কীভাবে আমি দুশ্চিন্তা জয় করি
কয়েকটি সত্য ঘটনা : ব্ল্যাকউড ডেভিস বিজনেস কলেজের মালিক সি. আই. ব্ল্যাকউডের অভিজ্ঞতার কাহিনী এই রকম :
১৯৪৩ সালের গ্রীষ্মকালে আচমকা আমার মনে হল পৃথিবীর সব সমস্যাই বুঝি আমার মাথায় ভেঙে পড়েছে।
চল্লিশ বছর ধরে আমি এক স্বাভাবিক, সাধারণ জীবন যাপন করে এসেছিলাম। আমি এক ব্যবসায়ী Rষ ছোটোখাটো সমস্যা যে আসত না তা নয়–তবে সেসব আমি সামলাতে পারতাম। কিন্তু আচমা আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ছটা মারাত্মক সমস্যা দেখা দিল। প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা হতে লাগল আমার। প্রথমত আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়ার মুখে এসে দাঁড়ায় কারণ ছাত্ররা সবাই যুদ্ধে যোগ দতে গেন। মেয়েরাও যুদ্ধের সরঞ্জাম উৎপাদনের কাজে লাগল। আমার ছেলেও যুদ্ধে যাওয়ায় বাবা মার যা চিন্তা আমারও তাই হল।
আমার বাড়ির জলের কুয়োটা শুকিয়ে এসেছিল। আমি জানতাম নতুন কুয়ো বসানো কতটা ব্যয় সাধ্য অন্তত খরচ হবে পাঁচশ ডলার।
আমার বড় মেয়ে হাইস্কুল থেকে পাশ করে বেরিয়েছিল। তার কলেজে যাওয়ার ইচ্ছা–কিন্তু অত টাকা পাব কোথায়? আমি জানতাম, না যেতে পারলে দুঃখে তার বুক ভেঙে যাবে।
একদিন সন্ধ্যায় অফিসে এসে ভাবনায় তলিয়ে গেলাম। আমার দুশ্চিন্তা তাতে বাড়ল বই কমল না। আমার সব সমস্যার কথা লিখে ফেলোম। আমি জানতাম রাতারাতি এসব সমস্যা মেটার কোনো আশা নেই। তাই ভাবতে লাগলাম আমার এইসব সমস্যার কতখানি মোকাবিলা বর্তমান অবস্থায় করতে পারব। কতখানি লাভ ওই সমস্যায় পেতে পারি।
এইভাবেই ছটা মাস কেটে গেল। আমি ক্রমে ভুলেই গেলাম আমার সামনে ওই সমস্যা আছে। হমাস পরে আগের লেখা কাগজখানা আমার হাতে পড়লে সেটা পড়ে ফেলোম।
আমার সমস্যাগুলো কাটল এইভাবে :
আমি আমার কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় করছিলাম। অথচ দেখলাম এসব কলেজকে সরকার বয় শিক্ষার কেন্দ্র করে তোলার ব্যবস্থা করলেন আর আমার কলেজেও ছাত্রে ভরে গেল।
ছেলের ব্যাপারেও দেখলাম আমার দুশ্চিন্তার কারণ ছিল না। সে যুদ্ধ থেকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসে
বাড়ির কুয়ো নিয়ে ভাবনাও কেটে গেল। আমার মেয়েও কলেজে সহজেই ভর্তি হয়ে পড়াশুনা করতে লাগল।
এই কারণেই আমার পরিচিত সকলকেই বলি, যে–সব ব্যাপার নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়ি তার শতকরা নিরানব্বই ভাগই ঘটে না।
এবার রোজার ডব্লিউ, ব্যাবসনের (বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ) তার কাহিনী শুনুন।
আমি যখন দেখি বর্তমান কোনো অবস্থায় অবসাদগ্রস্ত আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি, আমি সহজেই সব দুশ্চিন্তা দূর করতে পারি।
কীভাবে যা করি গুনুন। আমার পাঠাগারে ঢুকে চোখ বুজে ফেলি–তারপর কোনো একটা বইয়ের তাকের কাছে এগিয়ে যাই। ওই তাকটা ইতিহাসের বইয়ে ঠাসা। এরপর চোখ বুজেই যে–কোনো একখানা বই টেনে নিই, আর সেইভাবেই বইটা খুলে ফেলি। তারপর চোখ খুলে একঘণ্টা ধরে বইখানা পড়ে চলি। যতই পড়ি ততই উপলব্ধি করি পৃথিবীর বুকে কী যন্ত্রণা ছিল সেকালে। সভ্যতা কীভাবে টলায়মান অবস্থায় ছিল। ইতিহাসের পাতায় শুধু ছড়িয়ে আছে বিয়োগান্ত সব যুদ্ধের বর্ণনা, দুর্ভিক্ষ দারিদ। অত্যাচার আর মানুষের প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতার বিবরণ। একঘন্টা এইভাবে ইতিহাস পাঠ করে আমি বুঝতে পারি যে এখনকার অবস্থা খারাপ হলেও সেকালের তুলনায় তা কত ভালো। এই চিন্তায় আমাকে বর্তমানের অবস্থা মোকাবিলা করার সাহস এনে দেয়। আমি বুঝতে পারি পৃথিবী এগিয়ে চলেক, আরও ভালো হচ্ছে।
পাঁচটি উপায়ে আমি আমার দুশ্চিন্তা দূর করেছিলাম।–বলেছিলেন প্রফেসর ইউলিয়াম লিও ফেলপস।
তার কাহিনী শুনুন এবার :
আমার চব্বিশ বছর বয়সে আচমকা আমার দৃষ্টিশক্তি হারাতে বসেছিলাম। তিন চার মিনিট বই পড়লেই মনে হত চোখে কেউ সুঁচ ফুটিয়ে দিচ্ছে, বই না পড়লেও অনুভূতিটা আমায় পাগল করতে শুরু করে। নিউইয়র্কের সেরা চোখের চিকিৎসককে দেখালাম কিন্তু কোনো উপকার হল না। বিকেল সাড়ে চারটা বাজলেই শোবার কথা ভাবতাম। প্রচণ্ড ভীত হয়ে উঠলাম আমি। ভাবলাম শিক্ষকের কাজ ছেড়ে হয়তো মজুরের কাজই আমায় নিতে হবে। তারপরেই একটা আশ্চর্যজনক ব্যাপার ঘটে গেল—শারীরিক যন্ত্রণার উপর মনের প্রতিক্রিয়া কত সেটা টের পেলাম। আমার চোখের অবস্থা যখন প্রচণ্ড খারাপ তখনই কিছু আণ্ডার গ্র্যাজুয়েটদের সামনে বক্তৃতা দেবার আহ্বান পেলাম। হল ঘর খানায় গ্যাসের ঝোলানো আলো থাকায় চোখে এতই যন্ত্রণা বোধ করছিলাম যে মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। অথচ আশ্চর্য কথা যে আধঘন্টা বক্তৃতা করলাম ততক্ষণ চোখে কোন যন্ত্রণা ছিল না। আমার বক্তৃতা শেষ হতেই আবার যন্ত্রণা শুরু হল।
আমি বুঝলাম কোনো কাজে অন্যমনষ্ক থাকলে আমার যন্ত্রণা থাকবে না। হয়তো তাতে সেরে উঠব। নিঃসন্দেহে এ রোগ শরীরের উপর মনের।
আমি তাই অন্যমনষ্ক থাকার চেষ্টা করতে লাগলাম। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই অবাক হয়ে দেখলাম রোগ সেরে গেছে।
আমি এরপর থেকে নিচের পাঁচটি উপায়ে দুশ্চিন্তা দূর করতাম :
১. প্রতিদিন আমি বাঁচার মতোই বাঁচতে চাইতাম–সব কিছুরই তাই শেষ দেখতে চাইতাম।
২. যখনই কোনোরকম অবসাদে ভেঙে পড়তাম …সেই সময় ডেভিড অ্যালেক উইলসনের প্রেরণাদায়ক ‘কার্লাইলের জীবনী’ …বইয়ে এমনই মশুগুল হয়ে পড়তাম যে আমার সমস্ত দুশ্চিন্তার
কথাই ভুলে যেতাম।
৩. যখনই কোনো কারণে
মন ভালো থাকত না তখন শারীরিক পরিশ্রমের খেলায় অংশ
নিতাম।
৪. কাজ করতে করতে বিশ্রাম নেয়াই আমার নীতি।
এতেই আমার সব অবসাদ কেটে যায়।
৫. আমি সবসময় সমস্যাকে
তারই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করতে চাই। দুমাস পরে যখন এ ব্যাপারে নিয়ে ভাবতে হবে তখন এই মুহূর্তে তা নিয়ে ভাবব কেন?
এবার আর. ভি. সি. বড়লের উদ্ধৃতি দিচ্ছি :
১৯১৮ সালে পৃথিবীর সবকিছুকেই আমি এড়িয়ে চলতে আরম্ভ করেছিলাম। এইসময় আমি আমেরিকা ছেড়ে চলে যাই পশ্চিম আফ্রিকায়, আর সেখানে গিয়ে আরবদের মধ্যে বাস করতে শুরু করি । সেখানে বাস করি প্রায় সাত বছর। থাকতে থাকতে ওখানকার যাযাবর মানুষদের ভাষাও আমি আয়ত্ত করে নিই। শুধু তাই নয়, তাদের পোশাকও পরতে আরম্ভ করি। তাদের মতো খাদ্যাভ্যাসও গড়ে তুলে তাদের জীবনধারণের নিয়মও মানতে থাকি। গত বিংশ শতাব্দী ধরে ওদের জীবনধারার কণামাত্রও পরিবর্তন ঘটে নি। ভেড়ার পালের মালিক হয়ে আমি ওদেরই মতো তাঁবুর মধ্যে মেঝেয় শুয়ে রাত কাটাতাম। বেশ মনোযোগ দিয়ে আমি দিয়ে ওদের ধর্মও লক্ষ করতে থাকি। এরপর আমি একটা বইও এ–সম্পর্কে লিখে ফেলি। বইয়ের নাম দি মেসেঞ্জার।
আমার বলতে কোনো বাধা নেই যে, ওই সাতটা বছরই হল আমার জীবনের সবচেয়ে শান্তিময় আর নিরবচ্ছিন্ন আনন্দের দিন।
আমার জীবনে বেশ ভালোরকম অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ ইতোমধ্যেই ঘটেছিল। আমার জন্ম প্যারি শহরে। আমার বাবা মা ইংরাজ। ফ্রান্সে আমি প্রায় নয় বছর বাস করেছিলাম। এরপর আমি ইটনে পড়াশোনা করি, পরে স্যান্ডহারে সেনা কলেজে। এরপর ব্রিটিশ সেনাদলের একজন সামরিক অফিসার হিসেবে আমি ভারতে যাই। ভারতে গিয়ে পোলো খেলে, শিকার করে, হিমালয় পর্বতের আনাচে কানাচে ঘুরে বেশ ভালভাবেই আমার সময় কেটেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ গ্রহণও আমি করি তারপর প্যারির শান্তি আলোচনাতে সামরিক অ্যাটাশে হয়ে অংশ নিই। সেখানে যা দেখি তাতে নিদারুণ আঘাত পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে যাই। চার চারটি বছর ধরে পশ্চিমী রণাঙ্গনে কশাই খানার মতো হত্যাকাণ্ড চালানোর পর মনে করেছিলাম মানষ বুঝি সভ্যতাকে বাঁচানোর জন্য লড়াই করতে চাইছে। কিন্তু প্যারির শান্তি আলোচনায়। আমি দেখলাম স্বার্থপর মানুষ আর তথাকথিত রাজনৈতিক নেতারা কীভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ বপন করে চলেছিলেন–প্রত্যেক দেশ তাদের নিজেদের স্বার্থে ঘা পড়ছিল তাই দখল করে চলেছিল। এই জঘন্য কাজের ফলশ্রুতিতে জন্ম নিতে চলেছিল জাতীয় বিরোধিতা আর গোপন কুটনৈতিক চাল এবং ষড়যন্ত্র।
যুদ্ধ, সেনাবাহিনী, সমাজ সবকিছুতেই আমার ঘৃণা জমে গেল। জীবনে এই প্রথম আমাকে নিদাবিহীন রাত কাটাতে হল, কী করব আমি ঠিক করে উঠতে পারলাম না। লয়েড জর্জ আমাকে বললেন রাজনীতি করতে। তাঁর উপদেশ অনুযায়ী কাজকরব ভাবার সময়েই একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। আর ঠিক তারই ফলে পরের সাত বছরের জন্য আমার জীবনটাই বদলে গেল। উড লরেন্স অর্থাৎ লরেন্স অব অ্যারবিয়ার সঙ্গে কয়েক সেকেন্ডের কথাতেই সেটা ঘটে গেল। লরেন্স প্রথম বিশ্বয় করে, আশ্চর্য প্রতীক। আরব দেশেই তার কাজ আর জীবন কেটেছে। তিনি আমাকেও তাই করতে বললেন,
যাই হোক আমি সেনাবাহিনী ত্যাগ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। অন্য কেউ তো আমায় নোবে না, তাই লরেন্সের কথা মতই আরব দেশে চলে গেলাম আর ওদের মধ্যেই জীবন কাটাতে চাইলাম। ওরা জীবনকে সর্ব শক্তিমানের নির্দেশ বলেই ভাবে অযথা দুশ্চিন্তা করে না। আমাকে ওরা তাই করতে বলল। তবে বিপদের সময় তারা সাহসের সঙ্গেই তাকে মোকাবিলা করে। একবার সাহারায় প্রচণ্ড ঝাতেও তাই হয়। প্রচণ্ড সেই ঝাতেও তারা হাল ছাড়েনি। বহু ভেড়া মারা যায় তাদের, তবুও তারা ভেঙে পড়ে নি।
আর একবার মোটরে মরুভূমি পার হওয়ার সময় দেখা যায় তেল কম নেওয়া হয়েছে। আমি শঙ্কিত হয়ে উঠি কিন্তু আরবরা বলে ওঠে, ভয় পেও না, এটাই সর্ব শক্তিমানের ইচ্ছা। যা হওয়ার তাই হবে। এরপর আমাদের হেঁটে ফিরতে হয় কিন্তু ওরা ভেঙে পড়েনি। গান গাইতে গাইতেই সকলে দীঘ ওই মরুপথ অতিক্রম করে।
যে সাত বছর আমি সাহারায় ওদের সঙ্গে কাটাই সেই সময়ই আমার জীবনের সেরা সময়। যতদিন আমি সেখানে ছিলাম আমার কোন দুশ্চিন্তাই ছিল না। অনেকে বলেন দুর্ভাগ্যকে মেনে নেওয়া দুর্বলতা। হয়তো তাই, বা তাই নয়। তবে আমার জীবনেই আমি উপলব্ধি করেছি যে হাজার ওষুধ খেয়েও যে অবস্থা আমি পাইনি, সাত বছর সাহারায় থেকে আমি তাই পেয়েছি।