যে নীতিতে অনেক দুশ্চিন্তা দূর হয়
ছোটবেলায় আমি মানুষ হই মিসৌরীর এক খামারে । একদিন মাকে চেরীফল তুলতে সাহায্য করতে গিয়ে আমি কাঁদছিলাম। মা জিজ্ঞেস করলেন, কাঁদছ কেন ডেল? আমি কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিলাম, আমার মনে হচ্ছে আমার জ্যান্ত অবস্থায় কবর ঘটবে!
সে সময় আমার নানা দুশ্চিন্তা ছিল । ঝড় বৃষ্টি হলে ভয় লাগতো বজ্রপাতে মারা যাবো। অভাব এলে মনে হত, না খেয়েই মরতে হবে। ভয় লাগতো মরে বোধ হয় নরকেই যাবো। দারুণ ভয় পেতাম আমার চেয়ে বয়সে বড় স্যাম হোয়াইট যখন বলতো আমার বড় বড় কান দুটো সে কেটে নেবে। টপি তললে মেয়েরা আমায় দেখে হাসবে তাই ভেবেও ভয়ে পেতাম। কোন মেয়ে আমাকে বিয়ে করবে না ভেবেও ভীত হতাম। আরও ভয় লাগতো, ঠিক বিয়ের পর বউকে কি কথা বলবো ভেবেও। এই সব নানা অকিঞ্চিৎকর দুশ্চিন্তা আর ভয় আমায় পেয়ে বসত। কিন্তু অনেক বছর পরে দেখলাম, যে সব ভয় আমি করতাম তার শতকরা নিরানব্বই ভাগই ঘটেনি।
যেমন বজ্রপাত সম্পর্কে ভয় পেতাম। কিন্তু এখন জানি বাজপড়ে মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা আমার সাড়ে তিন লক্ষ ভাগে মাত্র এক। আমার জ্যান্ত অবস্থায় কবর হওয়া আরও হাস্যকর–এককোটিতে একজনই মাত্র। অথচ এই নিয়ে আমার ভাবনা ছিল।
প্রতি আটজনে একজন ক্যান্সারে মারা যায়–তাই যদি ভয় পেতে হত তালে ক্যান্সারে ভয় পাওয়াই সঙ্গত ছিলো। বাজ পড়ে বা জ্যান্ত কবর হওয়ার জন্য নয়।
আমি শিশু আর বাল্যকালের দুশ্চিন্তার কথাই বলছি। তবে বয়স্কদেরও অনেক ক্ষেত্রে হাস্যকর রকম ভয় জাসে; আপনি বা আমি এখনই গড়পড়তার নিয়মের মধ্য দিয়ে দেখে নিতে পারি আমাদের দুশ্চিন্তার সত্যিই কারণ আছে কিনা।
বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বীমা কোম্পানি লন্ডনের লয়েডস বিনা কারণে মানুষের দুশ্চিন্তায় নির্ভর করেই কোটি কোটি টাকা আয় করেছে। লয়েডস বাজী ধরে মানুষকে বলে তারা যে বিপদের ভয় করে তা আদৌ ঘটবে না। অবশ্য ব্যাপারটাকে তারা বাজী ধরা বলেন না, বলেন বীমা করা। আসলে ব্যাপারটা গড়পড়তার নীতিতে কার্যকর। এই প্রতিষ্ঠান দুশো বছর ধরে চলেছে, আর মানুষের প্রকৃতির যদি বদল না ঘটে তবে আরও পঞ্চাশ শতাব্দীই চলতে থাকবে। এই ভাবেই মানুষ জুতো থেকে আরম্ভ করে জাহাজ পর্যন্ত বীমা করে যাবে।
.
আমরা যদি গড়পড়তার নিয়মটা ভালো মত পরীক্ষা করি তাহলে যা দেখব তাতে হতবাক হয়ে যাবো। ধরা যাক, আমি যদি জানি আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমাকে গেটিসবার্গের যুদ্ধের মত রক্তাক্ত লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়তে হবে তাহলে আমি ঘাবড়ে যাব । তাহলে যতটা পারি বীমা করিয়ে উইলও করে ফেলবো। আমি বলতে চাইবো, এ যুদ্ধ থেকে আমার বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা বেশ কম–এতএব যতদিন সময় আছে সব গুছিয়ে ফেলি। অথচ ব্যাপারটা হল গড়পড়তার নিয়মে শান্তির সময়ে পঞ্চান্ন বছর বাচা যতটা বিপদজনক গেটিসবার্গ যুদ্ধের সময়েও তাই ছিল। যা বলতে চাই তা হল, শান্তির সময়েও পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন বছরে যত মানুষ মারা যায় গেটিসবার্গ যুদ্ধের ১,৬৩,০০০ সৈন্যের মধ্যে প্রতি পাঁচ হাজারে সেই সংখ্যাই মারা পড়ে।
কানাডার রকি অঞ্চলে বো হ্রদের কাছে জেমস সিমসনের লজে বসে এ বইয়ের কয়েকটা পরিচ্ছেদ আমি লিখি । সেখানে আমার সঙ্গে দেখা হয় মিঃ আর মিসেস হার্বার্ট এইচ, স্যালিঙ্গারেরা। মিসেস স্যালিঙ্গারের শান্ত, সমাহিত ভঙ্গী দেখে ভেবেছিলাম জীবনে তিনি দুশ্চিন্তা করেননি। তিনি কখনও দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন কিনা জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দেন : দুশ্চিন্তা করেছি কিনা? এজন্য আমার জীবনই নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। দুশ্চিন্তা যতদিন জয় করতে পারিনি সেই এগরো বছর নিজের তৈরি নরকবাস করেছি। আমি খিটখিটে আর বদমেজাজী হয়ে উঠি। সব সময় সন্ত্রস্ত থাকতাম। প্রতিদিন বাসে চড়ে স্যানফ্রান্সিসকোয় বাজার করতে আসতাম, তখনও আমার উদ্বেগের শেষ থাকতো না। যদি ইস্ত্রিটায় প্লাগ খুলে না এসে থাকি? যদি বাড়িতে আগুন লেগে যায়? কিংবা ঝি হয়তো ছেলে মেয়েদের ফেলে চলে গেছে। কেনাকাটার মধ্যেও আমি দুশ্চিন্তায় ঘামতে থাকতাম। আমার প্রথম বিয়ে ব্যর্থ হয় এতে অবাক হবার কিছু নেই।
আমার দ্বিতীয় স্বামী একজন আইনজীবী…অত্যন্ত শান্ত বিশ্লেষক মনের মানুষ, যিনি কিছুতেই দুশ্চিন্তা করেন না। আমি যখনই চিন্তিত আর উদ্বিগ্ন হই, তিনি বলেন, শান্ত থাকো ব্যাপারটা ভাবা যাক…কি নিয়ে দুশ্চিন্তা করছো? গড়পড়তা নিয়মটা দেখা যাক, এসো। তাতেই বোঝা যাবে এটা হতে পারে কি না।
একটা উদাহরণ দিচ্ছি। আমার মনে আছে একবার নিউ মেক্সিকোর আলবুকার্ক থেকে কার্লসবার্ড ক্যাভার্নে ধুলোয় ভরা রাস্তায় গাড়িতে চলেছিলাম। আচমকা জোর বৃষ্টি শুরু হল।
গাড়িটা পিছলে যেতে লাগল–সেটাকে কিছুতেই বাগ মানানো যাচ্ছিল না। আমি নিশ্চিত হলাম গাড়িটা পাশের খাদে পড়ে যাবে, কিন্তু আমার স্বামী শান্তভঙ্গীতে বলতে লাগলেন : আমি অত্যন্ত আস্তে গাড়ি চালাচ্ছি, ভয়ের কিছু নেই। গাড়িটা খাদে পড়লেও গড়পড়তা নিয়ম অনুযায়ী আমাদের আঘাত লাগবে না। তার শান্তভঙ্গীতে আমি শান্ত হলাম।
এক গ্রীষ্মে আমরা কানাডিয়ান রকি পাহাড়ের টুকিন উপত্যকায় তাঁবুতে কাটাই। সমুদ্র থেকে সাত হাজার ফিট উঁচুতে একরাতে আমরা ছিলাম–হঠাৎ ঝড় উঠে তাঁবুগুলো প্রায় উড়িয়ে নিচ্ছিল টকবো টুকরো করে। আমার স্বামী আমার প্রচণ্ড ভয় লক্ষ্য করে বললেন : দেখ, ভয় পেয়োনা, আমাদের পথ প্রদর্শকরা জানে এ সময় কি করতে হয়। ওরা বহু বছর ধরে তাবু ফেলে আসছে, ঝড়ে কখনও সেগুলো ওড়েনি আর গড়পড়তার নিয়মে আজও তা হবে না। আর তা যদি হয় তাহলে অন্য তাঁবুতে কাটানো যাবে, অতএব শান্ত হওয়। আমি তাই করলাম, আর বাকি রাত শান্তিতে কাটালাম।
কয়েক বছর আগে ক্যালিফোর্নিয়ায় শিশু–পক্ষাঘাত মহামারী হয়ে দেখা দিয়েছিল। আমি ভয়ে পাগল হয়ে যাই। আমার স্বামী আমাকে শান্ত থাকতে বলেন। আমরা ছেলেমেয়েদের সম্বন্ধে যথাসাধ্য সাবধানতা নিই। বোর্ড অব হেলথের সঙ্গে কথা বলার পর বুঝি, গড়পড়তা নিয়মে এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। সাধারণ সময়েও এমন হয়।
গড়পড়তা নিয়মে এটা ঘটবে না। এই কথাটাই আমার দুশ্চিন্তার শতকরা নব্বই ভাগই দূর করেছে আর আমার গত বিশ বছরের জীবনে আশাতীত আনন্দ এনে দিয়েছে।
জেনারেল জর্জ ক্রুক–যিনি আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত রেড ইন্ডিয়ান গবেষক, তিনি তার আত্মজীবনীর ৭৭ পাতায় বলেছেন : ইন্ডিয়ানদের সমস্ত দুশ্চিন্তা আর অসুখীভাবের কারণ তাদের কল্পনা প্রসূত, বাস্তব নয়।
অতীতের দিকে তাকালে বুঝতে পারি আমার দুশ্চিন্তারও কারণ তাই, কথাটা বলেছিলেন নিউইয়র্কের জেমস এ গ্র্যান্ট ডিষ্ট্রিবিউটিং কোম্পানির মালিক জিম গ্র্যান্ট । তিনি একবার প্রায় পনেরোটি ট্রাক বোঝাই কমলালেবু আর আঙুর আমদানি করেন। তিনি বলেছিলেন প্রায়ই তিনি নানা দুশ্চিন্তা করতেন। যেমন : যদি ট্রেন দুর্ঘটনা হয়? যদি সব রোগ সারাগ্রামে ছড়িয়ে পড়ে? সময় মত না এলে যদি বাজার না মেলে? তার দুশ্চিন্তা এমনই পর্যায়ে পেঁছিল যে তিনি পাকস্থলীতে আলসার হয়েছে ভেবে ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার তাকে জানালেন তার কিছুই হয়নি শুধু স্নায়ুর গোলমাল ছাড়া। আমি তখনই আলো দেখলাম, জেমস গ্র্যান্ট জানিয়েছিলেন। তখনই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, দেখ জিম, আজ অবধি কত গাড়ি ফল আমদানী করেছো? উত্তর এলো : প্রায় পঁচিশ হাজার। আমার প্রশ্ন : কতগুলো গাড়ি আজ পর্যন্ত ভেঙেছে? উত্তর হল : প্রায় পাঁচটা হবে। তখন ভাবলাম, পঁচিশ হাজারে মাত্র পাঁচ।
তখনই বুঝলাম আমি বোকার মতই চিন্তা করছি। তখনই ঠিক করলাম গড়পড়তা নিয়মই মেনে চলবো।
অল স্মিথ যখন নিউইয়র্কের গভর্ণর ছিলেন আমি তাকে বলতে শুনেছি তিনি তাঁর রাজনৈতিক শত্রুদের কথার কি জবাব দিতেন। তিনি শুধু বলতেন : আসুন প্রকৃত ঘটনা পরীক্ষা করি…। তারপর তিনি প্রকৃত ঘটনা বর্ণনা করতেন। আমি বা আপনি অল স্মিথের উপদেশটা মেনে চলতে পারি কিনা দেখি আসুন। ঠিক এইভাবেই ফ্রেডারিক জে. ম্যালন্টেড ট্রেঞ্চে শুয়ে এইরকম ভয় পান।
তিনি বলেছিলেন : ১৯৪৪ সালের জুন মাসের গোড়ায় আমি, ওমাবা সাগরতীরে একটা ট্রেঞ্চে শুয়েছিলাম। নরম্যাণ্ডির তীরে ওই ট্রেঞ্চ কাটা হয়। ছোট ওই গর্তে শুয়ে থাকতে গিয়ে ভাবলাম, এটা একদম কবরের মত। ওতে শুয়ে থাকতে গিয়ে মনে হলো এটাই বোধ হয় আমার কবর। রাত এগারোটায় যখন জার্মান বোমারু এসে বোমাবর্ষণ শুরু করল আমি ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম। প্রথম দু–তিন রাত একেবারেই ঘুমাতে পারলাম না। পাঁচদিনের মাথায় একেবারেই ভেঙে পড়লাম । বুঝলাম কিছু একটা না করলে পাগল হয়ে যাব। তাই পাঁচটা রাত কাটার পর নিজেকে বললাম, পাঁচটা রাত কেটে গেলেও আমি বেঁচে আছি, বাকিরাও তাই। মাত্র দুজন সামান্য আহত। তাই ঠিক করলাম আর দুশ্চিন্তা করব না। বুঝলাম একমাত্র মারা যেতে পারি সোজা বোমা পড়লে। আর সে রকম ঘটার আশঙ্কা দশ হাজারে মাত্র এক। এরপরেই বোমাবর্ষণের মধ্যেও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারলাম।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী, নৌসেনাদের মনোবল বাড়ানোর জন্য তাদের গড়পড়তা নিয়ম কাজে লাগাতো। একজন প্রাক্তন সেনা আমাকে বলে ছিলেন তাদের দাহ্য তৈলবাহী জাহাজে কাজ দেওয়া হত । সবাই ভয়ে কাঠ হয়ে থাকতো কারণ তারা ভাবতো টর্পেডোর আঘাতে জাহাজ পুড়ে যাবে।
নৌবাহিনী জানতো তা ঠিক নয়–তাই তারা আসল তথ্য প্রকাশ করল । দেখা গেল একশটা জাহাজে টর্পেডোর আঘাত লাগলে চল্লিশটা ডোবে আর ষাটটা ভেসে থাকে। পাঁচটা জাহাজ দশ মিনিটের কম সময় ধরে ডোবে তাতে পালাবার সময় থাকে। অর্থাৎ হতাহতের সংখ্যা কম হয়। গড়পড়তা নিয়মের এই তত্ত্বের ফলে আমার ভয় কেটে যায়। সব সৈনিকই এরপর নিশ্চিন্ত হয়।
দুশ্চিন্তা দূর করার তিন নম্বর নিয়ম হল : আসুন দেখে নিই গড়পড়তার নিয়মে যা ভয় করছি তা আদৌ ঘটতে পারে কি না।