি আম্মার দিকে সে একবারও তাকায় নাই। কেমন জানি লাগছে তাকাতে। গভীর কোনও অভিমান, নাকি অন্যকিছু কে জানে!

মরনি একবার মজনুর কথা তুলেছিল। মাহাজনে তারে ছুটি দেয় নাই। নাইলে নূরজাহানের বিয়ায় সে আসত।

শুইনা নূরজাহান মনে মনে বলছে, না আইয়া ভাল করছে। আমি চাই না আমার বিয়াতে সে থাকুক। তার লগে আমার আর দেখা হউক।

মজ্জেম মাতবরের খাসির গোস্ত আর ডাইল খাইয়া, সেন্টুর দোকানের দই খাইয়া মহাখুশি বেবাকতে। বিকালের দিকে সবকাজ শেষ। এখন মাইয়া উঠাইয়া দেওন। এই ফাঁকে রব্বান। আর নূরজাহানও খাইয়া নিছে। সরা পড়ানের সময় নূরজাহানের হাত রব্বানের হাতে দিয়া দবির-হামিদা দুইজনেই কানছিল। দবির বলছিল, বহুত আদর কইরা মাইয়াডারে আমি বড় করছি বাজান। অরে তুমি ভাল রাইখো। অর মনে তুমি কোনও দুঃখু দিয়ো না।

হামিদা কোনও কথা বলে নাই। সে শুধু চোখ মুছছিল।

কান্নাকাটি শুরু হইল সন্ধ্যাবেলা। বড়ঘর থেকে নতুন ঘরটায় যাবে নূরজাহান। বড়ঘর তার বাপের বাড়ি, নতুন ঘর হইল জামাইবাড়ি। মাঝখানে শুধু একখান উঠান। বড়ঘরের সামনে দাঁড়ায়া আছে রব্বান। বউ লইয়া নিজের ঘরে যাইবো। মরনি আবদুলের বউ হামিদা তারা ধইরা ধইরা ঘর থেকে বাইর করল নূরজাহানরে। দবির দাঁড়ায়া আছে রব্বানের পাশে। রমিজ আছে, আবদুল আলফু আছে। গাওয়াল চইলা গেছে বাড়িতে। তার নামাজ কালাম আছে। উঠানে হ্যাঁজাক বাতি জ্বলছে। চাঁদের আলোও আছে। বড়ঘর আর নতুনঘরে পরিষ্কার কাঁচের হারিকেন জ্বলছে। আবদুলের দেওয়া তোশক চকিতে বিছানো হয়েছে। তার ওপর নতুন আকাশি রঙের চাদর। নতুন বালিশে লাগানো হয়েছে সাদা গিলাপ। আলনায় রাখা আছে রব্বানের পুরানা জামা কাপড়। সব ঠিকঠাক।

তবে ঘর থেকে উঠানে নাইমাই হামিদার গলা জড়াইয়া ধইরা হাউমাউ কইরা কানতে লাগল নূরজাহান। হামিদাও কাঁদছে। দবির চোখ মুছতে মুছতে গেল মাইয়ারে সান্ত্বনা দিতে। কান্দিছ না মা, কান্দিছ না। তুই তো দূরে কোনওখানে যাইতাছস না, তুই তো আমার বাইত্তেঐ রইলি। কান্দিছ না।

হামিদারে ছাইড়া নূরজাহান তারপর দবিরের গলা প্যাঁচাইয়া ধরল। তারপর সেই সেদিনকার রাতের মতন হাউমাউ কান্না। বাবাগো, ও বাবা, আইজ থিকা আমি তোমার পর অইয়া গেলাম বাবা। আমি তোমার পর অইয়া গেলাম।

দবির কাঁদতে কাঁদতে বলল, নারে মা, না। মাইয়া জামাইবাড়ি যায় ঠিকই, তয় পর অয় না কোনওদিনও। তুই অইলি আমার জান, আমার কইলজার টুকরা। এই ঘর থিকা ওই ঘরে যাইতাছস তুই। আমার চোক্কের সামনে থাকতাছস। তরে তো আমি দূরে বিয়া দেই নাই মা। আমার কাছেই রাখছি। কান্দিছ না, কান্দিছ না।

সেই রাতের মতো রব্বান কীরকম চোখ করে বাপ-মেয়ের দিকে তাকায়া আছে। মুখটা কীরকম উদাস তার।

মরনি বলল, রাইত অইয়া যাইতাছে। বাইত্তে যাওন লাগবো গাছিদাদা। বাড়ি খালি হালাইয়া আইছি। মাইয়া বিদায় করেন। আর কাইন্দেন না।

নূরজাহানের পিঠে হাত রাখল সে। কান্দিস না মা, কান্দিস না। কান্দস ক্যা? বাপ-মা ছাইড়া তো কোনওহানে যাইতাছস না। তর কপাল কত ভাল চিন্তা কর। তুই জামাইবাড়ি গেলি না, জামাইঐ আইলো তগো বাইত্তে। যা মা যা।

রব্বানের দিকে তাকাল সে। বাজান, বউ লইয়া ঘরে যাও।

রব্বান একটু আগায়া আসল। কী করব বুঝতে পারল না। নূরজাহানের হাত ধরবো?

আবদুলের বউ বলল, বউ ঘরে নিতে অয় কুলে কইরা। পাথালি কুলে কইরা লইয়া যান জামাই।

রব্বান কথা বলল না। হাসিমুখে নূরজাহানকে পাথালি কোলে নিল। উঠান পার হইয়া নতুন ঘরে গিয়া ঢুকল।

বাদলা আলালদ্দি বারেক ওরা তখন হি হি কইরা হাসছে।

.

থুতনি তরি ঘোমটা দিয়া বইসা আছে নূরজাহান।

টুপি পাঞ্জাবি খুইলা নতুন লুঙ্গি আর নতুন স্যান্ডো গেঞ্জি পরছে রব্বান। ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ। ঘরে হারিকেন জ্বলছে। বাইরের জ্যোত্সা ঘরের ফাঁকফোকর দিয়া ঢুকছে কিছুটা।

রব্বান আইসা একটা বালিশ টাইনা নূরজাহানের সামনে আধশোয়া হইল। অহন ঘোমটা সরাও। ইট্টু কথাবার্তি কই।

নূরজাহান ঘোমটা সরাল না। কথা তো বললই না, নড়লও না।

রব্বান হাসল। ঠিক আছে, তয় আমিঐ সরাই।

বলেই নূরজাহানের মুখের ঘোমটা সরাতে গেল, নূরজাহান আস্তে করে তার হাত সরায়া দিল। রব্বান আবার চেষ্টা করল, নূরজাহান আবারও একই কাজ করল।

রব্বান হাসিমুখে বলল, তয় ঠিক আছে। সরানের কাম নাই। যেমতে আছো অমতেই বইয়া থাকো। বইয়া বইয়া আমার কথা হোনো। তোমার খবরাখবর কইলাম বেবাকঐ আমি জানি। বহুত তেজি মাইয়া তুমি। মান্নান মাওলানার মুখে ছ্যাপ ছিড়াইয়া দিছিলা পুলিশ দারোগার সামনে। বিরাট জিদ্দি মাইয়া তুমি। হোনো, একখান জিদ্দি মাইয়ার কিচ্ছা কই তোমারে। কিচ্ছাডা হোনলে বুজবা, তুমি কী আর আমি কী?

এক গ্রামে এক পাজি মাইয়া আছিল। তার আর বিয়া হয় না। কারণ চাইরদিকে বইটা গেছে যে মাইয়াটা খুবই বদরাগী আর সাই পাজি। এই মাইয়ারে কে বিয়া করবো? যদিও সমন্দ দুই-একটা আসে তাও আশপাশের লোকদের কাছে বদলাম শুইনা সমন্দ ফিরা যায়। মাইয়ার মা-বাপে তার বিয়ার আশা ছাইড়া দিছে। শেষ তরি এক পোলায় তারে বিয়া করতে আসলো। সে একজন পাজি মাইয়াই বিচড়াইতাছিল।

মাইয়ার বাপে ছেলের আগ্রহ দেইখা অবাক হয়। সে ছেলেরে সব কিছু খুইলা বলে। আমার মাইয়াটা বাবা একটু পাজি, এমনিতে স্বভাব চরিত্র ভাল কিন্তু খুব বদরাগী। তুমি বাবা পরে বলতে পারো কিন্তু আমি আগেই বলে নিলাম। শেষে আমারে দোষ দিতে পারবা না। আমি আগেই সবকিছু বইলা দিলাম। মেয়ের বাবার কথা শুইনা ছেলে বলল যে, আমার পাজি মাইয়াই পছন্দ। আমি এমন একজনরেই খুঁজতাছিলাম। আর মনে মনে বলল, পাজি মাইয়া কেমুন কইরা মানুষ করতে হয় তা আমার জানা আছে।

শুভলগ্নে শুভক্ষণে তাদের বিয়া হইয়া গেল, বিয়ার দিন সাধারণত পালকি দিয়া নতুন বউ নিয়া যায়। কিন্তু এই ছেলে বলে যে, আমার মানত আছে। আমি মানত করছিলাম। বিয়ার সময় আমার বউরে হাঁটাইয়া বাড়িতে নিব।

বউ তো হাঁটতে হাঁটতে বহুকষ্টে বাড়ি গেল। বাড়ি গিয়া বউ একটু বসতে চাইলো। জামাই বলল, এখন বসা যাইব না। আমার মানত আছে বিয়ার দিন বউরে একঘণ্টা উঠানে দাঁড়ায়া থাকতে হইব পাটার উপরে। না দাঁড়াইলে অনেক অমঙ্গল হইব। বউ তো রাগে কটমট করতাছে। ভাবছে বিয়ার দিনটা যাউক না তারপর দেখামু মজা।

আধাঘণ্টা দাঁড়ায়া থাকার পর বলল, আমার ক্ষুধা লাগছে। জামাই বলল, খাবার সময় হইলেই বলব। এখনও খাবার সময় হয় নাই। সময় হইলে খাবার দেওয়া হইলো। খাবার খাইয়া বউ বলল আইজ বিয়ার দিন দেইখা তোমারে ছাড়লাম কিন্তু অন্যদিন হইলে অন্যকিছু হইতো।

জামাই ভাবতাছে তোমারে আইজ কিছুই বলব না। আগামী কাইল দেখামু মজা। তুমি পাজি আর আমি হইলাম পাজির বাপ!

জামাই খুব সেয়ানা। সে ভাবছে বউ যত পাজিই হোক বিয়ার প্রথম রাইতে বিড়াল মারতে না পারলে অর্থাৎ বউটারে সিধা করতে না পারলে কাজ হবে না।

পরদিন ঘুম থেকে ওইঠা স্বামী স্ত্রী দুইজন দাঁত মাজতাছিল। এমন সময় স্বামীর পালা কবুতর বাকবাকুম করে ডাইকা উঠল। সে কবুতররে লক্ষ কইরা বলল, দেখ কবুতর, আমার সামনে বাকবাকুম করিস না। আমার সামনে কেউ বাকুম বাকুম করবো এইটা আমি সইজ্জ করুম না। চুপ কইরা থাক। নাইলে তোর দুই পাও টান দিয়া ছিড়া এক পাও ফালামু। ওই চালে আর এক পাও এই চালে। কবুতর তো আর তার কথা বুঝে নাই। তাই সে আবার বাকবাকুম কইরা উঠল।

জামাই বলল, তবে রে কবুতরের পো, তোর একদিন কী আমার একদিন। এইকথা বইলা সে কবুতরের খাঁচা থেকে কবুতরটারে ধইরা আইনা দুই হাতে দুই পাও ধইরা দুইদিকে টান দিয়া জীবন্ত কবুতররে দুইভাগ কইরা ফালাইলো। এরপর দুই পাও দুই চালের উপর ফিক্কা ফালাইলো।

স্ত্রী বলল, এত নিষ্ঠুর তুমি! কবুতর তো তোমার কথা বুঝতে পারে নাই। তুমি ওরে এইভাবে হত্যা করলা কেন?

সে তার বউরে শুনায়া শুনায়া বলল, আইজ তো কবুতরের উপরে দিয়া গেল। বাড়ির কেউ আমার কথা না শুনলে অর এই কবুতরের মতন অবস্থা হবে।

স্ত্রী ভাবে, কী পাজির হাতে আইসা পড়লাম রে বাবা, এইটা দেখি আমার থিকাও পাজি। যাউক বাপের বাড়ি গিয়া লই। তারপর দেখামু নে মজা।

তারা হাতমুখ ধুইয়া ঘরে আসছে। এমন সময় তার ঘরের পাশে বাইন্ধা রাখা ছাগলটা মে সেঁ কইরা ভ্যাবাইয়া উঠল। সে ঘর থেকে বাইরে গিয়া বলল, ওই ছাগল চুপ করলি। আর একবার চেঁ করলে কিন্তু তোর অবস্থা কবুতরের মতন করুম। ছাগল তার কথা কিছুই বুঝলো না। আবার সেঁ কইরা ভ্যাবানি দিল। জামাই হুংকার দিয়া উঠল, শালার ছাগল, এতবড় সাহস, মেঁ করতে না করলাম, আমার মুখের উপর সেঁ কইরা উঠলি! তোরে আইজকা খাইছি। এই বলে সে পাকের ঘরে গিয়ে ধারালো বঁটি নিয়া আসলো ছাগলরে কাটার জন্য। তার মা বউ সবাই বলল, খবরদার, বোবাজাত তোমার কথা বুঝতে পারে নাই। অরে মাইরো না।

সে বলল, তোমরা জানো না আমার কথা না শোনলে আমি কী করতে পারি? অর রক্ষা নাই আজ। এই বলে সে পাঠা বলির মতন এক কোপে ছাগলের কল্লা নামায়া দিল। ছাগলের রক্ত দেইখা বউ ভয়ে কাঁপতে লাগল।

বউরে শুনায়া শুনায়া জামাই বলল, এইডা তো জন্তুজানোয়ার! কোনও মানুষ আমার। কথা না শোনলে তার অবস্থাও এমন হইব, এইকথা আমি সবাইরে জানায়া দিলাম।

বউ তো পারলে অজ্ঞান হইয়া যায়। এ কী নিষ্ঠুর পাজির হাতে আইসা পড়লাম। তার কথা না শোনলে আমার প্রাণটা যাবে। এখন উপায় হইলো, হয় এর কথা শুনতে হইব নাইলে এরে ছাড়তে হইব। আর এরে ছাইড়া দিলে আমার আর জীবনে বিয়া হইবো না। নানাদিক চিন্তা কইরা শেষে স্বামী যা বলে তা মেনে চলার সিদ্ধান্তই সে নিল।

এদিকে বাবার বাড়ির লোকেরা ভাবছিল স্বামীর বাড়িতে একদিনও তাগো মাইয়া টিকবে না। তারা দেখলো না সে ঠিকই স্বামী সংসার করতাছে। তার বিরুদ্ধে শ্বশুরবাড়ির লোকের কোনও অভিযোগ নাই। তার দাদি একদিন জিজ্ঞাসা করলো, কী রে, তোর এত জিদ। আছিল, তোর এত রাগ আর এত পাজি তুই, তা কীভাবে দূর হইলো? সে বলল, তোমাদের নাতিন জামাই বিয়ার রাইতেই বিলাই মারছিল। তাতেই আমার সব রাগ চইলা গেছে।

রব্বান হাসল। আমার কিচ্ছা শেষ।

নূরজাহান মনে মনে দুইবার বলল, মজনু মজনু।

আর একখান কথা। আমি তাড়াতাড়ি কোনও পোলাপান হওয়ামু না। মাইয়া আমি দুইচোক্ষে দেখতে পারি না। আমি পছন্দ করি পোলা। চাইলাম পোলা, অইয়া গেল মাইয়া, এর লেইগা আমি সহজে পোলাপান হওয়াতে চাই না। পোলাপান যাতে না অয় আমি কইলাম সেই মতন চলুম।

নূরজাহান এবারও কথা বলল না। মনে মনে আবার বলল, মজনু মজনু।

.

সড়ক থেকে ঠাকুরবাড়ির দিকে যাওয়ার চিকন একখান হালট হইছে।

মসজিদের দক্ষিণ দিকে, সেই হালটের পাশে, ঠাকুরবাড়ির কোনায় টংঘরের একখান চায়ের দোকান দিছে হাফেজের পোলা ইনুস। রাস্তার কাজ শেষের পথে। এখন ঠাকুর চদরি বাড়ির দিকটায় মেয়েদের একটা কলেজ করার কথা ভাবছেন খাইগোবাড়ির কর্তারা। একটা প্রাইমারি স্কুল করার কথা ভাবছেন। ধীরে ধীরে আগাচ্ছে সবকাজ। এইসব টের পাইয়াই ব্যাবসাদার মানুষরা আগেভাগেই নানানপদের ব্যাবসার ফিকির করতাছে। ইনুস ওইসব ভাইবাই দোকান দিয়া বসছে। চালান খুবই কম। শুধু টংঘর তোলা আর চায়ের জিনিসপত্র, কিছু বিসকুট বনরুটি কলা, এই তো। দোকান চালু করার কয়েক দিন পরই বুইঝা গেল শুধু চায়ের দোকানে পোষাবে না। লগে মুদি মনোহারি মাল রাখলে দোকান জইমা যাইব। টাকাপয়সা আর কিছু জোগাড় কইরা, দোকানে র‍্যাক বানাইল দুইখান, মুদি মনোহারি জিনিস তুলল। বেচা বিক্রি ভাল রকম বাইড়া গেল। ইনুসের দোকানের সামনের বেঞ্চে সবসময়ই গাহেক দুই-চাইরজন আছে। ফুরুক ফুরুক চা খাচ্ছে, সিগ্রেট বিড়ি পান। খাচ্ছে। বনরুটি কলা খাচ্ছে, চায়ে ভিজাইয়া খাচ্ছে টোস্ট বিসকুট। দোকান চালাইতে গিয়া আজাইরই পায় না ইনুস। বড়পোলা কামাল আইসা বাপের লগে হাত লাগায়।

আছরের নামাজ পড়ে আজ বিকালে মান্নান মাওলানা আর মোতালেব হাঁটতে হাঁটতে আসল ইনুসের দোকানের সামনে। প্রথমে কেউ কিছুই ভাবে নাই, মোতালেব আসছিল হুজুররে আগায়া দিতে। তারপর নিজে হয়তো ইনুসের দোকানের সামনের বেঞ্চে বইসা এককাপ চা খাইব ফোকটে, একটু চাউমি মারবো।

নামাজ কালাম ধরার পরও মোতালেবের স্বভাব বদলায় নাই।

দোকানের সামনে আইসা মান্নান মাওলানা হঠাৎ কইরা বললেন, মোতালেব, লও চা খাই।

মোতালেব বিরাট উৎসাহী। লন খাই হুজুর। আমি তো এইমিহি আইলামঐ এর লেইগা। আপনেরে আউন্নাইয়া দিয়া ইনুসের দোকানে বইয়া এককাপ চা খামু। ইনুস বহুত ভাল চা বানায়। আপনে খান নাই অর দোকানের চা?

খাইছি মনে অয় দুই-একদিন। তাও মনে নাই।

দোকানে ইনুস আছে। সড়কে কাজ করা লেবার ধরনের একজন কেংলামতন লোক চায়ের গেলাসে টোস্ট বিসকুট ভিজাইয়া খাইতাছিল। মান্নান মাওলানা আর মোতালেবকে দেইখা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খাওয়া শেষ কইরা, পয়সা দিয়া ঠাকুরবাড়ির দিকে চইলা গেল।

মোতালেব বিনীত গলায় মান্নান মাওলানাকে বলল, বহেন হুজুর, বহেন।

হাত দিয়া বেঞ্চটা একটু ঝাইড়া দিল।

মান্নান মাওলানা বসলেন। মোতালেব বসল তার পাশে। ইনুস, দুই কাপ চা বানা। হুজুরে খাইবো। চা য্যান ভাল অয়।

ইনুস হাসল। আমার চা খারাপ হইবো না মামা। খাইয়া কইয়েন।

কেটলি থেকে গেলাসে চা ঢালল ইনুস, চামচে করে চিনি মিশাইয়া ফটাফট কয়েকটা নাড়া দিল। দুইজনের হাতে দুইকাপ চা ধরায়া দিয়া বলল, খাইয়া দেহেন। আমি দুধ আর লিকার আলাদা বানাই না। দুধপানি একলগে জ্বাল দেই। তারবাদে ছাড়ি চা-পাতা। চিনি মিশাই পরে। এর লেইগা আমার চা ভাল অয়।

মান্নান মাওলানা চায়ে চুমুক দিলেন। মোতালেবও দিল। দিয়া হুজুরের মুখের দিকে তাকাল। কেমুন চা হুজুর?

মান্নান মাওলানা মাথা নাড়লেন। না, ভাল। বহুত ভাল চা।

শুনে ইনুস খুবই খুশি। হুজুরের মতন পরহেজগার লোকে তার দোকানের চা খাইয়া বলছে ভাল, তয় এই দোকানের আয় উন্নতি হইবই। ইনুসের বরাত মনে অয় খুইল্লা গেল।

মোতালেব চায়ে চুমুক দিয়া বলল, হুজুরের এইবার কপাল কইতে অইবো। তার কথা মতন আমার ভাইগনায় মজজিদ বানাইয়া দিল। মসজিদ অওনের কয়দিন পর ঐ হুজুরে আতাহাররে বিয়া করাইলো বিরাট ধনী বাপের মাইয়া। সোনাদানা খাট পালং সোফা মোফা দিয়া বাড়ি তো ভইরা দিছেঐ, বিয়ার খরচাপাতি বাদ দিয়াও নগদ টেকা দিছে চাইর লাখ।

ইনুস বলল, হ এইডা বিরাট ভাগ্যি। হুজুর, তয় আতাহার অহন কী করবো? কায়কারবার ধরছে?

মান্নান মাওলানা উদাস গলায় বললেন, না অহন তরি ধরে নাই। ধরবো ধরবো করতাছে।

মোতালেব বলল, কী কারবার করবো?

পয়লা চাইছিল মাওয়ার বাজারে একখান বরফকল দিতে।

বরফকল?

হ।

মাওয়ার বাজারে বরফকল দিয়া লাব অইবো?

ভাল লাব অইবো মিয়া। বরফকল দিতে বেশি টেকা লাগে না। তিন-চাইর লাখে অইয়া যায়। তয় রোজগার ভাল।

কেমতে? দেশগেরামে এত বরফ দিয়া মাইনষে কী করবো?

মান্নান মাওলানা চায়ে চুমুক দিয়া মোতালেবের দিকে তাকালেন। তুমি বোজো নাই?

না হুজুর, বুজি নাই।

ইনুস বলল, আমি বুজছি। রাস্তা চালু অইয়া গেলে মাওয়া অইয়া যাইবো বিরাট কায়কারবারের জাগা। মাছের বিরাট বিরাট আড়ত অইবো…

ইনুসের কথা শেষ করতে দিল না মোতালেব। বলল, আর কওন লাগবো না। বুইজ্জা হালাইছি। মাছের আড়তে বরফ লাগে শয়ে শয়ে মন।

মান্নান মাওলানা হাসলেন। এইত্তো বুজছো। খালি মাওয়ার বাজারের মাছের আড়তে। বরফ সাপলাই দিয়া কুলাইতে পারবো না একখান বরফকলে।

তয় দেরি করতাছে ক্যা? নগদ টেকা আছে হাতে। কইরা হালাউক।

মান্নান মাওলানা মন খারাপ করা গলায় বললেন, না বরফকল হেয় করবো না।

কন কী?

হ।

ক্যা?

হেয় অহন অন্য কারবার ধরনের কথা চিন্তা করতাছে।

কী কারবার?

বাসের কারবার।

কী?

হ। ঢাকা-মাওয়া লাইনে বড় একখান বাস নামাইতে চায়। রাস্তা চালু অওনের লগে লগে বাস নামাইবো। বাসের কারবার বলে বহুত লাভজনক হইবো এই লাইনে। দিনে টিপের পরে টিপ দিব (ট্রিপ)। ঢাকার যাত্রাবাড়ি আর নাইলে গুলিস্থান থিকা আইবো আর যাইবো। একবচ্ছর একহান বাস চালাইতে পারলে পরের বচ্ছর ওই রোজগার দিয়া আরেকখান বাস করতে পারবো। এইভাবে চললে চাইর-পাঁচ বচ্ছরের মইদ্যে চাইর-পাঁচহান বাসের মালিক অইয়া যাইতে পারবো।

বুদ্ধিডা কইলাম মন্দ না।

মন্দ যে না হেইডা আমিও বুজি। তয় একহান বাস নামাইতে কত টেকা লাগে জানো?

কত আর লাগবো? চৌদ্দো পোনরো লাক টেকা?

আরে না মিয়া। আঠরো-উনিশ লাক টেকা। অর তো আছে চাইর লাক।

আপনের জাপাইন্না পোলারে কন টেকা দিতে। দুই ভাইয়ে মিল্লা কারবার করুক।

আজাহারে মনে হয় টেকা দিব না।

ক্যা?

আমার ওই পোলাড়া অন্যপদের। নিজের টেকা কের হাতে ছাড়বো না।

তয় আপনে কিছু জমিন বেচেন। বাপপোলায় মিল্লা বাসের কারবার করেন। পাঁচ বচ্ছরে লাল অইয়া যাইবেন।

দেহি কী করন যায়।

চা শেষ করে উঠলেন মান্নান মাওলানা। মোতালেবের গেলাসে চায়ের একটুখানি তলানি রয়ে গেছে। সেইটুকুও ফুরুক করে একটা টান দিল সে। বাইত্তে যাইবেননি হুজুর?

না। একবারে মাগরিব এশা পইড়াঐ যামু।

তয় এতক্ষুন কী করবেন?

তোমার কোনও কাম আছে নি?

আরে না। আমার আর কী কাম?

তয় লও এইমিহি ওইমিহি ইট্টু আডি আর গল্পসল্প করি।

লন তয় হজরতগো বাড়ির ওইমিহি যাই। মাগরিবের ওক্ত অইলে আইয়া পড়ম নে।

লও।

মান্নান মাওলানার লগে হাঁটা দেওয়ার আগে ইনুসের দিকে তাকায়া মোতালেব বলল, ওই ইনুস, চা’র পয়সা পরে লইচ। আমিই দিমু নে।

ইনুস মুখে বলল, আইচ্ছা মামা, দিয়েন।

মনে মনে বলল, তুই আর দিছস চুতমারানির পো। তর কাছে কত কাপ চা’র দাম পাই তুই জানচ? ফোকটে খাইতে খাইতে তো জিন্দেগি পার করলি?

হালট দিয়া হাইটা বড় সড়কের দিকে যাইতে যাইতে মোতালেব বলল, হুজুরের মনডা আইজ ইট্টু খারাপনি?

মান্নান মাওলানা সড়কের দিকে তাকায়া বললেন, তোমার মনে অইতাছে?

হ।

ক্যা মনে অইতাছে কও তো?

আপনের মুখ দেখলে বুজা যায়।

মান্নান মাওলানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। হ মনডা ইট্ট খারাপ।

ক্যা?

এত আশা কইরা আতাহাররে বিয়া করাইলাম, আতাহার আগ্রহ লইয়াঐ বিয়াড়া করল, বিয়ার পর থিকা দেহি পোলাডার মন কেমুন উচাটন। বউডার মিহি তেমুন ফিরাও চায় না। উটতে বইতে খারাপ ব্যবহার করে বউর লগে। একদিন একটা থাবড় মারছে, আরেকদিন রাইত্রে বলে লাখি দিয়া খাট থিকা হালাইয়া দিছে।

কন কী?

হ মিয়া। তুমি আমার আপন মানুষ দেইখা সংসারের ভিতরের এই হগল কথা তোমারে কইলাম। বিশ্বাস কইরা কইলাম। তুমি কইলাম দাদা কেঐরে এই হগল কথা কইয়ো না। শরমের কথা।

আরে না হুজুর। পাগল অইছেন নি আপনে? এই হগল কথা আমি কেঐরে কমু না। মজজিদ বানাইতে গিয়া আমি অইছি আপনের মুরিদ আর আপনে আমার পির, হুজুর। বুজুরগ ব্যক্তি। আপনের সংসারের গোপন কথা বিশ্বাস কইরা আপনে আমারে কইছেন, এইডা আমি মইরা গেলেও কেঐরে কমু না। তয় একটা কথা আমি বুজলাম না, বউ আতাহার পছন্দ করে নাই?

করবো না ক্যা? অরে দেহাইয়াই তো বিয়া করাইলাম।

বউ যে ট্যারা ও আগে দেহে নাই?

দেখছে, দেখছে। তয় এত ট্যারা তহন মনে অয় বোজে নাই। আমিও বুজি নাই মিয়া। ভাবছি লক্ষ্মীট্যারা। বিয়ার পর দেহি পুরা ট্যারা। আতাহার উটতে বইতে টেরি মেরি কইয়া বকাবাজ্জি করে বউডারে। বউডা মিয়া দিনরাইত কান্দে। এক-দেড়মাসও অইলো না বিয়া অইছে, অহনঐ যুদি এই দশা অয়, তয় বাকি জিন্দেগি এই বউর লগে কাডাইবো কেমতে?

মোতালেব মাথা নাড়ায়া বলল, হেইডা তো ঠিক। তয় হুজুর আপনেরে একটা কথা কই?

কও।

কিছু মনে কইরেন না।

না মনে করুম না। আমি বুজছি তুমি কী কইবা। কও।

মোতাহারের বউর লগে বিয়াড়া আতাহারের করাইলেন না ক্যা?

আরে মিয়া উইডা তো আমার একলা দোষ না। ও ওতো চাইছে অন্য জাগায় বিয়া করতে। ও না চাইলে আমি পারতামনি অরে অন্য জাগায় বিয়া করাইতে?

তয় অহন পোলা বিগড়াইলো ক্যা?

হেইডা মিয়া আমি বুজতে পারতাছি না। মাইয়া লক্ষ্মীট্যারা অউক আর যাই অউক ও তো নিজে যাইয়া দেখলো, তহন না করলেঐত্তো পারতো যে না আমি এই মাইয়া বিয়া। করুম না। অহন বিয়ার পর মাইয়াড়ার লগে খারাপ ব্যবহার করতাছে ক্যা? ওয়াজদ্দি সাব। গাউদ্দার বিরাট নামকরা মানুষ, হের কানে যুদি এই হগল কথা যায়, আমার মান ইজ্জত থাকবো, কও?

না হেইডা তো ঠিকঐ। আইচ্ছা আরেকখান কথা। আতাহারের বিয়ায় বলে মোতাহারের বউ পোলাপানরে আপনে দাওতঐ দেন নাই?

কে কইছে দেই নাই। দিছি।

তয় তারা আহে নাই ক্যা?

ক্যান যে আহে নাই হেইডা তো তুমি বোজোঐ। দেশগেরামের বেবাক মাইনষেঐ বুজছে। আহে তো নাঐ, মদিনার জামাইরে পাডাইছিলাম দাওত দিতে, পারু তারে সোজাসুজি কইয়া দিছে জিন্দেগিতেও আমার বাইত্তে সে আর আইবো না। আমগো লগে। কোনও সম্পর্ক রাখবো না। জাগাসম্পত্তির ভাগ নিতেও আইবো না, আমগো কোনওদিন। চিনবোও না। সে যে এই বাড়ির বউ আছিল, তার পোলাপান যে আমার নাতি নাতকুড় এই পরিচয়ও কোনওদিন দিবো না।

মাইয়াডা বহুত দুঃখু পাইছে হুজুর। এর লেইগা এই হগল কথা কইছে।

হ হেইডা আমিও বুজছি।

হাঁটতে হাঁটতে দবির গাছির বাড়ি বরাবর আসছে তারা। বাড়ি বরাবর রাস্তার ধারে নতুন একটা চায়ের দোকান। সড়কের কাজের কয়েকজন মজুর দোকানের সামনের বেঞ্চে বইসা চা খাচ্ছে। দেখতে শুনতে ভাল একটা ছেলে দোকান চালাচ্ছে। হাসিমুখে গাহেকদের লগে। কথা বলছে। একবার সেই ছেলের দিকে তাকায়া মান্নান মাওলানার মুখের দিকে তাকাল মোতালেব। চিনছেননি হুজুর ছেমড়াডারে?

মান্নান মাওলানা গম্ভীর গলায় বললেন, চিনছি মিয়া। ওই ট্যাটনি ছেমড়ির জামাই। অর নাম অইলো রব্বান।

মোতালেব হাসল। তয় দিহি বেবাক খবরঐ আছে আপনের কাছে?

থাকবো না। তোমার ভাইগনার লেইগা সেন নূরজাহানিরে আমি বিয়া করতে পারলাম না।

না কইরা ভালই করছেন।

ক্যা?

এমতেঐ পোলার বউ লইয়া সংসারে অশান্তি, তহন নূরজাহানরে লইয়া লাগতো আরেক অশান্তি। শেষ তরি বাপেপুতে কাইজ্জাকিত্তন লাইগ্যা যাইতো। পোলায় কইতো নিজে বুড়া বসে একহান ভাল মাইয়া বিয়া কইরা আমারে ধরাইয়া দিছে একহান টেরি।

মান্নান মাওলানা কথা বললেন না, চুপ কইরা রইলেন।

তারপর যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমন গলায় মোতাহার বলল, আরে আপনেরে তো আসল খবর দেওয়া অই নাই হুজুর।

মান্নান মাওলানা মোতালেবের মুখের দিকে তাকালেন। আসল খবর আবার কোনডা?

আরে দারুণ দুইহান খবর আছে।

কী কী কও তো?

এক হইল, আপনের পোলার দোস্ত আছিল না মাটির কনটেকদার আলী আমজাত, ও তো জেলে।

কী?

হ। সিলেট থিকা পুলিশ অরে এরেস্ট করছে। হজরত শাহজালাল সাবের দরবার শরিফে গিয়া ফকির মিসকিনের মতন পইড়া আছিল। পুলিশে অরে ওহেন থিকাই ধরছে। সরকারি কামে টালটি পালটি করছে, কেস অইয়া গেছে, পুলিশে তো অরে ধরবোঐ।

বোজলাম। আরেকখান খবর কী?

আরেকখান খবর অইলো আপনের মাকুন্দার।

মান্নান মাওলানা চমকালেন। মাকুন্দার কী অইছে?

মাকুন্দা খালাস পাইছে।

কও কী?

হ। তয় এই মিহি আর আইবো না। মুনশিগুইনজেই রইয়া গেছে। মুনশিগুইনজের হরগঙ্গা কলেজের ওইমিহি বিরাট নামকরা একজন ডাক্তার আছে, কাদির ডাক্তার। তার একপোলা বহুত নামকরা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে খবর পড়তো। স্বাধীনতার পর রেডিয়ো টেলিভিশনেও খবর পড়ে। নাম হইল বাবুল আকতার। হেই বাড়িতে কাম লইছে মাকুন্দা। তারা মানুষ ভাল। মাকুন্দা বহুত ভাল আছে তাগো বাইত্তে। বাড়ির একপোলা থাকে ফেরান্সের প্যারিস শহরে।

তোমারে এই হগল খবর কে দিল?

কুতুব আলীগো বাড়ির মাতাব আলী মকদ্দমার কামে গেছিল মুনসিগুইনজ, হেয় হুইন্না আইছে আলী আমজাতের কথা। আর মাকুন্দার লগে তার দেহা হইছিল।

মান্নান মাওলানা কথা বললেন না, কীরকম চিন্তিত হয়ে রইলেন।

মোতালেব বলল, মাতাব আলী অরে জিগাইছিল, কী রে মাকুন্দা, আমগো মেদিনমেণ্ডল গেরামে আর যাবি না? মাকুন্দা আপনেরে খুব খারাপ একটা বকা দিয়া কইছে, অমুন মানুষ যেই গেরামে আছে ওহেনে আর যামু না। তয় ওই গেরামে বহুত ভাল মানুষও আছে। বেশিরভাগ মানুষই ভাল। তাগো লেইগা মনডা বহুত কান্দে। যাইতে ইচ্ছা করে। আপনের নাম লইয়া কইছে, আপনে মরলে বলে আইবো।

মান্নান মাওলানা বিরক্ত হলেন। আরে থোও মিয়া ওই হগল চোরচোট্টার কথা। মাকুন্দা মুকুন্দা লইয়া কে চিন্তা করে? আমি অহন আছি আমার চিন্তায়। আতাহাররে কেমতে বাস নামাইয়া দিমু, এত টেকা কই থিকা জোগাড় করুম, এই হগল চিন্তায়। ছেমড়াডার বুদ্ধিশুদ্ধি ভাল না। বুদ্ধি ভাল অইলে বউডার লগে খাতির কইরা, বউরে পটাইয়া হৌর আর সমন্দিগো কাছে থিকা টেকা আইন্না নিজেঐ বাস নামাইতে পারতো। হেইডা না কইরা চুতমারানির পোয় বউডারে পিড়ায়।

আপনে অরে এই হগল বুজান।

দুই-একদিন কথাবার্তি আমি অর লগে কইছি। চিন্তা করতাছি আবার কমু। বউর লগে খাতির কইরা হৌর আর সমন্দিগো কাছ থিকা বাস বানানের টেকা জোগারে বুদ্ধি দিমু। কমু বউরে পটা, বউরে দিয়া কাম করা। আরে বেডা তুই তো টেকা আনবি উধার। বাস চালু কইরা হাজার হাজার টেকা রুজি করবি। ওই টেকা জমাইয়া জমাইয়া তাগো টেকা শোদ কইরা দিবি। আর হৌর সমন্দির টেকা সহাজে ফিরত না দিলেই কী? তরে কি তারা খাইয়া হালাইবো।

না তা খাইবো না। তয় এইক্ষেত্রে আতাহারের উচিত বউর লগে ভাল ব্যবহার। বউ যদি হাতে থাকে, তিন ভাইয়ের এক আদরের বইন, হেই বইনে যুদি তার বাপ ভাইরে কয় আমরা আরো একখান দুইখান বাস নামাইয়া তোমগো টেকা দিমু, তয় তারা কি কোনও কথা কইবো!

আরে আমি তো মিয়া এইডাঐ কই। চুতমারানির পোয় তো বোজে না। বউ হাতে থাকলে বউঐত্তো অরে বিজনিসে খাড়া করাইয়া দিতে পারে।

এইডা অরে আপনে বুজান।

হ যেমতেই অউক অরে বুজাইয়া বাজাইয়া ঠিক করন লাগবো।

তয় লন অহন আরেক কাপ চা খাই।

তারপর হাসল মোতালেব। নূরজাহানের জামাইর দোকানের চা খাইয়া দেহি ছেমড়া চা বানায় কেমুন।

লও দেহি। তয় কোনও প্যাচাইল পোচাইলের কাম নাই।

আরে না। নূরজাহানের বিয়াশাদি অইয়া গেছে অহন হেই হগল লইয়া কথাবার্তি কইয়া লাব কী! ভাইগনার কানে গেলে হেয় রাগ করব।

রাস্তার কাজের লোকগুলি চা খাইয়া চইলা গেছে। এখন বেলদার বাড়ির পশ্চিম দিককার পাশাপাশি দুই বাড়ির ঢাকায় থাকা দুইটা ছেলে বইসা চায়ের অর্ডার দিছে। একজনের পরনে জিনসের প্যান্ট সাদা টি-শার্ট পায়ে কেডস। আরেকজনের পরনে প্রিন্টের হাফহাতা শার্ট আর কালো প্যান্ট, পায়ে স্যান্ডেল চোখে চশমা। মোতালেব তাদেরকে চিনল। জিনসের প্যান্ট পরা ছেলেটার নাম আফজাল আর প্রিন্টের শার্ট পরাটার নাম বকুল। তারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়া কথা বলছিল। চা বানাতে বানাতে মুগ্ধ হয়ে তাদের কথা শুনছে রব্বান।

আফজাল ছেলেটা বলছিল, শহিদ মিন্টুর দাদা আমগো গেরামের নামকরা মানুষ আছিল। সরকারি কাম করতো। দফাদার। শুকুর দফাদার। একাত্তোর সালে মিন্টুর বয়স পনেরো বছর। ক্লাস নাইনে পড়তো। পঁচিশে মার্চ পাকিস্তানিরা যখন ঢাকার ঘুমন্ত মানুষের ওপর ঝাঁপায়া পড়ল, হাজার হাজার মানুষ মাইরা ফালাইলো, শহর ছাইড়া মানুষজন জান বাঁচাইতে আসতে লাগল গ্রামের দিকে। পুরা দেশের মানুষ যখন দিশাহারা, কেমন কইরা পাকিস্তানিগো ঠেকান যায়, কেমন কইরা শত্রুর হাত থিকা রক্ষা করা যায় দেশ এর লেইগা। এপ্রিল মাসেই দেশের ছাত্র জনতা সিপাহি পুলিশ সাধারণ মানুষ একত্র হইতে আরম্ব করল। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হইয়া গেল।

মিন্টু সেই সময় মুক্তিযুদ্ধে চইলা গেল।

সে আর তার ছোটভাই থাকতো একঘরে। রাতের অন্ধকারে ছোট ভাইর পাশ থিকা উইঠা, বাড়ির কাউরে কিছু না বইলা গেল ইন্ডিয়ায়। ইন্ডিয়ার কল্যাণী নামের এক জাগায়। সেখানে ততদিনে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শুরু হইয়া গেছে। এক মাস ট্রেনিং লইয়া বয়রা বর্ডার দিয়া বাংলাদেশে ঢুকলো মিন্টু। আট নম্বর সেক্টর কমান্ডার ফ্লাইট ল্যাফনেনেন্ট জামাল চৌধুরীর নেতৃত্বে মিন্টু যুদ্ধ করতে চইলা গেল ফরিদপুর জিলার ভাটিয়া পাড়ায়। সেখানে পাকিস্তানিগো লগে যুদ্ধ করতে লাগল।

ততক্ষণে দুই গেলাস চা বানাইয়া আফজাল আর বকুলের হাতে ধরাইয়া দিছে রব্বান। মান্নান মাওলানা আর মোতালেব আইসা দাঁড়াইছে দোকানের একটু দূরে। হয়তো দুইটা যুবক পোলা বইসা চা খাইতাছে দেইখা তারা একটু অপেক্ষা করছে। বেঞ্চ খালি হইলে আইসা বসবো।

রব্বান একবার তাদের দিকে তাকাল, কথা বলল না, আফজাল আর বকুলের কথা শুনতে লাগল।

আফজাল চায়ে চুমুক দিয়া বলল, আমগো এই মাওয়ার পোলা মিন্টু। বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার আগের দিন তরি যুদ্ধ করছে। পনেরোই ডিসেম্বর যুদ্ধ করতে করতে মিন্টু চইলা যায় পাকিস্তান আর্মির ক্যাম্পের একেবারে কাছে। ক্রোলিং কইরা গিয়া শুইয়া শুইয়া যুদ্ধ করতে করতে যুদ্ধের উত্তেজনায় এক সময় উইঠা দাঁড়ায়। আর তখনই এক সময় পাকিস্তানিগো বুলেট আইসা তার কপালে লাগে। মস্তক ছিন্নভিন্ন কইরা ফালায়। বীর মুক্তিযোদ্ধা, কিশোর মিন্টু বাংলার মাটিতে লুটায়া পড়ে। ততক্ষণে বিকাল হইয়া গেছে। ডিসেম্বরের পনেরো তারিখ। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর, মোলোই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হইয়া গেল।

মান্নান মাওলানা মোতালেবের হাত ধইরা টান দিলেন। শহিদ মুক্তিযোদ্ধা মিন্টুর কথা শুইনা তিনি যেন একটু বিরক্ত। বললেন, লও মিয়া, যাইগা। এহেনে পোলাপান চাডামি মারতাছে। এহেনে চা খাওনের কাম নাই।

মোতালেব হাসল। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা বলতাছে অরা, শহিদ মিন্টুর কথা বলতাছে আর। আপনে কইতাছেন অরা চাডামি মারতাছে?

অইছে লও মিয়া। কথা কইয়ো না।

মোতালেবরে নিয়া দ্রুত পায়ে ফিরতি পথে পা বাড়াইলেন মান্নান মাওলানা। আফজাল আর বকুল দুইজনেই ততক্ষণে খেয়াল করেছে মান্নান মাওলানার। বকুল রব্বানরে বলল, তোমার দুইজন গাহেক আমরা নষ্ট করলাম ভাই। আমগো লেইগা মাওলানা সাবে তোমার এহেনে চা খাইতে আইলো না।

রব্বান বলল, হেইডা মনে অয় খালি আপনেগো লেইগা না। আমার লেইগাও অইতে পারে। আমার বউয়ে তার মুখে ছ্যাপ দিছিল না?

আফজাল বলল, তার থিকাও বড় কথা হইল শালায় তো রাজাকার আছিল। হাতে কলমে রাজাকারি করে নাই। অর্থাৎ আর্মি ক্যাম্প কেম্পে গিয়া খবরাখবর দেয় নাই। রাজাকারি অস্ত্রও হাতে লয় নাই। তয় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করছে। পোলাগো মুক্তিযুদ্ধে যাইতে দেয় নাই। স্বাধীনতার পর বহুতদিন পলাইয়া আছিল। মোতাহার আতাহারের দোস্ত বন্ধুরা মুক্তিযোদ্ধা আছিল। তাগো লেইগা শালায় বাঁইচা গেছে। নাইলে তহনঐ অরে বিচড়াইয়া বাইর কইরা মাইরা হালাইতো মুক্তিযোদ্ধারা।

রব্বান বলল, বাদ দেন তার কথা। শহিদ মিন্টুর কথা কন।

আফজাল আবার চায়ে চুমুক দিল। যুদ্ধ শেষ কইরা, বাংলাদেশ স্বাধীন কইরা আমগো বীর মুক্তিযোদ্ধারা ফিরা আসলো। আমগো এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা গেল শহিদ মিন্টুগো বাড়িতে। মিন্টুর মা কানতে কানতে তাগো কাছে জানতে চাইলো, বাজানরা, তোমরা তো। ফিরা আইলা, আমার মিন্টুরে কই থুইয়া আইলা? তারা কেউ কোনও কথা বলতে পারে না। মিন্টুর মায়ের হাতে তুইলা দেয় ছেলের মানিব্যাগ, তার একটা ছবি আর একটা কয়েক লাইনের চিঠি। মা, আমি আপনাকে না বলিয়া যুদ্ধে আসিয়াছি। আমাকে ক্ষমা করিবেন আর দোয়া করিবেন যেন দেশকে শত্রুমুক্ত করিয়া, বাংলাদেশ স্বাধীন করিয়া আপনার বুকে ফিরিয়া আসিতে পারি। সেই ছেলে আর ফিরা আসে নাই।

রব্বান বলল, তয় তো ভাই আপনেগো এই মাওয়া এলাকা বিরাট পবিত্র জাগা। এই গেরামের পোলা মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হইছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা। প্রত্যেকদিন তার উদ্দেশে সালাম জানান উচিত আমগো।

কপালে স্যালুট করার ভঙ্গিতে হাত তুলে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ মিন্টুর উদ্দেশে সালাম জানাল রব্বান।

বকুল বলল, মাওয়া শব্দের অর্থ হইতাছে স্বর্গের বাগান। যেই গেরামে মিন্টুর মতন দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধা জন্মায় সেই গ্রাম সত্য সত্যই স্বর্গের বাগান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *