আমার বাবা মা কীভাবে দুশ্চিন্তা দূর করেন
আগেই বলেছি, আমি মিসৌরীর এক খামারে মানুষ হই। সে কালের কৃষকদের মতই আমার বাবা মা খুবই কষ্ট করতেন। মা এক গ্রামে শিক্ষিকার কাজ করতেন আর বাবা প্রচুর খেটে মাসে মাত্র বারো ডলার আয় করতেন। মা শুধু আমাদের পোশাকই বানাতেন না, সাবান তৈরিও করতেন কাপড় কাঁচবার জন্য ।
আমাদের কদাচিৎ নগদ পয়সা থাকতো–একমাত্র বছরে একবার যখন শুয়োর বিক্রি করা হত। আমাদের মাখন আর ডিম বদলে আমরা পেতাম ময়দা, চিনি আর কফি। আমার যখন বারো বছর বয়স তখনও বছরে খরচা করার জন্য পঞ্চাশ সেন্টও পেতাম না। আমার আজও মনে পড়ে একদিন ৪ঠা জুলাই বাবা আমায় খরচ করার জন্য দশ সেন্ট দেন। আমার মনে হয়েছিল যে ভারতবর্ষের সমস্ত সম্পদ হাতে পেয়েছি।
আমি এক মাইল হেঁটে গ্রামের এক কামরার স্কুলে যেতাম। যখন হাটতাম তখন হাঁটু অবধি বরফ ঠেলে যেতে হত, তাপমাত্রা শুন্যের আঠাশ ডিগ্রী নিচে। চৌদ্দ বছর বয়সের আগে রবার ঢাকা জতো পাইনি। সারা শীতকালই আমার পায়ের পাতা ঠান্ডায় ভিজে থাকতো। ছোট বেলায় ভাবতেই পারিনি কারও শীতকালে পায়ের পাতা শুকনো থাকে।
আমার বাবা মা রোজ মোল ঘন্টা খাটতেন, তবু আমাদের দুর্দশা কাটেনি, সব সময় ধার দেনা আর দুশ্চিন্তা ছিল । আমার মনে পড়ে একবার ১০২ নদীর প্রবল বন্যায় আমাদের সব শস্যক্ষেত্র ভাসিয়ে নেয়। বছরের পর বছর শুয়োরগুলো কলেরায় মারা যায়, তাদের পুড়িয়েও ফেলা হয়। সেই গন্ধ এখনও নাকে আসে।
এক বছর বন্যা হলনা, প্রচুর শস্য জন্মালো। আমাদের গরু বাছুরদের খাইয়ে মোটা করা হল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সে বছর শস্যের দাম কমে গেল আর আমরা বিক্রি করে পেলাম মাত্র বিশ ডলার। সারা বছরের পরিশ্রমের দাম মাত্র ত্রিশটা ডলার।
দুশ্চিন্তামুক্ত নতুন জীবন সব কাজেই আমাদের ক্ষতি হচ্ছিল। কোন ব্যাপারেই সাফল্য ছিল না। দশ বছরের হাড়ভাঙা খাটুনির ফল হল আমরা দেনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত। যে ব্যাঙ্কে খামার বাধা দেওয়া ছিল তারা বাবাকে অপমান করে সেটা নিয়ে নেবে জানালো। বাবার বয়স ছিল সাতচল্লিশ, ত্রিশ বছরের কঠোর পরিশ্রমে তিনি পান শুধু দেনার দায় । বাবা সেটা সহ্য করতে পারেন নি–দুশ্চিন্তায় তার শরীর ভেঙে গেল। খিদে ছিল না তার, স্বাস্থ্য ভেঙে গেল, ওজন কমে গেল। ডাক্তার বললেন বাবা আর ছ’মাসও বাঁচবেন না। বাবা খামারে ঘোড়াদের খাওয়াতে গিয়ে ফিরতে দেরী করলে মা ছুটে যেতেন। মা ভয় পেতেন হয়তো দেখবেন বাবার নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে আছে। বাবা ১০২ নদীর ব্রিজে দাঁড়িয়ে ভাবতেন ঝাঁপিয়ে পড়ে সব জ্বালা শেষ করে দেবেন কি না।
অনেক বছর পরে বাবা বলেছিলেন তিনি ঝাঁপ দেননি শুধু মা–র ঈশ্বরে বিশ্বাসের জন্য। মা বলতেন আমরা যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি তাহলে শেষ পর্যন্ত সব ঠিক হয়ে যাবে। মা ঠিকই বলেছিলেন, সব শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় মিটে গেল। বাবা এরপরেও বিয়াল্লিশ বছর বেঁচে ছিলেন আর ১৯৪১ সালে উননব্বই বছর বয়সে মারা যান।
ওই সমস্ত বছরের কষ্ট আর হৃদয় বেদনায় মা কখনও দুশ্চিন্তা করেন নি। তিনি ঈশ্বরের কাছে সব কষ্টের কথা বলে প্রার্থনা করতেন। প্রতি রাতে শুতে যাওয়ার আগে মা বাইবেল থেকে খানিকটা পড়ে শোনাতেন। মা আর বাবা প্রায়ই যীশুর সান্ত্বনার সেই বাণী পড়তেন : আমার পিতার প্রাসাদে অনেক ঘর আছে ….সেখানে তোমাদের জন্য ঘর রাখবো …আমি যেখানে থাকবো তোমরাও সেখানে থাকবে। এরপর আমরা হাঁটু মুড়ে বসে ঈশ্বরের কাছে চাইতাম ভালবাসা আর আশ্রয় ।
উইলিয়াম জেমস যখন হার্ভার্ডের প্রফেসর, তিনি বলেছিলেন : দুশ্চিন্তার একমাত্র ওষুধ হল ধর্মে বিশ্বাস রাখা।
এটা আবিষ্কারের জন্য হার্ভার্ডে যাওয়ার দরকার হবে না। আমার মা মিসৌরীর খামারেই তা জানতে পারেন। বন্যা, দেনা বা কষ্ট তার সুখী হাস্যোজ্জ্বল মুখের ভাব নষ্ট করতে পারেনি। আমার এখনও কানে ভেসে আসে মা কাজ করতে করতে এই গানটা গাইছেন :
ঈশ্বরের কাছ থেকে বর্ষিত হয়ে চলেছে অপরূপ শান্তি,
প্রার্থনা করি চিরকাল যেন আমার শক্তি
প্রেমে ডুবে থাকে।
মা চেয়েছিলেন আমি ধর্মের কাজে আত্মনিয়োগ করি। আমি বিদেশে মিশনারীর কাজ নেব ভেবেও ছিলাম। তারপর কলেজে ঢুকলাম। তারপর আস্তে আস্তে আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন এল। আমি জীববিদ্যা, বিজ্ঞান, দর্শন আর তুলনামূলক ধর্মপুস্তক নিয়ে পড়তে আরম্ভ করলাম। বাইবেল কিভাবে রচিত হয় তা পড়লাম। আমি বাইবেলের অনেক বিষয়েই প্রশ্ন তুলোম। সেকালের ধর্ম প্রচারকদের কাজকর্মের সম্বন্ধেও এসব প্রশ্ন তুলোম। আমি একটু বিহ্বল হয়ে পড়ি। ওয়াল্ট হুইটম্যানের মতই আমার অদ্ভুত সব প্রশ্ন জেগে উঠল। জীবনের কোন মূল্য আছে বলে মনে হল না। কি বিশ্বাস করা উচিত বুঝতে পারলাম না। প্রার্থনা বন্ধ করে দিলাম। মনে জাগল কোটি কোটি বছর আগের ডাইনোসরদের মতই মানুষের কোন স্বর্গীয় উদ্দেশ্য নেই। ভাবলাম ডাইনোসরদের মত মানুষও একদিন লুপ্ত হবে। আমি জানতাম বিজ্ঞানে আছে সূর্য আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে আসবে এবং তাপ শতকরা দশভাগ কমলেই পৃথিবী থেকে সব প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
এসব প্রশ্নের উত্তর জানি বলে প্রচার করব? না। কোন মানুষই এখনও জীবন রহস্য ব্যাখ্যা করতে পারেনি। আমরা রহস্যেই আবৃত। আমাদের শরীরটাই রহস্য। বাড়িতে যে বিদ্যুৎ আছে সেটাও তাই। ফাটা দেওয়ালে ফুল ফোঁটাও তাই। জানালার বাইরে সবুজ ঘাসও তাই । জেনারেল মোটরস রিসার্চ এর চার্লস এফ কেটারিং ঘাস কেন সবুজ জানার জন্য নিজের পকেট থেকে অ্যান্টিয়ক কলেজকে বছরে হাজার ডলার করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন আমরা যদি জানতে পারি ঘাস কি করে সূর্যালোক, জল আর কার্বনডাই–অক্সাইডকে খাদ্য আর শর্করায় পরিণত করে, তাহলে আমরা সভ্যতাকে বদল করতে পারব।
আপনার গাড়ির ইঞ্জিনের কাজও কম আশ্চর্য নয়। জেনারেল মোটরস, রিসার্চ ল্যাবরেটরিগুলি কোটি কোটি টাকা খরচ করে জানার চেষ্টা করেছেন সিলিন্ডারে সামান্য এক স্ফুলিঙ্গ কিভাবে মোটর চালায়।
আমাদের শরীর, বিদ্যুৎ, ইঞ্জিন ইত্যাদির রহস্য না জানলেও এসব আমাদের ব্যবহারে বাধা নেই। প্রার্থনা ও ধর্মের রহস্য আমি বুঝিনা বলে তা উপভোগ করতে পারব না এমন কথাও নেই। শেষ পর্যন্ত আমি সান্ডায়নের কথার মর্ম অনুধাবন করছি : মানুষ জীবন কি জানার জন্য জন্মায় নি, জন্মেছে তা উপভোগ করার জন্য।
আমি বোধ হয় ধর্মের ব্যাপারে কথা বলছি মনে হবে। আসলে তা নয়। আমি ধর্মের এক নতুন উপলব্ধি লাভ করেছি। গির্জায় যে মতভেদ আছে তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। কিন্তু ধর্ম আমার কি করতে পারে তা নিয়ে আমার ভাবনা আছে। যেমন ভাবনা আছে বিদ্যুৎ, ভাল খাদ্য ইত্যাদি নিয়ে । এগুলো আমায় আরও ভালো জীবন যাপনে সাহায্য করে, কিন্তু ধর্ম তার চেয়েও বেশি করে। এ দেয় সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ। এ আমায় সুখী, পূর্ণ জীবন কাটাতে সাহায্য করে। উইলিয়ম জেমসের ভাষায় আমরা যা পাই তাহল জীবনের নব আনন্দ …আরও জীবন …আর পরিপূর্ণ জীবন। এ আমায় দেয় সুস্বাস্থ্য, বিশ্বাস, আশা এবং সাহস। জীবনের এক নতুন দিগন্তই আমাদের সামনে খুলে ধরে।
ফ্রান্সিস বেকন ঠিকই বলেছিলেন সাড়ে তিনশ বছর আগে : অল্প দর্শনে লোকে নাস্তিক হয়, কিন্তু দর্শনের মধ্যে ঢুকলে তাকে ধার্মিক হতেই হয়।
আমার মনে পড়ছে মানুষ যখন ধর্ম আর বিজ্ঞান নিয়ে তর্ক করত। নতুন বিজ্ঞান–মনোবিজ্ঞানযীশু যা শিক্ষা দিয়েছেন তাই শিক্ষা দেয়। কেন? মনস্তাত্ত্বিকরা জানেন প্রার্থনা আর তাঁর ধর্মাকাঙক্ষা সমস্ত রকম দুশ্চিন্তা দূর করে, দূর করে উদ্বেগ, ভয় আর অর্ধেক রোগ। তারা জানেন, যেহেতু তাদেরই ডঃ এ. এ. ব্রিল বলেছেন : সত্যিকার যে ধর্মপরায়ণ তার মনরোগ জন্মায় না।
ধর্ম যদি সত্য না হয়, তাহলে জীবন হয়ে পড়ে অর্থহীন। এটা হাস্যকর হলেও করুণ।
হেনরী ফোর্ডের মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তাঁর সঙ্গে আমি দেখা করি। তার সঙ্গে দেখা করার আগে ভেবেছিলাম পৃথিবীর একটি বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্লান্তি তাঁর মধ্যে প্রকাশ পাবে । তাই অবাক হয়ে গেলাম যখন আটাত্তর বছর বয়সেও তাকে শান্ত সমাহিত দেখতে পেলাম। তাই যখন জানতে চাইলাম তিনি দুশ্চিন্তা করেন কি না, তিনি জবাব দিলেন, না। আমার মনে হয় ঈশ্বরই সমস্ত কিছু পরিচালনা করছেন আর তাই তিনি আমার কোন পরামর্শ চান না। ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। তাই দুশ্চিন্তার কি প্রয়োজন?
আজকের দিনে তাই মনস্তাত্ত্বিকরাও ধর্মপ্রচারক হয়ে পড়ছেন। তারা ধর্ম পালন করার কথা পরজীবনের শান্তির জন্য বলেন না বরং বলছেন এ জীবনের নরকাগ্নি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য। সেই নরকাগ্নি হল পাকস্থলির আলসার, এনজাইনা পেকটরিস, স্নায়ু ভেঙে পড়া আর পাগল হওয়া।
হ্যাঁ, খ্রিস্টধর্ম অত্যন্ত উৎসাহ ব্যঞ্জক স্বাস্থ্যদায়ক কাজ। যীশু বলেছেন : আমি এসেছি এইজন্যেই যে তোমরা আরও জীবন লাভ করতে পারো। যীশু তাঁর আমলে ধর্মের সূক্ষ্ম নিয়ম কানুন সম্বন্ধে প্রতিবাদ জানাতেন। তিনি ছিলেন এক বিদ্রোহী! তিনি এক নতুন ধর্ম সৃষ্টি করেন–যে ধর্ম পৃথিবীকে বদলে দিতেই চেয়েছিল। তাই তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। তিনি বলেছিলেন ধর্ম মানুষেরই জন্য ধর্মই মানুষ নয়। দুটি মানুষের জন্য–ছুটির জন্য মানুষ নয়। তিনি ভয়ের বিরুদ্ধে যত কথা বলেছিলেন পাপের জন্য ততটা নয় । যীশু তাঁর শিষ্যদের আনন্দ করতে বলতেন। তিনি এই শিক্ষাই দিতেন।
যীশু বলতেন ধর্মের দুটো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে : মন প্রাণ ঢেলে ঈশ্বরকে ভালোবাসো আর পড়শীকে নিজের মত মনে করো।
আধুনিক মনস্তত্বের জনক উইলিয়াম জেম্স তার বন্ধু প্রফেসর টমাস ডেভিডসনকে লিখেছিলেন। ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে আমার চলা অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
বইটির গোড়ায় দুটি গল্পের কথা বলেছিলাম । একটি আগে বলেছি, এবার দ্বিতীয়টি বলছি। একজন মহিলার কাহিনী এটি, যিনি ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে কিছুতেই চলতে পারেন নি।
আমি মহিলাটির নাম বলছি মেরী কুশম্যান, যদিও এটা তার আসল নাম নয়। এটা তাঁর পরিবারের পরিচয় গোপন রাখার জন্যই মাত্র। তবে কাহিনীটি সত্য। সেটা এই রকম :
তিনি লিখেছিলেন–অর্থনৈতিক ডামাডোলের সময় আমার স্বামীর সাপ্তাহিক আয় ছিল মাত্র আঠারো ডলার। মাঝে মাঝে তাও জুটত না কারণ তিনি অসুস্থ থাকতেন। মাঝে মাঝে নানা ব্যাধি আসত, মামপস, পীতজ্বর, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি। যে বাড়িটা নিজেদের হাতের তৈরী করি সেটাও শেষ পর্যন্ত চলে যায়। মুদীর দোকানে আমার দেনা ছিল পঞ্চাশ ডলার। পাঁচটা সন্তানকে খাওয়াতেও হত। পড়শীদের জামা কাপড় ইস্ত্রী করতাম আমি আর পুরনো জামা কাপড় কিনে ছেলেমেয়েদের ব্যবহারের মত করে নিতাম। দুশ্চিন্তায় আমার অসুখ করে । একদিন যে মুদীর কাছে আমাদের ধার ছিল পঞ্চাশ ডলার সে অভিযোগ করল আমাদের এগারো বছরের ছেলে কয়েকটা পেন্সিল চুরি করেছে। ছেলে আমায় কেঁদে সব কথা বলল । আমি জানতাম আমার ছেলে সৎ আর নম্র সে কখনই পেন্সিল চুরি করেনি। ব্যাপারটায় আমি ভেঙে পড়লাম। কত যে কষ্ট আমরা সহ্য করেছি তা ভাবলাম–ভবিষ্যতের কোন আশাই আমাদের রইল না। এরপর সাময়িক ভাবেই বোধ হয় আমার মাথা খারাপ হয়ে যায় । আমি কাপড় কাঁচা কল বন্ধ করে পাঁচ বছরের মেয়েকে নিয়ে ঘরের জানালা দরজা সব বন্ধ করে গ্যাস চালিয়ে দিলাম কিন্তু আগুন ধরালাম না। বাচ্চা মেয়েটি আমায় বলল, মা তুমি এরকম করছ কেন। আমি বললাম হাওয়া আসছে, তাই। মেয়েকে ঘুমুতে চেষ্টা করতে বললে সে বলল, কী আশ্চর্য, আমরা তো একটু আগেই ঘুম থেকে উঠলাম। আমি বললাম, তা হোক আরও একটু ঘুমবো। একথা বলে হিটার থেকে বেরিয়ে আসা গ্যাসের শব্দ শুনতে লাগলাম। গ্যাসের গন্ধ জীবনে ভুলবো না….
আচমকা আমার মনে হল গান শুনতে পেলাম । মন দিয়ে শুনতে চাইলাম। রান্নাঘরে রেডিওটা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলাম। এখন তাতে কিছু আসে যায় না। আচমকা কানে এল কে যেন প্রার্থনা গাইছে, সেই সঙ্গীতের মর্মার্থ হল এই : প্রভু যীশু আমাদের কত বড় বন্ধু, তাঁর কাছে কেন আমরা আমাদের দুঃখ বেদনার কথা জানাই না। ঈশ্বরের কাছে এই কষ্টের কথা বলিনা বলেই আমরা যন্ত্রণা পাই।
ওই গান শুনে আমি বুঝলাম কত বড় ভুল করেছি। আমি একাকী দুঃখ বহন করতে চেয়েছি। ঈশ্বরকে প্রার্থনার মধ্যে সব জানাই নি …। লাফিয়ে উঠে গ্যাস বন্ধ করে জানালা দরজা খুলে দিলাম।
আমি সারাদিন কাদলাম আর প্রার্থনা করলাম। একমাত্র সাহায্যের জন্য প্রার্থনা জানাইনি–বরং ঈশ্বরের যে আশীর্বাদ পেয়েছি তার জন্য ধন্যবাদ জানালাম : আমার পাঁচটি স্বাস্থ্যবান ছেলেমেয়ে পেয়েছি বলে। আমি ঈশ্বরের কাছে শপথ করলাম জীবনে কখনও অকৃতজ্ঞ হব না। সে প্রতিজ্ঞা আমি রেখেছি।
আমাদের বাড়ি হারাবার পর একটা স্কুল বাড়িতে মাসে পাঁচ ডলার ভাড়ায় থাকতে পেলাম। তবুও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম, এই কারণেই যে অন্ততঃ এ জায়গায় শুকনো আর গরম থাকা যায়। আরও ধন্যবাদ দিলাম এজন্য যে, সব কিছু এর চাইতে আরও খারাপ হয়নি।
আমার মনে হয় ঈশ্বর আমার কথা শুনেছিলেন। কারণ একটু একটু করে অবস্থা ভালো হতে লাগলো–রাতারাতি অবশ্য নয়, তবে অবস্থার উন্নতি হলে কিছু টাকা জমালাম। আমি একটা কাজও পেলাম । আমার ছেলেও কাজ পেয়ে গেল । আজ আমার ছেলেমেয়রা সবাই বড়, তারা বিয়েও করেছে। আমার তিনজন সুন্দর নাতি নাতনী আছে। আজ ভাবি সেই ভয়ানক গ্যাস খোলার কথা, হায়! যদি সময় মত না উঠে পড়তাম? তাহলে কত আনন্দময় মুহূর্তই না হারাতাম! কেউ আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে শুনলেই তাই বলি, কখনও একাজ করবেন না। কখনও না । যে অন্ধকার মুহূর্ত আমাদের জীবনে আসে, তা ক্ষণিকের–এরপরেই রয়েছে ভালো সময়…।
আমেরিকায় গড়ে পঁয়ত্রিশ মিনিটে একজন আত্মহত্যা করে। একশ কুড়ি সেকেন্ডে গড়ে একজন পাগলও হয়। এই সব আত্মহত্যা আর উন্মাদ হওয়ার ঘটনা অনেকটাই কমত, যদি এই সব মানুষ ধর্ম আর ঈশ্বরের স্মরণ নিত।
জীবিত মনস্তাত্ত্বিকদের মধ্যে ডঃ কার্ল জাঙ্গ অতি সুনামের অধিকারী। তিনি তার আত্মার সন্ধানে মানুষ বইতে লিখেছিলেন : গত ত্রিশ বছরে পৃথিবীর সব সভ্যদেশের বহু মানুষ আমার পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। আমি শত শত রোগীর চিকিৎসা করেছি। আমার পঁয়ত্রিশ বছর উর্ধ্বের রোগীদের সবাইকার একটাই প্রয়োজন দেখেছি–জীবনে কোন ধর্ম খুঁজে পাওয়া। এটা নির্ভয়েই বলতে পারি তাদের প্রত্যেকেই অসুস্থ হয় প্রাণময় ধর্মের কাছ থেকে তারা যা পেতেন তা হারিয়েছেন বলে, ওদের মধ্যে যারা ধর্মে বিশ্বাস ফিরে পাননি তারা সুস্থও হননি। এই কারণেই কার্ল জাঙ্গের লেখাটি বারবার পড়া দরকার।
উইলিয়াম জেমস ও ঠিক এই কথাই বলে গেছেন : বিশ্বাস এমন একটা শক্তি যার উপর নির্ভর করেই মানুষ বেঁচে থাকে, আর এর অনুপস্থিতি মানেই ধ্বংস অনিবার্য।
বুদ্ধের পর ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা মহাত্মা গান্ধী ও প্রার্থনার শক্তিতে উজ্জীবিত না হলে ঢের আগেই ভেঙে পড়তেন। একথা কি করে জেনেছি? গান্ধী নিজেই কথাটা বলেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, প্রার্থনা ছাড়া অনেক আগেই আমি পাগল হয়ে যেতাম।
হাজার হাজার মানুষের কথাও তাই। আমার বাবা, যার কথা আগেই বলেছি–তিনি আমার মা–র প্রার্থনা আর বিশ্বাস ছাড়া হয়তো জলে ডুবে আত্মহত্যাই করে বসতেন। আমাদের পাগলাগারদগুলোর হাজার হাজার নিপীড়িত মানুষ যদি একাই তাদের ভার বহন না করে বড় শক্তির কাছে প্রার্থনা করত তাহলে তাদের আত্মা শান্তি পেত।
আমরা যখন কষ্টে পড়ি তখন ঈশ্বরের স্মরণ নিই। যে বিপদে পড়ে সে আর নাস্তিক থাকে না। কিন্তু বিপদে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি কেন? আমরা নিজেদের শক্তি রোজই বাড়াব না কেন? শুধু রবিবারের জন্যই অপেক্ষা করব কেন? বহুঁকাল ধরেই আমি শনি বা রবিবার ছাড়া ফাঁকা গির্জায় গিয়েছি। যখন খুব তাড়াহুডোর ব্যাপার করি তখনই নিজেকে বলতে চাই : এক মিনিট দাঁড়াও, ডেল কার্নেগী। এত তাড়াহুড়ো কেন? ক্ষুদ্র মানুষ, তোমার ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা দরকার। এরকম অবস্থায় আমি প্রথম যে গিজা পাই তাতেই প্রবেশ করি। যদিও আমি প্রটেস্টান্ট ধর্মে বিশ্বাসী, তবুও আমি ফিফথ এ্যাভিনিউর রোমান ক্যাথলিক চার্চে ঢুকে পড়ি এবং মনে করি আর মাত্র ত্রিশ বছরের মধ্যে আমার আয়ু সীমাবদ্ধ; কিন্তু সমস্ত চার্চের আধ্যাত্মিক সত্য চিরকালীন। সেখানে চোখ বন্ধ করে বসে আমি প্রার্থনা করতে থাকি। এর ফলে আমার ক্ষমতা আর মুল্যবোধ ফিরে পাই। আপনাকেও এরকম করার পরামর্শ দিতে পারি ।
এ বই লেখার সময় গত ছ’বছর ধরে আমি অসংখ্য উদাহরণ জোগাড় করেছি। স্ত্রী পুরুষরা কিভাবে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে তাদের ভয় আর উৎকণ্ঠা দূর করেছেন। এখানে একজন বই বিক্রেতা জন আর, অ্যান্টনীর বিচিত্র অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনাব । তিনি সেটা আমাকে বলেছিলেন।
বাইশ বছর আগে আমি আমার আইন ব্যবসার প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে এক আমেরিকান আইন বই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বিক্রেতা হই। আমার বিশেষত্ব ছিল নিতান্ত দরকারী আইনের বই আইনজ্ঞদের বিক্রী করা।
আমি বেশ দক্ষই ছিলাম। সব কায়দা কানুনই আমার জানা ছিল। আইনজ্ঞের কাছে যাওয়ার আগে আমি তার আয়, কাজ কর্ম ইত্যাদি সম্পর্কে জেনে নিতাম । সাক্ষাতের সময় ওই খবরগুলোই কাজে লাগাতাম। তবুও কোথাও একটা গোলমাল হত, আমি অর্ডার পাচ্ছিলাম না।
খুবই হতাশ হয়ে পড়লাম । দ্বিগুণ উৎসাহে কাজে নামলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের খরচও উঠতো । একটা ভয় আমায় চেপে ধরল। লোকের কাছে যেতেই ভয় লাগত। ভয়টা এমনই হল যে কারও। কাছেই হাজির হতে পারতাম না, ঘুরে চলে আসতাম।
আমার ম্যানেজার আমাকে তিরস্কার করে জানালেন বিক্রী না বাড়াতে পারলে আগাম টাকা বন্ধ করে দেবেন। বাড়িতে আমার স্ত্রী তিনটি সন্তানকে মানুষ করতে এবং মুদির টাকা মেটানোর জন্য আরও টাকা চাইতে লাগলেন। দুশ্চিন্তা আমায় চেপে ধরল। ক্রমেই মরীয়া হয়ে উঠলাম। কি করব বুঝতে পারলাম না। আমি একেবারে ভেঙে পড়লাম। হোটেলের বিল মেটাবার ক্ষমতাও আমার ছিল না। বাড়িতে ফেরার গাড়ি ভাড়াও আমার ছিল না–নৈশভোজ হিসেবে খেলাম মাত্র একগ্লাস দুধ। সম্পূর্ণ পরাজিত এক মানুষই ছিলাম আমি। হতাশা আর দুঃখে ভেঙে পড়ে বুঝলাম মানুষ কেন জানালা দিয়ে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে। সাহস থাকলে আমিও হয়তো তাই করতাম। অবাক হয়ে কেবল ভাবতাম এ জীবনের উদ্দেশ্য কি?
আর কারও কাছে যাওয়ার উপায় ছিলো না বলে ঈশ্বরের কাছেই আত্মসমর্পন করলাম। আমি প্রার্থনা শুরু করলাম। আমি সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা করে চাইলাম আলোক আর পথের নির্দেশ–কি করে এই অন্ধকারময় দিন পার হব। আমি ঈশ্বরের কাছে চাইলাম আরও বইয়ের অর্ডার যাতে স্ত্রী পুত্রকে খাওয়াতে পারি । প্রার্থনার পর চোখ খুলতেই দেখলাম একখণ্ড বাইবেল টেবিলে রাখা আছে। বইটা খুলে আমি যীশুর অমর বাণী দেখতে পেলাম যা দিয়ে তিনি হাজার হাজার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষকে পথ দেখিয়েছেন যুগে যুগে। যার সাহায্যে তিনি তার শিষ্যদের দুশ্চিন্তা দূর করতে উপদেশ দান করতেন :
জীবন সম্পর্কে চিন্তা কোর না কি খাবে বা পান করবে ভেবো না, কি পরবে তাও ভেবো না। খাদ্য আর পোশাকের চেয়েও কি জীবন বেশী নয়?…প্রথমেই ঈশ্বরের রাজত্বের কথা ভাবো আর তার ন্যায় বিচার…।
প্রার্থনা করতে করতে একটা অলৌকিক ব্যাপার ঘটে গেল–আমার সব উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা কেটে গেল। সব দুশ্চিন্তা কেটে গিয়ে মন এক অদ্ভুত আশা আর জয়ের আনন্দের ভরে উঠল।
আমি আবার সুখী হয়ে উঠলাম। খাওয়ার পয়সা না থাকলেও বিছানায় শুয়ে গভীর দ্ৰিায় ঢলে পড়লাম। এমন বহুদিন ঘুমাইনি।
পরদিন সকালে আনন্দে কাজে যাওয়ার তর সইছিল না। মনে সাহস নিয়ে বৃষ্টিস্নাত সকালে এগিয়ে গেলাম। ক্রেতার অফিসে বেশ সপ্রতিভ ভঙ্গীতেই সটান ঢুকলাম, তারপর হাসিমুখে বললাম, সুপ্রভাত, মিঃ স্মিথ! আমি আমেরিকান ল বুক কোম্পানীর জন আর, অ্যান্টনী।
ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, তিনিও হেসে বললেন হাত বাড়িয়ে। আপনাকে দেখে খুশি হলাম। বসুন।
সারা সপ্তাহে যা ব্যবসা করেছি ওইদিন তার চেয়েও বেশি করলাম। ওইদিন সন্ধ্যায় একজন বিজয়। বীরের মতই হোটেলে ফিরলাম। নিজেকে নতুন বলেই মনে হতে লাগল। সত্যিই নতুন মানুষ হয়ে উঠলাম, মনটাও বদলে গেল। ওইদিন থেকে আমার বিক্রীও দারুণ বেড়ে গেল।
আমার যেন ওইদিন থেকে নবজন্ম হল। ঈশ্বরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নতুন করে স্থাপিত হল। সাধারণ একজন মানুষকে পরাজিত করা যায় কিন্তু ঈশ্বরের আশ্রিত কাউকে হারানো অসম্ভব। এটা আমার জীবনেই সত্য প্রমাণিত।
চাইলেই আপনি তা পাবেন, খুঁজলেই তা পাবেন; ডাকুন দরজা খুলে যাবে।
ইলিনয়ের মিসেস এল, জি, বীয়ার্ডের জীবনে যখন বিষাদের ছায়া নেমে আসে তিনি আবিষ্কার করেন ঈশ্বরের এই আরাধনাতেই পাওয়া যায় শান্তি : হে ঈশ্বর, আমার নয়, আপনার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।
আমার সামনেই তাঁর চিঠি রয়েছে। তিনি লিখেছিলেন : একদিন সন্ধ্যায় আমাদের টেলিফোন বেজে ওঠে। চোদ্দবার বাজার আগে ওটা ধরার সাহস পাইনি। আমি জানতাম ওটা হাসপাতাল থেকে আসছিল। আমি ভয়ে কাঠ হয়ে ছিলাম। আমার ভয় হচ্ছিল আমাদের ছোট্ট ছেলেটি মারা যাচ্ছে। ওর মেনিনজাইটিস হয়। ওকে পেনিসিলিন দেওয়া হয়েছিল আর তাতে জ্বর ওঠানামা করছিল । ডাক্তার ভয় পাচ্ছিলেন রোগ মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়েছে ফলে মস্তিষ্কে টিউমার হয়ে মৃত্যুও ঘটতে পারে। ফোন পেয়ে তাই প্রচণ্ড ভয় হল। হাসপাতাল থেকে ডাক্তার কথা বলতে চান।
আমার স্বামীর এবং আর মানসিক যন্ত্রণার কিছুটা আন্দাজ নিশ্চয়ই আপনারা করে নিতে পারছেন। আমরা হতাশায় ভেঙে পড়ে ভাবছিলাম, আর কি আমাদের সন্তানকে কোলে নিতে পারব? যখন ডাক্তারের ঘরে ঢুকলাম তার মুখ ভার দেখে ভয়ে আমার বুক কেঁপে গেল। তার কথায় আরও ভয় পেলাম । আমাদের ছেলের যে রোগ তাতে প্রতি চারজনে একজন বাঁচে। তাই অন্য ডাক্তার ডাকতে হলে ডাকতে পারি।
বাড়ি ফেরার পথে আমার স্বামী স্টিয়ারিং হুইলে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। গাড়ি থামিয়ে সব চিন্তা করে আমরা একটা গির্জায় ঢুকলাম। একটা আসনে বসে কাতর প্রার্থনা শুরু করলাম কান্নায় ভেঙে পড়ে : হে ঈশ্বর আমার নয়, আপনার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।
কথাটা উচ্চারণ করেই ভালো বোধ করলাম। মনে আচমকা শান্তি নেমে এল । বাড়ি ফিরেও একই কথা বলে চলোম : হে ঈশ্বর, আমার নয়, আপনার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। এরপর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলাম। কদিন পরে ডাক্তার জানালেন ববির বিপদ কেটে গেছে। ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ আজ আমাদের ববি সুন্দর স্বাস্থ্যবান চার বছরের ছেলে।
আমি অনেককেই জানি যারা ভাবেন ধর্ম হল মেয়েমানুষ, শিশুদের আর ধর্ম প্রচারকদের জন্য। তারা অহঙ্কার করেন পুরুষ মানুষের মতই তারা নিজেদের সামলাতে পারেন।
তারা হয়ত আশ্চর্য হবেন এটা জেনে যে পৃথিবীর বহু বিখ্যাত পুরুষ মানুষ সব সময় প্রার্থনা করে থাকেন। যেমন, বিখ্যাত পুরুষ জ্যাক ডেস্পসী আমায় বলেছেন প্রতিটি লড়াইয়ের আগে প্রার্থনা করে থাকেন। তিনি ঈশ্বরকে প্রার্থনা না জানিয়ে কখনও আহার্য গ্রহণ করতেন না। আরও তিনি জানিয়েছেন প্রার্থনা করার মধ্য দিয়েই লড়াই করার প্রেরণা তিনি পেতেন।
পুরুষ কনি–ম্যাক বলেছেন, প্রার্থনা না করে তিনি শুতে যেতেন না। এই রকম এডিরিকেনবেকারও আমায় বলেছেন প্রার্থনা ছাড়া কোন কাজই তিনি করতেন না। পুরুষ মানুষ এডওয়ার্ড আর. স্টেটিনিয়াম, পূর্বতন সেক্রেটারী অফ স্টেট বলেছেন তিনি জ্ঞান ও পথ প্রদর্শনের জন্য দিবারাত্রি প্রার্থনা করতেন।
‘পুরুষ মানুষ’ আইসেনহাওয়ার যখন ইংল্যান্ডে বিটিশ ও আমেরিকান সেনাবাহিনীর দায়িতনে জন্য যান, তখন প্লেনে সঙ্গে নিয়েছিলেন–একখানা বাইবেল।
‘পুরুষ মানুষ’ জেনারেল মার্ক ক্লার্ক আমাকে বলেছিলেন যুদ্ধের সময় তিনি রোজই হট মডেল প্রার্থনা করতেন। এই রকমই করতেন জেনারেল চিয়াং কাইশেক আর জেনারেল মন্টগোমারী –এল অ্যালামিনের মন্টি। ট্রাফলগারের যুদ্ধে লর্ড নেলসন ঠিক এমনই করতেন। এই ভাবেই করেছিলেন জেনারেল ওয়াশিংটন, রবার্ট ই. লী. স্টোনওয়াল, জ্যাকসন এবং আরও অসংখ্য বিখ্যাত সেনাপতিরা।
এই সব ‘পুরুষরা’ উইলিয়াম জেমসের কথার সারমর্ম আবিষ্কার করেছিলেন : ঈশ্বর আর আমাদের কাজ একই সঙ্গে, আর এই উপলব্ধির মধ্য দিয়ে আমরা তার অনুগত থাকলেই আমাদের মনস্কামনা পূর্ণ হয়।
বহু পুরুষই আজ বেশি করে ধর্মের দিকে ঝুঁকছেন। তেমনই ঝুঁকছেন বিজ্ঞানীরাও। যেমন ধরুন বিজ্ঞানী ডঃ ক্যারেল রিডার্স ডাইজেস্টে এক প্রবন্ধে লেখেন : প্রার্থনার মধ্য দিয়েই একজন মানুষ বিরাট শক্তি তৈরি করতে পারে। এ এমন এক শক্তি যা মহাজাগতিক শক্তির মতই বাস্তব। একজন চিকিৎসক হিসেবে আমরা দেখেছি যখন অন্য সব চিকিৎসা ব্যর্থ হয় তখন প্রার্থনার শক্তিই সব কিছু ঠিক করে দেয়…প্রার্থনা রেডিয়ামের মতই আলোকময়, স্বতনিঃসরিত এক শক্তি…। প্রার্থনার মধ্য দিয়ে মানুষ তাদের সীমিত শক্তি দিয়ে অসীম শক্তিকে ডেকে তাদের শক্তি বাড়ায়। যখন আমরা প্রার্থনা করি যেন ওই শক্তির কিছুটা আমরা পাই…। আমরা যখন ঈশ্বরকে একাগ্রতায় প্রার্থনা জানাই তখন আমরা দেহ মনকে আরও ভালো করে তুলি। এটা কখনই হয় না যে কেউ এক মুহূর্ত প্রার্থনা করলেন অথচ কোন ভালো ফল পেলেন না।
অ্যাডমিরাল বার্ড জানেন আমাদের বিশ্ব নিয়ন্ত্রক শক্তির সঙ্গে সংযোগ কথাটার অর্থ কি? এটা করার ক্ষমতাই তাঁকে তাঁর জীবনের কঠিনতম পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে। তিনি একাকী নামে লেখা বইতে সেকথা বলেছেন। ১৯৩৪ সালে তিনি পাঁচ মাস দক্ষিণ মেরুর বরফ স্তূপে ডুবে থাকা একটা তাবুতে বন ব্যারিয়ারে বাস করেছিলেন । ৭৮ ডিগ্রী দ্রাঘিমায় তিনিই ছিলেন একমাত্র জীবিত প্রাণী। তার ছাউনির উপর বয়ে যেত তুষার ঝড়–ঠাণ্ডা সেখানে শূন্যের ৮২ ডিগ্রীর নিচে। সমস্ত সময় ঘিরে থাকতো অন্ধকার। আচমকা একদিন তিনি সভয়ে আবিষ্কার করলেন তাঁর স্টোভ থেকে কার্বন মনক্সাইড বেরিয়ে তাঁকে তিলে মারতে চলেছে। তিনি কি করতে পারেন? কাছাকাছি সাহায্য রয়েছে ১২৪ মাইল দূরে–কয়েক মাসেও হয়তো তারা আসতে পারবে না। তিনি স্টোভ সারাতে চেষ্টা করলেন কিন্তু তবু গ্যাস বেরোতে লাগল। তাতে মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যেতেন। খেতে পারতেন না, ঘুমোতে পারতেন না। তিনি এতই দুর্বল হয়ে পড়লেন যে বাঙ্ক ছেড়ে বেরোতে পারতেন না। তার প্রায়ই ভয় হত সকাল অবধি হয়তো বাঁচবেন না। তিনি নিশ্চিত ছিলেন এই কেবিনেই তাঁর মৃত্যু ঘটবে আর অনন্ত তুষার তাকে ঢেকে রাখবে।
তাঁর জীবন রক্ষা হল কিভাবে? হতাশার মাঝখানে একদিন তিনি তাঁর ডায়েরী নিয়ে তাঁর জীবনদর্শন লিখতে চাইলেন । তিনি লিখলেন, মানুষ পৃথিবীতে একা নয়। তিনি ভাবছিলেন মাথার উপরে রাশি রাশি তারার কথা, আর সূর্যের কথা যা মেরুকেও আলোকিত করে। তাই তিনি লেখেন, আমি একা নই।
তিনি যে একা নন এই চিন্তাটাই রিচার্ড বার্ডকে বাঁচিয়ে দেয়। তিনি তাই লিখেছিলেন, আমি জানি এর ফলেই আমি রক্ষা পাই। খুব কম লোকেই তাদের সমস্ত শক্তি ব্যবহার করেন। মানুষের মধ্যে এমন বহু শক্তির কুয়ো আছে যা ব্যবহৃত হয় না। অ্যাডমিরাল বার্ড সেই কুয়োই ব্যবহার করেন শক্তির জন্য–ঈশ্বরের দিকে ফিরে প্রার্থনা করে।
ইলিনয়ের শস্যক্ষেত্রে ঠিক এটাই বার্ডের মতই আবিষ্কার করেন গ্লেন এ আর্নল্ড । তিনি একজন। বীমার দালাল। তিনি আমায় লিখেছিলেন, আট বছর আগে আমি আমার বাইরের দরজায় তালা লাগিয়ে বেরোই–ভেবেছিলাম সেটাই আমার শেষ যাওয়া। তারপর গাড়িতে উঠে নদীর দিকে চলোম । আমি এক ব্যর্থ মানুষ। গত এক মাসে সারা পৃথিবীই যেন আমার ঘাড়ে ভেঙে পড়েছিল। আমার বৈদ্যুতিক জিনিসের ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যায়। বাড়িতে আমার মা মৃত্যু শয্যায়। আমার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা। ডাক্তারের পাওনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আমাদের নিজস্ব গাড়ী, আসবাব পত্র ইত্যাদি যা কিছু ছিল তা বা দিয়েছিলাম। বীমার পলিসি থেকেও ধার নিলাম এরপর সব আশাই শেষ । আমার আর সহ্য হল না–তাই ঠিক করলাম গাড়িতে চড়ে নদীর জলেই সব দুঃখ শেষ করে দেব। কিছুক্ষণ গ্রাম্য পথে ঘরলাম তারপর এক জায়গায় শিশুর মত কান্নায় ভেঙে পড়লাম। তারপরেই ভাবতে বসলাম। সত্যিই আমার অবস্থা কতটা খারাপ? আরও খারাপ তো হতে পারতো। সত্যিই কি আশাহীন? এ অবস্থা ভালো করতে আর কি করতে পারি?
তখনই ঠিক করলাম সমস্ত কিছু ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করব আর তারই সাহায্য চাইব। আমি প্রার্থনা করতে লাগলাম। এমনভাবে প্রার্থনা করতে লাগলাম যেন এর উপরেই আমার জীবন নির্ভর করছে। হঠাৎই মনে অদ্ভুত শান্তি নেমে এল, গত এক মাসে যা ছিল না। কত ঘণ্টা সেখানে ছিলাম জানিনা–তারপর বাড়ি ফিরে শিশুর মতো ঘুমোলাম।
পরদিন আত্মবিশ্বাস নিয়েই জেগে উঠলাম। আর কিছুতেই আমার ভয় নেই আমি পথ প্রদর্শনের জন্য ঈশ্বরের কাছেই আত্মসমর্পণ করেছি। এরপর প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে যে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের দোকানে চাকরির আবেদন করেছি সেখানে ঢুকলাম। আমি জানতাম চাকরিটা পাবই, পেলামও। যুদ্ধের সময়, ওই ব্যবসা নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তাই করলাম। তারপর বীমার কাজ নিলাম–ঈশ্বর তখনও আমার পরিচালক। আমার সব দেনা শোধ করেছি, তিনটি সন্তানসহ আমার সুখের সংসার এখন। আমার নিজের বাড়ি হয়েছে, নতুন গাড়িও হয়েছে আর আছে পঁচিশ হাজার ডলারের বীমা।
পেছনে দিকে তাকালে এখন ভাবি সর্বস্ব হারিয়েছিলাম সেটা বোধহয় ভাগ্যের জন্যই–কারণ নদীর দিকে গিয়ে ঈশ্বরের উপর নির্ভর করতে শিখেছিলাম। আজ আমার শান্তি আর আত্মবিশ্বাস এতখানি যা কখনও পাব তা ভাবিনি।
ধর্মে বিশ্বাস কি করে এমন প্রশান্তি আর শক্তি আনতে পারে? এর উত্তর উইলিয়াম জেম্সই দিয়েছেন : উপরের ঝড়, ঢেউ সমুদ্রের তলায় পৌঁছয় না। যিনি বিশাল এবং চিরন্তন সত্য উপলব্ধি করেন। তার কাছে প্রতিটি সময়ের রূপান্তর প্রধান হয়ে উঠতে পারে না। প্রকৃত ধার্মিক অবিচল থাকেন আর শান্তভাবেই নিজের কাজ করে চলেন।
আমরা যদি উদ্বিগ্ন আর চিন্তান্বিত হই, তাহলে ঈশ্বরের দিকে ফিরি না কেন? ইমানুয়েল কান্ট যেমন বলেছেন : ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখুন–এ বিশ্বাস আমাদের প্রয়োজন। আসুন না বিশ্বচালক শক্তিতেই নিজেকে যুক্ত করি।
আপনি যদি স্বাভাবিকভাবে ধার্মিক নাও হন–যদি সন্দেহবাদীও হন, তাহলেও প্রার্থনা আপনাকে প্রভূত শক্তি দেবে–কারণ প্রার্থনা হল পরীক্ষিত সত্য। পরীক্ষিত সত্য মানে কি? যা বলতে চাই তা হল এই : প্রার্থনা মানুষের তিনটি মনস্তাত্বিক প্রয়োজন মেটাতে পারে, তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করুন চাই না করুন।
সে তিনটি হল এই :
১। প্রার্থনার মধ্য দিয়ে আমাদের যা যন্ত্রণা তা কথায় প্রকাশ করা যায় কারণ স্পষ্ট না হলে এর সমাধান করা কঠিন। প্রার্থনা এমনই করতে হবে যাতে আমাদের সমস্যা যেন কাগজে লেখার মতই হয়। ঈশ্বরের কাছেও সাহায্য চাইলে তা কথায় প্রকাশ করা প্রয়োজন।
২। প্রার্থনার মধ্য দিয়ে আমরা ভাবতে পারি সমস্যাটি আমার একার নয়, তা ভাগ করে নিতে পারি। আমাদের মধ্যে অনেকেই এমন দৃঢ়চিত্ত নই যে, নিজেদের সমস্যার ভার একাকী বহন করতে পারব। আবার কখনও এমন সমস্যা ঘটে যা নিজেদের একান্ত আপনার জন বা আত্মীয়দেরও বলা যায় না। এক্ষেত্রে উত্তর হল প্রার্থনা। যে কোন মনস্তাত্বিকই বলবেন সমস্যায় কন্টকিত হয়ে আমরা শক্ত হয়ে পড়লে সে কথা কাউকে বললে ফল ভালোই হয়। যখন তা কাউকে বলতে পারি না তখনই বলা যায় ঈশ্বরকে।
৩। প্রার্থনা কাজ করতেও সাহায্য করে। কাজে নামার এটাই প্রথম ভাগ। আমার সন্দেহ আছে কেউ কোন কিছুর জন্য প্রার্থনা করলে তার পূরণ হয় না । ডঃ অ্যালেক্সি ক্যারেল সে কথাই বলেছেন, সবচেয়ে বড় শক্তি প্রার্থনার কালেই সৃষ্টি হয়। অতএব তাই করুন না কেন? ঈশ্বরই বলুন, আল্লাই বলুন বা যে কোন শক্তিই বলুন; নাম নিয়ে কলহ করে কি লাভ? যতক্ষণ ওই রহস্যময় শক্তি আমাদের সাহায্য করে? এবার বইটা বন্ধ করে শোবার ঘরে হাঁটু মুড়ে ঈশ্বরের কাছে নিজের মন মেলে ধরুন না কেন? যদি সব বিশ্বাস হারিয়ে থাকেন, তাহলে সর্ব শক্তিমান ঈশ্বরের কাছে সেটা ফিরে পেতে চান না কেন? সাতশো বছর আগে আসিসির সাধু ফ্রান্সিস লিখেছিলেন : হে ঈশ্বর, আমাকে শান্তির কাজে নিয়োজিত করুন। যেখানে ঘৃণা আছে, সেখানে আমায় ভালোবাসার জীব বপন করতে দিন। যেখানে আঘাত আছে, সেখানে মার্জনা করতে দিন। যেখানে সন্দেহ, সেখানে দিন বিশ্বাস। যেখানে হতাশা, সেখানে আসুক আশা। যেখানে অন্ধকার, সেখানে আসুক আলোক। হে পবিত্র প্রভু, আমি সান্ত্বনা চাই না–সান্ত্বনা দিতে চাই–ভালোবাসা চাই না, ভালোবাসতে চাই–ক্ষমা করলেই যেহেতু ক্ষমা পাওয়া যায়, তাই মত্যর মধ্যেই ফিরে পাই অনন্ত জীবন।