গৃহকর্ত্রী কীভাবে অবসাদ দূর করবেন
গত শরৎকালে আমার সহকারী বোস্টনে উড়ে গিয়ে বিচিত্র এক ডাক্তারি ক্লাসে যোগ দেয়। ডাক্তারি? বেশ, ভালো কথা। আসলে কিন্তু এটা মনস্তত্বের ক্লাস। এ ক্লাসের উদ্দেশ্য হলো যে সমস্ত মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত তাদের চিকিৎসা। বেশির ভাগ রোগী হল এখানে অসুস্থ গৃহকত্রী।
এ ধরণের দুশ্চিন্তাগ্রস্তদের ক্লাস শুরু হওয়ার গোড়ার কথাটা কি? শুনুন তাহলে ১৯৩০ সালে ডঃ যোশেক এইচ প্র্যাট–যিনি ডঃ উইলিয়াম অসলারের ছাত্র ছিলেন–লক্ষ্য করেন যে সমস্ত রোগী বোস্টন ডিসপেনসারীতে চিকিৎসার জন্য আসেন তাদের বেশির ভাগেরই কোন শারীরিক বৈষম্য থাকে না। এই সব রোগীদের অনেকেই নানা রকম ব্যথার কথা বলতেন। কেউ বলতেন পাকস্থলীতে ক্যান্সার হয়েছে। কেউ বলতেন পিঠে ব্যথা। অথচ ডাক্তারী পরীক্ষায় কোন রোগই ধরা পড়েনি। বহু প্রাচীনপন্থী ডাক্তারই এসব শুনে বলতেন সব রোগটাই মনের । ডঃ ভ্যাট জানতেন সকলকে রোগের কথা ভুলে বাড়ি যেতে বলা বৃথা। কারণ–ওই গৃহকত্রীরা কেউই অসুস্থ হতে চাননি। রোগের কথা ভোলা সম্ভব হলে তারা নিশ্চয়ই তাই করতেন। অতএব করণীয় কি?
এই জন্যই তিনি ক্লাস আরম্ভ করলেন–সঙ্গে সঙ্গে অনেক ডাক্তারই আবার এতে সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করলেন অথচ ক্লাসে চমক সৃষ্টি হল। শুরু হওয়ার পর আঠারো বছর কেটে গেলে হাজার হাজার রোগী যারা এখানে এসেছিলেন, তারা আরোগ্য লাভ করেন। বহু রোগী সেরে যাওয়ার পরেও যেন নিয়মিত গির্জায় আসছেন মনে করে এসেছেন। একজনকে জানি যিনি রোগ সারার পর ন’বছর ধরে নিয়মিত এসেছেন। তিনি বলেছেন যে প্রথম যখন আসেন তাঁর ধারণা ছিল কিডনী বা বুকের অসুখে ভুগছিলেন। এতই দুশ্চিন্তা হত তাঁর যে মাঝে মাঝে কিছুদিনের জন্য অন্ধও হয়ে যেতেন। অথচ আজ তিনি আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ, বয়স মনে হয় যেন চল্লিশ; কোলে নিদ্রিত নাতি। তিনি বলেছিলেন পারিবারিক ব্যাপারে এত দুশ্চিন্তা করতাম যে মনে হত মরণই ভালো। এখানে এসে দুশ্চিন্তার অসারতা টের পেলাম, তা বন্ধ করতেও শিখলাম। এখন বলতে পারি আমার জীবন সম্পূর্ণ নিরুদ্বেগ।
ডঃ রোজ হিলফাডিং হলেন ওই ক্লাসের ডাক্তারী পরামর্শদাতা। তিনি বলেছেন : চট করে দুশ্চিন্তা দূর করার সেরা পথ হল যাকে বিশ্বাস করেন তাকে সমস্যার কথাটা মন খুলে জানানো। আমরা একে বলি ক্যানারসিস। রোগীরা যখন এখানে আসে, তাদের রোগের কথা পুরোপুরি বলার পরেই তারা শান্ত হন। দুশ্চিন্তা নিয়েই কেবল চিন্তা করে চললে, আর তা মনের মধ্যে চেপে রাখলে স্নায়ুর উপর প্রচণ্ড চাপ ও কিছু উপবজ্ঞানের ভিত্তিরও কিছু পড়ে। আমাদের দুশ্চিন্তা ভাগ করে নেওয়া দরকার। আমাদের মনে হওয়া দরকার পৃথিবীতে আমার সমস্যা ভাগ করে নেবার লোক আছে।
আমার সহকারী একবার এক মহিলাকে তাঁর সমস্যার কথা শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে দেখেন। তাঁর পারিবারিক দুশ্চিন্তা ছিল, তিনি যখন কথা বলতে আরম্ভ করেন তখন তাকে মনে হচ্ছিল প্যাঁচ খোলা একখণ্ড স্প্রিং। ক্রমশঃ কথা বলার পর তিনি শান্ত হন। সাক্ষাৎকারের শেষে তাঁকে হাসতেও দেখা যায়। তাঁর সমস্যার কি সমাধান হয়ে গিয়েছিল? না, সেটা তত সহজ নয়। পরিবর্তনের কারণ হল তিনি মনের সব কথা উজাড় করে দিতে পেরেছিলেন। এই চমৎকার নিরাময়ের মূল কথা হলো–মানুষের সহানুভূতি ও কিছু উপদেশ। এই পরিবর্তনের কারণ হল কথা। কথার বিরাট আরোগ্য লাভের ক্ষমতা আছে।
মনোবিজ্ঞানের ভিত্তিরও কিছুটা হল কথার আরোগ্য ক্ষমতা। ফ্রয়েডের আমল থেকেই মনস্তাত্বিকরা দেখেছেন রোগী খুবই স্বস্তি লাভ করে সে যদি শুধু মন খুলে কথা বলতে পারে। এর কারণ কি? হয়তো এর ফলে আমাদের কষ্ট সম্পর্কে কিছু জ্ঞানলাভ হয়, ভালো বোঝা যায়। পুরো ব্যাপারটা অবশ্য কেউ জানেন না। তবে আমরা সবাই জানি, কথা বললে সঙ্গে সঙ্গেই বেশ স্বস্তি মেলে।
অতএব এরপর যখন কোন আবেগ জনিত সমস্যা আসবে তখন কারও সঙ্গে কথা বলিনা কেন? অবশ্য এটা বলছিনা যার সঙ্গেই দেখা হবে তার কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করে সব সমস্যাটা জানাব। এটা কেউই পছন্দ করবেন না। আসলে যাকে বিশ্বাস করি তার কাছেই বলতে পারি। তার সঙ্গে দেখা করে বলতে পারবেন : আমার একটা সমস্যা আছে। আমি আপনার উপদেশ চাই–আশা করি আমার কথাটা একটু শুনবেন। হয়তো উপদেশ দিতে পারবেন, তাছাড়া এই সমস্যার ব্যাপারে আপনার দৃষ্টিভঙ্গীতে যা দেখা সম্ভব আমার পক্ষে তা নাও হতে পারে। যদি উপদেশ নাও দিতে পারেন আপনি শুনলেও আমার উপকার হবে।
বোস্টন ডিসপেনসারীতে কথা বলাই হল চিকিৎসার পদ্ধতি। এখানে কয়েকটা উপদেশ দেওয়া হচ্ছে–গৃহকত্রীরা সেগুলো বাড়িতে কাজে লাগাতে পারেন।
১। একখানা নোটবই রাখতে পারেন। যাতে আঠা দিয়ে আপনার প্রিয় কবিতা, প্রার্থনা বা উদ্ধৃতি সেঁটে রাখতে পারেন। কোন বর্ষণসিক্ত অপরাহ্নে মন মেজাজে ঠিক না থাকলে নোটবই থেকে পাঠ করলে মন ভালো থাকবে।
২। অপরের দোষত্রুটি নিয়ে বেশি ভাববেন না। হয়তো আপনার স্বামীর বহু ত্রুটি আছে। সেসব কথা না চিন্তা করে তার গুণের দিকটাই ভাববেন। ভাবলে পরে দেখবেন এরকম লোক আপনার স্বামী হওয়ায় আপনি গর্বিত বোধ করছেন।
৩। আপনার পড়শীর সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করুন। তাদের সঙ্গে একটা বন্ধুত্বের আবহাওয়া সৃষ্টি করে তুলুন।
৪। রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে পরের দিনের কাজকর্মের একটা তালিকা তৈরী করে রাখুন। এতে কাজকর্মের সুবিধা হবে, কোন কিছু এলোমেলো হবে না।
৫। শেষ কথা হল, সব রকম দুশ্চিন্তা আর অবসাদ এড়িয়ে চলুন। বিশ্রাম নিন। অবসাদ আর দুশ্চিন্তাই আপনাকে অসুস্থ করে তোলে।
হ্যাঁ, আপনি গৃহকত্রী হলে আপনাকে বিশ্রাম করতেই হবে। আপনার একাজে একটা বিশেষ সুবিধাও রয়েছে–আপনি যখন খুশি বিশ্রাম নিতে পারেন। যদি চান মেঝেতে ও শুয়ে পড়তে পারেন। আশ্চর্যের কথা হল শক্ত মেঝেয় শোওয়া স্প্রিং লাগানো গদীর চেয়ে ভালো–এতে মেরুদণ্ড ভালো থাকে।
ভালো কথা, এবার কিছু ব্যায়ামের কথা বলি। এগুলো একসপ্তাহ চেষ্টা করে দেখুন–তাতে কি ফল হয় দেখবেন :
(ক) যখনই ক্লান্ত মনে হবে সটান শুয়ে পড়ুন দরকার হলে গড়িয়ে নিতেও পারেন, দিনে দুবার এটা করবেন।
(খ) চোখ বন্ধ করুন। সমস্ত চিন্তা দূর করে সূর্য বা তারার মত নিজেকে বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত ভাবতে থাকুন।
(গ) সমস্ত রকম দুশ্চিন্তা বন্ধ করুন–আর আস্তে আস্তে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে থাকুন। এবিষয়ে ভারতীয় যোগীরা ঠিক বলেছেন, ছন্দময় শ্বাস প্রশ্বাসে স্নায়ু শান্ত হয়।