দুশ্চিন্তা সমাধানের পথ
আমার ছ’জন সৎ কর্মচারী আছে। (আমি যা জানি সব তারাই শিখিয়েছে)
তাদের নাম হল, কি, কেন, কখন, কে, কেমন করে আর কোথায়। –রাডিয়ার্ড কিপলিং
প্রথম খন্ডের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে উইলিস এইচ. ক্যারিয়ারের যে যাদুময় কৌশল বর্ণনা করা হয়েছে তাতে কি সব দুশ্চিন্তার সমাধান হয়ে যাবে? না, তা কখনই হবে না ।
তাহলে এর উত্তর কি কি? উত্তর হলো আমাদের দুশ্চিন্তা দূর করার জন্য প্রধান তিনটি ধাপ মেনে নিতে হবে। সেই ধাপ তিনটে হলো এই :
১. সমস্ত ব্যাপার বুঝে নেওয়া চাই।
২. তারপর ঘটনার বিশ্লেষণ করতে চাই।
৩. এরপর সিদ্ধান্তে পৌঁছে
যাওয়া আর সেই মত কাজ করা।
এ তো জানা কথা নয়? হ্যাঁ, অ্যারিস্টটল একথা বলে–সেইমতো কাজও করেছেন। আপনাকে আর। আমাকেও তাই করে যেসব সমস্যা আমাদের নরক যন্ত্রণা ভোগ করায় তা সমাধান করতে হবে।
প্রথম ধাপটাই ধরা যাক–সমস্ত ব্যাপার বুঝে নেওয়া চাই; ব্যাপারটা বুঝে নেওয়া জরুরি কেন? কারণ সেটা না জানলে আমরা হয়তো বুদ্ধিমানের মত তা সমাধান করতে পারবো না। ব্যাপারটা না জানলে আমাদের হয়তো শুধু ঘুরপাক খেয়ে যেতে হবে। কথাটা কি আমার? মোটেই না। একথা হলো প্রয়াত হার্বাট ই. হকনের। তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীন। বাইশ বছর ধরে লক্ষ লক্ষ ছাত্রদের দুশ্চিন্তা সমাধানে তিনি সাহায্য করে যান। তিনিই আমাকে বলেছিলেন, দুশ্চিন্তার প্রধান কারণ হলো এলোমেলা ভাবনা। তিনি বলেন, পৃথিবীতে অর্ধেক দুশ্চিন্তার কারণ তাদেরই হয় যারা জানেনা আসল ব্যাপারটা কিভাবে সমাধান করতে হবে। যেমন, আমায় যদি আগামী মঙ্গলবার বেলা তিনটেয় কোন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে মঙ্গলবার বেলা তিনটের আগে সমাধানের কথা আমি ভাবতেও রাজি নই! ইতিমধ্যে ওই সমস্যা সম্বন্ধে সব খবর জোগাড় করাই হবে আমার কাজ। এ নিয়ে আমি একেবারে দুশ্চিন্তা করব না। রাতের ঘুম নষ্ট করব না। ইতিমধ্যে সব খবরাখবর জোগাড় হলে মঙ্গলবার আসার পর সমস্যার ঠিক সমাধান হয়ে যায়!
আমি ডীন হকসকে প্রশ্ন করেছিলাম তিনি কি সব দুশ্চিন্তা দূর করতে পেরেছেন। তার জবাব ছিলো : হ্যা সত্যিকথা বললে আমার জীবনে কণামাত্র দুশ্চিন্তা নেই। একজন মানুষ যদি–আন্তরিকতা নিয়ে সব ব্যাপারের সন্ধান রাখে তাহলে জ্ঞানের আলোকে তার দুশ্চিন্তা আপনা আপনিই দূরীভূত হয়ে যায়।
কিন্তু আমরা বেশির ভাগ কি করি? টমাস এডিসন বলেছেন, চিন্তা না করার জন্য মানুষ হাজারো Tফাঁকর খোঁজে–মানুষ প্রায় সব করতে পারে শুধু চিন্তা করা ছাড়া। ঘটনাগুলো যদি সংগ্রহ করতেই হয়। তাহলে আমরা শুধু সুবিধাজনক ঘটনাই খুঁজে পেতে চাই। আমরা যা ভাবছি তা আমাদের কাজে প্রমাণ করার জন্যই কিছু খবর খুঁজি। আন্দ্রে মারোয়া বলেছেন : যা কিছু আমাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছার সঙ্গে মিল খায় তাই আমরা বিশ্বাস করি। যা মেলেনা তার জন্য আমদের রাগ হয়।
তাই আমাদের সমস্যার উত্তর পাওয়া এতো কঠিন, এতে অবাক হওয়ার কিছু আছে? একটা অঙ্কের সমাধান কি সম্ভব যদি আগেই ভেবে নিই দুয়ে আর দুয়ে পাঁচ হয়? তবুও এমন ঢের লোক আছে দুয়ে দুয়ে পাঁচ বা পাঁচশো হয় ভেবে নিজের আর অন্যের জীবন অতিষ্ঠ করে দেয়।
তাহলে কি করতে পারি আমরা? আবেগকে আমাদের চিন্তার বাইরে রাখা চাই। তাই ডীন হকসের কথা মত সব খবর নিরপেক্ষভাবে দেখতে হবে।
চিন্তিত থাকলে কাজটা আমাদের পক্ষে সহজসাধ্য নয়। আমরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলে আমাদের আবেগ থাকে খুবই বেশি। আমি সব কিছু পরিষ্কার এবং নিখুঁতভাবে দেখার কাজে দুটো ধারণা চমৎকার কাজ দেয় দেখেছি। যেমন–
১। কোন ব্যাপারে খবর সংগ্রহ করতে গেলে আমি এই ভাব করি যেন খবরটা আমার জন্য সংগ্রহ করছি না বরং পরের জন্যই। এর ফলে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী নিতে পারি। আর তাতে আবেগকে সরিয়ে রাখতে পারি।
২। যে সমস্যার আমার দুশ্চিন্তা তার বিবরণ সংগ্রহের সময় এমন ভাবতে থাকি যে, আমি যেন একজন আইনবিদ আর তাই নিজের বিরুদ্ধে বির্তক করতে চাই। অন্যভাবে বললে সব ব্যাপারটাই যেন আমার বিরুদ্ধে ভাবতে চাই। যে সব ব্যাপার আমার ইচ্ছার ক্ষতি করতে চাইছে, সে সব ঘটনার আমি মুখোমুখি হতে চাই না।
এরপর আমি দুপক্ষের কথাই কাগজে লিখে রাখি–আমার পক্ষের আর আমার বিপক্ষের। প্রায়ই দেখি এই দুটোর মাঝামাঝিই এর উত্তর থাকে।
আমি যা বলতে চাইছি তা হল এই–আপনি, আমি বা আইনস্টাইন বা সুপ্রীম কোর্টও তথ্য আহরণ করে সমস্যা সমাধান করতে উদ্যোগী হয় না। টমাস এডিসনও তা জানতেন। তার মৃত্যুকালে তার নানা সমস্যায় আকীর্ণ প্রায় আড়াই হাজার নোট বই ছিল।
অতএব আমাদের সমস্যা সমাধানের প্রথম নীতি হল : তথ্য সংগ্রহ করুন। তাই আসুন ডীন হকস যা করেছেন তাই করা যাক–কোন ভাবেই তথ্য সংগ্রহ না করে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করব না।
অবশ্য, দুনিয়ার সব তথ্য পেয়ে সেগুলো বিশ্লেষণ আর ব্যাখ্যা না করতে পারলে কোনই কাজে আসবে না।
আমি বেশ মূল্য দিয়ে অভিজ্ঞতালাভ করে দেখেছি তথ্যগুলো লিখে ফেললে বিশ্লেষণে সুবিধা হয় । অনেক সময় দেখা যায় কাগজে লিখে ফেললেই সমস্যার অনেকক্ষেত্রেই সমাধান হয়ে যায়। চার্লস কেটারিং যেমন বলেছেন, সমস্যা ভালো ভাবে ব্যক্ত করলেই অর্ধেক সমাধান হয়ে যায়।
বাস্তবে কী ঘটে আপনাদের বলছি। চীনারা যেহেতু বলে, একটা ছবি দশ হাজার শব্দের সমান। ধরুন আপনাদের একটা ছবি দেখিয়ে বলছি, আমরা যা বলছি তা সে কিভাবে ছবিতে প্রস্ফুটিত করে।
গ্যালেন লিচফিল্ডের কথাই ধরা যাক। ভদ্রলোককে বহুবছর ধরে চিনি–প্রাচ্যদেশে সবচেয়ে সফল আমেরিকান ব্যবসায়ী তিনি। মিঃ লিচফিল্ড ১৯৪২ সালে চীনে ছিলেন, সে সময় জাপানীরা সাংহাই আক্রমণ করে। আমার বাড়ির অতিথি হয়ে উনি যা বলেন তা এই
জাপানিরা পার্ল হারবার আক্রমণ করার কিছু পরে, তারা সাংহাইতে তরতর করে ঢুকে পড়ে। আমি সাংহাইতে এশিয়া জীবন বীমা কোম্পানীর ম্যানেজার ছিলাম। তারা ব্যবসা গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য একজনকে পাঠাল–লোকটা একজন অ্যাডমিরাল । এ ব্যাপারে আমার করণীয় কিছুই ছিল না। আমি সহযোগিতা করতে পারলে ভালো, না হলে নিশ্চিত মৃত্যু।
আমাকে যাই বলা হলো তাই করে গেলাম, কারণ অন্য পথ ছিলো না। তবে কিছু দলিল ছিলো যার মূল্য সাড়ে সাতলক্ষ ডলার। অ্যাডমিরালকে সেটা না দিয়ে চেপে গেলাম। কারণ সেটা ছিলো আমাদের হংকং ব্যাঙ্কের হিসেব, সাংহাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন। তাহলেও ভয় হলো জাপানীরা টের পেলে ভয়ানক বিপদ হবে। তারা টের পেয়েও গেল।
যখন ওরা জানতে পারলো আমি তখন অফিসে ছিলাম না। তখন আমার হেড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন। তিনি জানালেন জাপানি অ্যাডমিরাল ক্ষেপে আগুন, আমাকে তিনি চোর, বিশ্বাসঘাতক ইত্যাদি বলে গালাগাল দেন। আমি জাপানি সেনাদের আগ্রাহ্য করেছি–এর ফল কি হতে পারে তা আমার জানা ছিলো। আমাকে ব্রিজ হাউসে পাঠানো হবে।
ব্রিজহাউস হলো জাপানি গুপ্ত পুলিশের অত্যাচার কক্ষ। আমার কিছু বন্ধু ওখানে পাঠানোর আগেই আত্মহত্যা করে। আমার অন্য বন্ধু প্রশ্ন আর অত্যাচারের দশদিন পর ওখানে মারা যায়। এবার আমাকেই পাঠানো হবে।
আমি কী করলাম? আমি রবিবার বিকেলে খবরটা শুনি। ভয়ে আমার নীল হয়ে ওঠা উচিত ছিল। হতাম ও তাই, যদি না আমার সমস্যা সমাধানের নিজস্ব কায়দা থাকতো। বহু বছর ধরে সমস্যা এলেই টাইপ রাইটারে দুটো প্রশ্ন লিখে ফেলতাম :
১। কী নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি?
আমার ভয় হচ্ছে
আমাকে কাল সকালে ব্রিজহাউসে পাঠানো হবে।
২। এটা নিয়ে কি করতে পারি?
অনেকক্ষণ ভেবে চারটি পথ গ্রহণ
করার কথা ভাবলাম–আর তার
সম্ভাব্য পথ।
১। আমি
জাপানী অ্যাডমিরালকে বোঝানোর
চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু তিনি ইংরাজী জানেন না।
দোভাষীর
সাহায্যে চেষ্টা করলে তিনি ক্ষেপে যেতে পারেন।
লোকটি
নিষ্ঠুর হলে এতে মৃত্যু ঘটতে পারে। তিনি আমাকে হয়তো ব্রিজহাউসেই
পাঠাবেন।
২। আমি
পালানোর চেষ্টা
করতে পারি। সেটা অসম্ভব। তারা
সবসময় আমার উপর নজর রাখছে। পালাতে গেলেই ধরা পড়ে গুলি
করা হবে।
৩। আমার
ঘরেই বসে থেকে অফিসে না যেতে পারি। এটা করলে ওই জাপ অ্যাডমিরালের সন্দেহ হবে আর
ধরে এনে আমায় ব্রিজহাউসে পাঠানো হবে।
৪। সোমবারে
সকালে যথারীতি অফিস যেতে পারি। এটা করলে অ্যাডমিরাল এত ব্যস্ত থাকতে পারেন যে আমি কি করেছি তার মনে
থাকবে না। মনে থাকলেও ঠাণ্ডা হওয়ায় হয়তো কিছু বলবেন না । এটা হলে আমার ভয় নেই।
কিছু বললে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করতে পারি। অতএব
সোমবার সকালে
যথারীতি অফিসে গেলে ব্রিজহাউসে যাওয়া থেকে বাচার দুটো সুযোগ আছে।
যখনই ঠিক করলাম সোমবার অফিসে যাব, অনেকখানি দুশ্চিন্তাই আমার কেটে গেল।
পরদিন সকালে অফিসে ঢুকতেই জাপানী অ্যাডমিরালকে ঠোঁটে সিগারেট লাগিয়ে বসে থাকতে দেখলাম। তিনি বরাবরের মত চড়া চোখে তাকালেন, কিছু বললেন না। দু’সপ্তাহ পরে–ঈশ্বরকে ধন্যবাদ–তিনি টোকিও ফিরে গেলেন আর আমারও দুশ্চিন্তার অবসান হলো।
যা বলেছি, রবিবার বিকেলে বসে কি কি পথ নেওয়া উচিত লিখে ফেলার ফলেই সম্ভবতঃ আমার, জীবন রক্ষা হয়। এটা যদি না করতাম হয়তো ইতস্তত করতাম আর আচমকা ভুল কাজ করতাম–সারা রাত ঘুমোতে পারতাম না। পরদিন অফিসে ক্লান্তভঙ্গীতে গেলেই লোকটার সন্দেহ জাগতো। ১. অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছবার মূল্য কি আমি জানি। এটা যারা পারেন না তাদেরই বিপদ হয়, তারাই স্নায়বিক বিকারে ভুগে জীবিত অবস্থায় নরকবাস করেন। আমি দেখেছি কোন সিদ্ধান্তে এলেই আমার শতকরা পঞ্চাশভাগ দুশ্চিন্তা কেটে যায়, আর বাকি চল্লিশভাগও দূর হয় সিদ্ধান্ত কাজে লাগালে।
অতএব আমি শতকরা নব্বই ভাগ দুশ্চিন্তাই নিচের চারটি উপায় কাজে লাগিয়ে দূর করতে পারি :
১। পরিষ্কার লিখে ফেলা কিজন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
২। কি
করতে পারি তা লিখে ফেলা।
৩। কি করবো ঠিক করে ফেলা।
৪। সিদ্ধান্তটি সঙ্গে সঙ্গে কাজে লাগানো।
গ্যালেন লিচফিল্ড বর্তমানে স্টার, পার্ক ও ফ্রিম্যান কোম্পানীর প্রাচ্যের ডিরেক্টর। তিনি এশিয়াতে একজন বিশিষ্ট আমেরিকান ব্যবসায়ী। তিনি আমার কাছে স্বীকার করেছেন তার সব সাফল্যের মূল হল দুশ্চিন্তা বিশ্লেষণ করে সোজাসুজি তার মুখোমুখি হওয়া।
এই পদ্ধতি এত কাজের কেন? কারণ এটি চমৎকার আর সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে। এর উপর এটি সেই চরম আর তৃতীয় নিয়ম কাজে লাগায়, কিছু একটা করুন। কিছু না করার অর্থ তথ্য সংগ্রহের সব পরিশ্রমই যে ব্যর্থ হয়।
উইলিয়াম জেমস বলেছিলেন, কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছলে তাকে কাজে লাগানোর পর এর ফলের জন্য দায়িত্ব আর চিন্তা ত্যাগ করবেন (চিন্তা কথাটি তিনি দুশ্চিন্তা অর্থেই ব্যবহার করেন)। তার কথা হলো–তথ্যে নির্ভর করে কোন সিদ্ধান্তে এলে কাজে নেমে পড়ুন। কখনই পুনর্বিবেচনা করবেন না, ইতস্তত করবেন না, আত্মসন্দেহে দোদুল্যমান হবেন না তাতে অন্য সন্দেহ জাগে। পিছনে তাকাবেন না।
তাহলে গ্যালেন লিচফিল্ডের কৌশল, দুশ্চিন্তা দূর করতে কাজে লাগান না কেন? এবার প্রশ্নগুলো দেখে নিন–পেন্সিল দিয়ে নিচের ফাঁকে তা লিখে ফেলুন :
১নং প্রশ্ন : কি জন্য দুশ্চিন্তা করছি?
২নং প্রশ্ন : এ ব্যাপারে আমি কি করতে পারি?
৩নং প্রশ্ন : আমি এ ব্যাপারে যা করতে যাচ্ছি তা এই।
৪নং প্রশ্ন : কাজটা কখন শুরু করব?