পাথুরিয়াঘাটা ও চোরবাগানের মল্লিক পরিবার
এই পরিবারটি অতি প্রাচীন। জাতিতে এঁরা সুবর্ণ বণিক; দেশীয় প্রথা ও রীতি অনুযায়ী এঁরা মহাজনী কারবার ও ব্যবসায়িক উদ্যোগকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছেন। এই পরিবারটি (মল্লিক) স্মরণাতীত কাল থেকে তাঁদের ধনসম্পদ, ব্যবসায়িক উদ্যোগ ও দিন-ধর্মের জন্য বিখ্যাত। সামাজিক মর্যাদা এই পরিবারটির এত বেশি যে, সুবর্ণ- বণিক জাতির বহু পরিবারই এই মল্লিক পরিবারকে ‘দলপতি’ হিসাবে গণ্য করেন। তাছাড়া এই জাতির তিনটি কুলীন পরিবারের অন্যতম এই মল্লিক পরিবার তাঁরা ‘প্রামাণিক’। এঁদের পারিবারিক পদবী শীল; বংশের ত্রয়োদশ পুরুষ যাদব শীলকে মুসলিম সরকার পুরুষানুক্রমে ব্যবহারের অধিকার সহ ‘মল্লিক’* উপাধিতে ভূষিত করেন। শীল পদবীটি ধর্মীয় ও বৈবাহিক অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়।
[* ফার্সি ভাষায় শব্দটি অর্থ রাজা আমীর বা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। মুসলিম শাসকগণ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণকে এই পদবীতে ভূষিত করতেন) গয়াসুল লোগট ও তাজুল লোগট দ্রষ্টব্য।]
এই জাতিকে সুবর্ণ-বণিক নামে অভিহিত করার ইতিহাস নিম্নরূপ :
সে বহু শতাব্দী পূর্বের কথা। অযোধ্যা রাজ্যের রামগড় নিবাসী সনক আঢ্য ছিলেন যেমন ধার্মিক, পন্ডিত এবং বেদজ্ঞ, তেমনি বিপুল বিত্তের অধিকারী। তিনি অযোধ্যা থেকে বাংলার তদানীন্তন রাজা আদিশূরের রাজসভায় চলে আসেন।
তীর্থযাত্রী ও ব্যবসায়ী সনকের ব্যবহারে আদিশূর এতই মুগ্ধ হন যে, তিনি সনককে ব্রহ্মপুত্র নদীতীরে একখানি গ্রাম দান করেন। সেখানে সনক ও তাঁর পুরোহিত জ্ঞানচন্দ্র মিশ্র সপরিবারে বসবাস করতে থাকেন। সনক আঢ্যের ব্যাপক ব্যবসা বাণিজ্যের ফলে, সেই ক্ষুদ্র অজ্ঞাত গ্রামটি অনতিবিলম্বে বিরাট এক বাণিজ্য-কেন্দ্রে পরিণত হয়। সেই স্বর্ণ-ব্যবসায়ীর সম্মানে আজও স্থানটি সুবর্ণগ্রাম বা সোনার গাঁও নামে পরিচিত; অবশ্য, গ্রামটি এখন ধ্বংসস্তূপমাত্র। আদিশূর গ্রামদানের সুফল দেখে এত সন্তুষ্ট হন যে, তিনি সনক আঢ্যকে একটি তাম্রপত্র দান করেন; তাতে নিম্নলিখিত শ্লোকটি উৎকীর্ণ ছিল :
“স্বর্ণবাণিজ্য কারিত্বাদগ্রস্থিত বিশাংময়া।
সুবর্ণ বণিগিত্যাখ্যা দত্তা সম্মান বৰ্দ্ধয়ে॥”
অর্থাৎ স্বর্ণ ব্যবসায়ে ব্যাপৃত এই স্থানের বৈশ্যগণের সম্মান বর্ধনার্থ, আমি তাহাদিগকে সুবর্ণবণিক পদবী দান করছি (দ্রষ্টব্য : আনন্দ ভট্ট রচিত বল্লাল চরিত)।
সুবর্ণ বণিকগণ দীর্ঘকাল যাবৎ রাজ-অনুগ্রহ ভোগ করতে থাকেন। কিন্তু রাজা বল্লাল সেনের সঙ্গে সনক আঢ্যের তদানীন্তন বংশধর বল্লভানন্দ আঢ্যের ভুল বোঝাবুঝি হয়। বল্লভানন্দই তখন সুবর্ণ বণিক জাতির প্রধান। বল্লাল সেনের জীবনী লেখকের মতে রাজ্যে তখন সর্বাপেক্ষা ধনী ব্যক্তি– তিনি তখন ১৪ কোটি স্বর্ণমুদ্রার মালিক। মণিপুর যুদ্ধের সময় বল্লাল সেন তাঁর কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণস্বরূপ গ্রহণ করেন; এই ঋণ পরিশোধের ব্যাপারেই তাঁদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এর সঙ্গে অন্যান্য কারণ যুক্ত হয়ে মনান্তরকে গভীরতর করে তোলে। প্রতিশোধ নেবার জন্য বল্লাল সেন সুবর্ণ বণিক জাতির উপবীত ধারণের অধিকার রদ করেন; মনুর বিধান অনুযায়ী সুবর্ণ বণিক জাতি (বৈশ্য)-ও উপবীত ধারণের অধিকারী, কেননা ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের ন্যায় তাঁরা দ্বিজ।
মহান ইতিহাসবেত্তা টি ট্যালবইজ হুইলার এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বেনেদের জাতির কাছে হেয় করবার বল্লালী চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁদের সম্পদ ও ব্যবসায়িক উদ্যোগের জন্য বেনেদের ধনগৌরবান্বিত একটি অভিজাত শ্রেণি গড়ে উঠেছে; জাতির কাছে এই সম্প্রদায়ের সম্মান ও মর্যাদা প্রচুর; এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল বর্তমানের মল্লিক পরিবার। বহু বেনে পরিবারই গৌড় থেকে মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও বর্ধমান জেলা হয়ে হুগলী জেলার সাতগাঁ বা সপ্তগ্রামে চলে আসেন। (এঁদের একটা শ্রেণি এখনও সপ্তগ্রামিয়া সুবর্ণ-বণিক নামে পরিচিত।) দুঃসাহসী বণিক এই বেনেরাই ষোড়শ শতাব্দীতে হুগলীর পর্তুগীজদের সঙ্গে, সপ্তদশ অষ্টাদশ শতাব্দীতে চুঁচুড়ার ওলন্দাজ, চন্দনগরের ফরাসী এবং কলকাতার ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসায় করতেন। এই সব পরিস্থিতি বিবেচনা করলে বলা যায়, এই বেনেরাই (ভারতীয়দের মধ্যে) সর্বপ্রথম স্ত্রীজাতির প্রতি সুসংস্কৃত আচরণে অনুপ্রাণিত হন–এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে ভারতের অন্যান্য শ্রেণির অধিবাসীদের আরও বিলম্ব হয়েছিল।
যতদূর সংগ্রহ করা যায় এই বংশের ২২ পুরুষের একটি বংশলতিকা নিচে দেওয়া হল :
পাথুরিয়াঘাটার ও চোরাবাগানের মল্লিক পরিবারের বংশ সরণী*
[পরিবারটি ২৪শ পুরুষে পৌঁছলেও ২৩শ ও ২৪শ পুরুষের বংশধরগণের নাম এখানে দেওয়া হল না। ]
লিখিত তথ্য অনুযায়ী ১ম পুরুষ – মথু শীল
২য় পুরুষ – গজাশীল ও এগার ভাই
৩য় পুরুষ – সুমাইর শীল আর দুই ভাই
৪র্থ পুরুষ – বারণ শীল
৫ম পুরুষ – বাজো শীল
৬ষ্ঠ পুরুষ – তেজ শীল
৭ম পুরুষ – প্রয়াগ শীল
৮ম পুরুষ – নাগর শীল
৯ম পুরুষ – নিত্যানন্দ শীল ও দুই ভাই
১০শ পুরুষ – নারায়ণ শীল
১১শ পুরুষ – মদন শীল ও ছয় ভাই
১২শ পুরুষ – বনমালী শীল
১৩শ পুরুষ – যাদব শীল ও দুই ভাই (এই যাদব শীল মল্লিক উপাধি লাভ করেন)
১৪শ পুরুষ – কানুরাম মল্লিক ও চার ভাই
১৫শ পুরুষ– জয়রাম মল্লিক ও তিন ভাই
১৬শ পুরুষ – পদ্মলোচন মল্লিক ও পাঁচ ভাই
১৭শ পুরুষ – শ্যামসুন্দর মল্লিক
পরিবারটির দলিল দস্তাবেজ থেকে দেখা যায় যে, এঁদের আদিবাস ছিল সুবর্ণরেখা নদীর তীরে, তারপর সপ্তগ্রামে, আরও পরে হুগলী ও চুঁচুড়ায় (হুগলী ও চুঁচুড়ায় এখনও পরিবারটির বাস্তভিটার সন্ধান পাওয়া যায়); তখনও কলকাতায় ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আলোচ্য পরিবারটি জয়রামের চতুর্থ পুত্র পদ্মলোচনের বংশ; কিন্তু জয়রাম তাঁর পূর্বপুরুষগণ, পদ্মলোচন বা পদ্মলোচনের পুত্র শ্যামজন্দরের জীবনী সম্বন্ধে কিছু জানা যায় নি; তবে একথা কতকটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে, তাঁরা এমনভাবে তাঁদের ব্যবসা ও জীবন পরিচালনা করেছিলেন, যাতে তাঁদের পূর্বপুরুষের যশ ও অর্থ অটুট থাকে এবং বংশধরগণের সামনে একটা উচ্চ আদর্শ স্থাপিত হয়। বংশটির প্রকৃত প্রামাণিক ইতিহাস আরম্ভ হয়েছে শ্যামসুন্দরের দুই পুত্র রামকৃষ্ণ ও গঙ্গাবিষ্ণু মল্লিক থেকে। এই দুই ভাই পাথুরিয়াঘাটার পৈতৃক বাসভবনে একত্রে থেকে চিরাচরিত মহাজনী কারবারের সঙ্গে সারা বাংলা, উত্তর পশ্চিম প্রদেশ ছাড়াও চীন, সিঙ্গাপুর ও অন্যান্য অনেক বিদেশী বন্দরে ব্যবসা পরিচালনা করতেন। তাঁদের পারিবারিক জীবনযাপন প্রণালীও ছিল আদর্শস্থানীয় ও শ্রদ্ধেয়। নিজেদের আত্মীয় অনাত্মীয় বহু পোষ্য তো তাঁদের ছিলই, তাঁদের বাড়ীর সামনেই প্রতিষ্ঠিত ধরমশালায় প্রতিদিন বিরাট সংখ্যক অনাথ আতুর বুভুক্ষু মানুষকে তাঁরা অন্নদান করতেন। বহু আত্মীয়কে ব্যবসায়ে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য, তাঁরা যথোপযুক্ত অর্থ সাহায্য করতেন; কখনও বা তাঁরা যাতে লাভজনক ও দায়িত্বপূর্ণ পদ পেতে পারেন, তার জন্য জামিন দাঁড়াতেন। এইসবের মাঝেই তাঁদের দান ও উদারতা সীমাবদ্ধ ছিল না। তখনও এদেশে ইউরোপীয় পদ্ধতির ঔষধ বিতরণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় নি; তাই দরিদ্রদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষধলাভের সুবিধার্থে তাঁরা বহু সংখ্যক সুশিক্ষিত চিকিৎসক নিয়োগ করে আয়ুর্বেদীয় ওষুধ তৈরি করাতেন। ১১৭৬ বঙ্গাব্দ (১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ)-এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় শহরে অসংখ্য অনশনক্লিষ্ট মানুষ উপস্থিত হয়েছিল; জাতিধর্ম নির্বিশেষে তাদের প্রতিদিন রান্না করা খাবার বিতরণের জন্য তাঁরা শহরের বিভিন্ন স্থানে আটটি অন্নসূত্র প্রতিষ্ঠা করেন—-এগুলির সম্পূর্ণ ব্যয়ভার তাঁরা নিজেরাই বহন করতেন। অন্নসত্রগুলি শহরের বিভিন্ন অংশে মল্লিকদের আত্মীয় ও বন্ধুদের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল–তাঁরা স্বেচ্ছায় তাঁদের এই সৎকার্যে সহযোগিতা করতেন। অবশ্য শহরের দক্ষিণাংশেও অন্যান্য ব্যক্তি ও পরিবারের বদান্যতায় এইপ্রকার আরও বহু অন্নসত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ভ্রাতৃদ্বয়ের দান ধর্ম এই শহরে বা প্রদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বৃন্দাবনে তাঁরা একটি ‘ছত্তর’ প্রতিষ্ঠা করেন, এখানে হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী প্রতিদিন মহাধূমধামের সঙ্গে পূজা অর্চনা হত এবং বহু সংখ্যক দরিদ্র ব্যক্তিকে অন্নদান করা হত। পূর্বেই বলা হয়েছে, বহু সুবর্ণ বণিক পরিবার মল্লিকদের ‘দলপতি’ বলে মান্য করতেন, বিবাদ- বিসংবাদে তাঁরা এই দুই ভাইয়ের কাছে আসতেন বিরোধের মীমাংসা করে দেবার জন্য; বিবাহাদি ব্যাপারেও তাঁরা এই দুই ভাইয়ের পরামর্শ নিতেন।
একমাত্র পুত্র নীলমণিকে রেখে গঙ্গাবিষ্ণু মল্লিক ১৭৮৮-র ৭ ফেব্রুয়ারি পরলোকগমন করেন। রামকৃষ্ণ মল্লিকের মৃত্যু হয় ১৮০৩-এর ডিসেম্বর মাসে; তাঁর মৃত্যুকালে দুই পুত্র : বৈষ্ণবদাস ও সনাতন জীবিত ছিলেন; জ্যেষ্ঠ পুত্র আনন্দলালের মৃত্যু হয় পিতার জীবিতকালেই।
নীলমণির জন্ম হয় ১৭৭৫-এর ১০ সেপ্টেম্বর, বৈষ্ণবদাসের ঐ বছরই ৮ অক্টোবর এবং সনাতন জন্মগ্রহণ করেন ১৭৮১-এর ৪ সেপ্টেম্বর। এঁরা পাথুরিয়াঘাটার পৈতৃক বাসভবনে একান্নবর্তী সংসারে বাস করতেন। সনাতন মল্লিক মারা যান ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে; তাঁর কোন পুত্রসন্তান ছিল না। তখন অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে দুই জ্ঞাতি ভাই মিলে সংসার ও ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করতে থাকেন; ফলে পরিবারটির মান মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
নীলমণি মল্লিক ছিলেন ধর্মপরায়ণ এবং ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের প্রতিমূর্তি; মহৎ হৃদয়, ক্ষমাশীল এই ভদ্রলোক ছিলেন আর্তজনের বন্ধু, তাদের দুঃখে সহানুভূতিশীল, তাদের সুখে হতেন আনন্দিত। সংসারের ওপর তাঁর নির্দেশ ছিল, খাদ্য না পেয়ে যেন কোন ক্ষুধার্ত মানুষ দরজা থেকে ফিরে না যায়; অন্য খাবার না থাকলে আমার খাবার তাকে দিও। অসংখ্য দান ও পরোপকারিতার জন্য তিনি স্মরণীয় ব্যক্তি হয়েছিলেন–তাঁর ধর্মপরায়ণতা ও পরহিতৈষণার মাত্র কয়েকটি দৃষ্টান্ত আমরা এখানে দেব। তিনি মামাবাড়ির সূত্রে জগন্নাথদেবের প্রতি ভক্তিভাবাপন্ন হয়েছিলেন; ভক্তিবশত তিনি চোরবাগানে জগন্নাথ মন্দির ও মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন; এই মন্দিরের সংলগ্ন একটি অতিথিশালাও নির্মাণ করান; নামে অতিথিশালা হলেও, এখানে বহু দরিদ্রকে নারায়ণের সেবায় রান্না করা খাবার বিলি করা হত; এখনও (১১৮৮১) কাঙালী ভোজন নিত্যনিয়মিত চলে। রথযাত্রার নয় দিন তিনি সবশ্রেণির বণিকদের এখানে নিমন্ত্রণ করতেন। এই ক’দিন বহু ব্রাহ্মণ পন্ডিত সেবা ও বিদায় পেতেন; প্রতিদিনের দরিদ্রনারায়ণের সেবা তো ছিলই। পুরীতে তাঁর তীর্থযাত্রা দানের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠত। পুরীর গৌরবাড়ীশাহী ও হরচন্ডীশাহীতে আগুন লেগে বহু কুটির পুড়ে যায়। এই দরিদ্র হতভাগ্যদের প্রকৃতির অকরুণ আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে এবং আবার নিজ নিজ কুটির নির্মাণ করে নেবার জন্য তিনি তাদের অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন। সেকালে পুরীতে প্রবেশ করতে হলে তীর্থযাত্রীদের একটা কর দিতে হত। একবার এই কর দিতে না পারায় বহু তীর্থযাত্রী আঠারনালায় আটকে যান; তিনি তখন স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ব্যবস্থা করেন যে, তীর্থযাত্রীদের সমুদয় কর তিনি স্বয়ং দিয়ে দেবেন; ওই করের পরিমাণ শেষ পর্যন্ত এত বৃদ্ধি পায় যে, তাঁর কাছে যে পরিমাণ অর্থ ছিল, তার দ্বারা ওই কর মেটান সম্ভব ছিল না; তখন তিনি স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে তাঁর কলকাতায় অবস্থিত ভাই বৈষ্ণবদাস মল্লিকের নামে প্রদত্ত ড্রাফট নিতে অনুরোধ করেন। বহু ব্যয়ে তিনি দৌতনে জগন্নাথ দেবের একটি নাটমন্দির, নির্মাণ করান। দেউলিয়া আইন এদেশে বিধিবদ্ধ হবার পূর্বে তিনি ঋণের দায়ে কারারুদ্ধ ব্যক্তিদের ঋণের টাকা শোধ করে দিয়ে তাদের কারামুক্ত করেন। সে যুগে বহু গরীব মানুষ এবং সন্ন্যাসী প্রভৃতি ধর্মাশ্রয়ী ব্যক্তি কলকাতায় ভিড় করতেন। এঁদের জন্য তিনি নীলমণি মল্লিক ঘাটের নিকট একটি আশ্রয় নির্মাণ করান; এখানে বর্তমানে তাঁর পুত্রের পান পোস্তা বাজার অবস্থিত। ইষ্টক নির্মিত এই ঘাটটি ছিল সুপ্রশস্ত; এতে পুরুষ ও মহিলাগণের জন্য পৃথক পৃথক ব্যবস্থা ছিল। পুরাতন স্ট্র্যান্ড রোড ও ব্যাঙ্ক রোড নির্মাণের পথ ঘাটটি অব্যবহার্য হয়ে পড়ে। এখানে যে-সব তীর্থযাত্রী আসতেন তাদের শুধু আশ্রয় নয়, অন্ন-পথ্য-বস্ত্রও দেওয়া হত। বৈষ্ণবচরণও সাধু প্রকৃতির ব্যক্তি ছিলেন। ধর্ম-কর্ম ও দানধ্যানে তাঁর সময় কাটত। এই দুই ভাই মিলে পাথুরিয়াঘাটার পৈতৃক আবাসে একটি সদব্রত স্থাপন করেন, সেখানে অনাথ-আতুর সাধুসন্ন্যাসী যে-কেউ দিনের যে-কোন সময় এলে যথোপযুক্ত সিধা পেতেন এবং বাড়ির সামনে পূর্বপুরুষদের আমল থেকেই একটা ঘেরা জায়গায় রান্না করে খেতে পারতেন; জ্বালানি প্রভৃতিও তাঁদের দেওয়া হত। দারিদ্র্যের জন্য যাঁরা মৃত স্বজনের সৎকার করতে পারতেন না, এই দুই ভাইয়ের কাছে এলে তাঁরা সৎকারের খরচও পেতেন– এই শ্রেণীর প্রার্থীর সংখ্যাও কম ছিল না। নিকট আত্মীয়, নির্ভরশীল পরিবার ও প্রতিবেশীদের ছেলেদের শিক্ষার জন্য তাঁরা নিজ ব্যয়ে একটি বাংলা আর একটি ইংরেজি পাঠশালা চালাতেন। এছাড়া, পারিবারিক ধর্মকর্মেও তাঁদের পারিবারিক প্রথাগত জাঁকজমক ও দানের উদার ব্যবস্থা ছিল। পারিবারিক দূর্গাপূজায় জাঁকজমক, দরিদ্রনারায়ণ ও ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণকে সেবা ও দান তো ছিলই, তার ওপর দেশীয় ও ইউরোপীয় বহুসংখ্যক ভদ্রলোককে নিমন্ত্রণ করে আপ্যায়িত করা হত। দূর্গাপূজা উপলক্ষে ১৫ দিন ধরে নাচগানের আসর বসত; এই সব অনুষ্ঠানে বড়লাট, সুপ্রীম কোর্টের জজ প্রভৃতি বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে অনুষ্ঠানের গৌরব বাড়াতেন; গায়ক-গায়িকা ও নর্তক-নর্তকীরাও যথোপযুক্ত উপহারাদি পেতেন। শ্রীপঞ্চমী উপলক্ষে মল্লিক বাড়িতে মাইফেল বসত; প্রথম সারির সঙ্গীতজ্ঞগণ তাতে অংশগ্রহণ করে নিজ নিজ গুণ ও প্রতিভার পরিচয় দিতেন। যোগদানকারী প্রতিটি শিল্পীকেই উদারভাবে ইনাম দেওয়া হত। তিনি ‘ফুল আখড়াই’ গান বাজনা পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। ঐ উচ্চাঙ্গ ও মার্গ সঙ্গীতের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রের ঐকতান থাকত। উপযুক্ত গুণী সঙ্গীতশিল্পীর অভাবে গত পঞ্চাশ বছর যাবৎ এই পদ্ধতি অপ্রচলিত হয়ে গেছে; এর জায়গা নিয়েছে অসংস্কৃত হাফ-আখড়াই পদ্ধতি। সঙ্গীতাচার্য রামনিধি গুপ্তর (সাধারণ্যে নিধুবাবু নামে পরিচিত) জীবনীতে সংক্ষেপে নীলমণি মল্লিকের উক্ত প্রচেষ্টার উল্লেখ আছে। বৈষ্ণবদাসের ঝোঁক ছিল ভিন্নমুখী, তিনি ভালবাসতেন প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য। তিনি এই সাহিত্যের একটি চমৎকার সংগ্রহশালা গড়ে তোলেন। তাঁর আর একটি প্রিয় ঝোঁক ছিল দরিদ্র রোগীদের মধ্যে বিতরণের জন্য সঠিক শাস্ত্রীয় পদ্ধতিতে (আয়ুর্বেদীয়) ওষুধ তৈরি করান। সমসাময়িক স্বজাতিবর্গ এই দুই ভাইকেই অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। তাঁদের মধ্যে বহুজনই বহু সংকটজনক অবস্থায় তাঁদের উচ্চ হৃদয় ও বন্ধুত্বের পরিচয় পেয়েছিলেন; সরকারের খাজনা যথাসময়ে দিতে না পারায় বা ওই ধরনের সংকটে বহু জমিদারী নিলামের মুখে পড়েও তাঁদের আর্থিক সহায়তায় রক্ষা পেয়ে যায়; বন্ধুজনকে ব্যবসায়ে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য তাঁরা অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন; প্রয়োজনে উচ্চস্তরের চাকরি প্রার্থীর জন্য দুই ভাই-ই জামিনদার হতেন। অল্প কথায়, সাধ্যানুসারে তাঁরা অর্থপ্রার্থী সকলকেই সাহায্য করতেন। বিবাদ-বিসংবাদে মধ্যস্থতা করা তো ছিলই।
এঁদের জ্ঞাতিকুটুম্ব বহু পরিবারের এবং পোষ্যবর্গের বর্তমান বংশধরগণ আজও (১৮৮১) পূর্বে-প্রাপ্ত সাহায্যের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন। দলপতি হিসাবে তাঁরা কয়েকটি সংস্কার প্রবর্তন করে আত্মীয়স্বজনসহ বেশ কয়েকটি পরিবারকে সমাজচ্যুতি হতে রক্ষা করেন। নীলমণি মল্লিক পরলোকগমন করেন ১৮২১-এ। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পূর্বে তাঁর আদেশমত ভৃত্যবর্গ তাঁকে তাঁর ঠাকুরবাড়ি নিয়ে যায়, সেখানে প্রার্থনা ও পূজার্চনা করবার পর, তাঁরই আদেশে তাঁকে পূতসলিলা ভাগীরথী তীরে তাঁর ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়, যাবার পথে অন্যান্যর সঙ্গে তিনি নিজেও শাস্ত্রীয় শ্লোক আবৃত্তি করতে থাকেন। শান্তভাবে আপন ও বন্ধুজনের কাছে বিদায় এবং অজ্ঞাতে কোন অপরাধ করে থাকলে তার জন্য সকলের কাছে ক্ষমা চান। উপস্থিত সকলে কান্নায় ভেঙে পড়লে, তিনি তাঁদের কাতর না হয়ে শান্ত হতে এবং তাঁকেও শোকাচ্ছন্ন না করবার জন্য অনুরোধ করেন।
তাঁর খ্যাতি ও যশ এতই প্রসার লাভ করেছিল যে, তাঁর মৃত্যুর ২০/৩০ বছর পরও ভক্তগণ কলকাতা এসে সাহায্যের জন্য তাঁদের পারিবারিক আবাসের সামনে দাঁড়িয়ে ধ্বনি দিত ‘নীলমণি মল্লিক কী জয়’। নীলমণিবাবুর মৃত্যুর ৫৩ বছর পর, ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার তদানীন্তন ছোটলাট বাহাদুরের ব্যক্তিগত সচিব নীলমণি বাবুর একমাত্র পুত্র (পোষ্য পুত্র) রাজা রাজেন্দ্র লাল মল্লিক বাহাদুরকে একখানি চিঠি লিখে জানান, ‘ছোটলাট বাহাদুর আপনাকে জানাইতে চান যে, আপনার পিতা অনাথআতুরের সেবায় যে সকল সৎকার্য করিয়াছেন সে সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ ওয়াকেহাল।’ নীলমণি মল্লিক রেখে যান তাঁর বিধবা পত্নী ও তিন বছর বয়স্ক (পোষ্য) পুত্র রাজেন্দ্রলালকে। কিছুদিনের মধ্যেই এঁরা পাথুরিয়াঘাটার পৈতৃক আবাস ছেড়ে চোরবাগান চলে যান। ভাইয়ের মৃত্যুর পর বহু বছর যাবৎ বৈষ্ণবদাস সংসারের প্রধান ছিলেন; পরিবারের মর্যাদা ও সুনাম তিনি অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন; ঈশ্বরের আশীর্বাদে পুরুষানুক্রমে এই সুনাম ও মর্যাদা অক্ষুণ্ণ আছে। আজও পাথুরিয়াঘাটা ও বৃন্দাবনে তাঁর বংশধরগণ সেই দান ও সেবার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
পরিচিত সকলেই বাবু বৈষ্ণবদাসকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন; ১৮৪১-এর ১০ মার্চ তিনি পরলোকগমন করেন। তাঁর মৃত্যুতে হিন্দুসমাজ মহান একজন ভক্ত হারায়। তিনি রেখে যান পাঁচ পুত্র : বীর নরসিংহ, স্বরূপচন্দ্র, দীনবন্ধু, ব্রজবন্ধু এবং গোষ্ঠবিহারী। এঁরা সকলে একত্রে পৈতৃক বাসভবনে বাস করতেন। জ্যেষ্ঠ বীর নরসিংহ ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যশস্বী ছিলেন। তাঁর সংস্পর্শে যাঁরাই আসতেন তাঁরাই তাঁর মহানুভবতা, প্রজ্ঞা, নৈতিক দৃঢ়তা এবং অন্যান্য সদ্গুণের জন্য তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। বিপদে-আপদে বহুজনই তাঁর পরামর্শ ও সহায়তা চাইতেন, তিনিও সাগ্রহে তাঁদের সাহায্য করতেন। পূর্বপুরুষদের মতো তিনিও আর্থিক সংকটে বা মামলায় জড়িয়ে-পড়া বহু জমিদারকে রক্ষা, দান ও সেবার কাজ অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। পাঁচ ভাই পরস্পরকে খুব ভালবাসতেন; বৈষয়িক ও সাংসারিক কাজকর্ম তাঁরা একমত হয়ে আদর্শভাবে পরিচালনা করতেন। এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দু এবং প্রকৃত ভদ্রলোক ৷ প্রথম মারা যান স্বরূপচাঁদ (২৫ নভেম্বর, ১৮৪৭); তাঁর কোন পুত্রসন্তান ছিল না। বীর নরসিংহের মৃত্যু হয় ২৫ জুলাই, ১৮৪৯। মৃত্যুকালে দুই পুত্র তুলসীদাস ও সুবলদাস বর্তমান ছিলেন। কনিষ্ঠ গোষ্ঠবিহারী একটি শিশুপুত্র রেখে ১৮৫১তে মারা যান। বীর নরসিংহের মৃত্যুর পর মল্লিক পরিবারের এই শাখাঁটির পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে দীনবন্ধু মল্লিকের উপর। তিনিও পূর্বের মতই দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটের পূর্ব প্রান্তটিকে বাড়িয়ে রতন সরকার গার্ডেন লেনের সঙ্গে যুক্ত করেন; অবশ্য, এ-বিষয়ে তাঁর বুদ্ধিমান ভাইপো তুলসীদাসের প্রভূত চেষ্টা ও পারিবারিক চাঁদাও ছিল প্রচুর।
তাঁর মৃত্যুর পর সংসার ও বিষয়কর্মের দায়িত্ব পড়ে চতুর্থ ভাই ব্রজবন্ধুর উপর। তিনি ধর্মপ্রবণ দয়ালু মানুষ ছিলেন। ন্যস্ত দায়িত্ব তিনি সসম্মানে ও যোগ্যতার সঙ্গে পালন করেছিলেন। পরিবারের সকল সুখসমৃদ্ধিরও তিনি ব্যবস্থা করেছিলেন। ক্লাইভ স্ট্রিট এলাকায় একটি নতুন রাস্তা তৈরি করবার জন্য অত্যন্ত মূল্যবান একখন্ড জমি তিনি ছেড়ে দেন। এই রাস্তাটিই ক্লাইভ রো নামে পরিচিত। রাস্তাটির পাশে তিনি কয়েকটি বহুমূল্য অট্টালিকা নির্মাণ করেন। উদারভাবে তিনিও দানে অভ্যস্ত ছিলেন– তাই যোগ্য কারণেই সম্মান অর্জন করেছিলেন। ১৮৬৯-এর আগস্ট মাসে ৫০ বছর বয়সে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তাঁর পাঁচ পুত্র আশুতোষ, গোবিন্দলাল, গোপাললাল, বনমালী এবং মতিলালকে রেখে যান। বীর নরসিংহ মল্লিকের জ্যেষ্ঠপুত্র তুলসীদাস ছিলেন বৈষয়িক ব্যাপারে দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তি। ইংরেজি ভাষায় তাঁর জ্ঞান ছিল প্রগাঢ়, বিচারবুদ্ধিও ছিল গভীর। সাংসারিক বিষয়ে পিতৃব্যদের তিনি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। লোকে প্রায়ই তাঁর পরামর্শ চাইতে আসত, সুপরামর্শ দিয়ে তাঁদের সহায়তা করতে তিনিও সদা প্রস্তুত থাকতেন। সরকার কলকাতায় অনারারী ম্যাজিস্ট্রেটদের বেঞ্চ তৈরি করার পর তিনি হন প্রথম অনারারী ম্যাজিস্ট্রেটদের অন্যতম। দুই পুত্ৰ বলাইদাস ও গয়াপ্রসাদকে রেখে তিনি ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। ব্রজবন্ধুবাবুর মৃত্যুতে মল্লিক পরিবারের প্রধান হন সুবলদাস। অমায়িক বন্ধুবৎসল সুবলদাস সকলকে সাহায্য করতে সদা প্রস্তুত থাকতেন। বন্ধু ও পোষ্যবর্গ তাঁর দয়ামায়ার পরিচয় পর্যাপ্তভাবেই পেতেন। বস্তি উন্নয়নের জন্য স্বেচ্ছায় অগ্রসর হয়ে এদেশীয় ভদ্রলোকদের মধ্যে তিনি উচ্চ আদর্শ স্থাপন করেন। তিনি কলকাতার জাস্টিস অব দি পীস এবং অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান তাঁর এক পুত্র গোপীমোহনকে।
নীলমণি মল্লিকের মৃত্যুর অল্পকাল পরেই, বৈষ্ণবদাস ও নীলমণির বিধবা পত্নীদের মধ্যে শরিকানা মামলা শুরু হয় ১৮২২-এ। নীলমণির পত্নী চার বছর বয়সের পুত্র রাজেন্দ্রের অভিভাবিকারূপে এই মামলার একটি পক্ষ হন। রাজেন্দ্র মল্লিক বয়ঃপ্রাপ্ত না-হওয়া পর্যন্ত মাতাপুত্র চোরবাগানের সংলগ্ন বাড়িতে বাস করতে থাকেন– বাড়িটি নীলমণি মল্লিকই নির্মাণ করেছিলেন। নাবালকের সমস্ত বিত্ত ও সম্পত্তি আদালতের তত্ত্বাবধানে থাকায় ঠাকুরবাটীর ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানের এবং নীলমণি মল্লিক প্রতিষ্ঠিত দান ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যয় নির্বাহ অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ আদালত এসব কাজের জন্য কোন ব্যয় অনুমোদন করেননি। নিদারুণ এই সঙ্কটকালে উন্নতমনষ্ক এই বিধবা নিজস্ব সম্পত্তি হয় বিক্রি বা বন্ধক দিয়ে যথাসাধ্য ওই সব প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ করে থাকেন। তাঁরও দান ও দয়া ছিল আদর্শস্থানীয়। পোষ্যগণের নিকট তিনি ছিলেন মায়ের মতো; তাঁদের অনেককেই তিনি এই শহরে পাকা বাড়ি করে দিয়েছিলেন যাতে তারা ছেলেপুলে নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকতে পারে। যে-সব অন্নপ্রার্থী ও দুঃখী ঠাকুরবাটীতে উপস্থিত হত, তাদের আহার্য্য প্রস্তুত করতে তিনি নিজেও হাত লাগাতেন; দ্বারে আগত প্রতিটি ক্ষুধার্ত মানুষ তৃপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি অনুগ্রহণ করতেন না। রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক বাহাদুরের জন্ম ১৮১৯-এ; তিনি সাবালকত্ব প্রাপ্ত হন ১৮৩৫-এ। (প্রাক্তন) সুপ্রীম কোর্ট নাবালক রাজেন্দ্রের অভিভাবক নিযুক্ত করেন মিঃ (পরবর্তীকালে স্যার) জেমস ওয়েব হগকে। মিঃ হগ্ অতি যত্নসহকারে রাজা রাজেন্দ্রর বিষয়সম্পত্তি রক্ষা ও তাঁর মঙ্গলের দিকে লক্ষ্য রেখেছিলেন। নম্র বিনীত স্বভাবের জন্য রাজা রাজেন্দ্র তাঁর জীবনী সম্পর্কে কিছু জানাতে অস্বীকার করায়, আমরা তাঁর সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরণ দিতে অক্ষম। যা হোক, অন্যান্য সূত্র থেকে আমরা যেটুকু তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি, সেইটুকুই এখানে দেব, তবে আমাদের আশঙ্কা, এতে তাঁর মহান নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের প্রতি সুবিচার করা হবে না।
১৮৬৬-৬৭-র মহা মন্বন্তরে উল্লেখযোগ্য সেবাকাজের জন্য সরকার থেকে তাঁকে প্রথমে ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে রায় বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করা হয়। প্রায় সকলেই জানেন যে, ওই দুর্ভিক্ষের সময় তিনি চোরবাগান ও চিৎপুরে দুটি বিরাট আকারের অন্নসত্র খুলে বুভুক্ষু নরনারীকে ভিক্ষা ও রান্না করা খাবার জোগাতেন। রাজা তাঁর চোরবাগানের আবাসে প্রতিদিন জাতিনির্বিশেষে বহু কাঙালীকে অন্নদান করেন। এই সব দান খয়রাত ও অন্যান্য অনেক মহৎ কাজের জন্য, ইংল্যান্ডেশ্বরীর ভারতসম্রাজ্ঞী উপাধিধারণ উপলক্ষে ১৮৭৭-এর ১ জানুয়ারি কলকাতায় অনুষ্ঠিত দরবারে সাম্মানিক প্রশংসাপত্র দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করা হয়। ১৮৭৮-এর ১ জানুয়ারি উপরাজ ও বড়লাট লর্ড লিটন তাঁকে রাজা বাহাদুর খেতাব দ্বারা সম্মানিত করেন– এই উপলক্ষে তাঁকে একখানি সনদ ও মর্যাদার প্রতীকস্বরূপ খেলারূপে দেওয়া হয় বড় আকারের হীরার আংটিও। প্রকৃতিবিজ্ঞানে তাঁর গভীর জ্ঞানের জন্য তিনি বহু ইউরোপীয় সোসাইটি থেকে মেডেল ও ডিপ্লোমা দ্বারা সম্মানিত হয়েছেন; তিনি এইসব সোসাইটির পত্র-সভ্য।
তাঁর নির্মিত চমৎকার মার্বেল বৈঠকখানাটি প্রাচ্য স্থাপত্য ও বাস্তুবিদ্যার একটি সুন্দর নিদর্শন এই সব বিদ্যায় তাঁর দক্ষতা ও জ্ঞানের প্রমাণ তাঁর এই বৈঠকখানাটি। তিনি একটি পশুশালা করেছেন, এখানে, অবশ্য পশুপক্ষী দুই-ই রাখা হয়। কিছু পশুপাখি তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আনিয়েছেন। পশুশালাটি দেখতে কোন দর্শনী লাগে না; এটি দেখতে শুধু এই শহরের মানুষই নন, দূর-দূরান্ত থেকেও বহু লোক দল বেঁধে আসেন। ইউরোপের এবং এদেশেরও কয়েকজন সম্মানিত ব্যক্তি এই পশুশালা এবং তাঁর দেশীয় শিল্প সংগ্রহ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন।
কলকাতার চিড়িয়াখানাকে তিনি কয়েকটি দামী পশু উপহার দিয়েছেন; সেই সঙ্গে উদারভাবে অর্থ-সাহায্যও করেছেন। এই সকল দানের স্বীকৃতিস্বরূপ ঐ চিড়িয়াখানার একটি অট্টালিকার নাম দেওয়া হয়েছে ‘মল্লিক’স হাউস’। ইউরোপের কয়েকটি পশুশালাকে তিনি মূল্যবান পশুপাখি উপহার দেওয়ায়, ওই সকল প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ তাঁকে মেডাল ও ডিপ্লোমা দিয়ে সম্মানিত করেছেন; তাঁদের কেউ কেউ তাঁকে মূল্যবান পাখিও উপহার দিয়েছেন। তাঁর আবাসগৃহের সংলগ্ন বাগানে এবং কলকাতার উপকণ্ঠ স্থ তাঁর বাগানবাড়িতে তিনি যে দুর্লভ ও বহুমূল্য গাছ লাগিয়েছেন, তা থেকেই বোঝা যায় যে, উদ্ভিদবিদ্যাতেও তাঁর জ্ঞান কত গভীর। তিনি সৌখিন চিত্রশিল্পী এবং উচ্চমানের সঙ্গীতজ্ঞ। সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় ভাল দখল থাকায়, তিনি হিন্দু দেবদেবীর উদ্দেশ্যে ভক্তিমূলক শাস্ত্রীয় সঙ্গীত রচনা করেছেন। ইংরেজি ভাষায় তাঁর কাজ চালাবার মতো জ্ঞান আছে; ফার্সী ভাষায়ও তাঁর মোটামুটি দখল আছে।
তিনি অত্যন্ত ভদ্র, দয়ালু এবং উদারহৃদয়। আত্মীয়, বন্ধু ও প্রতিবেশীদের তিনি ভালবাসেন। তাঁর পোষাক-পরিচ্ছদ অত্যন্ত সাদাসিধা; এমনিতে তিনি নিরামিষাশী,– তবে অসুস্থ হয়ে পড়লে এবং চিকিৎসক তেমন পরামর্শ দিলে, তিনি মাছ আহার করেন। তিনি একান্তভাবেই ধর্মাশ্রয়ী; তাই, তাঁর দুটি বয়ঃপ্রাপ্ত সুশিক্ষিত পুত্র কুমার গিরীন্দ্র ও কুমার সুরেন্দ্র মারা গেলে তাঁর শোকের আদৌ কোনো বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। যেসব বন্ধু ও আত্মীয় তাঁর এই শোকে সমবেদনা জানতে গিয়েছিলেন, তাঁরা তাঁর নৈতিক দৃঢ়তা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন; তাঁরাই বরং তাঁর কাছে মৃত্যু ও ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ উপদেশ লাভ করেন।
কয়েকটি নূতন রাস্তা নির্মাণ করে চোরবাগান পল্লীটির উন্নয়নের জন্য তিনি সরকারের হাতে কোনপ্রকার মূল্য বা ক্ষতিপূরণ না নিয়ে স্বেচ্ছায় কয়েক খন্ড জমি তুলে দেন। জনস্বার্থে এই দানের জন্য তাঁকে অনেকেই ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন বলে মনে হয়।
রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক বাহাদুরের চিকিৎসা শাস্ত্রে কিছু জ্ঞান আছে। গরীবদের প্রতি দয়াবশত তিনি বাড়িতেই ওষুধ তৈরি করিয়ে, অভিজ্ঞ চিকিৎসকগণ দ্বারা পরীক্ষা করিয়ে, গরীবদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করেন। এ বিষয়ে তাঁর পিতা দাতব্য চিকিৎসার যেসব ব্যবস্থা করেছিলেন, তার ওপর তিনি জ্বরের মহামারী রোধের জন্য পেটেন্ট অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ, সিভিল সার্জনদের মত নিয়ে বিতরণ করেন। সাহায্যের আশায় শত শত লোককে আমরা প্রতিদিন তাঁর দরজায় উপস্থিত হতে দেখি। ঈশ্বর এই মহান মানবপ্রেমিক ও যোগ্য নাগরিককে দীর্ঘ জীবন দান করুন– এই কামনা।
তাঁর জীবিত চার পুত্র কুমার দেবেন্দ্র মল্লিক, কুমার মহেন্দ্র মল্লিক, কুমার যোগেন্দ্র মল্লিক এবং কুমার মানেন্দ্র মল্লিক তাঁদের সৎ ও শ্রদ্ধেয় পিতার বহু সদগুণের অধিকারী। জ্যেষ্ঠ কুমার দেবেন্দ্র মল্লিকের ইংরেজি ভাষায় গভীর জ্ঞান আছে। সংস্কৃতও তিনি জানেন। তিনি কলকাতা পুলিশের অনাররী ম্যাজিস্ট্রেট এবং জাস্টিস অফ দি পীস; এ ছাড়াও তিনি কলকাতার বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সভ্য। পিতার মতই তাঁরও চিত্রাঙ্কন ও বাস্তুবিদ্যায় বিশেষ দক্ষতা আছে। তাঁর পুত্র কুমার নগেন্দ্র ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষাদুটি ভালভাবেই শিখেছেন। পুত্র ও পৌত্রগণসহ রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক বাহাদুর অত্যন্ত নিষ্ঠাবান হিন্দু। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে তাঁদের প্রতিদিন অনেকখানি সময় অতিবাহিত হয়। তাঁর ছেলেরা ও পরিবারের অন্য সকলে ঠাকুরবাটী গিয়ে শাস্ত্রানুযায়ী প্রার্থনাদি করেছেন কিনা রাজা বাহাদুর প্রতিদিন সকালে নিয়মমত সে খোঁজ নেন।