কুমারটুলির গোবিন্দরাম মিত্র ও তাঁর পরিবার
এই প্রাচীন, সম্ভ্রান্ত পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা গোবিন্দরাম মিত্রের পিতার নাম রত্নেশ্বর এবং পিতামহের নাম ছিল হংসেশ্বর ।
আনুমানিক ১৬৮৬-৮৭ খ্রিস্টাব্দে গোবিন্দরাম ব্যারাকপুর ও চণকের নিকটবর্তী একটি গ্রাম থেকে এসে গোবিন্দপুরে বাস করতে থাকেন–এই স্থানে বর্তমান ফোর্ট উইলিয়াম অবস্থিত । গোবিন্দরামকে ফার্সী বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার বিশেষ ব্যুৎপন্ন এবং কাজ চালাবার মতো ইংরেজি-জানা দেখে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতা কুঠির তখনকার গভর্নর জব চার্নক কোম্পানির অধীনে তাঁকে একটি চাকরি দেন । অসাধারণ যোগ্যতার অধিকারী, তীক্ষ্ণ হিতাহিত জ্ঞানসম্পন্ন এবং কর্মোৎসাহী গোবিন্দরাম খুব শীঘ্রই অনারেবল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উচ্চ পদাধিকারীদের সুনজরে পড়ে যান ৷ ফোর্ট উইলিয়াম নির্মিত হবার কিছু আগে তিনি সপরিবারে কুমারটুলি চলে আসেন । এই অঞ্চলে এখনও তাঁর বেশ কয়েকজন বংশধর বাস করছেন ।
কোম্পানি পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করবার পর, গোবিন্দরাম হলেন কোম্পানির ডেপুটি ফৌজদার । ‘ব্ল্যাকহোল’ পুস্তকে হলওয়েল তাঁকে ‘কানা (কৃষ্ণাঙ্গ) ডেপুটি’, ‘নায়েব জমিদার’ কোথাও বা কলকাতার ‘মেয়র’ বলেছেন। Clacultta Review (Vol. III 1845) লেখেন–
‘গোবিন্দরামের সততা সম্পর্কে ১৭৪৮ নাগাদ কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের সন্দেহের উদ্রেক হয় : এই ‘কালা জমিদারের’ কার্যকলাপে কোম্পানি অপেক্ষা তিনি নিজে বেশি লাভবান হচ্ছেন । কিন্তু ১৭৫২ সালের আগে কোম্পানির অর্থ আত্মসাৎ করার এই স্রোত বন্ধ করার কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল বলে মনে হয় না ৷ ঐ বছর হলওয়েলকে জমিদার নিয়োগ করা হয়–প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, ঐ পদে তাঁকে দীর্ঘকাল রাখা হবে। তিনি গোবিন্দরামকে তাঁর কাজ শুরু করার দিন থেকে সেরেস্তার হিসাবপত্র দাখিল করবার আদেশ দিলেন । গোবিন্দরাম জানালেন ১৭৩৮ সালের আগের কাগজপত্র ঝড়ে উড়ে গেছে [১৭৩৭-এর বিধ্বংসী ঝড়ে কলকাতা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়– অনুবাদক] আর পরবর্তী বছরগুলির হিসাবের কাগজপত্রের অধিকাংশ উই-এ খেয়েছে । গোবিন্দরাম তখনও ক্ষমতায় আসীন, তাই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মতো একটি প্রাণীও পাওনা গেল না । যাই হোক অধ্যবসায়ের জোরে, হলওয়েল পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করে অবিলম্বে কাউন্সিলকে জানালেন যে, গোবিন্দরাম বহু জালিয়াতি করে কোম্পানির দেড় লাখ টাকার সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছেন এবং দাবী জানালেন, উক্ত পরিমাণ অর্থ আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে কড়া পাহারায় নজরবন্দী করে রাখা হোক, কিন্তু কাউন্সিলের সভ্যদের মধ্যে অনেকেই এই ‘কালা জমিদারের’ বন্ধু থাকায়, হলওয়েলের উৎসাহ বিশেষ পাত্তা পেল না । কাউন্সিলের সভাপতি তাঁকে গ্রেফতার বা তাঁর সম্পত্তি (সাময়িক ভাবে) বাজেয়াপ্ত না করে, তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলির একটি প্রতিলিপি দিলেন তাঁকে; সাতদিনের মধ্যে গোবিন্দরাম অভিযোগের দুটি উত্তর দিলেন; উত্তর দুটি লেখা হয়েছিল ইংরেজিতে এবং লিখে দিয়েছিলেন খুব সম্ভবত, কুঠিরই কোন না কোন (ইংরেজ) ভদ্র মহোদয় । উত্তরে তিনি জানালেন, তাঁর সব কাজকর্মেই ঊর্ধ্বতন ইউরোপীয় অধিকারীর অনুমোদন ছিল–(অনুমোদন নিতে তিনি কখনও ভুল করেন নি); আর তিনি নিজে যে সব সম্পদ বা সম্পত্তি নিয়েছেন, সে রকম সম্পত্তি ইত্যাদি এদেশের রাজা বা জমিদারের দেওয়ানমাত্রেই নিয়ে থাকেন–তাছাড়া ওটুকু না নিলে, মাসিক মাত্র পঞ্চাশ টাকা মাইনেতে উপযুক্ত ঠাটবাট বজায় রেখে পদমর্যাদা অনুযায়ী চলা সম্ভব নয় । জবাবে হলওয়েল জানালেন, কোন দেওয়ান সম্পত্তির প্রকৃত আয় যদি গোপন করেন, বা বেনামা করেন বা জনগণের উপর জোরজুলুম করে প্রাপ্য অপেক্ষা বেশি অর্থ আদায় করেন, তাহলে এদেশের রীতি অনুযায়ী ‘চাবুক, হাতে কড়া পায়ে বেড়িসহ জেল আর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত : এই হল তাঁর তাৎক্ষণিক শান্তি ।’ হলওয়েল মন্তব্য করলেন, মিত্র নিজেই স্বীকার করেছেন যে, তিনি তাঁর দেশের রীতি অনুযায়ী লুঠ চালিয়েছেন, কাজেই তাঁর দেশের প্রথানুযায়ী তাঁর (উপরিউক্ত ) শাস্তি হওয়া দরকার । কিন্তু উপনিবেশের প্রথম এদেশীটিকে ‘চাবুক বা কড়াবেড়ির’ শাস্তি দিতে কাউন্সিল ইচ্ছুক ছিলেন না। বিচারের বিরুদ্ধে কাউন্সিলই সম্ভাব্য সকল প্রকার ওজর আপত্তি তুলতে লাগলেন; কাজেই সকল অভিযোগই বিফলে গেল । আর দেওয়ান (মিত্র) তাঁর অর্জিত সকল সম্পদ ও সম্পত্তি ভোগ-দখল করতে থাকলেন ।’
[এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রথম কর্মচারী গোবিন্দরামের মতো বহু এদেশীয় কর্মচারীই অত্যন্ত অল্প বেতন সত্ত্বেও প্রচুর ধনসম্পদ অর্জন করেছিলেন । পলাশীর যুদ্ধের পর সিরাজদ্দৌলার খাস কোষাগারে সঞ্চিত ছিল আট কোটি টাকা; দেওয়ান রামচাঁদ আর মুন্সী নবকৃষ্ণ এবং অন্যান্য কয়েকজন ক্লাইভকে এই অর্থের বিষয় জানাননি । এই প্রসঙ্গে মাশম্যান তাঁর বিখ্যাত ‘হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল’ গ্রন্থে মন্তব্য করেন : মীরজাফর, আমীর বেগম খাঁ, রামচাঁদ এবং নবকৃষ্ণ এই অর্থ আত্মসাৎ করেন । এই আত্মসাতের কাহিনী অবিশ্বাস্য বলে মনে হয় না; কারণ, রামচাঁদ তখন বেতন পেতেন ষাট টাকা মাত্র; কিন্তু এর দশ বছর পর তিনি যখন মারা যান, তখন তার সম্পত্তির মূল্য এক কোটি পঁচিশ লক্ষ টাকা; আর ষাট টাকা মাইনের মুন্সী (পরে রাজা) নবকৃষ্ণ এর (পলাশীর যুদ্ধের) কিছু পরে তাঁর মাতৃশ্রাদ্ধে ব্যয় করলেন ন’ লাখ টাকা ৷]
ধর্মপ্রাণ হিন্দু গোবিন্দরাম চিৎপুরে বিরাট আকারের (মহাদেবের নামে উৎসর্গিত) নবরত্ন বা ন’টি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । তখনকার দিনের একটি বাংলা প্রবাদ থেকে জানা যায়, ইংরেজ-রাজের প্রজাদের উপর গোবিন্দ-রামের প্রভাব প্রতিপত্তি কত প্রবল ছিল-
গোবিন্দরামের ছড়ি,
বনমালী সরকারের বাড়ি,
উমিচাঁদের দাড়ি,
আর, জগৎশেঠের কড়ি ।
[প্রায় এক শ’ বছর আগে বনমালী সরকার নামে কলকাতার এক ধনী ব্যক্তির বাড়িটিকেই তখন কলকাতার সব চেয়ে বড় বাড়ি বলা হত। এখনও (১৮৮১) প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় বাড়িটি বর্তমান ।]
[তখনকার বিখ্যাত ধনী উমিচাঁদের দীর্ঘ ও দুর্লভ দাড়ি ছিল । ইনিই মুর্শিদাবাদের দরবার ও কলকাতার কাউন্সিলের মধ্যে সংবাদ আদান-প্রদানের মাধ্যম ছিলেন, শোনা যায়, কলকাতা আক্রমণ করবার জন্য তিনিই সিরাজউদ্দৌলাকে মন্ত্রণা দিয়েছিলেন । কলকাতার ইউরোপীয় এলাকায় এঁর বেশ কয়েকখানি বাড়ি আর সার্কুলার রোডে (হালসীবাগানে) বাগান ছিল । ১৭৫৬–তে গোলযোগের সূত্রপাতেই তাঁকে এই বাগান বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে ফোর্টে বন্দী করে রাখা হয় । আবার জাল দলিল মারফৎ ক্লাইভ এঁকে প্রবঞ্চনা করেন– মেকলে সেজন্য ক্লাইভের নিন্দাও করেছেন । ক্লাইভের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলবার জন্য ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছিল যে, ক্লাইভ (জালিয়াতি করে) তাঁকে তাঁর প্রাপ্য ৩০ লাখ টাকা ঠকিয়েছেন । এই টাকা না পাওয়ায় উমিচাঁদ প্রায় পাগল হয়ে মারা যান। আসলে তিনি এই ঘটনার পর আরও ছ’বছর বেঁচেছিলেন । মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর বিপুল অর্থের যে উইল করে যান তাতে পাগলামির কোন চিহ্ন ছিল না । উইলে তিনি দানখয়রাত বাবদ বহু অর্থের ব্যবস্থা রাখেন; তাঁকে আঘাতকারী ইংরেজদের দাতব্য প্রতিষ্ঠানেও তিনি ২৫,০০০ টাকা দান করে যান ।– Calcutta Review, Vol. III, 1845. ]
[মুর্শিদাবাদের অধিবাসী জগৎশেঠ ছিলেন তখনকার দিনের সর্বাপেক্ষা ধনী মহাজন ।]
১৭৬৬-তে প্রবীণ বয়সেই গোবিন্দরামের মৃত্যু হয় । তিনি রেখে যান তাঁর একমাত্র পুত্র রঘুনাথ মিত্রকে । রঘুনাথের বয়স তখন ২৫ বছর। প্রচুর বিত্তের মালিক হয়ে রঘুনাথ বিলাসব্যসনে মত্ত হয়ে উঠলেন । তবে, ধর্মপ্রাণ হিন্দু হিসাবে প্রচুর ব্যয় করে খুব জাঁকজমকের সঙ্গে দুর্গাপূজা ও কালীপূজা করতে লাগলেন । তাঁর চার পুত্র :- রাধাচরণ মিত্র, কৃষ্ণচরণ মিত্র, রসময় মিত্র ও আনন্দময় মিত্র। এঁদের মধ্যে রাধাচরণ ও রসময় রঘুনাথের জীবিতকালেই মারা যান; রঘুনাথও মারা যান ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে ।
১. রঘুনাথের জ্যেষ্ঠপুত্র রাধাচরণের দুই বিবাহ, প্রথম পক্ষের ছিল এক পুত্র আর দ্বিতীয় পক্ষের দুই পুত্রের অন্যতম অভয়চরণ ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং বিশেষ কর্মদক্ষ । ২৪ পরগণা এবং মীনপুরীর কালেক্টরদের দেওয়ানরূপে তিনি ওপরওয়ালাদের প্রচুর প্রশংসা পান । পূর্বপুরুষদের মতো তিনিও রাজকীয় জাঁকজমকের সঙ্গে দুর্গা ও কালীপূজা করতেন । গোঁড়া হিন্দু ছিলেন বলে কুলগুরুকে এক লাখ টাকা দান করে দেন; গুরু অত টাকা একসঙ্গে চোখে দেখেননি বলে শিষ্যকে লাখ টাকা একসঙ্গে একবার দেখাবার অনুরোধ করেছিলেন মাত্র, এতেই তিনি গুরুকে লাখ টাকা দান করে দেন । এখনও অভয়চরণ আদর্শ শিষ্য হিসাবে কলকাতায় পরিকীর্তিত । প্রখ্যাত ধনী নিমাইচরণ ও বৈষ্ণবচরণকে সালিস মানা হয় । তাঁদের রায়ে অভয়চরণ বিপুল পরিমাণ অর্থ লাভ করেন। কৃষ্ণচরণ তখন ঐ অর্থ দক্ষিণা হিসাবে প্রার্থনা করবার জন্য কুলগুরুকে নিয়োগ করেন। বিনা বাক্যব্যয়ে অভয়চরণ রায়ে প্রাপ্ত সমস্ত অর্থ গুরুদেবকে দান করেন; পরোক্ষে জয়ী হন কৃষ্ণচরণ । এই ঘটনার কিছু দিনের মধ্যেই স্বীয় কর্মনৈপুণ্য ও অধ্যবসায়ের গুণে অভয়চরণ পুনরায় বিপুল অর্থ এবং মর্যাদা ও খ্যাতি অর্জন করেন । [১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি মীনপুরীতে পরলোকগমন করেন–এই মীনপুরীর কালেক্টরের তিনি দেওয়ান ছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর ছয় পুত্র বর্তমান ছিলেন ।]
২. রঘুনাথের মধ্যমপুত্র কৃষ্ণচরণ ছিলেন ঢাকার কালেক্টরের দেওয়ান । আজ (১৮৮১) থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে তিনি নন্দনবাগানে একটি উল্লেখযোগ্য বাসগৃহ নির্মাণ করেন–এখানেই তাঁর বংশধররা বাস করছেন। তাঁর মধ্যমপুত্র রাজচন্দ্রের বিবাহ উপলক্ষে তদানীন্তন বড়লাট লর্ড কর্নওয়ালিস তাঁকে তাঁর বাড়ীতেই দুটি তোপ দাগবার দুর্লভ মর্যাদা দিয়েছিলেন– কেল্লার প্রাচীর থেকেও এই উপলক্ষে তোপধ্বনি করা হয়েছিল । নন্দনবাগান মিত্র বাড়ীতে এখনও দুটি কামান আছে। কৃষ্ণচরণের কনিষ্ঠ পুত্র শম্ভুচন্দ্র ছিলেন ফারাক্কাবাদের কালেক্টর বা সমাহর্তার দেওয়ান । তাঁর পান্ডিত্য, দান ও জনহিতৈষণার জন্য কতিপয় ইউরোপীয় ও বহু এদেশীয় তাঁকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন । মৃত্যুকালে তাঁর দুই পুত্র বিশ্বেশ্বর ও কাশীশ্বর জীবিত ছিলেন। কাশীশ্বরের ইংরেজি ভাষায় বিশেষ দখল ছিল । তিনি হুগলীর প্রধান সদর আমীন হয়েছিলেন । তখনকার আমলাদের মধ্যে তিনি ছিলেন কর্মদক্ষ ও সৎ। তিনি রাজা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু ও গোঁড়া ব্রাহ্ম ছিলেন ।
৩. রঘুনাথের তৃতীয় পুত্র রসময় ছিলেন অপুত্রক ।
৪. রঘুনাথের চতুর্থ পুত্র আনন্দময় ছিলেন রাজশাহীর সমাহর্তার দেওয়ান । এঁর বংশধরগণ ‘বেনারসের মিত্র পরিবার’ নামে পরিচিত ।