দুশ্চিন্তা দূর করার উপায়
একটা রাতের কথা আমি ভুলবো না, কবছর আগে ম্যারিয়ন জে. ডগলাস যখন আমার ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। (নামটা তিনি প্রকাশ করতে বারণ করেছিলেন বলে ছদ্মনাম দিচ্ছি)। গল্পটা কিন্তু সত্যি। আমার বয়স্ক শিক্ষার ক্লাসে তিনি এটা বলেন। তিনি জানান বারবার দুবার তার বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে আসে। প্রথমে তিনি তার পাঁচ বছরের মেয়েকে হারান। এই মেয়েটিকে তিনি প্রাণের অধিক ভালবাসতেন। তিনি আর তার স্ত্রী ভেবেছিলেন এ শোক তারা সহ্য করতে পারবেন না। দশমাস পরে ঈশ্বর তাদের আর একটি কন্যাসন্তান উপহার দিলেন। কিন্তু সেও পাঁচদিনের মাথায় মারা যায়।
এই দুটো পরপর শোক আমাদের কাছে অসহ্য হয়ে উঠলো, ভদ্রলোক আমাদের বলেছিলেন। কিছুতেই তা সহ্য করতে পারিনি। ঘুমোতে, বিশ্রাম নিতে বা খেতে পারছিলাম না। আমার সমস্ত স্নায়ু অবশ হয়ে যায়, সব আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তিন ডাক্তারের কাছে গেলে একজন ডাক্তার ঘুমের ঔষধ খেতে বলেন অন্যজন কোথাও ঘুরে আসতে বলেন। দুটোই তিনি করলেন কিন্তু তাতে কোন লাভ হলো না। তিনি বলেছিলেন, মনে হতে লাগলো আমার শরীর কেউ চিমটে দিয়ে চেপে ধরেছে–শোকের অসহায়তা যারা টের পেয়েছেন তারাই শুধু এটা বুঝবেন।
তবুও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ একটি সন্তান আমাদের ছিলো–চার বছরের একটা ছেলে। সেই আমার সমস্যার সমাধান করে দিলো। এক সন্ধ্যায় শোকাহত হয়ে যখন বসেছিলাম সে বললো : বাবা, আমায় একটা নৌকা বানিয়ে দেবে? নৌকা বানাবার মত মনের অবস্থা আমার ছিলো না–আসলে কিছু করার মতই আমার অবস্থা ছিলো না। কিন্তু ছেলে ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকায় মত দিতেই হলো।
নৌকা তৈরি করতে আমার তিনঘন্টা লেগে গেল। যখন কাজ শেষ করলাম টের পেলাম ওহ তিনঘন্টাই আমি দুশ্চিন্তা ত্যাগ করে প্রথম মানসিক প্রশান্তিতে কাটিয়েছি।
ওই আবিষ্কারের ফলেই অবসাদ কাটিয়ে আমি কয়েক মাসের মধ্যে প্রথম চিন্তা করতে পারলাম। বুঝলাম কাজে ব্যস্ত থাকলে দুশ্চিন্তা করার আর কোন সময় বা অবকাশ থাকে না। আমার ক্ষেত্রে ওই নৌকো বানানোই আমায় রক্ষা করেছে। তাই ঠিক করলাম কাজে ব্যস্ত থাকবো।
পরদিন সব ঘর ঘুরে কি কি কাজ করতে হবে স্থির করলাম। বহুঁকাজ করা বাকি ছিল–বইয়ের আলমারী, সিঁড়ির ধাপ, জানালা, দরজার হাতল, তালা, পাইপ, নানা জিনিস। আশ্চর্য লাগলেও দু’সপ্তাহের মধ্যে ২৪২টা জিনিসের তালিকা তৈরী করে ফেলোম।
গত দুবছরে প্রায় সবই শেষ করেছি। আমার জীবন নানা উত্তেজনায় নিয়োজিত রেখেছি। প্রতি সপ্তাহে নিউ ইয়র্কে বয়স্ক শিক্ষা ক্লাসে যোগ দিই। নানা সামাজিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছি, আমি এখন স্কুলবোর্ডের চেয়ারম্যান। রেড ক্রশের জন্য আমি টাকাও তুলি, তাই দুশ্চিন্তার সময় নেই। ঠিক এই কথাই উইনষ্টন চার্চিল বলেছিলেন যুদ্ধের বিবর্ণবিষময় দিনগুলোয় যখন তিনি দৈনিক আঠারো ঘন্টারও বেশি কাজ করতেন। তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হয় যে প্রচণ্ড দায়িত্ব সম্বন্ধে তার দুশ্চিন্তা হয় কিনা, তিনি জবাব দেন; আমি দারুণ ব্যস্ত। দুশ্চিন্তা করার মত সময় নেই।
মোটর গাড়ির ফেলফ স্টার্টার আবিষ্কারের সময় চার্লস্ কেটারিংয়েরও এই বিপদ আসে। অবসর নেওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি বিখ্যাত জেনারেল মোটরস্–এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তবুও তিনি তখন এতই গরীব ছিলেন যে প্রথমে খড় রাখা বাড়িতেই তাকে গবেষণাগার বসাতে হয়। মুদির দোকানের দেনা মেটাতে তাকে তার স্ত্রীর পিয়ানো শিখিয়ে আয় করা পনেরো শ’ ডলার ব্যয় করতে হয়, তাছাড়া বীমা কোম্পানী থেকেও পাঁচশ ডলার ধার করতে হয়। আমি তার স্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলাম তার দুশ্চিন্তা হয় কি না। তিনি উত্তর দেন, হ্যাঁ, এতোই দুশ্চিন্তা হয় যে ঘুমোতে পারিনি। তবে আমার স্বামীর কোনো দুশ্চিন্তাই ছিল না। নিজের কাজে ব্যস্ত থাকায় তার দুশ্চিন্তার সময় ছিলো না।
বিখ্যাত বিজ্ঞানী পাস্তুর বলেন গবেষণাগার আর পাঠাগারেই শান্তি থাকে। এরকম শান্তি সেখানে কেন থাকে? কারণ মানুষ সেখানে নিজের কাজে এমনই ব্যস্ত থাকে যে দুশ্চিন্তার সময় থাকে না। গবেষণাকারীদের কচিৎ স্নায়বিক অবসাদ ঘটে, কারণ এ বিলাসিতার সময় তাদের থাকে না।
ব্যস্ত থাকার মত সহজ ব্যাপারে দুশ্চিন্তা দূর হয় কেন? এর কারণ মনস্তত্বের একটা সরল নিয়ম। সেটা হলো : কোন মানুষ তিনি যতই বুদ্ধিমান হোন কিছুতেই একই সময়ে একাধিক বিষয়ে ভাবতে পারে না। বিশ্বাস করতে পারছেন না? তাহলে আসুন একটা পরীক্ষা করা যাক।
আপনি চেয়ারে হেলান দিয়ে ভাবুন তো স্ট্যাচু অব লিবার্টির কথা আর তার সঙ্গে কাল সকালে কি কি করবেন।
আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে একটার পর একটা ভাবতে পারছেন কিন্তু কিছুতেই একসঙ্গে নয়। আবেগের ক্ষেত্রেও তাই। কোনো উৎসাহের কাজে জড়িত থেকে একই সঙ্গে উদ্বেগে আমরা কাহিল হইনা। একটা আবেগ অন্যটাকে দূর করে দেয়। আর এই সহজ ব্যাপার আবিষ্কারের ফলেই সামরিক মনস্তত্ববিদেরা যুদ্ধে অলৌকিক ঘটনা করতে পারে।
যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে সৈন্যরা বাড়ি ফিরলে তাদের প্রায়ই তাদের সাইকো নিউরোটিক নামক এক প্রকার রোগ হত। তাদের চিকিৎসার জন্য ডাক্তাররা ব্যস্ত রাখতে বলতেন। এইসব লোকদের যা অবস্থা, প্রতিটি মুহূর্ত কাজে ব্যস্ত রাখা হত–বিশেষ করে মাছধরা, শিকার, বল খেলা, গলফ খেলা, ছবি তোলা, বাগান তৈরি, নাচ ইত্যাদিতে। তাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে ভাবতেই সময় দেওয়া হত না।
কাজকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করার মনস্তাত্ত্বিক নাম হলো ‘অকুপেশনাল থেরাপি’ (ব্যস্তরাখার ওষুধ)। এটা নতুন নয়। প্রাচীন গ্রীক ডাক্তাররা খ্রীষ্টের জন্মের পাঁচশ বছর আগেও এই বিধান দিতেন।
বেন ফ্রাঙ্কলিনের সময়েও কোয়েকার সমিতি এটা ফিলাডেলফিয়ায় ব্যবহার করতেন। কোয়েকার স্যানাটোরিয়ামে ১৭৭৪ সালে একজন গিয়ে অবাক হয়ে দেখেন মানসিক রোগীরা শনের তন্তু বুনছে। তিনি ভেবেছিলেন লোকগুলোকে বেআইনীভাবে শোষণ করা হচ্ছে। পরে কোয়েক সমিতি তাকে বুঝিয়ে দেন আসলে কাজে ব্যস্ত থাকায় রোগীদের মানসিক উন্নতি হয়। এতে স্নায়ু শান্ত থাকে।
যে কোন মনস্তাত্ত্বিকই বলবেন কাজে ব্যস্ত থাকাই স্নায়ুর পক্ষে সেরা দাওয়াই। হেনরি ডব্লিউ লঙফেলো সেটা বুঝেছিলেন তিনি যখন তার তরুণী বধূকে হারান। আগুনে পুড়ে তার স্ত্রীর মৃত্যু হয়। কিছুদিন পর্যন্ত লঙফেলো এমন শোকে কাটালেন যে প্রায় পাগল হওয়ার মতই হন। তবুও তার তিনটি ছোট ছেলেমেয়েকে দেখতে হতো–একেবারে তাদের বাবামার মতই তাকে হতে হয়। তিনি তাদের বেড়াতে নিয়ে যান, গল্প শোনান, খেলা করেন। ছেলেদের ঘন্টা নামের বইতে তিনি তার ছেলেমেয়েদের সঙ্গের মুহূর্তগুলো অমর করে গেছেন। তিনি দান্তের অনুবাদও করেন। ওইসব করতে গিয়ে তিনি এতই ব্যস্ত থাকতেন যে নিজেকে একেবারে ভুলে মানসিক শান্তি ফিরে পান। টেনিসন লিখেছিলেন তার প্রিয় বন্ধু আর্থার হ্যাঁলামকে হারিয়ে বলেছিলেন, আমায় কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে, না হলে আমি হতাশায় পাগল হয়ে যাব।
আমাদের অনেককেই নিজেদের কাজের মধ্যে হারিয়ে ফেলতে বেগ পেতে হয় না। কিন্তু কাজের পরবর্তী সময়টাই হল মারাত্মক। কাজের পর যখন আমাদের অবসর কাটানোর কথা তখনই দুশ্চিন্তার কালো মেঘ আমাদের ঘিরে ধরে। তখনই মনে হয় যেন জীবনে কিছু হলো না।
.
আমরা যখন ব্যস্ত থাকি না আমাদের মন তখন শূন্য হয়ে যায়। পদার্থবিদ্যার প্রতিটি ছাত্রই জানে প্রকৃতি শূন্যতাকে ঘৃণা করে। জ্বলন্ত বাল্বের মধ্যে যে শূন্যতা, বাল্বটা ভাঙলেই সেটা থাকে না–প্রকৃতি তখন সেখানে বাতাস পূর্ণ করে দেয়।
প্রকৃতি শূন্যমন ভরাট করতে চায়। কিন্তু কি দিয়ে? স্বভাবতই আবেগ দিয়ে। কেন? কারণ আবেগ হলো–দুশ্চিন্তা, ভয়, ঘৃণা, ঈর্ষা এইসব থেকেই আসা–এগুলোর জঙ্গলের শক্তি থাকে। এই সব আবেগের এতই ক্ষমতা যে শান্তি আর সুখের চিন্তাকে ঘরছাড়া করে দেয়।
কলম্বিয়ার শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক জেম্স এল মুর্শেল চমৎকারভাবে বলেছেন : দুশ্চিন্তা আপনার কাজে থাকার সময় ভর করে না বরং দিনের কাজের শেষেই করে। সে সময় আপনার কল্পনাগুলো উদ্ভট হতে চায় সমস্ত রকম অসম্ভব কথা মনে হতে চায়, ছোটখাটো ভুলকে বিরাট মনে হয়। এই সময় আপনার মনটা মোটর চালিত হয়ে চলে, কোনোরকম বোঝা তখন এই মোটর টানে না। মোটর এত জোরে চলে যেন মনে হয় মনকে পুড়িয়ে ভেঙে নিঃশেষ করে দেবে। দুশ্চিন্তা তাড়ানোর একমাত্র পন্থা হলো তাই গঠনমূলক কিছু করা।
এটা বুঝতে হলে আর বাস্তবে কাজে লাগাতে আপনাকে কলেজের অধ্যাপক হতে হবে না। যুদ্ধের সময় একজন শিকাগোর গৃহকত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তিনি আমায় বলেন তিনি দেখেছেন দুশ্চিন্তা তাড়াবার একমাত্র উপায় হলো গঠনমূলক কোন কাজে ব্যাপৃত থাকা।
ভদ্রমহিলা আর তার স্বামীর সঙ্গে আমার আলাপ হওয়ার পর তিনি আমায় বলেন যে তাদের ছেলে। পার্ল হারবার আক্রমণের পরদিন যুদ্ধে যোগ দেয়। ক্রমাগত তার ছেলের কথা মনে হত। সে কোথায় আছে? সে নিরাপদ তো? নাকি যুদ্ধ করছে? সে কি আহত হবে? মারা যাবে না তো?
আমি যখন তার কাছে কিভাবে দুশ্চিন্তা দূর করলেন জানতে চাই তিনি জবাব দিয়েছিলেন : আমি কাজে ব্যস্ত থাকতে চাইলাম। প্রথমে তাদের ঝিকে ছাড়িয়ে দিয়ে তিনি নিজেই সব ঘরের কাজ করতে লাগলেন, কিন্তু তাতে খুব সুবিধে হলো না। তিনি বলেছিলেন : মুশকিল হল ঘরের কাজ যান্ত্রিক ভাবেই করা হত, মনের ব্যবহার দরকার হতো না। তাই ঘরের কাজ করতে গিয়ে বুঝলাম আমার অন্য কিছু কাজ চাই যাতে সারাদিন শারীরিক আর মানসিকভাবে ব্যস্ত থাকি। তাই একটা বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কাজ নিলাম।
তাতে কাজ হলো। অচিরেই দারুণ ব্যস্ত হয়ে পড়লাম : দলে দলে ক্রেতারা আসায় তাদের চাহিদা মেটাতে হল। কেবলমাত্র তখনকার কাজ ছাড়া আর কিছুই মনে রইল না। রাত্রি এলে পায়ের ব্যথা ছাড়া আর কিছুই মনে থাকতো না। খাওয়ার পরেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। দুশ্চিন্তা করার মত আর শক্তি বা সময় আমার থাকেনি।
জন কাউপার পাউইস তার অপ্রীতিকর চিন্তা তাড়ানোর উপায় বইয়ে যা বলেছেন মহিলাটি তাই আবিষ্কার করেন। সেটা এই : কিছু নিশ্চিন্ত নিশ্চিয়তা, কিছুটা প্রগাঢ় মানসিক শান্তি কিছুটা সুখকর বোধশক্তি হীনতা–এইসব মানুষ নামক প্রাণীকে তার কাজে আনন্দ জোগায়।
আর এটায় কত আর্শীবাদই না থাকে। পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত মহিলা অভিযানকারী ওসা জনসন সম্প্রতি আমায় বলেছেন কিভাবে তিনি দুশ্চিন্তা আর দুঃখ ভুলেছিলেন। তার জীবনী ‘আমার সঙ্গী অ্যাডভেঞ্চার’ বইটি আপনি পড়ে থাকতে পারেন। কোন মহিলা অ্যাডভেঞ্চারকে যদি সঙ্গী করে থাকেন তিনিই সেই মহিলা। তাকে ষোল বছর বসে বিয়ে করেন মার্টিন জনসন আর প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যান কানসাসের ক্যানিউট শহর থেকে বোর্নিওর জঙ্গলে। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে এই দম্পতি সারা দুনিয়ার সর্বত্র ঘোরেন এবং এশিয়া ও আফ্রিকার বিলীয়মান প্রাণীদের ছবি তোলেন। ন’বছর আগে আমেরিকায় ফিরে তারা বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছিলেন আর সেইসঙ্গে তাদের বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলো দেখাচ্ছিলেন। এরপর ডেনভার থেকে প্লেনে উপকূলের দিকে যাচ্ছিলেন। প্লেনটা এক পাহাড়ে ধাক্কা খায়। মার্টিন জনসন সঙে সঙ্গেই মারা যান। ডাক্তাররা বলেছিলেন ওসা আর কোনদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবেন না। তিন মাস পরে তিনি হুইল চেয়ারে বসলেন কারণ তারা ওসা জনসনকে চিনতেন না। ওই ভাবেই তিনি বক্তৃতা দিয়ে চললেন। আসলে একবছর তিনি প্রায় একলা সভায় বক্তৃতা দিলেন। আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম তিনি ওই কাজ কেন করলেন। তাতে তিনি জবাব দেন; এটা করি যাতে শোক আর দুশ্চিন্তার কোন অবকাশ আমার না থাকে।
ওসা জনসন টেনিসনের মতোই সেই একশ বছর আগের সত্য আবিষ্কার করেছিলেন : আমায় কাজে জড়িয়ে থাকতে হবে, না হলে আমি হতাশায় পাগল হয়ে যাবো।
একই সত্য আবিষ্কার করেন অ্যাডমিরাল বার্ড, তিনি যখন পাঁচ মাস একটা বাজে কাঠের ঘরে দক্ষিণ মেরুর তুষারাবৃত অঞ্চলে নির্জনে বাস করেন। ওই কুমেরুর তুষার অঞ্চলের পরিধি যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপের মিলিত এলাকার চেয়েও বড়। সেখানে ছিল প্রকৃতির অপার রহস্য। কোন দিকেই একশ মাইলের মধ্যে কোন প্রাণী ছিল না। ঠাণ্ডা এমনই প্রচণ্ড যে নিঃশ্বাস ফেললেও সেটা জমাট বেঁধে উঠত। সেখানে সম্পূর্ণ একাকী কাটান বার্ড। তার লেখা বই ‘একাকী’তে বার্ড বর্ণনা করেছেন আশ্চর্য আত্মা ধ্বংসকারী অন্ধকারের কথা। দিনও সেখানে রাতের মতই আঁধার ঘেরা ছিল। উম্মাদ হওয়া থেকে রক্ষা পেতেই নিজেকে তার ব্যস্ত রাখতে হত।
তিনি লেখেন : রাত্রিবেলা লণ্ঠন নেভানোর আগে আমি পরের দিনের কাজের তালিকা তৈরী করে রাখতাম। নিজেই নিজেকে কাজ দিতাম–পালানোর সুড়ঙ্গের কাজে একঘন্টা, আধঘন্টা বরফ সমান। করার কাজ, একঘণ্টা বইয়ের তাক কাটার কাজ ইত্যাদি…।
তিনি লিখেছেন, এইভাবে কাজ করাটা চমৎকার লাগত। এটা আমার নিজের উপর দারুণ নিয়ন্ত্রণ আনতে সাহায্য করে…ওটা না থাকলে সারাটা দিনই আমার কাছে উদ্দেশ্য বিহীন হয়ে পড়তো। আর তাহলে দিনও শেষ হ’ত অসম্পূর্ণ ভাবেই।
আপনি বা আমি যদি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হই তাহলে মনে রাখবেন আমরা প্রাচীন সেই কাজ করাকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। হার্ভার্ডে–র ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের ভূতপূর্ব অধ্যাপক ডাক্তার রিচার্ড সি. ক্যাবটের মত লোকই সেটা বলেছেন। তিনি তাঁর বই মানুষ কিসে বাঁচে’ বইতে বলেছেন, ডাক্তার হিসেবে আমি আনন্দের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি কাজ করার ফলে লোকে সন্দেহ, ইতস্তত ভাব, অনিশ্চয়তা ইত্যাদি থেকে জন্মানো পক্ষাঘাত, যাতে লোকে কাঁপতে থাকে এই রোগ সেরে গেছে…যে কাজ থেকে সাহসের জন্ম তাকে চিরস্থায়ীরূপে গৌরবান্বিত করেছেন এমার্সন।
আপনি বা আমি যদি ব্যস্ত না থাকি–শুধু বসে চিন্তা করি–তাহলে তা থেকে জন্ম নেবে চার্লস্ ডারউইন যা বলেছেন দুষ্ট প্রকৃতির ভূত। এই ভূত আমাদের কাজের আর ইচ্ছা শক্তিকে ধ্বংস করে ফেলে।
আমি নিউইয়র্কের একজন ব্যবসায়ীকে জানি যিনি ওই ভুতকে নানা ধরনের কাজের মধ্য দিয়ে দূর করেন। তার নাম হলো ট্রেম্পার লংম্যান। দুশ্চিন্তা করার কোন সময় তার থাকেনি। তিনি আমার বয়স্ক শিক্ষার কাসে এসে এই কাহিনী শুনিয়েছিলেন : আঠারো বছর আগে দুশ্চিন্তায় আমার নিদ্রাহীনতা ধরেছিল। আমি শক্ত, বিরক্ত আর খিটখিটে হয়ে পড়ি। আমার ভয় হচ্ছিল হয়তো স্নায়বিক অবসাদে ভেঙে পড়ব।
আমার দুশ্চিন্তার কারণও ছিলো। আমি নিউইয়র্কের ক্রাউন ফুট কোম্পানির কোষাধ্যক্ষ ছিলাম। এক গ্যালন টিনের পাত্রে স্ট্রবেরি ভরার জন্য আমাদের পাঁচ লক্ষ ডলার নিয়োগ করা হয়। বিশ বছর ধরেই আমরা এইসব আইসক্রিম কোম্পানীদের বিক্রি করে আসছিলাম। আচমকা আমাদের বিক্রি পড়ে গেল। কারণ আইসক্রিম প্রস্তুকারীরা তাদের উৎপাদন বাড়াতে চেয়ে তারা গ্যালন টিনের পরিবর্তে বড় বড় ব্যারেলের স্ট্রবেরি কিনছিলো।
এর ফলে ব্যবসায় আমাদের যে শুধু পাঁচ লক্ষ ডলারই আটকে গেল তাই নয়, এছাড়াও আমরা বারোমাসের জন্য আরও দশ লক্ষ ডলারের স্ট্রবেরি কেনায় চুক্তিবদ্ধ ছিলাম। ব্যাঙ্ক থেকেও আমরা সাড়ে তিন লক্ষ ডলার ঋণও করেছিলাম। আমরা নতুন ঋণ করা বা আগের ঋণ শোধও করতে পারছিলাম না। অবাক হবার মত দুশ্চিন্তায় ডুবে গেলাম।
আমি ক্যালিফোর্ণিয়ার ওয়ান্টনভিলে আমাদের কারখানায় ছুটে গেলাম। সেখানে আমি আমাদের প্রেসিডেন্টকে বোঝাতে চাইলাম অবস্থা বদল হয়ে আমাদের বিপদ ঘটতে চলেছে। তিনি সেটা বিশ্বাসই করতে চাইলেন না। তিনি উল্টে সব দোষ চাপালেন আমাদের নিউ ইয়র্ক অফিসের উপর। বললেন তারা বিক্রির কায়দাই জানে না।
বেশ কদিন ধরে ওকালতি করার পর তাকে বাকি সব স্ট্রবেরি টিনে না ভরে খোলাবাজারে বিক্রিতে রাজি করাতে পারলাম। তাতে আমাদের সব সমস্যার প্রায় সমাধান হলো। আমার দুশ্চিন্তা আর না হওয়াই উচিত ছিলো–কিন্তু তা হলো না কারণ দুশ্চিন্তা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। আমার তাই হলো।
যখন নিউ ইয়র্কে ফিরলাম, সব কিছু নিয়েই দুশ্চিন্তা হতে লাগলো। ইতালী থেকে যে চেরী কিনেছিলাম আর হাওয়াই থেকে যে আনারস কিনেছিলাম, সে সব নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু হলো। দুশ্চিন্তায় আমার স্নায়ু ভেঙে পড়ার মত হলো।
অবশেষে হতাশায় এমন এক জীবন যাত্রা বেছে নিলাম, যাতে আমার নিদ্রাহীনতা আর দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেলো। সব সমস্যা নিয়ে এমন ভাবে জড়িয়ে থাকতে চাইলাম যে দুশ্চিন্তার আর অবকাশই রইলো না। রোজ সাতঘন্টা কাজ করে চলোম । রোজ সকাল আটটায় অফিসে এসে প্রায় মাঝ রাত অবধি রইলাম। নতুন কাজ আর দায়িত্ব নিতে লাগলাম। মাঝরাতে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন এতোই পরিশ্রান্ত থাকতাম যে বিছানায় শোবার কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই আমার সাড়া থাকতো না।
এইভাবে তিনমাস চালালাম। ইতিমধ্যে আমার দুশ্চিন্তার অভ্যাস দূর হয়ে গিয়েছিলো তাই আবার দৈনিক সাত, আটঘন্টা কাজ করতে লাগলাম। এ ঘটনা ঘটে আঠারো বছর আগে। এরপর আর কখনই নিদ্রাহীনতা বা দুশ্চিন্তায় ভুগিনি।
জর্জ বার্নার্ড শ ঠিক বলেছিলেন : দুঃখী হয়ে ওঠার রহস্য হলো আপনি সুখী না দুখী ভাবতে পারার মত সময় থাকা। এতএব এটা নিয়ে আর ভাববেন না। বরং কাজে লেগে পড়ুন, তাতে রক্ত চলাচল হবে। আপনার মন চনমন করতে থাকবে–অচিরেই আপনার শরীরে এই নিশ্চিন্ত শক্তি আপনার মন থেকে দুশ্চিন্তা দূর করে দেবে। তাই ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করুন। এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো আর সস্তা ওষুধ।
অতএব দুশ্চিন্তার অভ্যাস দূর করার একনম্বর নিয়ম হল : কাজে ব্যস্ত থাকুন।