১.১৬-২০ মান্নান মাওলানা

১.১৬

হঠাৎ করেই মান্নান মাওলানাকে দেখতে পেল নূরজাহান। দুই দিন পর ছাড়া পেয়ে পাগলের মতো ছুটছিল সে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমে ভেবেছে সড়কে যাবে, দেখবে কত উঁচু হল সড়ক, কত দূর আগাল। তারপরই সেই চিন্তা বাতিল করে দিয়েছে। এক দুইদিনে এতবড় সড়ক উঁচু একটু হতে পারে, আগাবে আর কতটুকু! অল্প একটু যা আগায় খেয়াল করে না দেখলে বোঝা যায় না। তারচেয়ে সড়ক দেখতে যাওয়া উচিত কয়েকদিন পর পর, ওইভাবে দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায় কতটা আগালো।

মাঠ ভেঙে ছুটতে ছুটতে এই ভেবে আজ সড়কের দিকে যায়নি নূরজাহান। তার মনে পড়েছে মজনুর কথা। চারমাস হল মজনু চলে গেছে টাউনে। সেখানে খলিফাগিরি শিখছে। তিন চারদিন হল বাড়িতে আসছে। হয়তো দুই একদিনের মধ্যে আবার চলে যাবে। আজ হালদার বাড়িতেই যাবে সে, মজনুকে দেখে আসবে। চারমাসে কতটা বদলেছে মজনু, কেমন হয়েছে দেখতে।

টাউনে থাকলে চেহারা অন্যরকম হয়ে যায় মানুষের। মজনুর কেমন হয়েছে!

মেন্দাবাড়ির সামনে দিয়ে ছুটে যেতে যেতে মজনুর চেহারা কল্পনা করছিল নূরজাহান এজন্য মান্নান মাওলানাকে প্রথমে দেখতে পায়নি। দেখল একেবারে কাছাকাছি এসে, আথকা। দেখে চমকাল সে, নিজের অজান্তে থেমে গেল পা। তবে পলকের জন্য, তারপরই আবার ছুটতে যাবে, মান্নান মাওলানা গম্ভীর গলায় বললেন, ঐ ছেমড়ি, খাড়ো।

নূরজাহান দাঁড়াল, মান্নান মাওলানার মুখের দিকে তাকাল।  

দাঁড়ি আঁচড়ানো শেষ করে মান্নান মাওলানা তখন চিরুনি পরিষ্কার করছেন। সেই ফাঁকে নূরজাহানের চোখের দিকে তাকালেন। দউবরার মাইয়া না তুই?

দবিরকে কেউ দউবরা বললে রাগে গা জ্বলে যায় নূরজাহানের, সে যেই হোক। এখনও তেমন হল। মান্নান মাওলানার চোখের দিকে ভয়ে কখনও তাকায় না নূরজাহান। তাকালে বুকের ভিতর ভয়ার্ত অনুভূতি হয়। এখন আর তেমন হল না। চোখ তুলে মান্নান মাওলানার চোখের দিকে তাকাল। চাপা রাগি গলায় বলল, আমার বাপের নাম দউবরা না, দবির, দবির গাছি।

চিরুনি পকেটে রাখলেন মান্নান মাওলানা কিন্তু নূরজাহানের চোখ থেকে চোখ সরালেন না। গলা আরেকটু গম্ভীর করে বললেন, কচ কী!

ঠিকঐ কই। আমার বাপরে কোনওদিন দউবরা কইবেন না।

 কইলে কী অইবো?

নূরজাহানের প্রায় মুখে এসে গিয়েছিল, কইলে দাঁড়ি টাইন্না ছিড়া হালামু। কী ভেবে কথাটা সে চেপে রাখল। তবে গলার ঝাঁঝ কমাল না, বলল, আমারে খাড়ঐতে কইলেন ক্যা?

আগের মতোই নূরজাহানের চোখের দিকে তাকিয়ে মান্নান মাওলানা বললেন, কথার কাম আছে।

কী কথা?

এতবড় মাইয়া এত ফরফর কইরা ঘোরচ ক্যা? যেহেনে যাই ওহেনেঐ দেহি তরে।

দেকছেন কী অইছে? আমার ইচ্ছা আমি যাই।

আর যাইতে পারবি না।

 লগে লগে ঠোঁট বাঁকাল নূরজাহান। তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, ইহ্ যাইতে পারবো না। আপনে আমার বাপ লাগেন যে আপনের কথা হোনন লাগবো?

নূরজাহানের কথায় রক্ত মাথায় লাফিয়ে উঠল মান্নান মাওলানার। রাগে দিশাহারা হয়ে গেলেন। চিৎকার করে বললেন, কচ কী, আরে কচ কী তুই! আমার মুখের উপরে এতবড় কথা! তরে তো আমি জবেহ কইরা ফালামু। তরে তো কেঐ বাচাইতে পারবো না। মজজিদের ইমাম অইলে অহনঐ সাল্লিশ (সালিশ) ডাকাইতাম আমি, ল্যাংটা কইরা তর পাছায় দোররা মারতাম। বেপরদা বেহাইইয়া মাইয়াছেইলা, মাওলানা ছাহেবের মুখে মুখে কথা কয়! খাড়ো মজজিদখান বানাইয়া লই, এই গেরামের বিচার সাল্লিশ বেবাক করুম আমি। শরিয়ত মোতাবেক করুম, তর লাহান মাইয়ারা বরকা (বোরখা) না ফিনদা বাইতথন বাইর অইতে পারবো না। চুদুরবুদুর (এদিক ওদিক, ইতরামো ফাজলামো অর্থে) করলে গদে (গর্তে) ভইরা একশো একহান পাথথর ফিক্কা (ছুঁড়ে) মারুম।

ডানহাতের বুড়া আঙুল মান্নান মাওলানার দিকে উঁচিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে নূরজাহান বলল, আপনে আমার এইডা করবেন। পচা মলবি, কিচ্ছু জানে না খালি বড় বড় কথা! জানলে তো খাইগোরা (খানেরা) আপনেরেঐ ইমাম বানাইতো, অন্যদেশ থিকা ইমাম আনেনি! মাওলানা কারে কয়, ইমাম কারে কয় খাইগো বাড়ি মজজিদের হুজুররে দেখলে বোজবেন। দেখলেঐ ছেলাম করতে ইচ্ছা করে। ফেরেশতার লাহান মানুষ। আর আপনে, আপনেরে দেখলে মনে অয় খাডাস (খাটাস), রাজাকার।

রাজাকার কথাটা আথকা মুখে এসে গেল নূরজাহানের। কথাটা সে কোথায়, কার কাছে শুনেছে মনে নাই, অর্থ কী তাও জানে না, তবু বলল। বলে আরাম পেল।

তারপর মান্নান মাওলানার সামনে আর দাঁড়াল না নূরজাহান। হালদার বাড়ির দিকে ছুটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে মনে হল বাপকে দউবরা বলার শোধটা ভালই নিয়েছে। ময়মুরব্বির মুখে মুখে কথা বলা, তাঁদের সঙ্গে বেয়াদবি করার পর মনের ভিতর এক ধরনের অপরাধবোধ হয়, হয়তো মা বাবার কাছ বিচার যাবে, হয়তো মারধোর করবে মা বাবা সেই ভয়ে ধুগযুগ ধুগযুগ করে বুক, কিন্তু নূরজাহানের তেমন কিছুই হল না। উৎফুল্ল মনে ছুটতে লাগল সে।

.

১.১৭

নিমতলার চুলায় ভাত চড়িয়েছে রাবি। নাড়ার আগুনে তেজ বেশি বলে চুলায় হাঁড়ি বসাতে না বসাতেই বলক ওঠে ভাতে। রাবির হাঁড়িতেও উঠেছে। সেদিকে খেয়াল নাই রাবির। সারাদিন বাড়া বানছে বেপারিবাড়িতে, খানিক আগে বাড়ি ফিরেই নিমতলায় বসেছে, একহাতে ভাত চড়িয়েছে চুলায় অন্যহাতে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরেছে দশ বছরের ছেলে বাদলাকে। এখন ভাতের দিকে মন নাই, মন বাদলার দিকে। এতবড় হয়েছে ছেলে তবু বুকের দুধ ছাড়তে পারেনি। মাকে দেখলেই নেশাটা বাদলার চেপে বসে। দুইতিন বছর বয়সী শিশুর মতো ভঙ্গি করে মায়ের কোলে প্রথমে মুখ গোঁজে তারপর নিজ হাতে কাপড় সরিয়ে বুকে মুখ দেয়। রাবি একটুও বিরক্ত হয় না। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। মেদিনীমণ্ডল, কুমারভোগ, মাওয়া, দোগাছি যে গ্রামের যে বাড়িতে ডাক পড়ে, বিয়াইন্না রাইত্রে (ভোর রাতে) উঠে কাজ করতে চলে যায়। ধান বানে, ধান সিদ্দ করে। যে বাড়িতে কাজ করে সকাল দুপুর দুইবেলা খাবার পায় সেই বাড়িতে, ফিরার সময় পায় দেড় দুইসের চাউল। সেই চাউল টোপরে করে বাড়ি ফিরার পরই অন্যমানুষ হয়ে যায় সে। তখন আর রাবি কাজের মানুষ না, তখন রাবি মা। বাদলাকে বুকে চেপে উদাস হয়ে বসে থাকে। বাদলা দুধ খায়, রাবি নির্বিকার।

আজ বিকালে নির্বিকার ছিল না রাবি। রাগে ক্রোধে রোদে পোড়া পরিশ্রমী মুখ তার ফেটে পড়ছে। রাবির স্বভাব হচ্ছে নিচু স্বরে কথা বলা, রাগ করুক আর যাই করুক গলা রাবির কখনও চড়ে না।

এখনও চড়েনি। বুকে মুখ দেওয়া বাদলার মাথায় পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে চাপা রাগি স্বরে বলল, কুনসুম মারছে?

মায়ের বুক থেকে মুখ সরাল না বাদলা, ঠোঁট আলগা করে জড়ানো গলায় বলল, দুইফরে।

কীর লেইগা মারলো?

এমতেঐ।

এমতেঐ কেঐ কাঐরে মারে না। তুই কী করছস ক!

কিছু করি নাই।

তরে হেয় পাইলো কই?

আমি তাগ ঐমিহি গেছিলাম।

কীর লেইগা গেছিলি?

কইতর (কবুতর) দেকতে।

কইতর কোনওদিন দেহচ নাই! আইজ নতুন কইরা দেহনের কী অইলো?

একথায় মায়ের বুক থেকে মুখ আলগা করে ফেলল বাদলা। তবে কোল থেকে মুখ সরাল না। যেন এখান থেকে মুখ সরালেই তার সম্পদ ছিনিয়ে নিবে অন্য কেউ, তার খাদ্যে ভাগ বসাবে অন্য কেউ। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বাদলা বলল, এই কইতর দেহি নাই মা। তুমিও দেহো নাই। আইজ গোয়ালিমান্দ্রার হাট থিকা কিন্না আনছে। লোটন (নোটন) কইতর। দুধের লাহান ফকফইক্কা। পাখ (পাখনা) দুইডা আর ঠ্যাং দুইডা এক হাতদা ধইরা, ঠোঁট দুইডা ইট্টু টান দিয়া কতক্ষুণ ঝাইক্কা (ঝাঁকুনি দিয়ে) মাডিতে ছাইড়া দিলে জব (জবাই) করা মুরগির লাহান দাপড়াইতে থাকে। খুব সোন্দর লাগে দেকতে।

রাবি বলল, কী দিয়া মারছে।

বাদলা কথা বলল না। খানিক থেমে মায়ের সঙ্গে কথা বলেছে এখন সেই সময় আর এই সময়ের খাদ্যটা একবারে উসিল (উসুল) করে নিচ্ছে।

রাবি বলল, ঐ ছেমড়া কথা কচ না ক্যা?

পলকের জন্য ঠোঁট আলগা করল বাদলা। খাড়ও কইতাছি।

তাড়াতাড়ি ক।

ক্যা?

আমার কাম আছে।

কী কাম?

বুজিরে কমু না?

কী কইবা?

মোতালেইব্বা যে তরে মারছে।

কইয়া কাম অইবো না। মোতালেব কাকায় কইছে আমি কেরে ডরাই না। এই বাড়ি আমার। আমার উপরেদা কেঐ কথা কইলে তারা এই বাইত্তে থাকতে পারবো না। দেলরা বুজিরেই থাকতে দিমু না, আর তরা তো চউরা, দেলরা বুজির ঘরে থাকচ।

একথা শোনার লগে লগে বাদলাকে ঠেলা দিয়ে কোল থেকে তুলে দিল রাবি। ওট, ম্যালা খাইছস। লাগলে ইট্টু পরে আবার খাইচ। অহন ল আমার লগে।

বাদলা হরতরাইস্যা (হকচকানো) ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। কই যামু?

বুজির কাছে।

বাদলা হি হি করে হাসল। বুজির কাছে যাইবা কী, ঐ যে বুজি।

বাড়ির দক্ষিণ দিককার পালানে (বাগানে) আনমনা ভঙ্গিতে পায়চারি করছেন দেলোয়ারা। কোনও কোনও বিকালে কী যেন কী কারণে উদাস হয়ে যান তিনি। বিশাল পালানে নরম পায়ে পায়চারি করেন, আকাশের দিকে তাকান আর ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। দেখে যে কেউ ভাববে গভীর কোনও দুঃখ বেদনায় যেন ডুবে আছেন মানুষটা।

দেলোয়ারা সব সময় সাদা থান পরেন। মাথার চুলও বেশিরভাগই পরনের থানের মতো। মোটাগাটা শরীর, গোলগাল ধপধপা মুখ, চোখে চশমা, পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল, সব মিলিয়ে দেলোয়ারা যে দীর্ঘকাল ধরে বিধবা এটা বোঝা যায়। কোনও কোনও বিকালের বিষণ্ণ আলোয় পালানে পায়চারি করা মানুষটাকে দেখে বুকের ভিতর অব্যক্ত এক কষ্ট মোচড় দিয়ে ওঠে রাবির। দেলোয়ারা তার কেউ না, তারা এই অঞ্চলের মানুষই না, পদ্মাচরের মানুষ। চরে কাজকাম নাই, দুইবেলার ভাত জোটে না। এজন্য চরের অন্যান্য মানুষের মতো রাবিও স্বামী সন্তান নিয়ে পদ্মা পাড়ি দিয়ে এপারে এসেছে। এপারে বিক্রমপুর, যুগ যুগ ধরে ধনী অঞ্চল। পদ্মা চরের মানুষেরা, চউরারা চিরকাল এপারেরটা খেয়ে পরে বাঁচে। রাবিও বাঁচছে। স্বামী সন্তান নিয়ে বাঁচছে।

এই অঞ্চলের পয়সাঅলা লোক বেশিরভাগই থাকে ঢাকায়। গ্রামে বড় বড় বাড়ি খালি পড়ে থাকে। ছোট সংসারের চউরা পরিবার পেলে বাড়িতে আশ্রয় দেয়। কাজ কাম দিয়ে সাহায্য করে, টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করে। দিনে দিনে অদ্ভুত এক আত্মীয়তা গড়ে ওঠে।

রাবিরও তেমন এক আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে দেলোয়ারার সঙ্গে। বোধহয় দেলোয়ারার উদাসীনতা দেখে বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে এজন্যই।

এই বাড়ির হদিস রাবিদেরকে দিয়েছিল মিয়াবাড়ির বাঁধা কামলা আলফু। একই চরের মানুষ তারা। দীর্ঘদিন এই অঞ্চলে যাতায়াত আলফুর। এলাকার প্রায় সবাইকে চিনে, সবাই তাকে চিনে। আলফুর কথায় এই বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছে তারা।

বাড়িটা তিন শরিকের। দেলোয়ারা বড় শরিকের মেয়ে। অল্প বয়সে বিধবা হয়েছেন বলে শ্বশুরবাড়ি আর যাননি। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে এসেছিলেন। মা বাবা গত হয়েছেন বহুকাল আগে। কোনও ভাই নাই, দুইটি মাত্র বোন তাঁরা। বড়বোনের বড় অবস্থা। ঢাকায় বাড়ি গাড়ি সবই আছে। ছেলেরা ব্যবসাবাণিজ্য করে কেউ, কেউ বিদেশে থাকে। দেলোয়ারার মেয়েটাও ছিল ঢাকায়, খালার কাছে। পড়াশুনা শিখিয়ে, ম্যালা টাকা পয়সা খরচা করে সেই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে দেলোয়ারার বোনপোরা। জামাই কাপড়ের ব্যবসা করে। অবস্থা ভাল। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখের সংসার।

মেয়ে জামাই কিছুতেই চায় না গ্রামে পড়ে থাকেন দেলোয়ারা। তাদের কাছে গিয়ে থাকেন। যান দেলোয়ারা, তবে দুইচার দিনের জন্য। বেড়াতে। টাউনে বেশিদিন মন টিকে না বলে চলে আসেন। বাপের বাড়ির সম্পত্তি দেলোয়ারা না থাকলে গিলে খাবে লোকে। রাবিদের নিয়ে বাড়ি আলগান (আগলান) তিনি, ঘর দুয়ার জায়গা সম্পত্তি আলগান। এই করতে করতে অদ্ভুত এক মায়া পড়ে গেছে সবকিছুর ওপর। দুইচার দিনের জন্য ফেলে গেলেও মন খুঁত খুঁত করে।

বাড়ির অন্য দুই শরিকের ঘরে ম্যালা ছেলেমেয়ে। কর্তারা কেউ বেঁচে নাই, তাদের ছেলেমেয়েরা আছে। মেয়েদের সবারই বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলেরা যে যার মতো সংসার করছে কেউ ঢাকায়, কেউ গ্রামে। কেউ আবার দুই জায়গায়ই। বউ ছেলেমেয়ে গ্রামে, নিজে থাকছে ঢাকায়। শুধু ছোট শরিকের চার নম্বর ছেলে মোতালেব থাকে বাড়িতে। গৃহস্থালী করে আর গ্রামে মাতাব্বরি সর্দারি করার চেষ্টা করে। দেশ গ্রামে তার দুই পয়সার দাম নাই। লোভী আর হ্যাঁচড়া ধরনের লোক বলে মোতালেবকে কেউ পাত্তা দেয় না। গ্রামের কোথাও তার কথা টিকে না বলে নিজের ক্ষমতা সে দেখায় বাড়িতে। বাড়িরও সবার সঙ্গে না, দেলোয়ারাদের ঘরে আশ্রিত রাবি, রাবির ছেলে বাদলা স্বামী মতলেব হচ্ছে তার ক্ষমতা দেখাবার জায়গা। সুযোগ পেলেই নানা রকমভাবে এদেরকে সে উৎপীড়ন করে। আজ যেমন মেরেছে বাদলাকে।

নিজে দুই চারটা খারাপ কথা শুনতে রাজি আছে রাবি, স্বামীকেও কেউ ছোটখাট অপমান করলে রাও করে না কিন্তু ছেলের গায়ে হাত দিলে তাকে রাবি কিছুতেই ছাড়বে না, সে যেই হোক।

 মোতালেবকেও রাবি আজ ছাড়বে না। প্রথমে দেলোয়ারা বুজিকে সব বলবে, বুজি যদি বিচার না করে সে নিজে গিয়েই দাঁড়াবে মোতালেবের সামনে। মুখে যা আসে তাই বলে বকাবাজি করবে। বউ পোলাপানের সামনে যতদূর অপমান করার করবে। মোতালেব তো আর মারতে পারবে না তাকে! অন্যের বউঝির গায়ে হাত তোলা এত সোজা না। দেশ গ্রামে বিচার সালিস আছে।

ছেলের হাত ধরে দেলোয়ারার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রাবি। বুজি, ও বুজি।

দেলোয়ারা তাকিয়েছিলেন আকাশের দিকে। রাবির ডাকে তার দিকে মুখ ফিরালেন। কী রে?

আপনের লগে কথার কাম আছে।

ক।

এই বিচার আপনের আইজঐ করন লাগবো, অহনঐ করন লাগব। না করলে এই বাইত্তে আমি থাকুম না। এই বাইত থিকা যামু গা।

চোখ থেকে মোটা কাঁচের চশমা খুলে শাড়ির আঁচলে মুছতে লাগলেন দেলোয়ারা। শান্ত গলায় বললেন, কী অইছে ক।

আমার পোলারে মারছে।

কে?

আপনের ভাইয়ে।

 কোন ভাইয়ে?

এই বাইত্তে আর কোন ভাই আছে আপনের! মোতালেব।

কীর লেইগা মারছে।

কইতর দেকতে গেছিলো।

বাদলার দিকে তাকাল রাবি। ঐ ছেমড়া কী দিয়া মারছে তরে, ক, বুজিরে ক।

বাদলা বলল, কিছু দিয়া মারে নাই। ঠাস কইরা পিডে একটা থাবর দিছে। তারবাদে গলা ধইরা ধাক্কা দিয়া খেদাইয়া দিছে।

কাঁচ মোছা শেষ করে চশমাটা আবার চোখে পরলেন দেলোয়ারা। নির্বিকার গলায় বললেন, আইচ্ছা, মোতালেবরে আমি কমুনে।

দেলোয়ারার এই আচরণ ভাল লাগল না রাবির। সে যে ধরনের মন নিয়ে বিচার দিতে এল তার ধারকাছ দিয়েও গেলেন না দেলোয়ারা। ছেলেটাকে মেরেছে এটা যেন পাত্তাই দিলেন না।

ভিতরে ভিতরে রেগে গেল রাবি। চাপা গলায় বলল, আপনের কাছে আইলাম বিচার দিতে আর আপনে কথাডা গায় লাগাইলেন না, এইডা ঠিক করলেন না বুজি!

রাবির মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন দেলোয়ারা। তুই তাইলে কী করতে কচ? আমি গিয়া বইক্কামু (বকে আসব) মোতালেইব্বারে, না মাইরামু (মেরে আসব)।

হেইডা আপনে পারবেন না। হেই ক্ষমতা আপনের নাই। মোতালেইব্বা তো কইছে অর লগে কাইজ্জা করলে আপনেরে সুদ্দা বাড়িত থন বাইর কইরা দিবো।

কথাটা দেলোয়ারার খুবই গায়ে লাগল। ভুরু কোঁচকালেন তিনি। কী কইলি?

 হ। বিশ্বাস না অইলে বাদলারে জিগান।

ছেলের দিকে তাকাল রাবি। কীরে বাদলা,কয় নাই?

বাদলা বলল, হ কইছে।

 কো মোতালেইব্বা কো? ল তো আমার লগে।

তিন বয়সী তিনজন মানুষ যখন পা বাড়িয়েছে মান্নান মাওলানা এসে দাঁড়ালেন পালানে। বইন আছোনি বাইত্তে?

মান্নান মাওলানাকে দেখে বেতিব্যস্ত হল তিনজন মানুষ। দেলোয়ারা রাবি মাথায়। ঘোমটা দিল।

দেলোয়ারা কথা বলবার আগেই রাবি বলল, এহেনেঐ বইবেন না ঘরে যাইবেন হুজুর?

মান্নান মাওলানা রাবির দিকে তাকালেন না। দেলোয়ারার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ঘরে বহি, কী কও বইন! তোমার লগে কথার কাম আছে।

দেলোয়ারা বললেন, লন তাইলে ঘরে লন।

দেলোয়ারা আর মান্নান মাওলানা ঘরে ঢোকার আগেই প্রায় ছুটে এসে বড়ঘরে ঢুকল রাবি। উত্তরমুখি কামরায় রাখা হাতলআলা চেয়ারগুলির একটা আঁচলে মুছে পরিষ্কার করল। দেলোয়ারার সঙ্গে মান্নান মাওলানা এসে এই কামরায় ঢোকার লগে লগে বলল, বহেন হুজুর। বহেন।

মান্নান মাওলানা তবু রাবির দিকে তাকালেন না। দাঁড়ি হাতাতে হাতাতে তাকালেন দেলোয়ারার দিকে। বহো বইন।

মাথায় ঘোমটা দেওয়া দেলোয়ারাকে এখন অন্যরকম দেখাচ্ছে। বয়সের তুলনায় বেশি বয়স্ক, বেশি ভারিক্কি। গুছিয়ে নরম ভঙ্গিতে একটা চেয়ারে বসলেন তিনি। চশমার ভিতর থেকে মান্নান মাওলানার দিকে তাকালেন। তিনি কথা বলবার আগেই রাবি বলল,

চা বানামু বুজি?

এবার রাবির দিকে তাকালেন মান্নান মাওলানা। বানাও, ভাল কইরা চা বানাও। দুদ দিবা না। লাল চা। আদা তেজপাতা দিবা। গলাডা দুইদিন ধইরা খুসখুস করতাছে।

রাবি দেলোয়ারার দিকে তাকাল। আপনেরেও দিমু বুজি?

 দেলোয়ারা বললেন, না। চা আমার ভাল্লাগে না।

রাবি যতক্ষণ বাড়িতে থাকে বাদলা আছে তার লগে লগে। মায়ের আঁচলটা ধরেই থাকে। এখনও আছে। চায়ের কথা শুনে রাবির আঁচল ধরে একটা টান দিল। রাবি বিরক্ত হয়ে ছেলের দিকে তাকাল। কী রে, এমন করচ ক্যা?

বাদলা ফিসফিস করে বলল, আমারেও ই চা দিও মা। বাডিতে কইরা দিও। ফুঁ দিয়া দিয়া খামুনে। চা খাইতে বহুত মজা।

দেলোয়ারা বললেন, ওই ছেমড়া কী কচ হাকিহুকি (ফিসফিস) কইরা?

রাবি হাসিমুখে বলল, না কিছু না। অন্যকথা।

তারপর ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে গেল।

দেলোয়ারা বললেন, কন মাওলানা সাব, কী কথা, হুনি।

মান্নান মাওলানা একটু গলা খাঁকারি দিনে। মুখখানা অমায়িক করে বললেন, তোমার বইনপো বাইত্তে আইবো না?

কে এনামুল?

হ।

আইবো।

কবে?

সঠিক কইতে পারি না। তয় তাড়াতাড়িঐ আইবো। বহুতদিন বাইত্তে আহে না।

এইবার আইলে আমারে ইট্টু খবর দিও। তার লগে কথার কাম আছে।

আইচ্ছা দিমুনে।

মান্নান মাওলানা হাসলেন। কী কথার কাম জিগাইলা না?

দেলোয়ারাও হাসলেন। যেই কথা এনামুলরে কইবেন হেই কথা আমার কাছে কইবেন কিনা জানি না তো!

কওনের কিছু নাই।

তাইলে কন।

তোমার বইনপোর তো টেকা পয়সার আকাল নাই! আল্লায় দিলে বহুত টেকা পয়সার মালিক হইছে। এখন তার উচিত আল্লার কাম করা।

সেইটা এনামুল করে মাওলানা সাব। আটরশি হুজুরের মুরিদ অইছে। কয়দিন পর পরঐ হুজুরের লগে দেহা করতে যায়। জাকাত ফেতরা ঠিক মতন দেয়, গেরামের গরিব মিসকিনগো কাপোড় লুঙ্গি দেয়, টেকা পয়সা দিয়া সাহাইয্য করে। কথায় কথায় মিলাদ শরিফ পড়ায়, মাদ্রাসার ছাত্রগো দিয়া কোরআন খতম দেওয়ায়। রোজার মাসে রোজঐ চাইর পাঁচজন কইরা রোজদাররে ইসতারি (ইফতার) করায়। আল্লার কাম অনেক করে এনামুল।

দেলোয়ারার কথা শুনে খুবই খুশি হলেন মান্নান মাওলানা। উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন, ভাল কথা, খুব ভাল কথা। আল্লার কাম করলে আল্লায়ও তাগো দেয়। তোমার বইনপোরেও আল্লায় দিছে এর লেগাই। তয় অহন আরেকখান বড়কাম এনামুলের করন উচিত।

কী কাম?

তোমগো এই পাড়ায় কোনও মজজিদ নাই। পুব পাড়ায় আমিন মুন্সির বাড়ির লগে ছোড একখান মজজিদ আছে। খাইগো বাইত্তে আছে বিরাট মজজিদ। তোমগো এই পাড়ায়ও একখান মজজিদ থাকন দরকার। এনামুলরে কও একখান মজজিদ কইরা দিতে। তুমি কইলে তোমার কথা হেয় না রাইক্কা পারবো না।

একটুখানি চুপ করে থেকে দেলোয়ারা বললেন, কথাডা মন্দ কন নাই। দেশে একখান মজজিদ কইরা দিলে নাম অইবো। বেবাকতে কইবো দেলরার বইনপোয় মজজিদ কইরা দিছে।

নামও অইবো আল্লার কামও অইবো। মচজিদ করন যে কত বড় ছোঁয়াবের কাম হেইডা কেঐরে কইয়া বুজান যাইবো না। আল্লায় কইছে, হে মমিন মোসলমান, হে আমার পেয়ারে বান্দা, রসুলের উম্মত, তোমাদের মইদ্যে যাহাদিগকে আমি ব্যাপক ধন সম্পদ দান করিয়াছি সেই ধন সম্পদের কিয়দাংশ তোমরা আমার কাজে ব্যয় করো। বলো সোবহানআল্লাহ।

দেলোয়ারা বিড়বিড় করে বললেন, সোবহানআল্লাহ।

মান্নান মাওলানার জন্য আদা চা বানিয়ে, পুরানা আমলের বড় একটা কাপে করে নিয়া আসছে রাবি। দরজার কাছে এসে শোনে ওয়াজ করছেন তিনি। ভয়ে তাঁকে আর ডাকেনি সে। ওয়াজরত মাওলানার মনোযোগ নষ্ট করলে আল্লাহ ব্যাজার হবেন। তবে ওয়াজ শেষ হওয়ার লগে লগে অত্যন্ত বিনীতভাবে চায়ের কাপটা সে মান্নান মাওলানার হাতে দিল। নেন হুজুর। মুখেদা দেহেন ঠিক আছেনি!

মান্নান মাওলানা চায়ে চুমুক দিলেন। বেশ গরম চা তবে সেই গরম চা তার ঠোঁট জিভে তেমন কোনও আলোড়ন তুলতে পারল না। শব্দ করে চা পান তিনি। চুমুকে চুমুকে লুইপস লুইপস করে শব্দ হতে লাগল। এই ধরনের শব্দ দেলোয়ারা অপছন্দ করেন। বনেদী বংশের মেয়ে। জন্মের পর থেকেই নানাবিধ সহবত তাদের শিখানো হয়েছে। সেইসব সহবতের একটা হচ্ছে পানি, দুধ চা যাই খাবে ঠোঁটে গলায় শব্দ হবে না। দুধভাত ডালভাত যাই খাবে, প্লেটে চুমুক দিয়ে খাবে ঠিকই শব্দ হবে না। ফলে ছোটবেলা থেকেই এই ধরনের শব্দ শুনলে গা রি রি করে দেলোয়ারার।

এখনও করছিল। অন্য কেউ হলে বেশ একটা ধমক তাকে দিতেন দেলোয়ারা। মান্নান মাওলানা মরুব্বি মানুষ, তাকে তো আর ধমক দেওয়া যায় না!

বিরক্তি চেপে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন দেলোয়ারা।

রাবির হয়েছে অন্য অবস্থা। গভীর আগ্রহ নিয়ে মান্নান মাওলানার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সে। চা ঠিক হয়েছে কী না বুঝতে পারছে না। ঠিক না হলে মাওলানা সাহেবের অদিশাপ (অভিশাপ) এসে লাগবে তার ওপর। জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে।

চা শেষ করে কাপটা রাবির হাতে ফিরত দিলেন মান্নান মাওলানা।

রাবি ভয়ে ভয়ে বলল, কিছু দিহি কইলেন না?

মান্নান মাওলানা রাবির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। কী কমু?

 চা কেমুন অইছে? খাইয়া আরাম পাইছেননি?

ভাল অইছে। আরাম পাইছি।

লগে লগে মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল রাবির। তাইলে আমার পোলাডারে একটা ফুঁ দিয়া দেন।

কী অইছে তোমার পোলার?

হারাদিন খালি বানরামি (বাদড়ামো) করে।

কো?

চুলারপাড় বইয়া চা খাইতাছে।

ভুরু কুঁচকে রাবির দিকে তাকালেন দেলোয়ারা। চা খাইতাছে।

হ। বাডিতে কইরা এই এতডু চা লইছে, লইয়া ফুঁ দিয়া ফুঁ দিয়া খাইতাছে।

পোলাপানের চা খাওন ভাল না। শইল কইষা (কষে) যাইবো। আদা চা শইল কষাইয়া হালায়।

রাবি একথা পাত্তা দিল না। পিছনের দরজার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ছেলেকে ডাকল। ঐ বাদলা হবিরে (তাড়াতাড়ি) আয়। হবিরে।

চোখের পলকে ছুটে এল বাদলা। কীর লেইগা বোলাও (ডাক)!

আয়।

 বাদলার হাত ধরে মান্নান মাওলানার সামনে এনে দাঁড় করাল রাবি। দেন, ফুঁ দেন। ও যেন আর কইতর দেকতে যাইতে না পারে, মোতালেইব্বা যেন অরে আর না মারতে পারে আর চা যেন ও আর কোনওদিন না খাইতে চায়।

রাবির কথা শুনে বেদম হাসি পাচ্ছিল দেলোয়ারার। অন্যদিকে তাকিয়ে হাসি চাপছিলেন তিনি। তবে মান্নান মাওলানা নির্বিকার। বিড়বিড় করে দোয়া পড়ছেন। পড়ে ফুস ফুস করে তিনটা ফুঁ দিলেন বাদলার মাথায়। যা।

রাবির দিকে তাকিয়ে বললেন, কোনও অসুবিদা অইলে আমার বাইত্তে লইয়া যাইয়ো। ফুঁ দিয়া দিমুনে। লাগলে পানি পড়াও দিমুনে।

আইচ্ছা।

রাবি গদগদ হয়ে ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে গেল।

রাবি বেরিয়ে যাওয়ার পর মান্নান মাওলানা বললেন, বইনপোরে তুমি খবর দেও বইন, আমি নিজে হের লগে কথা কই। তুমি তো কইবা, লগে যুদি আমিও কই, কথাডায় জোর অইবো।

দেলোয়ারা বললেন, আইচ্ছা খবর পাডামুনে।

কাম কাইজ শুরু করনের পর হের কোনও চিন্তা ভাবনা করন লাগবো না। মজজিদের বেবাক কাম আমি কইরা দিমু। দিনরাইত খাইট্টা মজজিদ বানাই দিমু। ইমামতিও করুম। বইনপোর কোনও ব্যাপারে চিন্তা করন লাগবে না।

মজজিদটা করবেন কই?

ক্যা তোমগো ছাড়ায়!

ঐ ডা তো আমার বাপের জাগা।

বাপের জাগা অইছে কী অইছে। অহন মালিক তুমি আর তোমার বইনে।

হ।

বেরাদারি হক (যে লোকের ছেলে সন্তান না থাকে, শুধু মেয়ে থাকে তার জায়গা সম্পত্তির সামান্য একটি অংশ ওই লোকের ভাই বোনরা পায়। এই ব্যাপারটিকে বোঝানো হচ্ছে) তো তোমার চাচা ফুবুগো কাছ থিকা তোমরা কিন্না লইছো!

হ অনেক আগেঐ লইছি।

তাইলে আর কোনও ঝামেলা নাই। তোমগো কাছ থনে তোমার বইনপোয় ঐ বাড়ি কিন্না লইবো।

এইডা ঠিক অইব না। যেই বইনপোরডা খাইয়া বাচতাছি তার কাছে কেমতে কমু আমগো ছাড়াবাড়ি কিন্না মজজিদ বানা।

তাইলে বইনপোর নামে বাড়িডা লেইক্কা দেও। আর নাইলে মজজিদের নামে ওয়াকফা কইরা দেও।

ঠিক আছে। এনামুলরে খবর দেই, আহুক, তারবাদে যা করনের করুম।

তয় আমি মনে করি মজজিদটা তোমগো করন উচিত।

আপনে চিন্তা কইরেন না। করুম।

এ কথায় আনন্দে একেবারে দিশাহারা হয়ে গেলেন মান্নান মাওলানা। কাঁচাপাকা দাঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে থাকা মুখ হাসিতে ভরে গেল। চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন। আমি জানতাম তুমি আমার কথা না হুইন্না পারবা না। বড় ঘরের মাইয়া তোমরা, বড়। বংশের মাইয়া, তোমগো আদব লেহাজঐ অন্যরকম। ময়মুরুব্বিগ মানতে শিখছো। আল্লায় তোমার বইনপোরে আরও বড় করুক।

একটু থেমে বললেন, তাইলে আমি অহন যাই বইন। বইনপোয় আইলে খবর দিও।

দেলোয়ারাও তখন উঠে দাঁড়িয়েছেন। মান্নান মাওলানার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, আইচ্ছা।

মান্নান মাওলানা বেরিয়ে যাওয়ার পর উঠানে মোতালেবকে দেখতে পেলেন দেলোয়ারা। হাতে ছালার একটা ব্যাগ। ব্যাগের পেট বেশ ফোলা।

ঘর থেকে বেরিয়ে মোতালেবকে ডাকলেন দেলোয়ারা। এই মোতালেব, হোন।

হাতের ব্যাগ ঘরের পিড়ার কাছে রাখল মোতালেব। বেশ একটা ভাব ধরে দেলোয়ারার দিকে এগিয়ে এল। কিন্তু দেলোয়ারার দিকে তাকাল না। পশ্চিমের ভিটিতে মোতালেবদের বাংলাঘর। সেই ঘরের সামনে ঝাপড়ানো একটা হাসনাহেনার ঝড়। হাসনাহেনা ঝাড়ের পাশ দিয়ে বাংলাঘরের সামনের দিককার দুইপাশ বেয়ে উঠেছে কুঞ্জলতা, উঠে চালের (চালার) উপর গিয়ে ছড়িয়েছে। ঘরের পিছনে বিশাল একখানা তেঁতুল গাছ। তেঁতুলের ঝাঁপড়ানো ডালা এসে নত হয়েছে চালের ওপর। বিকালবেলার রোদ যত্ন করে আটকে দেয় এই ডালখানা। ফলে বিকালের মুখে মুখে মোতালেবদের বাংলাঘরের চালে বেশ একটা ছায়া ছায়া ভাব। শীতকাল এসে গেল বলে, উত্তরের হাওয়া বইতে শুরু করেছে বলে আজ এসময় বেশ একটা শীত শীত ভাব। এজন্যই কী না কে জানে, বাংলাঘরের চালের ওপর তেঁতুলের ডালার দিকে তাকিয়ে রইল মোতালেব। সেই অবস্থায় দেলোয়ারার লগে কথা বলতে লাগল। কী?

মোতালেব তার দিকে তাকিয়ে কথা বলছে না দেখে বিরক্ত হলেন দেলোয়ারা। গলা একটু রুক্ষ হল তাঁর। বললেন, বাদলারে তুই মারছস ক্যা?

মোতালেব তবু দেলোয়ারার দিকে তাকাল না। আগের মতোই তেঁতুলের ডালার দিকে তাকিয়ে বলল, মারছি কী অইছে।

কী কইলি?

এবার তেঁতুলের ডালা থেকে চোখ ফিরাল মোতালেব। দেলোয়ারার দিকে তাকাল। নির্বিকার গলায় বলল, কইলাম, মারছি কী অইছে।

মোতালেবের কথার ভঙ্গিতে পিত্তি জ্বলে গেল দেলোয়ারার। কপালে তিনটা ভাঁজ পড়ল। গলা আরেকটু রুক্ষ হল। পরের পোলারে কীর লেইগা মারবি তুই?

শয়তানি করছে দেইক্কা মারছি।

কী শয়তানি করছে তর লগে?

কী করছে হেইডা আপনেরে কওন লাগবনি?

কওন লাগবো। বাদলারা আমগো ঘরে থাকে। আমগো মানুষ।

আপনেগো সব সমায় ছোডজাতের লগে খাতির। আগে আছিলো হাজামগো লগে, অহন অইছে চউরাগো লগে।

ঘাড় বাঁকা করে দেলোয়ারা বললেন, দেখ মোতালেইব্বা কথাবার্তা ঠিক মতন ক। ডাক দিলেই হাজামগো আমরা পাইতাম। অগো দিয়া আমগো কাম অইতো। অহন হেই কাম চউরাগো দিয়া করাই। এই হগল লইয়া কোনও রকমের বাড়াবাড়ি তুই করিস না।

বাড়াবাড়ি করলে কী অইবো? কী করবেন আপনে?

দেখবি কী করুম?

হ দেহুম।

কাউলকাঐ (কালই) ঢাকায় খবর পাডামু। এনামুলরে বাইত্তে আইতে কমু।

একথা শুনে মোতালেব নাক ফুলিয়ে বলল, এনামুলের ডর দেহাননি আমারে? এনামুলরে জমাখরচ দিয়া চলি আমি, এ্যা?

জমাখরচ দিয়া চলছ না? ভাত না জোটলেঐত্তো ঢাকায় এনামুলগো বাসায় গিয়া উডছ। আমার বইনের পায়ে ধইরা, এনামুলের পায়ে ধইরা টেকা পয়সা সাহাইয্য আইন্না খাচ। সাহাইয্য চাওনের সমায় এত বড় বড় কথা কই থাকে? এনামুল বাইত্তে আইলে তো দেহি চাকরের লাহান তার পিছে পিছে ঘোরছ। বড়খেত বরগা লওনের লেইগা মামু মামু কইরা পাগল অইয়া যাচ। বাইত্তে মাডি উডাইবো এনামুল, হেই কামও তো তুই করছ। আমগো বাড়ির কামের উপরে দিয়া টেকা কামাছ, তারবাদেও আমগো লগে বড় বড় কথা! জীবনভর তগো অইত্যাচার সইজ্জ করছি। আমগো কোনও আপনা ভাই বেরাদর আছিলো না দেইক্কা জীবনভর তরা আমগো অইত্যাচার করছস। তারবাদেও জীবনভর তগো আমরা উপকার করছি। কইলকাত্তা থিকা আইয়া পড়নের পর, জাহাজের চাকরি শেষ অইয়া যাওনের পর তর বাপে ঢাকা গিয়া আমার দুলাভাইয়ের হাত প্যাচাইয়া ধরলো। এতডি পোলাপান লইয়া না খাইয়া মইরা যামু জামাই, আপনে আমার একটা বেবস্থা কইরা দেন। দুলাভাই তারে মিনসিপালটিতে (মিউনিসিপ্যালিটিতে) কনটেকটারি কামে লাগাইয়া দিলো। তর মাজারো ভাইরে কাপড়ের দোকানের কামে লাগাইয়া দিলো। তরে দিলো জুতার দোকানের কামে। দুলাভাই মইরা যাওনের পর বুজির কাছ থিকা ছয় হাজার টেকা নিছস, হেই টেকার এক পয়সাও শোদ করছ নাই। মাইরা খাইছস। তারবাদেও আমগো লগে এত বড় কথা? নরম পাইছস আমগো? হেইদিন আর নাই। অহন বেশি বাড়াবাড়ি করবি খারাপ অইয়া যাইবো। আহুক এনামুল। ও যুদি তর বিচার না করে তাইলে আমি আমার মাজারো বইনপোরে খবর দিমু। অরে তো চিনস না, আইয়া রে কোনও কথা জিগাইবো না। বাড়ির উডানে হালাইয়া বউ পোলাপানের সামনে তর গলায় পাড়া দিয়া ধরবো। এতবড় সাহস তর, বাদলারে তুই কচ, লাগলে আমারেও এই বাইত থিকা বাইর কইরা দিবি। বাড়িডা তর বাপের?

বেশি রেগে গেলে কথা দ্রুত বলেন দেলোয়ারা। এখনও সেভাবেই বলছিলেন। ফলে মোতালেব আর কথা বলবার সুযোগ পাচ্ছিল না। এদিকে দেলোয়ারার গলা শুনে বাড়ির প্রতিটা ঘর থেকে লোকজন বের হয়ে উঠানে ভিড় করেছে। রাবি আর বাদলা এসে দাঁড়িয়েছে দেলোয়ারার পিছনে কিন্তু কথা বলছে না। মোতালেবকে কেউ শায়েস্তা করলে বাড়ির অন্যান্য লোকজন খুশি হয়। সেই খুশির ছাপ লেগেছে কাইজ্জা শুনতে আসা প্রতিটি মানুষের মুখে।

মোতালেবের বউ দাঁড়িয়ে ছিল কবুতরের খোঁয়াড়ের সামনে। কাইজ্জায় স্বামী সুবিধা করতে পারছে না দেখে, কথা বলবারই সুযোগ পাচ্ছে না দেখে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে মোতালেবের হাত ধরল সে। বাদ দেও এই হগল। ঘরে আইসা পড়।

লগে লগে দেলোয়ারার ওপরকার রাগ বউর ওপর ঝেড়ে দিল মোতালেব। জোরে হাত ঝটকা মারল। কাহিল বউটা প্রায় উড়ে গিয়ে পড়ল দূরে। মোতালেব চিৎকার করে বলল, তুই আমারে থামাইতে আহচ ক্যা মাগী? আমি কি কেঐরে ডরাই? কেঐরডা খাই ফিন্দি?

মোতালেবের বউ কথা বলল না। উঠে কাপড় থেকে ধুলা ঝাড়তে লাগল। স্বামীর এই ধরনের ঠেলাধাক্কা প্রায়ই খায় সে। যে কোনও কাজের ব্যর্থতার ঝাল মোতালেব তার বউর ওপর ঝাড়ে। বউটা এই সব ব্যাপারে অভ্যস্ত। বাড়ির লোকজন তাকিয়ে তাকিয়ে তার উড়ে গিয়ে পড়াটা দেখল তবু সে কিছুই মনে করল না। আবার এসে স্বামীর সামনে দাঁড়াল।

দেলোয়ারা তখন বলছে, কথা কইতে কইতে গলা বইল্লা (বড় হয়ে) গেছে, না? যার তার শইল্লে হাত তোলতে তোলতে হাত বইল্লা গেছে। এর লেইগাইত্তো মন্না দাদার পোলায় ধইরা খালে চুবাইয়া দিছিলো। এইবার আর চুবান না, বেশি বাড়াবাড়ি করবি জেল খাডাইয়া ছাড়ুম। মনে নাই? ভুইল্লা গেছস বেবাক কথা? মাজারো কাকার পোলারা আর তরা মিল্লা যে বড়খেতের ধান কাইট্টা নিছিলি, তারবাদে যহন দরগা পুলিশ আইয়া গুষ্টিসুদ্দা বানছিলো, রাইত দুইফরে ছালাভরা ধান মাথায় কইরা আমগো ঘরে দিয়াইছিলি। গুষ্টিসুদ্দা কাইন্দা কুল পাছ নাই। বেবাকতে মিল্লা আমার দুলাভাইয়ের পাও প্যাচাইয়া ধরছিলি। ভুইল্লা গেছস? দুলাভাই মইরা গেছে কী অইছে। তার পোলারা নাই? এনামুল না পারলে মাজরো বইনপোরে খবর দিমু আমি। আইয়া কইলজা (কলিজা) গালাইয়া হালাইবো তর।

এবারও মোতালেব কোনও কথা বলতে পারল না। তার আগেই মন অন্যদিকে চলে গেল তার। বউ এসে আবার হাত ধরেছে। অন্যদিকে দেলোয়ারার হাত ধরেছে তার মেজো চাচার আগের পক্ষের ছেলে হাফেজের বউ। বাদ দেন বুজি। অনেক অইছে। লন। ঘরে লন।

হাত ধরে টানতে টানতে দেলোয়ারাকে ঘরে নিয়ে গেল হাফেজের বউ। তখনও রাগ কমেনি দেলোয়ারার। আগের মতোই রাগে গো গো করছেন তিনি। ওদিকে মোতালেবের তখন সব রাগ গিয়ে পড়েছে বউর উপর। প্রথমে গলা ধরে প্রচণ্ড জোরে বউকে একটা ধাক্কা দিল সে। তারপর গুমগুম করে তিন চারটা কিল মারল পিঠে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, চুতমারানী মাগী খালি আমার লগে লাইগ্যা থাকে। অর লেইগা মাইনষের লগে কাইজ্জাও করতে পারি না।

বউ কোনও প্রতিবাদ করল না, কাঁদল না। দুঃখি মুখ করে স্বামীর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

মোতালেবের মেয়ে ময়না ছিল ঘরের ভিতর। ছয় সাত বছর বয়স মেয়ের। ডানপা খোঁড়া। হাঁটুর নিচ থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত শুধুই হাড়। হাড়ের ওপর লেগে আছে টিকটিকির চামড়ার মতো ফ্যাকাশে চামড়া। এক ছটাক মাংস নাই। এই পা নিয়ে দাঁড়াতে পারে না মেয়েটা, হাঁটতে পারে না। সারাক্ষণ বসে থাকে, কোথাও যেতে হলে হেউচড়াইয়া (ছেছড়ে) যায়।

ঘরের ভিতর থেকে মাকে মার খেতে দেখে হাচড় পাছড় করে বের হল ময়না। হেউচড়াইয়া হেউচড়াইয়া মার কাছে গেল। দুইহাতে মার শাড়ি খামছে ধরে বলতে লাগল, দুঃকু পাইছ মা? দুঃকু পাইছ! বহো আমি তোমারে আদর কইরা দেই। আমি আদর করলে দুঃকু তোমার থাকবে না।

এতক্ষণ কিচ্ছু হয়নি বউর, মেয়ের কথা শুনে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। চোখের পানি গাল বেয়ে দরদর করে নামল।

মার মুখের দিকে তাকিয়ে ময়না বলল, কাইন্দো না মা, কাইন্দো না। বহো, আমি তোমারে আদর কইরা দেই।

এক পলক বউকে দেখল মোতালেব, মেয়েকে দেখল। তারপর বড়ঘরের পিড়ায় গিয়ে বসল। ছালার ব্যাগ থেকে একমুঠ গম নিয়ে উঠানে ছিটিয়ে দিল। ঘরের চাল থেকে, গাছের ডাল ধোয়াড় থেকে উঠানে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল অনেকগুলি কবুতর। গম খেতে লাগল।

হাফেজের বউ তখন দেলোয়ারাকে একটা চেয়ারে বসিয়েছে। চেয়ারে বসে ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলছেন দেলোয়ারা। একটানা এতক্ষণ চিৎকার করে কথা বলার ফলে ক্লান্ত হয়েছেন। দেলোয়ারার স্বভাব হল কোথাও বসলে প্রথমেই চশমা খোলেন, খুলে শাড়ির আঁচলে যত্ন করে কাঁচ মোছেন। যেন রাজ্যের সব ধুলাবালি জমে আছে কাঁচে। এখনও তাই করতে গেলেন। চোখ থেকে মাত্র চশমাটা খুলবেন, চোখ গেল উঠানের দিকে। উঠানে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে মোতালেবের বউ, ময়না তার শাড়ি খামছে ধরে টানছে। অদূরে পিড়ার ওপর বসে নির্বিকার মুখে কবুতরদের গম খাওয়াচ্ছে মোতালেব। সব দেখে বউটার ওপর অদ্ভুত এক মমতায় মন ভরে গেল দেলোয়ারার। আহা তার জন্য মাঝখান থেকে মার খেল নিরীহ বউটা।

দেলোয়ারার তারপর ইচ্ছা হল আবার উঠে গিয়ে মোতালেবের সামনে দাঁড়ান। আগে কী বকাবাজি করেছেন তার দ্বিগুণ করেন এখন। মরদামি (মরদগিরি) দেহাচ ঘরের বউর লগে? মন্নাফ দাদার অতডু (অত ছোট) পোলায় যে ধইরা চুবাইয়া দিলো, তারে তো কিছু কইতে পারলি না। সাহস থাকলে যা, তারে মাইরা আয়, দেহি!

ইচ্ছা ইচ্ছাই, সব ইচ্ছা কাজে লাগে না।

উঠানে দাঁড়ানো মোতালেবের বউর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দেলোয়ারা। চশমা খুলে শাড়ির আঁচলে কাঁচ মুছতে লাগলেন।

.

১.১৮

এই অঞ্চলের বাড়ি থেকে নামার সময় গতি বেড়ে যায় মানুষের। উঁচু ভিটা থেকে নেমে আসতে হয় সমতল চকেমাঠে। ফলে নামার দিকে পা ফেলা অর্থ হচ্ছে পা দুইটা আপনা আপনি দৌড়াতে থাকবে, যার পা সে টের পাবে না।

আজ বিকালে মজনুরও এই অবস্থা হল। বাড়ির উত্তর পশ্চিম কোণ দিয়ে নামতে গেছে, একটু আনমনা ছিল, ফলে পা এত জোরে দৌড়াল, নিচে নেমে একজন মানুষের ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

মানুষটা তখন দুইহাতে জড়িয়ে ধরেছে মজনুকে। আস্তে আস্তে। আছাড় খাইবেন তো!

লজ্জা পেয়ে নিজেকে সামলাল মজনু। মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল। নূরজাহান দাঁড়িয়ে আছে তাকে ধরে। নাকে নথ পরা মিষ্টি মুখখানা উজ্জ্বল হাসিতে ঝকঝক করছে।

মজনুকে এভাবে তাকাতে দেখে জীবনে এই প্রথম শরীরের খুব ভিতরে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ হল নূরজাহানের। অদ্ভুত এক লজ্জায় চোখ মুখ নত হয়ে গেল। চট করে মজনুকে ছেড়ে দিল সে। চোখ তুলে কিছুতেই আর মজনুর দিকে তাকাতে পারল না।

মজনু তখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নূরজাহানকে দেখছে। চারমাসে যেন অনেক বড় হয়ে গেছে নূরজাহান। মুখটা ঢলঢল করছে অপূর্ব এক লাবণ্যে। চোখে আশ্চর্য এক লাজুকতা। পিঠের ওপর ফেলে রাখা বেণী দুইখানা যেন হঠাৎ করেই তার চপলতা হরণ করেছে।

নূরজাহান তো এমন ছিল না! কোন ফাঁকে এমন হয়ে গেছে!

মজনুর ইচ্ছা হল নূরজাহানকে জিজ্ঞাসা করে, কীরে নূরজাহান তুই দিহি বিয়ার লাইক (লায়েক) অইয়া গেছস! চাইর মাসে এতবড় অইলি কেমতে?

কী ভেবে কথাটা মজনু বলল না। বলল অন্যকথা। কই যাইতাছিলি নূরজাহান?

নূরজাহান মুখ তুলে মজনুর দিকে তাকাল। হাসল। আপনেগ বাইত্তে।

ক্যা?

একথায় রাগল নূরজাহান। ক্যা আবার, এমতেঐ। মাইনষের বাইত্তে মাইনষে যায় ক্যা?

নূরজাহানের এই রাগি ভাব সব সময়ই ভাল লাগে মজনুর। এখনও লাগল। ইচ্ছা হল রাগটা আরেকটু বাড়িয়ে দেয় তার। কিন্তু বাড়াল না। বলল, এতদিন বাদে আমগো বাইত্তে আহনের কথা মনে অইলো তর?

এতদিন বাদে কো? কয়দিন আগেও তে আইয়া গেলাম!

তয় আমি দিহি (দেখি) তরে দেকলাম না!

নূরজাহান অপূর্ব মুখভঙ্গি করে হাসল। আপনে দেকবেন কেমতে! আপনে তহন বাইত্তে আছিলেননি?

এবার মজনুও হাসল। আমি বাইত্তে আইছি পাঁচদিন অইল।

তার আগে আইছি আমি।

তাইলে তো আমার কথা ঠিকঐ আছে।

মজনুর কথাটা বুঝতে পারল না নূরজাহান। সরল মুখ করে মজনুর দিকে তাকাল। কী ঠিক আছে?

ওই যে কইলাম এতদিন বাদে আমগো বাইত্তে আইনের কথা মনে অইলো তর। পাঁচদিন কী কম দিন? আগে তো রোজঐ আমগো বাইত্তে আইতি!

নূরজাহানের ইচ্ছা হল বলে, আগে যে আপনে বাইত্তে আছিলেন এর লেইগা রোজঐ আইতাম। অহন তো আর আপনে নাই, কীর লেইগা আমু! আপনের খালার লগে প্যাচাইল পাড়তে আমার ভাল্লাগে না। বুড়া মাইনষের লগে কথা কইয়া জুইত (জুত) পাই না।

কথাটা বলল না নূরজাহান। জীবনে এই প্রথম মুখে আসা কথা আটকে রাখল। কী রকম লজ্জা হল।

মজনু বলল, আমগো কথা তর মনে অয় অহন আর মনে থাকে না।

নূরজাহান বলল, কে কেইছে?

কে আবার কইবো! আমি কই।

আপনে কইলেঐ অইবোনি? মনে না থাকলে আইজ আইলাম ক্যা?

মনে হয় এই মিহি কোনও কাম আছিলো, কাম সাইরা এক ফাঁকে মনে অইছে আমগো বাইত ঘুইরা যাবি, এর লেইগা আইলি!

নূরজাহান আবার হাসল। টাউনে থাইক্কা দিহি বহুত ঘুরাইন্না প্যাচাইন্না কথা হিগছেন আপনে! আগে এমুন আছিলেন না!

আগে তুইও এমুন আছিলি না।

তয় কেমন আছিলাম আমি?

অন্যরকম।

কেমুন হেইডা কইতে পারেন না?

এত সোন্দর আছিলি না। পচা আছিলি।

ঠোঁট বাঁকিয়ে মজাদার ভঙ্গি করল নূরজাহান। ইস পচা আছিলো! আমি কোনদিনও পচা আছিলাম না। পচা আছিলেন আপনে।

নূরজাহানের দিকে সামান্য ঝুঁকে ঠোঁট টিপে হাসল মজনু। আর অহন?

অহনও পচা। তয় আগের থিকা ইট্টু কম।

একথায় মজনু থতমত খেল। তারপরই ঠিক হয়ে গেল। নূরজাহান তো এরকমই। যা মুখে আসে ঠাস ঠাস বলে ফেলে। কে কী ভাবল ভেবে দেখে না।

তবে নূরজাহান চোরাচোখে তখন মজনুকে দেখছে।

মজনু পরে আছে আকাশি রঙের ফুলহাতা শার্ট। হাতা বেশ সুন্দর করে ভঁজ দিয়ে গোটান। লুঙ্গি পরে আছে বেগুনি চেকের। মাথার চুলে বুঝি আজই সাবান দিয়েছে। রুক্ষ উড়ু উড়ু চুল। মুখটা চারমাস আগের তুলনায় অনেক ফর্সা, অনেক সুন্দর হয়েছে।

এখন পরিপূর্ণ বিকাল। আসন্ন শীতের রোদ আদুরে ভঙ্গিতে ছড়িয়ে আছে চারদিকে। গাছপালা আর মানুষের বাড়িঘর যেন উচ্ছাস আনন্দে ভরা। এরকম বিকালে মজনু যা না তারচেয়ে যেন অনেক বেশি সুন্দর।

নূরজাহান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে দেখতে থাকে।

মজনুদের বাড়ির পশ্চিম দিকে সরু একখানা হাট। এই হালটের দক্ষিণে কালিরখিল, মাওয়া। উত্তরে খানবাড়ি হাতের বাঁদিকে রেখে হালট ঘুরে গেছে সীতারামপুরের দিকে। গিয়েই মাঝপথে থেমে গেছে। এই হালট মুছে ফেলে তার উপর দিয়ে উত্তরে দক্ষিণে ধা ধা করে আসছে সেই মহাসড়ক। সড়কের কাজে ওদিকটায় দিনরাত লেগে আছে লোকজনের চিল্লাচিল্লি কিন্তু মজনুদের বাড়ির দিকটা একেবারেই নির্জন। হালটের ওপাশ থেকে শুরু হয়েছে বিল। পশ্চিমে মাইল দেড়েক, উত্তরে দুই আড়াই মাইল, দক্ষিণে অল্প, তারপরই গ্রাম, নয়াকান্দা। পশ্চিমে কান্দিপাড়া, জশিলদিয়া। উত্তরে কবুতরখোলা, কোলাপাড়া, রাড়িখাল। এই বিশাল বিলের মাঝখানে খুব কাছাকাছি সামনে পিছনে দুইটা বাড়ি। একটা বাড়িতে গোরস্থান। কয়েকটা বাঁশঝাড় আর মানুষের কবর ছাড়া আর কিছু নাই। পিছনের বাড়িটার নাম বিলেরবাড়ি। বিশাল একটা শিমুল গাছ আছে বাড়িতে, দূর থেকে এই গাছ দেখে দিক চিনে নেয় পথিকেরা।

এই বিলে এক সময় আমন আউশের ব্যাপক চাষ হতো। বর্ষার পানিতে প্রান্তরব্যাপী মাথা তুলে থাকত ধানডগা। ঋতুর সঙ্গে বদলাত বিলের চেহারা, রঙ। এই সময়, শেষ হেমন্তের বিকালে বিল ঝকমক ঝকমক করত ছড়ার ভারে নত হওয়া সোনালি ধানে। ধানকাটা শুরু হতো। ভোরবেলা, সূর্য ওঠার আগে কিষাণরা কাচি (কাস্তে) হাতে নামত বিলে। দিনভর ধানকাটা চলত। বিকালে দেখা যেত কাটা ধানের বোঝা বাঁধছে কিষাণরা। এখন ধানের বোঝা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরার সময়। বাড়ির উঠানে নিয়ে ভুর (টাল) দিয়ে রাখবে ধান। বিয়ানরাতে উঠে পাড়াতে (মলন দেয়া। বিক্রমপুর অঞ্চলে সাধারণত গরু দিয়ে ধান মলন দেওয়া হয় না। কিষাণরা পা দিয়ে ডলে ডলে ডগা থেকে ধান ছাড়ায়। এই ব্যাপারটাকে বলে ‘ধান পাড়ানো’) শুরু করবে। গতদিনের কাটাধান সূর্য ওঠার আগে আগে পাড়িয়ে শেষ করে কাচি হাতে আবার যাবে বিলে। আবার ধান কাটবে। দেশ গ্রাম ম ম করবে ধানের গন্ধে। চারদিকে ভা র একটা উৎসব আনন্দের ভাব।

বেশ কয়েক বছর হল এই চেহারাটা আর নাই বিলের। সেই দিনও আর নাই দেশ গ্রামের। এখন বিক্রমপুরে শুধু ইরির চাষ। কোথাও কোথাও বোরো হয়, তবে এই দিকটায় না। শ্রীনগর থেকে ষোলঘর হয়ে আলমপুর যাওয়ার পথে পড়ে আড়িয়ল বিল। বোরোর চাষটা আড়িয়ল বিলে ভাল হয়। এই বিলে শুধু ইরি। শীতকালে বোনা শুরু হয়। বর্ষার আগে আগে, বৃষ্টি বাদলার আগে আগে ধান উঠে যায়। তারপর সারাবর্ষা ফাঁকা বিল। অঞ্চলটা নিচু বলে বর্ষায় এই বিলে পানি হয় অগাধ। দশ বারো হাতি (হাত) লজ্ঞিও ঠাই (থই) পায় না ভরাবর্ষায়। এখন ধান নাই বিলে, পুরা বিল বর্ষার পানিতে টইটুম্বর, মজনুদের বাড়ি থেকে বিলের দিকে তাকালে মনে হয় এটা বোনও বিল না, এটা আরেক পদ্মা, এপার ওপার দেখা যায় না তার। অথবা এ এক অচেনা অকূল দরিয়া। ‘অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে’।

 আজ বিকালে নূরজাহানের সামনা সামনি দাঁড়িয়ে কোন ফাঁকে যেন মজনুর চোখ চলে গেছে বিলের দিকে। ফাঁকা বিলে এখন হা হা করছে উত্তরের হাওয়া আর ডুবতে বসা সূর্যের বিপন্ন রোদ। দূরে, বিলেরবাড়ির শিমুল গাছ বরাবর উড়ে যাচ্ছে সারধরা তিনটা পাখি। সেই পাখির দিকে তাকিয়ে গভীর এক আনন্দে মন ভরে গেল মজনুর। এতক্ষণ নূরজাহানের সঙ্গে কী কথা বলছিল ভুলে গেল। নূরজাহান যে চোরাচোখে তাকে দেখছে একবারও সে তা দেখতে পেল না। আনন্দভরা গলায় বলল, ঐ যে তিনডা পইখ উইড়া যাইতাছে, দেক নূরজাহান, কী সোন্দর!

খুবই তাচ্ছিল্যের চোখে বিলেরবাড়ির দিকে তাকাল নূরজাহান। যেন দয়া করে পাখি তিনটা দেখল কিন্তু একদমই পাত্তা দিল না। বলল, এই হগল জিনিস আপনে দেহেন। থাকেন টাউনে, এই হগল টাউনে পাইবেন কই, দেকবেন কই থিকা!

মজনু মুগ্ধ গলায় বলল, টাউন থিকা গেরাম অনেক সোন্দর রে!

তাইলে টাউনে থাকেন ক্যা?

থাকি ঠেইক্কা। গেরামে থাকলে খামু কী! আর আমার খালায় চায় না আমি গেরামে থাকি।

আমিও চাই না।

কথাটা বলেই লজ্জা পেয়ে গেল নূরজাহান। লগে লগে অন্যদিকে ঘুরাল কথা। পুরুষপোলারা গেরামে পইড়া থাকব কী করতে? গেরামে কোনও ভাল কাম আছেনি! মাইয়া না অইলে কবে আমি টাউনে যাইতাম গা! এহেনে থাকতামনি? সড়কটা অউক, বাস চালু অউক, পলাইয়া অইলেও একদিন টাউনে যামু গা।

তারপরই ছটফট করে উঠল নূরজাহান। যাইগা, হাজ অইয়াইলো।

মজনু খুবই অবাক হল। কীয়ের হাজ অইয়াইলো! আমগো বাইত্তে বলে যাবি? ল।

না, আইজ আর যামু না।

ক্যা?

আপনেরে দেহনের লেইগা যাইতে চাইছিলাম। দেহা তো আপনের লগে অইলো। ও মজনু দাদা, কয়দিন বাইত্তে থাকবেন আপনে?

আছি আর দুই তিনদিন।

তাইলে যাওনের আগে আর একদিন আমুনে।

চোখ সরু করে নূরজাহানের দিকে তাকাল মজনু। অহন কি তুই সত্যঐ বাইত্তে যাইতাছস?

নূরজাহান হাসল। কী মনে অয় আপনের?

 আমার মনে হয় না। মনে অয় অন্য কোনহানে যাবি তুই।

হ সড়কে যামু। দেইক্কাহি কতাহানি আউজ্ঞাইলো সড়ক। আপনে যাইতাছেন কই?

খাইগো বাড়ির মাডে যামু। মাডে বলে আইজ ফুডবল নামবো। পিডাইয়াহি (পিটিয়ে আসি)।

কাম নাই ঐ মিহি যাওনের। আমার লগে লন, সড়ক দেইক্কাহি।

ল তাইলে।

ওরা দুইজন পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে ফাঁকে আনমনা হয়ে গেল নূরজাহান। ভুলেই গেল লগে মজনু আছে।

ব্যাপারটা খেয়াল করল মজনু। করে পিছন থেকে নূরজাহানের বেণী ধরে টান দিল। কীরে নূরজাহান, কী অইলো?

চমকে মজনুর দিকে তাকাল নূরজাহান। ডর করতাছে আমার।

কীয়ের ডর?

মন্নান মাওলানারে বকছি।

কুনসুম?

আইজঐ। আপনেগো বাইত্তে আহনের আগে।

ক্যা?

আমার বাপেরে কয় দউবরা। আমার বাপের নাম কি দউবরা কন? ক্যা, দবির কইতে পারে না? কইছি আরেকদিন দউবরা কইলে দাঁড়ি টাইনা ছিড়া হালামু। আপনে একটা পচা মলবি। আপনে একটা রাজাকার।

মজনু চিন্তিত গলায় বলল, ভাল করচ নাই। মন্নান মাওলানা বহুত খারাপ মানুষ। এইডা লইয়া দেকবি তর বাপের কাছে বিচার দিব। মাইর খাওয়াইবো তরে।

নূরজাহান ঝাঁঝাল গলায় বলল, খাওয়াইলে খাওয়াইবো। আমার বাপের নাম পচা কইরা কইবো, আমি তারে ছাইড়া দিমুনি? আপনের বাপের নাম কেঐ অমুন কইরা কইলে আপনে তারে ছাইড়া দিবেন?

বাপের কথায় মন খারাপ হয়ে গেল মজনুর। বাপ বলতে কোনও মানুষের কথা মনেই পড়ে না তার। কেমন দেখতে মানুষটা, সে যখন জন্মায় তখন কেমন ছিল দেখতে, এই এতকাল পর আজ কেমন হয়েছে এসব কিছুই সে জানে না। বেঁচে যে আছে তা জানে। নামও যে একটা আছে, তা জানে। আদিলদ্দি।

মনে মনে আদিলদ্দি শব্দটা উচ্চারণ করেই লজ্জা পেল মজনু। নাম তো আদিলদ্দি না, আদিলউদ্দিন। সে কেন আদিলদ্দি বলল! লোকমুখে এই নাম শুনে আসছে বলে! নাকি মা মারা যাওয়ায় বাপ তার দেখভাল করে নাই, ভরণপোষণ করে নাই, এই রাগে! যদি সে বাপের সংসারে থাকত তাহলে কি কখনও বিকৃত করে বাপের নাম বলত! অন্য কেউ বিকৃত করে বললে কি সেও নূরজাহানের মত রেগে যেত না!

তারপর মজনু ভাবল, বাপ বাপই। ভরণপোষণ করুক না করুক, ছেলেকে চিনুক না চিনুক, জন্ম যে দিয়েছে এটাই কম কী? বাপ না থাকলে কি এ সুন্দর দুনিয়া তার কখনও দেখা হতো! খালার এমন আদর স্নেহ ভালবাসা কোথায় পেত সে? এই যে এইরকম এক বিকালে নূরজাহানের সঙ্গে হাঁটছে, মন ভরে আছে গভীর আনন্দে, এই আনন্দ তাকে কে দিত!

বাপ ব্যাপারটা বোঝার পর থেকেই বাপের ওপর ভারি একটা রাগ মজনুর। তার মা মারা যাওয়ার পর পরই আরেকটা বিয়া করছে। আগের বউর কথা ভুলে সংসার করতে শুরু করছে। নিজের সন্তান চলে গেছে আরেকজনের কোলে, ফিরেও সেদিকে তাকায়নি। এই যে এতগুলি বছর কেটে গেছে একবারও ছেলের খোঁজ নিতে আসে নাই। অন্য ছেলেমেয়ের মুখ দেখে প্রথমটার কথা ভুলে গেছে। যদি এমন সে না করত। যদি বউ মারা যাওয়ার পর ওই অতটুকু মজনুকে রেখে দিত তার সংসারে তাহলে কি জীবন এরকম হতো মজনুর! হতো না। সৎমা কিছুতেই মেনে নিতে না মজনুকে। জীবন ছাড়খাড় করে ফেলত মজনুর। বাপের সংসারে থেকেও মজনু হয়ে যেত অসহায়। শহরে খলিফাগিরি করতে যাওয়া হতো না, নাবালক বয়সেই গিরস্ত বাড়িতে কামলা দিতে হতো।

এই হিসাবে বাপ তো মজনুর সঙ্গে সম্পর্ক না রেখে ভালই করেছে! মজনুর জীবন সুন্দর করে দিয়েছে!

আজ বিকালে এই সব ভেবে বাপের ওপর জমে থাকা রাগ হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেল মজনুর। কোনও কারণ ছাড়াই নূরজাহানকে সে বলল, আমার বাপের নাম জানচ নূরজাহান, আদিলউদ্দিন।

.

১.১৯

ছাপড়া ঘরের সামনে খয়েরি চাদর পরা মানুষটা জবুথুবু হয়ে বসে আছে। আলী আমজাদ তার দিকে তাকাল না। মাওয়ার বাজার থেকে আনা পাউরুটি আর ছোট সাইজের কয়েকটা কবরি কলা এই মাত্র খেয়েছে। এখন ম্যাচের কাঠির মাথা চোখা করে দাঁত খিলাল করতাছে। সড়কের পাশে একটু নামার দিকে জাহিদ খাঁর বাড়ির সঙ্গে একটা ছাপড়া ঘর কয়দিন হল তুলেছে সে। মাথার ওপর ছয়খান জংধরা টিন ফেলে, চারদিকে বুকাবাঁশের বেডা, ছাপড়া ঘরটা সে করেছে নিজের আরামের জন্য। সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা দুইখান ধরে যায়। কখনও কখনও জাহিদ খাঁর বাড়ি থেকে গোবদা মতো হাতলআলা চেয়ার এনে বসে। সড়কের পাশের হিজল গাছটার তলায় সারাক্ষণই ঝিরিঝিরি হাওয়া। চেয়ার নিয়ে বসলেই ঘুমে চোখ ভেঙে আসে। শরীরের অজান্তেই ছেড়ে দেয় শরীর। এই সব কারণেই ছাপড়া ঘরখান করেছে আলী আমজাদ। নিজের একটু আরাম হল, দরকারী জিনিসপত্র কিছু রাখাও গেল ঘরটায়, এক কাজে দুই কাজ।

ঘর করার জন্য পুরানা ঢেউ টিনগুলি যেমন বাড়ি থেকে এনেছে আলী আমজাদ তেমন এনেছে পুরানা একখান চকি। গোয়ালিমান্দ্রার হাট থেকে নতুন একখান পাটি কিনে এনে বিছিয়েছে চকির উপর। আর আছে দুইখান ল্যাড়ল্যাড়া বালিশ। অল্প কিছু পয়সা এই কাজে খরচা হয়েছে আলী আমজাদের তবে সেই খরচা গায়ে লাগছে না। ঘর তোলার পর থেকে নিজের লক্কর ঝক্কর মোটর সাইকেল এই ঘরের সামনে দাঁড় করিয়ে মাটিয়ালদের কাজের তদারক করে। তবে সেটা পাঁচ দশমিনিট। তারপরই ছটফট করে ছাপড়া ঘরে গিয়ে ঢুকে। ঘর তোলার পর থেকে রোদ জিনিসটা যেন আর সহ্যই করতে পারে না আলী আমজাদ। পাঁচ দশ মিনিট দাঁড়ালে এ রকম শীতের মুখে মুখেও ঘামে ভিজে জ্যাবজ্যাবা হয়ে যায়। ডাঙায় তোলা বড় সাইজের কাতলা মাছের মতো হাঁ করে খাস টানতে থাকে, মোটকা শরীর নিয়ে হাসফাস করতে থাকে। সড়ক যত আগাচ্ছে ততই মোটা হচ্ছে সে, শরীরে, টাকায়। শরীর এবং টাকা যে কারও কারও একটা আরেকটার লগে পাল্লা দিয়া বাড়ে আলী আমজাদকে দেখলে তা বোঝা যায়। ফলে আগের আলী আমজাদ আর নাই। আগে যেমন সারাদিন খাড়া রোদে দাঁড়িয়ে মাটিয়ালদের কাজ দেখত, ভাল একখান ছাতি (ছাতা) পর্যন্ত ছিল না, যেটা ছিল সেটা ছেঁড়া, তালিমারা, খুলতে গেলে বেজায় হাঙ্গামা, বন্ধ করতে গেলে ছাতির কালা কাপড় ফুটা করে শিক (শলাকা) বেরিয়ে যেত এদিক ওদিক। বিরক্ত হয়ে ছাতিটা আলী আমজাদ ব্যবহারই করত না, রোদেই দাঁড়িয়ে থাকত। কোনও মাটিয়ালের গোড়ায় মাটি কম দেখলে কাজে ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে ভেবে মুখে বকাবাজির তুবড়ি ছোটাত, সেই মাটিয়ালের সাতপুরুষ কবর থেকে টেনে তুলত। সাতপুরুষের পুরুষগুলি দৈহিক কারণে রেহাই পেত কিন্তু মহিলাদের গতি ছিল না। যত রকমভাবে উৎপীড়ন তাদের করা যায় মুখে মুখে তা করে ফেলত আলী আমজাদ। কোনও মাটিয়ালের গোড়া উপচে হয়তো এক চাকা (ঢেলা) মাটি পড়ে গেল নিচে, ছুটে গিয়ে আলী আমজাদ তা তুলে দিত। কেটে তোলা মাটি সব সময়ই একটু ভিজা ভিজা হয়। চাপড়ে চাপড়ে পরে যাওয়া চাকাটা গোড়ার অন্য মাটির সঙ্গে বসিয়ে মোড়া তুলে পর্যন্ত দিত। সেই আলী আমজাদ এখন মাটিয়ালদের কাজের তদারক করার জন্য একজন সরদার রেখেছে। লোকটার নাম হেকমত। পাটাভোগের লোক। কাজে লাগবার লগে লগেই শ্রীনগর বাজার থেকে নতুন একখান শরীফ ছাতি কিনেছে হেকমত। আলী আমজাদের মোটর সাইকেলের শব্দ পেলেই মাটিয়ালদের ফেলে সেই শব্দের দিকে মন দেয়। মাথায় দেওয়া ছাতি বন্ধ করে ফেলে। আলী আমজাদ সাইটে আসার লগে লগে বন্ধ ছাতি হাতে ছুটে যায় তার কাছে। অতি যত্নে ছাতিখান আলী আমজাদের মাথার উপর মেলে ধরে। আলী আমজাদ যেদিকে যায় হেকমতও যায় লগে লগে। এই সব কারণে হেকমতকে পছন্দ করেছে আলী আমজাদ। টাকা পয়সা হয়ে গেলে, বড় মানুষদের দুই চারটা ট্যাণ্ডল (চামচা অর্থে) লাগে। উত্তর দক্ষিণ মেদিনীমণ্ডল মিলিয়ে চারটা ট্যাণ্ডল এখানে কাজ পাওয়ার লগে লগে বানিয়ে ফেলেছে আলী আমজাদ। তারা নাম করা লোকের পোলাপান। একজন আছে আতাহার, মান্নান মাওলানার মেজোছেলে। আর তিনজনের একজন মেন্দাবাড়ির আলমগির, হালদার বাড়ির সুরুজ, গোঁসাই বাড়ির নিখিল। এরা আছে বলে এলাকায় কাজ করতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না আলী আমজাদের। ওয়াজের চান্দা, ধরাছি (হাডুডু) খেলার চান্দা চাইতে কেউ আসে না আলী আমজাদের কাছে। যারা আসবে তারা জানে তাদের খাদ্য চার ট্যাণ্ডলে অনেকদিন ধরেই খাচ্ছে। নতুন করে তারা আর কী খাবে!

তবে ট্যাণ্ডল আতাহাররা হলেও ট্যাণ্ডলের মতো আচরণ তাদের লগে করে না আলী আমজাদ। করে বন্ধুর মতন আচরণ। বয়সে অনেক ছোট হওয়ার পরও আতাহররা এখন আলী আমজাদের ইয়ার দোস্ত। আলী আমজাদ যতবার সিগ্রেট খায় লগে থাকলে ততবারই তাদেরকেও সিগ্রেট দেয়। এমন কী ম্যাচ জ্বেলে আঙ্গাইয়া তরি (ধরিয়ে পর্যন্ত) দেয়। প্রথম প্রথম আতাহারদের বাড়িতে তাদের বাংলাঘরে বসে লৌহজং থেকে আনা কে কোম্পানীর মাল চালাত। ছাপড়া ঘর তোলার পর থেকে সেই বাড়িতে আর যেতে হয় না। এই ঘরে বসেই চালায়। দিনে দোফরে, সন্ধ্যার পর। কোনও কোনওদিন রাত গম্ভীর হয়ে গেলে আলী আমজাদ আর বাড়িই ফিরে না। মাওয়ার বাজার থেকে তিন চারটা কুকরা কিনে পাঠিয়ে দেয় নিখিলদের বাড়ি। নিখিলের বিধবা বোন ফুলমতি সেই কুকরা কষিয়ে দেয়। ইয়ার দোস্তদের নিয়ে কুকরার গোস্ত আর কেৰু কোম্পানী মাল কোৎ কোৎ করে চালিয়ে যায় আলী আমজাদ। ট্যাগুল হওয়ার পরও প্রকৃত ট্যাণ্ডলের স্বাদ আতাহারদের কাছ থেকে পায়নি আলী আমজাদ। হেকমতকে রাখার পর তার কাছ থেকে পাচ্ছে। ফলে সাইটে আসার লগে লগে হেকমত যখন ছাতি খুলে দিশাহারা ভঙ্গিতে তার কাছে ছুটে আসে তখন অকারণেই আলী আমজাদ একটু গম্ভীর হয়ে যায়। চালচলন রাশভারি হয়ে যায় তার, গলার স্বর মোটা হয়ে যায়। অর্থাৎ বেশ একটা বড় দরের কনটাক্টর কন্ট্রাক্টর ভাব আসে। ভিতরে ভিতরে ব্যাপারটা উপভোগ করে সে। কথা খুব কম বলে। বেশির ভাগই হুঁ হাঁ না ইত্যাদি। আর কোনও মাটিয়ালের তো নাইই, হেকমতের মুখের দিকে পর্যন্ত তাকায় না। আকাশের দিকে তাকিয়ে, গ্রামের গাছপালা বাড়িঘরের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। যেন এই সবই তার দেখার ব্যাপার, মাটিয়ালরা না, সড়কের কাজ না। তারপরই ছাপড়া ঘরটায় গিয়ে ঢোকে। ঢুকে ল্যাড়ল্যাড়া বালিশ দুইখান মাথার নিচে দিয়ে চকিতে গা এলিয়ে দেয়।

আজ সাইটে এসেছে আলী আমজাদ দুপুরের ভাত খেয়ে। এসেই দেখে ছাপড়া ঘরের সামনে খয়েরি চাদর পরা একটা লোক বসে আছে। ভাঙাচোরা মুখখানা দাঁড়িমোচে একাকার। দাঁড়িমোচ যেমন কাঁচাপাকা মাথার চুলও তেমন। বুড়া না, মাঝ বয়সী। তবে শরীরের ওপর দিয়ে যে ম্যালা ধকল অনাহার গেছে, যে কেউ দেখে বুঝে যাবে।

লোকটাকে দেখে হেকমতকে আলী আমজাদ জিজ্ঞাসা করেছে, এইডা কে?

হেকমত লগে লগে বলেছে, কেঐ না।

কী চায়?

কাম।

শইল্লের দশা তো ভাল না। মাইট্টালগিরি করতে পারবো?

কয় তো পারবো।

তাইলে লাগায় দেও।

হেকমত বিনীত গলায় বলল, আপনের লেইগা লাগাই নাই। বহায় থুইছি। কইছি সাবে আহুক। তার লগে কথা কইয়া লই।

আলী আমজাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কামের নিয়ম কানন (কানুন), রোজ কত, এই হগল কইছো?

না।

ক্যা?

আপনের লেইগা। এহেনকার সরদার অওনের পর কোনও নতুন মাইট্টাল কামে লই নাই। আপনের পারমিশন ছাড়া লই কেমতে! এই যে অহন আপনে কইলেন, দেহেন অহন আমি কথা ফাইনাল কইরা হালাইতাছি। কাইল বিয়ান থিকাঐ কামে লাগাইয়া দিমু।

কী ভেবে আলী আমজাদ বলল, থাউক তোমার কথা কওনের কাম নাই। বইয়া থাউক, আমিঐ কথা কমুনে। হাদাইয়া (ক্লান্ত হওয়া) গেছি। ইট্টু জিরাইয়া লই। তয় কথা কওনের সমায় তুমি সামনে থাইক্কো। নতুন মাইট্টাল কামে লওনের সমায় কী কী কথা তাগো লগে কইতে অয় হিগগা যাইবা। তারবাদে আমারে আর লাগবে না, তুমি নিজেই কথা কইয়া বেবাক ঠিক করতে পারবা। তয় মাইট্টাল কইলাম আমার আরও লাগবো। কাম তাড়াতাড়ি শেষ করন লাগবো। এরশাদ সাবে অডার দিছে দুই তিনমাসের মইদ্যে রাস্তার কাম শেষ করন লাগবো। দুই তিনমাসের মইদ্যে এই রাস্তা দিয়া বাস টেরাক চলবো।

তারপর প্রায় সন্ধ্যা হতে চলল, লোকটা বসেই আছে, তার লগে কথা বলা তো দূরের কথা তাকিয়েও দেখছে না আলী আমজাদ। দুপুরের পর পরই ঘণ্টা দেড়েকের একটা ঘুম দিয়েছে। সে যখন ঘুমে তখন আতাহাররা চারজন এসেছে, এসে ডেকে তুলেছে। কত ঘুমান মিয়া? বিয়াল অইয়া গেল। এই দিনে দোফরে ঘুমাইলে শইল ম্যাজ ম্যাজ করে। ওডেন।

উঠেছে আলী আমজাদ। উঠে অল্প বয়সী মাটিয়াল বদরকে মাওয়ার বাজারে পাঠিয়েছে পাউরুটি কলা আনতে। সিলবরের (এলুমিনিয়ামের) একটা কেতলি আছে ঘরে, সেই কেতলি দিয়েছে চা আনতে। পাউরুটি কলা খাওয়া শেষ। এখন মরাপাতা জ্বেলে তার উপর কেতলি বসিয়ে চা গরম করতাছে বদর। কোনাকানি ভাঙ্গা তিন চারটা কাপ আছে। গরম চা সেই কাপে করে আতাহারদের নিয়ে এখনই খাবে আলী আমজাদ, তার আগে দাঁতটা খিলাল করে নিচ্ছে। পাউরুটি কলা দুইটাই ভেজাইল্লা জিনিস। খেতে আরাম কিন্তু ফাঁকআলা পোকে খাওয়া দাঁত থাকলে সেই দাঁতের গর্তে এমন করে ঢোকে, খিলাল না করলে বের হতে চায় না। সেই কাজটাই আলী আমজাদ এখন করতাছে। এক পায়ের ওপর আরেক পা ভাজ করে বসেছে চকির উপর, দুয়ারটা মুখ বরাবর, ফলে সামনে বসা লোকটাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। তবে দেখছে না। ঘরে বসেই দেখছে নীল রঙের আলোকিত আকাশ, দূরের ছায়া ছায়া গাছপালা, বাড়িঘর।

এইসময় কাপে করে চা নিয়ে এল বদর।

কাপ হাতে নিয়ে আলী আমজাদ বলল, আতাহরগো দে।

বদর হাসিমাখা গলায় বলল, দিতাছি। কাপ তো চারইখান। এক লগে চা দিলে একজন বাদ থাকবো।

সে তাইলে আমারে পরে দে।

আতাহার বলল, না না আপনে খান। নিখিলা পরে খাইবো নে।

আলী আমজাদ কথা বলল না। ঠোঁটে সরু একখানা হাসি ফুঠে উঠল তার।

নিজেদের দলের মানুষ হওয়ার পরও, ছেলেবেলা থেকে একলগে বড় হওয়ার পরও, গভীর বন্ধুত্ব থাকার পরও আতাহাররা তিনজন নিখিলকে একটু অবজ্ঞা করে। লগে রাখে ঠিকই, সঠিক মর্যাদাটা দেয় না। কখনও কখনও চাকর বাকরের মতো খাটায়। হিন্দু বলে এই অবজ্ঞাটা যে নিখিলকে ওরা করতাছে পরিচয়ের পর পরই আলী আমজাদ তা বুঝে গেছে। তবে মুখে কখনও এই সব নিয়া কথা বলে নাই। নিখিলকে খেয়াল করে দেখেছে আতাহারদের অবজ্ঞা টের পায় সে। মুখটা বিষণ্ণ হয়ে যায়।

এখনও হল। সামান্য আনমনা দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল নিখিল।

আড়চোখে নিখিলকে একবার দেখল আলী আমজাদ। চায়ে চুমুক দেওয়ার আগে। বুক পকেট থেকে সিগ্রেটের প্যাকেট বের করে নিজে প্রথমে ধরাল তারপর প্যাকেটটা ফেলে রাখল সামনে, ইচ্ছা হলে যে কেউ যেন ধরাতে পারে। কিন্তু নিখিল ছাড়া কেউ সিগ্রেট ধরাল না।

নিখিলের সিগ্রেট ধরান দেখে আলী আমজাদ বুঝে গেল মুখের বিষণ্ণতা কাটাবার জন্য সিগ্রেটটা এখন ধরিয়েছে সে। না হলে বন্ধুদের মতো চা খাওয়ার পরই ধরাত।

চায়ে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে ঠোঁটে সরু হাসিটা আরেকবার ফুটল আলী আমজাদের। নিখিলকে উদ্দেশ্য করে মনে মনে সে বলল, মালাউন আইছস ক্যা বেডা? মোসলমান অইতে পারলি না? এইডা মোসলমানগো দ্যাশ। অহনতরি (এখন পর্যন্ত) যে তগো থাকতে দিছি এইডাঐত্তো বেশি। আবার যদি একখান রায়ট লাগে, যেই কয়জন মালাউন অহনতরি এই দ্যাশে আছে বেবাকটির গলা কাইট্টা হালামু। মাইয়াডিরে করুম গণধর্ষণ আর পুরুষডিরে কচু কাডা। মালাউনের জাত ফিনিশ। এই দ্যাশ মোসলমানগো দ্যাশ, এই দ্যাশে কোনও মালাউন রাখুম না। আমার লাহান ম্যালা মোসলমান আছে যারা হিন্দুগো দুই চোক্ষে দেকতে পারে না। উপরে উপরে খাতির দেহায় ঠিকঐ ভিতরে ভিতরে হিন্দুগো উপরে মহাখাপ্পা (ক্ষেপে থাকা)। চানস পাইলেঐ ফিনিশ কইরা দিব।

আলী আমজাদ অনেকক্ষণ চুপচাপ আছে দেখে আতাহার বলল, কী চিন্তা করেন কনটেকদার সাব?

চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে সামনে কেতলি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা বদরের হাতে কাপটা দিল আলী আমজাদ। নিখিলরে চা দে।

নিখিল বলল, আমি চা খামু না দাদা।

আলী আমজাদ কথা বলবার আগেই সুরুজ বলল, ক্যা?

এমতেঐ। সিগরেট ধরাই হালাইছি। অহন আর চা খাইতে ইচ্ছা করতাছে না।

আলমগির ছেলেটা ফুর্তিবাজ ধরনের। সারাক্ষণই গভীর আনন্দে আছে। তার কোনও দুঃখ বেদনা নাই। এই দলের মধ্যে দেখতে সবচেয়ে সুন্দর। গায়ের রঙ পাকা গয়ার (পেয়ারা) মতো। খাড়া নাক, টানা চোখ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল। সুন্দর গলা গানের। একটা শিল্পী শিল্পী ভাব আছে। কাজির পাগলা হাইস্কুলে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছে।

নিখিল চা খাচ্ছে না দেখে সে বলল, খা বেডা। সিগরেডের লগে চা বহুত মজা।

নিখিল তবু চা নিল না।

আলী আমজাদ বলল, আরে খাও মিয়া। কীর লেইগা খাইতে চাইতাছো না বুঝি তো!

আতাহার তীক্ষ্ণচোখে আলী আমজাদের দিকে তাকাল। কীর লেইগা কন তো!

ঐযে তুমি কইলা নিখিলা পরে খাইবো।

কইছি কী অইছে? সব সময়ঐত্তো কই!

না তেমন কিছু অয় নাই। নিখিল মনে করতাছে ও হিন্দু দেইক্কা অরে তুমি সব সময় পিছে রাখো। আলমগির সুরুজ অগো লাহান দাম দেও না।

একথা শুনে হা হা করে উঠল নিখিল। ধুর দাদা কী কন? এই হগল ফালতু কথা আমি ভাবি না। অরা আমার ছোডকালের দোস্ত।

ভাবো ভাবো। আতাহার না বোজলে কী অইবো? আমি বুজি।

সুরুজ একটু থলথলা শরীরের। দেহে কথায় বোকা বোকা একটা ভাব আছে। আলী আমজাদের কথা শুনে সরল গলায় বলল, আতাহার বোজবো না এমুন জিনিস দুইন্নাইতে নাই। পলেটিকস করা পোলা। সিরাজ সিকদার পারটি করতো। বহুত রক্ষিবাহিনী মারছে।

আতাহার সম্পর্কে এই কথাটা একেবারেই নতুন শুনল আলী আমজাদ। অবাক হয়ে আতাহারের দিকে তাকাল। মুখটা দুইকান পর্যন্ত ছড়িয়ে হাসল। নিকি (তাই নাকি অর্থে)? ভাইয়ে তাইলে পলটিনেসিয়ান (পলিটিসিয়ান)? বা বা বা। জানতাম না তো!

আতাহার লাজুক গলায় বলল, আরে ধুর। কবে ছাইড়া দিছি ঐসব। তয় আমি যহন সর্বহারা পারটি করতাম তহন বিক্রমপুরে আমার বস্বের (বয়সের) ম্যালা পোলাপান ঐ পারটি করতো। শেক মজিবের মাথা আমরা খারাপ কইরা হালাইছিলাম। হাজার হাজার রক্ষিবাহিনী দিছিল বিক্রমপুরে। অরা তো আর আমগো ধরতে পারতো না, ধরতো দেশ গেরামের নিরীহ মানুষটিরে। ম্যালা অইত্যাচার রক্ষিবাহিনী বিক্রমপুরে করতাছে। তয় আমরাও ছাড়ি নাই। রক্ষিবাহিনী মাইরা বাজারের বটগাছের লগে উপরের দিকে ঠ্যাং দিয়া ঝুলাইয়া রাকছি। আপনেরা যাঐ কন, শেক মজিবররে আমি দেকতে পারি না। তার একটা হিন্দু হিন্দু ভাব আছিলো।

আলমগির সাধারণত রাগে না। রাগলে মুখ লাল হয়ে যায়, আর যার ওপর রাগে প্রথমে বেশ খানিকক্ষণ কটোমটো চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর রাগ ঝারে। আতাহারের কথা শুনে বেদম রাগল সে। মুখ লাল করে কটোমটো চোখে মাত্র আতাহারের দিকে তাকিয়েছে, আতাহার বলল, চক্কু গোরাচ (রাঙান) ক্যা বেডা? শেক মজিবের নামে মিছাকথা কইছিনি?

 আতাহারের কথা শেষ হওয়ার লগে লগে বেশ জোরে তাকে একটা ধমক দিল আলমগির। নাম ঠিক মতন ক ব্যাডা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হিন্দু হিন্দু ভাব আছিল তার, না? বেবাক ভুইল্লা গেছ? স্বাধীনতা যুইদ্ধের সময় মেলেটারিগো ঠেলা খাইয়া যহন ইণ্ডিয়ায় গেছেলা তহন এই হিন্দুরাই তোমগো জাগা দিছে। খাওয়াইয়া বাঁচাইছে। ইণ্ডিয়ার মোসলমানরা তোমগো জাগা দেয় নাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হউক ইণ্ডিয়ান মোসলমানরা ওইডা চায় সাই। অরা চাইছে এইডা পূর্ব পাকিস্তান আছে পূর্ব পাকিস্তানই থাকুক। আর যেই মুক্তিযুইদ্ধ অইছে, মুক্তিযোদ্ধাগো টেরনিং অইছে কই রে বেডা? ইণ্ডিয়ায় অয় নাই? ইণ্ডিয়ান আর্মি হেলপ না করলে খালি আমগো মুক্তিযোদ্ধারা মাত্র নয় মাসে দেশ স্বাধীন করতে পারতো? বহুত সময় লাগতো স্বাধীন অইতে। আর বঙ্গবন্ধুর কাছে তো তগো লাহান মাইনষেরঐ বেশি রিনি (ঋণী) থাকনের কথা।

কথাটা বুঝতে পারল না আতাহার। বলল, ক্যা?

বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা না করলে তর বাপে বাইচ্চা থাকে না। রাজাকাররা বাইচ্চা থাকে না। মুক্তিযোদ্ধারা বেবাকটিরে ঢওয়াইয়া (ধ্বংস করা অর্থে) হালাইতো।

আলমগিরের কথা শুনে হাসল আতাহার। ওই অর্থে ধরলে তো জিয়াউর রহমানের কাছেও রিনি আমরা। বঙ্গবন্ধু রাজাকারগো বাঁচাইয়া দিছে, জিয়াউর রহমান রাজনীতি করবার পারমিশন দিছে। আর এরশাদ আইয়া রাজাকারগো খালি মিনিস্টার বানাইছে, খালি মিনিস্টার বানাইছে।

সুরুজ মুখ বিকৃত করে বলল, এই হগল প্যাচাইল বাদ দে তো। আমার ভাল্লাগে না। পলেটিসক বহুত খারাপ জিনিস।

আলী আমজাদ তাকিয়েছিল আলমগিরের দিকে। সুরুজের কথা শেষ হওয়ার পর বলল, ভাইয়ে মনে অয় আওয়ামী লীগ করে!

আলমগির লাজুক হাসল। আরে না মিয়া, আমি কোনও লীগঐ করি না। তয় বঙ্গবন্ধুর খুব ভক্ত আমি। বঙ্গবন্ধুর নামে কেঐ কোনও খারাপ কথা কইলে সইজ্জ করতে পারি না। মিজাজ খারাপ অইয়া যায়।

আতাহার বলল, ও আসলে আওয়ামী লীগঐ করে। ইলেকশনের টাইমে দেকবেন আওয়ামী লীগের লাইগা কেমুন ফালান ফালায় (লাফানো অর্থে)। আলইম্মারে তহন হারিকেন দিয়া বিচড়াইয়াও (খুঁজে) পাইবেন না।

আর তুমি যে ফালাইবা বিএনপির লেইগা!

আমি বিএনপি সাপোট করি এইডা বেবাকতে জানে। বিএনপির লেইগা তো ফালামু। সাপোটাররা না ফালাইলে কারা ফালাইবো!

আলী আমজাদ বলল, এরশাদ সাবের তো তাইলে খুব খারাপ দশা দেকতাছি। এহেনে আওয়ামী লীগ আছে, বিএনপি আছে, জাতীয় পারটি তো দেকতাছি না! জাতীয় পারটি অহন ক্ষমতায়। বিক্রমপুরের দুই বাঘা নেতা আছে জাতীয় পারটিতে। কোরবান আলী, শাহ মোয়াজ্জেম। আর তোমগো মইদ্যে কোনও জাতীয় পারটি নাই।

সুরুজ কেলানো একখানা হাসি দিয়ে বলল, কে কইলো নাই? আমি আছি। আমি জাতীয় পারটি। এরশাদ সাব জিন্দাবাদ!

সাব্বাস। তাইলে নিখিল কী?

আতাহার বলল, হিন্দু তো, সিউর আওয়ামী লীগ।

বাদ রইল খালি জামাতটা। ঠিক আছে আমি জামাত অইয়া যামুনে। তাইলে এই ঘরে যহন আমরা পাঁচজন একলগে বহুম ঘরডা ছোট্ট একখান বাংলাদেশ অইয়া যাইবো।

জামাত করতে অইলে আমার বাপের লগে দুস্তি করেন। ঐ লাইনের লোক।

আলী আমজাদ চিন্তিত গলায় বলল, এই এলাকায় আর কে কে রাজাকার আছিলো?

সুরুজ এবার বেশ বিরক্ত হল। আরে এই প্যাচাইলডা বাদ দিতাছেন না ক্যা? কইলাম যে ভাল্লাগে না।

আইচ্ছা বাদ দিলাম। অহন অন্যকথা কই।

আলমগির চোখ সরু করে আলী আমজাদের দিকে তাকাল। আপনে কইলাম মহা ত্যান্দর মানুষ ভাই। শইল মোডা অইলে কী অইবো, বুদ্ধি বহুত চিকন আপনের। আমি আপনেরে বুইজ্জা হালাইছি। নিখিলারে পরে চা দেওনের কথা থিকা আপনে বাইর করলেন ও হিন্দু দেইখা অরে আমরা আমগো লাহান দাম দেই না। ছোড কইরা রাখি। এইডা কইলাম আমগো মাথায় আছিলো না। আমরা কোনওদিন এই লাইনে চিন্তা করি নাই। আইজ থিকা দুস্তির মইদ্যেও হিন্দু মুসলমানের প্যাঁচখান আপনে লাগাইয়া দিলেন। এই ফাঁকে আমরা কে কেমুন হেইডাও ইট্টু বাজাইয়া দেকলেন। বহুত চালাক মানুষ ভাই আপনে। তয় সোজা একখান কথা আপনেরে আমি কইয়া রাখি, আমরা কেঐ আওয়ামী লীগ সাপোট করি কেঐ বিএনপি নাইলে জাতীয় পারটি কিন্তু দোস্ত যে এইডা ভুইলা যাওন ঠিক অইবো না। একজনরে খোঁচা দিয়া দেহেন বেবাকতে মিল্লা আপনেরে খাইয়া হালাইবো।

তারপর মুচকি হেসে আলমগির বলল, আপনে তো জামাতী। জামাতীরা বেবাকতেরঐ শত্রু।

আলী আমজাদ মনে মনে বলল, দেহা যাইবনে। টাইম আহুক। দুস্তি কেমতে ভাইঙ্গা দিতে অয় হেইডা আমি জানি। মুখে বলল, এই হগল প্যাচাইল বাদ। অন্য প্যাচাইল পাড়ি। এই দিকে ‘ইউ টু’ পাওয়া যায় না?

শব্দটা জীবনে শোনেনি আতাহাররা। চারজন একলগে আলী আমজাদের মুখের দিকে তাকাল।

নিখিল বলল, ইউ টু কী?

ইউ টু অইলো ‘উধাবা ঠুল্লি’।

আতাহার বলল, অর্থ কী?

আলী আমজাদ হাসল। তারপর সিগ্রেট ধরিয়ে মুখভর্তি করে ধুমা ছাড়ল। উধাবা ঠুল্লি কথাটার অর্থ কইতে পারুম না, জিনিসটা কী হেইডা বুজাইয়া দিতাছি। পাকিস্তান আমলে ঢাকার নিউ মার্কেটে থান কাপোড়ের দোকানের কর্মচারি আছিলাম আমি। ঐ টাইমে নিউ মার্কেটে এক ধরনের মাইয়াছেইলা ঘুইরা বেড়াইতো। হাতে ভ্যানেটি ব্যাগ, চোক্কে কালো গগস (গগলস)। পরনে রঙচঙা শাড়ি। কিছু কিনতো না খালি ঘুইরা বেডাইতে। তারবাদে যার তার লগে রিকশায় উইট্টা যাইতো গা। পয়লা পরথম ঘটনা কী বোঝতে পারতাম না। পরে অন্য কর্মচারিরা বুজাইয়া দিল। অগো নাম উধাবা ঠুল্লি। এই নাম কে দিছে, ক্যা দিছে জানতাম না। সংক্ষেপে আমরা বানাইয়া লইছিলাম ইউ টু। পরে কত ইউ টু নিজেগো মেসে লইয়াইছি আমরা!

আতাহার হেসে বলল, বুজছি।

তারপর সামনে ফেলে রাখা সিগ্রেটের প্যাকেট থেকে সিগ্রেট ধরাল। আতাহারের দেখাদেখি প্রত্যেকেই সিগ্রেট ধরাল।

বাইরে খয়েরি চাদর পরা লোকটা তখনও একই ভঙ্গিতে বসে আছে। একবার লোকটার দিকে তাকাল আতাহার। বলল, আমগো এইদিকে ঐসব জিনিস নাই। চউরাণী মউরাণী দুই একখান পাওয়া যায়। জিনিস ভাল না।

আলী আমজাদ কিছু একটা বলতে যাবে, কী ভেবে বাইরে তাকিয়েছে, দূরে সড়কের পশ্চিমপাড় থেকে সড়কে উঠতে দেখল একজোড়া ছেলেমেয়েকে। মেয়েটা ভাঙন থেকে আগে উঠল, উঠে ছেলেটাকে হাত ধরে টেনে তুলল। এতদূর থেকেও আলী আমজাদ বুঝতে পারল দুইজনেই পাখির মতো ছটছট করতাছে।

খানিক তাকিয়ে থেকেই মেয়েটাকে সে চিনতে পারল। নূরজাহান।

কিন্তু ছেলেটি কে আগে কখনও দেখেনি তো!

আলী আমজাদ আর আশপাশে তাকাল না, নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে রইল। সন্ধ্যার মুখে মুখে এই এতটা দূর থেকেও অপূর্ব লাগছে মেয়েটাকে।

আলমগির বলল, কী দেকতাছেন কনটেকদার সাব?

আলী আমজাদ আগের মতোই নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে বলল, কিছু দেহি না। চিন্তা করতাছি।

কী চিন্তা করেন?

টেকা পয়সা অইছে অহন আরেকখান বিয়া করন দরকার। একটা বউ দিয়া চলে না। ধ্যারধ্যারা অইয়া গেছে। লগে হুইয়া থাকলে মনে অয় ভিজা কেথার (কাঁথার) লগে হুইয়া রইছি।

আলী আমজাদের কথা শুনে আতাহাররা চারজনই হেসে উঠল।

হাঁটতে হাঁটতে নূরজাহান আর সেই ছেলেটা তখন আলী আমজাদের ঘর বরাবর সড়কে এসে দাঁড়িয়েছে। কী কথায় নূরজাহান শিশুর মতো দুলে দুলে হাসছে। আলী আমজাদ মুগ্ধ হয়ে নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে রইল।

সুরুজ ঠাট্টার গলায় বলল, মনে যহন চাইছে, বিয়া তাইলে আর একখান কইরা হালান। অসুবিদা নাই। মোসলমানরা চাইরখান বিয়া করতে পারে।

আতাহার বলল, কারে করবেন চিন্তা করছেন?

আলী আমজাদ আঙুল তুলে নূরজাহানকে দেখাল। ঐ অরে।

আতাহাররা সড়কের দিকে তাকাল।

আলমগির ভুরু কুঁচকে বলল, নূরজাহানরে! কন কী? ও তো আপনের মাইয়ার লাহান।

আলী আমজাদ নিঃশব্দে হাসল। দুই নম্বর বউ মাইয়ার লাহান অওনঐ ভাল।

তারপর চিন্তিত গলায় বলল, নূরজাহানের লগে ছেমড়াডা কে?

নিখিল বলল, হালদার বাড়ির মজনু। ঢাকায় থাকে। খলিফাগিরি হিগতাছে।

আলী আমজাদ তারপর চকি থেকে নামল। তোমরা বহ, আমি ইট্টু ঘুইরাহি।

.

১.২০

বন্ধ ছাতি হাতে সড়কের মুখে দাঁড়িয়ে আছে হেকমত। শখানেক মাটিয়ালের কেউ কোদাল দিয়ে মাটি কেটে কোদালের আগায় তুলে কায়দা করে ভরে দিচ্ছে মোড়ায়। তারপর হুমহাম শব্দে সেই মোড়া তুলে দিচ্ছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা, লুঙ্গি কাছা মারা, মাজা বরাবর শক্ত গিটটু (গিট) দিয়ে বান্ধা গামছা, মাথায় নাড়ার তৈরি বিড়া, বিড়াখানার দুই দিকে আছে সরু শক্ত দড়ি, সেই দড়ি দুই কানের পাশ দিয়ে বান্ধা যাতে হাঁটাচলা করার সময়, মাটি ভর্তি যোড়া মাথায় তোলার সময় বিড়াখান সরে না যায়, পড়ে না। যায়, এমন মাটিয়ালের মাথায়। কেউ কেউ মাটি ভর্তি যোড়া মাথায় সড়কের নামা থেকে উঠছে উপরে, জায়গা মতো গোড়া উপুড় করে মাটি ফেলছে কেউ, কেউ খালি মোড়া নিয়ে নেমে আসছে নামার দিকে। সব মিলিয়ে এলাহি কারবার। হেকমতকে রাখা হয়েছে এই সবের তদারক করতে। কিন্তু আলী আমজাদ যতক্ষণ এখানে এসে থাকে ততক্ষণ হেকমত কিছুতেই কাজে মন দিতে পারে না। মিলেমিশে দাঁড়িয়ে থাকে মাটিয়ালদের মাঝখানে, নজর থাকে ছাপড়া ঘরটার দিকে। কখন আলী আমজাদ বের হবে, কখন ছাতি খোলার সুযোগ পাবে সে।

এখনও তেমন একটা ভাবের মধ্যেই ছিল হেকমত। মাটিয়ালদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থেকেও তাদের কাজকর্ম কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। চঞ্চল চোখে বার বার তাকাচ্ছিল ছাপড়া ঘরটার দিকে। ফলে আলী আমজাদকে বের হতে দেখে ব্যাকুল হয়ে গেল সে, ফটাস করে ছাতি মেলল, দিশাহারা ভঙ্গিতে ছুটে এল আলী আমজাদের সামনে। দুই হাতে অতিশয় বিনয়ে খোলা ছাতি ধরল তার মাথার উপর।

এখন প্রায় সন্ধ্যা। পশ্চিমে, বহুদূরের গ্রামপ্রান্তে সিন্দুইরা (সিঁদুরে) আমের মতো বোঁটা আলগা হতে শুরু করেছে সূর্যখানার। যে কোনও সময় টুপ করে বসে যাবে। তার আগে কোন ফাঁকে যেন বাড়ির আঙিনায় শুকাতে দেওয়া শাড়ি যেমন তুলে নেয় গিরস্থ। বউ তেমন করে তুলে নিয়েছে দিনভর ফেলে রাখা রোদ। ছায়া ছায়া মায়াবি একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে চারদিকে। উত্তরের হাওয়া আরও জোরে বইছে। বেপারি বাড়ির আথালে (গোহালে) হাম্বা স্বরে ডাকছে একটা আবাল (তরুণ ষাড়)। সারাদিন ইচ্ছা স্বাধীন চড়েছে চকেমাঠে। এখন বাড়ি ফিরে আথালের পরাধীনতা মানতে চাইছে না। পদ্মার নির্জন চরে শস্যদানা খুঁটতে গিয়েছিল যেসব পাখি এখন তাদের ফিরার পালা। মাথার অনেক উপর দিয়ে সাং সাং শব্দে উড়ে যাচ্ছে সেই সব দিনশেষের পাখি। ঠাকুর চদরি বাড়ির দেবদারু তেঁতুলের অন্ধকার থেকে, বাঁশঝাড়ের ডগা থেকে পা খসাতে শুরু করেছে বাদুড়েরা। আকাশ কালো করে এখনই ওড়াউড়ি শুরু করবে তারা। আর এসময় কী না রোদ আড়াল করবার জন্য একজন মানুষ ছাতি মেলে ধরেছে আরেকজনের মাথায়!

দৃশ্যটা দেখে খিলখিল করে হাসতে লাগল নূরজাহান।

নূরজাহানের পাশাপাশি ধীর পায়ে হাঁটছে মজনু। সড়কে এসে ওঠার পর থেকেই সে কেমন আনমনা। কোনও কারণ নাই তবু মন উদাস উদাস লাগছে। এই এক অদ্ভুত জিনিস মানুষের দেহে ঢুকিয়ে দিয়েছেন আল্লাহপাক, মন। কখন খারাপ হবে তা, কখন ভাল, কখন না ভাল না খারাপ, কখন উদাস বিষণ্ণ অনেক সময়ই মানুষ তা বুঝতে পারে না। এখন যেমন পারছে না মজনু।

নূরজাহানের বাবার কথায় নিজের বাবার কথা মনে পড়েছিল বলেই কী মন এমন খারাপ হয়েছে তার!

কে জানে!

নূরজাহানকে হাসতে দেখে তার মুখের দিকে তাকাল মজনু। কী অইছে রে? এমতে হাসছ ক্যা?

নূরজাহানের স্বভাব হচ্ছে তার হাসির সময় সেই বিষয় নিয়ে কেউ কথা বললে হাসি আরও বেড়ে যায়। এত জোরে হাসতে শুরু করে সে, হাসির চোটে চোখে পানি আসে।

এখনও তেমন হল। হাসতে হাসতে চোখ পানিতে ভরে গেল। হাসির চোটে ফেটে যেতে যেতে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছল।

মজনু আবার বলল, কী অইছে? হাসতে হাসতে মইরা যাইতাছস দিহি!

হাসির চোটে তখনও কথা বলতে পারছে না নূরজাহান। আঙুল তুলে ছাপড়া ঘরের ওদিকটা দেখাল। মজনু তাকাল ঠিকই কিছুই বুঝতে পারল না। বিরক্ত হয়ে বলল, ওই মিহি কী দেহাচ? ওহেনে হাসনের কী দেকলি?

খয়েরি চাদর পরা লোকটা তখনও একই ভঙ্গিতে বসে আছে আগের জায়গায়। মজনু ভাবল ওই লোকটাকে দেখে বুঝি হাসছে নূরজাহান। এমন করে বসে থাকা একটা লোককে দেখে হাসার কী হল! যে ভঙ্গিতে বসে আছে, দেখেই বোঝা যায় অসহায় মানুষ। একে দেখে হাসি পাওয়ার কথা না, মায়া লাগার কথা।

নূরজাহানকে ধমক দেওয়ার জন্য তৈরি হল মজনু। ঠিক তখনই নূরজাহান বলল, আপনে অহনতরি বোজেন নাই আমি কীর লেইগা হাসতাছি।

মজনু গম্ভীর গলায় বলল, না।

কনটেকদারের মিহি চান।

মজনু আবার তাকাল, এবারও কিছু বুঝতে পারল না।

নূরজাহান বলল, অহনও বোঝেন নাই?

না।

ধুরো আপনে একখান বলদ (বোকা অর্থে), দেকতাছেন না কনটেকদারের মাথার উপরে ছাতি মেইল্লা (মেলে) ধরছে এক বেডায়।

হ দেকতাছি।

অহন কি রইদ আছে না ম্যাগ অইতাছে যে ছাতি লাগবো!

এবার ব্যাপারটা বুঝল মজনু। বুঝে হাসল। ও এর লেইগা হাসতাছস?

হাসুম না? এইডা তো হাসনেরঐ জিনিস।

আর আমি মনে করছি ঐ যে চাইদ্দর গায়দা (গায়ে দিয়ে) বইয়া রইছে ঐ বেডারে দেইক্কা হাসতাছস।

ভুরুর অদ্ভুত একটা ভঙ্গি করে মজনুর দিকে তাকাল নূরজাহান। ঐ বেডারে দেইক্কা হাসুম ক্যা? ঐ বেডা কি হাসনের জিনিস! দেকলে তো মায়া লাগে!

মজনু আনমনা গলায় বলল, হ।

লন ঐ ঘরডার সামনে যাই, ঐ বেডারে দেইক্কাহি আর হাজের সমায় ছাতি মাথায় দেওয়া কনটেকদাররে ইট্টু খোঁচাইয়াহি (খুঁচিয়ে আসি)।

মজনু গম্ভীর গলায় বলল, না।

নূরজাহানের উৎসাহে ভাটা পড়ল। ক্যা?

চিনাজানা নাই এমুন মাইনষের লগে খোঁচাখুচি করতে যাওন ঠিক না। কাইজ্জা কিত্তন লাইয়া যাইবো। এমতেঐ আউজকা মান্নান মাওলানারে চেতাইয়া দিছস। অহন আবার লাগাইতে চাইতাছস আরেক ভেজাল। আমি যামু না।

নূরজাহান হাসল। কনটেকদার সাবরে আমি চিনি। বহুত খাতির আমার লগে। হের লগে কত ফাইজলামি করি। হেয়ও করে। মুখের ভিতরে সোনায় বানদাইন্না দাঁত আছে হের। একদিন হাসতে দেইক্কা কইছিলাম আপনে যহন হাসেন মনে অয় ব্যাটারি লাগাইয়া হাসতাছেন।

বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল নূরজাহান। মুখের ভিতরে কেউ চান্দা ব্যাটারি লাগাইতে পারে, কন?

এবার মজনুও হাসল। ইস তুই যে কী মাইয়ারে!

লগে লগে নূরজাহান বলল, তয় অহন লন।

মজনু অবাক হল, কই?

কনটেকদারের ঘরের ওহেনে।

তারপর মজনুকে আর কথা বলবার সুযোগ না দিয়ে তার হাত ধরে হঠাৎ করেই নামার দিকে দৌড় দিল নূরজাহান। এমন আচমকা দৌড়, তাল সামলাতে না পেরে মজনুও দৌড় দিল। খাড়া ঢাল বেয়ে চলে এল ছাপড়াঘরটার সামনে। তবে তাল সামলাতে খুব একটা বেগ পেতে হল না। যেমন আচমকা মজনুর হাত ধরে দৌড় দিয়েছিল নূরজাহান ঠিক তেমন আচমকাই দৌড় থামিয়ে স্থির হল। কী করে যে পারল, কে জানে। বোধহয় এরকম দৌড়াদৌড়ির অভ্যাস তার অনেক দিনের। অভ্যাসে সব হয়।

নূরজাহানকে দেখবার জন্যই, নূরজাহানের সঙ্গে কথা বলবার জন্যই ছাপড়াঘর থেকে বেরিয়েছে আলী আমজাদ। বেরিয়ে বেকায়দায় পড়ে গেছে। সেই বেকায়দার নাম হেকমত। এমন ভঙ্গিতে আলী আমজাদের মাথার উপর ছাতি মেলে আছে, এমন উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে আলী আমজাদের মুখের দিকে একটা কথাও পড়তে দেবে না তার আগেই কথা মতো কাজটা করে ফেলবে। ট্যান্ডলরা যে বিরক্তির কারণও হয় এই প্রথম আলী আমজাদ তা বুঝতে পারল। বুঝেও তার এখন কিছু করার নাই। অকারণে গম্ভীর হয়ে থাকতে হল। আড়চোখে নূরজাহান এবং মজনুর দিকে একবার তাকিয়ে জবুথুবু হয়ে বসে থাকা লোকটার সামনে এসে দাঁড়াল। পেটের অনেক ভিতর থেকে শব্দ করে করে বলল, বাড়ি কবে?

প্রশ্নটা যে তাকে করা হয়েছে লোকটা প্রথমে বুঝতে পারল না। পেটের অনেক ভিতর থেকে শব্দ বের করেছে বলে আলী আমজাদের স্বর হয়ে গেছে জলদগম্ভীর। একে ওরকম শব্দ তার ওপর কোথায়কে বলছে কবে, আলী আমজাদের কায়দা কানুনের সঙ্গে যারা পরিচিত না, কথাবার্তার সঙ্গে যারা পরিচিত না তাদের পক্ষে এসব বোঝা মুশকিল। তবে কন্ট্রাক্টর সাহেবকে নিজের সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে লোকটা ভড়কে গেছে। চোখে মুখে বেশ একটা চাঞ্চল্য। দিশাহারা গলায় বলল, আমারে জিগাইলেন?

আলী আমজাদ কথা বলবার আগেই হেকমত বলল, তয় আবার কারে? এহেনে তুমি ছাড়া আর আছে কে?

লোকটা কাঁচুমাচু গলায় বলল, কথাডা বোজতে পারি নাই। কী জানি জিগাইলেন?

ঠিক আগের মতো করেই আলী আমজাদ বলল, বাড়ি কবে?

লগে লগে হেকমত বলল, বাড়ি কই?

জ্বে কামারগাও সাহেব।

হেকমত ধমকের গলায় বলল, কামারগাওর মানুষরা কি আদব লেহাজ (কায়দা) জানে না? সাবের সামনে যে বইয়া বইয়া কথা কইতাছো? উডো, উইট্টা খাড়ও।

লোকটা জড়সড় হয়ে উঠে দাঁড়াল। ভুল হইয়া গেছে সাব, মাফ কইরা দিয়েন।

লোকটার দিকে আর তাকাল না আলী আমজাদ তাকাল নূরজাহান এবং মজনুর দিকে। মুখে বেশ একটা প্রশান্তির ভাব। লোকটার ওপর হেকমতের হামতাম (হম্বিতম্বি) বেশ পছন্দ করেছে সে। ট্যাণ্ডলদের এরকমই হওয়া উচিত। সাহেবরা যা ভাববেই না। আগ বাড়িয়ে সেই ধরনের কিছু একটা করে সাহেবদের মন জিততে না পারলে সে আবার কিসের ট্যাণ্ডল! লোকটাকে আদব কায়দা শিখিয়ে ঠিক এই কাজই করেছে। হেকমত। তবে আলী আমজাদ যখন নূরজাহানের দিকে মন দিয়েছে, মাত্র কথা শুরু করবে, হেকমত বলল, সাব, কথাডা কন।

ভিতরে ভিতরে খুবই বিরক্ত হল আলী আমজাদ কিন্তু প্রকাশ করল না। নির্বিকার চোখে তাকাল হেকমতের দিকে। কোন কথা?

নতুন মাইট্টাল কামে লওনের কথা।

ও।

তারপর আবার লোকটার দিকে তাকাল। গম্ভীর গলায় বলল, মাইট্টাল অইবা?

জ্বে সাহেব। এর লেইগাঐ বইয়া রইছি।

য়োড়া আছে?

না।

তয়?

 য়োড়া যোগার কইরা লমুনে

কেমতে? য়োড়া আনতে আবার কামারগাও যাইবা?

না। এই গেরামে আততিয় (আত্মীয়) বাড়ি আছে। তাগো কাছ থিকা আনুম।

 থাকবা কই?

থাকনের বেবস্তা অইবনে। কইয়া বুইল্লা (বলে কয়ে) ঐ আততিয় বাইতঐ থাকতে পারুম। নাইলে ভিনদেশি মাইট্টাইলরা যেমতে থাকে, তাগো লগে থাকুম। ছাড়া বাইত্তে, ইসকুলে।

এবার আসল কথাটা বলল আলী আমজাদ। আমার কামের রোজ জানো?

না সাহেব, তয় অন্যরে যা দেন আমারেও তাই দিয়েন।

হেইডা দিমু না।

ক্যা?

আমার এহেনকার এহেক মাইট্টালের এহেক রকম রোজ। কেঐর পনচাইশ কেঐর চল্লিশ। সইত্তর আশিও আছে। মাইট্টাল বুইজ্জা রোজ। শইল বুইজ্জা রোজ। তোমার যা শইল, চল্লিশ টেকার বেশি পাইবা না। করলে কাইল বিয়ানে য়োড়া লইয়া আইয়ো। ফয়জরের আয়জানের লগে লগে কামে লাগবা, দুইফরে আধাঘণ্টা টিবিন (টিফিন) তারবাদে মাগরিবের আয়জান পইরযন্ত কাম। সপতায় একদিন টেকা পাইবা। শুক্কুরবার।

কথাগুলি বলে লোকটার দিকে আর তাকাল না আলী আমজাদ, তাকাল হেকমতের দিকে। কেমতে কথা কইলাম খ্যাল করছো?

হেকমত বিগলিত ভঙ্গিতে হাসল। করছি সাব। এরবাদে আমিই পারুম। আপনেরে আর লাগবো না।

লোকটা তখন কাতর চোখে তাকিয়ে আছে আলী আমজাদের দিকে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে যখন দেখল আলী আমজাদ আর তার দিকে তাকাচ্ছেই না বাধ্য হয়ে বলল, আমার একখান কথা আছিলো সাহেব।

তবু লোকটার দিকে তাকাল না আলী আমজাদ। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি কও। কাম আছে।

পয়লা সপতাডা রোজকার পয়সা রোজ দেওন লাগবো।

ক্যা?

আমার কাছে একখান পয়সাও নাই। রোজ না পাইলে খামু কী? তয় পয়লা সপতার পর আর কোনওদিন লাগবো না।

আলী আমজাদ হেকমতের দিকে তাকাল। হেকমত, কইয়া দেও, অইবো না, নিয়ম নাই।

তারপর বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথার ওপর মেলে ধরা ছাতি একহাত দিয়ে সরিয়ে দিল। অদূরে দাঁড়ান নূরজাহান খিলখিল করে হেসে উঠল। কয়েক পা হেঁটে আলী আমজাদ এসে নূরজাহানের সামনে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, হাসো ক্যা?

নূরজাহান হাসতে হাসতে বলল, আপনেরে ছাতি মাথায় দেইক্কা। রইদ নাই ম্যাগ নাই মাথায় ছাতি দিয়া আছেন ক্যা?

আমি দেই নাই। মাথার উপরে ছাতি ধরছে আমার ম্যানাজারে। অগো কামঐ এমুন। রইদ ম্যাগ বোজে না। মালিক দেখলেই তার মাথায় ছাতি মেইল্লা ধরে।

ঐ বেডায় আপনের ম্যানাজার?

হ। বড় কনটেকদার অইলে একজন ম্যানাজার লাগে। আমি অহন বড় কনটেকদার। ম্যানজার রাখছি।

মজনু দাঁড়িয়ে আছে নূরজাহানের পাশে কিন্তু আলী আমজাদ একবারও তাকাচ্ছে তার দিকে। নূরজাহানকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। চোখের দৃষ্টি ভাল না লোকটার। খানিক আলী আমজাদকে দেখেই বিরক্ত হয়ে গেল মজনু। সেই বিরক্তি কাটাবার জন্য নূরজাহানকে কিছু না বলে হেকমত আর চাদরপরা লোকটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে গিয়ে দাঁড়াল। হেকমত কী বলছে, লোকটা মন দিয়ে শুনছে। মজনু গিয়ে সামনে দাঁড়াবার পর হেকমতকে যেন ভুলে গেল সে, হেকমতকে যেন আর চিনতেই পারল না। ঘোরলাগা চোখে মজনুর দিকে তাকিয়ে রইল।

প্রথমে দুই একবার চোখ সরিয়ে নিল মজনু তারপর সেও কেমন তাকিয়ে রইল। চোখ সরাতে পারল না।

ওদিকে নূরজাহান তখন আলী আমজাদকে বলছে, অনেকক্ষণ ধইরা খাড়ইয়া রইছি ছাতির কথাডা আপনেরে কমু, এমুন প্যাচাইল আপনে ঐ বেডার লগে আরম্ব করলেন আর শেষঐ অয় না। কথাও কইতে পারি না যাইতেও পারি না।

নূরজাহানের কথা শুনে আলী আমজাদ যেন আকাশ থেকে পড়ল। কও কী? তুমি আমার লগে কথা কওনের লেইগা খাড়ইয়া রইছো? হায় হায় আমি তো বুঝি নাই। লও ঘরে লও। ঘরে বইয়া কথা কই। আমারও কথা আছে তোমার লগে।

ঘরে যে আতাহাররা বসে আছে সেই কথা যেন মনেই রইল না আলী আমজাদের, একদম ভুলে গেল।

কিন্তু আলী আমজাদের কথা পাত্তা দিল না নূরজাহান। বলল, ধুরো, ঐ ঘরে মানুষ যায়নি। রাইত অইয়াইলো। আমি অহন বাইত যামু।

 মজনুকে ডাকল নূরজাহান। ও মজনু দাদা, তাড়াতাড়ি আহেন। রাইত অইয়াইলো। বাইত্তে যামু না?

নূরজাহানের ডাকে চমক ভাঙল মজনুর। লোকটার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে দ্রুত নূরজাহানের দিকে পা বাড়াবে, লোকটা বলল, খাড়াও বাজান। তোমার নাম মজনু?

হ।

এই গেরামেঐ বাড়ি?

হ।

কোন বাড়ি?

 হালদার বাড়ি।

লোকটা আরও কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাবে তার আগেই নূরজাহান রাগি ভঙ্গিতে এসে হাত ধরল মজনুর। কানে বাতাস যায় না? কইলাম যে রাইত হইয়া যাইতাছে। লন।

মজনুর হাত ধরে টানতে টানতে তাকে নিয়ে সড়কে উঠল নূরজাহান। পিছন দিকে আর ফিরেও তাকাল না।

কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে মজনু বার বারই পেছন ফিরে তাকাচ্ছিল। লোকটাকে দেখছিল। সন্ধ্যার ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে দূর থেকে লোকটার চোখ দেখা যায় না, পরিষ্কার দেখা যায় না মুখ। তবে সে যে তখনও ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে আছে মজনুর দিকে এটা বোঝা যায়।

কে, লোকটা কে?

এই সড়কে যে মাটিয়ালের কাজ করতে এসেছে এটা আলী আমজাদ হেকমত এবং লোকটার কথা শুনে বুঝেছে মজনু। কিন্তু সে গিয়ে সামনে দাঁড়াবার পর সব ভুলে এমন করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কেন? চলে আসার সময় নাম ধামই বা জিজ্ঞাসা করল কেন? এখন এই যে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে মজনু এসময় কেন তার বার বার ফিরে তাকাতে ইচ্ছা করতাছে লোকটার দিকে।

মজনু মনে মনে বলল, আপনে কে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *