৩.৬ ফজরের আজান

মান্নান মাওলানা ফজরের আজান দিচ্ছেন, তখনই নৌকা নিয়া আসলো বদু মাঝি।

হাফিজদ্দি তাকে বুঝাইয়া বইলা আসছিল কোন ঘাটে নৌকা ভিড়াইতে হইব। সেইভাবেই মোতাহারের সীমানার ঘাটপারে আইসা নৌকা ভিড়াইল বদু। পারু আর তার তিন পোলাপান আজানের আগেই উইঠা গেছে। কাপড়চোপড় পরে রেডি সবাই। বদু নৌকা নিয়া আসার পর হাফিজদ্দি আর রহিমা আসল পারুর ঘরে। ব্যাগ দুইটা নিয়া নৌকায় তুইলা দিল হাফিজদ্দি। সে আর রহিমা অন্য সবার মতন জানে বইনের বাড়ি, বাপের বাড়ি নার যাইতাছে পারু। সামনে ভাদ্দরমাস, ওই মাস কাবার কইরা, বাইষ্যার পানি থাকতে থাকতে ফিরত আইবো। এইজন্য তাদের মনে কোনও দুঃখ বেদনা নাই। তারা এক ধরনের আনন্দেই আছে। বাড়ির বউঝিরা বেড়াইতে যাওয়ার সময় বাড়ির কাজের লোকদের কেন যে একটা আনন্দ হয়!

এত সকালে নাস্তাপানি খাওয়ার কিছু নাই। পোলাপান তিনটা পেশাব পায়খানা সাইরা নিছে। হাতমুখ ধুইয়া, দাঁত মাইজা একদম পয় পরিষ্কার। রাস্তাঘাটে নসু আর নুরির পেশাব করার দরকার হলে অসুবিধা নাই। নসু তো পোলা, তার অসুবিধা কী? ছইয়ের বাইরে গিয়া দাঁড়ায় দাঁড়ায়া ছ্যাড়ছ্যাড় কইরা ছাইড়া দিলেই হইল। নূরিরেও বসাইয়া দিলেই হবে। অসুবিধা শুধু পারু আর শিরির। সেটারও কোনও অসুবিধা মনে করে না দেশ গ্রামে নাঐর যাওয়া বউঝিরা। রাস্তায় কত গিরস্তবাড়ি। কোনও বাড়িতে নামলেই হল।

আলো ফুটছে বাইরে। বর্ষার পানির মতন আলোটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে লাগল। আমগাছ জামগাছে কাকপক্ষী ডাকছিল বিয়ানরাত থেকে। জামগাছের ওদিকটায় ওড়াউড়ি করছে শালিক পাখি। হিজল ডুমুরের ঝোঁপের ওদিক থেকে উইড়া আসল একটা দইকুলি (দোয়েল)। আথালে বান্দা গোরুগুলির একটা হাম্বা হাম্বা করছে। আস্তে ধীরে জেগে উঠছে দুনিয়াদারি। মান্নান মাওলানার নামাজ পড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আতাহার ঘুমাচ্ছে। বাংলাঘরে। যে মানুষটার লগে সম্পর্ক সে যে বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে, সে জানে মাসখানেক পর ফিরবে, তাও কি একবার উইঠা আসব না! হাসিমুখে আর নাইলে মন খারাপ করা ভঙ্গিতে। বিদায় দিবো না মানুষটারে!

হালকা কলাপাতা রঙের সুতি শাড়ি পরেছে পারু। তার হাতে এক গোছা চাবি আর একটা তালা। কেবিনের আলমারি তালা মারছে সে, কেবিনের দুয়ারে তালা মারছে। এখন। ঘর থেকে বাইর হইয়া হাতের তালাটা ঘরের দুয়ারে লাগায়া দিল।

গোরুর হাম্বা শুইনা হাফিজদ্দি চলে গেছে আথালের দিকে। রহিমা আছে পারুর লগে। নসুর এমন অবস্থা, মা কেন দেরি করছে বুঝতে পারছে না। বারবার তাড়া দিচ্ছে। ওমা, লও নাওয়ে উডি। দেরি করতাছো ক্যা?

নূরি বলল, আমি ইট্টু গনিদাদাগো ওইমিহি যাই মা? হিরা মানিকরে ইট্টু দেইক্কাহি।

পারু কথা বলার আগেই শিরি বলল, অরা অহনতরি উডে নাই।

রহিমা বলল, তোমরা ফিরত আহনের পর দেহা কইরো। অহন যাও, দাদার লগে গিয়া দেহা করো। তারবাদে নাওয়ে ওডো।

বদু মাঝি বলল, দেরি কইরেন না। লন বেলা উডনের আগেঐ মেলা দেই। রইদ উডনের আগে যতাহানি আউন্নাইতে পারি। রইদ উইট্টা গেলে নাও বাইতে জান বাইর অইয়া যায়।

পারুর ইচ্ছা হল না মান্নান মাওলানার সামনে গিয়া দাঁড়ায়। তার কাছ থেকে বিদায় নেয়। ওই মুখ তার আর দেখার ইচ্ছা নাই। তবু যেতে হবে। চাবি বুঝাইয়া দেওনের ব্যাপার আছে।

রহিমার লগে পোলাপান নিয়া মান্নান মাওলানার ঘরের সামনে আসল পারু। ততক্ষণে নামাজ শেষ করেছেন মান্নান মাওলানা। এখন খাটের উপর জায়নমাজে বসে তসবি টিপছেন। আর দোয়া পড়ছেন। ওদেরকে দেখে বললেন, ভিতরে আয় শিরি।

ওরা ভিতরে ঢুকল।

শিরি না, নসু বলল, আমরা যাইতাছি দাদা।

মান্নান মাওলানা উৎসাহের গলায় বললেন, হ হ যাও যাও। বেড়াইয়া আসো।

পারুর দিকে তাকায়া বললেন, বদুর ভাড়াভোড়া বেবাক আমি দিয়া দিমু। তোমগো দেওন লাগবো না। তোমরা দিলে বেশি নিবো।

পারু মাথা নাড়ল, তবে মান্নান মাওলানার মুখের দিকে তাকাল না। হাতের চাবি তিনি যেখানে বসে আছেন তার কাছাকাছি রাখল। মুখের দিকে না তাকায়া, কোনও সম্বোধন না। কইরা বলল, ঘরের চাবি, কেবিন আলমারির বেবাক চাবি এহেনে আছে।

আইচ্ছা আইচ্ছা।

পারু আর দাঁড়াল না, ঘর থেকে বাইর হইয়া আসল। মান্নান মাওলানা অবাক। বাড়ির বউ নাঐর যাইতাছে, শ্বশুররে চাবি বুঝাইয়া দিল, কদমবুসি করল না! ঘটনা কী! বউ তো দিহি বিরাট বেদ্দপ অইয়া গেছে।

পারু ইচ্ছা করেই কদমবুসি করে নাই। যার মুখের দিকে তাকাতে ঘৃণা হচ্ছিল তার পায়ে হাত দেয় কেমন করে!

উঠানে নাইমা আতাহারের ঘরের দিকেও তাকাল না পারু। ওই ঘরের দিকে তাকাতেও তার ঘৃণা হল। মনে হল ওটা গিরস্তবাড়ির একটা পায়খানা। পুরান মলের মধ্যে শুইয়া আছে। গুয়ের একখান পোক। ওইদিকে তাকানো যায় না।

নিজের সীমানায় আইসা পারু দেখে ফিরোজা দাঁড়ায়া আছে। দাদার ঘর থেকে বাইর হইয়াই নসু আর নূরি দৌড় দিয়া গিয়া উঠছে নৌকায়। শিরি আছে পারুর লগে। রহিমাও আছে। পারু রহিমার দিকে তাকাল। যাও, তুমি গিয়া কামকাইজ শুরু করো।

রহিমা বলল, আপনেগো নৌকা ছাড়ক তারবাদে যামু নে।

আমগো নৌকা অহনঐ ছাড়বো। তুমি যাও।

আইচ্ছা তয় যাই। যাওনের আগে কইয়া যাই, তাড়াতাড়ি আইয়া পইড়েন গো মা। হুজুরানি মইরা গেছে, আপনেও যুদি বাইত্তে না থাকেন তয় বাড়িডা খালি খালি লাগবো।

পারু কথা বলল না।

শিরি তাকায়া আছে পারুর দিকে। পারু তার দিকে তাকাল। নাওয়ে উট মা, আমি আইতাছি।

শিরি গিয়া নৌকায় চড়ল।

রহিমা তখন রানঘরের দিকে পা বাড়াইছে, পারু বলল, খাড়াও।

রহিমা দাঁড়াল।

পারু বলল, তোমার লগে কত সময় কত খারাপ ব্যবহার করছি, রাগারাগি বকাবকি করছি, তোমার মনে কত সময় কত দুঃখ দিছি, তুমি ওই হগল মনে রাইখো না। তুমি আমার মা’র বয়সি। ভুলভাল কইরা থাকলে মাপ কইরা দিয়ো।

রহিমা থতমত খেল। এই কথা কইতাছেন ক্যা গো মা? এই কথা তো তারা কয় যারা আর কোনওদিন ফিরত আহে না।

ফিরোজার লগে তখন তরি একটাও কথা বলে নাই পারু। তবু ফিরোজা কাঁদছে। নিঃশব্দে গাল বাইয়া পানি পড়ছে তার। আঁচলে একবার চোখ মুছল সে, গাল মুছল।

ফিরোজার কান্না দেখে কী বুঝল রহিমা কে জানে, পারুর একটা হাত ধরল। আপনে এমুন কইরা আমারে কইলেন ক্যা গো মা? ঘটনা কী?

পারুর তখন গলা বন্ধ হয়ে আসছে, কথা বলতে পারছে না। একটু থেমে নিজেকে সামলাল সে। তারপর বলল, ফিরোজা তোমারে সব কইবো। তয় তোমার আল্লার কছম তুমি কেঐরে কইয়ো না।

রহিমা ফ্যালফ্যাল করে পারুর দিকে তাকায়া রইল। পারু আর তার দিকে তাকাল না, ফিরোজার সামনে আইসা দাঁড়াল। ফিরোজার কাঁধে হাত দিল। কানদিস না। আমি চইলা যাওনের পর রহিমারে বেক কথা কইচ। অরে আমি চিনি। মইরা গেলেও কেঐরে কোনওদিন কইবো না। আর তুইও বইন আমারে মাপ কইরা দিচ। যুদি কোনও ভুলচুক কইরা থাকি, তর মনে না বুইঝা দুঃখ দিয়া থাকি, মাপ কইরা দিচ।

ফিরোজা আর নিজেরে ধরে রাখতে পারল না, পারুরে জড়ায়া ধইরা কাঁদতে লাগল। আপনেরে আমি কী মাপ করুম, আপনে আমারে মাপ কইরা দিয়েন।

কান্নার চাপে পারুর তখন বুক ফেটে যাচ্ছে, চোখ ফেটে যাচ্ছে, তবু চোখে পানি আসতে দিল না সে, শক্ত মুখে নৌকায় উঠল। রহিমা হতবাক হয়ে তাকায়া আছে, ফিরোজা কাঁদছে, এসবে বদু মাঝির কিছুই যায় আসে না। সে লগির প্রথম খোচ দেওয়ার আগে বেশ শব্দ করে বলল, বিসমিল্লাহ বিসমিল্লাহ।

বদুর খেচে খেচে তালুকদার বাড়ি আর কামারবাড়ির মাঝখানকার চক দিয়া পুব দিকে যায় নৌকা। তখন মাত্র রোদ উঠেছে। বর্ষার পানিতে, গিরস্তবাড়ির গাছপালা আর উঠান পালানে পড়েছে সকালবেলার তাজা রোদ। তিনটা পোলাপান নিয়া ছইয়ের তলায় বসে আছে পারু, উপরে তার এক চেহারা, ভিতরে আরেক। মনে মনে সে কত যে কথা বলে। এই যে বিয়ানবেলার রোদ, আমারে তুমি মাপ কইরা দিয়ে। এই যে বাইষ্যাকালের পানি, পদ্মা নদীর হাওয়া, পানির তলার মাছ, চকমাঠের ঘাস বিচালি, কাইশ্যা ধইনচার খেত, আমারে তোমরা মাপ কইরা দিয়ে। এই যে গেরামের গিরস্তবাড়ি, গাছগাছালি, উঠান পালান আর মানুষজন, আমারে তোমরা মাপ কইরা দিয়ো। গোরুবাছুর পাখপাখালি, আর মেদিনীমণ্ডল গ্রাম, মাপ কইরো, আমারে তোমরা মাপ কইরো। এই যে মাথার উপরে আশমান, তার উপরে আছে সাত আশমান, সেই আশমানে তুমি বইসা আছো হে আল্লাহ, পাক পরোয়ারদিগার, আমি বড় গুনাগার। আমার বেক কিছু তুমি জানো আল্লাহ। তুমি দায়ারসাগর, মাপ করনেআলা, আমার গুনাহ তুমি মাপ কইরো আল্লাহ।

নিজের অজান্তে পারু যে তখন চোখের জলে ভাসছিল, সে তা টের পায় নাই। শিরি নসু আর নূরি মায়ের চোখের পানি দেখে স্তব্ধ হয়ে আছে। বদু মাঝি পারুর কান্না দেখতে পায় না। লগিতে খেচের পর খোচ দেয় সে আর মনের আনন্দে গান গায়।

আমার পাগলা ঘোড়া রে
কই মানুষ কই লইয়া যাচ!

.

ছাড়াবাড়ির হিজল ডুমুরের জঙ্গলে কানিবকের ছানাগুলি এখন আর ছানা নাই। ধারিবক হয়ে গেছে। চকমাঠের পানি নামতে শুরু করেছে দেখে মা-বাপের লগে তারাও উড়ে উড়ে যায় মাছ শিকারে। পেটভরে চেলামাছ খেয়ে পুরানা বাসায় ফিরে আসে। তবে বাসায় তারা আর থাকে না। হিজল ডুমুর আর নয়তো বউন্নার ডালে দিনভর আসা যাওয়া করে, রাতভর। বসে থাকে। ভোরবেলা দিনের আলো ফুটে উঠবার লগে লগে তাদের ককর মকর শব্দ পাওয়া যায়। ডানা ঝাঁপটে, ঠোঁট ঠ্যাং তুলে মারামারি করে, নূরজাহান ঘরে বসে এইসব শব্দ পায়। উঠানে নেমে ছাড়াবাড়ির জঙ্গলটার দিকে তাকিয়ে বকপাখি দেখে। দুইটার জায়গায় পাখি এখন চারটা। সংসার বড় হয়েছে তাদের। বর্ষায় এদিকটায় আধার বেশি পাওয়া যায় দেখে এখনও বাসার কাছাকাছিই আছে তারা। বর্ষাকাল শেষ হলে, এদিককার চকমাঠ ভেসে উঠলে, আধারে টান পড়লে বিলের দিকে চলে যাবে বকগুলি। এইমুখী হয়তো আর হবেই না।

পাখিদের জীবন কী সুন্দর। এক গাছে সারাটা জীবন তারা কাটায় না, এক বাসায় কাটায় না। দুইজনে ভাব ভালবাসা হলে একসঙ্গে বাসা বাঁধে কোনও নিরাপদ গাছে, ডিম দেয়, বাচ্চা ফুটায়, কত আদরে যত্নে বাচ্চাগুলিরে খাওয়াইয়া দাওয়াইয়া বড় করে। তারপর উড়তে শিখে কিছুদিন হয়তো মা-বাবার লগে থাকে ছানারা, তারপর যে যার মতন উড়ে যায়। নিজের দুনিয়া তৈরি করে নেয়। মা-বাবা ভাইবোন কাউকে আর চিনে না।

মানুষের লগে এই জায়গাটায় বিরাট ব্যবধান তাদের। মানুষ মা-বাবা ভাইবোন আত্মীয় স্বজন প্রিয় পছন্দের মানুষজনকে কখনও ভোলে না, মনে রাখে। তাদেরকে জড়িয়ে প্যাচিয়েই বাঁচতে চায়। যদিও সব সময় তা হয় না। তবু মনের মধ্যে থেকে যায় প্রিয় মানুষরা, চোখের ভিতরে থেকে যায় তাদের মুখ, স্মৃতিতে থেকে যায় তাদের ভালমন্দ, সুখ দুঃখ, হাসি আনন্দ আর বেদনার কথা।

ভাদ্রমাস পড়তে না পড়তেই উধাও হয়ে গেছে বৃষ্টি। নীল আকাশে শুধুই ভাসে সাদা মেঘ। সকাল থেকে রোদে ঝলমল করে দেশগ্রাম, ফুরিয়ে আসা বর্ষার চকমাঠ। চারদিক থেকে ঠিকরে আসে চুলার নিভে আসা আগুনের মতন গরম। হাঁসফাঁস লাগে। ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছা করে না।

দুপুরের ভাত খেয়ে ঘণ্টাখানেকের একটা ঘুম দেওয়ার অভ্যাস আছে নূরজাহানের। আজও শুয়েছিল, তবে ঘুম আসে নাই। খানিক এপাশ ওপাশ করে ঘর থেকে বের হয়েছে। হামিদা আঁচলে মুখ ঢেকে শুয়ে আছে। গভীর ঘুম যে ঘুমাচ্ছে বোঝা যায়। খাওয়াদাওয়া শেষ করে দবির তার কোষানাও নিয়া বের হয়ে গেছে। নূরজাহানকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলেছে, আইজ বিয়ালে জসিলদার (জসলদিয়া) হাট। হাট ঘুইরা আসি। কান্দিপাড়ার লগের গেরাম হইল জসিলদা। রমিজ ঘটকের বড়পোলা হারুনের মদিদোকান আছে হাটে। রমিজরে হাটের দিন ওই দোকানে পাওয়া যায়। পোলার লগে দোকানদারি করে। যাই ঘটকার লগে কথা কইয়াহি। কয়ডা টেকা দেও, ডাইল ডুইল মাচ তরকারি হস্তায় পাইলে কিছু লইয়ামুনে।

হামিদা কত টাকা দিয়েছে খেয়াল করে নাই নূরজাহান। আঁচলে মুখ ঢেকে শুয়েছিল। শুয়ে শুয়ে একটা কথাই শুধু তার কানে লেগে থাকল, রমিজ ঘটক। তার বিয়ার লেইগা। পাগল হইয়া গেছে মা-বাপে। একবার পাগল হইছিল মান্নান মাওলানার মুখে ছ্যাপ দেওনের পর, এইবার হেই শুয়োরের পোয়, এতদিন বাদে যখন অন্য তরিকা ধরছে, নূরজাহানরে বিয়া করতে চায়, শুইনা পাগল হইল বাপে, কেঐরে কিছু না কইয়া মরনি আম্মার বুদ্দি লইয়া, দেলরা আম্মারে ধইরা এনামুল সাবরে দিয়া থামাইলো ইবলিশটারে। এনামুল সাবে বইলা দিছে, মাইয়া তাড়াতাড়ি বিয়া দিয়া দেও। তারপর থিকা বাপে পাগল অইয়া গেছে। যত তাড়াতাড়ি বিয়া দেওন যায় নূরজাহানরে তত তাড়াতাড়িই বিপদ শেষ অয়।

আহা রে, আমার নিরীহ মা-বাপটারে কী আজাবের মইদ্যে আমি হালাইছি!

এইসব ভেবে ঘুমটা আসে নাই নূরজাহানের। খুব কান্না পাচ্ছিল। আস্তে করে উঠে বাইরে এল সে। ছাড়াবাড়ির ঝোঁপজঙ্গলের দিকে তাকিয়ে রইল। বকপাখিগুলি দেখে মনে। হল, তার জীবন কেন পাখির জীবন হয় নাই। তার জীবন কেন পুরুষমানুষের জীবন হয় নাই। আর নাহয় তার জীবন যদি হত বড়ঘরের মেয়েদের জীবন, স্কুল কলেজে পড়ে দেশে বিদেশে জীবন কাটাত, ইসকুল মাস্টার হত, বড় চাকরি করত, নিজের স্বাধীন জীবন! টাউনে তো অনেক মেয়ের জীবন এমন। দেশগ্রামের বড়ঘরের মেয়েরাও তো গ্রামের স্কুল শেষ করে টাউনে চলে যায় পড়তে। লেখাপড়া জানা মেয়েদের বিয়াশাদি হচ্ছে বড়ঘরে, কত সুখের জীবন। দুঃখ কষ্টের জীবন শুধু নূরজাহানদের মতন মেয়েদেরই। যাদের লেখাপড়া নাই, বাপের অবস্থা ভাল না। বড় আত্মীয় স্বজন নাই, পাশে দাঁড়াবার কেউ নাই, এইরকম মেয়েদের জীবন মানুষের জীবনই না। তাদের জীবন কুত্তা বিলাইয়ের জীবনের মতন। যে সামনে পায় সেই একটা লাথি দেয়, সেই একটা খাবলা দেয়।

ঘরের ছেমায় দাঁড়িয়ে ছাড়াবাড়ির ঝোঁপজঙ্গলের দিকে তাকিয়ে হাজামবাড়ির তছির কথা মনে পড়ে নূরজাহানের। বদ্ধ পাগল মেয়েটা এখন আরও পাগল হয়ে গেছে। দিনেরবেলা ঘর থেকে বের হয় না। তার দিন হয়ে গেছে রাত, রাত হয়ে গেছে দিন। সারাদিন তার শিথানে বসে আছে মা। কাঁথার তলা থেকে একটা হাত বের করে মায়ের হাত ঘুমের ভিতরও শক্ত করে ধরে রাখছে তছি। যেন তার ঘুমের তালে মা তাকে ছেড়ে যেতে না পারে।

নূরজাহানের জীবন যদি হত তছির জীবন। বদ্ধ পাগলের জীবন তা হলে কি মান্নান মাওলানা তার পিছনে লাগত? পাগল হয়ে সে যদি মান্নান মাওলানার মুখে ছ্যাপ ছিটাত তা হলে কি কেউ কিছু মনে করত?

না মনে করত না। ভাবত পাগলনির পাগলামি।

পাগল হলে মাকুন্দার জন্যও এত মায়া হত না নূরজাহানের। দেখতে শুনতে যত ভালই সে হউক, পাগল তো আর বিয়া করতে চাইতেন না মান্নান মাওলানা। যত রাগই পাগলের উপর থাউক, তাকে কি আর সংসারে নিতে চাইত। তার উপর কি আর শোধ নিতে চাইত। পাগলের উপর কী শোধ নিব? পাগল তো উলটা পাগলামি করে জান খেয়ে ফেলত ওই পোংটা মাওলানার!

আইচ্ছা, মানুষ তো বদলায়! গাওয়াল দাদায় বদলাইয়া গেল না? তার বউ, খাড়েদজ্জাল বানেছা বদলাইছে, পোলাপানডি বদলাইছে। তারা আর পুরানা মানুষ নাই, বেবাকতে নতুন হইয়া মানুষ হইয়া গেছে। মান্নান মাওলানা নতুন হইতে পারল না? আল্লায় তার মনে ইট্টু রহম দিতে পারল না? আমারে মাপ কইরা সত্যই বদলাইয়া যাইতে পারত না সে?

হ আমি অন্যায় করছি, বিরাট অন্যায় তার লগে করছি, ক্যান করছি হেইডা হে বুজছে। বুইঝা বেবাকতেরে কইছেও, নাদান মাইয়া, অরে আমি মাপ কইরা দিলাম! বান্দরডার মুখে এক অন্তরে আরেক। মাপ করে নাই। অহন অন্য তরিকায় আমারে বউ বানাইয়া শোধ লইতে চায়। অর ঘরে যাওনের আগে আমি গলায় দড়ি দিমু! তাও আমার শইল্লে অরে হাত দিতে দিমু না!

রান্নাচালার সামনে একটা ফিরি পড়ে আছে। দুইটা কাক আর একটা শালিক চরছে ওইদিকে। খাবার খুঁজছে। রোদের তাপে তিনটা পাখিই ঠোঁট ফাঁক করে শ্বাস টানছে। নূরজাহান রান্নাচালার দিকে গেল। আনমনা ভঙ্গিতে ফিরিটায় বসল। বসেই কুট্টির কথা মনে পড়ল। কেমুন পাগল হইয়া গেছে আলফুর লেইগা। বেবাক কথা আমারে কইছে। একবার বিয়া হইছিল কুট্টির। জামাইবাড়ি, হতিন, হতিনের পোলা, মাজায় ঝুনঝুনি বান্দা নয়ন, বেক কথা কইছে। এতদিন মিয়াবাইত্তে আছে, তারবাদে আথকা আলফুর লগে কেমতে কী হইল, মাতবরের চরে আলফুর বউ আর তিনডা পোলাপান, তারবাদেও আলফু হইল কুট্টির জান, আত্মা, আলফুর লেইগা কাইন্দা মইরা যাইতাছে। মনের মানুষের লেইগা তো এমুনই পাগল হওনের কথা মানুষের।

নূরজাহানের তারপর মজনুর কথা মনে পড়ল। মনে মনে মজনুর লগে কথা বলতে লাগল সে। তোমারে আমার বহুত ভাল লাগে মজনুদাদা। বহুত ভাল লাগে। তুমি দ্যাশে থাকলে রোজ আর নাইলে দুই-চাইর দিন পর পর যুদি তোমার লগে আমার দেহা অইতো, তয় আমার দশা অইতো কুট্টির লাহান। তোমার দশা অইতো আলফুর লাহান। আমারেও যে তোমার ভাল লাগে, আমারেও যে তুমি পছন্দ করো হেইডা তোমার চোক্কের মিহি চাইয়া আমি বুজছি। তুমি হেদিন ঘুরাইয়া প্যাচাইয়া অনেক কথা কইতে চাইছো আমারে। আমি বুজছি, তোমার বেক কথাঐ আমি বুজছি। তয় মাইয়া মাইনষের তো বুক ফাডে তাও মুখ ফোড়ে না। আমি কোনওদিনও আমার কথা তোমারে কইতে পারুম না। ই পারুম, তোমার লগে যুদি আমার বিয়া অয়, তয় বিয়ার পর কইতে পারুম। বাসর রাইত্রে, নাইলে তারবাদে কোনও এক রাইত্তে, তোমার লগে শুইয়া শুইয়া, আথকা কইয়া হালামু, তোমারে আমার বহুত ভাল লাগে। তোমারে আমি ভালবাসি। তোমার লগে বিয়া অওনে আমি যে কী খুশি হেইডা তোমারে আমি কইয়া শেষ করতে পারুম না।

তারপরই অন্য একটা কথা ভেবে উত্তেজিত হল নূরজাহান। বাবায় যে ঘটকার কাছে দৌড়াইতাছে, ঘটকারে মজনু দাদাগো বাইত্তে পাড়ায় না ক্যা? মজনুদাদার লগে আমার। বিয়ার পোরোসতাব দেয় না ক্যা? মরনি আম্মায় তো আমারে জান দিয়া আদর করে। হেদিন বাড়ির বউর লাহান পোলাও মোরগ রাইন্দা খাওয়াইলাম ওই বাড়ির মাইনষেরে। লগে আমি আর আমার বাপেও খাইলাম। বেবাকতে এত গুণ গাইলো আমার। মান্নান। মাওলানার হাত থিকা দুইবারঐত্তো আমারে বাঁচাইলো। অহন হারাজীবনের লেইগা তার বাড়ির বউ বানাইয়া হারাজীবন আমারে বাঁচায় না ক্যা? মরনি আম্মায় ক্যান মজনুর লগে আমার বিয়া ঠিক করে না! ক্যান তার বাড়ির বউ বানায় না আমারে!

আর আমার মা-বাপেই বা কেমুন! তারা রমিজ ঘটকারে লইয়া চিন্তা করতাছে ক্যা? মরনি আম্মার কাছে যায় না ক্যা? তারে গিয়া কয় না ক্যা, বুজি, আমার মাইয়াডা আপনে নেন। হ দেশ গেরামের মাইনষে এইভাবে সাইধা সাইধা মাইয়া দেয় না। এইডা শরমের কথা। তয় মরনি আম্মার কাছে আমগো আবার কীয়ের শরম! আমগো সমন্দে হের তো আর অজানা কিছু নাই!

তয় সমস্যা একহান আছে। বংশ। তারা হালদার বংশ। মজনু অল্পবিস্তর লেখাপড়া শিখছে। নূরজাহান তো কিছু শিগে নাই। খাইগোবাড়ির ইসকুলে ছোডকালে দুই-চাইরদিন গেছে, কায়দা সিপারা পড়ছে, তারপর আর কিছু না। কোরান শরিফও পড়তে শিগে নাই। বাপ হইল গাছি। মজনুর লগে কি এমুন মাইয়ার বিয়াতে রাজি হইব মরনি আম্মায়!

যুদি রাজি না হয় তয় তো শরমে একদোম মইরা যাইবো নূরজাহান। জিন্দেগিতে আর মরনি আম্মার সামনে গিয়া খাড়ইতে পারবো না, মজনুরে এই মুখ দেহাইতে পারবো না!

নূরজাহানের খুবই দিশাহারা লাগল। উঠে দাঁড়াল সে। হঠাৎ মনে পড়ল ভাদাইম্মার কথা। কুকুরটা আজ গেল কোথায়? সকাল থেকে একবারও দেখে নাই নূরজাহান। বর্ষার পানি ভেঙে যেমন করে একদিন এই বাড়িতে আইসা উঠছিল সেইভাবেই চলে গেল নাকি! কাউরে কিছু না বলে চলে গেল!

আজবপদের কুত্তা তো!

আনমনা ভঙ্গিতে রান্নাচালা আর দক্ষিণের ভিটির ঘরটার মাঝখান দিয়া বাঁশঝাড় তলার ওদিকটায় আসল নূরজাহান। ভাদ্রমাসের রোদ তেমন পড়তে পারে নাই এই দিকটায়। বাঁশঝাড় আর হিজল বউন্নার গাছগুলি রোদ আটকে রেখেছে। এই দিকটায় এসে ভাল রকমের একটা চমক খেল নূরজাহান। আরে ভাদাইম্মা তো এইখানে! মাঝিবাড়ির সাদা কালোর মিশেল দেওয়া মাইগ্না কুত্তাটা কখন সাঁতরাইয়া আসছে এই বাড়িতে। কখন গাছিবাড়ি থেকে তারে ইশারা করছে ভাদাইম্মা। সে এসে বাঁশঝাড় তলার ওইদিককার নিটাল জায়াগায় গাইট লাগছে (গাঁট লাগা, কুকুরের যৌনকর্ম) ভাদাইম্মার লগে।

কুকুরদের এই কাজটা অদ্ভুত। মাইন্নাটার উপর মরদাটা চড়ে স্বাভাবিক পদ্ধতিতেই কাজটা চালায়, কাজ সারার পর মরদাটা নিজের অঙ্গ আর সহজে ছাড়াতে পারে না। মাইন্নাটার ভিতর আটকে যায়। ছাড়তে অনেক সময় লাগে। আধঘণ্টা, পৌনে একঘণ্টা। দেশগ্রামের পোলাপান এইরকম কুত্তার গাইট লাগা দেখতে ভিড় করে। নানা রকমভাবে ত্যাক্ত করে কুকুর দুইটাকে। লাঠি দিয়া বাইড়াবাড়ি করে। কুকুর দুইটা তখন দুইমুখী হয়ে থাকে, মাঝখানে মাইগ্যাটার ভিতর মরদাটার সঙ্গ। হয়তো অঙ্গের অর্ধেকটা বের হয়ে আছে। গোলাপি রঙের সেই জিনিসটায় মজা করার জন্য নুন ছিটাইয়া দেয় দুষ্টু পোলাপান। কাঁচি (কাস্তে) দিয়া পোচও দেয়।

ইস, মানুষ যে কী খারাপ জন্তু! কোনও কোনও সময় কুত্তার থেকেও খারাপ।

তবে ভাদাইম্মা আর মাঝিবাড়ির কুকুরটার গাইট লাগা দেখে শরীরের ভিতর কীরকম করে উঠল নূরজাহানের। গা কাঁটা দিল, রোমকূপে সাড়া পড়ল। বিয়া হইলে রাইত দোফরে আন্ধার ঘরে জামাইর লগে সেও তো গাইট লাগবো। বছর ঘুরতে না ঘুরতে পেট হইবো, তারপর পোলাপান। মাঝিবাড়ির কুত্তাটার যেমন কয়েক মাস পরই বাচ্চা হবে। ভাদাইম্মা হবে বাপ, তয় তার খবরও থাকবো না। এইরকম কত মাইগ্যা কুত্তার পেট বাজাইবো, কে জানে! মরদারা তো কাজ সাইরাই খালাস, কষ্ট হইল মা জীবের। পেটের ভিতরে বাচ্চা লইয়া ঘোরন লাগে, তারপর দেওন লাগে জন্ম। আর জন্ম দেওন যে কী কষ্টের, যে জন্ম দেয় সে ছাড়া দুনিয়ার কেঐ সেই কষ্ট বুঝবো না। তারবাদে বুকের দুধ দেও, লালন পালন করো, শত্রুর হাত থিকা বাঁচাও। দুনিয়ার বেবাক কষ্ট মাইয়া জীবের। এখন যেমন কষ্টে আছে নূরজাহান। ছেলে হলে এইরকম কি তার হত! তার যেমন ভাল লাগছে মজনুকে, মজনুর যদি এমন ভাল লাগত তাকে, আর সে যদি হত মজনুর জায়গায় তা হলে মা বাপে যখন তার বিয়ার জন্য ঘটকের কাছে দৌড়াচ্ছে এই দৌড়ান এক কথায় বন্ধ করে দিত নূরজাহান। সোজা বাবা মাকে বলত, আমি অন্য কোনওখানে বিয়া করুম না। আমার পছন্দের মাইয়া হইল নূরজাহান। অরে আমি বিয়া করুম। তোমরা ব্যবস্তা করো।

মা-বাপে বাধ্য হয়ে করত। ছেলের পছন্দের দাম আছে, মেয়ের পছন্দের দাম নাই। তারা পছন্দ করবে একজনকে, বিয়া করবে আরেকজনকে। সংসার করবে আরেকজনের। তার পোলাপানের মা হবে আর গোপনে মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা পছন্দের মানুষটির কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে!

নিজের জন্য একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল নূরজাহানের। ভাদাইম্মা তখনও গাইট লেগে আছে মাঝিবাড়ির কুত্তিটার লগে।

.

ভোররাতের দিক থেকে মাথাটা ঘুরছে কুট্টির। উকাল আসছে। একদিকে আজ দেড় মাসের উপর আলফুর কোনও খবর নাই, মনের অবস্থা খুবই খারাপ কুট্টির। রাতেরবেলা একফোঁটা ঘুমাতে পারে না, খালি আবোল তাবোল স্বপ্ন দেখে। দিনেরবেলা না খাইতে নাইতে ইচ্ছা করে, না কোনও কাজকাম। মনে মনে খালি অপেক্ষা। এই বুঝি বাড়ির ঘাটে এসে লাগল কারও নাও, সেই নাও থেকে রেকসিনের খয়েরি রঙের ব্যাগটা হাতে নিয়া নামল আলফু। পরনে নীল লুঙ্গি আর সাদা ঝুলপকেটআলা শার্ট। গলায় মাজায় বান্দা গামছা। পদ্মার ওপারের মাতবরের চর থেকে বিয়ানরাতে মেলা দিয়া পদ্মা পার হইছে তারপর মাওয়ার বাজার থেকে মেদিনীমণ্ডলের কারও নৌকায় মিয়াবাড়ির ঘাটে আসছে।

না, আসে না। আলফু আসে না। অপেক্ষায় অপেক্ষায় দিন কাটে কুট্টির।

এই বাড়িতে কাজ নেওয়ার পর থেকে যতবার আলফুকে চরে যাইতে দেখছে, আলফু রওনা দিছে ভোরবেলা। যেদিন ফিরার কথা ফিরা আসছে বিকালের দিকে। এইজন্য দুপুরের পর থেকে কুট্টির শুরু হয় অপেক্ষা।

সকাল থেকে সংসারের কাজ, বড়বুজানের কাজ। করতে ভাল লাগে না তারপরও নিজের কাজগুলি করে। নাওয়াধোওয়া, খাওয়াদাওয়া। দুপুরের পর চারদিক একদম নিটাল। বড়বুজান খাওয়াদাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়েন। সন্ধ্যা তরি ঘুমান। কুট্টির তখন কিছু করার থাকে না। ইচ্ছা করলে দরজা বন্ধ করে সেও বুজানের পালঙ্কের পাশে মেঝেতে শুয়ে ঘুম দিতে পারে। দুই একদিন চেষ্টাও করেছে, ঘুম আসে না। উসপিস উসপিস লাগে। খালি মানুষটার কথা মনে হয় তার আর ঘনঘন নিয়াস পড়ে। বুক ফেটে, চোখ ফেটে কান্না আসে।

মানুষটা তার লগে এমন করল ক্যান? এত ভাল মনের মানুষ, জ্বর থেকে ওঠার পর কুট্টির কথা ভেবে সাত-আষ্ট মাস বাড়িতে যায় নাই। বউ পোলাপানের কথা ভাবে নাই। শেষ তরি গেল বউ যাতে পোলাপান নিয়া এই বাড়িতে আইসা না ওঠে সেই ডরে। বলে। গেল সাত থেকে দশদিন, ফিরত আমি আসুমই। তোমারে ছাইড়া থাকুম না। তারপর দেড় মাসের বেশি। কোনও খবর নাই। কুট্টি রোজ ভাবে, আইজ সে আসবো। দুপুরের পর। থেকে শুরু হয় অপেক্ষা। দুপুর শেষ হয়ে বিকাল হয়, বিকাল শেষ হয়ে সন্ধ্যা, রাত, সে আসে না। কুপি হারিকেন জ্বেলে রাতের কাজ করে কুট্টি। বড়বুজানকে খাওয়ায়, ইচ্ছা হলে নিজে খায় না হলে খায় না, শুয়ে পড়ে।

বড়বুজানের লগে টুকটাক কথা হয় সারাদিনই। এই কাজে ওই কাজে কত কথা যে বুড়া মানুষটা বলে। অকাজেও বলে। তার লগে কথা বলতে আগে ভালই লাগত কুট্টির। আলফু চলে যাওয়ার পর থেকে, সে ফিরা আসে না দেখে মনমেজাজ ভাল নাই কুট্টির। বড়বুজান দশ কথা বললে সে বলে একটা, তাও হু হা না, এইসব। বেশি কথা না।

আলফুর কথা বড়বুজানেও জিজ্ঞাসা করেন। রোজই একবার-দুইবার তার কথা ওঠে। কী লো কুট্টি, আউলফা যে সাত-দশদিনের কথা কইয়া গেল আর দেহি আহে না? একলা বাইত্তে আমরা দুইজন থাকি কেমতে? হাটবাজার কে করে? বাড়ির কাম কাইজ, ছাড়াবাড়ির কাম কাইজ, খেতখোলা এইডি অহন দেখব কে?

কুট্টি বাঁচে না কুট্টির জ্বালায় আর বুড়ি আছে বুড়ির হাটবাজার বাড়িঘর আর খেতখোলা লইয়া। ওইসব কথা শুনলেই চেইতা ওঠে কুট্টি। আলফু আহে না ক্যা হেইডা আমি জানিনি? আমারে কন ক্যা?

বড়বুজান অবাক হন। তরে কমু না তয় কারে কমু? এই বাইত্তে কথা কওনের আছে কে?

কেউ যখন নাই তয় কইয়েন না।

বড়বুজান ফোকলা মুখে হাসেন। তর অইছে কী রে ছেমড়ি? আগে তো এমুন আছিলি না। অহন কথায় কথায় এমুন ছ্যান ছ্যান করচ ক্যা?

আমার ইচ্ছা আমি করি।

না রে তর মনে অয় কোনও ভেজাল অইছে।

কী ভেজাল অইবো আমার?

হেইডা সেন তুই জানচ।

না আমার কিছু অয় নাই। আমি সব সময় যেমুন অহনও তেমুন।

তয় আলফু এমতে যদি বাইত্তে গিয়া পইড়া থাকে, যুদি সহাজে না আহে তয় তো আমগো সংসার বাড়িঘর বেবাক অচল অইয়া যাইবো। হাটবাজার করবো কে? বাড়িঘরের কাম, ছাড়াবাড়ি, খেতখোলা…

কুট্টি রাগী গলায় বলে, এত প্যাচাইল পাইরেন না তো। আপনের প্যাচাইলে আমার শইল জ্বলে। আমি কি আপনেরে না খাওয়াইয়া রাকছি? হাটবাজার তো কেঐরে না কেঐরে দিয়া করাইতাছি। বাদলার বাপ মতলা কইরা দিছে দুইদিন, বাদলারে বাজারে পাইছি একদিন। গাওয়ালে গোয়ালিমান্দ্রা হাট থিকা সদাইপাতি আইন্না দিছে। আপনের অসুবিদা তো অইতে দিতাছি না আমি। তাও এত প্যাচাইল পারেন ক্যা?

বড়বুজানে হাসেন। হ বেবাকঐ ঠিক আছে তয় তুই ঠিক নাই। তর জানি কী অইছে। আমি চোকে দেহি না, লড়তে চড়তে পারি না তয় কানডা আমার পরিষ্কার আছে, মনডা আর মাথাডাও ঠিক আছে, আমি বুজি।

কী বোজেন আপনে?

তুই আগের কুট্টি নাই। তুই অহন অন্য কুট্টি।

মুখে কুট্টি বলে, হ কইছে আপনেরে। মনে মনে বলে, ঠিকঐ কইছেন আপনে। আমি আর আগের কুট্টি নাই। আমি অহন অন্য কুট্টি। আমি অহন আলফুরে ছাড়া কিছু বুজি না। হেয় আমার বাঁচন মরণ। হেয় আমার জান, আমার কইলজা।

এই জান কইলজার জন্য অপেক্ষা করতে করতে পাগল হয়ে যাচ্ছে কুট্টি। রাতেরবেলা শুয়ে পড়ার পরও তার ঘুম আসে না আলফুর জন্য। পালঙ্কে শুয়ে বড়বুজান ঘুমান। মেঝেতে শুয়ে আলফুর জন্য জেগে থাকে কুট্টি। দেশে গিয়া তার আবার অসুকবিসুক হয় নাই তো? কোনও বিপদ আপদে পড়ে নাই তো? হেয় বাঁইচ্চা আছে তো? এই দিনে পদ্মায় বিরাট ঢেউ, বিরাট কাটাল (কোটাল)। নাও ডুবলে যত সাঁতারই জানুক মানুষ, বাঁচনের পথ নাই। যাওনের সময় নাইলে ফিরত আহনের সময় নাও ডুইব্বা…

না না, না। হেয় মরে নাই, হেয় বাঁইচ্চা আছে। হের মতন ভাল মানুষরে আল্লায় এমতে মারবো না।

আসলে রাতেরবেলাও আলফুর জন্য অপেক্ষা করে কুট্টি। হয়তো মাতবরের চর থেকে দেরি করে মেলা দিছে। পদ্মা পার হয়ে মাওয়ার ওইদিকে আসতে রাত হয়ে গেছে। মাওয়া থেকে কোনও দোকানদারের লগে ভাও কইরা তার নাও লইয়া বাইত্তে আইছে। দুয়ারে আওজ দিয়া অহনই হয়তো ডাকবো কুট্টিরে। কুট্টি কুট্টি, দুয়ার খোলো। আমি আইছি।

রাত কেটে যায়। দুয়ার খুলতে হয় না কুট্টির। আলফু ফিরে না। রাতেরবেলার কত রকমের শব্দ চারদিকে। ঝিঁঝিপোকার ডাক, বাদুড়ের ওড়াউড়ি, চদরি বাড়ির দেবদারু গাছে কোড়ল পাখিটা বাগ দেয়, কপাখি ডাকে দূরে কোথায়, বাঁশঝাড়ে ভাদ্রমাসের হাওয়ার শনশন শব্দ, ভোরের দিকে মোরগে বাগ দেয়, কাক দোয়েল ডাকে, আজানের শব্দ আসে খাইগোবাড়ি থেকে, সব ঠিক আছে। খালি কুট্টি ঠিক নাই। আলফুর জন্য কুট্টি আর কুট্টি নাই।

কালরাতে ঘুমানের আগে বড়বুজান বললেন, দুই একদিনের মইদ্যে ঢাকায় খবর দেওন। উচিত। রাজা মিয়ার মা’রে জানান উচিত যে আলফু দেড় মাস ধইরা বাইতে গিয়া বইয়া রইছে। আলফুরে বাদ দিয়া অন্য মানুষ রাখনের বেবস্তা করন উচিত।

শুনে জবাই করা মুরগির মতন ধড়ফড় করেছে কুট্টির বুক। হায় হায় যদি সত্য এইডা করে এই বাড়ির মাইনষে, তয় কুট্টি এই বাইত্তে থাকবো কেমতে? আলফুরে ছাড়া সে বাঁচবো কেমতে? হয় গলায় দড়ি দিতে অইবো নাইলে মাতবরের চরে গিয়া আলফুরে। বিচড়াইয়া বাইর করন লাগবো। তারে ছাড়া বাঁচনের কোনও পথ নাই কুট্টির।

বড়বুজানের কথা শুনে একটা বুদ্ধি বাইর করল সে। বলল, বেশ উত্তেজিত গলায় বলল, হেইডা কয়দিন পরে করেন বুজি। তার আগে আলফুরে বিচড়াইতে মাতবরের চরে কেঐরে পাডাই।

বড়বুজান বিরক্ত হলেন। এত ভেজালের কাম কী? বাড়ির বান্দা কামলা। আষ্ট-দশদিনের কথা কইয়া ফিরতাছে না, অর লেইগা বইয়া থাকনের কাম কী?

না না হেইডা তো ঠিকঐ। তয় এতদিনের পুরানা মানুষ, বিশ্বাসী মানুষ…।

হ আলফু বিশ্বাসী মানুষ। চোর ধাউর না। মানুষও ভাল। তয় না আইলে কী করবি?

ওই যে কইলাম কেঐরে চরে পাডাই।

কারে পাডাবি?

রাবির জামাই মতলারে।

পাডাইতে টেকাপয়সা লাগবো না।

হেইডার বেবস্তা অইবোনে।

কেমতে অইবো? সংসারখরচ থিকা দিলে রাজা মিয়ার মা’য় আইয়া ইসাব লইবো না। তারে বুজ দিবি কেমতে?

আমার কাছে কয়ডা টেকা আছে, হেই টেকা দিয়া পাডামু নে।

তুই টেকা পাইলি কই?

ওই যে দুই-চাইর সময় দেশে আইলে মাজারো বুজানে দুই-চারডা টেকা দেয়, হেই টেকা তো আমি খরচা করি না। আমার কাছে জমে। হেই টেকা দিয়া রাবির জামাইরে পাডাই।

বড়বুজান হাসলেন। আলফুর লেইগা দিহি বিরাট টান তর। ঘটনা কী লো ছেমড়ি? আমি চোকে দেহি না, হারাদিন হুইয়া থাকি, তরা দুইজনে কী দা কী করছ বুজি না। কী লো, পিরিতি মিরিতি করছসনি আলফুর লগে?

হ করছি।

বড়বুজান চমকালেন। কী?

আপনের যা কথা? আপনে বেককিছু বেঁকা কইরা দেহেন। দুইজন মানুষ এক বাইত্তে কাম করি, একজনের লেইগা আরেকজনের ইট্টু চিন্তা লাগবো না? এইডা খারাপ কিছু? খালি পিরিত থাকলেই মাইনষে মাইনষের কথা চিন্তা করে? এমতে করে না?

করে। তয় তগো দুইজনেরঐ জুয়ান বয়স। এই বয়সে ওইসব অয়। নিজে না চাইলেও ঠেকায়া রাখন যায় না।

আমগো ঘটনা অমুন না।

যদিও মুখে কথাগুলি বলল কুট্টি, তবে মনে মনে বড়বুজানের কথা শুনে অবাক। বুড়ি তো কথা খারাপ বলে নাই। আসলেই তো, কেমতে কেমতে কী হইয়া গেল দুইজন মানুষের একজনও বুজল না। ঘটনা ঘইটাই গেল।

বড়বুজান বললেন, তয় তুই যখন চাইতাছস, তয় পাড়া মতলারে। খবরডা আলফুর লইয়াহুক।

তখন কথার ভিতরকার একটা ফাঁক ভরার চেষ্টা করল কুট্টি। আপনেরে একখান কথা কই বুজান। আমি গরিব মাইনষের মাইয়া। আমার কথা বেবাকঐ আপনে জানেন। এই যে নিজের কয়ডা জমাইন্না টেকা দিয়া মতলারে আমি আলফুর লেইগা পাডাইতে চাইতাছি। এইডা হুইন্না আপনে আবার মনে কইরেন না আমি আপনেগো সংসার থিকা চুরি কইরা টেকা জমাইছি, হেই টেকা অহন আলফুর লেইগা খরচা করতে চাইতাছি।

বড়বুজান সরল গলায় বললেন, না লো ছেমড়ি, আমি এই হগল ভাবি নাই। তুই পাডা মতলারে। আমিও চাই না এই বাইত্তে নতুন কামলা আহুক। আমিও চাই আলফুই থাউক।

শুনে খুশি হয়েছে কুট্টি। ভোরবেলা উঠে উত্তরের সীমানায় দাঁড়িয়ে বাদলাকে ডেকে বলবে, তর বাপরে ইট্ট আইতে ক বাদলা। কাম আছে। তার অনেক আগ থেকে মাথাটা ঘুরছে, বুকটা চাপ ধরে আছে, গলার ভিতর দলা পাকায়া আছে কী যেন। খালি উকাল আসতে চায়। নানারকম চেষ্টায় সেই উকাল ঠেকায়া সকালবেলার কাজগুলি করল কুট্টি। বড়বুজানের গু-মুতের ডহি পরিষ্কার করল, তাকে পরিষ্কার করল, নাস্তা পানি খাওয়াল। তারপর রান্নঘরে এসে নিজে একটু চা আর দুইটা আটারুটি নিয়া বসছে, মাত্র মুখে। দিয়েছে, লগে লগে উটকি (বমির উদ্রেক) পাড়তে লাগল। শেষ পর্যন্ত উকাল ঠেকাতে পারল না। ঘোয়াক ঘোয়াক করে উকাল করল। পেট থেকে তেমন কিছু বের হল না। তবে মাথাটা ঘুরতেই লাগল।

কুট্টি বুঝে গেল কারবারটা তার হয়ে গেছে। আলফুর লগে সহবাসের ফল গর্ভে ঢুকে গেছে। হায় হায় সব্বোনাশ! অহন কী করুম আমি? অহন তো কিলিংকার অইবো? মতলারে পাডাইয়াও যুদি আলফুরে ফিরত না আনতে পারি, তয় আমার উপায় অইবো কী? গলায় দড়ি দেওন ছাড়া তো গতি নাই। হায় হায়! ওই যে হেদিন নূরজাহানরে কইলাম আমি চাই আলফুর পোলা আহুক আমার পেডে। অর মাজায় আমি ঝুনঝুনি বাইন্দা থুমু। আমার। পোলায় হাঁটলে য্যান ঝুনঝুন কইরা আওজ হয়। হায় হায়, আল্লায় কি আমার হেই কথা। হুনলো!

উকাল পরিষ্কার করে, চা রুটি ফেলেই উত্তর দিককার সীমানায় গিয়া চিৎকার করে বাদলাকে ডাকতে লাগল কুট্টি। বাদলারে, ওই বাদলা। বাদলা।

বাদলাকে পাওয়া গেল না। তাড়া দিল রাবি। সে বদনা হাতে পায়খানা ঘর থেকে বের হচ্ছিল। কুট্টির ডাক শুনে সে যেদিকটায় দাঁড়িয়ে আছে সেই মুখী এসে দাঁড়াল। কী লো। কুট্টি, বাদলারে ডাক পারচ ক্যা?

তোমার জামাইরে দরকার।

ক্যা?

নিজের কথা বললে রাবি তেমন পাত্তা দিবে না ভেবে বলল, বড়বুজানে তারে তোমগো চরে পাডাইবো।

কীর লেইগা?

দেড়মাস অইয়া গেছে আলফু আহে না, তারে আনতে পাডাইবো।

হেয় মনে অয় যাইতে পারবো না। হের শইল খারাপ।

কুট্টি নিয়ারার গলায় বলল, তুমি তারে ইট্ট বুজাও। বুজাইয়া বাজাইয়া পালাও। নাইলে বড়বুজানে চেতবো নে। পরে মাজারো বুজানের কানে কথাডা গেলে হেয় আরও চেতবো। তোমরাই তো আলফুরে এই বাইত্তে আইন্না দিছিলা, এর লেইগা তোমগোই কইতাছে।

রাবি চিন্তিত হল। আইচ্ছা ঠিক আছে। আমি বাদলার বাপরে কইতাছি। তয় আইজ কাইলের মইদ্যে মনে অয় যাইতে পারবো না। শইলডা ইট্ট ভাল অউক, আমি তারে বুজাইয়া বাজাইয়া পাড়ামুনে চরে। তয় টেকা পয়সা ঠিক মতন দিয়ো। চরে যাইতে অইতে চল্লিশ-পনচাশ টেকা খরচা আছে।

অইলো, ওই হগল লইয়া তুমি চিন্তা কইরো না। হের যাইতে আইতে দুইদিন লাগবো, দুইদিনের মজুরিও দিয়া দিমু নে।

তয় ঠিক আছে। পশু তার যাওনের বেবস্তা করুম নে। কাইল তোমগো বাইত্তে পাডামু নে।

আইজ পাড়ান যায় না। যাতে কাইলই হেয় মেলা দিতে পারে।

না আইজ তার শইলডা সত্যঐ খারাপ। কয়দিন পর পর জ্বর আহে। হেই জ্বরডা কাইল রাইতে আইছে। কাইল তরি ভাল অইয়া যাইবো।

কুট্টি হতাশ গলায় বলল, তয় আর কী করুম। আইচ্ছা আমি বড়বুজানরে কইতাছি। কাইল তাইলে আমগো বাইত্তে পাডাইয়ো।

আইচ্ছা।

উত্তর সীমানা থেকে ফিরার সময় মাথা ঘোরাটা বাড়ছে কুট্টির, বুকের ভার, গলার ভিতর দলা পাকানো ভাব, উটকি আসছে। উকাল আসছে। দিশাহারা কুট্টি কী রেখে কী করবে বুঝতে পারছে না। রানঘরে এসে অনেকক্ষণ বসে রইল। তারপর ভাবলো, পশশু যুদি মতলা যায়, ফিরবো তার পরদিন। যদি আলফুরে লগে লইয়াহে তয় তো একহান চিন্তা গেল। তারবাদে কী হইবো? পেডের জিনিস সামাল কেমনে দিব কুট্টি? আলফুর কী করার আছে? সে কি বিয়া করবো কুট্টিরে?

কুট্টি ভাবল, না, আলফুকে সে কোনও চাপ দিবে না। ঘটনা তাকে বলবে তারপর সে যা সিদ্ধান্ত নেয়, তাই সই। আলফুর জন্য যত কলঙ্কিনী হতে হয় হবে কুট্টি। আলফুর কাছে। বিয়া না বইসাঐ তার বাচ্চা জন্ম দিবো। যুদি এইসব নিয়া দেশ গ্রামে ঢি ঢি পড়ে, তয় বাচ্চা কুলে লইয়া যেইমিহি দুইচক্ষু যায় চইলা যাইবো। পোলা লইয়া ভিক্কা কইরা খাইবো।

এইসব ভাবার পরও মন ভাল হল না কুট্টির। মাথা ঘুরানোটা আছে, উটকি পারা, উকাল উকাল ভাব সব কিছুর পরও সংসারের সবকাজ সারল সে। রান্দনবাড়ন, বড়বুজানের নাওন ধোওন, তার খাওনদাওন সব সেরে নিজেও খাওয়ার চেষ্টা করল। খেতে পারল না। বড় বুজানকে ঘুম পাড়ায়ে দিয়া নিজে এসে বসে রইল আলফু যে বারান্দায় শোয় সেই বারান্দার বাইরের দিককার দরজার সামনে।

শেষ দুপুরের রোদে তখন ঝিমঝিম করছে চারদিক। থেকে থেকে হাওয়া আসে বর্ষার চকমাঠ থেকে। বাঁশের ঝাড়ে শনশন শব্দ হয়। দিনেরবেলাও ঝিঁঝির ডাক শোনা যাচ্ছে। একটা কাঠঠোকরা পাখি অবিরাম ঠোঁট ঠুকছে পুব-দক্ষিণ কোনার বড় আমগাছটায়। কী একটা পাখি শিস দিচ্ছে আমরুজগাছটার ওদিকে। দুইটা শালিক লাফায় রানঘরের ওদিকটায়, একটা কাক উড়াল দিয়া এসে নামে, আবার উড়াল দিয়া চলে যায়। বড়বুজান গভীর ঘুমে। কুট্টির শরীর মন দুইটাতেই উথাল পাথাল। নিজে বুঝতে পারে নাই, কখন। গাল বেয়ে নামছে কান্না। চোখের পানিতে গাল ভাসছে, বুক ভাসছে।

এসময় খুব কাছ থেকে কে বলল, এমতে কানতাছো ক্যা গো? আমার লেইগা? কুট্টি ফ্যালফ্যাল করে মানুষটার দিকে তাকাল। চোখ মুছতে ভুলে গেল। সে যেমন ভেবেছিল ঠিক তেমন বেশ মানুষটার। নীল লুঙ্গির উপর সাদা ঝুলপকেটের শার্ট। মাজায় বান্ধা গামছা। একহাতে খয়েরি রঙের রেকসিনের পুরানা ব্যাগটা।

কুট্টির তবু বিশ্বাস হয় না। কুট্টির তবু মনে হয় সে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে। যার কথা দিনরাত চব্বিশঘণ্টা ভাবে সেই মানুষটা স্বপ্নে তার অদূরে এসে দাঁড়িয়েছে।

মানুষটা বলল, এমতে চাইয়া রইলা ক্যা? সত্যঐ আমি।

কুট্টি তারপর পাগলের মতন উঠে দাঁড়াল, পাগলের মতন একটা লাফ দিল। লাফ দিয়া মানুষটার সামনে এসে দুই হাতে তার গলা জড়ায়া ধরল। কান্না আনন্দের মিশাল দেওয়া গলায় বলল, তুমি এত দেরি করলা ক্যা? ক্যা এত দেরি করলা তুমি? আমি যে এইদিকে তোমার লেইগা মইরা যাইতাছিলাম।

হাতের ব্যাগ উঠানে নামিয়ে দুই হাতে আলফুও জড়িয়ে ধরল কুট্টিকে। মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে, গালে গলায় মুখ ঘষে আদর করতে করতে বলল, আমিও তোমার লেইগা। মইরা যাইতাছিলাম। একদোম মইরা যাইতাছিলাম।

তয় আহো নাই ক্যা? ক্যা আমারে ছাইড়া এতদিন রইলা?

পোলাপানের মা’রে বুজ দেওনের লেইগা। সে বড় ভেজাল করতাছিল।

গলা ছেড়ে আলফুর মুখের দিকে তাকাল কুট্টি। কী ভেজাল?

আমি তোমার কথা তারে কইয়া দিছি।

হায় হায় কও কী?

হ! কইছি আমি তোমারে বিয়া করুম। যুদি তুমি মত দেও তয় তো দিলাঐ, না দিলে তোমারে তালাক দিয়া কুট্টিরে আমি বিয়া করুম।

ক্যা এইডা কইলা তুমি? তার কী দোষ?

না তার কোনও দোষ নাই। দোষ আমার মনের। আমি তারে রাইখাই তোমারে বিয়া করতে চাইছি। কইছি তুমি আমার পোলাপানের মা। তোমগো ভরণপোষণ বেবাক আমি দিমু। বচ্ছরে একবার আইয়া তোমগো দেইক্কা যামু। আমি মানুষ ভাল দেইক্কা বেবাক কিছু খোলসা কইরা তোমারে কইলাম। না কইলে তুমি বুজতা না। আমি গোপনে কুট্টিরে বিয়া কইরা ওই বাইত্তে থাকতাম। তোমরা উদিসও পাইতা না। তয় ছলচাতুরি আমি নিজেও করি না, পছন্দও করি না। এর লেইগা তোমারে কইলাম। অহন তোমার সিদ্ধান্ত তুমি আমারে জানাও। হেয় বহুত চিল্লাচিল্লি করল, তার বাপ ভাইগো ডাকলো, বিচার সালিশ বসাইলো, হেয় হের কথা কইলো। বিয়া করলে আমার সংসার করবো না। আমি আমার কথা কইলাম। শেষমেশ মাতবররা, আমার হৌর হমুন্দি শালা ভায়রারাও আমার পক্ষ নিল। মোসলমান পুরুষপোলায় চাইরখান বিয়া করতে পারে। আলফু করলে দোষ কী? হেয় তো আর তোমাগো ছাইড়া দেয় নাই। যেহেনে কাম করে ওহেনে এক বউ থাকবো, আর তুমি চরে থাকবা পোলাপান লইয়া। এমুন ঘটনা কত ঘটে।

একটু থামল আলফু। এই হগল দরবাদরবিতে এত দিন গেল।

কুট্টি বলল, শেষতরি বড়বউ কী কইলো?

কী আর কইবো, মাইনা লইছে। অনেক কান্দাকাটি করছে। তারবাদেও মাইন্না লইছে।

এত আনন্দের মধ্যেও মন খারাপ করল কুট্টি। আমার লেইগা একজন নিরীহ মানুষরে তুমি কষ্ট দিলা?

কী করুম কও? আমার তো কোনও উপায় আছিল না। তারে তো আমি তিনডা পোলাপান দিছি, তোমারে তো কিছু দেই নাই। ওইদিক ঠিক রাইখা আমি যুদি মাতবরের চরে থাইকা যাইতাম তয় তোমার লগে বহুত বড় বেইমানি করা হইতো। ওইডা আমি করতে পারতাম না। তয় আমি তার লগে খারাপ ব্যবহার করি নাই। তারে বুঝাইয়া শুনাইয়া ঠিকঠাক কইরা আইছি। তয় তোমার লেইগা বহুত কষ্ট হইছে। একটা রাইত ঘুমাইতে পারি নাই, একটা দিন তোমারে ভুইলা থাকতে পারি নাই। আমার দেহ রইছে মাতবরের চরে, মন রইছে। বিক্রমপুরের মেদিনীমণ্ডল গেরামের মিয়াবাড়িতে, তোমার কাছে।

আলফুর কথায় সব ভুলে গেল কুট্টি। আবার জড়িয়ে ধরল আলফুকে। তার বুকে মুখ ঘষতে লাগল, পিঠে হাত বুলাতে লাগল। তুমি তো আমারেও দিছো, আমার জন্মও তো। সার্থক করছো। আইজ বিয়াইন্না রাইত্রেঐ আমি হেইডা উদিস পাইছি।

কুট্টির মাথায় পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে আলফু বলল, কী অইছে?

তুমি বাপ অইতাছো?

আলফু চমকাল। কুট্টিকে বুক থেকে ঠেলে সরিয়ে তার মুখের দিকে তাকাল। কী?

কুট্টি লাজুক হাসল। হ। আইজ বিয়াইন্না রাইত থিকা মাথা ঘুরাইতাছে। খালি উটকি পাড়ি। একবার উকাল করছি। কিছু খাইতে ইচ্ছা করে না।

তয় তো আর উপায় নাই।

কীয়ের উপায় নাই?

দুই-চাইর দিনের মইদ্যেই বিয়া কইরা হালান লাগে। দেরি করলে তোমার বদলাম অইবো। ওইডা আমি অইতে দিমু না।

কেমতে কী করবা?

পয়লা বড়বুজানরে কমু। তারে কইয়া ঢাকা গিয়া মাজারো বুজানরে কইয়া আইয়া বিয়া কইরা হালামু। দেরি করুম না।

আলফুকে জড়িয়ে ধরে গভীর আবেগের গলায় কুট্টি বলল, আমার কিছু কওনের নাই। আমি তো আমার সবকিছু তোমারে দিয়াঐ দিছি। আমার নিজের বইলা তো কিছু আর নাই। তোমার নিজের জিনিস তুমি রাখবা না হালাইয়া দিবা তোমার ব্যাপার।

আলফু বলল, না আমি তোমারে সারাজীবন আমার এই বুকে তুইলা রাখুম।

সমেদ খাঁ-র বাড়ির লম্বা পুকুরটার উত্তরদিক দিয়া কে যেন নাও বাইয়া যাইতে যাইতে গান ধরছে তখন,

উপরতালায় কোট কাচারি
মাঝের তালায় রয় বেপারি
নীচের তালায় কর্মচারী ধ্যান করে প্রেমের মালা
ঘরখানা হয় তিনতালা!

মিয়াবাড়ির দোতলা ঘর থেকে তার কিছুক্ষণ পর বড়বুজানের গলা শোনা গেল। ও লো কুট্টি, কার লগে কথা কচ? কে আইছে বাইত্তে?

কুট্টি না, আলফু জবাব দিল। আমি আইছি বুজান। আলফু।

আলহামদুলিল্লাহ। খুব ভাল করছস বাজান। তর লেইগা বহুত পেরেশানির মইদ্যে আছিলাম আমরা। আগে ভাতপানি খা, তারবাদে কথা কমু নে।

আইচ্ছা বুজান।

আলফু কুট্টির দিকে তাকাল। হাসি আনন্দ মাখা গলায় বলল, তোমার পোলার বাপরে ভাত দেও।

কুট্টি হাসল। আমি চাই আল্লায় আমারে একখান পোলাঐ দেউক। পোলার মাজায়। কাইতানের লগে ছোট্ট একহান ঝুনঝুনি বাইন্দা দিমু। আমার পোলা বাড়ি ভইরা দৌড় পাড়বো আর মাজার ঝুনঝুনি ঝুনঝুন ঝুনঝুন করবো। পোলার নাম রাখুম আমি নয়ন।

আলফু মুগ্ধ গলায় বলল, রাইখো।

আর রাইত্রে আমার বুকে কাছে শুইয়া থাকবো আমার পোলা, পিঠের কাছে শুইয়া থাকবা তুমি। মাঝখানে আমি। তুমি আমার উপরে একটা হাত দিয়া রাখবা, আমি আমার পোলার উপরে একটা হাত দিয়া রাখুম। আমি আল্লার কাছে আর কিছু চাই না। আল্লায় য্যান আমার জীবনডা এমতেঐ কাডায়।

আলফু বলল, আল্লাপাকে অবশ্যই তোমার মনের আশা পূরণ করবো।

.

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব তার ঘরের পশ্চিম দিককার দেয়ালে হেলান দিয়া বসে আছেন। ঘরটা মসজিদের উত্তর পাশে। উত্তর পাশের জানালার বাইরে একটা আমগাছ। ঘরের পুবদিকে দরজা। এই দরজা দিয়া তাকালে বাড়ির পুকুরটা দেখা যায়। পুকুরের উপরকার গাছপালাগুলি দেখা যায়। তার উপর দিয়া দেখা যায় আকাশ।

মহিউদ্দিন সাহেব উদাস চোখে খোলা দরজা দিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। বাইরের রোদ দেখছেন, হাওয়া অনুভব করছেন, পাখপাখালির ডাক শুনছেন।

তার ঘরে খাট চৌকি কিছু নাই। মোটা একখান জাজিমের উপর তোষক, তার উপর সাদা চাদর পাতা বিছানা। বিছানা পশ্চিমের দেওয়াল ঘেঁষে। বিছানার বাইরে ঘরের অনেকখানি জুড়ে সাদা ফরাশ পাতা। মুসল্লিরা কেউ দেখা করতে এলে ওই ফরাশে বসে।

এখন বসে আছে সোনা মিয়া আর আজিজ গাওয়াল।

আশ্বিনমাস শুরু হওয়ার লগে লগে চকমাঠ থেকে কমতে শুরু করেছে পানি। এতটাই ধীরে ধীরে কমছে, ভাল করে খেয়াল না করলে বোঝা যায় না। দুই-চাইরদিন পর হঠাৎ করে বর্ষার পানিতে ডোবা কোনও ঝোঁপঝাড়ের দিকে তাকালে দেখা যায় ঝোঁপের ডালপালায় পানির যে দাগ পড়েছে সেই দাগের উপরের দিকটা শুকনা, নীচের দিকটা ভিজা ভিজা। ওই ভিজা ভিজা দাগ দেখে বুঝা যায় পানি কতটা কমেছে।

তবে নৌকা বাইতে এখনও কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। নৌকার চলাচল ঠিক আছে। অসুবিধা হবে কার্তিক মাসে। চকের উঁচু আইল, টেক এইসব জেগে উঠবে। বাইতে গেলে খানে খানে ঠেকে যাবে নৌকা। তখন আবার শেষবর্ষার বৃষ্টিটাও নামবে। পাঁচ-সাতদিনের বৃষ্টি। এই বৃষ্টিকে বলে কাইত্তানি’। কার্তিক মাসের বৃষ্টি। শরতের আকাশ হয়ে উঠবে দেখার মতন। তারপর হেমন্ত, শীত। আল্লাহর কী কুদরত। সময়ে সময়ে কেমন করে বদলে দিচ্ছেন দুনিয়া। সেই বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলায় মানুষের জীবনধারা।

দুপুরের ভাত খেয়ে খাইগোবাড়ির দিকে নৌকা বাইয়া আসতে আসতে এসব কথা মনে হয়েছে আজ আজিজ গাওয়ালের। অনেকদিন হুজুরের লগে দেখা হয় না। তিনি গিয়েছিলেন ঢাকায় ডাক্তার দেখাতে। খান সাহেবরা কেউ বড় ডাক্তার দেখাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। কারণ হুজুরের শরীরটা ভাল না। কী অসুখ জানে না আজিজ। সোনা মিয়ার মুখে কাল বাজারে শুনেছে হুজুর ফিরেছেন। এজন্য আজ তার লগে দেখা করতে আসছে।

তবে হুজুরকে দেখে আজিজের মনটা বড় খারাপ হয়েছে। সেই নূরানি চেহারাটা আর নাই হুজুরের। কী রকম ম্লান, ফ্যাকাশে হয়ে গেছেন। মুখটা ভাঙাচোরা, চোখ দুইখান অনেকটা ঢুকে গেছে গদে। শরীরও যে খুবই দুর্বল দেখেই বুঝা যায়।

তারপরও আজিজকে দেখে সুন্দর করে হাসলেন। বিনয়ী গলায় আজিজের সালামের জবাব দিয়া বললেন, আসুন বাবা, আসুন। বসুন।

সোনা মিয়া আগে থেকেই বসে আছে। সে এখন পুরা দস্তুর মুসল্লি। পরনে পরিষ্কার সাদার ওপর হালকা বেগুনি ডোরা দেওয়া লুঙ্গি, সাদা পাঞ্জাবি পায়ের গুড়মুড়া তরি, মাথায়। গোল সাদা টুপি। নাকের তলা সুন্দর করে কামানো। দাড়ি গলা তরি নেমেছে। চোখে সুরমা।

সে বসে আছে মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেবের পায়ের কাছে। হুজুরের হাতের কাছে একখান কাঁচের জগ পিরিচ দিয়া ঢাকা, পাশে কাঁচের একটা গ্লাস। গ্লাসে কিছুটা পানি। জগ গ্লাস দুইটারই গায়ে বাষ্প জমেছে। ভিতরের পানিটা ঘোলা দেখাচ্ছে। অর্থাৎ গরম পানি।

আজিজের সালামের জবাব দিয়াই গ্লাস থেকে এক ঢোক পানি খেলেন মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব। আজিজকে বললেন, কেমন আছেন বাবা?

আছি হুজুর আল্লার রহমতে ভাল। আপনের দোয়ায় আল্লায় খুব ভাল রাখছে।

আজিজ খেয়াল করল হুজুরের গলার আওয়াজটা আগের মতন পরিষ্কার না, একটু ভাঙা ভাঙা। বলল, হুজুরের গলাটা ভাঙছে মনে অয়! ঠান্ডা লাগছে হুজুর? অনেক সময় গরম ঠান্ডা মিলা এইরকম হয়।

মহিউদ্দিন সাহেব বললেন, গলায় অসুখ হয়েছে বাবা। গলার চিকিৎসার জন্যই ঢাকায় গিয়েছিলাম। মাসুদ খান সাহেব বড় বড় ডাক্তার দেখালেন। অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে।

অনেক অমুদ দিয়েছেন ডাক্তার সাহেবরা। সেই অমুদ খাচ্ছি। আর খাচ্ছি গরম পানি।

এই প্রথম সোনা মিয়াকে খেয়াল করে দেখল আজিজ। সেও কেমন মনমরা, বিষণ্ণ চোখ দুইখান একটু যেন ছলছল করছে।

আজিজ ভাবল, হয়তো ইসলাম ধর্মের এমন কোনও ঘটনার কথা এতক্ষণ সোনা মিয়াকে বলেছেন হুজুরে, শুইনা মন অন্যরকম হইছে তার। এর লেইগা চোখ ছলছল করতাছে।

আজিজের ইচ্ছা হল সে যে আশা নিয়া আজ হুজুরের কাছে আসছে সেই বিষয়ে কিছু কথা শুনবে। কিছু না ভেবে কথাটা সে তুলে ফেলল। প্রথমে খুবই কোমল গলায় মহিউদ্দিন সাহেবকে ডাকল। হুজুর।

মহিউদ্দিন সাহেব আনমনা ছিলেন। আজিজের ডাকে তার দিকে তাকালেন। বলুন বাবা।

দুই-একখান কথা আছিল।

সোনা মিয়া বলল, আইজ থাউক আজিজ। হুজুরের শইলডা ভাল না। আরেকদিন আইসা বইলো।

মহিউদ্দিন সাহেব বললেন, না না বাবা। কোনও অসুবিধা নেই। আপনি এতটা দূর থেকে নৌকা বেয়ে কষ্ট করে আসছেন, কোনও অসুবিধা নেই। বলুন।

সোনা মিয়া বলল, তয় হুজুর আপনের তো বেশি কথা কওন নিষেধ। ডাক্তার সাহেবরা বইলা দিছেন।

না না তেমন কোনও অসুবিধা আমার হচ্ছে না। আপনি আমাকে নিয়ে চিন্তিত হবেন। দীন দুনিয়ার সব কিছুর মালিক আল্লাহপাক পরোয়ারদেগার। তিনি জীবন দিয়েছেন তিনি জীবন নেবেন। আর আমার জীবন আমি আল্লাহপাকের কাজে লাগাবার চেষ্টা করি। আল্লাহর সৃষ্টি শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের কাজে লাগাবার চেষ্টা করি। আজিজ সাহেব আমার কাছে আসছেন যে কথা শুনতে, জানা থাকলে অবশ্যই আমি তাকে তা বলব। আমার জীবন। যতক্ষণ আছে ততক্ষণ আল্লাহপাকের কাজ, মানুষের কাজ আমি করতে চাই বাবা। আজিজ সাহেব, আপনি বলুন বাবা কী জানতে আসছেন?

ভিতরে ভিতরে আজিজ একটু বেকায়দায় পড়ে গেল। আহা হুজুরের শরীরের এই অবস্থা জানলে সে আসত না। সোনা মিয়া তো তাকে বাজারে দেখা হওয়ার পর হুজুরের শরীরের এই অবস্থার কথা বলে নাই। এখন তো ফিরারও উপায় নাই আজিজের। কথা যখন একবার তুলে ফেলেছে, এখন তো বলতেই হবে।

মহিউদ্দিন সাহেব তাকিয়ে ছিলেন আজিজের দিকে। আজিজের দোনোমোনো ভাবটা খেয়াল করেছেন। হাসিমুখে বললেন, আপনি কোনও সংকোচ করবেন না বাবা। বলুন।

আজিজ ভাবল, না আর দোনোমোনো করনের কাম নাই। বইলাই ফালাই।

হুজুরের মুখের দিকে তাকাল সে। বলল, হুজুর, আমি ওই যে একদিন আইসা আপনেরে কইছিলাম আমার মা’র কথা। আমার ইসতিরি বানেছার লেইগা, মা’র লেইগা আমি আমার কর্তব্যকাজ কিছুই করতে পারি নাই। তয় হুজুর আমি তারে ঠিক কইরা ফালাইছি। মাস দেড়েক বাড়ির বাইরে থাইকা ফিরত আসনের পর আমার পুরা পরিবার অহন অন্যরকম। আমার ইসতিরি বানেছাও অহন একদম ঠিক।

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব একটোক গরম পানি খেলেন। তারপর বললেন, আল্লাপাক সুরা নিস’র ৩৪ আয়াতে বলেছেন, স্ত্রীদের মধ্যে যাহাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা করো তাহাদেরকে ভাল করে উপদেশ দাও, তারপর তাহাদের বিছানায় যেয়ো না ও তাহাদেরকে প্রহার করো। যদি তাহারা তোমাদের অনুগত হয় তবে তাহাদের বিরুদ্ধে কোনও পথ খুঁজিবে না।’ বলুন সোবাহানআল্লাহ।

সোনা মিয়া এবং আজিজ গাওয়াল দুইজনই বিড়বিড় করে বলল, সোবাহানআল্লাহ।

এই আয়াতের শুরুতেই আল্লাহপাক বলেছেন ‘পুরুষ নারীর রক্ষাকর্তা, কারণ আল্লাহ তাহাদের এককে অপরের উপর বিশিষ্টতা দান করিয়াছেন, আর ইহা এইজন্য যে পুরুষরা তাহাদের ধন সম্পদ থেকে ব্যয় করে। তাই সাধ্বী স্ত্রীগণ অনুগতা এবং যা লোকচক্ষুর অন্তরালে আল্লাহর হেফাজতে তাহারা তাহার হেফাজত করে। বলুন। সোবাহানআল্লাহ।

সোনা মিয়া আর আজিজ বলল, সোবাহানআল্লাহ।

তারপর আজিজ বলল, হুজুর আমি আল্লাহপাকের কথা মতন চলতে পারি নাই। আমার ইসতিরি আমার মা’র লগে খুবই খারাপ ব্যবহার করছে, তার ডরে আমিও মা’র পক্ষে। কথা কইতে পারি নাই। আমার ইসতিরি আমার অবাধ্যই আছিল। আমার কোনও কথা সে শোনে নাই, উলটা সে যা বলতো আমি সেইটা শুনতাম। আমার উচিত আছিলো তারে ভাল কইরা বুঝানো, তারপরও যুদি সে আমার কথা না শুনতে আমার উচিত আছিল যাতে সে আমার কথা শোনে সেই বেবস্তা নেওয়া। মাইর ধইর করা।

যা চলে গেছে তা আপনি আর ফিরে পাবেন না বাবা। তবে এখন যেহেতু সে আপনার অনুগত, আপনার কথামতো চলে, সেক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই আল্লাহপাকের বিধান মেনে চলতে হবে। আল্লাহপাক সুরা নিসা’তেই বলেছেন যদি তাহারা তোমাদের অনুগত হয় তবে তাহাদের বিরুদ্ধে কোনও পথ খুঁজিবে না। এখন আপনার স্ত্রী আপনার অনুগত। সুতরাং অতীত ভেবে তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবেন না।

মহিউদ্দিন সাহেব আরেক টোক পানি খেলেন। জীবন থেকে যা হারিয়ে যায় তা আর ফিরে পাওয়া যায় না। তবে অতীত জীবনের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষকে চলতে হয়। আর যদি কেউ তার অতীত কর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়, আল্লাহপাকের কাছে তওবা করে, তবে তো আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

সোনা মিয়া আস্তে করে বলল, হুজুর, আপনের তো কথা বলা নিষেধ। ডাক্তাররা বইলা দিছেন। আপনে একদম কথা বলবেন না। একদম চুপ কইরা থাকতে হইবো। গরম পানি খাইতে হইবো। গলায় যাতে কোনও চাপ না পড়ে।

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব স্নিগ্ধমুখে হাসলেন। ডাক্তাররা তো বলেছেনই। কিন্তু আমার যে বাবা আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। এই যে জহুর এবং আছরের মাঝখানকার সময়টুকু আপনাদের সঙ্গে এই ঘরে বসে কথা বলছি, এই জীবনে এই সময় আর কখনও পাব কিনা জানি না। নসিবে আল্লাহপাক কী রেখেছেন তা তিনিই জানেন। আজিজ সাহেব যে প্রসঙ্গটা তুলেছেন, তাঁর স্ত্রীর একদার আচরণ ইত্যাদি সম্বন্ধে, সেই। প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ছে হজরত ইব্রাহিম আল্লাইহেওয়াসাল্লামের জীবনের কিছু কথা। তার পুত্র হজরত ইসমাইল আল্লাইহেওয়াসাল্লামের জীবনের একটি বিশেষ ঘটনার কথা। বলি বাবারা। মন যখন চাইছে বলতে, আর এ তো আল্লাহপাকেরই ইশারা। আমাকে দিয়ে তিনি বলতে চাচ্ছেন। শুনুন, এই হাদিসটা দীর্ঘ, ধৈর্য ধরে শুনবেন। বুখারী শরীফে আছে ‘আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) রসূলল্লাহ্ সাল্লাল্লাহুআলাইহেওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করিয়াছেন, ইব্রাহিম আল্লাইহেওয়াসাল্লামের দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরা রাদিয়াল্লাহুতায়ালা আনহার গর্ভে ইসমাইল (আঃ) জন্মগ্রহণ করিলে, মাতৃজাতির মানবীয় স্বভাবের প্রবণতায় ইব্রাহিম (আঃ) এর প্রথমা স্ত্রী সারাহ্ (রাঃ) ও বিবি হাজেরা (রাঃ) র মধ্যে গরমিলের সৃষ্টি হইল। বিবি হাজেরাই প্রথম নারী যিনি পরিচারিকা নারীদের কোমরে পরিকর বা কোমরবন্ধ বাধার রীতি অবলম্বন করেন। তিনি সাধারণ পরিচারিকাদের মতো কোমরবন্ধ বেঁধে বিবি সারাহর সেবায় আত্মনিয়োগ করিলেন, বিবি সারাহর মনের আবিলতা দূর করিবার উদ্দেশ্যে। যখন ইব্রাহিম (আঃ) বিবি সারাহর মধ্যে প্রতিক্রিয়া সংঘটিত হইল তখন ইব্রাহিম (আঃ) বিবি হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাইলকে নিয়া বাহির হইলেন। তাঁহাদের সঙ্গে একটি মোশকে পানি ছিল, তাহারা পথে তাই পান করিতেন আর শিশু ইসমাইল মাতার দুগ্ধ পান করিতেন। এইভাবে তাঁহারা মক্কানগরীর বর্তমান অবস্থান স্থানে পৌঁছাইলেন। ইব্রাহিম (আঃ) বিবি হাজেরা ও শিশু ইসমাইলকে বড়ো একটি বৃক্ষের নীচে রাখিলেন। এই এলাকায় তখন কোনও মানুষ ছিল না, পানিরও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ইব্রাহিম (আঃ)। তাহাদের কাছে শুধুমাত্র একটি থলের মধ্যে কিছু খুরমা আর মোশেকের মধ্যে অল্প পরিমাণ পানি দিলেন। এই অবস্থায় শিশু ও তার মাকে সেখানে রাখিয়া ইব্রাহিম (আঃ) তাহাদের গৃহজনের দিকে রওয়ানা হইলেন। যখন ইব্রাহিম (আঃ) শিশু ও শিশুর মা’কে ছাড়িয়া চলিয়া আসিতেছিলেন তখন হাজেরা (রাঃ) তার পিছনে ছুটিলেন আর চিৎকার করিয়া বলিলেন, “হে ইব্রাহিম। আপনি কোথায় চলে যাচ্ছেন? অথচ আমাদের এমন জায়গায় রেখে যাচ্ছেন, যেখানে কোনো মানুষ নেই, পানাহারের কোনো ব্যবস্থা নেই। বারংবার এই কথা বলিতে লাগলেন। কিন্তু হজরত ইব্রাহিম (আঃ) সেইদিকে একেবারেই তাকাইলেন না, তাঁহার দৃষ্টি ও গতি ছিল সম্মুখ দিকেই।

অবশেষে হাজেরা (রাঃ) জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি আল্লাহর আদেশে এই ব্যবস্থা করলেন?” ইব্রাহিম (আঃ) বলিলেন, “হ্যাঁ।”

উত্তর শুনিয়া হাজেরা (রাঃ) সান্ত্বনালাভ করিলেন আর ভয়শূন্য চিত্তে বলিলেন, “তা হলে আমাদের ভয় নেই, আল্লাহ আমাদের হালাক করবেন না।”

বিবি হাজেরা (রাঃ) আরও জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “আপনি আমাদের এই জনশূন্য এলাকায় কার আশ্রয়ে রেখে যাচ্ছেন?”

ইব্রাহিম (আঃ) বলিয়াছিলেন, “আল্লাহর আশ্রয়ে।”

তাই শুনিয়া বিবি হাজেরা (রাঃ) বলিয়াছিলেন, “আল্লাহর আশ্রয়ে আমি পূর্ণ সন্তুষ্ট।” এই বলিয়া তিনি ইব্রাহিমের অনুসরণ ছাড়িয়া ফিরিয়া আসিলেন।

ইব্রাহিম (আঃ) শিশুপুত্র ও তাঁহার মা’কে ত্যাগ করিয়া পিছন দিকে না তাকাইয়া সম্মুখপানে অগ্রসর হইতেছিলেন। যখন গিরিপথের বাঁকে পৌঁছাইলেন যেখান থেকে স্ত্রী পুত্র চোখের নজরে পড়িবার সম্ভাবনা নাই, তখন কাবাগৃহের দিকে মুখ করিয়া দাঁড়াইলেন আর হাত উঠাইয়া দোয়া করিলেন, “হে পরওয়ারদেগার! আমি জনশূন্য মরুর বুকে আমার পরিজনের বসতি স্থাপন করে যাচ্ছি তোমার সম্মানিত ঘরের নিকটে, এই উদ্দেশ্যে যে, ওরা নামাজকে ভালভাবে আঁকড়ে থাকবে। প্রভু হে! তুমি আরও লোকের মন এই স্থানের প্রতি আকৃষ্ট করে দাও যেন এখানকার জনশূন্যতা দূর হয়ে যায়। আর ফলফলাদি খাদ্যদ্রব্য আমদানি করে পানাহারের ব্যবস্থা করে দাও; যাতে তোমার নেয়ামত উপভোগ করে মানুষ তোমার শোকর গুজারি করবে।”

বিবি হাজেরা (রাঃ) হজরত ইব্রাহিম (আঃ) এর পিছন থেকে নিজের জায়গায় চলিয়া আসিলেন। মোশকের পানি তিনি নিজে পান করিতেন আর শিশুকে তাঁহার বুকের দুধ পান করাইতেন। কিছুদিনের মধ্যেই পানি ফুরাইয়া গেল; তখন নিজেও ভীষণভাবে তৃষ্ণার্ত হইলেন আর শুষ্কতার কারণে বুকের দুগ্ধ না থাকাতে শিশুও পিপাসায় কাতর হইয়া পড়িলেন; এমনকী চোখের সামনে শিশুপুত্র পিপাসায় ছটফট করিতে লাগিল। তখন হাজেরা (রাঃ)। চোখের সামনে শিশুপুত্রের এই করুণ অবস্থা সহ্য করিতে না পারিয়া সেখান থেকে উঠিয়া গেলেন; নিকটতম ‘ছাফা” পর্বতের উপরে উঠিয়া এদিক ওদিক তাকাইতে লাগিলেন, যদি কারও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়, কিন্তু কোনো কিছুরই খোঁজ ছিল না। সুতরাং তিনি দ্রুত ছাফা পর্বত হইতে নামিয়া তারই সম্মুখস্থ ‘মারওয়া পর্বতের দিকে অগ্রসর হইলেন। ছাফা পাহাড় থেকে নামিয়া সম্মুখের অপেক্ষাকৃত নিচু জায়গা অতিক্রম করিতে তিনি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া দৌড়াইয়া চলিলেন। তারপর মারওয়া পাহাড়ের উপর উঠিয়া চারদিকে তাকাইলেন, কিন্তু কোনও কিছুরই খোঁজ পাইলেন না। এইভাবে বিচলিত হয়ে তিনি ওই পাহাড় দুইটির মধ্যেই দৌড়াদৌড়ি করিতে লাগিলেন, এমনকী বারংবার একটি থেকে অপরটিতে যাওয়ার সংখ্যা সাতবার হইল।

ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহুআলাইহেওয়াসাল্লাম উক্ত ঘটনার প্রতি ইশারা করিয়া বলিয়াছেন, বিবি হাজেরা (রাঃ) কর্তৃক উক্ত পাহাড়দ্বয়ে আসা যাওয়া করার স্মরণেই আজও হজ্জসমাপণকারীগণ হজ্জের একটি বিশেষ অঙ্গ হিসাবে এই পাহাড়দ্বয়ের মধ্যে বিভিন্ন দোয়া ও জিকির করিতে করিতে সাতবার সা’য়ী বা আসা যাওয়া করেন।

বিবি হাজেরা (রাঃ) সপ্তমবার ‘মারওয়া পাহাড়ে উঠিবার পর শিশুপুত্রের অবস্থা দেখিবার জন্য শিশুর কাছে ফিরিয়া যাইবার ইচ্ছা করিলে হঠাৎ একটি শব্দ শুনিলেন। তিনি সম্পূর্ণ মনোযোগের সঙ্গে ঐ শব্দের প্রতি ধ্যান দিলেন আর পুনরায় শব্দ শুনিলেন। এইবার তিনি। বলিলেন, “তোমার আওয়াজ তো শুনিয়েছ; সাহায্য করার কোনো ব্যবস্থা তোমার কাছে থাকলে সাহায্য করো।” তখন তিনি বর্তমান জমজম কূপের জায়গায় একজন ফেরেশতা দেখিলেন; তিনি জিব্রাইল (আঃ)। ওই ফেরেশতা তাঁহার পায়ের গোড়ালির আঘাতে সেখানে গর্ত করিলেন, তা থেকে পানি উঠিতে লাগিল। বিবি হাজেরা (রাঃ) আচম্বিত হইলেন আর মাটি দিয়া চতুর্দিকে বাঁধ সৃষ্টি করিয়া হাউজের মতো বানাইলেন; অতঃপর অঞ্জলি ভরিয়া মোশকে পানি ভরিতে লাগিলেন।

ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, উক্ত বিষয় উলেখ করিয়া নবী সাল্লাল্লাহুআলাইহেওয়াসল্লাম বললেন, ইসমাইলের মাতাকে আল্লাহ্ রহম করুন! তিনি পানির চতুর্দিকে বাঁধ না দিলে জমজমের ঐ পানি কূপ না হয়ে প্রবহমান ঝরনায় পরিণত হইত।

বিবি হাজেরা (রাঃ) এই পানি পান করিয়া দিন কাটাইতে লাগিলেন; তার বক্ষেও দুধের সঞ্চার হইল; শিশুকে পর্যাপ্ত দুধ পান করাইতে লাগিলেন। জিব্রাইল (আঃ) তাহাকে এই সান্ত্বনাও দিয়াছিলেন যে, আপনি আশঙ্কা করিবেন না যে, এই পানি নিঃশেষ হইয়া আপনি আবার বিপদের সম্মুখীন হইবেন। জানিয়া রাখুন, এখানেই আল্লাহর ঘরের স্থান নির্দিষ্ট আছে এবং এই শিশু তাঁহার পিতার সঙ্গে সেই ঘর পুনর্নির্মাণ করিবেন। এই ঘরের নির্মাতাগণকে আল্লাহতায়ালা ধ্বংস করিবেন, তা হতে পারে না। ঐ সময় সেখানে আল্লাহর ঘরের নিদর্শন শুধুমাত্র তার ভিটে জমিনের উপর উঁচু টিলার মতো ছিল, তাও পাহাড়ি বন্যার স্রোতে ভাঙ্গিয়া যাইতেছিল।

বিবি হাজেরা (রাঃ) একাকিনী এই এলাকায় বাস করিতে লাগিলেন। কিছুদিনের মধ্যে ইয়ামন দেশীয় “জুরহুম গোত্রের কিছু লোক এই এলাকা অতিক্রম করিবার সময় নিকটবর্তী জায়গায় বিশ্রাম নিল। তাহারা হঠাৎ দেখিতে পাইলো, কতকগুলি পাখি কোনো কিছুকে কেন্দ্র করিয়া উড়িতেছে। ইহা দেখিয়া তাহারা অনুমান করিতে পারিল যে, এই পিপাসার্ত জীবগুলি নিশ্চয় পানিকে কেন্দ্র করিয়া ঘুরিতেছে এবং আশ্চর্য হইল, ‘আমরা তো এই এলাকায় বহুবার এসেছি; এখানে পানি দেখিনি। তখনই তাহাদের দুই-একজন লোক পাঠাইল ঐ জায়গা থেকে সংবাদ আনিবার জন্য। এই প্রেরিত লোকেরা পানির সংবাদ আনিলে তাহারা সকলে সেখানে উপস্থিত হয়ে বিবি হাজেরা (রাঃ) কে দেখিতে পাইল। ওরা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “আমরা আপনার এই স্থানে বসতি স্থাপন করতে চাই, অনুমতি দেবেন কি?” বিবি হাজেরা (রাঃ) বলিলেন, “অনুমতি দিতে পারি, কিন্তু এই কূপের উপর তোমাদের স্বত্ব হইবে না।” ওরা সম্মত হয়ে সেখানে বসবাস আরম্ভ করিল।

ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহুআলাইহেওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন, বিবি হাজেরা (রাঃ) লোকের সাহচর্যের আশা করিয়াছিলেন, তিনি সেই সুযোগও পাইলেন। এই পর্যটক দলটি সেখানে বসতি স্থাপন করিল, তাহারা নিজেদের আরও লোককে সংবাদ দিয়া সেখানে আবাদ করিল; এমনি ভাবে সেখানে কয়েকটি পরিবারের বসতি হইল। এদিকে ইসমাইল (আঃ) এর বয়সও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি হইল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জ্বরহুম গোত্র থেকে তাহাদের ভাষা আরবি শিক্ষা করিলেন। ফলে তিনি জ্বরহুম গোত্রের লোকেদের প্রিয় হইয়া উঠিলেন। ইসমাইল (আঃ) বয়স্ক হইলে তাহারা নিজেদের একটি মেয়েকে তাঁহার সঙ্গে বিবাহ দিল। বিবাহের পর ইসমাইল আলাইহেওয়াসাল্লামের মাতা হাজেরা (রাঃ) ইন্তেকাল করিলেন।

ইসমাইলের বিবাহ ও তাঁহার মাতার মৃত্যুর পর একদা ইব্রাহিম (আঃ) তাঁহার পরিজনদের পরিদর্শনে সেখানে তশরীফ আনিলেন। ইসমাইল (আঃ) তখন বাড়িতে ছিলেন না। তাঁর স্ত্রীর নিকট ইব্রাহিম (আঃ) ইসমাইলের সংবাদ জিজ্ঞাসা করিলেন। স্ত্রী বলিলেন, “তিনি শিকার করে আহার্যের ব্যবস্থায় কোথাও গিয়েছেন।” অতঃপর ইব্রাহিম (আঃ) পুত্রবধূকে তাহাদের জীবনযাপনের অবস্থা জিজ্ঞাসা করিলেন। পুত্রবধূ বলিলেন, “আমরা অতিশয় দুরবস্থা, দারিদ্র্য ও কষ্টে আছি।” পুত্রবধূ শ্বশুর ইব্রাহিম (আঃ) কে চিনেন নাই। ইব্রাহিম (আঃ) বলিলেন, “তোমার স্বামী বাড়ি এলে আমার সালাম জানিও আর বোলো, সে যেন তার ঘরের দরওয়াজার চৌকাঠ বদলে নেয়।” এই বলে হজরত ইব্রাহিম (আঃ) চলিয়া গেলেন।

ইসমাইল (আঃ) বাড়িতে উপস্থিত হইলে, তিনি তাঁহার পিতার আগমনের আভাস অনুভব করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাড়িতে কোনো মেহমান এসেছিলেন কি?” স্ত্রী বলিলেন, হ্যাঁ, আকৃতি প্রকৃতির বর্ণনা করিয়া বলিলেন, এমন আকৃতির এক বৃদ্ধ এসেছিলেন; তিনি এসে আপনার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি সে সম্পর্কে উত্তর দিয়েছি। আর আমাদের সাংসারিক অবস্থা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আমি বলেছি, আমরা অত্যন্ত কষ্ট ও দারিদ্র্যের মধ্যে আছি।” ইসমাইল (আঃ) জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোনো আদেশ করে গিয়েছেন কি?” স্ত্রী বলিলেন, “হ্যাঁ, আপনাকে সালাম জানাবার আদেশ করে গিয়েছেন আর আপনাকে আপনার ঘরের চৌকাঠ বদলাতে আদেশ করে গিয়েছেন।” এই শুনিয়া ইসমাইল (আঃ) বলিলেন, “সেই বৃদ্ধ আমার পিতা; তিনি এই কথার দ্বারা আমাকে তোমায় পৃথক করে দেওয়ার আদেশ করে গিয়েছেন, অতএব তুমি তোমার পিত্রালয়ে চলে যাও।” এই বলিয়া। ইসমাইল (আঃ) স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিলেন এবং ঐ গোত্রেরই অপর একটি মেয়েকে বিবাহ করিলেন।

কিছুদিন অতিবাহিত হইলে ইব্রাহিম (আঃ) পুনরায় আসিলেন। সেই দিনও ইসমাইল (আঃ) বাড়ি ছিলেন না। তাঁহার স্ত্রীকে ইব্রাহিম (আঃ) ইসমাইল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলেন; স্ত্রী জানাইল, “তিনি আহার্যের সন্ধানে বাইরে গিয়েছেন।” তাহাদের সাংসারিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলে পুত্রবধূ বলিলেন, “আমরা ভাল ও স্বচ্ছলতায় আছি।” এই বলিয়া আল্লাহর প্রশংসা করিলেন। পুত্রবধূ তাঁহাকে পানাহারের জন্যও বিশেষ অনুরোধ করিলেন। ইব্রাহিম (আঃ) জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমাদের প্রধান খাদ্যদ্রব্য কী?” পুত্রবধূ বলিলেন, “গোশত।” পানীয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলে বলিলেন, “পানি।” ইব্রাহিম (আঃ) দোয়া করিলেন, “আয় আল্লাহ্! ওদের জন্য গোশত ও পানিতে বরকত দান কর।”

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইয়ে ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “ঐ সময় ওখানে শস্য ফসল ছিল না, নতুবা সে সম্পর্কেও ইব্রাহিম (আঃ) দোয়া করিতেন। ইব্রাহিম আলাইহেওয়াসাল্লামের এই দোয়ার ফলেই শুধু গোশত ও পানির দ্বারা মক্কা অঞ্চলে মানুষের স্বাস্থ্য ঠিক থাকিতে পারে, অন্য কোনো স্থানে শুধু এই দুই বস্তুর দ্বারা মানুষের স্বাস্থ্য টিকিতে পারে না। ইব্রাহিম (আঃ) তখন এই দোয়াও করিয়াছিলেন, “হে আল্লাহ! আমাদের খাদ্য ও পানীয়ের বরকত দান কর।” নবী সাল্লাল্লাহুআলাইহেওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন, মক্কা শরীফে খাদ্যের ও পানীয়ের বরকত ইব্রাহিম আল্লাইহেওয়াসাল্লামের দোয়ার বরকতেই।”

ইব্রাহিম (আঃ) পুত্রবধূর সঙ্গে আলাপের পর বলিলেন, “তোমার স্বামী বাড়ি এলে আমার সালাম বলো আর বলো যে, নিজের ঘরের চৌকাঠ যেন বহাল রাখে।

ইসমাইল (আঃ) বাড়ি আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমাদের কাছে কেউ এসেছিলেন কি?” স্ত্রী বললেন, “হ্যাঁ, এক নূরানি চেহারার বৃদ্ধ এসেছিলেন, তিনি আপনার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন; আমি যথাযথ উত্তর দিয়েছি। সাংসারিক অবস্থা জিজ্ঞেস করলে আমি বলেছি, আমরা সুখে শান্তিতেই আছি।” ইসমাইল (আঃ) জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোনো আদেশ করে গিয়েছেন কি?” স্ত্রী বললেন, “হ্যাঁ, আপনার নিকট সালাম বলেছেন আর আদেশ করেছেন আপনি যেন নিজ ঘরের চৌকাঠ বহাল রাখেন।” ইসমাইল (আঃ) বলিলেন, “তিনি আমার পিতা, তোমাকে স্ত্রীরূপে বহাল রাখবার আদেশ করেছেন।”

কিছুদিন পর ইব্রাহিম (আঃ) আবার আসিলেন। এইবার ইসমাইল (আঃ) য়ের সাক্ষাৎ পাইলেন; তিনি জমজম কূপের নিকটে বৃক্ষের নীচে বসে তির বানাচ্ছিলেন। ইসমাইল (আঃ) ইব্রাহিম (আঃ) কে দেখামাত্র উঠিয়া দাঁড়াইলেন আর পিতাপুত্রের মধ্যে যে ব্যবহারের আদান প্রদান হয় পরস্পর তাহাই করিলেন। অতঃপর ইব্রাহিম (আঃ) বলিলেন, “হে ইসমাইল! আল্লাহ্ আমাকে একটি আদেশ করেছেন।” ইসমাইল (আঃ) বলিলেন, “আপনার প্রভুর আদেশ বাস্তবায়িত করুন।” ইব্রাহিম (আঃ) বলিলেন, “আল্লাহ্ আদেশ করেছেন, তুমি আমার সাহায্য করবে; তুমি আমার সাহায্য করবে কি?” ইসমাইল (আঃ) বলিলেন, “আমি নিশ্চয় আপনার সাহায্য করব।” ইব্রাহিম (আঃ) বলিলেন, “আল্লাহ্ আমাকে আদেশ করেছেন, এই উঁচু ভিটাটিকে ঘিরে এক ঘর তৈরি করতে।”

ঐ সময়েই দুইজনে বাইতুলাহ্ শরীফের ঘর প্রস্তুত করিতে লেগে গেলেন। ইসমাইল (আঃ) পাথর আনিয়া দিতেন আর ইব্রাহিম (আঃ) গাঁথুনি করিতেন। দেওয়াল যখন উঁচু হইয়া গেল তখন ইসমাইল (আঃ) একটি বড়ো পাথর আনিলেন; ইব্রাহিম (আঃ) তার উপর দাঁড়াইয়া নির্মাণ কাজ করিতে লাগিলেন আর ইসমাইল (আঃ) তাঁহাকে গাঁথুনির পাথর। আনিয়া দিতে লাগিলেন। তাহারা উভয়েই চতুর্দিকে ঘুরে ঘর নির্মাণ করিয়াছিলেন আর এই দোয়া করিয়াছিলেন, “হে আমার প্রভু! আমাদের এই আমলটুকু কবুল করে গ্রহণ করে নিন। আপনি সবকিছু শোনেন আর প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সবকিছু জানেন।”

যে পাথরটির উপর দাঁড়াইয়া ইব্রাহিম (আঃ) কাবা শরীফের নির্মাণ কাজ করিয়াছিলেন সেই পাথরটি অলৌকিক উপায়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হচ্ছিল। এখনও ঐ পাথরটি কাবা শরীফের সন্নিকটে সুরক্ষিত আছে। এই পাথরের উপর ইব্রাহিম (আঃ) এর পদচিহ্নের রেখাপাত আছে। এই পাথরকেই মক্কামে ইব্রাহিম’ বলা হয়।

সুরা বাকারার ১২৫ আয়াতে আল্লাহ্পাক বলিয়াছেন, আর স্মরণ করো সেই সময়কে যখন আমি (কাবা) ঘরকে মানুষের মিলনক্ষেত্র ও আশ্রয়স্থল করিয়াছিলাম।’ (আর আমি বলিয়াছিলাম) “তোমরা ইব্রাহিমের দাঁড়াইবার জায়গাকেই নামাজের জায়গারূপে গ্রহণ করিও’। আর যখন আমি ইব্রাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করি যে, তোমরা আমার ঘরকে পবিত্র রাখিবে তাহাদের জন্য যাহারা ইহা প্রদক্ষিণ করিবে, এখানে বসিয়া এতেকাফ করিবে এবং এখানে রুকু ও সিজদা করিবে।

এতেকাফ কাকে বলে জানেন বাবারা?

সোনা মিয়া এবং আজিজ দুইজনেই মাথা নাড়ল। না হুজুর।

সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছুকালের জন্য ধ্যান করাকে এতেকাফ বলে। অনেকে রমজান মাসের শেষ দশদিন মসজিদে অবস্থান করে এতেকাফ করেন।

তারপর মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব বললেন, হজরত ইব্রাহিম আলাইহেওয়াসাল্লাম ইসমাইল (আঃ) ও তার মাতা হাজেরা (রাঃ) কে যখন মক্কার মরুভূমিতে রাখিয়া গিয়াছিলেন তখন ইসমাইল (আঃ) এর বয়স ছিল দুইবছর।

কথা বলতে বলতে গলা আরো ভেঙে আসছে মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেবের। একটু থামলেন তিনি, গ্লাস থেকে এক টোক গরম পানি খেলেন। সোনা মিয়া কাতর চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মুখে না, চোখ দিয়াই যেন অনুনয় করছে, আর না হুজুর, আর কথা কইয়েন না। আপনের গলার দশা খারাপ। ডাক্তাররা আপনেরে কথা কইতে একদোম না করছে। গলায় আওজ করতেই না করছে। কইছে ইশারায় কথা কইতে।

সোনা মিয়ার দিকে একবার তাকালেন মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব। আগের মতোই স্নিগ্ধ মুখে হাসলেন। আপনি চিন্তিত হবেন না বাবা। এমন এক মহামানবের কথা আমি বলছি, আল্লাহপাক যাকে নিজের দোস্ত বলেছেন। যাকে ইসলামের জনক বলতেও অসুবিধা নেই। তাঁর কাছ থেকে অনেক অনেক পেয়েছে মুসলমান জাতি।

আজিজ গাওয়ালের দিকে তাকালেন তিনি। আপনাকে বলি বাবা, এতক্ষণকার কথার মধ্যে হজরত ইসমাইল আলাইহেওয়াসাল্লামের প্রথম স্ত্রীর সম্পর্কে ওই যে হজরত ইব্রাহিম আলাইহেওয়াসাল্লামের কথা, দরওয়াজের চৌকাঠ বদলে নেওয়া, অর্থাৎ ওই স্ত্রীকে তালাক দিয়ে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করা। ইসমাইল আলাইহেওয়াসাল্লাম তাই করার পর তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে এসে তার কথা শুনে বলে গেলেন, দরওয়াজার চৌকাঠ বহাল রাখতে। অর্থাৎ এই স্ত্রীকে নিয়েই যেন সংসার করেন ইসমাইল আলাইহেওয়াসাল্লাম। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আমাদের বুঝাতে হবে কোন নারী সংসারের জন্য শুভ, কোন নারী শুভ নয়। আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বুঝতেই পারি না, আমাদের কী করণীয়। তবে কোনও কোনও স্ত্রীর ব্যাপারে, আমরা অকারণে বেশি কাতর হই, তাদেরকে মাথার উপর তুলে ফেলি, আবার অনেক ক্ষেত্রে অকারণে নির্দোষ সুশীল স্ত্রীর উপর অত্যাচার চালাই, তাকে কষ্ট দিই, অবিচার করি তার উপর। বিনা দোষে তাকে তালাক দিই।

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব খুক খুক করে একটু কাশলেন। একটোক গরম পানি খেলেন।

সোনা মিয়া বলল, পানি কি গরম আছে হুজুর, নাকি গরম কইরা আনুম?

না বাবা, আছে। কুসুম কুসুম গরম আছে। এইরকম গরম পানিই খেতে বলেছেন। ডাক্তার সাহেবরা।

আজিজ গাওয়াল স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব তাকে বললেন, আপনাকে দেখলে আর আপনার কথা ভাবলে আমার খুব ভাল লাগে বাবা। এই সোনামিয়া বাবাকে দেখলে আমার খুব ভাল লাগে। ধীরে ধীরে আমার কাছে এলেন সোনামিয়া বাবা, আমার সঙ্গে মিশে দিনে দিনে নিজেকে বদলে ফেললেন। আপনিও এলেন একদিন, এসে আপনার সংসারের কথা, মায়ের কথা, মৃত মেয়েটির কথা বললেন, তারপর নিজে একটা পথ বের করে, সংসার থেকে কিছুদিন দূরে থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বদলে ফিরে এলেন। স্ত্রীকে নিজের মতো তৈরি করে নিলেন, ছেলেমেয়েদেরকে নিজের চিন্তায় সুপথে নেওয়ার পথ তৈরি করলেন। এখন আপনার জীবন একজন প্রকৃত মুসলমানের জীবন। আপনার সংসার প্রকৃত মুসলমানের সংসার। আপনার কথা ভাবলেই আমার ভাল লাগে বাবা।

আজিজ বিনয়ী গলায় বলল, আপনে আমারে দোয়া করবেন হুজুর। আমি য্যান জীবনটা এইভাবে কাটাইয়া যাইতে পারি। পোলাপানগুলিরে য্যান মানুষের মতন মানুষ বানাইয়া যাইতে পারি। আল্লায় য্যান আমার জীবনের বেবাক গুনাখাতা মাপ কইরা দেয়।

নিশ্চয় দোয়া করবো বাবা, নিশ্চয় করব। আল্লাহপাক আপনার মনের আশা পূরণ করবেন।

সোনামিয়ার দিকে তাকালেন তিনি। সোনামিয়া বাবা, আমার গলা তো আর কাজ করে না। আছরের আজানটা দিন বাবা। ওয়াক্ত হয়ে গেছে।

বাইরে তখন পুরাপুরি বিকাল। রোদের রং বদলাতে শুরু করেছে। আকাশ যেন আরও বেশি স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে। হাওয়া তিরতির করে বইছে। গাছের ডালে ডালে ডাকছে পাখিরা।

সোনামিয়া আজান দেওয়ার জন্য বেরিয়ে গেল। আজিজ গাওয়াল তখনও বসে আছে। আছরের নমাজ পড়ে তারপর নৌকায় চড়বে। বাড়ির পথ ধরবে।

.

কই থিকা আইলেন গাছিদাদা।

মরনির বড়ঘরের সামনের তক্তায় বসতে বসতে দবির বলল, খাইগোবাড়ি গেছিলাম। তয় মনডা বহুত খারাপ বুজি। বহুত খারাপ।

মরনি চমকাল। আবার কী অইলো? নূরজাহানের ভেজাল তো সাইরা হালাইছেন। এনামুল সাবে বলে সব মিটমাট কইরা দিছে।

না না, নূরজাহানের লেইগা মন খারাপ না বুজি। মনডা খারাপ খাইগোবাড়ির হুজুরের লেইগা।

মরনি ছিল রান্নাচালার দিকে। কথা শুনে দবিরের কাছে এগিয়ে এল। কী অইছে হুজুরের? গলার আওজ একদোম বন্দ হইয়া গেছিলো। চাইরদিন আগে তারে ঢাকায় লইয়া গেছে। গলায় বলে বিরাট অসুক। তার আগেও ঢাকায় গেছিলেন হুজুরে। মাসুদ খান সাব বড় বড় ডাক্তার দেখাইছে। বহুত রকমের পরীক্ষা করাইছে গলার। ডাক্তাররা অমুইদ মষইদ দিছিল। কাম অয় নাই। পাঁচদিন আগে গলা দিয়া আর আওজ বাইর অয় না দেইক্কা আপেল মেম্বররা হুজুররে ঢাকায় লইয়া গেছে।

তয় অহন মজজিদের ইমাম কে?

নতুন একজন ইমাম আইছে। তার লগে চিন পরিচয় অইলো। তয় হেয় ওই হুজুরের লাহান না। কথাবার্তি কম কয়।

আপনে হুজুরের কাছে গেছিলেন ক্যা?

নূরজাহানের বিয়াশাদির চেষ্টা করতাছি। ঘটক ধরছি রমিজরে। হুজুরের কাছে গেছিলাম কইতে। হুজুরে যুদি দোয়া করে তয় আমার মাইয়াডার তাড়াতাড়ি বিয়া অইয়া যাইবো। গিয়া দেখি সোনামিয়া বইয়া রইছে ঘাটলায়। মনডা বহুত খারাপ। হুজুরের কথা জিগানের পর এই হগল কথা কইলো। কথা কইতে কইতে চোক্কের পানি ছাইড়া দিল (কেঁদে ফেলা অর্থে)। যেই মানুষ তার মধুমাখা গলা দিয়া জিন্দেগির কোরান হাদিসের কথা কইছে, আয়জান দিছে, ইমামতি করছে সেই মানুষটার গলায় এমুন অসুক দিল আল্লায়? গলার আওজ বন্দ অইয়া গেল? আহা রে! আহা!

মরনি এসে দবিরের পাশে বসল। হুইন্না আমারঐত্তো কান্দন আইতাছে। তার মতন ভাল মানুষ আমি জিন্দেগিতে কমঐ দেকছি। মজনু পয়লা মাসের বেতনের টেকা আইন্না আমার হাতে দেওনের পর আমি মজজিদে গিয়া পাঁচটা টেকা দিছিলাম হুজুরের হাতে। হুজুর সেই টেকাটা পয়লা হাতে লইলেন, দোয়া করলেন আমার পোলারে। তারবাদে টেকাড়া ফিরত দিলেন।

দবির অবাক। ফিরত দিলেন?

হ।

ক্যা?

কইলেন এই টেকাডা আপনে মা এমুন কোনও গরিব মানুষরে দেন, এই পাঁচ টেকায় য্যান তার বহুত উপকার অয়।

তারবাদে তুমি কারে দিলা?

আমি দিলাম নিখিলাগো বাড়ির ওইমিহি থাকে এক হিন্দু বুড়িরে।

কও কী? হিন্দু বুড়িরে?

হ। বুড়িডার দুইন্নাইতে কেঐ নাই। লাবি ঠাইরেনের বাড়ির ভাঙ্গা দালানডায় পইড়া থাকে। হিন্দুপাড়ার বাইরে ভিক্কা করতে যায় না। মোসলমান গিরস্তবাড়ির মাইনষে ভিক্কাও দেয় না বুড়িরে।

তুমি কি হুজুররে এই বেডির কথা কইছিলা?

হ।

কী কইলা?

কইলাম এমুন এক বেড়িরে আমি চিনি হুজুর, তার থিকা গরিব আর কষ্টে থাকইন্না মানুষ মনে অয় মেদিনমোল গেরামে আর নাই। তয় বেডি হুজুর হিন্দু। শুইনা হুজুরে কইলো, আল্লাহপাকের তৈরি সেরা জীব হইল মানুষ। একজন মানুষ পয়লা মানুষ তারবাদে হইল মোসলমান আর নাইলে হিন্দু, খিরিসটান আর কত জাইত ধর্ম আছে। তয় মা আপনে এই। টেকা পাঁচটা ওই মহিলারেঐ দেন। তার কাম হইবো। আল্লাহপাকও খুশি হইবেন যে তাঁর তৈরি একজন মানুষরে আরেকজন মানুষ উপকার করতাছে। আর আপনেরে আমি কী কমু। গাছিদাদা, টেকা পাঁচটা পাইয়া বুড়ি যে কী খুশি অইলো! জিন্দেগিতে এমুন খুশি অইতে আমি কম মানুষরেঐ দেকছি। কত রকমভাবে যে আমার পোলাডারে, আমার মজনুরে সে দোয়া করল। হিন্দুরা তো দোয়া কয় না, কয় আশিববাদ। খালি কপালে টেকাডা ছোঁয়ায় আর আমার পোলাডারে আশিববাদ করে।

দবির আনন্দের একটা শ্বাস ফেলল। এই হইল হুজুরের লাহান হুজুর। পয়লা মানুষ। বিচার করে তারপর জাইত ধর্ম বিচার করে। তার জাগায় যদি ওই শালার পো শালায় অইতো, ওই মন্নাইন্না, তয় টেকাডা পয়লাঐ নিজের পকেটে হান্দাইতো।

মরনি বলল, তয় হুজুরের কথাডা হুইন্না মনডায় কষ্ট পাইলাম গাছিদাদা।

হ বুজি পাওনেরঐ কথা। আমি তোমারে কইলাম না, আমার মনডা বহুত খারাপ অইছে। হুজুরের লগে এই জিন্দেগিতে মনে অয় না আর কোনওদিন দেহা অইবো।

ক্যা? অসুক ভাল অইলে হেয় ফিরত আইবো না?

দবির মরনির মুখের দিকে তাকাল। এই অসুক কি ভাল অইবো?

কী অসুক যে ভাল অইবো না?

সোনামিয়া পুরাপুরি খোলসা কইরা কইলো না। তয় তার কথায় মনে অইলো ভাল অওনের মতন অসুক না। আমিও হেইডা বুজলাম।

কেমতে?

যুদি ভাল অওনের মতন অসুক অইতো তয় খাইগোরা এত তাড়াতাড়ি নতুন ইমাম আনাইতো না তাগো মজজিদের লেইগা। হুজুররে এক-দুইমাস চিকিচ্ছা করাইতো। ঢাকায় হাসপাতালে রাকতো আর হেই ফাঁকে সোনামিয়ারে দিয়াঐ টেমপরালি (টেমপোরারি) ইমামতি করাইতো। সোনামিয়ারে তো হুজুরে সবই হিগাইছে। নতুন ইমাম দেইক্কাঐ আমার মনডায় কামড় দিছে। ওই হুজুরে আর মনে অয় ফিরবো না।

মরনি চিন্তিত গলায় বলল, কী এমুন অসুক অইলো, গলা বন্দ অইয়া গেল হুজুরের? অহন আপনে কইতাছেন আর ফিরতও আইবো না।

সোনামিয়ার কথায় আমার সন্দ অইছে বুজি।

কী সন্দ অইছে?

হুজুরের গলায় মনে অয় ক্যান্সার ধরা পড়ছে।

হায় হায় কয় কী!

হ আমার মনে অইলো।

মরনির মুখটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। উদাস চোখে গয়াগাছটার ওদিক দিয়া আকাশের দিকে তাকাল সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এমুন একজন মানুষরে আল্লায় এমুন অসুক দিল। আহা রে, আহা।

দবির বলল, ভাল মানুষগো আল্লায় তাড়াতাড়ি দুনিয়া থিকা উড়াইয়া নেয়। বাঁচাইয়া রাখে শয়তানডিরে। আল্লাখোদার নাম লইয়া, ধর্মের নাম লইয়া একটা ভণ্ড মাওলানা যে মেদিনমণ্ডল গেরামডারে ছারখার করতাছে আল্লায় অরে ক্যান বাঁচাইয়া রাখছে? অরে ক্যান কোনও অসুক বিসুক দেয় না?

মরনি বলল, আল্লার মাইর, দুনিয়ার বাইর। শয়তান বদমাইশগো আল্লায় এমুন শাস্তি দিবো, মানুষ ওইডা চিন্তাও করতে পারবো না। মান্নান মাওলানার কপালে যে কী আছে ওইডা আল্লাপাক ছাড়া আর কেঐ জানে না। হেয় যেই গুনা করছে মাকুন্দার মতন একজন মাইনষের লগে, ছনুবুড়ির জানাজা পড়ন লইয়া, অরে আল্লায় ছাড়বো না। অর কপালে বিরাট শনি আছে। তারবাদে অহন লাগছে নূরজাহানের লাহান নাতিনের থিকাও কম বয়সি মাইয়াডার পিছে। তয় আল্লার রহমত যে এনামুল সাবে ঘটনা মিটমাট কইরা দিছে।

হ বুজি। এইডা অইছে তোমার লেইগাঐ। আমি তো দিশা না পাইয়া তোমার কাছে আইছিলাম। তুমি কইলা দেলরা বুজির কাছে যাইতে। গেলাম। তারবাদে তো ঘটনা মিটলো। আমার নূরজাহানরে দুইবার তুমি বাঁচাইলা।

মরনি মুখের স্নিগ্ধ একটা ভঙ্গি করল। আমি তো বাঁচাই নাই, বাঁচাইছে আল্লায়।

দবির লগে লগে বলল, হ বিপদে পড়া মানুষরে আসলে আল্লায়ঐ বাঁচায়। তয় একখান উছিলা লাগে। উছিলা আছিলা তুমি।

তয় রমিজ ঘটক পোলার খোঁজখবর পাইলো?

অহনতরি পায় নাই। দেকতাছে। ঘটকাগো কারবার তো তুমি বোজেঐ বইন। ঘটকারা হাতে পোলা পাইলেও ঘুরায়, মাইয়া পাইলেও ঘুরায়।

হ যতদিন ঘুরাইবো ততোদিনঐ টেকা খাইতে পারবো। আইজ পঞ্চাশ টেকা, কাইল একশো টেকা। পোলা পাইয়াও কয়, পোলা পাই নাই। দেখতাছি। দেন একশো টেকা দেন অমুক গেরামে পোলা দেকতে যামু।

একদোম ঠিক কথা কইছো বইন। রমিজ ঘটকারে ধরছি মাসেকহানি অইয়াইলো। এর মইদ্যে ছয়-সাতশো টেকা দিয়া দিছি। দেহা অইলেই টেকা চায়।

তা তো চাইবোঐ। আর আপনেরও দেওন লাগবো। মাইয়া যত তাড়াতাড়ি অহন বিদায়। করতে পারেন ততো সুবিদা।

হ। এনামুল সাবে কইছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভাব বিয়া দিয়া দেও মাইয়ার।

কথা ভালঐ কইছে। বিয়া দিয়া দিলে আপনে এক্কেরে জানে বাঁইচ্চা যান। গোলামের পোয় যেমতে লাগছে ছেমড়ির পিছে, বিয়া না দিলে ওই শুয়োরের পোর হাত থিকা মাইয়া রক্ষা করা কঠিন অইয়া যাইবো।

হ। এর লেইগাঐ আমি টেকা পয়সার মিহি চাইতাছি না। আমার অবস্তা তো তুমি জানোঐ বুজি। কয়টেকা রুজি করি, কয় টেকা জমাইতে পারি। তাও মাইয়ার লেইগা যেডু জমাইছি হেডু খরচা করতাছি। যত তাড়াতাড়ি সমভাব, ইট্টু পছন্দ মতন পোলা পাইলেঐ বিয়া দিয়া হালামু মাইয়ার।

মরনি চিন্তিত গলায় বলল, হেইডা তো দিবেন, তয় আইজ কাইলকার পোলাগো তো চাহিদা অনেক। এইডা দেও জামাইরে, ওইডা দেও।

হ জিনিসপত্র তো চায়ঐ, ঘড়ি আংটি গলার চেন কাপড় চোপড় তো দিতে হইবোই, কোনও কোনও পোলায় মটরসাইকেল চায়, নগদ টেকা চায়। রাস্তা অইয়া যাইতাছে, দেশ গেরামে বিজলি আইয়া পড়বো। দেহা গেল টেলিভিশনও চাইতাছে পোলায়।

দবির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আল্লাই জানে কী আছে মাইয়াডার বরাতে। দেহা গেল পোলা ভালঐ পাইলাম, তয় বিরাট ফর্দ দিল। এইডা এইডা চাই। তহন কী করুম কিছু বুজতাছি না।

মরনি আশ্বস্ত করল দবিরকে। আরে না, নূরজাহান দেকতে শোনতে ভাল। অর লেইগা এত কিছু লাগবে না। দেকবেন যেই পোলায় অরে দেখবো হেয়ঐ অরে পছন্দ করবে। আপনে এত চিন্তা কইরেন না গাছিদাদা। আল্লার উপরে ভরসা রাইখেন। আল্লায়ঐ পার করবো অরে।

যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে মরনি তারপর জিজ্ঞাসা করল, ও গাছিদাদা, গোলামের পোয় যে অরে বিয়া করতে চাইছিল এই কথা কি ও হোনছে?

হ বইন হোনছে। তোমার ভাবিছাবে অরে কইছে। সব মিটমাট অইয়া যাওনের পর আমি কইছি নূরজাহানের মা’রে, তারবাদে হেয় কইছে নূরজাহানরে।

হুইন্না মাইয়ায় কী কয়?

মাইয়াডা এমুন ডরান ডরাইছে, অর মায় হেদিন খিচুড়ি রানতে দিছিলো অরে, খিচড়ি আইন্না (লবণ কম হওয়া) কইরা হালাইলো।

ডরানের তো কথাঐ দাদা। এমুন একটা বেডায় যুদি অতড়ু একটা মাইয়ারে বিয়া করতে চায়, যেই বেডায় আবার অর উপরে ভিতরে ভিতরে চেতা, গোলামের পোয় তো অর উপরে শোদ লওনের লেইগা অরে বিয়া করতে চাইছে। আপনেরে জাগা সম্পত্তি দিতে চাইছে। পুরাডা অইলো অর হেই জিদ। অর জিদ যায় নাই। রইয়া গেছে। বিয়া কইরা নূরজাহানের উপরে ও জিদ মিটাইবো, এইডা নূরজাহানও বুজছে। এর লেইগাঐ বেশি ডরাইছে মাইয়ায়।

তয় অহন আর ডর ভয়ের কিছু নাই। ও জানে আমরা অর বিয়ার চেষ্টা করতাছি।

দবির বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল দুপুরের ভাত খেয়ে। কোষানাও বাইয়া খাইগোবাড়ি গেছে, সেই বাড়ি থেকে আসছে হালদারবাড়ি। তারপর এতক্ষণ ধরে কথা বলছে মরনির লগে, এর মধ্যে অনেকবার মাথার ভিতর চাগা দিয়া উঠেছে তামাকের নেশা। একবার ভেবেছে রহমান হালদারের সীমানায় গিয়া একটু তামাক খেয়ে আসে। কথার তালে তালে আর যাওয়া হয় নাই। কোন ফাঁকে যেন বিকাল হয়ে গেছে।

না এখন আর তামাক খাওয়া যাবে না। এখন বাড়ির পথ ধরতে হবে। তবে মনের ভিতরে যে কথাটা জোয়াইরা পুঁটি মাছের মতন থেকে থেকে লাফ দিচ্ছে সেই কথাটা কি কোনও না কোনও কায়দায় একটু তুলে দেখবে দবির! মরনি বুজি কী বলে একটু শুনবে!

কথাটা খুবই অন্যরকম একটা ভঙ্গিতে তুলল দবির। আমি তো আমার মাইয়ার বিয়ার কথা চিন্তা ভাবনা করতাছি, দুই-চাইর-ছয়মাসের মইদ্যে মাইয়া বিয়া দিয়া হালামু। তুমি তোমার পোলা বিয়া করাইবা কবে?

মরনি হাসল। ওই দেহো গাছিদাদায় কয় কী? আরে আমার পোলার অহনতরি বিয়ার বস অইছেনি? কুড়ি-একইশ বচ্ছর বস। এই বসের পোলারা আইজকাইল বিয়া করেনি! আর বিয়া করলে বউরে খাওয়াইবো কী? পুরাপুরি খলিফা অহনতরি অয় নাই। খালি মিশিনে বইতাছে। বেতন অইছে ছয়শো টেকা। নিজের পকেট খরচা বাদ দিয়া কয় টেকা আর বাঁচে। ওই টেকা থিকা আমারে পাড়ায় কিছু। দেশে আইয়া খরচা করে। আমি পোলা বিয়া করামু আরও চাইর-পাঁচ বচ্ছর পর। যহন ও বড় খলিফা অইয়া যাইবো। দরকার অইলে জমিন বেইচ্চা অরে আমি টেকা দিমু। হেই টেকা দিয়া ও নিজো খলিফা দোকান দিবো। ভাল টেকা পয়সা রুজি করবো। বউ লইয়া, আমারে লইয়া টাউনে থাকতে পারবো।

দবির ভিতরে ভিতরে দমে গেল, তবে চেহারায় সেইভাব ফুটতে দিল না। বলল, তয় পোলায় বউ লইয়া টাউনে থাকলে তুমিও তাগো লগে থাকবা?

হ। আমার পোলার ওই রকমঐ চিন্তা।

আর এই বাড়িঘর?

বাড়িঘরে চউরা মউরা বহাইয়া দিমু। রাবির মতন, আলফুর মতন।

আলফুর নামটা ওঠার লগে লগে কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিল দবির। আলফুর ঘটনা হোনছো বুজি?

মরনি হাসল। হুনছি না? কুট্টিরে বিয়া কইরা হালাইছে। চরে এক বউ, এই দেশে এক বউ। আমিন মুনশি সাবে বিয়া পড়াইছে।

হ।

ওই গোলামের পোয় আছিলো কই? কুট্টির বিয়া লইয়া ভেজাল লাগায় নাই?

না। মনে অয় সাহস পায় নাই।

হ রাজা মিয়ার মা’র ডরে সাহস পায় নাই। রাজা মিয়ার মা’য় বলে কইছে, হ কুট্টির লগে আলফুর বিয়া অইলে ভালঐ অয়। আলফু আর সহাজে চরে যাইতে চাইবে না। বাড়ি পইর (পাহারা) দিতে সুবিদা অইবো। আর এই বিয়ায় তো কোনও দোষ নাই। কুট্টিরও তো আগে বিয়া অইছিল। পুরুষ পোলাগো চাইর বউ থাকলেই বা কী!

দবির বলল, রাজামিয়ার মা’র ডরেই মান্নাইন্না শালার পো শালায় কুট্টি আলফুর বিয়া লইয়া ভেজাল করে নাই। আমিন মুনশি বিয়া পড়াইছে ওইডা লইয়াও কথা কয় নাই।

তারপরই উঠল দবির। যাইগো বুজি। হাজ অইয়াইলো।

মরনিও উঠল। হ যান গাছিদাদা। আমার বাইত্তে আইলে আপনেরে তো এক ছুলুম তামুকও খাওয়াইতে পারি না। বাইত্তে উক্কা নাই।

দবির হাসল। উক্কা না থাকলে কেমতে খাওয়াইবা।

হালদারবাড়ির ঘাট থেকে নৌকা ছাড়ার পর দবির টের পেল তার মনটা খুবই খারাপ হয়েছে। মনের ভিতরে গোপন একটা আশা ছিল, হয়তো এইভাবে মজনুর বিয়ার কথা হুনলে মরনি বুজি বলবে, আপনের মাইয়াডা আমার মজনুর লেইগা দিয়া দেন গাছিদাদা। আমার একখান পোলা আছে, একখান মাইয়াও থাউক। কোথায় কী? ওসবের ধার দিয়াও গেল না মরনি। বলল মজনুরে বিয়া করাইবো চাইর-পাঁচ বছর পর।

চক পাথালে লগির খোঁচ দিতে দিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল দবির। বিকাল ফুরিয়ে আসা রোদ হাওয়া আর পরিষ্কার আকাশের তলায় কোথায় যে মিলিয়ে গেল সেই দীর্ঘশ্বাস!

.

গণেশ নাপিতের বড়মেয়ে আরতির বিয়া ঠিক হইছে।

জামাইও নাপলি করে। ভাগ্যকুলের পোলা। ভাগ্যকুল বাজারে তার সেলুন আছে। সেলুন নামেমাত্র সেলুন। ছোট্ট একখান দোকানঘরে একখান চেয়ার, মাঝারি মাপের একখান আয়না আর নাপতালির যন্ত্রপাতি। মাওয়ার বাজারের দুলালের সেলুনের মতন।

জাতপাত বনে গেছে দেখে বিয়া হয়ে যাচ্ছে দ্রুতই। অঘ্রান মাসের মাঝামাঝি। তোড়জোড় শুরু হয়েছে এখন থেকেই। গরিব মানুষের ঘর, তার উপর হিন্দু। হিন্দুবাড়ির মেয়ের বিয়াতে নানানপদের ফ্যাকড়া। জামাইকে দিতে হয় অনেক কিছু। আরতির জামাইকে দিতে হচ্ছে নগদ তিরিশ হাজার টাকা। জামাইর নাম পরিতোষ। পরিতোষের সেলুন বড় করতে হবে। নাপতালি কাজের আকাল নাই তার। দোকানে আরও দুইখান চেয়ার বসাতে পারলে, দুইজন কর্মচারী রাখতে পারলে ব্যাবসা ভাল জমবে। দুই-চার বছরের মধ্যে অবস্থা ফিরে যাবে পরিতোষের। তাদের বাড়ির অবস্থাও নির্ভেজাল ধরনের। বড় দুই। বোনের একমাত্র ভাই। বোনদের বিয়া হয়ে গেছে অনেক আগে। একজন থাকে নবাবগঞ্জে আরেকজন কয়কীর্তন। জামাইরা নাপতালির কাজই করে। পোলাপান বড় হয়ে গেছে, জমিজিরাত কিছু পৈতৃকসূত্রে পেয়েছে কিছু নিজেরা করেছে, অবস্থা মন্দ না একজনেরও। পরিতোষের সংসার এখন ঝাড়া হাতপায়ের। বাপ মারা গেছে। শুধুমাত্র মা আছে। সেই মহিলাই সংসার সামলায়। দেবর-ননদের ঝামেলা পোহাতে হবে না আরতিকে। শুধু যদি শাশুড়িটা মানুষ ভাল হয়, পোলার বউকে যদি জ্বালাতন তেমন না করে তবে আরতির জীবন হবে মহাসুখের।

এইসব কথা বলবার জন্যই আজ দুপুরের পর ফুলমতির কাছে আসছে আরতি। গণেশ নাপিতের এই মেয়েটা আর নিমাইয়ের বউ মায়ারানি তার কোলের মেয়ে পুষ্পকে নিয়া বিকালের দিকে প্রায়ই আসে ফুলমতির কাছে। ফুলমতি তাদেরকে রামায়ণ-মহাভারতের গল্প বলে, রাধাকৃষ্ণের গল্প বলে। পুরানা বই থেকে কখনও কখনও পড়ে শোনায়। আরতি আর মায়ারানি খুবই ভক্ত ফুলমতির।

দুপুরের পর ফুলমতি আজ বড় আমগাছটার ওদিকটায় উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শরৎকালের আকাশ ঝকঝক করছে মাথার ওপর। বাড়ির উত্তরপাশের খালের ধারে কাশবন। কাশবন ভরে গেছে ফুলে ফুলে। হাওয়ায় কী সুন্দর দোল খায় আর রেণু ছড়ায় কাশফুল। তেমন গরমও নাই। চকমাঠ থেকে নামতে শুরু করেছে বর্ষার পানি। জেগে উঠছে পুকুরগুলির উঁচু পাড়, খেতখোলার আইল, পানিতে ডোবা হালট। দেশগ্রামে আগের মতন মাছ নাই। বর্ষাশেষের মাছে এক সময় পলকে ভরে যেত গিরস্তের ডুলা। ঝাঁকিজাল পেনিজাল, দোয়াইর ওচা, টেটা জুতি আর বঁড়শি তো ছিলই। মাছ ধরার কত যন্ত্র। এখন মাছ কম। ইরি ধানের সার আর কীটনাশকের তেজে সব মাছ দেশ ছেড়ে পলাইছে। তারপরও এই দিনে মাছ কিছু না কিছু পাওয়া যায়ই। চকেমাঠে এখনও, এই আশ্বিনমাসের অল্প পানিতে খাজা (রোদে বর্ষার পানি গরম হয়ে উঠলে, পানি কমে এলে, নলা কাতলা গরমা রুই মৃগেল জাতীয় মাছ পানির উপর মুখ ভাসিয়ে শ্বাস নেয়, ঘাস বিচালির গা থেকে ঠুকরে ঠুকরে খাবার খায়। এই পদ্ধতিটাকে বিক্রমপুর অঞ্চলে বলে খাজা’) খেতে ওঠে। জুতি টেটা দিয়া ওই মাছ ধরতে যায় গিরস্তলোক। খালে থাকে বেজায় কাটাল। বর্ষার পানি চকমাঠ থেকে খালে নেমে ফিরা যায় নদীর দিকে। খালে পাওয়া যায় ইচা আর বাইল্লামাছ। দোয়াইর পাতলে আগে যেমন দোয়াইর ভরে যেত, এখন তেমন ভরে না। তবে অল্পবিস্তর মাছ পাওয়া যায়। ফুলমতির বাপ রামদাস এই সময় পাউন্নার কাজটা চালু তো রাখেই, ফাঁকে ফাঁকে ছোট দুই পোলা সেন্টু মিন্টুকে নিয়া খালে দোয়াইর পেতে মাছও ধরে। সকাল থেকে দুপুর তরি দোয়াইর বঁড়শি এইসব দিয়া মাছ ধরে খালে। বাড়িতে থাকলে বিকালের দিকে বহ্নিছাড়া ছাড়িয়ে পশ্চিম দিককার বিলে নাও নিয়া যায় খাজার মাছ মারতে। এক পোলায় কিছুক্ষণ নাও বায় আর আরেক পোলা আর বাপে জুতি টেটা চালায়। কাজটা পালা করেই করে তারা। একটানা বেশিক্ষণ নাও বাওয়ার কাজ করে না কেউ। তিনজনেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করে। মাছ পায় ভালই। যেদিন সকাল থেকে তিন বাপপুতে শুধু মাছ ধরার কাজ করে, বিকালের দিকে রামদাস নিজে সেই মাছ সংসারের জন্য কিছুটা রেখে বাকিটা ডুলায় করে নিয়া যায় মাওয়ার বাজারে। এক-দেশশো টাকার মাছ বিক্রিও করতে পারে। পানের কাজ, মাছের কাজ আর যেটুকু খেতখোলা আছে সেইটুকু নিজেরা চাষ করে রামদাস তার সংসারটা স্বচ্ছলই রেখেছে। এতকিছুর মধ্যে শুধু বড়পোলা নিখিল সংসার উদাসী। সে আছে মোতাহারদের লগে। সংসারের আয় রোজগার নিয়া তার কোনও মাথাব্যথা নাই। তার মাথাব্যথা শুধু ফুলমতিকে নিয়া। গোপনে বাল্যবিধবা দিদিটিকে সে পাহারা দিয়া। রাখে। দোস্ত হওয়ার পরও, হুজুরের পোলা হওয়ার পরও দোস্তের দিদি ফুলমতির দিকে নজর আতাহারের। তাদের লগে চব্বিশ ঘণ্টা লেগে থেকে আসলে সে দিদিকে রক্ষা করছে। এই কথা নিখিল আর ফুলমতি ছাড়া কেউ জানে না। জানে না বলেই মা বাসনা আর বাপ রামদাস দিনে চৌদ্দোবার নিখিলকে বকাঝকা করছে, উঠতে বসতে কথা শোনাচ্ছে। যদিও নিখিল বাড়িতে বলতে গেলে থাকেই না। তারপরও যখনই হাতের কাছে পায় তখনই কথা। শুধু ফুলমতি ওইসব সময়ে ভাইটাকে যতটা পারে রক্ষা করে। তার পক্ষ নিয়া কথা বলে। ও তো তোমগো মতন উন্না হইবো না, মাছও ধরবো না, খেতখোলার কামও করবো না। ও করবো অন্যকাম। যাউক না আর কিছুদিন। তারবাদে নিজের গরজেই করবো নে!

বাপ মা আর ছোট দুইভাই এই চারজন মানুষের একটা দল, আরেক দলে ফুলমতি আর নিখিল, এই চলছে রামদাসের সংসারে।

আজ সকালের দিকে বাজারে গিয়েছিল রামদাস। পানের চাঙ্গারি নিয়াই গেছে। পান বেচা ভালই হয়েছে। বিড়া হিসাবে তো আর খোলাবাজারে পান বিক্রি হয় না, হয় গন্ডা হিসাবে। সেই হিসাবে বিক্রি মন্দ না। ওদিকে দুই ভাই সেন্টু-মিন্টু খালে পেনিজাল দিয়া, আর দোয়াইর তো দিন রাতই পাতা থাকে, ঘণ্টায় ঘণ্টায় তুলে ইচা বাইল্লাও পেয়েছে ভালই। সেইগুলি নিয়া দুপুরের ভাত খেয়ে সেন্টু চলে গেছে বাজারে, মিন্টু রামদাসকে নিয়া জুতি টেটা আর কোষানাও নিয়া গেছে চকের দিকে খাজার মাছ মারতে। নিখিল সকালের নাস্তা করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে আর ফিরেই নাই। আতাহারদের লগে আছে। ল্যাংড়া বসির আতাহারের বিয়ার ঘটকালি নিয়া উইঠাপইড়া লাগছে। মোতাহারের বউ পারুল গেছে বাপের বাড়ি। এই ফাঁকে আতাহারের বিয়ার ব্যবস্থা করতে চাইছেন মান্নান মাওলানা।

নিখিলের মুখে সব শোনে ফুলমতি। ওই বাড়ির সব ঘটনা নিখিল তাকে বলে। মোতাহারের বউ পারুর লগে কী সমন্ধ আতাহারের, কী বিত্তান্ত সবই জানে ফুলমতি। পারুর লগেই বিয়া হওয়ার কথা ছিল আতাহারের। অর্থাৎ বড়ভাইয়ের বিধবার লগে। দেওর-ভাবির সম্পর্ক ম্যালা দিনের। এখন লোভে পড়ে অন্যত্র বিয়া করছে আতাহার। ভাবি নাঐর গেছে বাপের বাড়ি আর এই ফাঁকে…। ছি, মানুষ এত বেইমান হয়! নিজের মনের মানুষের লগে বেইমানি!

আজ দুপুরের পর থেকে এরকম নানান পদের ভাবনা ফুলমতির মনে। ভাঙা দরদালানে। নিজেদের কামরার চৌকিতে কাত হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে মা। বাতের ব্যথায় কাতর হয়ে আছে। কয়দিন ধরে। এই অবস্থায়ও শুইলেই ঘুমায়া পড়ে। বাড়ির ছয়জন মানুষের চারজনঐ বাইরে। দুইজন বাড়িতে, তার একজন ঘুমে। ফুলমতি এখন একদম একা। মা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ ছপ বিছিয়ে দরদালানের বারান্দায় বসে ছিল। দেওয়াল ফুটা করে ওঠা বট অশথের চারাগুলি দিন দিন বড় হচ্ছে। ঘর শালিক আর জালালি কবুতর বাসা বানছে কার্নিশের দিককার খুপরিতে। কবুতরগুলির বাকবাকুম এই দুপুরবেলাও কিছুক্ষণ ছিল। এখন নাই। শালিক পাখিগুলি কিচির মিচির করে সন্ধ্যার দিকে। তাদেরও শব্দ নাই এখন। সবকিছু চুপচাপ। আথালে একজোড়া গাইগোরু আর একটা বকনা বাছুর। মুখের সামনে কচুরির বোঝা সকালবেলাই দিয়া রাখছে সেন্টু না মিন্টু, নাকি রামদাস নিজে। বর্ষাকালে সারাদিন ওই খেয়ে কাটায় গোরুগুলি।

বারান্দা থেকে উঠে তুলসী মঞ্চটার সামনে একটু দাঁড়িয়ে ছিল ফুলমতি। তারপর আথালের দিকে একবার তাকিয়ে, গোরুগুলি দেখে পুব-দক্ষিণ দিককার পালানের মুখে আমগাছটার তলায় এসে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনকার মতন আজও তার পরনে সাদা থান। কিশোরী বয়সে বিয়া হয়েছিল। সাত মাস স্বামীর সংসার করেছে, তারপর থেকেই বিধবার জীবন। বিয়ার সময় যতটা সুন্দরী ছিল, বিধবা হওয়ার পর সেই সৌন্দর্য যেন দিন দিন। বাড়ল মেয়েটির। যত দিন গেল, এই বহুকালের পুরানা ধসে পড়া দরদালান আর ঘুপচি অন্ধকার মতন বাড়িটায়, ফুলমতি যখন ঘর থেকে বের হয়, বাড়িটা যেন আলোকিত হয়ে যায়। অন্ধকার রাতে যেন ভরে যায় ফুটফুটা জ্যোৎস্নায়।

আজ এই মন খারাপ করা, বিষণ্ণ মেয়েটির আলোয় সত্যি সত্যি যেন আলোকিত হয়ে আছে পালানের দিকটা। আমগাছের ছায়াময় পরিবেশ যেন ফকফক করছে।

এসময় এল আরতি।

বয়স হয়ে যাচ্ছে, বিয়া হচ্ছিল না, ভারী একটা মনোকষ্টে ছিল মেয়েটি। গরিব নাপিত ঘরের মেয়ে। দেখতেও ভাল না। লম্বা একহারা গড়ন। কালোকোলো গায়ের রং। বেশ রোগা। সীতারামপুরের কারিগরদের বোনা সস্তা শাড়ি পরে থাকে। যুবতী মেয়ে, তবু বুক বোঝা যায় না। চেহারা ভাঙতে শুরু করেছিল। নিজের দিকে ফিরাও তাকাত না আরতি। বিয়ার কথাবার্তা পাকা হওয়ার পর কাঁচা হলুদ বাটা মাখতে শুরু করেছে স্নানের আগে। মাথায় তেলপানি দিচ্ছে। মুখ ফরসা করার ক্রিম কিনে এনেছে মাওয়ার বাজার থেকে। ওসব ব্যবহার করে চেহারা ফিরাবার চেষ্টা করছে। রাতে বোধহয় ঘুমও আজকাল ভাল হচ্ছে। শরীর চেহারা একটু বদলেছে আরতির। মুখে সারাক্ষণই যেন আনন্দমাখা। চলাফেরা হয়ে গেছে পাখির মতন। চঞ্চল, ছটফটা। আজ দেখা গেল নখ পালিশ লাগিয়েছে লাল রঙের। চোখে কাজল, জোড়া বেণি করেছে। কপালে টিপ। দাঁতগুলিও যেন অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশি সাদা। ফুলমতির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আমারে কেমুন লাগতাছে দিদি?

ফুলমতি আরতির দিকে তাকাল। বিষণ্ণমুখ উজ্জ্বল করে হাসল। ভাল লাগতাছে। সোন্দর।

জামাই আমারে পছন্দ করবো না?

করবো না মানি, অবশ্যই করবো। তরে তো আগেঐ পছন্দ করছে। নাইলে বিয়া করতে রাজি অইতোনি?

হেইডা তো ঠিক আছে। তয় দিন দিন আমি যে সোন্দর অওনের চেষ্টা করতাছি, যেদিন তারা আমারে দেইক্কা গেছে, অহন যে হেদিনকার থিকা বেশি সোন্দর আমি, আগনমাসে বিয়া অইবো, ততোদিনে যে আরও সোন্দর অইয়া যামু, বাসররাইত্রে জামাই আমারে দেইক্কা পাগল অইয়া যাইবো না?

ফুলমতি আবার হাসল। হ যাইবো। একদম পাগল অইয়া যাইবো।

তারপর দুষ্টুমি করে বলল, পয়লা রাইত্রেঐ তরে খাইয়া হালাইবো।

আরতি লজ্জা পেল। যা।

সত্যঐ। দেহিচ।

আমি তারে খাইতে দিলে তো।

না দিয়া মনে অয় পারবি না। তর বয়স অইছে না। তুইও চাবি।

ফুলমতির চোখের দিকে তাকাল আরতি। আপনে চাইছিলেন?

ফুলমতি একটু থতমত খেল। তারপর উদাস হল। আমার তো তহন চাওনের বয়স হয় নাই। মাত্র এগারো বছর বয়স আছিল আমার। ওই বয়সে এই হগল বোঝেনি মাইয়ারা?

আইজ কাইলকার মাইয়ারা বোজে।

আমি বুঝি নাই রে দিদি। একদম কিছু বুঝি নাই।

বাসররাইত্রে জামাইবাবু আপনের লগে কিছু করে নাই?

না।

কন কী?

হ। আমি এগারো বচ্ছর বয়সের মাইয়া। এই এতডু। বিয়ার শাড়ি গয়না পইরা পুঁটলি অইয়া গেছিলাম। তার উপরে বিয়ার ধকল। বাসরঘরে জামাইর লেইগা বইয়া থাকতে থাকতে কুনসুম ঘুমাইয়া গেছি, উদিসঐ পাই নাই। চকু মেইলা দেহি বিয়ান অইয়া গেছে। আমার পাশে ধুতি পানজাবি পইরা ঘুমাইতাছে আমার জামাই। মুখটা আমার মিহি, আমার মুখটাও তার মিহি। আমি গুটলি পাকাইয়া (কুকুর কুণ্ডলী) তার বুকের সামনে শুইয়া রইছি।

সে তোমারে রাইত্রে আদর ওদর করছে কি না উদিস পাও নাই?

না। শইল্লে হাত দিলে উদিস পাইতাম। তয় তরে একখান কথা কই, এতদিন আগের কথা তাও আমার কইলাম বেবাক মনে আছে। সে খুব ভাল মানুষ আছিল, ভদ্ৰ আছিল। আমগো জাতের পোলা। সাহা। সাহারা তো হয় কারবারি। কায়কারবার করে। তাগো বাড়ির মাইনষেও করতো। তয় সে আছিল লেখাপড়া জানা মানুষ। মেট্রিক পাশ। ইছাপুরা গেরামে বাড়ি। ইছাপুরা স্কুলে মাস্টারি করত। নাম আছিল অমল সাহা। নামের মতনই পবিত্ৰ আছিল সে, সুন্দর আছিল। কী সুন্দর কইরা কথা কইতো, কী সুন্দর কইরা হাসতো। গলায় মধুমাখা আছিল। ওই বয়সেই, কিছুই বুজতাম না আমি, তয় তারে খুব ভাল লাগতো আমার। আমি ঘুইরা ঘুইরা তারে দেখতাম। সে যহন স্কুলে থাকতো, আমার ভাল্লাগতো না। আমি তার লেইগা ছটফট করতাম। বিকালে সে বাড়িতে আসলে আমার মন ভাল অইয়া যাইতো।

ফুলমতি আরতির দিকে তাকাল। আইজকাইল তো ধর্মের বিধান সহাজে কেঐ মানতে চায় না। আগের দিনের মাইনষে মানতো। বাসর রাইত্রে বা বিয়ার রাইত্রে তো বউর শরিলে হাত দিতোই না জামাইরা। পরের রাইত তো কালরাইত। সূর্য অস্ত যাওনের পর থিকাই দুইজন দুইদিকে। জামাই দেখতে পারবো না বউর মুখ, বউ দেখতে পারবো না জামাইর। মুখ। দুইজন দুইঘরে। তৃতীয় রাইত হইতাছে ফুলশয্যা। আদর সোহাগের রাইত, প্রেম ভালবাসার রাইত। আমার বর বেবাক নিয়ম কানুন মাইনা চলছিল। লোভীলোক আছিল না, ভাল লোক আছিল।

আবার উদাস হল ফুলমতি। ফেলে আসা সেই জীবনের কথা একের পর এক মনে পড়ল তার। মানুষটার ছবি এতদিনেও ম্লান হয়নি চোখে। এখনও চোখের ভিতর রয়ে গেছে তার হাসিমাখা মুখখানি। শরতের আকাশের দিকে তাকিয়ে সেই মুখ দেখতে লাগল সে।

আরতি বলল, আপনের কথা শুইনা আমার আইজ বহুত ভাল লাগল দিদি। আমি আইজকাইলকার মাইয়াগো লাহান করুম না। জামাইরে কমু, আমি ধর্মের বিধান মাইন্না চলুম। বাসর রাইত মানুম, বেহুলার মতন। কালরাইত মানুম। তারবাদে ফুলশয্যা। পূজাআর্চা করুম, শাখে ফুঁ দিমু, ধূপ দিমু বাড়িতে। গোবর দিয়া উঠান লেপুম, তুলসীতলাটা লেইপ্পা পুইচ্ছা ঠিক রাখুম। জামাইবাড়িতে জবা ফুলের গাছ লাগামু, বেলি গন্ধরাজ গেন্দা, সব পূজার ফুল রাখুম। আমি আমার জামাইরে লইয়া সুন্দর একখান জীবন কাটামু। গরিব সংসারও সুখের করুম।

ফুলমতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমিও তাই চাইছিলাম রে আরতি। ওই বয়সেই জামাই, দেওর ননদ শ্বশুর শাশুড়ি বেবাকতেরে লইয়া ধীরে ধীরে সুন্দর একখান জীবন তৈরি করতে চাইছিলাম। ভগবান আমার কপালে সুখ দিল না। মাত্র সাতমাস, তহনও আমার বারো বচ্ছর পুরা অয় নাই, বিধবা অইয়া গেলাম। ব্লাড়ি অইয়া গেলাম। কপালের সিন্দুর মুইচ্ছা গেল আমার। সাদা থান ফিনদা বাপের বাড়িতে ফিরত আইলাম।

আরতি দুঃখী গলায় বলল, ওই রকম তরতাজা মানুষটা কেমনে মরলো দিদি?

আর কইছ না। কপাল, কপালের দোষ। স্কুল থিকা ফিরছে। বাইষ্যাকাল। শাওনমাস। এমুন বিষ্টি নামছে। বিয়ালেই আন্ধার হইয়া গেছে চাইরদিক। রান্ধনঘরে আমার হরি রানতে বইছে। গোয়ালঘরের একপাশে আরেকখান খোলা ঘর। উপরে টিনের চাল, চাইরমিহি খোলা। লাকড়ি খড়ি রাখে ওই ঘরে, ঘহি (ঘঁটে) রাখে। সে বাড়িতে আসতে আসতে বিষ্টিতে ভিজ্জা চুইঙ্গা গেছে। আমার হরি কইলো, বাবা অমল, ভিজছস যহন, তহন একহান। কাম কর। বিষ্টির হ্যাঁচলায় (ছাটে) ওই ঘরের লাকড়ি খড়ি ভিজতাছে। লাকড়ি খড়িডি ইট্টু ঘরডার মাঝখানে আইন্না রাখ, ঘহি আছে গোড়ায়। গোড়াড়ি সরাইয়া রাখ। সে গেছে ওই কাম করতে। লাকড়ি খড়ির ভিতরে বিষ্টি দেইক্কা যে একখান কালজাইত অইয়া হাইন্দা রইছে, কে জানে! হেই সাপে তারে দংশাইলো। ডাইন হাতের রগের মইদ্যে দিছে ঠোকর। হেয় একখান চিইইর দিয়া উডানে পড়ল। বিষ্টির মইদ্যেই বাড়ির বেবাকতে দৌড়াইয়া নামলো উডানে। হেয় তহন চিত অইয়া পইড়া রইছে উডানে, মুখ দিয়া ছেবড়ি (ফেনা)। উঠতাছে। ওঝামোঝ ডাকনের আগেঐ শ্যাষ। শাওনমাসের বিষ্টিতে ধুইয়া গেল আমার কপালের সিন্দুর, জীবনের বেবাক স্বপ্ন!

একটু থামল ফুলমতি। আমার শ্বশুরবাড়ির মানুষজন মন্দ আছিল না। তারা চাইছিল আমি ওই বাইত্তেঐ থাইক্কা যাই। আমি থাকি নাই খালি একজন মাইনষের লেইগা। আমার শাশুড়ি। সে আমারে ভালই জানতো। বিয়ার সাতমাসের মাথায় পোলা মরল সাপের কামড়ে, হেয় তারপর থিকা আমারে দেখতে পারতো না। উঠতে বসতে খালি কথা হুনাইতো। পোড়াকপালি মাগি, ভাতারখাগি মাগি। অপায়া। সাত মাসও আমার পোলাডারে বাঁচতে দিলি না। সাপে তো আমার পোলারে খায় না, খাইছে ওই মাগি। পোলা মরণে তার মাথাডা বিগড়াইয়া গেছিল। এর লেইগা ওই বাইত্তে আমি আর থাকি নাই। বেবাক হুইন্না মা-বাপে আমারে লইয়াইলো। তারবাদে তাগো লগে আমার আর কোনও সম্পর্ক নাই। ওই বাড়ির কেউ কোনওদিন আমার খোঁজখবর লইতে আহে নাই। আমগো এই দিককার কেউও আর কোনওদিন যায় না। মানুষটা মরল, বেবাক কিছু শেষ অইয়া গেল!

ফুলমতি আবার উদাস হল আর আরতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

ফুলমতি তারপর বিষণ্ণ গলায় বলল, আমার জীবনডা এমতেই যাইবো এই বাড়িতে। এই বাড়ির বাইরে আমার আর কোনও জীবন নাই। দিন যাইবো, মা-বাপে মরবো। ভাইরা বিয়া কইরা বউ আনবো বাড়িতে। তাগো গঞ্জনা শুনুম। তিন ভাইয়ের পোলাপান হইবো, তাগো পোলাপান লালন পালন করুম। পোলাপানের গু-মুতের কথা কাপড় ধুমু। রাইন্দা বাইড়া খাওয়ামু বাড়ির মানুষরে। পূজা পার্বণে ভাইরা একজোড়া থান দিবো, ওই থান পইরা বচ্ছর যাইবো। বচ্ছরের পর বচ্ছর যাইবো। মাঝ বয়স, বুড়া বয়সে এই বাড়ির পুরানা দালানের মতন ঝুরঝুর কইরা শরিল থিকা খইসা যাইবো সইনদর্য। চামড়া কুঁচকাইবো, চুল পাকবো, দাঁত পড়বো। অসুক বিসুকে ধরবো। কেউ আমার মিহি ফিরাও চাইবো না। তারবাদে একদিন চিতায় উডুম। বাড়ির মাইনষে হাঁপ ছাইড়া বাঁচবো। যা, একটা ভেজাল আছিল সংসারে, হেইডা গেছে।

ফুলমতি আরতির দিকে তাকাল। আরতি রে, দিদি, এই হইল আমার জীবন। রাইত্রে শুইয়া শুইয়া ভগবানরে আমি কই, ভগবান, আমার জীবন তুমি এমুন করলা ক্যান? আমি কী পাপ করছিলাম ভগবান? সুন্দর মাইয়া হিসাবে দুনিয়ায় পাডাইলা তারবাদে জীবনডা কইরা দিলা অসুন্দর। আলোর জীবন কইরা দিলা আন্ধার। ক্যান ভগবান, ক্যান! আবার যুদি কোনওদিন এই জগতে আমারে তুমি পাডাও তয় আর মাইয়া মাইনষের জীবন দিয়ো না ভগবান। পুরুষের জীবন দিয়ো। পুরুষের জীবন হইলে এইরকম খাঁচার জীবন আমার হইতো না। বউ মরলে আবার বিয়া করতাম, নতুন কইরা সংসার শুরু করতাম। আর সংসার না করলে যেই মিহি দুইচক্ষু যায় হেই মিহি চইলা যাইতাম। কেঐ তো আর আমারে আটকাইয়া রাখতে পারতো না। পুরুষপোলার জীবন পাখির জীবন, স্বাধীন জীবন। মাইয়া মাইনষের জীবন জেলখানার জীবন। এমুন এক জেলখানা, মরণ ছাড়া হেই জেলখানা থিকা ছাড়া পাওয়া যায় না। আমগো মতন গরিব হিন্দুবাড়ির বিধবা মাইয়ারা অইলো যাবজ্জীবনের আসামি। তাগো জীবন কাডে এমুন এক জেলখানায় যেই জেলখানার মোটা মোটা লোহার গারদ (গরাদ) বাইরে থিকা দেহা যায় না। ওই গারদ ভাইঙ্গা বাইর অওন যায় না। মরণ, খালি মরণই পারে ওই গারদ ভাঙতে। এর লেইগা বহুত বিধবা হিন্দু মাইয়া আত্মহত্যা করে। জেলখানার জীবন সইজ্য করতে পারে না।

একটু থেমে আরতির চোখের দিকে তাকিয়ে ফুলমতি বলল, আমি আশিববাদ করি, ভগবান তরে য্যান সুখী করে আরতি। জামাই লইয়া, সংসার লইয়া তুই য্যান তর জামাইর আগে হইলোক ত্যাগ করতে পারছ। বিধবার জীবন য্যান কোনওদিনও তর না হয়।

কথা বলতে বলতে গলা ধরে এল ফুলমতির। চোখ ছলছল করে উঠল।

এত সুখ আনন্দের মধ্যেও ফুলমতির জন্য আজ এত কষ্ট হল আরতির। হঠাৎ করে শিশুর মতন দুইহাতে ফুলমতিকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে লাগল সে।

.

পৌষমাসের পয়লা তারিখেই মসজিদের কাজ শুরু হল।

এনামুল যেভাবে যা বলেছিল সেইভাবেই কাজে নামল মোতালেব আর মান্নান মাওলানা। ছাড়াবাড়ির পশ্চিমদিককার গাড় (ডোবা) কেটে মাটি তুলতে লাগল একুশজন মাটিয়াল। হজরতদের বাড়ি ছাড়িয়ে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের মাটি ফেলার কাজ বাকি ছিল মাওয়া ফেরিঘাট তরি। আলী আমজাদ যে কাজ শেষ করতে না পেরে কেস খেয়েছে, কেস খেয়ে পলাতক, সেই কাজও চলছে ধুমছে। মাটির কাজ এবার আর সাবকন্টাক দেন নাই আসলাম কন্ট্রাক্টর। নিজের একজন ম্যানেজার আর শ-তিনেক মাটিয়াল, মাটিয়ালদের ছয়জন সর্দার, অর্থাৎ প্রতি পঞ্চাশজনে একজন সর্দার দিয়া কাজ শুরু করে দিয়েছেন। দিনরাত চব্বিশঘণ্টা কাজ চলছে। এক-দেড়মাসের মধ্যে মাওয়া ফেরিঘাট তরি মাটি ফেলার কাজ শেষ হবে। তারপর ইট বিছানোর কাজ, তারপর কার্পেটিং। হয়ে গেল ঢাকা-মাওয়া সড়ক, ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের মূলকাজ। পদ্মার ওপার থেকে কাজ করছে অন্য কন্ট্রাক্টর। সেই কাজও চলছে একই কায়দায়। দিনরাত।

আসলাম কন্ট্রাক্টরের মাটিয়ালদের ওখান থেকে একুশজনকে ভাগিয়েছে মোতালেব। সড়কের কাজে রোজ যা পায় তার থেকে দশটাকা করে বেশি দিয়া একুশজন জোগাড় করেছে। বুদ্ধিটা এনামুলেরই। কয়েকদিন আগে বাড়িতে আসছিল সে। পৌষমাসের পয়লা তারিখে কাজ শুরু করবে। মোতালেব বলল, সবঐ ঠিক আছে মামু, তয় মাইট্টাল তো পাই না। দেশের বেবাক মাইট্টাল সড়কের কামে লাইগ্যা গেছে।

এনামুল গম্ভীর গলায় বলল, আমগো কাম তো কোনও কামই না। গড় কাইট্টা চাইর পাঁচদিন মাডি উড়াইলে ছাড়াবাড়ির ভাঙ্গন ভইরা যাইবো। মাইট্টালও বেশি লাগবো না। বিশ-পঁচিশজন অইলেই অয়। নাকি?

হ তার বেশি লাগবো না।

মান্নান মাওলানা ছিলেন লগে। বললেন, মজজিদের আসল জাগা তো ঠিক আছে। ছাড়াবাড়ির যেই জাগা তুমি মজজিদের লেইগা দেহাই দিছো ওই জাগায় তো মাডি হালান লাগবো না। ওই জাগায় গদমদ (গর্তটত) কইরা ঢালাই গাঁথনির কাজ হইবো।

হ আমার ইঞ্জিনিয়ার শামিম আইসা দেহাই দিবো। মজজিদের নকশা মকশা তো রেডিঐ। শামিম আইয়া কাদির মিস্তিরিরে বেবাক বুঝাইয়া দিবো। তারবাদে আর কোনও ঝামেলাঐ নাই। জাহিদ খাঁ-র বাড়ির ওই তরি টেরাক আইবো। পয়লাদিন আইবো বাঁশ কাঠ টিন, পানি রাখনের ডেরাম এইসব। তারবাদে আইবো ইট রড সিমিট। মিস্তিরিগো থাকনের লেইগা লাম্বা টেমপরালি একখান ঘর উঠান লাগবো। আমার দিক থিকা বেবাক রেডি। অহন কইতাছেন মাইট্টাল পাওয়া যাইতাছে না।

মোতালেব কাচুমাচু গলায় বলল, কী করুম কও মামু?

মাইট্রাল জোগাড় করেন।

মান্নান মাওলানা রাগী গলায় বললেন, এই ভেজালডা লাগাইছে ওই শুয়োরের পোয়। আলী আমজাদ। শালার পো শালায় কাম লইছে, কাম শেষ করে নাই। ক্যা রে বান্দির বাচ্চা, যেই কাম শেষ করতে পারবি না হেই কাম লচ ক্যা? অহন যে কেস খাইছস, পলাইছস। ধরা পড়লে যে জেলে যাবি? সরকারের কাম লইয়া চুদুরবুদুর করো? এতবড় সাহস তোমার?

এনামুল বিরক্ত হল। ওই হগল লইয়া আমগো চিন্তার কাম নাই মাওলানা সাব। আমরা আমগো কাম কেমতে করুম ওইডা কন।

মান্নান মাওলানা কাতর হলেন। আমরা কী কমু বাজান। তুমি কও।

মোতালেবের দিকে তাকাল এনামুল। এককাম করেন মামু, খবর লন সড়কের কামে মাইট্টালেরা রোজ পায় কত?

মোতালেব উৎসাহী গলায় বলল, আইচ্ছা লইলাম। তার বাদে?

তার বাদে কী করবেন বোজেন নাই?

মোতালেব মাথা নেড়ে বলল, বুজছি। তাও তুমি কও মামু।

সড়কের কামে রোজ যা পায় তার থিকা দশটেকা কইরা রোজ বেশি দিয়া মাইট্টাল ভাগাইয়া আনেন। চাইর-পাঁচদিনে আমার যুদি দুই-চাইর হাজার টেকা বেশি যায় যাইবো, কাম আমি পয়লা তারিখেই শুরু করুম। চল্লিশ দিনে শেষ করুম।

মোতালেব তারপর একটা লাফ দিল। আমিও এইডাই তোমারে কইতে চাইছিলাম। পয়সা বেশি দিলে মাইট্টাল আমি ঠিক ঐ ভাগাইয়া আনতে পারুম।

আনেন। যেই কয়জন লাগে আনেন।

মান্নান মাওলানা বললেন, বিশ-পঁচিশজনের বেশি লাগবো না।

মোতালেব ঠিকই একুশজন ভাগায়া আনল। ডহুরি-নওপাড়ার ওদিককার একটা দল। ঠাকুরবাড়ির বাঁশঝাড়তলার ওদিকটায় ছাপরা করে থাকে। রোজ দশটাকা বেশি পাওয়ার লোভে তারা আসছে। এই কাজ শেষ করে আবার যাবে সড়কের কাজে। গেলে যে সড়কের কাজ পাবে না সেই ভয় নাই। কারণ এখন আর কন্ট্রাক্টর সাহেবরা চোখে মুখে পথ দেখছেন। না। লোক যত পাবেন নিবেন। কে কয়দিন অন্য জায়গায় বেশি পয়সার লোভে কাজ করে এল, তাদের না নিয়া শাস্তি দেওয়া উচিত, ওইসব উচিত অনুচিত ভাববার সময় তাদের নাই।

এই পদ্ধতিতে মোতালেব চাইলে আরও মাটিয়াল ভাগাতে পারত। তার তো দরকার নাই। যেই কয়জন পাওয়া গেছে তাতেই চার থেকে পাঁচদিন, মসজিদ বাড়ির মাটি তোলার কাজ শেষ।

বেশ সকাল থেকেই আজ কাজ শুরু হয়েছে। পৌষমাসের শীত এমন পড়া পড়ছে এবার, হাড্ডির ভিতরকার মজ্জা তরি শিরশির করে। বেশিরভাগ মাটিয়ালের পরনে লুঙ্গি। লুঙ্গি কাছা মেরে, মাজায় গামছা বেঁধেছে আইট (আঁট) করে। শীত আসার আগে আগেই গ্রামের হাট বাজারে পুরানা শীতের কাপড় ওঠে সস্তায়। মোটা সোয়েটার, হাতাঅলা মোটা গেঞ্জি, উলের কোট, মাফলার টুপি। পায়ের মোজা তো পাওয়া যায়ই, শীত একদম সহ্য করতে না পারা মানুষদের জন্য হাতমোজাও পাওয়া যায়। কানটুপি পরেন মান্নান মাওলানা। মাত্র গজিয়েছে এমন নরম, গাঢ় খয়েরি রঙের গাবপাতা রঙের একখান কানটুপি আজ পরে আছেন মান্নান মাওলানা।

মাটিয়ালরা কাছামারা লুঙ্গির উপর কেউ কেউ পরেছে সোয়েটার আর নইলে মোটা হাতাআলা গেঞ্জি। দুইজনে কোটও পরছে। নীচের দিক খালি, উপর দিক কাপড় চোপড়ে ঢাকা। গলায় মাফলারও আছে দুই-তিনজনের। অল্পবয়েসি চার-পাঁচজন আছে, তারা পরেছে প্যান্ট। সাহেবদের ফেলে দেওয়া শীতের কাপড়চোপড় যা এদেশে আসে, ঢাকার সদরঘাটে ওরকম পুরানো কাপড়ের বিরাট মার্কেট। সেই মার্কেট থেকে সাপ্লাই দেয় সারা দেশে। দেশগ্রামের হাটবাজার থেকে গরিব মানুষরা শীত নিরাময়ের জন্য কিনে। মোতালেবের কয়েকজন মাটিয়াল ওরকম ফুলপ্যান্ট হাফপ্যান্ট পরেছে। মাটিমুটি মেখে ময়লা হচ্ছে গায়ের কাপড়, কে খেয়াল করে ওইসব, শীত মানলেই হইল?

একজন মাটিয়াল আবার এমন একটা প্যান্ট পরেছে সেটা না ফুলপ্যান্ট না হাফপ্যান্ট। মাজা থেকে হাঁটুর নীচ তরি নামছে। মাজায় পায়জামার মোটা ফিতার মতন ফিতা দিয়া গিঠটু দিয়া রাখছে। উপরে কালো সোয়েটার। কয়েকজন মাটিয়াল কোদালের কোপে কোপে নরম মাটি কেটে গোড়ায় ভরছে, ভরে তুলে দিচ্ছে অন্য মাটিয়ালের মাথায়। তারা সার ধরে উঠছে মসজিদ বাড়িতে। মোতালেব আর মান্নান মাওলানা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে কোনদিকে ফেলবে মাটি। কোনদিক ভরাট করে তারপর ফেলবে কোনদিক।

দুধের পুরো সরের মতন পড়ে আছে কুয়াশা। বেলা কিছুটা হয়েছে তবু সূর্যের দেখা নাই। ফজরের নামাজ শেষ করেই মসজিদ বাড়িতে চলে আসছেন মান্নান মাওলানা। তাঁর পরনে কানটুপি, গলায় প্যাচানো সবুজ মাফলার। আজ আর লুঙ্গি পরেন নাই তিনি। সাদা পায়জামা পরেছেন। পায়ে মোটা উলের মোজা আর কালো পুরানা পামশু। খয়েরি ফ্লানেলের পাঞ্জাবির তলায় প্রথমে আছে ফুলহাতা একটা গেঞ্জি। গেঞ্জির ওপর হাফহাতা সোয়েটার তার ওপর পাঞ্জাবি, পাঞ্জাবির ওপর ঘিয়া রঙের আলোয়ান। মান্নান মাওলানার দিকে তাকালেই বোঝা যায়, শীতের বাবার সাধ্য নাই এই জিনিসকে কাবু করে।

মোতালেবের অবস্থাও প্রায় মান্নান মাওলানার মতনই। সে পরেছে খাকি রঙের ফুলপ্যান্ট। পায়ে সস্তা ধরনের কালো কেডস, মোটা মোজা। হলুদ রঙের ফুলহাতা শার্টের তলায় গেঞ্জি আছে। শার্টের উপরে আছে হাফহাতা সোয়েটার তার উপর কালো একখান কোট। গলায় মাফলার আর মাথায় বান্দরটুপি (মাঙ্কিক্যাপ)। এই টুপিটা বহুদিন ধরে ঘরে পড়ে আছে। এইবার ব্যবহারের একটা সুযোগ পেয়েছে মোতালেব।

মসজিদের কাজ শুরু করতে পেরে মান্নান মাওলানা আর মোতালেব খুবই খুশি। দশটাকা বেশি রোজে মাটিয়াল জোগাড় করাটাকে বিরাট গৌরব হিসাবে নিয়েছে মোতালেব। এখন। মসজিদ বাড়ির তেঁতুলগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে আছে সে আর মান্নান মাওলানা। মাটিয়ালরা তাদের মতন কাজ করছে। মান্নান মাওলানার দিকে তাকিয়ে মোতালেব বলল, আমার ভাইগনায় বিরাট চালাক মানুষ হুজুর। ঠিক আমার মতন। আমিও ভাবতাছিলাম কহেকটা টেকা বেশি রোজ দিয়া মাইট্টাল আনুম। ভাইগনায় আইয়া ঠিক ওই কথাড়াই কইলো।

মান্নান মাওলানা চালাকির হাসি হাসলেন। তোমার ভাইগনা না মিয়া! চালাক না অইয়া পারেনি!

খোঁচাটা মোতালেব টের পেল। পেয়ে অন্য দিক দিয়া মান্নান মাওলানাকে খোঁচাটা ফিরিয়ে দেওয়ার পথ ধরল। ও আইচ্ছা, আপনেরে তো জিগাইতে ভুইল্লা যাই হুজুর। আতাহারের বিয়ার কী করলেন? ঘটকায় অহনতরি বিয়া ঠিক করতে পারে নাই?

পারছে।

কন কী?

হ। গাউদ্দার বহুত বড়ঘরের মাইয়া।

ও হেই কথা তো জানিঐ। তয় ওহেনেই ঠিক অইলো?

হ। আমরা যেমুন মাইয়া পছন্দ করছি, তারাও আতাহাররে বহুত পছন্দ করছে।

আতাহাররে না পছন্দ করনের কথা না। আপনের পোলা তো দেখতে মাশাল্লা! তয় দিবো কী?

বেবাকঐ দিবো। পোলার সংসার সাজাইয়া দিবো। নগদ টেকা দিবো চাইরলাখ।

মাশাল্লা মাশাল্লা। বিয়া কবে?

এই মাসেই করাইতে চাইছিলাম। পিছাইছে।

ক্যা?

এনামুল সাবে কইলো চল্লিশ দিনের মইদ্যে মজজিদের কাম শেষ করবো। মাঘমাসের দশ তারিখে মজজিদের কাম শেষ অইবো দেইক্কা আমি আতাহারের বিয়ার দিন তারিখ করছি ফাল্গুন মাসের সতেরো তারিখ। শুককুরবাইরা দিন।

এইডা ভাল করছেন। হ মজজিদের কাম শেষ কইরাঐ পোলার বিয়া দেন। পর পর দুইখান বড় কাম অইয়া গেল আপনের জীবনের। তয় এই মাসেও বিয়া করাইতে পারতেন। আতাহারের।

মান্নান মাওলানা মোতালেবের মুখের দিকে তাকালেন। কেমতে? বিয়ার কাম কি য্যানত্যান। পোলার বিয়ার কাম লইয়া থাকলে মজজিদের কাম দেখবো কে?

ক্যা আমি দেহুম?

মান্নান মাওলানা একটু থতমত খেলেন। না না ওইডা তো তুমি দেখবাঐ। তারবাদেও আমার থাকন দরকার আছে না! আমি না থাকলে এনামুল সাবে কইবো, আপনের লেইগা গেরামে মজজিদ বানাইতাছি আমি, আর আপনে হেই মজজিদের কাম হালাইয়া পোলার বিয়া করাইতাছেন।

মোতালেব মাথা নাড়ল। হ লেইজ্য কথা।

এর লেইগাই বিয়া পিছাইলাম।

এবার আসল খোঁচাটা মোতালেব মারল। তয় চাইর লাখ টেকার লেইগা কামডা আপনে করলেও পারতেন।

মান্নান মাওলানা অবাক। কোন কামডা?

ওই আর কী! বড়পোলার বউর বিষয়ডা…

মান্নান মাওলানা দমে গেলেন। গম্ভীর মুখে বললেন, বড়পোলার বউ তো মিয়া বাপের বাড়ি গেছে গা।

হেইডা তো জানি। আর এই ফাঁকেঐ আপনে আতাহাররে বিয়া করাইতাছেন!

আরে না মিয়া। কোনও ফাঁকফোকের আমার দরকার নাই। আমি আর আতাহারের মায় চিন্তা করছিলাম মোতাহারের বউর লগেঐ আতাহারের বিয়া পড়াইয়া দেই। বউ রাজি অইলো না।

কন কী?

হ।

আতাহার রাজি অইছিলো?

হ মিয়া। আমগো দিক থিকা কোনও অসুবিদা আছিল না। বউঐ রাজি হইল না। পোলাপান লইয়া বাপের বাড়ি গেল গা। অহন থিকা ওই বাড়িতেই থাকবো। তয় খরচাপাতি আমিঐ দিমু। মোতাহারের ভাগের জাগাসম্পত্তির দাম ধইরা টেকাপয়সাও দিয়া দিমু। যুদি টেকা অরা নিতে চায়। আর যুদি না নিতে চায় তয় ভাগের জাগা সম্পত্তিঐ মোতাহারের পোলাপানরা বড় অইয়া, সাবালক অইয়া যার যার ভাগেরটা নিবো। আমি কেঐরে ঠকামু না। যার যা পাওনা বুঝাইয়া দিমু। আমি হইলাম মিয়া আল্লার খাসবান্দা। আমি নিজের নাতি নাতকুড়রে, পোলার বউরে ঠকামুনি।

মোতালেব মনে মনে বলল, তরে আমি চিনি না শালার পো শালা। তুই দিবি জাগা সম্পত্তি বুঝাইয়া? সড়ক অইছে দেইক্কা এই এলাকার জাগাজমিনের দাম বহুত বাইড়া গেছে। হেই জমিন তুই দিবি নাতি নাতকুড়রে, পোলার বিধবা বউরে? কোন প্যাঁচ খাড়াইয়া বউডারে বাড়ি থিকা খেদাইছস কে জানে। আতাহারের বিয়ার রাস্তা কিলিয়ার করছস। তুই যেমুন শয়তান তোর পোলা তর থিকাও বড় শয়তান। দুইজনে মিলাঐ বউডারে বাইত থিকা খেদাইছস।

এই খোঁচাটাই মান্নান মাওলানাকে মারল মোতালেব। খুবই বিনয়ের গলায় বলল, হোনা কথার কোনও দাম নাই হুজুর। হোনা কথায় আমি কানও দেই না। তাও কথাডা আপনেরে আমার কওন উচিত। আমার কানে আইছে আপনেরা বলে বাপপুতে মিলা বড়পোলার বউরে বাড়িত থিকা খেদাইছেন। এমুন ষড়যন্ত্র করছেন, বউডা পোলাপান লইয়া চইলা যাইতে বাইধ্য হইছে।

মান্নান মাওলানা চমকালেন। কও কী মিয়া? হ। এই হগল কথা তো দেশগেরামে হইতাছে। আমার কানে আইছে। আমি তো হুনি নাই? আপনেরে ডরে কেঐ কয় নাই। আমি কইলাম এর লেইগা যে আপনে আর আমি মিলা মজজিদ বানাইতাছি। দুইজনের পেডের কথা দুইজনের জানন উচিত। না কী কন?

মান্নান মাওলানা কোনও কথা বললেন না।

চুপ করে রইলেন। মোতালেব মনে মনে বলল, কী রে শালার পো শালা অহন কথা কচ না ক্যা? ভাইগনারে লইয়া আমারে যে খোঁচাইলি, অহন উলটা খোঁচা খাইয়া কেমুন লাগতাছে?

তারপর আরেক লাইনে গেল মোতালেব। যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমন গলায় বলল, অনেকদিন ধইরা ভাবতাছি একখান কথা জিগামু আপনেরে, ভুইল্লা যাই।

কী?

মাকুন্দার কথা।

মান্নান মাওলানা তাকিয়ে ছিলেন মাটিয়ালদের দিকে। কীভাবে মাটি কাটছে তারা, কীভাবে মোড়া ভরে তুলে এনে জায়গা মতন ফেলছে, কীভাবে বদলাচ্ছে ছাড়াবাড়িরটার এতদিনকার পুরানা চেহারা। ভিতরে ভিতরে বিরক্তও হয়ে আছেন মোতালেবের উপর। চুতমারানির পোয় এত প্যাচাইল পারতাছে ক্যা? আমার পোলা, পোলার বউ এই হগল লইয়া অর এত চিন্তা ক্যা?

তবে মুখে এই বিরক্তির ছায়া পড়তে দেয় নাই। মোতালেব হচ্ছে এনামুলের মামা। আপন মামা না হোক, মা’র চাচাতো ভাই, আপনই। তাকে আবার মাটির কাজ দিয়েছে। এনামুল। ভাবচক্করে মনে হচ্ছে মসজিদের পুরা কাজের মধ্যেই তাকে রাখবে এনামুল। শুধু মান্নান মাওলানার হাতে ছেড়ে দিবে না। এই অবস্থায় মোতালেবের লগে রাগ বিরক্ত দেখানো ঠিক হবে না। অর লগে ভাও দিয়া চলনঐ ভাল। বললেন, ওই চোরার আবার কী কথা?

আছে কই?

ক্যা জেলে। মুনশিগুইঞ্জের জেলে।

কতদিনের জেল অইছে কিছু জানেননি?

না রে মিয়া, ওই হগল চোরমোর লইয়া চিন্তা করনের টাইম কো?

মোতালেব ঠোঁট টিপা হাসল। সেই হাসিটা খেয়াল করলেন মান্নান মাওলানা। হাসো ক্যা মিয়া?

হাসনের তেমুন কোনও কারণ নাই।

তয়?

ঘটনা অইলো কী হুজুর, মাকুন্দারে লইয়াও কথা হয় দেশগেরামে। মাইনষে কয় মাকুন্দারে আপনে চোর সাজাইয়া জেলে দিছেন মাকুন্দা ছনুবুড়ির জানাজা পড়তে গেছিল দেইক্কা। ভিতরে ভিতরে আপনের হুজুর বদলাম অনেক। শেষ বদলামখান অইছে। বড়পোলার বউরে লইয়া। আমি এই হগল কথা আইজ উডাইলাম এর লেইগা যে আপনে আর আমি একলগে মজজিদের কাম কাইজ করুম, আপনের বদলাম আমার বদলাম। গেরামের নতুন মজজিদের ইমাম অইবেন আপনে, আপনের তো বদলাম থাকন উচিত না। আপনে আল্লার খাসবান্দা। আপনের বদলাম থাকবো ক্যা?

মান্নান মাওলানা বিষণ্ণ হয়েছেন। অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, যে যত ভাল মানুষ তার ততো বদলাম রে দাদা। আমার হোগার পিছে লাইগ্যা থাকনের মানুষ তো দেশ গেরামে কম নাই। তারা এই হগল বদলাম করে। এই হগল কথায় তুমি মিয়া কান দিয়ে না। তোমারে আমি অহন সোজা একখান কথা কই, ভাইগনায় তো তোমারে খালি মাডি উডানের কাম দিছিল আর মজজিদের বাকি কাম অইলো আমার। আমি তোমারে কইতাছি, তুমি খালি মাডির কামে না, মজজিদের বেবাক কামেঐ আমার লগে থাকবা। আমারে আঠরো শো টেকা বেতন দিবো তোমার ভাইগনায়, তারে আমি কমু নে তোমারে আমি আমার লগে রাখতে চাই।

মোতালেব হাসল। ওইডা আপনের আর কওন লাগবো না হুজুর। ওইডা ফাইনাল অইয়া গেছে।

মান্নান মাওলানা চমকালেন। কী ফাইনাল অইয়া গেছে?

আইজ থিকা আপনের যেমুন বেতন অইছে আঠরো শো টেকা আমারও বেতন ঠিক কইরা দিয়া গেছে ভাইগনায়।

সত্যঐ?

হ।

কত ঠিক করছে?

বারো শো। আপনের আঠরো শো আর আমার বারো শো, মোট তিনহাজার টেকা মাসে মজজিদের লেইগা ভাইগনায় খরচা করবো।

তয় তো মিয়া বিরাট লাভ হইল তোমার। মজজিদ দেখভাল করবা হেই কামের লেইগাও বেতন।

কারণ আছে হুজুর। ওই যে কইছিলাম মজজিদের কামে এক পয়সাও এদিক ওদিক করুম না আমি। আল্লার ঘরের কাম কইরা টেকা খামু না। এর লেইগা ভাইগনায় আমারে পাকাপাকি বন্দোবস্ত কইরা দিছে।

এই ব্যবস্থা তেমন ভাল লাগল না মান্নান মাওলানার। সে অন্যমনস্ক হয়ে রইল। মোতালেব তখন ভিতরে ভিতরে উৎফুল্ল। মনে মনে বলল, কী রে শালার পো শালা, কেমুন সাইজ করলাম তরে? এই সাইজের কারণ কী জানচ, আমার লগে যাতে বড়কথা। কইতে না পারচ। আমার লগে যাতে মাতবরি করতে না পারচ। হোন অহন শেষ বাড়ি তরে দেই।

হাসিহাসি মুখে মোতালেব বলল, তয় হুজুর এই কামডা আপনে ভাল করেন নাই।

মান্নান মাওলানা আবার চমকালেন। কোনডা?

ওই যে গাছির মাইয়ার কামডা?অতডুমাইয়াডারে আপনেবিয়ার পোরোসতাব পাডাইছেন। কীর লেইগা পাডাইছেন, কী উদ্দেশ্য আপনের হেইডা কইলাম দেশগেরামের বেবাকতে বুজছে। আপনে কইলাম ধরা খাইছেন। মাকুন্দার লেইগা ক্যান নূরজাহান আপনেরে ছ্যাপ দিছিল হেইডা যেমুন দেশগেরামের বেবাকতে বুজছিল, এইডাও বেবাকতে বুজছে।

মান্নান মাওলানা হঠাৎ রেগে গেলেন। থোও মিয়া এই হগল প্যাচাইল। বুজলে আমার বাল হালানি যায়! আইজ মজজিদের কাম শুরু করছি আইজ এই হগল প্যাচাইল আর পাইড়ো না।

তারপর নরম হলেন মান্নান মাওলানা। লও দুই ভাইয়ে মিল্লা কামডা ভাল মতন শেষ করি। তারবাদে আমি মজজিদে ইমামতি করুম, তুমি থাকবা আমার লগে লগে। পাঁচওক্ত নমজ পড়বা। দেশগেরামের মুসল্লিরা তোমারে খাতির করবো। আমগো এই দিককার বিচার সালিশ শরিয়ত মোতাবেক বেবাক করুম তুমি আর আমি। মাতবরি থাকবো আমগো দুইজনের হাতে। তুমি যে আমারে এই হগল কথা কইলা, আমিও তো তোমার নামে কত কথা হুনি। ছুনিবুড়ির কাফোনের কাপড় থিকাও বলে তুমি চুরি করছে। আরও কতপদের কথা মাইনষে কয়। এই হগলে কান দিলে মিয়া জীবন চলে না। দুইজন দুইজনের বদলামের কথা বাদ দিয়া লও মিয়া কামের কাম করি।

মোতালেব গভীর উৎসাহের গলায় বলল, আপনের কথাঐ সই হুজুর। আমরা দুইজন অহন থিকা একপেট অইয়া চলুম। নিজেগো দোষোষ ধইরা লাব নাই। দোষে গুণেই মানুষ। আমরা দুইজন একপেট থাকলে দেখবেন এই পাড়ার বেবাক বিচার সালিশ মাতবরি আমরা দুইজনেঐ করুম। এমনেও খাইগোবাড়ির মাইনষে আমগো এইমিহি লইয়া চিন্তা ভাবনা করে না, অহন আমরা মজজিদি বানাইয়া হালাইতাছি, শরিয়ত মোতাবেক বিচার সালিশ আপনে আমি করলে খাইগোরাও আমগো লইয়া মাথা ঘামাইবো না। তারা থাকবো। তাগো মতন, আমরা থাকুম আমগো মতন।

মান্নান মাওলানা হাসলেন। এইত্তো লাইনে আইছো দাদা। আমি তো এইডা তোমারে কইতে চাইতাছি। অহন হোনো, আরেকখান কামের কথা কই। কাইল থনে ঢাকা থি কা টেরাক আইবো। পয়লা আইবো বশ কাঠ টিন ডেরাম এই হগলের টেরাক। কাদির মিস্তিরি আইবো আরও দুই-একজন ওস্তাগার লইয়া। জোগালুরা আইবো। ইঞ্জিনিয়ার সাবে আইবো। এই মাইট্টালডিরে তুমি ছাইড়ো না। অগো দিয়াঐ কইলাম জাহিদ খাঁ-র বাড়ির ওহেন থিকা ইট বালি রড সিমিট বেবাক টানন লাগবো। মাইট্টালগো আগেঐ কইলাম বেবাক কইয়া রাইখো। সড়ক থিকা দুই-আড়াইকানি জমিন ভাইঙ্গা ইটা আইন্না সাজাইয়া রাখবো এহেনে। রড রাখবো খোলা জাগায়। তয় সিমিট রাখন লাগবো টিনের যে একচালা অইবো ওই এক চালায়। ওস্তাগার জোগালুরাও ওই ঘরে থাকবো।

হ এই হগল ঠিক আছে। আমিও এমতেঐ চিন্তা কইরা রাকছি। তয় এই জাগায় টিনের একচালা কইরা থাকতে বেড়াগো জান বাইর অইয়া যাইবো। যেই শীত পড়ছে।

এইসব শীতে মিয়া কামলা-কোমলাগো কিছু অয় না। অরা এই হগলে অভ্যস্ত।

একটু থামলেন মান্নান মাওলানা। তয় আমি অহন ইট্টু বাড়িমিহি যাই। নাস্তা পানি খাইয়াহি। ফয়জরের নমজ পইড়া আইয়া পড়ছি। খিদা লাইগ্না গেছে।

হেইডা আমারও লাগছে। তয় আমার নাস্তা এহেনেই দিয়া যাইতে কমু নে। খামু তো মুড়ি আর মিডাই। বাইত থিকা নিয়া আইবোনে। আপনে যান।

মান্নান মাওলানা বললেন, তয় দুইডা চেরও আনাইয়ো বাইত থিকা। এতক্ষুন খাড়াইয়া থাকন যায় না। ইট্ট বইতে পারলে সুবিদা।

আইচ্ছা আনামু নে।

ততক্ষণে বেলা বেশ হয়েছে। তবে রোদ উঠেছে এইমাত্র। তাও এমন পাতলা রোদ, কুয়াশা ভেঙে তেমন সুবিধা করে ছড়াতে পারছে না চারদিকে। শীতও কমে নাই।

মান্নান মাওলানা বাড়িমুখী হাঁটতে হাঁটতে একবার আকাশের দিকে তাকালেন। চকমাঠে যেটুকু রোদের আভাস দেখা যাচ্ছে সেই দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললেন, এনামুল সাবের কথায় নূরজাহানরে বিয়া আমি করতে পারলাম না ঠিকঐ, যেইভাবে অর উপরে শোদ লইতে চাইছিলাম ওইভাবে শোদটা লইতে পারুম না। খায়েশটা মিটাইতে পারলাম না অর উপরে। তয় অরে আমি তারবাদেও ছাড়ম না। সুযুগ একখান পাইলেঐ অরে আমি খামু।

মান্নান মাওলানার এই ভাবনার লগে লগে চারদিককার রোদের আভা যেন ম্লান হয়ে গেল।

.

সকালবেলা এক ঠিলা খাজুরের রস নিয়া হাজির মুকসেদ।

এখনও রোদ ওঠে নাই। কুয়াশা এমন পড়া পড়ছে, চারদিক সাদা হয়ে আছে। মতি মাস্টারের সংসার জেগে উঠেছে ঠিকই, আছিয়া ছাড়া ঘর থেকে একজনও বের হয় নাই। এই ঘরের অর্ধেক জুড়ে বিশাল একখান চকি। এক চকিতেই চারজন মানুষ শোয় তারা। শীতের দিন বলে এই ব্যবস্থা। বেড়ার দিকটায় শোয়া হিরা তারপর আছিয়া তারপর মানিক তারপর মতি মাস্টার। কাঁথা কাপড়ের লগে চারজন মানুষের শরীরের ওমে শীত টের পাওয়া যায় না। রাত কাটে আরামে। সকালবেলা আছিয়া উঠে এক হাঁড়ি পানি গরম করে। সেই পানির হাঁড়ি রান্ধনঘরের সামনে রেখে দেয়। পাশেই থাকে পুকুর থেকে আনা এক বালতি ঠান্ডা পানি। গরম পানির লগে ঠান্ডা পানি মিলিয়ে সকালবেলার কাজগুলি শেষ করে তারা। মতি মাস্টার আর আছিয়ার তো কোনও সমস্যা নাই, সমস্যা হিরা-মানিককে নিয়া। পায়খানা ঘরের ওদিকটায় ধরে ধরে নিয়া হিরার কাজগুলি সারায় আছিয়া, মানিকেরটা মতি মাস্টার। হাঁটাচলা তারা করতেই পারে না, লেছড়ে ছেড়ে মা-বাবার লগে যায়। সিঁড়ি বেয়ে পায়খানা ঘরে উঠতে পারে না। ওদিককার জংলা মতন জায়গাটায় কাজ সারে। কাজ সারার পর মেয়েকে পয়পরিষ্কার করে আছিয়া, ছেলেকে মতি মাস্টার। সাবান টাবান দিয়া ভাল করেই করে কাজটা। কিছুদিন ধরে এইসব কাজে মতি মাস্টার আর আছিয়ার মতোই লেগে আছে মুকসেদ। সকালবেলা সে এসে পাথালি কোলে করে মানিককে নিয়া যায় পায়খানা ঘরের ওদিকটায়, হিরাকে নিয়া যায়। পরের কাজগুলি মা-বাবাই করায়। কাজ শেষ করে, পয়পরিষ্কার করে দেয় মা-বাবা, মুকসেদ গিয়া আবার কোলে করে নিয়া আসে। হিরা-মানিক এখন মা-বাবার মতোই মুকসেদের বাধুক। মুকসেদও যেন তাদের কাছে আরেকজন মতি মাস্টার, আরেকজন আছিয়া। মুকসেদকে দেখলেই আনন্দে খলবল খলবল করে হাসে তারা। উঠানে, জামগাছতলায় বসে থাকলে হেঁউচড়াইয়া হেঁউচড়াইয়া আসে মুকসেদের কাছে।

আরেকজন সঙ্গীও তাদের এই বাড়িতে ছিল। পারুর ছোটমেয়ে নূরি। সেই যে শ্রাবণমাসে চলে গেল তারা, আর ফিরল না। এই জীবনে হিরা-মানিকের লগে নূরির আর কোনওদিন হয়তো দেখাই হবে না।

মুকসেদেরও খুব মনে পড়ে নুরির কথা। কিছুদিন হিরা-মানিকের পাশে নূরিকেও দেখেছে। মান্নান মাওলানা আর আতাহারের কারণে চিরতরে এই বাড়ি ছেড়েছে তারা।

আজ সকালবেলা রসের হাঁড়ি নিয়া এই বাড়িতে আসতে আসতে নূরির কথাটাও একবার মনে পড়েছে মুকসেদের। আহা মাইয়াটা থাকলে হিরা-মানিকের লগে সেও ইট্টু রস খাইতে পারতো। রসের জাউ খাইতে পারতো। মন্নাইন্না শালার পো শালায় আর মানুষ অইলো না। আপন পোলার বউর লগে কতবড় বেইমানিডা করলো, নাতি নাতকুড়গুলির লগে করলো। বড়পোলা মোতাহার আর অর মায় মানুষ ভাল আছিল দেইক্কা আল্লায় তাগো উড়াইয়া নিছে। মন্নাইন্নাইর মাজারো পোলাডাও অইছে বাপের মতন ইবলিশ। বাপ বড় ইবলিশ, ওই শুয়োরের পোয় ছোড় ইবলিশ। আরে শুয়োরের পো, তর বাপে নাইলে টেকার ললাবে পোলার বউর লগে, নাতি নাতকুড়গো লগে বেইমানি করল। তুই করলি ক্যা রে চুতমারানির পো? পোলাপান তিনডা তো তোর। তাগো লেইগা তর মায়া লাগলো না? আর পারুর লাহান বউ তুই পাবি? অহন তো হোনতাছি ফাল্গুন মাসে তর বিয়া। বউ অইলো ট্যারি। চায় দিল্লি, দেহে লাহোর। টেকার লোবে বাপপুতে তরা এই কাম করলি? দোজকে যাবি শুয়োরের বাচ্চারা, হাবিয়া দোয়ক তগো লেইগা রেডি।

মুকসেদের পরনে আজ লুঙ্গির ওপর ফুলহাতা মোটা গেঞ্জি, গেঞ্জির ওপর নীল মোটা সুয়েটার। পায়ে মোটা কালো মোজা আর রাবারের পামশু। মাথায় পুরানা শ্যাওলা রঙের কানটুপি। হাতে রসের হাঁড়ি নিয়া মতি মাস্টারের বাড়িতে ঢুকেই সে দেখে আছিয়া গরম পানির হাঁড়ি রান্ধনঘরের বাইরে রাখছে। এক ঠিলা পানি কাল বিকালেই এনে জায়গা মতন রেখেছিল। আছিয়ার খালি পা, পরনে ত্যানা ত্যানা সবুজের কাছাকাছি রঙের সুতি শাড়ি, তার ওপর অতি সস্তা বহুদিনের পুরানা একটা চাদর জড়ানো। এইরকম শীতে এই সামান্য কাপড়ে কেমন করে আছে সে। চুলার পারে থাকলে আর কাজকাম করলে শরীর অবশ্য গরম হয়। শীত লাগে কম। তার পরও যেরকম শীত পড়ছে, তাতে এই কাপড়ে মানুষ থাকে কী করে?

এই নিয়া কথা বলল না মুকসেদ। রসের হাঁড়ি রান্ধনঘরে নামিয়ে বলল, রসের জাউ রান্ধো বইন। বেবাকতে মিলা খামুনে।

আছিয়া হাসিমুখে বলল, দবিরগাছি আইছিলো নি?

হ। আমিঐ খবর দিছিলাম। দুই ঠিলায় যা রস অয় দিয়া যাইতে কইছিলাম। এক ঠিলা আমগো বাড়ির মাইনষের লেইগা আরেক ঠিলা তোমগো লেইগা। কো, আমার মা আর বাজানে কো? ওডে নাই? মাস্টার সাবে ওডে নাই?

হিরা-মানিককে–বাজান ডাকে মুকসেদ।

আছিয়া বলল, উটছে বেবাকতে। অহনতরি কেঁতার তলে।

তয় তুমি জাউ বহাইয়া মা’র কামডি সাইরাহো, মাস্টার সাবরে কও বাজানের কাম সারাইতে। আমি কুলে কইরা দিয়ামুনে। তোমরা বাকি কাম সারাইয়া আহো। রইদ উটলে আমি অগো রইদ্রে আইন্না বহামুনে।

আইচ্ছা।

দৌড়ে বড়ঘরে গিয়া ঢুকল আছিয়া। সেরখানেক আলা চাউল (আতপ চাউল) এনে, ধুয়ে পাকলে চোখের পলকেই রসের জাউ চড়ায়া দিল চুলায়। বাড়িতে ততক্ষণে খবর হয়ে গেছে। মুকসেদ আসছে। হিরা-মানিক খলবল খলবল করতে শুরু করেছে।

প্রথমে হিরাকে জায়গা মতন নিয়া গেল মুকসেদ। লগে গেল আছিয়া। তার কাজ শেষ হওয়ার পর আছিয়া ডাকলো, দাদা, অইয়া গেছে।

ততক্ষণে একটু একটু রোদের আভা দেখা দিয়েছে। কুয়াশা পাতলা হচ্ছে। এই অবস্থায় হিরাকে এনে আবার চকিতে তুলল মুকসেদ। কথা প্যাচিয়ে বসিয়ে দিল। ঠিক একইভাবে সারল মানিকের কাজ। ততক্ষণে উঠানের অর্ধেকটায় রোদ। পুরানা ছেঁড়া একটা হোগলা আছে বেশ বড় সাইজের। সেই হোগলা নিজেই এনে রোদে বিছাল মুকসেদ। শীত পড়ার লগে লগে গোয়ালিমান্দ্রার হাট থেকে মোটা মোটা পায়জামা ফুলহাতা পুরানা গেঞ্জি সোয়েটার কানটুপি মোজা এইসব কিনে এনেছিল। উঠানে হোগলা বিছিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে হিরা মানিক একদম রেডি। হিরাকে পায়জামা গেঞ্জি সোয়েটার কানটুপি মোজা পরায়া যেমন ফিটফাট করছে আছিয়া, মতি মাস্টার করছেন মানিককে। সকালবেলার কাজ সেরে গরমে ওমে ভালরকম আরাম পাচ্ছে ছেলেমেয়ে দুইটা। আনন্দে খলবল খলবল করছে।

মুকসেদ তাদের দুইজনকে একে একে উঠানের রোদে এনে বসাল। ওদিকে চুলায় টগবগ টগবগ করে ফুটছে খাজুরের রসের লগে আলা চাউল। মনোহর একখান গন্ধে ভরে গেছে গনি মিয়ার আঙিনা। হিরা মানিক বুঝে গেছে ভাল জিনিস রান্না হচ্ছে বাড়িতে। গন্ধে আকুল হয়েছে তারা।

আছিয়া আবার ঢুকে গেছে রান্ধনঘরে। মুকসেদ বসেছে হিরা-মানিকের মাঝখানে। তাদের ভঙ্গিতে তাদের লগে খেলছে, কথা বলছে। মতি মাস্টার হাতমুখ ধুয়ে এসে একটা জলচকি নিয়া বসলেন রোদে, হিরা যেখানটায় বসেছে তার একেবারে গা ঘেঁষে। তার পরনে লুঙ্গি আর মোটা খদ্দরের সাদা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির ওপর বেশ মোটা খদ্দরেরই চাদর। চাদরটার রং হালকা নীল। পায়ে পুরানা স্যান্ডেল। চাদরে গা ঢেকে বেশ আরাম করে রোদে বসেছেন। মুকসেদ একবার তাঁর দিকে তাকাল। তিনিও তাকিয়ে ছিলেন মুকসেদের দিকেই। চোখাচোখি হতেই বললেন, হঠাৎ রস নিয়া আসলেন দাদা?

মুকসেদ হাসল। হঠাৎ না। দবিরগাছিরে বইলা রাখছিলাম। সে তো এই বাড়িতে আহে না, এর লেইগা ভাবলাম, আমগো বাইত্তে আইতে কই। দুই ঠিলা রস রাখুমনে। এক ঠিলা আমার ভাইর সংসারের লেইগা আরেক ঠিলা হিরা মানিকের লেইগা। নাইলে তো এইবারের শীতে আমার মা-বাজানের আর রস খাওয়া হইব না। তয় মাস্টারসাব আইজকার রসখানও পড়ছে। লাল টকটইক্কা রস। তয় বেবাক রস লাল আছিল না। যেই দুই ঠিলা লাল আছিল ওইডাঐ আমারে দবির দিছে। সব রস তো লাল অয় না। খাজুরগাছের সবাব তো আপনে জানেন। পুরুষ খাজুরগাছের রস অয় সাদা। বেশি মিডা অয় না। মিডা অয় মাইয়া খাজুরগাছের রস। রং অয় লাল।

হ এইটা জানি। দেখেন আল্লার কুদরত। একই রকম গাছ। তয় রস দুই রকম।

জে।

কিন্তু দবিরগাছি এই বাড়িতে আসবো না বললেন, কারণটা কী?

আপনে জানেন না?

কিছুটা জানি। গাছির মেয়ে নূরজাহান…

না খালি ওইটা না।

তবে?

মনে মনে মান্নান মাওলানাকে যতই গালাগাল করুক মুকসেদ মুখে সেই গালাগালের ভাব ফুটায় না। বেশ সয়সম্মান করেই কথা বলে।

এখনও সেইভাবেই বলল। আরে হুজুরে তো আরেকখান কাম করছিল।

কী?

নূরজাহানরে বিয়ার পোরোসতাব দিছিল।

মতি মাস্টার বেশ একটা ধাক্কা খেলেন। কন কী?

হ। ওই যে ঘটকা আছে ল্যাংড়া বসির অরে দিয়া পোরোসতাব পাঠাইছিল। গাছি রাজি হয় নাই। এনামুল সাবরে দিয়া মিটমাট করছে।

মতি মাস্টার মাথা নাড়লেন। ভাল কথা না।

জে। খুব খারাপ কথা। নাতিনের থিকাও ছোড় মাইয়াডারে বিয়া করতে চায়। তয় মজজিদের ব্যাপার না থাকলে এনামুল সাবের কথাও হেয় হোনতো না। গাছির মাইয়ারে বিয়া কইরা ছাড়তো। কীর লেইগা করতো, বুজছেন তো?

জি বুজছি। ভাল কথা না।

মানিক আজ একটু চুপচাপ। রোদে বেশ চুপচাপ বসে আছে। চোখ শীতের চকমাঠের দিকে। হিরা বাপকে পাশে পেয়ে তার কোলের কাছে চেপে গেছে। মতি মাস্টার মেয়ের মাথাটা কোলের কাছে ধরে মাথায় পিঠে আনমনা ভঙ্গিতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। মেয়েটা শিশুর ভঙ্গিতে আদর নিচ্ছে।

মানিক একবার বাবার দিকে তাকাল। এই তাকানোটা খেয়াল করল মুকসেদ। বোনকে বাবা আদর করছে, এখনই হয়তো সে লেছড়ে লেছড়ে আসবে বাবার কাছে। বোনকে ধাক্কা দিয়া সরায়া দিতে চাইবে। বোনও সরবে না। দুইজনে একটা কিলাকিলি লাগবে। বিষয়টা বুঝে মুকসেদ বসল মানিকের গা ঘেঁষে। আহো বাজান তুমি আমার কাছে আহো। তোমারে আমি আদর কইরা দেই।

মতি মাস্টার যেভাবে হিরাকে আদর করছেন সেই ভঙ্গিতে মানিককে আদর করতে লাগল মুকসেদ।

মতি মাস্টার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আপনেরে একটা কথা বলব দাদা?

জে বলেন। বাপ হিসাবে এইটা বলা ঠিক না। তারপরও বলি। আমার কিন্তু মানিকের চেয়ে হিরার জন্য মায়া লাগে বেশি। মাইয়াটারে আমি মনে হয় বেশি আদর করি।

মুকসেদ হাসল। জে সেইটা আমি বুঝি।

একসময় আরবদেশে কন্যা সন্তান জন্মাইলে জ্যান্ত কবর দেওয়া হইতো, জানেন?

জে, শুনছি।

সেই সময়টাকে বলা হয় জাহিলিয়া যুগ। জহল হইতাছে আরবি শব্দ। অর্থ হইলো মূর্খতা, অজ্ঞানতা, বর্বরতা। প্রাচীনকাল থেকে আরম্ভ করে ইসলাম প্রচারের পূর্বকাল পর্যন্ত সময়কে সাধারণত জাহিলিয়া বলা হয়। এই যুগে নবজাতক শিশুকন্যাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হত। এই বিষয়ে একটা বইতে আমি পড়েছিলাম, একজন আরব বাণিজ্য উপলক্ষে বিদেশে যাওয়ার সময় তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে বলে গেল, যদি তোমার পুত্রসন্তান হয় তবে তাকে লালন পালন করবে, আর যদি কন্যাসন্তান হয় তা হলে তাকে জন্মের পর আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিবে।

মুকসেদ হতভম্ব হয়ে মতি মাস্টারের মুখের দিকে তাকায়া রইল।

মতি মাস্টার হিরার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, আরেকটা ঘটনা এত করুণ, শুনলে চোখে পানি আসে।

বলেন মাস্টারসাব, শুনি।

সেই যুগে আরব দেশে ওসমান নামে একজন লোক বাস করতেন। খুবই কঠিন হৃদয়ের মানুষ। তার চোখে কোনওদিন পানি আসত না। কোনওদিন কাঁদত না। জীবনে শুধু একবার কেঁদেছিল। তার স্ত্রী চাঁদের আলোর মতন ফুটফুটা একটা কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে। ওসমান কন্যাসন্তান রাখবে না। জীবিত কবর দিবে। সেই শিশুকন্যার জন্য কবর খোঁড়া হচ্ছে। কবর খুঁড়তে গিয়া ওসমানের দাড়িতে মাটি লেগে গেছে। ওইটুকু শিশুকে যখন সে জীবন্ত কবর দিচ্ছে, শিশুটি দুইহাত দিয়া তার বাবার দাড়িতে লেগে থাকা মাটিটুকু ঝেড়ে পরিষ্কার করে দিয়েছিল। তারপরও মেয়েটিকে সে জীবন্ত কবর দেয় আর জীবনে ওই একবারই কাঁদে।

ঘটনাটা বলতে বলতে চোখ ছলছল করে উঠল মতি মাস্টারের। হিরার মাথাটা বুকে জড়ায়া ধরলেন তিনি। অন্যদিকে তাকায়া চোখের পানি সামলালেন।

মুকসেদেরও মনটা তখন ভারাক্রান্ত। সেও অন্যদিকে তাকায়া রইল।

মতি মাস্টার বললেন, কায়েস বিন আসিম নামে একজন লোক ছিল সেই যুগে। তার চেয়ে বড় পাপী আর কেউ ছিল বলে আমার মনে হয় না। সেই তার নিজের দশটি কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দিয়েছিল। মেয়েদের বয়স পাঁচ থেকে ছয় বছরের মধ্যে। ‘কিতাবুল আগানী’তে উলেখ আছে, কায়েস যখন তার কন্যাসন্তানদের কবরস্থানে নিয়া জীবন্ত কবর দিচ্ছিল, তখন তার কন্যারা বলে উঠেছিল, বাবা, তুমি আমাদেরকে এইরকম ধুলাবালি ভরা মাটিতে ফেলে যাচ্ছ কেন? মেয়েদের এই করুণ আকুতি পাষাণ হৃদয় পিতার হৃদয়ে একটুও দাগ কাটে নাই। একটুও বিচলিত করে নাই সেই নিষ্ঠুরকে। একটা-দুইটা না, দশটা কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দিয়েছিল কায়েস।

মুকসেদ কাতর গলায় বলল, মাস্টারসাব এইসব ঘটনা আর শোনতে চাই না। বহুত খারাপ লাগতাছে। কষ্টা হইতাছে।

মতি মাস্টার বললেন, আমারও কষ্ট হচ্ছিল। তবু বললাম। আমি আমার প্রতিবন্ধী মেয়েটার জন্য, ছেলেটার জন্য জান দিয়া দেই, আপনার বোন জান দিয়া দেয়, আর এক ধরনের মানুষ আপন সন্তানকে…

কথা শেষ না করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন মতি মাস্টার।

রান্ধনঘরে আছিয়া খাজুরের জাউ নিয়া ব্যস্ত। চুলায় টগবগ টগবগ করে ফুটছে রস আর চাউল। চুলার পারে বসে আগুনের তাপে আরাম পাচ্ছে আছিয়া। জাউ হতে আরও সময় লাগবে। চাউল ফুটে গলে রসের লগে মিশে, সামান্য ঘন আর নয়তো পাতলা ট্যালট্যালা জাউ হবে। সামান্য ঘনটাই বানাবে আছিয়া। ঘনটাই পছন্দ করবে সবাই।

উঠানে রোদ তখন আরেকটু প্রখর হয়েছে। রোদের তাপ একটুখানি বেড়েছে। চকমাঠ, বাড়ির উঠান পালান, গাছপালা ঝোঁপঝাড় থেকে উধাও হতে শুরু করেছে কুয়াশা। শীতে জবুথবু হয়ে হিরা বসে আছে বাবার কোলে কাছে মুখ দিয়া, দুইহাতে তাকে জড়িয়েও ধরেছে। মানিক বসে আছে মুকসেদের গা ঘেঁষে। এখন আর তেমন খলবল খলবল করে শব্দ করছে না তারা, মুখেও ছেবড়ি (ফেনা) নাই। শীতের হাত থেকে রোদের তাপে চুপচাপ আরাম নিচ্ছে।

মতি মাস্টার বললেন, মুকসেদ দাদা, এনামুল সাবের মসজিদের খবর কী? কতখানি হইলো।

মুকসেদ বলল, কাম তো ধুমাইয়া চলতাছে। মাডি মুডি উডাইন্না হইয়া গেছে। ইট বালি সিমিট রট বেবাক আইয়া পড়ছে। ওস্তাগার জোগালুগো থাকনের ঘর হইছে, বিয়ান থিকা। সন্ধ্যা তরি কাম চলে। মজজিদের দেওয়াল হইয়া গেছে। দুই-একদিনের মইদ্যে ছাদ ঢালাই দিবো। হুজুর আর মোতালেব বিয়ান থিকাঐ ওহেনে থাকে। হুজুরে খালি ভাত খাওনের লেইগা দোফরে একবার বাইত্তে আহে।

একটু থেমে যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে মুকসেদ বলল, ও কয়দিন ধইরা ভাবতাছি আপনেরে একখান কথা জিগামু, জিগাইতেই পারি না।

কী কথা?

খাইগোবাড়ির হুজুরের খবর কী?

আগের হুজুরের?

হ।

ঢাকায় তার চিকিৎসা চলছিল। তবে একটা সময়ে সে আর ঢাকার হাসপাতালে থাকতে চায় নাই।

ক্যা?

হোনলাম, তিনি আপেল মেম্বার, মাসুদ খান সাহেব তাদেরকে বলছেন, আমি আমার গ্রামে গিয়া থাকতে চাই। পরিবার, ছেলেমেয়েদের কাছে গিয়া থাকতে চাই। আল্লাহপাকের যখন আদেশ হবে তখনই মরণ হবে। নিজের গ্রামে, নিজের বাড়িতে, পরিবারের সবার মধ্যে থাইকাই মরতে চাই। তখন তারা তারে নোয়াখালিতে, তার গ্রামে পাঠাইয়া দিছে। মাওলানা হুজুরের দুই ছেলে আসছিল বাবাকে নিতে। খান সাহেবরা ভাল টাকা পয়সাও দিয়া দিছেন।

মুকসেদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, খানিক উদাস হয়ে রইল। তারপর বলল, অহন যেই ইমাম সাব আইছেন তিনি মানুষ কেমুন?

গম্ভীর প্রকৃতির। চুপচাপ নিজেরে নিয়া থাকেন। কোরান কিতাব পড়েন। একলা একলা পায়চারি করেন। আমি দুই একদিন কথা বলছি। বাড়তি কথাবার্তা বলেন না। প্রশ্ন করলে উত্তর দেন, আর নিজের কিছু জানার থাকলে ওইটা জানতে চান।

আল্লাহর দুনিয়ার মানুষ এহেকজন এহেক পদেরঐ হয়।

তবে লোক তিনি ভাল।

আমি চিন্তা কইরা দেকছি মাস্টার সাব, দুইন্নাইতে ভাল মানুষঐ বেশি। যেই দুই চাইরটা খারাপ মানুষ আছে, ওই খারাপগুলিতে বদমাইশি কইরা দুইন্নাইডা ছ্যাড়াভেড়া কইরা হালায়।

একটু হাসল মুকসেদ। অমুন একটা বদমাইশের নাম আমার মুখে পেরায় আইয়া পড়ছিল, নামডা আমি কইতে চাই না। আপনে আমারে হিগাইছেন, মাইনষের ভাল গুণের কথাটা কইবেন, বদগুণের কথাটা না কওনই ভাল।

হ সেইটাই আপনি মাইনা চলবেন।

তয় মাস্টার সাব আমারে আইজ আপনে ইট্টু মজজিদ বিষয়ে বলেন তো! দুনিয়ার পয়লা মজজিদ কেমতে হইল, এইসব আমারে ইন্টু বলেন। রসের জাউ অইতে অইতে মজজিদের কথা হুনি।

হিরার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মতি মাস্টার বললেন, কাবাগৃহই হচ্ছে পৃথিবীর সর্বপ্রথম ইবাদত গৃহ। সুরা আল ইমরান’ এর ৯৬ আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন, “নিশ্চয় মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা মক্কাতেই অবস্থিত, তা সৌভাগ্যযুক্ত ও বিশ্বজগতের পথপ্রদর্শক। কাবাঘর মোট এগারোবার নির্মিত হয়েছে। প্রথম নির্মাতা ফেরেশতাগণ। আল্লাহপাক তাঁর ফেরেশতাগণকে বললেন, “আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি প্রেরণার ইচ্ছা প্রকাশ করছি। শুনে ফেরেশতারা বললেন, হে পরওয়ারদিগার আমাদেরকে ছাড়া অন্য সৃষ্টি পৃথিবীতে কলহ বিবাদ ও রক্তারক্তি করবে এবং একে অপরের প্রতি হিংসাপরায়ণ হবে। তারপর বলল, এই সৃষ্টি আমাদের মধ্য হতে করুন আল্লাহপাক। তা হলে আমরা পৃথিবীতে কলহ বিবাদ রক্তারক্তি কিছুই করব না, এবং কেউ কারও সঙ্গে হিংসা বিদ্বেষ করব না। আপনার প্রশংসায় সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকবো, আপনার নির্দেশ মেনে চলবো, কখনও আপনার অবাধ্য হবো না। তখন আল্লাহপাক বললেন, “তোমরা যাহা জানো না, আমি তাহা জানি। তখন ফেরেশতারা। মনে করল যদিও তারা আল্লাহর কথার প্রতিবাদ করে নাই, তবু তারা ভাবল যে তাদের কথায় আল্লাহপাক হয়তো তাদের ওপর রাগান্বিত হয়েছেন। তারা ভয় পেয়ে গেল। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আরশে আজিমকে জড়িয়ে ধরল এবং কাঁদতে কাঁদতে মাথা উঁচু করে আল্লাহর গজবের হাত হতে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য হাতের আঙুল দিয়া ইশারা করল। এই অবস্থায় তারা বহুক্ষণ পর্যন্ত তওয়াফে থাকল। তখন আল্লাহপাক তাদের উপর দৃষ্টিপাত করলেন এবং রহমত নাজেল করলেন। আল্লাহপাক তাদের জন্য আরশে আজিমের নীচে চারটি স্তম্ভবিশিষ্ট একখানা গৃহ নির্মাণ করলেন। তারপর আল্লাহতাআলা বললেন, “তোমরা আরশকে ছাড়িয়া এই গৃহকে তওয়াফ করো। তখন থেকে ফেরেশতারা এই গৃহকে তওয়াফ করতে লাগল। এটাই বায়তুল মামুর’ নামে অভিহিত হল। এই গৃহে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টায় একেক দলে সত্তর হাজার করে ফেরেশতা হাজির হয়, তওয়াফের পর তারা আর ফিরে আসে না। তখন আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে বললেন, তোমরা পৃথিবীতে যাও এবং তথায় এই গৃহের অনুরূপ একখানা গৃহ প্রস্তুত করো। আল্লাহপাক পৃথিবীতে তাঁর সৃষ্টিকে এই গৃহ তওয়াফ করতে আদেশ দিলেন। যেমন করে আশমানবাসীগণ বায়তুল মামুরের তওয়াফে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা রত আছে।

মুকসেদ বলল, তওয়াফ অর্থ কী মাস্টার সাব?

তওয়াফ হচ্ছে প্রদক্ষিণ। প্রদক্ষিণ করা। প্রদক্ষিণ অর্থ বোঝেন তো?

জে বুঝি। ঘোরা।

জি।

বায়তুল মামুর সমন্ধে একটু বলেন?

বায়তুল মামুর হচ্ছে বেহেশতের একটি বিশিষ্ট নূরানি মসজিদ। শোনেন তার পরের কথা। হজরত আদম আলাইহেওয়াসাল্লাম যখন আশমান থেকে অবতরণ করেন, মানে নেমে আসেন, তখন তিনি সর্বপ্রথম বায়তুল্লাহ শরিফকে তওয়াফ করেন। তার সঙ্গে ফেরেশতাদের দেখা হলো। ফেরেশতারা তাঁকে বললেন, বায়তুল্লাহ শরিফ তারা তওয়াফ করছেন হজরত আদম আলাইহেওয়াসাল্লামের পৃথিবীতে আগমনের দুই হাজার বছর আগে থেকে। হজরত ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহুআনহু হতে বর্ণিত আছে, হজরত আদম আলাইহেওয়াসাল্লাম হজ্জ করলেন এবং সাতবার ওই গৃহ তওয়াফ করলেন। তওয়াফের সময় ফেরেশতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। ফেরেশতারা বললেন, “আমরা আপনার দুই হাজার বৎসর পূর্ব হইতে হজ্জব্রত পালন করিয়া আসিতেছি। হজরত আদম আলাইহেওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা তওয়াফে কী কী দোয়া পাঠ করতে?’ ফেরেশতারা বললেন, “আমরা এই দোয়া পাঠ করি আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করিতেছি এবং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদের অস্তিত্ব নাই এবং আল্লাহ অতি মহান।

হজরত আদম আলাইহেওয়াসাল্লাম তাদের দোয়ার সঙ্গে যোগ করতে বললেন ‘আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত কাহারও ভালমন্দ কিছুই করিবার ক্ষমতা নাই।

ফেরেশতারা তাদের দোয়ার সঙ্গে হজরত আদম আলাইহেওয়াসাল্লাম যা বললেন তা যুক্ত করে দোয়া পাঠ করলেন।

হজরত ইব্রাহিম আলাইহেওয়াসাল্লাম যখন বায়তুল্লাহ শরীফ পুনরায় নির্মাণের পর হজ্জ করলেন তখন তওয়াফের ফেরেশতারা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন, সালাম জানালেন। হজরত ইব্রাহিম আলাইহেওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন, “আপনারা তওয়াফের মধ্যে কোন কোন দোয়া পাঠ করতেন?’ ফেরেশতারা বললেন, আমরা আপনার আদিপিতা আদম আলাইহেওয়াসাল্লামের উল্লেখিত প্রথম দোয়া পাঠ করতাম। তারপর দ্বিতীয় দোয়াটি আগের দোয়ার সঙ্গে যোগ করে পাঠ করতাম। ইব্রাহিম আলাইহেওয়াসাল্লাম ওই দোয়ার সঙ্গে যোগ করলেন, তিনি সর্বোচ্চ ও সর্বমহান।

ফেরেশতারা এই দোয়া পাঠ করলেন।

ততক্ষণে রোদ আরও চড়েছে। রোদে তাপে শীত কমেছে অনেক। আছিয়া রসের জাউ চুলা থেকে নামিয়েছে। দুইটা টিনের খাবদা থালে (যে থালায় খাবার বেশি ধরে) জাউ বেড়ে ঠান্ডা করার জন্য রেখেছে। বেশি গরম জাউ পোলাপানে মুখে দিতে পারবে না। একটা অ্যালুমিয়ামের জগে পানি নিয়েছে, টিনের দুইটা হাতলআলা মগ নিয়েছে। কথা শোনার ফাঁকে রান্ধনঘরের দিকেও চোখ ছিল মুকসেদের। আছিয়ার কাজ শেষ হয়েছে দেখে সে মতি মাস্টারকে বলল, জাউ হইয়া গেছে মাস্টার সাব। আমি বইনরে ইট্টু সাহাইয্য করি। আমার মা-বাজানের খিদা লাইগা গেছে। তাগো খাওয়াই। খাওয়াইতে খাওয়াইতে আপনের কথা হুনুম নে। তার বাদে আমরা খামু নে।

মতি মাস্টার হাসিমুখে বললেন, ঠিক আছে দাদা, ঠিক আছে।

মুকসেদ উঠে দাঁড়াতে যাবে, দেখা গেল তার জামার কোনা টেনে ধরে রেখেছে মানিক। মানিকের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে মুকসেদ বলল, ছাড়ো বাজান, ছাড়ো। তোমার খাওন আনতাছি।

মানিকের হাত ছাড়িয়ে রান্ধনঘরে এল সে। দেও বইন, বাজানের থালাডা আমারে দেও।

ছেলেমেয়েকে জাউ খাওয়াবার জন্য দুইটা চামচও ধুয়ে রেখেছিল আছিয়া। দুই থালে দুই চামচ দিয়া একটা থাল মুকসেদের হাতে দিল সে, আরেকটা নিজে নিয়া উঠানে এল। খাবার দেখে খলবল খলবল করে উঠল হিরা-মানিক। বাপের কোল থেকে মাথা তুলে মায়ের দিকে তাকাল হিরা। সকালবেলার রোদের মতন আনন্দে ফেটে পড়ছে মুখ।

মুকসেদের হাতে জাউয়ের থাল দেখে একই অবস্থা মানিকের। তারা দুইজন দুইজনকে চামচে করে জাউ খাওয়াতে লাগল। মতিমাস্টার উঠে গিয়া পানির জগ আর মগ দুইটা এনে রাখল তাদের কাছে।

রসের জাউয়ের গন্ধে তখন উঠানে একটা কাক নামছে। বাড়ির মোরগ মুরগিগুলি এদিক ওদিক চরছে। চারটা হাঁস পালে আছিয়া। হাঁসগুলি কুঁড়া খেয়ে নেমে গেছে পুকুরে। শালিক পাখি ডাকছে ঘরের চালে বসে।

হিরা-মানিক দুইজনেই তখন হুমহাম করে, বেশ মজা করে, ঠোঁটে মুখে নানা রকমের স্বাদের শব্দ করে রসের জাউ খাচ্ছে। মতি মাস্টার তার মতো করে আবার কথা বলতে শুরু করেছেন। জান্নাত হতে হজরত আদম আলাইহেওয়াসাল্লামকে আল্লাহপাক যখন পৃথিবীতে নামালেন তখন তার মাথা ছিল আকাশে আর পা মাটিতে। তাঁর পা যখন। মাটি স্পর্শ করল তখন আকাশে বিদ্যুৎ চমকাবার মতন দৃশ্য দেখা গেল। আল্লাহপাক হজরত আদম আলাইহেওয়াসাল্লামকে নাড়া দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি ষাট হাত লম্বা হয়ে। গেলেন। হজরত আদম আলাইহেওয়াসাল্লাম আল্লাহপাকের কাছে আরজ করলেন, “হে। আল্লাহ! আমি ফেরেশতাদের আওয়াজ শুনতে অক্ষম কেন?’ জবাবে আল্লাহপাক বললেন, ইহা তোমার অপরাধের কারণেই, কিন্তু এখন তুমি পৃথিবীতে যাও। সেখানে তোমার। ইবাদতের জন্য একখানা গৃহ প্রস্তুত করো। ওই গৃহ তওয়াফ করো এবং চারপাশে আমার প্রশংসা করো, যেমন তুমি আমার ফেরেশতাদেরকে আরশের চারপাশে করতে দেখেছো।

হজরত আদম আলাইহেওয়াসাল্লাম চলতে লাগলেন, পৃথিবী তার নিকটতর হতে লাগল এবং বিশাল প্রান্তর, পাহাড় পর্বত নদীনালা সবকিছুই সংকুচিত হতে লাগল। বিশাল প্রান্তর আর সমুদ্র তিনি এক এক পদক্ষেপে অতিক্রম করতে লাগলেন। পৃথিবীর যে যে জায়গায় তাঁর পায়ের স্পর্শ পড়ল সেইসব জায়গা আবাদি ও বরকতময় হতে লাগল। তিনি বহু প্রান্তর ও সমুদ্র অতিক্রম করে পবিত্র মক্কাভূমিতে এসে পৌঁছালেন। তারপর বায়তুল হারাম বা কাবা শরীফ নির্মাণ করলেন। হজরত জিবরাইল আলাইহেওয়াসাল্লাম যখন তাঁর পাখা দিয়া পৃথিবীর মাটিতে আঘাত করলেন তখন কাবা শরীফের ভিত পৃথিবীর সবচেয়ে নীচের স্তর। থেকে উপরের স্তরে দৃশ্যমান হল। ফেরেশতারা সেই ভিতের উপর পাথর ঢালতে লাগলেন। সেইসব পাথর এত বড় বড় আকৃতির যে ওই পাথরের একটি তিরিশজন পুরুষমানুষেও তুলতে পারবে না। এইসব পাথর ফেরেশতারা সংগ্রহ করেছিলেন পাঁচটি পর্বত থেকে। ১. লেবানন ২. তুরেজিতা ৩. তুরেসিনা ৪. জুদি বা আরারাত পর্বত ৫. হেরা পর্বত।

হজরত ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহুআনহু বলেছেন, হজরত আদম আলাইহেওয়াসাল্লাম। প্রথম কাবাগৃহ নির্মাণ করেন। তারপর তিনি সেখানে নামাজ ও তওয়াফ আদায় করেন। অনেকদিন পর মানুষের বেইমানি ও কুফুরির সীমা অতিক্রম করলে মানবজাতির শাস্তির জন্য হজরত নূহ আলাইহেওয়াসাল্লামের জামানায় আল্লাহর হুকুমে এক মহাপ্লাবনের সৃষ্টি হয়। এই সময় কাবাগৃহও সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়।

তারপর আল্লাহপাক হজরত ইব্রাহিম আলাইহেওয়াসাল্লাম ও হজরত ইসমাইল। আলাইহেওয়াসাল্লামকে নবি মনোনিত করে দুনিয়াতে পাঠালেন। তারা কাবা শরীফের ভিত ও দেওয়াল মাটি খুঁড়ে তুললেন। কাবাগৃহ বেহেশতের বায়তুল মামুরের বরাবর সোজা, নীচে স্থাপন করা হয়েছে।

মতি মাস্টারের কথা খুবই মন দিয়া শুনছিল মুকসেদ আর আছিয়া। ফাঁকে ফাঁকে হিরা মানিকের খাওয়ার কাজও চালিয়ে গেছে। একথাল জাউ শেষ করে আরও খেতে চেয়েছে হিরা-মানিক। আছিয়া আরও আধাথাল পরিমাণ জাউ এনে দিয়েছে। দেড়থাল করে রসের জাউ খেয়ে দুইজন তারা মহাখুশি। পানি খেয়ে, মুখ মুছে দু’জনেই এখন আনন্দিত মুখে বসে আছে। আছিয়া মতিমাস্টারের দিকে তাকালেন। এইবার আপনেরা খান। বেইল তো অনেক অইছে।

মতিমাস্টার হাসিমুখে বললেন, দেও।

মুকসেদ বলল, আমারে ইট্টু কম কইরা দিয়ো বইন। বিয়ানবেলা বেশি খাইতে পারি না আমি। আর তোমার লেইগা রাইখো কইলাম। বেবাক আমগো খাওয়াইয়া দিয়ো না।

আছিয়া হাসল। না দাদা। অনেক জাউ আছে। আমরা খাওনের পরও পোলাপানে আরও এক-দুই থাল কইরা খাইতে পারবো।

রসের জাউ খেতে খেতে মতি মাস্টার একসময় বললেন, আল্লাহর ঘরের চেয়ে পবিত্র আর কিছু হইতে পারে না। এনামুল সাবে খুব ভাল একটা কাজ করল গ্রামে। মানুষের নামাজ আদায় করার ঘর তৈরি করে দিলেন।

মুকসেদ মুখের জাউ গিলে বলল, সেইটা ঠিক আছে। তয় ইমাম হইতাছে আমগো হুজুরে। মান্নান মাওলানা। সে নিজে যুদি ঠিক থাকে…

কথা শেষ করল না মুকসেদ।

মতিমাস্টার বললেন, না না ঠিক থাকবেন। মানুষকে নিয়া খারাপ চিন্তার দরকার নাই। আল্লাহপাক তাকে হেদায়েত করুন। দোষ ত্রুটি কাটায়া তিনি য্যান ইমামতিটা ঠিক মতন করেন। বিচার সালিশ শরিয়ত মোতাবেক করেন। কারও উপর য্যান অবিচার না করেন। আমরা তাঁর জন্য সেই দোয়াই করি।

তারপর হঠাৎ করেই যেন রসের জাউয়ের মূল স্বাদটা টের পেলেন মতি মাস্টার। কথার তালে ছিলেন বলে যেন বুঝতে পারেন নাই এমন দুর্দান্ত স্বাদ হয়েছে জিনিসটার। বললেন, জাউটা কেমন লাগছে?

মুকসেদ হাত দিয়াই জাউ খাচ্ছে। হাতের চার আঙুল বেঁকা করে খানিকটা জাউ তুলে মুখে দিল। দিয়া বলল, বিরাট সাদের জিনিস। খাজুরের রসের কোনও তুলনা হয় না। মাস্টারসাব। আল্লায় কত সাদের নিয়ামত যে মাইনষের লেইগা দিছে, তার মইদ্যে এই একখান হইল খাজুরের রস।

মতিমাস্টার বললেন, আরবদেশে যত উদ্ভিদ আছে, গাছপালা আছে তার মধ্যে খাজুরগাছকে বলা হয় রানি। খাজুর ফল খুবই পরিচিত আর দামি। আরবরা বলে উৎকৃষ্টতম ফল। এর উপরে কোনও ফল হয় না। খাজুরের রস দিয়া ‘নাবিয’ নামের মদ তৈরি করা হয়। ওই মদ বেদুইনদের বিরাট পছন্দ। খাজুরের বীজ গুঁড়া করে উটের খাবার খইল তৈরি করে আরবরা। প্রত্যেক বেদুইনের দুইটি স্বপ্ন থাকে, পানি আর খাজুর খেতে পাওয়া। হজরত মুহাম্মাদ সাল্লালাহেআল্লাইহেওয়াসাল্লাম আদেশ দিয়াছিলেন, তোমার চাচি, খেজুরকে সম্মান করো। কারণ আদমের মতো একই উপাদানে তারা তৈরি হয়েছে। মদিনা ও তার আশেপাশে একশো রকমের খাজুরগাছ দেখতে পাওয়া যায়।

মুকসেদ তারপর অন্যরকম একটা কথা বলল। তার অর্থ হইল খাজুর খুবই পবিত্র গাছ। এই গাছ ঝুইরা রস বাইর করে দবির গাছি। আমগো খাওয়ায়। আর তার মতন একটা মাইনষের মাইয়ারে লইয়া হুজুরে যেই কারবারটা শুরু করছে, এইডা তো বড় অন্যায়। হইতাছে মাস্টার সাব।

মতি মাস্টার আরেকটু রসের জাউ মুখে দিয়া বললেন, এখন মসজিদের ইমামতি করবেন হুজুর। মন আগে যেমুনই আছিল, এখন হয়তো বদলাবেন। এখন হয়তো সত্যিকার ভাল মানুষ হয়ে যাবেন।

মুকসেদ বলল, আল্লায় য্যান তারে সুমতি দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *