অবশ্যম্ভাবীকে মেনে চলুন
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন একদিন মিসৌরীর উত্তর–পশ্চিম দিকে এক পরিত্যক্ত বাড়ির চিলে কোঠায় বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করছিলাম। যখন চিলে কোঠায় জানালায় পা রেখে নামতে গেলাম আমার হাতের আঙটিটা পেরেকে লেগে যাওয়ায় একটা আঙুল প্রায় ছিঁড়ে গেল।
ভয়ে আতঙ্কে আমি চিৎকার করে উঠি। আমার মনে হয়েছিল আমি মারা যাব । তারপর হাতটা সেরে গেলে এনিয়ে কোন সময়েই দুশ্চিন্তা করিনি। আমার ওই হাতে যে মাত্র চারটে আঙ্গুল আছে একটা মাসে একবারও তা নিয়ে ভাবিনা। ভেবে লাভ কি? অবশ্যম্ভাবীকে অর্থাৎ যা ঘটবেই তাই আমি মেনে নিয়েছি।
ক বছর আগে একজন লিফট চালককে কব্জি পর্যন্ত কাটা হাত নিয়ে কাজ করতে দেখে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম কাটা হাত নিয়ে সে ভাবে কিনা। সে জানিয়েছে আদৌ না, একমাত্র সুঁচে সুতো পরানোর সময়েই একটু ভাবনা হয়।
এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয় আমরা যে কোন অবস্থাতেই অবশ্যম্ভাবীকে যেমন মানিয়ে নিতে পারি–তেমন সব ভুলেও যাই ।
প্রায়ই আমার হলান্ডের আমস্টারডামের একটা প্রাচীন গির্জায় ধ্বংসাবশেষে লেখা একটা বাণীর কথা মনে হয় । বাণীটি ফ্লেমিশ ভাষায় লেখা আর এই রকম : এটা এই রকম। কারণ অন্যরকম হতে পারে না।
আমি বা আপনি যখন যুগ যুগ ধরে এগিয়ে চলি তখন কিছু না কিছু অপ্রীতিকর অবস্থার সামনে পড়ি যা অন্যরকম হতে পারে না। আমাদের দুটো পথই থাকে–হয় অবস্থাটা মেনে নেওয়া অথবা বিদ্রোহ করে, নিজেদের স্নায়ুকে ভেঙে ফেলতে পারি ।
উইলিয়ম জেমস–ই এবিষয়ে আমার প্রিয় দার্শনিক। তিনি বলেছেন : যা ঘটেছে তাকে মেনে নিতে তৈরি হও। দুর্দশা এড়ানোর জন্য যা ঘটেছে তাকে মেনে নেয়াই শ্রেয়। অরিগণের এলিজাবেথ কলেকে অনেক দাম দিয়েই এটা শিখতে হয়েছিল। সম্প্রতি তিনি আমাকে এই চিঠিটা লিখেছেন : যেদিন আমেরিকা উত্তর আফ্রিকায় বিজয় দিবস পালন করছিল তখন আমি সমরদপ্তর থেকে একটা চিঠি পেলাম, তাতে জানানো হয়েছিল আমার ভাইপো যাকে দুনিয়ায় সবচেয়ে ভালোবাসি–তাকে পাওয়া যাচ্ছেনা। কিছুদিন পরেই খবর এল সে মারা গেছে।
আমি দুঃখে ভেঙে পড়লাম। এর আগে পর্যন্ত ভাবতাম আমার জীবন কত সুখের। আমার পছন্দসই একটা চাকরি ছিল। ভাইপোকে আমিই মানুষ করেছি। আমার কাছে সে ছিল সব আশা আকাঙ ক্ষার প্রতীক। … আর প্রয়োজন নেই। কাজে অবহেলা শুরু করলাম। বন্ধুদেরও তাই। সবই ত্যাগ করলাম। সারা জীবন আমার তিক্ত হয়ে উঠল। কেন আমার ভাইপোকে কেড়ে নিল? এত সুন্দর একটি ছেলেকে কেন যুদ্ধে মারা যেতে হল? সারা জীবন যে ওর সামনে পড়ে ছিল। আমি কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারলাম না। আমার শোক এতই ভয়ঙ্কর হল যে ভাবলাম সব ছেড়ে পালিয়ে যাব।
চলে যাওয়ার জন্য আমার ডেক্সটা সাফ করছিলাম–তখনই একটা চিঠি আমার হাতে পড়ল। এই চিঠি আমার ভাইপো–ই আমায় লিখেছিল ক’ বছর আগে আমার মার মৃত্যু হলে। চিঠিটায় ছিল, নিশ্চয়ই আমরা তাকে আর পাবনা, বিশেষ করে তুমি। তবু জানি তুমি শোক সামলে নিতে পারবে। তোমার নিজের ব্যক্তিগত জীবন দর্শনেই তা মেনে নিতে পারবে। যে সুন্দর সত্য তুমি আমায় শিখিয়েছ তা কখনই ভুলব না। আমি যেখানে যতদূরেই থাকি সব সময় মনে রাখব তুমি আমাকে হাসতে শিখিয়েছ জীবনে যা ঘটুক তাকে মেনে নিতে শিখিয়েছ, প্রকৃত মানুষের মত গ্রহণ করতে তুমি আমায় শিখিয়েছিলে।
আমি বারবার চিঠিটা পড়লাম। মনে হল সে যেন আমার পাশেই দাঁড়িয়ে। সে যেন বলছে আমাকে যা শিখিয়েছ তাই করছে না কেন? যাই ঘটুক কাজ করে যাও। তোমার ব্যক্তিগত শোক সরিয়ে রেখে হেসে এগিয়ে চল।
আবার তাই কাজে ফিরে গেলাম। তিক্ত সেই বিদ্রোহী ভাব ত্যাগ করলাম। বারবার নিজেকে বললাম : যা হবার হয়ে গেছে, আমি এটা বদলাতে পারব না। আমি যা করতে পারি তা হল, সে যা করতে বলেছে তাই করা। আমি সৈন্যদের আর অন্যান্য ছেলেদের চিঠি লিখতে লাগলাম। রাতের এক শিক্ষাক্রমে যোগ দিলাম নতুন বহু বন্ধুও হল। আমার নিজের পরিবর্তন দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গেছি। আমার ভাইপো যা চাইতো আমি তাই করে চলেছি, ভাগ্যকে আমি মেনে নিয়েছি। জীবনকে এখন আমি সম্পূর্ণ উপভোগ করছি।
পোর্টল্যাণ্ডের এলিজাবেথ কনলি যা শিখেছিলেন এখন আমাদেরও তাই শেখা দরকার–আর তা হল যা অবশ্যম্ভাবী তাকে মেনে নিতেই হবে। যা হবার তা হবেই। এটা শেখা অবশ্য সহজ নয়। রাজা মহারাজাদেরও এটা বারবার স্মরণে রাখতে হয়। স্বৰ্গতঃ রাজা পঞ্চম জর্জ বাকিংহাম প্যালেসে তার লাইব্রেরীর দেওয়ালে এই লেখাটা ফ্রেমে বাঁধিয়ে রেখেছিলেন : আমি যেন অসম্ভবকে সম্ভব করতে না চাই, যা ঘটে গেছে তার জন্য অনুতাপ না করি। ঠিক এমনই করেছেন শোপেন হাওয়ার : জীবনপথে চলার জন্য একটু উদাসীনতা চাইই।
এটা ঠিক যে, সব সময় পারিপার্শ্বিকতা মানুষকে সুখী বা অসুখী করে না। পারিপার্শ্বিকতায় আমাদের প্রতিক্রিয়াই আমাদের অনুভূতি গড়ে তোলে। যীশু বলেছিলেন স্বর্গের আবাস মানুষেরই মনে, আবার নরকও তাই।
আমরা সকলেই নিরুপায় হলে অনেক সময় ধ্বংস আর শোককে জয় করতে পারি। মনে হতে পারে এটা আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়, অথচ আমাদের অন্তরের শক্তি এতই প্রবল যে ইচ্ছে করলেই পারা যায়। আমরা নিজেদের যা ভাবি তার চেয়ে ঢের শক্ত ধাতুর আমরা।
স্বর্গীয় বুথ টার্কিংটন বলেছিলেন : জীবনে যা ঘটুক সবই আমি সহ্য করতে পারবো শুধু অন্ধতু ছাড়া। এটা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারব না।
এরপর একদিন তিনি যখন ষাট বছর বয়সে মেঝের কার্পেটের দিকে তাকালেন তার মনে হলো রঙগুলো কেমন অস্পষ্ট হতে চাইছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞের কাছে গেলেন। আর তখনই দুঃখজনক সেই কথাটা জানতে পারলেন : তিনি দৃষ্টি হারাচ্ছেন। তার একটা চোখ অন্ধ হয়ে গেছে, অন্যটারও সেই অবস্থা হবে। যা ভয় করতেন তাই হতে চলেছে।
টার্কিংটন এই ভয়ানক পরিস্থিতি কিভাবে গ্রহণ করেছিলেন? তিনি যা ভেবেছিলেন, তাই হলো? এটাই কি আমার জীবনের শেষ? না, তিনি নিজেই আশ্চর্য হয়ে যান যে তিনি খুশি থাকতে পেরেছেন। অনেক মজার কথাও বলতে পেরেছিলেন তিনি। আশ্চর্য ব্যাপার, তিনি অন্ধকারে নানারকম ভেসে চলা মূর্তি দেখতে আরম্ভ করেন। একসময় বলেও ফেলেন : বাঃ কি মজার ব্যাপার। দাদু ভেসে চলেছেন–কিন্তু এত সকালে কোথায় চললেন?
এমন মনোভাব যার, ভাগ্য তার কী করবে? সত্যিই জয় করতে পারেনি তাকে। সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর টার্কিংটন বলেন : দেখলাম দৃষ্টি হারানোকে আমি সহজ মনেই গ্রহণ করতে পেরেছি। মানুষ যেভাবে সব পারে। আমার পাঁচটা ইন্দ্রিয়ও যদি নষ্ট হয়ে যায় আমি জানি আমার মনের জোরেই আমি বেঁচে থাকব। কারণ এই মনের মধ্যেই আমরা বাস করি আর মন দিয়েই দেখি।
দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার জন্য টার্কিংটনকে বারোবারেরও বেশি অস্ত্রোপচার করা হয় এক বছরে। আর সবটাই স্থানীয় ভাবে চোখকে অসাড় করে, সম্পূর্ণভাবে তাঁকে অজ্ঞান করা হয়নি। তিনি এজন্যে বিদ্রোহ করেছিলেন? তিনি জানতেন এটা করতেই হবে, এ থেকে তার রেহাই নেই। তাই মুক্তি পাওয়ার পথ হল শান্ত ভাবে তা গ্রহণ করা। তাঁকে আলাদাভাবে রাখার কথায় তিনি আপত্তি করেন এবং হাসপাতালের ওয়ার্ডেই থাকেন। কারণ তাতে তিনি অন্য সকলের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন বলে। তিনি সকলকে উৎসাহ দিতেন। তারপর সজ্ঞানে যখন অস্ত্রোপচার করা হল, তিনি কি ভাগ্যবান বলেই না নিজেকে ভাবলেন। তিনি বলেছিলেন, কি আশ্চর্য কথা । বিজ্ঞান মানুষের চোখের মত কোমল বস্তুতে ও অস্ত্রোপচার করার কৌশল আয়ত্ত করেছে!
সাধারণ মানুষ এরকম হলে ভেঙে পড়ত। তবুও টার্কিংটন বলেন, এর চেয়েও কোন সুখবর অন্য কিছুর জন্য এ অভিজ্ঞতা বদল করবে না। এ ব্যাপারে তাকে মেনে নেবার কৌশল শিখিয়েছিল–আরও শিখিয়েছিল জীবনে যাই আসুক তাকে সহ্য করে নেওয়ার ক্ষমতা। জন মিল্টনও আবিষ্কার করেছিলেন, অন্ধ হওয়া দুঃখের নয়, দুঃখের হল তা সহ্য করার ক্ষমতা যদি না থাকে।
নিউ ইংল্যাণ্ডের বিখ্যাত মহিলা আন্দোলনকারী মার্গারেট ফুলার একবার বলেছিলেন : ধর্ম সম্পর্কে আমি পৃথিবীকে গ্রহণ করেছি। খুঁতখুঁতে স্বভাবের বুড়ো টমাস কার্লাইল যখন কথাটা শুনেছিলেন তিনি বলে ওঠেন : হুম তার এটা করাই উচিত! আর আসল কথাটা হল এরকম আমরা সবাই অবশ্যম্ভাবীকে মেনে নিলেই ভালো।
আমারাও যদি অবশ্যম্ভাবীর বিরুদ্ধে মাথা খুঁড়ি তাহলে ফল কিছুই হবে না–যা ঘটার তা ঘটবেই, তার বিরুদ্ধে গেলে ক্ষতি আমাদের নিজেদেরই। একবার আমি ও অবশ্যম্ভাবী কোন ব্যাপার মেনে নিতে পারিনি। বোকার মতই বিদ্রোহ করেছিলাম। তাতে আমার রাতের ঘুম চলে যায়। শেষ পর্যন্ত একবছর আত্মনির্যাতনের পর ব্যাপারটা মেনে নিতেই হল। অথচ আমি আগে থেকেই জানতাম এটা পরিবর্তনের শক্তি আমার নেই।
.
ওয়াল্ট হুইটম্যানের সঙ্গে গলা মিলিয়েই আমার বলা উচিত ছিল যে জন্তু আর বৃক্ষের মত হওয়াই ভালো, তারা কি সুন্দরভাবে রাত্রি, ঝঞঝা, ক্ষুধা, দুর্ঘটনাকে এড়িয়ে যায়।
আমি বারো বছর গোরুবাছুরের দেখাশোনা করেছি অথচ কোনদিন তাদের বৃষ্টির অভাব নিয়ে ভেবে জ্বর বাধাতে দেখিনি। জন্তুরা রাত্রি, ঝড় বা ক্ষুধাকে শান্তভাবেই গ্রহণ করে। তাই তাদের স্নায়ু ভেঙে পড়ে। না বা পেটে আলসারও হয় না, মাথাও খারাপ হয় না ।
তাহলে কি আমি যে বিপদই আসুক তাকে মাথা নিচু করে মেনে নিতে বলছি? না, কখনও তা নয়! এ হলে তো নিয়তির দাস হতে হয়। যতক্ষণ কোন ব্যাপারে উদ্ধার পাওয়ার আশা থাকে ততক্ষণ চেষ্টা করতেই হবে। কিন্তু যদি স্পষ্ট বোঝা যায় কোন দিকেই কোন আশা নেই তখন যেন কি পাবো বা না পাবো তার হিসেব মেলানোর চেষ্টা না করি ।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ডীন হগস্ আমাকে বলেছিলেন তিনি একটা ছড়ার মধ্য থেকে তার জীবনের আদর্শ ঠিক করেছিলেন। সেটা এই রকম ছিল :
সব ব্যথারই ওষুধ আছে, হয়তো বা তা নেই, থাকে যদি হাত পেতে নাও, চেয়োনা অলীককেই।
এ বই লেখার সময় বহু আমেরিকান ব্যবসায়ীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলাম। একটা ব্যাপার আমার খুব মনে লেগেছিল তা হল এই যে, তাদের প্রায় সবাই অবশ্যম্ভাবীকে মেনে নিয়ে দুশ্চিন্তাকে জয় করেছিলেন। এটা না করলে তারা ওই যন্ত্রণার চাপে ভেঙে পড়তেন।
দেশ জোড়া পেনী ষ্টোর্সের প্রতিষ্ঠাতা জে. সি. পেনী আমায় বলেন : আমার প্রতিটি ডলারের ক্ষতি হলেও দুশ্চিন্তা করি না–কারণ তাতে কোন লাভ হয় না। আমি ভালোভাবে কাজ করার চেষ্টা করি–ফল ঈশ্বরের হাতেই ছেড়ে দিই।
হেনির ফোর্ডও আমাকে বলেছিলেন একই কথা! যখন কোন ব্যাপার নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না তখন তাদের হাতেই ব্যাপারটা ছেড়ে দিই।
ক্রাইশলার কর্পোরেশনের প্রেসিডেন্ট কে. টি. কেলারকে যখন প্রশ্ন করেছিলাম তিনি দুশ্চিন্তাকে কিভাবে ঠেকিয়ে রাখেন, তিনি উত্তর দেন : যখন কোন কঠিন অবস্থার সামনে পড়ি, তখন নিজে কিছু করার থাকলে তা করি, না থাকলে স্রেফ ভুলে যাই। আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি না, কারণ জানি যে কোন মানুষই ভবিষ্যতের গর্ভে কি আছে তা জানতে পারে না। বহু শক্তিই ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণ করে। কে. টি কেলারকে যদি বলতাম তিনি দার্শনিক তাহলে বোধ হয় তিনি অস্বস্তিতে পড়তেন, কারণ তিনি একজন ভালো ব্যবসায়ী। এসত্ত্বেও কিন্তু তিনি উনিশ শতক আগে, এপিক্টাস রোমে যে দর্শনের কথা বলেছিলেন সেই কথাই বলেছেন। এপিক্টাস বলেছিলেন : সুখ লাভের একটাই পথ আছে আর তা হলো আমাদের ক্ষমতার বাইরে যা আছে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করা।
সারা বার্নহার্ট, যার নাম ‘ঐশ্বরিক সারা’–তিনি জানতেন কিভাবে অবশ্যম্ভাবীকে মানিয়ে নিতে হয়। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে চারটে মহাদেশের মঞ্চে তিনি সকলের হৃদয় জয় করে রাণীর মত রাজত্ব করেছিলেন–তিনি ছিলেন দুনিয়ার সবচেয়ে প্রিয় অভিনেত্রী। তার সত্তর বছর বয়সের সময় তিনি সম্পূর্ণ কপর্দকহীন হয়ে যান। সেই সময় তার চিকিৎসক, প্যারীর প্রফেসর পোৎসী তাঁকে জানালেন তার একটা পা কেটে বাদ দিতে হবে কারণ আটলান্টিক পার হতে গিয়ে জাহাজে পড়ে পায়ে প্রচন্ড আঘাত লাগে; এবং তার পায়ের শিরা ফুলে যায়। পা কুঁচকে যায়। তাতে এতই যন্ত্রণা হতে থাকে যে ডাক্তার পা বাদ দিতে চান। ডাক্তার কথাটা তাকে জানাতে ভয় পান, কেননা ঐশ্বরিক সারা কিভাবে তা গ্রহণ করবেন জানা ছিল না। সারা ভেবেছিলেন তিনি হয়তো হিষ্টিরিয়ায় আক্রান্ত হবেন। কিন্তু তাদের ভুলই হয়। সারা শান্তভাবে তাকিয়ে থেকে বলেন, এটা যদি করতে হয় তাহলে করতে হবে। এই হল ভাগ্য।
তাকে যখন হুইল চেয়ারে করে অপারেশন কামরায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তার ছেলে কাঁদছিল। তিনি তাকে ডেকে বেশ হাসি মুখেই বলেন : একটু দাঁড়াও, আমি এখনই ফিরব।
অপারেশন কক্ষে যাওয়ার সময় তিনি তার একটা নাটক থেকে আবৃত্তি করতে থাকেন। একজন তার কাছে জানতে চায় নিজের মন প্রফুল্ল রাখার জন্যই তিনি আবাও করছেন কিনা। তিনি উত্তর দেন : না, ডাক্তার আর নাসকে প্রফুল্ল রাখার জন্য। ওদের মনের উপর অনেক চাপ পড়বে, তাই।
অপারেশন থেকে সেরে ওঠার পর সারা বার্নহার্ট সারা বিশ্ব ঘুরে আরও সাত বছর ধরে মানুষকে মোহিত করেন।
রীডার্স ডাইজেস্ট পত্রিকায় এসলি ম্যাককরমিক লিখেছিরেন, আমরা যখন অবশ্যম্ভাবীর সঙ্গে লড়াই করা ছেড়ে দিই তখন নতুন শক্তির জন্ম হয়ে আমাদের জীবন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
কোন লোকই এমন শক্তিশালী হতে পারে না যে অবশ্যম্ভাবীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারে আর বাকি ক্ষমতায় নতুনজীবন গড়ে তুলতে পারে। যে কোন একটাকেই গ্রহণ করতে হবে। অবশ্যম্ভাবী ঝড় শিলা বৃষ্টি মেনে নিলে আপনি বেকে পড়তে পারেন কিন্তু তাকে প্রতিরোধ করতে গেলে একেবারে ভেঙে পড়বেন।
মিসোরীর এক খামারে আমি ব্যাপারটা ঘটতে দেখেছি। ঐ খামারে আমি অনেক গাছ লাগিয়ে ছিলাম। প্রথমে তারা বেশ দ্রুত বেড়ে উঠলো। তারপর একদিন তুষারপাত গাছের সব ডাল ঢেকে ফেলল। বোঝার ভারে গাছগুলো না নুইয়ে পড়ে গর্বের সঙ্গে তা প্রতিরোধ করার চেষ্টা চালালো তারপর ভারের ফলে ভেঙে পড়লে সবগুলোকে কেটে ফেলতে হল। গাছগুলো উত্তরাঞ্চলের গাছের মত জ্ঞান অর্জন করতে পারে নি। আমি কানাডার চিরসবুজ অরণ্য এলাকায় শত শত মাইল ঘুরেছি। কোথাও দেখিনি কোন স্কুস বা দেবদারু গাছ ভেঙে পড়েছে। কারণ ওই চিরসবুজ গাছগুলো জানে কিভাবে নিজেকে বাঁকাতে হয় আর অবশ্যম্ভাবীতাকে কিভাবে মেনে নিতে হয়।
জুজুৎসু শিক্ষকরা তাদের ছাত্রদের বলে থাকেন; উইলো গাছের মতই নিজেকে বাঁকাবে, ওক গাছের মত প্রতিরোধ করবে না।
গাড়ির চাকা কিভাবে খারাপ রাস্তায় ধাক্কা সামলায় জানেন? প্রথমে যে চাকা বানানো হয়েছিল সেটা রাস্তার ধাক্কা সামলাতেই দেখা যায় সব চাকাই টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এরপর তাই এমন চাকা বানানো হলো যাতে ধাক্কা সামলাতে পারে। জীবনের ক্ষেত্রেও একই কথা
আমরা যদি জীবনের ধাক্কাকে হজম না করে বাধা দেবার চেষ্টা করি তাহলে কি ঘটবে? আমরা উইলোর মত নমনীয় না হয়ে যদি ওকের মত শক্ত হতে চাই? এতে এক বিরাট অন্তর্দ্বন্দ্বে পতিত হব আর এর ফলে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ক্লান্ত, অসুস্থ হয়ে পড়ব।
আমরা যদি আরও অগ্রসর হয়ে কঠিন বাস্তবকে অগ্রাহ্য করে নিজেদের মনে গড়া কোন স্বপ্নময় জগতে প্রবেশ করি তাহলে আমরা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাব।
.
যুদ্ধের সময় লক্ষ লক্ষ সৈন্য এই অবশ্যম্ভাবীকে হয় মেনে নিয়েছে বা ভেঙে পড়ছে। এ ব্যাপারে একটা উদাহরণ রাখা যাক। নিউইয়র্কের উইলিয়াম ক্যাসেলিয়াসের কাছ থেকে যা বিবরণ পাই তা এই রকম :
উপকূল রক্ষী বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর আমাকে আতলান্তিকের এপারের সবচেয়ে বিপজ্জনক একটা কাজ দেওয়া হয়। আমাকে বিস্ফোরক দ্রব্যের দেখাশোনার ভার দেওয়া হয়। একবার ব্যাপারটা ভাবন! আমি! যে কিনা সামান্য বাজি বিক্রীর কাজ করে তাকে বিস্ফোরক তদারকির ভার দেওয়া হল। হাজার হাজার টন টি এন টি’র বিস্ফোরক দ্রব্যের উপর দাঁড়িয়ে আছি এই ভাবনাটাই কোন বাজি বিক্রেতার মেরুদণ্ডে বরফ স্রোত বইয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। আমায় মাত্র দুদিন নির্দেশ দেওয়া হল। তাতে সা শিখলাম আমার ভয় আরও মাত্রা ছাড়ালো। আমার প্রথম দায়িত্বের কথা ভুলব না। এক কুয়াশাময়, অন্ধকার দিনে আমাকে নিউজার্সির ক্যাভেন পয়েন্টে খোলা জায়গায় পাহারায় পাঠানো হল।
আমার কাজ ছিল জাহাজে পাঁচ নম্বর গর্তে পাহারা দেওয়া। আমাকে সেখানে আরও পাঁচজন লোকের সঙ্গে কাজ করতে হত। তাদের পিঠ বেশ শক্ত ছিল, তবে বিস্ফোরক সম্বন্ধে কোনো জ্ঞানই তাদের ছিল না। তারা জাহাজের গর্তে বিস্ফোরক বোঝাই করত, যেগুলোর প্রতিটায় এক টন টি এন টি–ওই জাহাজটাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার পক্ষে তা যথেষ্ট। ওই বিস্ফোরক নামানো হত দুটো তারের সাহায্যে। আমি নিজেকে বলতাম : ধর, ওই তারের একটা যদি ছিঁড়ে যায়, তাহলে কি ঘটবে? আমি ভয়ে কাঠ হয়ে থাকতাম। আমরা গলা শুকিয়ে আসতো। এমন কাপুনি ধরতো যে হাঁটুতে লেগে যেত। বুক ধড়াস ধড়াস করত। তবু আমি পালাতে পারতাম না। তার অর্থ হত অপরাধ। এতে আমার মান থাকতো না। আমার বাবা মারও অপমান হত–পালানোর জন্য আমাকে গুলি করাও হতে পারতো। পালানোর উপায় না থাকায় আমি থেকে গেলাম। আমি চেষ্টা করে হালকাভাবে লোকগুলোকে বিস্ফোরক নামাতে দেখতাম এরপর। এই রকম মেরুদণ্ড শীতল করা ভয়ের একঘন্টা পর আমি সাধারণ বুদ্ধি কাজে লাগালাম। তাই নিজেকে বললাম : দেখ, মনে করো তুমি বিস্ফোরণে উড়ে গেছো! তাতে হলোটা কি? এর পার্থক্য তো টেরই পাবে না। মৃত্যু হবে খুবই সহজ। ক্যান্সারে মরার চেয়ে তা অনেক ভালো। তাই বোকামি কর না। চিরকাল তো বেঁচে থাকবে না। একাজ না করলে গুলি খেতে হবে। অতএব এই কাজকেই ভালো লাগাও না কেন?
ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজেকে এটা বললাম তারপরেই মন শান্ত হল। শেষপর্যন্ত আমার দুশ্চিন্তা আর ভয় দূর হয়ে অবশ্যম্ভাবীকে মেনে নিলাম।
আমি জীবনে এই শিক্ষা ভুলিনি। প্রতিবার যখন যা বদলাতে পারবো না ভেবে কোন দুশ্চিন্তায় পড়েছি তখনই বলেছি এটা ভুলে যাও। এতে সত্যিই কাজ হয়েছে।
যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ছাড়া পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত মৃত্যু হচ্ছে সক্রেটিসের মৃত্যু। আজ থেকে দশ হাজার শতাব্দীর পরেও মানুষ প্লেটোর লেখা ওই বর্ণনা পড়বে–সাহিত্যের অসামান্য আবেগময় সুন্দর এক বর্ণনা। এথেন্সের কিছু লোক–সক্রেটিসের উপর ঈর্ষান্ধ আর হিংসাকাতর হয়ে তার সম্বন্ধে নানা অভিযোগ এনে তার বিচার করে প্রাণদণ্ড দিয়েছিল। কারারক্ষক বন্ধু ভাবাপন্ন ছিলেন, তিনি সক্রেটিসকে বিষের পাত্র তুলে দিয়ে বলেন : অবশ্যম্ভাবীকে হালকাভাবেই গ্রহণ করুন। সক্রেটিস তাই করেছিলেন। তিনি মত্যুকে যেরক শান্তভাবে আর অবশ্যম্ভাবী হিসেবে গ্রহণ করেন যে তা স্বর্গীয় হয়ে উঠেছিল।
অবশ্যম্ভাবীকে হালকাভাবেই গ্রহণ করুন কথাটা উচ্চারিত হয় খ্রীষ্টের জন্মের ৩৯৯ বছর আগে। কিন্তু আজকের পুরনো এই জটিল পৃথিবীর পক্ষে কথাটার প্রয়োজন অনেক বেশি।
গত আট বছরে আমি দুশ্চিন্তা দূর করার বিষয়ে প্রচুর বই আর পত্র–পত্রিকা পাঠ করেছি। আপনার কি জানার বাসনা আছে দুশ্চিন্তা দূর করার বিষয়ে কোন্ উপদেশ আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে? তাহলে বলছি শুনুন–কথাটায় মাত্র সাতাশটা শব্দই আছে। এটা এমনই মূল্যবান যে আমাদের প্রত্যেকের বাথরুমের আয়নার সামনে ঝুলিয়ে রাখা উচিত যাতে রোজই চোখে পড়ে । এর অমূল্য প্রার্থনাটি লিখেছিলেন নিউ ইয়র্কের ব্যবহারিক খ্ৰীষ্টধর্মের অধ্যাপক ডঃ রেইনহোল্ড নাইবুর । সেটি এই রকম :
ঈশ্বর আমাকে সেই শক্তি দিন যাকে বদল করতে পারবো না তাকে যেন মেনে নিতে পারি। আর যা বদল করতে পারি তা করার সাহস দিন এবং আমি যেন এই দুটির পার্থক্য হৃদয়ঙ্গম করতে পারি।
তাই দুশ্চিন্তা দূর করার চার নম্বর নিয়ম হল : অবশ্যম্ভাবীর সঙ্গে সহযোগিতা করুন।