একুশের চেতনা, ও তিন দশকের উপন্যাস

একুশের চেতনা, ও তিন দশকের উপন্যাস

মধ্যবিত্ত বাঙালির রাজনীতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্মৃতি স্বপ্ন বাস্তব, তিনটি উথালপাথাল দশক ধ’রে, জড়ো হচ্ছে একটি দিনকে ঘিরে; এবং রচিত হয়েছে বাঙালির জীবনের মহত্তম কিংবদন্তি : একুশে ফেব্রুয়ারি। যে-চেতনারাশির নাম একুশ, তা বহু রঙে রাঙা আর বহুমুখি; শুধু একটি ও একরঙা চেতনা দিয়ে বায়ান্নোর ফাল্গুন- ফেব্রুয়ারিকে নির্দেশ করা অসম্ভব। একুশে, কারো কাছে, বাঙলা ভাষার উত্থানদিবস; কারো কাছে আধুনিক বাঙালি জাতির উদ্ভবের দিন; কারো কাছে অঘোষিত অস্বীকৃত স্বাধীনতা দিবস। একুশের অর্থ তারুণ্য, প্রতিরোধ বিদ্রোহ প্রগতিশীলতা, সামাজিক ন্যায়বিচার, অধিকারহীন মানুষের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বেলে রাখা। বায়ান্নোর ফাল্গুনে পাখিডাকা ছায়াঢাকা গ্রামেরই সহোদর ঢাকা শহর রূপান্তরিত হয়েছিলো অগ্নিগিরিতে, যার বিচ্ছুরিত শিখা ছড়িয়ে পড়েছিলো বাঙলার শহরে গ্রামে। তার পরের প্রতিটি বছর আগুন সংগ্রহ করেছে বায়ান্নোর অগ্নি থেকে। এমন নয় যে বায়ান্নোর বিদ্রোহীরা বিপ্লবের ছক তৈরি ক’রে নিয়েছিলেন নিপুণভাবে, সুচারুরূপে স্থির ক’রে নিয়েছিলেন ভবিষ্যৎ বছরগুলোর লক্ষ্য ও বিদ্রোহকৌশল। তাঁদের লক্ষ্য ছিলো পাকিস্তানি ঘাতকদের দ্বারা আক্রান্ত বাঙলা ভাষাকে রক্ষা করা। তাঁদের কাছে বাঙলা ভাষা শুধু ব্যাকরণিক অর্থে ভাষা ছিলো না; বাঙলা ভাষা ছিলো বাঙালির অস্তিত্ব অধিকার স্বাধীনতার অন্য নাম। তাই বাঙালিবিরোধী পাকিস্তানে বিপ্লবের প্রথম রক্ত বেরিয়েছিলো বাঙলা ভাষার শরীর থেকে।

যে-চেতনা বায়ান্নোর বিদ্রোহীদের ঠেলে দিয়েছিলো ঘাতকের অস্ত্রের মুখোমুখি, তার প্রত্যক্ষ লক্ষ্য ছিলো বাঙলা ভাষার প্রতিষ্ঠা; কিন্তু পরোক্ষ লক্ষ্য ছিলো অনেক। তাঁরা চেয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বাদ আর শস্য ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে, ব্যাপক শোষণ থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন পাকিস্তান নামক একটি মধ্যযুগীয় সামন্ত রাষ্ট্রকে আধুনিক যুগে নিয়ে আসতে; চেয়েছিলেন পাকিস্তান যদি আধুনিক যুগে আসতে রাজি না হয়, তবে তাকে ধ্বংস ক’রে নতুন আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। এ-সমস্ত চেতনার স্ফুলিঙ্গই বায়ান্নোর একুশের ভেতরে ছিলো; এবং তার পরের বছরগুলোতে ওই স্ফুলিঙ্গরাই দাউদাউ আগুন হয়ে পাকিস্তানকে জতুগৃহে পরিণত করে। বায়ান্নোর বিশ আর একুশে ফেব্রুয়ারির মধ্যে শতাব্দীর ব্যবধান : একুশের রক্তাঞ্জলির পর আর কোনো কিছুই আগের মতো থাকে নি পাকিস্তানের পূর্বখণ্ডে। তরুণমাত্রই হয়ে ওঠে বিদ্রোহী, নতুন আলো ঢোকে বুড়োদের ছানিপড়া চোখে, শ্রমিকচাষীর পর্যুদস্ত পেশিতে শিহরণ জাগে, বাঙালি মুসলমান বাঙালি হয়ে ওঠে, এবং আধুনিকতার উন্মেষ ঘটে জীবনে শিল্পে সাহিত্যে। আর পাকিস্তানের সামন্ত রাষ্ট্রপতিদের চোখে ঢোকে একটি চব্বিশ ঘন্টার দুঃস্বপ্ন : পাকিস্তান নামক অপরাষ্ট্রটি অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে।

বায়ান্নোর বিদ্রোহ বিশশতকের বাঙালিজীবনের প্রথম বড়ো ঘটনা। ওই ঘটনার স্রষ্টা ও লালনপালনকারীরা প্রধানত মধ্যবিত্তশ্রেণীর; তাই একুশের চেতনারাশির বড়ো অংশ গ’ড়ে উঠেছে মধ্যবিত্তের কামনা বাসনা স্বপ্নে। একুশের, ও তার পরের সমস্ত, আন্দোলনে তারাও যোগ দিয়েছে, যাদের বলা হয় ‘সাধারণ মানুষ’। কিন্তু ওই সাধারণ মানুষের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, স্বার্থ কখনোই বড়ো হয়ে ওঠে নি। তাই একুশ আমাদের দিয়েছে একগুচ্ছ মধ্যবিত্ত চেতনা। ওই চেতনারাশির অনেক চেতনাই গত তিন দশকে ধার আর তীব্রতা হারিয়ে ফেলেছে, তার অনেক চেতনাই এখন আর প্রশংসনীয় নয়; কিন্তু বায়ান্নোর পাকিস্তানের মধ্যযুগীয় পটভূমিতে বিচার করলে ওগুলোকে অত্যন্ত উজ্জ্বল ব’লে মানতেই হয়। আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র তিন দশক ধ’রে যে শুধু সামনের দিকেই এগিয়েছে, তাও নয়। বায়ান্নোর পরবর্তী দু-দশক ধ’রে সামনের দিকে এগোতে এগোতে সত্তরের দ্বিতীয়াংশে আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র ফিরে যায় বায়ান্নোরও আগের কালে; এবং এখন তো চারদিকে মধ্যযুগীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার জিন্দাবাদ ধ্বনিই শোনা যায় প্রহরে প্রহরে। তাই বর্তমানের পটভূমিতেও বায়ান্নোর চেতনাসমূহ অত্যন্ত উজ্জ্বল। একুশের অজস্র চেতনা থেকে আমি বেছে নিতে চাই যে-চেতনাগুলো, তা হচ্ছে : আধুনিকতা, বিদ্রোহ, পাকিস্তানে অনাস্থা ও স্বাধীনতার স্বপ্ন, বাঙলা ভাষার প্রতিষ্ঠাকামনা, অসাম্প্রদায়িকতা, সমাজতন্ত্র স্পৃহা, গণতন্ত্রের জন্যে আকুলতা ইত্যাদি; এবং দেখতে চাই এ-চেতনাগুলোর কেমন বিকাশ ঘটেছে বায়ান্নোর পরের তিন দশকের উপন্যাসে।

এ-তিন দশকের কবিতা, প্রবন্ধ ও উপন্যাসের ওপর একটু চোখ দিলেই একটি কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বাঙলাদেশের কবি ও প্রাবন্ধিকেরা একুশের চেতনার সাথে যতোটা একাত্ম হয়েছেন, ঔপন্যাসিকেরা ততোটা হন নি। প্রতিটি একুশ উপলক্ষে কবিরা পালন করেছেন বিদ্রোহীর ভূমিকা, প্রতিটি আন্দোলনের সময় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে তাঁদের রক্ত; এবং বাঙলা ভাষায় রচিত হয়েছে একরাশ ক্ষুব্ধ শাণিত সমাজকাঁপানো কবিতা। প্রাবন্ধিকেরা একুশে থেকে সংগ্রহ করেছেন তীব্র অনুপ্রেরণা, রচনা করেছেন সমাজ পাল্টানোর বিপুল পরিমাণ ইশতেহার। যে-দ্রোহ আর ভবিষ্যৎমুখিতা দেখা যায় কবিতা আর প্রবন্ধে, উপন্যাসে তা দুর্লভ। এদিক দিয়ে ঔপন্যাসিকেরা অনেক পিছিয়ে আছেন কবি ও প্রাবন্ধিকদের থেকে, যেমন তাঁরা অনেক পেছনে প’ড়ে আছেন শিল্পসৃষ্টির সাফল্যে। কবিতা ও প্রবন্ধ যতোটা আকর্ষণ করে, উপন্যাস তার সিকি ভাগও করে না। কবিতা তো এগিয়ে গেছে অনেক দূর, তা সমাজ ও আধুনিকতাকে আত্মস্থ ক’রে নিয়েছে চমৎকারভাবে; কিন্তু আমাদের উপন্যাস সমাজ ও সময়কে ধরতে গিয়ে বারবার পদস্খলিত হয়ে পড়ে; আধুনিকতা এখনো তার আয়ত্তে আসে নি, শিল্পসৃষ্টি এখনো তার বাসনামাত্র। গত তিন দশক ধ’রে পশ্চিমে উপন্যাস বাঁকের পর বাঁক নিচ্ছে, কিন্তু আমাদের উপন্যাস এগোচ্ছে প্রথাসম্মত পথ ধ’রে। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে এবং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে গত তিন দশকে উপন্যাসে প্রধান হয়ে উঠেছে তিনটি প্রবণতা : একশ্রেণীর ঔপন্যাসিক তথাকথিত কল্পনাকে পরিহার ক’রে উপন্যাসের বিষয় হিশেবে গ্রহণ করছেন বাস্তব ঘটনা ও তথ্য, রচনা করছেন গবেষণাগ্রন্থের প্রতিদ্বন্দ্বী উপন্যাস; আরেক শ্রেণীর ঔপন্যাসিক লিখছেন বৈজ্ঞানিক কল্পনাপ্রসূত উপন্যাস; এবং তথ্য ও বৈজ্ঞানিক রূপকথাবিরক্ত একশ্রেণীর ঔপন্যাসিক দার্শনিকতাকে পরিণত করেছেন উপন্যাসের বিষয়ে। আমাদের ঔপন্যাসিকেরা প্রথাসম্মতভাবে কল্পনানির্ভর, বানানো গল্পে বিশ্বাসী। বাস্তব ঘটনা যখন তাঁদের কাহিনীতে ঢুকে পড়ে, তখন তাঁরা ভীত হয়ে ওঠেন; ভূমিকায় জানিয়ে দেন যে ‘উপন্যাস উপন্যাসই, ইতিহাস নয়।’ তাই আমাদের অধিকাংশ উপন্যাস রূপকথাধর্মী, বাস্তব থেকে যতো দূর যেতে পারে ততোটুকুই যেনো এগুলোর সাফল্য। অনেক উপন্যাসেই ঐতিহাসিক ঘটনা- দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, পাকিস্তান- আন্দোলন, ভাষা-আন্দোলন ইত্যাদি- স্থান পেয়েছে; কিন্তু ওই ঘটনাগুলো উপন্যাসে বিন্যস্ত হয়েছে এমনভাবে, যাতে ওগুলোকে বানানো গল্প ব’লে মনে হয়। ওসব ঘটনা- আন্দোলন সম্পর্কে এর মধ্যেই লেখা হয়েছে বেশ কিছু তথ্যপূর্ণ গবেষণাগ্রন্থ। ওই সমস্ত ঘটনাখচিত উপন্যাস ও গবেষণাগ্রন্থগুলোর মধ্যে গবেষণা গ্রন্থগুলো অনেক বেশি আকর্ষণীয়: উপন্যাসের চেয়েও শিহরণ জাগানো।

পঞ্চাশের শুরুর পাকিস্তান ও বাঙালি মুসলমান ছিলো অনাধুনিক, অসংস্কৃত, শিল্পহীন। পৃথিবীর চারদিকে, জীবনে ও শিল্পে, ছড়িয়ে পড়ছিলো তখন আধুনিক চেতনা; আধুনিক বাঙলা সাহিত্য তখন অন্তত পঁচিশ বছর বয়স্ক, কিন্তু পাকিস্তানি সাহিত্য ব্যস্ত ছিলো মধ্যযুগপরিক্রমায়। আবু রুশদের নোঙর-এর নায়ক পবিত্র পাকিস্তানে নোঙর ফেলতে এসে দেখেছিলো, ‘সাহিত্য ঝাঁঝরা হয়ে গেছে; সঙ্গীত স্তব্ধ; চিত্রকলা ক্লান্ত।’ বায়ান্নোর আগে, দু-একটি ক্ষীণ ব্যতিক্রম বাদে, মধ্যযুগীয় পাকিস্তানে আধুনিক চেতনার কোনো বিকাশ ঘটে নি; আর শিল্প সাহিত্য চিত্রকলা সঙ্গীত ওই রাষ্ট্রের চিত্তে ঢোকে নি। ‘কায়দে আজম’ নিয়ে পদ্য লেখাই ছিলো তখন চূড়ান্ত কাব্যসৃষ্টি। ‘আর্ট’ সম্পর্কে পাকিস্তানি ধারণার পরিচয় পাওয়া যায় আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘জবানবন্দী’ গল্পের জেবুন্নিসার উক্তিতে : ‘একটা গোলাপ আরেকটি বুলবুলি, পাপড়ি আর পাথর, কয়েক লাইন আরবী হরফ চালিয়ে দিলেই আর্ট হয়ে গেলো’ ব’লে মনে করতো পাকিস্তানের পিতারা। ওই আর্টকে ‘আছাড় মেরে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো ক’রে ফেলা’র চেতনা যুগিয়েছিলো একুশের আন্দোলন। আমাদের উপন্যাসে আধুনিক চেতনা, নতুন শিল্পসৃষ্টির চেতনা কতোটা সংক্রামিত হয়েছিলো? বায়ান্নোর পরের ঔপন্যাসিকেরা বিষয় ভাষা আঙ্গিকে আধুনিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন; কিন্তু বাঙলাদেশের উপন্যাস, কবিতার তুলনায়, অনাধুনিক। বারবার মনে হয় বায়ান্নোর পরিস্রুতি অভিযান আমাদের উপন্যাসকে পরিচ্ছন্ন করতে পারে নি; এখনো তার শরীর-মনে জড়িয়ে আছে অনেক অতীত অপরিচ্ছন্নতা। একটি বিষয় চোখে পড়ার মতো : পাকিস্তান-আন্দোলনের সময় যে-ঔপন্যাসিকেরা তরুণ ছিলেন, তাঁরাই বিশেষভাবে অপরিস্রুত; আর বায়ান্নোর চেতনা বুকে জ্বালিয়ে ঔপন্যাসিকরূপে আবির্ভূত হন যে-তরুণেরা, তাঁরা অনেক বেশি আধুনিক। আবুল ফজল, আবু জাফর শামসুদ্দীন বা সরদার জয়েনউদ্দীনের সাথে জহির রায়হান, আলাউদ্দিন আল আজাদ বা সৈয়দ শামসুল হককে তুলনা করলে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অবশ্য বয়স্কদের মধ্যে ব্যতিক্রমী যে কেউ নেই, তা নয় : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমানকে বয়স্ক আধুনিকরূপে গ্রহণ করতে হয়।

পঞ্চাশের দশকের আগেই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস রচিত হয়েছিলো : শওকত ওসমানের জননী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু, এবং আবু ইসহাকের সূর্যদীঘল বাড়ি। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে এ-মানের উপন্যাস লিখতে সক্ষম হন নি কেউ। বায়ান্নোর পরের যে-কটি উপন্যাসের নাম, উৎকৃষ্ট কোনো উপন্যাসের অভাবে, উল্লেখ করতে হয়, সে-ক’টি হচ্ছে আবুল মনসুর আহমদের জীবনক্ষুধা (১৯৫৫), সরদার জয়েনউদ্দীনের আদিগন্ত (১৯৫৬), আবু রুশদের সামনে নতুন দিন (১৯৫৬), ও আবুল ফজলের রাঙ্গাপ্রভাত (১৯৫৬)। এর কোনোটিই সার্থক শিল্পসৃষ্টি নয়; তবে জীবনক্ষুধা ও রাঙ্গাপ্রভাত কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এ-উপন্যাস দুটিতে একুশের চেতনার দুই বিপরীত দিকের পরিচয় আছে। আবুল মনসুর আহমদ সামন্তবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল, আধুনিক চেতনা তাঁর মধ্যে কখনোই প্রবেশ করে নি; এবং তাঁর উপন্যাস জীবনক্ষুধা সম্পূর্ণরূপেই একুশের চেতনাবিরোধী। যে-জীবন ও সাহিত্যাদর্শ জীবনক্ষুধার পাতায় পাতায় ছড়িয়ে দিয়েছেন আবুল মনসুর আহমদ, বায়ান্নোর পরে তা কাম্য হ’তে পারে না কোনো আধুনিক শিল্পীর ও মানুষের। জীবনক্ষুধার নায়ক হালিম ও লেখক আবুল মনসুর আহমদ অভিন্ন ব্যক্তি : ওই উপন্যাসের নায়ক সাম্প্রদায়িক ও সামন্ত মানসিকতায় আবদ্ধ, ঠিক যেমনভাবে সাম্প্রদায়িকতায় ও সামন্ত ভাবনায় আচ্ছন্ন আবুল মনসুর আহমদ। বায়ান্নোর কয়েক বছর পরে পাকিস্তান সম্পর্কে যখন অবিশ্বাস জন্মে গেছে সাধারণ মানুষেরও মনে, তখনও জীবনক্ষুধার লেখক পাকিস্তানপন্থী। আবুল ফজল বিপরীত দিকে অবস্থান করেন আবুল মনসুর আহমদের; এবং তাঁর উপন্যাস রাঙ্গাপ্রভাত মর্মমূলে না হ’লেও আপাতদৃষ্টিতে বায়ান্নোর চেতনা অর্জন করেছে অনেকখানি। এ-উপন্যাসের দুটি চেতনাকে– সমাজতন্ত্র স্পৃহা ও অসাম্প্রদায়িকতাকে– অনেকটা একুশের দান ব’লে গ্রহণ করতে পারি। যে-মানসিকতা কাউকে দৃঢ় সমাজতন্ত্রীতে পরিণত করে, তা লেখকের ও তাঁর নায়ক কামালের নেই; কিন্তু সমাজতন্ত্র যেহেতু হাওয়ায় উড়ছিলো তখন, তাই লেখক ও নায়কের মনে একরকম রোম্যান্টিক সমাজতন্ত্র দোলা দিয়ে গেছে। উপন্যাসটির অসাম্প্রদায়িক বাণীও লক্ষ্য করার মতো : হিন্দুমুসলমানকে মেলানোর জন্যে আবুল ফজল নায়ক সংগ্রহ করেছেন মুসলমান ও নায়িকা সংগ্রহ করেছেন হিন্দু সমাজ থেকে। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটি বেশ অসাম্প্রদায়িক; কিন্তু আমি বোধ করি এর অত্যন্ত অভ্যন্তরে রয়েছে একরকম সাম্প্রদায়িকতা। মুসলমান লেখক যখন মুসলমান নায়ক ও হিন্দু নায়িকার প্রেমবিবাহ আঁকেন, তা যতোটা উদার অসাম্প্রদায়িকভাবেই আঁকুন না কেনো, তখন তাকে চারপাশের ইসলামি সাম্প্রদায়িকতারই বহিঃপ্রকাশ ব’লে মনে হয়। মুসলমান হিন্দু বা অন্য কোনো ধর্মের রমণীতেই বীতস্পৃহ নয়, সুযোগ পেলে তারা হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-ইহুদি নায়িকার সঙ্গে প্রেমে ও বিবাহে প্রস্তুত; কিন্তু যাতে তারা প্রস্তুত নয়, তা হচ্ছে নিজের বোন, মেয়ে, বা সমাজের কোনো মেয়েকে অন্য ধর্মের কারো সাথে প্রেমে লিপ্ত হ’তে, বা বিয়ে দিতে। নায়ক যখন অন্য ধর্ম ও সমাজের কাউকে বিয়ে করে, তখন সে তার স্ত্রীর ধর্ম ও সমাজটাকেও নিজের শয্যায় ও অধীনে নিয়ে আসে; অর্থাৎ প্রচণ্ডভাবে জয়ী হয়। নায়িকা হয় পরাজিত, সে তার ধর্ম ও সমাজকে নতজানু ক’রে দেয় অন্যের কাছে। আবুল ফজল যদি পাকিস্তানে হিন্দু নায়ক আর মুসলমান নায়িকার প্রেমবিবাহ আঁকতে পারতেন, তাহলেই তাঁকে ভাবা যেতো একুশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার সন্তান। তা পারেন নি ব’লে তাঁকে ইসমাইল হোসেন সিরাজিরই উত্তরাধিকারী ব’লে মনে হয়।

ষাটের দশকে উপন্যাস কিছুটা গভীর ও অনেকটা ব্যাপক হয়ে ওঠে।ভাষা- আন্দোলনের তরুণেরা এর মাঝে বয়স্ক হয়েছেন, আর পাকিস্তান-আন্দোলনের তরুণেরা হয়েছেন প্রৌঢ়। প্রৌঢ়রা এ-সময়ে পেশ করতে থাকেন তাঁদের যুবককালের অভিজ্ঞতা, আর বায়ান্নোতে যাঁরা তরুণ ছিলেন, তাঁরা জীবন ও আধুনিক চেতনার নানা বিকাশ ধরার চেষ্টা করেন উপন্যাসে। পঞ্চাশের দশকে উপন্যাসের এলাকায় যে-দুর্দশা বিরাজ করছিলো, তার অনেকটা কেটে যায় ষাটের দশকে, গুণগত দিকে না হ’লেও পরিমাণগত দিকে। আনোয়ার পাশা, আবদুল রাজ্জাক, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আবু রুশদ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, জহির রায়হান, মেসবাহুল হক, রশীদ করিম, শওকত আলী, শওকত ওসমান, শহীদ আখন্দ, শহীদুল্লা কায়সার, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, সত্যেন সেন, সরদার জয়েনউদ্দীন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, ও আরো কারো কারো উপন্যাস বছরে বছরে প্রকাশ পেয়ে ষাটের দশককে উপন্যাসের সোনালি দশকে পরিণত করে। যাঁদের নাম উল্লেখ করেছি, একা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাদে, তাঁরা কেউ অসামান্য ঔপন্যাসিক নন। বাঙলা ভাষায় প্রধান উপন্যাসগুলোর সাথে তুলনা করলে তাঁদের রচনাকে বেশ সামান্য মনে হয়; এবং এমনও মনে হয় যে আমাদের ঔপন্যাসিকদের অনেকের খ্যাতি সত্যিকার ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। ষাটের দশকের উপন্যাস আলোচনা, একটি কারণে, আমি শুরু করতে চাই জহির রায়হানকে দিয়ে। জহির রায়হান সম্ভবত বাঙলাদেশের একমাত্র কথাসাহিত্যিক, যাঁর উদ্ভবের পেছনে আছে বায়ান্নোর ভাষা-আন্দোলন, যাঁর স্বপ্ন কল্পনা জীবন ভ’রে আছে ভাষা-আন্দোলনের স্মৃতি ও দ্রোহে। যদি বায়ান্নোর একুশ না ঘটতো, তবে জহির রায়হান হয়তো কথাসাহিত্যিক হতেন না। তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলো ভাষা-আন্দোলনের প্রত্যক্ষ লক্ষ্য অর্থাৎ বাঙলা ভাষার প্রতিষ্ঠা; এবং একুশের অন্যান্য চেতনাও তাঁর মধ্যে বিদ্যুৎ-ঢেউ জাগিয়েছিলো। তাঁর অনেকগুলো গল্প; যেমন : ‘অতি পরিচিত’, ‘কয়েকটি সংলাপ’, ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’, ‘একুশের গল্প’, এবং একটি উপন্যাস- আরেক ফাল্গুন– একুশের প্রত্যক্ষ চেতনা থেকে জন্মেছে। তবে জহির রায়হানের মন ঢাকা ছিলো এক তরল ভাবালুতাগ্রস্ত রোম্যান্টিক কুয়াশার আস্তরণে; এবং তিনি সব কিছুকেই রূপকথায় পরিণত করেছেন। তাঁর আরেক ফাল্গুন বা হাজার বছর ধ’রে একধরনের রূপকথা, যাতে বস্তুসত্যের চেয়ে ভাবালুতা অনেক বেশি। আরেক ফাল্গুন উপন্যাসটি বারবার প’ড়েও বোঝা যায় না এটা কোন ফাল্গুনের গল্প; এবং সারাক্ষণই মনে হয় বিদ্রোহবিপ্লব একরকম ভাবালু হৃদয়বৃত্তিমাত্র। কিন্তু বিদ্রোহের চেতনা যতোটুকু আছে আরেক ফাল্গুন-এ, তার সামান্যও নেই হাজার বছর ধরেতে।

ষাটের দশকের কয়েকটি উপন্যাসের পটভূমি বেশ বিস্তৃত : দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, পাকিস্তান-আন্দোলন, পাকিস্তানের উদ্ভবের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থান পেয়েছে উপন্যাসগুলোতে। এগুলোর মধ্যে আছে আলাউদ্দীন আল আজাদের ক্ষুধা ও আশা (১৯৬৪), শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক (১৯৬৫), সরদার জয়েনউদ্দীনের অনেক সূর্যের আশা (১৯৬৬), ও আবু রুশদের নোঙর (১৯৬৭)। আবু জাফর শামসুদ্দীনের পদ্মা মেঘনা যমুনা (১৯৭৪) ও সরদার জয়েনউদ্দীনের বিধ্বস্ত রোদের ঢেউ (১৯৭৫) সত্তরের দশকে বেরোলেও পটভূমিগত কারণে ওপরের চারটি উপন্যাসের সাথেই বিন্যস্ত করতে চাই এ-উপন্যাস দুটিকে। এ-উপন্যাসগুলো যখন রচিত হয়, সে-ষাটের দশকে পাকিস্তানে অনাস্থাই ছিলো স্বাভাবিক। সামান্য অন্তর্দৃষ্টিও যাঁদের ছিলো, তাঁরা বুঝেছিলেন পাকিস্তানের কাছে আশা করার মতো কিছু নেই; কিন্তু পঞ্চাশের রাঙ্গাপ্রভাত আর ষাটের অনেক সূর্যের আশা, নোঙর ইত্যাদি আশায় উজ্জ্বল নাম ইঙ্গিত করে যে ওই উপন্যাসগুলোর লেখকদের মনে একুশের চেতনা বিশেষ ঢোকে নি; বরং জমাট হয়ে আছে পাকিস্তান-আন্দোলনের চেতনা। সরদার জয়েনউদ্দীনের ষাটের দশকের মাঝামাঝি প্রকাশিত অনেক সূর্যের আশা পাকিস্তানি মানসিকতার ফসল; এতে পাকিস্তান ও তার পিতার প্রশংসা ছড়ানো এখানে সেখানে, কিন্তু সত্তরের দশকে প্রকাশিত বিধ্বস্ত রোদের ঢেউ-এ দেখা দেয় পাকিস্তানের সমালোচনা। সরদার জয়েনউদ্দীন যদি বিধ্বস্ত রোদের ঢেউ ষাটের দশকে, আদমজি পুরস্কারকে মনে রেখে, লিখতেন, এবং অনেক সূর্যের আশা লিখতেন সত্তরের দশকে, তাহলে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি উল্টে যেতো। এ-উপন্যাসগুলোর কোনোটিই মহৎ রচনা নয়; তবে একুশের চেতনা এগুলোতে নানাভাবে, অনেক সময় এলোমেলোভাবে, ঢুকে গেছে। শহীদুল্লা কায়সার, আলাউদ্দীন আল আজাদ, আবু জাফর শামসুদ্দীন, সরদার জয়েনউদ্দীন দুর্ভিক্ষ দেখে ক্ষিপ্ত হয়েছেন, মহাযুদ্ধকে তিরস্কার করেছেন, সমাজতন্ত্র আর স্বাধীনতার জন্যে প্রকাশ করেছেন আকুলতা। এঁদের মধ্যে সব মিলিয়ে কিছুটা সফলতা অর্জন করতে পেরেছেন শহীদুল্লা কায়সার। শহীদুল্লা কায়সার বেশ বড়ো কাহিনী বর্ণনা করেছেন, শোষকশোষিতের দ্বন্দ্ব মাঝেমাঝে তীব্রভাবে আঁকতে পেরেছেন; কিন্তু আলাউদ্দীন আল আজাদ দুর্ভিক্ষ-দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-স্বাধীনতার মতো কড়া বিষয় নিয়েও রোম্যান্টিক-সাংকেতিক আশাবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। সরদার জয়েনউদ্দীনের ব্যর্থতা আরো বড়ো ও মর্মান্তিক : দুটি উপন্যাসে তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ থেকে একুশের আন্দোলন পর্যন্ত সময়ের উপাখ্যানকে পরিণত করেছেন ক্লান্তিকর, দ্যুতিহীন গল্পে। তাঁর তুলনায় অনেক সফল আবু জাফর শামসুদ্দীন, যাঁর মধ্যে শিল্পিতার অভাব থাকলেও সময়কে নিরাবেগ দৃষ্টিতে দেখার গুণ বিদ্যমান। তাঁর এ-বৈশিষ্ট্য যেমন দেখা যায় সাড়ে এগারো শো পৃষ্ঠার পদ্মা মেঘনা যমুনায় তেমনি দেখা যায় সম্ভবত সত্তর পৃষ্ঠার দেয়াল-এ [গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত]। আবু জাফর শামসুদ্দীনের আছে তথ্যনিষ্ঠ দলিলধর্মী উপন্যাস রচনার শক্তি। পাকিস্তান-বিষয়ক উপন্যাসে একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো : প্রায় প্রতিটি উপন্যাসেই দেখা যায় যে পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠা ও উন্নতি ঘটেছিলো বদমাশশ্রেণীর। সংশপ্তক-এ দেখি গুণ্ডা রমজান পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে হয়ে উঠেছে সম্ভ্রান্ত কাজি মোহাম্মদ রমজান; অনেক সূর্যের আশার দুশ্চরিত্র ছমির মিয়া পাকিস্তান- আন্দোলনের সময় হয়ে ওঠে মুসলিম লিগের ‘সালার’, ক্ষুধা ও আশায় দেখা যায় বাদশা গুণ্ডার উন্নতি; পদ্মা মেঘনা যমুনায় অসৎ আকবর খাঁকে দেখি মুসলমানের নেতারূপে, আর নোঙর-এর নায়কের মনে হয়েছে পাকিস্তানি ‘সমাজের পরিবেশে কোনো স্নিগ্ধতা বা মহত্ত্বের সম্ভাবনা একেবারে বিলুপ্ত।’

আর দুজন ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নানা কারণে উল্লেখযোগ্য; এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ একটু অতিপ্রশংসিত, দেশে থাকলে এতোটা প্রশংসা তিনি পেতেন না। শওকত ওসমানের মধ্যে একরকম দ্রোহ সবসময়ই সক্রিয়; আর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সমস্ত দ্রোহবিদ্রোহের পরপারে বাস করেন। তবে শওকত ওসমান কোনো কিছুকেই যেনো গুরুত্ব, ধ্যান ও চৈতন্যের সাহায্যে গ্রহণ করেন নি;- যদি তিনি আঙ্গিক ও চাতুর্যের ওপর বেশি জোর দিয়ে চমকপ্রদ হ’তে চেষ্টা না করতেন, গভীরভাবে পাঠ করতেন তাঁর সময় ও সমাজকে, তবে তিনি হয়তো একজন প্রধান ঔপন্যাসিক হ’তে পারতেন বাঙলা ভাষায়। চল্লিশ-দশকের প্রথাগত জননীর মধ্যে যে-সম্ভাবনা ছিলো, ষাটের দশকের ঝিলিক দেয়া ক্রীতদাসের হাসিতে তা পরিণতি না পেলেও ক্রীতদাসের হাসি, এবং চৌরসন্ধি, রাজা উপাখ্যান একুশের বিদ্রোহী উদ্ধত চেতনাকে ধরেছে অনেকখানি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ একুশের চেতনার বাইরে থেকেছেন। তাঁর পরিণত জীবনের সবটাই কেটেছে এমন এক দেশে ও সময়ে, যখন যেখানে অস্তিত্ববাদই ছিলো উপন্যাসের বড়ো বিষয়। ওই বিপন্ন অস্তিত্বের দর্শন তিনি পেশ করেন বাঙলা ভাষায়– জীবনকে সম্পূর্ণরূপে নির্বাক ও নিঃশব্দ ক’রে দিয়ে। কাঁদো নদী কাঁদোতে জীবন এক অতীত ব্যাপার, সেখানে বিনাশ আর আত্মহননই জীবনের নিয়তি; কিন্তু তিনি আধুনিক, যে-গুণটি আমাদের অনেক ঔপন্যাসিকেরই আয়ত্তের অতীত। তাঁর একুশের চেতনার প্রকাশ ঘটেছে সংকটচেতনার মধ্য দিয়ে। একজন সত্যেন সেন অনেকগুলো ‘প্রগতিশীল’ উপন্যাস লিখেও ভাষা ও সাহিত্যকে যা দিতে পারেন না একজন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ একটিমাত্র উপন্যাস লিখেও তা দিতে পারেন।

একুশ প্রধানত একগুচ্ছ চেতনার সমষ্টি; একুশের আন্দোলন ঘটনার ঘনঘটাপূৰ্ণ নয়। বিভিন্ন চেতনা প্রকাশের জন্যে ঔপন্যাসিকের দরকার হয় নানা ঘটনায় আন্দোলিত জীবন। ঔপন্যাসিকেরা একুশের আন্দোলনে ঘটনার প্রাচুর্য পান নি ব’লে দু-একজন ছাড়া সবাই একুশের দিনকে এড়িয়ে চলেছেন, এবং দুর্ভিক্ষ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পাকিস্তান আন্দোলনের ঔপন্যাসিকেরা তাঁদের উপাখ্যান শেষ করেছেন একুশের অব্যবহিত আগে। একুশ যেনো তা বুঝতে পেরেছিলো, তাই একুশ ঔপন্যাসিকদের দু-দশক পরে উপহার দেয় একাত্তর : যুদ্ধ ধ্বং সৃষ্টি হিংস্রতা মহত্ত্ব বিদ্রোহে পরিপূর্ণ ঘটনাপূর্ণ জীবন। একাত্তর একুশেরই দু-দশক পরবর্তী মহাঢেউ। একাত্তর সৃষ্টি করে বাঙালি জীবনের মহত্তম ইতিহাস। আমাদের সত্তর দশকের ঔপন্যাসিকেরা কি একাত্তরের মহাজীবন ও ইতিহাসকে ধরতে পেরেছেন? এর উত্তর : না। একাত্তর যে কোনো মহৎ উপন্যাসের প্রেরণা হ’তে পারে নি, এতে মনে হয় ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারে যে-কোনো নির্বোধ, কিন্তু তাকে শিল্পে রূপায়িত করার জন্যে দরকার প্রতিভা। প্রতিভার অভাবেই একাত্তরের জীবন ও চেতনা এখনো উপন্যাসরূপ লাভ করে নি। ষাটের তুলনায় সত্তরদশকের উপন্যাস অনেক পাংশু, দরিদ্র। ঔপন্যাসিকেরা একাত্তরে দেখেছেন পলায়ন, নিপীড়ন, হিংস্রতা, কিছু খণ্ড আক্রমণ, এবং ঘনঘন ধর্ষণ। ধর্ষণের ব্যাপারটিই বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছিলো ঔপন্যাসিকদের কাছে। এ-ব্যাপারটি বিভীষিকাময় সন্দেহ নেই, এর প্রতীকী তাৎপর্যও অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু অনেক গল্পউপন্যাসে এর যে-ছবি পাই, তাতে মনে হয় পাকিস্তানি তাতারদের সাথে লেখকেরাও উপভোগ করেছেন হিংস্র সুখ।

সত্তর দশকের উপন্যাসগুলোকে দু-ভাগে ভাগ করতে পারি : বড়ো ভাগটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক, অন্যটি বিবিধ বিষয়ক। প্রথম ভাগে পড়ে সৈয়দ শামসুল হকের নীলদংশন, নিষিদ্ধ লোবান, শওকত আলীর যাত্রা, মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন, মির্জা আবদুল হাইয়ের ফিরে চলো ইত্যাদি, দ্বিতীয় ভাগে পড়ে রশীদ করিমের আমার যতো গ্লানি, প্রেম একটি লাল গোলাপ, সৈয়দ শামসুল হকের দূরত্ব, কালধর্ম, শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন, রাহাত খানের কোলাহল প্রভৃতি। সব ঔপন্যাসিক ও উপন্যাসের তালিকা দেয়া লক্ষ্য আমার নয়, শুধু প্রবণতা বোঝানোর জন্যে ওপরের নামগুলো উল্লেখ করলাম। সত্তর দশকের অনেক উপন্যাসই ‘ঈদসংখ্যার উপন্যাস’; এগুলোর অধিকাংশই উপন্যাসনামী বড়োগল্প। সত্তরদশকে একজন ঔপন্যাসিকেরই মূল্যবান বিকাশ ঘটেছে, তিনি সৈয়দ শামসুল হক। এ-দশকে প্রচুর লিখেছেন তিনি এবং প্রচুর ভালো রচনা লিখেছেন। নীলদংশন সম্ভবত তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উৎকৃষ্টতম উপন্যাস বা বড়োগল্প। বন্দী হয়ে একজন সাধারণ কাজি নজরুল ইসলাম কীভাবে বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলামে পরিণত হলো, পীড়িত হয়ে হয়ে ঢুকলো মৃত্যুর গর্তে : সে-কাহিনী স্নায়ুছেঁড়া তীব্রতার সাথে পেশ করেছেন সৈয়দ শামসুল হক। তিনি ব্যাপক বিস্তৃত জীবন ও সমাজের ঔপন্যাসিক নন, ব্যক্তিই তাঁর বিষয়; আধুনিক ঔপন্যাসিকদের বিষয় ব্যক্তিই। এ-জন্যেই তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বহুমাত্রিক জীবন বা যুদ্ধ আশ্রয় ক’রে লেখা হয় নি, হয়েছে ব্যক্তিকে অবলম্বন ক’রে। তাঁর শক্তি চরমভাবে বিকাশ পেয়েছে দূরত্ব (১৯৮১) উপন্যাসে, যা চেতনা ও উৎকর্ষে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর চাঁদের অমাবস্যাও কাঁদো নদী কাঁদোর কাছাকাছি। শওকত আলীর যাত্রা মুক্তিযুদ্ধের পলায়নপর পর্যায়ের খণ্ডচিত্র, মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন চমৎকার, কিন্তু অনেকাংশে গ্লানিকর। অন্য শ্রেণীর উপন্যাসে ব্যক্তিক ও সামাজিক গ্লানিই বড়ো হয়ে উঠেছে; যেমন হয়েছে রশীদ করিমের আমার যত গ্লানি, ও রাহাত খানের কোলাহল-এ। রশীদ করিম শরৎচন্দ্রেরই স্মার্ট, ও নিম্নমানের, ষাট-সত্তর দশকীরূপ; তাঁর পাত্রপাত্রীরা সমাজের নষ্ট উচ্চবিত্তশ্রেণীর, লেখকের ভাষায় ‘খচ্চর’শ্রেণীর। ওই শ্রেণীর চেতনার সাথে লেখকের চেতনাও অভিন্ন : হুইস্কি, পরস্ত্রী, রাতের ক্লাবচর্চার মানসিকতা রশীদ করীমের, এতে নতুনত্ব আছে। রাহাত খানও মোটামুটিভাবে ওই শ্রেণীকেই নিয়েছেন কোলাহল-এ, তবে দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। পঙ্ক উদঘাটনে উৎসাহী ও আকৃষ্ট হ’লেও ওই সামাজিক পঙ্ককে রূপান্তরিত করার মধ্যবিত্তসুলভ বিলাসী চেতনা তাঁর মাঝে দেখা যায়।

একুশের চেতনা তিন দশকের উপন্যাসে আধেয়ে প্রকাশ পেয়েছে যতোটুকু, তারচেয়ে বেশি সম্ভবত প্রকাশ পেয়েছে উপন্যাসের ভাষায়। একুশের আগে বাঙালি মুসলমানের ভাষা ছিলো অপরিস্রুত, অনেকটা পুথিসাহিত্যের ভাষা; ওই ভাষার অবিরল আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দ জানিয়ে দিতো যে রচয়িতা মুসলমান, পাকিস্তানি। বায়ান্নোর পরে পরিস্রুত হয়ে উঠতে থাকে বাঙলা ভাষা, বিদায় নিতে থাকে আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দ, এবং ষাটের দশকে বাঙলা ভাষা প্রায় বিশুদ্ধ বাঙলায় পরিণত হয়। এখন পশ্চিম বঙ্গের লেখকেরাও যে-পরিমাণ ইসলামি শব্দ ব্যবহার করেন, বাঙলাদেশের আধুনিকেরা সে-পরিমাণ ব্যবহার করেন না। ভাষা-আন্দোলন ভাষাকেই স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত করেছে বেশি। এ-রচনা লেখার সময় একটি বইয়ের কথা আমার বারবার মনে পড়েছে, কিন্তু সেটি কোনো প্রথাসম্মত উপন্যাস নয়; তবু কেনো যেনো আমার ওটিকেই মনে হয় একুশের চেতনার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, যদিও ওটি গবেষণাগ্রন্থ এবং একপেশে; বইটি বদরুদ্দীন উমরের পূর্ব বাঙলার ভাষা-আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি। বাঙলাদেশে তিন দশকে এ-একটি বই-ই লেখা হয়েছে, যার নায়ক কোনো বিশেষ ব্যক্তি নয়, যার ‘নায়ক পূর্ব বাঙলার সংগ্রামী জনগণ’। তবে উপন্যাসের, আধুনিক উপন্যাসের, নায়ক যে সংগ্রামী জনগণই হ’তে হবে, তা নয়; ভীরুতম ব্যক্তিও নায়ক হ’তে পারে আধুনিক উপন্যাসের, এবং সাধারণতই হচ্ছে তাই। উপন্যাস থেকে বিদায় নিয়েছে বীরেরা, যারা কখনো ছিলো না; অন্তত আধুনিক সময়ে নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *