ঠনঠনিয়ার দিগম্বর মিত্র, সি এস আই
রাজা দিগম্বর মিত্র, সি এস আই-এর জন্ম কোন্নগরের মিত্র পরিবারে । তাঁর জন্ম হয় ১৮১৭ খ্রীস্টাব্দে কোন্নগরে । হিন্দু কলেজে পড়বার জন্য তিনি কলকাতায় তাঁর পিতা শিবচন্দ্র মিত্রের নিকট রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটে থাকতেন । ইংরেজি সাহিত্য, গণিত ও দর্শনে বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করবার পর তিনি কলেজের শিক্ষা সমাপ্ত করেন ।
মুর্শিদাবাদের কালেক্টর মিঃ রাসেলের অধীনে তিনি আমিন হিসেবে কৰ্মজীরন আরম্ভ করেন। পরে, রাজা কিষেণনাথের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন; রাজা কিষেণনাথ সাবালকত্ব লাভ করবার পর দিগম্বর হন রাজার সুবিস্তৃত জমিদারীর ম্যানেজার । তাঁর কর্তব্যপরায়ণতা ও দক্ষতার স্বীকৃতিস্বরপ রাজা তাঁকে এক লক্ষ টাকা উপহার দেন । এই বিপুল পরিমাণ অর্থ লাভ করে দিগম্বর শুরু করলেন নীল আর রেশমের ফাঁকা;; কয়েকবার লোকসান খাবার পর (ঐ ব্যবসায় ছেড়ে দিয়ে) প্রাপ্ত সম্পদ দিয়ে জমিদারী কিনতে লাগলেন; জমিদারী কিনলেন ২৪ পরগণা, যশোহর, বাখরগঞ্জ এবং কটক জেলায়; ফলে, তিনি হয়ে উঠলেন একজন গণ্যমান্য জমিদার ।
কলকাতার ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে যৌবনেই তাঁর পরিচয় হয়; তিনি রাজনৈতিক শিক্ষা লাভ করেন আদর্শস্থানীয় দ্বারকানাথ ঠাকুরের নিকট । মাননীয় প্রসন্নকুমার ঠাকুর, সি এস আই এবং মহারাজা রামনাথ ঠাকুর, সি এস আই-র তিনি ছিলেন ব্যক্তিগত বন্ধু এবং সহযোগী ৷ গোপাললাল ঠাকুরেরও তিনি ছিলেন অন্তরঙ্গ বন্ধু । ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন স্থাপিত হবার পর দিগম্বর তার সহকারী সচিব হন এবং পরে এর কার্যনির্বাহী সভাপতির পদত্ত অলঙ্কৃত করেন। প্রথম জীবনে তিনি বেশি মিশতেন সরকারী নয়, বেসরকারী ইউরোপীয়দের সঙ্গে । তিনি পরিচিত ছিলেন গর্ডন, স্টলের, হারী প্রভৃতি বেসরকারী ইউরোপীয় পরিবারের সঙ্গে এবং তাঁদেরই সঙ্গে তিনি তখনকার দিনের রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশও নিতেন । তবে নিজে সাধারণত থাকতেন আড়ালে, পিছনে; অন্যান্য সকলকে ঠেলে দিয়ে নিজে এগিয়ে যাবার প্রবৃত্তি তাঁর ছিল না । ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের তিনি বুদ্ধিমান ও সক্রিয় সভ্যদের অন্যতম ছিলেন; জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার জন্য তাঁর পরামর্শও ছিল মূল্যবান; কিন্তু সে সময় তিনি সামনের সারিতে এগিয়ে আসতে চাইতেন না। ১৮৫৬র তথাকথিত কালা কানুন (বিরোধী) বিদ্রোহের (Black Act Mutiny) সময় তিনি জনসাধারণের সামনে উপস্থিত হন । সে সভায় বক্তা ছিলেন চার ‘মিত্র’, মিঃ কর্ হারী তাঁকে ১নং মিত্র নামে অভিহিত করেন । ১৮৬৪তে সরকারী সংক্রামক জ্বর আয়োগে (কমিশনে) তিনি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরূপে যোগদান করেন; সেই সময় থেকেই সরকার তাঁর গুণাবলী ও কর্মদক্ষতার সঙ্গে পরিচিত হন। অনতিবিলম্বে তাঁকে বাংলার আইন পরিষদের সভ্য করে নেওয়া হয় । অবশ্য, এর আগে তাঁকে কলকাতায় জাস্টিস অফ্ দি পীস, অনারারী ম্যাটিস্ট্রেট এবং ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনের পরিদর্শক করা হয়েছিল । কার্যত এই সময় থেকেই তাঁকে বিভিন্ন কমিটির সভ্য হবার জন্য সরকার থেকে আহ্বান করা । পর পর তিন ছোটলাট–স্যার সেসিল বিডন, স্যার উইলিয়াম গ্রে এবং স্যার জর্জ ক্যাম্পবেল তাঁকে বেঙ্গল কাউন্সিলের সভ্যরূপে মনোনীত করেন । তাঁর পরামর্শ এঁদের প্রত্যেকের কাছেই প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান বলে গণ্য হত । বেঁচে থাকলে, তিনি খুব সম্ভবত বড়লাটের কাউন্সিলেও সভ্যরূপে মনোনীত হবার সম্মান লাভ করতেন । ১৮৬৬ তে দুর্ভিক্ষের সময় তিনি দুঃস্থ জনগণের ত্রাণের জন্য সরকারের সঙ্গে সোৎসাহে সহযোগিতা করেন। ১৮৬০-এ আয়কর আইন, পথ-কর প্রকল্প এবং বাঁধ আইন প্রণয়নে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন । স্ত্রী-শিক্ষা বিস্তারে তিনি উৎসাহ দিতেন এবং ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতারও তিনি উৎসাহী সমর্থক ছিলেন এবং তাঁর মতে, প্রাচ্যে ব্রিটিশ প্রভুত্ব রক্ষার সবচেয়ে ভাল উপায় হল জনগণকে এই অধিকার ভোগ করতে দেওয়া; কিন্তু তারপর লর্ড লিটন প্রেস অ্যাক্ট প্রণয়ন করাতে তিনি বিশেষ দুঃখ পেয়েছিলেন । ইউরোপ, আমেরিকার শিক্ষা মন্দিরসমূহে ভারতীয় যুবকদের তীর্থযাত্রাকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন এবং এ বিষয়ে তাঁর আগ্রহের প্রমাণস্বরূপ তিনি তাঁর একমাত্র পুত্র বাবু গিরিশচন্দ্র মিত্রকে তাঁর শিক্ষা সমাপ্ত করবার জন্য ইংল্যান্ডে পাঠান; কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেখানেই তিনি প্রাণত্যাগ করেন ।’ জেলা দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দেশীয়দিগের সমিতির তিনি ছিলেন অবৈতনিক সম্পাদক। ২০ জন গরীব মানুষের মাসিক ভরণ-পোষণের জন্য তিনি নিজ নামে একটি নিধি স্থাপন করেন । শিক্ষা বিস্তারে উৎসাহ দেবার জন্য তিনি প্রতিদিন নিজ বাড়ীতে ৮১ জন ছাত্রকে খেতে দেওয়া ছাড়াও, তাদের বইপত্র এবং স্কুলের মাইনেও যোগাতেন ।
মাননীয় যুবরাজের ভারত-দর্শনের সময় তিনি ছিলেন কলকাতার শেরিফ । মহামান্য যুবরাজ ১৮৭৬-এর ১ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত ‘Grand Chapter of the Star of India’ ‘Companion of the Most Exalted Order of the Star of India’ পদবীতে ভূষিত করেন । ১৮৭৭-এর ১ জানুয়ারী দিল্লীতে অনুষ্ঠিত Imperial Assemblage-এ তাঁকে রাজা খেতাব দান করা হয় ।
১৮৭৯ সালে রাজা দিগম্বর মিত্র সি এস আই জ্বর, উদরাময় এবং কণ্ঠনালীতে রক্তক্ষরণের জন্য অসুস্থ হয়ে পড়েন । এই সকল অসুখেই তিনি ১৮৭৯ সালের ২০ এপ্রিল সকাল ৭-৩৫ এ পরলোক গমন করেন । তখন তাঁর বয়স ৬৩ বছর । তিনি রেখে যান বিধবা স্ত্রী এবং বাবু গিরিশচন্দ্রের দুটি নাবালক পুত্রকে । রাজা দিগম্বর মিত্র নিজ চেষ্টাতেই বড় হয়েছিলেন; অর্থ ও যশ তিনি অর্জন করেছিলেন নিজ সাধনায় । দুঃস্থ অবস্থা থেকে কীভাবে মানুষ সম্পদ ও যশের শীর্ষে উঠতে পারে, তিনি তার একটি উজ্জ্বল আদর্শ দেশবাসীর সামনে রেখে গেছেন ।