বাক্য

বাক্য

ভূমিকা। বাক্য কাকে বলে?- এ-প্রশ্ন করা হ’লে বহুদিন আগে ব্যাকরণ-ভুলে-যাওয়া ব্যক্তিও বেশ দৃঢ় উত্তর দেবেন : ‘মনের ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করে এমন শব্দসমষ্টিই বাক্য।’ তিনি বিদ্যালয়ে-মহাবিদ্যালয়ে ব্যাকরণ পড়েছেন; বাক্যের সংজ্ঞা, আরো নানা সংজ্ঞার সাথে, মুখস্থ করেছেন। তারপর ভুলে গেছেন ব্যাকরণের বহু আদেশ-উপদেশ; কিন্তু তিনি যে-সব ব্যাকরণিক পরিভাষা আমৃত্যু বহন ও ব্যবহার করবেন, তার মধ্যে বাক্য প্রধান। শিক্ষিত মানুষকে কিছু-না-কিছু লিখতেই হয়, ও পড়তে হয় অনেক কিছু; তাই ‘বাক্য’ শব্দ ও ধারণাটিকে ভোলা সম্ভব হয় না তাঁদের পক্ষে। তাঁদের অনেকে বিশ্বাস করেন যে বাক্য সম্পর্কে তাঁদের ধারণা বেশ পরিচ্ছন্ন : সহজেই বুঝতে পারেন কোন বাক্যটি শুদ্ধ, আর কোনটি অশুদ্ধ বা অসম্পূর্ণ। বাক্যের যে-সংজ্ঞাটি তাঁরা শিখেছেন প্রথাগত ব্যাকরণে, সেটিকে তাঁরা অনন্য ধ্রুব ব’লে জানেন; কিন্তু বাক্যসংগঠন সম্পর্কে গবেষণায় রত হওয়ার সাথেসাথে গবেষক মুখোমুখি হন একঝাঁক বাক্য সংজ্ঞার। বিভিন্ন ইংরেজি ব্যাকরণে পাওয়া যায় বাক্যের দু-শোরও বেশি সংজ্ঞা; বাঙলা ব্যাকরণেও একগুচ্ছ সংজ্ঞা পাওয়া যায়। প্রথাগত ইংরেজি, ও তার অনুকরণে রচিত বাঙলা, ব্যাকরণে যে- সংজ্ঞাটি ফিরেফিরে পাওয়া যায়, সেটি এমন : ‘যে-শব্দগুচ্ছ মনের ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করে, তা-ই বাক্য।’ দু-হাজার বছর ধ’রে জনপ্রিয় এ-সংজ্ঞাটিতে এমন কোনো মানদণ্ড নেই, যার সাহায্যে নির্ভুলভাবে বাক্যশনাক্তি সম্ভব। ‘মনের ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশের’ যে-মানদণ্ড পাওয়া যায় এতে, তা প্রয়োগযোগ্য নয়; তাই বাস্তবে বাক্যনির্ণয়ের সময় এটির প্রয়োগ থেকে বিরত থাকি আমরা। যদি কেউ কোনো মুদ্রিত রচনার বাক্যসংখ্যা গুণতে চান, তবে তিনি এক পূর্ণচ্ছেদের পরের শব্দ থেকে আরেক পূর্ণচ্ছেদের আগের শব্দ পর্যন্ত শব্দগুচ্ছকে এক বাক্যরূপে ধ’রে হিশেব করবেন সমগ্র রচনার বাক্যসংখ্যা;– ওই শব্দগুচ্ছে মনের ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পেয়েছে কি-না, সেদিকে তিনি খেয়ালই করবেন না। তাঁর কাছে বাক্যের সংজ্ঞা এমন : ‘এক পূর্ণচ্ছেদের অব্যবহিত পরবর্তী শব্দ থেকে পরবর্তী পূর্ণচ্ছেদের অব্যবহিত পূর্ববর্তী শব্দ পর্যন্ত বিন্যস্ত শব্দের সমষ্টিই বাক্য।’ এতে মনোভাব-সম্পূর্ণতার কোনো স্থান নেই, যদিও গণনাকারী ধ’রে নিতে পারেন যে লেখকমাত্রই দু-পূর্ণচ্ছেদের মধ্যে বিন্যস্ত শব্দে মনের ভাব সম্পূর্ণরূপে নিঃশেষ করেন।

ছাত্রদের বাক্যবোধ জাগানোর চেষ্টা বাঙলা ভাষা-অঞ্চলে খুব প্রবল নয়; কিন্তু পশ্চিমে এ-চেষ্টা অন্তহীন। সেখানে শিক্ষার্থীদের মনে বাক্যবোধ সৃষ্টির নিরন্তর চেষ্টা চালানো হয়, ও শুদ্ধ বাক্য রচনার কৌশল শেখানো হয় নিত্য অভিনব উপায়ে। তবুও ত্রুটি ঘটে, যা অনেকে লালন করে সারা জীবন। পাওয়া যায় এমন বাক্য, যা আসলে কয়েকটি বাক্যের সমাহার; আবার এমন বাক্যগুচ্ছও রচিত হয়, যা মাত্র একটি বাক্যে রূপ পেলেই ঠিক হতো। এমন ঘটে যেহেতু বাক্যবোধহীনতাবশত, তাই পশ্চিমের ছাত্রদের মনে বাক্যবোধ বা এমন আন্তর শক্তি সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়, যার সাহায্যে তারা বাক্য থেকে অবাক্য বা অপবাক্যকে পৃথক করতে পারে। বাক্যবোধ সৃষ্টি সম্পর্কে ওয়ালকট ও অন্যান্যের পরামর্শ এমন (উদ্ধৃত ফ্রিজ (১৯৫২, ১০)) : ‘আমাদের বাক্যগুলো সম্পূর্ণ কি অসম্পূর্ণ, তা নির্ণয়ের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে বাক্য ‘অনুভব করা’। অসম্পূর্ণ বাক্য কোন ভাব প্রকাশ করেনা…সম্পূর্ণ বাক্য থেকে অবাক্য পৃথক করা কঠিন কাজ নয়। কোনো ভাবনা সম্পূর্ণভাবে ব্যক্ত হয়েছে কি-না, তা আমরা ‘অনুভব করি’ সহজাতভাবেই।…ছাত্রদের রচনায় আরো একটি পুনরাবৃত্ত ত্রুটি হচ্ছে ‘কমার সাহায্যে সংযোজন’…তারা অনেক সময় একাধিক বাক্যকে কমা দিয়ে একসাথে জুড়ে দেয়। যদি আপনি সম্পূর্ণ বাক্য-একক ‘অনুভব করা’র শক্তি আয়ত্ত ক’রে থাকেন, তবে আপনার এমন ভুল হওয়ার কথা নয়।…এমন ত্রুটি নির্ণয়ের উৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে রচিত বাক্য উচ্চস্বরে পড়া, ও অনুভব করা যে রচিত বাক্যে ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পেয়েছে কি-না।’ বাক্যবোধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু প্রথাগত আনুশাসনিক ব্যাকরণবিদেরা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারেন নি একটি বাক্যে ঠিক কি পরিমাণ ভাবনার প্রকাশ ঘটালে মনোভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পায়।

এক শব্দের বাক্য যেমন দেখা যায়, তেমনি চোখে পড়ে প্রচুর পরিমাণ শব্দে গঠিত বাক্য। উনিশশতকী বাঙলা ভাষার লেখকদের বাক্য সাধারণত দীর্ঘ; তা অনেক সময় পংক্তি- পরম্পরায় ছড়িয়ে প’ড়ে গ’ড়ে তোলে পরিপূর্ণ অনুচ্ছেদ। বিশশতকের লেখকেরা ছোটো বাক্যের প্রতি আকৃষ্ট; তাই তাঁদের রচনায় পাওয়া যায় এমন বাক্য, যার অনেকাংশ গঠিত অল্পসংখ্যক শব্দে। অনেক লেখক তাঁদের পাত্রপাত্রীদের মানস- জটিলতা উন্মোচনের জন্যে জটিল সূত্রে গঠিত বাক্যের পাশাপাশি রচনা করেন এমন অনেক উপবাক্য, বাক্যটুকরো, যাতে কোনো সম্পূর্ণ মনোভাব প্রকাশ পায় না। দীর্ঘ বাক্যের একটি উদাহরণ দিয়েছেন ফ্রিজ (১৯৫২, ১১);- তিনি জানিয়েছেন যে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতির ১৯৪৩ সালের প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে একটি বাক্য, যা গঠিত ৪২৮৪টি শব্দে, এবং মুদ্রিত হয়েছে এগারো পৃষ্ঠাব্যাপী। এ-সমস্ত উদাহরণ একটি কথা জানায় যে একটি বাক্যে ঠিক কতোখানি ভাব প্রকাশ পাবে, এবং ঠিক কতোগুলো শব্দ বসবে, তা বাক্য রচনার আগে নির্ণয়ের উপায় নেই।

ভাষাবিজ্ঞানের তিনটি প্রধান ধারা- প্রথাগত ব্যাকরণ, সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞান, ও রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ- বাক্য সম্পর্কে মোটামুটি তিন রকম ধারণা পোষে। এর মধ্যে প্রথাগত ব্যাকরণের বাক্যধারণা সম্পর্কে আমরা অনেকটা অবহিত। প্রথাগত ব্যাকরণ বাক্যের সংজ্ঞা রচনা করে আর্থ মানদণ্ডে এবং আধেয়-অনুসারে বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করে বাক্য নামী ব্যাকরণিক এককটিকে। নানা ভাষায় এককটির নানা নাম, যেমন : বাক্য, লোগোস, প্রোপ্রোজিতিও, ফ্রেজ, থিস, সাটজ; তবে পুবপশ্চিমের সমস্ত প্রথাগত ব্যাকরণই প্রায় অভিন্ন কৌশলে নির্ণয় করতে চেয়েছে বাক্য। প্রথাগত ব্যাকরণ ‘অভিলাষী বাক্যের এক সর্বজনীন ও সর্বভাষিক আর্থ বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করতে, যার সাহায্যে যে-কোনো ভাষার বাক্য শনাক্ত করা সম্ভব। প্রথাগত ব্যাকরণবিদেরা ধ’রে নিয়েছিলেন যে ভাষা আন্তর ভাবনার প্রতিফলন বা বহিঃপ্রকাশ, এবং ব্যাকরণ যেহেতু ভাষার সূত্র উদঘাটনে উৎসাহী, তাই তা উদঘাটন করবে ভাবনার সমস্ত সূত্র। তাঁরা এমন ধারণাও পুষতেন যে মানব-মন চিন্তা করে বাক্যের সাহায্যে, আর সব মানুষের মনের গঠন যেহেতু একই রকম, তাই সব ভাষার বাক্যের মূল বৈশিষ্ট্য সদৃশ হ’তে বাধ্য। তাই প্রথাগত ব্যাকরণবিদেরা রচনা করেছিলেন বাক্যের সর্বজনীন আর্থ সংজ্ঞা, যা ব্যবহৃত হয়েছে দু-হাজার বছরেরও অধিক সময়; কিন্তু তা বাক্যশনাক্তির উপযুক্ত মানদণ্ড দিতে পারে নি। আদি প্রথাগত ব্যাকরণবিদেরা বাক্যের বিশ্বজনীন ও সর্বভাষিক সংজ্ঞা রচনায় উৎসাহী হ’লেও তাঁরা উপাত্ত-ভাষারূপে নিতেন সাধারণত গ্রিক, লাতিন, সংস্কৃত, বা ফরাশি, এবং বিশ্বাস করতেন যে তাঁদের উপাত্ত-ভাষাতেই চিন্তাভাবনা সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রকাশ পায়; সুতরাং অন্যান্য ভাষায়ও চিন্তাভাবনা অবিকল অমনভাবে প্রকাশ পাওয়া উচিত। যেমন : দিদরো মনে করতেন যে একমাত্র ফরাশি ভাষায়ই মনোভাব প্রকাশ পায় সবচেয়ে স্বাভাবিক ও সঙ্গত- ভাবে, তাই ফরাশিই বিজ্ঞানচর্চার উপযুক্ততম ভাষা। তবু প্রথাগত ব্যাকরণবিদেরা বাক্যসংগঠন সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছিলেন, যদিও সীমাবদ্ধতাও কম নয় তাঁদের। প্রথাগত বাক্যধারণার বিরুদ্ধে প্রথম আপত্তি তোলেন সাংগঠনিকেরা। সাংগঠনিকেরা সমস্ত ক্ষেত্রে আর্থ মানদণ্ডের বিরোধী, রৌপ মানদণ্ডের পক্ষপাতী এবং সর্বজনীনতায়ও অবিশ্বাসী তাঁরা। তাঁরা রৌপ মানদণ্ডে বাক্য শনাক্ত করায় উৎসাহী; এবং বিশ্বাস করেন যে প্রত্যেক ভাষার অনন্য নিজস্ব বাক্যসংগঠন রয়েছে। বাক্যসংগঠনের ওপর নতুন আলো ছড়িয়ে তাঁরা বাক্যসংগঠনের অনেক বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে সমর্থ হ’লেও তাঁদের বাক্যধারণা গভীর নয়। রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ভাষাবিজ্ঞানীরা উপস্থিত করেন বাক্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন ধারণা, এবং বাক্য বর্ণনায় অর্জন করেন অভূতপূর্ব সফলতা। এ-পরিচ্ছেদে আমার লক্ষ্য প্রথাগত, সাংগঠনিক, ও রূপান্তরবাদী বাক্যসংজ্ঞা ও ধারণার পরিচয় দেয়া, ও তাদের উপযুক্ততা বিচার করা।

গ্রিক-রোমান বাক্যসংজ্ঞা ও ধারণা। পাশ্চাত্য প্রথাগত ব্যাকরণে যে-বাক্যসংজ্ঞা ও ধারণা পাওয়া যায়, তার উৎস গ্রিক-রোমান বাক্যসংজ্ঞা ও ধারণা। পশ্চিমে প্রথম বাক্য সম্পর্কে ভেবেছিলেন গ্রিক দার্শনিক ও ব্যাকরণবিদেরা; এবং তাঁদের প্রতিভামণ্ডিত অনুকরণ করেছিলেন রোমানগণ। গ্রিক দার্শনিকেরাই প্রথম বাক্যের স্বরূপ উদঘাটনে মন দেন, ও পরে তাতে যোগ দেন ব্যাকরণবিদেরা। গ্রিক ভাষার তিনটি শব্দে ধরা পড়ে দু-রকম বাক্যধারণা। গ্রিক ধাতুজাত ‘সিন্ট্যাক্স’ ও ‘সেন্টেন্স’ শব্দের অর্থ ‘একত্রবিন্যাস’;–এ-শব্দ দুটি থেকে ধারণা করা যায় যে তাঁরা বিভিন্ন শব্দের সমবায় বা বিন্যাসকে বাক্য ব’লে মনে করতেন। এ-বাক্যধারণাটি প্রধানত রৌপ। আরো একটি শব্দ আছে গ্রিক ভাষায়, শব্দটি হচ্ছে ‘লোগোস’;-এর আছে বেশ কয়েকটি অর্থ; যেমন : ‘পদ’, ‘বাক্য’, ‘প্রস্তাব’ প্রভৃতি। এ-শব্দটি নির্দেশ করে বাক্যের আধেয় বা অর্থ।

গ্রিকদের মধ্যে প্রথম বাক্যশনাক্তির গৌরব দেয়া হয় প্রোতাগোরাসকে, তবে তাঁর বাক্যসংজ্ঞাটি সম্ভবত বিলুপ্ত হ’য়ে গেছে। অনেকের মতে তিনি শনাক্ত করেছিলেন চার রকম বাক্য;- ‘প্রার্থনা’, ‘প্রশ্ন’, ‘বিবৃতি’, ও ‘অনুজ্ঞা’; আবার কারোকারো মতে তাঁর শনাক্ত বাক্য সাত শ্রেণীর;- ‘পরোক্ষোক্তি’, ‘প্রশ্ন’, ‘উত্তর’, ‘অনুজ্ঞা’, ‘প্রতিবেদন’, ‘প্রার্থনা’, ও ‘আমন্ত্রণ’। তাঁর শনাক্ত বাক্যশ্রেণীগুলো দেখে মনে হয় তাঁর বাক্যসংজ্ঞা ছিলো আর্থ। প্লাতো থেআতেতুস গ্রন্থে সক্রেতিসের মুখে ভাষার একটি সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। ওই ভাষাসংজ্ঞাটিকে গ্রহণ করা যায় বাক্যসংজ্ঞারূপে। সক্রেতিসের ভাষাসংজ্ঞাটি: ‘ভাষা হচ্ছে ‘ওনোমাতা’ [নাম, বিশেষ্য, বিশেষ্যপদীয়, কর্তা] ও ‘হিমাতা’র [পদ, উক্তি, ক্রিয়া, ক্রিয়াপদীয়, বিধেয়, কর্ম] সাহায্যে চিন্তাভাবনার প্রকাশ, যা মুখনিঃসৃত বায়ুস্রোতে বক্তার চিন্তাভাবনাকে প্রতিফলিত করে।’ এ-সংজ্ঞাটি নির্দেশ করে যে সক্রেতিস ভাষা ও বাক্যকে অভিন্ন মনে করতেন। তাঁর সংজ্ঞায় বাক্যের যে-দুটি উপাদানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, তাই পরবর্তীকালে ‘উদ্দেশ্য’ ও ‘বিধেয়’ নাম ধারণ করে। সক্রেতিসের মুখে প্লাতো যে-ভাষাসংজ্ঞা বসিয়েছেন, সেটিকেই গ্রহণ করতে পারি প্লাতোর বাক্যসংজ্ঞা ব’লে। এ-সংজ্ঞায় নির্ণীত হয়েছে বাক্যের মৌল উপাদান– “ওনোমা’ ও ‘হিমা’ : ‘বিশেষ্য’ (উদ্দেশ্য) ও ‘ক্রিয়া’ (বিধেয়), যা রক্ষিত হয়েছে পরবর্তী প্রথাগত ব্যাকরণে। তিনি যে-মানদণ্ডে বাক্য ও বাক্যের মৌল উপাদান নির্ণয় করেছিলেন, তা আর্থ। আরিস্ততলও আর্থ, ও নৈয়ায়িক, মানদণ্ডভিত্তিক বাক্যসংজ্ঞা রচনা করেছিলেন। বাক্য সম্পর্কে আরিস্ততলের মত : ‘বাক্য হচ্ছে তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি, যার বিভিন্ন অংশের অর্থ থাকতে পারে, তবে তা হ্যাঁ-বা না-সূচক কোনো বিবেচনা জ্ঞাপন করে না। উদাহরণস্বরূপ নেয়া যাক ‘মরণশীল’ শব্দটি। নিঃসন্দেহে এর অর্থ আছে, তবে এটি কোনো কিছুকে স্বীকার বা অস্বীকার করে না। স্বীকার বা অস্বীকার করার জন্যে এর সাথে অন্য কিছু যোগ করা দরকার।’ তাঁর কাছে বাক্য পূর্ণ অর্থপ্রকাশক উক্তি। তিনি বাক্যের সংজ্ঞা রচনায় প্লাতোকেই অনুসরণ করেছেন।

দিওনিসিউস থ্রাক্স, পাশ্চাত্যের প্রথম ব্যাকরণরচয়িতা, তাঁর গ্রান্মাতিকি তেকনিতে বাক্য সম্পর্কে আলোচনা করেন নি, তবে বাক্যের যে সংজ্ঞাটি রচনা করেছিলেন তিনি, সেটিই তেইশ শো বছর ধ’রে গৃহীত হয়ে আসছে বাক্যের জনপ্রিয়তম ও প্রধান সংজ্ঞারূপে। থ্রাক্সের বাক্যসংজ্ঞা নিম্নরূপ : ‘বাক্য হচ্ছে পূর্ণ অর্থবহ শব্দের সমষ্টি।’ যে-শব্দগুচ্ছ পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করে, তাকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন বাক্যরূপে। থ্রাক্স বাক্য বিশ্লেষণ করেন নি;- গ্রিক বাক্য বিশ্লেষণে প্রথম মনোযোগ দেন খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের ব্যাকরণবিদ আপোল্লোনিউস দিস্কোলুস। বাক্যসংগঠন সম্পর্কে দিস্কোলুসের মত : ‘অক্ষরের সমাবেশে যেমন শব্দ গঠিত হয়, তেমনি প্রতিটি স্বাধীন বাক্য গঠিত হয় যথাযোগ্য ভাবের সমাবেশে।’ দিস্কোলুসের সংজ্ঞা নির্দেশ করে যে শব্দের গ্রহণযোগ্য বিন্যাসেই বাক্য গ’ড়ে ওঠে না, বরং বাক্য গঠনের জন্যে দরকার গ্রহণযোগ্য ভাবের সমাবেশ। তাঁর সংজ্ঞাও আর্থ।

লাতিন ভাষার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ব্যাকরণ রচনা করেন প্রিস্কিআন, ষষ্ঠ শতকে। আঠারো খণ্ডে সম্পূর্ণ তাঁর ব্যাপক ব্যাকরণগ্রন্থের শেষ দু-খণ্ডে তিনি বর্ণনা করেন লাতিন বাক্য। বাক্যের সংজ্ঞা রচনায় তিনি অনুসরণ করেন থ্রাক্সকে, যদিও তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রে অনুসরণ করেছিলেন দিস্কোলুসকে। প্রিস্কিআনের বাক্যসংজ্ঞা : ‘বাক্য হচ্ছে শব্দের গ্রহণযোগ্য বিন্যাস, যা পূর্ণ অর্থ জ্ঞাপন করে।’ এ-সংজ্ঞায় থ্রাক্সের প্রভাব স্পষ্ট। এ-ধারায়ই বাক্যের সংজ্ঞা রচনা করেছিলেন ত্রয়োদশ শতকের ব্যাকরণবিদ পিত্রস ইস্পানুস। তাঁর সংজ্ঞা এমন : ‘বাক্য হচ্ছে অর্থপূর্ণ উক্তি, যার বিভিন্ন অংশেরও অর্থ আছে।…সুষ্ঠু বাক্য শ্রোতার মনে একটি সম্পূর্ণ ভাব সঞ্চার করে, কিন্তু অশুদ্ধ বাক্য তেমন ভাব সঞ্চার করে না।’ এটি প্রিস্কিআনের সংজ্ঞারই সম্প্রসারণ।

সংস্কৃত বাক্যসংজ্ঞা ও ধারণা ॥ পুরোনো ভারতে বাক্যের সংজ্ঞা ও স্বরূপ নির্ণয়ে বিপুল শ্রম করেছেন দার্শনিক ও ব্যাকরণবিদগণ। বাক্য সম্পর্কে অনন্ত তর্কবিতর্ক করেছেন তাঁরা : কখনো চ’লে গেছেন অতীন্দ্রিয়লোকে, পরম ব্রহ্মের বহিঃপ্রকাশরূপে দেখেছেন বাক্যকে; আবার কখনো বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞানীর মতো পর্যবেক্ষণ করেছেন বাক্যসংগঠন। বাক্যচিন্তায় দু-ভাগে বিভক্ত হ’য়ে গিয়েছিলেন তাঁরা;-এক গোত্রে ছিলেন ‘বাক্যবাদী’গণ যাঁদের বিশ্বাস বাক্যই একমাত্র সত্যবস্তু; অন্যগোত্রে ছিলেন ‘পদবাদী’গণ, যাঁরা বিশ্বাস করতেন সবার ওপরে পদই সত্য, বাক্য নয়। বাক্যবাদীদের মতে বাক্য অখণ্ড-অবিভাজ্য একক, তা বিদ্যুচ্চমকের মতো জ্ব’লে উঠে ছড়ায় অর্থরশ্মি। পদবাদীদের মতে বাক্য খণ্ডনযোগ্য একক, যা গ’ড়ে ওঠে বিভিন্ন পদের সমবায়ে। তবে তাঁরা সবাই প্রধানত আর্থ মানদণ্ডে শনাক্ত করতে চেয়েছিলেন বাক্য। বাক্যপদীয় নামক গ্রন্থের রচয়িতা ভর্তৃহরি বাক্য সম্বন্ধে ব্যাপক গবেষণা ক’রে জানিয়েছেন যে সংস্কৃত দার্শনিক ও ব্যাকরণবিদগণ বাক্য সম্পর্কে কমপক্ষে আট রকম মত পোষণ করতেন। এ-মতসমূহকে দু-ভাগে ফেলা সম্ভব : একভাগে আছেন ‘অখণ্ডবাদী’ বা বাক্যবাদীগণ, অন্যভাগে আছেন ‘খণ্ডবাদী’ বা পদবাদীগণ। স্ফোটবাদী ব্যাকরণবিদগণ ছিলেন অখণ্ড-বা বাক্য-বাদী, আর মীমাংসক ও নৈয়ায়িকেরা ছিলেন খণ্ড-বা পদ-বাদী।

বাক্যের যে-সংস্কৃত সংজ্ঞাটি সবচেয়ে জনপ্রিয়, ও প্রথাগত বাঙলা ব্যাকরণে গৃহীত হয়েছে, সেটির রচয়িতা হিশেবে নাম পাওয়া যায় দুজনের : একজন বিখ্যাত নন্দনতাত্ত্বিক বিশ্বনাথ কবিরাজ, ও অন্যজন ব্যাকরণবিদ জগদীশ। বাক্যের সে-সংজ্ঞাটি : ‘বাক্যংস্যাদযোগ্যতাকাঙ্ক্ষাসত্তিযুক্তঃ পদোচ্চয়’ (বিশ্বনাথ), অর্থাৎ ‘আকাঙ্ক্ষা, যোগ্যতা, ও আসত্তিযুক্ত পদসমুচ্চয়ই বাক্য।’ সংজ্ঞাটির ‘আকাঙ্ক্ষা’, ‘যোগ্যতা’, ও ‘আসত্তি’ পারিভাষিক শব্দ, যার মধ্যে ‘আকাঙ্ক্ষা’ ও ‘আসত্তি’ বাঙলা ব্যাকরণে অনেক সময় ভুল অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘আকাঙ্ক্ষা’ বলতে বোঝানো হয় যে শুধু সহাবস্থানযোগ্য শব্দই বাক্যে ব্যবহৃত হ’তে পারে, সহাবস্থানঅযোগ্য শব্দ পারে না। আধুনিক পরিভাষায় একে ‘সহাবস্থানবিধি’ [কোঅকারেন্স রেস্ট্রিকশন] বলা হয়। ‘যোগ্যতা’ বোঝায় যে বাক্যে ব্যবহৃত শব্দসমূহকে অর্থগতভাবে সুসঙ্গত হ’তে হবে, বিসঙ্গত শব্দের বিন্যাসকে বাক্য ব’লে গ্রহণ করা হবে না। আধুনিক পরিভাষায় একে বলা হয় ‘সঙ্গতিবিধি’ [সিলেকশনাল রেস্ট্রিকশন]। ‘আসত্তি’ (‘আসক্তি’ নয়) বোঝায় যে বাক্যে যে-সমস্ত শব্দ ঘনিষ্ঠভাবে ব’সে এককের মতো কাজ করে, সেগুলো পাশাপাশি বা সন্নিকটে অবস্থান করবে, তাদের একটিকে অন্যটির থেকে বেশি দূরে সরিয়ে নেওয়া যাবে না। এ-সংজ্ঞায় যে-তিনটি মানদণ্ড পাওয়া যায়, তার মধ্যে ‘আকাঙ্ক্ষা’ ও ‘আসত্তি’ রৌপ, ‘যোগ্যতা’ আর্থ।

ব্যাসের মতে প্রতিটি শব্দ মর্মমূলে বাক্যের শক্তি বহন করে, তাই শব্দমাত্রই বাক্য হ’তে পারে। মীমাংসকদের মতে ভাবের একত্বদ্যোতক শব্দসমষ্টিই বাক্য। তাঁরা বোঝাতে চান যে বাক্যে ব্যবহৃত শব্দসমূহের নিজস্ব অর্থ থাকলেও সেগুলো সবাই মিলে সৃষ্টি করে একক-বাক্যার্থ; তাই বাক্যের বিভিন্ন শব্দের নিজস্ব মূল্য নেই। বাক্যের অর্থ জ্ঞাপন করাতেই তাদের সার্থকতা। মীমাংসকেরা বাক্যে ক্রিয়াপদের প্রাধান্য বুঝতে পেরেছিলেন, এবং ক্রিয়াপদকেই বাক্যের প্রধান পদরূপে চিহ্নিত করেছিলেন। যেমন : কাত্যায়ন তাঁর বার্ত্তিক-এ ক্রিয়াপদকেই বাক্যরূপে নির্দেশ করেছিলেন। ভর্তৃহরি বাক্য সম্পর্কে যে-আট রকম ধারণা খুঁজে পেয়েছিলেন, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে যে ক্রিয়াপদ বা ‘অখ্যাত শব্দ’ই বাক্যগঠনের জন্যে যথেষ্ট। মীমাংসকগণ, যাঁরা বিভক্ত ছিলেন দু-গোত্রে, বাক্য সম্পর্কেও পোষণ করতেন দু-মত। তাঁদের একগোত্রের নাম ‘অভিহিতান্বয়বাদী’, অন্যগোত্রের নাম ‘অন্বিতাভিধানবাদী’। অভিহিতান্বয়বাদীদের মতে বাক্য হচ্ছে শব্দসমবায়, বা শব্দ-’সংঘাত’, বা শব্দক্রম। অন্বিতাভিধানবাদীদের মতে বাক্য হচ্ছে ক্রিয়ারূপ বা আখ্যাত, বা ‘আদিপদ’। সংস্কৃত বাক্যসংজ্ঞাসমূহে আর্থ মানদণ্ড বড়ো হ’য়ে দেখা দিয়েছিলো, যদিও রৌপ মানদণ্ডও অনুপস্থিত নয়।

প্রথাগত ইংরেজি বাক্যসংজ্ঞা ও ধারণা। প্রথাগত ইংরেজি ব্যাকরণবিদেরা বাক্যধারণা ও সংজ্ঞা পেয়েছিলেন গ্রিক-রোমান ব্যাকরণবিদদের কাছ থেকে। থ্রাক্স ও প্রিস্কিআনের বাক্যসংজ্ঞা তাঁরা কখনো অবিকল, কখনো কিছুটা বিকলরূপে ব্যবহার করেছেন তাঁদের ব্যাকরণপুস্তকে। ফলে রচিত হয়েছে বক্তব্যে প্রায়-অভিন্ন, কিন্তু ভাষায় কিছুটা ভিন্ন, কয়েক শো বাক্যসংজ্ঞা। তাঁরা প্রধান জোর দিয়েছেন থ্রাক্সকথিত ‘সম্পূর্ণ অর্থ বা ভাব’-এর ওপর, এবং বাক্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাঁরা মেনে নিয়েছেন প্লাতোকে। প্লাতো প্রতিটি বাক্যকে যেমন ‘বিশেষ্য’ ও ‘ক্রিয়া’, বা ‘উদ্দেশ্য’ ও ‘বিধেয়’, খণ্ডে ভাগ করেছিলেন, ইংরেজি ব্যাকরণবিদেরাও তা-ই করেছেন। তাই ইংরেজি ব্যাকরণে প্রধানত দু-রকম বাক্যসংজ্ঞা পাওয়া যায়;-একটি আর্থ, অন্যটি উপাদানগত। আর্থ সংজ্ঞাগুলো সম্পূর্ণ মনোভাবের ওপর জোর দেয়, আর উপাদানগত সংজ্ঞাগুলো গুরুত্ব আরোপ করে বাক্যের উদ্দেশ্য ও বিধেয় খণ্ডের ওপর। পাশ্চাত্য ভাষা-গবেষকেরা বাক্যসংজ্ঞা ও ধারণা সম্পর্কে গবেষণা করেছেন বারবার। জন রিজ (১৮৯৪) একশো চল্লিশটি বাক্যসংজ্ঞা পর্যালোচনা ক’রে কোনোটিকেই ঠিক মনে না ক’রে নিজেই রচনা করেছিলেন নতুন একটি সংজ্ঞা, যেটিকে অন্যরা গ্রহণযোগ্য মনে করেন নি। ইউজিন সিইডেল (১৯৩৫) বিচার করেছেন আশিটির মতো গুরুত্বপূর্ণ বাক্যসংজ্ঞা, এবং ১৯৪১-এ কার্ল সুনডেন (১৯৪১) পরীক্ষা করেন সাম্প্রতিককালে রচিত বাক্যসংজ্ঞা- গুলো। তিনিও কোনো সংজ্ঞাকেই গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করেন নি।

উল্লিখিত দু-ধরনের সংজ্ঞার একটি সংগ্রহ উপস্থিত করছি : (১)-এ গুচ্ছিত করা হলো আর্থ সংজ্ঞা, আর (২)-এ উপাদানগত সংজ্ঞা :

(১) ক ‘বাক্য হচ্ছে সুগঠিত ও সুবিন্যস্ত শব্দের সমষ্টি, যা পূর্ণ ভাব রচনা করে।’১–(লৌথ (১৭৬২, ১১৮; উদ্ধৃত (গ্লিসন (১৯৬৫, ৯১))।

খ ‘ভাষা গ’ড়ে ওঠে পৃথকপৃথক উক্তিতে, যার প্রতিটি স্বয়ংসম্পূর্ণ…এ উক্তিগুলোই বাক্য। যে-কোনো পূর্ণ অর্থই বাক্য।’২-(বেইন (১৮৭৯, ৮; উদ্ধৃত ফ্রিজ (১৯৫২, ১৩))।

গ ‘বাক্য হচ্ছে শব্দসমষ্টি, যার সাহায্যে আমরা কোনো ব্যক্তি বা বস্তু সম্পর্কে কিছু বলি।’৩-(রো ও ওয়েব (১৮৯৭, ১))।

ঘ ‘বাক্য হচ্ছে এমন শব্দগুচ্ছ যাতে কমপক্ষে একটি উদ্দেশ্য ও একটি বিধেয় বিদ্যমান থাকে, আর তাতে শব্দগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত হয় যাতে একটি সম্পূর্ণ ভাব প্রকাশ পায়।৪- (ম্যাকমোরডি (১৯১১, ১৪৯))।

ঙ ‘সম্পূর্ণ ভাবজ্ঞাপক শব্দগুচ্ছই বাক্য।’৫-(নেসফিল্ড (১৮৯৫, ৫))।

চ ‘বাক্য হচ্ছে পূর্ণভাবজ্ঞাপক শব্দগুচ্ছ। বাক্যে অবশ্যই একটি উদ্দেশ্য ও একটি বিধেয় থাকতে হবে।’৬–(হাউজ ও হারম্যান (১৯৩১, ১৪৫))।

ছ ‘বাক্য হচ্ছে এমন শব্দগুচ্ছ যাতে থাকে একটি ক্রিয়া ও একটি কর্তা, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় শব্দ, যাতে ভাবটি ব্যাকরণগতভাবে পূর্ণতা পায়।’৭–(জোন্স্ (১৯৩৫, ২))।

জ ‘বাক্য হচ্ছে স্বয়ংসম্পূর্ণ শব্দগুচ্ছের সাহায্যে পূর্ণ ভাবের প্রকাশ।’৮-(ট্যানার (১৯২৮, ১৪))।

ঝ “বাক্য হচ্ছে এক বা একাধিক শব্দের সাহায্যে ভাব বা অনুভূতির প্রকাশ,–বাক্যে শব্দগুলো এমন রূপে ও ভাবে বিন্যস্ত হয়, যাতে ঈপ্সিত অর্থ দ্যোতিত হয়।’৯–(কারমে (১৯৪৭, ৯৭))।

ঞ ‘বাক্য হচ্ছে শব্দসমবায়, যা এক বা একাধিক বোধের সমবায়ে গঠিত অন্তত একটি পূর্ণভাব জ্ঞাপন করে।’১০-(ফকনার (১৯৫০, ১))।

চ ‘বাক্য হচ্ছে রচনা-একক, যার ওপর স্থাপিত হয় ভাব।’১১–(ওয়ারফেল ও অন্যান্য (১৯৪৯, ৮০))।

ঠ ‘বাক্য হচ্ছে এমন উক্তি, যার সাহায্যে বক্তা, বিরাম গ্রহণের আগে, ঈপ্সিত বক্তব্য প্রকাশ করেন।’১২-(গার্ডিনার (১৯৩২, ২০৮; উদ্ধৃত ফ্রিজ (১৯৫২, ১৪))।

২) ক ‘প্রত্যেক বাক্যের গোপন কথা নিহিত এখানে : আমরা সবসময় প্রথমে উল্লেখ করি কোনো বস্তু বা স্থান বা ব্যক্তি বা জিনিশের নাম, এবং তারপর আমরা ওই বস্তু বা স্থান বা ব্যক্তি বা জিনিশ সম্পর্কে কিছু বলি। এ-কাজ দুটি যদি না করি, তবে সম্পূর্ণ বাক্য গঠিত হয় না। যে-বস্তু, স্থান বা ব্যক্তি অথবা জিনিশ সম্পর্কে কিছু বলা হচ্ছে, তাই সব সময় হবে উদ্দেশ্য। ওই বস্তু, স্থান, ব্যক্তি অথবা জিনিশ সম্পর্কে যা ব্যক্ত হচ্ছে, তাই সব সময় হবে বিধেয়।’১৩–(ওয়ালকট ও অন্যান্য (১৯৪০, ১, ৬১-৬২; উদ্ধৃত ফ্রিজ (১৯৫২, ১৪))।

খ ‘পূর্ণভাব প্রকাশের জন্যে দুটি জিনিশ দরকার : (১) একটি কর্তা, যা কোনো ব্যক্তি অথবা বস্তু অথবা ভাবের নাম করে, এবং যার সম্পর্কে কোনো উক্তি করা হয়, এবং (২) একটি বিধেয়, যা কর্তা বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোনো উক্তি করে।১৪-(বারকার (১৯৩৯, ৪; উদ্ধৃত ফ্রিজ (১৯৫২, ১৫))।

গ ‘সংগঠন বা রূপ অনুসারে সংজ্ঞা রচনা করতে গেলে বলতে হয় যে বাক্য হচ্ছে ভাষার এক মৌল একক, শাব্দ যোগযোগ, যাতে কেন্দ্রবস্তুরূপে আছে একটি স্বাধীন ক্রিয়া, ও তার কর্তা।’১৫- (কিয়েরজেক ও গিবসন (১৯৬০, ৩৯))।

প্রথাগত ইংরেজি ব্যাকরণবিদেরা বাক্যের সংজ্ঞা রচনার সময় বাক্যের রূপের দিকে কিছুট মনোযোগ দিলেও তাঁদের মন বিশেষভাবে আকৃষ্ট অর্থের প্রতি। অর্থকেই তাঁরা যেনো বাক্য ব’লে মনে করেন, বাক্যের রূপটি দরকার হয় ওই অর্থ প্রকাশের জন্যে। প্রথাগত ব্যাকরণবিদদের কেউকেউ বাক্যের অর্থ পরিহার ক’রে বাক্যের রৌপ সংজ্ঞা রচনা করেছিলেন। তাঁদের একজন হচ্ছেন ফরাশি ভাষাবিজ্ঞানী মিইয়ে (১৯০৩)। তাঁর বাক্যসংজ্ঞা নিম্নরূপ : বাক্যের নিম্নরূপ সংজ্ঞা দেওয়া যায় : ব্যাকরণিক প্রক্রিয়ায় পরস্পরঅন্বিত শব্দগুচ্ছ, যা স্বয়ংসম্পূর্ণ, এবং ব্যাকরণগতভাবে অন্য কোনো শব্দগুচ্ছের ওপর নির্ভরশীল নয়।’১৬ মিইয়ের এ-সংজ্ঞাটিকে গণ্য করা যায় বাক্যের সাংগঠনিক সংজ্ঞার অন্যতম আদিউদাহরণ ব’লে। তাঁর সংজ্ঞা ভিত্তি ক’রে প্রথাগত ব্যাকরণবিদ ইয়েসপারসেন রচনা করেছিলেন বাক্যের নিম্নরূপ সংজ্ঞা : ‘বাক্য হচ্ছে (আপেক্ষিকভাবে) সম্পূর্ণ ও স্বাধীন মনুষ্যোক্তি- এ-সম্পূর্ণতা ও স্বাধীনতা প্রকাশ পায় এর একাকী অবস্থানে বা এর একাকী অবস্থানের শক্তিতে, অর্থাৎ একে নিরপেক্ষভাবে উচ্চারণ করা যায়।’১৭ ইয়েসপরসেন বাক্যের অর্থকে যদিও বেশি গুরুত্ব দিতেন, তবু এখানে তিনি রচনা করেছেন সাংগঠনিক সংজ্ঞা। কিন্তু সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানীরা তাঁর সংজ্ঞাকেও গ্রহণ করেন নি, করেছেন ব্লুমফিল্ডরচিত সংজ্ঞা, যার ওপর মিইয়ের প্রভাব বিদ্যমান।

প্রথাগত বাঙলা বাক্যসংজ্ঞা ও ধারণা॥ বাক্যসংজ্ঞা ও ধারণা প্রথাগত বাঙলা ব্যাকরণবিদেরা পেয়েছেন দুটি উৎস থেকে : সংস্কৃত ব্যাকরণ, ও প্রথাগত ইংরেজি ব্যাকরণ থেকে। বিশ্বনাথ কবিরাজ ও জগদীশের নামে প্রচলিত সংজ্ঞাটি-’আকাঙ্খা, যোগ্যতা, ও আসত্তিযুক্ত পদসমূহই বাক্য’- কিছু ভুলত্রুটিসহ সম্ভবত গত একশো বছর ধ’রে প্রায় অবিকলরূপে বাঙলা ব্যাকরণে ব্যবহৃত হচ্ছে, কিন্তু ইংরেজি- অনুসারী বাক্যসংজ্ঞার ঘটেছে নানা রকম বদল। কেননা বাঙলা ব্যাকরণরচয়িতাগণ নিজনিজ সময়ের প্রভাবশালী ইংরেজি ব্যাকরণরচয়িতাদের অনুকরণ করেন, এবং মূলের পরিবর্তনের সাথে অনুকৃত বস্তুরও ঘটে বদল। বাঙলা ব্যাকরণবিদসমাজ একটি মৌলিকত্ববর্জিত সমাজ;- তাঁদের ধারণা ভাষা ও বাঙলা ভাষা সম্বন্ধে সব কিছু আগেই বলা হয়ে গেছে, তাই তাঁদের কর্তব্য শুধু পুনরাবৃত্তি। বাক্যের সংজ্ঞারচনায়ও তাঁরা পুনরাবৃত্তিপ্রতিভার চমৎকার পরিচয় দিয়েছেন। নিচে তাঁদের একগুচ্ছ সংজ্ঞা সংগৃহীত হলো :

(৩) ক ‘পদসকল পরস্পর অন্বিত হইয়া অভিপ্রেত অর্থকে যখন কহে, তখন সেই সমুদায়কে বাক্য কহি।’-(রামমোহন (১৮৩৩, ৩৬৮))।

খ ‘আকাঙ্খা, যোগ্যতা ও আসত্তিযুক্ত পদসমুহকে বাক্য বলে।’-(প্রসন্নচন্দ্র (১৮৮৪, ২১৯))।

গ ‘ক্রিয়াদিযুক্ত পদসমুদায়কে বাক্য কহে। এক পদের সহিত অন্য পদের “যোগ্যতা”, “আকাঙ্খা” ও “আসত্তি” না থাকিলে বাক্য হয় না।’-(লালমোহন (সংবৎ ১৯১৯, ২০))।

ঘ ‘দুই বা অধিক পদ একত্র থাকিয়া পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করিলে ঐ পদসমষ্টিকে বাক্য বলে। বাক্যে অন্ততঃ কর্তা ও ক্রিয়া-এই দুই পদ থাকা আবশ্যক, নতুবা অর্থ সম্পূর্ণ হয় না।’-(নকুলেশ্বর (২১৩০৫, ১))।

ঙ ‘যে পদসমূহদ্বারা কোন একটি মনোভাব সম্পূর্ণরূপে ব্যক্ত করা যায়, তাহাকে বাক্য বলে; অথবা যোগ্যতা, আকাঙ্খা, ও আসত্তিযুক্ত পদসমূহের নাম বাক্য।’-(হরনাথ (১৯৩০, ২৫৯))।

চ ‘পরস্পর অর্থসঙ্গতিযুক্ত পদসমূহকে বাক্য বলে।’- (প্রসন্নচন্দ্র (১৯৩৭, ১১৩))।

ছ ‘যে পদসমূহের দ্বারা মনের ভাব সম্পূর্ণরূপে ব্যক্ত হয় তাহার নাম বাক্য।’-(জগদীশচন্দ্ৰ (১৩৪০, ৩৩৮))।

জ ‘যে পদ-বা শব্দ-সমষ্টির দ্বারা কোনোও বিষয়ে সম্পূর্ণ-রূপে বক্তার ভাব প্রকটিত হয়, সেই পদ-বা শব্দ-সমষ্টিকে বাক্য বলে।’-(সুনীতিকুমার (১৯৩৯, ৪২৭))।

ঝ ‘কোনও ভাষায় যে উক্তির সার্থকতা আছে, এবং গঠনের দিক হইতে যাহা স্বয়ংসম্পূর্ণ, সেইরূপ একক উক্তিকে ব্যাকরণে বাক্য বলা হয়।’-(সুনীতিকুমার (১৯৭২, ২৮৪))।

ঞ সুবিন্যস্ত পদসমষ্টির দ্বারা যদি বক্তার পুরাপুরি আকাঙ্খা প্রকাশ পায় তবে ঐ পদসমষ্টিকে ‘বাক্য’ নামে অভিহিত করা যাইতে পারে।’-(মু এনামুল (১৯৫২, ২১৭))।

ট ‘একটি সম্পূর্ণ মনোভাব যে সমস্ত পদ দ্বারা প্রকাশ করা যায় তাহাদের সমষ্টিকে বাক্য বলে।’ (মু শহীদুল্লাহ (১৩৫৬, ২৪০))।

ঠ ‘কতকগুলি পদ যখন যথাযোগ্য ক্রম অনুসারে অন্বিত হইয়া একটি ভাবের আংশিক বা পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ দান করে তখন সেই পদগুলির সমষ্টিকে বাক্য বলে।’– (কালিদাস (?, ৩৮১))।

ওপরের সংজ্ঞাগুলোর অধিকাংশ গ্রিক-লাতিন অনুসারী প্রথাগত ইংরেজি বাক্যসংজ্ঞার অনুবাদ, বা অনুকরণে রচিত; এবং কোনোকোনোটি রৌপ মানদণ্ডভিত্তিক আধুনিক সংজ্ঞার অনুবাদ। যেমন : সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়(৩জ) সংজ্ঞাটি রচনা করেছিলেন প্রথাগত ইংরেজি ব্যাকরণের অনুকরণে; আর (৩ঝ) সংজ্ঞাটি গঠন করেছেন ইয়েসপারসেনর সংজ্ঞার আদলে। আকাঙ্খা-আসত্তি-যোগ্যতার মানদণ্ডনির্ভরতাও অনেকের মধ্যে দেখা যায়। সংস্কৃত এ-বাক্য সংজ্ঞাটির ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন অনেক ব্যাকরণরচয়িতা। তাঁদের ত্রুটি ঘটেছে প্রধানত ‘আকাঙ্খা’ ও ‘আসত্তি’ ধারণা দুটি ব্যাখ্যায়। তাঁরা ‘আকাঙ্খা’র পারিভাষিক অর্থের বদলে গ্রহণ করেছেন এর শব্দার্থ, তাই ঘটেছে ত্রুটি। সুনীতিকুমার (১৯৩৯, ৪২৮) ‘আকাঙ্খা’ ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে : ‘কোনও বাক্য বা উক্তির পূর্ণ উদ্দেশ্য গ্রহণের জন্য শ্রোতার আগ্রহ বা আকাঙ্খা থাকে; এই আকাঙ্খা যতক্ষণ পর্যন্ত না মিটে, বা যতক্ষণ পর্যন্ত অর্থ পূর্ণ না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত বাক্যে অন্য নতুন পদ আসিবার আবশ্যকতা থাকে।’ এখানে ‘আকাঙ্খা’র আভিধানিক অর্থ ধ’রে বাক্যসংজ্ঞাটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু সংস্কৃত ব্যাকরণবিদেরা ‘আকাঙ্খা’ বলতে বুঝিয়েছেন বাক্যে পদের সহাবস্থানের বিধিনিষেধকে, আরো বলা বা জানার বাসনাকে নয়। ‘আসত্তি’ শব্দটি অজ্ঞতাবশত ‘আসক্তি’ রূপ পেয়েছে অনেকের হাতে। ‘আসত্তি’র অর্থ ‘নৈকট্য’; কিন্তু প্রথাগত অনেক ব্যাকরণপ্রণেতা এ-শব্দটিতেও আরো জানা বা বলার এক রকম কামনা লুকিয়ে আছে ভেবে এটিকে পরিণত করেছেন ‘আসক্তি’ শব্দে।

সাংগঠনিক বাক্যসংজ্ঞা ও ধারণা। প্রথাগত ব্যাকরণের বিরুদ্ধে প্রথম আপত্তি তোলেন সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানীরা; এবং তাঁরা নানাভাবে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন যে প্রথাগত ব্যাকরণ অবৈজ্ঞানিক। প্রথাগত ব্যাকরণ ও সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞান পরস্পরবিরোধী, একটির দৃষ্টিতে যা মূল্যবান অন্যটির চোখে তা তুচ্ছ। প্রথাগত ব্যাকরণ বিশ্বাসী সর্বজনীন তত্ত্বে ও অর্থে, সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞান বিশ্বাসী প্রত্যেক ভাষার নিজস্ব সংগঠনে ও রূপে। বাক্যক্ষেত্রে এ-বিরোধ চরমরূপে দেখা দেয় : সাংগঠনিকেরা দেখাতে থাকেন যে প্রথাগত ব্যাকরণের আর্থ মানদণ্ডে কোনো ভাষারই বাক্য নির্ণয় সম্ভব নয়। তাঁরা দাবি করেন বাক্য নির্ণয়ের জন্য রৌপ মানদণ্ড, যা ভাষায় ভাষায় ভিন্ন। প্রথাগত ব্যাকরণবিদদের মধ্যে মিইয়ে ও ইয়েসপারসেন সাংগঠনিকদের উদ্ভবের আগেই রচনা করেছিলেন বাক্যের সাংগঠনিক সংজ্ঞা, যা সাংগঠনিকদের প্রভাবিত করেছে। ‘বাক্য’ ধারণার সাথে একটি নতুন ধারণা যুক্ত করেন সাংগঠনিকেরা, সেটি হচ্ছে ‘উক্তি’।

ব্লুমফিল্ড, মিইয়ের অনুসরণে, বাক্যের যে-সংজ্ঞা রচনা করেছিলেন, সেটিই গৃহীত হয়েছে আদর্শ সাংগঠনিক বাক্যসংজ্ঞারূপে। সংজ্ঞাটি নিম্নরূপ : ‘যে-কোনো উক্তি-অন্তর্গত বৃহত্তম রূপই বাক্য। সুতরাং, বাক্য হচ্ছে উক্তি-অন্তর্গত এমন রূপ, যা বৃহত্তর কোনো সংগঠনের অংশ নয়।’১৮- এ-সংজ্ঞার তাৎপর্য বোঝা যাবে ব্লুমফিল্ড (১৯৩৩, ১৭০) থেকে উদ্ধৃত নিচের ব্যাখ্যার সাহায্যে :

যে-কোনো উক্তিতে কোনো ভাষিক রূপ উপস্থিত হয় অন্য কোনো বৃহত্তর রূপের উপাদান রূপে;-যেমন ‘জন’ উপস্থিত ‘জন পালিয়ে গেছে’ উক্তিতে; অথবা তা উপস্থিত হয় স্বাধীন রূপে, কোনো বৃহত্তর (জটিল) ভাষিক রূপের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে;-যেমন ‘জন’ উপস্থিত বিস্ময়সূচক উক্তি ‘জন’!-এ। যখন কোনো ভাষিক রূপ কোনো বৃহত্তর রূপের অংশরূপে উপস্থিত হয়, তখন সেটি অবস্থিত ‘অন্তর্ভুক্ত-অবস্থানে’, অন্যথায় সেটি অবস্থিত থাকে ‘স্বাধীন-অবস্থানে’ এবং বাক্য গঠন করে। কোনো রূপ এক উক্তিতে উপস্থিত হ’তে পারে বাক্যরূপে, আবার অন্য কোনো উক্তিতে থাকতে পারে অন্তর্ভুক্ত-অবস্থানে। ওপরের বিস্ময়সূচক উক্তিতে ‘জন’ একটি বাক্য, কিন্তু বিস্ময়সূচক উক্তি ‘দুর্ভাগা জন!’-এ ‘জন’ অবস্থিত অন্তর্ভুক্ত- অবস্থানে। দ্বিতীয় বিস্ময়সূচক উক্তিতে ‘দুর্ভাগা জন’ একটি বাক্য, কিন্তু ‘দুর্ভাগা জন পালিয়ে গেছে’ উক্তিতে তা অন্তর্ভুক্ত-অবস্থানে অবস্থিত। পুনরায় ওপরের উদাহরণে ‘দুর্ভাগা জন পালিয়ে গেছে’ একটি বাক্য, কিন্তু ‘যখন কুকুরটি ঘেউঘেউ ক’রে উঠেছিলো, তখন দুর্ভাগা জন পালিয়ে গেছে’ উক্তিতে তা অন্তর্ভুক্ত-অবস্থানে অবস্থিত।

উক্তি গঠিত হ’তে পারে একাধিক বাক্যেও। এমন ঘটে যখন কোনো উক্তিতে সন্নিবিষ্ট হয় কয়েকটি ভাষিক রূপ, যাদের কোনো তাৎপর্যপূর্ণ, প্রথাগত ব্যাকরণিক বিন্যাসের মাধ্যমে (অর্থাৎ কোনো সাংগঠনযোগে) বৃহত্তর কোনো রূপে আবদ্ধ করা না হয়। যেমন : ‘কেমন আছো? আজ দিনটা চমৎকার। আজ বিকেলে কি তুমি টেনিস খেলবে?’ এ-রূপ তিনটির মধ্যে বাস্তব যে-সম্পর্কই বিদ্যমান থাক-না-কেনো, কোনো ব্যাকরণিক প্রক্রিয়ায় এদের কোনো বৃহত্তর রূপে আবদ্ধ করা হয়নি। তাই এ-উক্তিটি তিনটি বাক্যের সমষ্টি।
কোনো উক্তিতে অংশী বাক্যসমূহকে এ-কারণে পৃথকভাবে চিহ্নিত করা হয় যে প্রতিটি বাক্যই একটি ক’রে স্বাধীন ভাষিক রূপ, যা কোনো ব্যাকরণিক প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর কোনো ভাষিক রূপের অন্তর্ভুক্ত নয়। অধিকাংশ, সম্ভবত সব, ভাষায়ই নানা রকম ট্যাকসিমযোগে বাক্য পৃথক করা হয়, এবং বিভিন্ন শ্রেণীর বাক্য শনাক্ত করা হয়।
ব্লুমফিল্ডের সংজ্ঞানুসারে বাক্য হচ্ছে স্বয়ংসম্পূর্ণ সংগঠন, যা অন্য কোনো সংগঠনের অংশ নয়। সাংগঠনিকেরা সবাই মেনে নিয়েছেন তাঁর সংজ্ঞা, যদিও অনেকে একই বক্তব্য পেশ করেছেন বিভিন্ন ভাষায়। যেমন : লায়ন্স এ-সংজ্ঞাকেই পেশ করেছেন এভাবে: ‘বাক্য হচ্ছে ব্যাকরণিক বর্ণনার বৃহত্তম একক।’ অর্থাৎ যে-সমস্ত একক ভিত্তি ক’রে ভাষা বর্ণনা করা হয়, তার মধ্যে বৃহত্তমটি হচ্ছে বাক্য। হকেটও (১৯৫৮, ১৯৯) ব্লুমফিল্ডের সংজ্ঞাকেই ভিন্নরূপে প্রকাশ করেছেন : ‘বাক্য হচ্ছে এমন ব্যাকরণিক রূপ, যা অন্য কোনো সংগঠনভুক্ত নয় : তা উপাদান নয়, উপাদানে গঠিত।’ এ-সব সংজ্ঞা একটি কথা স্পষ্টভাবে জ্ঞাপন করে যে বাক্য ব্যাকরণিক বর্ণনার একটি একক, যা ব্যাকরণিক প্রণালিপদ্ধতি প্রয়োগেই শনাক্ত করা সম্ভব। বাক্যকে স্থূল অর্থে বাস্তব বস্তু ভাবা ঠিক নয়।

সাংগঠনিকেরা বাক্যপ্রসঙ্গে ‘উক্তি’ শব্দটি বারবার ব্যবহার করেন। ‘উক্তি: কাকে বলে? কতোখানি কথাকে আমরা ধরতে পারি ‘উক্তি’ রূপে? উক্তিরও নানা সংজ্ঞা পাওয়া যায়। ব্লুমফিল্ডের (১৯২৬, ২৬) মতে ‘যে-কোনো ভাষিক ক্রিয়াই উক্তি।’ কিন্তু এর সাহায্যে উক্তি নির্ণয় কঠিন, কেননা এতে স্পষ্ট ক’রে বলা হয় নি একটি উক্তিতে কি পরিমাণ ‘ভাষিক ক্রিয়া’ স্থান পাবে। হ্যারিসের (১৯৫১, ১৪) মতে ‘উক্তি হচ্ছে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির বাকাংশ, যার আগে-পরে নীরবতা বিরাজ করে।’ ফ্রিজ (১৯৫২) বাক্যবর্ণনার সময় উক্তিতে ‘ভাষিক ক্রিয়া’র পরিমাণ স্থির ক’রে নিতে চেয়েছিলেন। তিনি কাজ করেছিলেন রেকর্ড করা দূরালাপের ভাষা নিয়ে, এবং হ্যারিসের অনুসরণে তৈরি করেছিলেন ‘উক্তি’র সংজ্ঞা। টেলিফোনে একজনের কথা শেষ হ’লে অন্যজন কথা শুরু করে। একজন যতোক্ষণ কথা বলে, ফ্রিজ সেটুকু কথাকে গ্রহণ করেছেন উক্তি হিশেবে, এবং তার নাম দিয়েছেন ‘উক্তি-একক’। ফ্রিজ নানা রকম উক্তি বর্ণনা করেছেন; তার মধ্যে একরকম উক্তির নাম তিনি দিয়েছেন ‘ন্যূনতম স্বাধীন উক্তি’। তাঁর কাছে ‘ন্যূনতম স্বাধীন উক্তি’ই বাক্য। ফ্রিজ (১৯৫২) কাজ করেছেন একরাশ টেলিফোন-আলাপকে উপাত্ত হিশেবে গ্রহণ ক’রে, অর্থাৎ তাঁর কাছে ভাষা সীমিত সংখ্যক বাক্যের সমষ্টি।

রূপান্তরবাদী বাক্যসংজ্ঞা ও ধারণা। রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ভাষাবিজ্ঞানীরা পোষণ করেন ভাষা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন ধারণা, এবং এ-ধারণা প্রকাশ পায় বাক্য কেন্দ্র ক’রে। প্রথাগত ব্যাকরণবিদেরা ভাষা বিশ্লেষণের সময় বিশেষ ও অশেষ গুরুত্ব দেন রূপতত্ত্বের ওপর; তাঁদের ব্যাকরণ প্রধানত শব্দশাস্ত্র। সাংগঠনিকেরা প্রধানত ধ্বনিতাত্ত্বিক, ও কিছুটা রূপতাত্ত্বিক। বাক্যতত্ত্ব তাঁদের ব্যর্থতার এলাকা। যেখানে ব্যর্থ হন সাংগঠনিকেরা, সেখান থেকে যাত্রা শুরু করেন রূপান্তরবাদীরা। তাঁদের ব্যাকরণ বাক্যকেন্দ্রিক : তাঁদের মতে প্রতিটি ভাষা অসংখ্য বাক্যের সমষ্টি;- তাই ব্যাকরণের কাজ হচ্ছে ভাষার সংখ্যাহীন বাক্য সৃষ্টি করা। রূপান্তরবাদী ব্যাকরণে বাক্য বর্ণনা বা বিশ্লেষণ করা হয় না, সৃষ্টি করা হয়; এবং সৃষ্টি করার সময় দেয়া হয় প্রতিটি বাক্যের তাৎপর্যপূর্ণ সাংগঠনিক বর্ণনা। বাক্য সম্পর্কে রূপান্তরবাদী ধারণাও অভিনব। প্রথাগত ও সাংগঠনিকদের মতে বাক্য এক রকম মূর্ত বস্তু; কিন্তু রূপান্তরবাদীরা বাক্যকে গ্রহণ করেন বিমূর্ত ব্যাকরণিক ধারণা হিশেবে। রূপান্তর ব্যাকরণে দুটি মূল্যবান ধারণার নাম ‘ভাষাবোধ’, ও ‘ভাষাপ্রয়োগ’। ভাষাবোধসংশ্লিষ্ট ব্যাকরণিক একক হচ্ছে ‘বাক্য’, আর ভাষাপ্রয়োগসংশ্লিষ্ট ধারণা হচ্ছে ‘উক্তি’।

প্রথাগত ব্যাকরণে বাক্যের সংজ্ঞা পাওয়া যায় বহু; সাংগঠনিকেরাও বাক্য বর্ণনার আগে বাক্যসংজ্ঞা দেন; কিন্তু রূপান্তর ব্যাকরণে বাক্যের সংজ্ঞা পাওয়া বেশ দুর্লভ ঘটনা। চোমস্কির রচনাবলিতে বাক্যসৃষ্টির কথা বারবার ব্যক্ত হয়; কিন্তু বাক্য বলতে তিনি কী বোঝেন, তা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন না। তিনি যেনো অনেকটা ধ’রে নেন যে ভাষাভাষী মাত্রই বাক্যবোধসম্পন্ন। তাই তাঁর প্রস্তাবিত ব্যাকরণের কাজ হচ্ছে ভাষাভাষীর বাক্যবোধ স্পষ্টভাবে উদ্ঘাটন করা। নিচের উদ্ধৃতিটি লক্ষণীয় :

এখন থেকে আমি ধ’রে নেবো যে-কোনো ভাষা হচ্ছে একরাশ(সীমিত-সংখ্যক বা অসংখ্য) বাক্যের সমষ্টি, যার প্রতিটি সসীম দৈর্ঘ্যসম্পন্ন ও সীমিত সংখ্যক বস্তুতে গঠিত। সমস্ত স্বাভাবিক ভাষা, তাদের কথ্য অথবা লিখিত রূপে, এ-অর্থে ভাষা; কেননা প্রতিটি স্বাভাবিক ভাষায়ই আছে সীমিতসংখ্যক ধ্বনিমূল (অথবা বর্ণ) এবং প্রতিটি বাক্যকেই উপস্থাপিত করা যায় এ-সব ধ্বনিমূলের (অথবা বর্ণের) এক সীমিত পরম্পরারূপে, যদিও ভাষায় বাক্য অসংখ্য। অনুরূপভাবে, গণিতের কোনো সুশৃঙ্খল সিস্টেমে ‘বাক্য’রাশিকেই গণ্য করা সম্ভব ভাষারূপে। কোনো ভাষা ‘ভ’-র ভাষিক বিশ্লেষণের মৌল লক্ষ্য হচ্ছে ব্যাকরণসম্মত পরম্পরাসমূহকে অর্থাৎ ‘ভ’-র বাক্যসমূহকে ব্যাকরণঅসম্মত পরম্পরাসমূহ অর্থাৎ যেগুলো ‘ভ’-র বাক্য নয়, তা থেকে পৃথক করা, এবং ব্যাকরণসম্মত পরম্পরাসমূহের সংগঠন বিশ্লেষণ করা। তাই ‘ভ’-র ব্যাকরণ হবে এমন একটি যন্ত্র বা কল, যা ‘ভ’-র সমস্ত ব্যাকরণসম্মত পরম্পরা সৃষ্টি করবে, এবং কোনো ব্যাকরণঅসম্মত পরম্পরা সৃষ্টি করবে না।

এ-উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায় যে চোমস্কি বিশেষ ‘ভাষাবস্তু’র পরম্পরাকে বিবেচনা করেন বাক্যরূপে। ওই পরম্পরা ধ্বনিমূলের, বর্ণের, বা অন্য কিছুর হ’তে পারে। কিন্তু ধ্বনিমূল বা বর্ণের পরম্পরারূপে বাক্য বর্ণনা এক ভয়ানক ব্যাপার; কেননা এতে ব্যাকরণ জড়িয়ে পড়বে অনন্ত জটিলতায়। তাই চোমস্কির কাছে বাক্য ধ্বনিমূলের নয়, রূপমূলের পরম্পরা। এ সম্পর্কে তাঁর সিদ্ধান্ত (দ্র চোমস্কি (১৯৫৭, ১৮)) :

আমরা প্রতিটি বাক্যকে মনে করতে পারি সীমিত দৈর্ঘ্যের ধ্বনিমূলপরম্পরা ব’লে। প্রতিটি ভাষা এক বিশাল-ব্যাপক ব্যাপার; এবং এটা অতি স্পষ্ট যে ব্যাকরণসম্মত ধ্বনিমূল পরম্পরার সহায়তায় ভাষা বর্ণনা করতে গেলে ব্যাকরণ এতো জটিল হ’য়ে উঠবে যে তার কোনো মূল্যই থাকবে না। এ-(ও অন্যান্য) কারণে ভাষিক বর্ণনা এগোয় ‘উপস্থাপনা স্তর ক্রমে। সরাসরি বাক্যের ধ্বনিমূলসংগঠন বর্ণনার বদলে ভাষাবিজ্ঞানী প্রতিষ্ঠা করেন ‘রূপমূল’ প্রভৃতি বস্তুর মতো ‘উচ্চতর স্তর’; এবং স্বতন্ত্রভাবে বাক্যের রূপমূলসংগঠন ও রূপমূলের ধ্বনিমূলসংগঠন বর্ণনা করেন। এ-স্তর দুটির সম্মিলিত বর্ণনা সরাসরিভাবে বাক্যের ধ্বনিমূলসংগঠন বর্ণনার চেয়ে অনেক সরল কাজ। এখন আমরা পরীক্ষা করবো বাক্যের রূপমূলসংগঠন বর্ণনার বিভিন্ন পদ্ধতি।

এ থেকে বোঝা যায় যে চোমস্কির নিকট বাক্য হচ্ছে রূপমূলপরম্পরা। তাই তিনি তাঁর প্রস্তাবিত ব্যাকরণের সাহায্যে সৃষ্টি করতে চান ব্যাকরণসম্মত রূপমূলপরম্পরারাশি, অর্থাৎ বাক্যরাশি। তিনি স্বায়ত্তশাসিত বাক্যতাত্ত্বিক, তাই অর্থ পরিহার ক’রে রূপমূলের শুদ্ধ পরম্পরা সৃষ্টি তাঁর লক্ষ্য। আস্পেক্টস্-কাঠামোর ব্যাকরণ পেশের সময়ও তিনি বাক্য সম্পর্কে অভিন্ন ধারণা পোষণ করেছেন। তাঁর একটি উক্তি : ‘এটির বিষয় সৃষ্টিশীল ব্যাকরণের বাক্যিক কক্ষ, অর্থাৎ সে-সূত্রসমূহ, যা ক্ষুদ্রতম বাক্যিক একক –(গঠক)- সমূহের সুগঠিত বিন্যাস নির্দেশ করে।’ সিন্ট্যাক্টিক স্ট্রাকচারস-এ যে-ভাষাবস্তুদের নাম ছিলো ‘রূপমূল’, আস্পেক্টস্-এ তাদের নতুন নাম হয়েছে ‘ক্ষুদ্রতম বাক্যিক একক’ বা ‘গঠক’; কিন্তু বাক্য সম্পর্কে চোমস্কির ধারণা বদলায় নি। তবে চোমস্কির এ-উক্তি বা ধারণাকে প্রথাগত অর্থে গ্রহণ করলে বিভ্রান্তি জন্ম নেবে।

রূপান্তর ব্যাকরণের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হচ্ছে ‘ভাষাবোধ’ ও ‘ভাষাপ্রয়োগ’, যার আলোতে নির্ণয় করতে হবে বাক্য। ভাষাবোধ বলতে বোঝানো হয় ভাষা সম্পর্কে ভাষা- ভাষীর সহজাত অসচেতন জ্ঞান বা বোধকে, আর বাস্তব পরিস্থিতিতে ভাষা ব্যবহারকে নির্দেশ করা হয় ভাষাপ্রয়োগ ব’লে। রূপান্তর ব্যাকরণে বাক্য হচ্ছে ভাষাবোধতত্ত্বের অন্তর্গত ধারণা, আর উক্তি হচ্ছে ভাষাপ্রয়োগতত্ত্বের অন্তর্গত ধারণা। বাক্য বিমূর্ত একক, উক্তি মূর্ত একক। অনেক সময় বাক্য ও উক্তির মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক বিদ্যমান থাকতে পারে, আবার অনেক সময় আমরা এমন উক্তি উচ্চারণ করতে পারি, যার বাস্তবতা স্বীকার ক’রেও বলতে হবে যে ব্যাকরণিক কোনো বাক্যের সাথে ওই উক্তির কোনো সম্পর্ক সেই। উক্তিমাত্রই বাক্য নয়, বাক্য এক রকম ব্যাকরণিক বিমূর্ত একক। এ সম্পর্কে পোস্টালের ব্যাখ্যা স্মরণীয় :

বাক্য এমন এক বোধ বা ধারণা, যা বিমূর্ত বস্তুজগতের অন্তর্ভুক্ত; তা তুলনীয় সঙ্গীতের কনসার্টোর সাথে। উক্তি ধারণাটি আচরণ-জাগতিক বা প্রয়োগক্ষেত্রিক। যদিও শুনতে কেমনকেমন লাগতে পারে, তবুও বলা যায় যে উক্তিরাশি হচ্ছে বাক্যউপস্থাপন। বাক্যের বিমূর্ত সংগঠনই ভাষাপ্রয়োগের প্রধান নিয়ন্ত্রক। তবে আরো অনেক কিছু ভাষাপ্রয়োগকে নিয়ন্ত্রণ করে।…সুতরাং বাক্য ও ব্যাকরণ বিমূর্ত বস্তু। নানা বিমূর্ত বস্তুর সাথে পরিচিত আমরা দৈনন্দিন জীবনে, যেমন : সংখ্যা, বিধিবিধান, সিম্ফনি, গাড়িচালানোর নিয়মকানুন, রসিকতা। এ-সব বস্তুর একটি নঞার্থক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে এরা কোনো বিশেষ স্থানে-কালে বস্তুগতভাবে বিরাজ করে না।…তবে এ-বিমূর্ত বস্তুদের মূর্ত বস্তুরূপে অথবা বিশেষ স্থানে- কালে উপস্থাপিত করা সম্ভব।…ভাষা বিমূর্ত বস্তু, তবে তা বিশেষ অর্থে এক অ-সাধারণ বিমূর্ত বস্তু। ভাষা অসীম, আর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পরিচিতি অধিকাংশ বিমূর্ত বস্তু, গণিত, ব্যতীত, সসীম।…বাক্য এমন এক ধারণা, যা নির্দেশ করে সে-সব বিশেষ বস্তুর প্রতি, যা প্রতিটি ভাষায় আছে অসংখ্য পরিমাণে। ব্যাকরণ ধারণাটি নির্দেশ করে সে-সসীম সিস্টেমের প্রতি, যা সংখ্যাহীন বাক্য শনাক্ত ও সৃষ্টি করে। ভাষা যেহেতু অসীম বিমূর্ত বস্তু, তাই তাকে দেখতে পারি দুটি ভিন্ন কিন্তু সমতুল্য দৃষ্টিতে। উদাহরণরূপে বলতে পারি যে ইংরেজি ভাষা অসংখ্য ইংরেজি বাক্যের সমষ্টি, অথবা অন্য ভাবে বলা যায় যে ইংরেজি ভাষা হচ্ছে সে-সসীম সিস্টেম, যা সৃষ্টি করে অসংখ্য বাক্য।

অর্থাৎ রূপান্তর ব্যাকরণে বাক্য এক বিমূর্ত তাত্ত্বিক ধারণা। ওই বাক্য আমরা পর্যবেক্ষণ করি বাস্তব ভাষাপ্রয়োগের সময়; এবং লক্ষ্য করি যে প্রতিটি বাক্য ত্রিবিধ বৈশিষ্ট্যের সমাহার : ধ্বনিক, আর্থ, ও বাক্যিক বৈশিষ্ট্যের এক জটিল সমবায়ে গ’ড়ে ওঠে প্রতিটি বাক্য।

মূল্যায়ন। ভাষাবিজ্ঞানের তিনটি ধারা-প্রথাগত, সাংগঠনিক ও রূপান্তরবাদী-ভাষা ও বাক্য সম্পর্কে পোষণ করে বিভিন্ন, ও অনেকাংশে বিরোধী, ধারণা। প্রথাগত ব্যাকরণ আর্থ ও সর্বজনীনতামুখি। এ-ব্যাকরণের তত্ত্ব হচ্ছে যে বিশ্বের সব মানুষ সদৃশ : তারা অভিন্ন বিষয়ে ভাবে, চিন্তা করে, ও কথা বলে; তাই সব ভাষার বাক্যসংগঠন অভিন্ন। প্রথাগত ব্যাকরণবিদেরা অবশ্য লক্ষ্য করেছেন, ভাষায় ভাষায় সাংগঠনিক বৈসাদৃশ্য ব্যাপক, যা বিনষ্ট ক’রে দিতে পারে সর্বজনীনতাতত্ত্বকে। তাই তাঁরা আশ্রয় নেন অর্থের কেননা বিভিন্ন ভাষায় মানুষেরা মোটামুটিভাবে সদৃশ ও সর্বজনীন ভাবই প্রকাশ ক’রে থাকে। বাক্যের সংজ্ঞা রচনার সময় আর্থ মানদণ্ডকে বড়ো ক’রে তোলেন তাঁরা এমন বিশ্বাসে যে ওই মানদণ্ড সমস্ত ভাষায় প্রয়োগ করা সম্ভব, এবং অভিন্ন উপায়ে শনাক্ত করা সম্ভব সমস্ত মানবভাষার বাক্য। সাংগঠনিকেরা বিরোধী আর্থ মানদণ্ড ও সর্বজনীনতার, অর্থাৎ প্রথাগত ব্যাকরণের। তাঁরা উৎসাহী ভাষার রূপসংগঠনে, পর্যবেক্ষণসম্ভব ভাষাবস্তুতে। বিভিন্ন ভাষার বাহ্য সাংগঠনিক বৈসাদৃশ্য সাংগঠনিকদের চোখে দেখা দিয়েছিলো বড়ো আকারে। তাঁরা সিদ্ধান্তে পৌঁচেছিলেন যে মানব ভাষাগুলোতে মিলের চেয়ে অমিল অধিক, এবং প্রতিটি ভাষারই রয়েছে একান্ত নিজস্ব ও অনন্য সংগঠন। প্রতিটি ভাষার অনন্য সংগঠন বর্ণনাকে তাঁরা নিজেদের লক্ষ্য ব’লে স্থির করেছিলেন। তাই বাক্যের সংজ্ঞা রচনার সময় তাঁরা আর্থ মানদণ্ড পরিহার ক’রে প্রয়োগ করেছেন রৌপ মানদণ্ড। তবে বাক্য ধারণায় প্রথাগত ও সাংগঠনিকদের মধ্যে এ-বিরোধ সত্ত্বেও মিল রয়েছে এক মূল জায়গায় : উভয় গোত্রের কাছে বাক্য একরকম বাস্তব বস্তু। কিন্তু বিরোধটাই বড়ো;– প্রথাগত ব্যাকরণবিদেরা অনেক বেশি অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন, ও সৃষ্টিশীল; অন্যদিকে সাংগঠনিকেরা ভাষার বাহ্যস্তরেই সীমাবদ্ধ ও অ-সৃষ্টিশীল। প্রথাগত ব্যাকরণবিদেরা স্পষ্টভাবে না বললেও বোঝা যায় তাঁরা প্রতিটি ভাষার বাক্যের অসংখ্যতায় বিশ্বাসী, আর সাংগঠনিকদের ধারণা হচ্ছে যে প্রতিটি ভাষা সীমিত সংখ্যক, যদিও বিপুল, বাক্যের সমষ্টি। প্রথাগত ও সাংগঠনিক ব্যাকরণ বাক্যকেন্দ্রিক নয়। প্রথাগত ব্যাকরণ প্রধানত শুদ্ধ শব্দগঠনের নিয়মকানুন শেখায়, আর সাংগঠনিক ব্যাকরণ গুরুত্ব আরোপ করে ভাষার ধ্বনি-ও রূপ-সংগঠন বর্ণনার ওপর। রূপান্তর ব্যাকরণ পেশ করে ভাষা ও বাক্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন মত। রূপান্তরবাদীদের মতে প্রতিটি ভাষা অজস্র ও অনন্ত বাক্যের সমষ্টি; ব্যাকরণের কাজ ওই অজস্র অনন্ত বাক্যরাশি সৃষ্টি করা। তাদের কাছে বাক্য একটি বিমূর্ত তাত্ত্বিক ধারণা, যা সর্বজনীন। বাক্য সৃষ্টি বা বর্ণনার জন্যে যে-তাত্ত্বিক কাঠামো ও প্রণালিপদ্ধতি তাঁরা উদ্ভাবন করেন, তা শুধু অভিনব নয়, সর্বাংশে বিজ্ঞানসম্মতও।

বাক্যের তিনটি প্রথাগত সংজ্ঞা- দুটি গ্রিক-লাতিন ও একটি সংস্কৃত- প্রথাগত ব্যাকরণবিদদের প্রভাবিত করেছে সবচেয়ে বেশি। বাক্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও প্রিয় সংজ্ঞাটি– ‘পূর্ণ মনোভাবজ্ঞাপক শব্দসমষ্টিই বাক্য’-রৌপ ও আর্থ মানদণ্ড একসাথে ব্যবহার করেছে বাক্য নির্ণয়ের জন্যে। সংজ্ঞাটিতে আছে দুটি শর্ত;- (এক) বাক্য শব্দসমষ্টি, এবং (খ) ওই শব্দগুচ্ছ পূর্ণ মনোভাব জ্ঞাপন বা প্রকাশ করে। যে-ভাষাসংগঠন মেটায় এ-শর্ত দুটি, তাকে গণ্য করা যায় বাক্যরূপে। শর্ত দুটির প্রথমটি রৌপ, দ্বিতীয়টি আর্থ। প্রথম শর্তটি নির্দেশ করে যে বিশেষ এক রকম ভাষা-এককে– শব্দে– গঠিত হয় বাক্য; কিন্তু যে-কোনো শব্দসমষ্টিই বাক্য নয়। বাক্য হয়ে ওঠার জন্যে একত্র-বিন্যস্ত শব্দগুচ্ছকে মনের ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে হয়। সমস্যা জটিল হয়ে ওঠে এখানেই, কেননা ‘পূর্ণ মনোভাব বা অর্থ’ নির্ণয় করা শক্ত কাজ। কোনো কিছু সম্পর্কে কতোখানি ভাব প্রকাশ করা হ’লে বলা সম্ভব যে মনের ভাব সম্পূর্ণরূপে, বা পূর্ণ মনোভাব, প্রকাশ পেয়েছে? যদি বলি যে ‘মেয়েটি সুন্দর’, তবে কি মনের ভাব উজাড় ক’রে দেয়া হলো সম্পূর্ণরূপে? নাকি মনোভাব পূর্ণতার জন্যে আরো বলা দরকার যে তার চোখ দুটি বিখ্যাত, ওষ্ঠ শহরবিশ্রুত, মাংস তরঙ্গসঙ্কুল? এটা নির্ণয়ের কোনো বস্তুগত উপায় নেই ব’লে বাক্যের এ-সংজ্ঞাটির সাহায্যে বাক্যশনাক্তি সম্ভব নয়। গ্রিক-উৎসজাত বাক্যের দ্বিতীয় সংজ্ঞাটি বাক্যের আধেয় ও উপাদানগত সংগঠন নির্দেশ করে;- বলা হয় যে পূর্ণ অর্থ প্রকাশের জন্যে বাক্যের দরকার দুটি বস্তু। এর প্রথমটির নাম উদ্দেশ্য, দ্বিতীয়টির নাম বিধেয়। বাক্যে উদ্দেশ্যরূপে উপস্থিত থাকে কোনো ব্যক্তি অথবা বস্তু অথবা ভাব, আর বিধেয়ের কাজ হলো উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোনো বিবৃতি পেশ করা। এ-সংজ্ঞাটিতেও এমন কোনো মানদণ্ড নেই, যার সাহায্যে অবাক্য থেকে পৃথক করা যায় বাক্য। এ-সংজ্ঞা অনেক সময় অবাক্যকে গ্রহণ করাবে বাক্যরূপে, আর বাক্যকে শনাক্ত করবে অবাক্যহিশেবে। ‘মেয়েটি সুন্দর’ উদাহরণে উদ্দেশ্যরূপে আছে একটি বিশেষ্যপদ বা ব্যক্তি, আর বিধেয়রূপে আছে একটি বিশেষণ, যা উদ্দেশ্য সম্বন্ধে মন্তব্য করছে। এ-উদাহরণটিকে প্রথাগত ব্যাকরণে বাক্যরূপে গ্রহণ করা হবে। কিন্তু একই উক্তিকে যদি সামান্য বদলে দিই, বলি ‘সুন্দর মেয়েটি’, তবে একে প্রথাগত ব্যাকরণে বাক্য হিশেবে গ্রহণ করা হবে না, যদিও সংজ্ঞানুসারে একে বাক্যরূপে গ্রহণ করা উচিত। এতেও আছে একটি বিশেষ্য, উদ্দেশ্যরূপে; এবং আছে একটি বিধেয়-বিশেষণ, যা উদ্দেশ্যের ডানে না ব’সে বাঁয়ে বসেছে। দ্বিতীয় উদাহরণটির অর্থ এবং প্রথমটির অর্থ প্রায় এক, তাই দ্বিতীয়টিকেও বাক্যরূপে গ্রহণ করা উচিত; কিন্তু এক অজানা কারণে প্রথাগত ব্যাকরণে দ্বিতীয়টিকে বাক্যরূপে স্বীকার করা হবে না। বাক্যে উদ্দেশ্য-বিধেয়ের উপস্থিতিকে যদি মানা হয় অপরিহার্য ব’লে, তবে বিশ্বের অধিকাংশ ভাষার অনুজ্ঞাসূচক বাক্যরাশিকে অবাক্যরূপে চিহ্নিত করতে হবে। ‘যাও’, ‘এখানে আসো’ জাতীয় বাক্যে কোনো উদ্দেশ্য নেই, আছে শুধু বিধেয়। তাই এগুলোকে গ্রহণ করা উচিত অবাক্যরূপে, কিন্তু প্রথাগত ব্যাকরণে এগুলোকে বিলুপ্ত উদ্দেশ্যসম্বলিত বাক্যরূপে গ্রহণ করা হয়। তাই দেখা যাচ্ছে পাশ্চাত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী বাক্যসংজ্ঞা দুটি ব্যর্থ। অবশ্য এ-দুটিকে শোচনীয়ভাবে বিফল বলা যাবে না, কেননা এ-দুটি বাক্যশনাক্তির সুশৃঙ্খল মানদণ্ড দিতে না পারলেও বাক্য ও বাক্যসংগঠন সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দেয়। বাক্যের জনপ্রিয় সংস্কৃত সংজ্ঞাটি- ‘আকাঙ্খা, যোগ্যতা, ও আসত্তিযুক্ত পদসমুচ্চয়ই বাক্য’–যদিও ব্যর্থ, তবু উদঘাটন করে বাক্যের অনেক বৈশিষ্ট্য। সংজ্ঞাটিতে যে তিনটি শর্ত রয়েছে, তার দুটি রৌপ ও একটি আর্থ। ‘আকাঙ্খা’ ও আসত্তি’ বাক্যে শব্দ বা পদের বিন্যাসের সূত্র নির্দেশ করে, ‘যোগ্যতা’ নির্দেশ করে আর্থসঙ্গতির বিধি। সংজ্ঞাটি একটি বড়ো জটিলতা থেকে মুক্ত : এক বাক্যে কতোখানি অর্থ বা মনোভাব প্রকাশ পেতে পারে, বা কোনো মনোভাব-অর্থ আদৌ প্রকাশ পাওয়া উচিত কি-না, সে-সম্পর্কে এটি নীরব। সংজ্ঞাটির ‘আকাঙ্খা’ জ্ঞাপন করে যে বাক্যে শব্দের বা পদের সহাবস্থানের বিশেষ বিধি রয়েছে, যে-কোনো শব্দের পরে যে-কোনো শব্দ বসতে পারে না। যেমন : ‘একটি–’ পদের পরে বসতে পারে ‘ছেলে, মেয়ে, গরু’ প্রভৃতি পদ, কিন্তু ‘জল, করে’ বসতে পারে না। আধুনিক পরিভাষায় এর নাম ‘কোঅকারেন্স রেস্ট্রিকশন’ বা ‘সহাবস্থান বিধি’। প্রথাগত বাঙলা ব্যাকরণে ‘আকাঙ্খা’র ভুল ব্যাখ্যা প্রায়ই পাওয়া যায়। প্রথাগত ব্যাকরণবিদেরা শব্দটির আভিধানিক অর্থ অনুসারে এর এমন আর্থ ব্যাখ্যা দেন, যা ভ্রান্ত ও বিভ্রান্তিকর। ‘আসত্তি’ও রৌপ শর্ত; এর সাহায্যে নির্দেশ করা হয় যে বাক্যে যে-সব পদ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িত, তাদের অবস্থান হবে কাছাকাছি। যেমন : ‘একটি মেয়ে সাত দিন ধ’রে ঘুম যাচ্ছে’ বাক্যে ‘একটি মেয়ে’, ‘সাত দিন ধ’রে’, ‘ঘুম যাচ্ছে’ পদগুচ্ছভুক্ত শব্দরাশি পরস্পরের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িত; তাই তাদের অবস্থান হবে সন্নিকট। যদি এর কোনোটিকে দূরে সরিয়ে নেয়া হয়, তবে বাক্যে বিপর্যয় ঘটবে। ‘আসত্তি’ শব্দটিকে অনেক প্রথাগত বাঙলা ব্যাকরণবিদ ভ্রান্তিবশত ‘আসক্তি’ রূপে গ্রহণ ক’রে ভুল ব্যাখ্যা দেন। ‘যোগ্যতা’ শর্তটি আর্থ; আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে একে বলা হয় ‘সিলেকশনাল রেস্ট্রিকশন’ বা ‘সঙ্গতিবিধি’। শর্তটি দাবি করে যে বাক্যের বক্তব্যমাত্রই হবে সুসঙ্গত; বিসঙ্গত কোনো ভাব থাকবে না বাক্যে। ‘যোগ্যতা’র মানদণ্ডে ‘গোপাল কলা খায়’ চমৎকার বাক্য, কেননা এর ভাব সুসঙ্গত; আর ‘*গোপাল রাজনীতি খায়’ অশুদ্ধ, কেননা রাজনীতি খাদ্যসংগ্রহের সহায়ক হ’লেও তা খাদ্য নয়। রূপান্তর ব্যাকরণবিদগণ বাক্যের অর্থসঙ্গতি সম্পর্কে প্রচুর আলোচনা ক’রে সিদ্ধান্তে পৌঁচেছেন যে আর্থ ত্রুটি বা বিসঙ্গতি বাক্যিক ত্রুটি নয়, তাই বিসঙ্গত বাক্যকে শুদ্ধ বাক্যরূপে গ্রহণ করতে হবে। চোমস্কি (১৯৫৭, ১৫) রূপান্তর ব্যাকরণ প্রস্তাবের সময় ‘রঙহীন সবুজ ভাবনাগুলো ভয়ংকরভাবে ঘুমোচ্ছে’র মতো একটি বিসঙ্গত বাক্যকে সুগঠিত বাক্যরূপে গ্রহণ করেছিলেন; কিন্তু পরে (১৯৬৫, ১১৩-১২০) মত বদলান। আস্পেক্টস-এ তিনি বিসঙ্গত বাক্যকে ব্যাকরণঅসম্মত ব’লে নির্দেশ করেন। কিন্তু রূপান্তরবাদীদের অনেকে দেখান যে বিসঙ্গতি বাক্যিক ত্রুটি নয়, আর্থ ত্রুটি; তাই বিসঙ্গতির জন্যে কোনো বাক্যকে গ্রহণঅযোগ্য ব’লে শনাক্ত করা যায় না। ‘আমি গতকাল সেখানে যাবো’, বা ‘আগামীকাল আমি সেখানে গিয়েছিলাম’-এর মতো কালবোধচূর্ণকারী বাক্যও ব্যাকরণগতভাবে অশুদ্ধ নয়, যদিও তা বিসঙ্গত। তাই সংস্কৃত বাক্যসংজ্ঞার যোগ্যতা শর্তটি গ্রহণযোগ্য নয়। সব মিলিয়ে এ সংজ্ঞাটির সাহায্যেও নির্ভুলভাবে বাক্য নির্ণয় অসম্ভব।

সাংগঠনিকদের বাক্যসংজ্ঞা ও ধারণা রৌপ। অর্থ বা আধেয় পরিহার ক’রে ভাষা বর্ণনার জন্যে তাঁরা যে-বৃহত্তম ব্যাকরণিক একক নির্ণয় করেন, তার নাম বাক্য। বাক্যশনাক্তির জন্যে তাঁরা একটি আদিম ধারণার সহায়তা নেন, ও তার নাম দেন উক্তি। ভাষাপ্রয়োগের সময় উচ্চারিত হয় উক্তি; আর সে-উক্তিকে খণ্ডিত করা হয় স্বয়ংসম্পূর্ণ বিভিন্ন সংগঠনে, যা গঠিত নানা ছোটো উপাদানে। কিন্তু ওই সংগঠন কোনো বৃহত্তর সংগঠনের অংশ নয়। এ-সংগঠনই বাক্য। ব্লুমফিল্ডের বাক্যসংজ্ঞাটি, যা মেনে নিয়েছেন সাংগঠনিকেরা, ভাষাবর্ণনার বৃহত্তম একক নির্ণয় করে চমৎকারভাবে। রূপান্তরবাদীগণ বাক্যের এ-সংজ্ঞাটিকেই গ্রহণ করেছেন, তবে অনেকটা অন্যভাবে। সাংগঠনিকদের কাছে বাক্য ও উক্তি বাস্তব একক; কিন্তু রূপান্তরবাদীগণ এ-দুটিকে গ্রহণ করেন বিমূর্ত এককরূপে। সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানের লক্ষ্য পর্যবেক্ষণসম্ভব ভাষা-উপাত্ত বর্ণনা করা; তাই তাঁরা বাক্যকে বাস্তব এককরূপেই গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু রূপান্তরবাদীদের লক্ষ্য ভাষার অনন্ত অসীম বাক্য সৃষ্টি করা, যা কোনো বিশেষ উপাত্তে সীমাবদ্ধ নয়। বাক্য তাঁদের কাছে একটি বিমূর্ত ধারণা, এবং তার বাস্তব রূপ অনেক সময় পাওয়া যায় উক্তিতে। বাক্য ও উক্তি কখনোকখনো অভিন্নরূপ ধরতে পারে, তবে উক্তিমাত্রই বাক্য নয়। অবশ্য বাক্যমাত্রই উক্তি। রূপান্তর ব্যাকরণের লক্ষ্য এমন ব্যাকরণ রচনা, যা ভাষার সমস্ত বাক্য সৃষ্টি করবে, ও প্রতিটি বাক্যের সাংগঠনিক বর্ণনা দেবে। রূপান্তর ব্যাকরণ সাংগঠনিক ব্যাকরণের কিছু কিছু ধারণা গ্রহণ করলেও তা সাংগঠনিক ভাষিক তত্ত্বের বিরোধী, এবং অনেক বিষয়ে প্রথাগত ব্যাকরণের সাথে একমত। প্রথাগত ব্যাকরণ, তার সমস্ত বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও, বাক্যসংগঠন সম্পর্কে যে-গভীর বোধের পরিচয় দেয়, সাংগঠনিক ব্যাকরণ তা পারে না। রূপান্তর ব্যাকরণ জয় করেছে প্রথাগত ব্যাকরণের অবৈজ্ঞানিকতা ও সাংগঠনিক ব্যাকরণের অদূরদৃষ্টি : বাক্যকে প্রধান একক ধ’রে রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ উদঘাটন করে ভাষার সমস্ত দৃশ্য-অদৃশ্য সূত্র।

টীকা

[১] Lowth (1762, 118): ‘A sentence is an assemblage of words, expressed in proper form, arranged in proper order and occurring to make a complete sense.’

[২] Bain (1879, 8): ‘Speech is made up of separate sayings, each complete in itself…these sayings are sentences. Any complete meaning is a sentence.’

[৩] Rowe and Webb (1897, 1): ‘A sentence is a combination of words by which we say something about a person or a thing.’

[8] McMordie (1911, 149) : ‘A sentence is a group of words containing at least one subject and one predicate, the words being so arranged as to express a complete thought.’

[৫] Nesfield (1895, 5): ‘A combination of words that makes a complete sense is called a sentence.’

[৬] House and Harman (1931,145): ‘A sentence is a group of words expressing a complete thought. A sentence must contain a subject and a predicate.’

[৭] Jones (1935, 2) : ‘A sentence is a group of words that contains a verb and its subject and whatever else is necessary to make the thought grammatically complete.’

[৮] Tanner (1945, 14): ‘A sentence is the expression of a complete thought by means of a group of words that can stand alone.’

[৯] Curme (1947, 97): ‘A sentence is an expression of a thought or feeling by means of a word or words used in such a form and manner as to convey meaning intended.’

[১০] Faulkner (1950, 1): ‘A sentence is a combination of words which conveys at least one complete thought consisting of a combination of concepts.’

[১১] Warfel et al (1949, 80): ‘The unit of composition upon which thought is based is the sentence.’

[১২] Gardiner (1932, 208) : ‘A sentence is an utterance which makes just as long a communication as the speaker has intended to make before giving himself a rest.’

[১৩] Walcott et al (1940, 1, 61, 62): ‘Here then is the secret of every sentence: first we always name some object or place or person or thing; and then, second, we say something about that object or place or person or thing. Unless we do these two things, we are not making complete sentences…The subject will always be the object, place, person, or thing that is being talked about. The predicate will always be what is said about the object, place, person, or thing.’

[১৪] Barker (1939, 4): Two elements are necessary to the expression of a complete thought: (1) a subject which names a person or thing or idea about which a statement is made; and (2) a predicate which makes a statement about the subject.’

[১৫] Kierzek and Gibson (1960, 36) :’Defined in terms of form or pattern, a sentence is a basic unit of language, a communication in words, having as its core at least one independent verb with its subject.’

[১৬] Meillet (1903, 32): ‘The sentence can be defined (as follows) : a group of words joined together by grammatical agreements (relating devices) and which not grammatically dependent upon any other group are complete in themselves.’

[১৭] Jespersen (1924, 307) : ‘A sentence is a (relatively) complete and independent human utterance…The completeness and independence being shown by its standing alone or its capability of standing alone i.e., of being uttered by itself.’

[১৮] Bloomfield (1926, 28) : ‘A maximum form in any utterance is a sentence. Thus, a sentence is a form which, in the given utterance, is not part of a larger construction.’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *