২.৭ গণির হাতে চায়ের কাপ

কী রে গণি তুই বলে আমার লগে দেহা করতে গেছিলি?

গণির হাতে চায়ের কাপ। খানিক আগে এক ডালা মুড়িমিঠাই খেয়েছে। মুড়িমিঠাই খেয়ে পানি খেলে পেট ফুলে কোমড় (কুমড়া) হয়। হাঁটাচলা করলে পেটের ভিতর ঘটমট ঘটমট শব্দ হয়। কিন্তু খানিক পরই মেলা দিতে হবে গণির। কাঁধে রেকসিনের ব্যাগ নিয়ে সোজা হেঁটে যাবে শ্রীনগর। সেখান থেকে স্পিডবোটে মোলোঘর হয়ে আলমপুর। আলমপুর থেকে লঞ্চে ফতুলা সদরঘাট। কিন্তু এই দুই জায়গার আগেই সৈয়দপুরে নেমে যাবে গণি। নেমে নৌকা করে নদী পার হয়ে ওপারে গিয়ে বাসে চড়বে। সেই বাস সোজা। যাবে জিঞ্জিরা। জিঞ্জিরা থেকে পার হতে হবে বুড়িগঙ্গা। ওপারে বাদামতলি ঘাট। সেখান থেকে রিকশা করে সোজা যাত্রাবাড়ি।

এই পথে হাঙ্গামা একটু বেশি। তবু একটানা তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টা লঞ্চে বসে থাকার একঘেয়েমি নাই। আধঘণ্টা-পৌনে একঘণ্টা কখনও কখনও তার চেয়েও কম সময়ে এটা বদলে ওটায় ওঠো, পা থেকে স্পিডবোট, তারপর লঞ্চ, তারপর নৌকা, তারপর বাস, তারপর আবার নৌকা, তারপর রিকশা, তারও পরে বাড়ি। অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলি যানে চড়া, অদল বদল করা, সবমিলে ভাল রকমের ব্যস্ততা। কোথা দিয়ে সময় কেটে যায় টের পাওয়া যায় না। একঘেয়েমি বলতে কিছু নাই।

তবে ধৈর্য ধরে তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টা লঞ্চে বসে থাকলে এত হাঙ্গামা করতে হয় না না। ফতুল্লায় নেমে নারায়ণগঞ্জ থেকে গুলিস্তান ফিরা বাসে চড়লে যাত্রাবাড়ির মোড়ে নেমে যাওয়া যায়। তারপর পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথে বাড়ি।

সদরঘাটে নামলেও অসুবিধা নাই। সদরঘাট থেকে রিকশায় যাত্রাবাড়ি। ভাড়াটা একটু বেশি পড়ে এই আর কী!

বয়স বাড়ার ধৈর্য যেখানে বেড়ে যায় মানুষের, গণির ক্ষেত্রে হয়েছে উলটা। কমে গেছে। ধৈর্য বলতে গেলে এখন নাইই। সারাক্ষণ অস্থিরতার মধ্যে আছে সে। ছটফটানির মধ্যে আছে। আগে হাঁটাচলায়, কথা বলায় ধীর শান্ত ভাব ছিল। সেটা এখন নাই। গণি এখন আর হাঁটে না, দৌড়ায়। গণি এখন কথা বলে হড়বড় হড়বড় করে। যেন পলকেই জীবনের সব কথা বলে শেষ করবে। কয়েক বছরের মধ্যে এই বদলটা হয়েছে তার। দুই ছেলে জাপানে গিয়া দেদারছে টাকা পাঠাতে শুরু করবার পর থেকে এইভাবে বদলে গেল গণি। এখন যে চা খাচ্ছে সেই খাওয়ায়ও কেমন এক তাড়াহুড়ার ভাব। অতিরিক্ত গরম চা মুখে দিয়া জিবটা একটু পুড়ছেও। মতিমাস্টারের বউ এই দৃশ্য দেখে বলেছে, গরম চা আস্তেসুস্থে খান দাদা। হরতরাইস্যার লাহান খাইয়েন না। মোক পোড়বো।

তারপরও ঠিক একই কায়দায় চায়ে চুমুক দিতে গেছে গণি তখনই মান্নান মাওলানা এসে দাঁড়িয়েছেন তার বড়ঘরের সামনে, ওই কথা বলেছেন। শুনে গণি লাফিয়ে উঠতে গিয়েছিল। হাতের চা চলকে পড়ার ভয়ে ঠিক লাফিয়ে না উঠলেও অনেকটাই ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। মুখে বিগলিত হাসি ফুটিয়ে বলল, হ দাদা, গেছিলাম।

মান্নান মাওলানার হাতে তসবি। অবিরাম তসবিদানা টিপে যাচ্ছেন আর মনে মনে দোয়া পড়ছেন। সেই অবস্থায় গণির লগেও কথা বলতে শুরু করলেন। কীর লেইগা?

আহেন, ঘরে আইয়া বহেন। তারবাদে কই।

না অহন আর বমু না। বেইল উইট্টা গেছে। বাজার মিহি যামু। রহি কইলো তুই আমার লগে দেহা করতে গেছিলি, আমি তহন নমাজ শেষ কইরা কোরান শরিফ লইয়া বইছি এর লেইগা বলে না দেহা কইরাঐ আইয়া পড়ছস।

হ দাদা।

ক্যা? কীর লেইগা গেছিলি?

কথার কাম আছে।

ক।

তারপরই মান্নান মাওলানার মনে হল হয়তো গোপন কথা হবে। বললেন, বেশি দরকারি কথা? এহেনে কওন যাইবো না?

গণি বলল, হ দরকারিঐ। তয় গোপন না। সবহানেঐ কওন যাইবো।

উঠানের পুবকোণে একখান আমগাছ। বউল আর গোটায় ভরে গেছে গাছ। সকালবেলার রোদ পড়েছে গাছে। বাতাসে ভাসছে বোলের ঝাঝালো গন্ধ। অজস্র মধুপোকা এসে জমেছে মধু নিতে। তাদের সূক্ষ্ম গুনগুনানিতে মুখর হয়ে আছে গাছ। এই গাছের পুবপাশে গণির বড়সড় রান্নাঘর। ঢেউটিনের দোচালা, চারপাশে বাঁশের বেড়া। ঘরটা রান্না আর চেঁকি দুই ঘরই। একপাশে মাটির দুইমুখী চুলা অন্যপাশে ঢেঁকি, চেঁকির লোট। ঢেঁকির একপাশ দিয়ে কারে ওঠার জন্য চার-পাঁচখান কাঠ গজাল দিয়ে খামের লগে গেঁথে মইয়ের মতো সিঁড়ি করা হয়েছে। কারে রাখা হয় সারা বছরের লাকড়িখড়ি, দুই-তিন হাঁড়ি মুড়ি ভাজার বালি, ঝাঁঝড়। কাহাইল ছিয়াও আছে চিড়া কোটার জন্য। পিঠা বানাবার জন্য চাউল গুড়া করবার কাজেও লাগে কাহাইল ছিয়া। অনেক সময় বেঁকিতেও কাজটা সারে কেউ কেউ। এই ঘরের সামনে, দরজার দক্ষিণপাশে আমগাছটার তলায় মাটিতে লেছড়ে পেছড়ে বসে আছে মতিমাস্টারের প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়ে হিরা-মানিক। হিরা মেয়ে, সে বড়। মোলো সতেরো বছর বয়েস হবে। মোটাসোটা নড়বড়ে শরীর, মুখটা গোলগাল, চোখ টানা টানা, গায়ের রং মতিমাস্টারের বউর মতোই ফরসা। নীল রঙের পাজামা আর ছিট কাপড়ের ফ্রক পরা হিরা হাঁটাচলা করতে পারে না, পরিষ্কার করে কথা বলতে পারে না। সারাক্ষণ মুখ দিয়ে ছেবড়ি উটছে। মানিকের অবস্থাও একই রকম। তয় অতিকষ্টে হাঁটাচলা সে করতে পারে। পা দুইখান বেঁকা, হাত দুইখান বেঁকা, মুখও স্বাভাবিক না। দুইজনেই কথা বলে হাউমাউ করে। হিরার স্বভাব হচ্ছে যে কাউকে দেখলেই মাটিতে লেছড়ে ছেড়ে তার পায়ের কাছে চলে আসে। গোঙানির মতো শব্দ করে হাসতে থাকে। আসলে মানুষ দেখে আমোদ পায়।

আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে এই দুই প্রতিবন্ধী ভাইবোনের একে অপরের জন্য অপরিসীম টান, অপরিসীম মায়া। কেউ কাউকে এক পলক না দেখে থাকতে পারে না। এক লগে খাওয়া ঘুমানো তাদের, এক লগে দিনরাত্রি কাটানো।

এখন এই সকালবেলা দুইজনেই তারা অসহায় ভঙ্গিতে জবুথবু হয়ে বসে আছে আমগাছটার তলায়। মান্নান মাওলানাকে দেখে হিরা তার স্বভাব অনুযায়ী লেছড়ে ছেড়ে পায়ের কাছে আসতে চাইছে, কিন্তু মানিক তাকে আসতে দিচ্ছে না। যতবারই আসার চেষ্টা করে ততবারই মানিক তার ফ্রক টেনে ধরে আর ঠিক ততবারই খলখল করে হেসে ওঠে হিরা। যেন খুবই মজার খেলা খেলছে দুই ভাইবোনে। অদূরে বাড়ির নেড়িকুত্তাটা খামোশ হয়ে বসে আছে।

মান্নান মাওলানাকে দেখেই মতিমাস্টারের বউ আছিয়া মাথায় ঘোমটা দিয়ে রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। চায়ের কাপ হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে গণি তাকে বলল, এক কাম করো, আগে দুইখান চের দেও উড়ানে। দাদায় আমি বহি, বইয়া বইয়া কথা কই। এই ফাঁকে দাদার লেইগা তুমি এককাপ চা বানাও।

মান্নান মাওলানা বললেন, নারে অহন আর চা খামু না। বিয়ানে খাইছি। বেশি চা খাই না।

তয় ঠিক আছে। আমি তাইলে দুই চুমুকে চা-ডা খাইয়া লই।

হুস হুস করে দুই-তিন চুমুকে কাপের পুরা চা শেষ করল গণি। আছিয়া চেয়ার এনে রেখেছে উঠানে। মান্নান মাওলানা বসেও পড়েছেন। বসার আগে গণি তার হাতের কাপ আছিয়ার হাতে দিল। নেও, ধুইয়া রাখো। দাদার লেইগা চা বানানের কাম নাই। হেয় খাইবো না।

মান্নান মাওলানার দিকে তাকাল গণি। সে কথা বলবার আগেই মান্নান মাওলানা বললেন, ওই গণি, তগো বাড়ির মানুষজন কো? বউ পোলাপান?

গণি হাসল। ঢাকা গেছে গা!

কবে?

সাত-আষ্ট দিন অইলো।

তর বাড়ির কাম শেষ অইছে?

হ। গত শুক্কুরবার বাইত্তে মলুদশরিপ (মিলাদ) পড়াইছি।

কচ কী?

হ।

এর লেইগাঐ তর বাইত্তে নতুন মানুষজন দেকতাছি?

হ দাদা। আমার এক দূর সম্পর্কের খালাতো ভাই অইলো মতি, মতিমাস্টার। ওই যে মতির বউ আছিয়া, আর ওই যে দুইখান লুলা আতুর পোলাপান, হিরা-মানিক। মতি গরিব মানুষ। মেট্রিক পাশ। আগে জশিলদা প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করতো। চাকরিডা অহন নাই। নিজের বাড়িঘরও নাই। এক সময় আছিলো। গ্রামের নাম উয়ারি। জাগাজমিন বাড়িঘর বেবাকঐ আছিলো। কিছু নিছে গাঙ্গে বাদবাকি গেছে পোলাপান দুইডার চিকিস্যায়। অহন পথের ফকির। এই গেরাম হেই গেরাম ঘুইরা ছাত্র পড়ায়। রোজগারপাতি খুব কম। পেরায় পেরায় আমার কাছে আহে সাহাইয্যের লেইগা। কইলাম, আমি তো আর দ্যাশ গেরামে থাকুম না, তরা আইয়া আমার বাইত্তে থাক। বাড়ি পইর দিবি আর থাকবি। দরকার অইলে টেকাপয়সা দিয়াও সাহাইয্য করুম। দুইদিন অইলো আইছে অরা।

আর এর লেইগাঐ তুই গেছিলি আমার লগে দেহা করতে?

গণি হাসল। হ দাদা। আমি আর মন্তাজ এই বাড়ির দুই শরিক অইলেও বাড়ির আসল মালিক অইলেন আপনে। আমগো সীমানায় যেঐ থাউক, তাগো কথা তো আপনেরে না কইয়া পারুম না। তাগো দেখাশুনা ভালমন্দ সবকিছু নির্ভর করবো আপনের উপরে। আপনের কথা মতন চলবো সবাই। আপনে যা কইবেন হেইডাঐ হোনবো। অর্থাৎ কিনা আপনে অইলেন মুরব্বি। ইংরেজিতে যারে বলে গার্জিয়ান। আগে আমি পরিবার লইয়া থাকতাম বাইত্তে, তহন আপনে আছিলেন আমার গার্জিয়ান, অহন অইবেন মতিমাস্টারের গার্জিয়ান, মতির বউ আর আতুড় লুলা পোলাপানের গার্জিয়ান।

গণির কথায় খুবই খুশি হলেন মান্নান মাওলানা। এতটা তোয়াজ আজকের আগে কখনও তাঁকে করেনি গণি। আজ কেন করছে তাও বুঝলেন। নিজে এখন থেকে বউ পোলাপান নিয়ে থাকবে ঢাকায় আর বাড়িতে থাকবে মতিমাস্টার আর তার বউ-পোলাপান, আগেভাগেই যদি মতির বউর সামনে মান্নান মাওলানাকে অতিরিক্ত তোয়াজ করে পটিয়ে ফেলা যায় তা হলে এই বাড়িতে তারা থাকবে রাজার হালে। মান্নান মাওলানা ঠিক তো পুরা বাড়ি ঠিক। কায়দাটা গণি ভালই ধরেছে।

এসব কথা তো আর গণির মুখের ওপর বলা যায় না! তোয়াজ শুনে খুশি হওয়ার ব্যাপারটাও চেপে থাকার নিয়ম। এসব দিক বিবেচনা করে অন্য লাইন ধরলেন মান্নান মাওলানা। আমগাছ তলায় জবুথবু হয়ে বসা মতি মাস্টারের অথর্ব ছেলেমেয়ে দুইটির দিকে তাকিয়ে বললেন, পোলাপান দুইডারে আতুড় লুলা কইচ না গণি। আল্লায় ব্যাজার অইবো। আল্লার ইশারা ছাড়া গাছের পাতা লড়ে না। অরা দুইজন যে এমুন অইছে এইডাও আল্লার ইশারায়ঐ অইছে। এই দুইন্নাইতে অরা নাইলে আজাব পাইতাছে পরকালে অরা থাকবো তর আমার থিকা বেশি আরামে।

গণি বলল, হ দাদা, এইডা দামি কথা কইছেন।

গণির পরনে আজ কালো রঙের ফুলপ্যান্ট, পায়ে দোয়ালাঅলা রঙের চামড়ার স্যান্ডেল। গায়ে সাদার ওপর সূক্ষ্ম নীল ডোরাকাটা হাফহাতা শার্ট। বাঁ হাতের কবজিতে সাদা। নিকেলের চেনআলা ঘড়ি। দেখে বোঝা যায় এই ঘড়ি ঢাকা থেকে কিনে নাই গণি, এই ঘড়ি আসছে জাপান থেকে। দুই দুইটা পোলা জাপানে পাঠিয়ে হাড়হাভাতে গণি হয়ে গেছে বড়লোক, তিন কাঠার ওপর চারতলা বাড়ি করে ফেলেছে যাত্রাবাড়িতে। বউ পোলাপান নিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেছে ঢাকায়। এখন বাড়ি দেখাশোনার জন্য মতিমাস্টারের পরিবারকে রেখে যাচ্ছে। দুই পোলার কারণে কোথাকার মানুষ কোথায় গেছে!

তাঁর ছোট ছেলেটাও আছে জাপানে, আজাহার। টাকা যে পরিমাণ এতদিনে পাঠাবার কথা সেই পরিমাণ পাঠায় নাই। ছেলেটা একটু বেশি স্বার্থপর। হয়তো নিজের কামাই রোজগারের বেশির ভাগটাই নিজের কাছে রেখে দিচ্ছে। হয়তো ভাবছে দেশে যা পাঠাবে তাই চলে যাবে বাপের পেটে। বাপের উপর ভরসা কম। ভাবছে দেশে ফিরে দেখবে তার পাঠানো টাকার একটাও নাই। আর আজকালকার বাজারে নগদ টাকা না থাকলে তার কোনও দাম নাই। এইসব কারণেই হয়তো টাকাপয়সা আজকাল সে ঠিকঠাক মতো পাঠাচ্ছে না। দুই-তিন মাস পর পর কিছু পাঠায়।

মান্নান মাওলানা আনমনা হয়ে আছেন দেখে গণি বলল, কী চিন্তা করেন দাদা?

মান্নান মাওলানা চমকালেন। না কিছু চিন্তা করি না।

একটু থেমে বললেন, তুই কোনও চিন্তা করি না গণি। আমার উপরে যহন ভরসা করছস ভরসার কাম আমি করুম। আমি অগো দেইক্কা শুইন্না রাকুম। তুই কি অহনঐ ঢাকা যাইতাছস?

হ দাদা। ব্যাগবোগ রেডি। চা খাইয়াঐ মেলা দিতাম। আপনেরে দেইক্কা বইলাম।

ঠিক আছে যা। অগো খালি কইয়া যা সুবিদা অসুবিদা বেবাক যেন আমারে জানায়।

রান্নাঘরের সামনে দাঁড়ানো আছিয়ার দিকে তাকাল গণি। হোনছো কী কয় দাদায়? কয় সুবিদা অসুবিদা বেবাক তারে কইয়ো।

মাথায় লম্বা ঘোমটা দিয়ে শাড়ির আঁচল দাঁতে কামড়ে রেখেছে আছিয়া। সেই অবস্থায় কোনওরকমে বলল, আইচ্ছা কমু।

গণি উঠল। তয় আমি অহন মেলা দেই দাদা?

আর ইট্টু বয়। তর কাছ থিকা জাপানের খোঁজখবর লই। জাপান থিকা বলে বেবাক বাংলাদেশিগো খেদাইয়া দিবো?

গণি হাসল। কে কইছে আপনেরে?

হোনলাম।

বাজে কথা। আমিও হুনছিলাম। হুইন্না পোলারা ফোন করনের পর অগো জিগাইছি, কয় মিছাকথা। যতদিন ইচ্ছা জাপানে অরা থাকতে পারবো। আমিও কইছি, যতদিন পিরচ থাইক্কা আয়। দরকার অইলে থাকতে থাকতে বুড়া অইয়া যাবি তাও দেশে ফিরনের নাম। লবি না। এই দেশে কোনও কাম নাই, ব্যাবসাবাণিজ্য নাই। টেকা যা রুজি কইরা আনবি ওইডিঐ বইয়া বইয়া খাওন লাগবো।

আবার হাসল গণি। এইডি আসলে মিছাকথা দাদা। এইসব কইয়া পোলা দুইডারে জাপানে আমি আটকাইয়া রাখছি। এইদিক দিয়া অগো টেকায় চাইরতালা বাড়ি করছি। দোতালায় আমরা থাইক্কা বাকি তিনহান তালা ভাড়া দিমু। এহেক তালায় দুইখান কইরা ফেলাট। এহেক ফেলাটের ভাড়া তিন হাজার। ভাড়া পামু আঠরো হাজার টেকা। আমি থাকুম দোতালায়। দোতালার দুইখান ফেলাট জোড়া দিয়া একখান বানাইছি। আপনে তো বোজেনঐ দাদা, আমার বড় সংসার। আটখান মাইয়া। বিয়া দিছি মাত্র তিনজনের। বাকি পাঁচজনের বিয়া বাকি। দুই পোলারে কইছি পাঁচ বইনের বিয়া দিয়া তারবাদে দেশে আবি। পোলারাও রাজি। কয় বইনগো লেইগা সমন্দ দেহেন। টেকা দিয়া পারেন পয়সা দিয়া পারেন বিদাই করেন এহেকজনরে। আমি দাদা ঘটকও লাগাই দিছি। ঢাকায় যহন নিজের বাইত্তে উইট্টা গেছি, মাইয়াগো বিয়া অহন অঐবোঐ। তিন জামাইও চেষ্টা করতাছে। তয় মাজে মাজে পোলা দুইডার লেইগাও দাদা মায়া লাগে। বিদেশের বাইত্তে খাইয়া না খাইয়া অডু অডু দুদের পোলারা লাক লাক টেকা পাডাইতাছে।

টাকার আওয়াজটা গণি কেন দিল বুঝলেন মান্নান মাওলানা। যাতে তিনি প্রশ্ন করেন গণির দুই ছেলে মাসে কত টাকা পাঠায়। যা পাঠায় গণি বলবে তার দ্বিগুণ। তারপর জানতে চাইবে আজাহার কত পাঠায়। মান্নান মাওলানা যে অঙ্কই বলবেন শুনে অযথা অবাক হয়ে বলবে, ক্যা মতো কম পাড়ায় ক্যা? আমার দুই পোলায় তো মাসে পাড়ায় তিনলাক। তয়। মনে অয় আজাহার ভাল কাম পায় নাই জাপানে। অর্থাৎ আজাহারের তুলনায় নিজের ছেলেদেরকে বড় করে তোলার চেষ্টা।

এই কারণে ওসব বিষয়ের ধার দিয়েই মান্নান মাওলানা গেলেন না। তুললেন অন্য কথা। আচমকা বললেন, ওই গণি, কী অইছে রে তর?

গণি থতমত খেল। কী অইবো?

তর মাথায় কোনও গন্ডগোল অইছেনি?

গণি আকাশ থেকে পড়ল। কন কী দাদা, কীয়ের গন্ডগোল?

তুই দিহি অহন ম্যালা প্যাচাইল পারচ! আগে তো এত প্যাচাইল পারতি না!

গণি কেলানো একখান হাসি দিল। হ দাদা, এইডা আপনে ঠিক কইছেন। প্যাচাইল আমি অহন ইট্টু বেশি পাড়ি। আর খালি ছটফট ছটফট করি। আমি চাই চোক্কের নিমিষে আমার এহেকখান কাম অইয়া যাউক। পাঁচদিনের মইদ্যে পাঁচ মাইয়ার বিয়া অইয়া যাউক। দুই পোলার লেইগা দুইহান দোকান কিনুম গাউছিয়া মার্কেটে, টেকাও জমছে, তয় হেই টেকায় কুলাইতাছে না। বাড়ি করনের পর ক্যাশ টেকা আইটকা গেছে ম্যালা। পোলারা কইতাছে আষ্ট-নয় মাস দেরি করেন আব্বা, অইয়া যাইবো নে। আমার সইজ্জ অয় না। বাড়ি বানানের সময়ও এমুন অইছে। মনে অয় বহুতদিন লাইগ্যা যাইতাছে তাও য্যান বাড়ির কাম শেষ অয় না। সব কিছুতে আমার একখান হরতরাইস্যা ভাব। এই বদলানডা আমি দাদা কুনসুম জানি বদলাইয়া গেছি। আমার খালি মনে অয় টাইম শ্যাষ অইয়া যাইতাছে, কামডি শেষ অইতাছে না।

এই লক্ষণডা ভাল না রে? এইডা মরণের লক্ষণ।

একথা বলেই পুব-দক্ষিণ কোনার ঘাটলার ওদিকে চোখ গেছে মান্নান মাওলানার, দেখেন মুকসেইদ্দা চোরার বাড়ির উত্তর ভিটির ঘরের পেছন দিকে অচেনা একজন লোক দাঁড়িয়ে এই বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। পরনে উঁচু করে পরা লুঙ্গি, খালি গা। হাতে বোধহয় সিগ্রেট জ্বলছে। মুখে মোচ দাড়ি নাই, কামানো মুখ।

লোকটা কে?

গণিকে জিজ্ঞাসা করতেই বলল, অরে চিনেন নাই দাদা? ঐত্তো মুকসেইদ্দা!

কচ কী?

হ। মাস দুয়েক নাকি তারও আগে জেল থিকা ছাড়া পাইছে।

আগে না মোকে দাড়িমোচ আছিল?

হ। কামাই হালাইছে।

মান্নান মাওলানা চিন্তিত হলেন। মুকসেইদ্দা ছাড়া পাইছে, এইডা তো চিন্তার কথা। গেরামে চুরিচামারি বাইড়া যাইবো।

না দাদা বাড়বো না।

কেমতে কচ?

মুকসেইদ্দার লগে আমার কথা অইছে।

কী কয় চোরায়?

কয় চুরিচামারি আর করবো না। দ্যাশ গেরামে থাকবো। গিরস্তি কইরা খাইবো। জেল খাটতে খাটতে অর বলে আর ভাল্লাগে না।

কথা যুদি সত্য অয় তয় তো ভালঐ।

আমার মনে অয় সত্য। কারণ অইলো দুই-আড়াই মাসে তো কোনও বাইত্তে চুরি অয় নাই। আর মানুষ তো দাদা বদলায়। মাইনষের বাইরের রূপ বদলায়, ভিতরের রূপ বদলায়। এই যে আমারে আপনে কইলেন আমি বদলাইয়া গেছি। এমুন বদলান কইলাম দাদা আপনেও বদলাইছেন। নাইলে গাছির মাইয়ায় আপনের লগে যেই অন্যায় করছে, অরে তো আপনে কব্বর দিয়া হালাইতেন! অর বাপ-মারে পিডাইয়া মাইরা হালাইতেন। কিন্তু আপনে দিলেন ছেমড়িরে মাপ কইরা। এতেঐ বুজা যায়, আপনেও বদলাইছেন।

তারপর হাতের ঘড়ি দেখল গণি। দেখে ছটফটা ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল, পাগলের মতো ছুটে গিয়ে বড়ঘরের দরজার সামনে রাখা ব্যাগটা হাতে নিল। আর দেরি করণ যাইতাছে না দাদা, আমি মেলা দেই।

মান্নান মাওলানাও উঠলেন। আচ্ছা যা।

গণি যখন উত্তর দিককার নামার দিকে নেমে যাচ্ছে, গণির দিকে তাকিয়ে মান্নান মাওলানা মনে মনে বললেন, তর কথা ঠিক না গইন্না। আমি ইট্টুও বদলাই নাই। আমি খালি থোম ধইরা রইছি। অহনঐ যুদি গাছির মাইয়ারে লইয়া কাইজ্জাকিত্তন আরম্ব করি তাইলে আমার আসল কামডা অইবো না। ওই কামডা করনের লেইগা দরকার অইলে দুই চাইর বচ্ছর দেরি করুম আমি। তারবাদে যেই ছ্যাপ ছেমড়ি আমার মোকে ছিডাইছে হেই ছ্যাপ দিয়া অরে আমি….।

.

গোলাঘরের পুবদিককার বাঁশের বেড়ার তলা দিয়ে চাঁদের এক টুকরা আলো এসে ঢুকেছে। ঘুটঘুটা অন্ধকার ঘর ওইটুকু আলোয় অপার্থিব হয়ে উঠেছে। সেই আলোর দিকে তাকিয়ে হাসু বলল, ও ফুবু, ঘুমাইছো?

হাসুর দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে আছে রহিমা। ভাইঝির কথায় সোজা হল। না।

হাসু শুয়ে আছে রহিমার দিকে মুখ করে। চৌকির উপর থেকে তার খোলা চোখ গিয়ে পড়েছে পুবদিককার বেড়ার ওদিকে। চাঁদের আলোটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। এই আলোর কারণেই কি না কে জানে, ঘুম আসছেই না হাসুর। মন কেমন করছে। মনে হচ্ছে। আজ রাতে ঘুম আর আসবেই না। মনে হচ্ছে আজ রাতটা ফুবুর লগে গল্প করে কাটালে ভাল লাগবে। এই কারণেই রহিমাকে সে ডাকল। রহিমা সোজা হয়ে শোয়ার পর মনটাও আনন্দে নেচে উঠল হাসুর। ওই যে তোমারে একদিন বিয়ালে একখান কথা জিগাইতে চাইছিলাম ফুবু, তোমার মনে আছে?

রহিমা বলল, থাকবো না ক্যা?

কথাহান আউজকা জিগাই?

জিগা।

হুইন্না তুমি আবার চেইত্তা যাইবা না তো?

রহিমা হাসল। তর মনে অয় চেতুম?

চেততে পারো।

আমি ইট্টু ইট্টু বুজছি তুই কী জিগাবি। হেদিন বিয়ালেঐ বুজছিলাম। জিগা, আমি চেতুম না।

না চেতলা, হাচা কথা কইবা তো?

উদাস দুঃখী গলায় রহিমা বলল, কমু। মনের বেবাক কথা হারাজীবন মনের মইদ্যে চাইপপা রাখলাম। চাইপপা রাখতে রাখতে বুকের ভিতরডা পাথরের লাহান অইয়া গেছে। কেঐরে যুদি বেবাক কথা একদিন কই, বুকের পাথরডা মনে অয় নামবো। পাতলা বুক লইয়া মরতে পারুম। তুই জিগা, যা তর মনে লয় জিগা! বেবাক সত্যকথা তরে আমি কমু। একখানও মিছাকথা কমু না, একখান কথাও হামলামু (লুকানো) না। লজ্জাশরমের কথাও কইয়া দিমু।

ফুফুর কথা শুনে বুকের ভিতরটা কী এক মায়ায় মোচড় দিয়ে উঠল হাসুর। একটা হাত ফুফুর বুকের কাছে রাখল সে। গভীর মায়াবী গলায় বলল, আমার কাছে তোমার আবার শরম কী? আমারে তুমি বেবাক কথা কইতে পারো। আর আমারে না কইলে কইবাবা কারে। আমি ছাড়া তোমার আছে কে?

হ, তরও তো আমি ছাড়া কেঐ নাই।

এর লেইগাঐত্তো আমরা দুইজন দুইজনরে বেবাক কথা কইতে পারি। তোমার কথা হোননের পর আমিও তোমারে আইজ আমার কথাডি কমুনে। কীর লেইগা মউচ্ছামান্দ্রার বাইত্তে আমি থাকতে চাই না, খালি এই বাইত্তে তোমার কাছে আইয়া পড়ি। আমার শইল্লের এমুন ব্যাডা ব্যাডা দশা ক্যান, বেবাক তোমারে কমু নে।

আইচ্ছা।

আমার কথা হোনতে হোনতে তুমি আবার ঘুমাইয়া পড়বা না তো?

রহিমা ম্লান গলায় হাসল। আরে না ছেমড়ি। সুকদুঃখের কথা কইতে কইতে মাইনষে আবার ঘুমায় কেমতে?

না, ঘুম তো আইতে পারে। হারাদিন যেই কাম করো তুমি! বিয়াইন্না রাইত্রে উইট্টা আরম্ব করো, দুইফইরা ভাত খাইয়া ইট্টুহানি জিরান, তারবাদে আবার। আজাইর অও। অনেক রাইত্তে।

হারাজীবন ধইরাঐত্তো এই আন্নাতান্না করতাছি। এই হগল কইয়া আর লাব কী! কপালে যা বাইন্দা লইয়াইছি তা কি আর বদলাইবো? ছনুবুড়ি আর আলার মা’র মরণের কথা হোননের পর থিকা যহনঐ ইট্টু আজাইর থাকি, কামকাইজ না থাকে হাতে, উড়ানের কোনায় নাইলে রানঘরে, নাইলে এই ঘরে হুইয়া বইয়া থাকি, হুজরানির পান থিকা যেই পানডু হামলাইয়া নাইলে চাইয়া চুইয়া আনি, হেই পান চাবাইতে চাইতে মরণের কথাও মনে অয়। মনে অয়, যে জিন্দেগি কাড়াইয়া গেলাম হেই জিন্দেগির থিকা মরণ অনেক ভাল। আছিলো। মাইয়ামানুষ অইয়া জন্মাইলাম তারবাদেও নিজের সংসার অইলো না, পোলাপান অইলো না। জিন্দেগি কাটলো হুজুরের বাড়ির বান্দি অইয়া। খালি বান্দির কাম কইরা বাইচ্চা থাকলেও ভাল আছিলো। তাও তো পুরাপুরি অইলো না। এই হগল কামের আড়ালে আবডালে আরও কত কাম করতে অইছে।

কোন কাজের কথা বলতে চাইল রহিমা মোটামুটি বুঝল হাসু তয় ওই নিয়া কথা বলল না। বলল অন্যকথা। বিয়া তো তোমার অইছিল, হেই বিয়া টিকলো না ক্যা, সংসার অইলো না ক্যা তোমার?

রহিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ওই যে কইলাম, কপালের দোষ। বিয়া তো বাপ চাচারাঐ দিছিলো। জামাইবাড়ি আছিল কোলাপাড়া। কোলাপাড়া অইলো কাঁচারুগো (কাশারু) গেরাম। কাঁচারু কাগো কয় জানচ তো? যারা তামাপিতলের কারবার করে, কাঁচের থাল বাসনের কারবার করে। তারা এহেকজন বিরাট বড়লোক। টেকাপয়সার আকাল নাই। তয়। তর ফুবা কইলাম কোলাপাড়ার মানুষ অইয়াও কাঁচারু আছিলো না। ছিন্নগর বাজারে এক কাঁচারুর দোকানে কাম করতো। নাম আছিলো খালেক। আমগো লাহানঐ গরিব গুরবা মানুষ। সংসারে বুড়ি মা, তিনহান পোলাপানআলা বিধবা বইন, বইনডার নাম আছিল মাজেদা। খাড়ে দজ্জাল আছিলো মাগি। আমার হরিও কম দজ্জাল আছিলো না। জামাইডা ভালই আছিলো, তয় ইট্টু মেউন্না। মা’রে আর বইনরে সাই ডরান ডরাইতো। বিয়ার পর দেড়বচ্ছর কাডে নাই, আমার নন্দে আর হরি বদলাম উডাইলো, আমি বাঁজা। আমার পোলাপান অইবো না। নতুন বিয়ার পর যাগো পোলাপান অওনের তাগো এতদিনের মইদ্যে হইয়া যায়। বিয়ার দুই-তিন মাসের মইদ্যে মাথা ঘুরান আরম্ব অয়, তেতইল খাওন। আরম্ব অয়, ঘনঘন উকাল করে বউরা। আর দেড় বচ্ছর অইয়া গেল এই হগল কিছুই। অয় না আমার, না মাথা ঘুরান, না উকাল পাকাল, না কিছু। জামাইও জুয়ানমর্দ। আমি নিজেও চিন্তায় পইড়া গেলাম। পোলাপান অয় না দেইক্কা হরি আর নন্দে তো আগে চেচছে, অহন দেহি জামাইও ঠিক নাই। আবল তাবল কথা কয়। কিছু না করলেও শইল্লে হাত উডায়, বকাবাজি করে। কয়দিন বাদে হুনি বিয়ার চাড়ি (হুজুগ) উডাইছে। হরি কয়, পোলারে আবার বিয়া করামু। এই বাজা মাগিরে সংসারে রাখুম না। নন্দেও হের লগে উচালি (উৎসাহ) দেয়। জামাই দিহি কোনও কথা কয় না। তারবাদেও আরও আষ্টমাস। ওই বাইত্তে আমি আছিলাম। যেদিন মলবি ডাইক্কা বাড়ির উডানে ময়মুরব্বিগো সামনে খালেক আমারে তালাক দিল, কী কমু তরে, মাডিতে আছড়াইয়া পাছড়াইয়া চিক্কইর পাইড়া। কানছিলাম আমি। বহুত হাতে পায়ে ধরছিলাম জামাইয়ের, হরি-নন্দেরও কম ধরি নাই। জামাইরে কইছিলাম, বিয়া আপনে আরেকখান ক্যা, আরও তিনডা করেন, আমি কিছু। কমু না। আমার লগে আপনের হোওনও লাগবে না। খালি এই বাইত্তে আমারে ইট্টু জাগা দেন। দাসী বান্দির কাম কইরা আপনেগো আমি খাওয়ামু। কেঐ আমার কথা হোনলো না। কইলাম তয় আমি অহন যামু কই? বেবাকতে কইল হেইডা আমরা জানি না। নন্দে কইলো, ক্যা তোমগো বাইত্তে যাও! তোমার বাপ নাইলে মরছে, চাচা ফুবুরা আছে, ভাই আছে, তাগো কাছে যাও।

আমারে বিয়া দেওনের পর বচ্ছরও ঘোরে নাই বাবায় মরলো। মায় তো মরছিলো। আরও আগে। দইল্যাদায় তহনও বিয়া করে নাই। তর মায় আহে নাই সংসারে। অবস্তাও ভাল না আমগো। বাবায় মরণের আগে হের ভাইবেরাদররা জাগাজমিন খেতখোলা বেবাক ভাগ করছে। আমগো ভাগে যেডু জমিন পড়ছে হেই জমিন চইয়া তিন-চাইরজন মাইনষের বচ্ছর চলবো না। বাপের জাগাজমিনের ভাগ দুই-ইটু মাইয়ারাও পায়। চিন্তা করলাম বাইত্তে যাই, গিয়া দইল্যাদারে কই, জাগা জমিনের দাবি আমি করি না,তয় আপনে খালি এই বাইত্তে আমারে থাকতে দেন। আপনে আমার ভাই, আপনে জাগা না দিলে আমি যামু কই।

এই তরি শুনে হাসু বলল, ইস, আর মানুষ পাইলা না তুমি? গেলা আমার বাপের কাছে? ওই শুয়োরের পোয় মানুষনি? অর কাছে গেলা ক্যা?

হের কাছে ছাড়া আর যামু কই? আছে কে আমার?

আর কোনও আততিয় স্বজন আছিলো না? দুইন্নাইর বেবাক মাইনষের ঐত্তো আততিয় স্বজন দুই-চাইরজন থাকে। তাগো মইদ্যে কি বেবাক মানুষঐ খারাপ? কেঐর লেইগা কেঐর মায়া মহব্বত নাই?

থাকবো না ক্যা, আছে। তয় গরিব মাইনষের আসলে মায়া মহব্বত থাকে না। যাগো। প্যাডে ভাত নাই, নিজের প্যাডের ভাত জোগাইতে যাগো দিন যায় তারা আবার অন্য মাইনষেরে মায়া দেহাইবো কেমতে? আমগো আততিয় স্বজন বেবাক অইলো গরিব। আশিন কাতি মাসে না খাইয়া থাকে অনেকে। এমুন আততিয় স্বজনরা কে কারে জাগা। দিবো নিজের সংসারে? কে কারে খাওয়াইবো?

হ, এইডা ঠিক কথা। আইচ্ছা কও দিহি, তারবাদে বাবায় তোমারে কী কইলো?

কইবো আর কী, জামাই তালাক দিছে যেই বইনরে হেই বইন বাইত্তে আইয়া উডনের লগে লগেঐত্তো তারে আর খেদাই দেওন যায় না। দুই-চাইরদিন থোম ধইরা রইলো। হেই ফাঁকে দেহি বাইত্তে ঘটক আহে, দইল্যাদায় নিজেঐ নিজের বিয়ার লেইগা মাইয়া দেকতাছে। দুইদিন দেখলাম আমার ছোডচাচা আর চাচতো ভাইগো লইয়া শাট পায়জামা ফিন্দা, মোকে ছুনু পাউডার মাইক্কা মাইয়া দেকতে গেল। বিয়াও ঠিক অইয়া গেল। তহন একদিন ছোডচাচা আর চাচতো ভাইগো লইয়া, দুই ফুবু আইলো বাইত্তে, তাগো। পোলাপানরা আইলো, বেবাকতে মিলা বইয়া ঠিক করলো আমার অহন উপায় অইবো কী? তালাক অওয়া মাইয়ার কত বিয়া অয় আবার! তয় হেইডা তো আর আমার অইবো না। আমি তো বাঁজা! বাজা মাইয়া কে বিয়া করবো? আর ভাইর সংসারেও যে আমি থাকুম, ভাই বিয়া করতাছে, দিনে দিনে সংসার বড় অইবো, হেয় আমারে টানবো কেমতে? খাওয়াইবো কী? শেষমেশ আমার মাজারো ফুবায় কইলো, রহিরে কোনও বড়গিরস্ত বাইত্তে কামে দিয়া। দিলে অয়। বিক্রমপুরে পয়সাআলা গিরস্তের আকাল নাই। ঝি চাকর ম্যালা লাগে তাগো। ইট্টু চেষ্টা করলে যে-কোনও গেরামে কামে দিয়া দেওন যাইবো অরে। ভাল গিরস্ত বাড়ি পাইলে হারাজীবনঐ এক বাইত্তে থাকতে পারবো। ল বেবাকতে মিলা চেষ্টা কইরা দেহি অমুন বাড়ি পাইনি। যতদিন না পাই ইট্টু কষ্ট অইলেও দইল্যার সংসারেঐ রহি থাউক।

ওই ফুবাঐ কয়দিন বাদে কেমতে কেমতে জানি মেদিনমণ্ডলের এই বাড়িডা বিচড়াইয়া বাইর করলো। আল্লাআলা মাইনষের বাড়ি। এই বাইত্তে একজন বান্দা ঝি লাগবো। ঝি যুদি ভাল অয় হারাজীবন থাকতে পারবো। হুইন্না আততিয় স্বজনরা বেবাকতে খুশি। মাওলানা সাবের বাড়ি অইলে তো ভাল। যুবতী মাইয়া ওইরকম বাইত্তে ভাল থাকবো। মাইয়ার মিহি কেঐ কুনজর দিবো না।

শুনে খিক করে হাসল হাসু। ইস মাইনষের যা চিন্তাভাবনা না! হুজুর মুজুর হোনলেঐ মাইনষে মনে করে তাগো লাহান ভাল মানুষ আল্লার দুইন্নাইতে আর নাই। ভিতরে ভিতরে আলেমগুনি যে কী জালেম হেইডা বোজে খালি তোমার-আমার লাহান মাইনষে।

হ এইডাঐ ঠিক কথা।

যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে রহিমা বলল, ওই হাসু, হুজুরে তরে কোনওদিন পাও পোও টিপতে ডাক দিছে?

না, অহনতরি দেয় নাই।

কোনওদিনও দেয় নাই?

না।

তয় দিতে পারে। সাবধানে থাকিস।

অহন আর সাবধানে থাকনের কিছু নাই আমার।

ক্যা?

আমি কি অহন আর মাইয়ামানুষনি! থোও আমার কথা। আমার কথা পরে হুইন্নো। আগে তোমার শেষ করো।

অনেকক্ষণ সোজা হয়ে শুয়ে কথা বলার ফলে ক্লান্ত লাগছে রহিমার। হাসুর দিকে পাশ ফিরল সে। কত কথা! হারারাইত ধইরা কইলেও ফুরাইবো না।

ফুফুকে পাশ ফিরতে দেখে হাসু এবার সোজা হল। আরে কও তুমি। ফুরাইবো। আইজ না ফুরাইলে আরেক দিন কইবা।

আইচ্ছা। তয় তর ঘুম আইতাছে না তো?

না। তোমার?

আমারও না।

তয় কও।

মাইনষের বাইত্তে ঝিয়ের কাম কইরা জিন্দেগি কাড়াইতে অইবো হোননের পর থিকা আমি এক্কেরে থোম ধইরা গেছি। মনডার মইদ্যে এমুন দুঃখু অইছে! আহা রে, গিরস্ত ঘরের মাইয়া, পেটখান বাজা অইছে দেইক্কা, কপালের ফ্যারে কোনমিহি অহন যাইতে অইতাছে। ইচ্ছা করলে ভাইয়ে আমারে তার সংসারে রাকতে পারতো। নাইলে নিজের ভাইয়ের সংসারেঐ ঝিয়ের কাম কইরা খাইতাম! অন্যের বাইত্তে যাওনের কাম কী! যেই সংসারে দুইজন মাইনষের আহার জোডে হেই সংসারে তিনজনেরও জোডে। নাইলে নিজেগো গেরামে এই বাইত্তে ওই বাইত্তে ধান বাইন্না, মুড়ি ভাইজ্জা, চাউল কুইট্টা খাইতাম। হারাদিন কাম করতাম মাইনষের বাইত্তে রাইত্রে আইয়া খালি হুইয়া থাকতাম নিজেগ বাইত্তে। বড়ঘরে নাইলে দইল্যাদায় তার বউ লইয়া থাকতো, আমি নাইলে থাকতাম রান্নঘরে! এইভাবে কেঐ আমারে লইয়া চিন্তা করলো না! সংসার বাড়ি থিকা, গেরাম থিকা ভিন গেরামে পাড়ানের বন্দোবস্ত করলো!

দুঃখে বুকটা আমার তহন ফাইট্টা যায় তয় কেঐরে কিছু কই না। যা আছে কপালে, আমি ওই বাইত্তে ঝিয়ের কামেঐ যামু গা। বাপের বাইত্তে কোনওদিন আহুম না।

তর মা’র লগে দইল্যাদার তহন বিয়া ঠিক অইয়া গেছে। বিয়ার দিন তারিকও ঠিক অইছে। ছোডচাচায় আমারে কইলো ভাইয়ের বিয়া খাইয়া যাইচ। আমি কইলাম, না। কাকা, থাউক। আমি পোড়া কপালি, এই হগল সুক আহ্লাদ আমার কপালে নাই। আমি আগেঐ যাইগা। আর নতুন বউ সংসারে আইয়া দেকবো হের নন্দে ঝিয়ের কামে মেলা। দিছে ভিন গেরামে, নুতন বউর কাছে শরম পাওন লাগবো। আগেঐ যাইগা।

কাকায় কইলো, হ, কথা মন্দ কচ নাই। তয় যা গা। বুকের দুঃখ বুকে চাইপপা, মাজারো ফুবার লগে পথে নামলাম। দুই হাতে বুকের কাছে ধরা ছোট্ট একখান গাট্টিতে আমার দুইহান ফিনের কাপড়, ছায়া বেলাউজ, আরও দুই চাইরহান টুকুর টাকুর জিনিস। দইল্যাদায় আমারে একবার কইলোও না, অহন যাই না বইন, বিয়ার পর যা। এই বাইত্তে আমি আইয়া উটলাম দোফরের পর। আমারে দিয়া ফুবায় গেল গা। মনে আছে ফুবার যাওন দেইখা আমি পোলাপানের লাহান ফোঁপাইয়া ফেঁপাইয়া কানছিলাম। মনে অইছিলো আমার শেষ আপনজন আমারে অচিন এক বাইত্তে রাইখা চিরদিনের লেইগা গেল গা। এই দুইন্নাইতে আমি অহন একলা। আমার কেঐ নাই।

রহিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কতকাল আগের কথা, তাও বেবাক মনে আছে। পয়লা পয়লা ভাল্লাগতো না এই বাইত্তে, আস্তে আস্তে দেহি ভাল লাগে। বেবাকঐ কেমুন জানি আপনা আপনা অইয়া ওডে। সব কিছু নিজের মনে অয়। মাইনষের নিয়মঐ এইডা, বুজলি হাসু, একহানে থাকতে থাকতে কুনসুম জানি হেই জাগাড়াঐ তার আসল জাগা অইয়া যায়। এই বাড়িডাও দিনে দিনে আমার আসল বাড়ি অইয়া গেল।

গণি মিয়ার সীমানায় তাদের বুড়া কুত্তাটা হঠাত্র দু-তিনটা ঘেউ দেয় এ সময়। চাঁদের আলোয় দূরে কোথায় একটানা ডেকে যাচ্ছে একটা কোকিল পাখি। তেঁতুলগাছটার ওদিকে বোধহয় বাদুড় ওড়াউড়ি করছে, ডানা ঝাঁপটাবার শব্দ পাওয়া যায়। বাঁশের বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে হু হু করে আসছে চৈত্র রাতের হাওয়া। গুটি ধরে আসার পরও পারুর ঘরের পিছন দিককার আমগাছ থেকে বোউলের গন্ধ এসে মিশছে হাওয়ায়। এই হাওয়া কিছুক্ষণের জন্য যেন বুকে আটকে রাখল রহিমা। সেই ফাঁকে হাসু বলল, তয় তোমগো বাইত্তে তুমি আবার কবে গেলা? এই বাইত্তে আহনের কতদিন পর?

রহিমা বলল, দেড়-দুই বছর পর। তুই হইছস হুইন্না গেলাম। একমনে যাইতে চাই নাই, আরেক মনে চাইছি। ভাইয়ের বিয়ার আগে আহনের দিন তো মনে মনে কইছিলাম আর কোনওদিন ফিরত আমু না। দেড়-দুই বচ্ছর হেই ভাবটাঐ আছিলো মনে। তারবাদে যহন হোনলাম আমার ভাইয়ের একহান মাইয়া অইছে, হুইন্না মনডা নুলাম অইয়া গেল। একে ভাইর বউরে দেহি নাই, তার উপরে অইছে মাইয়া, দুইজনরে দেহনের লেইগাঐ মনডা আনচান আনচান করতে লাগলো। নিজে বাজা মাইয়াছেইলা, পোলাপান অইবো না কোনওদিন, এর লেইগা পোলাপানের লেইগা একখান আকাই (আকাক্ষা) আমার আছে। তার উপরে আছে নিজের বাপের ভিডির টান, যত পরঐ কইরা দেউক ভাইয়ে, ভাই তো ভাইঐ, হের আবার একখান মাইয়া অইছে, মাইয়াডার মোক দেহনের লেইগা মনডা ছুঁইট্টা গেল। হুজরানিরে কইলাম পাঁচ-ছয়দিনের লেইগা বাইত্তে যামু। হেয় কয়, যা। একদিন গিয়া উটলাম বাইত্তে।

বোজলাম, তয় ষোল্লঘর থিকা কেডা আইয়া তোমারে বাড়ির খবর কইতো? আমার জন্মের কথা কে আইয়া কইলো তোমারে?

দ্যাশগেরামের খবরাখবর কেমতে কেমতে জানি মাইনষের কাছে আইয়া পড়ে, বুজলি। সীতারামপুরের একজন মানুষ আছিলো, কারিকর। নাম অইলো মোসলেম। কারিকরের কাম হেয় করতো না, করতো দোকানদারি। তয় ঘরে বইয়া দোকানদারি না। কান্দে ভার লইয়া, ভারের দুই মিহির চাঙ্গারিতে মালছামান লইয়া গেরামে গেরামে যাইতো। বেড়া আবার ফউকরালিও (ফকিরি, ওঝার কাজ) করতো। কেঐর গলায় মাছের কাঁডা বিনলে বিড়বিড় কইরা দোয়া পইড়া কইতো, এইবার সেঁক গিলো। যার গলায় কাঁডা বিনছে হেয় ঢোক গিল্লা দেকতো কাডা নাই, গেছে গা। এই মোসলেম পেরায় পেরায়ঐ আইতো এই বাইত্তে, আবার দোকানদারি করতে আমগো গেরাম মিহিও যাইতো। আমার মোকে হুইন্না আমার ভাইরে চিনছিলো। ওই মোসলেম মোদি আইয়াঐ তর জন্মের খবর আমারে দিছিলো। রহিমা, তোমার ভাইর একখান মাইয়া অইছে।

তারবাদে তুমি গেলা?

হ।

যাওনের পর তোমার ভাইয়ে তোমারে দেইক্কা কী করলো?

হেয় দুইফইরা ভাত খাইতে বইছে। ভাবীছাবে তারে ভাত বাইড়া দিতাছে। তরে হোয়ায় রাকছে চকির উপরে। এই এত্তোড়ু মাইয়া তুই। নিঃসাড়ে ঘুমাইতাছিলি। আমারে দেইক্কাঐ তর বাপে মোকহান কালা কইরা হালাইলো। যেন আমি তার খাওনে ভাগ বহাইতে গেছি। দেইক্কা আমি কইলাম, মোক কালা কইরেন না দাদা, আমি এই বাইত্তে থাকতে খাইতে আহি নাই। ভাস্তি অইছে হুইন্না মনডা ছুঁইট্টা গেল, এর লেইগা অরে ইট্টু দেকতে আইছি।

হুইন্না তর বাপে কথা কইলো না, তর মায় পাগলের লাহান ফালদা বাইরে আইলো। পোলাপানের লাহান দুইহাতে আমারে প্যাচাইয়া ধরলো। হায় হায় কয় কী, আমার নন্দে আইছেনি? আহেন বুজি, ঘরে আহেন। আমার মাইয়া তো আপনের মাইয়াঐ। দেহেন ওই যে হুইয়া রইছে।

তর মা’র ব্যাভার দেইক্কা চোক্কে পানি আইয়া পড়লো আমার। এত ভাল একহান মানুষ আমার ভাইর বউ অইয়া আইছে! এমুন মায়া লাইগ্যা গেল তার লেইগা!

চোক্কের পানি পুইচ্ছা তরে আমি কুলে লইলাম। তুই তহন বেভোর ঘঘামে। অনেকক্ষুন তরে কুলে লইয়া বইয়া রইলাম। এই ফাঁকে তর মায় আমার লেইগা আবার ভাত রানলো, ঘোপায় জিয়াইন্না কইমাচ রানলো। তারবাদে আমারে সামনে বহাইয়া খাওয়াইলো। তার ব্যাভারে আমি আর ভাত খাইতে পারি না, আমার চোক্কে খালি পানি আহে। তর মায় যে আমার ভাইর বউ হেইডা আর মনে অয় না। মনে অয় হেয় আমার মা। বহুদিন আগে মইরা গেছিলো তারবাদে য্যান আবার ফিরত আইছে। ছোডকালে আমারে যেমুন সামনে বহাইয়া ভাত খাওয়াইছে অহনও যেমুন হেমুন কইরাঐ খাওয়াইতাছে। বিয়ালবেলা আমি কইলাম, অহন যাইগা ভাবিছাব। ম্যালা দূরের পথ, যাইতে যাইতে হাজ অইয়া যাইবো। হুইন্না ভাবীছাব য্যান আসমান থিকা পড়লো। হায় হায় কন কী? কই যাইবেন আপনে? না না আপনে আর যাইতে পারবেন না। আপনে অহন থিকা এই বাইত্তেঐ থাকবেন। আমি খাইলে আপনে খাইবেন, আমি না খাইলে আপনেও খাইবেন না। আর বাইত্তে কোনও কামও আপনের করন লাগবো না। আপনে খালি ভাস্তিরে কুলে লইয়া বইয়া থাকবেন, বেবাক কাম আমি একলা করুম।

হাসু বলল, তারবাদেও তুমি থাকো নাই?

তিনদিন রইছিলাম। দইল্যাদার ব্যাভারে থাকতে পারি নাই।

কী করলো হেয়?

খালি ভাবিছাবের লগে পিসপিস পিসপিস। একদিন দেহি ভাবিছাবে চুপ্পে চুপ্পে কানতাছে। আহা রে আমার লেইগা একজন মানুষ স্বামীর গঞ্জনা সইতাছে। আপনা ভাই পর অইয়া গেছে, পর অইয়া গেছে আমার আপন। ভাবিছাবরে বুজাইয়া বাজাইয়া তিনদিনের দিন আমি আবার এই বাইত্তে আইলাম। তয় তারবাদেও বচ্ছর-দুইবচ্ছরে একবার যাইতাম বাইত্তে। তরে দেকতে, ভাবিছাবরে দেকতে। তারবাদে মানুষটা মরলো। তর বাপে বিয়া করলো একটা দজ্জালনিরে। তরে আইন্না আমি কামে দিলাম মউচ্ছামান্দ্রা।

হাসু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আইচ্ছা ফুবু আমারে একখান কথা কও তো, বদ বেডাগো লগে খালি ভাল বেডিগো বিয়া অয় ক্যা? এইডা আল্লার কেমুন বিচার? ভাল মাইনষের কপাল বাইন্দা দেয় খাচ্চড় বেড়াগো লগে। যেমুন আমার বাপের লগে দিছিলো আমার মা’রে। এই বাইত্তে হুজুরের লগে দিছে হুজরানিরে। হুজুর যত বদ, হুজরানি তত ভাল।

হ এইডা ঠিকঐ কইছস। তয় হুজুর যে কীরকম বদ এইডা আমার থিকা ভাল আর কেঐ জানে না। হেই হগল কথা জিন্দেগিতে কেঐরে আমি কইতে পারুম না। যেই পেডের লেইগা জামাইর ঘর আমি করতে পারি নাই, জামাই আমারে তালাক দিছে, মাইয়া মাইনষের জীবনের সব থিকা বড় সুখ মা অওন, যেই পেডের লেইগা আমি কোনওদিন মা অইতে পারি নাই, এই বাইত্তে আহনের কয়দিন পর থিকাঐ আল্লার কাছে আমি খালি শুকুর করছি, আল্লাহ পেড়হান এমুন কইরা তুমি আমারে বাঁচাইয়া দিছো। নাইলে যে কী আছিলো আমার কপালে! বচ্ছর বচ্ছর খালি জাউরা পোলাপান অইতো আমার পেডে। মাইনষেরে আমি মোক দেহাইতে পারতাম না। তুই ডাঙ্গর মাইয়া, তুই আমার কথা বোজছচ। এর থিকা বেশি কিছু তরে আমি আর কইতে পারুম না। গিরস্ত ঘরের যেই মাইয়া একদিন। স্বামীর সংসারে গিয়া পোলাপান লইয়া সুখের সংসার করনের স্বপ্ন দেখছিলো হেই মাইয়া কপালের ফ্যারে অইয়া গেল এক বাড়ির দাসীবান্দি। যেই দাসীবান্দির দিনে অইলো এক কাম রাইত্রে আরেক কাম। হুজুরের ইশারায় হারারাইত ঘরের দুয়ার আবজাইয়া রাখন লাগে, কুনসুম হুজরানি ঘোমে বেভোর অইবো, কুনসুম হেয় আইয়া আমার লগে হুইবো। এই কইরা কইরা জীবনডা গেল আমার। কী জীবন কী অইয়া গেল!

রহিমা আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আর একহান কথা আইজ তরে আমি কই। আমার মনে। অয় আমার পেডহান বাজা না।

যেন আচমকা কাটার খোঁচা খেয়েছে হাসু, এমন করে চমকাল। কী?

হ। জামাই বাইত্তে যেই দেড়বচ্ছর আছিলাম হেই দেড়বচ্ছর কিছু অয় নাই। এই বাইত্তে আইয়া যহন হুজুরের লগে থাকতে আরম্ব করলাম, তিন-চাইরবার কইলাম আমার মনে অইছিল আমার পেড অইছে।

গভীর বিস্ময়ের গলায় হাসু বলল, কও কী তুমি?

হ। পয়লাবার পাক্কা সাড়ে তিনমাস হায়েজ বন্দ। দেড়-দুইমাসের মইদ্যে দেহি ইট্টু ইট্টু মাথা ঘুরায়, উকাল আহে। কেঐরে কিছু বোজতে দেই নাই। একমিহি ডরে কইলজা হুগাইয়া যায়, আরেকমিহি মনে জানি কেমুন ফুর্তি লাগে। একমিহি মনে অয়, সত্য যুদি হুজুরের পোলাপান আইয়া থাকে আমার পেডে তাইলে তো মাইনষে খানকি কইবো, আরেকমিহি মনে অয় তাইলে তো আমার পেডহান বাজা না। এক রাইত্রে হুজুররে কইলাম, হুইন্না হুজুরেও ডরাইয়া গেল। হায় হায় কচ কী! তর ফুবায় যে কইছিলো তুই বাজা দেইক্কা জামাই তরে তালাক দিছে! অহন তাইলে এই ভেজাল কেমতে অইলো? আগে জানলে তো অন্য বেবস্তা করতাম আমি!

কইলাম, আমিও জানতাম আমি বাঁজা। এমুন তো কোনওদিন হয় নাই।

দুইজনেই তারবাদে আমরা চিন্তায় চিন্তায় থাকি। সাড়ে তিনমাসের মাথায় একদিন শইল খারাপ অইলো আমার। তয় হেই শইল খারাপটা সব সময়কার লাহান না। কেমুন। জানি অন্যরকম। মনে অইলো পেড থিকা খালি রক্তঐ বাইর অইলো না রক্তর লগে যেন আরও কিছু বাইর অইলো?

আগের মতই বিস্ময়ের গলায় হাসু বলল, আর কী বাইর অইবো?

তুই বোজচ নাই?

না। পোয়াতি মাইয়াছেইলাগ পেড নষ্ট অয় না, আমার মনে অইলো আমারও য্যান পেড নষ্ট অইয়া গেল।

হ এইবার বুজছি।

তারও দুই বচ্ছর পর আরেকবার এমুন অইলো। হেইবারও হায়েজ বন্ধ থাকল দুই তিন মাস। তারবাদে আবার অমুন অইলো। এই জীবনে মোটমাট চাইরবার এমুন অইছে আমার। তারবাদে আইজ সাত-আষ্ট বচ্ছর পুরাপুরিঐ বন্ধ।

আইজকাইল আমার কোনও কোনও সময় মনে অয় কী জানচ হাসু, মনে অয় পেড আমার পুরাপুরি বাজা আছিলো না। অল্পবিস্তর গন্ডগোল আছিলো পেড়ে। ডাক্তার কবিরাজ দেহাইলে, চিকিচ্ছা করলে গন্ডগোলডা যাইতো গা। পোলাপান আমার অইতো। কপালের দোষ, বেবাকঐ কপালের দোষ। গরিবের ঘরে না জন্মাইয়া যুদি বড় গিরস্তের ঘরে জন্মাইতাম, ধনী মাইনষের লগে যুদি বিয়া অইতো তাইলে এই জীবনডা অন্যরকম অইতো। টেকাপয়সা খরচা কইরা জামাই আমার পেড ভাল কইরা দিতো, পোলাপান লইয়া। অন্য মাইয়াছেইলার লাহান সুখের সংসার করতাম আমি। আহা রে, জীবন!

হাসু ততক্ষণে একেবারেই স্তব্ধ হয়ে গেছে। ফুফুর কাছে আর যেন কিছুই জানার নাই তার। যা জানতে চেয়েছে তা তো জেনেছেই যা না চেয়েছে তাও জেনেছে। একজন মানুষের মনের অতলে লুকিয়ে থাকা সব কথাই আরেকজন মানুষ আজ জেনে গেছে। এখন বলার আছে হাসুর নিজের সবকথা। সেসব এখন আর বলতে ইচ্ছা করছে না। এখন বললে যেন সেইসব দুঃখের ভিতরকার প্রকৃত বেদনাবোধ ঠিকঠাক বোঝানো যাবে না ফুফুকে। বলতে হবে আরেকদিন, যেদিন ফুফুর ভিতরকার সব কথা জেনে প্রবল কষ্টের যে ধাক্কা হাসুর বুকে লেগেছে সেই ধাক্কার প্রচণ্ডতা কিছুটা হলেও কমে আসবে।

বাইরে চৈত্রমাসের জ্যোৎস্না রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল তখন। ঝিঁঝিরা ডেকে যাচ্ছিল আপন মনে। গাছের পাতায় পাতায় ছিল আমের বোউলের গন্ধে মাতোয়ারা হাওয়া। দূরে হঠাৎ হঠাই ডেকে উঠছিল ক্ষুধার্ত শিয়াল। সবকিছুর পরও প্রকৃতি উদাস হয়ে ছিল আপন মহিমায়।

.

বিয়ার পর পরই স্বামীর শরীরের ঘাটতিটা বুঝে ফেলেছিল পারু।

বিছানায় পুরুষের উদ্দামতা বলে কিছু নাই তার। নতুন বউর লগে দুর্বল কিছু আচরণ করেই নিস্তেজ হয়ে যায়। মরার মতো ঘুমায়া পড়ে। এদিকে শরীরভরা চাহিদা নিয়ে জেগে থাকে পারু। ছটফট করে। রাতের পর রাত ঘুম হয় না। মাথা সারাক্ষণ ধরে থাকে। কালিমায় কালো হয় ডাগর দুইখান চোখের কোল। মুখে হাসি নাই, বিষণ্ণতার ছায়া। তারপরও সংসারকর্ম করতে হয়। বিয়ার পর পরই মোতাহারকে আলাদা করে দিয়েছেন। মান্নান মাওলানা, দুইজন মানুষের হলেও সংসার তো! কাজের আকাল নাই সেই সংসারে। সকাল থেকে শুরু করে দুপুর তরি একটানা কাজ। রান্নাবান্না, গোসল, খাওয়া। দুপুর শেষ হওয়ার আগ তরি আজার নেই।

দুপুরের পর ঘণ্টা-দেড়ঘণ্টার একটা ঘুম ছোটবেলা থেকেই বাধা পারুর। শ্বশুরবাড়িতে এসেও সেই অভ্যাস বজায় ছিল। তার দেখাদেখি মোতাহারও শুয়ে পড়ত বউর পাশে। কয়েকদিনের মধ্যে তারও দুপুরের ভাতঘুমের অভ্যাস হয়ে যায়। বিকালের দিকে ঘুম। থেকে উঠেই চকেমাঠে চলে যেত মোতাহার আর পারু মনমরা ভঙ্গিতে সামান্য সাজগোজ করত।

বিকালের দিকে সাজগোজের অভ্যেসটা হয়েছিল তার বালিকা বয়স থেকে। স্বর্ণগ্রাম হাইস্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছিল। স্কুল থেকে ফিরে ভাত খেয়েই ঘুম দিত, ঘুম ভাঙার পর মা সুন্দর করে চুল বেঁধে দিতেন, চোখে কাজল দিতেন। কোনও কোনওদিন শাড়ি পরিয়ে দিতেন। সাজগোজের পর মন প্রফুল হয় মানুষের। পারুর হয় একটু বেশি। সেই বালিকা বয়সে প্রফুল্ল মন নিয়া প্রতিটি বিকাল পারু কাটাত তাদের বাড়ির বাঁধানো ঘাটলায় বসে, বাড়ির সামনের গাছপালা ঘেরা জায়গাটায় ঘুরে ফিরে।

তাদের বাড়িটা ছিল গাছপালায় ঘেরা, পুরানো ধরনের হিন্দুবাড়ি। ওই এলাকাটা হিন্দু প্রধানই ছিল। গ্রামগুলির নাম কামাড়খাড়া বাণীখাড়া নশঙ্কর। নামকরা মুখার্জি ব্যানার্জিদের বাড়ি ছিল। পার্টিশানের সময় সবাই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন কলকাতায়। পানির দামে বাড়িঘর কিনে রেখেছে মুসলমানরা। কেউ কেউ আবার কিনেওনি, দখল করেছে। দিনে দিনে চেহারা বদলে গেছে বাড়িগুলির। তারপরও কোনও কোনও বাড়ির পুকুরে এখনও রয়ে গেছে বাঁধানো ঘাটলা, বাড়ির ভিতরে বাইরে প্রচুর গাছপালা, বাগান, বনেদিআনার ছাপ। পারুদের বাড়িটা তেমন।

বিকালবেলা যখন রোদ উঠে যেত গাছপালার মাথায়, রোদছায়ার মনোরম একটা পরিবেশ তৈরি হত চারদিকে, পাখি ডাকত, হাওয়ায় ভাসত ফুলের গন্ধ তখন সাজগোজ করা প্রফুল্ল মনে পুকুরঘাটে বসে থাকতে খুব ভাল লাগত পারুর, গাছপালায় ভরা বাগানে বেড়াতে ভাল লাগত। মনে আনন্দময় একটা ভাব সারাক্ষণই থেকে যেত।

শ্বশুরবাড়িতে এসে এই ভাবটা আর ছিল না। স্বামীর শারীরিক দুর্বলতা হরণ করেছিল মনের প্রফুল্লতা। তবু বিকালের মুখে মুখে সাজতে বসত পারু। চুলে বেণি করত, চোখে কাজল দিত। কোনও কোনওদিন দুপুরে পরা শাড়ি বদলে সুন্দর শাড়ি পরত। এমনিতে নতুন বউ, গয়নাগাটি তার শরীরে দুই-একটা থাকতই। নাকে সুন্দর নাকফুল, কানে সরু রিং, হাতে কাঁচের চুড়ির লগে দুইখান করে সোনার চুড়ি, গলায় চিকন একখান সোনার চেন। সাধারণ মেয়েদের তুলনায় একটু বেশি লম্বা সে, একহারা সুন্দর গড়ন, শ্যামল বরণ মুখোন খুব মিষ্টি। বিকেলের মুখে ওই সামান্য সাজে অসাধারণ লাগত পারুকে।

সেই বিকালেও লাগছিল।

আকাশ রঙের শাড়ি পরে নিজের এক চিলতা উঠানে পায়চারি করছিল পারু। কেন যে সেই বিকালে তার বালিকা বয়সের একটি ঘটনার কথা মনে পড়েছিল।

তখন বর্ষাকাল। গ্রামের পাশে বড়সড় খালের মতন যে নদী, নদীর নাম রজতরেখা। এই নদী উত্তরে গিয়ে শেষ হয়েছে মুনশিগঞ্জের কাটাখালির ওদিকে, আর দক্ষিণে দিঘিরপারের ভিতর দিয়ে গিয়ে পড়েছে পদ্মায়। খরালিকালে রজতরেখা আর নদী থাকে না, একেবারেই খাল, কোথাও কোথাও মরাখাল। পানি কমে মানুষের গলা বুক তরি নামে, কোথাও কোথাও মাজা সমান। বর্ষার মুখে মুখে পদ্মা থেকে আসা পানিতে প্রথমে টইটম্বুর হয় রজতরেখা, তারপর গ্রামের ভিতর ঢুকে যাওয়া নালার মতন সরু খাল দিয়া পানি পাঠাতে থাকে পশ্চিম পাশের গ্রামগুলিতে। নদীর পুবপারে গ্রাম কম, চরাভূমি। মানুষের ঘরবাড়ির চেয়ে শস্যের জমি বেশি।

সেই বছর বর্ষা একটু যেন তাড়াতাড়িই হয়েছিল। বর্ষা শুরুর দেড় দুই সপ্তাহের মাথায় গ্রামের মাঠঘাট, পুকুর ডোবা সব পানিতে ডুবে গেল। একে পদ্মা থেকে রজতরেখা ধরে আসা পানি খাল বেয়ে ঢুকছিল গ্রামে, লগে আছে একটানা বৃষ্টি, বড় বড় ফোঁটার অবিরাম বৃষ্টি, এরকম বৃষ্টিকে বিক্রমপুর এলাকার লোকে বলে ‘ঢল। একদিকে পদ্মা থেকে আসা পানি আরেকদিকে ঢলের পানি, দুই পদের পানি মিলে মাস যেতে না যেতে লোকের উঠান পালানও ডুবুডুবু। পারুদের বাড়ির চারদিকে পানি। বাঁধানো ঘাটলাঅলা পুকুরের দক্ষিণ পাশের উঁচু হালট সামান্য জেগে আছে, পুকুরের পুব-উত্তর পারে গাছপালা ঘেরা জঙ্গুলে জায়গাটা ডুবুডুবু। পারুদের পশ্চিমের ভিটির বড়ঘরটার পিছনে বাঁশবাগান, সেই বাগানে একটু একটু করে ঢুকছে পানি। রান্নাঘরটা দক্ষিণের ভিটিতে, এই ঘরের পিছনে কচুবন, কচুগাছগুলির মাজা তরি উঠে গেছে পানি। শুধু পুবের ভিটির, পুবে-পশ্চিমে লম্বা পাটাতন ঘরটার লগের দক্ষিণে যে ফলফুলের বাগান সেই বাগানে ঢোকে নাই পানি। বর্ষার শুরু দিকে দিন বিশেক স্কুল বন্ধ। ওই বছরটাই ছিল পারুর স্কুলজীবনের শেষ বছর। ক্লাস এইটে পড়ছে। একটু বেশি বড় হওয়ার পরই স্কুলে দেওয়া হয়েছিল তাকে। ক্লাস এইটে পড়বার সময় পারুর বয়স ষোলো-সাড়েষোলোর কম না। লম্বা স্বাস্থ্যবতী মেয়ে। ওই বয়সে তাকে দেখাত আর একটু বয়স্ক।

সেবারের সেই বর্ষায়ই ঘটেছিল ঘটনা।

পারুর বাবা আফাজউদ্দিন আর বড়ভাই রফু বরিশাল পটুয়াখালির ওদিককার গলাচিপা এলাকায় কাটাকাপড়ের কারবার করে। ওদিকটা ভাটির দেশ। চারদিকে শুধুই নদী খাল বিল, শুধুই পানি। কারবারটা তাদের নৌকায় নৌকায়। নৌকা নিয়া একেকদিন একেক হাটেবাজারে যায়, সেখানে দোকান সাজিয়ে বসে, সন্ধাবেলা দোকান গুটিয়ে আবার ওঠে। নৌকায়। মাঝিরা সারারাত নৌকা বেয়ে যায় অন্য এলাকার হাটবাজারে। এই কারবার। কারবারটা মন্দ না। রোজগার ভাল। তবে থাকাখাওয়া নৌকায় এই এক যন্ত্রণা। আর ছয়মাস-নয়মাসের আগে বাড়ি ফিরা হয় না, ওই হচ্ছে আরেক যন্ত্রণা। তবে পারুদের বাড়ির আরও যে তিন শরিক তারাও ওই একই এলাকায় একই কারবার করে। দুই-তিন মাসের মধ্যে ঘুরে ফিরে কেউ না কেউ বাড়ি আসেই। পারুর বাপ আর বড়ভাই তাদের লগে টাকাপয়সা পাঠায়, তাতে সংসার চলে। খোরাকির কোনও অসুবিধা হয় না।

পারুরা চারবোন তিনভাই। বড়বোন মোরশেদা খুবই সুন্দরী। ভাইবোনদের মধ্যে তার গায়ের রংই ফরসা। হলে হবে কী, এই সুন্দরী বোনটাকে বাবা বিয়া দিছে দোজবরের কাছ। মোরশেদার জামাই হালিম আগে একটা বিয়া করছিল। আবদুল হাই নামের তিন বছরের একটা ছেলে রেখে বউ মারা যায়। হালিম অবস্থাপন্ন। ঢাকার সদরঘাটে থান কাপড় কাটাকাপড় মিলে চার-পাঁচখান দোকান। অবস্থা ভাল দেখেই এত সুন্দরী বড়মেয়েকে আফাজউদ্দিন হালিমের কাছে বিয়া দেয়।

তয় হালিম বদরাগী স্বভাবের লোক। পান থেকে চুন খসলেই চেতে বোম হয়ে যায়। একবার চেতলে রাগ কমতে সময় লাগে। বউর উপর চেতলে শ্বশুর শাশুড়ি আর অন্যান্য ময়মুরব্বি কিছু মানে না, সবার সামনেই বকাবাজি এমনকী মারধরও শুরু করে।

পারুদের পরিবারের সবাই নিরীহ, নরম আর নির্বিরোধ স্বভাবের। আফাজউদ্দিন আর রফু তো অতি সজ্জন! রাগারাগি দূরের কথা, জোরে কথাটা পর্যন্ত বলে না।

এই পরিবারের একটু রাগী ছেলে হচ্ছে কামরুল, কামু। কামু সেবার বাড়িতে ছিল না। গ্রামের মির্জাবাড়িতে কিছুদিন আগে ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতি কেসে গ্রামের আরও কয়েকজন উঠতি যুবকের লগে কামুকেও আসামি করা হয়েছে। কেসের তদবির করতে কামু এখন ঢাকায়। মিরপুরে আফাজউদ্দিনের দুর সম্পৰ্কীয় এক ভাইয়ের বাসায় থাকে। ভাইয়ের নাম হায়দার। হায়দারের মেজছেলে বুলু সেই বর্ষায় হঠাৎ করেই বেড়াতে এসেছিল পারুদের বাড়িতে। পারুর চেয়ে বছর তিন-চারেকের বড় হবে। দেখতে সুন্দর। মায়াবী চেহারা। একটু উদাস উদাস ধরনের। কথাটথা কম বলে। তবে ভারী সুরেলা গলা তার, ভারী সুন্দর গান করে।

পারুর মেজোবোনের নাম নাহার। তার বিয়া হইছে বৈলতলি গ্রামে। শ্বশুর নাই, এক বিধবা ননদ আর শাশুড়ির লগে সে থাকে গ্রামে, জামাই তার ছোটভাই নিয়া ঢাকার নিউমার্কেটের কাঁচা বাজারের ফুটপাতে বসে রেডিমেড জামাকাপড় বিক্রি করে। থাকে বাজারের লগের মেসে।

বাড়িতে সেবার পারু আর তার ছোট তিনটা ভাইবোন। পারুর পর এক ভাই মন্টু, মন্টুর পর বোন গোলাপি, তারপর সবশেষ ভাই মিজু। এই অবস্থায় হঠাৎ করেই বুলু এসে হাজির। যেদিন দুপুরের পর খাজুরতলার ঘাটে লঞ্চ থেকে নামল বুলু, সেদিন সন্ধার সময় একখান কেরায়া নৌকা এসে থামল পারুদের বাড়ির সামনের হালটে। নৌকা থেকে সপরিবারে নামল হালিম। মোরশেদার কোলে মাস সাতেকের ছেলে আর হালিমের হাতে ধরা তিন বছরের মেয়ে।

একদিনে দুই আত্মীয় বেড়াতে আসছে, বাড়িতে ভাল রকমের হইচই পড়ে গেল। রান্না খাওয়াদাওয়ার বেশ ভাল আয়োজন। তখন কয়েকদিন ধরে মেঘ বৃষ্টিটা একদমই নাই। আষাঢ়ের মাঝামাঝি সময়। ভাল গরম পড়েছে।

বাড়িতে ঘর মাত্র দুইটা, এতগুলি লোকের থাকার ব্যবস্থা কী হবে!

মেয়েজামাইকে বড়ঘর ছেড়ে দেওয়া হল। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে বুকের শিশুটিকে নিয়া স্বামীকে নিয়া বড়ঘরের দরজায় খিল তুলে দিল মোরশেদা আর পাটাতন ঘরে গিয়া ঢুকল বাকিরা। পাটাতন ঘরের দক্ষিণের জানালা ঘেঁষে বড় চৌকি। সেই চৌকিতে পশ্চিমে মাথা দিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা হল উত্তর দিক থেকে প্রথমে বুলু, বুলুর পর মিজু তারপর দক্ষিণের জানালা ঘেঁষে মন্টু।

চৌকির মাথার দিকে পাটাতনের উপর মোরশেদার তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে শুয়েছেন পারুর মা, পারু আর গোলাপির শোয়ার ব্যবস্থা হয়েছে উত্তর দিককার বেড়ার লগে, চৌকি বেড়ার মাঝখানকার জায়গায়। কিছু না ভেবেই বেড়ার দিকে শুয়েছিল গোলাপি আর চৌকি ঘেঁষে পারু। চৌকির ঠিক এদিকটাতেই বুলু শুয়েছিল।

অনেকরাত তরি বুলু সেই রাতে বাইরে।

ঘরে গরম। বাইরে ফুটফুটা জ্যোৎস্না। একটু একটু হাওয়া আছে। বাগানের দিকটায় হাঁটতে হাঁটতে গান গাইছিল বুলু। কোনও গানই পুরা না। যে গানের যতটুকু জানে ততটুকুই দরদ দিয়া, মায়াবী গলায় গাইছিল। একটা গানের কথা আজও মনে আছে পারুর।

আমিও পথের মতো হারিয়ে যাব
আমিও নদীর মতো আসবো না ফিরে আর
আসবো না ফিরে কোনওদিন!

বুলুর গান শুনে মন উদাস হচ্ছিল পারুর। ঘুম আসছিল না। ঘরের আর সবাই গভীর ঘুমে। পারুর ইচ্ছা হল সে একটু বাইরে যায়। বাইরে গিয়া সেও একটু পায়চারি করে উঠানে, কাপড় রোদ দেওয়ার যে তারটা টাঙানো আছে ওই তার ধরে চাঁদের আলোয় একটুখানি দাঁড়িয়ে থাকে।

মনের মধ্যে অন্যকোনও উদ্দেশ্য নাই, এমনিতেই বেরুতে ইচ্ছা হয়েছিল পারুর। শেষ তরি, বেরিয়েছিল সে। উঠানে গিয়ে তার ধরে উদাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

বুলু তখনও বাগানের দিকে হাঁটছে, গান গাইছে। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় উঠানের দিকে এল। এসে পারুকে দেখে চমকাল হয়তো, কোনও কথা বলল না। তখনও গান গাইছে সে। গান গাইতে গাইতেই পারুর পাশে এসে দাঁড়াল। আলতো করে একটা হাত রাখল পারুর কাঁধে। সেই প্রথম ওইরকম নির্জন রাতে কোনও পুরুষের স্পর্শ। পারুর। শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। শরীরের ভিতরকার কোন অচিনস্তরে গিয়ে যেন নাড়া দিল এই স্পর্শ। পারু কথা বলল না, নড়ল না, কাঁধ থেকে বুলুর হাত সরিয়েও দিল না। চাইল হাতটা বুলু তার কাঁধেই রাখুক। যতক্ষণ ইচ্ছা রাখুক।

শুধু পারুর কাঁধেই তারপর হাতটা রাখেনি বুলু। শুধু একটা হাতই পারুর শরীরের রাখেনি। একসময় পেছন থেকে দুইহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে পারুকে। পারুর বুকে পেটে হাত বুলাতে শুরু করেছে। কখন কোন ফাঁকে পারুর পেটের কাছ থেকে জামা তুলে হাত দিয়েছে ভোলা বুকে।

পারু তখন অদ্ভুত এক রোমাঞ্চে ডুবে গিয়েছিল, আশ্চর্য এক ভাল লাগায় আচ্ছন্ন। হয়েছিল। সে চাইছিল বুলু যা করছে তা আরও করুক, শরীরের যেখানে ইচ্ছা হাত দিক, যা ইচ্ছা করুক।

কিন্তু ঘরের দুয়ারখোলা। এতগুলি মানুষ একটা ঘরে শুয়ে আছে। যে কেউ যখন তখন বেরুতে পারে, কোনও কিছুই খেয়াল করছিল না পারু। হয়তো বুলু আড়চোখে পাটাতন ঘরের দরজার দিকে তাকাতে পারে। সে হয়তো একটু সাবধানি ছিল।

এভাবে কতটা সময় কেটেছিল মনে নাই পারুর। শুধু মনে আছে একটা সময়ে সে টের পাচ্ছিল তার শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে, তার শরীর যেন গলে গলে যাচ্ছে। পুরুষ মানুষের স্পর্শে যে এমন জাদু সেই প্রথম টের পাওয়া পারুর।

বাকি রাতটুকু পারুর শরীর নিয়ে অন্য এক খেলা খেলেছিল বুলু।

ঘরে চলে আসার পর যে যার জায়গায় শুয়ে পড়েছিল তারা। বুলু চৌকিতে আর ঠিক তার পাশে মেঝের পাটাতনে পারু। কিছুক্ষণ পরই পারু টের পেল চৌকি থেকে বুলুর একটা হাত নেমে এসেছে নীচে আর সেই হাত তার শরীরের আনাচে কানাচে বিচরণ করছে।

সারারাত ওভাবেই কেটেছিল। শুধু হাতাহাতিতেই যেন পুরাপুরি সন্তুষ্ট হতে পারছিল না পারু। সে চাইছিল চৌকি থেকে নিঃশব্দে তার শরীরের উপর নেমে আসুক বুলু, পুরুষমানুষরা যা করে তাই করুক। কিন্তু বুলু বোধহয় সাহস পায়নি।

পরদিন ভোরবেলা পারু টের পেল তার মাথা ধরে আছে। কিছু ভাল লাগছে না।

সেবার বুলু ছিল তিনদিন, তিনরাত। তিনরাত ধরে একই রকমের আচরণ চলল। আর তিনটি দিন তিনটি রাত পারুর মাথা এক রকম ভাবেই ধরে থাকল। আশ্চর্য ব্যাপার দিনেরবেলা পারু এবং বুলুর অবিরাম দেখা হচ্ছে কিন্তু রাতের ওই আচরণ নিয়ে কেউ কোনও কথা বলছে না, এমনকী কোনও ইঙ্গিতও করছে না। যেন রাতেরবেলা যে আচরণটা একজন মানুষ আরেকজনের শরীর নিয়া করছে সেটা যেন একেবারেই অন্য বিষয়, যে বিষয় নিয়া দিনের আলোয় কথা বলা যায় না। আর সেই প্রথম পারু টের পেল বুলুর লগে তার আচরণটা ছিল অসম্পূর্ণ। আচরণটা পূর্ণ হয় নাই বলে তার মাথা ধরেছে।

এসব ক্ষেত্রে মাথা কি শুধু মেয়েদেরই ধরে? পুরুষমানুষের ধরে না? এই প্রশ্নের উত্তর আতাহারের লগে সম্পর্ক হওয়ার কিছুদিন পর পেয়েছিল পারু। বসন্তের সেই মনোরম বিকালে বুলুর কথা মনে পড়েছিল পারুর, সেই ঘটনার কথা মনে পড়েছিল। সেবার সেই যে প্রথম মাথা ধরেছিল, বিয়ার পর ছয়-সাত মাস ধরে যেন সেই মাথা ব্যথাটাই পাকাপাকি ব্যবস্থা করে নিয়েছে মাথায়, অবিরামই হচ্ছে। কোথায় বিয়ার পর শরীরের চাহিদা পূরণ হবে, স্বামীর কারণে মাথা ব্যথা দূর হবে চিরতরে, তা না ব্যথা স্থায়ী হয়ে গেল। স্বামী যেন স্বামী না, স্বামী যেন সেই ছেলেবেলার আরেকজন বুলু। জাগিয়ে দেয়, নিবৃত্ত করে না।

সেই বিকালেই পারুর জীবনে এসেছিল আতাহার। একজন প্রকৃত পুরুষ। যে জাগাতে জানে, নিবৃত্ত করতে জানে।

কাছাকাছি বয়সের বলে আতাহারের লগে মধুর একটা সম্পর্ক ছিল পারুর। একে দেবর দুয়ে দূর সম্পর্কের ভাই, যখন তখন নানারকমের খুনসুটি তারা করত। সেই বিকালেও খুনসুটি করতেই আতাহার আসছিল। উত্তর দিককার জোড়া হিজলগাছের তলার পায়েচলা পথ দিয়ে চক থেকে উঠে এসেছিল আতাহার। আথালের পাশের আমগাছ তলায় ঘাপটি মেরে দেখেছিল ভাবিছাব কী করে! তারপর পা টিপে টিপে এসে পিছন থেকে চোখ টিপে ধরেছে পারুর। পারু লগে লগেই বুঝে গেছে কাজটা কার। তয় আতাহারের হাতের ছোঁয়া যেন আজ অন্যরকমভাবে উপলব্ধি করল সে। আগেও যে আতাহার তার লগে এই ধরনের আচরণ না করেছে এমন না, তবে ঠিক এভাবে যেন উপলব্ধি করেনি পারু। তা ছাড়া তার গ্রীবার কাছে পড়ছিল আতাহারের শ্বাস প্রশ্বাস, কেমন যেন উষ্ণতাও ছিল সেই শ্বাস প্রশ্বাসে। ফলে শরীরের ভিতর সেই ছোটবেলাকার আমেজ ফিরে আসছিল পারুর। মনে হচ্ছিল আতাহার যেন আতাহার না, তার স্বামীর ভাই, দেবর না, আতাহার যেন সেবারের সেই উদ্দাম বর্ষাকালের বুলু। তার শরীর শুধুই জাগিয়ে দিবে যে, নিবৃত্ত করবে না।

কিন্তু অবিরাম শুধুই শরীরের জাগরণ, শুধুই মাথা ধরা, একজন একজন করে তিন তিনজন পুরুষ ছোঁবে তাকে, যা ইচ্ছা তাই করবে তার শরীর নিয়া, বিনিময়ে শুধুই মাথা ব্যথা, কতকাল ধরে চলবে এই খেলা!

পারু তারপর নির্লজ্জের মতন একটা কাজ করেছিল। চোখ থেকে আতাহারের হাত সরিয়ে না দিয়ে নিজের কোমল মসৃণ হাতে তার চোখের ওপর ধরা আতাহারের হাতে বুলাতে শুরু করেছিল। এই স্পর্শে কী ছিল কে জানে, আতাহার প্রথমে একটু চিন্তিত হয়, তারপর সেও কেমন অন্য মানুষ হয়ে ওঠে। মুখ নামিয়ে নেয় পারুর গ্রীবার কাছে, চোখ থেকে দুইহাত নামিয়ে নেয় পারুর বুকে। গভীর আবেশে চোখ বুজে পারু শুধু বলেছিল, ঘরে লও ছোডমিয়া।

সেই সন্ধ্যায় পারু টের পেল সত্যিকার পুরুষমানুষ কেমন! সাতমাস ধরে মাথায় চেপে বসা ব্যথা সেই সন্ধ্যায় উধাও হয়ে গেল। সেই প্রথম আতাহারের জন্য পাগল হল সে। আজ বারো বছর ধরে সেই একই রকম পাগল হয়ে আছে।

.

চাঁদের আলোয় ভোররাতের দিকে মোতাহারের বিধবা বউ পারুর ঘর থেকে আতাহারকে বেরিয়ে যেতে দেখল মুকসেদ, মুকসেইদ্দা চোরা। মাঝরাতে এই বাড়িতে এসে ঢুকেছে সে। তিন শরিকের প্রত্যেকের সীমানায়ই ছায়ার মতন ঘুরে বেরিয়েছে। কোথাও চুরি করার মতন কিছু আছে কি না খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। গ্রামগিরস্তের বাড়িতে উঠান পালানে, ঘরের ছনছায়, গাছতলায় কখনও চুরি করবার মতন কিছু পড়ে থাকে না একথা মুকসেদ তার দীর্ঘ চোরজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জানে। দুই পয়সা দামের জিনিসও যত্ন করে ঘরে নিয়ে তুলে রাখে গিরস্তবাড়ির বউঝিরা। সুতরাং এই বাড়িতে যে কিছু পাওয়া যাবে না তা মুকসেদ ভাল করেই জানে।

আর পাওয়া গেলেই কি চুরিটা আজ মুকসেদ করবে! গ্রামে ফিরার পর কাজটা কি সে। আজ পর্যন্ত করেছে! ফিরার দিন সন্ধ্যার পর পর দবির গাছির বাড়িতে গিয়া এতবড় সুযোগ পেয়েও তো শেষ পর্যন্ত চুরিটা সে করে নাই। মনের ভিতর গন্ডগোল লেগে গিয়েছিল। গন্ডগোলটা অবশ্য জেলখানায় থাকা অবস্থাতেই কমবেশি শুরু হয়েছিল।

বয়স মুকসেদের ম্যালাই হয়েছে। মান্নান মাওলানার চেয়ে বয়সে সে ছোট, তবে খুব ছোট না। ষাট-বাষট্টি তো হবেই। অন্যান্য পেশায় যারা থাকে এই বয়সে তারা কাজকর্ম ছেড়ে ঘরে বসে আল্লাহ বিল্লাহ করে। কাজকর্ম করে ছেলেরা। যদিও মুকসেদের সংসার। নাই, যৌবন বয়সে বছর চারেকের জন্য সংসার একবার হয়েছিল। আড়াই বছরের একটা ছেলে রেখে বউটা মরল কলেরায়। ছেলেটাকে নিয়া গেল মুকসেদের ছোট বোন রিজিয়া। সে থাকে কক্সবাজার ছাড়িয়ে আরও দূরের নাফনদীর তীরবর্তী শহর টেকনাফে। তার স্বামী সেখানে পুঁটকি মাছের কারবার করে। দিনে দিনে মুকসেদের ছেলে হয়ে গেছে রিজিয়ার ছেলে। রিজিয়ার জামাইকেই বাপ ডাকে, বাপের সঙ্গে সেও পুঁটকি মাছের কারবার করে। বছর দুয়েক আগে ছেলে বিয়া করছে এক রাখাইন মেয়ে এই খবরও মুকসেদ পেয়েছে। তয়। মুকসেদের লগে সেই ছেলের যোগাযোগ নাই। মুকসেদকে সে চিনেই না। চিনলেও প্রকাশ করে না। বাপ দাগি চোর হলে তার পরিচয় দেয় কোন ছেলে? আপন বোন হয়ে রিজিয়াই। তো পরিচয় দেয় না। নিতান্তই মা-মরা ছেলেটাকে দেখে মায়া লেগেছিল বলে কোলে করে চিরতরে টেকনাফে নিয়ে গিয়েছিল। কোনওদিন মেদিনীমণ্ডল গ্রামে আর ফিরতে দেয় নাই। নিজেও আর কখনও আসে নাই বাপের বাড়িতে। দুই ভাইয়ের একমাত্র বোন যে সে, সেই কথা ভুলে গেছে।

তয় মুকসেদের ছোটভাই আক্কাস পারে নাই তার ভাইকে ভুলতে, পারে নাই ভাইকে ফেলতে। সে নিতান্তই গোবেচারা গিরস্ত। বাপদাদার সম্পত্তি তিন ভাইবোনে যা ভাগে পেয়েছে সব সে একাই ভোগ করে। ধান পাট তিল কাউন সরিষা কলুই সবমিলে ফসল পায় ভালই। আথালে গোরু আছে পাঁচ-সাতটা, সংসারে পোলাপান আছে আটজন, তিন মেয়ের বিয়ে দিয়ে ফেলেছে। অল্পবয়সেই বড় মাজারো পোলা বিয়া করছে, ছেলের ঘরের নাতিনাতকুড়ও আসছে আক্কাসের সংসারে। পাঁচ ছেলের তিনজন গেরস্তি কাজ করে বাপের লগে। চার নম্বরটা ঢাকায় কোন এক ব্যাঙ্কের দারোয়ান, একদম ছোটটা মাওয়ার বাজারে চায়ের দোকান দিয়েছে। সবমিলে বেশ জমজমাট সংসার আক্কাসের। চুরির দায়ে জেল খেটে আক্কাসের সংসারেই ফিরে মুকসেদ। জেলে যাওয়ার আগেও এই বাড়িতেই তার বাস। পশ্চিমের ভিটির ভাঙাচোরায় দিনভর পড়ে পড়ে ঘুমায়, আর রাত হলেই চুরি করতে বের।

এবার তার মন চুরিচামারিতে টানছে না। ফিরার দিন দবির গাছির বাড়ি থেকে যখন বেরিয়ে আসছে, তখন অল্পের জন্য তিনজন মানুষের গায়ের ওপর গিয়ে সে পড়েনি। মানুষের পায়ের শব্দ পেয়েই ঘরের পিছনে গিয়ে ঘাপটি মেরেছিল। পরে মানুষ তিনজনের কথাবার্তায় বুঝেছে দবির তার বউ হামিদা আর মেয়ে নূরজাহান বড় রকমের বিপদে পড়েছে। বিপদটা কী বিস্তারিত বোঝার আগেই দবির গাছির বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল সে। বাড়ি এসে সেই রাতেই আক্কাসের মুখে ঘটনা শুনেছে। শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে। ওইটুকু মেয়ে নূরজাহানের তো সাহস আছে! মান্নান মাওলানার মুখে থুতু ছিটায়া দিছে! যাক ওই বাড়িতে চুরি না করে সে ভালই করেছে।

অবশ্য জেলখানায় বসে আর চুরি না করার একটা সিদ্ধান্ত মুকসেদ এবার নিয়েছিল। সংসার জীবন নাই, কোনও পিছুটান নাই সুতরাং চুরি তার করবার দরকার কী? কে খাবে তার চুরির পয়সা?

তা ছাড়া বয়সও হয়েছে, একটা বয়সে এসে যে-কোনও কাজ থেকেই অবসর নেয় লোকে। মুকসেদই বা নিবে না কেন? হোক না চুরি! চুরি কি কাজ না? চোরের কি অবসর নাই?

তার ওপর চুরি শুরু করার পর থেকে জীবনটা জেলে জেলেই কাটল। পুলিশের রোলের বাড়িতে শরীরের হাড়গোড়, মাংস চামড়া সবই লোহা হয়ে গেছে। মারধরটা আজকাল সহ্যও হয় না। বাড়িগুলি এখন আর শরীরে লাগে না। শরীরের যেখানেই পড়ুক লাগে মাথার তালুতে গিয়া, বুকের মাঝখানে লুকিয়ে থাকা রুহের গোড়ায়। এইসব কারণেই চোর জীবনটা বাদ দিতে চাইছে মুকসেদ। অবসর নিতে চাইছে।

তয় বহু বছরের পুরনো অভ্যাস। মুক্ত জীবনে থাকলেই রাতেরবেলা ঘুম আসে না। মন উচাটন হয়ে চুরির ধান্ধায়। ঘরে মন বসেই না। পা উসপিস উসপিস করে। খালি এইবাড়ি ওইবাড়ি যাইতে ইচ্ছা করে।

আজ রাতেও এই কারণেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছে মুকসেদ। বেরিয়ে দূরে কোথাও যায়নি। নিজেদের বাড়ির সীমানার ঢাল বেয়ে নেমে মান্নান মাওলানার বাড়ির তিন নম্বর শরিক গণি মিয়ার সীমানায় উঠেছে। গণি মিয়া ঢাকায় চলে গেছে কয়দিন হল। বাড়িতে রেখে গেছে মতিমাস্টার, তার বউ আর অথর্ব দুই ছেলেমেয়ে। তাদের লগে আছে বাড়ির কুকুরটা। আজ রাতে মুকসেদকে তাদের সীমানায় উঠতে দেখেই দৌড়ে এল তবে তেমন ঘেউ ঘেউ করল না। কারণ ঢাকায় যাওয়ার কয়দিন আগেই নিজের মনিব গণি মিয়ার লগে এই লোকটাকে কথা বলতে দেখেছে কুকুরটা। গত দু-আড়াই মাসে দিনরাত মিলে দুই-চারবার তাদের সীমানার পুবদিককার বাড়িটায়ও লোকটাকে সে দেখছে ঘরের ছাইছে দাঁড়িয়ে বিড়ি সিগ্রেট টানছে। দেখে দেখে চিনা হয়ে গেছে। লোকটা চোরাচড় কি না বুঝতে পারছে না।

রাতেরবেলা বাড়ি থেকে সব সময়ই খালি গায়ে বেরোয় মুকসেদ। শীত গরম নাই শরীরের উপরের অংশ খালিই থাকে। নিম্নাঙ্গে লুঙ্গি যতটা সম্ভব শক্ত আর খাটো করে কাছা মারা। তার উপর কোমরের কাছে লুঙ্গি যেখানে গিটই দেওয়া ঠিক সেখানে একখান পুরনো লম্বা ধরনের গামছা লুঙ্গির মতোই শক্ত করে গিটঠ দিয়ে বাঁধে। গলা থেকে পায়ের গুড়গুড়া তরি সরিষার তেল এমন ভাবে মেখে নেয়, যেন তেল মাখে নাই শরীরে, যেন পুকুর থেকে এইমাত্র ডুব দিয়া উঠছে।

এরকম তেলমাখার কারণ চুরি করতে গেলে আচমকা যে কেউ দুইহাতে জাবরে (জাপটে) ধরবে, বা থাবা দিয়ে ধরবে হাত পা, ধরলেও ধরে রাখতে পারবে না। শোলমাছের মতন পিছলে যাবে মুকসেদ। কাছা মারা লুঙ্গির দিকটাও যে থাবা দিয়ে ধরবে, তাও পারবে না, গিঁট খুবই কায়দা করে দেওয়া। থাবা দিয়া ধরেও হাতের মুঠায় রাখতে পারবে না, খুলে ল্যাংটাচোংটা করে ফেলতে পারবে না মুকসেদকে। একে শরীরে মাখা চপচপা তেল তার ওপর ধরার লগে লগে মাছের মতন পিছলে যাওয়ার সব কায়দা দীর্ঘদিন ধরে রপ্ত করেও ধরা জীবনে কম পড়ে নাই মুকসেদ। আর ধরা পড়ার পর যে দশা হয়েছে, বহুবার মরতে মরতেও মরে নাই। পুলিশের রোলের বাড়ি আর জেল তো পরের কথা, তার আগে ধরা পড়ার লগে লগে গিরস্তের যে মাইরটা আছে সেটার কোনও তুলনা নাই। কেচকি মাইর বলে একখান মাইর আছে, সেটা হল মাইরটা যে বেদম ভাবে মাইরা হইছে বাইরে থেকে দেখে বোঝাই যাবে না। মনে হবে একদমই মারা হয়নি। শরীর চেহারা একেবারেই তেলতেলে তয় তলে তলে দশা কেরাসিন। কেচকি মাইর খেয়ে বসে আছ তো ঠিক আছে, উঠে দাঁড়াতে গেলেই টের পাওয়া যাবে মাইরটা কী পরিমাণ হয়েছে।

কেচকি মাইর জিনিসটা আসলে হাড়ের জোড়ায় জোড়ায় মারা হয়, পায়ের তালুতে, হাতের তালুতে মারা হয়। হাত দুয়েক লম্বা হেঁচা কাঠের মুঠ পরিমাণ মোটা, তেল চকচক একখান রোলার দিয়া হাড়ের জোড়াগুলি, যেমন পায়ের হাঁটু, গোড়ালি, হাতের কনুই, কবজি এসব জায়গা বেছে বেছে রোলার দিয়া বেদম পিটানো, চিত করে ফেলে বুকে চেপে থাকবে দুই-তিন জুয়ান আর আরেকজন রোলার চালাবে পায়ের তালুতে, কখনও কখনও এক রোলারের উপর হাত পায়ের আঙুল লম্বা করে বসিয়ে আরেক রোলার দিয়া আঙুলের জোড়াগুলিই পিটানো, এই হচ্ছে কেচকি মাইর। জীবনে এক-দুইবার ওই মার খেলে বাপের নাম ভুলে যেতে সময় লাগে না।

কেচকি মাইর জীবনে মুকসেদে খেয়েছে পাঁচ-সাতবারের কম না। শেষবার তো এমন খাওয়া খেল, সাতঘরিয়ার এক বাড়িতে চুরি করতে গিয়া ধরা পড়ছিল, কেচকি মাইর খেয়ে একদম ভাল মানুষের কায়দায় উঠানে বসে আছে, লৌহজং থানার পুলিশ দারোগা এসে মোটা দড়ি দিয়া কোমর বরাবর বাঁধল, দাঁড়াতে বলার পর মুকসেদ তো আর উঠে দাঁড়াতে পারে না! দারোগা পুলিশ দড়ি ধরে টানছে। কী রে মুকসেইদ্দা, উঠছিস না কেন?

মুকসেদ কিছুতেই উঠতে পারে না। দুই-একবার উঠবার চেষ্টা করেই নেতিয়ে পড়ছে।

সেবারের দারোগাটি ছিল অল্পবয়েসি, বুদ্ধিমান মানুষ। মুকসেদের দশা দেখে বুঝল কারবারটা কী হয়েছে। গিরস্তের নাম মকবুল ফারাজি, তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, কারবার তো মন্দ করেননি দেখি!

শুনে লোকটা আকাশ থেকে পড়ল। কীয়ের কারবার ছার (স্যার)। আমরা তো কোনও কারবার করি নাই। চোর ধরছি ঠিকঐ তয় ফুলের টোকাডাও শইল্যে দেই নাই। দিলে তো দেকতেনঐ। দেহেন, ভাল কইরা দেহেন, শইল্যে কোনও দাগ আছে চোরার!

দারোগা হাসলেন। উপরের দাগ দিয়েই কি সব কিছু হয়! কিছু দাগ আছে দেয়া হয় শরীরের উপর দিয়েই কিন্তু দাগটা পড়ে গিয়ে ভিতরে। এই বিষয়ে আপনারা যে খুবই এলেমদার তা আমি বুঝেছি।

শুনে মুকসেদ কাঁদোকাঁদো গলায় বলেছিল, ঠিকঐ কইছেন ছার। ভিতরের দাগে ফরাজিরা এইবার আমারে দাগাইছে। এমুন দাগাইন জিন্দেগিতেও খাই নাই। এর থিকা বাঁশডলা বহুত ভাল।

দীর্ঘ চোরজীবনে বাঁশডলাও কয়েকবার খেয়েছে মুকসেদ। কান্দিপাড়ার গাজীবাড়িতে বছর কয়েক আগে চুরি করতে গিয়া পাঁচজনের মধ্যে তিনজনই তারা সেবার ধরা পড়ল। সে নওশের আর রহা, রহমত। ধরা পড়ার পর বাড়ির উঠানে ফেলে তাদের উপর একত্রে বাশলা চালাল গাজীরা।

বাঁশডলা জিনিসটা কায়দার। মাটিতে উপুড় করে ফেলে, হাত আটেক লম্বা শক্ত ধরনের একখান বাঁশের দুইমাথায় দুইজনে ধরে উপুড় হওয়া লোকটার পা থেকে মাথা তরি বেলুনে রুটি বেলার মতো করে বেলে। তাতে উপুড় হওয়ার দিকটার ছাল চামড়া কিছুক্ষণের মধ্যেই ছিলা মুরগির রূপ ধারণ করে, আর শরীরের ভিতরকার হাড়গোড় হরমাইলের মতন পটাপট ভাঙতে শুরু করে।

এ ছাড়াও কত পদের মার যে জীবনটা ভর খেল মুকসেদ! একবার এক কাঠমিস্ত্রির বাড়ি ধরা পড়ার পর কাঠের গায়ে অযথা গেঁথে থাকা পেরেক সাঁড়াশি দিয়ে যেভাবে টেনে তোলে সেভাবে বুড়া মিস্তিরিটা মুকসেদের হাত পায়ের প্রায় সবগুলো নখ টেনে তুলে ফেলেছিল।

আরেকবার সমষপুরের এক বাড়িতে নখের তলা দিয়া ইয়া লম্বা লম্বা, মোটা মোটা সঁচ ঢোকাল কয়েকজন মিলে।

এ ছাড়া লাথথি গুঁতা, ইটা মুগুর দিয়া পিটানো, বাঁশ দিয়া পেটানো, কন্নি (কনুইয়ের গুঁতো), মুক্কি (এক ধরনের ঘুসি), কিল ঘুসি থাপ্পড়, এমনকী ঠোকনা (ঠোনা) পর্যন্ত খেতে হয়েছে। অর্থাৎ এমন কোনও মাইর নাই জীবনে যা না খেয়েছে মুকসেদ। বাঁ দিককার কানের লতিটাও তো একবার কেটে দিল কোলাপাড়ার এক কাঁচারু বাড়ির লোকজন। দুই তিনবার নাইড়া করে মাথায় গোবর দিয়া দিছে। একবার শিমুলিয়ার এক গিরস্ত বাড়িতে ধরা পড়ার পর ব্লেড দিয়া বুক পিঠের অনেক জায়গা কেচেছিল গিরস্ত বাড়ির লোক, তারপর দলা দলা লবণ মাখায়া দিছিল।

গণি মিয়ার সীমানায় দাঁড়িয়ে আজ রাতে এসব কথা মনে পড়ছিল মুকসেদের। তারপর হঠাৎ করেই যেন মনে হল, আইচ্ছা, এমুন পাকা চোর হওনের পরও এতবার ধরা আমি পড়ছি ক্যান?

গণি মিয়ার সীমানা থেকে মন্তাজদের সীমানার দিকে যেতে যেতে মুকসেদ মনে মনে গুনতে শুরু করল মোট কতবার গিরস্তের হাতে ধরা পড়েছে সে, কতবার জেলে গেছে।

আটবার।

এই আটবারের প্রত্যেক বারই যে জেলে যেতে হয়েছে তা না। তিনবার থানা পুলিশ জেল তরি গড়ায়ইনি ব্যাপার। এমন মার গ্রামের লোকরা দিছে, মাইরের চোটে হেগেমুতে একসা হয়েছে মুকসেদ, জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। মৃত ভেবে জঙ্গলে, ডোবা নালায় নয়তো ধানের খেতে ফেলে দিয়েছে। একবার কবুতরখোলার সর্দারবাড়ির লোকেরা শুধু মুখ বরাবর লাঠি চালিয়েছিল। লাঠি চালাতে চালাতে একটা কথাই তারা বলছিল, যেই মোক দিয়া চুরির জিনিস খাচ হেই মোক শেষ কইরা দিমু।

অবিরাম লাঠির বাড়িতে মুখের ভিতর মুকসেদের দুই-তিনটি দাঁত কদু বিচির মতন ঝরে পড়েছিল। পরে থুতু ফেলার সময় মুখের লালা আর রক্তের লগে মাটিতে পড়েছিল।

আর যে পাঁচবার থানা পুলিশের হাতে পড়েছে, মাইর তো একটা সেখানেও আছে। সব মিলিয়ে জীবনটা মুকসেদের মাইর খেতে খেতেই গেল। তবু স্বভাবটা সে বদলাতে পারল না, অভ্যেসটা বদলাতে পারল না। এখনও রাতদুপুরে লুঙ্গি কাছা মেরে, মাজার কাছে গামছা বান্দা, গায়ে চপচপা তেল, বাড়ি থেকে বেরোয় মুকসেদ। গিরস্তবাড়ি ঢুকে পিড়ার দিকে তাকিয়ে সিঁদ কাটার স্বপ্ন দেখে।

এবারের ভাবটা নিজের কাছেই কেমন যেন অন্যরকম লাগছে মুকসেদের। সেই যে সেদিন, গ্রামে ফিরার দিন লঞ্চঘাটের চায়ের দোকানে পিয়ার খাঁ-র বাড়ির ওদিককার লোকটা তাকে চিনার পরই মাওয়ার বাজারে গিয়া মোচ দাড়িটা কামিয়ে মুখটা ফকফকা করে ফেলেছে। চুলে দিছে কদমছাট। তারপর গত দুই-আড়াই মাসে আরও তিনবার মাথায় কদমছাট দিছে, দুই-চারদিন পর পর বাড়িতে বসেই মুখ বানাচ্ছে। সব মিলিয়ে মুকসেদ এখন আর পুরনা মুকসেদ নাই। নতুন হয়ে গেছে। মোচ দাড়ি আর চুল যে মানুষকে এমন করে বদলে দিতে পারে বহুদিন পর টের পেল মুকসেদ। তখন থেকেই থেকে থেকে মনে হয় চেহারার মতো করে মনটাও যদি ফকফকা করে ফেলা যেত! মনের উপর মোচ দাড়ির মতন দাগি চোরের যে স্বভাবটা রয়ে গেছে সেটা যদি কামিয়ে ফেলা যেত!

চেষ্টা ভিতরে ভিতরে যে না করছে মুকসেদ তা নয়। গণি মিয়াকে সেদিন বলেছেও যে ওসব সে ছেড়ে দিছে। এখন থেকে ভাল হয়ে যাবে।

তয় এতদিনের অভ্যাস চট করে কি আর বাদ দেওয়া যায়! রাত হলেই, ঝিঁঝিপোকারা ডাকতে শুরু করলেই মনের ভিতর থেকে ডাক দিয়ে যায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের পুরনা একজন চোর, মুকসেইদ্দা চোরা।

মুকসেদের পিছন পিছন লেজ নাড়াতে নাড়াতে মন্তাজের সীমানা তরি এল গণি মিয়ার কুত্তাটা। এদিক ওদিক দুই-তিনবার মুখ ঘুরিয়ে আবার ফিরে গেল নিজেদের সীমানায়।

রাত এখন কতটা হয়েছে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় আন্দাজ করতে পারে মুকসেদ। ভোর হওয়ার আরও ঘণ্টা তিনেক বাকি। এসময় মানুষের ঘুম গাঢ় হয়। সহজে ভাঙতে চায় না। গিরস্তের ঘরে সিঁদ কেটে ঢোকার এই হচ্ছে মোক্ষম সময়। ইচ্ছা করলেই বাড়ি গিয়া একটা শাবল এনে যে-কোনও ঘরের পিড়ায় শাবল চালাতে পারে সে। মানুষ ঢুকে যাওয়ার মতন। গর্ত করে ঢুকে যেতে পারে। বেরুবার সময় তো দরজা খুলেই বেরুবে। শরীরে তেল মাখা তো আছেই, লুঙ্গিও কাছামারা আছে।

না, এই কাজটা মুকসেদ করবে না।

আর মান্নান মাওলানার বাড়িতে চুরি যদি তাকে করতেই হয় বড় রকমের চুরি তো সে ইচ্ছা করলেই করতে পারে। আথালে এতগুলি গোরু বান্দা। জুয়ান তাগড়া দামি একখান গোরু খুলে নিলেই হল। দুইটো নিলে একা সামাল দেওয়া যাবে না। একটা নিলে টেনে হিঁচড়ে পথে নামাতে সুবিধা হবে। তারপর বাড়ির যে-কোনও শরিকের রান্নাঘর বা কদু কুমড়ার ঝকা থেকে বাঁশের কঞ্চি জোগাড় করে ওই দিয়া গোরুটার পাছায় দু-চার ঘা দিলেই সেটা সামনে হাঁটতে থাকবে। এখন গোরু নিয়া রওনা দিলে ভোরবেলা গিয়া পৌঁছানো যাবে দেলভোগের হাটে। দুপুর নাগাদ বিক্রি করে নগদ টাকা কেঁছড়ে নিয়া বাড়ি ফিরা যাবে।

তয় গোরু চুরি মুকসেদ করবে না। চোর কথাটা ভাল, গোরুচোর খুবই খারাপ। জীবনে। গোরুচোর কখনও হয় নাই মুকসেদ। তার নামের লগে গোরুচোর কথাটা যুক্ত হয়নি। চোর হলেও তার একটা সম্মান আছে, নীতিধর্ম আছে। এই বয়সে এসে সেই সম্মান আর। নীতিধর্ম কিছুতেই বিসর্জন দিতে পারে না।

মন্তাজের বড়ঘরের ভিতর থেকে কাশির শব্দ এল। মন্তাজের এখন যাই তখন যাই মা ঘ্যারঘ্যারা গলায় কাশছে। তিন-চারবার কেশেই থেমে গেল। তালুকদার বাড়ি আর কামারবাড়ির মাঝবরাবর পুবদিকে ধানি মাঠের কোনায় যে বিশাল মেঘশিরীষের গাছ সেই গাছের দিক থেকে ভেসে আসছে কোকিলের একটানা ডাক। মেঘশিরীষের ডালপালার আড়ালে বসে আকাশ থেকে আসা চাঁদের আলোর দিকে মুখ তুলে হয়তো ডেকে যাচ্ছে প্রকৃতির যৌবনে মগ্ন হয়ে থাকা পাখি। রাতের মধ্যযাম শেষ হয়ে আসার সময়কার নির্জনতায় এই ডাক যেন এই পরিচিত দেশগ্রাম আর দুনিয়া ছাড়িয়ে বহুদূরের কোনও অচিনলোকে পাড়ি জমাচ্ছে। রাতের এসময় শীতল বাতাস বয়। চাঁদ পশ্চিমে হেলে পড়েছে বলে গিরস্তবাড়ির ঘরদুয়ার তয় গাছপালার ছায়া পড়েছে উঠান পালানে। মন্তাজের সীমানায়, উঠানের এক কোণে নিমগাছ। নিমের ঝিরকিকাটা বড় রকমের ছায়া পড়েছে উঠানের অনেকখানি জুড়ে। হাওয়ায় নিমের ডালপালা দুলছে দেখে উঠানে পড়া ছায়াও দুলছে। পুবদিক থেকে উড়ে আসা একটা বাদুড়ের ডানার ছায়াও পড়ল উঠানে। ঠিক তখনই আনমনা চোখে মোতাহারের ঘরের দিকে তাকিয়েছে মুকসেদ, দেখে নিঃশব্দে খুলে যাচ্ছে সেই ঘরের সামনের দিককার দরজা, দেখেই চট করে নিমগাছটার পিছনে সরে গেছে মুকসেদ, চোখ খুলে যাওয়া দরজার দিকে। তারপরই আতাহারকে পরিষ্কার দেখতে পেল সে। লুঙ্গির ওপর হাফহাতা গেঞ্জি পরা। ঘর থেকে বেরিয়েই এদিক ওদিক তাকিয়ে। দ্রুত পা চালিয়ে নিজেদের বাংলাঘরের দিকে চলে গেল। আর মোতাহারের বউ নিঃশব্দে বন্ধ করে দিল দরজা। দুইজন মানুষের আচরণই চোরের মতো। চোরের মতো সাবধানতা, চোরের মতো শব্দ বাঁচিয়ে চলা।

এই দেখার পর মুকসেদের মনে হল সে তার এতদিনকার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছে প্রত্যেক মানুষের ভিতরই একজন চোর বসবাস করে। জীবনের কোনও না কোনও সময়ে সেই চোরটি বেরিয়ে আসে, লোকের অগোচরে কিছু না কিছু চুরি করে। কখনও কখনও নিজের অগোচরেও করে, নিজের কাছ থেকেও কিছু না কিছু চুরি করে। সমাজ সংসার স্ত্রী সন্তান, মা বাপ ভাই বোন, আত্মীয় স্বজন বা প্রাণের মানুষ প্রত্যেকের সঙ্গেই প্রত্যেকের চলছে এক ধরনের চৌর্যবৃত্তি। এমনকী প্রকৃতির মধ্যেও যেন চলছে এক বিশাল চৌর্যবৃত্তির খেলা। গাছপালা, শস্যচারা মাটিকে জানান না দিয়ে মাটি থেকে রস শুষে নিয়ে বেঁচে থাকছে, নদী-সমুদ্রকে জানান না দিয়ে মাথার ওপরকার বিশাল আকাশ মেঘ তৈরির জন্য টেনে নিচ্ছে পানি, রোদের ছদ্মবেশে সূর্যের আলো শুষে নিচ্ছে মাটির রস, বহতা হাওয়ার মধ্যেও যেন আছে এক চোরের বসবাস। এমন করে নিঃশব্দে বইছে, বহু সময়ই মানুষ যেন তা বুঝতে পারে না। আর জীবন অবসানের যে প্রক্রিয়া মৃত্যু, সে। তো আসে একেবারেই চোরের মতো। রুহ কবচ করতে মহান আল্লাহতায়ালার প্রেরিত ফেরেশতা আজরাইল মানুষের শিয়রে এসে দাঁড়ান একেবারেই নিঃশব্দে, কখনই কাউকে বুঝতে দেন না কখন তিনি আসবেন, কখন কবচ করবেন আল্লাহর বান্দার জান।

এসব ভেবে নিজের চোরজীবন নিয়ে কেন যে আর কোনও আক্ষেপ রইল না মুকসেদের! ভোররাত তরি মান্নান মাওলানার বাড়িতে ঘুরঘুর করে ফজরের আজানের আগে আগে নিজেদের বাড়ির দিকে ফিরতে গিয়া গণি মিয়ার সীমানায় মাত্র আসছে মুকসেদ, দেখে উঠানের এক কোণে দুই-তিনটা কুনোব্যাং থপ থপ করে লাফাচ্ছে। খাদ্যের খোঁজে বেরিয়েছে। গিরস্তবাড়ির আঙিনায় রাতের যে-কোনও মুহূর্তেই লাফাতে পারে ব্যাং, এ এমন কিছু চোখে দেখার মতন দৃশ্য না। মুকসেদ তেমন তাকিয়ে দেখছিল না ব্যাংগুলি, নিজের মতো করে বাড়ির নামার দিকে পা বাড়িয়েছে, তখন গা হিম করার মতন দৃশ্যটা সে দেখল। গণি মিয়ার আঙিনার পুব দিককার নামায় দুইটো বউন্নাগাছ, একটা মটকুরা গাছ আর ছিটকি টোসখোলার ঝোঁপ, সেই ঝোঁপের দিক থেকে নিঃশব্দে উঠে আসছে হাত পাঁচেক লম্বা, সাদার কাছাকাছি রঙের উপর কালো চওড়া ছোপ ছোপ অতিকায় এক সানকি (শঙ্খীনি) সাপ। একেবারেই নিঃশব্দে, চোরের ভঙ্গিতে ব্যাংগুলির দিকে আগাচ্ছে।

সাপ দেখেই লাফ দিয়ে অনেকটা দূর সরে গেল মুকসেদ। অপলক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল কাজটা কী হচ্ছে। শরীর টেনে টেনে নিঃশব্দে ব্যাংগুলির কাছাকাছি এসে স্থির হল সাপ, তারপর আচমকা প্রথম থাবাটা দিল, একটা ব্যাং ধরে আস্তেধীরে গিলতে লাগল। অন্য ব্যাংগুলি তখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না ব্যাপারটা কী! তারা। নিজেদের মতন চরছে। উঠানের এদিককার মাটির সরু সরু গর্ত থেকে এক ধরনের পোকা বেরুচ্ছে। ব্যাংগুলিও চোরের ভঙ্গিতে সেই পোকা ধরে ধরে খাচ্ছে। ব্যাং খাচ্ছে মাটিপোকা, আর সাপে খাচ্ছে ব্যাং। দুই খাওয়াখাওয়ির মধ্যেই যেন কাজ করছে এক ধরনের চৌর্যবৃত্তি। জীবজগতের প্রত্যেকের কাজই যেন চুরির কাজ। রাতদুপুরে গিরস্ত বাড়ির ফলগাছে চোরের মতো এসে নামছে বাদুড়, গিরস্তের ফল খেয়ে শেষ করছে। বাদুড় তাড়াবার জন্য কত রাতদুপুরে ক্যানেস্তারা পিটায় কোনও কোনও গেরস্তে। তবু চোরের ছদ্মবেশে আসা বাদুড় ঠেকিয়ে রাখা যায় না।

শস্যের চকেমাঠেও চলে এই একই ধরনের কাজ। গিরস্তের সোনার ধান চোরের মতো এসে কেটে নেয় বাবুই পাখি আর মেঠো ইঁদুর। মেঠো ইঁদুরের গর্তে এসে চোরের মতন ঢুকে তাদেরকে খেয়ে শেষ করে দাঁড়াস সাপ। বনের বাঘ চোরের মতন এসে ধরে খায় হরিণ, তার ফেলে রাখা খাবার আবার চোরের মতন করেই এসে খেয়ে যায় শিয়াল হায়েনা। পানির তলার মাছ, মাছকে জানান না দিয়ে শিকার করে জেলেরা, সেই মাছেরা পেটের আহার জোটাতে শিকার করে অন্য মাছেদেরকে। শিকারও তো এক ধরনের চুরিই। জগতের সব প্রাণীই এক অর্থে চোর। আর এই চৌর্যবৃত্তির মূলে আছে ক্ষুধা, কোনও না কোনও রকমের ক্ষুধা।

এইসব ভাবতে ভাবতে নিজের বাড়িতে এসে উঠল মুকসেদ। তখন চাঁদ নেমে গেছে পশ্চিমে।

.

হাফিজদ্দি খেয়ে চলে যাওয়ার পর আজ দুপুরের ভাত খেতে বসল রহিমা আর হাসু। রান্নাঘরের মেঝেতে থালাভরতি ভাততরকারি আর টিনের মগে দুই মগ পানি নিয়ে সিঁড়ি পেতে মুখামুখি বসেছে ফুফু-ভাইজি। আজ একটু সময় নিয়ে আয়েশ করে খেতে কোনও অসুবিধা নাই। কারণ বাড়িতে মান্নান মাওলানা, তহুরা বেগম বা আতাহার কেউ নাই। বড়ঘর তালা দিয়ে তারা গেছে মেজোমেয়ে মদিনার শ্বশুরবাড়িতে দাওয়াত খেতে। দুপুরের খাওয়ার দাওয়াত। এজন্য সকালের নাস্তা করেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছে তারা। পায়ে হেঁটে ঘণ্টাখানেক লাগবে সেই বাড়িতে পৌঁছাতে, তারপর দুপুরের খাওয়া সেরে বিকালের মুখে। মুখে মেলা দিলে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা, সুতরাং দিনটা মোটামুটি শাসন বাঁধনের বাইরে আজ। রাখাল হাফিজদ্দির জন্য যেমন বাড়ির ঝি রহিমার জন্যও তেমন। আর রহিমা আজার থাকা মানে হাসুও আজার।

দূরে বাংলাঘরের ছনছায় বসে এখন বেশ গা-ছাড়া ভঙ্গিতে তামাক টানছে হাফিজদ্দি। হাঁটুর উপর লুঙ্গি তুলে, গামছাটা গলার উপর, গুড়গুড় করে তামাক টানছে সে। ভঙ্গি দেখে বোঝা যায় কাজকামের ব্যাপারে আজ তারও কোনও তাড়া নাই।

থালে ভাত মাখতে মাখতে একবার হাফিজদ্দিকে দেখল হাসু, তারপর রহিমার দিকে তাকিয়ে বলল, ফুবু, তোমার হেদিনকার কথাডি লইয়া আমি বহুত চিন্তা করছি।

মুখে ভাত ছিল রহিমার। ভাত চিবাতে চিবাতে হাসুর দিকে তাকাল। জড়ানো গলায় বলল, কী চিন্তা করছস?

এই বাইত্তে কামে আহনের পর হুজুরে যা চাইলো তাতে তুমি রাজি হইছিলা ক্যা?

মুখের ভাত গিলে রহিমা বলল, না রাজি অইয়া উপায় আছিলো না।

ক্যা, উপায় থাকবো না ক্যা?

হেই হগল অনেক কথা।

কও, আমি হুনুম।

হ আইজ তো কওন যায়। আইজ তুই আমি দুইজনেঐ আজাইর।

আমার কথা কইয়ো না, আমি তো আর এই বাড়ির বান্দি না!

বান্দিঐ।

কেমতে?

বান্দির কাছে আইয়া দিনের পর দিন যে থাকে হেও বান্দি। আর তুই তো এই বাইত্তে আমার কাছে থাকতেঐ চাইতাছস। বান্দি তো অইতেঐ চাইতাছস।

হাসু হাসল। হ।

তারপর এক লোকমা ভাত মুখে দিল। এইবার কও।

পয়লা পয়লা হুজুরের কথা আমি হুনি নাই। হেয় খালি তক্কে তক্কে থাকতো, আমার মিহি। খালি চাইয়া থাকতো, আঐলে পাইলেঐ প্যাচাইয়া পোচাইয়া ধরতো, শইল্লে হাত দিত। টেকাপয়সা হাততো (সাধতো)। টেকাপয়সার লোব আমার আছিলো না। আইজও নাই। হের কাছ থিকা একখান পয়সাও আমি কোনওদিন নেই নাই।

বোজলাম। আসল কথা কও।

এই হগল কথাও আসল কথাঐ। বেবাক না কইলে বুজবি কেমতে?

ভাত খাওয়ার মাঝখানে ঢোঁকে ঢোঁকে পানি খাওয়ার অভ্যাস হাসুর। টিনের মগ তুলে একঢোঁক পানি খেল সে। ফুফুর দিকে তাকিয়ে বলল, আইচ্ছা কও।

রহিমা আরেক লোকমা ভাত মুখে দিল। দিনের পর দিন একজন মানুষ, তাও হুজুরের লাহান মানুষ এমুন করন লাগল, আমিও তো মানুষ, না কি! মাইয়ামানুষ, বয়েস তহন তর লাহান, শইল সাস্ত ভাল, হুজুরের বয়েসও কম। অহন যা দেহচ তার থিকাও কত জুয়ান মর্দ। দেড়-দুই বচ্ছর জামাইর ঘর করছি আমি। আমার শইলও তো শইল, আমারও তো সাদ আহ্লাদ আছে! পয়লা পয়লা এই সাদ আহ্লাদ আমি ঠেকাইয়া রাকছি। শইল্যে হাত দিলেঐ হুজুররে আমি ডর দেহাইতাম। এমুন করলে কইলাম হুজরানিরে কইয়া দিমু। হুইন্না হুজুরে ডরাইতো। কয়দিন আর আমার মিহি চাইতো না। দেকতো সত্যই আমি হুজরানিরে কইনি। কই না দেইক্কা আবার আগের লাহান অইয়া যাইতো। আবার আগের লাহান ঘ্যানর ঘ্যানর করতো কানের সামনে। হারাজীবন এই বাইত্তে থাকতে পারবি তুই, খাওন ফিন্দনের আকাল অইবো না। অসুকবিসুক অইলেও আমি তরে দেহুম, আমি কোনওদিন না তরে হালামু না। আমি জামাই তালাক দেওয়া মাইয়া, তারপর পোলাপান অইবো না। কোনওদিন, ভাইয়ে বাইত্তে জাগা দেয় নাই, এমুন কোনও আততিয় স্বজন নাই যার কাছে। গেলে একওক্ত আমারে খাওয়াইবো। বোজলাম হুজুরে খারাপ মানুষ, হেয় যা চায় হেইডা না দিলে হেয় কোনও না কোনও উছিলায় এই বাইত থিকা আমারে খেদাইয়া দিবো। আমি তহন যামু কই? নাইলে অন্য বাইত্তে গিয়া কামলমু। তয় যেই বাইত্তে কাম লমু হেই হগল বাইত্তেও তো পুরুষপোলা আছে, আমার লাহান যুবতী কামের ছেমড়ি পাইলে তারাও তো হুজুরের লাহানঐ করবো! এই বাইত্তে অইলো এক হুজুর আর অন্য বাইত্তে তো শয়ে শয়ে হুজুর! অত হুজুর আমি হামলামু কেমতে?

থালার ভাত অর্ধেক পরিমাণ শেষ হয়েছে। আরেক লোকমা ভাত মাত্র মুখে দিতে গিয়েছিল হাসু, ফুফুর শেষ কথাটা শুনে থতমত খেয়ে তার মুখের দিকে তাকাল। তারপর কেমন দুঃখী, মন খারাপ করা গলায় বলল, ঠিক কইছো। মৌচ্ছামান্দ্রার যেই বাইত্তে আমারে কামে দিছ হেই বাইত্তেও হুজুরের কোনও আকাল নাই। বাপ পোলা বাড়ির কামলাবেড়া থিকা শুরু কইরা এতজনে আমারে জ্বালায়, অগো ঠেকাইতে ঠেকাইতে, নিজের শইল অগো বদ মতলব আর কুনজর থিকা বাঁচাইতে বাঁচাইতে আমার আইজ এই দশা। রাইতের পর রাইত বেডাগো জ্বালায় আমি ওইবাইত্তে ঘুমাইতে পারি না, দিনেরবেলা আঐলে পাইলে বুক টিপ্পা ধরতে চায় কেঐ না কেঐ। এই হগল যন্ত্রণা থিকা নিজেরে বাঁচানডা অইলো যুইদ্ধের লাহান। আইজ দশ-বারো বছর ধইরা এই যুইদ্ধ করতে করতে আমি এক্কেরে শেষ অইয়া গেছি ফুবু। মাইয়ামানুষ থিকা বেড়ামানুষ অইয়া যাইতাছি আমি। যুইদ্ধ করতে করতে যহন আর পারি না, শইল্যে কুলায় না, তহন আমি তোমার কাছে আইয়া উডি। ঐ বাইত্তে আর ফিরত যাইতে চাই না।

হাসুর কথা শুনে অপলক চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল রহিমা। আইজ আমি বেবাক কিছু বোজলাম। এই হগল কথাঐ তর কাছ থিকা আমি জানতে চাইছি।

হাসু আরেক লোকমা ভাত মুখে দিল। ওই বাইত্তে এহেকটা রাইত অয়, আর আমার আজাব শুরু অয়। আমি হুই রান্নঘরে। হেই ঘরের ঝাঁপহান আলগা। ইট্টুহানি ঠেলা দিয়াঐ ঘরে হান্দন যায়। পয়লা পয়লা বাড়ির আম্মারে কইছি, আম্মা, এই ঘরডায় আমারে রাইকেন না, আমার ঘুম আহে না, অসুবিদা অয়। হেয় আমার কথা হোনে নাই। কয়, বাড়ির বান্দিরে রান্নঘরে হুইতে দিমু না তো কি বড়ঘরের পালঙ্কে হুইতে দিমু? ওই ঘরে তর থাকন লাগবো। তারবাদে বাড়ির বেডাগো কথাও তারে আমি ভাইঙ্গা চুইরা কইছি, কেঐর নামনোম কই নাই, হুইন্না হেয় আমারে কইল, বেডারা অমুন। বেডাগো হাত থিকা নিজেরে বাঁচানোর কাম অইলো মাইয়াগো। তুইও বাঁচাইয়া চলবি। তয় তুমি আমারে কও তো ফুবু, কয়জনের হাত থিকা, কতদিন তুমি নিজেকের বাঁচাইবা?

রহিমা বলল, হ। এই হগল চিন্তা এই বাইত্তে আইয়া পয়লা পয়লা আমিও করছি। তারবাদে বেবাক চিন্তা বাদ দিয়া হুজুরের কথায় রাজি অইয়া গেছি। অহন যেই ঘরে তুই আমি থাকি, পয়লা থিকাঐ ওই ঘরে থাকি আমি। হুজুরের কথায় ভিতর থিকা দুয়ারের খিল আলগা কইরা রাকতাম। রাইত দোরে চোরের লাহান হুজুরে তার বউর পাশ থিকা উইট্টা আইয়া আমার ঘরে হানতো। নিজের শইল্যের সাদ আহ্লাদ মিটাইতো। এই কইরা কইরা দিন গেল।

খাওয়া শেষ করে মগের পানিতে থালাতেই হাত ধুতে লাগল রহিমা।

হাসুর থালায় তখনও সামান্য ভাত রয়ে গেছে। কাচিয়ে কুচিয়ে সেই ভাত লোকমা করে মুখে দিল হাসু। আমি তোমার কথা বুজছি ফুবু। তয় তোমার আর আমার তো একদশা না। আমি তো বিয়াতো মাইয়া না। আমি অইলাম আবিয়াত মাইয়া। নিজের পেট আমি চিনি না। আর যেই বেডারা আমার কাছে আইতো হেরা তো কেঐ আমারে বিয়া। করবো না! কামকাইজ সাইরা যাইবো গা। আমার পেট অইয়া গেলে যাগ কারণে পেট হইব তারাঐ আবার আমার বিচার করবো। খারাপ মাইয়া কইয়া বাইত থিকা খেদাইবো আমারে। এই হগল চিন্তা কইরা বেডাগো হাত থিকা আমি খালি নিজেরে বাঁচাইছি। তয় কতদিন এমুন বাঁচান বাঁচান যায় কও? আইজ কয় বছর ধইরা রোজ রাইত্রে বিছানায় হুইয়া হুইয়া আমি খালি চিন্তা করি, মাইয়াছেইলা থিকা কোনওরকমে আমি যদি বেড়া অইয়া যাইতে পারতাম, আমার গলার আওয়াজখান অইতো বেডাগো লাহান, হাত পাও, বুক মোক অইতো বেডাগো লাহান, আমার পোলাপান অওনের জাগাড়া অইতে বেড়াগো। লাহান তয় বেডারা আমারে এমুন জ্বালান জ্বালাইতে পারতো না। রাইত ভর আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাইতে পারতাম।

ভাত শেষ করে এক ঢোক পানি খেল হাসু। তারপর মগের পানিতে রহিমার মতো করে থালায় হাত ধুতে ধুতে বলল, তারপর থিকা আমি কইলাম সত্যঐ বেড়াগো লাহান অইতে লাগলাম ফুকু, খ্যাল করছ?

আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে রহিমা বলল, হ। তুই তো অহন বেডাঐতর হাত পাও গলার আওজ বেবাকঐ বেডাগো লাহান। বুকও উঁচা না, বেডাগো লাহান।

ফুফুর মতো করে হাসুও আঁচলে মুখ মুছল। তারপর হাসল। হ, অহন খালি পোলাপান অওনের জাগাহান বেড়াগো লাহান অইয়া গেলেঐ অয়।

রহিমা ধমক দিল ভাইঝিকে। ধুর ছেমড়ি, কী কচ?

হ ফুবু, ভাল কথা কই। তুমি দেকবা আমি একদিন সত্য সত্যই বেডা অইয়া যামু। মাইয়াছেইলা আমি আর থাকুম না। মাইনষের কোনও কোনও কথা আল্লায় কইলাম সত্য সত্যঐ হোনে। কহেক বচ্ছর ধইরা আমার কথা মনে অয় হোনতাছে। এর লেইগাঐ ইট্টু। ইট্টু কইরা বেডাগো লাহান অইয়া যাইতাছি আমি। একদিন দেকবা পুরাপুরিঐ বেডা অইয়া গেছি।

রহিমা আর কথা বলল না। তার হাসুর আর হাফিজদ্দির আইট্টা (এঁটো) থালা বাসন নিয়া পুকুরঘাটের দিকে চলে গেল। দুইটো কাক তখন রান্নাঘরের ছনছায় নেমে চঞ্চল চোখে চারদিকে তাকিয়ে খাদ্য খুঁজছিল।

.

বিকালবেলা বড়ঘরের পিছন দিককার জামতলায় দাঁড়িয়ে উদাস হয়ে চকের দিকে তাকিয়ে আছে ফিরোজা। এখান থেকে পশ্চিমে ঢাকা থেকে আসা বড় সড়কের অনেকখানি দেখা যায়, পুব-উত্তরে দেখা যায় তালুকদার বাড়ির গাছপালা, গাছপালার আড়ালে দাঁড়ানো দালান কোঠার কার্নিশের উপরকার অশ্বথের চারা। বাড়ির গা ঘেঁষে চলে যাওয়া খালের বাঁক দেখা যায়, সীতারামপুরের বাঁকে ছোট্ট একখান টংঘরের দোকান, দোকানের ওপাশে কারিকরদের বাড়িঘর, সব পরিষ্কার দেখা যায় এখান থেকে।

এই বাড়ি থেকে পোয়া মাইল দূরত্বে এইসব দৃশ্যাবলি। মাঝখানে চক। চকে এখন ইরির চাষ হয়। জমির আল বেঁধে পানি আটকে ইরি রুয়েছে কৃষকরা। ফলে চক এখন গাঢ় সবুজ। এই সবুজের দিকে তাকিয়ে মন উদাস হচ্ছিল ফিরোজার।

ঠিক এই সময় ভেতর বাড়ির দিক থেকে তার পাশে এসে দাঁড়াল নিখিল। কী করো ফিরোজা?

আচমকা পিঠের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে একজন মানুষ, কথাও বলছে, শুনে উদাস ছিল বলেই যেন একটু বেশি চমকাল ফিরোজা। চমকে মানুষটার মুখের দিকে তাকাল। ও নিখিলদাদায়! আমি ডরাই গেছিলাম।

নিখিল হাসল। ক্যা, ডরাইলা ক্যা?

আথকা মাইনষের পিছে মাইনষে আইয়া খাড়ইলে না ডরাইয়া উপায় আছে?

তারপরই যেন নিখিলকে খেয়াল করে দেখল ফিরোজা। নিখিলের পরনে আজ নীল রঙের নতুন লুঙ্গি। লুঙ্গির উপর পরেছে সাদা খদ্দরের পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির হাতা কনুই তরি গুটানো। বোধহয় আজই চুল কাটিয়েছে, দাড়ি মোচ কামিয়েছে। তারপর সাবান দিয়া হয়তো গোসল করছে। সব মিলিয়ে তরতাজা, প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে নিখিলকে। এমনিতে বেশ লম্বা, ছিপছিপা শরীরের নিখিলের গায়ের রং কালো। তবে মুখটা মায়াবী, নিরীহ ধরনের, কেমন একটু বিষণ্ণতাও আছে মুখে। খানিক তাকিয়ে থাকলেই মায়া লাগে।

আজ নিয়া খুব বেশিদিনি যে কাছ থেকে নিখিলকে ফিরোজা দেখছে তা না। দূর থেকে মান্নান মাওলানার বাংলাঘরে আতাহারের লগে আনাগোনা করতে দেখছে অনেকদিন ধরেই। তখন ফিরোজার চোখে এতটা পড়েনি নিখিল। কিছুদিন ধরে পড়ছে। কারণ কিছুদিন ধরে কোনও না কোনও অছিলায় মন্তাজদের বড়ঘরে আসছে আতাহার। লগে বেশির ভাগ দিনই আছে নিখিল। আতাহারের বন্ধু হওয়ার পরও নিখিলের লগে আতাহারের ব্যবহার চাকর বাকরের মতন। যখন তখন মানুষের সামনে ধমক দিচ্ছে, গালাগাল করছে, অপমানের একসা। তবু যেন ওসব আচরণ গায়ে মাখে না নিখিল। দুইদিন তার সামনেই মালাউনের বাচ্চা বলে গাল দিল। সেই গাল শুনে বিষণ্ণ মুখ আরও বিষণ্ণ হল নিখিলের, তারপরই মুখটা হাসিহাসি করল। যেন গালটা সে শুনতে পায়নি বা শুনেও ভুলে গেছে।

ওই সময়কার নিখিলের মুখ দেখে মায়া লেগেছে ফিরোজার!

কিন্তু আতাহার কেন আজকাল ঘনঘন আসছে তাদের ঘরে, মন্তাজের বুড়িমাকে দেখার অছিলায়, তার ভালমন্দ খোঁজখবর নেওয়ার অছিলায় সে যে আসলে ফিরোজার কাছেই আসছে, ফিরোজাকেই পেতে চাইছে এসব মেয়েমানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা দিয়েই বুঝে নিয়েছে ফিরোজা। ছেলের মতন একই উদ্দেশ্যে মান্নান মাওলানাও যে সেদিন মন্তাজের বড়ঘরে এসে ঢুকেছিল, অনেকদিন ধরেই যে মাওলানা হুজুর চেষ্টা তদবির চালিয়ে যাচ্ছে ফিরোজার ব্যাপারে, সবই ফিরোজা টের পাচ্ছে। এই নিয়া মুখে কাউকে কিছু বলতে পারছে না। যেমন করে পারে নিজেকে রক্ষা করে চলেছে। আতাহার এলেই তাকে চা করে খাওয়াচ্ছে। হাসিহাসি মুখে কথা বলে শরীর থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছে। আর মান্নান। মাওলানাকে সেদিন চিরতরে ফিরিয়েছে তার ছেলের এই ঘরে আসাযাওয়া নিয়া। কথায় কথায় এমনভাবে আতাহারের কথা বলেছে শুনে মান্নান মাওলানা ভেবেছেন এই লাইনে তার এলেমদার মাজারো পোলা ঠিকই অনেকদূর আগায়া গেছে। পোলায় যে মেয়ের ক্ষেত্রে এতদূর আগাইছে বাপ হয়ে সেই একই মেয়ের ক্ষেত্রে তার আগানো ঠিক হবে না। তবু শেষ পর্যন্ত নূরজাহানকে নিয়ে একখানা অশ্লীল কথা বলে মন্তাজের বড়ঘর থেকে মান্নান মাওলানা বেরিয়ে ছিলেন।

নূরজাহানের লগে চিন পরিচয় নাই ফিরোজার। তবে হুজুরের মুখে ছ্যাপ ছিটিয়ে যে আলোড়ন গ্রামে সে তুলেছে সে-কথা তার কানে আসছে। সেদিন হুজুরের মুখে নূরজাহানের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার যে ধুরন্ধর ছায়া ফিরোজা দেখেছে ওই ভাবনায় রাতের ঘুমটা তার ঠিকঠাক মতো হয় নাই। বারবার মনে হয়েছে মান্নান মাওলানা যেরকম মানুষ ঠিকই মেয়েটিকে সে দেখে নিবে। কোনও না কোনও কায়দায় যা বলেছেন ঠিক ওই কাজটাই মেয়েটার লগে করবেন। সত্যি যদি কোনও মেয়ের লগে ওই কাজটা করা হয়, তা হলে তার আর থাকল কী! সবই তো গেল! বিয়ে হলে স্বামীকে সে দেবে কী?

এই একই ভয়ে আতাহারের কাছ থেকে প্রাণপণে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। ফিরোজা। মান্নান মাওলানাকে ছেলের কথা বলে ফিরিয়েছে, আতাহারকে ফিরাবে কার কথা বলে!

নিখিলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করেই যেন সেই মানুষটার সন্ধান আজ বিকালে পেয়ে গেল ফিরোজা। আতাহারকে কি যে কোনও কায়দায় একদিন সে জানিয়ে দিবে, আমার মিহি আর আউগাইয়েন না আতাহার দাদা। আপনের দোস্ত নিখিলের লগে আমার অইয়া গেছে। দোস্ত অইয়া দোস্তের মনের মাইনষের মিহি আউগান ঠিক অইবো না।

তয় নিখিল যে হিন্দু! হিন্দু পোলার লগে কি মোসলমান মাইয়ার এইসব হয়?

মনে মনে হাসল ফিরোজা। সত্যঐ তো আর অইতাছে না! এইডা তো মিছা! আতাহার দাদারে ফিরানের লেইগা।

ফিরোজার মতো নিখিলও তাকিয়ে ছিল ফিরোজার মুখের দিকে। শ্যামলা গোলগাল মুখের এই মেয়েটিকে তার ভালই লাগে। লাল সবুজের ডুরে শাড়ি আজ পরেছে সে। ঘটিহাতা ছিট কাপড়ের ব্লাউজ পরেছে। লালফিতা দিয়া দুইখান বেণি করেছে, নাকে নাকফুল আছে, চোখে কাজল দিছে, সব মিলায় ভাল লাগছে ফিরোজাকে দেখতে।

কিন্তু কিছু ভেবে ফিরোজা কি মনে মনে হাসছে!

মনে মনে হাসার সময় নিজের অজান্তেই মানুষের মুখে সেই হাসির আভা ফুটে ওঠে। ফিরোজার মুখেও ফুটেছিল। এই ব্যাপারটা খেয়াল করল নিখিল। বলল, কী অইছে তোমার?

ফিরোজা চমকাল। কী অইবো?

আমার মনে অয় কিছু অইছে।

কেমতে বোজলেন?

তোমার মোক দেইক্কা।

ক্যা কী অইছে আমার মোকে?

মোক দেইক্কা মনে অইতাছে তুমি জানি মনে মনে কী চিন্তা কইরা হাসতাছো!

ফিরোজা চমকাল। আল্লা, কেমতে কইলেন আপনে?

নিখিল হাসল। ওই যে কইলাম তোমার মোক দেইক্কা মনে অইলো।

ঠিকঐ মনে অইছে। আসলেই আমি হাসতাছিলাম।

ক্যা, আমারে এহেনে দেইক্কা?

ফিরোজা ভুরু কোঁচকাল। ক্যা আপনেরে দেইক্কা হাসুম ক্যা?

একলা একলা তোমাগো মিহি আইছি!

হেতে কী অইছে?

না তুমি অন্যকিছু মনে করতে পারো।

অন্যকিছু কী মনে করুম?

মনে করতে পারো আমি কোনও মতলবে আইছি।

মতলবে আহেন নাই?

নিখিল চমকাল। না, কী মতলবে আমু?

তয় আইছেন ক্যা?

আইছিলাম আসলে আতাহারের কাছে। আইজ হারাদিন অর লগে দেহা অয় নাই। কনটেকদার সাবে আলম সুরুজ অরা কইলো দেইক্কা আয় আতাহার বাইত্তে আছেনি, থাকলে ডাইক্কা লইয়ায়। আইয়া হাসুর কাছে হোনলাম অরা বেবাকতে মাজারো বইনের বাইত্তে দাওত খাইতে গেছে। তারবাদে ফিরত যাওনের সময় ভাবলাম, কী জানি আতাহার অর বইনের বাইত্তে থিকা আগেঐ আইয়া পড়ল কি না, আইয়া তোমগো ঘরে বইয়া রইলো। কি না!

ফিরোজা অবাক হওয়ার ভান করল। ক্যা, বাইত্তে আইয়া নিজেগো ঘরে না গিয়া হেয় আমাগো ঘরে আইয়া বইয়া থাকবো ক্যা?

নিখিল হাসল। তুমি তো জানঐ আতাহারে তোমারে খুব পছন্দ করে।

হ জানি, তয় আমি তারে পছন্দ করি না।

ক্যা?

হের লাহান মাইনষেরে পছন্দ কইরা আমার কোনও লাব নাই।

কীয়ের লাব?

আপনে বোজেন নাই কীয়ের লাব?

না।

বোজন উচিত আছিলো।

নিখিল আবার হাসল। বুজি নাই যহন তহন আর কী করন যাইবো, বুজাইয়া কও।

হেয় অইলো বিরাট নামকরা মাইনষের পোলা। টেকাপয়সা জাগাজমিনের আকাল নাই। আমি যুদি হেরে পছন্দ করি, আর যাই করুক হেয় তো আমারে বিয়া করবো না।

নিখিল আবারও হাসল। করতেও পারে। রাজার পোলায়ও ভিকারির মাইয়ারে বিয়া করে?

হেইদিন আইজ কাইল আর নাই।

আছে। পেরেম মহব্বত থাকলে ধনী গরিব দিয়া কিছু অয় না।

আতাহার দাদার যে আরেকজনের লগে পেরেম আছে।

কার লগে?

এবার ফিরোজাও হাসল। ক্যান আমার মোক থিকা হোনতে চান? আপনে তো বেবাকঐ জানেন। বিয়া করনের মতলব থাকলে হেয় তো হের ভাবিছাবরেঐ করতে পারে। ভাবিছাবে অহনও কী সোন্দর! অহনও এক্কেরে আবিয়াত মাইয়াগো লাহান। হেমুন মাইয়ারেঐ যে। বিয়া করে না হেয় আমার লাহান কামের ছেমড়িরে মইরা গেলেও বিয়া করবো না। আতাহার দাদায় বহুত চালাক। ভোমরার লাহান। একবার এই ফুলে যাইবো, মধু খাইবো। আবার অন্য ফুলে যাইবো, মধু খাইবো। কোনও ফুলেঐ হারাজীবন বইয়া থাকবো না।

ফিরোজার কথা শুনে নিখিল হকচকিয়ে গেল। কথা বলতে যেন ভুলে গেল। হাঁ করে ফিরোজার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসল ফিরোজা। কী অইলো? এমতে চাইয়া রইছেন ক্যা?

নিজেকে সামলাল নিখিল। তোমার কথা হুইন্না।

ক্যা, খারাপ কিছু কইছিনি আমি?

না খারাপ কও নাই। সত্য কথা কইছো। আমি খালি চিন্তা করতাছি তুমি এত কিছু বোজলা কেমতে?

মাইয়ামানুষরা দুনিয়ার বেবাক পুরুষপোলার চকু দেইখাঐ বোজে হেয় কী চায়? আতাহার দাদার মতলব, হের বাপের মতলব বেবাকঐ আমি বুজি।

তোমার মোক দেইক্কা কইলাম মনে অয় না তুমি এত কিছু বোজো।

মোক দেইক্কা মানুষ চিনন যায় না। কার ভিতরে কী, মোক দেইক্কা কেমতে বোজবেন?

হেইডা ঠিক। তয় মোক দেইক্কাঐ কইলাম মাইনষের লগে মাইনষের ভাব ভালবাসা অয়।

হ হেইডা ঠিক। মোক দেইক্কাঐ মাইনষে মাইনষের পয়লা বিচার করে। তারবাদে ঠক খায়।

নিখিল হাসল। বাপ রে, তুমি তো দেহি এক্কেরেঐ অন্যপদের মাইয়া। তোমার মোক দেইক্কা তোমারে আমি যেমুন ভাবছি তুমি দিহি তার থিকা পুরাপুরি আলাদা।

একপলক নিখিলের মুখের দিকে তাকিয়েই উদাস হল ফিরোজা। আমরা গরিব মাইয়া দাদা। বহুত হিসাবকিতাব কইরা, চিন্তাভাবনা কইরা আমগো চলতে অয়। আমি জানি আমগো লাহান মাইয়ার শইলখানঐ আসল, শইলখানঐ সম্পদ। এই সম্পদ যুদি একবার নষ্ট অইয়া যায় তাইলে আর কিছু থাকলো না। বিয়াশাদি তো অইবোঐ না, আউজকা একজনে কাউলকা আরেকজনে খাবলাইয়া খাবলাইয়া খাইবো। মাইয়া মাইনষের নষ্ট শইল। মরা গোরুর লাহান। হকুনের লাহান বেডারা খালি ঠোকরাইয়া ঠোকরাইয়া খায়। খাইতে খাইতে ছিবড়া কইরা হালাইয়া দেয়। কুনে যেমুন গোস্ত খাইতে খাইতে মরা গোরুর কঙ্কাল বাইর কইরা তারবাদে উড়াল দেয় আশমানে, বেডারাও হেমুন করে।

ফিরোজার কথা শুনে নিখিল হতবাক। আরে এ তো আশ্চর্য মেয়ে! বাইরে থেকে দেখে। বোঝা যায় না কিন্তু ভিতরে ভিতরে খুবই বুদ্ধিমতী। আতাহারকে নিয়া ঠিক ভাবনাটাই সে ভাবছে। আর ফিরোজার কথাবার্তার ধরনে মেয়েটাকে যে হঠাৎ করেই কী ভাল লেগে গেল। নিখিলের! আজ পর্যন্ত কোনও মেয়েকে এমন ভাল তার লাগে নাই।

নিখিলের ইচ্ছা হল যতক্ষণ সম্ভব এই নির্জনে দাঁড়িয়ে ফিরোজার লগে গল্প করে। আরও অনেক কথা শোনে ফিরোজার কাছ থেকে। সে যে বলল সে গরিব ঘরের মেয়ে, কেমন গরিব ঘর তাদের! কোন গ্রামে বাড়ি! মা বাবা ভাই বোনের কী বিত্তান্ত সবই জানতে ইচ্ছা করছে নিখিলের।

সেই কথা কীভাবে শুরু করা যায়?

ছোট্ট করে গলা খাকারি দিল নিখিল। এতক্ষন ধইরা তুমি যে এহেনে খাড়ইয়া আমার লগে কথা কইতাছো, তোমার কোনও অসুবিদা অইতাছে না?

ফিরোজা অবাক হল। অবাক হলে তার নাকের দুইপাশে ছোট্ট ভাজ পড়ে, নাকের পাটা সামান্য কুঞ্চিত হয়। মিষ্টি মুখটা তাতে আরও মিষ্টি দেখায়। ফিরোজার এই সৌন্দর্য। আজকের আগে দেখে নাই নিখিল। তার কথা শুনে ফিরোজা যে বলল, কীয়ের অসুবিদা, সে-কথা যেন শুনতেই পেল না। মুগ্ধ চোখে ফিরোজার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফিরোজা হাসল। কীয়ের অসুবিদা কইলেন না? নিখিল থতমত খেল। না, ওই যে মন্তাজকাকার মায়, তারে ছাইড়া এতক্ষুন ধইরা তুমি বাইরে! হেয় তোমারে বিচড়াইবো না?

না। দোফরের পর থিকা বেদম ঘুম ঘুমাইতাছে হেয়।

ক্যা রাইত্রে ঘুমায় নাই?

কাইল রাইত্রে ঘোমডা পুরা অয় নাই। কেমুন উসপিস উসপিস করছে। হেই রাইত্রের ঘোম অহন দিতাছে।

আর এই ফাঁকে তুমি আইয়া খাড়ই রইছো জামগাছ তলায়!

হ। এই জাগাটায় খাড়ই থাকতে আমার বহুত ভাল্লাগে।

পাঞ্জাবির ডান দিককার পকেট থেকে হাতিয়ে হাতিয়ে বাঁকাচোরা হয়ে যাওয়া একটা স্টার সিগ্রেট বের করল নিখিল। কয়েকটা মাত্র কাঠি আছে এমন একখান ম্যাচ বের করল। তারপর সিগ্রেট ধরিয়ে বড় করে একটা টান দিয়ে বলল, এহেনে খাড়ইয়া কী দেহো তুমি?

তেমুন কিছু না। সড়কটা দেহি, খোলা চক দেহি। আর একখান কথা চিন্তা করি।

কী?

চিন্তা করি বাড়ির বাইরে এতবড় একখান দুনিয়া, হেই দুনিয়ায় পা হালানের ক্ষমতা নাই আমার। আমি যেন খাঁচায় আটকাইন্না পাখি। এই বাড়ির খাঁচার মইদ্যে আইটকা রইছি।

নিখিল আবার সিগ্রেটে টান দিল। অর্থ কী কথাডার?

অর্থ অইলো, এই বাইত্তে যেমতে আছি এমতে থাকতে আমার আর ভাল্লাগে না। রাস্তা আর চকের মিহি চাইয়া আমার খালি মনে অয় একদিন ওই চকের মাঝখানকার রাস্তা দিয়া বহুত দূরে কোনওহানে যামু গা আমি। আর কোনওদিন এই দেশে ফিরত আমু না।

ক্যা এমুন মনে অয় ক্যা তোমার?

কইতে পারি না। মাইনষের মন কত কিছুঐত্তো কয়!

ফিরোজা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। উদাস হয়ে চকের দিকে তাকিয়ে রইল।

এ বাড়ির উঠানপালানে পড়ে থাকা রোদ এখন ঘরের চালে আর গাছপালার মাথার দিকে উঠতে শুরু করেছে। রোদের রং হয়েছে গেন্দা ফুলের পাপড়ির মতন। চকের ধানিজমি আর খোলা মাঠে রোদ বেশ মোলায়েম। সেদিকে তাকিয়ে সিগ্রেটে আরেকটা টান দিয়ে নিখিল বলল, হোনো ফিরোজা, তুমি যে কইলা তুমি গরিব ঘরের মাইয়া, কোন গেরামের গরিব ঘর তোমগো?

নিখিলের দিকে তাকাল না ফিরোজা। চকের দিকে তাকিয়েই বলল, আমগো গেরাম অইলো গাদিঘাট। গাদিঘাট চিনেন?

চিনুম না ক্যা? বিক্রমপুরের কোন মাইনষে গাদিঘাট না চিনে? গাদিঘাটের নাম না হোনছে এমুন মানুষ বিক্রমপুরে নাই। মিষ্টি কোমড়ের লেইগা বিখ্যাত অইলো গাদিঘাট। হেই গেরামের খেতখোলায় খালি মিষ্টি কোমড় বোনে গিরস্তে। একমন দেড়মন ওজনের এহেকখান কোমড় হয়। এক কোমড়ে এক বাড়ির বিয়াশাদির মেজবানি হইয়া যায়। হেই কোমড়ের নাম ভোজকোমড়। ভোজ খাওনের কোমড়।

হ, হেই গাদিঘাটে আমগো বাড়ি।

তোমার বাপে করে কী? গিরস্তি?

গিরস্তিঐ করে, তয় নিজের জমিন নাই। অন্যের জমিন বর্গা চোয়।

ভাইবইন কয়জন তোমার?

পাঁচবইন তিনভাই। আমার বড় দুইবইন দুইভাই। দুই বইনের বিয়া দিয়া বাবায় গেছে ফতুর অইয়া। বড়ভাই দুইডা বাপের লগে গিরস্তি করে। ছোড একটা বইন আমগো গেরামে এক বাইত্তে আমার লাহান থাকে। একদোম ছোড বইনডা ইসকুলে পড়ে, কেলাস ফোরে। ছোড ভাইডা পড়ে সিকসে। বড় সংসার তো! সংসার চলে বহুত কষ্টে। কোনও কোনওদিন না খাইয়াও থাকন লাগে। এর লেইগা বাবায় আমারে এই বাইত্তে দিয়া দিছে।

গাদিঘাট থিকা মেদিনমণ্ডল ম্যালা দূর। এত দূরের এই বাইত্তে কোন পরিচয়ে আইলা তুমি?

ফিরোজা ম্লান হাসল। অ্যারা আমগো আত্মীয় অয়। কাছের আত্মীয়। আমরা গরিব দেইক্কা আত্মীয় পরিচয় দেয় না। তয় বাবার লগে মন্তাজমামার কথা অইছে হের মায় যতদিন আছে হেতদিন তার মা’রে আমি দেহুম। আমার বচ্ছরের কাপড়চোপড় বেবাক হেরা দিবো, আর নানি মইরা গেলে মন্তাজমামায় ভাল পোলা দেইক্কা ধুমধাম কইরা আমারে বিয়া দিয়া দিবো।

সিগ্রেটে শেষ টান দিয়ে নামার দিকে সিগ্রেটের শেষ অংশ ছুঁড়ে ফেলল নিখিল। তয় তো ভালঐ। তয় আর তোমার চিন্তা কী?

এবার খুবই রহস্যময় একখান হাসি হাসল ফিরোজা। চিন্তা আছে।

কী?

আমি একজনরে পছন্দ করি। আমি চাই আমার বিয়াডা হের লগে অউক।

কও কী? কারে, কারে পছন্দ করো তুমি?

হেইডা আপনেরে আমি কমু না।

ঠিক এসময় মন্তাজের বড়ঘর থেকে তার মায়ের জড়ানো গলার চিৎকার ভেসে এল। তারস্বরে ফিরোজাকে ডাকছে বুড়ি। অন্য যে কারও কাছে এই চিৎকারটা গোঙানির মতন বীভৎস মনে হবে, তয় ফিরোজা এই ডাকের অর্থ জানে। তার নাম ধরেই ডাকছে বুড়ি।

ডাক শুনে ফিরোজা চঞ্চল হল। ওই যে নানি ডাক পাড়তাছে। আমি যাই।

বলেই বড়ঘরের দিকে দৌড় দিতে গেল ফিরোজা, দৌড় দিতে গিয়েই কী ভেবে থামল। একটা হাত জামগাছটার গায়ে রেখে অপূর্ব এক ভঙ্গিমায় বলল, আমি যারে পছন্দ করি, যার কাছে বিয়া বইতে চাই তার কথা আপনেরে একদিন কমু।

তারপর দৌড়ে বড়ঘরের দিকে চলে গেল।

নিখিলের বুকের ভিতর তখন একেবারেই অচেনা এক আবেশ খেলা করছে। মন ছেয়ে গেছে আশ্চর্য এক অনুভূতিতে। আজকের আগে কখনও এই অনুভূতি হয়নি তার। কাকে পছন্দ করে ফিরোজা? কার কাছে বিয়া বসতে চায়? সে-কথা অন্য কাউকে না বলে তাকেই কেন বলবে একদিন? তা হলে ফিরোজার মনের কোনও এককোণে কি তার জন্যও একটুখানি জায়গা হয়েছে!

এসব ভাবতে ভাবতে মান্নান মাওলানার সীমানায় না ফিরে জামতলার ওদিককার ভাঙন দিয়ে উত্তরের চকে নেমে গেল নিখিল। একেবারেই শেষ হওয়া বিকালের রোদে তখন পাকা পেঁপের রং ধরেছে। যখন তখন এই রোদ মুছে অন্ধকার নামবে। এর মধ্যেই ঝিঁঝিপোকারা ডাকতে শুরু করছে।

.

চৈত্রমাসের শেষ দিককার এক বিকালে তামা পিতল কাঁসা অ্যালুমিনিয়ামের নানান পদের মালছামান ভরতি ভার কাঁধে একজন মানুষ চকপাথালে আস্তে ধীরে হেঁটে আজিজ গাওয়ালের বাড়ির দিকে আগাতে লাগল। তার চলাচল গাওয়ালদের মতন অস্থির ধরনের না। ভার কাঁধে গাওয়ালরা যেমন ঘোড়ার মতন ছোটে, মুখে ক্লান্তির হুমহাম শব্দ করে, গাওয়াল বলতে যা বোঝায়, আজিজ গাওয়ালকে দেখে দেশগ্রামের লোক গাওয়াল মানুষের যে ছবি মনের ভিতর ধরে রেখেছে, মানুষটির চালচলন তেমন না। ধীর শান্ত নরম গতিতে বিকালের রোদ ভেঙে হাঁটছিল। মাথায় সাদা গোল টুপি, পরনে গেরুয়া রঙের পরিষ্কার ফতুয়া, গাঢ় সবুজ রঙের লুঙ্গি সামান্য উঁচু করে পরা, যেন পথের ধুলায় ময়লা না হয়। মুখে মানুষটার মাসখানেকের দাড়ি গোঁফ, খানে খানে সাদা খানে খানে কালো। চোখে নির্মল নিরীহ দৃষ্টি আর চোখের কোলে সুর্মা। দূর থেকে দেখেও মানুষটাকে খুবই পাক পবিত্র আর ধার্মিক মনে হচ্ছিল।

আজিজ গাওয়ালের বাড়ির পুব দিককার নামায় চার-পাঁচটা বউন্না হিজল আর মটকুরা গাছ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। তার তলায় একখণ্ড সবুজ ঘাসের জমিন। বিকালবেলা বাড়ির পোলাপান এইখানে গোল্লাছুট দাড়িয়াবান্ধা ধরাছি খেলে। আজিজ গাওয়াল উধাও হওয়ার পর মাসখানেক হল খেলাধুলায় উৎসাহ নাই কারও। বাড়িটা যেন আর মানুষের বাড়ি নাই, গোরস্থান হয়ে গেছে। বাড়ির মানুষগুলি যেন বেঁচে নাই, লাশ হয়ে গেছে।

বিকালবেলা আজ বাড়ির পোলাপান সব উঠানে। নাজুকে কোলে নিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে বড়ঘরের ওটায় বসে আছে বানেছা। তার মুখটা ভাঙাচোরা, চোখের কোলে গাঢ় হয়ে পড়েছে কালি, মাথার চুলে তেল পড়ে না অনেকদিন, পরনের শাড়িটা বেশ ময়লা, সব মিলিয়ে বানেছা একেবারেই ভেঙে পড়া অসহায় মানুষ। উদাস চোখে কোনদিকে যে তাকিয়ে আছে বোঝা যায় না।

নাদের হামেদ পরি জরি বদু বসে আছে মায়ের চারপাশে। এতগুলি মানুষ একলগে তয় কারও মুখে কোনও কথা নাই। সারাক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করা বদু তরি স্তব্ধ হয়ে গেছে।

গাছপালা বাড়ির উঠানপালান আর ঘরের চালে বিকালবেলার রোদ তখন নরম হতে শুরু করেছে। একটা কাক ডাকছে উেঁকিঘরের পিছনে। দুটো শালিকপাখি টুকটুক করে লাফাচ্ছে বারবাড়ির দিকে। সামান্য একটু হাওয়া আসছে দক্ষিণ দিক থেকে।

বাবা উধাও হওয়ার পর বিকালের দিকটায় হামেদের কখনও কখনও মনে হয়, আগে প্রতিদিন গাওয়াল করে বিকালের এই সময়টায় ফিরে আসত বাবা। চকপাথালে ভার কাঁধে দুলে দুলে হেঁটে পুবদিককার ভাঙন ঠেলে উঠত বাড়িতে। হয়তো আজও সেইভাবে ফিরে আসবে।

এই আশায় কোনও কোনওদিন বিকালে বাড়ির ওদিকটায় যায় হামেদ। বাড়ি থেকে নেমে যাওয়া ওটার মুখে পথ চেয়ে বসে থাকে। মনে হয় এই বুঝি বাবা ফিরল। ওই তো চকপাথালে ভার কাঁধে দেখা যাচ্ছে তাকে।

বাবা ফিরে না।

বিকাল ফুরিয়ে সন্ধ্যা হয়। চকমাঠ ডুবে যায় অন্ধকারে, বাবা ফিরে না।

কোনও কোনও সন্ধ্যায় ওঠে চাঁদ। চাঁদের আলোয় স্বপ্নের মতন মায়াবী হয় চক মাঠ আর পায়েচলা মেঠোপথ। সেই পথে কত মানুষ ফিরে, বাবা ফিরে না।

তবু হামেদ বসেই থাকে, তাকিয়েই থাকে।

আজও সেই আশায় নামার দিকটায় এল হামেদ। এসেই চকপাথালে তাদের বাড়িমুখী হেঁটে আসতে দেখল একজন মানুষকে। কাঁধে নতুন মালছামান ভরতি ভার, মানুষটি গাওয়াল মানুষ, দেখতে বাবার মতন, আবার বাবার মতন না। হাঁটাচলা অন্যরকম, পরনের কাপড় অন্যরকম। মাথায় টুপি, দূর থেকেও দেখা যায় মুখের দাড়িমোচ।

মানুষটা কে?

কয়েক পলকমাত্র খেয়াল করে দেখল হামেদ। তারপর প্রাণফাটানো একখান চিৎকার দিল। মাগো, ওমা, বাবায় আইছে। বাবায়।

তারপর দিকপাশ না তাকিয়ে একদৌড়ে চকের দিকে নেমে গেল।

হামেদের চিৎকারে তখন বাড়িতে বিশাল সাড়া পড়ে গেছে। পোলাপানরা তো বারবাড়ির দিকে ছুটে গেছেই, নাজুকে কোলে নিয়াই পাগলের মতন ছুটে গেছে বানেছা। তার বুক থেকে যে খসে পড়েছে শাড়ির আঁচল, উঠোনের ধুলামাটিতে যে লুটাচ্ছে, খেয়ালই করল না।

হামেদ তখন বাবার কাছে পৌঁছে গেছে। গিয়ে প্রথমেই দুইহাতে জড়িয়ে ধরেছে বাবাকে। তারপর কেঁদে ফেলেছে। তুমি কই গেছিলাগা বাবা? এতদিন আহো নাই ক্যা?

ছেলের এই আবেগ আগে কখনও দেখা হয় নাই আজিজের। বুকটা হু হু করে উঠল তার, চোখ ছলছল করে উঠল। ছেলের মাথায় ডানহাত রেখে মায়াবী গলায় বলল, কান্দি না বাজান, কান্দি না। এইত্তো আমি আইয়া পড়ছি।

তখন নাদের পরি জরি এমনকী বদুও ছুটে আসছে বাবার কাছে। বাবাকে ঘিরে ধরে। কত আবেগ, কত মমতা তাদের। কেউ বাবার হাতটা একটু ধরে, পেটটা পিঠটা একটু ধরে, বদু এসে লেগে থাকে বাবার হাঁটুর লগে। নাদেরের ইচ্ছা করে বাবার কাঁধের ভারটা নামিয়ে নিজের কাঁধে নেয়। তয় সেই সামর্থ্য এখনও তার হয়নি। তবু অন্য একটা উপায় সে বের করল। বলল, এত ভারী ভার কান্দে, তোমার তো বহুত কষ্ট অইতাছে বাবা। আমরা বেবাকতে একটা একটা কইরা জিনিস হাতে লই, তাইলে বাজার ভার কমবো।

কোন ফাঁকে যে ভারটা কাঁধ থেকে চকে নামিয়েছে আজিজ, খেয়াল নাই। পোলাপানের এত আবেগ কখনও দেখা হয় নাই বলে ভিতরটা তোলপাড় করছিল গভীর আবেগে। চোখ বেয়ে বারবার নামতে চাইছিল কান্না। নাদেরের কথা শুনে কান্নাটা আর ধরে রাখতে পারল না সে। একহাতে চোখ মুছে আরেক হাতে বুকের কাছে টেনে আনল ছেলের মাথা। না বাজান না, এত কষ্ট তোমগো করন লাগবো না। আমিঐ পারুম।

পরি জরিকে কাছে টানল আজিজ। কী গো মা’রা, কেমুন আছো তোমরা?

বাপের আদরে দুই মেয়েই তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পরি বলল, তোমার লেইগা একটা রাইতও ঘুমাইতে পারি নাই বাবা। একদিকদা মায় কানছে বিলাপ কইরা আরেক দিকদা আমি আর জরি কানছি চুপ্পে চুপ্পে। বাবা গো, তুমি কই গেছিলা গা? আমগো কথা তোমার মনে অয় নাই? আমগো লেইগা তোমার মায়া লাগে নাই বাবা?

আজিজ চোখ মুছতে মুছতে বলল, হ গো মা লাগছে। খুব মায়া লাগছে। দূরে থাইক্কা, এতদিন বাদে ফিরত আইয়া আমি আইজ বুজছি তোমরা আমারে কত মহব্বত করো মা, আমি তোমগো কত মহব্বত করি।

জরি কান্নাভরা নাক টেনে বলল, আর কোনওদিন এমুন কইরো না বাবা। আমগো ছাইড়া কোনওদিন চইলা যাইও না।

না গো মা, যামু না, কোনওদিনও যামু না। হারাডা জীবন তোমগো বুকে লইয়াঐ বাঁইচ্চা থাকুম। তোমরা দেইখো।

হাজামবাড়ির নামার দিকে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছে তছির মা, মেয়ে কোলে দেখছে আবদুলের বউ। আর নিজেদের বারবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে নাজুকে কোলে নিয়া অপলক চোখে দেখছে বানেছা।

চকে তখন নাদের আজিজকে বলল, ভারডা এহেনে থাউক, তুমি বাইত যাও বাবা।

আজিজ অবাক হল। কচ কী? তয় ভার নিবো কেডা?

আমরা নিতাছি।

কেমতে?

ওই যে কইলাম এহেকজনে এহেকখান জিনিস হাতে লমু। বেবাকতে একহান দুইহান কইরা লইলে ভার খালি অইয়া যাইবো।

হামেদ বলল, তারবাদে খালি ভারডা ভাজ কইরা লইবো নে দাদায়।

আজিজ মায়াবী গলায় বলল, এত কষ্টের কাম কী বাজান? আমিঐ লইয়া যাই!

ভাইদের লগে পরিও তখন গলা মিলিয়েছে। না বাবা আমরাঐ নেই। তুমি যে ফিরত আইছো এইডা আমগো ইদের লাহান আমোদ। আমগো ইট্টু আমোদ করতে দেও।

আইচ্ছা মা, আইচ্ছা। করো, যত ইচ্ছা আমোদ করো। তয় আমিও তোমাগো লগে একলগেঐ বাইত্তে যাই।

একটা-দুইটা করে জিনিস হাতে নিল ছেলেমেয়েরা। কেউ দুইখান কলসি দুইহাতে, কেউ বুকের কাছে একপাজা থালবাসন, কেউ ঘটিবাটি লোটা বদনা, কেউ হাঁড়ি পানদান কড়াই। ছোট্ট বদু নিয়েছে অ্যালুমিনিয়ামের একেবারেই হালকা একখান জগ। ভারটা ভজ করে নিয়েছে নাদের। বাবাকে মাঝখানে রেখে বিকাল শেষ হয়ে আসা আলোয় দলটা বাড়ির দিকে আগাতে লাগল।

বানেছা তখনও পাথরের মতন দাঁড়িয়ে আছে বারবাড়িতে। কী যেন কী কারণে একদমই কান্না পাচ্ছে না তার। যে মানুষটার জন্য হাহাকার করে গত একমাসে প্রায় শেষ হয়ে গেছে। সে, খাইতে পারে নাই, ঘুমাইতে পারে নাই, দুনিয়াদারি এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল যার জন্য সেই মানুষের ফিরে আসার কথা শুনে আনন্দ উত্তেজনায় যেরকম তোলপাড় করে উঠেছিল বুক, সেই অনুভূতিটাও যেন এখন আর নাই। কোথা থেকে যেন তার মনের ভিতর এসে চেপে বসেছে আশ্চর্য এক অভিমান। সেই অভিমান যেন একেবারেই নিরাবেগ করে। রাখছে তাকে।

পোলাপানের লগে আজিজ তখন উঠে আসছে বারবাড়িতে। বানেছার সামনে দাঁড়িয়ে গভীর দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার মুখ দেইখাই আমি বুইজ্জা গেছি কেমুন আছিলা তুমি। এর লেইগা কথাডা আর জিগাইলাম না। তয় বহুত কথা আছে তোমার লগে। পরে কমুনে। মাগরিবের ওক্ত অইলো, অহন ঘাডে গিয়া অজু কইরা আইয়া। নমজ পড়ুম। এই ফাঁকে তুমি ইট্টু ভালভালাই রান্দ। পোলাপানের লগে বইয়া খামুনে।

বানেছা কথা বলল না। রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

.

কয়দিন ধরে সারারাত মাটি ফেলার কাজ চলছে সড়কে।

একদল নতুন মাটিয়াল নেওয়া হয়েছে, মাটিয়ালদের আরেকজন সর্দারও নেওয়া হয়েছে, তার নাম চানমিয়া। দিনেরবেলা সর্দারি করে হেকমত, সন্ধার পর থেকে করে চানমিয়া। আবার উলটাপালটাও হচ্ছে কোনও কোনওদিন। দিনের সর্দার দিনভর জিরায় কাজ করছে রাতেরবেলা, রাতের সর্দার করছে দিনে। মাটিয়ালরাও কেউ কেউ সময় বদলে যার যখন। ভাল লাগছে করছে। এই নিয়া আলী আমজাদের কোনও কথা নাই। যার যখন ইচ্ছা করুক তার কাজ হলেই হল। উপর থেকে চাপ আসছে, যত দ্রুত সম্ভব মাটির কাজ শেষ করতে হবে। তারপর শুরু হবে ইটবিছানোর কাজ, তারও পর পাকা করার কাজ। সেই ফাঁকে রাস্তার দুইপাশে লাগানো হবে গাছ।

অবশ্য ঢাকার দিক থেকে এইসব কাজ শুরুও হয়ে গেছে। ষোলোঘরের ওদিক তরি ইট বিছানো হয়ে গেছে, গাছ লাগানো হয়ে গেছে। গাড়ি ঘোড়াও চলতে শুরু করেছে। এখন। মাওয়া তরি মাটি ফেলার কাজ শেষ হলেই অন্যান্য কন্ট্রাক্টররা এসে অন্যান্য কাজ শুরু করে দেবে।

চব্বিশ ঘণ্টাই কাজ চালাতে হচ্ছে বলে বাড়িতে আলী আমজাদ আজকাল যাচ্ছেই না। মোটরসাইকেল নিয়া সাঁ সাঁ করে এদিক যাচ্ছে, ওদিক যাচ্ছে। মোটরসাইকেলের পিছনে সব সময়ই কোনও না কোনও ইয়ারদোস্ত আছেই। দৌড়াদৌড়ি শেষ করে পথপাশের ঘরে বসে আড্ডা চাটামি করছে। মদ প্রতিদিনই চলছে। দিন নাই, রাত নাই, যখন ইচ্ছা। ফলে ঘরের চারপাশ মদের গন্ধে সারাক্ষণই মাতোয়ারা হয়ে আছে।

টাকা যেমন কামাচ্ছে লোকটা, ইয়ারদোস্তদের নিয়া খরচাও করছে মন্দ না। তবে ব্যবহারটা তার এখন যেন আগের চেয়েও খারাপ, আগের চেয়েও মারমুখী। মনমতো কিছু না হলে সর্দার মাটিয়াল কাউকেই ছাড়ছে না। আগে বকাবাজি করত প্রথমে, তারপর হয়তো থেমে যেত, নয়তো চড়-চাপড় লাথি গুঁতা দুয়েকটা মারত। এখন শুরুই করে মাইর দিয়া, বকাবাজি পরে।

এই কারণে সর্দার মাটিয়াল সবাই খুব সচেতন।

তবে রাতের কাজ দিনে, দিনের কাজ রাতে করা যাচ্ছে বলে কোনও কোনও মাটিয়াল এই সুযোগটা নিচ্ছে। পয়সা যে বেশি পাওয়া যাবে তা না, নিত্যদিনকার একঘেয়েমি কাটাবার জন্যই সময় বদলে নিচ্ছে কেউ কেউ।

আদিলউদ্দিনও শুরু করেছে আজ।

সর্দার চানমিয়া আর নতুন তাগড়া জোয়ান মাটিয়ালদের ভিড়ে নিজের ভাঙাচোরা শরীর নিয়ে তার মতন করে কাজটা সে শুরু করেছে। সবাই নতুন, কেউ তাকে চিনে না, সে কাউকে চিনে না। তবু নিয়ম মতো মাটি ভরে দিচ্ছে গোড়ায়, মাথায় তুলে দিচ্ছে। জায়গামতন নিয়া ফেলে আসছে আদিলউদ্দিন। দুইখান হ্যাঁজাক জ্বলছে রাস্তার দুইপাশে। সাদা ম্যান্টেল থেকে আসছে সাঁ সাঁ শব্দ। সর্দার প্রায়ই পাম্প করছে হ্যাঁজাগে। এলাহি। কাণ্ড। কেউ কারও দিকে ফিরাও তাকাচ্ছে না।

আকাশে ম্লান চাঁদ আছে, ম্যাটম্যাটা জ্যোৎস্না ফুটেছে গ্রাম প্রান্তরে। শেষ চৈত্রের রাত্রিকালীন হাওয়াটা আছে। এই হাওয়ায় খাইগোবাড়ির মসজিদ থেকে ভেসে আসছে। মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেবের মধুময় সুরের এশার আজান।

মাথায় তখন মোড়া ভরতি মাটি আদিলউদ্দিনের। ফেলতে গিয়াই আজানের শব্দ পেল। লগে লগে নামাজের জন্য তৈরি হয়ে গেল সে। অন্ধকার মতন একটা দিকে চানমিয়ার চোখে যাতে না পড়ে এমন ভঙ্গিতে ছোঁড়া হাতে নেমে গেল।

এই দিকটায়ই মাটি ফেলছে মাটিয়ালরা। দূরে গেলে ফিরতে দেরি হবে দেখে মাটি ফেলবার জায়গার একটি কোণে মাজার গামছা বিছায়া, লুঙ্গির কোচড়ে যত্ন করে রাখা টুপি বের করে নামাজ পড়তে বসে গেল আদিলউদ্দিন। তবে বসল বেশ গা বাঁচিয়ে, যাতে মাটি এসে গায়ে না পড়ে। নির্বিঘ্নে নামাজটা শেষ করা যায়।

নামাজে বসে বহুদিন ধরেই এই মাটির পৃথিবীতে যেন আর থাকে না আদিলউদ্দিন। অচিনলোকের অলৌকিক এক মহাজগতে যেন চলে যায়। পার্থিব সবকিছু লুপ্ত হয়ে যায় চোখ থেকে, চিন্তা চেতনা থেকে।

আজও তাই হয়েছে।

ঠিক তখন মাটিয়ালদের একটা দলকে ওদিকেই পাঠিয়েছে চানমিয়া। ওদিকে মাটি ফেলার আদেশ দিয়েছে। দিকপাশ না ভেবে মাটিয়ালরা ছোঁড়ার পর গোড়া ভরতি মাটি এনে ফেলতে শুরু করেছে। একজন মানুষ যে নামাজে বসেছে, পরম করুণাময়ের উদ্দেশে দুইহাত তুলে নিজের সারাজীবনের গুনার জন্য যে কাঁদছে, মজনুর জন্য যে কাঁদছে, টেরই পেল না তারা। মাটি ফেলতে লাগল।

মাটির আড়ালে ডুবে যেতে যেতে মানুষটা তখন তার মোনাজাত শেষ করেছে। শেষ করেই পার্থিব জগতে ফিরেছে। তখন তার আর শব্দ করবার উপায় নাই, নড়াচড়ার উপায় নেই। পাঁচদিক থেকে উড়ে আসা মাটির চাপে চোখের আলো নিভে আসছে। বুকের ভিতর থেকে প্রবল চাপে নাকমুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে গনগনে তাপ উত্তাপ। বুঝি বা এই উত্তাপের নামই জীবন।

অদূরের মাঠে তখন পড়েছিল ম্লান চাঁদের ম্যাটম্যাটে একটুখানি জ্যোত্সা। সেই জ্যোৎস্নায় সাদা আলখাল্লা পরা চারজন মানুষকে আদিলউদ্দিন তারপর দেখতে পায় সবুজ রঙের কাঁচা বাঁশের তৈরি চারদিক ভোলা একখান পালকি নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। মানুষ চারজনের নিজস্ব আলোয় যেন মার খেয়ে যাচ্ছে চাঁদের আলো, মানুষ চারজনের নিজস্ব আলোয় যেন আদিলউদ্দিনের চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে অচিনলোকে পৌঁছুবার এক মায়াবী পথ।

মাটিয়ালরা তখনও তাদের নিজস্ব নিয়মে মাটি ফেলে যাচ্ছিল।

.

তুমি অহন বিড়ি খাও না?

ঘরের চাল টপকে উঠানে এসে পড়েছে একটুখানি ম্লান জ্যোত্স। এই জ্যোৎস্নায় বানেছার মুখ পরিষ্কার দেখা যায় না। তবু মুখটা দেখার চেষ্টা করল আজিজ। সে ফিরে আসার পর এখনও কি বানেছার মুখে লেগে আছে গভীর দুঃখকষ্ট, উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আর প্রিয়মানুষ উধাও হয়ে যাওয়ার বেদনা! নাকি এখন তার মুখ অন্যরকম! নাকি এখন তার মুখে এসে ভর করেছে অন্তর ভরে থাকা অভিমানের ছায়া!

বানেছা বসে আছে বড়ঘরের ওটায়। জায়গাটা ছেয়ে আছে আবছা অন্ধকারে। ম্লান জ্যোৎস্নাটুকু ওখানে পৌঁছায়নি। ঘরের চাল টপকে ছনছা ছাড়িয়ে অনেকখানি দূরে এসে পড়েছে।

বানেছার পিছনে ঘরের দরজা হাট করে খোলা। ঘরে কোনও আলো নাই, শব্দ নাই। বহুদিন পর বাবাকে ফিরে পেয়ে পোলাপানরা আমোদ আহ্লাদ আবেগ আনন্দে ফেটে পড়েছিল। অনেকটা রাত তরি উঠানে বসে, ছুটাছুটি করে, গল্প গুজব হাসিমজায় বাড়িটা মাতিয়ে রেখেছিল। রান্নাচালায় বসে বানেছা তখন ব্যস্ত হাতে রান্না করছিল। ফিরে এসেই স্বামী চেয়েছে ভালভালাই খেতে। তয় কী খাওয়াবে সে! ঘরে তো তেমন কিছুই নাই।

তখনই মনে পড়েছে সের পাঁচেক চিনিগুড়ি চাউল আছে একটা জেরে। আর বছর দক্ষিণ পাইকসার এক শৌখিন গিরস্তবাড়ি থেকে চাউলটা এনেছিল আজিজ। সেই বাড়িতে গাওয়াল করতে গিয়া পুরানা মালছামান আর সের পাঁচেক চিনিগুড়ি চালের বিনিময়ে পিতলের মাঝারি সাইজের একখান কলসি দিতে হয়েছিল গিরস্তকে।

চাউলটা পোলাওয়ের জন্য অতুলনীয়। তয় পোলাও আজ তরি রান্না করা হয় নাই। মাঝখানে দুইটা ইদ গেল, চাউলটা হাতে আসার কিছুদিন পরেই ছিল কোরবানির ইদ, সেই ইদে গিরস্তঘরে পোলাও তেমন রান্না হয় না। হয় খিচুড়ি। খিচুড়ি আর সেঁউই (সেমাই) খেয়ে নামাজ পড়তে চলে যায় লোকে। ফিরে এসেই শুরু করে কোরবানি। তারপর তো দিন কাটে গোরু বরকির গোস্ত নিয়া। তিন-চারটা দিন গ্রামে শুধুই রান্না করা গোস্তের গন্ধ। চকের এদিক ওদিক গোরু বরকির হাড়গোড় আর নাড়িভুড়ির ভিতর থেকে বের হওয়া মলের দুর্গন্ধ। হাওয়াটাই যায় অন্যরকম হয়ে, পরিবেশটাই যায় অন্যরকম হয়ে।

আজিজ গাওয়াল কোরবানি দেয় না। কোরবানির দিন নামাজ পড়েই নাদের-হামেদকে নিয়ে চলে যায় মেন্দাবাড়ি। এনামুল ঢাকা আর মেদিনীমণ্ডল দুই জায়গাতেই কোরবানি। দেয়। নানার বাড়িতে খালার সম্মানে দেয় বড় এক ষাঁড়। গোরু বানানোর কাজে ওস্তাদ এমন লোকজনের লগে মিলেমিশে দুই ছেলেকে নিয়া আজিজও কাজটা করে। তারপর ভাগে পাওয়া গোস্তের লগে উপরি পায় উজরিটা (নাড়িভুড়ি)। সেই জিনিস গোড়ায় ভরে বাড়িতে এনে আবার পড়ে ওই নিয়া। উজরি পরিষ্কার করা, ধোয়া পাকলা, ম্যালা কাজ। তারপর দুইদিন ধরে চলে ওই জিনিস রান্না আর গরম করা। পোলাপানরা দিন দুইতিনেক থালভরতি মুড়ির লগে উজরি আর দুয়েক টুকরা গোস্ত, গোস্তের সুরা (ঝোল) খেয়েই আনন্দে থাকে। ওই ফাঁকে পোলাও রান্নার দরকারটা কী! তা ছাড়া পোলাও রান্না তো খরচেরও ব্যাপার! ঘি লাগবে। কোরবানির ইদে না হয় বড় গিরস্তবাড়ি থেকে পাওয়া গোরু বরকির গোস্ত দিয়া পোলাওটা খাওয়া হল! রোজার ইদে! রোজার ইদে তো পোলাও রাধলে মুরগিও লাগে! মুরগির গোস্ত ছাড়া পোলাও খাওয়ার অর্থই হয় না। যার লগে। আর মুরগি মানে কমপক্ষে দুইটা। দুইটা মুরগি ছাড়া এতগুলো পোলাপানের হবে নাকি! এক টুকরা করে দিলেও তো দুইটা মুরগি লাগে!

এইসব কারণে দুই ইদের কোনওটাতেই চিনিগুড়ি চালের পোলাওটা বানেছার রান্না করা হয় নাই। আজ এত বিপর্যয়ের পর সংসারে মানুষটা তার ফিরেছে। এসেই চেয়েছে পোলাপান নিয়া ভালভালাই খেতে। বানেছা কি আজ পোলাও রাধবে!

তয় ঘি? মুরগি?

মুরগি সমস্যা না। বাড়ির পালা মোরগ মুরগি থেকে ড্যাকরা মতন দুইটা জবাই করলেই হবে। সমস্যা হচ্ছে ঘি। ঘিও ইচ্ছা করলে এখনই মাওয়ার বাজারের সেন্টু ঘোষের দোকান থেকে আনায়া নেওয়া যায়। রসগোল্লাটা যেমন খাঁটি বানায় সেন্টু, ঘিটাও বানায় তেমন। নাদের-হামেদকে পাঠায়া দিলেই দৌড়ে গিয়া নিয়া আসবে।

আয়োজনটা করার জন্য তৈরি হয়ে গেল বানেছা।

ঘরে গোপনে কিছু টাকাপয়সা সবসময়ই বানেছার কাছে রাখত আজিজ। গত এক মাসে সেইসব টাকার কিছু খরচা হয়েছে। নগদ পঁচিশ-তিরিশ টাকা গেছে জিন ডাক দিতে। এদিক ওদিক গেছে আরও কিছু। তবু এখনও হাতে যা আছে পোয়াখানেক ঘি আনানো যাবে।

আজিজ তখন চৌকিতে উঠে মাগরিবের নামাজ পড়ছে।

দুই ইদ ছাড়া বাবাকে কখনও নামাজ পড়তে দেখে নাই পোলাপানে। মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি এই বাবাকেও দেখে নাই কোনওদিন। ফিরে আসার পর থেকে তাই বাবার প্রতিটা আচরণ খেয়াল করছিল তারা। মাগরিবের সময় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছিল বাবার নামাজ পড়া।

এসময় শিকায় তোলা একটা পট থেকে টাকা যা ছিল বের করল বানেছা। সেই টাকা হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নাদের-হামেদকে পরি-জরিকে ডাকল। নাদের-হামেদকে বলল, সব থিকা বড় মোরগ দুইডা জবো কইরা দে। তারবাদে মাওয়ার বাজারে গিয়া সেন্টুর দোকান থিকা একপোয়া ঘি লইয়ায়। পরি-জরিরে লইয়া আমি মোরগ বানাইতে বানাইতে ঘি লইয়া ফিরত আবি। দৌড়াইয়া যাবি, দৌড়াইয়া আবি। তর বাপে তগো লইয়া ভালভালাই খাইতে চাইছে। এর লেইগা আমি পোলাও মোরগ রাম।

শুনে আনন্দে একেবারে ফেটে পড়ল সবাই। লগে নাদের-হামেদ দৌড়ে গেল মোরগ ধরতে। তাদের লগে ছুটাছুটি শুরু করল পরি জরি বদু। ছোট্ট নাজুও টলমল পায়ে ভাইবোনদের লগে তাল মিলাতে চাইল।

মোরগ ধরে পশ্চিম দিককার আমগাছটার কাছে নিয়ে জবাইয়ের কাজটা দ্রুতই সেরে ফেলল নাদের হামেদ। একহাতে শক্ত করে মোরগের দুই পা আর ডানা ধরল হামেদ। অন্যহাতে টানা দিয়া ধরল গলার কাছটা। নাদেরের একহাতে মাঝারি সাইজের ধারালো ছুরি। মোরগের মাথাটা একহাতে টেনে ধরে, তার আর হামেদের ধরা মোরগের গলার টানা দেওয়া জায়গাটার মাঝবরাবর বিসমিল্লাহ বলে ছুরি চালিয়ে দিল। পলকে ফিনকি দিয়ে বেরুল রক্ত, মোরগটা শরীরের শেষ শক্তি দিয়ে নড়াচড়ার চেষ্টা করল, হামেদের শক্ত হাতের জোরে কুলাতে পারল না।

জবাই শেষ করেও লগে লগেই মোরগটাকে মাটিতে ফেলে দিল নাদের। হামেদ চাইছিল। নাদের বলল, না, জবো করনের লগে লগে ছাইড়া দিলে মাডিতে পইড়া দাপড়া দাপড়িডা মোরগে বেশি করে। অমুন করলে রক্তমক্ত ছিট্টা জামা কাপড় বিনাশ হইবো বেবাকতের।

শুনে হামেদ বুঝদারের মতন বলল, হ ঠিকঐ কইছস দাদা।

তারপর মোরগের প্রাণটা একেবারে বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত, মোরগ একেবারে নিস্তেজ হওয়া তরি দুইভাইয়ে মিলে ধরেই রাখল। যখন বুঝল, হ্যাঁ, এখন আর নড়াচড়ার ক্ষমতা নাই, প্রাণটা চলে গেছে মোরগের, তখন অদূরে মোরগ জবাই করতে দেখা ভাইবোনদের পায়ের কাছে ফেলে দিল।

অন্য মোরগটা ছিল পরির হাতে, ঠিক আগের কায়দায় সেটাও জবাই করল নাদের হামেদ। তারপর রান্নাচালার বাইরে পুরানা মাটির ঠিলায় রাখা পানি ঢেলে হাত ধুয়ে দুইভাইয়ে মিলে রওনা দিল মাওয়ার বাজারে। পরি জরিদের মনে তখন ইদের দিনকার সকালবেলার মতন আনন্দ। মায়ের লগে হাত মিলিয়ে এটা ওটা করতে লাগল।

নামাজ শেষ করে বড়ঘরের ওটায় পিঁড়ি নিয়ে বসেছিল আজিজ। বদু নাজু ঘুরঘুর করছিল তার কাছে। নাজুকে একহাতে কোলে টেনে বসাল সে, অন্যহাতে বন্দুকে ধরে রাখল বুকের কাছে। টুকটাক কথা বলতে লাগল তাদের লগে আর রান্নাচালার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মা-মেয়েদের রান্নাবান্নার আয়োজন দেখতে লাগল।

এইভাবে কেটেছে সারাটা সন্ধ্যা, রাতের অনেকখানি। নাদের হামেদ ঘি নিয়া ফিরে। আসার আগেই মোরগ বানিয়ে চুলায় বসিয়ে দিয়েছে বানেছা। মশলা পিয়াজের গন্ধে ভরে গেছে বাড়ি। সেই ফাঁকে রাবি আর বাদলা এসে ঘুরে গেছে, মেয়ে কোলে আবদুল আর আবদুলের বউ এসে ঘুরে গেছে। মিয়াবাড়ি থেকে আসছিল আলফু। একটু দূরে বাড়ি, তবু খবর পেয়ে আসছিল দবির গাছি। তাদের লগে টুকটাক কথা বলেছে আজিজ। কোথায়। ছিল এতদিন, কী বৃত্তান্ত খোলসা করে বলে নাই কিছুই। জানতে চেয়েছে সবাই। আজিজ হাসিমুখে বলেছে, আছিলাম নানান জায়গায়। ইচ্ছা কইরাঐ আছিলাম। কোনও বিপদ আপদ অয় নাই।

শুনে আশ্বস্ত হয়ে যে যার মতন ফিরে গেছে। শুধু হতাশ হয়েছে বাদলা। সে আশা করেছিল ভীষণ একখান উত্তেজক গল্প শুনবে গাওয়ালের মুখে, হয়তো শুনবে ডাকাতেই ধরেছিল তাকে, ধরে নিয়ে আটকে রেখেছিল কোথাও, তারপর দয়া করে ছেড়ে দিয়েছে। এই দয়ার পিছনে আছে কোনও মানবিক গল্প। যখন শুনল এসবের কিছুই না তখন হতাশ। হয়ে রাবিকে বলল, রাইত অইয়া গেছে। লও মা, বাইত যাই।

রান্নাবান্না শেষ হতে হতে বেশ রাত। তারপর পোলাপান নিয়া খাইতে বসছে আজিজ। বানেছা বেড়ে দিচ্ছিল। আজিজ বলল, তুমিও বহো। বেবাকতে একলগে খাই।

বানেছা আজিজের দিকে তাকাচ্ছিল না। অন্যদিকে তাকিয়ে ম্লান গলায় বলল, না। থাউক। আমি পরে খামুনে।

আজিজ অনুনয়ের গলায় বলল, ক্যা? আমগো লগেঐ খাও। বেবাকতে একলগে মিল্লা খাইলে ভাল খাওন আরও ভাল লাগে। তুমি এতো কষ্ট কইরা মোরগ পোলাও রানছো, আর আমগো লগে বইয়া খাইবা না, এইডা আমার ভাল্লাগবো না। বহো।

আজিজ ফিরে আসার পরপরই বানেছা তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝে গিয়েছিল মানুষটা আর আগের মানুষ নাই, অন্যমানুষ হয়ে গেছে। বাইরের বদলটা পলকেই বুঝে গিয়েছিল সে। ভিতরের বদলটা বুঝতে সময় লাগছিল। এখনকার কথায় সেটাও অনেকখানি বুঝে গেল।

তারপর নিজের থাল নিয়ে খেতে বসেছিল বানেছা।

খাওয়াদাওয়া শেষ করে পোলাপানরা যে যার মতন শুয়ে পড়েছে। এতদিনকার উদ্বেগ উৎকণ্ঠা শেষ হয়েছে আজ, বাবা ফিরা আসছে, ফলে শোয়ার লগে লগেই নিশ্চিন্তে ঘুমায়া পড়ছে সবাই। চৌকির উপর আজিজ তখন এশার নামাজ পড়তে দাঁড়িয়েছে, আর এতগুলি। মানুষের খাওয়াদাওয়ার পরের কাজগুলি করছিল বানেছা।

নামাজ শেষ করে ঘর থেকে বেরিয়েছে আজিজ। বানেছাকে ডেকেছে। বাইরে জোছনা আছে। আহ উডানে বইয়া কথাবার্তা কই দুইজনে।

হাতের কাজ শেষ করে বেরিয়েছে বানেছা। বড়ঘরের ওটায় বসেছে। আজিজ গিয়ে বসেছে ঢেঁকিঘরের ওটায়। তখন আচমকাই বিড়ি খাওয়ার কথাটা বলল বানেছা। আজিজ ফিরে আসার পর তার লগে নিজ থেকে এই প্রথম কথা বানেছার। শুনে আজিজ বলল, না, বিড়ি খাওন আমি ছাইড়া দিছি। জীবনের অনেক কিছু আমি ছাইড়া দিছি। জীবনডা আমি বদলাইয়া হালাইছি। আজিজ গাওয়াল আর আগের মানুষ নাই। অন্য মানুষ অইয়া গেছে।

বানেছা উদাস গলায় বলল, হেইডা আমি বুজছি। তোমার চেহারা সুরৎ বদলাইয়া গেছে, মন বদলাইয়া গেছে। তুমি নমজ ধরছো। পোলাপানের লেইগাও মায়া মহব্বত আইজ দেকলাম বেশি। কোনওদিন পেপালাপানরে এত আদর করতে দেহি নাই। কথাবার্তা, চালচলনও বদলাইছে তোমার।

হ কইলাম না, বেবাকঐ বদলাইছে। তয় পোলাপানডিরও যে আমার লেইগা এত টান এইডা আমি আগে কোনওদিন বুজি নাই। আইজ যহন ফিরত আইলাম তহন বোজলাম।

বানেছা কথা বলল না, দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

আজিজ বলল, তোমার টানডাও আমি বুঝছি। আমার লেইগা তোমার বহুত টান। তুমি যে আমার লেইগা একদোম শেষ অইয়া গেছিলা, বাইত্তে উইট্টা, তোমার মোক দেইক্কাঐ আমি হেইডা বুজছি।

আজিজের কথায় চোখ ফেটে কান্না এল বানেছার। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছল সে, নাক টানল।

আজিজ বুঝল বানেছা কাঁদছে। উঠে এসে বানেছার সামনে দাঁড়াল সে, হাত বাড়িয়ে বানেছার একটা হাত ধরল। কাইন্দো না, আহো আমার কাছে।

বানেছা নড়ল না, বসেই রইল।

আজিজ বলল, পোলাপানরা মনে অয় ঘুমাইয়া গেছে। তাও এহেনে বইয়া কথা কওন। ঠিক অইতাছে না। যুদি কেঐ জাগনা জোগনা থাকে তয় আমগো কথা হুইন্না হালাইবো। লও ওইঘরের ওটায় বইয়া কথা কই দুইজনে। তোমার লগে অনেক কথা আছে আমার।

এবার বানেছা উঠল। নাক টেনে খোলা দরজা আবজায়া দিল, স্বামীর লগে এসে বসল ঢেঁকিঘরের ওটায়।

পাশাপাশি বসেই একটা হাত বানেছার কাঁধে দিল আজিজ। গভীর আবেগে তাকাল স্ত্রীর মুখের দিকে। তুমি আমারে লইয়া অনেক চিন্তা করছো, না? মনে করছো আমি মইরা ধইরা গেছি! এতডি পোলাপান লইয়া তুমি কেমুন করবা, আমারে কই বিচড়াইবা! আমিও আলার বাপের লাহান নিরুদ্দিশ অইয়া গেলাম, আমিও আর কোনওদিন ফিরত আমু না, এমুন চিন্তা করছো না?

স্বামী ফিরে আসার পর থেকেই আশ্চর্য এক অভিমানে বুক ভরে আছে বানেছার। স্বামীর মুখের দিকে সহজে তাকাতে পারছিল না সে, কথা বলতে পারছিল না। অচেনা এক অনুভূতি। সন্ধার মুখ থেকে এতটা রাত তরি সেই অনুভূতির মধ্যেই ছিল। খানিক আগে স্বামী হাত ধরায় সেই অনুভূতি খানিকটা ভেঙেছে, এখন কাঁধে হাত দেওয়ায় পুরাপুরিই ভাঙল। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না বানেছা, স্বামীর দিকে ঘুরে দুইহাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেলল। আমগো হালাইয়া কই গেছিলা গা তুমি? ক্যান গেছিলা? আমার লেইগা না অউক পোলাপানডির লেইগা তোমার মায়া লাগে নাই? এতো। নিঠুর তুমি অইলা কেমতে? কেমতে এতদিন আমগো ছাইড়া থাকলা?

বানেছার কান্নায় আজিজেরও চোখ ভরে এল পানিতে। একহাতে বানেছাকে জড়িয়ে ধরে তার মাথায় পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে ধরা গলায় বলল, আমি ইচ্ছা কইরা এমুন করছি। ইচ্ছা কইরা। নিজেরে বদলানের লেইগা এমুন করছি। আমি তো মানুষ আছিলাম না, আছিলাম আমানুষ। আমানুষ থিকা মানুষ অওনের লেইগা আমি এমুন করছি।

মা’কে নিয়া নিজের অপরাধবোধ, সাতদিন বয়সের মেয়েটির জন্মমুহূর্তে আলার মা’র লগে যেসব কথা হয়েছিল সেইসব, মৃত্যুর পরে মেয়েটিকে দাফন না করার অপরাধ, এক দুপুরে বহ্নিছাড়ার ওদিককার হিজলতলায় বসে তোতার সঙ্গের কথা, শেষ পর্যন্ত মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেবের কাছে গিয়া নিজের যাবতীয় গুনার কথা স্বীকার করা, সব বানেছাকে খুলে বলল আজিজ।

শুনে কান্না ভুলে বানেছা স্তব্ধ হয়ে গেল। স্বামীর বুক থেকে মুখ তুলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। যদিও উঠান থেকে ছিটকে আসা ম্যাটম্যাটে জ্যোৎস্নায় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না মুখ, তবু তাকিয়ে রইল।

আজিজও তখন ছেড়ে দিয়েছে বানেছাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, মাওলানা সাবে কইছিলো আল্লার কাছে তোবা (তওবা) কইরা নমজ শুরু করেন বাবা। পাঁচওক্ত নমজ পইড়া এই হগল গুনার লেইগা আল্লার কাছে মাপ চান। মাপ করনেআলা আল্লা। পাকপরোয়ারদিগার লিশ্চই সব গুনা মাপ করবো। যেদিন হুজুরে এই হগল কথা কইল তার দুই-তিন দিন বাদেঐ গাওয়ালে বাইর অইয়া আমি আর ফিরত আইলাম না।

বানেছা নরম গলায় বলল, গেছেলা কই?

পয়লা গেছি দিগলি বাজারে, রতন ভাঙ্গারির দোকানে।

হ হেইডা আমরা জানি।

ওহেন থিকা গেছিগা পয়সা গেরামে। ওই গেরামে বিরাট নামকরা এক মাওলানা হুজুর আছেন। রফিউদ্দিন মাওলানা। তাঁর কাছে গিয়া তোবা করলাম। নমজ তো ছোডকালেঐ হিগছিলাম। তয় পাঁচওক্ত কোনওদিনও পড়ি নাই। আবার নতুন কইরা হিগলাম, পড়তে আরম্ব করলাম। হেদিন থিকা আর দাড়িও কাডি না। পাঁচওক্ত নমজ পড়ি আর পয়সা বৈলতলি ইছাপুর তালতলা কলমা এই হগল গেরামে গাওয়াল করি। যেই গেরামে রাইত অয় হেই গেরামেঐ কোনও না কোনও গিরস্ত বাইত্তে থাকি। নমজি মানুষ, গিরস্তে আদর কইরা থাকতে খাইতে দেয়। গাওয়ালের ফাঁকে ফাঁকে নমজের সময় অইলেঐ নমজ পড়ি আর আল্লার কাছে কান্দি। ইয়া হে আল্লা, পাকপরোয়ারদিগার, আমার জীবনের বেবাক গুনা মাপ করো আল্লা। মাপ করো।

বানেছা বলল, তয় গাওয়াল যে করতা, পুরানা মালছামান দিতা কারে, নিতা কার কাছ থিকা? রতন ভাঙ্গারির দোকানে তো মনে অয় আর যাও নাই?

আইজ গেছিলাম। এতদিন আর যাই নাই। এতদিন ইছাপুর বাজার, কলমা নাইলে তালতলা বাজারের ভাঙ্গারিগো কাছে গেছি। সব ভাঙ্গারিগোঐ একরকম নিয়ম। অসুবিদা। অয় নাই।

তোমার দুই পোলায় যে রতন ভাঙ্গারির কাছে গেছিলো ভাঙ্গারি কি হেই কথা আইজ কইলো তোমারে?

হ।

একটু থেমে আজিজ বলল, তয় কেঐ না কেঐ যে আমারে ভাঙ্গারির দোকানে বিচড়াইতে যাইবো এইডা আমি বুজছিলাম।

এর লেইগাঐ ওইমিহি আর আহো নাই?

হ এইডা একটা কারণ। যুদি ভাঙ্গারি লোকজন দিয়া আমারে বাইত্তে পাড়াইয়া দেয়?

একটু থেমে কী ভাবল বানেছা, তারপর বলল, যেই কামের লেইগা এমুন করলা তুমি, হেই কাম তো বাইত্তে থাইক্কাও করতে পারতা? খাইগোবাড়ির মাওলানা হুজুরের কাছে তোবা কইরা নমজ শুরু করতে পারতা?

হ পারতাম। তয় ঐডা আমি ইচ্ছা কইরা করি নাই।

ক্যা?

নিজেরে বদলানের লেইগা একলা একলা থাকন দরকার আছিলো আমার।

আর এইমিহি আমরা মনে করছি ডাকাইতে মারছে তোমারে।

না। মনডারে আল্লার রাস্তায় নেওনের লেইগা মুসাফির অইয়া গেছিলাম। তোমগো কথা যে চিন্তা করি নাই তা না, তোমগো লেইগা যে মায়া মহব্বত লাগে নাই তা না। তয় বেবাক কিছু মিল্লা আল্লার রাস্তায় গিয়াঐ আমি কইলাম আবার সংসারে ফিরলাম। কারণ তুমি আমার পরিবার, তোমার লেইগা আমার একহান দায়িত্ব আছে। পোলাপানডি আমার, পোলাপানের লেইগাও দায়িত্ব আছে। আল্লার রাস্তায় থাইক্কা বেবাক দায়িত্ব আমি অহন থিকা পালন কইরা যাইতে চাই। তয় সবকিছুর আগে তোমার লগে আমার কথা আছে।

কী কথা, কও।

আমি যা কমু তুমি হোনবা?

হুনুম। তুমি যা কইবা, যেমতে কইবা আমি হুনুম।

বানেছার কথায় আজিজ খুব খুশি হল। হাত বাড়িয়ে বানেছার একটা হাত ধরল। খুশি অইলাম, বহুত খুশি অইলাম তোমার কথা হুইন্না। মনে অইলো মাসেকহানি ধইরা বাইত্তে না আইয়া আমি যেমুন বদলাইছি, বাইত্তে থাইক্কা তুমিও হেমুন বদলাইছো। এই একমাসে তুমি মনে অয় অনেক কিছু চিন্তা করছ।

বানেছা সরল গলায় বলল, হ নিজের অন্নাই অপরাদের কথা চিন্তা করছি। তুমি তোমার মা’র লগে যেই অন্নাই করছ, হেই অন্নাইডা আসলে তোমার না। অন্নাইডা আছিলো আমার। আমার ডরেঐ তুমি তোমার মা’র মিহি ফিরা চাইতে পারো নাই, তার ভরণপোষণ দিতে পারো নাই। আমার লেইগাঐ কিরপিন অইছো তুমি, বচ্ছর বচ্ছর পোলাপানের বাপ অইছো। অন্নাই তোমার না, বেবাক অন্নাই আমার। তোবা তোমার করনের কাম আছিলো না, তোবা করনের কাম আছিলো আমার। যেই অন্নাই আমি আমার হরির লগে করছি, আমার পোলার বউ যুদি আমার লগে অমুন করে তহন যেই দুঃখু আমি পামু, আমার হরিরে তো হেই দুঃখুঐ আমি দিছি। সংসারডা এমুন ছেঁড়াভেড়া অইছে আমার লেইগা। বেবাক দোষ আমার।

শেষদিকে আবার গলা বুজে এল বানেছার। কথা জড়িয়ে এল। আর আজিজের আত্মায় লাগল অন্যধরনের এক কাঁপন, মন ভরে গেল অন্যধরনের এক ভাল লাগায়। আবেগে আবেশে কথা বলতে যেন ভুলে গেল সে। সত্যিই তো, বানেছাও তো চিন্তা করেছে অনেক কিছু। নিজের যাবতীয় অন্যায় অপরাধের কথা চিন্তা করে সেও তো মরছে তীব্র অনুশোচনায়! এই এক মাসের দূরত্বে তারা দুইজনেই তো পেরেছে ভিতর থেকে বদলে যেতে!

আল্লাহ, আল্লাহ! সবই আল্লাহপাকের কুদরত। আল্লাহ চাইলে সব হয়। মানুষ হচ্ছে তার হাতের পুতুল। যেভাবে ইচ্ছা তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে তাদের মনকে তিনি ঘুরিয়ে দেন। মাত্র মাসখানেকের মধ্যে দুইজন মানুষের মনকে কীভাবে ঘুরিয়ে দিয়েছেন! অন্য মানুষ করে দিয়েছেন!

বানেছার পাশে বসে মনে মনে আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করল আজিজ। ইয়া হে আল্লাহ, পাকপরোয়ারদিগার, তোমার রহমতের দুয়ার আমগো লেইগা খুইলা দিছো। বইলাই এমুন বদলান আমরা দুইজন বদলাইতে পারছি। এর লেইগা আল্লাহ আমি তোমার দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া আদায় করতাছি। আল্লাহপাক, তুমি আমগো আরও দয়া করো, আমরা যেন হারাডা জীবন ঠিক থাইকা জীবনডা কাড়াইয়া যাইতে পারি। আর কোনও গুনা য্যান জীবনে আমরা না করি।

নিজেকে সামলে বানেছা বলল, তুমি তো আছিলা না, সংসারের কামকাইজ আমি কিছু করি নাই। বেবাকঐ করছে পরি-জরি। আমি বইয়া বইয়া খালি তোমার কথা চিন্তা করতাম। এই সংসারে আহনের পর থিকা কী কী অন্নাই আমি করছি, বেবাক কথা আমার মনে অইতো। মনে অইতো আমার অন্নাইয়ের লেইগাঐ তুমি এমতে নিরুদ্দিশ অইয়া গেছে। অন্নাইয়ের শাস্তি আল্লায় আমারে, তোমারে নিরুদ্দিশ কইরা দিল। এতডি পোলাপান লইয়া হারাড়া জীবন অহন আমার শাস্তি ভোগ করন লাগবো। এই হগল চিন্তা কইরা রাইত্রে ইট্টুও ঘুমাইতে পারতাম না। খালি কানতাম আর আল্লার কাছে কইতাম, আল্লা তারে তুমি ফিরত আইন্না দেও, আইন্না দিয়া দেহো এই জিন্দেগিতে আমি আর কোনও অন্নাই করুম না, কোনও গুনার কাম করুম না।

গভীর আবেগের গলায় আজিজ বলল, সত্য, সত্যঐ তুমি আল্লার কাছে এই হগল কইয়া কানছো?

হ। তুমি আইজ ফিরত আইছো দেইখা আমার খালি মনে অইছে আল্লায় আমার কথা হোনছে। আমারে দয়া করছে আল্লায়।

ঠিক কথাঐ কইছো। আল্লায় না চাইলে কিছু অয় না। পয়সার রফিউদ্দিন মলবি সাহেব আমারে কইছে, বাজান নমজ পইড়া খালি আল্লার কাছে কান্দেন। মাপকরনেআলা আল্লাহপাক। নিজের বান্দাগো নানান রকমের পরীক্ষার মইদ্যে হালান আল্লাপাকে। হালাইয়া দেহেন পরীক্ষায় তারা পাশ করে কি না। আল্লার কাছে কাইন্দা মাপ চায় কি না। তুমি যে তোমার অন্নাইডা বুইজ্জা আল্লার কাছে কানছো এইডাঐ আছিলো তোমার পরীক্ষা। আমারে সরাইয়া দিয়া এই পরীক্ষা আল্লায় তোমার নিছে। তোমার কান্দন দেইখা তোমার মিহি মুখ তুইলা চাইছে। তয় যেই কথা তোমারে আমি কইতে চাইলাম, যেই জীবন এতদিন আমরা কাডাইছি ওই জীবন আর কামু না।

তয় কেমুন জীবন কাড়ামু?

ভাল মানুষের জীবন, পাক পবিত্র আর আল্লার ন্যাকবান্দার জীবন। কাইল থিকা তুমিও নমজ পড়বা। আল্লার কাছে তোবা কইরা নতুন জীবন শুরু করবা। কোনওদিন একহান মিছাকথা কইবা না, ছল চাতুরি চালাকি করবা না। পোলাপানডিরে আমি নমজ কালাম কোরান শরিফ পড়া হিগাইতে চাই। স্কুল মাদরাসায় ভরতি করাইতে চাই। মানুষের লাহান মানুষ বানাইতে চাই বেবাকতেরে। আল্লায় আমারে জাগাসম্পত্তি টেকাপয়সা যা দিছে এই হগল দিয়া, গাওয়াল কইরা সব ঠিকঠাক লাহান চালাইতে পারুম আমি। তুমি খালি আমার

লগে থাকবা, আমার কথা হোনবা।

বানেছা ধীর গলায় বলল, তুমি যেমতে যেমতে কইলা ওমতে ওমতেঐ সব অইবো। তোমার বেক কথাঐ আমি হুনুম। আইজ থিকা তুমি যা কইবা ওইডাঐ সই। যেমতে আমারে চালাইবা ওমতেঐ আমি চলুম, ওমতেই পোলাপানগো চালামু। জীবনে কোনও অন্নাই আর কোনওদিন করুম না।

একটু চুপ করে থেকে আজিজ বলল, বাইত থিকা যেদিন গেলাম তার পরদিন আরেকহান কাম আমি করছি।

বানেছা বলল, কী কাম?

লৌহজংয়ের সরকারি হাসপাতালে গিয়া একহান অরাপেশন, না না অপরেশন, অপরেশন করাইছি।

বানেছা চমকে উঠল। কী করাইছো? অপরেশন? কীয়ের অপরেশন?

পোলাপান না অওনের।

কও কী?

হ। ওইডারে কয় ভেসেকটেমি। পথটা আমারে ধরণীচাচি দেহাইয়া গেছিলো। খুব ছোড অপরেশন। একদিন হাসপাতালে আছিলাম আমি। তার পরদিনঐ ভার কান্দে লইয়া রাস্তায় নামছি, মুসাফির অইয়া গেছি। আমার কোনও অসুবিদায়ই অয় নাই।

বানেছা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এইডার লেইগাও আমিঐ দুষি। আমি যুদি তোমার কথা হোনতাম তয় এই কষ্ট তোমার করন লাগতো না। কতপদের অষইদ বাইর অইছে আইজ কাইল, হেই হগল অষইদ খাইলেঐ পারতাম।

স্ত্রীকে বুঝ দেওয়ার ভঙ্গিতে তার কাঁধে হাত রাখল আজিজ। থাউক এই হগল লইয়া আর চিন্তা কইরো না। যা অওনের অইয়া গেছে। অহন চিন্তা করো ভবিষ্যৎ লইয়া। কেমতে আল্লার রাস্তায় থাইকা নিজেরা চলুম, পোলাপানডিরে চালামু এইডাঐ অইলো অহন আসল কাম। আইজ থিকা নতুন কইরা আমরা বেবাক কিছু শুরু করলাম, খালি এইডা মনে রাখবা।

স্বামীর বুকে হাত রেখে বানেছা বলল, আইচ্ছা। তুমি যা যা কইলা দেখবা তার বেবাকঐ আমি করুম। ইট্টুও এদিক ওদিক অইবো না।

কও ইনশাল্লাহ।

ইনশাল্লাহ।

ততক্ষণে রাত অনেকটাই গম্ভীর হয়েছে। আকাশের চাঁদ পশ্চিমে বেশ খানিকটা হেলেছে বলে আজিজ গাওয়ালের উঠান থেকে ম্লান জ্যোৎস্নাটাও যেন খানিকটা নেমে গেছে ভাঙনের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *