মাইকেল মধুসূদন : প্রথম বিশ্বভিখারি ও ত্রাতা
বিশ্বের সেই আদিম উর্বরতা আজ আর নেই। এখন সারা ব্রহ্মাণ্ড খুঁজে বীজ সংগ্রহ না করলে, কাব্যের কল্পতরু জন্মায় না। : সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
তিনজন কবির মহিমা পরিণত হয়েছে বাঙলা সাহিত্যের প্রিয় কিংবদন্তি ও সংস্কারে;- তাঁদের প্রথমজন মাইকেল মধুসূদন। জনশ্রুতি, অনেক সময়, নিজের চেয়ে বড়ো ক’রে তোলে কবিদের, যাচাই করতে গিয়ে দেখি সত্যের মাত্রা কম, অনেক বেশি লোকবিশ্বাস ও দশকপরম্পরার রটনা। ভারতীয় অঞ্চলে সংস্কার ও কিংবদন্তি পরিগ্রহ করতে পারে সাংঘাতিক রূপ; বিচারবিবেচনা বাদ দিয়ে একই শ্লোক পুনরাবৃত্তি ক’রে যেতে পারি আমরা শতাব্দীর পর শতাব্দী, এবং হয়ে উঠতে পারি অন্ধ পৌত্তলিক। তবে মধুসূদনের মহিমা শুধু জনশ্রুতিনির্ভর নয়, তা দাঁড়িয়ে আছে অটল ভিত্তির ওপর। ঠাণ্ডা, ঢেউশূন্য, অন্ধকার, ও আঞ্চলিক বাঙলা ভাষায় তিনি সঞ্চার ক’রে দিয়েছিলেন অভাবিত তাপ, তরঙ্গ, আলো ও আন্তর্জাতিকতা, যা প্রায় তুলনাহীন। বাঙলা ভাষার প্রথাগতভাবে বিনয়ী ভক্ত কবিদের মধ্যে প্রথম অবিনয়ী, দ্রোহী ও সংস্কারহীন তিনি; এবং একই সঙ্গে তিনি এক দুঃখী বিশ্বভিখারি, যিনি আপন ভাণ্ডার ভরার জন্যে ভিক্ষা ক’রে ফিরেছেন দেশে দেশে, ও রত্নে ভরেছেন বাঙলা ভাষার শূন্য ভাঁড়ার। মধুসূদন আমাদের প্রথম আধুনিক, যেহেতু তিনি বাঙলা ভাষার প্রথম বিশ্বভিখারি কবি। তিনি বুঝেছিলেন, বিশশতকি আধুনিকতা উন্মেষের অনেক আগেই, যে মরুভূমির মতো আধুনিক কালে দেশদেশান্তর থেকে কবিতার বীজ সংগ্রহ না করলে কবিতার কল্পতরু জন্মানো অসম্ভব।
এক বিস্ময়কর শতাব্দী উনিশশতক; তা বিস্ময়কর একটি সাহিত্যিক কারণেও। বাঙলা সাহিত্যের আত্মা-অস্থি-মজ্জা কবিতায় গঠিত; কবিতাই বাঙলা সাহিত্যের মাতৃভাষা। হাজার বছর আগে যখন উন্মেষ ঘটেছিলো বাঙলা সাহিত্যের, তখন তা প্রথম কথা ব’লে উঠেছিল কবিতায়- পদ্যে। সে-ভাষা সে ভোলে নি কয়েক শো বছর; যখনি কথা বলতে চেয়েছে, তখনি তার কণ্ঠ থেকে উৎসারিত হয়েছে নানা সুরস্বরের ছন্দমিলবিন্যস্ত স্তবক। পদ্য ছাড়া আর কোন ভাষা সে শেখে নি অনেক শতাব্দী। উনিশশতকে বাঙলা সাহিত্য আয়ত্ত করে এক নতুন ভাষা, যার নাম গদ্য। গদ্য নতুন তা বিস্ময় ছড়িয়ে দেয় দিকে দিকে; আর এ-বিস্ময় টিকে রয় আধশতাব্দী ভ’রে। তাই উনিশশতকের প্রথমার্ধ ভ’রে বাঙলা সাহিত্যের কণ্ঠ থেকে গদ্য ছাড়া উচ্চারিত হয় নি আর কোন ভাষা। গদ্য- গদ্য- গদ্য : এই হচ্ছে উনিশশতকের প্রথমার্ধ। যে-দিকে তাকাই দেখি দশদিগন্ত ছেয়ে লাফিয়ে উঠেছে গদ্যের ঢেউ, যে-দিকে কান পাতি শোনা যায় কলহ, বিতর্ক, বিচার, অর্থাৎ গদ্যস্বর। দারুণ কর্মময় ও কর্মী এ-সময়টি; বাঙলা তার সারা ইতিহাসে এতো কাজে আগে আর হাত দেয় নি। কাজের জন্যে দরকার গদ্য, স্বপ্নের জন্যে কবিতা। উনিশশতকের প্রথম পাঁচ দশকের দু-হাত ভ’রে ছিলো কাজ, তাই তার দরকার পড়েছিলো গদ্যের, তা যতোই খিন্ন-কৃশ-রুগ্ন হোক-না-কেনো। বাঙলার স্বাপ্নিকেরা তখন ম’রে গেছে, বা প্রতীক্ষা করছে জন্মের, বা প্রস্তুতি নিচ্ছে আত্মপ্রকাশের, ওই বাস্তব সময়ে চারদিক কলরোলিত ক’রে রেখেছিলেন কর্মীপুরুষেরা। প্রচণ্ড কর্ম ও ভয়াবহ স্বপ্নহীনতার সময় উনিশশতকের প্রথম ভাগ; তাই এ-সময় কোনো কবি নেই বাঙলা ভাষায়। এমনি অন্ধকারাচ্ছন্ন অসময় তখন বাঙলার। সব বাঙালি লিপ্ত তখন গদ্যে ও কর্মে।
এ-সময়ে ছিলেন একজন পদ্যরচয়িতা, যাঁর কোনো পংক্তিই কবিতা হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখে নি। কোনো স্বপ্নই ছিলো না ঈশ্বর গুপ্তের, তাঁর পেশাও ছিলো স্বপ্নহীনতার সাথে খাপ-খাওয়া সাংবাদিকতা। তাঁর সমস্ত পদ্য হয়ে ওঠে পদ্যসাংবাদিকতা, আর তিনি হয়ে ওঠেন ওই কর্মী সময়ের পদ্যসাংবাদিক। প্রতি যুগের কমপক্ষে একজন সভাকবি চাই, সভাকবি দরকার ছিলো ওই গদ্য-সময়েরও। উনিশশতকের কর্মময় স্বপ্নহীন প্রথমাংশ একজন সভাকবি জন্ম দিতে গিয়ে জন্ম দিয়েছিলো একজন পদ্যসাংবাদিক, যাঁর নাম ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। চারপাশের ব্যাপক কবিতাহীনতার মধ্যে কবিতা সৃষ্টির শক্তি ছিলো না তাঁর। কথাটি অন্যভাবে, ও সরলরূপে, বললে বলতে হয় যে সৃষ্টিশীলতাহীন উনিশশতকের প্রথম ভাগকে সৃষ্টিশীল করার শক্তি ছিলো না ঈশ্বর গুপ্তের। সাহিত্যের বন্ধ্যাত্ব মোচনের জন্যে দরকার হয় কোনো কবি বা কবিগোত্রের, একমাত্র কবিরাই এগিয়ে থাকেন তাঁদের সময়ের থেকে। উনিশশতকে মধুসূদন দেখা দিয়েছিলেন সে-কবিরূপে, যিনি বাঙালির সৃষ্টিশীলতার রুদ্ধ ধারাটি মুক্ত করার প্রতিভা বহন করতেন রক্তমাংসস্বপ্নে। মধুসূদন আধুনিক বাঙলা কবিতা বা সাহিত্যের প্রথম মুক্তিদাতা, ও প্রথম দ্রোহী। তাঁর দ্রোহ ছাড়া উনিশশতকের প্রথম ভাগের আটকেপড়া কবিতাকে বিশাল ব্যাপক তীব্র স্রোতে বইয়ে দেয়া ছিলো অসম্ভব।
উনিশশতকে একটি আধুনিক সংকট দেখা দেয়া বাঙলা সাহিত্যে। মধুসূদনপূর্ব বাঙলা কবিতা ছিলো কবির বুক থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে উৎসারিত স্তবকগুচ্ছ। স্বভাবকবিদের এক বড়ো লীলাক্ষেত্রের নাম বাঙলা সাহিত্য। শুরু থেকে উনিশশতক পর্যন্ত স্বতস্ফূর্ততা ও স্বভাবকবিত্বের নানা বাঁকে ঘুরে ঘুরে বাঙলা কবিতার ধারাটি শুকিয়ে পড়ে, তাকে স্রোতগ করার জন্যে স্বভাবকবিত্ব, স্বতস্ফূর্তি, স্বদেশনিষ্ঠা, বা শেকড়সন্ধান যথেষ্ট ছিলো না। দরকার ছিলো এমন কিছু, যা আগে বাঙলা কবিতায় দেখা যায় নি। কেবল স্বদেশী সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার দিন কেটে গেছে তখন, সময় এসে গেছে বিদেশি ঋণের। তখন তাঁর পক্ষেই কবিতাকে মুক্তি দেয়া, নতুন খাতে বইয়ে দেয়া, সম্ভব ছিলো, যাঁর শক্তি ও প্রতিভা ছিলো বিদেশি ঋণের। এ-প্রতিভা ঈশ্বর গুপ্ত বা রঙ্গলাল বা ওই সময়ের আর কারো ছিলো না, ছিলো শুধু মধুসূদনের। মধুসূদন আমাদের প্রথম মহান অধমর্ণ, যিনি নির্বিচারে বা বিশেষভাবে বিচার ক’রে ঋণ করেছেন পশ্চিমের কাছে : কখনো ছুটে গেছেন গ্রিক কবির মন্দিরে, কখনো হাত পেতেছেন লাতিন কবির দরোজায়, কখনো উপস্থিত হয়েছেন ইংরেজ কবির আঙিনায়। পশ্চিমের কবিতালোকের দরোজায় দরোজায় ফিরেছেন এ-মহাভিখারি- মহাঋণী- আর সে-ঋণে গ’ড়ে তুলেছেন নিজের পুঁজি। পুঁজির অপব্যবহার হয় অনেকের হাতে, কিন্তু সৌভাগ্য আমাদের ঋণের অপব্যবহার করেন নি মধুসূদন, বরং গ’ড়ে তুলেছেন নতুন কালের নতুন সাহিত্য, যার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়বোধ না করলে বুঝতে হবে যে অন্তরের কোথাও পঙ্গু হয়ে পড়েছি।
কোনো স্বাদেশিক, বাঙলার কাদামাটির গন্ধমাখা, কবির পক্ষে রচনা করা সম্ভব ছিলো না মেঘনাদবধকাব্য; পশ্চিমের সাথে যার আন্তর ঘনিষ্ঠতা গ’ড়ে ওঠে নি, তাঁর পক্ষে কৃষ্ণকুমারীনাটক বা চতুর্দশপদী কবিতাগুচ্ছ রচনা চরম দুঃস্বপ্ন। ঋণ ক’রে মধুসূদন নিত্য অভিনব সামগ্রী সৃষ্টি করেন। বাঙলা ভাষার আকাশেবাতাসে যা কোনোদিন কল্পিত হয় নি, তা একদিন বাস্তব রূপ নেয় বাঙলা ভাষায়, মধুসূদনের আঙুলে। বিরামহীন অভিনবত্বের নামই মাইকেল মধুসূদন। যা ছিলো না, তিনি সৃষ্টা তার; শুধু স্রষ্টা নন, তিনিই শ্রেষ্ঠ অনেক ক্ষেত্রে। বাঙলা ভাষায় তাঁর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, যদিও অনুকারী রয়েছেন অনেক। এমনকি বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের চেয়েও তিনি বলিষ্ঠ প্রতিভা। তিনি পশ্চিম থেকে ঋণের যে-রাস্তা খুলে দেন, সে-পথেই চলেছেন বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু তাঁরা কেউ মধুসূদনের মতো তীব্র বিশালত্বমুখি ছিলেন না। বাঙলা ভাষার শ্রেষ্ঠ ও মহত্তম কল্পনা ও পরিকল্পনা মেঘনাদবধকাব্য; একশতাব্দী পরেও বিস্ময়বোধ করতে হয় একথা ভেবে যে মধুসূদন ওই মহৎ কল্পনাকে কাব্যবাস্তবে পরিণত করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন এমন এক সময়ে যখন বাঙলা ভাষা ছিলো একটি আঞ্চলিক, ক্ষুদ্র, গোত্রের, অনেকটা কৃষিসম্প্রদায়ের ভাষা, যার মানরূপ তখনো অনির্ধারিত। আমাদের সাহিত্যদ্রোহীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তিনি; মধ্যযুগ থেকে তিনি কয়েক বছরে বাঙলা সাহিত্যকে নিয়ে আসেন আধুনিক কালে। এমন এক সময়ে তিনি জন্ম নিয়েছিলেন, এবং জন্ম দিচ্ছিলেন তাঁর স্পর্ধিত রচনাবলি, যখন বিনয়-বিকাশ-ক্রমমুক্তি কাজে আসততা না কোনো। তাঁর পক্ষে রবীন্দ্রনাথের মতো ক্রমবিকশিত হওয়ার সাধনার অর্থ ছিলো ব্যর্থতা। তাঁর সার্থকতা আকস্মিক বিস্ফোরণে, চারপাশ হঠাৎ তীব্র আলোকে ভ’রে দেয়ায়। তাঁর সংস্কারমুক্তি, বিশ্বপরিব্রাজকতা, অতৃপ্তি তাঁকে ঠেলে দিয়েছিলো হঠাৎ সফল হয়ে বিনাশের অভিমুখে ধাবিত হওয়ার দিকে। এদিকে তিনি আমাদের অতি কাছাকাছি, রবীন্দ্রনাথের চেয়েও; মধুসূদনের মধ্যে যে-বিক্ষোভ, বিনাশ ও মহান অশুভকে পাই, তা বর্তমান সময়ের বান্ধব। তাঁর সংস্কারমুক্তি ঈর্ষা জাগায় আমাদের; এখন আমরা প্রতিদিন বাঁধা পড়ছি এক একটি সংস্কারের শেকলে, খুলে বেরোতে- না-বেরোতেই নতুন কোনো শেকলে জড়িয়ে পড়ে আমাদের শিল্প ও জীবনভাবনা। কিন্তু মধুসূদন সমস্ত সংস্কার পরিহার করতে পেরেছিলেন ব’লে তিনি যেমন প্রথাগত বিশ্বাসের বিরোধী কল্পনাকে মূল্যবান ক’রে তুলতে পেরেছিলেন, তেমনি পেরেছিলেন একের পর এক নতুন সাহিত্য-আঙ্গিক সৃষ্টি করতে। তাঁর রাম-রাবণ পরিকল্পনা মহত্তম দুঃসাহসের উদাহরণ, এমন সংস্কারমুক্তির পরিচয় বাঙলা ভাষায় আর পাওয়া যায় না। মধুসূদন এমন কাজ ক’রে গেছেন মেঘনাদবধকাব্য-এ, যা সাম্প্রতিক হিন্দু মৌলবাদীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হ’তে পারে। তিনি যখন একের পর এক নতুন সাহিত্য-আঙ্গিক সৃষ্টি করছিলেন, পয়ার ভেঙে ফেলে বইয়ে দিচ্ছিলেন প্রবহমাণ অক্ষরবৃত্ত, রচনা করছিলেন নিষিদ্ধ ট্র্যাজেডি, বা সৃষ্টি করছিলেন অভিনব চতুর্দশপদী, তখন সংস্কারমুক্তির কাজ করেছে প্রধান প্রেরণারূপে।
আধুনিক চৈতন্যের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যই বিশ্বজনীন, দেশ ও ভাষা নিরপেক্ষ; কিন্তু ওই চৈতন্যের কিছু অংশ অবশ্যই বিশেষ দেশ ও ভাষা-অপেক্ষী। মধুসূদনের মধ্যে এমন অনেক বৈশিষ্ট্য খচিত হয়ে আছে, যা হয়তো আধুনিক ব’লে গৃহীত হবে না ইংরেজি, ফরাশি, বা জর্মন সাহিত্যে, কিন্তু বাঙলাদেশ ও ভাষার পরিপ্রেক্ষিতে ওই বৈশিষ্ট্যরাশি অবশ্যই আধুনিক। মধুসূদনের ধ্রুপদী কাব্য, বহির্জীবনের প্রাধান্য, সংস্কারমুক্তি প্রভৃতি আধুনিক মানদণ্ডে সর্বাংশে আধুনিক নয়, কিন্তু বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের যে-অবস্থায় তিনি ওই প্রবণতাসমূহের বিকাশ ঘটিয়েছেন, তাতে তাঁকে আধুনিক ব’লে অস্বীকারের উপায় নেই। যে-আধুনিক চৈতন্যের উন্মেষবিকাশ লক্ষ্য করি রোম্যান্টিসিজমের মধ্যে, যা ইউরোপের প্রথাগত চিন্তাভাবনার মেরুদণ্ডে ফাটল ধরিয়ে দেয় চিরকালের জন্যে, এবং যা বিলম্বে হ’লেও সংক্রামিত হয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে, যা ব্যক্তিকেই ক’রে তোলে সব কিছুর মানদণ্ড, তা পাই না মধুসূদনে। তাঁর মধ্যে যা পাই, তাকে বলতে পারি ধ্রুপদী আধুনিকত্ব। ধ্রুপদী আধুনিকত্বের প্রথম ও শেষ পুরুষ তিনি বাঙলা ভাষায়। তিনি বাঙলা সাহিত্যকে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে নিয়ে আসেন, দেন তাকে সুস্বাস্থ্য, শুধু আধুনিক চৈতন্যের বিস্ময়কর ব্যাধিটুকু সংক্রামিত করার দায়িত্ব রেখে যান অন্যের জন্যে, যা চমৎকারভাবেই পালন করেন বিহারীলাল চক্রবর্তী। মধুসূদন পরিহার করেছিলেন তথাকথিত ‘খাঁটি বাঙালিত্ব’, যা আদিমতা, অমার্জিত রুচি, ও আঞ্চলিকতার মিশ্রণ। তার বিকল্পে তিনি বরণ করেছিলেন আন্তর্জাতিকতা। তাই বঙ্কিম, উনিশশতকের নবম দশকে, সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পেরেছিলেন যে ‘এখন আর খাঁটি বাঙ্গালী কবি জন্মে না- জন্মিবার যো নাই- জন্মিয়া কাজ নাই। বাঙ্গলার অবস্থা আবার ফিরিয়া অবনতির পথে না গেলে খাঁটি বাঙালী কবি আর জন্মিতে পারে না।’ মধুসূদন বাঙলা কাব্যে নিয়ে এসেছিলেন আরো একটি আধুনিক প্রবণতা : কবিতার জন্য কবিতা বা শিল্পের জন্যে শিল্প চর্চার সূত্রপাত, বাঙলা ভাষায়, করেছিলেন মধুসূদন। তাঁর আগের ও সমকালের, এমনকি অব্যবহিত পরের পদ্য, ও গদ্য, লেখকেরা পংক্তি বিন্যস্ত করতেন কোনো- না-কোনো অশৈল্পিক উদ্দেশ্যে, শিল্প পেতো গৌণ মূল্য তাঁদের কাছে। কিন্তু মধুসূদনই প্রথম সহিত্যের জন্যে সাহিত্য সৃষ্টির বীজ বুনে যান বাঙলা ভাষায়, যা বিশশতকি আধুনিক কবিতায় ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়।
প্রত্যেক ভাষার প্রধান কবিরা তাঁদের গোত্রের ভাষাকে পরিস্রুত করেন, এবং বিশেষ বিশেষ সন্ধিক্ষণের কবিরা এ-পরিস্রুতির কাজটি করেন দক্ষভাবে। মধুসূদন যখন কবিতা লিখছিলেন, তখন বাঙলা নামক ভাষাটির নামই স্থির হয় নি ভালোভাবে– সে-ভাষা ছিলো অপরিস্রুত আঞ্চলিক, যাতে মেঘনাদবধ-এর মতো মহাকল্পনাকে বাস্তবায়িত করা ছিলো অসম্ভব। তাই মধুসূদনকে রচনা বা সৃষ্টি করতে হয়েছিলো নিজস্ব ভাষা ও ছন্দ; আধার-আধেয়ের পরম মিলনের এক অনন্য নিদর্শন মেঘনাদবধকাব্য। মেঘনাদবধ-এর স্পর্ধিত কল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে হ’লে দরকার যে-ভাষা, তাই চারদিকের প্রাকৃত কোলাহলের ভেতর থেকে ছেঁকে তুলেছিলেন মধুসূদন। মেঘনাদবধ-এর দুরূহ শব্দাবলি, গ্রিকধরনে রচিত অভিধা, প্রয়োজনীয় শব্দ তৈরির জন্যে নবশব্দরূপতত্ত্ব, উক্তির ধ্রুপদী ঢং, উপমাউৎপ্রেক্ষার অভিনবত্ব, চলতি ও সংস্কৃতের মিশেল, নানা রকম ক্রিয়ারূপ বাঙলা ভাষার মান স্থিররূপ নির্দেশে সাহায্য করেছে অনেকখানি। মধুসূদনের দুরূহ শব্দের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আছে বহুর; অনেকের কাছে তিনি মৃত শব্দের অধীশ্বর। কিন্তু এটা প্রশংসার বিষয় এ-জন্যে যে মধুসূদন দেখিয়ে গেছেন শব্দ কখনো সম্পূর্ণরূপে লোকান্তরিত হয় না, যদিও তা শতাব্দীর পর শতাব্দী নিঃশব্দে থাকতে পারে অভিধানের গহ্বরে। দীর্ঘ অব্যবহারে তার গায়ে জড়ো হয় উজ্জ্বলতা, এবং একদিন কোনো প্রতিভা এসে ওই শব্দরাশিতে সংক্রামিত ক’রে দেন জীবনতাপ। মধুসূদন করেছেন, না করলে চলতো না তাঁর। উনিশশতকের বাঙালির মুখে যে-বাঙলা প্রত্যহ ব্যবহৃত হতো, তাতে মেঘনাদবধ সম্ভব ছিলো না। মধুসূদনের বাঙলা পরিস্রুত বাঙলা। এ-ভাষা শুধু তাঁর কবিতাকে মহত্ত্ব দেয় নি, আধুনিক মান বাঙলা ভাষা সৃষ্টিতেও সাহায্য করেছে প্রভূত।
আধুনিক কালের সাথে মধুসূদনের ঘনিষ্ঠতার অনেকগুলো গ্রন্থি রয়েছে : তাঁর মতো আমরাও পশ্চিমমুখি, কোনো পরম শুভ নেই আমাদের সামনে, বিনাশ আমাদের ঘিরে থাকতে চায় সারাক্ষণ। ধ্রুপদী ও রোম্যান্টিকের মিশ্রণ এখন স্বাভাবিক ঘটনা, দুরূহ শব্দকে এখন আর আমরা তিরস্কার ক’রে হটাতে রাজি নই; এবং এসে গেছি মধুসূদনের অব্যবহিতপূর্ব সময়ের মতো অন্ধকারে : চার দিকে অভাব সৃষ্টিশীলতার, কবিতা আটকে গেছে শুকনো চরায়, কিন্তু মুক্তি নেই আমাদের। উনিশশতকের মধ্যভাগে তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন বিশ্বভিক্ষায়, তাঁর পর আরো একজন বেরিয়েছিলেন, এবং বিশশতকের তৃতীয় দশকে গোত্রবদ্ধ আধুনিকেরা বেরিয়েছিলেন একই উদ্দেশ্যে। সুফল ফলেছিলো তিনবারই। এখন কি এসে গেছে চতুর্থ বিশ্বভিক্ষায় বেরোনোর সময়? আমরা কি ধরবো মধুসূদনের আধুনিক পথ, দূরযাত্রী হবো, নাকি ‘খাঁটি বাঙলা’ কবিতায়, স্বভাবকবিত্বে, অশিল্পে, অমার্জিত রুচিতে, ও সংখ্যাহীন শহুরে পল্লীকবিতে ভ’রে তুলবো অবনতির পথে দ্রুত ধাবিত দরিদ্র বাঙলার পথঘাট?