রামকোমল সেন
এই পরিবারের যে-ব্যক্তি প্রথম খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেন, তাঁর নাম রামকমল সেন। সাধারণ্যে তিনি দেওয়ান রামকমল সেন নামে খ্যাত ছিলেন। তাঁর পিতার নাম গোকুলচন্দ্র সেন; বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি আন্তরিক নিষ্ঠা ও কঠোরভাবে তার আচার অনুষ্ঠান পালন করার জন্য তাঁর খ্যাতি ছিল। স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তা ও অনুসন্ধিৎসা ঠিকপথে পরিচালিত ও নিয়োজিত হলে মানুষ যে কতখানি উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারেন, রামকমল ছিলেন তার অন্যতম উজ্জল দৃষ্টান্ত। রামকমল যে-যুগে জন্মেছিলেন, তখন আধুনিক শিক্ষা-ব্যবস্থার কল্পনাও কেউ করেন নি। রামকমল ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষার সে সীমাবদ্ধ সুযোগ-সুবিধার সদ্ব্যবহার করেন; সে যুগে যাঁরা প্রাথমিক ইংরেজি শিক্ষা দিতে পারতেন, সেই ধরনের শিক্ষকদের কাছে শিক্ষা নিয়ে ও কঠোর শ্রম সাপেক্ষ অধ্যয়নের মাধ্যমে তিনি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বলা ও লেখার এমন অধিকার অর্জন করেন যে, সে যুগের পক্ষে তা ছিল একান্তই দুর্লভ। একমাত্র নিজ চেষ্টাতেই তিনি খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন। প্রাচীন এই পরিবারটি ভাগ্য বিপর্যয়ে দারিদ্র্যের স্তরে নেমে গিয়েছিল; রামকমল তাঁর প্রতিভা, চারিত্রিক সততা, দৃঢ়তা ও নিষ্ঠার দ্বারা ছাপাখানার সামান্য কম্পোজিটারের পদ থেকে ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গলের দেওয়ানের পদে উন্নীত হতে পেরেছিলেন; উল্লেখযোগ্য যে, তখন সরকারই ছিলেন এই ব্যাঙ্কের মুখ্য অংশীদার ও পরিচালক। তাঁর পিতা গোকুলচন্দ্র ছিলেন হুগলী আদালতের সেরেস্তাদার; মাসিক মাইনে ছিল ৫০ টাকা; বৈষ্ণব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠা ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। ধর্মপ্রাণ পিতার সন্তান রামকমলও ছিলেন একান্তভাবেই ধর্মপ্রাণ; জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি নিষ্ঠাবান হিন্দুরূপেই জীবন অতিবাহিত করেছেন; পিতৃপিতামহের ধর্মের প্রতি তাঁর আস্থা ছিল আজীবন অম্লান। ধর্মের প্রতি এমন নিষ্ঠা সত্ত্বেও, এবং নিজ ধর্মবিশ্বাস থেকে কখনও একচুল বিচ্যুত না হয়েও তিনি খোলামেলাভাবে ইউরোপীয় সমাজে মিশতেন; সেখানে তিনি বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। এত গোঁড়া হওয়া সত্ত্বেও ইউরোপীয় জ্ঞান বিজ্ঞান ও রীতিনীতি যে হিন্দু সমাজকে আমূল পরিবর্তিত ও পুনর্গঠিত করে উন্নত নব জীবনের পথে পরিচালনা করতে পারবে, তিনি তাদের গুরুত্ব ও মূল্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। বাংলায় গভীর জ্ঞান এবং ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে প্রগাঢ় পান্ডিত্যের অধিকারী রামকমল এবং বাস্তব বুদ্ধি নিয়ে সানন্দে বাংলায় প্রগতির পথ-প্রদর্শক হন! যে উদ্দীপনা থাকলে মহৎ হৃদয়ের চিন্তাশীল মানুষ প্রচন্ড জীবনীশক্তি লাভ করে, রামকমল সেই উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে জনগণের প্রগতির জন্য সরকার যে-সব সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করেছিলেন, তার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেন। বাংলার জনগণের প্রগতিমূলক প্রতিটি প্রকল্পে তিনি প্রধান ও সক্রিয় অংশ নিতেন। তিনি তাঁর সময়ের প্রতিটি সোসাইটি ও কমিটির সক্রিয় সদস্য ছিলন। এদেশীয়দের শিক্ষার জন্য গঠিত হয়েছিল হিন্দু ও সংস্কৃত কলেজ; এই উভয় কলেজেরই পরিচালন সমিতির তিনি সক্রিয় সদস্য ছিলেন। কালক্রমে তিনি বাংলার নেটিভ এডুকেশন প্রকল্পের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেলেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ পরিচালনায় তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার গভীরতা এবং শিক্ষা আন্দোলনের প্রতি তাঁর উদার সহানুভূতি থাকায়, এদেশীয় (নেটিভ) হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে পেরেন্টাল অ্যাকাডেমিক ইন্সটিটিউশনের পরিচালনা সংক্রান্ত কমিটির সদস্য করে নেওয়া হয়েছিল; পরে এই প্রতিষ্ঠানটিকে মধ্যবিত্ত ইউরোপীয় ও ইউরেশীয় তরুণদের শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত ডাটন কলেজের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়।
এদেশীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারে তিনি শুধু উপদেশ বা পরামর্শ দিয়ে ক্ষান্ত থাকতেন না, স্বয়ং এ-বিষয়ে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল ও এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড হর্টিকালচারাল সোসাইটির জার্নাল দুটিতে লিখতেন, বিশেষত তাঁর বিখ্যাত বাংলা- ইংরেজি অভিধানখানি শিক্ষাবিস্তারে তাঁর প্রবন্ধাবলী, বিশেষত তাঁর অভিধানের তিনি যে ভূমিকা লিখেছিলেন সেটি পড়লে বোঝা যায়, কারও কাছে থেকে বিশেষ কোন সাহায্য না পেয়েও, একমাত্র স্বীয় পরিশ্রম ও চেষ্টার দ্বারা তিনি ইংরেজি ভাষায় কিরূপ পান্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। তাঁর মননশক্তি ও হৃদয়বত্তার জন্য এদেশবাসী বহুকাল অবধি তাঁকে স্মরণে রাখবেন; তাঁর কর্মময় জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের বোডেন অধ্যাপক হোরেস হেম্যান উইলসনের কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন– জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ও উইলসন ছিলেন ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত বন্ধু। পাশ্চাত্য প্রথায় শিক্ষার মূল রামকমল সেন অভ্রান্তভাবেই উপলব্ধি করে এর বিস্তারে তাঁর সমগ্র শক্তি, বিশেষ করে তাঁর মানসিক শক্তি প্রয়োগ করেন। পেশার দিক থেকে তিনি যে-সব পদে অধিষ্ঠিতি ছিলেন, সে-সব পদের প্রকৃতি অনুযায়ী অর্থার্জন ও ব্যবসা বাণিজ্যের দিকেই তাঁর ঝোঁক থাকা ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু তাঁর প্রচারবিমুখ নীরব স্বদেশ-প্রীতির জন্য তিনি কর্ম-ব্যস্তজীবনে যতখানি সম্ভব সময় ও ব্যক্তিত্বের প্রভাব দিয়ে শিক্ষাপ্রসারে ব্রতী ছিলেন।
রামকমলের জন্ম ১৭৮৩-র ১৫ মার্চ; স্বগ্রাম গরিফা ত্যাগ করে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের ১৯ নভেম্বর থেকে তিনি জীবিকার্জন শুরু করেন। ১৮০২-এর ডিসেম্বর তিনি কলকাতার ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ ব্ল্যাকোয়ারের কেরাণী পদে নিযুক্ত হন। এর এক বছর পর, অর্থাৎ ১৮০৩ এর ডিসেম্বরে তিনি বিবাহ করেন। প্রথম চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি এবার সরকারি স্থপতি মিঃ ব্লেচিনডিনের অধীনে চাকরি নেন। সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৮০৪- এর জুলাই-এ ডাঃ হান্টারের অধীনে চাকরিতে বহাল হন; তার সঙ্গে হিন্দুস্তানী প্রেসের দায়িত্বও গ্রহণ করেন। ১৮০৬-এ তিনি প্রথম এশিয়াটিক সোসাইটির সংস্রবে আসেন। চাঁদনীর নেটিভ হাসপাতালের নেন ১৮০৮-এর নভেম্বর মাসে। ১৮১১-র মার্চ মাস থেকে তিনি ডাঃ হোরেস হেম্যান উইলসনের জন্য কাজ করতে থাকেন। ১৮১২-তে তিনি লেফটেন্যান্ট র্যামজের অধীনে ফোর্ট উইলিয়ামে চাকরি নেন।
তখন হিন্দু কলেজের (তদানীন্তন নাম ‘বিদ্যালয়) ডিরেক্টর ছিলেন রাজা গোপীমোহন দেব, বাবু (পরে, রাজা স্যার) রাধাকান্ত দেব, বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর, শ্রীকিষেণ সিং, বাবু শিবচন্দ্র সরকার, বাবু ‘রসোময়’ দত্ত, মিঃ ডেভিড হেয়ার ও মিঃ জে সি জি সাদার্ল্যান্ড– এঁদের সঙ্গে রামকমলও ছিলেন অন্যতম ডিরেক্টর। তিনি উক্ত কলেজের ম্যানেজিং কমিটিরও সদস্য ছিলেন; তাছাড়া, তিনি ছিলেন অনারেবল (পরে লর্ড) টি বি মেকলে’র সঙ্গে পাবলিক ইন্স্ট্রাকশন কমিটির অবৈতনিক সদস্য। উল্লেখ্য যে, এদেশীয়দের মধ্যে (পাশ্চাত্য প্রথায়) শিক্ষাবিস্তার সম্পর্কে মিঃ মেকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রামকমলের মতামতের সঙ্গে সহমত হতেন। কমিটি অব পাবলিক ইন্স্ট্রাকশন পরে কাউন্সিল অব এডুকেশনের সঙ্গে যুক্ত হলে, তাঁকে কাউন্সিলেরও সদস্য করা হয়– তিনি কিছুকাল এর সম্পাদকরূপেও কাজ করেছিলেন। তাঁকে সংস্কৃত কলেজের সম্পাদক ও সুপারিনন্টেডেন্ট করা হয়; উল্লেখ্য যে, এই পদে ইতিপূর্বে পর্যায়ক্রমে অধিষ্ঠিত ছিলেন অধ্যাপক এইচ এইচ উইলসন ক্যাপটেন প্রাইস, ক্যাপটেন মার্শাল ও ক্যাপটেন ট্রয়ার। এদেশীয়দের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারে উৎসাহী বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতো অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে তিনিও ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটির সভ্য বা সদস্য ছিলেন। রাজা নরসিংচন্দ্র রায়, বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর, মিঃ রুস্তমজী- কাউয়াসজী ও অন্যান্য কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে তিনিও নেটিভ্ হপিট্যালের গভর্নর ছিলেন। এগ্রিকালচারাল ও হর্টিকালচারাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার তিনি ছিলেন ‘নেটিভ সেক্রেটারী’; তাছাড়া বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর ও রাজা রাধাকান্ত দেবের সঙ্গে তিনিও এই প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি স্ট্যান্ডিং কমিটির ‘নেটিভ মেম্বার’ ছিলেন; পরবর্তীকালে তিনি রাজা রাধাকান্ত দেবের সঙ্গে উক্ত প্রতিষ্ঠানের যুগ্ম সহ-সভাপতি হন। সে-সময় সাহিত্য সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান বলতে ছিল এশিয়াটিক সোসাইটি আর বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতিষ্ঠান ছিল এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড হর্টিকালচারাল সোসাইটি। ডাঃ কেরির সঙ্গে তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য সমান পরিশ্রম করতে থাকেন; এর মুখপত্র ‘ট্রান্জ্যাকশনে’ তিনি ‘ভারতে কাগজ উৎপাদন’ শীর্ষক একটি মূল্যবান প্রবন্ধ লেখেন : বাবু হেমচন্দ্র কের্ (কর) তাঁর পাট সম্পর্কিত প্রতিবেদনে এই প্রবন্ধ থেকে বহু উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
জনগণের মঙ্গলের জন্য রামকমলের আগ্রহ এত প্রবল ছিল যে, স্বদেশীয়দের মঙ্গল ও উন্নতিবিধানের জন্য তিনি তাঁর সময়ের কত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন তাদের নাম উল্লেখ করাও প্রায় অসম্ভব। ক্যালকাটা ডিসট্রিক্ট চ্যারিটেবল্ সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এই জনহিতৈষী ও প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানটির সাহায্যে এগিয়ে আসতে এদেশীয় ধনীদের উদ্দেশে একটি আবেদনপত্র প্রচার করেন। এজন্য এবং তাঁর অন্যান্য সেবামূলক কাজের জন্য, তাঁকে উক্ত সমিতির সহ-সভাপতি নিয়োগ করা হয়। দরিদ্রতর শ্রেণির মানুষদের প্রতি তাঁর আন্তরিক সহানুভূতির নিদর্শনস্বরূপ তিনি ‘আস্হাউস’ কে তার নিজস্ব গৃহনির্মাণের জন্য এক খন্ড জমি দান করেন। বহু ইউরোপীয় ও দেশীয় কর্তৃক সমর্থিত এবং (সম্ভবত) বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর ও কয়েকজন বে-সরকারি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তখনকার একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ‘ল্যান্ড-হোল্ডার্স’ সোসাইটিরও তিনি সভ্য ছিলেন। বর্তমান ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ কেবলমাত্র দেশীয় সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকগণ দ্বারা গঠিত—- এদিক থেকে উক্ত সোসাইটির প্রকৃতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ডাঃ রোন্যাল্ড মার্টিনের সুপারিশ ক্রমে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক তাঁকে মিউনিসিপ্যাল কমিটিরও সদস্য নিযুক্ত করেন। তাঁরই গভীর জ্ঞান ও দূরদৃষ্টি আর ডাঃ আইজ্যাক্ জ্যাকসনের বাস্তব বুদ্ধির জন্য কলকাতা শহরের স্বাস্থ্যবিষয়ক বহু উন্নতি সাধিত হয়েছে। এদেশীয়দের মঙ্গলের জন্য এই কমিটি যে- সকল সুপারিশ করেন, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল ফিভার হসপিট্যাল’ স্থাপন; এটি পরে ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ নামে জনগণের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। বলা বাহুল্য সরকার কমিটির সুপারিশটি গ্রহণ করেছিলেন। এটি এখন ভারতের সমশ্রেণির হাসপাতালগুলির মধ্যে সর্ববৃহৎ।
তিনি শুধু যে এদেশীয়দের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারে উৎসাহী প্রবক্তা ছিলেন তাই নয়, সে সময় খুব কম লোকই যে-দিকে নজর দিতেন, সেই কৃষির উন্নতির জন্যও তিনি সোচ্চার হন; তাছাড়া তখনকার রাজনৈতিক সংগঠনকে নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি দিয়ে যে-ভাবে সমর্থন করেছিলেন এবং বিশেষজ্ঞ না হয়েও তিনি যে-ভাবে কলকাতার স্বাস্থ্য- বিষয়ক কার্যপ্রণালী সম্পর্কে সুপারিশ করেছিলেন, তা সত্যই বিস্ময়কর
তাঁর মৃত্যুতে এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড হর্টিকালচারাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়া তাঁদের শোকপ্রস্তাবে বলে, ‘আমাদের যে-সকল সভ্যকে মৃত্যু ছিনিয়ে নিয়েছে, তাঁদের অভাবে সোসাইটি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হল রামকমল সেনের মৃত্যুতে। সোসাইটি গঠিত হবার অল্প দিনের মধ্যেই তিনি এর সঙ্গে যুক্ত হন; সর্বপ্রথম যাঁরা এর সদস্য হন, তাঁদের মধ্যে জীবিত সামান্য কয়েকজনের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। বেশ কয়েক বছর তিনি এর দেশীয় সেক্রেটারী ও কালেক্টর ছিলেন; কিছুকাল পূর্বে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সহসভাপতির পদটিও অংলকৃত করেন। যে যুগে এদেশবাসী দেশের উন্নতি বিধানের দিকে আদৌ নজর দিতেন না, সেই সময় তিনি কাজের দ্বারা স্বদেশবাসীর সামনে সৎদৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। প্রতিটি মাসিক সভায় তিনি নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন; এর কার্যাবলীতে সক্রিয় অংশ নিতেন। সোসাইটি দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছে যে এ-বিষয়ে এদেশীয়দের মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি।’
তাঁর মৃত্যুর পাঁচ দিন পর, অর্থাৎ ১৮৪৪-এর ৭ আগস্ট অনারেবল স্যার এডওয়ার্ড রায়ানের সভাপতিত্বে এশিয়াটিক সোসাইটিতে একটি শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে গৃহীত শোকপ্রস্তাবের সারাংশ আমরা নিচে উদ্ধৃত করছি :
‘সম্পাদক গভীর দুঃখের সঙ্গে একজন পুরাতন, বিশেষ প্রতিভাবান সহযোগীর মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করেন। সোসাইটির প্রাক্তন একনিষ্ঠ কর্মচারী, দেওয়ান রামকমল সেন, তাঁর শিষ্টাচার ও উল্লেখযোগ্য বিদ্যাবত্তার জন্য যেমন খ্যাত ছিলেন, ততোধিক খ্যাতি ছিল শিক্ষা বিস্তারে তাঁর অবিরাম চেষ্টার জন্য, সৎ ও প্রয়োজনীয় কাজে তাঁর অক্লান্ত উৎসাহ ও পরিশ্রম যার দ্বারা ইউরোপীয় ও দেশীয় জনগণের সকলেই উপকৃত হতেন, সেই উৎসাহ ও পরিশ্রমের জন্য; ততোধিক খ্যাতি ছিল তাঁর অমায়িক ব্যবহার, আত্মপ্রচার-বিমুখতা এবং সীমাহীন দানশীলতার জন্য।
‘মিঃ কোলব্রুক, অধ্যাপক উইলসন, মিঃ ডব্ল্যু বি বেইলে এবং অন্যান্য বহু বিশিষ্ট ইউরোপীয় ভদ্রলোক যাঁরা কাজের খাতিরে এককালে ভারতে ছিলেন, তিনি (রামকমল) ছিলেন তাঁদের বন্ধু; পত্র মারফতও তাঁদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল; ফলে এদেশের মতো ইউরোপেও তিনি স্বদেশীয় সাহিত্যে তাঁর পান্ডিত্য এবং তাঁর স্বদেশীয়গণ যাতে জগৎসভায় তাঁদের হৃতস্থান পুনরুদ্ধার করতে পারেন, সে জন্য তাঁর তীব্র আগ্রহের জন্যও তিনি বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। এবং (আমরা বলতে পারি যে) এই মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টাতেই তাঁর সমগ্র জীবন ব্যয়িত হয়েছে। তাঁর এই উৎসাহ অতি উৎসাহে পরিণত হওয়ায় অত্যধিক অধ্যয়ন এবং ব্যাংক অব বেঙ্গলের দেওয়ানের মতো দায়িত্বপূর্ণ পদের অত্যধিক পরিশ্রম সম্ভবত তাঁর অকালমৃত্যুর কারণ।’
মাননীয় সভাপতি কর্তৃক উত্থাপিত এবং উপস্থিত সকলের দ্বারা সমর্থিত একটি প্রস্তাবে বলা হয়, সোসাইটি এই (দেওয়ান রাকমল সেনের) মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাভিভূত, একথা একখানি পত্রদ্বারা তাঁর পরিবারবর্গকে জানান হোক।
‘বাবু হরিচরণ সেন সমীপেষু–
আপনার পিতার মৃত্যু-সংবাদে সোসাইটি গভীর ও অকৃত্রিম শোক পেয়েছে– এই সংবাদ আপনাকে জানাতে ও পরিবারের অন্যান্যদের জানাবার জন্য আপনাকে অনুরোধ করতে, আমি সোসাইটির মাননীয় সভাপতি ও সদস্যগণ কর্তৃক নির্দেশিত হয়েছি। মহাশয়, সোসাইটির মাননীয় সভাপতি ও সদস্যবৃন্দ একথা আপনাকে, আপনাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও বন্ধুবান্ধবকে না জানিয়ে পারেন না যে, তাঁর পান্ডিত্য ও সাহিত্যকৃতি, এদেশীয়দের মধ্যে শিক্ষা-বিস্তারে তাঁর নিরন্তর প্রয়াস, তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রচারিত বহু গুণাবলী, এবং সোসাইটির জন্য তাঁর মূল্যবান সেবামূলক কার্যাবলীর জন্য সোসাইটি এবং এদেশের ও ইউরোপের বহু জ্ঞানীগুণী তাঁকে অসীম শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলেন। সোসাইটি তাঁর মৃত্যুতে যেমন গভীর শোক প্রকাশ করছে, তেমনি তাঁর স্মৃতিও এই প্রতিষ্ঠান চিরকাল বহন করবে। ইতি–
(স্বাঃ) এইচ, টরেন্স
সহ-সভাপতি ও সম্পাদক
এশিয়াটিক সোসাইটি
মিউজিয়াম,
৯ আগস্ট, ১৮৪৪
দেওয়ান রামকমল সেনের মৃত্যুতে মিঃ জন ক্লার্ক মার্শম্যান কর্তৃক সম্পাদিত ‘দি ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া’র ১৮৪৪-এর ১৫ আগস্ট তারিখের সংখ্যায় নিম্নোদ্ধৃত শোকজ্ঞাপক লেখাটি প্রকাশিত হয় :
‘গত কয়েকদিন যাবৎ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গলের দেওয়ান বা ট্রেজারার রামকমল সেনের মৃত্যু সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এদেশীয়দের মধ্যে তিনি যে উচ্চস্থানের অধিকারী হয়েছিলেন এবং তাঁর স্বদেশবাসীদের ওপর তাঁর যে প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল সে কথা বিবেচনা করলে, তাঁর মৃত্যু সংবাদটুকুমাত্র প্রকাশ করা যথেষ্ট বলে মনে হয় না। বর্তমান শতাব্দীতে যে-সব দেশীয় ভদ্রলোক ধনার্জন ও দানের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছেন, রামকমল সেন ছিলেন তাঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। আরও এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যাঁরা অজ্ঞাত অপরিচিত অবস্থা থেকে মহাধনী হয়ে উঠেছেন, কিন্তু তাঁদের কেউই শিক্ষা সংস্কৃতিতে তাঁর মতো প্রতিষ্ঠা অর্জন, করতে পারেন নি। ‘বিশোনাথ’ মতিলাল মাসিক আট টাকা মাইনের চাকরি নিয়ে জীবন শুরু করেন। পরে তিনি লবণগোলার দেওয়ান হয়েছিলেন; ওই পদ ত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার আগে তিনি, শোনা যায়, বারো থেকে পনের লাখ টাকার মালিক হয়েছিলেন। বাবু আশুতোষ দেবের পিতা এবং দেব পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা রামদুলাল দে’র জীবন আরম্ভ হয় দেশীয় একজন মনিবের অধীনে মাসিক পাঁচ টাকা মাইনের চাকরি নিয়ে, পরে তিনি প্রাক্তন ফেয়ার্লি, ফার্গুসন অ্যান্ড কোম্পানির কেরাণী হন– এরপর চাকরি পান মার্কিন বণিকদের অধীনে তাঁরা তো তাঁদের একটি জাহাজের নামকরণ করেন তাঁরই নামে– ‘রামদুলাল দে। ভারতের রথচাইল্ড, মুদ্রা বাজারের বর্তমান একচ্ছত্রাধিপতি মতিবাবু জীবন শুরু করেন দশ টাকা মাইনের চাকরি নিয়ে। রামকমল সেনও নিজের হাতে তাঁর ভাগ্য গড়েছিলেন। মাসিক আট টাকা মাইনেতে তিনি ডাঃ হান্টারের হিন্দুস্তানী প্রেসে কম্পোজিটারের চাকরি নিয়ে জীবন শুরু করেন। জীবনশেষে তাঁর বংশধরদের জন্য তিনি যা রেখে গেছেন– উপরিউক্ত ব্যক্তিদের সঞ্চিত অর্থ অপেক্ষা তার পরিমাণ অনেক কম– কেউই এর পরিমাণ দশ লক্ষ টাকার বেশি বলেন নি– তবুও তিনি অনেক বেশি ও স্থায়ী যশের অধিকারী হয়েছেন; এর কারণ, জ্ঞান ও সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আর স্বদেশবাসীর উন্নতির জন্য একনিষ্ঠ বিরতিহীন প্রচেষ্টা।
‘ছাপাখানার ঐ নীচু পদে তিনি বেশি দিন থাকেন নি। বর্তমানে অকসফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতের অধ্যাপক ডাঃ উইলসনের দৃষ্টি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়; রামকমলের স্বাভাবিক দক্ষতা ও কর্মক্ষমতা এবং জ্ঞানপিপাসা লক্ষ্য করে ডাঃ উইলসন তাঁকে সামনের সারিতে এগিয়ে আনবার সকল সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন। রামকমলের প্রথম পদোন্নতি, আমাদের ধারণা, এশিয়াটি সোসাইটিতে নিয়োগ– পদটি অবশ্য নিচের দিকেরই ছিল। এখানে এসে তিনি তখনকার ইউরোপীয়দের মধ্যে বিশেষ বিশিষ্ট কয়েকজনের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন। এদিকে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার জন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করতে থাকেন। ফলে অল্পকালের মধ্যে তিনি অবাধে দ্রুত ইংরেজি বলবার ক্ষমতা অর্জন করেন। আমরা যে সময়ের কথা বলছি, তখন দ্রুত নির্ভুল ইংরেজি বলবার ক্ষমতা এদেশীয়দের মধ্যে ছিল দুর্লভ; কাজেই এই ক্ষমতা তখন বিশিষ্টতা অর্জনে বিশেষ সহায়ক ছিল। শীঘ্রই রামকমল সুশিক্ষিত এদেশীয়দের নেতৃস্থানীয়রূপে পরিগণিত হতে থাকেন। ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হলে তাঁকে এর (কার্যনির্বাহক) সমিতির সভ্য করা হয়। তিনিও কয়েকখানি বই রচনা ও অনুবাদ করে সমিতির পক্ষে প্রয়োজনীয় কাজ করেন। পরবর্তী বছর হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে, তাঁর চির-উপকারী পৃষ্ঠপোষক ডাঃ উইলসনের সুপারিশক্রমে নবগঠিত প্রতিষ্ঠানটিকে সংগঠিত করবার ভার পড়ে রামকমলের উপর। এখানে রামকমল স্বদেশবাসীর মধ্যে শিক্ষাবিস্তারে তাঁর আগ্রহ ও উৎসাহকে রূপ দেবার পরম সুযোগ লাভ করলেন; তাছাড়া জটিল পরিস্থিতিতে সুব্যবস্থা প্রবর্তনের দক্ষতা প্রমাণেরও অবকাশ পেলেন। এই প্রতিষ্ঠানে এসে দেশীয়দের মধ্যে তাঁর মর্যাদা উন্নত স্থানে প্রতিষ্ঠিত হল, এবং ভবিষ্যৎ জীবনে তিনি যে প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করেছিলেন তার ভিত্তিও এখানেই স্থাপিত হল। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হবার তিন বছর পর তিনি ও মিঃ ফেলিক্স্ কেরি (ডাঃ কেরির জ্যেষ্ঠপুত্র) একখানি ইংরেজি-বাংলা অভিধান প্রণয়নের পরিকল্পনা করেন। অভিধানখানির একশত পৃষ্ঠা মুদ্রিত হবার পূর্বেই মিঃ কেরির জীবনাবসান হওয়ায়, কাজটি তখনকার মতো বন্ধ হয়ে গেল। টাঁকশালের অ্যাসে- মাস্টার ডাঃ উইলসন, মনে হয়, এর কিছুদিন পরেই তাঁকে টাঁকশালের এদেশীয়দের প্রধান পদে নিয়োগ করেন। অত্যন্ত লাভদায়ক ও দায়িত্বপূর্ণ এই পদে নিযুক্ত হবার ফলে, তাঁর মর্যাদা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। তাঁর কলুটোলার হর্ম্যটি হয়ে ওঠে ধনী ও জ্ঞানীদের নিত্য যাতায়াতের স্থান। তাঁর মহত্ত্বের খ্যাতিও বাংলার দূর-দূরান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৩০-এ তিনি অভিধান প্রকল্পটির কাজ পুনরায় আরম্ভ করেন এবং ব্যক্তিগত বিপুল শ্রমে সাত শত পৃষ্ঠার এই মহাগ্রন্থ রচনা ও মুদ্রণের কাজ সম্পন্ন করেন। আমাদের এই শ্রেণির যতগুলি গ্রন্থ আছে, তাদের মধ্যে এখানিই সম্পূর্ণ ও সর্বাপেক্ষা মূল্যবান বলা যায়; তাছাড়া, গ্রন্থখানি তাঁর শ্রম, উদ্যম ও পান্ডিত্যের দীর্ঘকালস্থায়ী স্মারক কীর্তি হয়ে থাকবে; অন্য কিছুর জন্য না হলেও শুধুমাত্র এই একখানি গ্রন্থের জন্যই ভবিষ্যৎ তাঁকে স্মরণে রাখবে।
ডাঃ উইলসন ইংল্যান্ড চলে গেলে, রামকমল সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গলের এদেশীয় ট্রেজারার বা দেওয়ানের পদ গ্রহণ করেন। তিনি অমানুষিক পরিশ্রম করতেন (অবশ্য এই পরিশ্রমই তাঁর উত্থানের অন্যতম কারণ) এবং নতুন পদ গ্রহণের কয়েক মাস আগে থেকেই তাঁর স্বাস্থ্য ভাল যাচ্ছিল না। এখন স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়ে। মাত্র একপক্ষ কাল পরে হুগলীর বিপরীত তীরে অবস্থিত স্বগ্রামে তাঁর জীবনাবসান হয়।
জনগণের এমন কোন প্রতিষ্ঠান কমই ছিল, যার তিনি সভ্য ছিলেন না বা যেটির উন্নয়নের জন্য তিনি চেষ্টা করেন নি। এশিয়াটিক সোসাইটির কমিটি অব পেপার্সের তিনি সভ্য ছিলেন, উপ-সভাপতি ছিলেন এগ্রিকালচারাল সোসাইটির। ছিলেন ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটির পরিচালক সমিতির একজন, হিন্দু কলেজের ম্যানেজার। কি ইউরোপীয়, কি এদেশীয় উভয় সমাজেই তিনি সমভাবে সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। আর কলকাতার সমাজে দীর্ঘকাল যাবৎ তিনি সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ভারতীয় হিসাবে গণ্য হয়ে আসছিলেন। সারা জীবন তিনি কঠোর নিষ্ঠা, ক্ষেত্রবিশেষে গোঁড়ামির সঙ্গে আপন ধর্মীয় বিশ্বাস অবলম্বন করে থাকলেও, লর্ড হেস্টিংসের শাসনকালে যখন সর্বপ্রথম এই বিশ্বাসের– যে, জনগণের অজ্ঞতাই সাম্রাজ্য রক্ষার সর্বোত্তম রক্ষা- বিরোধিতা করা হয়, সেই সময় তিনি স্বদেশবাসীর মধ্যে শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তারের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন, এটা অবশ্যই তাঁর কৃতিত্ব হিসাবে গণ্য হবে। যে- সব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এদেশবাসীর মধ্যে ইউরোপীয় বিজ্ঞানের প্রসার হয়েছে, সেগুলির প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনিই ছিলেন প্রধান উদ্যোগী। এর ফলে এদেশীয় সমাজের চিন্তাধারাও উন্নত হয়েছে।’
রামকমলের মৃত্যুতে অধ্যাপক হোরেস হেম্যান উইলসন নিম্নোদ্ধৃত পত্রখানি তাঁর পুত্র হরিমোহন সেনকে লিখেছিলেন–
তোমার পত্রে যে শোকাবহ সংবাদ পেলাম, তার জন্য আমি আন্তরিকভাবেই শোকাচ্ছন্ন; অবশ্য তোমার পিতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে ডাঃ গ্র্যান্ট আর মিঃ পিডিংটনের কাছ থেকে কিছুকাল যাবৎ যে সংবাদ পাচ্ছিলাম, তাতে আমি এই শোক-সংবাদের জন্য যেন অনেকখানি প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। বহু বছর ব্যাপী তাঁর সঙ্গে আমার মেলামেশা ও একান্ত ব্যক্তিগত পত্রালাপের মধ্যে দিয়ে তাঁর বৌদ্ধিক উৎকর্ষের সঙ্গে আমি ভালভাবে পরিচিত হতে পেরেছিলাম। বহু পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে তাঁর গুরুত্ব আমি উপলব্ধি করেছিলাম; আর সেই জন্যই তিনি ছিলেন আমার শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র। কলকাতার সমাজে—- কি ইউরোপীয় অথবা ভারতীয়– এরূপ উজ্জল চরিত্র ছিল একান্তই বিরল। তাঁর জীবনের মহান লক্ষ্য ছিল দেশের মঙ্গলসাধন ও দেশবাসীর উন্নয়ন। কিন্তু এজন্য তাঁর কোন আত্মপ্রচার ছিল না; তিনি কাজ করতেন নিজেকে আড়ালে রেখে। সততা ও একাগ্রতা নিয়ে তিনি তরুণ সম্প্রদায়কে উন্নত করতে চেষ্টা করতেন, কিন্তু এজন্য তাঁর কোন তাড়া ছিল না। তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা কিন্তু তাঁর ছিল না, বাইরে থেকে চাপান উন্নতি তাঁর কাম্য ছিল না, তিনি চাইতেন তরুণরা উন্নত হোক নিজের থেকে, অন্তরের তাগিদে, নিরুপদ্রবে; এই কারণেই তাঁর অন্যান্য কয়েকজন সহযোগীর মতো তিনি জনপ্রিয় হতে পারেন নি। শুধু তাঁর কাজের মানুষরাই তাঁর গুণমুগ্ধ একজন ছিলাম। তাঁর অন্য যে-কোন বন্ধু অপেক্ষা আমি তাঁকে সর্বসময় অত্যন্ত কাছে থেকে লক্ষ্য করবার সুযোগ পেয়েছিলাম; তার ফলে, আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, স্বদেশবাসীর উন্নতিবিধানের এত বড় দক্ষতাসম্পন্ন মিত্র আর কেউ ছিলেন না; অবশ্য তিনি নিজের মত কারও ওপর কখনও চাপিয়ে দিতে চাইতেন না।
রামকমলের সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্রপাত ১৮১০-র শেষ দিকে। তখন তিনি ডাঃ হান্টারের হিন্দুস্তানী প্রেসে চাকরি করেন; তাঁর অন্যান্য কাজের মধ্যে প্রেসটির কাজকর্ম দেখাশোনা করাও ছিল অন্যতম। উক্ত সময়ে ডাঃ লেইডেন আর আমি প্রেসটির অংশীদার হই। ১৮১১তে ডাঃ হান্টার ও ডাঃ লেইডেনের জাভাতে মৃত্যু হয়; তখন প্রেসটি প্রায় সম্পূর্ণরূপে আমার মালিকানাধীন হয়ে যায়; এই সময় ক্যাপটেন রোবাক প্রেসের অংশীদাররূপে আমার সঙ্গে যোগ দেন; প্রেসের পুঙ্খানুপুঙ্খ কাজসহ প্রেসের সামগ্রিক পরিচালনার ভার থাকে রামকমলের ওপর; তাঁর কাজে আমরা উভয়েই সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট ছিলাম। ১৮২৮-এ প্রেসের মালিকানা হস্তান্তরিত হয়। আমি ছিলাম এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদক আর রামকমল ছিলেন ঐ প্রতিষ্ঠানের ‘সরকার’। প্রেসের কাজের সঙ্গেই তিনি এ-কাজটিও করতেন। এই সব কাজকর্মের ব্যাপারেই প্রতিদিন প্রায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় আমাদের দুজনের দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা হত; এইভাবে আমি তাঁর কর্মদক্ষতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও স্বাধীনচিত্ততার পরিচয় পেয়েছিলাম। তাঁকে আমি যেমন ভালবাসতাম, তাঁর প্রতি তেমনি আমার শ্রদ্ধাও ছিল; এই জন্য আমার ব্যক্তিগত বৈষয়িক ব্যাপার তাঁর হাতেই আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার থেকে তিনি আমার ব্যক্তিগত বৈষয়িক ব্যাপারগুলি অনেক সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতেন। আমাদের উভয়ের মধ্যে বহু বিষয়েই সহমত ছিল। সংস্কৃত শিক্ষায় তিনি বিশেষ অগ্রগতি লাভ করবার সময় পান নি; কিন্তু এই ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর তীব্র আগ্রহ ছিল। এই ভাষার অধ্যাপকদের ওপরেও তাঁর শ্রদ্ধা ছিল। তোমরা তো জান, বাংলা ভাষায় তাঁর জ্ঞান ছিল গভীর, তাঁর এইসব অর্জিত গুণ ও এশিয়াটিক সোসাইটির সংস্রবে আসার ফলে তাঁর জ্ঞান-পিপাসার উদ্ভব হয়। উল্লেখ্য, তিনি এককালে এই এশিয়াটিক সোসাইটির নেটিভ সেক্রেটারি হয়েছিলেন; যাই হোক, জ্ঞান পিপাসা ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কালক্রমে তিনি টাঁকশালের দেওয়ান হয়েছিলেন। এরপর আমার কলকাতা ত্যাগের সময় তিনি হন ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গলের ক্যাশিয়ার। ভারতবর্ষ থেকে আমি ১৮৩৩এ চলে আসি। কাজেই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়ের পর তেইশ বছর ধরে তাঁকে জানবার সুযোগ আমার হয়েছিল। এই সমগ্র সময়ে তাঁকে আমি একইভাবে ধীরস্থির, উচিতমনা, স্বাধীনচেতা, অপরাজেয় ও বুদ্ধিদৃপ্ত দেখেছি। কখনও দেখিনি কোন কিছু বুঝতে বা উপলব্ধি করতে তাঁর বিলম্ব হয়েছে, পরিশ্রম করতে ক্লান্তি বোধ করেছেন, মেজাজ তিক্ত হয়েছে বা কারও ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছেন। প্রভূত পরিমাণ টাকাকড়ি তাঁর দায়িত্বে থাকত কিন্তু আমার তো নয়ই, তাঁর সংস্রবে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের কারোরই তাঁর সততায় সন্দেহ করবার অবকাশ হয়নি। টাকশালে তাঁর কাজ ছিল কঠোর পরিশ্রমসাধ্য; একটানা দশ থেকে বারো ঘণ্টা তাঁকে পরিশ্রম করতে হত; কিন্তু সব সময়ই তিনি প্রফুল, কর্তব্য-সচেতন থাকতেন; সততার সঙ্গে কর্তব্যকর্ম সম্পাদনেই তিনি প্রকৃত আনন্দ পেতেন। তাঁর স্বদেশবাসীর সঙ্গে আমার মত বিনিময়ের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অশেষ মূল্যবান পরামর্শদাতা। সহকর্মী হিসাবে তাঁর বিচারবুদ্ধি ও বিবেচনার ওপর আমি নির্দ্বিধায় নির্ভর করতে পারতাম। আমার আদর্শ ও উদ্দেশ্য তিনি খুব ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারতেন; আমার আদর্শের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাও ছিল; এইজন্য তাঁর সহযোগিতা ও সমর্থনের ওপর আমি নির্ভর করতে পারতাম। এই মন্তব্যগুলি হিন্দু কলেজ পরিচালনার ব্যাপারে ছিল বিশেষভাবে প্রযোজ্য– উল্লেখ্য যে, উক্ত কলেজের পরিচালন সমিতির তিনি ছিলেন, আমারই মতো, সক্রিয় সদস্য। সংক্ষেপে বললে বলতে হয়, প্রেসে, এশিয়াটিক সোসাইটিতে, সাহিত্য-সংক্রান্ত কাজকর্মে, জনগণের ও ব্যক্তিগত কার্যকলাপে, টাকশালে এবং কলেজে আমরা দুজনে সব সময় মিলিতভাবে কাজ করেছি; আজ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি যে, অতগুলি বছরব্যাপী আমাদের মিত্রতার মধ্যে কোন ছেদ পড়েনি, বরাবর উভয়ের আন্তরিকতা বজায় ছিল আর দুজনের উদ্দেশ্যও বরাবর এক ছিল। কলকাতা থেকে চলে আসবার সময়, রামকমলকে ছেড়ে আসতে হয়েছিল বলে যে দুঃখ পেয়েছিলাম, সে-রকম দুঃখবোধ কলকাতার আর অতি সামান্য কয়েকজনকে ছেড়ে আসার জন্য হয়েছিল। তারপর একই স্বার্থে একই উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার পত্রালাপ চলেছে নিয়মিতভাবে; কিন্তু ব্যক্তিগত যোগাযোগের অভাব তাতে পূরণ হয়নি। তাঁর পত্রের জন্য আমি আকুল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম, তার কারণ সেগুলিতে থাকত আমারই মতো একই প্রকার কার্যকলাপের চিত্র, এইসব কার্যকলাপের মাধ্যমেই তিনি প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন, আর আমাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা যে এত দিন ধরে অক্ষত ছিল, তারও প্রমাণ থাকত ঐ সব পত্রে। তাঁর মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্তও যে শ্রদ্ধা অটুট ছিল এ আমার কাছে বড় সান্ত্বনার সংবাদ। তাঁর প্রতি আমার প্রীতি ও শ্রদ্ধার অবসান হবে সেইদিন যখন আমিও আর এই পৃথিবীতে থাকব না।
উপরের পর্যালোচনার রামকমলের সঙ্গে আমার দীর্ঘ ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের স্মৃতিচারণ করে ফেললাম। তবে, আগামী মাসে (আমি যত দূর জানি) তাঁর (সমাজের কাছে) প্রয়োজনীয় এবং সম্মানিত জীবনের একটি সুসংবদ্ধ বিবরণ পাঠাবার চেষ্টা করব। ইতি–
আন্তরিকভাবে তোমার শুভার্থী
(স্বা) এইচ এইচ উইলসন
দুর্ভাগ্যবশত প্ৰতিশ্ৰুত ঐ সুসংবদ্ধ বিবরণটি পাওয়া যায়নি।
লংম্যান, ব্রাউন, গ্রীন অ্যান্ড লংম্যান্স্ কর্তৃক ১৮৪৫এ প্রকাশিত ‘মন্ডার্স বায়োগ্রাফিক্যাল ট্রেজারি : এ ডিকসনারি অব ইউনিভার্সাল বায়োগ্রাফিতে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। উল্লেখ্য যে রাজা রামমোহন রায় ব্যতীত অন্য কোন ভারতীয়ের জীবনী উক্ত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়নি। বিবরণটি নিচে তুলে দেওয়া হল :
বহু উচ্চগুণ, অপরাজেয় শ্রমশীলতা ও বিপুল প্রভাবের অধিকারী হিন্দু (ভারতীয় ) রামকমল সেন ছিলেন ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গলের দেওয়ান বা ট্রেজারার। তার কর্মজীবন আরম্ভ হয় ডাঃ হান্টারের হিন্দুস্তানী প্রেসের কম্পোজিটাররূপে; এজন্য বলা যায় যে, তিনি প্রকৃতই স্বীয় ভাগ্য নির্মাতা ছিলেন। প্রয়োজনীয় জ্ঞান বিস্তারে তাঁর প্রচেষ্টাসমূহ ছিল উৎসাহপূর্ণ ও সুপরিচালিত। তাঁর স্বদেশবাসীর শিক্ষাগত অগ্রগতি ও ইউরোপীয় বিজ্ঞান প্রচারের জন্য প্রতিষ্ঠিত তাঁর সময়ের কলকাতার প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের সুপরিচালনার জন্য তিনি সক্রিয়ভাবে সারাজীবন অতিবাহিত করে গেছেন। মৃত্যু, আগস্ট, ১৮৪৪ ৷
নৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে এই মহৎ মানুষটি শুধু জীবিত থাকার সময়ই উল্লেখযোগ্য ছিলেন তাই নয়, ভবিষ্যৎকালের পটেও তিনি তাঁর কীর্তিচিহ্ন এঁকে গেছেন; এই সংক্ষিপ্ত জীবনীও একান্তই অপূর্ণ থেকে যাবে, যদি না তাঁর জীবনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করা যায়। প্রথমটি হল তাঁর ধর্মনিষ্ঠা, আর দ্বিতীয়টি হল তাঁর সরল স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। রামকমল ছিলেন বৈষ্ণব; প্রতিদিন প্রত্যূষে তিনি বিষ্ণুর প্রিয় তুলসীকুঞ্জে বসে পূজা প্রার্থনা করতেন; যত জরুরি কাজই থাক, তাঁর দীর্ঘসময়ব্যাপী পূজা থেকে তিনি কখনও বিরত হননি। তাঁর পারিবারিক নথিপত্রে তাঁর স্বরচিত কতকগুলি প্রার্থনাও পাওয়া গেছে, সেগুলিতে তাঁর প্রগাঢ় আত্মনিবেদনের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর চালচলনও ছিল একান্তই সাদাসিধা। নিরামিষাশী, পূর্ণ আহার গ্রহণ করতেন দিনে একবার, মধ্যাহ্নকালে। মদ্যপানও করতেন না। সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফিরে সামান্য কয়েকটি সন্দেশ আর দু’কাপ চা খেতেন। চা কখনও কখনও এক সঙ্গে তিন কাপও খেতেন; চা ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয় পানীয়; নৈশ আহার্য রান্না করতেন মানিকতলা বাগান বাড়িতে হয় নিজে, কিংবা নিজের তত্ত্বাবধানে রান্না করাতেন। এর দ্বারা বৈষ্ণবোচিত দীনতা যেমন প্রকাশ পেত, তেমনি রান্না যে কঠোরভাবে হিন্দু আচার ও রীতি অনুযায়ী হয়েছে সে সম্বন্ধেও তিনি নিশ্চিত হতে পারতেন।
রামকমলরা তিন ভাই; মদনমোহন ছিলেন জ্যেষ্ঠ আর কনিষ্ঠের নাম ছিল রামধন। মদনমোহন ছিলেন আর্মি ক্লোদিং এজেন্সির দেওয়ান। মদনমোহনের জ্যেষ্ঠপুত্র গোবিন্দচন্দ্র সেন ছিলেন কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশনের সহকারী সচিব। পরে এই কমিটির স্থলাভিষিক্ত হয় কাউন্সিল অব এডুকেশন। কাউন্সিলেও তিনি ঐ একই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, পিতার মৃত্যুর পর তিনি আর্মি ক্লোদিং এজেন্সিতে পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ছিলেন বড় জমিদার, এককালে সমগ্র হালিশহর পরগণা ছিল তাঁর মালিকানাধীন। তিনি ছিলেন কলকাতার জাস্টিস অব দি পীস, কিছুকালের জন্য এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড হর্টিকালচারাল সোসাইটির ভাইস-প্রেসিডেন্ট এবং ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের কমিটির সদস্য, বর্তমানে অবলুপ্ত ব্যাঙ্ক অব হিন্দুস্তান, চায়না অ্যান্ড জাপানের কলকাতা শাখার পরিচালকদের অন্যতম। তাঁর ভাই মধুসূদন সেন আগ্রা ব্যাঙ্কের খাজাঞ্চী।
রামকমলের কনিষ্ঠ ভাই রামধন ছিলেন ডেপুটি কালেক্টর। ফার্সী ভাষায় তাঁর অসাধারণ পান্ডিত্য ছিল। অতি চমৎকার একখানি ইংরেজি-ফার্সী অভিধান তিনি রচনা করেছিলেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মাধবচন্দ্র প্রথমে ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গলের সহকারী খাজাঞ্চী, পরে হরিমোহন সেন বিদায় নেবার পর, তিনি ঐ ব্যাঙ্কের খাজাঞ্চী হন। বিয়াল্লিশ বছর তিনি এই পদে চাকুরী করেন। মাসিক ১২০০ টাকা বেতন পেতেন ৷ এই দীর্ঘকাল যাবৎ তিনি ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর ও সেক্রেটারিদের শ্রদ্ধা পেয়ে এসেছেন। ১৮৭৯তে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি মাসিক ২৫০ টাকা পেনসন” পাচ্ছেন; অত্যন্ত ভালভাবে ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে দীর্ঘকাল ব্যাঙ্কের চাকুরি করার স্বীকৃতিস্বরূপ ব্যাঙ্কের ডিরেক্টরবর্গ তাঁকে এই পেনসন মঞ্জুর করেন। তাঁর জ্যৈষ্ঠপুত্র রামকিষেণ ব্যারিস্টারী পাস করে এসে এখন মুনসেফের চাকরি করছেন। কনিষ্ঠ ঠাকুরচরণ হাইকোর্টের উকিল ছিলেন, এখন তিনি এই শহরেরই মেসার্স এ এজ্ লাস্টো কোম্পানির বেনিয়ান।
রামকমল চার পুত্র রেখে যান : হরিমোহন, পিয়ারিমোহন, বংশীধর ও মুরলীধর। তৃতীয় পুত্র বংশীধর টাঁকশালের ‘বুলিয়ান কীপার’ ছিলেন, অল্প বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়; মৃত্যুকালে তিনি দুই কন্যা রেখে গেছেন। হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে তিনি পারদর্শী ছিলেন।