দুশ্চিন্তা আপনার কতখানি ক্ষতি করতে পারে
‘যে ব্যবসায়ীরা জানে না দুশ্চিন্তা কী করে জয় করতে হয় তাদের অল্প বয়সেই মৃত্যু হয়’–ডঃ অ্যালেক্সিস ক্যারেল
কিছুদিন আগে এক প্রতিবেশী আমাদের বাড়ি এসে বলেন আমাদের সকলের বসন্ত রোগের জন্য টিকা নেওয়া উচিত। তার মত এমন হাজার হাজার লোক স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নিউ ইয়র্কের বাড়ি বাড়ি ঘুরে আবেদন জানাচ্ছিলেন। ভীত মানুষরা ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা নিচ্ছিলো। এজন্য হাসপাতাল ছাড়াও দমকলের অফিস, পুলিশ থানা, বড় বড় কারখানা, সর্বত্র টিকা দেবার অফিস খোলা হয়। দুহাজার ডাক্তার আর নার্স পাগলের মতই সারাদিন পরিশ্রম করছিলেন। এরকম উত্তেজনার কারণ কি? নিউ ইয়র্কে আটজনের বসন্ত হয় আর তাদের দুজন মারা যায়। ভাবুন, আশি লক্ষ মানুষের মধ্যে মাত্র দুজন।
আমি নিউইয়র্ক শহরে প্রায় সাতচল্লিশ বছরেরও বেশি কাটিয়েছি অথচ আজ পর্যন্ত কেউ আমার বাডির কড়া নেড়ে আবেগজনিত দুশ্চিন্তার বিষয়ে সতর্ক করেনি–এই রোগে গত সাইত্রিশ বছরে বসন্তের চেয়ে অন্তত দশ হাজার গুণ বেশি ক্ষতি করেছে :
কেউ আমায় সতর্ক করে বলেনি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দশজনের মধ্যে একজনের স্নায়বিক রোগে ভেঙে পড়ার ভয় আছে–এর মূল হল আবেগজনিত দুশ্চিন্তা। এজন্যই আমি এই পরিচ্ছেদ লিখে আপনাদের কড়া নেড়ে সাবধান করতে চাইছি।
চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী বিখ্যাত উ. আলেক্সিস ক্যারেল বলেছেন, যে ব্যবসায়ীরা দুশ্চিন্তা কি ভাবে জয় করতে হয় জানে না তাদের অল্পবয়সেই মৃত্যু হয়। কেবল ব্যবসায়ীরা নয়, গৃহিণী, ঘোড়ার ডাক্তার, রাজমিস্ত্রিদের বেলাতেও একই কথা।
কবছর আগে আমি টেক্সাস আর নিউ মেক্সিকোতে মোটরে চড়ে বড় মাল্টাফে রেলওয়েজের ডং ও এফ, গোবারের সঙ্গে ছুটি কাটাই। আমরা আলোচনা করতে করতে দুশ্চিন্তার কথা উঠতেই তিনি বললেন, ডাক্তারের কাছে আসা রোগীদের শতকরা সত্তর ভাগই তাদের রোগ নিরাময় করতে পারতো যদি তারা ভয় আর দুশ্চিন্তা দূর করতে পারত। তবে মনে করবেন না তাদের রোগটা কাল্পনিক বলছি। দাঁত ব্যথা এবং আর ও শতগুণ বিপজ্জনক রোগ তাদের হয় কথাটা ঠিক। যেমন পাকস্থলীর আলসার, ন্দ্রিাহীনতা, হৃদরোগ, কোন ধরনের পক্ষাঘাত ইত্যাদি।
রোগগুলো ঠিকই, ড. গোবার বলেছিলেন, কারণ আমি নিজেই বারো বছর ধরে আলসারে ভুগেছি, তাই কি বলছি আমি জানি।
ভয় থেকেই আসে দুশ্চিন্তা। দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগে স্নায়ুর বিকৃতি দেখা দেয় আর সেটা পাকস্থলীর স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত করে, ফলে পাঁচক রসে বিকৃতি ঘটে আর শেষ অবধি আলসারে দাঁড়ায়।
আর একজন চিকিৎসক, ‘স্নায়বিক পেটের রোগ’ বইয়ের লেখক ডঃ যোশেক এফ. মন্টেগু একই কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন: আপনি যা খান তাতে আলসার হয় না। আপনাকে যা কুরে কুরে খায় তাতেই আলসার হয়। মেয়ো ক্লিনিকের ডাক্তার ড, ডব্লিউ সি. আলভারেজ বলেন, আলসার কমে বা বাড়ে মানসিক অবস্থার উত্থান পতনে। এই কথা বলা হয় মেয়ো ক্লিনিকে ১৫,০০০ হাজার রোগীর পাকস্থলীর চিকিৎসার অভিজ্ঞতায় । ভয়, উদ্বেগ, ঘৃণা, অতিমাত্রায় স্বার্থপরতা বাস্তবের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর অক্ষমতাই এই আলসারের জন্য দায়ী। …. পাকস্থলীর আলসারে মৃত্যু ঘটতে পারে। লাইফ পত্রিকায় বলা হয়েছে যে মারাত্মক রোগের তালিকায় এর স্থান দশম।
কিছুকাল আগে মেয়ো ক্লিনিকের জনৈক ডাক্তারের সঙ্গে আমার পত্রালাপ হয়। তিনি কিছুদিন আগে এক প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন। তাতে তিনি বলেন তিনি ১৭৬ জন ব্যবসা জগতের উপরতলার কর্মীকে পরীক্ষা করেন। তাদের বয়সের গড় ৪৪.৩ বছর। তাদের প্রায় এক তৃতীয়াংশের কিছু বেশি হৃদরোগ, পাকস্থলীর আলসার আর উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন। ভাবুন তো–এই সব মানুষ পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের আগেই ওই সব রোগে আক্রান্ত। হৃদরোগ বা আলসারে ভুগছেন এমন কেউ কি ব্যবসায় সফল হতে পারবেন? সাফল্য পেতে কি ভয়ানক দামই দিতে হচ্ছে। আর তাতে সাফল্য আসছে? যদি ব্যবসা সফল করতে আলসার বা হৃদরোগ বানাতে হয় তাকে কি সাফল্য বলা যায়? তিনি যদি সারা পৃথিবীর অধীশ্বর হন তাহলেও তো একটা বিছানাতেই শুতে হবে আর দিনে তিনবারের বেশি খেতেও পারবেন না। যে লোক মাটি কুপিয়ে খাল বানায় সেও তাই করে অনেক আনন্দে দিন কাটায় এবং ব্যবসা সংক্রান্ত যে কোন অফিসারের চেয়ে ভালোই ঘুমোয়। সত্যি বললে চাষ করেও স্বাস্থ্য ঠিক রাখা যায় । আমি রেলপথ বা সিগারেট কোম্পানির অধিকারী হতে গিয়ে পঁয়তাল্লিশ বছরে নিজেকে শেষ করতে চাই না।
সিগারেটের কথায় মনে পড়ছে সম্প্রতি পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত সিগারেট কোম্পানীর প্রস্তুতকারক কানাডিয় জঙ্গলে ছুটি কাটাতে গিয়ে হৃদরোগে মারা যান। তিনি লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করেন আর একষট্টি বছর বয়সে মারা গেলেন। ব্যবসাতে সাফল্য আনতে গিয়ে তিনি বোধহয় জীবনের সেরা অংশই ব্যয় করেছিলেন।
.
আমার মতে সিগারেট কোম্পানির ওই মালিক আমার বাবার তুলনায় অর্ধেকও জীবনে সফল হননি। মিসৌরীর চাষী, আমার বাবা বেঁচেছিলেন ৮৯ বছর আর এক কপর্দকও মৃত্যুর সময় রেখে যাননি।
বিখ্যাত মেয়ো ভাইয়েরা বলেছেন আমাদের হাসপাতালের অর্ধেকেরও বেশি রোগী হলেন স্নায়ুর রোগী। তবুও এইসব স্নায়ু রোগীরা মারা যাওয়ার পর অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পরীক্ষার পর দেখা যায় তাদের স্নায়ু ম্যাক ডেম্পসীর চেয়েও সবল ছিল। তাদের স্নায়ুর গোলযোগ ঘটে শারীরিক কারণে নয় বরং ব্যর্থতা, পরাজিতের মনোভাব, উদ্বেগ, ভয়, দুশ্চিন্তা এবং হতাশা থেকে। প্লেটো বলেছিলেন, চিকিৎসকরা যে ভুল করেন তা হলো তারা মনের চিকিৎসা না করে শরীর সারাতে চান, যদিও মন আর শরীর অবিচ্ছেদ্য তাই আলাদা করে চিকিৎসা উচিত নয়।
এই মহাসত্য বুঝতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের লেগেছিল তেইশশো বছর। আমরা এখন এক নতুন ধরনের ওষুধ তৈরির চেষ্টা করছি যার নাম সাইকোসোমাটিক ওষুধ–যে ওষুধ মন ও শরীরের একসঙ্গে চিকিৎসা করবে। আমাদের এটা করার উপযুক্ত সময় কারণ চিকিৎসা বিজ্ঞান ইতিমধ্যেই সাংঘাতিক সব রোগ–যেমন বসন্ত, কলেরা, ইয়োলোফিভারের মতো রোগ নির্মূল করতে পেরেছে, যে রোগে কোটি কোটি মানুষের অকালমৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞান উদ্বেগ, ভয়, ঘৃণা, হতাশা ইত্যাদিতে যে মন ও শরীর ভেঙে যায় তা রোধ করতে পারেনি। এই জাতীয় রোগ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
ডাক্তারদের মত হল প্রতি বিশজনে একজন আমেরিকান তার জীবনের একাংশ কোন না কোন সময় মানসিক হাসপাতালে কাটাতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেনাদলে যোগ দিতে যেসব যুবক আসে তাদের প্রতি ছ’জনের মধ্যে একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত বলে ভর্তি নেয়া হয়নি।
লোকে উন্মাদ হয় কেন? এর সব উত্তর কেউ জানেন না। তবে এটা খুবই সম্ভব যে অনেক ক্ষেত্রেই ভয় আর উদ্বেগ এজন্য দায়ী। দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগে যে হতাশাগ্রস্ত হয়, নিজেরাই এক স্বপ্নের জগৎ গড়ে নেয় আর সেইভাবেই তারা দুশ্চিন্তা কাটায়।
লেখার অবসরে দেখছি আমার সামনে একখানা বই রয়েছে। বইখানা ডঃ এডওয়ার্ড পোলস্কির লেখা, নাম ‘দুশ্চিন্তা কাটিয়ে নিরাময় হোন।’ বইয়ের কিছু পরিচ্ছদের নাম এইরকম:
দুশ্চিন্তা
হৃদয়ের কী করে?
দুশ্চিন্তায় রক্ত
চাপ বাড়ে।
দুশ্চিন্তায় বাত
হতে পারে।
পাকস্থলীর
জন্যই দুশ্চিন্তা কম করুন।
দুশ্চিন্তায় কিভাবে
সর্দিকাশি হয়?
দুশ্চিন্তা ও থাইরয়েড গ্রন্থি।
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বহুমূত্ররোগী।
দুশ্চিন্তা সম্পর্কে আর একখানা চমৎকার বই হলো ডঃ কার্ল মেনিনজারের ‘নিজের বিরুদ্ধে মানুষ’। তার বইতে দুশ্চিন্তা দূর করার কোন পরামর্শ নেই তবে এতে পাবেন আমরা কিভাবে আমাদের স্বাস্থ্য আর মন, উদ্বেগ হাতাশা ঘৃণা, তিক্ততা, ভয় ইত্যাদিতে সমস্ত নষ্ট করে ফেলি তারই অভাবিত সব দৃষ্টান্ত।
দুশ্চিন্তা কঠিন ধাতের মানুষকেও অসুস্থ করে তুলতে পারে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের শেষ দিকে জেনারেল গ্র্যান্ট সেটা বুঝেছিলেন। কাহিনীটি এই রকম: গ্র্যান্ট ন’ মাস যাবৎ রিচমন অবরোধ করেছিলেন। জেনারেল লী’র সেনাদল ক্ষুধা–তৃষ্ণায় চরম দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পরাজিত। সমস্ত রেজিমেন্ট পালাতে ব্যস্ত। বাকিরা তাবুতে বসে আর্তনাদ করছিল আর কাঁদছিল কেউ বা প্রার্থনায় রত। শেষের আর দেরি ছিলো না। লী’র সেনারা রিচমণ্ডের অস্ত্রের গুদাম, তুলো আর তামাকের গুদামে আগুন লাগানোয় সারা রিচমণ্ড যেন জ্বলছিল। তারা রাতের অন্ধকারে পালায়। গ্র্যান্ট চারদিক থেকে তেজের সঙ্গে তাড়া করে চলেছিলেন কনফেডারেট সেনাদের। সেই সময় শেরিডানের অশ্বারোহী বাহিনী সামনে রেল লাইন উপড়ে ফেলে সরবরাহের গাড়ি অধিকার করেছিলেন।
গ্র্যান্ট প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণায় প্রায় অন্ধ হয়ে পিছিয়ে পড়ে একটা খামারবাড়িতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। তিনি তার স্মৃতিকথায় বলেছেন, আমি সারা রাত গরম জলে পা ডুবিয়ে ঘাড়ে আর হাতের কব্জিতে সরষের তেল মেখে সকালে সুস্থ হব ভেবে কাটালাম।
পরদিন সকালে তিনি চট করেই সেরে উঠলেন। আর তাকে যা সরিয়ে তুললো তা কিন্তু সরষের তেলের পুলটিস নয়, একজন অশ্বারোহী লী’ আত্মসমর্পণ করতে চান লেখা একটা চিঠি আনার ফলে।
অফিসারটি চিঠিসহ আমার কাছে আসার সময়েও, গ্র্যান্ট লিখেছেন, আমার অসহ্য মাথার যন্ত্রণা হচ্ছিলো। কিন্তু যে মুহূর্তে চিঠির বক্তব্য দেখলাম আমি ভালো হয়ে গেলাম।
বোঝা যাচ্ছে গ্ল্যান্টের দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ আর আবেগই তাকে অসুস্থ করে তুলেছিল। কিন্তু যে মুহূর্তে তার সব আবেগ আত্মবিশ্বাস, সমাধা এবং জয় এনে দিলো তখনই তিনি সেরে উঠলেন।
এর ঠিক সত্তর বছর পরে ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের ক্যাবিনেটের ট্রেজারী সেক্রেটারী হেনরি মর্গেনথাউ জুনিয়র আবিষ্কার করেন যে, দুশ্চিন্তা তাকে এতই অসুস্থ করেছে যে তার মাথা ঘুরতে থাকে। তিনি তাঁর ডায়েরীতে লিখেছিলেন যে তার অসম্ভব দুশ্চিন্তা হয় প্রেসিডেন্ট যখন গমের দাম বাড়ানোর জন্য একদিনে চুয়াল্লিশ লক্ষ বুশেল গম কেনেন। তিনি ডায়েরিতে লেখেন, ব্যাপারটা যখন চলছিল তখন সত্যিই আমার মাথা ঘুরছিল। বাড়ি ফিরে আমি দুঘণ্টা ঘুমোই।
দুশ্চিন্তা মানুষের কী ক্ষতি করতে পারে জানার জন্য আমাকে লাইব্রেরিতে বা ডাক্তারের কাছে যেতে হয় না। এই বই লেখার সময় জানালা দিয়ে তাকালে দেখতে পাই একটা বাড়িতে একজন স্নায়বিক অবসাদে ভেঙ্গে পড়েছেন–আর অন্য একটা বাড়িতে অপরজনের ডায়াবেটিস হয়েছে। শেয়ার বাজার পড়ে যাওয়াতেই তার রক্ত আর প্রস্রাবে সুগার বেড়ে যায়।
বিখ্যাত ফরাসী দার্শনিক মন্টেইন–কে তার নিজের শহর বোর্দোর মেয়র নির্বাচিত করা হলে তিনি নাগরিকদের বলেন: আপনাদের সব কাজের দায়িত্ব আমার হাতে নিতে পারি তবে আমার লিভার আর পাকস্থলীতে নয়।
আমার ওই প্রতিবেশী শেয়ার মার্কেটের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করেই প্রায় মরতে বসেছিলেন।
দুশ্চিন্তার কুফল নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমাকে অবশ্য প্রতিবেশীর দিকে তাকানোরও দরকার হয় না কারণ আমার এই ঘরেই তার প্রমাণ আছে। এ বাড়ির পূর্বতন মালিকও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে অকালে মারা যান ।
বিশ্বের অন্যতম গেঁটে বাত–বিশেষজ্ঞ ড. রাসেল ডি. মিসিল বলেছেন দুশ্চিন্তা মানুষকে বাতে পঙ্গু করে হুইল চেয়ারে বসাতে পারে। তার মতে গেঁটে বাত হওয়ার প্রধান চারটি কারণ হল :
১
বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য।
২ অর্থনৈতিক বিপর্যয় আর দুঃখ ।
৩ নিঃসঙ্গতা আর দুশ্চিন্তা।
৪ বহুঁকাল পুষে রাখা অসন্তোষ।
এই কারণগুলো অবশ্যই আবেগজনিত আরও ঢের কারণে গেঁটে বাত হতে পারে। তবে সাধারণ কারণ বলতে ওই দুশ্চিন্তাই আছে। উদাহরণ হিসেবে বলছি, আমার এক বন্ধুর আর্থিক দুরবস্থার সময় গ্যাস কোম্পানী গ্যাস বন্ধ করে দেয়। ব্যাঙ্ক ও বাড়ির মর্টগেজ রদ করে দেয়। এই সময় তার স্ত্রীর গেটে বাত জন্মায়–আর যতদিন না তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো হয় ততদিন রোগ সারেনি।
দুশ্চিন্তায় দাঁতেরও ক্ষয় হয়। ডঃ উইলিয়াম আই.এল. ম্যাকগনিগল বলেন, অসুখী মনোভাব যদি দুশ্চিন্তা, ভয় ঘ্যানঘ্যানানি থেকে জন্মায় তা শরীরের ক্যালসিয়াম নষ্ট করে দিতে পারে আর তাতেই দাঁতে ক্ষয় হয়। তিনি এক রোগীর কথা বলেছেন যার চমৎকার দাঁত ছিলো কিন্তু তার স্ত্রীর অসুস্থতার চিন্তায় প্রায় নটি দাঁতে গর্ত হয়ে যায়। সবটাই ওই দুশ্চিন্তার জন্য।
এমন কাউকে দেখেছেন যার থাইরয়েড গ্রন্থি অতি চঞ্চল? আমি দেখেছি, তারা থর থর করে কাঁপে–তারা যেন মৃত্যুভয়ে সবসময়েই ভীত। থাইরয়েড গ্ল্যান্ড যা শরীর নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের এমন অবস্থায় এনে ফেলে যে, হার্টের গতি বৃদ্ধি হয়–সারা দেহ যেন চুল্লির আগুনে হাওয়া পেয়ে জোরে চলতে থাকে। আর এটা বন্ধ না করতে পারলে, অস্ত্রোপচার বা চিকিৎসা না করলে এঁরা মৃত্যুবরণ করতে পারে।
কিছুদিন আগে এক বন্ধুর সঙ্গে ফিলাডেলফিয়ায় গিয়েছিলাম, তার এই রোগ ছিল। তাকে এক বিখ্যাত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই, তিনি আটত্রিশ বছর এই রোগের চিকিৎসা করছেন। তার বৈঠকখানার দেয়ালে ফ্রেমে আঁটা একটা উপদেশ ছিলো। আমি সেটা টুকে নিই। সেটা এই রকম :
সবচেয়ে আরামপ্রদ অবসর বিনোদনের শক্তি হলো সুস্থধর্ম, ঘুম, সঙ্গীত আর হাসি । ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখুন–ভালোভাবে ঘুমোতে শিখুন–সঙ্গীতকে ভালোবাসুন আর জীবনের মজার দিকটি দেখার চেষ্টা করুন। তাহলেই সুস্বাস্থ্য আর সুখ আপনার আয়ত্ত হবে।
***
আমার ঐ বন্ধুকে ডাক্তার প্রথমেই এই প্রশ্ন করেন: আপনার কি কোন মানসিক আবেগের ফলে এমন অবস্থা হয়েছে। তিনি আমার বন্ধুকে সাবধান করে বলেন তিনি যদি দুশ্চিন্তা দূর না করেন তাহলে অন্য উপসর্গ যেমন–হৃদরোগ, আলসার বা বহুমূত্র ইত্যাদি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। ডাক্তার জানান, এই সব রোগ খুড়তুতো, জ্যেঠতুতো ভাইয়ের মতই–এর সবই দুশ্চিন্তার রোগ!
আমি যখন প্রথম মার্লে ওবেরনের সাক্ষাৎকার নিই তিনি আমাকে জানান তিনি কিছুতেই দুশ্চিন্তা করেন না। কারণ তার জানা ছিলো দুশ্চিন্তা সিনেমার পর্দায় তার প্রধান আকর্ষণই নষ্ট করে দেবে।
তিনি আমায় বলেছিলেন : প্রথম যখন সিনেমায় নামতে যাই দুশ্চিন্তা আর ভয়ে কাঠ হয়েছিলাম। আমি সাবে ভারতবর্ষ থেকে এসেছি আর লন্ডনে কাউকে চিনতাম না সেখানে একটা কাজ চাইছিলাম। যখন প্রযোজকের সঙ্গে দেখা করি, কিন্তু কেউ আমায় নিলেন না, আমার সামান্য পুঁজি ফুরিয়ে আসছিল। দু’সপ্তাহ ধরে আমি শুধু বিস্কুট আর জল খেয়ে কাটাই। তখন দুশ্চিন্তা ছাড়াও আমার খিদের জ্বালাও জটলো৷ নিজেকে তাই বললাম, হয়তো তুমি একটি বোকা–হয়তো কোনদিনই ছবির জগতে ঢুকতে পারবে না। তোমার কোন অভিজ্ঞতা নেই। জীবনে কখনো অভিনয় করোনি–তোমার সুন্দর মুখোনা, ছাড়া আর কি দেখার আছে?
আমি আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। যখন আয়নায় তাকালাম দেখলাম দুশ্চিন্তা আমার মুখের কি দশা করেছে, কালো রেখা পড়েছে সেখানে। উদ্বেগের চিহ্ন ও চোখে পড়ল। তাই নিজেকে বললাম : এটা এখনই বন্ধ করা চাই। তোমার দুশ্চিন্তা করা একেবারে চলবে না। দেবার মত তোমার ওই সৌন্দর্যই আছে, তাকে নষ্ট করা চলবে না।
মেয়েদের চেহারা সবচেয়ে খারাপ হয়ে যায় দুশ্চিন্তায়। দুশ্চিন্তা নিজেকে প্রকাশে বাধা দেয়। চুলে পাক ধরতে পারে, তা উঠেও যেতে পারে, চামড়ার রোগ হতে পারে।
আমেরিকায় হৃদরোগেই আজকাল সবচেয়ে বেশি লোক মারা যায়। দ্বিতায় বিশ্বযুদ্ধে এম সাতলক্ষ লোক মারা যায়। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে বিশ লক্ষ লোক মারা যায় হৃদরোগে–এর অর্ধেক আবার এমন হৃদরোগ, যার উৎপত্তি হয় দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগে জীবন যাপনের জন্য। হ্যাঁ, এই কারণেই ডঃ অ্যালেক্সিস বলেছিলেন, যে সমস্ত ব্যবসায়ীরা জানেন না দুশ্চিন্তা কিভাবে দূর করতে হয় তাদের অল্পবয়সে মৃত্যু হয়।
নিগ্রো আর চীনাদের কদাচিৎ এই ধরনের দুশ্চিন্তার কারণে হৃদরোগ হয়। কারণ তারা সবকিছুই শান্তভাবে মেনে নিতে অভ্যস্ত। খামারের কৃষকদের চেয়ে ডাক্তারদের মধ্যে হৃদরোগে মৃত্যুর সংখ্যা বিশগুণ বেশি। ডাক্তারদের জীবন দুশ্চিন্তায় কাটে বলে তারা উচিত মূল্য পেয়ে থাকেন।
উইলিয়াম জেমস বলেছেন, ঈশ্বর আমাদের পাপ ক্ষমা করেন, কিন্তু আমাদের স্নায়ু তা করে না।
একটা আশ্চর্যজনক আর প্রায় অবিশ্বাস্য ব্যাপার শুনুন, আমেরিকায় সবচেয়ে ছোঁয়াচে রোগে যত লোক মারা যায় তার চেয়ে ঢের বেশি মারা যায় আত্মহত্যা করে।
কেন এরকম হয়? এর প্রধান কারণই হল : দুশ্চিন্তা।
চীনের নিষ্ঠুর সেনাধ্যক্ষরা তাদের বন্দীদের উপর অত্যাচার চালাতে তাদের খুঁটির সঙ্গে হাত–পা বেঁধে উপরে ঝোলানো চামড়ার ব্যাগ ভর্তি জলের নিচে রাখতেন–ওই ব্যাগ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে পড়ত মাথায়। ….অনবরত …সারা দিন রাত ধরে। ওই জলের ফোঁটাকে শেষ অবধি মনে হত যেন হাতুড়ির আঘাত–মানুষ তাতে পাগল হয়ে যেত। হিটলারের আদেশে এই একই পদ্ধতি কাজে লাগানো হয় স্পেনের বন্দী নিবাস আর জার্মানির কনসেনট্রেশান শিবিরে।
দুশ্চিন্তা ও অনেকটা এই অনবরত ঝরে পড়া জলের ফোঁটার মত, আর ক্রমাগত এই দুশ্চিন্তায় মানুষ উন্মাদ হয়ে যায় আর আত্মহত্যা করতে চায়।
মিসৌরীতে আমি যখন অল্পবয়সের ছেলে তখন বিলি সানডের কাছে পরজন্মের নরকাগ্নির কথায় দারুণ ভয় পেতাম। কিন্তু এই জীবনে শরীরে যে নরকাগ্নি জ্বলছে এবং তার যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে কেউ তার কথা কখনও বলেন নি। যেমন, আপনি যদি ক্রমাগত দুশ্চিন্তা করেন তাহলে একদিন হয়তো এমন বেদনায় আক্রান্ত হতে পারেন যার নাম এঞ্জাইনা পেক্টোরিস অর্থাৎ হৃদযন্ত্রের ব্যাথা।
এ রোগের আক্রমণ যে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করবেন তাতে দান্তের ‘ইনফারনো’কেও মনে হবে ছেলেমানুষী। তখন আপনি নিজেই বলতে চাইবেন, হে ঈশ্বর, এ থেকে মুক্তি পেলে আর কখনই দুশ্চিন্তা করবো না। বাড়িয়ে বলছি কিনা পারিবারিক চিকিৎসককে প্রশ্ন করুন একবার ।
আপনি কি জীবনকে ভালোবাসেন? দীর্ঘদিন সুস্থ শরীরে বাঁচতে চান? তাহলে একটা কথা শুনে নিন। আমি আবার ডঃ অ্যালেক্সি ক্যারেলের উদ্ধৃতি দিচ্ছি। তিনি বলেন, যারা এই আধুনিক শহর কোলাহলের মধ্যেও অন্তরের শান্তি বজায় রাখতে পারেন তাদের স্নায়ুর রোগ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
আপনি আভ্যন্তরীণ সত্তাকে এভাবে শান্তিতে রাখতে পারেন কি? আপনি একজন স্বাভাবিক মানুষ হলে এর উত্তর হলো : হ্যাঁ। বা ‘অবশ্যই’। আমরা বেশির ভাগই অনেকাংশে শক্তিশালী, যদিও আমরা তা সব সময় বুঝে উঠতে পারি না। আমাদের মধ্যে যে ক্ষমতা আছে তাকে আমরা হয়তো কখনই খুঁজে বার করে কাজে লাগাইনি। থোরো তার অমর রচনা ‘ওয়ালডেন’ নামক বইটিতে লিখেছেন : আপন জীবনকে সচেষ্টভাবে উন্নত করার শক্তির উৎসাহব্যঞ্জক কথা আমার কাছে খুবই বড় বলে মনে হয়..দঢ়তা নিয়ে কেউ যদি তার স্বপ্নের দিকে এগুতে চেষ্টা করে, আর সেরকম জীবনযাপন করতে পারে তাহলে সে সাফল্য হবে অসামান্য।
ওলগা কে, জার্ভির মতো মনের জোর আর শক্তি এই বইয়ের পাঠকের অনেকেরই অবশ্য জানা আছে। তিনি বুঝেছিলেন অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থার মধ্যেও তিনি দুশ্চিন্তা সরিয়ে রাখতে পারতেন। আপনি বা আমিও তা পিরবো, এই বইয়ে যা আলোচিত হয়েছে সেই পুরনো সত্যগুলো যদি কাজে লাগাই। ওলগা কে, জার্ভি আমাকে যা লেখেন তা এই : সাড়ে আট বছর আগে আমি দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে মরতে বসেছিলাম। দেশের বিখ্যাত ডাক্তাররাও আমার জীবনের আশা নেই বলেন। আমার সামনে আসে বিরাট এক শূন্যতা। তখন আমার বয়স অল্পই ছিল। আমি মরতে চাইনি! হতাশায় আমার ডাক্তারকে ফোন করে সব জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ি। অধৈর্যের সঙ্গে তিনি বললেন, কী ব্যাপার ওলগা, লড়াই করার মত মনের জোর তোমার নেই? কাঁদলে নিশ্চিত মরবে। হ্যাঁ, সবচেয়ে খারাপই তোমার হয়েছে। ঠিক আছে সত্যের মুখোমুখি হও। দুশ্চিন্তা ত্যাগ করো; আর কিছু একটা করো! সেই মুহূর্তেই শপথ করলাম, আর দুশ্চিন্তা করব না। আমি আর কাঁদবো না। বস্তুর চেয়ে মনের জোর যদি বেশি হয় তাহলে আমি জয়ী হবই। আমি বেঁচে থাকবো!
রেডিয়াম আর দেওয়া যাচ্ছিল না তাই রঞ্জন রশি দেওয়া হতে লাগল ৪৯ দিন ধরে রোজ সাড়ে চোদ্দ মিনিট। আমার শরীরের হাড় দেখা যাচ্ছিল, আমার পা সীসের মত ভারি হয়ে গিয়েছিল। তবুও আমি দুশ্চিন্তা করিনি। হ্যাঁ, এমনকি জোর করে হাসতেও চাইছিলাম ।
আমি এমন মূর্খ নই যে ভাববো, হাসিতে ক্যান্সার নিরাময় হয়। তবে এটা জানি আর বিশ্বাস করি মানসিক অশান্তি থাকলে রোগ নিরাময়ে সুবিধা হয় না। যাই হোক দৈবের সাহায্যে যে ক্যান্সার সারে তা উপলব্ধি করলাম। গত ক’বছরে যে স্বাস্থ্য আমার আছে তেমন সুস্থ আগে কখনও থাকিনি। সেই কথাগুলোকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারছি না : দুশ্চিন্তা ত্যাগ করো। কিছু একটা করো!
এই পরিচ্ছেদে ইতি টানবো আবার সেই ড, অ্যালেক্সি ক্যারেলের কথা দিয়ে : যে ক্যারেল কি আপনার কথা ভাবছিলেন?
হতেও পারে।
মহম্মদের ক্ষ্যাপা শিষ্যদের মধ্যে অনেকে কোরাণের বাণী উল্কি করে বুকের উপর লিখে রাখত। তাই আমারও ইচ্ছে এই কয়টি কথা মনের একান্ত গভীরে প্রবেশ করুক। “যে সমস্ত ব্যক্তিরা দুশ্চিন্তা প্রতিরোধ করতে পারেন না তাদের আয়ু অল্প।”