সুকিয়াস স্ট্রিটের পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সি আই ই
১৮২০ খ্রিস্টাব্দে হুগলী জেলার বীরসিংহ গ্রামে পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম হয় । তিনি ছিলেন ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র । দারিদ্র্যপীড়িত হলেও ঠাকুরদাস ঈশ্বরের শিক্ষার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন । ১৮২১-এর ১ জুন তাঁকে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করা হয় । ১৮৪১ পর্যন্ত সেখানে তিনি অধ্যয়ন করেন । শিক্ষা সমাপ্তির পর তিনি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের হেড পন্ডিত নিযুক্ত হন; মাসিক বেতন হয় ৫০ টাকা । ১৮৪৬-এ স্কুল-পাঠ্য পুস্তক হিসাবে তাঁর বেতাল পঞ্চবিংশতি প্রকাশিত হয়; এবং তাঁকে সংস্কৃত কলেজের সহকারী অধীক্ষক নিয়োগ করা হয়– ঐ পদে তিনি পরের বছরেই ইস্তফা দেন। ১৮৪৯-এর ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে মাসিক ৮০ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেড ক্লার্ক নিযুক্ত করা হয় । পর বছর ডিসেম্বর মাসে মাসিক ৯০ টাকা বেতনে তিনি সংস্কৃত কলেজের অন্যতম অধ্যাপক পদ লাভ করেন । ১৮৫১-র জানুয়ারি মাসে মাসিক ১৫০ টাকা বেতনে ঐ কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন । ঐ পদে অধিষ্ঠিত থাকবার সময় ছাত্রদের শিক্ষার পথ সুগম করার জন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করে উপক্রমণিকা, সংস্কৃত ব্যাকরণ কৌমুদির তিনটি খন্ড এবং সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করে শকুন্তলা প্রকাশ করেন । সহজে ও অনায়াসে সংস্কৃত শিখতে এই বইগুলি আজও ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে সহায়ক ।
বিধবা বিবাহের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে ১৮৫৪-তে তিনি একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন; উদ্যম প্রশংসনীয় হলেও এতে কোন ফল হল না । সকল হিন্দুই– সে যুবক বা বৃদ্ধ হোক, ধনী বা দরিদ্রই হোক তাঁকে ঘৃণা করতে লাগল । সে ঘৃণার যেন সীমা ছিল না । বিধবা বিবাহ সম্পর্কে আলোচনা করবার জন্য সারা বাংলার পন্ডিত-সমাজ সভার পর সভা করতে লাগলেন– তাঁদের সকলেরই মত গেল তাঁর বিরুদ্ধে । প্রথম প্রথম যে সকল পন্ডিত তাঁকে সমর্থন করেছিলেন, তাঁরাও পরে মত পরিবর্তন করে তাঁর বিপক্ষে চলে গেলেন; তাঁর মতের বিরুদ্ধে মত দিতে থাকলেন । তিনি কিন্তু স্বীয় মতে দৃঢ় থেকে, বিধবা বিবাহের সপক্ষে পর পর কয়েকটি পুস্তিকা প্রকাশ করে চললেন । সংস্কৃত শাস্ত্র থেকেই অসংখ্য উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করে চললেন, স্মরণাতীত কাল থেকে এদেশে বিধবা বিবাহের প্রচলন আছে । এক্ষেত্রেও কয়েক ব্যক্তি বিরুদ্ধ উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর মত খন্ডনের চেষ্টা করলেন । কিন্তু তাঁদের সে চেষ্টা বিফল হল । ১৮৫৬-র জুলাই মাসে সরকারকে দিয়ে তিনি বিধবা বিবাহ আইন পাস করাতে সক্ষম হলেন । ১৮৬৫-র ৭ ডিসেম্বর তাঁরই নেতৃত্বে সুকিয়াস স্টীটে প্রথম বিধবা বিবাহ অধিষ্ঠিত হয় । ফলে বৃহত্তর হিন্দু সমাজে মহা আলোড়নের সৃষ্টি হয়। বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে প্রধান ব্যক্তিগণ ঘোষণা করলেন, কোন হিন্দু বিদ্যাসাগরের সঙ্গে যোগ দিলে, তাকে হিন্দু সমাজ থেকে বহিষ্কার করা হবে । সুহৃদ ও স্বদেশবাসীরা তাঁকে বর্জন করলেও, তিনি তাঁর মতবাদে অবিচল থেকে অধ্যবসায় সহকারে বিধবা বিবাহের পক্ষে কাজ করে যেতে লাগলেন । বিধবা-বিবাহের ব্যয়ও তিনি নিজেই করতেন; শোনা যায়, এজন্য তাঁর প্রচুর ঋণ হয়ে গিয়েছিল ।
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে হুগলী, বর্ধমান, মেদিনীপুর ও নদীয়া জেলার স্কুল পরিদর্শক নিযুক্ত করা হয়; তাঁর মাসিক বেতন ৫০০ টাকা । এই পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা-ব্যবস্থার উন্নতিবিধানে প্রভূত চেষ্টা করেন, উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক, যেমন : বর্ণ পরিচয়, কথামালা, চরিতাবলী প্রভৃতিও রচনা করেন। স্ত্রী শিক্ষার বিষয়ে সবিশেষ আগ্রহী হওয়ায়, তিনি বেশ কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন– কিন্তু সরকারি অনুদানের এবং জনসমর্থনের অভাবে এই সকল বিদ্যালয়ের অধিকাংশই পরে বিলুপ্ত হয়। ১৮৫৮র শেষ দিকে তিনি ঐ পদ ত্যাগ করেন; ফলে, হাতে প্রচুর সময় থাকায় তিনি পুস্তক রচনায় মনোনিবেশ করেন; রচিত হয় বাংলায় ব্যাকরণ কৌমুদির চতুর্থ ভাগ, আখ্যান মঞ্জরী, সীতার বনবাস, বাংলা মহাভারতের একটি ভূমিকা, ভ্রান্তিবিলাস প্রভৃতি; এতদ্ব্যতীত মেঘদূত, উত্তর চরিত, শকুন্তলা প্রভৃতি স্বীয় টীকা সহ বাংলায় প্রকাশ করেন ।
সে যুগে হিন্দু সমাজে বহু-বিবাহ বহুল প্রচলিত ছিল; ১৮৭১ নাগাদ তিনি এই ব্যাধির মূলেও কুঠারাঘাত করতে উদ্যত হলেন । কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের সমর্থন ও হস্তক্ষেপের অভাবে তিনি বিশেষ অগ্রসর হতে পারেন নি।
নিজ ব্যয়ে তিনি স্বগ্রামে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় ও একটি দাতব্য ঔষধালয় প্রতিষ্ঠা করে গ্রামটির প্রভূত উপকার করেছেন । তিনি বহু অনাথ ও বিধবার ভরণপোষণ করেন । আর, কেউ বিপন্ন হয়ে তাঁর সহায়তা চাইলে, তিনি সাহায্য করতে সদা প্রস্তুত ছিলেন। তিনি সরল জীবন যাপন করতেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ চরিত্রের অধিকারী । শিক্ষার মহান পৃষ্ঠপোষক ও বান্ধব ঈশ্বরচন্দ্র শিক্ষার উন্নতির জন্য প্রতি মাসে নিজ আয় থেকে প্রচুর ব্যয় করেন। কলকাতায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনকে বাংলা বিহার ওড়িশার শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়গুলির অন্যতমরূপে গণ্য করা হয়; তাঁর গ্রন্থাগারটিকে বহু ব্যক্তি মহামূল্যবান বলে মনে করেন । তাঁকে বর্তমানের শ্রেষ্ঠ ও খ্যাতিমান সংস্কৃতজ্ঞরূপে গণ্য করা হয়; ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষাতেও সাহিত্যকৃতীর জন্য তিনি বিখ্যাত । ইংল্যান্ডে-শ্বরীর, ‘ভারত সম্রাজ্ঞী’ উপাধি ধারণ উপলক্ষে কলকাতায় ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে ১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দরবারে তাঁকে সাম্মানিক প্রশংসাপত্র দেওয়া হয় এবং ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ১ জানুয়ারি তাঁকে ‘কম্প্যানিয়ন অফ্ দি ইন্ডিয়ান এমপায়ার’ পদবীতে ভূষিত করা হয় । (তিনি ১৮৯১ সালে ৭১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন । –সম্পাদক) তাঁর একমাত্র পুত্রের নাম নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ।