দুশ্চিন্তার ভার বইবেন না
এই নাটকীয় কাহিনীটি আমৃত্যু আমর মনে থাকবে। নিউ জার্সির রবার্ট মূর এটা আমায় বলেছিলেন।
তিনি যা বলেছিলেন সেটা এই রকম : ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা পাই। ইন্দোচীনের উপকূলের কিছু দূরে জলের ২৭৬ ফিট নিচে আমার এটা শিক্ষালাভ হয়। এম, এস, বায়া–৩১৮ নামে একটা ডুবোজাহাজের অষ্টাশি জনের মধ্যে আমি ছিলাম একজন। আমরা রাডারে আবিষ্কার করি ছোট্ট একটা জাপানি জাহাজ আমাদের দিকে আসছে। সকাল হওয়ার মুখে আমরা সেটা আক্রমণের জন্য ডুব মেরে তৈরি হলাম। পেরিস্কোপের মধ্য দিয়ে দেখলাম একটা জাপানি ডেস্ট্রয়ার, একটা ট্যাঙ্কার আর মাইনফেলা জাহাজও আছে। আমরা তিনটে টর্পেডো ছড়লাম–কিন্তু কোনোটাই লাগলো না। প্রত্যেকটা টর্পেডোর মধ্যে কিছু গোলযোগ ঘটে যায়। ডেস্ট্রয়ারটা যে আক্রান্ত হয়েছে না বুঝেই এগিয়ে চললো। আমরা শেষের মাইন পাতা জাহাজটা আক্রমণ করবো ভেবে তৈরি হতেই সে আচমকা ঘুরে আমাদের দিকে চলে এলো (একটা জাপানি প্লেন আমাদের ষাট ফুট জলের নিচে দেখতে পেয়ে মাইন পাতা জাহাজটাকে জানিয়ে দেয়।) আমরা ১৫দ্ম ফিট নেমে গেলাম যাতে আমাদের আর দেখা না যায় আর ডেপথচার্জ আক্রমণের জন্য তৈরি হলাম। আমরা নিঃশব্দে থাকার জন্য ফ্যান বন্ধ করলাম, ঠাণ্ডা করার যন্ত্র আর বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও বন্ধ করে দিলাম।
তিন মিনিট পরে যেন নরক ভেঙে পড়ল। আমাদের চারপাশে ছয়টা ডেপথচার্জ ফেটে আমাদের ঠেলে প্রায় সমুদ্রের ডাঙ্গায় পৌঁছে দিল–প্রায় ২৭৬ ফিট তলায়। আমরা প্রচণ্ড ভয় পেলাম। একহাজার ফিট গভীরতায় আক্রমণই বিপজ্জনক–পাঁচশো ফিটের কম হলে তো মারাত্মক। আর আমাদের প্রায় তার অধেক জলের গভীরতায় আক্রমণ করা হয়েছে–মাত্র হাঁটু জলে। পনেরো ঘন্টা ধরে জাপানি মাইন পাতা জাহাজটা ডেপথচার্জ ফাটিয়ে গেল। ডুবোজাহাজের সতেরো ফিটের মধ্যে ডেফথচার্জ ফাটলে সেই ধাক্কায় এতে গর্ত হতে পারে। আমাদের পঞ্চাশ ফিটের মধ্যে গাদা গাদা ডেফথচার্জ ফাটলো । আমাদের আদেশ দেওয়া হয় চুপচাপ নিজেদের বাঙ্কে শুয়ে থাকতে। আমি এমনই ভয় পেয়ে যাই যে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। বারবার নিজেকে বলতে থাকি মৃত্যুর আর দেরি নেই! মৃত্যুর আর দেরি নেই!… পাখা আর ঠাণ্ডার যন্ত্র বন্ধ থাকায় ভিতরে তাপ প্রায় একশ ডিগ্রী দাঁড়ায়–তা সত্ত্বেও আমার এমনই শীত লাগতে থাকে যে একটা সোয়েটার আর জ্যাকেট পরেও শীতে থরথর করে কেঁপে চলি। আমার দাঁতে দাঁত লেগে যায়। আক্রমণ প্রায় পনেরো ঘন্টা চললো, তারপরে আচমকা বন্ধ হয়ে যায়। আপাতদৃষ্টিতে বোঝা গেল জাপানীদের ডেপথচার্জ নিঃশেষ হওয়াতেই তারা চলে গেছে। ওই পনেরো ঘন্টা আমার কাছে পনেরো কোটি বছর বলেই মনে হয়েছিল। আমার সারা জীবনের ঘটনাগুলো চোখের সামনে ফুটে উঠেছিল। সারা জীবনে যত খারাপ কাজ করেছি আর সামান্য ব্যাপারে যে দুশ্চিন্তা করেছি তাই ভাবতে লাগলাম। নৌবাহিনীতে যোগদানের আগে আমি একটা ব্যাঙ্কের কেরানী ছিলাম। কম মাইনে, দীর্ঘ সময়, ভবিষ্যতে ক্ষীণ উন্নতির আশা সম্পর্কে দুশ্চিন্তা করতাম। নিজস্ব একটা বাড়ি ছিলো না বলেও ভাবতাম, নতুন গাড়ি আর স্ত্রীকে ভালো পোশাক কিনে দিতে পারতাম না বলেও ভাবতাম। আমার বসের সম্বন্ধে কত কথা ভাবতাম, কি রকম তাকে ঘৃণাও করতাম! ভাবলাম রাতে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে কি সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া করতাম। আমার কপালে গাড়ি দুর্ঘটনায় ঘটা একটা কাটা দাগ নিয়েও কত ভাবতাম সেটাও মনে পড়ে।
বহু বছর আগে এসব দুশ্চিন্তা কত বিরাটই না মনে হত। কিন্তু আমার চারদিকে যখন ডেপথচার্জ পড়ছে আর আমাকে স্বর্গে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত হচ্ছে তখন সেগুলো কতই না তুচ্ছ মনে হলো। আমি শপথ নিলাম এবার যদি বেঁচে উঠে আবার সূর্যের আলো দেখতে পাই তাহলে আর কখনও দুশ্চিন্তা করবো না। কখনও না। সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চারবছর অধ্যয়ন করে যা শিখিনি ওই পনেরো ঘন্টায় তার চাইতে ঢের বেশি শিখেছি।
আমরা অনেকক্ষেত্রে বড় বড় বিপদগুলি বেশ সাহসের সঙ্গেই প্রতিরোধ করতে পারি। কিন্তু সামান্য জিনিস নিয়ে আমরা ভেঙ্গে পড়ি। এ প্রসঙ্গে স্যামুয়েল পিপস্ তার ডায়েরিতে বর্ণনা করেছেন কীভাবে তিনি লন্ডনে স্যার হ্যারিভেনের মাথা কেটে ফেলতে দেখেন। তিনি তখন তার জীবন ভিক্ষা করেন নি। তিনি ঘাতককে শুধু বলেছিলেন তার ঘাড়ের উপর একটা খুব যন্ত্রণাদায়ক ফোড়া আছে সেটার উপর যেন খাঁড়ার ঘা না পড়ে!
ঠিক এমনই প্রমাণ পান এ্যাডমিরাল বার্ড মেরু প্রদেশের প্রচণ্ড ঠাণ্ডায়–তিনি বলেন মানুষ বড় বড় বিপদের চেয়ে ছোট খাট বিপদ নিয়েই বেশি চিন্তা করে। তারা প্রায়ই শূন্য ডিগ্রির চাইতে আশি ডিগ্রির বেশি ঠাণ্ডায় অনেক কষ্ট সহ্য করতে পারত। অ্যাডমিরাল বার্ড বলেছেন, কিন্তু আমার কিছু সঙ্গীর কথা জানি যারা একে অন্যের সঙ্গে কথা বন্ধ করে দেয় কারণ তারা ভেবেছিল তাদের নির্ধারিত জায়গায় অন্যেরা তাদের যন্ত্রপাতি রেখেছে। আমি একজনকে জানতাম যে কিছুতেই ফ্রেচেরিষ্টের সামনে খেতে পারতো না, সে দূরে এক জায়গায় গিয়ে খেত। কারণ ফ্লেচেরিষ্টের অভ্যাস ছিল পেটে যাওয়ার আগে খাদ্যগুলোকে আঠাশবার চিবিয়ে খাওয়া।
কোন মেরুশিবিরে অ্যাডমিরাল বার্ড বলেন, এধরনের ছোট ব্যাপার ও শিক্ষিত মানুষকেও উম্মাদ করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট।
অ্যাডমিরাল বার্ডের মত আপনি আর একটা বিষয়ও জানতে পারেন, তাহলো বিয়ের ব্যাপারেও এইরকম ছোটখাটো ব্যাপার মানুষকে উম্মাদ করে দিতে পারে ।
এটাই বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন। উদাহরণ হিসাবে শিকাগোর যোশেফ স্যাবাথের কথাই ধরুন। তিনি অন্ততঃ চল্লিশ হাজার অসুখী বিবাহ বিচ্ছেদের শুনানী গ্রহণ করেন। তিনি বলেছেন, বিয়ের অসুখী হওয়ার মূল অতি তুচ্ছ কিছু ঘটনা । নিউইয়র্কের ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নী ফ্রাঙ্ক এস. বোগানও বলেছেন, আমাদের ফৌজদারী আদালতের অর্ধেক মামলাই অতি তুচ্ছ কারণে ঘটে। কোন খারাপ কাজ–এই সব তুচ্ছ ব্যাপার থেকেই মারামারি আর খুনজখম ঘটে যায়। আমাদের মধ্যে সামান্য কেউই বড় কোন কারণে আঘাত পাই, তুচ্ছ কোন কারণেই আমাদের অহমিকায় আঘাত লাগে।
এলিনর রুজভেল্টের যখন সবে বিয়ে হয় তিনি অনেকদিন চিন্তায় ছিলেন কারণ তার বঁধুনি অতি বাজে রান্না করতো। মিসেস রুজভেন্ট বলেছেন, ব্যাপারটা আজ ঘটলে আমি গ্রাহ্যই করতাম না। এটাই সবচেয়ে ভালো। এমনকি ক্যাথরিন দি গ্রেটও চরম কর্তৃত্বপরায়না হয়েও পাঁচক রান্না খারাপ করলে হেসে উড়িয়ে দিতেন।
ডিসরেলি বলেছিলেন : জীবন ছোট বলেই এত মহান। একটি পত্রিকায় আন্দ্রে মারোয়া বলেন, এই কথা কটি আমাকে বহু কষ্টকর অবস্থা থেকে মুক্ত করেছে। যে সব ব্যাপার ভুলে যাওয়া দরকার এমন ছোটোখাটো ব্যাপারই আমাদের পীড়ন করে। আমরা যে এই পৃথিবীতে আছি, কবছরই বা আমরা বেঁচে থাকবো; এরই মধ্যে আমরা কত তুচ্ছ বিষয়ে দুশ্চিন্তা করি এবং একবছরের মধ্যেই আমরা তা ভুলে যাবো। না, আসুন আমরা আমাদের জীবন ভালো কাজের মধ্যে দিয়ে সার্থক করে তুলি কারণ জীবন ছোট বলেই তো এতো মহান।
রাডিয়ার্ড কিপলিংয়ের মত বিখ্যাত মানুষও কথাটা ভুলে গিয়েছিলেন। ফল কি হলো? তিনি আর তার শ্যালক ভারমন্ট ইতিহাসে বিখ্যাত মামলায় জড়িয়ে পড়েন। এ ব্যাপারটা এতোই বিখ্যাত হয়ে ওঠে যে একটা বইও লেখা হয়, যার নাম রাডিয়ার্ড কিপলিংয়ের ভারমন্ট বিবাদ।
ব্যাপারটা ছিলো এই রকম : কিপলিং ভারমন্টের একটি মেয়ে ক্যারোলিন ব্যালেস্টিয়ারকে বিয়ে করেন। তিনি ব্র্যাটলবোরোতে চমৎকার একটা বাড়ি বানান সেখানেই বরাবর থাকবেন বলে। তার শালা বিটি ব্যালেসটিয়ারের সঙ্গে কিপলিংয়ের দারুণ বন্ধুত্ব হয়। তারা একসঙ্গে কাজকর্ম আর খেলাধুলো করতেন।
কিপলিং শালার কাছ থেকে কিছু জমি কেনেন, তাতে ব্যবস্থা থাকে ব্যালেস্টিয়ার প্রতিবছর সেখান থেকে খড় কেটে নেবেন। একদিন ব্যালেস্টিয়ার দেখলেন কিপলিং ওই মাঠে ফুলের বাগান তৈরি করছেন। তার রক্ত গরম হয়ে গেল আর তাই তিনি চোটপাট করতে লাগলেন। কিপলিংও জবাব দিলেন। সারা ভারমন্ট গরম হয়ে গেল!
.
এরপর একদিন কিপলিং যখন সাইকেল চড়ছিলেন তখন তার শালা একটা গাড়ি এবং কিছু ঘোড়া নিয়ে এমন আচমকা হাজির হলেন যে কিপলিং প্রায় পড়ে গেলেন। আর সেই কিপলিংই, যিনি লিখেছিলেন তোমার চারপাশের লোক যখন মাথা খারাপ করে, তার জন্য তোমায় দোষ দেয়, তখন তোমার মাথা ঠিক রাখার ক্ষমতা থাকা চাই। তিনি স্বয়ং মাথা খারাপ করে বসলেন। তিনি শালাকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশকে জানালেন। একটা দারুণ মামলা চলল–নানা শহর থেকে বহু সাংবাদিক এলেন–সারা পৃথিবীতে তা রাষ্ট্র হল। কিন্তু সমাধান হলো না। এর ফলে কিপলিং এবং তার স্ত্রী আর আমেরিকায় থাকা সম্ভব না হওয়ায় তারা সেখান থেকে চিরকালের জন্য দেশত্যাগ করলেন। ব্যাপারটা কিন্তু নেহাতই সামান্য–এক বোঝা খড়!
চব্বিশ শো বছর আগে পেরিক্লিস বলেন, থামুন ভদ্রমহোদয়েরা, আমরা সামান্য বিষয় নিয়ে বড় সময় নষ্ট করছি। সত্যিই আমরা তাই করি।
কলোরাডোর লঙ পাহাড়ের গায়ে এক বিশাল গাছের ধ্বংসাবশেষ আছে। প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা বলেন গাছটা চারশো বছর বেঁচেছিল। কলম্বাস যখন যান সালভাডরে নামেন এই গাছটি তখন শিশু, আর প্লীমাউথে যখন ঔপনিবেশিকরা আসে তখন সেটা অর্ধেক বড় হয়। ওই গাছটির উপর চোদ্দবার বাজ পড়ে এ কত যে তুষার ঝড় হয়ে গেছে তাও তার কিছু হয়নি। অবশেষে একঝাক মৌমাছি গাছটিকে একেবারে হয়ে দেয়। এই সব পোকারা গাছটির ভিতরের সব শক্তি করে করে খেয়ে নেয়। এই বিশাল অরণ্যের দেত্য যে বয়সের ভারে ভেঙে পড়েনিঃ বজ যাকে শেষ করতে পারেনি, সে কিনা সামান্য পোকার আক্রমণে শেষ হয়ে গেল! যে পোকাকে মানুষ আঙুলে টিপে মারতে পারে।
আমরাও ওই অরণ্যের দৈত্যের মত যুদ্ধ করছি না কি? আমরা জীবনযুদ্ধের ঝড় ঝাঁপটা আর হিমবাহের ধাক্কা অনেকটা সহ্য করতে পারি কিন্তু ছোট ছোট দুশ্চিন্তা যা আমরা দুআঙুলে মারতে পারি, তারই কাছে হেরে যাই।
কয়েক বছর আগে আমি উইওমিঙের ট্রেটন ন্যাশানাল পার্কের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করছিলাম, সঙ্গে ছিলেন উইওমিঙের চার্লস্ সিফ্রেড, আর তার কিছু বন্ধু । সিফ্রেড ছিলেন সেখানকার বড় রাস্তার কর্তা। আমরা সবাই চলেছিলাম জন ডি রকফেলারের জমিদারী দেখতে। কিন্তু ব্যাপার হলো আমি যে গাড়িতে ছিলাম সেটা ভুল পথে গিয়ে প্রায় একঘন্টা পরেই নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছল। মিঃ সিফ্রেডের কাজেই ছিল গেটের চাবি, তাই তিনি ওই একঘণ্টা মশার উৎপাতের মধ্যে বাগান অপেক্ষায় ছিলেন। ওগুলো যে সে মশা নয়, যে কোন সাধুকেও ক্ষেপিয়ে তুলতে পারতো। কিন্তু সেইসব মশারা চার্লস সিফ্রেডকে কিছুই করতে পারেনি। তিনি গাছের একটা ডাল কেটে বাঁশি বানিয়ে দিব্যি তা বাজিয়ে সময় কাটাচ্ছিলেন। আমি বাঁশিটা সযতে রেখে দিয়েছি স্মৃতি হিসেবে–যাতে একজন মানুষ সামান্য ব্যাপার কি করে কাটান সেটা আমার যাতে মনে পড়ে।
দুশ্চিন্তার অভ্যাস কাটাতে হলে দু নম্বর নিয়ম হল :
ছোটখাটো সব ব্যাপারে দুশ্চিন্তা না করে তা ভুলে যাওয়াই উচিত। মনে রাখবেন জীবন ছোট বলেই এত মহান।