সমালোচনা আপনাকে স্পর্শ করবে না
আমি একবার মেজর জেনারেল স্মেডলি বাটলারের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। নানা বিশেষণেই তিনি ভূষিত হন। তাঁর কথা শুনেছেন তো? তিনি ছিলেন আমেরিকার নৌবাহিনীর ইতিহাসে সবচেয়ে খ্যাতনামা আর আঁকজমকপূর্ণ সেনাপতি।
তিনি আমায় বলেছিলেন যে তাঁর যখন বয়স কম ছিলো খুব জনপ্রিয় হবার দারুণ চেষ্টা করতেন আর প্রত্যেকের উপর প্রভাব বিস্তারের আগ্রহ পোষণ করতেন। তখনকার দিনে সামান্য সমালোচনাও আঘাত লাগতো আর হুল ফোঁটাতে চাইতো। তবে তিনি স্বীকার করেন যে নৌবাহিনীতে ত্রিশ বছর কাটানোর ফলে তার চামড়া বেশ পুরু হয়ে উঠেছিলো। তিনি বলেছিলেন, আমাকে অপমান করে, নিন্দা করা হয়েছিলো আর হলদে কুকুর, সাপ এবং অন্যান্য জানোয়ারের সঙ্গে তুলনাও করা হয়। বিশেষজ্ঞরা আমায় নিন্দা করেন। ইংরাজী ভাষায় যতরকম ছাপার অযোগ্য খারাপ কথা আছে সবই আমায় বলা হয়। এতে আমি ভাবনায় পড়ি ভাবছেন? ফুঃ! এখন কেউ আমাকে গাল দিতে চাইলেও আমি ঘাড় ফিরিয়ে দেখি না কে কথাটা বলছে।
তীক্ষ্ম–দৃষ্টিসম্পন্ন বাটলার হয়তো সমালোচনা গ্রাহ্য করতেন না, তবে একটা কথা নিশ্চিত, আমাদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষই ছোটোখাটো মন্তব্য আর ব্যঙ্গ বিদ্রুপে বড় বেশি রকম বিচলিত বোধ করি । আমার বেশ ক’ বছর আগেকার কথাটা মনে পড়ছে, যখন নিউ ইয়র্ক সানের একজন রিপোর্টার আমার বয়স্ক শিক্ষার ক্লাসে এসে সব দেখে কাগজে ব্যঙ্গ করে জঘন্য সব কথা লেখেন। আমি কি ক্ষেপে গিয়েছিলাম? আমি ব্যাপারটাকে ব্যক্তিগত অপমান বলেই ভেবেছিলাম। আমি টেলিফোন করে সানের কার্যকরী কমিটির চেয়ারম্যান গিল হাজেসকে প্রায় দাবী জানাই তিনি যেন সব ঘটনার বর্ণনা দিয়ে একটা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন–আর মস্করা না করেন। আমি মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করি এই অপরাধের উপযুক্ত শাস্তিদান করবোই।
আজ অবশ্য আমি আমার সেদিনের কাজের জন্য লজ্জাবোধ করি। এখন বুঝতে পারি ওই কাগজ যারা কেনে তারা ওই প্রবন্ধটা হয়তো চোখেই দেখেনি। যারা কাগজ পড়েছে তাদেরও অর্ধেক বোধহয় ব্যাপারটাকে নিছক আমোদ বলেই ভেবেছিলেন। আবার যে অর্ধেক সেটা পড়ে হেসে মজা পান তারাও আবার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তা ভুলেও যান।
এখন বুঝতে পারি মানুষ আমার বা আপনার সম্বন্ধে ভাবে না বা সেটা গ্রাহ্য করে না। তারা কেবল নিজেদের কথাটাই ভেবে চলে–প্রাতরাশের আগে, প্রাতরাশের পরে, বা মাঝরাতের দশ মিনিট আগে বা ঠিক পরেও। আমার বা আপনার মৃত্যুর খবরের চেয়েও তাদের প্রায় হাজার গুণ বেশি ভাবনা নিজেদের সামান্য মাথা ব্যথা নিয়ে।
যদি আপনার বা আমার সম্পর্কে মিথ্যা কথা ছড়ানো হয়, ঠাট্টা করা হয় ঠকানো হয়, অথবা পিঠে ছুরি মারা হয়, হয়তো বা আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের প্রতি ছ’জনের মধ্যে একজন যদি আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে–তাহলেও যেন আমরা আত্মধিক্কারে অস্থির হয়ে না পড়ি। তার বদলে আসন আমরা মনে মনে যীশু খ্রীষ্টের কথাই ভাবি–কারণ তার ভাগ্যে ঠিক এমনটাই ঘটেছিলো। তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের মধ্যে একজন সামান্য টাকার বিনিময়ে–আজকের টাকার হিসেবে মাত্র উনিশ ডলারের ঘষ নিয়ে তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। তার বারোজন বন্ধুর মধ্যে একজন, যীশু বিপদে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ত্যাগ করে তিনবার বলে দেয় সে যীশুকে চেনে না–কথাটা সে শপথ নিয়ে বলে । ঠিক ছ’জনের মধ্যে একজন। ঠিক এই রকম ঘটে যায় যীশুর জীবনেও। আমি বা আপনি এরচেয়ে আর ভালো আশা করি কেমন করে?
বেশ কয়েক বছর আগেই আমি আবিষ্কার করি যে মানুষের অন্যায়ভাবে আমাকে সমালোচনা করা বন্ধ করতে পারি না বটে–তবে একটা ব্যাপার অবশ্যই বন্ধ করতে পারি, তাহলে অন্যায় সমালোচনা শুনে দুশ্চিন্তা করা। আমি নিশ্চিয়ই ঠিক করতে পারি অন্যায় এই নিন্দাবাদে আমি চিন্তায় পড়বো কিনা।
ব্যাপারটা পরিষ্কার করেই বলি। আমি এর মধ্য দিয়ে সবরকম সমালোচনা আগ্ৰহ্য করার কথা বলছি । একেবারেই না। আমি শুধু অন্যায় সমালোচনা অগ্রাহ্য করতে বলছি। আমি একবার এলিনর রুজভেল্টের কাছে জানতে চেয়েছিলাম অন্যায় সমালোচনার তিনি কীভাবে মোকাবিলা করেন। আর ঈশ্বর জানেন এমন জিনিস তাকে কত সহ্য করতে হতো। হোয়াইট হাউসে যত মহিলা বাস করেছেন তার মধ্যে তারই বোধ হয় সবার চেয়ে বেশি বন্ধু আর সাংঘাতিক রকম শত্রু ছিল।
তিনি আমায় বলেন অল্পবয়সে তিনি সাংঘাতিক লাজুক মেয়ে ছিলেন। তাঁর খালি ভয় হতো লোকে কি বলবে । সমালোচনা সম্বন্ধে তার এমনই ভয় ছিলো যে একদিন তিনি তাঁর কাকিমা, থিয়োডোর রুজভেল্টের বোনের কাছে এব্যাপারে পরামর্শ চাইলেন। তিনি যা জানতে চেয়েছিলেন সেটা এই রকম : কাকিমা, আমি যা কাজ করতে যাই খালি ভয় হয় লোকে কী বলবে।
তার কাকিমা তার মুখের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন : লোকে কী বলবে তা নিয়ে মোটেও ভাববে, যতক্ষণ তুমি জানো যে তুমি ঠিক পথেই আছো। এলিনর রুজভেল্ট আমায় বলেছেন যে ওই পরামর্শই তার পরবর্তী হোয়াইট হাউসের জীবনে একেবারে একটা শক্ত ভিত হয়ে দাঁড়ায়। তিনি আমাকে আরও বলেছিলেন সমালোচনায় কান না দেওয়ার একটা পথ হলো চীনা মাটির মূর্তি যেমন আলমারীর তাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সেই ভাবে থাকা। তার পরামর্শ ছিল এইরকম : নিজের মনে যা ঠিক বলে মনে হয় তাই করবে–কারণ তোমার সমালোচনা করা হবেই। কাজ করলেও লোকে তোমার সমালোচনা করবে–আবার না করলেও তাই।
প্রয়াত ম্যথুসি ব্রাস ছিলেন ওয়ান স্ট্রীটের আমেরিকান ইন্টার ন্যাশনাল কর্পোরেশনের প্রেসিডেন্ট। আমি তাকে একবার প্রশ্ন করেছিলাম তিনি কোনদিন সমালোচনায় চিন্তিত হতেন কিনা। তিনি জবাব দেন : হ্যাঁ, ছোটবেলায় আমি এ ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর ছিলাম। তখন ভাবতাম আমার প্রতিষ্ঠানের সব কারই মনে করুক আমি ঠিক মানুষ। তারা না ভাবলেই আমার দুশ্চিন্তা হতো। কোন মানুষ আমার বিরুদ্ধে গেলেই আমি তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতাম, কিন্তু তাতে আবার আর একজন ক্ষেপে যেতে! এতে বুঝলাম যতই একজনকে সন্তুষ্ট করতে চাইবো ততই অন্যের অসন্তোষ বাড়বে। আমি শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করলাম যে আমি যতই মনের অসন্তোষ দূর করে কাউকে সুখী করার চেষ্টা করলাম, ততই আমি নিশ্চিন্ত হলাম আমি শত্রু সংখ্যা বাড়িয়ে তুলছি। তাই নিজেকেই শেষ অবধি বললাম : তুমি যনি সাধারণের মাথার উপর মাথা তুলে থাকার চেষ্টা করো ততই সমালোচনার সামনে পড়তে হবে। অতএব সমালোচনায় অভ্যস্ত হতে থাকে। এটা আমাকে দারুণ সাহায্য করেছে। এরপর থেকে যতটা ভালো হওয়া যায় তাই হতে চেষ্টা করলাম এবং তারপরেই আমি আমার পুরনো ছাতাটা মাথায় মেলে ধরবে। তাহলে সমালোচনার বৃষ্টিধারায় আর শরীর ভিজবে না।
জেমস টেলর এ ব্যাপারে আর একটু এগিয়ে ছিলেন। তিনি সমালোচনার ধারায় অবগাহন করতেন আর প্রকাশ্যে হেসে সব উড়িয়ে দিতেন। তিনি প্রত্যেক রবিবারের বিকেলে বেতারে নিউ ইয়র্কের সিম্ফনি অষ্টোর সঙ্গীত–বিরামের উপর নানা রকম কথিকা প্রচার করতেন। এক মহিলা তাকে চিঠি লিখে চোর, বিশ্বাসঘাতক, সাপ আর নানা সম্বোধনে ভূষিত করেন। মিঃ টেলর তার অব মেন অ্যান্ড মিউজিক গ্রন্থে বলেছে : আমার সন্দেহ ভদ্রমহিলা আমার বক্তৃতা পছন্দ করতেন না। মিঃ টেলর পরের রবিবার বেতার ভাষণের সময় চিঠিটার উল্লেখ করলেন আর আবার সেই মহিলার কাছ থেকে চিঠি পেলেন চোর, সাপ, বিশাসঘাতক বলে। যিনি সমালোচনাকে এমন ভাবে নিতে পারেন তাকে প্রশংসা না করে সত্যিই পারা যায় না। আমাদের চোখে পড়ে তার প্রশান্তি, অবিচলিত মনোভাব আর তার হাস্যরসবোধ।
চালস শোয়ার যখন প্রিন্সটনে ছাত্রদের কাছে বক্তৃতা দিতেন তখন তিনি স্বীকার করেছিলেন যে জীবনে তিনি যে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা লাভ করেন সেটা তিনি পেয়েছিলেন তার ইস্পাত কারখানার একজন বৃদ্ধ জার্মানের কাছে। এই বদ্ধ জার্মানের সাথে তার সহকর্মীদের যুদ্ধের আমলের কিছু কথাবার্তা নিয়ে তর্কাতর্কি বেধে যায় । সে আমার কাছে আসে, শোয়াব লিখেছিলেন, তার সারা গায়ে কাদা আর জল মাখামাখি। আমি ওকে হিফাসা করলাম, সে কি এমন বলেছে যাতে তাকে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে ওরা? সে জবাব দিয়েছিলো : আমি কেবল হেসেছিলাম।
মিঃ শোয়াব স্বীকার করেছেন যে তিনিও ওই বৃদ্ধ জার্মানের নীতিই গ্রহণ করেছেন–শুধু হেসে ফেলা।
এই নীতি বিশেষ করেই ভালো, যখন আপনি অন্যায় সমালোচনার শিকার হবেন। যে আর কথায় জবাব দেয় তার কথার উত্তর আপনি দিতে পারেন, কিন্তু যে কেবল হাসে, তাকে কি জবাব দেবেন,
লিঙ্কন বোধহয় ভেঙে পড়তেন, গৃহযুদ্ধের সময়কার প্রচণ্ড চাপের সময় তাঁকে যে রকম বিষাক্ত সমালোচনা করা হতো তার যদি উত্তর দিতে হতো। এটা যে চরম বোকামি তা তিনি শিখেছিলেন। তাঁর সমালোচকদের তিনি কিভাবে মোকাবিলা করতেন তার বর্ণনা সাহিত্যের দুনিয়ায় একরকম রত্নের মতই হয়ে আছে। জেনারেল ম্যাক আর্থার যুদ্ধের সময় এটা তাঁর সদর দপ্তরের ডেস্কে সাজিয়ে রাখতেন। উইনস্টন চার্চিল এটা তার চার্টওয়েলের পাঠকক্ষে দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখতেন। এটা ছিল এই রকম : আমাকে আক্রমণ করে যা লেখা হয় সেগুলো যদি আমি পড়ার চেষ্টা করি, উত্তর দেওয়া তো দূরের কথা তাহলে এজায়গাটা বন্ধ করেই দেওয়া উচিত আমার অন্য কাজের জন্য। আমি সবচেয়ে ভালো কাজটি করার কৌশল আয়ত্ত করেছি আর তাই করে চলেছি–সবচেয়ে ভালো কাজ, আর আমি এই ভাবেই শেষ পর্যন্ত কাজ করে যাওয়ার আশা রাখি। যদি শেষ পর্যন্ত আমি সঠিক বলেই প্রমাণিত হতে পারি তাহলে আমার বিরুদ্ধে যা বলা হবে তাতে কিছুই যায় আসে না। শেষে যদি আমি ভুল বলে প্রমাণিত হই তাহলে দশজন দেবদূতের সাক্ষ্যতেও আমি ঠিক প্রমাণিত হলে কিছু তারতম্য হবে না।
আপনি বা আমি যখন অন্যায় সমালোচনার মুখোমুখি হব তখন এই নীতিটা মনে রাখা উচিত :
সবচেয়ে ভালো যা করা সম্ভব করুন তারপর আপনার পুরানো ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়ে সমালোচনা বৃষ্টির হাত থেকে আত্মরক্ষা করুন।