হিংসা ও ঘৃণার পরিণতি
বহু বছর আগে ইয়োলোস্টোন পার্কে যখন বেড়াচ্ছিলাম তখন ভ্রমণার্থীদের সঙ্গে বসে ঘন পাইনবনের ঝোঁপের দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। ঠিক তখনই আমরা যে জন্তুটিকে দেখার অপেক্ষায় ছিলাম সেই জঙ্গলের আতঙ্ক এক প্রকাণ্ড আকারের গ্রিসূলি ভালুক আলোয় বেরিয়ে এসে পার্কের হোটেলের জমা করা জঞ্জাল ঘাটতে আরম্ভ করল। জঙ্গলের একজন শিকারী মেজর মার্টিনডেল ঘোড়ায় চড়ে ভ্রমণার্থীদের ভালুক সম্বন্ধে নানা কাহিনী শোনালেন। তিনি বললেন ওই গ্রিলি ভালুক একমাত্র বন্য মহিষ আর কোডিয়াক ভালুক ছাড়া পশ্চিম জগতের কোন জানোয়ারকেই ভয় করে না। অথচ আমি সে রাতে দেখলাম গ্রিসলি ভালুকটা সে রাতে একটা জন্তুকে বাইরে এনে ওর সঙ্গে খেতে দিল। জন্তুটা একটা স্কাঙ্ক। অথচ ভালুকটা জানত ওর থাবার এক আঘাতেই ও ছোট্ট স্কাঙ্কটাকে শেষ করে দিতে পারে। কিন্তু সে তা করল না কেন? কারণ সে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জেনেছিল এতে কোন লাভ হয় না।
এটা আমিও আবিষ্কার করি। আমার ছেলে বয়সে কাজ করার সময় আমি চার পেয়ে বহু স্কাঙ্ক ধরেছি আর নিউইয়র্কের ফুটপাথে হাঁটার সময় বহু দুপেয়ে স্কাঙ্কও দেখেছি। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি এই দুজাতের জীবকেই ঘাঁটিয়ে লাভ হয় না।
আমরা যখন আমাদের শত্রুদের ঘৃণা করি তখন তারা মানসিক দিক দিয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আমাদের ঘুম, হজমশক্তি, ব্লাড প্রেসার, স্বাস্থ্য আর আমাদের সুখের উপর প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের শত্রুরা যদি জানতে পারত তারা কিভাবে আমাদের দুশ্চিন্তায় ফেলে ক্ষতি করে চলেছে তাহলে তারা আনন্দে নাচতে থাকতো। আমাদের ঘৃণা তাদের কোনই ক্ষতি করে না বরং সে ঘণা। আমাদেরই দিনরাতকে নরক করে তোলে। এই কথাটা কে বলেছিলেন জানেন? স্বার্থপরেরা যদি আপনাদের উপর টেক্কা দিতে চায় তাহলে তাদের তুচ্ছ জ্ঞান করে বাতিল করুন, শোধ নেবার দরকার নেই। যখন শোধ নেবার চেষ্টা করবেন, জানবেন তার ক্ষতি করার চেয়ে নিজেরই বেশি ক্ষতি করবেন। ..কথাটা শুনে মনে হয় কোন বিখ্যাত আদর্শবাদীর উক্তি। কিন্তু তা নয়। কথাটা মিলওয়াকির পুলিশ দপ্তরের এক বুলোটিনে বের হয়।
শোধ নেবার চেষ্টা কিভাবে আপনার ক্ষতি করতে পারে? নানা ভাবেই তা পারে। লাইফ পত্রিকার ভাষা অনুযায়ী এতে আপনার স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হতে পারে। ব্যক্তিত্বময় রক্তচাপ সম্পন্ন মানুষের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ঘৃণা। যখন ঘৃণা দীর্ঘকালীন হয় তখনই সঙ্গী হয় দীর্ঘকালের রক্তচাপ আর হার্টের অসুখ।
অতএব দেখছেন যখন যীশু বলেছিলেন, ‘আপনার শত্রুকে ভালোবাসুন’, তখন তিনি শুধু নীতিশাস্ত্রের কথাই বলেন নি। তিনি বিংশ শতাব্দীর চিকিৎসাশাস্ত্রের কথাও বলেছেন। তিনি যখন বলেন, শতশতবার ক্ষমা কর তখন তিনি আপনাকে আর আমাকে উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের রোগ, পাকস্থলীর আলসার এবং অন্যান্য বহু রোগ থেকে কিভাবে দূরে থাকতে হয় সেটাই বলেছিলেন।
আমার এক বন্ধুর সম্প্রতি সাংঘাতিক হৃদরোগ হয়। তার চিকিৎসক তাকে চুপচাপ শুয়ে থাকতে বলেছিলেন আর বলেছিলেন যাই ঘটুক না কেন কোনরকম ক্রুদ্ধ হওয়া চলবে না। ডাক্তাররা জানেন আপনার যদি হৃৎপিণ্ড দুর্বল থাকে তাহলে আচমকা রাগ আপনার মৃত্যু ঘটাতে পারে। মৃত্যু ঘটাতে পারে বলেছি? এই রাগ সত্যিই একজন রেস্তোরাঁ মালিকের মৃত্যুর কারণ হয়। এটা ঘটে কবছর আগে ওয়াশিংটনের স্পোকেনে। আমার সামনেই স্পোকেনের পুলিশ দপ্তরের পুলিশ প্রধানের একখানা চিঠি রয়েছে, তাতে তিনি লিখেছেন : ক’বছর আগে স্পোকেনের এক রেস্তোরাঁর মালিক আটষট্টি বছরের মিঃ উইলিয়াম থডেবার রেস্তোরাঁর পাঁচকের উপর প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হন। এমনই তার রাগ হয় রিভলবার বের করে তিনি পাঁচককে তাড়া করেন আর তৎক্ষণাৎ পড়ে গিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে যারা যান–হাতে তখনও রিভলবারটা ধরা। করোনারের বক্তব্য ছিল প্রচণ্ড রাগের ফলে হৃদরোগে মৃত্যু।
যীশু যখন বলেছিলেন ‘শত্রুকে ভালোবাসো’, তখন তিনি এটাই বলেছেন কি করে আমরা চেহারা ভালো রাখতে পারি। আমি বা আপনি জানি, যেসব মেয়েদের মুখ কুঁচকে গেছে বা চেহারা শুকিয়ে গেছে। তা ঘৃণারই পরিণতি। পৃথিবীর সবরকম চিকিৎসাতেও এটা ভালো হবে না। কিন্তু ক্ষমা, নমনীয়তা আর প্রেমে তাদের চেহারার উন্নতি হতে পারে।
ঘৃণা আমাদের খাদ্যকেও বিস্বাদ করে তোলে। বাইবেলে ব্যাপারটা এই ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে : ঘৃণার সঙ্গে মোটা ভেড়ার মাংসের চেয়ে প্রেমময় নিরামিষ খাদ্যই শ্রেয়।
আমাদের শত্রুরা যদি জানতে পারে তাদের প্রতি আমাদের ঘৃণা আমাদের কিভাবে শেষ করে ফেলছে, নার্ভাস করছে আর সৌন্দর্য নষ্ট করছে, হৃদরোগ আনছে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে জীবনীশক্তি নিঃশেষ করছে তাহলে তারা আনন্দে লাফাতো।
আমরা যদি শত্রুদের ভালোবাসতে নাও পারি অন্ততঃ নিজেদের ভালোবাসি আসুন। নিজেদের এমন ভাবে ভালোবাসতে হবে যে কিছুতেই শত্রুদের আমরা আমাদের সুখ, স্বাস্থ্য বা চেহারা নষ্ট করতে দেব না। শেক্সপীয়ার যেমন বলেছিলেন :
শত্রুর জন্য এমন উত্তাপ সৃষ্টি করবেন না যাতে নিজেই দগ্ধ হবেন।
যীশু যখন বলেছিলেন শতশতবার শত্রুকে ক্ষমা কর, তিনি তখন দরকারী কথাই বলেছিলেন। যেমন ধরুন, একখানা চিঠির কথা বলি। চিঠিখানি লিখেছেন সুইডেন থেকে জর্জ রনা। তিনি সুইডেনের একজন অ্যাটর্নী। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তিনি ভিয়েনা থেকে সুইডেনে পালান। তাঁর কোন টাকা পয়সা না থাকায় কাজের খোঁজ করছিলেন। যেহেতু তিনি বহু ভাষায় লিখতে কইতে পারতেন তাই আমদানী রপ্তানীর কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ পাবেন ভেবেছিলেন। সবাই জানাল যুদ্ধের জন্য তাদের লোক দরকার নেই, তবে নামটা তারা ফাঁইলে লিখে রেখে ছিলেন…। একজন লিখেছিলেন : আমার ব্যবসা সম্বন্ধে আপনি যা ভাবেন তা ঠিক নয়। আপনি ভুল করেছেন এবং আপনি মহামুখ । আমার কোন পত্রলেখক চাই না। যদি দরকার হয়ও আপনাকে নেব না কারণ আপনি ভালো সুইডিশ ভাষায় লিখতে পারেন না, আপনার চিঠিতে অসংখ্য ভুল।
জর্জ রনা যখন চিঠিটা পেলেন তখন রেগে আগুন হয়ে গেলেন। লোকটা ভেবেছে কি আমি সুইডিশ ভাষায় লিখতে পারি না। বরং লোকটা যা লিখেছে তাই ভুলে ভরা! প্রত্যুত্তরে জর্জ রনা যা একটা চিঠি লিখলেন তাতে লোকটা জ্বলে পুড়ে মরবে। এবারই রণা একটু থামলেন। তিনি নিজেকে বললেন : এক মিনিট দাঁড়াও। কিভাবে বুঝলে লোকটা ঠিক বলেনি? আমি সুইডিশ ভাষা শিখেছি বটে তবে তা আমার মাতৃভাষা নয়, অতএব ভুল করতেও পারি। তাই কাজ পেতে গেলে আরও ভালো করে ভাষাটা শিখতে হবে এই লোকটা পরোক্ষ ভাবে উপকারই করেছে। ওর কাছে ঋণী রইলাম! অতএব সে যা করেছে তার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি লিখব।
অতএব জর্জ রনা এবার আগের চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে নতুন একটা চিঠি লিখলেন : আপনি একজন পত্রলেখক না চাইলেও কষ্ট করে যে চিঠিটা লিখেছেন তার জন্য ধন্যবাদ। আপনার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ভুল করার জন্য দুঃখিত। আপনাকে চিঠি লেখার কারণ হল আপনাদের কারবারই শ্রেষ্ঠ শুনেছিলাম। জানতাম না চিঠিতে ব্যাকরণ ভুল করেছি। আমি এজন্য দুঃখিত ও লজ্জিত। এরপর থেকে ভুল সংশোধন করার জন্য ভালো করে সুইডিশ ভাষা শিখব। আত্মোন্নতির পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
কয়েক দিনের মধ্যেই জর্জ রনা লোকটির কাছ থেকে উত্তর পেলেন, তিনি তাঁকে দেখা করতে বলেছেন। রনা দেখা করলেন–আর একটা কাজও পেলেন। জর্জ রনা এইভাবেই আবিষ্কার করলেন যে নরম উত্তর দিলে রাগ জল হয়ে যায়।
আমরা হয়তো আমাদের শত্রুদের ভালোবাসার মত অতখারি সাধু হবে পারব না, তবে আমাদের স্বাস্থ্য আর সুখের জন্য আসুন তাদের ক্ষমা করে সব ভুলে যাই। এটা একটা চমৎকার কাজ। কনফুসিয়াস বলেছিলেন : অন্যায় নিগ্রহ ভোগ বা লুণ্ঠিত হওয়া কিছুই নয়, যদি তা মনে না রাখি । আমি একবার জেনারেল আইসেনহাওয়ারের ছেলে জনকে প্রশ্ন করি তার বাবা কি কোনদিন রাগ পুষে রেখেছিলেন? সে উত্তরে বলে, না বাবা যাদের পছন্দ করেন না তাদের কথা এক মুহূর্তও ভাবেন না।
একটা প্রাচীন প্রবাদ আছে যে লোক রাগতে জানে না সে মুখ, কিন্তু যে রাগ করে না সে বুদ্ধিমান। নিউইয়র্কের ভূতপূর্ব একজন মেয়র উইলিয়াম জে. গেনরের নীতিও ছিল এই । সস্তা কুরুচিকর খবর কাগজগুলো তার পিছনে লেগেছিল আর এক উম্মাদ তাকে গুলিও করে, তিনি প্রায় তাতে মরতে বসেছিলেন। হাসপাতালে চিকিৎসার সময় তিনি বলেন : প্রত্যেক রাতেই আমি সবকিছু আর সবাইকে ক্ষমা করি। একি অতিরিক্ত আদর্শবাদ? অতিরিক্ত মিষ্টি কথা? তাই যদি হয় তাহলে আসুন বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক সোপেনহাওয়ারের কথা শুনি। স্টাডিস ইন পেসিমিজম, তার রচনা। জীবন তার কাছে দুঃখ আর হতাশায় ভরা ছিল । দুঃখ আর হাহাকারে মথিত অবস্থায় থেকেও তিনি বলেছিলেন : যদি সম্ভব হয় কারও প্রতি শত্রুতা থাকা উচিত নয়।
আমি একবার ছ’জন প্রেসিডেন্ট–উইলসন, হার্ডিং, বুলিজ, হুভার, রুজভেল্ট আর টুম্যানের বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা বার্নার্ড বারুচকে প্রশ্ন করি তার শত্রুদের আক্রমণে তিনি কিছু মনে করেন কি না। তিনি জবাব দেন কেউই আমায় খারাপ লাগাতে বা ছোট করতে পারে না, তাদের করতেই দিই না।
আমি বা আপনি অন্যকে সুযোগ না দিলে তারা কেউই আমাদের ছোট করতে পারবে না। লাঠি আর পাথরে আমার হাড় ভাঙতে পারে কিন্তু কথাকে আমি ভয় পাই না।
যুগ যুগ ধরে মানুষ খ্রীষ্টের মত মানুষের উপাসনা করেছে যিনি কখনও শত্রুকে ঘৃণা করেন নি । আমি বহুবার কানাডার জ্যাসপার ন্যাশনাল পার্কে দাঁড়িয়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা পর্বতের দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়েছি। ওই পর্বত ব্রিটিশ নার্স এডিথ ক্যাডেলের নামে নামাঙ্কিত–যিনি ১৯১৫ সালের ১২ই অক্টোবর সন্যাসিনীর মতই জার্মান ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে মৃত্যু বরণ করেন। তার অপরাধ? তিনি গোপনে বহু আহত ফরাসী আর ইংরেজ সৈন্যকে তার বেলজিয়ামের বাড়িতে রেখে সেবা করেন আর তাদের হল্যান্ডে পালাতে সাহায্য করেন। একজন ইংরেজ পাদ্রী যখন তার মৃত্যুর আগে তার ব্রাসেলসের কারাগারে দেখা করতে আসেন এডিথ ক্যাডেল দুটি কথা বলেছিলেন, আর তা ব্রোঞ্চ গ্রানাইট পাথরে তার মূর্তির কাছে। খোদাই করে রাখা আছে : আমি বুঝতে পারছি শুধু স্বদেশপ্রেমই সব নয়। কারও প্রতিই আমার তিক্ততা বা ঘৃণা নেই। চারবছর পরে তার মৃতদেহ ইংল্যান্ডে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং ওয়েস্টমিনষ্টার অ্যাবিতে তার স্মৃতিসভা হয়। একবার লন্ডনে এক বছর কাটানোর সময় এডিথ ক্যাডেলের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে তার বাণী পড়েছিলাম।
.
শত্রুদের ক্ষমা করা আর ভুলতে পারার একটা পথ হল, আমাদের সব চাইতেও বড় কিছু করায় শপথ গ্রহণ করা। তাহলে আমরা অপমান ও শত্রুতার কথা ভুলে যাব আর আমাদের কাজই আমাদের কাছে বড় হয়ে উঠবে। উদাহরণ হিসেবে ১৯১৮ সালের মিসিসিপির পাইনের বনে যে নাটকীয় ঘটনার জন্য নেয় সেটাই দেখা যাক। বিনা বিচারে মৃত্যুদন্ড দান বা ঘৃণ্য লিঞ্চিংয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছিল একজন.. লরেন্স জোন্স নামে একজন কালা আদমী, যিনি একজন শিক্ষক ও পাদী, তাকেই লিগ সকাল হচ্ছিল। কয়েক বছর আগে লরেন্স জোন্স পাইনী উড কান্ট্রি স্কুল স্থাপন করেন। এ ঘটনাটা ঘটে নন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আবেগময় দিনগুলোয়। একটা গুজব রটে যায় যে জার্মানরা নিগোদের উত্তেজিত করে বিদ্রোহে প্ররোচিত করছে। যাকে লিঞ্চ করা হচ্ছিল সেই লরেন্স জোন্স একজন নিগ্রো, সন্দেহ করা হচ্ছিল তিনি নিগ্রোদের প্ররোচিত করছেন। একদল সাদা মানুষ–চার্চের সামনে জমায়েত হয়ে লরেন্স জোন্সকে কিছু লোকের সামনে এই বক্তৃতা করতে শোনে : জীবন হল একটা লড়াই আর প্রত্যেক নিগ্রোকে বেঁচে থাকতে গেলে অস্ত্র নিয়ে লড়াই করে জয়লাভ করতে হবে।
লড়াই! অস্ত্র! এই কথাগুলো যুবকদের খেপিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। তারা তাই একজোট হয়ে রইলো, পাদ্রী গির্জায় ফিরে এলে তার গলায় একটা দড়ি পরিয়ে এক মাইল দূরে টেনে নিয়ে এক রাশ। শুকনো কাঠের উপর দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর তারা সবাই ঠিক করল তাকে ফাঁসি দেওয়া হবে আর সেই সঙ্গে আগুনেও পোড়ানো হবে। ঠিক তখনই একজন চেঁচিয়ে বললো, পোড়ানোর আগে ঘ্যানর ঘ্যানর মশাইর কাছ থেকে কিছু শোনা যাক। বল! কিছু বল! লরেন্স জোন্স কাঠের গাদার উপর দাঁড়িয়ে গলায় সেই দড়ি নিয়ে তাঁর জীবন আর আদর্শের কথা শুনিয়ে গেলেন। তিনি ১৯০৭ সালে আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। তার সুন্দর চরিত্র, তার জ্ঞান, সঙ্গীতে দক্ষতা ইত্যাদির ফলে তিনি ছাত্র আর অধ্যাপক সকলের কাছেই জনপ্রিয় হন। স্নাতক হওয়ার পর তিনি একজন হোটেল মালিকের সঙ্গে ব্যবসার আমন্ত্রণ আর সঙ্গীত শিক্ষার জন্য অর্থ সাহায্যের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কেন? কারণ তিনি এক আদর্শের পূজারী ছিলেন। বুকার টি,ওয়াশিংটনের জীবনী পাঠ করে তিনি ভেবেছিলেন দারিদ্র পীড়িত, অশিক্ষিত নিগ্রো জাতের মানুষের সেবায় তার জীবন নিয়োজিত করতে চান। তাই তিনি দক্ষিণের সবচেয়ে অনগ্রসর অংশ–জ্যাকসন থেকে পঁচিশ মাইল দক্ষিণে মিসিসিপিতে চলে যান। মাত্র পৌনে দু ডলারে তার ঘড়িটি বাধা দিয়ে তিনি জঙ্গলের মধ্যে এক খোলা জায়গায় তার স্কুল খোলেন। লরেন্স জোন্স কুদ্ধ জনতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, গরীব ছাত্রদের শিক্ষিত করে তুলতে কি অমানুষিক পরিশ্রমই না তিনি করেছেন। তিনি তাঁদের একথাও জানান পাইনী উড কান্ট্রি স্কুল খোলার জন্য কোন কোন সাদা মানুষরা তাঁকে জমি, কাঠ, শুয়োর, গরু আর টাকা দেন।
এরপর লরেন্স জোন্সকে যখন প্রশ্ন করা হয় যারা গলায় দড়ি পরিয়ে আগুনে পোড়তে চায় তাদের। তিনি ঘৃণা করেন কিনা। এর জবাবে বলেছিলেন–নিজের কাজ নিয়ে তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত তাই ঘৃণা করার সময় তাঁর নেই, নিজের চেয়েও কড় কাজ করবরর ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত। তিনি বলেছিলেন, আমার ঝগড়া করার সময় নেই, সময় নেই অনুশোচনা করার আর কোন মানুষই আমাকে ঘৃণা করার মত নিচে নামাতে পারবে না।
লরেন্স জোন্স যখন আন্তরিকতার সঙ্গে সুন্দর বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, এবং যখন নিজের জীবন ভিক্ষা না চেয়ে নিজের কাজ সম্বন্ধে ওকালতি করছিলেন, তখন জনতা আস্তে আস্তে নরম হতে আরম্ভ করল । অবশেষে একজন বৃদ্ধ জনতার মাঝখান থেকে বলে উঠলেন : আমি বিশ্বাস করি এই ছেলেটি সত্য কথাই বলছে। যে সাদা লোকদের নাম ও করেছে তাদের আমি চিনি। ও ভাল কাজ করছে। আমরাই ভুল করেছি। আমাদের উচিত ওকে ফাঁসি না দিয়ে সাহায্য করা। এই বলে তিনি তার টপি সকলের সামনে ধরলেন–আর বাহান্ন ডলার সাহায্য তুলে দিলেন ঠিক তাদেরই কাছ থেকে–যারা পাইনি উড স্কুলের প্রতিষ্ঠাতাকে একটু আগে ফাঁসি দিতে যাচ্ছিল।
এপিকটেটাস ঊনিশ শতাব্দী আগে বলেছিলেন : যে যেরকম কাজ করে সে তদনুরূপ ফল পায়। তিনি আরও বলেন, শেষ পরিণতিতে প্রত্যেক মানুষই তার কুকর্মের ফল পায়। যে মানুষ একথা মনে রাখে সে কোন কারণেই রাগ করে না, অসন্তুষ্ট হয় না। কুৎসা রটনা করে না। কাউকে দোষ দেয় না কাউকে ঘৃণাও করে না।
আমেরিকার ইতিহাসে সম্ভবতঃ লিঙ্কনের চেয়ে আর কাউকে এত ঘৃণা, নিন্দা বা ঠকানো হয়নি। তা সত্বেও হার্নানের লেখা তার বিখ্যাত জীবনী অনুসারে, মানুষকে লিঙ্কন কখনও তার ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ দিয়ে বিচার করতেন না। যদি কোন কাজ করানো প্রয়োজন দেখা দিত তিনি ভাবতেন তার শত্রুও সেকাজ করতে পারে। কোন লোক তাকে গালমন্দ করে থাকলেও সে যদি কাজটি করার উপযুক্ত হত তিনি তাকেই সে কাজের ভার দিতেন যেটা তার যে কোন বন্ধুকেও দিতে পারতেন। …আমার মনে হয় তিনি কখনই তাঁর ব্যক্তিগত শত্রু হওয়া সত্ত্বেও বা তাঁকে অপছন্দ করলেও কাউকে কাছ থেকে সরিয়ে দেন নি।
.
লিঙ্কন যেসব মানুষকে উঁচু পদে বসান যেমন, ম্যাকলেলান, সেওয়ার্ড, স্ট্যানটন আর চেজ–তারা অনেকেই তাকে অপমান ও প্রকাশ্যে নিন্দা করেন। তা স্বত্তেও হার্ডনের কথা অনুযায়ী, লিঙ্কন কখনই তাদের নিন্দা করেন নি। লিঙ্কন বলেন : কোন লোককেই তার কাজের জন্য বেশি প্রশংসা বা নিন্দা করা উচিত নয়। কারণ আমরা সকলেই অবস্থা, পরিবেশ, শিক্ষা, অভ্যাস, বংশগত ধারা ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল আর তাই চিরকাল থাকব।
লিঙ্কন সম্ভবতঃ ঠিকই বলেছিলেন। আমি বা আপনি যদি আমাদের শত্রুদের মতই শারীরিক, মানসিক আর আবেগমন্ডিত হতাম তাহলে হয়তো তাদের মতই ব্যবহার করতাম। হয়তো অন্য কিছু আমরা করতে পারতাম না। তাই আসুন আমরা এবার আমেরিকার আদিম অধিবাসী সিউক্স ইন্ডিয়ানদের মত প্রার্থনা করি : হে মহান দেবতা, আমি যতক্ষণ না অন্য একজনের মত অবস্থায় অন্ততঃ দুসপ্তাহ কাটাচ্ছি ততক্ষণ যেন তার সমালোচনা না করি। তাই আমাদের শত্রুদের ঘৃণ্য করার বদলে আসুন তাদের অনুকম্পা জানাই আর ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই যে তাদের মত জীবন কাটাতে হয়নি। শত্রুদের দুর্নাম দিয়ে আর প্রতিশোধ গ্রহণ না করে আসুন তাদের জন্য সাহায্য প্রার্থনা আর ক্ষমতা করি।
আমি যে পরিবারে জন্মেছি সেখানে প্রত্যেক রাতে বাইবেল থেকে পাঠ করে প্রার্থনা করা হত। আমার মনে পড়ছে বাবার কথা–যিনি মিসৌরীর খামারে বসে এই কথাগুলো আবৃত্তি করতেন : শত্রুকে ভালোবাসো। যে তোমায় অভিশাপ দেয় তাকে আশীর্বাদ কর, যারা ঘৃণা করে তাদের ভালো কর । যারা তোমায় শাস্তি দেয় তাদের জন্য প্রার্থনা কর।
আমার বাবা যীশুর ওই কথাগুলো মেনে চলার চেষ্টা করতেন এতে তিনি অন্তরের শান্তি পান, যে অন্তরের শান্তির জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাজা আর সেনাপতিরা হন্যে হয়েও তা পাননি।
শান্তি আর সুখের জন্য তাই দু–নম্বর নিয়ম হল :
কখনই শত্রুদের উপর প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করবেন না, তাতে তাদের ক্ষতি করার চেয়ে নিজেরই ক্ষতি হয় বেশি। বরং জেনারেল আইসেনহাওয়ার যা করতেন তাই করা ভালো : যাদের পছন্দ করি না তাদের নিয়ে যেন এক মিনিটও ভেবে সময় নষ্ট না করি।