শ্যামবাজারের দেওয়ান কৃষ্টরাম বসুর পরিবারবর্গ
হুগলী জেলার তারা গ্রাম নিবাসী দয়ারাম বসুর পুত্র কৃষ্টরাম ১৬৫৫ শকাব্দের ১১ পৌষ বা ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন । পারিবারিকভাবে বিপর্যস্ত দয়ারাম তারা ত্যাগ করে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন, কিন্তু পথে হুগলী জেলার বালতিতে যাত্রা-বিরতি করে ওখানেই বসবাস করতে থাকেন । কিশোর কৃষ্টরাম হিন্দু ধর্ম ও পুরাণের বহু কাহিনী বলে ভগ্নহৃদয় পিতাকে সান্ত্বনা দিতে থাকেন । একদিকে পিতৃভক্তি, অন্যদিকে এই ১৪/১৫ বছর বয়সের বালকের মধ্যে হিন্দু ধর্ম ও শাস্ত্রে গভীর জ্ঞান দেখে স্থানীয় অধিবাসীরা অত্যন্ত বিস্মিত হন । বাণপ্রস্থী এক সন্ন্যাসী কৃষ্টরামের দেহ-লক্ষণ দেখে তাঁকে দীক্ষা দিতে উৎসুক হয়ে ওঠেন। দয়ারামের অনুমতি নিয়ে সন্ন্যাসী তাঁকে দীক্ষা দিয়ে স্বীয় শিষ্য করে নেন ।
কলকাতা এসে কৃষ্টরাম দেখলেন আর্থিক দিক দিয়েও পিতার সেবা করা প্রয়োজন; ইতিমধ্যে তিনি হিসাবশাস্ত্রেও বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন । পিতার কাছ থেকে কিছু অর্থ চেয়ে নিয়ে কৃষ্টরাম স্বাধীন ব্যবসা শুরু করলেন । এই সময় তাঁর একটা মস্ত সুযোগ এসে গেল । জনগণের জন্য প্রেরিত লবণের একটা পুরো সরকারি চালান কৃষ্টরাম কিনে নিয়ে গুদামজাত করলেন । এতে এক দফাতেই তাঁর লাভ হল ৪০,০০০ টাকা । উৎসাহিত হয়ে তিনি ফাটকার ব্যবসয়ে নেমে পড়লেন; অল্পকালের মধ্যেই তিনি বিপুল অর্থের অধিকারী হলেন । এখন তিনি ব্যবসা ত্যাগ করে, সরকারের অধীনে একটি চাকুরি খোঁজ করতে লাগলেন । সুযোগও এসে গেল । অনারেবল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে তিনি মাসিক ২,০০০ টাকা বেতনে হুগলীর দেওয়ান পদ লাভ করলেন । যোগ্যতার সঙ্গে এই চাকুরি কয়েক বছর করবার পর, পদত্যাগ করে তিনি কলকাতা চলে এসে শ্যামবাজারে বসবাস করতে লাগলেন । এখানে এখনও তাঁর বংশের কেউ কেউ বাস করেন, অন্যেরা বাংলা ও ওড়িশার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছেন । তখন কলকাতার কোটিপতিদের অন্যতম কৃষ্টরাম, ইতিমধ্যে যশোর, হুগলী ও বীরভূমে জমিদারী কিনেছেন। তাঁর সহৃদয়তা ও দান দুই-ই ছিল অতুলনীয় । একবার লাভ করবার জন্য তিনি ১,০০,০০০ টাকার চাল কিনে মজুত করেছিলেন । মজুত ভান্ডারের একটা দানাও বিক্রি হবার পূর্বে দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় ৷ তখন লাভ করার বাসনা ত্যাগ করে তিনি অন্নসত্র খুলে জাতিধর্ম নির্বিশেষে অন্নক্লিষ্ট সকল মানুষকে অন্নদান করতে থাকেন। এই একইভাবে তিনি আরও কয়েকবার মানবতার সেবায় নিজ স্বার্থ ত্যাগ করেন । সব কাজ থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি জনগণ ও সাধু সেবায় আত্মনিয়োগ করেন । এবং জনগণ যাতে তাঁকে মনে রাখেন তার জন্য তিনি দানধ্যানও করেন। মহাধুমধামের সঙ্গে দূর্গাপূজা করতেন । কথিত আছে বিসর্জনের পর গঙ্গার ঘাট থেকে তাঁর বাড়ি পর্যন্ত (এক মাইল অপেক্ষাও কম) পথে যে-কেউ.. তাঁকে পূর্ণকলস দেখাত তাঁকেই তিনি একটি করে টাকা দান করতেন; সাধারণত সাত আট হাজার মানুষ তাঁর ঘাট থেকে ফেরার পথের দুধারে সার বেঁধে বসে থাকত—- তাঁর দানস্বরূপ কত অর্থ ব্যয় হত এর থেকে তার একটা অনুমান করা যায় । তাঁর পুত্র পৌত্রাদির মধ্যেও এই প্রথা প্রচলিত ছিল, তারপর অবস্থা অনুযায়ী পরিমাণ কমতে থাকে– প্রথমে আট আনা, পরে দানের পরিমাণ দাঁড়ায় কলসি প্ৰতি চার আনা ।
দেওয়ান কৃষ্টরামের দান শুধুমাত্র কলকাতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বাংলা, বিহার, ওড়িশা এবং উত্তর পশ্চিম প্রদেশেও তাঁর দানকার্য বিস্তৃত ছিল। নিচে আমরা তার সামান্য কিছু বিবরণ দিচ্ছি ।
মাহেশে মহাধুমধামের সঙ্গে তিনি জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা সম্পন্ন করেন; এই উৎসব আজও তাঁর বংশধরগণ চালিয়ে যাচ্ছেন । যশোরে মদনগোপাল জীউর এবং বীরভূমে রাধাবল্লভ জীউর মন্দির প্রতিষ্ঠা করে নিযুক্ত সেবাইতকে পূজার্চনা চালাবার জন্য তিনি ভূসম্পত্তি দান করেন। তিনি বারাণসীতে কয়েকটি শিব মন্দির এবং ভাগলপুর জেলার জাহাঙ্গীরা গ্রামের নিকট গঙ্গার মধ্যে উচ্চতম পাহাড়টির উপর বিরাট ও অত্যন্ত সুন্দর একটি মহাদেব মন্দির নির্মাণ করেন; এই সকল মন্দিরের পূজার্চনা যাতে চলতে পারে, সম্পত্তি দান করে তারও ব্যবস্থা তিনি করেন । হুগলী জেলার তারা থেকে মধুরাবাটি পর্যন্ত তিনি একটি রাস্তা নির্মাণ করান– রাস্তাটি কৃষ্ট জাঙ্গাল নাম পরিচিত; গয়ার রামশীলা পাহাড়ে তিনি সিঁড়ি নির্মাণ করিয়ে দেন, যাতে পিন্ডদানেচ্ছু হিন্দুগণ সহজে পাহাড়ে উঠতে পারেন। কটক থেকে পুরী পর্যন্ত বিশ ক্রোশব্যাপী পথের উভয় পার্শ্বে তিনি আম গাছ লাগিয়েছিলেন, যাতে তীর্থযাত্রীরা ছায়া ও ফল পেতে পারেন । পুরীতে প্রবেশ পথের পাশে, জগন্নাথ দেবের মন্দিরের নিকট একটি দীঘি খনন করান এবং পুরীতে জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রার রথযাত্রায় বার্ষিক ব্যয় নির্বাহ করবার জন্য তিনি পুরীর রাজার কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত রাখেন ।
দান, ধর্মানুষ্ঠান ও পরোপকারে দিন যাপন করে ৭৮ বছর বয়সে কৃষ্টরাম পরলোকগমন করেন । মৃত্যুকালে তাঁর দুই পুত্র মদনগোপাল ও গুরুপ্রসাদ জীবিত ছিলেন । পিতার মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পর মদনগোপালের মৃত্যু হয় । এর বংশধরগণ বাংলার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়লেও, এঁদের সম্পর্কে আমাদের বিশেষ কিছু জানা নাই ৷
গুরুপ্রসাদের তিন স্ত্রী; প্রথমার কোন সন্তান ছিল না; দ্বিতীয়া স্ত্রীর গর্ভজাত তিন পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ কালাচাঁদ বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন; কালাচাঁদের একমাত্র পুত্র রাজেন্দ্রনারায়ণ পিতার জীবিতকালেই মারা যান । রাজেন্দ্রনারায়ণের তিন পুত্র বিশ্বম্ভর, রাধারমণ ও কৃষ্টচন্দ্র । রাধারমণ মারা গেছেন । বিশ্বম্ভরের আর্থিক অবস্থা বেশ সচ্ছল, তিনি শ্যামবাজারে বাস করেন । কনিষ্ঠ কৃষ্টচন্দ্র দাদার মতই বিনয়ী ও বুদ্ধিমান; তিনি এখন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ছেন ।
দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ও তাঁর সন্তানদের শ্যামবাজারে রেখে, গুরুপ্রসাদ তাঁর তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী ও তাঁর সন্তানদের নিয়ে ওড়িশায় চলে যান । সেখানে বালেশ্বর জেলার ভদ্রক মহকুমায় একটি জমিদারী কিনে সপরিবারে বাস করতে থাকেন । কয়েকবছর পর কটক জেলার জাজপুরে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুকালে বর্তমান ছিলেন তাঁর দুই পুত্র বিন্দুমাধব এবং রাধামাধব ।
বিন্দুমাধবের তিন পুত্র, রায় নিমাইচরণ বসু বাহাদুর, হরিবল্লভ বসু বিএ, এ এল এবং অচ্যুতানন্দ বসু। নিমাইচরণ জমিদারী দেখাশোনা করেন; তিনি কোঠারের অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট; কয়েকটি ক্ষেত্রে তাঁর দানের জন্য (সরকার) তাঁকে রায় বাহাদুর খেতাব দান করেন। মধ্যম পুত্র হরিবল্লভ বসু এখন কটকে সরকারি উকিল । কনিষ্ঠ অচ্যুতানন্দ কলকাতায় স্বাধীন জীবন যাপন করেন । এই তিন ভাই-ই খ্যাতিমান ।
রাধামোহন বসুর বয়স ৬৫, এখনও তিনি সংস্কৃত ভাষা ও ধর্মালোচনায় ব্যাপৃত থাকেন । তাঁর দুই পুত্র বলরাম ও সাধুপ্রসাদ । জ্যেষ্ঠ বলরাম যৌবনেই পিতার ন্যায় ধর্মকর্ম নিয়ে লোকলোচনের আড়ালে থাকতে চান; আর কনিষ্ঠ সাধুপ্রসাদ বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজের মেধাবী ছাত্র ।