স্বাধীনতা ও বিশ্ববিদ্যালয়
শৃঙ্খলিত সিংহের চেয়ে স্বাধীন গাধা উত্তম। শৃঙ্খল মানুষকে, যে-কোনো প্রাণীকে, রোধ ও বিনাশ করে; স্বাধীনতা বিকশিত করে। মানুষের মুখ্য লক্ষণ সৃষ্টিশীলতা, যার অন্য নাম প্রতিভা; ওই সৃষ্টিশীলতার, প্রতিভার, বিকাশের প্রথম শর্ত স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন। স্বাধীনতা শুধু রাজনীতিক হ’লে চলে না; তথাকথিত স্বাধীন রাষ্ট্রের অধিবাসীমাত্রই যে স্বাধীন এমন নয়, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তরকালে এ-গ্রহের মাঠেঘাটে জন্ম নিতে থাকে নতুন পতাকাখচিত রাষ্ট্র, এবং তাদের অধিবাসীরা অধীন হয়ে পড়ে দেশি ঔপনিবেশিকদের। তাই এমন ব্যাপার বেশ সুলভ হয়ে উঠেছে এখন যে রাষ্ট্রটি স্বাধীন, কিন্তু তার অধিবাসীরা স্বাধীনতাহীন। এমন অবস্থা ক্ষতিকর পরাধীনতার চেয়েও, কেননা রাজনীতিক পরাধীনতার মধ্যে যে-দ্রোহ ও স্বাধীনতাস্পৃহা থাকে জাতির চেতনাস্রোতে, ছদ্মস্বাধীনতায় তাও থাকে না। ছদ্মস্বাধীনতা নষ্ট করে সব কিছু;- দ্রোহ, স্বাধীনতাস্পৃহা, মেধা ও প্রতিভা। স্বাধীন দেশে স্বাধিকারহীনতা এক ভয়াবহ ব্যাপার, তাতে সমগ্র জাতি পরিণত হয় দাসে বা জন্তুতে, এবং এক সময় তা বিলুপ্ত হ’য়ে যেতে বাধ্য। এমন দেশে স্বাধীনতা পায় একমুঠো মানুষ, যারা শক্তিমান কিন্তু প্রতিভাবান নয়; সারা দেশে হয়ে ওঠে তাদের স্বেচ্ছচারের লীলাভূমি। কিন্তু যে-কোনো জাতির বিকাশের জন্যে অপরিহার্য স্বাধীনতা আর স্বায়ত্তশাসন। কোনো রাষ্ট্রে কেউ হবে অবাধ স্বাধীন, আর বিপুল জনমণ্ডলি হবে পরিমিতভাবে স্বাধীন, এমন অবস্থা জাতির দুরারোগ্য ব্যাধির লক্ষণ। রেশন করা স্বাধীনতা পরাধীনতার চেয়েও অনিষ্টকর।
একটি জাতি কতোটা উন্নত ও সৃষ্টিশীল, তার মাপকাঠিরূপে ব্যবহার করা যায় স্বাধীনতাকে;– ওই জাতি কতোটা ভোগ করে স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন, তার পরিমাণ জানলে পরিমাপ করা সম্ভব তার উন্নতি ও সৃষ্টিশীলতার মাত্রা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও জাতির দিকে তাকালে স্পষ্ট প্রতিভাত হয় যে উন্নত জাতিমাত্রই বিপুল স্বাধীনতাভোগী; আর অনুন্নতরা বেঁচে আছে রেশন করা স্বাধীনতা-স্বায়ত্তশাসনে। একটি জাতি ও রাষ্ট্র অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের সমষ্টি;- মানুষ জীবনের প্রয়োজনে গ’ড়ে তোলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, মুদির দোকান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভবপ্রতিষ্ঠার মূলে আছে জীবনের চাহিদা। প্রতিষ্ঠানের জন্যে জীবন নয়, জীবনের জন্যে প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয় ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অনন্য : বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাংক নয়, জীবনবীমা সংস্থা নয়, আমদানিরপ্তানির প্রতিষ্ঠান নয়, নয় এমনকি মন্দির-মশজিদ-গির্জা। সমস্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পবিত্রতম ও সর্বজনীনতম। ব্যাংক, বীমাসংস্থা, আমদানিরপ্তানি কেন্দ্র, ও অজস্র পার্থিবতামুখি প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, কিন্তু তার সাথে মহত্ত্বের, পবিত্রতার সম্পর্ক কেউ খোঁজে না। উপাসনালয়ের সঙ্গে পবিত্রতার ভাবনা জড়িত হয়ে আছে প্রথাগতভাবে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তারও উর্ধ্বে, কেননা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বমানবের; মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ- খ্রিস্টান ও অজস্র ধর্মাবলম্বীর; বর্ণের, গোত্রের ও শ্রেণীর। বিশ্ববিদ্যালয় এমন আরাধনাস্থল যেখানে মিলিত সবাই, আর ওই আরাধনাভবনে যার আরাধনা করা হয়, তার নাম জ্ঞান। আমি ব্যক্তিগতভাবে মহৎ ও পবিত্র শব্দগুচ্ছের মহিমা সাধারণত স্বীকার করি না, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মহৎ ও পবিত্রতা বোঝানোর জন্যে এদের চেয়ে অর্থময় শব্দ আমার জানা নেই।
তাই স্বীকার ক’রে নিতে হয় যে জাতির প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য, তা পৃথক অন্যান্য পার্থিব প্রতিষ্ঠান থেকে। যারা এ-সত্য স্বীকার করে না, বিশ্ববিদ্যালয় ও বীমাসংস্থাকে চালাতে চায় একই বিধিতে, তারা ভ্রান্ত, জাতির জন্যে ক্ষতিকর। আপাতদৃষ্টিতে বীমাসংস্থা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে, কেননা প্রথম প্রতিষ্ঠানটি অর্থকরী, আর দ্বিতীয়টি শুধুই অর্থ ব্যয় করে। দ্বিতীয়টি সৃষ্টি করে জ্ঞান, যা সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ মানুষের। জ্ঞান সৃষ্টি, সম্প্রচার, বিভিন্ন প্রতিযোগী জ্ঞানের মধ্যে বিতর্ক, বিচার ও পরিশেষে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া লক্ষ্য ও দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের। বিশ্ববিদ্যালয় বলতে দালানকোঠা, কলা বা বিজ্ঞানভবন, গ্রন্থাগার, গবেষণাগার ও অন্যান্য সহায়ক উপকরণ বোঝায় না, এগুলো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত সম্পদ নয়; বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত সম্পদ জ্ঞান, যার চর্চা হয় কিছু দালান- ভবন-গবেষণাগারে। জ্ঞানচর্চার জন্যে স্বাধীনতা অপরিহার্য; কেননা সত্য কোনো রাষ্ট্রিক বিধি, সামাজিক নিষেধ, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে না। জ্ঞান ও তার সত্যের সাথে মিল নাও হ’তে পারে প্রথাগত সামাজিক, রাষ্ট্রিক, ধর্মীয় বিশ্বাসের; এবং না হওয়াই স্বাভাবিক, কেননা প্রথা এড়াতে না পারলে জ্ঞানের অগ্রগতি অসম্ভব। যে-জ্ঞান প্ৰথাপরিক্রমায় ব্যস্ত, তা কোনো জ্ঞান নয়। সভ্যতার ইতিহাস প্রথা ও মুক্তজ্ঞানের সংঘর্ষের কাহিনীতে পরিপূর্ণ। যুগে যুগে দেখা গেছে প্রথা ও প্রথাবাদীরা নতুন জ্ঞানান্বেষীদের পীড়ন করেছে হিংস্রভাবে, কিন্তু তাতে ভবিষ্যৎমুখি জ্ঞান আর সত্য পরাস্ত হয় নি। এককালের জ্ঞান পরবর্তীকালে প্রথা, সংস্কার, ও অন্ধবিশ্বাসে পরিণত হ’তে পারে; বাধা দিতে পারে জ্ঞানচর্চায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব হচ্ছে স্বাধীনভাবে জ্ঞানচর্চার জলবায়ু তৈরি ক’রে রাখা, যাতে কোনো বিশ্বাস, স্বার্থ, সংস্কার কারাগারে তুলতে না পারে। এ-স্বাধীন জ্ঞানচর্চার জন্যে স্বাধীনতা-স্বয়ত্তশাসন প্রথম শর্ত; রাষ্ট্র ও সমাজকে মেনে নিতেই হবে যে তার বিশ্ববিদ্যালয় নামক যে-অনন্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাকে দিতে হবে অপার স্বাধীনতা। এ-জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় মাত্রই রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র; দেশের ভেতরে সবচেয়ে মুক্ত, স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত পরিমণ্ডলের নাম বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় যে রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র, তা দেশ ও সমাজের স্বার্থেই।
কেনো বিশ্ববিদ্যালয়ের দরকার এতা স্বায়ত্তশাসন, প্রয়োজন রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র হওয়া? এমন বৈশিষ্ট্য অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নয়, কিন্তু কেনো প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ের? উন্নত দেশগুলো, যাদের কয়েক শতাব্দী ধ’রে ধারাবাহিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে, স্বীকার ক’রে নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন। কী পড়ানো হবে, কে পড়াবেন, কাদের পড়াবেন, ও কীভাবে পড়াবেন ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার ওই সমস্ত দেশে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের, তাতে রাষ্ট্র বা সমগ্র সমাজ প্রভাব বিস্তার করতে উদ্যত হয় না। ওই সব রাষ্ট্র জ্ঞানীদের ওপর আস্থা পোষণ করে, এবং তাঁদের সিদ্ধান্তকেই শিরোধার্য ক’রে নেয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের একরকম ঐতিহাসিক অধিকার। কিন্তু কোনো অধিকার একবার পাওয়া গিয়েছিলো ব’লেই যে তা চিরকাল পাওয়া যাবে, এমন নয়; বরং এখন দেখা যায় ঐতিহাসিক অধিকারই বর্তমান অধিকারের বিরুদ্ধে যায়। এখন কোনো চুক্তি বা সংবিধানের ওপর বেশি ভরশা করা যায় না, যে-কোনো সময় তা বাতিল হয়ে যেতে পারে; তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাব্দীপরম্পরার অধিকারের দাবি বেশি শক্তিশালী নয়।
এবার অন্যভাবে বিচার করা যেতে পারে প্রসঙ্গটি;- বাস্তব মানদণ্ড প্রয়োগ ক’রে দেখা যেতে পারে স্বাধীনতা-স্বয়ত্তশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাপ্য কি না? বিচার ক’রে দেখতে পারি স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চা ও সমাজরাষ্ট্রের জন্যে বেশ উপকারী, না কি পর্যুদস্ত, শৃঙ্খলিত, অবরুদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় বেশি উপকারী? কালপরম্পরায় দেখা গেছে স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রের ও সমাজের যতো উপকারে এসেছে, নিত্য নতুন জ্ঞানসৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে, পর্যুদস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে তা হয় নি। এজন্যে দেখা যাবে পর্যুদস্ত রাষ্ট্রের পর্যুদস্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু সাক্ষরশ্রেণী সৃষ্টি করেছে, বিভিন্ন উপাধি বিতরণ করেছে নানা বিমর্ষ পরীক্ষা ভিত্তি ক’রে, এর বেশি পারে নি; আর স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যাগুলো সমৃদ্ধ করেছে বিশ্বকে ও নিজের সমাজকে নতুন জ্ঞানসম্পদে। পর্যুদস্ত বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে সরকারি প্রতিষ্ঠান, আর স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয় সমগ্র জাতিকে সঞ্জীবিত করে রাখে। তাই রাষ্ট্র ও জাতির অস্তিত্বের প্রয়োজনেই স্বীকার ক’রে নিতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন। যে-জাতি ও রাষ্ট্র তা করে না, তা আত্মহত্যাকেই শ্রেয় ব’লে গণ্য করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের কোনো শক্তি নেই স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত থাকার; বিশ্ববিদ্যালয় এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নয় যে তার নিজস্ব অর্থকোষ আছে, নিজের প্রয়োজন নিজেই মেটাতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নয় যে তার নিজস্ব রক্ষীবাহিনী আছে, আছে বিমান-নৌ-পদাতিক বাহিনী, এবং প্রতিহত করতে পারে যে-কোনো আক্রমণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব কিছুই নেই; তাকে, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে, সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল থাকতে হয় রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর। এখন খুব কম বিশ্ববিদ্যালয়ই আছে, যা আপন ব্যয় নির্বাহ করতে সক্ষম। রাষ্ট্র অর্থ না যোগালে পৃথিবীর অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় একমাসের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু সারা রাষ্ট্রে একটিও বিশ্ববিদ্যালয় নেই, এমন রাষ্ট্র অকল্পনীয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় দরকার আপন প্রয়োজনে, এবং সমাজ-রাষ্ট্র-সভ্যতাকে অধিক মাত্রায় সেবা করার সুযোগ দেয়ার জন্যেই সমাজ-রাষ্ট্র মেনে নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন। তাই স্বায়ত্তশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকার নয়, তা সমাজ-রাষ্ট্র কর্তৃক স্বেচ্ছায় অর্পিত অধিকার। কিন্তু কোনো সমাজ-রাষ্ট্র যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বাধীনতা স্বায়ত্তশাসন দিতে প্রস্তুত না থাকে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানান্বেষীদের সামনে খোলা থাকে দুটি পথ। প্রথমত, তাঁরা বেছে নিতে পারেন আত্মবিনাশ, অথবা প্রতিরোধ করতে পারেন সমাজ-রাষ্ট্রের অপসিদ্ধান্ত। বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে পারে অবরুদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়, যাকে ঘিরে থাকতে পারে শক্তিমান জ্ঞান ও সমাজ বিরোধীরা। সমাজ-রাষ্ট্র-সভ্যতার ভবিষ্যৎ স্মরণে রেখে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্য হয়ে ওঠে স্বায়ত্তশাসনবিরোধীদের প্রতিহত করা। অবরুদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় অবরুদ্ধ নগরের মতোই শ্রদ্ধেয়। যে-বিশ্ববিদ্যালয় নিজের স্বাধীনতা স্বায়ত্তশাসন রক্ষার পুণ্য সমরে না নেমে নিজের স্বাধীনতা অর্পণ করে অন্ধকারের পশুদের পদতলে, তার ওপর সভ্যতার ও মানুষের সমস্ত অভিশাপ বর্ষিত হওয়া উচিত। অমন বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চায় নয় নিয়োজিত পতিতাবৃত্তিতে, যেমন নিয়োজিত হয়েছিলো বন বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৭-এ হিটলারের আদেশে টমাস মানের ডিগ্রি কেড়ে নিয়ে। জর্মন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তখন ছিলো হিটলারের রক্ষিতা, নাটশিদের তুষ্টিবিধান ছিলো তাদের লক্ষ্য; এবং এর ফলে পতনই হয়ে ওঠে জর্মন জাতির নিয়তি।
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় লালন করে দ্বৈত আনুগত্য; তার আনুগত্য নিজের সমাজের প্রতি, ও বিশ্বমানবের প্রতি। যে-সমাজ পালন করছে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে, তার প্রতি যে বিশেষ কর্তব্য আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের, তা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। আপন সমাজের প্রতি দায়িত্বপালনের সুবিধার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে হয় এমন কিছু বিশেষ সুযোগসুবিধা ও অধিকার, যা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে দায়িত্বপালন অসম্ভব। এমন বিশেষ অধিকার অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় নয়, কিন্তু একান্ত প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ের। তাই বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েও এক স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। স্বতন্ত্র রাষ্ট্রত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের দোষ নয়, গুণ। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব রয়েছে সমগ্র সভ্যতা ও মানবমণ্ডলির প্রতিও। বাঙলা ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দটির আক্ষরিক তাৎপর্য অনুধাবনযোগ্য; এটি বিশ্বের বিদ্যালয়, এখানে চর্চা হয় বিশ্বজ্ঞান। জ্ঞানের বিচিত্র রূপ ও বহুমুখি বিকাশের এলাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশুদ্ধরূপে জ্ঞান দেশ-সমাজ এমনকি মানব-নিরপেক্ষ। বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের চর্চা করা যায় কোনো দেশ-সমাজ- ও মানুষকে স্মরণে না রেখে; এবং এর যা ফল, তা বিশ্বমানবেরই কল্যাণে আসে। বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নয়, এমনকি পেশাদার বিদ্যার বিদ্যালয়ও নয়। শুধু জীবিকা উপার্জনের শিক্ষা দেয়াই লক্ষ্য নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের। সংস্কারহীন জ্ঞানচর্চা, তার সম্প্রচার ও বিচারবিবেচনার স্থান বিশ্ববিদ্যালয়। সমাজ-রাষ্ট্রের বহু এলাকা আছে, যেখানে মুক্ত চিন্তা গ্রহণযোগ্য নয়। উপসনালয় তার ধর্মবিরোধী চিন্তা সহ্য করে না, সচিবালয়ে সহ্য করা হয় না. ক্ষমতাসীন দলের গৃহীত মতের বিরোধী চিন্তা; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরোধী, প্রথাবিরোধী চিন্তাভাবনারই বিকাশ ঘটে বহুমুখে। এর জন্যে দরকার স্বাধীনতা স্বায়ত্তশাসন, যাকে বিবেচনা করতে পারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেকড়ের জল ব’লে, যার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয় শুষ্ক বৃক্ষে, আর সচ্ছলতায় শত ভাবনার ফুলফল ধরে শাখায় শাখায়। আমরা কি মৃত গাছ চাই, না কি চাই ফলফুলভারাবনত সবুজ সমৃদ্ধ বৃক্ষ?
প্রশ্ন উঠতে পারে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কতোটা সাফল্য অর্জন করেছে জ্ঞান চর্চায়, কোন অসাধারণ জ্ঞান প্রথম বিকশিত হয়েছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে? আমাদের অধ্যাপকেরা জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৌলিক গবেষণা করতে সমর্থ হয়েছেন কতোখানি? এমন সব প্রশ্নের উত্তর বেশ বুক ফুলিয়ে দেয়া সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে; আমাদের অধ্যাপকেরা দাবি করতে পারবেন না যে পদার্থবিজ্ঞানের একটি বিশেষ মৌলিক তত্ত্ব তাঁরাই উদ্ভাবন করেছেন, বা আবিষ্কার করেছেন সমাজবিজ্ঞানের কোনো মূলসূত্র, বা মানববিদ্যায় তাঁরা নতুন পথনির্দেশ করেছেন। এমন দাবি তাঁদের পক্ষে করা অসম্ভব। তাঁরা যে তাঁদের মেধা দিয়ে সভ্যতাকে আরো উজ্জ্বল করতে পারেন নি, তার বহু কারণের দুটি হচ্ছে স্বাধীনতা স্বায়ত্তশাসনের অভাব, ও মৌলিক মহৎ গুরুত্বপূর্ণ কিছু করার সুযোগের অভাব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার বিধিসমূহ, ১৯২১ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত, লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে বিধিপ্রণেতারা বিশ্ববিদ্যালয়কে এক রকম প্রাথমিক বিদ্যালয় ব’লেই ভেবেছেন। সমাজের সমস্ত শ্রেণীর লোক কর্তৃত্ব করার জন্যে ছুটে এসেছে, খ্যাতি পেতে চেয়েছে সমাজসেবক ও শিক্ষাবিদের, এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিণত করেছে তাদের দর্প দেখানোর আরো একটি ক্ষেত্রে। গৌণ থেকে গেছেন শিক্ষক ও ছাত্ররা। ব্রিটিশ যুগে তবুও কিছুটা স্বায়ত্তশাসন ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, কিন্তু পাকিস্তানকালে তা পরাধীন হয়ে ওঠে; এবং ষাটের দশকে প্রণীত বিধিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা হয়ে ওঠেন রাষ্ট্রপরিচালকদের দাস। এমন দাসত্ব মৌলিক জ্ঞানচর্চার পরিপন্থী। তবু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অব্যাহত রেখেছেন জ্ঞানচর্চার ধারা।
‘শিক্ষক’ সম্পর্কে আমাদের সমাজ বেশ ভণ্ড, রহস্যজনক, ও পীড়নকারী মনোভাব পোষণ করে। একটি বুলি, ‘শিক্ষকেরা শ্রদ্ধেয়’, খুবই শোনা যায় আমাদের সমাজের চারদিকে; কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় বিপরীত আচরণ। কেউ কারো চেয়ে সহজাতভাবে বা পেশাগতভাব বেশি শ্রদ্ধেয় হ’তে পারে না, তবু শিক্ষক জ্ঞান দিয়ে থাকেন ব’লে বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠতে পারেন জ্ঞানার্থীর কাছে। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্র শিক্ষকদের সাথে যে-আচরণ করে, তাতে শ্রদ্ধার মাত্রাধিক্য ঘটে না, বরং পীড়নকারী মনোভাবই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমাদের সমাজ শিক্ষকদের অসহায় ও দরিদ্র দেখতে পছন্দ করে, যেনো শিক্ষকের দারিদ্র্যই তার শ্রদ্ধেয় হওয়ার চাবিকাঠি। কিন্তু দরিদ্রকে কেউ সম্মান করে না, তাই দরিদ্র শিক্ষককেও করে না। প্রাথমিক-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কথা ছেড়েই দেয়া যায়, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা বড়ো অংশ বাধ্য হন যে-জীবনযাপনে, তা জ্ঞানসাধনার সহায়ক নয়। যাঁর জীবনের প্রাথমিক চাহিদাগুলো অপূর্ণ, তাঁর থেকে অসামান্য কিছু প্রত্যাশা করা যায় না। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় এমন কোনো সহায়তা দেয় না, যা শিক্ষকদের জ্ঞানচর্চায় উৎসাহিত করতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উঁচু পর্যায়ের শিক্ষকের অবস্থা বিচার করা যাক। তিনি যে-বেতন ও বাড়িভাড়া পান, তাতে তাঁর বিশ দিন চলে, ও বাড়িভাড়ার শতকরা ষাটভাগ শোধ করা যায়। তাঁর জীবনের মূল এলাকাতেই সংকট বিরাজমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে একটি ছোটো কক্ষে তিনি ও তাঁর এক সহকর্মী বসেন; মোটামুটি বারো বর্গফুট এলাকায় তাঁরা দুজন জ্ঞানঅর্জন ও বিতরণ করেন। তাঁর ঘরের পর্দাটি তিনি নিজেই কিনেছেন, কেননা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর জন্যে একটি পর্দারও ব্যবস্থা করতে পারে নি। কাগজপত্র, পেন্সিল, কলম, টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিশ তিনি নিজেই কেনেন, কেননা বিভাগ গুগুলো সরবরাহ করতে পারে না। বিভাগ তাঁকে একটা গ্লাশ ও টাওয়েল দেয়, কেনো দেয় তিনি বুঝতে পারেন না। তাঁর টেবিলটি উচ্চমান করণিকের, তাঁর চেয়ারটি জীর্ণ, ছাত্ররা যেগুলোতে বসে সেগুলো জীর্ণতর। বিভাগে দুজন পিয়ন আছে, তারা চেয়ারম্যানকে নিয়েই ব্যস্ত। তাঁর ডাকে কোনো পিয়ন সাড়া দেয় না, তাঁর কিছু টাইপ করাতে হ’লে ছুটে যেতে হয় বাইরে, বা বিভাগীয় টাইপিস্টকে বারবার অনুরোধ ক’রে এক সপ্তাহে দু-পাতা টাইপ করাতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে জিরোক্স করার সুবিধা আছে, কিন্তু তিনি সরাসরি জিরোক্স করাতে পারেন না নিজের পয়সায়ও, সভাপতির সম্মতি লাগে। এ হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উচ্চপদস্থ শিক্ষকের সুযোগসুবিধা; এতে তো ফাইলও লেখা যায় না, মহাগ্রন্থ লেখা দূরের কথা। আধুনিক কালের মহাগ্রন্থ কীভাবে লেখা হয় তা আমরা জানিঃ প্রধান লেখকের সহায়করূপে থাকেন কয়েকজন সহকারী, যাঁরা তাঁকে বাঁচিয়ে দেয় অনেক শারীরিক শ্রম থেকে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যাঁরা গ্রন্থ রচনা করেন, তাঁরা মানস প্রেরণাতেই রচনা করেন; বিশ্ববিদ্যালয় তাতে কোনো উৎসাহ দেয় না। আরো একটি প্রসঙ্গ তোলা দরকার; এককালে শিক্ষকদের গুরু জ্ঞান করা হতো, আর এখন বিবেচনা করা হয় প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরূপে; বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তো অনেকটা মূল্যায়নই করা হয় উপসচিব, যুগ্মসচিব প্রভৃতির সাথে তুলনা ক’রে। কিন্তু শিক্ষকেরা কর্মচারী নয়, যে-অর্থে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা কর্মচারী।
ঐতিহাসিকভাবে ক্ষমতাবঞ্চিত আমাদের সমাজের মানুষেরা ক্ষমতা খুব ভালোবাসে; স্বেচ্ছাচার তাদের খুবই পছন্দ। আমরা জাতিগতভাবে এমন ধারণা পুষি যে যদি স্বেচ্ছাচার করতে না পারি, যাকে তাকে মারতে কাটতে পদচ্যুত করতে না পারি, তাহলে ক্ষমতা কিসের? তাই সারা সমাজ ক্ষমতালোভী, ও স্বেচ্ছাচারী। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গৌণ এলাকা হচ্ছে প্রশাসন, কিন্তু ওই এলাকাতেই ক্ষমতা বিরাজ ক’রে ব’লে ওটাই হয়ে উঠেছে মুখ্য এলাকা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রধান উপাচার্য; ক্ষমতামোহ এ-পদটিকে অন্যায়ভাবে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ক’রে তুলেছে। এ-পদটিকে ঘিরেই জড়ো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত সম্পদ ও ক্ষমতা। প্রত্যাশা করতে পারি উপাচার্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ব্যক্তি, হবেন বিশিষ্ট পণ্ডিত;- তাঁর রচনাবলি সমৃদ্ধ করবে আমাদের জ্ঞানভাণ্ডার। কিন্তু বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যতালিকা আমাদের সীমাহীনভাবে হতাশ করে : দেখতে পাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যরা সাধারণত পণ্ডিত ব্যক্তি নন, তাঁরা আমলামাত্র। এমন অবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে ক্ষতিকর। বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রকৃত জ্ঞানকেন্দ্রে পরিণত করতে হ’লে উপাচার্যপদটি বিশিষ্ট পণ্ডিতদের জন্যেই নির্ধারিত রাখতে হবে। এমন একটি বিধি আরোপ করা যেতে পারে যে যিনি অন্তত দশটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন নি, তিনি উপাচার্যপদের জন্যে উপযুক্ত নন। এমন বিধি ক্ষমতালোভীদের উৎসাহী ক’রে তুলবে জ্ঞানচর্চায়, এবং বিশ্ববিদ্যালয় তথাকথিত রাজনীতি ও আমলাবৃত্তির মুঠো থেকে মুক্তি পাবে। প্রশাসনের অন্যান্য এলাকায়ও প্রাধান্য দিতে হবে পণ্ডিতদের, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু পাণ্ডিত্যের মহিমাই স্বীকৃত হয়, অন্য কোনো মহিমা নয়।
এটা এক আন্তর্জাতিক ও সর্বকালিক ব্যাপার যে বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজনীতি বেশ ঘনিষ্ঠজড়িত;- ছাত্রসমাজ বিশেষভাবে রাজনীতিকাতর, আর শিক্ষকেরাও একরকম রাজনীতিক ভূমিকা পালন ক’রে থাকেন। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে, যেখানে দারিদ্র্য ও সংকট জীবনের নিত্যসঙ্গী, শোষণ যেখানে অবাধ, ব্যক্তিস্বাধীনতা যেখানে অস্বীকৃত, সেখানে ছাত্ররাজনীতি চরমভাবেই দেখা যায়। ছাত্ররা এসব দেশে রাজনীতি করে, মিছিলসহ রাস্তায় নামে, কখনো দালানে যানবাহনে আগুন ধরায়, এগুলো বড় ঘটনা, তবে এর চেয়েও বড়ো ঘটনা হচ্ছে এরা প্রতিমুহূর্তে এমন করে না, যদিও এসব দেশের অবস্থা প্রাত্যহিক মিছিল শ্লোগান ধ্বংসাত্মক কাজের জন্যে খুবই চমৎকার। ছাত্ররাজনীতি যারা বন্ধ করতে চায়, তারা খুবই মহৎ মানুষ, বা দেবতা, বা নির্বোধ। যদি শাসকেরা মনে করে যে ছাত্ররা কেনো রাজনীতি করে, তারা খুঁজে বের করবে সে-সমস্ত কারণ, এবং রাষ্ট্রিক ইন্দ্রজালে সমাধান ক’রে দেবে সমস্ত সমস্যা, তাহলে তাদের মহৎ মানুষ, এমনকি দেবতা, ব’লে মানতেই হয়। কিন্তু যদি তারা মনে করে যে জারি করবে তারা বিধিবিধান অনুশাসন, তথাকথিত শৃঙ্খলারক্ষাকারীদের জড়ো করবে মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ধারে, এবং পরিচ্ছন্নভাবে বন্ধ হয়ে যাবে ছাত্ররাজনীতি, তাহলে তাদের নির্বোধ গণ্য করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। আমাদের দেশে ছাত্ররাজনীতি ও আন্দোলনের প্রধান প্রেরণা আসে সরকারের কাছ থেকে; সরকার এমন কিছু উদ্যম দেখায় যা আন্দোলনে উৎসাহ দেয়। কয়েক দশক ধরেই দেখা যাচ্ছে সরকার শিক্ষা-জ্ঞান ও তার মানে উৎসাহী নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই, কিন্তু বিশেষ আগ্রহ আছে তাদের ছাত্ররাজনীতিতে অংশ নেয়ার। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে আমাদের সরকারমাত্রই অতিশাসনে আগ্রহী; তাদের মনোভাব অনেকটা এমন যে যেহেতু তারা শাসক, তাই তারা নিয়ন্ত্রণ করবে সব কিছু;- রাষ্ট্রনীতি থেকে শুরু ক’রে বনের পাখির উড়ালের নিয়মকানুনও। অতি নিয়ন্ত্রণ ও শাসনপ্রবণতা দেশে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সংকট সৃষ্টি করে। তৃতীয় বিশ্বের ছাত্রসমাজের বড়ো অংশ প্রগতিশীল ও বিদ্রোহী; তারা বয়স্কদের শোষণ, সুবিধাবাদ, অন্যায়ের যেমন সংশোধন চায়, তেমনি চায় দেশের সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা। তাই ছাত্ররা অনেকটা বিবেকের ভূমিকাই পালন ক’রে থাকে। তারা আত্মদানেও সমর্থ। দেশবিদেশের উদাহরণ না এনে বাঙলাদেশের দুটি উদাহরণই এখানে উল্লেখ করতে পারি। বায়ান্নোর আন্দোলনের মতো অসাধারণ ঘটনা ছাত্রদেরই সৃষ্টি, তারাই সেদিন বপন করেছিলো বাঙলাদেশের বীজ। সত্তর-একাত্তরে দেশকে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে দিয়েছে ছাত্ররাই; বিবেচক রাজনীতিকদের সিদ্ধান্ত গৃহীত হ’লে বাঙলাদেশ আজো থাকতো পাকিস্তানের উপনিবেশ। বাঙলাদেশে ছাত্ররা বিদ্রোহী ও ত্রাতার ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এটা এক ঐতিহাসিক পরিহাস যে প্রাক্তন বিদ্রোহীরা সর্বদা প্রশংসিত, আর সমকালীন বিদ্রোহীদের প্রাপ্য মৃত্যু বা কারাদণ্ড। প্রাক্তন বিদ্রোহীদের নির্দ্বিধায় প্রশংসা করা যায়, প্রগতিশীল থেকে প্রতিক্রিয়াশীল থেকে পতিতা সবাই তাঁদের স্তব করে, তাঁদের লাশের ওপর স্তম্ভ ওঠে; কিন্তু বিপদ শুধু সমকালীনদের নিয়ে- তিরস্কার ও দণ্ডই তাঁদের নিয়তি। কিন্তু যতো দিন নারকী সমাজব্যবস্থা ও ছাত্র থাকবে, ততো দিন থাকবে ছাত্ররাজনীতি।
শিক্ষকদের রাজনীতি নিয়েও কথা ওঠে, ও অভিযোগ তোলা হয় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা রাজনীতিপরায়ণ। এটাও ভুল ব্যাখ্যার ফল। রাজনীতি এখন সবাই করে; আর শিক্ষকেরা সাধারণত যে-রাজনীতি করেন, তাকে বিবেকের প্রকাশ ব’লে গণ্য করতে পারি; কেননা আমাদের দেশে এমন পরিস্থিতি, দুর্ভাগ্যক্রমে, আসে মাঝেমাঝেই যখন মৌনতা হচ্ছে অসততা ও বিবেকশূন্যতা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার বিশেষ বিশেষ শিক্ষককে বিশেষভাবেই রাজনীতিপ্রবণ ব’লে শনাক্ত ক’রে থাকে। এটাও হয় ভুলশনাক্তি। কয়েক দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে-শিক্ষকেরা শাসকসম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, তাঁদের কিন্তু কোনো সরকারই রাজনীতিদোষদুষ্ট মনে করে না, কেননা ওই ব্যক্তিরা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আর কোনো বিবেকী ভূমিকা কখনোই পালন করে নি। যাঁরাই বিবেকবান তাঁরাই রাজনীতিপ্রবণ এমন ভাবা ভুল। শিক্ষকেরা, বা তাঁদের একটি খণ্ডাংশ, যা করেন, তা হচ্ছে স্বাধীনতা-স্বায়ত্তশাসনের চর্চা; দেশকে শোষণমুক্ত করার চেতনার চর্চা। এটুকু চর্চার অধিকার ও দায়িত্ব যদি তাঁদের না থাকে, তাহলে তাঁদের শিক্ষকত্ব শূন্য বুলি মাত্ৰ।
জ্ঞানের অবাধ, দেশিক ও বিশ্বজনীন চর্চার কেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, এবং জ্ঞানচর্চার প্রাথমিক শর্ত স্বাধীনতা স্বায়ত্তশাসন। স্বাধীনতা স্বায়ত্তশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ অধিকার, সমাজ-রাষ্ট্র এ-অধিকার স্বেচ্ছায় অর্পণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর, যাতে বিশ্ববিদ্যালয় চূড়ান্তভাবে সেবা করতে পারে দেশ-জাতি ও সভ্যতাকে। যারা এ-অধিকার হরণ করতে চায়, দেশ-জাতি-সভ্যতার নামে তাদের প্রতিরোধ করা দরকার, নইলে ভবিষ্যৎ জাতি-সমাজ-সভ্যতা অভিযোগ তুলবে যে তাঁদের পূর্বপুরুষেরা জ্ঞানচর্চার পবিত্র অধিকার রক্ষার সমরে না নেমে পরিণত হয়েছিলো অন্ধশক্তিমানদের রক্ষিতায়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তোরণে বড়ো বড়ো অক্ষরে খচিত থাকা উচিত দক্ষিণ আফ্রিকার উইটওয়াটরসর্যাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাবাণীটি : ‘আমরা যারা জ্ঞানচর্চা ও অন্বেষণে এখানে সমবেত তাদের পবিত্র দায়িত্ব এ-মৌলনীতি চিরভাস্বর রাখা যে বিশ্ববিদ্যালয় এমন স্থান, যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে নরনারীরা মিলিত হয় জ্ঞানান্বেষণ ও জ্ঞানাগ্রসরণের জন্যে। জ্ঞানচর্চায় আমরা স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন যারা বিধিবিধান, অনুশাসন ও অন্যান্য প্রক্রিয়ায় খর্ব করতে উদ্যত হবে, তাদের আমরা প্রতিহত ক’রে জ্ঞানচর্চার স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন যে-কোনো পরিস্থিতিতে রক্ষা করবো। আমরা যার নামে আত্মোৎসর্গিত, তার নাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন।’