শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ

শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ

আধুনিক শিল্পকলার সূচনা-দশকগুলোতে এ-অভিনবজাতকের মুখোমুখি অত্যন্ত অসহায় বোধ করে প্রথাগত শিল্পকলাভ্যস্ত জনগণ, যেনো তাদের চোখের সামনে হঠাৎ হাজির হয়েছে এক দুরূহ-দুর্বোধ্য-অভাবিত স্ফিংস, যার কবিতা দুরূহ, সঙ্গীত দুৰ্জ্জেয়, চিত্রকলা দুর্বোধ্য। এতোদিন তারা কবিতা-সঙ্গীত-চিত্রকলার মতো ব্যাপারগুলো সম্ভোগ ক’রে এসেছে বেশ আরামে; কেউ কোনো বাধা দেয় নি। কিন্তু আধুনিক শিল্পকলা নিজের আর সম্ভোগলিপ্সু জনগণের মধ্যে তুলে দেয় এক নিষ্ঠুর দেয়াল, যার নাম দুরূহতা। সাধারণ সম্ভোগীরা আধুনিক শিল্পকলার উদ্ধত দুরূহতায় প্রথমে অসহায় আক্রান্ত-বিব্রত বোধ করে, পরে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। কেননা এ-শিল্পকলা তাদের বোধ-বোধি-মেধা-অনুভূতিকে যারপরনাই অপমান করেছে। আধুনিক শিল্পকলার উন্মেষবিকাশের দশকগুলোতে যখন নতুন দেবতারা সৃষ্টি ক’রে চলেছিলেন তাঁদের নতুন স্বর্গনরক, আর তার বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠছিলো সাধারণ শিল্পসম্ভোগীরা, তখন আধুনিক শিল্পকলার চারিত্র্য-তার দুরূহতার ব্যাকরণ-ব্যাখ্যা ক’রে এক অনন্য অতুলনীয় দীর্ঘ রচনা লিখেছিলেন স্পেনীয় দার্শনিক সমালোচক হোসে অর্তেগা ঈ গাসেৎ। তাঁর রচনাটি আজো অপরিচিত বাঙলা ভাষাঞ্চলে, অন্তত আমি যতোটা জানি ‘শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ’ নামী ওই রচনাটি আজো অনুবাদিত হয় নি বাঙলা ভাষায়; এমনকি আধুনিক শিল্পকলার দুরূহতা সম্পর্কে গাসেতের ব্যাখ্যাও চোখে পড়ে নি বাঙলা ভাষার লেখা কোনো রচনায়। ছ-দশক আগে প্রকাশিত গাসেতের রচনাটির সাথে পরিচয় না থাকা দুর্ভাগ্যের কথা। খুব ভালো হতো যদি এ-দীর্ঘ রচনাটির একটি বিশ্বস্ত অনুবাদ প্রকাশ করা যেতো, কিন্তু সে-উদ্যমের বিশেষ অভাব আমার। তাই এখানে আমি অর্তেগার বক্তব্য-ব্যাখ্যার সারাংশ লিপিবদ্ধ ক’রেই তৃপ্তি পেতে চাই। এ-সারাংশও হবে আমার রুচি-অনুসারী, হয়তো অর্তেগার ব্যক্তিগতভাবে প্রিয় অনেক অংশ বাদ প’ড়ে যাবে, এবং কোথাও কোথাও প্রবল হয়ে উঠবে আমার নিজেরই ব্যাখ্যা। তাই এটিকে মনে করা যেতে পারে অর্তেগাভিত্তিক একটি নতুন রচনা।

সব রকমের আধুনিক শিল্পকলাই অজনপ্রিয়। আধুনিক কবিতা বা নাটক বা সঙ্গীত বা চিত্রকলা বা শিল্পকলার অন্য যে-কোনো শাখার কথাই ধরা যাক না কেনো, দেখা যাবে এরা অজনপ্রিয়। এদের অজনপ্রিয়তা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং তা অবধারিত ও নিয়তিবশত। কেউ কেউ হয়তো বলবেন যে শিল্পকলার জগতে যে-কোনো নবাগতকেই যাপন করতে হয় একটা সঙ্গরোধতার কাল। এ প্রসঙ্গে অনেকেরই মনে পড়বে এরনানিকে ঘিরে কলহের কথা, রোম্যান্টিসিজমের উদ্ভববিকাশের সময়ের নানা গোলযোগের কাহিনী। তবে আজকালকার শিল্পকলার অজনপ্রিয়তা ভিন্ন রকমের। কি জনপ্রিয় আর কি অজনপ্রিয় তার মাঝে একটা স্পষ্ট পার্থক্য নির্দেশ করা দরকার। একটা নতুন রচনা-বা শিল্প-রীতি জনপ্রিয়তা আয় করতে সাধারণত কিছুটা সময় নিয়ে থাকে। এ-সময়ে এটা জনপ্রিয় নয়, তবে একে অজনপ্রিয়ও বলা চলে না। রোম্যান্টিসিজমের উদ্ভব ও বিকাশের সময়ের পরিস্থিতির সম্পূর্ণ বিপরীত পরিস্থিতি বিরাজ করছে আজকাল। রোম্যান্টিসিজম বেশ তাড়াতাড়িই জয় ক’রে নিয়েছিলো জনগণকে, যাদের কাছে পুরোনো ধ্রুপদী শিল্পকলা কখনোই কোনো আবেদন জাগাতে পারে নি। রোম্যান্টিসিজমের শত্রুরা ছিলো মুষ্টিমেয়। মুদ্রাযন্ত্র আবিষ্কারের পর প্রথম বহুসংস্করণ জুটেছিলো রোম্যান্টিকদের ভাগ্যেই। রোম্যান্টিসিজম ছিলো জনপ্রিয় শিল্পরীতির আদিরূপ। রোম্যান্টিসিজম, গণতন্ত্রের প্রথম সন্তান, জনতা বা জনগণের আদর পেয়েছে ভালোভাবেই।

অন্যদিকে আধুনিক শিল্পকলা জনতা বা জনমণ্ডলিকে সব সময়ই পাবে বিরোধীরূপে। কারণ, তা অনিবার্যভাবেই অজনপ্রিয়, উপরন্তু তা জনপ্রিয়তাবৈরী। আধুনিক যে-কোনো শিল্পসৃষ্টিই সাধারণ জনমণ্ডলির মনে জন্ম দেয় এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া। এ-শিল্পকলা জনমণ্ডলিকে ভাগ ক’রে দেয় দু-গোত্রে: পাওয়া যায় একটি ক্ষুদ্র গোত্র, যা গঠিত মুষ্টিমেয় অনুরাগীতে, এবং একটি বড়ো গোত্র, যাতে যুথবদ্ধ শত্রুতাপরায়ণ সংখ্যাগরিষ্ঠরা। তাই এ-শিল্পকলা কাজ করে এক সামাজিক অনুঘটকের মতো, যা নিরবয়ব নিরাকার অসংখ্যকে বিভক্ত করে দুটি পৃথক মানবগোত্রে। তবে কি সেই সূত্র বা নীতি, যা এ-দুটি পরস্পরবৈরী গোত্রের জননী? প্রতিটি শিল্পসৃষ্টিই জাগায় মতপার্থক্য;–কেউ কেউ তা পছন্দ করে, কেউ কেউ করে না। কেউ কেউ বেশি পছন্দ করে, কেউ কেউ কম। তবে এমন মতপার্থক্যের মূলে কোনো নীতি বা সূত্র নেই, বিভিন্ন ব্যক্তির আকস্মিক রুচি অনুসারে কোনো শিল্পকর্ম পছন্দ হয় বা হয় না। কিন্তু আধুনিক শিল্পকলার ব্যাপারে যে-গোত্রভাগ ঘটে, তা ব্যক্তিগত রুচিভিন্নতার থেকে অনেক গভীর স্তরীয় ব্যাপার। এমন নয় যে সংখ্যাগরিষ্ঠরা তরুণদের শিল্পকলা পছন্দ করে না, আর সংখ্যালঘিষ্ঠরা পছন্দ করে। আসল ব্যাপার হচ্ছে অধিকাংশ মানুষ, জনমণ্ডলি, এ-শিল্পকলা বুঝতে পারে না। সমস্যাটি বোঝা ও না বোঝার, ব্যক্তিগত বা গোত্রগত রুচি বা নীতির নয়। উগোর এরনানির বিরুদ্ধে যারা হৈচৈ করেছিলো, তারা নাটকটি ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলো, এবং বুঝতে পেরেছিলো ব’লেই তারা অপছন্দ করেছিলো নাটকটি।

সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আধুনিক শিল্পকলার যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটি চোখে পড়ে সহজে, তা হচ্ছে এ-শিল্পকলা জনগণকে ভাগ ক’রে দেয় দু-ভাগে। একভাগ বুঝতে পারে এ-শিল্পকলা, আরেকভাগ বুঝতে পারে না। এর মানে একটি গোত্রের রয়েছে অনুধাবনের এমন শক্তি, যা নেই অন্য গোত্রটির। তাই তারা মানবপ্রজাতির দুটি ভিন্ন উপগোত্র। আধুনিক শিল্পকলার লক্ষ্য রোম্যান্টিসিজমের মতো সমগ্র জনমগুলি নয়; বরং বিশেষ শক্তিসম্পন্ন সংখ্যালঘু একটি গোত্রকে লক্ষ্যে রেখেই সৃষ্টি করা হয় আধুনিক কবিতা বা নাটক বা চিত্রকলা। তাই এ-শিল্পকলার প্রতি রুষ্ট হয়ে ওঠে জনমণ্ডলি। যখন কেউ কোনো একটি শিল্পকর্ম বুঝতে পারে, বুঝেসুঝে অপছন্দ করে, তখন সে নিজেকে উন্নততর বোধ করে শিল্পকর্মটি ও তার স্রষ্টার থেকে। তাই তার ক্রোধ জাগার কোনো কারণই ঘটে না। কিন্তু যখন সে শুধু বুঝতে না পারার জন্যেই অপছন্দ করে কোনো শিল্পসৃষ্টি, তখন সে অপমানিত বোধ করে গোপনে; তার মনে জন্ম নেয় হীনমন্যতা, আর ওই হীনমন্যতাবোধটুকু লুকোনোর জন্যে সে ব্যবহার করে তার ক্রোধকে। একজন বন্দে আলী মিয়ার রচনা হয়তো অপছন্দ করে অনেকেই, কেননা তারা ওই রচনা ভালোভাবেই বুঝতে পারে, এবং বুঝতে পারে যে ওই রচনা তুচ্ছ। এতে পাঠক সহজেই একরকম আত্মতৃপ্তি বোধ করে, নিজেকে অধিকতর প্রতিভাবান গণ্য করে ওই লেখকের চেয়ে; কেননা ইচ্ছে করলে তারাও সহজে ওই রচনার চেয়ে উৎকৃষ্ট কিছু লিখতে পারতো। কিন্তু একজন সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মুখোমুখি পাঠকের এমন তৃপ্তির অবকাশ ঘটে না। পাঠক তাঁর মুখোমুখি নিজেকে বোধ করে অসহায় ও সামান্য, যেনো তার মস্তিষ্কের কোনো অংশ রয়ে গেছে এখনো অবিকশিত। তখন একরকম হীনতাবোধ দ্বারা আক্রান্ত হয় সে, এবং ক্রমশ সুধীন্দ্রনাথকে গণ্য করতে থাকে নিজের শত্রু ব’লে। আধুনিক শিল্পকলা অধিকাংশ মানুষকে বুঝতে বাধ্য করে তারা কি, অর্থাৎ তারা নিখাদ সাধারণ মানুষ–এমন এক ধরনের প্রাণী, যারা শিল্পকলার মন্ত্র অনুধাবনের শক্তিরহিত, বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের কাছে যারা অন্ধ ও বধির। কিন্তু জনগণ কেনো সহ্য করবে এমন অপমান, যারা শতবর্ষ ধ’রে লাভ ক’রে আসছে নানা রকম স্তব আর স্তুতি? তারা তো শতবর্ষ ধ’রে শাসন ক’রে আসছে সব কিছু, আর এখন বহিষ্কৃত হবে সে-অধিকার থেকে? তাই জনগণ বোধ করতে থাকে যে এ-নতুন শিল্পকলা, যা সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়ানুভূতিসম্পন্ন একটি ক্ষুদ্র গোত্রের শিল্পকলা, মানুষ হিশেবে তাদের অধিকারকেই বিপন্ন ক’রে তুলেছে। তাই যেখানেই একটু আত্মপ্রকাশ করে নতুন শিল্পকলা, সেখানেই শোনা যায় জনমণ্ডলির কোলাহলচিৎকার।

আধুনিক শিল্পকলা যে আপামর সাধারণ উপভোগ করতে পারে না এতে বোঝা যায় এর প্রেরণাপুঞ্জ সর্বজনীনভাবে মানবিক নয়। সকলের জন্যে এ-শিল্প নয়, বরং একটি বিশেষ গোত্রের জন্যে। এ-গোত্রটি উৎকৃষ্টতর নাও হ’তে পারে, তবে সুস্পষ্টভাবে স্বতন্ত্র। একটি বিষয় এখানে পরিষ্কার ক’রে নেয়া দরকার। নান্দনিক সুখানুভূতি বা আনন্দ বলতে কি বুঝে থাকে অধিকাংশ মানুষ? যখন তারা কোনো একটি শিল্পকর্ম, কবিতা বা গ্রন্থ বা নাট্যাভিনয়, ‘পছন্দ’ করে, তখন কি ঘটে তাদের চিত্তে? এর উত্তর কঠিন নয়, বরং বেশ সহজ। সাধারণ জনমণ্ডলি কোনো নাটক বা উপন্যাস তখনি পছন্দ করে, যখন ওই নাটকে বা উপন্যাসে উপস্থাপিত মানবিক নিয়তি আকর্ষণ করে তাদের। যখন পাত্রপাত্রীদের প্রেম-ঘৃণা, আনন্দ-বেদনা তাদের চিত্তকে আলোড়িত করে, এবং তারা নিজেরা তাতে এমনভাবে অংশ নেয় যেনো ওই সব ঘটনা সত্যিকার বাস্তব জীবনে ঘটছে। তখনই তারা কোনো একটি নাটক বা উপন্যাসকে ‘ভালো’ বলে, যখন তাদের কাছে এমন প্রতিভাস সৃষ্টি হয় যে ওই নরনারীরা বাস্তবেরই পাত্রপাত্রী। কবিতায় তারা খোঁজে কবির আড়ালে আছে যে-ব্যক্তিটি, তার ব্যক্তিগত বেদনা ও সংরাগ। সে-সব চিত্রকলা পছন্দ করে তারা, যাতে তারা পায় এমন সব নরনারীর প্রতিকৃতি, যাদের সাক্ষাৎ পেলে বাস্তব জীবনে তারা আনন্দ পেতো। তাই অধিকাংশ মানুষ নান্দনিক সুখানুভূতি বলতে বোঝে চিত্তের এমন এক অবস্থা, যা তাদের প্রাত্যহিক আচরণের সাথে অভিন্ন। শিল্পকলায় তারা খুঁজে ফেরে বাস্তব জীবনকেই-বাস্তব জীবনের সুখদুঃখ, আনন্দবেদনা, ভাবাবেগভাবালুতা। অর্থাৎ যার প্রতি তাদের সমস্ত মানসিক সক্রিয়তা চালিত হয়, তা দৈনন্দিন জীবনের সাথে অভিন্ন। তা হচ্ছে মানুষ ও তাদের সংরাগ। শিল্পকলা তাদের কাছে এমন এক সামগ্রী, যা তাদের সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দেয় আকর্ষণীয় মানবিক ক্রিয়াকলাপের সাথে। কিন্তু যেই শিল্পকলায় প্রাধান্য ছড়াতে থাকে নান্দনিক উপাদানরাশি, অন্তর্হিত হয় প্রাত্যহিক জীবনের উপভোগ্য ব্যাপারস্যাপার, অমনি অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করে তারা, এবং বিমূঢ় হয়ে পড়ে কিছু বুঝতে না পেরে। যেহেতু তাঁরা ব্যবহারিক প্রবণতা ছাড়া আর কিছুই কখনো চর্চা করে নি, তাই সে-শিল্পকর্ম, যা তাদের ভাবাবেগ-ভাবালুতা জাগিয়ে তোলে না, তাতে তারা খেই হারিয়ে ফেলে। অধিকাংশ মানুষ গ্রন্থের পাত্রপাত্রীদের বেদনায় অশ্রুভারাতুর হ’তে ভালোবাসে আর সুখ পায়, এবং পাত্রপাত্রীদের আনন্দে হয়ে ওঠে উল্লসিত। তবে এ-আনন্দবেদনা প্রকৃত শৈল্পিক সুখানুভূতি থেকে অত্যন্ত পৃথক। শিল্পকলার মানবিক উপাদানে আবিষ্ট থাকা অসমঞ্জস প্রকৃত নান্দনিক আনন্দানুভূতির সাথে। তাই অধিকাংশ মানুষ নান্দনিক সুখানুভূতি উপভোগে ব্যর্থ হয়, আনন্দ আহরণ করে শুধু মানবিক উপাদানের ভাবাবেগ থেকে। জনপ্রিয় উপন্যাস বা নাটক বা কবিতায় তারা মানবিক উপাদানের স্বাদ পায় প্ৰাণ ভ’রে, আর শিল্পকলা উপভোগের নামে ভোগ করে শুধু স্বল্পমূল্য আবেগ।

এখানে রয়েছে একটি সহজ সরল দৃকসমস্যা। কোনো কিছু দেখার জন্যে বিশেষভাবে পাত করতে হয় আমাদের দৃষ্টি। ঠিক মতো দৃষ্টিপাত না করলে বস্তুটি হয়তো দেখা যাবে অস্পষ্টভাবে বা দেখাই যাবে না। ধরা যাক কাঁচের জানালার ভেতর দিয়ে দেখা কোনো বাগানের কথা। বাগানটি দেখার জন্যে চোখ এমনভাবে ফেলতে হবে, যাতে জানালার ভেতর দিয়ে দৃষ্টিরশ্মি অবলীলায় চলতে পারে, এবং অবিলম্বে গিয়ে পড়ে বাগানের লতাগুল্ম পুষ্পরাশির ওপর। যেহেতু বাগানটিকে দেখতে চাই এবং আমাদের চোখ নিপতিত ওটিরই ওপর, তাই আমরা জানালাটিকে দেখি না। জানালার ভেতর দিয়ে দেখি বাগানটিকে। তবে ইচ্ছে করলে আমরা বাগানটিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে পারি, দৃষ্টি ফেলতে ও দেখতে পারি জানালাটিকে। তখন আমাদের চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যায় বাগানটি; শুধু জানালার কাঁচে লেগে থাকে বাগানের উদ্ভিদপুষ্পের অস্বচ্ছ বর্ণালি। তাই বাগান আর জানালা দেখা দুটি ভিন্ন ব্যাপার; কারণ তাতে দরকার দৃষ্টির দু-রকম বিন্যাস। একইভাবেই যখন কেউ কোনো শিল্পকর্মে শুধু দেখতে চায় জন ও মেরি বা ট্রিস্টান ও ইজোলডের হৃদয়-মন-অভিভূত করা ভাগ্য, তখন সে এমনভাবে তার দৃষ্টি বিন্যস্ত করে যে তার চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে যায় শিল্পকর্মটি। তার মন দখল ক’রে থাকে শুধু ওই পাত্রপাত্রীদের আনন্দবেদনা। ট্রিস্টানের বেদনা যতোটুকু সত্য বা বাস্তব ব’লে মনে হয় তার কাছে, শুধু সেটুকুই তার মনে জাগিয়ে তোলে আলোড়ন। কিন্তু কোনো শিল্পকর্ম ততোটুকুই শৈল্পিক, তার যতোটুকু অ-বাস্তব বা অ-সত্য। টিশিয়ানের আঁকা অশ্বারোহী পঞ্চম চার্লসের চিত্রটি উপভোগ করতে হ’লে আমাদের ভুলে যেতে হবে যে ওটি পঞ্চম চার্লসের চিত্র। এটিকে মনে করতে হবে একটি প্রতিকৃতি বা চিত্র অর্থাৎ সৃষ্ট সামগ্রী। চিত্রিত ব্যক্তি ও তার চিত্র দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিশ। আমরা এ-দুটির যে-কোনো একটির প্রতি আকর্ষণ বোধ করতে পারি। যদি ব্যক্তির প্রতি আকর্ষণ বোধ করি, তাহলে আমরা জীবন যাপন করি তারই সাথে, আর যদি আকৃষ্ট হই চিত্রটির প্রতি, তাহলে আমরা অবলোকন করি একটি শিল্পকর্ম। বেশি লোক বাগানকে এড়িয়ে জানালার ওপর নিবদ্ধ করতে পারে না তাদের দৃষ্টি, অর্থাৎ তারা শিল্পকে দেখতে পায় না। তার বদলে তারা এর ভেতর দিয়ে সরাসরি তাকায় এবং শিল্পকর্মটির মানবিক উপাদানে জড়িয়ে পড়ে। যখন তাদের ওই মানবিক উপাদানটুকু বাদ দিয়ে শিল্পকলার ওপর চোখ ফেলতে বলা হয়, তারা জানায় যে অমন কিছু দেখতে পায় না তারা। সত্যিই তারা দেখতে পায় না; কারণ তার সবটাই শৈল্পিক স্বচ্ছতা–যা দেখা যায় না; কারণ তার ভেতর দিয়ে দৃষ্টি অন্যত্র চ’লে যায়-এবং বিষয়বস্তুহীন।

সারা উনিশশতক ভ’রে শিল্পীরা এগিয়েছিলেন অবিশুদ্ধ রীতিতে। তাঁরা শিল্পকর্মে নান্দনিক উপাদান কমিয়ে এনেছিলেন চরমভাবে, এবং মানবিক উপাদানে ভ’রে দিয়েছিলেন প্রায় তার সবটা। এ-অর্থে উনিশশতকের সমস্ত স্বাভাবিক শিল্পকলাই বাস্তবধর্মী। বিটোফেন ও বাগনার বাস্তবধর্মী, আর শাতোব্রায়াঁ ও জোলাও তাই। এ-ধরনের রচনা শুধু অংশত শিল্পকর্ম বা শৈল্পিক বস্তু। এগুলো ভোগ করার জন্যে খাঁটি শৈল্পিক সংবেদনশীলতার দরকার হয় না; যা দরকার, তা হচ্ছে মানবিক সংবেদনশীলতা ও আমাদের প্রতিবেশীদের সুখদুঃখে সহানুভূতি জানানোর ইচ্ছে। তাই উনিশশতকী শিল্পকলা জনপ্রিয় হয়েছিলো, তা তৈরী হয়েছিলো জনমণ্ডলির জন্যে। তা যতোখানি জীবনখণ্ড ছিলো, ততোখানি শিল্পকলা ছিলো না। মনে রাখা ভালো যদি কোনো কালে দেখা দেয় দু-ধরনের শিল্পকলা, যার একটি সংখ্যালঘুদের অপরটি সংখ্যাগুরুদের জন্যে, তাহলে সংখ্যাগুরুদের জন্যে রচিত শিল্পকলাকে অবশ্যই হতে হবে বাস্তবধর্মী। এখানে প্রশ্ন উঠবে-বিশুদ্ধ শিল্পকলা কি সম্ভব? হয়তো সম্ভব নয়। তবে বিশুদ্ধ শিল্পকলা যদি অসম্ভবও হয়, তাহলেও একটি প্রবণতা থাকতে পারে, যার লক্ষ্য শিল্পকলার বিশুদ্ধিসাধন। এ-প্রবণতা ক্রমিকভাবে কমিয়ে আনে শিল্পকলায় মানবিক উপাদানের প্রাধান্য। অথচ রোম্যান্টিক ও প্রাকৃতবাদী শিল্পকলায় ছিলো মানবিক উপাদানেরই প্রাবল্য প্রাধান্য। এ-প্রক্রিয়ায় এমন হ’তে পারে যে শিল্পকলা থেকে মানবিক আধেয় এতো কমে যেতে পারে যে তা আর চোখেই পড়বে না! এর ফলে জন্ম নিতে পারে এমন শিল্পকলা, যা বোধগম্য শুধু সেই স্বল্পসংখ্যকের কাছে, যারা শৈল্পিক সংবেদনশীলতাঋদ্ধ। এ-শিল্পকলা জনমণ্ডলির জন্যে নয়, শিল্পীদের জন্যে।

এভাবেই আধুনিক শিল্পকলা জনসাধারণকে ভাগ করে দেয় দু-শ্রেণীতে-যারা এ-শিল্পকলা বোঝে ও যারা বোঝে না; অর্থাৎ যারা শিল্পী ও যারা শিল্পী নয় ৷ নতুন শিল্পকলা শৈল্পিক শিল্পকলা। এর প্রশংসা আর পুরোনো শিল্পকলার নিন্দে করা আমার উদ্দেশ্য নয়, আমি চাই শুধু তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করতে। নতুন শিল্পকলা এখন একটি বিশ্বজনীন ব্যাপার। এর স্রষ্টারা বুঝতে পেরেছেন যে প্রথাগত শিল্পকলা তাঁদের জন্যে নয়। উপরন্তু তাঁরা বিরক্ত প্রথাগত শিল্পকলার প্রতি। এ-তরুণ শিল্পীদের আমরা খুন করতে পারি বা পারি অনুধাবনের চেষ্টা করতে। যেই আমরা তাঁদের বোঝার বা অনুধাবনের উদ্যোগ নিই, তখন ধরা পড়ে যে তাঁরা পোষেণ এক সুস্পষ্ট, সুসমঞ্জস ও যৌক্তিক শিল্পবোধ। শিল্পকলায় পুনরাবৃত্তির কোনো মূল্য নেই। প্রতিটি শৈল্পিক ধারা একসময় নিঃশেষ হয়ে যায়। যখন কোনো পুরোনো ধারা নিঃশেষ হয়ে যায় তখন নতুন ধারার উদ্ভবকে ভাগ্য বলেই মানা উচিত। আধুনিক শিল্পকলার বিশ্লেষণ করলে ধরা পড়ে যে এর একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর বিমানবিকীকরণ প্রক্রিয়া

এখন একটু প্রপঞ্চবিজ্ঞান চর্চা করতে চাই। মনে করা যাক একজন বিখ্যাত ব্যক্তি মারা যাচ্ছেন। তাঁর পাশে ব’সে আছেন তাঁর শোকাতুরা স্ত্রী, আর একজন চিকিৎসক পরীক্ষা করছেন নাড়ি। এছাড়াও আছেন আরো দু-ব্যক্তি : পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্যে সেখানে উপস্থিত একজন সংবাদদাতা, এবং আকস্মিকভাবে সেখানে উপস্থিত রয়েছেন একজন চিত্রকর। তাঁরা চারজন-স্ত্রী, চিকিৎসক, সংবাদদাতা, চিত্রকর- দেখছেন একই ঘটনা, তবু একই ঘটনা তাঁদের চারজনকে নাড়া দিচ্ছে বিভিন্নভাবে। শোকাতুরা বিহ্বল স্ত্রীর কাছে এ-ঘটনার, বিখ্যাত ব্যক্তিটির মৃত্যুর, যে-তাৎপর্য, তার সাথে সামান্যই মিল আছে চিত্রকরের কাছে প্রতিভাত তাৎপর্যের। স্ত্রী ঘটনাটিকে দেখছেন ব্যক্তিকভাবে আর চিত্রকর দেখছেন নৈর্ব্যক্তিকভাবে। তাঁদের দৃষ্টি এতো ভিন্ন যে সন্দেহ হ’তে পারে তাঁরা দুজন একই ঘটনাস্থলে উপস্থিত কিনা। তাই একই বাস্তবতা বা সত্য বিভিন্ন বাস্তবতা বা সত্যে বিশ্লিষ্ট হয়ে যেতে পারে যখন তার প্রতি তাকানো হয় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। তাই মনে প্রশ্ন জাগে–এসব বাস্তবতার মধ্যে কোনটিকে গ্রহণ করবো সত্য ও প্রামাণিক ব’লে? এর উত্তর হবে স্বেচ্ছাচারী। নিজ নিজ খেয়াল অনুসারেই আমরা কোনো একটিতে সত্য ব’লে মেনে নেবো। এ-বাস্তবতারাশি সমতুল্য; তবে এদের প্রতিটি প্রকৃত বা প্রামাণিক বিশেষ বিশেষ দৃষ্টিকোণের নিকট। কথিত বিখ্যাত ব্যক্তিটির মৃত্যুশয্যায় চারজন ব্যক্তি চার দৃষ্টিকোণ নিয়ে উপস্থিত। তাঁদের চারজনের দৃষ্টিকোণের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করার জন্যে প্রয়োগ করতে পারি একটি মানদণ্ড। তা হচ্ছে মৃত্যুর ঘটনাটির সাথে তাদের আবেগিক দূরত্বের মাত্রা। ওই ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনা ও তাঁর শোকাতুরা স্ত্রীর মধ্যে কোনো আবেগিক দূরত্ব নেই, ঘটনাটি তাকে এতোটা পীড়ন করছে, তাঁর মনকে এতোটা নিমগ্ন ক’রে রাখছে ঘটনার মধ্যে যে তিনি অভিন্ন হয়ে উঠেছেন মৃত্যুপথযাত্রীর সাথে। তিনি ওই ঘটনার অংশ। কোনো কিছু দেখতে হ’লে তার থেকে দর্শককে থাকতে হয় একটু দূরে। কিন্তু এখানে স্ত্রী ঘটনা থেকে দূরস্থিত নন;-তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত নন, তিনি অবস্থিত ঘটনার অভ্যন্তরে। তাই তিনি ঘটনাটি দেখছেন না; তিনি ‘যাপন’ করছেন ঘটনাটি।

চিকিৎসক অবস্থিত বেশ কিছুটা দূরে। তিনি পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন, তিনি ওই শোকভারাতুর মহিলার মতো ঘটনার অংশ হয়ে পড়েন নি। তবে চিকিৎসক হিশেবে দায়িত্ব পালনের জন্যে, আপন পেশার মহিমা রক্ষার জন্যে তিনিও কিছু পরিমাণে অংশ নেন ওই ঘটনায়। তিনি ওই ঘটনায় হৃদয়াবেগের সাথে জড়িত নন, তবে পেশাগতভাবে জড়িত। তিনিও কিছুটা ‘যাপন’ করেন ওই ঘটনা, তবে আবেগে নয়, পেশাগতভাবে। সাংবাদিকটির দিকে তাকালে দেখি তিনি সুদূরে অবস্থিত ওই বিয়োগান্তক ঘটনা থেকে। তাঁর মনে কোনো আবেগ নেই। সাংবাদিক এ-ঘটনাস্থলে কোনো মানবিক উৎসাহে নয়, পেশাগত কারণেই হাজির হয়েছেন ঘটনাস্থলে। তবে চিকিৎসকের সাথে তাঁর পার্থক্য আছে। চিকিৎসকের পেশা চিকিৎসককে ঘটনার অংশ হতে বাধ্য করে, আর সাংবাদিকের পেশা সাংবাদিককে বাধ্য করে দূরে থাকতে, পর্যবেক্ষকের ভূমিকা নিতে। তাঁর কাছে এটি একটি ঘটনামাত্র, যা সম্পর্কে তিনি পত্রিকায় প্রকাশ করবেন একটি প্রতিবেদন। ঘটনায় তিনি আবেগিক অংশ নেন না, আবেগগতভাবে মুক্ত তিনি; ঘটনাস্থলে তিনি একজন বহিরস্থিত। তিনি ঘটনাটি ‘যাপন’ করেন না, পর্যবেক্ষণ করেন। তবে পাঠকের মনে কিছুটা আবেগবেদনা সঞ্চারিত সংক্রামিত ক’রে দেয়ার বাসনা আছে তাঁর মনে। তিনি পাঠকদের আকৃষ্ট, আলোড়িত, এমনকি অশ্রুভারাতুরও ক’রে দিতে চান যেনো তাঁরা একজন প্রিয়জনের বিয়োগবেদনা বোধ করতে পারে। হোরেসের বিখ্যাত পরামর্শটি তাঁর জানা যে কাউকে কাঁদাতে হ’লে প্রথমে নিজে কাঁদতে হবে। তাই সাংবাদিক আবেগাভিনয় করেন এ-আশায় যে এতে তাঁর প্রতিবেদন সাহিত্যরসসমৃদ্ধ হবে। যদিও তিনি ঘটনাটি ‘যাপন’ করেন না, তবুও তিনি ভান করেন ঘটনাটি ‘যাপনের’।

চিত্রকর ওই ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও তিনি ওই ঘটনা থেকে যেনো শতক্রোশ দূরবর্তী। ঘটনার আবেগ তাঁকে আলোড়িত করে না, তিনি একজন নিরাসক্ত নৈর্ব্যক্তিক দর্শক। ঘটনার বিয়োগান্তক আন্তর তাৎপর্য তাঁর চোখে পড়ে না; তাঁর সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ শুধুমাত্র দৃষ্টিগ্রাহ্য বস্তুরাশির ওপর-বর্ণ, আলো ও ছায়ার ওপর। তাই চিত্রকর ওই ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও ঘটনা থেকে তিনি সবচেয়ে দূরবর্তী ও সবচেয়ে কম আবেগে আলোড়িত।

ওপরে চেষ্টা করা হয়েছে বাস্তবতা ও আমাদের মধ্যে দূরত্বের মাত্রা নির্ণয়ের। আবেগগতভাবে কোনো ঘটনায় আমরা যতোটা অংশ নিই ততোটা অংশ হয়ে পড়ি ঘটনার, আর যতোটা দূরে থাকি আবেগগতভাবে ততোটাই নিজেদের মুক্ত ক’রে নিই ঘটনা থেকে। তখন আমাদের কাছে বাস্তব ঘটনাটি হয়ে ওঠে পর্যবেক্ষণের বস্তু। এর এক দিকে আছে বাস্তব জগত-ব্যক্তি, বস্তু, পরিস্থিতি, অর্থাৎ যাপিত বাস্তবতা, আর অন্য দিকে রয়েছে পর্যবেক্ষিত বাস্তবতা। বিভিন্ন ধরনের বাস্তবতার মূলে রয়েছে যাপিত বাস্তবতা; অন্যান্য বাস্তবতা এ-যাপিত বাস্তবতা থেকেই উৎসারিত। যাপিত বাস্তবতার সাথে যদি পরিচয় না থাকতো তাহলে তার কোনো বর্ণনা বা প্রতিকৃতিই বোধগম্য হতো না আমাদের। যে-চিত্রে বা কবিতায় যাপিত বাস্তবতার সামান্য চিহ্নও নেই, তা আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অবোধ্য ও অর্থহীন। তাই বাস্তবতার মাত্রারাশির মধ্যে যাপিত বাস্তবতাই প্রধান, আর একেই আমরা গণ্য করি ‘বাস্তবতা’ রূপে। যাপিত বাস্তবতাকে মানবিক বাস্তবতাও বলা যায়। যে-চিত্রকর নৈর্ব্যক্তিকভাবে মৃত্যুদৃশ্য দেখেন, তাঁকে ‘অমানবিক’ ব’লে মনে হবে।

আধুনিক শিল্পকলা বিস্ময়কর দ্রুততায় এগিয়ে চলেছে বিচিত্র পথে, তবে তার রয়েছে এক সাধারণ বৈশিষ্ট্য। আধুনিক শিল্পকলায় প্রধান হয়ে উঠছে এক নতুন শৈল্পিক সংবেদনশীলতা। যখন আধুনিক শিল্পকলার সবচেয়ে সাধারণ ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করতে উদ্যোগী হই, তখন দেখতে পাই যে এতে বড়ো হয়ে উঠেছে বিমানবিকীকরণপ্রবণতা। ১৮৬০-এর একটি চিত্রের দিকে তাকালে ধরা পড়ে যে চিত্রকর চিত্রটিতে আঁকা বস্তুসমূহকে এমনভাবে উপস্থাপিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন যাতে তা অবিকল তেমন থাকে, যেমন ছিলো যাপিত বা মানবিক বাস্তবতায়। অর্থাৎ তিনি চেষ্টা করেছেন অবিকল সাদৃশ্য প্রতিষ্ঠার। ওই চিত্রের মানুষ, গৃহ, পাহাড় মুহূর্তের মধ্যে চেনা যায়, অনেক দিনের বান্ধব তারা আমাদের। কিন্তু একটি আধুনিক চিত্রে ওগুলোকে চিনতে কষ্ট হয়। আধুনিক শিল্পী বাস্তবকে অবিকল আঁকতে পারেন নি ব’লে যে এমন হয়, তা নয়, বরং এমন হয় কারণ তিনি যাত্রা করেছেন বাস্তবের বিপরীত অভিমুখে। বাস্তবের দিকে যাওয়ার বদলে যাচ্ছেন তিনি বাস্তবের বিপরীতে। তিনি বাস্তবকে ভাঙছেন, চুরমার করছেন তার মানবিক উপাদান, করছেন বাস্তবের বিমানবিকীকরণ। প্রথাগত চিত্রকলায় উপস্থাপিত অনেক কিছুর সাথেই কাল্পনিক সম্পৰ্ক পাতাতে পারি আমরা, প্রেমে পড়তে পারি কারো কারো; কিন্তু আধুনিক চিত্রে উপস্থাপিত কারো সাথে এমন সম্পর্ক পাতানো অসম্ভব। কারণ আধুনিক শিল্পী তাদের সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন ক’রে এনেছেন যাপিত বাস্তবতা থেকে, তাই তাদের আশ্রয় ক’রে আমরা কিছুতেই পৌঁছোতে পারি না চেনাজানা প্রাত্যহিক মানবিক জীবনে। আধুনিক শিল্পী আমাদের বন্দী করেন এক দুর্বোধ্য বিশ্বলোকে, যেখানে ছড়িয়ে আছে এমন সব বস্তুরাজি, যাদের সাথে মানবিক যোগাযোগ অকল্পনীয়। তাই তাদের সাথে গ’ড়ে তুলতে হয় যোগাযোগের ভিন্ন রীতি, যা বস্তুর সাথে আমাদের প্রথাগত সম্পর্করীতি থেকে আপাদশির ভিন্ন। এই যে নতুন জীবনরীতি, যাতে লুপ্ত হয়ে যায় স্বাভাবিক স্বতস্ফূর্ত জীবন, তাকে বলা যেতে পারে শিল্পবোধ ও শিল্পসম্ভোগ। এ-জীবনে যে আবেগ ও সংরাগ নেই, তা নয়, তবে এ-আবেগ ও সংরাগ আমাদের মানবিক জীবনের আবেগসংরাগ থেকে ভিন্ন। এ-অতিবস্তুরাশি আমাদের আন্তর শিল্পীর মনে জাগায় দ্বিতীয় এক ধরনের সংরাগ। ওগুলোই বিশেষভাবে নান্দনিক আবেগঅনুভূতি।

কেউ কেউ বলতে পারেন এ-ফলাফল লাভের সহজ উপায় তো মানবিক রূপ-আকার-আকৃতি-মানুষ, গৃহ, পাহাড়, অরণ্য প্রভৃতি একেবারে বাদ দেয়া, এবং এর বদলে গ’ড়ে তোলা সম্পূর্ণরূপে অভিনব মৌলিক আকার-আকৃতি-রূপ। কিন্তু তা সম্ভব নয়। এমনকি চরম বিমূর্ততম রেখায়ও লেগে থাকে কোনো-না-কোনো স্বাভাবিক আকার-আকৃতির ইশারা। তাছাড়া আধুনিক শিল্পকলা যে অমানবিক, তা শুধু এ-কারণে নয় যে এতে কোনো মানবিক উপাদান নেই, বরং এ-কারণে যে এটি এক সুস্পষ্ট বিমানবিকীকরণ ক্রিয়া। শিল্পী মানুষ, পাহাড়, গৃহ থেকে একেবারে ভিন্ন কিছু আঁকছেন বা আঁকবেন, এটা বড়ো কথা নয়, কথা হচ্ছে তিনি আঁকছেন এমন মানুষ, যার সাথে মানুষের সাদৃশ্য যথাসম্ভব স্বল্প, আঁকছেন এমন গৃহ বা পাহাড়, যাদের সাথে বাস্তব গৃহ ও পাহাড়ের রয়েছে ক্ষীণতম সাদৃশ্য। আধুনিক শিল্পী মানবিক উপাদানের ওপর এমন আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ক’রেই আহরণ করেন নান্দনিক সুখানুভূতি। অনেকের কাছে মনে হ’তে পারে যে বাস্তবতাকে এমনভাবে জয় করা বেশ সহজ, কিন্তু আসলে তা নয়। সম্পূর্ণ নিরর্থক ছবি আঁকা বা কথা বলা কঠিন কাজ নয়; আসত্তিহীন শব্দ ও এলোমেলো রেখা সাজালেই তা হ’তে পারে। কিন্তু এমন কিছু সৃষ্টি করা, যা ‘প্রকৃতি’র নকল নয় অথচ বহন করে তার সারবত্তা, তার জন্যে দরকার প্রতিভা।

উনিশশতকের অনুগ্রহ পাওয়া শিল্পকলা সব সময়ই ধারণ করেছে যাপিত বাস্তবতার এমন একটি শাঁস, যা কাজ করেছে নান্দনিক সুখানুভূতির মূলরূপে। অধিকাংশ মানুষের কাছে মানবিক উপাদান উপভোগ করাই হচ্ছে নান্দনিক সুখানুভূতি। তাদের কাছে শিল্পকলা হচ্ছে প্রতিফলিত জীবন, বিশেষ মেজাজে প্রকৃতিকে দেখা বা মানবভাগ্যের উপস্থাপন। কিন্তু নবশিল্পীরা বিশ্বাস করেন এর বিপরীতে। যাপিত বাস্তবকে উপভোগ করা প্রকৃত শিল্পসম্ভোগ নয়; তা একরকম প্রতারণা, অথচ উনিশশতক তার মাঝেই ঘোরাফেরা করেছে। শিল্পকলার সমস্ত মহৎ যুগই চেষ্টা করেছে যাতে তাদের শিল্পসৃষ্টি মানবিক উপাদানকে ঘিরেই আবর্তিত না হয়। আধুনিক শিল্পীরা ওই জীবন ছেড়ে চলেছেন শিল্পের মহিমামণ্ডিত সরণীতে। আর এ-জন্যেই তাঁরা ভাঙছেন বাস্তবকে, এবং চালাচ্ছেন বিমানবিকীকরণ প্রক্রিয়া।

আধুনিক সম্প্রদায় নিষিদ্ধ ক’রে দিয়েছেন শিল্পকলায় মানবিক উপাদানের অনুপ্রবেশ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বস্তুরাশিতে গ’ড়ে ওঠা মানবিক উপাদান সৃষ্টি করে তিন স্তরের এক স্তরক্রম। প্রথমে আছে মানুষের জগত; তারপর সপ্রাণ বস্তুরাশির জগত; আর তৃতীয়ত রয়েছে অজৈব বস্তুরাশি। এ-স্তরক্রমে যা যতো ওপরে আধুনিক শিল্পকলা তাকে ততো নিষিদ্ধ মনে করে। তাই প্রথম স্তরটি, অর্থাৎ মানুষের জগতটিকে তাঁরা এড়িয়ে চলেন সবচেয়ে বেশি; কারণ তা সবচেয়ে মানবিক। এ-ব্যাপারটি সঙ্গীত ও কবিতায় চোখে পড়ে স্পষ্টভাবে। বিটোফেন থেকে বাগনার পর্যন্ত সঙ্গীত প্রধানত ব্যাপৃত ছিলো ব্যক্তিক আবেগানুভূতির উৎসারণে। সুরকার ধ্বনির মহাকাঠামোতে পরিবেশন করতেন আত্মজীবনী। শিল্পকলা, কম-বেশি, ছিলো স্বীকারোক্তি। সংস্পর্শ- সংক্রমণ ছাড়া শিল্পভোগের আর কোনো উপায় ছিলো না তখন। ‘সঙ্গীতে সংরাগরাশি সম্ভোগ করে নিজেদের’, ঘোষণা করেছিলেন নিটশে। ‘ট্রিস্টান ও ইজোড্’-এ বাগনার ঢেলে দিয়েছিলেন মাথিলডা হোসেনডংকের সাথে তাঁর ব্যভিচারকে। এ-সঙ্গীত উপভোগ করার জন্যে আমরাও কতিপয় ঘণ্টার জন্যে হয়ে উঠি অস্পষ্টভাবে ব্যভিচারী। ওই সঙ্গীত আমাদের কাঁদায়, কাঁপায়, ইন্দ্রিয়াতুরভাবে বিগলিত করে। বিটোফেন থেকে বাগনার পর্যন্ত সব সঙ্গীতই মেলোড্রামা। কিন্তু একে প্রতারণা ব’লে মনে হয় আধুনিক শিল্পীর কাছে। কারণ এটা সুযোগ নেয় মানুষের সে-সহজাত মহৎ দুর্বলতার, যা মানুষের মধ্যে সংক্রামিত করে তার প্রতিবেশীর আনন্দবেদনাকে। হাসি ও অশ্রু, নান্দনিকভাবে, প্রতারক। সৌন্দর্য কখনো বিষণ্ণ বা প্রসন্ন স্মিতহাসির অধিক ইশারা করে না। নান্দনিক সুখানুভূতি হওয়া উচিত দৃষ্টিসুখানুভূতি। সুখানুভূতি হ’তে পারে অন্ধ বা দৃষ্টিসম্পন্ন ৷ মাতালের সুখ অন্ধ। তার সুখের মূলে আছে মদ্য, কিন্তু এর কোনো উদ্দেশ্য বা প্রেরণা নেই। যে-লোক কোনো বাজি জেতে, সেও সুখী, কিন্তু কিছুটা ভিন্নভাবে। সে কোনো কিছু পাবে ব’লে সুখী। মাতালের সুখ তাঁর ভেতরেই আবদ্ধ, সে জানে না কেনো সে সুখী। কিন্তু বাজিজয়ী জানে তার সুখের কারণ। সে জানে এমন কিছু ঘটেছে, যা সুখকর। কোনো ঘটনা যখন যান্ত্রিক না হয়ে মানসিক হয়ে উঠতে চায়, তখন তার থাকা দরকার এ-বোধ, এ-উদ্দেশ্যে। রোম্যান্টিক শিল্পকলায় উপভোগীরা শিল্পকর্মটি উপভোগ না ক’রে উপভোগ করে তাদের আবেগপুঞ্জ, ওই শিল্পকর্মটি হচ্ছে তাদের আনন্দের অ্যালকোহল। শিল্পকলা যখন কেবল যাপিত বাস্তবতারই সমাবেশ হবে, তখন এমন হবেই। যাপিত বাস্তবতার শক্তি এতো বেশি যে তা শিল্পের সৌন্দর্য ভোগে বাধা দেয়।

দেখার জন্যে দূরত্ব দরকার। প্রতিটি শিল্পকলা ব্যবহার করে একটি যাদুবাতি, যা তার বিষয়বস্তুকে দূরে সরিয়ে নেয় ও রূপান্তরিত করে। তার পর্দায় বিরাজ করে তারা সুদূর, অগম্য বিশ্বের অধিবাসীর মতো, পরম দূরত্বে। যখন তা না ঘটে তখন আমরা অভিভূত হই এক কিম্ভূত বিহ্বলতায়,–বুঝে উঠতে পারি না ওই বস্তুরাশি যাপন’ করবো, না ‘পর্যবেক্ষণ’ করবো। এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ে মাদাম তুসোর মোমের পুতুলগুলোর কথা। ওগুলো মনে জাগায় একরকম অদ্ভুত অস্বস্তি। ওগুলো যে অস্বস্তি জাগায়, তার কারণ ওগুলো বাধা দেয় ওগুলো সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি নিতে। ওগুলোকে সজীব প্রাণী মনে করার সাথে সাথে ওগুলো রটিয়ে দেয় তাদের গোপন কথা। আবার পুতুল হিশেবে গণ্য করার সাথে সাথে ওগুলো যেনো প্ৰতিবাদী শ্বাস ফেলতে থাকে। পরিশেষে ওই সবগুলো ক্লান্ত, অসুস্থ করে আমাদের। নতুন সংবেদনশীলতা শিল্পকলায় মানবিক উপাদানের প্রাধান্যকে ততোটা অরুচিকর মনে করে যেমন অরুচিকর অনুভূতি জাগে সংস্কৃত মানুষের মনে মাদাম তুসোর মোমের পুতুল দেখে, যদিও জনতা সব সময়ই আনন্দ পাচ্ছে এ-জঘন্য মোমের ধোঁকা দেখে। জীবন ও শিল্পকে মিশ্রিত হ’তে দেখা খুবই বিরক্তিকর।

হ্বাগনারে মেলোড্রোমা হয়ে ওঠে শিখরস্পর্শী। তাই তাঁর পর দেখা দেয় এক মৌল পরিবর্তন। সঙ্গীতকে ব্যক্তিক আবেগানুভূতি থেকে মুক্তি দেয়ার দরকার হয়ে পড়ে। প্রয়োজন হয়ে পড়ে তার বিশুদ্ধিকরণ। দেবুসি তাই করেন। তাঁর কারণেই এখন মূর্ছা আর অশ্রু ছাড়া প্রশান্তভাবে সঙ্গীত শোনা সম্ভব হয়ে উঠেছে। দেবুসি সম্পন্ন করেছেন সঙ্গীতের বিমানবিকীকরণ, তাই তিনি সূচনা করেছেন সঙ্গীতকলার নবযুগ।

একই ঘটনা ঘটেছে কবিতায়। কবিতাকেও মুক্ত করতে হয়েছে সব দায় থেকে মানবিক উপাদানে বোঝাই হয়ে হাওয়া-ক’মে-যাওয়া বেলুনের মতো কবিতা গড়াচ্ছিলো, ঢু খাচ্ছিলো গাছ আর গৃহচুড়োয়। এখানে মালার্মে দেখা দেন ত্রাতারূপে। তিনি গীতিকবিতাকে ফিরিয়ে দেন তার স্বর্গীয় গুণ ও উড়ালের শক্তি। সম্ভবত তিনি গন্তব্যে পৌঁছোতে পারেন নি, তবে তিনিই এর সূচনাকারী। রোম্যান্টিক শতকে কবিতার বিষয় কি ছিলো? কবিরা আমাদের জানাতেন তাঁদের উচ্চমধ্যবিত্ত ব্যক্তিক আবেগরাশি: তাঁদের প্রধানঅপ্রধান বেদনাপুঞ্জ, কামনাবাসনা, ধর্মীয় ও রাজনীতিক বিশ্বাস। তাঁদের দৈনন্দিন সত্তাকে প্রবল করে তোলাই ছিলো তাঁদের অভিলাষ। তাঁরা চাইতেন খুব মানবিক হ’তে।

আধুনিক কবি চান শুধুমাত্র কবি হ’তে। সমস্ত নতুন শিল্পকলাই বিশ্বাসী স্বায়ত্তশাসনে, সুনির্দিষ্ট সীমানায়। তাঁর কাছে জীবন এক জিনিশ শিল্পকলা অন্য জিনিশ, তাই তিনি দুটিকে পৃথক রাখারই পক্ষপাতী। যেখানে ব্যক্তিমানুষটির শেষ সেখানেই শুরু কবির। ব্যক্তির নিয়তি হচ্ছে মানবিক জীবন যাপন করা, আর কবির নিয়তি যা অস্তিত্বহীন, তা উদ্ভাবন করা। কবি জগতকে ঋদ্ধ করেন বাস্তবতার সাথে তাঁর কল্পনাপ্রতিভার মহাদেশ যোগ ক’রে।

উনিশশতকে মালার্মেই প্রথম কবি, যিনি হ’তে চেয়েছিলেন আর কিছু নন, শুধু কবি। তিনি বর্জন করেছিলেন, তাঁর নিজের ভাষায়, ‘প্রকৃতিদত্ত উপাদানরাশি’ এবং রচনা করেছিলেন ক্ষুদ্র গীতিময় একগুচ্ছ বস্তু, যা মানবিক প্রাণী ও পুষ্প থেকে ভিন্ন। তাঁর কবিতা ‘অনুভবের’ জন্যে নয়। এ-কবিতায় যেহেতু নেই কোনো মানবিক উপাদান, তাই এর আবেগ অনুভবের কোনো সূত্রও নেই এতে। কবিকে তিনি মুক্ত করেছেন পেছনের ব্যক্তিটি থেকে। যে-দিকে তাকাই সে-দিকেই দেখতে পাই মানবিকতা থেকে পলায়ন। বিমানবিকীকরণ প্রক্রিয়ার কৌশল নানাবিধ। মালার্মের কৌশল থেকে আজকালকার কৌশল অনেক ভিন্ন। তবে আধুনিক সঙ্গীত যেমন শুরু হয়েছে দেবুসি থেকে, তেমনি সমস্ত আধুনিক কবিতা এগিয়ে চলেছে মালার্মের নির্দেশিত পথ ধরেই। এখন কবিতা হয়ে উঠেছে রূপকের উচ্চতর বীজগণিত।

আধুনিক কবিতা রূপকখচিত, আর রূপকই হচ্ছে বিমানবিকীকরণ প্রক্রিয়ার প্রধান অস্ত্র। রূপকই সম্ভবত মানুষের সবচেয়ে ফলবান সম্ভাবনার এলাকা। আমাদের আর সমস্ত শক্তি সীমাবদ্ধ ক’রে রাখে আমাদের বাস্তব জগতে, যা কিছু আছে তারই মাঝে। আমরা বড়োজোর পারি বিভিন্ন বস্তুকে মেলাতে বা ভাঙতে। শুধু রূপকই দিতে পারে মুক্তি। বাস্তবের মাঝে রূপক সৃষ্টি করতে পারে কাল্পনিক শিখর, ভাসমান দ্বীপপুঞ্জ। তবে রূপক বিমানবিকীকরণের বড়ো অস্ত্র হ’লেও এটিই একমাত্র নয়। আরো বহু আছে। প্রেক্ষাপট বদলে দিয়ে সহজেই এ-কাজ করা যায়। প্রাত্যহিক জীবনে সব কিছুই আমরা বিন্যস্ত দেখি এক স্বাভাবিক ক্রমে, সুনির্দিষ্ট স্তরক্রমে। কিছু কিছু জিনিশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিছু কিছু জিনিশ কিছুটা কম গুরুত্বপূর্ণ, আর কিছু জিনিশ একেবারেই তুচ্ছ। বিমানবিকীকরণের জন্যে বস্তুরাজির স্বাভাবিক স্বভাব বদলানোর দরকার নেই। শুধু মূল্যবিন্যাস বদলে দিয়ে এমন শিল্প সৃষ্টি সম্ভব, যাতে জীবনের তুচ্ছ ব্যাপারগুলো মহাআকার ধ’রে আবির্ভূত হয়।

এখানেই খুঁজে পাই আধুনিক শিল্পকলার দুটি আপাতবিষম রীতির মধ্যে রূপকের পরাবাস্তবতার মধ্যে-সম্পর্কের সূত্র। এরা উভয়েই পরিতৃপ্ত করে বাস্তবকে এড়ানোর আকাঙ্খা। কাব্যিক ঊর্ধ্বলোকে উড়াল না দিয়ে শিল্পকলা ডুব দিতে পারে স্বাভাবিক প্রেক্ষাপটের নিম্নতলে। জীবনে যে-সব জিনিশ থাকে আমাদের চোখের আড়ালে, সেগুলোকে বড়ো করে তুলে সাধন করা যায় শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ।

নিজ অধিকারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত ক’রে রূপক এখন কমবেশি প্রধান ভূমিকা নিচ্ছে কবিতাসৃষ্টিতে। অর্থাৎ নান্দনিক লক্ষ্য বদলে গেছে, তা চলছে এখন বিপরীত অভিমুখে। আগে বাস্তবতাকে সাজিয়েগুজিয়ে দেয়া হতো রূপকালঙ্কারে, আর এখনকার প্রবণতা হচ্ছে কবিতাবহির্ভূতকে বা বাস্তবকে পরিত্যাগ করা। রূপককেই ‘বাস্তবায়িত’ করা, তাকেই কবিতায় পরিণত করা এখনকার লক্ষ্য। নান্দনিক প্রক্রিয়ার এ-উৎক্রম শুধু রূপকের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। এ-উৎক্রম ছড়ানো আধুনিক শিল্পকলার সমস্ত কলাপ্রকৌশলেই।

আমাদের মন ও বস্তুর মধ্যে সম্পর্ক এখানে যে আমরা বস্তুসমূহকে ভাবি ও তাদের সম্বন্ধে ধারণা সৃষ্টি করি। বাস্তবতার ততোটুকুই আয়ত্তে আমাদের তার যতোটুকু সম্পর্কে আমরা ভাবনাধারণা তৈরি করতে সক্ষম হই। এ-ভাবনাধারণাগুলো মিনারের মতো, যেখান থেকে আমরা দেখি বিশ্বকে। প্রতিটি নতুন ভাবনাধারণা, গ্যেটে বলেছেন, নতুন বিকশিত প্রত্যঙ্গের মতো। ভাবনাধারণা দিয়ে আমরা দেখি বিশ্বজগতকে, কিন্তু মনের স্বভাব হচ্ছে যে ভাবনাধারণাগুলো দেখতে পাই না আমরা। যেমন চোখ দেখার সময় দেখতে পায় না নিজেকে। বলতে পারি, চিন্তা হচ্ছে ভাবনাধারণার সাহায্যে বাস্তবকে আয়ত্ত করার প্রচেষ্টা। তবে এক ধ্রুবদূরত্ব বিরাজ করে ভাবনা ও বস্তুর মধ্যে। বস্তু সব সময়ই তার সম্পর্কিত ধারণার পাত্রটিকে ভ’রে দিয়ে উপচে পড়ে, কারণ বস্তুটি তার সম্পর্কিত ভাবনাধারণা থেকে বেশি কিছু, অন্য কিছু। তাই ভাবনাধারণা থেকে যায় এমন এক মাচানের মতো যার সাহায্যে আমরা পৌঁছোতে চাই বাস্তবতায়। তবুও আমাদের স্বভাব হচ্ছে আমরা যাকে বাস্তবতা ভাবি তাকেই বাস্তবতা ব’লে গণ্য করি, এবং ভাবনাকে বস্তু ব’লে মেনে নিই। বাস্তবতার জন্যে আকুলতা আমাদের নিয়ে যায় বাস্তবতার এক আদর্শায়িতরূপে। এই হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি। এখন যদি বদলে দিই এ-প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক অভিমুখ, তাকে ক’রে তুলি বিপরীতমুখি, বাস্তবের দিকে পিঠ ফিরিয়ে ভাবনাধারণাগুলোকে সজীব করে তুলি ভাবনাধারণারূপেই, অর্থাৎ যদি আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে ‘বাস্তবায়িত’ ক’রে তুলতে চাই আমাদের ভাবনাধারণাগুলোকে, তাহলে আমরা সম্পন্ন করি সেগুলোর বিমানবিকীকরণ ও বিবাস্তবায়ন। কারণ ভাবনাধারণ বাস্তবিকই অবাস্তব। তাদের বাস্তব রূপে গ্রহণ করা এক রকম আদর্শায়ন, অসত্যায়ন। অভিব্যক্তিবাদ, ঘনক্ষেত্রবাদ প্রভৃতি বাস্তবায়িত করতে চায় ভাবনাধারণাকে। এ-শিল্পীরা বস্তুর ছবি না এঁকে আঁকেন ভাবনাচিন্তার চিত্র। তাঁরা বাহ্যজগতের দিকে চোখ বন্ধ ক’রে দৃষ্টি স্থিরনিবদ্ধ করেন অন্তর্লোকের মন্বয় চিত্রপুঞ্জের ওপর।

কেনো এ-বিমানবিকীকরণ? কেনো এ-বিরাগ মানবিক উপাদানের প্রতি? অন্যান্য ঐতিহাসিক প্রপঞ্চের মতো এরও মূলে রয়েছে নানা জটিল কারণ। তার সবগুলো বর্ণনা খুবই দুরূহ ও অসম্ভব। এর একটি কারণ প্রথাগত শিল্পকলার সাথে নতুন শিল্পীর সংঘর্ষ। নতুন প্রতিভার চিত্রে এতোদিন চলে আসা শিল্পকলা সৃষ্টি করতে পারে ধনাত্মক বা ঋণাত্মক প্রতিক্রিয়া। তিনি খাপ খাওয়াতে পারেন অতীতের সাথে, মনে করতে পারেন অতীত তাঁর ঐতিহ্য, এবং তার উৎকর্ষসাধনে আত্মনিয়োগ করতে পারেন তিনি। বা হ’তে পারেন তিনি অতীতের প্রতি বিরূপ, প্রথাগত প্রতিষ্ঠিত গৃহীত শিল্পকলার প্রতি তাঁর থাকতে পারে স্বতস্ফূর্ত বিরাগ। অতীত-অনুরাগী শিল্পী খুশি থাকবেন প্রথাগত আধারআধেয় নিয়েই, পুনরাবৃত্তি করবেন তিনি কতিপয় পবিত্র রীতির, আর অতীতবিমুখ শিল্পী প্রথাগত ঐতিহ্য থেকে শুধুমাত্র স’রেই যাবেন না, সাথে সাথে তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করবেন কালপরম্পরায় মাননীয় আদর্শের প্রতি তাঁর প্রতিবাদ। কোনো কালের শিল্পকলা যদি গ’ড়ে ওঠে তার আগের কোনো কালের শিল্পকলার ওপর ভিত্তি ক’রে, তবে তা বুঝতে বিশেষ কষ্ট হয় না, বেশ সহজেই তা বোধগম্য হয়। কিন্তু অতীতের ঋণাত্মক প্রভাব বুঝতে, বিশেষ একটি শিল্পরীতি যে গ’ড়ে উঠেছে প্রথাগত রীতির সাথে সচেতন বিরোধিতায়, তা বোঝার জন্যে দরকার বিশেষ উদ্যম। আধুনিক শিল্পকলার অনেক কিছুই জন্মেছে অতীতের, রোম্যান্টিসিজমের ঋণাত্মক প্রভাবে। বদলেয়ার কালো ভেনাসের স্তব করেছেন, কারণ প্রথাগতটি শাদা। তখন থেকেই শিল্পকলা প্রথাগত খাত থেকে দূরে স’রে আসতে শুরু করে, এবং এখন পুরোপুরি জন্ম নিয়েছে এমন এক শিল্পকলা, যা অতীতের বিরোধিতায় মুখর। এর কারণ খুবই সহজ। অতীতের ভার এখন বড়ো বেশি হয়ে পড়েছে, এতে রুদ্ধ হয়ে পড়েছে সমকালীন অনুপ্রেরণা। অন্যভাবে বলা যায়, প্রথাগত প্রণালিরাশি বাধা দেয় শিল্পী ও তাঁর চারপাশের জগতের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগে। এমন ক্ষেত্রে দুটি ব্যাপার ঘটতে পারে। অতীত শ্বাস রোধ করতে পারে নতুন সৃষ্টিপ্রতিভার, যেমন ঘটেছে মিশরে, বাইজানটিয়ামে, এবং সাধারণভাবে প্রাচ্যে। বা ধীরে ধীরে নতুন সৃষ্টিপ্রতিভা নিজেকে মুক্ত করতে পারে অতীতের ঘাতক হাত থেকে, এবং বিকশিত করতে পারে নতুন শিল্পকলার পর্ব। এটা ঘটেছে ইউরোপে। ইউরোপ চিরকালই ভবিষ্যমুখি, আর প্রাচ্য আক্রান্ত এক অসংশোধনীয় দুরারোগ্য প্ৰথাবাদে।

বিমানবিকীকরণ ও মানবিক উপাদানে বিরাগের মূলে বিশেষভাবেই রয়েছে বাস্তবতার প্রথাগত ভাষ্যের প্রতি বিরূপতা। আক্রমণের তীব্রতা ততো বেশি হয় লক্ষ্যস্থল হয় যতো সন্নিকট। উনিশশতকই আমাদের সবচেয়ে সন্নিকট, তাই উনিশশতকি রীতিনীতির প্রতি বিরাগবিরূপতা আধুনিক শিল্পকলায় সবচেয়ে প্রবল। অন্যদিকে আধুনিক সংবেদনশীলতা স্থানকালগতভাবে দূরস্থিত শিল্পের প্রতি পোষে সন্দেহজনক উৎসাহ। আদিমতা বা প্রাগৈতিহাসিকতার প্রতি আগ্রহ তার প্রবল। আসলে আদিম শিল্পের শৈল্পিক উৎকর্ষে মুগ্ধ নন আধুনিক শিল্পীরা, তাঁরা আকৃষ্ট ওই শিল্পকলার ঐতিহ্যহীনতার প্রতি। ঐতিহ্য, আধুনিক শিল্পীর কাছে, একটি অশ্লীল শব্দ।

অর্তেগা ঈ গাসেতের প্রবন্ধটি বেরোনোর পর কেটে গেছে ছটি দশক, এবং এ-গ্রহের পুবেপশ্চিমে নতুন কাল সৃষ্টি ক’রে বিকশিত হয়ে গেছে আধুনিক শিল্পকলা-কবিতা, উপন্যাস, সঙ্গীত, চিত্রকলা প্রভৃতি। এখন জেগে উঠছে প্রতিক্রিয়া, এবং আবার মানবিক উপাদানরাশি-বস্তু, মানুষ, মানুষের কামনা-বাসনা-আবেগ-দেয়াল ভেঙে ঢুকছে শিল্পকলায়। বাঙলায় আধুনিকতা এসেছিলো এক সময়, এখন চলছে তার বিদায়ের পালা। বাঙলা সাহিত্য সব সময়ই সাধারণত বোঝাই থেকেছে মানবিক উপাদানে, এবং এর দিকে তাকালে বারবার মনে হয় এ যতোখানি জীবনসৃষ্টি ততোখানি শিল্পসৃষ্টি নয় ৷ এখানে জীবনের প্রাবল্য খুবই বেশি। মানবিক উপাদান এখানে এতো শস্তা ও সুলভ যে দু-হাতে ছানতে কে উৎসাহ বোধ করবে না! তাই এ-সাহিত্য মানবিক উপাদানে অনেক সময় এতোটা বোঝাই হয়ে ওঠে যে সমস্ত ব্যাপারটিকে মনে হয় ঘিনঘিনে, যদিও সাধারণ উপভোগীরা ভালোবাসেন ওই মানবিক নোংরার মধ্যে ডুবে থাকতেই। বাঙলা সাহিত্য ভাবালুতাপ্রাণ। ভাবালুতাই শিল্পকলা ব’লে গণ্য এখানে। আমাদের দুটি নোংরা শব্দ ‘সুখদুঃখ’। মধ্যবিত্ত বাঙালির মনে রয়েছে একটি দুরারোগ্য দাদ, যা চুলকোলে পাওয়া যায় বিশেষ আনন্দ। ওই দাদটির নাম ‘সুখদুঃখ’। যে-লেখক বাঙালিচিত্তের ওই দাদটি চুলকোনোর যতো বেশি প্রতিভা রাখেন, তিনিই ততো বেশি আদরণীয়। তিরিশের দশকে কবিতায়, ও কিছুটা গদ্যে, এসেছিলো আধুনিকতা, এখন পুনরায় ফিরে যাচ্ছি অনাধুনিকতায়। এটা স্বাভাবিক। দীর্ঘকাল ধ’রে একই রকম চলতে পারে না। তাছাড়া জীবন শিল্পসাহিত্যে উপস্থাপিত করা সহজ। যে-কোনো নির্বোধ আবেগ-বেদনা-অশ্ৰুচাপ পরিবেশন করতে পারে শিল্পকলার ছদ্মবেশ, আর তাতে মানবিক সহানুভূতিবশত আলোড়িত হয়ে উঠতে পারে উপভোগীরা। তাই হচ্ছে এখন বাঙলা গদ্যেপদ্যে-স্রষ্টা শিল্পকলাঅন্ধ, উপভোগী শিল্পকলাঅন্ধ, অন্ধকারে দু-অন্ধ সৃষ্টি ও সম্ভোগ ক’রে চলেছে অশিল্প।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *