হরিমোহন সেন
রামকমলের জ্যেষ্ঠ পুত্র হরিমোহন পিতার দক্ষতা ও গুণাবলীর অধিকারি ছিলেন। অধিকন্তু প্রতিভা বিকাশের জন্য যে-সব সুযোগ-সুবিধা রামকমল ছোট বেলায় আদৌ পাননি, হরিমোহন সে-সব পুরোমাত্রায় পেয়েছিলেন। হিন্দু কলেজ এদেশের বেশ কিছু প্রতিভাধরকে পূর্ণতালাভে সাহায্য করেছিল; হরিমোহন এখানকার পাঠ্যক্রম সসম্মানে উত্তীর্ণ হন; তাঁর সহপাঠী ছিলেন রসিককৃষ্ণ মল্লিক, (ডাঃ) কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং (রাজা) দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়। কিন্তু পিতার নির্দেশ অনুযায়ী দিনলিপি লেখার ফলে তাঁর লেখার বিশেষ একটি শৈলী গড়ে ওঠে। এই কাজটির ফলে তাঁর জীবনে শুধু যে নিয়মানুবর্তিতা ও পরিমিতিজ্ঞান গড়ে উঠেছিল তাই নয়, তাঁর হাতের লেখা– কি বাংলা কি ইংরেজি হয়ে উঠেছিল অতি সুন্দর; এছাড়া নিয়মিত ইংরেজি লেখার ফলে তাঁর প্রবন্ধাদি বিশিষ্টত অর্জন করতে পেরেছিল। তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও অধ্যবসায়ের ফলে তিনি ইংরেজি, বাংলা ও ফার্সী ভাষায় সুপন্ডিত হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর হরিমোহন ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গলের দেওয়ানের পদটি লাভ করেন। এই পদে তিনি ১৮৪৪ থেকে ১৮৪৯ পর্যন্ত চাকুরী করেছিলেন। কিছুকাল তিনি সরকারি ট্রেজারিরও দেওয়ান ছিলেন; এই চাকুরী সূত্রে তিনি উক্ত ট্রেজারির সাবট্রেজারার মিঃ ওসের একটি চমৎকার প্রশংসাপত্র অর্জন করেন। পিতার মতই তিনি ধর্মভীরু ও নিষ্ঠাবান হিন্দু ছিলেন; অবশ্য, পিতার মতো অত কঠোরভাবে আচার অনুষ্ঠান তিনি পালন করতে পারতেন না। পিতার মতই তিনি তাঁর সময়ের উল্লেখযোগ্য মানুষ ছিলেন।
ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গলের সেক্রেটারি মিঃ হগ্ দেশীয় কেরাণীদের ওপর অযথা পীড়ন চালাতেন; তাঁর এই আচরণের সমালোচনা করে এদেশীয়দের একমাত্র ইংরেজি পত্রিকা হিন্দু ইনটেলিজেন্সারে একটি প্রবন্ধ বের হয়; পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন কালীপ্রসাদ ঘোষ; কিন্তু মিঃ হগ্ সন্দেহ করেন যে সমালোচনাটি লিখেছেন হরিমোহন সেন; তাঁর সঙ্গে মতান্তর হওয়ায় হরিমোহন পদত্যাগ করেন। ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হরিমোহনের ভাষার সঙ্গে উক্ত প্রবন্ধের একটু-আধটু মিল থাকায় সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়েছিল। এই সন্দেহের বিরুদ্ধে হরিমোহন একজন ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে হলফ করেন। মিঃ হগের ব্যবহারে হরিমোহনের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। আদালতে ভিত্তিহীন অভিযোগের বিরুদ্ধে অস্বীকৃতি জানিয়েও তিনি স্বস্তি পেলেন না; বিভাগীয় তদন্তের বিরুদ্ধে তাঁর বিবেক ও অন্তর বিদ্রোহী হওয়ায়, তিনি মাসিক ১৫০০ টাকা মাইনের চাকুরীটিতে ইস্তফা দিলেন। কল্পনাপ্রবণ মানুষ, এবার ব্যবসায়ে মন দিলেন; কিন্তু তিনি ভুল পেশা বেছে নিয়েছিলেন, ব্যবসায়ে তিনি সফল হতে পারলেন না। তাঁর অন্যান্য পরিকল্পনার মধ্যে একটি হল, ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে প্রতিষ্ঠিত হবার পূর্বে কলকাতা থেকে দিল্লী পর্যন্ত ঘোড়ার ডাকের প্রবর্তন। রেলগাড়ি চালু হবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ব্যবসাও উঠে গেল। এর পর তিনি জাহাজ নির্মাণ শিল্পে মনোনিবেশ করে সম্বলপুরে একখানা জাহাজ নির্মাণও করান। উদ্দেশ্য ছিল, সম্বলপুর থেকে কলকাতায় ওই জাহাজে করে সেগুন কাঠ আমদানি ৷
তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল জয়পুরের মহারাজা রামসিংহের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক। সুশিক্ষিত মহৎ হৃদয় এই মহারাজার সঙ্গে কয়েক বছর পূর্বেই তাঁর বন্ধুত্ব হয়েছিল। সিপাহী বিদ্রোহ দমনের পর লর্ড ক্যানিং কর্তৃক আগ্রায় অনুষ্ঠিত দরবারে দু’জনের বন্ধুত্ব আরও ঘনিষ্ঠ হয়। অনেকেই মহারাজাকে ভয় দেখিয়েছিলেন যে, দরবারে তিনি যোগদান করলে, ফল খুব খারাপ হবে।
কিন্তু হরিমোহন দরবারে যোগদানের জন্য মহারাজাকে শুধু পরামর্শ নয়, অনেক অনুরোধ-উপরোধও করলেন। দরবারে মহারাজার আশঙ্কিত বিপদ তো হলই না, বরং তিনি আরও খেতাবও পেলেন; তাঁর থেকেও যা গুরুত্বপূর্ণ, এই দরবারে তাঁর রাজ্যের আয়তনও বাড়িয়ে দেওয়া হল। হরিমোহনের পরামর্শে দরবারে যোগদানের ফল এত ভাল হওয়ায়, মহারাজা, তাঁর পরিবারবর্গ ও দরবারের ওপর তাঁর প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। একজন বাঙালির পক্ষে জয়পুর গিয়ে রাজা প্রজা সকলের আস্থা অর্জন করা কম কথা নয়, চারিত্রিক সততা, দৃঢ়তা ও স্বাভাবিক দক্ষতার জন্য হরিমোহন এই কৃতিত্ব অর্জন করতে পেরেছিলেন; তাঁর পরবর্তীকালের কার্যাবলী দ্বারা তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, এই আস্থা অপাত্রে স্থাপিত হয় নি। রামসিংহও ছিলেন উচ্চমনা, উদারচেতা মানুষ; তাঁর রাজ্যের প্রয়োজনসমূহ তিনি ভালভাবেই উপলব্ধি করতেন। তাঁর সমর্থন পেয়েই হরিমোহন সুদূরপ্রসারী জনহিতকর সংস্কার সাধন করেছিলেন। তাঁর পরামর্শে ও পরিকল্পনা অনুযায়ী জয়পুর রাজকীয় কাউন্সিল এবং জয়পুর স্কুল অব আর্টস প্রতিষ্ঠিত হয়। আর্টস স্কুলটি প্রতিষ্ঠায় মাদ্রাজ আর্টস কলেজের ভূতপূর্ব অধ্যক্ষ ডাঃ হান্টারের অভিজ্ঞতার সহায়তা পাওয়া গিয়েছিল। হরিমোহনেরই চেষ্টায় তদানীন্তন জয়পুর স্কুল, বর্তমানের মহারাজার কলেজ, এখনকার উন্নত অবস্থায় পৌঁছতে পেরেছিল। কান্তিচন্দ্র মুখার্জীকে হরিমোহন মহারাজার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার ফলে, তিনি সেখানে এখন চাকরি করছেন; হরিমোহন আরও কিছু বাঙালিকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা সেখানেই বর্তমানে বসবাস করছেন। তাঁর পরামর্শমত চলার ফলে স্বয়ং মহারাজার এবং তাঁর রাজ্যের অনেক মঙ্গল হয়, কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে মঙ্গলজনক বহু পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয়। নিজেকে তিনি এঁদেরই মঙ্গলের জন্য সম্পূর্ণরূপে নিয়োগ করেছিলেন। তাঁর ওপর মহারাজার আস্থা এত প্রগাঢ় ছিল এবং তাঁর কাজের ফলে রাজ্যের এত মঙ্গল hoyeছিল যে, জীবনের শেষ কয়েক বছর কার্যত তিনিই ছিলেন রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল সব সময় অবিরাম নিজের অর্থ ও সামর্থ্য দিয়ে জনগণের মঙ্গল করে যাওয়া; প্রত্যাশী হয়ে গেলেই তাঁর সাহায্য পাওয়া যেত। একদিকে তিনি ছিলেন কোমলমনা, অন্যের দুঃখে তাঁর মন বিগলিত হত, অন্যদিকে, নিজের যত বড় বিপদই আসুক তিনি থাকতেন অবিচল। তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সৌজন্যবোধ, পরিশীলিত আচরণ ও সক্রিয় পরোপকারিতার জন্য যাঁরাই তাঁর সংস্রবে আসতেন, তাঁরাই তাঁকে ভালবাসতেন। যে তিনটি ভাষায় ভারতে সাধারণত ভাবের আদান-প্রদান হয়, সেই তিনটি ভাষাতেই তিনি পন্ডিত ও সুবক্তা ছিলেন; কাজেই কোন সমাজেই তিনি মেলামেশা করতে অসুবিধা বোধ করতেন না। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন রাজা স্যার রাধাকন্ত দেব, বাবু (পরে, মহারাজা) রমানাথ ঠাকুর এবং আশুতোষ দেব। এঁরা সকলেই তাঁকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন, ভালওবাসতেন। এই প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয়ের উল্লেখ না করলে বিবরণ অপূর্ণ থেকে যাবে। সেটি হল, সঙ্গীতে তাঁর পারদর্শিতা; সঙ্গীতের তিনি ছিলেন উচ্চশ্রেণির সমঝদার; সে সময় তাঁর মতো আর কোন ভারতীয় পিয়ানো বাজানোয় দক্ষ ছিলেন না। কলকাতার মেসার্স হার্বাডেন অ্যান্ড কোম্পানির সহযোগিতায় তিনিই প্রথম এদেশীয় গানে ইউরোপীয় সুর সংযোজন করেন।
জনসেবামূলক কাজে তিনিও তাঁর পিতার মতই বিশিষ্টতা অর্জন করেছিলেন, অবশ্য পিতার মতো তাঁর ক্ষেত্র এত ব্যাপক ছিল না। লেক্স লোসি, ১৮৫০এর একবিংশ আইন (উত্তরাধিকার আইন) দ্বারা হিন্দু ধর্মের ওপর প্রথম খোলাখুলি আঘাত হানা হয়; হিন্দুগণ স্বভাবতই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। কার্যত ইংরেজ শাসনের আর কোন সময়ে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার হিন্দু জনগণ এমনভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেনি, যেমন এই প্রস্তাবিত আইনের বিরুদ্ধে তাঁরা আইনসম্মত পন্থায় বিরোধিতার আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। কোর্ট অব ডিরেক্টর্সের কাছে এই উপলক্ষে যে ভাষায় স্মারকলিপি পেশ করা হয়েছিল, সে রকম ভাষা আর কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়নি। কলকাতায় এক মহতী সভায় লেক্স লোসির বিরুদ্ধে একটি স্মারকলিপি ইংল্যান্ডে কোর্ট অব ডিরেকটর্সের কাছে প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যে কমিটি গঠিত হয়, হরিমোহন সেনকে করা হয়েছিল তার সম্পাদক। আমাদের ধারণা তাঁর কর্মদক্ষতা ও উদ্যমের এর থেকে বড় স্বীকৃতি আর কিছু হতে পারে না। তিন বছরকাল তিনি এই অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থাকার সময় কঠোর পরিশ্রম দ্বারা সর্বজনের সন্তোষ বিধানে সক্ষম হয়েছিলেন। এশিয়াটিক সোসাইটি ও এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড হর্টিকালচারাল সোসাইটিরও তিনি সভ্য ছিলেন। ১৮৫৩তে বাবু রামগোপাল ঘোষের সঙ্গে যুগ্মভাবে দ্বিতীয়োক্ত সোসাইটিরও তিনি সহসভাপতি ছিলেন। এই সোসাইটির ট্রানস্লেশন কমিটিরও তিনি সভ্য ছিলেন। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রাচ্য বিভাগেরও তিনি সদস্য ছিলেন; সদস্য ছিলেন ল্যান্ডহোল্ডার্স সোসাইটি এবং ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সোসাইটির; এই দুটি সংগঠন মিলিত হয়ে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন সৃষ্ট হলে, তিনি তারও সক্রিয় সদস্য হন। কার্যত তাঁর প্রাত্যহিক কার্যালয় ছিল ঐ অ্যাসোসিয়েশনের একটি কক্ষ। অ্যাসোসিয়েশনের অপরাপর সক্রিয় সদস্য ছিলেন বাবু (পরে মহারাজা) রমানাথ ঠাকুর, বাবু জয়কিষেণ মুখার্জী প্রভৃতি; রাজা রাধাকান্ত দেব ছিলেন সভাপতি। ১৮৫৪তে স্যার জন পিটার গ্র্যান্টের সভাপতিত্বে স্থাপিত ক্যালকাটা লাইসিয়ামের তিনি সক্রিয় সদস্য ছিলেন। প্রধানত ইউরোপীয়গণই লাইসিয়ামের কাউনসিলের সদস্য ছিলেন; দেশীয় সদস্যদের মধ্যে ছিলেন রুস্তমজী কাওয়াসজী, রমানাথ ঠাকুর, হরিমোহন সেন ও পিয়ারীচাঁদ মিত্র। শিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করা ছিল লাইসিয়ামের উদ্দেশ্য। সোসাইটি ফর দি প্রোমোশন অব ইনডাসট্রিয়াল আর্টসেরও তিনি সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এই সংগঠনের প্রচেষ্টাতে ক্যালকাটা স্কুল অব আর্টস প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে এটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়; এইচ্ গুড় ওয়াইন্ন্ ছিলেন এর সভাপতি। এছাড়া, তিনি সদস্য ছিলেন ক্যালকাটা মেকানিকস ইনসটিউটের। ১৮৫৬তে লেফটেন্যান্ট (বর্তমান কর্নেল) উইলিয়াম ন্যাস লীজের সঙ্গে যুগ্মভাবে তিনি বেথুন সোসাইটির সহ-সভাপতি ছিলেন। বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তিনি হিন্দু চ্যারিটেবল সোসাইটির যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন। খ্রিস্টিয়ান মিশনারীদের শিক্ষার প্রভাব প্রতিরোধে এই প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।