পাকিস্তানবাদী সাহিত্যতত্ত্ব : প্রতিক্রিয়াশীলতার বিষবৃক্ষ
মধ্যযুগ থেকে শুরু ক’রে বিশশতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান যে-বাঙলা সাহিত্য সৃষ্টি করে, কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম বাদে সে-সাহিত্য শৈল্পিকভাবে উন্নত নয়; তবে তাতে বিকশিত হয় তাদের সীমাবদ্ধ সৃষ্টিশীলতা ও ধরা পড়ে তাদের স্বাতন্ত্র্য ও সাম্প্রদায়িক চারিত্র্য। বাঙলা সাহিত্যের প্রধান স্রোতের পাশে বাঙালি মুসলমানের সৃষ্ট সাহিত্য একটি ক্ষীণ শাখাস্রোতের মতো প্রবাহিত হয়। তাতে জীবনের পরিচয় যেমন সংকীর্ণ, তেমনি শৈল্পিক নৈপুণ্যও দুর্লভ। উন্নত শিক্ষা উনিশ ও বিশশতকে বাঙালি হিন্দু কবি-ঔপন্যাসিক-নাট্যকারদের যেমন উন্নত সাহিত্য সৃষ্টিতে সমর্থ করেছিলো, সে-উন্নত শিক্ষা বাঙালি মুসলমান লেখকেরা বিশশতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত পান নি; তাই তাঁদের সৃষ্ট সাহিত্য প্রধানত স্বতস্ফূর্ত প্রতিভার প্রকাশ। বিশশতকের তৃতীয় দশকে যে-আধুনিকতা দেখা দেয় বাঙলা সাহিত্যে, বাঙালি মুসলমানেরা শিক্ষাগত কারণে তার থেকে দূরে থেকে যান। মুসলমান লেখকদের সামাজিক অবস্থান, তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সমকালীন রাজনীতি তাঁদের আধুনিকতা আয়ত্ত করা থেকে বিরত রাখে। তাঁরা যে-সাহিত্যশাখা-স্রোতটি সৃষ্টি করেছিলেন, সেটিকেই এ-সময়ে সজীব রাখার চেষ্টা করেন তাঁরা, এবং উনিশশো চল্লিশের পর সেটি বেশ তীব্র হয়ে ওঠে। ১৯৩০-এর দ্বিজাতিতত্ত্ব ও ১৯৪০-এর পাকিস্তান প্রস্তাব বাঙালি মুসলমানকে সাম্প্রদায়িকতায় উৎসাহী ক’রে তোলে, এবং সাহিত্যক্ষেত্রে পড়ে তার প্রবল প্রভাব। ১৯৪০-এর পর থেকে বাঙালি মুসলমান লেখকেরা উদ্যোগী হয়ে ওঠেন সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানবাদী সাহিত্যসৃষ্টিতে, যাতে শিল্পকলা ও জীবনের থেকে সাম্প্রদায়িকতার পরিমাণ অনেক বেশি।
পাকিস্তানবাদী সাহিত্য সৃষ্টির প্রত্যক্ষ প্রেরণা ছিলো পাকিস্তান প্রস্তাব; এবং যাঁরা এতে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশ সৃষ্টিশীল লেখক ছিলেন না। কেউ ছিলেন সাংবাদিক-সাংবাদিকই ছিলেন অধিকাংশ, কেউ রাজনীতিক বা রাজনীতিপ্রবণ, কেউ প্রাবন্ধিক; এবং তাঁদের পরবর্তী জীবন প্রমাণ করেছে যে তাঁরা সবাই ছিলেন প্রগতিবিমুখ। তাঁরা সবাই মুসলিম লিগের রাজনীতিক দর্শন বিনাপ্রশ্নে গ্রহণ করেছিলেন; এবং উগ্রভাবে তাতে বিশ্বাসী ছিলেন। পাকিস্তানবাদী সাহিত্যসৃষ্টি ও সাহিত্যে পাকিস্তানবাদ প্রচারের জন্যে তাঁরা দু’টি সংঘও গ’ড়ে তুলেছিলেন,-একটি কলকাতায়, অপরটি ঢাকায়। এ-সংঘ দুটি আলোচনা-অনুষ্ঠান ও সাহিত্যসম্মেলন আয়োজন ক’রে মুসলমান সমাজে বিশেষ এক ধরনের সংস্কৃতি ও সাহিত্যচেতনা গ’ড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। তাঁদের তত্ত্ব বা দর্শন প্রচারে ব্যবহৃত হয় মাসিক মোহাম্মদী নামক সাময়িকপত্রটি। পরে, পাকিস্তানপর্বে, সরকারি মাহে-নওসাময়িকপত্রটি পাকিস্তানবাদী সাহিত্যতত্ত্ব প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
১৯৪২-এ কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পূর্ব-পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’। যে-এগারোজন প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ‘পরাণুকরণমুক্ত সুস্থ সাহিত্যসংস্কৃতি-সাধনার জন্যে সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁরা কেউই সৃষ্টিশীল লেখক ছিলেন না। সোসাইটির সদস্যরা ছিলেন : আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মুহম্মদ হাবীবুল্লাহ বাহার, মুজীবর রহমান খাঁ, সৈয়দ সাদেকুর রহমান, মোহাম্মদ খায়রুল আনাম খাঁ, মোহাম্মদ মোদাব্বের, আবদুল হাই, জহুর হোসেন চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন, ফজলুল করিম খাঁ ও মোশাররফ হোসেন। কিছু পরে রেনেসাঁ সোসাইটিতে যোগ দেন আবুল মনসুর আহমদ। রেনেসাঁ সোসাইটির সদস্যরা পাকিস্তান-আন্দোলন দ্বারা প্রবলভাবে প্ররোচিত অনুপ্রাণিত ছিলেন; এবং সাহিত্যকে পরিণত করতে চেয়েছিলেন পাকিস্তানবাদের প্রচারমাধ্যমে। সোসাইটির মূলনীতিগুলো ছিলো : (১) জাতীয় রেনেসাঁর উদ্বোধক পাকিস্তানবাদের সাহিত্যিক রূপায়ণ; (২) পাকিস্তানবাদ সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক ও মননমূলক বক্তৃতা, বিতর্কিকা, বৈঠকী রচনাপাঠ, তথ্যানুসন্ধান ও সংগ্রহ, গবেষণা ও আলোচনা, পুস্তক ও পুস্তিকা প্রচার প্রভৃতি কাজের আয়োজন ও উৎসাহ দান; (৩) সাহিত্যিক, সাহিত্যামোদী, মহিলা ও ছাত্রদের মধ্যে বিশেষভাবে পাকিস্তানী ভাবধারা সম্প্রসারণ; (৪) জাতীয় তমদ্দুনের উন্মেষক ও সহায়ক আন্দোলনের সাথে টডটঢণবধড যোগ সংরক্ষণ; (৫) সাহিত্যে হিন্দু ও মুসলমানের আন্তর্জাতিক সম্প্রীতিমূলক আবেদনের রূপায়ণ; (৬) সাহিত্যে পাকিস্তানবাদবিরোধী সর্বপ্রকার প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারা, ফ্যাসিবাদ প্রভৃতির বিরুদ্ধে মনোভাব সৃষ্টি। সোসাইটির গঠনতন্ত্রের (৭)-সংখ্যক বিধিটি যদিও ছিলো যে ‘সর্বপ্রকার সক্রিয় রাজনীতি হতে সোসাইটি দূরে থাকবে’, তবুও বোঝা যায় রেনেসাঁ সোসাইটি শুধু সাহিত্যিক সংঘ ছিলো না; মুসলিম লীগের রাজনীতি এ-সোসাইটিকে পরিচালিত করতো। ১৯৪৩-এ ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’। এটি গঠনে প্রধানত উদ্যোগ নিয়েছিলেন সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন ও সৈয়দ আলী আহসান। রেনেসাঁ সোসাইটির সাথে সাহিত্য সংসদের কোনো নীতিগত পার্থক্য ছিলো না, শুধু পার্থক্য ছিলো যে রেনেসাঁ সোসাইটি জীবনের সমস্ত ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করতে উৎসাহী ছিলো, আর সাহিত্য সংসদ উৎসাহী ছিলো শুধু পাকিস্তানি সাহিত্য নিয়ন্ত্রণে। দুটি সংঘই ছিলো সাম্প্রদায়িক ও প্রগতিবিমুখ। পাকিস্তানবাদ ছিলো উভয় সংঘেরই মূলমন্ত্র।
পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ ও পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি ১৯৪৩ ও ১৯৪৪-এ যে-সম্মেলনের আয়োজন করে, তাতে প্রদত্ত সভাপতি ও অন্যান্যের ভাষণে পাকিস্তানবাদী সাহিত্যের রূপ কী হবে, তা বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। রেনেসাঁ সোসাইটি শুধু সাহিত্যের রূপ নির্দেশ ক’রেই তৃপ্ত থাকে নি, মুসলমানদের জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রের রূপই সোসাইটি নির্দেশ করার চেষ্টা করে। পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের প্রথম বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা মুসলিম হল মিলনায়তনে, ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে; এবং পরের বছর এর দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটির প্রথম অধিবেশন হয় ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে, কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ হলে। এ-অধিবেশনগুলোতে পাকিস্তানবাদী সাহিত্যের যে-রূপ নির্দেশ করা হয়,
তা মুসলমান লেখকমণ্ডলিতে সাড়া জাগিয়েছিলো। এর ফলে সাম্প্রদায়িক সাহিত্যের একটি সচেতন ধারা বিকশিত হয়, এবং পাকিস্তান লাভের পর ওই ধারাটি প্রবল হয়ে ওঠে। সাম্প্রদায়িক সাহিত্যতত্ত্ব বেশ ক্ষতি করেছিলো বাঙালি মুসলমান সাহিত্যের : চল্লিশের দশকে সুস্থ একটি আধুনিক বাঙলা সাহিত্যের ধারা তাঁরা সৃষ্টি করতে পারতেন যদি না পাকিস্তানি রাজনীতি ও পাকিস্তানবাদী সাহিত্যতত্ত্ব তাঁদের রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতো। এ-নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তির জন্যে দরকার হয়েছিলো বায়ান্নোর ভাষা-আন্দোলন।
পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের প্রথম বার্ষিক অধিবেশনে (১৩৪৯ : ১৯৪৩) উদ্বোধন-ভাষণ দেন কায়কোবাদ। কায়কোবাদ বলেন, ‘সেকালে হিন্দু লেখকগণ আমাদিগকে বিশেষ ঘৃণার চক্ষে দেখিতেন, তাঁহারা বলিতেন, ‘মুসলমানেরা বাংলা লিখিতে জানে না।” তিনি কেনো হিন্দু লেখকদের অনুকরণ করেছিলেন তা বর্ণনা ক’রে কায়কোবাদ নতুন লেখকদের স্বাতন্ত্র্যস্পৃহাকে অভিনন্দন জানান : ‘আজ আপনাদের অনুকরণের কোন প্রয়োজন নাই। আজ আপনারা আপনাদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিয়া মুসলিম বঙ্গভাষার শ্রীবৃদ্ধি করিতে থাকুন, কোন বাধা নাই, বিঘ্ন নাই, নিন্দা করিবার কেহ নাই।’ কায়কোবাদ যে-স্বাতন্ত্র্য কামনা করেন, তার মাঝে উগ্রতা নেই, সাম্প্রদায়িকতা নেই। নতুন সাহিত্যের রূপ কেমন হওয়া উচিত, সে-সম্পর্কেও কোনো মন্তব্য তিনি করেন নি। সৈয়দ এমদাদ আলী সাহিত্যের রূপ সম্পর্কে কিছুটা ইঙ্গিত দেন। তিনি বলেন, ‘সর্বপ্রথমে ভাবের বিপ্লব ঘটাইবার জন্যই আপনারা সাহিত্য সৃষ্টি করিবেন, কিন্তু নিজেদের তালিম ও তমদ্দুনের দিকে দৃষ্টি রাখিয়াই আপনাদের কাজ করিতে হইবে। কোরআনের শিক্ষা ও আদর্শ সর্বদা আপনারা সম্মুখে রাখিবেন। মনে রাখিবেন আপনারা মুসলমান।’ সৈয়দ এমদাদ আলী তরুণ লেখকদের ধর্মীয় পরিচয়টি স্মরণ রাখতে বলেছেন, কিন্তু সাহিত্য সংসদের তরুণেরা স্মরণে রেখেই সন্তুষ্ট ছিলেন না, তাঁরা ওই পরিচয়টিকে উগ্রভাবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।
সাহিত্য সংসদের তাত্ত্বিক ছিলেন সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন ও সৈয়দ আলী আহসান। তরুণ বয়স থেকেই তাঁরা প্রগতিবিমুখ। সভাপতির ভাষণে সাজ্জাদ স্বীকার ক’রে নেন যে বাঙলাই বাঙালি মুসলমানের ভাষা, এবং বাঙলা ভাষায়ই বাঙালি মুসলমান সাহিত্য চর্চা করবে। উর্দুর দাবিকে তিনি অস্বীকার করেন। তিনি বাঙালি মুসলমানের জন্যে একটি পৃথক সাহিত্য দাবি করেন। তাঁর মতে, ‘এ-কথাকে অস্বীকার আমরা কিছুতেই করতে পারছিনে যে বাঙালী মুসলমানের মতো বিশিষ্ট সমাজের একটা স্বতন্ত্র সাহিত্য দাবি করার অধিকার আছে। সাহিত্যে আপনার চিত্র প্রতিবিম্বিত করে দেখবার আগ্রহ এবং আকুতি থাকা তার পক্ষে স্বাভাবিক।’ তিনি তাঁদের আন্দোলনকে কেলটিক পুনর্জাগরণের সাথে তুলনা করেন। ইয়েট্স্ ও অন্যান্য লেখক যেমন আইরিশ ঐতিহ্য গ্রহণ করেছিলেন, তেমনভাবে মুসলমানেরাও নিজেদের ঐতিহ্য গ্রহণ করবে ব’লে তিনি মত দেন। কেলটিক পুনর্জাগরণের সাথে সাহিত্য সংসদের আন্দোলনের যে একটা বড়ো পার্থক্য রয়েছে, সেটা অবশ্য তাঁর চোখ এড়িয়ে যায়। ইয়েটস ও অন্যান্য কেলটিক পুনর্জাগরণবাদী যেখানে নিয়েছিলেন স্বদেশি ঐতিহ্য সেখানে মুসলমান বাঙালি লেখকদের শরণ নিতে হয়েছে বিদেশি মুসলিম ঐতিহ্যের। এখানেই দেখা দিয়েছে সংকট। তাঁদের আন্দোলন যে পাকিস্তান-আন্দোলনেরই প্রভাবজাত এটা স্পষ্ট করে তিনি বলেন, ‘আমাদের মানসিক ক্লৈব্যের যুগ অতীত হয়ে গেছে, রাজনৈতিক জাগরণের সংগে সংগে একটা সাহিত্যিক জাগরণ আসাও অবশ্যম্ভাবী।’ এ-আন্দোলন প্রাণশক্তি আহরণ করবে কোথা থেকে? তিনি অনুপ্রেরণার জন্যে ‘মুসলমান জীবনের বিশিষ্ট ঐতিহ্য’ অবলম্বনের কথা বলেন; এবং আরো বলেন, ‘প্রয়োজন হলে আমরা ইসলামের ইতিহাস মন্থন করে আমাদের সাহিত্যের উপকরণ সঞ্চয় করবো।’ আলী আহসান ‘সম্পাদকের বিবৃতি’তে মুসলমানদের বিশিষ্ট স্বতন্ত্র সাহিত্যের কথা বলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘আমি কেবলি স্বপন করেছি বপন বাতাসে’ গানটি স্থূলভাবে ব্যাখ্যা ক’রে তিনি বলেন, ‘এ ব্যর্থতার ক্লান্তি আমরা চাই নে। অনুপ্রেরণার জন্য যদি আমরা আমাদের জীবনের দিকে লক্ষ্য করি, তবে আমাদের ব্যর্থ হতে হবে না।’ তিনি আলাওল থেকে শুরু ক’রে কায়কোবাদ পর্যন্ত মুসলমান লেখকদের রচনায় ‘পূর্ণভাবে মুসলমান জাতির সংস্কৃত প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে নি’ বলে মনে করেন। তিনি বলেন, “বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এলেন নজরুল; মুসলমান জাতিকে নবপ্রাণচেতনায় উদ্বোধিত করবার প্রয়াস করা হয় তখনই। এ-প্রয়াস অর্থহীন হয় নি। নজরুলের সাহিত্যিক মূল্য যত তুচ্ছই হোক না কেন, এ-প্রয়াসের সত্যিকারের উদ্বোধক হিসাবে তাঁর স্থান আজও নিঃসংশয়ে অনেকের পুরোভাগে।’ তিনি বলেন, ‘যদি সমাজের পূর্ণ পরিচয় ফুটিয়ে তুলতে পারি আমাদের সাহিত্যে তবে তাতেই থাকবে অনিত্য-নিত্যের-সংযোগে এক সুষমামণ্ডিত আভা।’ সাহিত্য সংসদের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে সাজ্জাদ হোসায়েন ও আলী আহসান বিশেষ উগ্র সাম্প্রদায়িকতা দেখান নি; কিন্তু পরে তাঁরা দু’জনেই উগ্র সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠেন যখন তাঁরা আরো একটু বয়স্ক ও পাকিস্তানবাদে ভালোভাবে দীক্ষিত হন।
‘সভাপতির অভিভাষণ’-এ আবুল কালাম শামসুদ্দীন বলেন, ‘বস্তুতঃ পাকিস্তান শুধু রাজনীতি ক্ষেত্রে নয়, সাহিত্য-ক্ষেত্রেও রেনেসাঁর বাণী নিয়ে এসেছে। মুখ্যতঃ পাকিস্তান এদেশের রাজনৈতিক সত্তাকে ঘা মেরে জাগিয়ে দেওয়ার জন্যে পরিকল্পিত হয়েছে সত্য, কিন্তু সে আঘাতের বেদনা জাতীয় সত্তার মর্মস্থল সাহিত্যেও সঞ্চারিত হয়েছে।’ তিনি লক্ষ্য করেন যে বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যে লক্ষণীয় হচ্ছে ‘মৌলিকতার অভাব এবং পরাণুকারিতার প্রভাব।’ তাঁর মতে, ‘মুসলমানের কৃষ্টি, মুসলমানের তমদ্দুন, মুসলমানের সমাজ-ব্যবস্থা, মুসলমানের জীবনযাত্রা প্রণালী সাহিত্যে রূপায়িত করতে হবে এবং তাতেই হবে মুসলমানের সাহিত্য সাধনার সার্থকতা।’ তিনি মুসলমান লেখকদের সাহিত্যিক প্রেরণার একটি স্থল নির্দেশ করেন, তা হচ্ছে পুথিসাহিত্য। তিনি বিশ্বাস করেন, ‘মুসলমানের দানে বাংলা সাহিত্যে রেনেসাঁ’ আসবেই।
১৯৪৪-এর জুলাই মাসের প্রথম ও দ্বিতীয় তারিখে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ হলে অনুষ্ঠিত হয় ‘পূর্ব-পাকিস্তান রেনেসাঁ সম্মেলন’। রেনেসাঁ সোসাইটি শুধু সাহিত্যে উৎসাহী ছিলো না, তার লক্ষ্য ছিলো জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে পাকিস্তানবাদের রূপায়ণ। তাই রেনেসাঁ সম্মেলন বিভক্ত হয়েছিলো নানা শাখায় : সাহিত্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থবিজ্ঞান, শিক্ষা, পুথিসাহিত্য, তহজিব ও তমদ্দুন, শিল্প ও সঙ্গীত, ভাষাবিজ্ঞান, ধর্মদর্শন, আনন্দ মজলিছ প্রভৃতি শাখায় বিভক্ত ক’রে তাঁরা মুসলমানের জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে সংক্রামিত করতে চেয়েছিলেন পাকিস্তানচেতনা। সাহিত্য সংসদের সম্মেলনের চেয়ে এ সম্মেলন ছিলো যেমন ব্যাপক, তেমনি উগ্র। তাঁরা পাকিস্তানবাদী যে-জীবন ও সাহিত্য কামনা করেছিলেন, তা সম্মেলনের প্রত্যেক শাখার সভাপতির ভাষণে স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় ৷ তবে সব শাখা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। সম্মেলনের মূল সভাপতি (আবুল মনসুর আহমদ), সাহিত্য শাখার সভাপতি (সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন), পুথিসাহিত্য শাখার সভাপতি (আদমউদ্দীন), তহজিব ও তমদ্দুন শাখার সভাপতি (মুজিবর রহমান খাঁ), ভাষাবিজ্ঞান শাখার সভাপতি (আবুল হাসানাত) ও অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির (আবুল কালাম শামসুদ্দীন) ভাষণ থেকে পাকিস্তানবাদী সাহিত্যের রূপটি সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
রেনেসাঁ সম্মেলনের বিভিন্ন শাখার সভাপতি বক্তব্যে ও ভাষায় পাকিস্তানবাদী সাম্প্রদায়িকতাকে মূর্ত করে তোলেন। ‘হাজেরান বন্ধুগণ’ বা হাজেরান মজলিস’-এর মতো সম্বোধন, এবং ‘আমাকে সরফরাজ করেছেন’, ‘শুকরিয়া জানবেন’, ‘নিয়ত-মকসেদ সম্বন্ধে শুরুতেই কিছু আরজ’, ‘দুরাতে চাই না’, ‘খোশ-আমদেদ জানাবার’, ‘জলসা আহুত হয়েছে’, ধরনের মিশ্রভাষার ব্যবহার তাঁদের প্রবণতার স্পষ্ট পরিচয় বহন করে। বোঝা যায় তাঁরা এমন এক ধরনের সাহিত্য চাইবেন যা একান্তভাবেই-ভাব ও ভাষায়– ইসলামি বা পাকিস্তানি ও অনাধুনিক। আবুল কালাম শামসুদ্দীন দাবি করেন, ‘আমরা পূর্ব-পাকিস্তানের অধিবাসীদের চিন্তারাজ্যে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন আনতে চাই।’ এ-বিপ্লব মধ্যযুগমুখি পাকিস্তানি বিপ্লব। তিনি যদিও তাঁর প্রবন্ধে বুদ্ধির মুক্তির কথা বলেছেন, তবে তা শিখাগোষ্ঠির বুদ্ধির মুক্তি নয়, বরং তার বিরোধী। তিনি বলেন, ‘পূর্ব-পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি আমাদের সাহিত্যে স্বস্থতা ও স্বকীয়তা ফিরিয়ে আনতে চায়।’ কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় ‘স্বস্থতা ও স্বকীয়তা’? তিনি তাও নির্দেশ করেন। তাঁর বক্তব্য ‘পুঁথি ও লোকসাহিত্যে পুরাপুরি প্রত্যাবর্তনে সে-স্বস্থতা, স্বকীয়তা আসবে না- কারণ ওটা অতীতে প্রত্যাবর্তনেরই কথা,-রেনেসাঁর কথা নয়। তবে পুঁথি ও লোকসাহিত্যের ভিত্তিতে আমাদের সাহিত্যকে দাঁড় করাতে হবে নিশ্চয়ই। সে-ভিত্তির উপর বর্তমানের ব্যর্থ সাহিত্যিক কসরতের অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যতের প্রয়োজনে আমাদের ভাবী সাহিত্যের সৌধ রচনা করতে হবে।’ অর্থাৎ তিনি আধুনিক কোনো ভিত্তির বদলে পুথি ও লোকসাহিত্যের মতো বাতিল ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চান পাকিস্তানবাদী সাহিত্যকে।
আবুল মনসুর আহমদ তাঁর মিশ্রভাষায় বলেন, ‘রাজনীতিকের বিচারে ‘পাকিস্তানের’ ‘অর্থ যাই হোক না কেন, সাহিত্যিকের কাছে তার অর্থ তমদ্দুনী আজাদী, সাংস্কৃতিক স্বরাজ, কালচারেল অটনমী।’ তিনি উল্লেখ করেন যে অনেকের মতে, ‘পাকিস্তান আন্দোলনটা প্রগতি বিরোধী। কারণ এতে জোর দেয়া হচ্ছে ধর্মোন্মাদনার দিকে।’ তিনি এ-অভিযোগ খণ্ডন ক’রে এমন এক পাকিস্তানের কল্পনা করেন, যা পুরোপুরি বুলিসর্বস্ব তিনি বলেন, ‘রেনেসাঁর পথে সে সর্বাংগীন জলজলা পয়দা হবে, তাতে এ-ডিক্টেটর বা ও-ডিক্টেটরের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে না- প্রতিষ্ঠিত হবে এক আল্লাহর রাজত্ব। সে রাষ্ট্রে তখন এ শাসক, ও শাসিত বলে কেউ থাকবে না, সবাই হবে স্বরাট, সকলে হবে সমান। সে রাজ্যে এ ধনিক আর ও শ্রমিক বলে কেউ থাকবে না। সব ধরনের মালিক হবে আল্লাহ।’ এমন আল্লাহর রাজত্বে সাহিত্যও হবে আল্লাহ বা ধর্মকেন্দ্রিক। বাঙলা ভাষায় এতোদিন যে-সাহিত্য রচিত হয়েছে, তাকে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য বলতে অস্বীকার করেন। তাঁর মতে, ‘পূর্ব-পাকিস্তান অর্থাৎ বাঙলা ও আসামের সাহিত্য বলতে আমরা যা বুঝি, তা বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্র যুগের সাহিত্যিকদের সাহিত্য। এটা খুবই উন্নত সাহিত্য। তবে এ-সাহিত্য পূর্ব-পাকিস্তানের সাহিত্য নয়। কারণ এটা বাঙলার মুসলমানের সাহিত্য নয়। এ-সাহিত্যে মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য কোনো দান নেই, শুধু তা নয়, মুসলমানদের প্রতিও এ-সাহিত্যের কোনো দান নেই। অর্থাৎ এ-সাহিত্য থেকে মুসলিম সমাজ-প্রাণ প্রেরণা পায় নি এবং পাচ্ছে না। এর কারণ আছে। সে কারণ এই যে, এ-সাহিত্যের স্রষ্টাও মুসলমান নয়, এর বিষয়বস্তুও মুসলমান নয়; এর স্পিরিটও মুসলমানী নয়; এর ভাষাও মুসলমানের নয়।’ অর্থাৎ হিন্দুর সাহিত্যকে তিনি সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেন। তিনি নজরুল ইসলামকে ‘পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় কবি’ স্বীকার ক’রে পুথিসাহিত্য ভিত্তি ক’রে পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য সৃষ্টির কথা বলেন। তাঁর মতে, ‘বাঙলার মুসলমানের যেমন একটা নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, তেমনি তাদের একটা নিজস্ব সাহিত্যও আছে। সে সাহিত্যের নাম মুসলমানী বাঙলা সাহিত্য বা পুঁথি-সাহিত্য।’ তিনি বলেন, ‘পূর্ব-পাকিস্তানের সাহিত্যিক রেনেসাঁ আসবে এই পুঁথি-সাহিত্যের বুনিয়াদে।’ ওই সাহিত্য রচিত হবে কোন বাঙলা ভাষায়? তাঁর মতে, ‘সে সাহিত্যের ভাষায়ও হবে মুসলমানেরই মুখের ভাষা।’ অর্থাৎ তিনি আরবি ফার্সি উর্দু মিশ্রিত বাঙলা ভাষায় মুসলমানি বাঙলা সাহিত্য সৃষ্টি হবে ব’লে মনে করেন। সে-ভাষা ‘সংস্কৃত বা তথাকথিত বাঙলা ব্যাকরণের কোনো তোয়াক্কা রাখবে না।’
সাজ্জাদ হোসায়েনের মতে বাঙলা সাহিত্যে ‘ইসলামী তমদ্দুনের রস’-এর বিশেষ অভাব, অন্য দিকে উর্দু সাহিত্যে এ-রস রয়েছে প্রবলভাবে। তাঁর মতে বাঙলা ভাষার অনৈসলামিক রূপই মুসলমান সাহিত্যিকদের সাহিত্য সাধনার প্রধান প্রতিবন্ধক। তিনি সাহিত্যে প্রচুর পরিমাণে ইসলামি শব্দ প্রয়োগের কথা বলেন, এবং বলেন, ‘বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের যে সংস্কারের কথা আমি উপরে বললাম, তার জন্যে মালমসলা বহু কিছু আমাদের গ্রহণ করতে হবে পুঁথি-সাহিত্য থেকে।’ তিনি পুথিসাহিত্যের ভাষাকেই মুসলমানের ভাষা হিশেবে গণ্য করেন। তাঁর মতে মুসলমানের সাহিত্যের ‘বুনিয়াদ এই পুঁথির ভাষার উপরেই গড়ে তুলতে হবে।’ এ কিউ এম আদমউদ্দীন বলেন, ‘পুঁথি-সাহিত্যের পুরানো ধারা হুবহুভাবে আবার ফিরাইয়া আনা সম্ভবপর নয়-হয়ত তাতে বাঙ্গালার মুসলিম সাহিত্যকে প্রগতির দিক দিয়া কল্যাণকরও নয়। তবে পুঁথি সাহিত্যক ভিত্তি করিয়া এবং বর্তমান পাঙক্তেয় বাঙলা সাহিত্যের অভিজ্ঞতাকে বরণ করিয়া লইয়াই তাকে পূর্ব-পাকিস্তানের সত্যকার সাহিত্য-রচনায় ব্রতী হইতে হইবে। বাঙ্গালার মুসলিম সাহিত্য-প্রতিভা এই পথ অনুসরণেই আপন নিজস্বতা খুঁজিয়া পাইবে বলিয়া মনে হয়।’ আবুল হাসানাত পরিচয় দেন বানানে বাতিকগ্রস্ততার ৷ তিনি এমন অদ্ভুত বানানে তাঁর রচনাটি লেখেন, যা গৃহীত হ’লে মুসলিম বাঙলা বানান হয়ে উঠতো ভয়াবহ ও সাহিত্য হতো অপাঠ্য।
সাহিত্য সংসদ ও রেনেসাঁ সম্মেলনের আগে থেকেই মুসলমানের সাহিত্যের রূপ সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ বেরোতে শুরু করে; এবং এর পরে, বিশেষ ক’রে পাকিস্তানি স্বাধীনতার পরে প্রচুর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। কাজী মোহাম্মদ ইদরিস ‘জাতীয় সাহিত্যের কথা’ লেখেন ১৩৫১ সালে। তিনি মুসলমানের জাতীয় সাহিত্য দাবি করেন, যে-সাহিত্য হবে মুসলমানের সৃষ্টি ও মুসলমানের জীবনভিক্তিক। তিনি বলেন, ‘যে মুসলমান সাহিত্যিক মুসলমান-মনের প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটন করার কলাকৌশলে পারদর্শী, মুসলিম জীবনের বিশিষ্ট সমস্যার সন্ধান দিতে সমর্থ এবং মুসলিম চিত্তের ভাবাবেগে স্পন্দন সৃষ্টি করিতে সক্ষম একমাত্র তিনিই জাতীয় সাহিত্যস্রষ্টার দাবীদার বিবেচিত হতে পারেন। মুজীবর রহমান খাঁ ‘সাহিত্য ও জাতীয় ইচ্ছাপূরণ’ প্রবন্ধে মুসলমানের সাহিত্যের দুর্বলতার কারণ হিশেবে উল্লেখ করেন ‘মুসলমানের জাতীয় মনের সাথে তাঁদের পরিচয়ের অভাব।’ তিনি মুসলমানের সাহিত্যে মুসলমানের জাতীয় ইচ্ছার প্রকাশ দেখতে চান। তাঁর মতে, ‘মুসলমানের জাতীয় ইচ্ছাপূরণের অনেকখানি দৃপ্ত ও শক্তিমান বিকাশ এখন আমরা দেখতে পাই নজরুল ইসলাম ও জসীমুদ্দীনের রচনায়। নজরুল ইসলাম এবং জসীমুদ্দীনের শত দোষত্রুতি থাকা সত্ত্বেও এরা আমাদের জাতীয় সাহিত্যের এখন মুখপাত্র।’ মোহাম্মদ আবদুল হক বলেন, ‘বাংলা সাহিত্য জাতীয় সাহিত্য নয়, হিন্দু সাহিত্য।’ তাঁর মতে মুসলমানের সাহিত্য মুসলমানকেই রচনা করিতে হইবে।’ তিনি চান হিন্দু-সাহিত্য থেকে পৃথক মুসলমান সাহিত্য। তিনি বলেন, “বাংলা সাহিত্যে শুধু হিন্দুয়ানী সুরই ফুটিয়াছে, এই একঘেয়েমি দূর করিয়া সাহিত্যে একটা নূতন সুর আনিতে হইবে, এবং সে সুর হইবে ইসলামী সুর। বাংলা সাহিত্যে এতদিন শুধু হিন্দু জীবনই প্রতিফলিত হইয়াছে, তাহাতে এখন মুসলিম জীবন প্রতিফলিত করিতে হইবে।’ তিনি ইসলামের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন, এবং ইসলামকেই মনে করেন মুসলমানের প্রকৃত প্রেরণা। তিনি বলেন, ‘মুসলমানের সাহিত্যসৃষ্টির পেছনে এই ‘নিজস্ব’ প্রেরণার প্রয়োজন। এই প্রেরণা হইবে ইসলামী প্রেরণা। ইসলামী প্রেরণা ছাড়া মুসলমানের সাহিত্যসৃষ্টি মূল্যবান হইবে না, হয় নাই-এ শিক্ষা আমরা সাহিত্যের ইতিহাস হইতে পাইয়াছি।’ তাঁর মতে ইসলামি সংস্কৃতির সাথে মুসলমানের ঘনিষ্ঠ পরিচয় নেই ব’লেই তাঁরা সার্থক সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেন নি। তাঁর মতে, ‘আমাদের মধ্যে একটা প্রবল ইসলামী ভাব নাই। এই ইসলামী ভাব আমাদের মনে যতদিন না আসিবে ততদিন আমাদের সৃষ্ট সাহিত্যও একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত হইবে না, একটা বিশেষ সুরে বাজিয়া উঠিবে না, ততদিন আমাদের সাহিত্যে হিন্দুয়ানী ভাবেরই বারবার আবির্ভাব হইবে, হিন্দুয়ানীর অনুকরণ আসিয়া পড়িবে, এবং আমাদের সৃষ্টি ব্যর্থ হইতে থাকিবে।’ ইসলামি ভাব সৃষ্টির জন্যে তিনি ইসলামি শাস্ত্রগ্রন্থগুলোর অনুবাদের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। রেজাউল করিম ‘পাকিস্তানের সংস্কৃতি ও পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য’ প্রবন্ধে পাকিস্তানে বিশুদ্ধ ইসলামি সংস্কৃতি গ’ড়ে তুলতে চান, এবং পাকিস্তানি রাজনীতি ও পাকিস্তানি সাহিত্যকে একই ধারায় প্রবাহিত করতে চান। তিনি বলেন, ‘আমাদের বিধান পরিষদের অবজেকটিব রেজুলেশন ও আমাদের সাহিত্য-পরিষদের অবজেকটিব রেজুলেশনের মূল কথা অভিন্ন হওয়া চাই। কারণ আমরা তওহীদের আমানতদার এবং তওহীদই আমাদের সংস্কৃতির শেষ কথা।’
এর মাঝে পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছে। ১৯৪৯ থেকে ঢাকায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হ’তে শুরু করেছে। চারদিকে ইসলাম ও পাকিস্তানবাদ প্রচারিত হতে শুরু করেছে প্রবলভাবে। পাকিস্তানবাদী সাহিত্যতাত্ত্বিকেরা পাকিস্তানবাদে আরো বিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন, এবং পাকিস্তানকে অবিনশ্বর ভাবতে শুরু করেছেন। বেড়েছে সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা, এবং বেড়েছে পাকিস্তানবাদীদের সাহিত্যিক সাম্প্রদায়িকতাও। যাঁরা পাকিস্তানবাদে বিশ্বাসী নন, তাঁদের মতামত প্রকাশিত-প্রচারিত হওয়ার পথ সে-সময় বন্ধ। তাই বিভিন্ন পত্রিকায় পাকিস্তানবাদী সাহিত্যতাত্ত্বিক প্রবন্ধই চোখে পড়ে। ১৯৪৯-এ আবুল কালাম শামসুদ্দীন ‘পাকিস্তানে শিল্প ও সাহিত্যের ধারা’ প্রবন্ধে পাকিস্তানবাদী সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর মত পুনরায় ব্যক্ত করেন। তাঁর বিশ্বাস, ‘পাকিস্তান ক্ষণস্থায়ী জীবন নিয়ে আসে নি-বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহে জল-বুদের জীবন তার নয়। তিনি পাকিস্তানকে একটি ‘বিপ্লব’ ব’লে গ্রহণ করেন, এবং ঘোষণা যে পাকিস্তানি সাহিত্যও হবে বিপ্লবাত্মক। পাকিস্তানি সাহিত্যের সত্যিকার রূপটি কী হবে, তিনি তা স্পষ্ট নির্দেশ করতে না পারলেও, তাঁর মতে, ‘বিজাতীয় ভাবধারা, বিজাতীয় উপমা রূপক শব্দ কোন কিছুই আর নতুন পোষাক পরে পাকিস্তান সাহিত্যে চালু হতে পারবে না। এই উপলব্ধির ভিত্তিতে যে সত্যিকার পাকিস্তানী সাহিত্য জন্ম নেবে তারই আয়োজনে আমাদের সাহিত্যিকগণ নিয়োজিত আছেন।
নওবাহার (১৩৫৬) পত্রিকার প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় ‘আমাদের মত ও পথ’ নামক সম্পাদকীয়তে পত্রিকাটির ও পাকিস্তানি সাহিত্যের পথ নির্দেশ করা হয়। সম্পাদকীয়তে বলা হয় যে এটি ‘নিছক একখানি সাহিত্য-পত্র’, এবং ‘পাকিস্তান-বিরোধী কোন বিষয়বস্তুও ‘নওবাহারে’ স্থান পাইবে না।’ পত্রিকাটির লক্ষ্য ‘আমাদের (পাকিস্তানের) তাহজীব ও তমদ্দুনের রূপায়ণ।’ বলা হয়, ‘বাংলাদেশ বিভক্ত হইবার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা দ্বিধা-বিভক্ত হইয়া গিয়েছে। পাকিস্তানের ওপারের সাহিত্য আর এপারের সাহিত্যে তাই এখন আর পূর্বের ধারাবাহিকতা রহিবে না।’ পত্রিকাটি মারফতী ও মুর্শিদীগান, বেহুলার ভাসান, বেদে-বেদেনীর গান প্রভৃতি ইসলামবিরোধী ব’লে বর্জন করতে চায়। এমনকি পুথিসাহিত্যকেও ত্যাগ করতে চায়, কারণ ‘সাচ্চা ইসলামী আদর্শ ও ভাবধারা ঐ সাহিত্যে খুব কমই আছে।’ পত্রিকাটির মতে, ‘বাঙালী মুসলমানের জাতীয় অধঃপতনের মূল কারণ হইল আমাদের আদর্শ-বর্জিত বাংলা সাহিত্যের প্রভাব।’ পত্রিকাটি প্রকৃত পাকিস্তানি সাহিত্য চায়, কিন্তু দুঃখের সাথে লক্ষ্য করে যে ‘আমাদের একদল কবি-সাহিত্যিক এখনও প্রাক-পাকিস্তান যুগের আদর্শে বাংলা ভাষার চর্চা করিতেছেন।’ নওবাহার-এর বিভিন্ন লক্ষ্যের একটি হচ্ছে-এটি ‘কমিউনিজমকে রুখিবে।’ নওবাহার-এর প্রকৃত সম্পাদক ছিলেন গোলাম মোস্তফা, যদিও সম্পাদক হিশেবে মুদ্রিত হতো তাঁর স্ত্রীর নাম। কাজী মোতাহার হোসেন ‘নতুন অবস্থায় সাহিত্য’ প্রবন্ধে ভিন্ন স্বরে কথা বলেন। এই প্রথম দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ভিন্ন স্বর শোনা যায়। তিনি বলেন, ‘যাঁরা ইসলামী সাহিত্য বলতে কেবল তউহীদের ব্যাখ্যা এবং হিন্দু-সাহিত্য বলতে তশরীকের কীর্ত্তন বোঝেন, আমার বোধ হয়, তাঁরা সাহিত্যকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ বলে মনে করেন।’ তিনি পাকিস্তানি সাহিত্যের ভিন্ন চরিত্র নির্দেশ করেন। তাঁর মতে, ‘পাকিস্তানী সাহিত্য হবে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির মিলন-ভূমি। রসমাধুর্য্যে সে সাহিত্য সকলেরই মনোহরণ করবে।’ তিনি মৃদুভাবে সাবধান ক’রে দেন যে ‘শিশুরাষ্ট্রে যাতে চিন্তার কণ্ঠ রোধ না হয়, সেদিক যেন রাষ্ট্রপতিদের লক্ষ্য থাকে।’ এ-সাবধানবাণী থেকে বোঝা যায় শুরুতেই পাকিস্তানে চিন্তার কন্ঠরোধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিলো।
দিলরুবা (১৩৫৬, ১:৩) পত্রিকাটি ‘আমাদের ভাষা ও সাহিত্য’ নামে ‘পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ গতিপথ’ সম্বন্ধে বিভিন্ন লেখকের বক্তব্য প্রকাশ করে। মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের রচনা থেকে নিচের উদ্ধৃটিতে তখনকার পরিস্থিতির পরিচয় মেলে : ‘আমাদের মধ্যে একদল ভাবছেন বাংলা ভাষাকে একেবারে বাদ দিয়ে উর্দুকে বরণ করা যখন সম্ভব হলো না তখন প্রচুর আরবী ফারসী তথা উর্দু শব্দ আমদানি করে, বাংলার বর্ণমালা পর্যন্ত পাল্টে দিয়ে বাংলাকে ধীরে ধীরে উর্দুর সমপর্যায়ে টেনে তুলতে হবে। এরা হলেন চরমপন্থী। নরমপন্থীরা মনে করেন বড় রকমের রাজনৈতিক বিবর্তন প্রতি দেশেরই জাতীয় জীবনে একটা পরিবর্তন এনে দেয়। তাই আমরা যখন পাকিস্তান অর্জনে সফলকাম হয়েছি তখন পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তার জন্য আস্ফালনের প্রয়োজন নেই, ভাষাকে আজই ঢেলে সাজাবার তাগিদ নেই আর বাংলা বর্ণমালাকে গঙ্গা পার করে বাংলার ‘কুফরস্থানে’ ঠেলে দিয়ে হুরুফুল কোরাণের ভাঁওতায় উর্দু অক্ষর গ্রহণ করারও জরুরাত নেই। পাকিস্তান রাষ্ট্রের উন্নতির সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা সাহিত্যও ধীরে ধীরে পাকিস্তানী (পূর্ব পাকিস্তানী অবশ্য) ছাপ বহন করবে।’ তিনি মিশ্র বাঙলা ভাষাকে গ্রহণযোগ্য ভাবেন না। তাঁর শ্লেষাত্মক একটি বাক্য ‘কথা উঠেছে সাহিত্যকেও দীন ইসলামের কালেমা পড়াতে হবে’- থেকেই বোঝা যায় পাকিস্তানবাদী ইসলামী সাহিত্যেও তিনি বিশ্বাসী নন। মুহম্মদ আবদুল হাই মনে করেন, ‘পাকিস্তানের সোনার কাঠির স্পর্শে বাঙালী মুসলমানের ঘুমন্ত অন্তরপুরীতে দোলা লেগেছে; সৃষ্টি প্রেরণায সে আজ মশগুল। আজ তার ভুল করলে চলবে না। সে যে বাঙলার মানুষ। সুতরাং তার মুসলমানত্ব ও বাঙালীত্ব, তার পাকিস্তান ও পূর্ব বাঙলা- এই বৈশিষ্ট্যের উপরেই তার জীবন গাথা তার সাহিত্য তাকে রচনা করতে হবে।’
সাজ্জাদ হোসায়েন ‘মাশরেকী পাকিস্তানের ভাষার স্বরূপ’ প্রবন্ধে বাংলা ভাষার কাঠামো স্থির করতে উদ্যোগী হন উগ্র পাকিস্তানপন্থীরূপে। তিনি বলেন, “বাংলাকে মুসলিম তমদ্দুনের উপযুক্ত বাহনে পরিণত করিতে হইলে আমাদের যে আরবী-ফারসী আলফাজ এস্তেমাল করিতে হইবে, তাহা অস্বীকার করা চলে না। এবং যে সমস্ত শব্দ বিজাতীয় তমদ্দুনের পরিচয় বহন করে, সেগুলিকে পরিত্যাগ করিতে হইবে, তাহাও সত্য।’ তাঁর মতে, ‘ইসলামী তমদ্দুনের নামগন্ধবর্জিত বঙ্কিমী-বিদ্যাসাগরী ভাষা পাকিস্তানের তরুণ শিক্ষার্থীরা শিখিবে, ইহার চাইতে পরিতাপের বিষয় আর কি হইতে পারে?’ ‘পাকিস্তানের সাহিত্যের আদর্শ’ প্রবন্ধে আহমদ শরীফ সে-সময়ের পরিস্থিতি বর্ণনা করেন এভাবে : ‘চারদিক থেকে ধ্বনি উঠছে– ইসলামী সাহিত্য চাই। ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে ইসলামী-তমদ্দুন-তাহজীব, ঐতিহ্য-আদর্শ প্রতিফলিত করাই হবে আমাদের সাহিত্যিকদের ব্রত। কিন্তু আমাদের কবির দল (দু’একজন ছাড়া) তবু কাস্তে, লাঙ্গল, ধানক্ষেত, লড়াই আর বুভুক্ষ নিয়েই গুরুদের সাগরেদি করছেন। প্রমাণ- সদ্য-প্রকাশিত নবীন কবিদের কবিতা-সংকলন ‘নতুন কবিতা’ বইখানি। খুঁজলে অতি সহজেই কারণের সন্ধান মিলবে। প্রথমতঃ আমাদের মনে বা মাথায় কোথাও ইসলাম নেই, যদিও আমরাই ইসলামকে আঁকড়ে ধরে রেখেছি সব চেয়ে শক্ত করে।’ তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘অন্তরে বাইরে কোথাও আমরা ইসলামী আদর্শ দেখতে পাই না। তবু বলা হচ্ছে ইসলামী-আদর্শে সাহিত্য সৃষ্টি করে মুসলমানী তমদ্দুন ও তাহজীবের মর্যাদা রক্ষা করতেই হবে, দুনিয়ার বৃহত্তর মুসলিম-রাষ্ট্র পাকিস্তানে। উত্তম কথা। উদ্দেশ্যও সাধু। সুতরাং দ্বিমত অবাঞ্ছিত। তবু ‘কিন্তু’ না করে উপায় নেই।’ তাঁর মতে, “ইসলামী আদর্শ হচ্ছে দেশ-কাল-পাত্র-নিরপেক্ষ এবং সাহিত্যের প্রধান উপকরণ হচ্ছে মানুষ– ইসলামের মূলনীতির পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের জীবনের সমস্যা বিচার ও সমাধান প্রচেষ্টার মধ্যেই ইসলামী বা পাকিস্তানী সাহিত্য গড়ে উঠতে পারে।’ মোস্তফা কামাল ‘আগামী সাহিত্যের ভূমিকা’য় বলেন, ‘পাকিস্তান লাভের পর আমাদের ভবিষ্যৎ সাহিত্যদর্শ কি হবে, এটা তাহলে পরিস্ফুট। সোজা কথায় বলতে গেলে, আজ পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা সাহিত্যে স্থান পাবে পাকিস্তানের লক্ষ্য ও আদর্শ, পাকিস্তানীদের জীবন-দর্শন ও তাদের সমাজ-জীবন ৷’
ইব্রাহীম খাঁ ‘আমাদের সাহিত্য’ প্রবন্ধে ‘রুশীয় সাম্যে’র নিন্দা ক’রে সমাজ-সমালোচনামূলক সাহিত্যের বদলে ‘জীবনের আনন্দধ্বনি- সংগ্রাম-মুখী মুক্তি অভিসারীর জয়যাত্রার প্রাণময়ী সঙ্গীত’ শুনতে চান। তিনি বলেন, ‘আমাদের মাসিক কাগজগুলিতে যে সব ছোট গল্প প্রকাশিত হয়, তার অনেকগুলিতে ধ্বনিত হয়ে ওঠে একটা বেদনার্ত হাহাকার। কেউ মরে জমিদারের জুলুমে, কেউ পথে ঢলে পড়ে অনশনের পীড়নে, কেউ জর্জরিত হয় কারখানার মালিকের নির্মম কষাঘাতে, কেউ হাসপাতালের দুয়ারে শুয়ে মহাযাত্রা করে, হাসপাতালে গেলে স্থান পায় না, স্থান পায় বড়লোকের চিকিৎসা-বিলাসী অপদার্থ নন্দনেরা, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার বক্তব্য, বাংলার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের ছবি আমরা দেখেছি, তার বর্ণনা আমরা পড়েছি, বড়র অত্যাচারের কাহিনী নিয়ে যথেষ্ট আন্দোলন করেছি। আর নয়। আর মরণের হাহাকার শুনতে চাই না।’ অর্থাৎ ইব্রাহীম খাঁ গণসাহিত্য চান না; কিন্তু আহমদ শরীফ ‘গণসাহিত্য’ প্রবন্ধে গণসাহিত্যেরই পক্ষাবলম্বন করেন। তিনি বেহেস্ত-দোজখের শান্তি-শাস্তি-নিরপেক্ষ’ জীবন ও সাহিত্য কামনা করেন।
পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের কাল থেকে সৈয়দ আলী আহসান পাকিস্তানবাদী সাহিত্যের নিষ্ঠাপরায়ণ প্রগতিবিমুখ ভাষ্যকারের দায়িত্ব পালন করেন। একগুচ্ছ প্রবন্ধ রচনা ক’রে পাকিস্তানি সাহিত্যের রূপ নির্দেশ করার তিনি চেষ্টা করেন; এবং ক্রমশ তিনি প্রগতিবিমুখ থেকে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠেন। ‘আমরা যারা লিখছি’ প্রবন্ধে তিনি ‘পুথির ভাবধারা আমাদের পক্ষে আজ মিথ্যে হয়েছে’ মনে করলেও পুঁথিকে নতুন সাহিত্যের প্রেরণা হিশেবে গ্রহণ করেন, এবং ‘নজরুলকে জাতীয় কবি বলা নিজেদের প্রবোধ দেয়া মাত্র’ ব’লে মনে করলেও তাঁকে স্বীকার ক’রে নেন, কারণ তাঁর মধ্যে ইসলামী ঐতিহ্যের অংশ ছিলো।’ ‘পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য’ প্রবন্ধে তিনি ‘নবলব্ধ আজাদীর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সাহিত্য কি রূপ নেবে’ সে সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। তাঁর মতে দেশ বিভাগের আগে থেকেই স্থির হয়ে গেছে যে ‘পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যের ধারা সম্পূর্ণ বাংলা সাহিত্যের ধারা হতে হবে ভিন্ন।’ কিন্তু ভিন্ন সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব হয়ে ওঠে নি, তবে ‘একমাত্র কাব্যক্ষেত্রে ইসলামী ঐতিহ্যের অনুসরণ আরম্ভ হয়েছিলো।’ তিনি এ-প্রবন্ধেও পুথিসাহিত্যকে ঐতিহ্য হিশেবে গ্রহণের কথা বলেন, কারণ তা ‘উপাদানের দিক দিয়ে যথেষ্ট শক্তিশালী।’ তাঁর মতে, ‘যে-জীবন সাহিত্যিকের উপজীব্য হবে গ্রামের পত্রচ্ছায়ায় তা লালিত, তাই গ্রামকে বঞ্চিত করে শহরকে নিয়ে এখানকার সাহিত্য হতে পারে না।’ ১৯৫১-তে বেরোয় তাঁর ‘পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা সাহিত্যের ধারা’ প্রবন্ধটি, যার জন্যে তিনি কুখ্যাতি অর্জন করেন। আয়ারল্যান্ডে যেমন নতুন সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিলো, পূর্ব পাকিস্তানেও তেমনি নতুন সাহিত্য সৃষ্টির কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘সাহিত্য সৃষ্টির পূর্বাহ্নে তিনটি আদর্শকে সামনে রেখে কাজে অগ্রসর হতে হবে। সে তিনটি আদর্শ হচ্ছে, প্রথমতঃ- ইসলামের প্রবহমান ঐতিহ্য থেকে উপাদান আহরণ, দ্বিতীয়তঃ- অধুনা অপাংক্তেয় মুসলমানী পুথিকে পরিমার্জিত করে শালীন সাহিত্যের অংগীভূত করা, এবং তৃতীয়তঃ–পূর্ব-পাকিস্তানের অস্বীকৃত গ্রাম্য জীবনকে আরো বেশী করে সাহিত্যের বিষয়ীভূত করা।’ তবে ইসলামি তমদ্দুনই ছিলো তাঁর ও তাঁর গোত্রের লক্ষ্য। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান আন্দোলনের শুরু থেকেই এই আশা সবার মনে জেগেছিলো যে, পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা সাহিত্য ইসলামি তমদ্দুনের বাহন হবে।’ এ-উদ্দেশ্যে তাঁরা ইকবালের কবিতা অনুবাদের উদ্যোগ নিয়েছিলেন; কারণ ‘তিনি প্রথম পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তিভূমি রচনা করেন’, এবং ‘তাঁর ভাবধারা মূলতঃ ছিল ইসলামী।’ সৈয়দ আলী আহসান কয়েক দশক পূর্ববর্তী প্রগতিশীল ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনকারীদের তিরস্কার করেন এভাবে : ‘দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত মুসলমান সাহিত্যিকরা অনেকটা হিন্দু ভাবধারায় দীক্ষিত ছিলেন। এই দীক্ষার চরম নিদর্শন মেলে ঢাকার মুসলমান সাহিত্য সমাজের তথাকথিত মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনে। ইসলামী নীতিবোধকে লাঞ্ছিত করে যে মুক্তবুদ্ধির প্রতিষ্ঠা তা বিকৃত মানসের সৃষ্টি, তাতে নতুনত্বের উন্মত্ততা আছে, কিন্তু স্থির বিবেচনার প্রশান্তি নেই।…এই মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনকে বাংলার মুসলমান কখনও স্বীকার করে নেয় নি।’ পাকিস্তানবাদীরা যেখানে ছিলেন প্রগতিবিমুখ সেখানে মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনকারীরা ছিলেন প্রগতিশীল, এটা এতোদিনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আলী আহসানের পাকিস্তানবাদে দীক্ষা উগ্র হয়ে উঠেছে প্রবন্ধটিতে শেষাংশে : ‘আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখবার জন্য এবং হয়তোবা জাতীয় সংহতির জন্য যদি প্রয়োজন হয়, আমরা রবীন্দ্রনাথকেও অস্বীকার করতে প্রস্তুত রয়েছি। সাহিত্যের চাইতে রাষ্ট্রীয় সংহতির প্রয়োজন আমাদের বেশী।’ কিন্তু বাঙলাদেশ ও সাহিত্য গেছে বিপরীত দিকে : রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালিত্বের জন্যে বাঙালি মুসলমান পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
পাকিস্তানবাদী সাহিত্যতত্ত্ব (১৯৪৩-১৯৫১) ছিলো সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে প্রগতিবিমুখ, এবং শৈল্পিকভাবে অনাধুনিক ও অনুর্বর। মুসলিম লিগের দ্বিজাতিতত্ত্ব ও পাকিস্তান-আন্দোলনে বিশ্বাসী এ-সাহিত্যতত্ত্বের প্রচারকেরা ভূমিকা পালন করেছিলেন পাকিস্তানি রাজনীতির প্রচারকের। পরবর্তী জীবনে তাঁরা প্রায় সবাই প্রতিক্রিয়াশীল হিশেবে নিন্দিত হন। যে-পাকিস্তানে তাঁদের অন্ধ বিশ্বাস ছিলো, সেটি তার স্বাধীনতার শুরু থেকেই জীর্ণ হ’তে শুরু করে, এটা তাঁরা বুঝে উঠতে পারেন নি; এবং অনুভব করেন নি যে বাঙালিরা পাকিস্তানকে অস্বীকার ক’রে অন্য দিকে অগ্রসর হ’তে শুরু করেছে। পাকিস্তানি আবহাওয়ায় পাকিস্তানবাদবিরোধী বক্তব্য প্রকাশের সুযোগ বিশেষ ছিলো না; সাহসেরও অভাব ছিলো। তাই পাকিস্তানবিরোধী প্রবন্ধ বিশেষ পাওয়া যায় না। কিন্তু গল্প-কবিতায় গোপন বিরোধিতা চোখে পড়ে। বায়ান্নোর ভাষা-আন্দোলনে ঘটে তার স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। শৈল্পিকভাবে এ-সহিত্যতত্ত্ব আধুনিক ও উর্বর ছিলো না। বাঙলা সাহিত্যে বিশের দশকের দ্বিতীয়াংশেই যে-আধুনিকতা সূচিত হয়ে গেছে, তা তাঁরা পুরোপুরি ভুলে থেকেছেন; তার বদলে তাঁরা সৃষ্টি করতে চেয়েছেন এমন এক সাহিত্য যা আধেয়তে মধ্যযুগীয় এবং আধারে অমার্জিত-অসংস্কৃত। তাঁরা সাহিত্যে নবজাগরণ আনতে চেয়েছিলেন ইসলামি ঐতিহ্য নির্ভর করে, যা আধুনিককালে শুধু অসম্ভবই নয়, হাস্যকরও। তাঁরা ভাষাকে ক’রে তুলতে চেয়েছিলেন আরবি-ফারসি-উর্দুর মিশ্রণে অপরিসুত। তাঁদের তত্ত্ব অবলম্বন ক’রে বাঙলাদেশের সাহিত্যের মুক্তি ঘটা সম্ভব ছিলো না। তাই দেখা গেছে পাকিস্তানবাদী লেখকেরা, বিশেষ ক’রে কবিরা– এঁরাই ছিলেন উগ্র- কবিতা থেকে দূরে স’রে গেছেন, বা কালাতিক্রমণদুষ্ট পদ্য তৈরি করেছেন। তাঁরা পুথিসাহিত্যকে ঐতিহ্য হিশেবে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা সম্ভব হয় নি। তাঁরা যা প্রত্যাখ্যান করেছেন, বাঙলাদেশের সাহিত্য বিকশিত হয়েছে তা নির্ভর ক’রেই। পঞ্চাশ, বিশেষ করে ষাটের দশকে, বাঙলা সাহিত্যের তিরিশি স্রোতের সাথে সংযুক্ত হয়ে এবং পাশ্চাত্য সাহিত্যের অনুপ্রেরণায় বিকশিত হয় বাঙলাদেশের আধুনিক সাহিত্য। পাকিস্তানবাদী সাহিত্যতত্ত্ব নির্ভর ক’রে যা রচিত হয়েছে, তার কোন শিল্পমূল্য নেই। বাঙলাদেশের সাহিত্যে তা কলঙ্কের মতো। পাকিস্তান ও পাকিস্তানবাদী সাহিত্যতত্ত্ব বাঙালির জীবনের দু’টি দুর্ঘটনা।