লেবু থাকলে সরবৎ তৈরি করুন
এই বইটি লেখার সময় একদিন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রবার্ট মেনার্ড হাচিস এর কাছে জানতে চেয়েছিলাম তিনি কিভাবে দুশ্চিন্তা দূর করেন। তিনি বলেছিলেন, আমি সব সময় প্রয়াত জুলিয়াস রোজেন ওয়ালডের উপদেশ মেনে চলি । তিনি ছিলেন একটি কোম্পানীর প্রেসিডেন্ট । তার উপদেশ হলো : তোমার কাছে লেবু থাকলে সরবৎ তৈরি করো।
একজন বড় শিক্ষাবিদ এই রকমই করেন। আর মুখরা করে ঠিক তার উল্টো। সে যদি দেখে ভাগ্য তার হাতে একটা লেবু দিয়েছে তাতে সে হতাশায় বলে আমি হেরে গেলাম। আমার ভাগ্যই খারাপ আশা নেই। এরপর সে সারা পৃথিবীকে ঘৃণা করে নিজেকে করুণা করতে আরম্ভ করে। কিন্তু কোন বুদ্ধিমান কেউ ওই লেবু পেলে বলবে : এই দুর্ভাগ্য থেকে কি শিক্ষা নেব? কিভাবে অবস্থাটা বদলানো যায় । কি করে লেবুটাকে সরবৎ বানাতে পারবো।
বিখ্যাত মনস্তত্ববিদ অ্যালফ্রেড অ্যাডলার সারা জীবন ধরে মানুষ আর তাদের অন্তরের শক্তি সম্বন্ধে গবেষণা করে বলেন, মানুষের আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য হলো তারা বিয়োগকে যোগে রূপান্তরিত করতে পারে।
এবার আমার পরিচিত এক মহিলার কৌতূহলোদ্দীপক গল্প শোনাই, তিনি ঠিক তাই করেছিলেন । ভদ্রমহিলার নাম খেলমা টমসন থাকেন নিউইয়র্কে। তিনি বলেছেন যুদ্ধের সময় আমার স্বামী ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ায় মোজাভে মরুভূমিতে এক শিক্ষণ শিবিরে । আমি তার কাছাকাছি থাকবো বলে যাই। জায়গাটা আমার দারুণ খারাপ লাগে। জীবনে এত খারাপ আগে কখনও লাগেনি। স্বামী যখন শিক্ষার জন্য চলে যেতেন আমি একা পড়ে থাকতাম। অসহ্য গরম–প্রায় ১২৫ ডিগ্রী তাপে ফণিমনসার ঝোঁপের আড়ালে বসে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না। কথা বলার কেউ নেই, শুধু মেক্সিকান আর ইণ্ডিয়ান ছাড়া, আর তারাও একবর্ণ ইংরাজী জানেনা। সারাক্ষণ বাতাস বইছে আর শ্বাস টানলেই শুধু বালি আর বালি।
এমন দুরবস্থায় পড়েছিলাম যে নিজের জন্যই কষ্ট হত। তাই বাবা মাকে চিঠি লিখলাম। তাতে লিখলাম আমার আর একমুহূর্তও সহ্য হচ্ছে না বরং এর চেয়ে জেলে থাকাই ভালো। আমার বাবা উত্তরে দুটো মাত্র লাইন লিখেছিলেন–সেই দুটো লাইন সারা জীবন আমার মনে থাকবে–দুটো লাইন আমার জীবন যাত্রা বদলে দেয় :
দুজন মানুষ কারাগারের জানালা দিয়ে তাকিয়েছিল,
একজনের চোখে পড়ত কাদা, অন্যজন দেখত তারা।
বারবার লাইন দুটো পড়লাম। নিজের ব্যবহারে আমার লজ্জা হলো। আমি ঠিক করে ফেলোম আমার এই অবস্থায় যা ভালো তাই খুঁজে নেব। আমি আকাশের তারা দেখব।
আমি স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলাম, তাদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে অবাক হয়ে গেলাম। আমি তাদের বোনা আর মৃৎশিল্পে আগ্রহ দেখানোয় তারা তাদের প্রিয় জিনিসগুলো আমাকে উপহার দিয়ে দিলো, এগুলোই তারা টুরিষ্টদের কাছে বিক্রি করেনি। আমি ক্যাকটাস, ইয়ুক্কাস আর যোশুবা গাছের শোভা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমি প্রেইরী কুকুরদের বিষয় জানলাম, মরুভূমির সূর্যাস্ত একদৃষ্টে লক্ষ্য করতাম আর সমুদ্রের ঝিনুক কুড়োতাম। এ মরুভূমি লক্ষকোটি বছর আগে সমুদ্রের তলায় ছিল।
আমার মধ্যে এমন পরিবর্তনের কারণ কি? মোজাভে মরুভূমি তো বদলে যায়নি । রেড ইণ্ডিয়ানরাও বদলায়নি,কিন্তু আমি বদলে গেছি। আমার মনের ভাব বদল ঘটেছে। আর এর সাহায্যেই আমার যন্ত্রণা কাতর মন বদলে যায় জীবনের এক শ্রেষ্ঠ অ্যাডভেঞ্চারে, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে। এই নতুন জগত আবিষ্কার করে আমার মধ্যে নতুন এক উত্তেজনার জন্ম হল। এতই উত্তেজনা জাগল যে একটা বই লিখে ফেলোম–একটা উপন্যাস। বইটি ছাপা হল ব্রাইট র্যাম্পার্টস নামে …আমি জেলের জানালা দিয়ে কাদার বদলে তারা খুঁজে পেলাম।
খেলমা টমসন আপনি যা আবিষ্কার করেন সেটা গ্রীকরা যীশুখ্রীষ্টের জন্মের পাঁচশ বছর আগেই আবিষ্কার করে : সবচেয়ে ভালো জিনিসই সবচেয়ে কঠিন।
হ্যারী এমার্সন ফসডিক এটারই পুনরাবৃত্তি করেন বিংশ শতাব্দীতে : সুখ শুধু আনন্দের নয়; এ হলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জয়লাভ। হ্যাঁ, সে জয় আসে কোন কিছু চেষ্টা করে পাওয়ায়। লেবুকে সরবতে পরিণত করার মধ্য দিয়ে এ রকম আনন্দ হয়।
আমি একবার ফ্লোরিডার একজন সুখী খামার মালিকের সঙ্গে দেখা করি, লোকটি বিষময় লেবুকে সরবতে পরিণত করে। প্রথম যখন সে খামারটা পায় তার ভাল লাগেনি। জমিটা এতই খারাপ ছিল যে তাতে ফলচাষ দূরের কথা শূকর পালনও করতে পারত না। জমিটায় কেবল ছিল র্যাটল সাপ আর ঝোঁপের মধ্যে ছিল ওক গাছ । তারপরেই তার মাথায় একটা মতলব গজালো। সে তার খামারকে লাভজনক করে তুলবে–এই সব র্যাটল সাপ নিয়েই কাজ শুরু করবে। সকলে অবাক হলো, সে তখন র্যাটল সাপের মাংস টিন বোঝাই করে চালান আরম্ভ করল। ক বছর আগে ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখলাম যে তার র্যাটল সাপ দেখতে বছরে কুড়ি হাজার লোক ভিড় জমাচ্ছে। ওর ব্যবসা ফুলে উঠেছে। দেখলাম তার খামারে গবেষণাগারের জন্য র্যাটল সাপের বিষ বের করা হচ্ছে, সাপের চামড়া প্রচুর দামে বিক্রি হচ্ছে মেয়েদের জুতো আর ব্যাগ তৈরির জন্য। দেখলাম সারা বিশ্বে বোতলভরা সাপের মাংস চালান যাচ্ছে । আমি এখানকার একটা ছবিওয়ালা কার্ড কিনে ডাকঘর থেকে পাঠিয়ে দিলাম। ডাকঘরের নাম এখন বদলে রাখা হয়েছে র্যাটল সাপ ডাকঘর, ফ্লোরিডা। এটা করা হয়েছে এমন একজন লোককে সম্মান জানাতে, যে বিষাক্ত লেবুকে মিষ্টি সরবতে পরিণত করেছে।
আমি এই দেশটা জুড়ে বহুবার ঘুরেছি। তখন আমি দেখেছি অসংখ্য স্ত্রী–পুরুষ কিভাবে বিয়োগকে যোগে পরিণত করেছেন, অর্থাৎ ক্ষতি থেকে লাভ করেছেন।
ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বারোজন’ গ্রন্থের লেখক উইলিয়াম বলিথো কথাটা এইভাবে বলেছেন : জীবনে সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় হলো লাভের উপর নির্ভর না করা। যে কোন বোকাই এটা পারে। সবচেয়ে জরুরি হলো ক্ষতি থেকে লাভ করা। এর জন্য চাই বুদ্ধি–এতেই একজন কেরানি আর বোকার তফাতটুকু বোঝা যায়।
বলিথো কথাটা বলেছিলেন এক দুর্ঘটনায় একটা পা হারানোর পর। কিন্তু আমি একজনকে জানি যিনি দুটো পা হারিয়ে বিয়োগকে যোগে পরিণত করেন। ভদ্রলোকের নাম বেন ফর্মটন। তাঁর সঙ্গে আমার জর্জিয়ার আটলান্টায় দেখা হয়। এলিভেটরে উঠতেই হাসিখুশি দু–পা হারানো লোকটিকে দেখি। তিনি সেখানে একটা হুইল চেয়ারে বসেছিলেন। এলিভেটর থামতেই তিনি নম্রভাবে জানতে চাইলেন আমি একটু পাশে সরে যাবো কিনা যাতে চেয়ারটা নিয়ে যেতে পারেন। আপনার অসুবিধা করার জন্য মাপ চাইছি, ভদ্রলোক হৃদয় গলানো হাসি হেসে বললেন।
আমি এলিভেটর ছেড়ে নিজের ঘরে এসে ওই হাসিখুশি মানুষটির কথা ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতে পারলাম না। শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোককে খুঁজে বের করে তাঁর জীবনের কাহিনী বলতে অনুরোধ করলাম।
ভদ্রলোক একটু হেসে বললেন, এটা ঘটে ১৯২৯ সালে । আমি একরাশ বাদাম কাঠ কেটে ফোর্ড গাড়িতে করে আসছিলাম। আচমকা মোড় ফেরার সময় একটা কাঠ সামনে এসে পড়ল। গাড়িখানা সঙ্গে সঙ্গে সোজা সামনে হড়কে গিয়ে একটা গাছে ধাক্কা খায় । আমার মেরুদণ্ডে আঘাত লাগে আর পা দুটো অসাড় হয়ে যায়।
এটা যখন ঘটে তখন আমার বয়স চব্বিশ আর তারপর একপাও আমি হাঁটতে পারিনি।
চব্বিশ বছরে বিকলাঙ্গ সারা জীবনেরই জন্য। আমি ভদ্রলোককে প্রশ্ন করেছিলাম এত সাহসের সঙ্গে ব্যাপারটা তিনি কিভাবে নিলেন। তিনি বললেন, আমি নিইনি। তিনি বলেন, প্রথমত রাগে দুঃখে ফেটে পড়েন তিনি, বিদ্রোহ করেন। কিন্তু সময় কেটে চললে তিনি বুঝেছিলেন ঐ বিদ্রোহে কোন লাভ হবে না শুধু তিক্ততাই বাড়বে। তাছাড়া তিনি আরও বলেছিলেন, আমি বুঝলাম লোকেরা যখন আমার প্রতি ভদ্র ব্যবহার করে, তখন আমিও তাদের প্রতি ভদ্র হব।
আমি তাকে প্রশ্ন করলাম এত বছর পরে তার কি মনে হয় না তার পা হারানো দুর্ভাগ্যের কারণ।, তিনি বলেন, ঘটনাটা যে ঘটেছিল তার জন্য আমি খুশি। তিনি আমাকে জানান প্রাথমিক আঘাত আর শোক কাটিয়ে ওঠার পর তিনি এক নতুন জীবন কাটাতে আরম্ভ করেন। ভাল সাহিত্যে তার আগ্রহ জাগল। চোদ্দ বছরে তিনি প্রায় চোদ্দশ বই পড়ে ফেলেন আর ওই সব বই তাঁর জীবনকে নতুন দিগন্তে পৌঁছে দেয় এবং মানসিকভাবে শক্তিশালী করে তোলে। তিনি ভাল সঙ্গীতে আকৃষ্ট হন আর সিম্ফনি আগ্রহের সঙ্গে শুনতে আরম্ভ করেন, অথচ আগে যা তাকে বিরক্ত করত। সবচেয়ে বড় জিনিস হল তিনি চিন্তা করার প্রচুর সময় পেলেন। এই প্রথম তিনি পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে জীবন সম্বন্ধে অবহিত হলেন। তিনি বুঝলেন আগে যে সব জিনিসে আগ্রহ প্রকাশ করতেন তার কোনই দাম নেই।
পড়ায় আগ্রহের জন্য তিনি রাজনীতিতে আগ্রহী হলেন, জনসাধারণ সম্পর্কেও আগ্রহী হলেন আর হুইল চেয়ারে বসেই বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন। তিনি জনগণ সম্পর্কে জানতে আরম্ভ করলেন আর জনগণও তাই তাঁকে জানতে চাইল। আর আজ বেন ফর্টসন এখনও হুইল চেয়ারেই আছেন–তিনি জর্জিয়ার সেক্রেটারি অব স্টেট।
গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে নিউইয়র্কে বয়স্ক শিক্ষার ক্লাস নিয়ে আমি আবিষ্কার করেছি যে অনেক বয়স্কর ই ক্ষোভ তারা কলেজী শিক্ষা পাননি। তাঁদের ধারণা কলেজী শিক্ষা না পেলে বিরাট ক্ষতি হয়। আমি জানি এ ধারণা ঠিক নয়, কারণ এমন হাজার হাজার মানুষ আছেন যারা যথেষ্ট উন্নতি করলেও উঁচু স্কুলেরও গন্ডী পার হননি। আমি এমন একজনের কথা জানি যিনি প্রাথমিক স্কুলও পেরোননি এবং চরম দারিদ্রের মধ্যে লালিত হন। তাঁর বাবার মৃত্যুর পরে কবর দেবার জন্য বাবার বন্ধুরা চাদা করে কফিন জোগাড় করেছিলেন। তাঁর মা এক ছাতা তৈরীর কারখানায় কাজ করতেন আর রোজ দশ ঘন্টা ধরে রাত এগারোটা পর্যন্ত কাজ করতেন।
ছেলেটি ওই পরিবেশে মানুষ হয়ে চার্চের ক্লাবে সৌখীন নাটুকে দলে যোগ দেয়। নাটক করতে তার এতই ভাল লাগল যে তিনি বক্তৃতা দানে আগ্রহী হলেন–এর ফলে তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি হল। ত্রিশ বছর বয়স হতে তিনি নিউইয়র্কের বিধান সভায় নির্বাচিত হলেন । তিনি আমায় বলেছিলেন, ব্যাপারটা তাঁর বোধগম্যই হতো না। হিসেবের বিল নিয়ে তিনি প্রচুর লেখাপড়া করতেন। কিন্তু সেগুলো পড়ে তার অর্থ বুঝে ওঠা তার পক্ষে খুবই কষ্ট সাধ্য ছিল। কোন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার আগে তিনি নির্বাচিত হলেন স্টেট ব্যাঙ্কিং কমিশনে। অথচ ব্যাঙ্ক সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট ধারণাই এর আগে ছিল না। এসবের জন্যই তিনি রোজ ষোল ঘন্টা পড়াশোনা করে নিজের জ্ঞান বাড়াতে সচেষ্ট হলেন। তিনি বলেছিলেন প্রতি মুহূর্ত তখন আমার এত খারাপ লাগত যে পদত্যাগ করবার কথা প্রায় ঠিক করে ফেলেছিলাম কিন্তু মায়ের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে হবে,এই ভেবে তা করতে পারিনি। এই করে তিনি লেবুকে লেমনেডে পরিণত করলেন। এরই ফলে দেশের চারদিকে তার নাম ছড়িয়ে পড়লো, তিনি হয়ে উঠলেন একজন জাতীয় বীরের মত । নিউইয়র্ক টাইমস তাকে নিউইয়র্কের সবচেয়ে প্রিয় নাগরিক আখ্যা দেয়।
আমি অল স্মিথ সম্বন্ধে বলছি।
দশ বছর ধরে অল স্মিথ রাজনীতির আত্ম–শিক্ষা নেবার পর নিউ ইয়র্কের সবসেরা সরকারী বিশেষজ্ঞ হয়ে পড়েন। তিনি চারবার নিউইয়র্কের গভর্ণর হন এ একটা রেকর্ড। ১৯২৮ সালে তিনি ডেমোক্র্যাটিক দলের হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হন। কলম্বিয়া এবং হার্ভার্ডসহ ছটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানীয় ডক্টরেট ডিগ্রী দেয়, অথচ যিনি কোনদিন স্কুলের গন্ডী পার হননি।
অল স্মিথ আমাকে বলেছিলেন, তিনি যদি রোজ ষোল ঘন্টা খেটে তাঁর বিয়োগকে যোগে পরিণত না করতেন তাহলে কিছুই ঘটত না।
শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে নীটশের মত হল যে, কেবল অভাবকে সহ্য করা নয় তাকে ভালবাসারও ক্ষমতা থাকা চাই।
বিখ্যাত কৃতি মানুষদের জীবনী পড়ে আমি এটাই বুঝেছি যে যারা জীবনে বাধা পেয়েছেন ততই তারা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন সে বাধা কাটিয়ে জীবনে উন্নতি করতে। উইলিয়াম জেম্স যেমন বলেছিরেন : আমাদের অক্ষমতাই আমাদের অভাবিতভাবে সাহায্য করে।
হ্যাঁ, এটা খুবই সম্ভব। কারণ হয়তো মিলটন অন্ধ হয়ে যান বলেই উচ্চশ্রেণীর কাব্য রচনা করেছিলেন আর বিঠোফেন বধির ছিলেন বলেই এতো ভালো সঙ্গীত রচনা করতে পেরেছিলেন।
হেলেন কেলারের অন্ধত্ব আর বধিরতুই তাকে এত উন্নতিতে সাহায্য করে। চেইকোভস্কি যদি হতাশ না হতেন যদি না তার জীবন করুণ বিবাহের জন্য নষ্ট না হত তা হলে কখনই তিনি করুণ সিম্ফনি সৃষ্টি করতে পারতেন না।
ডস্টয়ভস্কি আর টলস্টয় জীবন যন্ত্রণা ভোগ না করলে কখনই তাঁদের অমর উপন্যাস রচনা করতে পারতেন না।
পৃথিবীতে জীবনধারার বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক প্রবক্তা বলেছিলেন–আমি যদিও ওই রকম পঙ্গু না হতাম, তাহলে যা করেছি তত কাজ করতে পারতাম না। এ হল চার্লস ডারউইনের স্বীকারোক্তি । তার মশক্ততাই আশ্চর্যজনকভাবে তাকে ওই কাজে উদ্বুদ্ধ করে।
যেদিন চার্লস ডারউইন ইংল্যান্ডে জন্ম নেন ঠিক তখনই আমেরিকার কেনটাকীতে এক কাঠের কেবিনে এক শিশু জন্ম নেয়। তার অক্ষমতাও তাকে সহায়তা করেছিল। তিনি হলেন লিঙ্কন–আব্রাহাম লিঙ্কন। ইনি যদি অভিজাত বংশে জন্ম নিয়ে হার্ভার্ডে শিক্ষা নিয়ে আইন পাশ করে সুখী বিবাহিত জীবন যাপন করতেন, তাহলে গেটিসবার্গে তিনি যে চমৎকার বক্তৃতা দেন তা তিনি দিতে পারতেন না, বা তার দ্বিতীয় অভিষেকের সময় যে আশ্চর্য কবিতা উচ্চারণ করেন তা করতে পারতেন না। যা ছিল কোন শাসকের শ্রেষ্ঠ উক্তি : কারও প্রতি নাহি মোর ঘৃণা, শুধু আছে দয়া আর স্নেহ …।
হ্যারী এমার্সন ফসডিক তাঁর পাওয়ার টু সী ইট থ্র, গ্রন্থে বলেছেন একটি স্ক্যান্ডীনেভীয় প্রবচন আছে যেটা আমাদের জীবন সঙ্কেত হতে পারে! উত্তুরে হাওয়া ভাইকিংদের সৃষ্টি করেছে। কথাটার অর্থ হল কোথায় কবে শোনা গেছে আরাম আর নিশ্চিন্ত মানুষকে সুখী আর ভালো করতে পেরেছে? ঠিক এর উল্টোটাই যে সব লোক সহজে সন্তুষ্ট হয় না। তারা নরম গদীতে শুয়েও খুঁতখুঁতে করে । ইতিহাসেও দেখা যায় লোকেরা চরিত্রবান হয়েছে, সুখী হয়েছে তখনই তারা নিজের দায়িত্ব নিতে পেরেছে। উত্তুরে হাওয়াই তাই বারবার ভাইকিংদের সৃষ্টি করেছে।
ধরুন আমরা হতাশ হয়ে যদি ভাবি আমাদের লেবু দিয়ে সরবত বানানোর আশা নেই–তাহলে আমাদের চেষ্টা করা উচিত দুটো কারণে। যে দুটি কারণে আমাদের লাভই হবে, ক্ষতির কিছু নেই।
এক নম্বর কারণ : আমরা সাফল্য পেতে পারি ।
দু নম্বর কারণ : যদি আমরা সফল নাও হই, আমাদের বিয়োগকে যোগে পরিণত করার চেষ্টাই আমাদের সামনে তাকাতে সাহায্য করবে। তাই এটা আমাদের অতীত নিয়ে দুঃখ বা অনুতাপ করতে ব্যস্ত রাখবে না।
পৃথিবীর বিখ্যাত ওলিবুল নামে বেহালাবাদক প্যারীতে তাঁর বাজনা শোনাবার সময় বেহালার একটা তার ছিঁড়ে যায় । কিন্তু ওলিবুল তিনটি তারেই বাজনা শেষ করেন। হ্যাঁরী এমার্সন ফসডিক তাই ঠিকই বলেছেন : এই হল জীবন। বেহালার একটা তার ছিঁড়ে গেলেও তিনটি তারেই বাজবে।
এ শুধু জীবন নয়, এ হল জীবনের চেয়েও বেশি। এ হল বিজয়ী জীবন।
আমার ক্ষমতা থাকলে আমি উইলিয়াম বোলিথের এই কথাটা ব্রোঞ্চে বাঁধিয়ে দেশের প্রতিটি জায়গায় ঝুলিয়ে দিতাম।
জীবনের উদ্দেশ্য কেবল লাভ নিয়ে নয়। যে কোন বোকাই তা পারে। আসল প্রয়োজন ক্ষতি থেকে লাভ করা …।
অতএব সুখ আর সমৃদ্ধি পেতে হলে ৬ নম্বর নিয়ম হল :
ভাগ্য কোন লেবু হাতে দিলে তা দিয়ে সরবত বানান।