একঘেয়েমি জনিত অবসাদ ও উদ্বেগ কাটানোর উপায়
অবসাদের অন্যতম প্রধান কারণই হলো একঘেঁয়েমি। উদাহরণ হিসেবে একজনকে হাজির করতে দিন। ধরুন এলিসের কথাটাই। আপনারই বাড়ির কাছে সে থাকে। পেশায় সে স্টেনোগ্রাফার। একরাতে সে বাড়ি ফিরলো অবসাদে প্রায় ভেঙে পড়ে মাথায় যন্ত্রণা নিয়ে। মায়ের অনুরোধে সে খেতে বসল কিন্তু খেতে পারলো না। তখনই টেলিফোন বেজে উঠলো। ওর এক বয় ফ্রেন্ড ফোন করছিল! সে নাচের আসরে যেতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। আনন্দে চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল এলিসের। ওর মন চনমনে হয়ে উঠলো। তাড়াতাড়ি উপরে গিয়ে পোশাক পালটে ও ছুটল। এরপর রাত তিনটে পর্যন্ত নাচ গান করে বাড়ি ফিরলো এলিস–ক্লান্তির কোন চিহ্নই ছিলো না। ওর এমন আনন্দ হচ্ছিল যে ঘুম আসছিল না।
তাহলে কি আট ঘন্টা আগে এলিস ক্লান্ত ছিলো না? নিশ্চয়ই ছিল। সে অবসাদে ভেঙে পড়েছিলো কারণ নিজের কাজে ওর একঘেঁয়েমি এসেছিল। এরকম আরও এলিসকে খুঁজে পাওয়া যাবে। আপনিও একজন হতে পারেন।
আর এটা সত্য যে আপনার আবেগজনিত মনোভাবই শারীরিক পরিশ্রমের চেয়ে অবসাদ সৃষ্টির জন্য বেশি . দায়ী। কয়েক বছর আগে জোসেফ ই. বারম্যাক আর্কাইভস অব সাইকোলজি–তে এক প্রবন্ধে বুঝিয়েছিলেন একঘেঁয়েমি কেমন করে অবসাদ সৃষ্টি করে। একটা পরীক্ষার মধ্য দিয়েই তিনি এটা জানান। ডঃ বারম্যাক কিছু ছাত্রকে কোন এক পরীক্ষার কাজে লাগিয়েছিলেন যেটায় তিনি জানতেন তাদের কণামাত্রও আগ্রহ ছিল না। ফলাফল কি হলো? ছাত্ররা অভিযোগ করলো তারা অবসাদগ্রস্ত, মাথার যন্ত্রণায় আক্রান্ত, চোখ টাটানিতে বিরক্ত আর তাদের ঘুম পাচ্ছিলো। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের পেটেরও গণ্ডগোল হয়। সবটাই কি কল্পিত? না। বিপাকীয় পরীক্ষায় দেখা যায় যে শরীরে রক্তের চাপ আর অক্সিজেন গ্রহণ কোন মানুষ একঘেয়ে বোধ করলেই কমতে থাকে। অথচ সে কাজে আগ্রহ আর আনন্দ বোধ করার সঙ্গে সঙ্গেই বিপাকীয় ক্রিয়া বেড়ে যায়।
আমরা যখন পছন্দসই আর উত্তেজনাময় কাজ করি তখন কদাচিত আমরা অবসাদগ্রস্ত হই। উদাহরণ হিসেবে ধরুন, আমি কিছুদিন আগে কানাডিয়ান রকি পর্বত এলাকার লুইজি হ্রদ অঞ্চলে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলাম। সেখানে বেশ কিছুদিন আমি প্রবাল খাড়ি বরাবর মাছ ধরেছিলাম। এই আনন্দ করতে গিয়ে আমার মাথার চেয়েও উঁচু সব ঝোঁপের মধ্য দিয়ে পথ করে চলেছি, গাছের গুঁড়িতে হোঁচট খেয়ে পড়েছি–অথচ আট ঘন্টার টানা পরিশ্রম করার পরেও এতটুকুও ক্লান্ত হইনি। এমন হওয়ার কারণ কি? কারণ হলো উত্তেজনা আর দারুণ আনন্দে ছিলাম। দারুণ কাজ করেছি বলে আমি ভাবছিলাম। মস্ত আকারের ছ’টা ট্রাউট মাছ ধরেছিলাম। ধরুন যদি মাছ ধরতে ধরতে আমার একঘেয়েমি আসতো, তাহলে আমার মনোভাব কেমন হতো? তাহলে এমন পরিশ্রমের পর সাত হাজার ফিটের উপর আমায় অবশ্যই অবসাদে ভেঙে পড়তে হতো।
পাহাড়ে চড়ার মতো পরিশ্রমসাধ্য কাজে একঘেয়েমিই পরিশ্রমের চেয়ে ঢের বেশি অবসাদগ্রস্ত করে দেয়। একটা উদাহরণ দিচ্ছি : মিনিয়াপোলিশের মিঃ এস. এইচ. কিংম্যান ব্যাপারটা আমায় জানান। ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে কানাডা সরকার কানাডা আলপাইন ক্লাবকে প্রিন্স অব ওয়েলস রেঞ্জার্সের কিছু সৈন্যকে পর্বতারোহণ শেখানোর জন্য কিছু পথপ্রদর্শক দিতে অনুরোধ জানায়। মি কিংম্যান ছিলেন ঐ সৈন্যদের পর্বতরোহণ শেখানোর একজন শিক্ষক আর গাইড। তিনি আমায় বলেছিলেন ওই সব গাইডদের বয়স ছিল বিয়াল্লিশ থেকে ঊনষাট বছর–তারা ওই সব তরুণ সৈন্যদের হিমবাহ আর তুষার স্কুপের উপর দিয়ে প্রায় চল্লিশ ফুট খাড়া চুড়োতেও নিয়ে যান। সেখানে তাদের ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক পথে যেতে হয়, কোন রকমে পা রাখা যায় এমন পথেও উঠতে হয়। তারা কানাডিয়ান রকি পর্বতের উচ্চ শিখরে তার নাম করণ হয়নি এমন সব শিখরেও ওঠেন। কিন্তু পনেরো ঘন্টা ধরে এই পর্বতারোহণের পর স্বাস্থ্যবান তরুণ সৈন্যরা (যারা প্রায় ছ’মাস কঠিন শিক্ষাক্রম অনুসরণ করেছিলো) প্রায় অবসাদে ভেঙে পড়ে।
ওদের ওই অবসাদ কি আগেকার কঠিন শিক্ষায় মজবুত না হয়ে ওঠা পেশীর জন্য? যারা কমাণ্ডো ট্রেনিং গ্রহণ করেছেন তারা কথাটা শুনে হেসে উঠবেন! না, তাঁরা অবসাদগ্রস্ত হয়েছিল পাহাড়ে চড়ার একঘেয়েমির জন্য। তাদের কেউ কেউ এমনই ক্লান্ত হয়ে পড়ে যে খাবার জন্য অপেক্ষা না করেই ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের পথপ্রদর্শকরা যারা সৈন্যদের চেয়ে বয়সে দুই বা তিনগুণ বড়–তারাও কি ক্লান্ত হয়? হ্যাঁ, তারা ক্লান্ত হলেও ভেঙে পড়েনি। তারা নৈশভোজ সেরে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্পগুজব করে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা আলোচনা করে চলেছিলো। তারা ভেঙে পড়েনি কারণ তাদের আগ্রহ ছিলো।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ড ব্রডওয়ার্ড থাইক অবসাদ নিয়ে পরীক্ষা করার সময় কিছু তরুণকে প্রায় এক সপ্তাহ ঘুমোতে দেননি নানা উৎসাহজনক কাজে ব্যস্ত রেখে। নানা রকম পরীক্ষার পর তিনি ঘোষণা। করেন : একঘেয়েমিই হলো কাজে উৎসাহ কমে আসার কারণ।
আপনি যদি মানসিক পরিশ্রম করে থাকেন তাহলে আপনার কাজের পরিমাণ আপনাকে অবসাদগ্রস্ত করে তোলে না। যে কাজ আপনি করেন না তাই আপনাকে ক্লান্ত অবসাদময় করে তুলতে পারে। যেমন ধরুন, গতসপ্তাহে কথাটাই, সে সময় আপনি হয়তো বারবার বাধাপ্রাপ্ত হন। কোনো কাজ শেষ হয়নি, চিঠির জবাব দেওয়া হয় নি, সাক্ষাৎকার করা যায়নি। সবই কেমন গোলমেলে হয়ে যায়। কিন্তু আপনি সেদিন কিছু না করেও বাড়ি ফিরলেন ক্লান্ত হয়ে মাথায় যথেষ্ট যন্ত্রণা নিয়ে।
অথচ পরের দিন অফিসে সবই চমৎকার কাজকর্ম হয়। আগেকার চল্লিশগুণ বেশি কাজ করেন। আপনি। তা সত্বেও ঝকঝকে সাদা টাটকা গার্ডেনিয়া ফুলের মতো হয়েই বাড়ি ফিরলেন। আপনার এ অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই হয়েছে। হয়েছে আমারও।
এ থেকে কি শিক্ষা পাচ্ছি আমরা? এই শিক্ষা যে, আমাদের অবসাদ আসে কাজের জন্য নয় বরং ভাবনা চিন্তা হতাশ আর বিরক্তি থেকে।
এই পরিচ্ছেদ লেখার সময় আমি জেরোম কার্ণের সঙ্গীত বহুল ‘শো বোট’ নাটকটি দেখতে গিয়েছিলাম। নাটকের নায়কের মুখে শোনা যায় : একমাত্র ভাগ্যবান তারাই যারা কাজ করে আনন্দ পায়। এরকম মানুষেরা ভাগ্যবান এই জন্যই যে তাদের রয়েছে অনেক বেশি ক্ষমতা, কম উদ্বেগ আর কম অবসাদ।
কিন্তু এসব কথা জেনে লাভ কি? আপনার এতে করার আছেই বা কি? একজন স্টেনোগ্রাফারের কথা বলছি–অকলাহোমার টুলসার এই স্টেনোগ্রাফার কি করেছিল শুনুন। তাকে সারা মাস ধরেই একঘেয়েমিভরা কাজ করে চলতে হতো। তার কাজ ছিল কাগজপত্র গোছানো, চিঠিপত্র তৈরি রাখা, এই সব। অত্যন্ত একঘেয়ে কাজ বলে সে একদিন নিজে বাচার জন্যেই কাজটা একটু আনন্দময় করবে বলে ভেবে নিল। নিজে নিজেই সে একটা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে ফেললো। প্রতিদিন সকালে কতগুলো ফর্ম সে তৈরি করতো এবং সেগুলো গুণে রাখতে আরম্ভ করলো। তারপর সেই সংখ্যা বিকেলের দিকে যাতে অতিক্রম করতে পারে তার ব্যবস্থা করা হল। সে প্রতিদিনের কাজের হিসেব রেখে পরদিন সেটা। পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে আরম্ভ করল। এর ফল কেমন হয়েছিল? সে অল্প কদিনের মধ্যেই ওর দপ্তরের বাকি স্টেনোগ্রাফারের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করে ফেলতে লাগলো। কিন্তু তাতে তার কি হলো? সে প্রশংসা লাভ করলো, না…ধন্যবাদ পেলো? না,…পদোন্নতি ঘটলো? না।…মাইনে বাড়লো? তাও না …তবে এর ফলে তার অবসাদের ভাব কেটে গেলো। সে পেলো সেই একঘেয়েমি ভরা কাজ থেকে মানসিক আনন্দ এবং আরও শক্তি, আনন্দ আর অবসর যাপনের সুখ।
গল্পটা যে সত্যি সেটা আমার জানা, কারণ ওই মেয়েটিকেই আমি বিয়ে করেছি।
আরও একজন স্টেনোগ্রাফারের গল্প শোনাচ্ছি। তিনিও একঘেঁয়েমি ভরা কাজকে আনন্দময় করতে চেষ্টা চালিয়ে সফল হন। তিনি আমাকে নিজের কাহিনী লিখে জানিয়ে ছিলেন। সেটা তার নিজের ভাষাতেই বলছি :
আমাদের অফিসে স্টেনোগ্রাফারের সংখ্যা হলো চারজন। চারজন নানাজনের চিঠিপত্র দেখাশোনা করে। আমাদের কাজের চাপে মাঝে মাঝে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়। একবার একজন সহকারী অধিকর্তা আমাকে একটা বড় চিঠি টাইপ করার কথা বলেন। আমি আপত্তি জানিয়ে বলি কয়েকটা কথা শুধরে নিলেই কাজ চলতে পারে। নতুন করে টাইপ করতে হবে না। ভদ্রলোক আমাকে দু কথা শুনিয়ে। জানালেন আমার ইচ্ছে না থাকলে অন্য কাউকে দিয়েই তিনি টাইপ করিয়ে নেবেন। প্রচণ্ড রাগ করেই। আমি চিঠিটা নিলাম। হঠাৎ আমার মনে হলো আমার জায়গায় থেকে কাজ করতে পারলে অনেকেই ধন্য হতো। তাছাড়া ঠিক এই রকম কাজ করার জন্যেই আমাকে মাইনে দিয়ে রাখা হয়েছে। এরপরেই ভালো। বোধ করতে লাগলাম। আচমকা মন ঠিক করে ফেলোম, যেন ভালো লাগে এমন মনোভাব নিয়ে এবার থেকে কাজ করবো–যদিও মনে মনে আমার ঘৃণাই হতো। তারপরেই আমি এই দারুণ দরকারী জিনিস আবিষ্কার করে বসলাম। আমি যদি কাজটা ভালোবাসি মনে করে কাজ করে যাই, তাহলে কিছুটা ভালো করে কাজ করতে পারবো। অতএব আমায় কদাচিৎ বাড়তি কাজ করার দরকার হতো। আমার এই নতুন পদ্ধতির ফলে ভালো কর্মচারী হিসেবে আমার সুনাম হলো। এরপর যখন একজন বিভাগীয় সুপারিন্টেডেন্টের একজন প্রাইভেট সেক্রেটারির দরকার হলো তিনি আমাকেই চাইলেন, কারণ তাঁর মতে। আমি অসন্তুষ্ট না হয়ে বাড়তি কাজ করতে চাই এবং ঠিক এমনটাই তার দরকার। এই ভাবে শুধু মানসিক চিন্তাধারা বদলের ফলেই দারুণ কিছু ঘটে গেলো। এ এক দারুণ আবিষ্কার। অদ্ভুত কিছুই এতে ঘটেছে।
ক’বছর আগে হারল্যান এ. হাওয়ার্ড এমন একটা সিদ্ধান্ত নেয় যে তাতে তার জীবন ধারাই সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। তিনি নীরস একটা কাজকে সরস করতে চেষ্টা করেন। সত্যিই তার কাজটা একঘেয়েমিতে ভরা ছিলো–প্লেট সাফ করা, কাউন্টার ধোলাই করা, উঁচু ক্লাসের খাওয়ার ঘরে আইসক্রিম সরবরাহ করা ইত্যাদি যখন করত, তখন অন্য ছেলেরা খেলাধূলোয় বা মেয়েদের সঙ্গে খুনসুটি করতে ব্যস্ত। হারল্যান হাওয়ার্ড মনে প্রাণেই তার কাজকে ঘৃণা করত। কিন্তু কাজটা যখন তাকে করে যেতেই হবে, তখন সে আইসক্রীম কি দিয়ে তৈরী সেটা জানবে বলে ঠিক করে ফেলল। তাছাড়া একটা আইসক্রীম আর একটার চেয়ে কেনই বা ভালো। সে আইসক্রীমের রসায়ন পড়তে আরম্ভ করল আর পরে দক্ষতাও অর্জন করলো। খাদ্য রসায়ন সম্পর্কে তার আগ্রহ এতই বেড়ে উঠল যে শেষপর্যন্ত সে ম্যাসাচুসেটস্ স্টেট কলেজে ভর্তি হলো। এরপর যখন নিউইয়র্ক কোকো এক্সচেঞ্জ, কোকো আর চকলেট সম্বন্ধে একশ ডলার পুরস্কার প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করলে কলেজ ছাত্রদের জন্য–কে জয়ী হল জানেন? হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। হারল্যান হাওয়ার্ড।
কাজকর্ম জোগাড় করতে না পেরে সে তার বাড়ি ম্যাসাচুসেটসের আমহাস্টের ৭৫দ্ম নর্থ প্লেজান্ট স্ট্রীটে একটা ছোট্ট গবেষণাগার খুললো। কিছুদিনের মধ্যে দেশে একটা নতুন আইন চালু হলো যে দুধের মধ্যেকার বীজানু গুনতে হবে। হারল্যান হাওয়ার্ডকে কিছুদিনের মধ্যেই আমহার্স্টের অন্তত কুড়িটা প্রতিষ্ঠানের দুধের বীজানু গোনার কাজে দেখা গেল। তাকে দুজন সহকারীও রাখতে হলো।
পঁচিশ বছর পরে এই ছেলেটির কি হবে জানেন? এখন যারা ব্যবসা পরিচালনা করে চলেছেন সেই সব মানুষ ততদিনে অবসর নেবেন বা হয়তো পরলোকে যাবেন, আর তাদের স্থান নেবেন আজকের হাস্যোজ্জ্বল করিকর্মা তরুণ ছেলেরাই। পঁচিশ বছর পরে আজকের হারল্যান হাওয়ার্ড হয়ে উঠবে তার পেশায় একজন অতি বিখ্যাত মানুষ, অন্য দিকে তার সহপাঠিরা, যাদের সে আইসক্রীম বিক্রী করতো তারা হয়তো বেকার থেকে সরকারকে অভিসম্পাত দিয়ে চলবে। হারল্যান এ, হাওয়ার্ড হয়তো কোন সুযোগ পেত না যদি না সে একটা একঘেয়েমি ভরা কাজকে আনন্দময় করে তুলতে চাইত।
বেশ ক’বছর আগে আর একজন তরুণও তার কাজ নিয়ে একঘেয়েমিতে আক্রান্ত হয়েছিল। তার কাজ ছিল কারখানার লেদ মেসিনে বল্ট তৈরি করা। ছেলেটির নাম ছিলো শ্যাম। কাজ ভালো লাগতো না বলেই শ্যাম কাজ ছেড়ে পালাতে চাইত, কিন্তু তার ভয় ছিল অন্য কাজ যদি না পায়। কাজটা তাই করে যেতে হবে বলেই শ্যাম ঠিক করলো কাজকে আনন্দময় করে তুলতে হবে এই ভেবেই সে তার পাশের মেসিন চালকের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল। দুজনে পাল্লা দিয়ে বল্ট বানাতে আরম্ভ করলো। দুজনে দেখতে কে বেশি বানিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা ফোরম্যানের নজরে পড়লো। তিনি শ্যামের কাজের গতিতে দারুণ খুশি হয়ে তাকে আরও ভালো কাজে লাগালেন। এই হলো পরপর কতকগুলো পদোন্নতির শুরু। ত্রিশ বছর পরে, শ্যাম–স্যামুয়েল ভকলেন–হলেন বণ্ডুইন লোকোমোটিভ ওয়ার্কসের প্রেসিডেন্ট। তিনি সারা জীবন ধরেই ওই মেকানিক থেকে যেতেন যদি না নিজের কাজকে আনন্দময় করে তুলতে চাইতেন।
বিখ্যাত বেতার সংবাদ ঘোষক এইচ. ভি. ক্যাপ্টেনবর্ণ একবার আমাকে বলেন কিভাবে তিনি নীরস একটা কাজকে আনন্দময় করে তোলেন। তার বাইশ বছর বয়সের সময় তিনি জাহাজে আতলান্টিক পাড়ি দেন। কিছু গবাদি পশুর তদারকির কাজ করেন। বাইসাইকেলে ইংল্যাণ্ড পরিক্রমার পর প্যারি শহরে পৌঁছন ক্যাপ্টেনবর্ণ। নিজের ক্যামেরা মাত্র পাঁচ ডলারে বাঁধা রেখে তিনি প্যারির সংস্করণ নিউইয়র্ক হেরাল্ডে একটা কাজের আবেদন করে বিজ্ঞাপন দেন। কাজও একটা জুটে যায়–ছবি দেখার ষ্টিরিওস্কোপ মেসিন বিক্রির। মেশিনের কথাটা বয়স্ক মানুষেরা সবাই জানেন দুটো ছবি ঘোরাতে থাকলে একটা হয়ে ত্রিস্তর ছবি হয়ে ওঠে।
ক্যাপ্টেনবর্ণ শেষ পর্যন্ত ওই মেসিন প্যারীর দরজায় ঘুরে বিক্রী করতে আরম্ভ করলেন–অসুবিধাও ছিলো কারণ ফরাসীতে তিনি কথা বলতে পারতেন না। তা সত্বেও কিন্তু তিনি প্রথম বছরেই পাঁচ হাজার ডলার কমিশন পেয়ে সে বছরে ফ্রান্সের সবচেয়ে বেশি আয়ের বিক্রেতা হয়ে উঠলেন। ক্যাপ্টেনবর্ণ আমায় জানিয়ে ছিলেন এমন কাজ তার পক্ষে করা সম্ভব হয়েছিল একটা মাত্র কারণেই–আর সেটা হলো আত্মবিশ্বাস। হার্ভার্ডে এক বছর পড়াশুনা করার ফলেই এই আত্মবিশ্বাস তার মধ্যে জন্ম নেয়।
তাহলে ফরাসি ভাষা না জানা সত্বেও এ আত্মবিশ্বাস তাঁর এল কি করে? আসলে কিভাবে বিক্রীর সময় কথাগুলো বলতে হবে সেটা তাঁর নিয়োগকর্তা চোস্ত ফরাসীতে তাকে লিখে দেয়ার পর তিনি সেটা মুখস্থ করে রাখেন। কোন বাড়ির দরজায় ঘন্টা বাজিয়ে দিতে গৃহকত্রী দরজা খুললে, ক্যাপ্টেনবর্ণ সুন্দর উচ্চারণে সেই মুখস্থ করা ফরাসিতে কথা বলে মেশিনটা ইঙ্গিত করতেন আর ছবিও দেখাতেন।
গৃহকর্ত্রী বাড়তি প্রশ্ন করলে তিনি শুধু টুপি তুলে বলতেন আমেরিকান…আমেরিকান আর সঙ্গে লেখা সেই ফরাসী লেখাও দেখিয়ে দিতেন। গৃহকত্রীরা আমোদ পেয়ে হাসতেন আর তার কাজও সমাধা হয়ে যেত। ক্যাপ্টেনবর্ণ নিজেই স্বীকার করেছেন কাজটা আদৌ সহজ ছিলো না। তাহলে তার সাফল্যের কারণ কি? একটাই–নিজের কাজ সমাধা করার অদম্য উৎসাহ আর আনন্দময় করে তোলা। প্রতিদিন সকালে বাইরে বেরোনোর আগে তিনি একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলতেন : ক্যাপ্টেনবর্ণ, যদি খেতে চাও তাহলে একাজ তোমাকে করতেই হবে। আর করতে যখন হবেই তখন আনন্দেই সেকাজ করোনা কেন? নিজেকে কোন অভিনেতা ভেবে নাও আর মনে কর কোন মজাদার চরিত্রের অভিনয় করছো।
মিঃ ক্যাপ্টেনবর্ণ নিজে আমায় বলেছেন প্রতিদিনের ওই স্বগতোক্তি তাকে যে কাজ একদিন ঘৃণা করতো তাতেই সফল হতে সাহায্য করেছে। আমেরিকান তরুণদের কাছে তার পরামর্শ হলো, প্রতিদিন কাজে নামা চাই। শারীরিক ব্যায়ামের মতো আমাদের দরকার মানসিক কিছু ব্যায়ামও। তাই প্রতিদিন কিছু স্বগতোক্তি করা ভালো।
এটা কি কোন হাস্যকর ব্যাপার? মোটেই না। এটা সম্পূর্ণ মনোবিদ্যার ব্যাপার। আমাদের জীবন হলো আমাদের মন যা তৈরি করে, আমরা ঠিক তাই। ঠিক মত চিন্তার মধ্য দিয়েই যে কোন কাজ আপনি কম নীরস করে তুলতে পারেন। শুধু ভাবতে চেষ্টা করুন কাজকে আনন্দময় করে তুলতে পারলে তার বদলে কি পাবেন আপনি। একবার ভাবুন এতে আপনার জীবনের আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে উঠতে পারে কারণ আপনি আপনার জাগ্রত থাকার সময়ের শুধু অর্ধেকটাই কাজে ব্যয় করেন। মনে রাখার চেষ্টা করুন। আপনার কাজকে আনন্দময় করে তুললে তাতে পদোন্নতি বা আয়বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। আর তা না হলেও অন্তত আপনার দৈনন্দিন অবসাদ দূর হয়ে আনন্দের পরশ পেতে পারেন।