মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট : অগ্নিশিখা ও অশ্রুবিন্দু
মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট (১৭৫৯-১৭৯৭) চোখে জাগিয়ে তোলেন দুটি আপাতবিষম সুন্দর ভয়াবহ চিত্রকল্প : অগ্নিশিখা ও অশ্রুবিন্দুর। মনে হয় কোথাও গভীর মিল রয়েছে অগ্নি ও অশ্রুর, অন্তত মেরি মিলিয়ে দিয়েছিলেন দুটিকে; আগুন তাঁর মধ্যে অশ্রু হয়ে টলমল ক’রে উঠতে পারতো, আবার অশ্রু হয়ে উঠতে পারতো লেলিহান অগ্নিশিখা। মেরি, ফরাশি বিপ্লবের থেকেও বিপ্লবাত্মক, ১৭৯১-এ বত্রিশ বছরের তরুণী; মাত্র ছ-সপ্তাহে লেখেন তাঁর তেরো পরিচ্ছেদের ভয়ঙ্কর বইটি : ভিন্ডেকেশন অফ দি রাইট্স্ অফ ওম্যান : উইথ স্ট্রিকচার্স্ অন পলিটিকেল অ্যান্ড মোরাল সাবজেক্টস্। বেরোয় ১৭৯২-এ; দু-শো বছর আগে; ভাবতে ভালো লাগছে, শিহরণ বোধ করছি এজন্যে যে বাঙলা ভাষায়, পৃথিবীর এক অন্ধকার এলাকায়, একা পালন করছি বইটির দ্বিশতবার্ষিকী! বইটি নারীবাদের প্রথম মহাঘোষণা; মানুষের লেখা সবচেয়ে বিপ্লবাত্মক, বিখ্যাত ও আপত্তিকর বইগুলোর একটি তাঁর ভিন্ডিকেশন। বইটি প্রকাশের পর পিতৃতন্ত্রের ইতিহাসে প্রথম বিপ্লবী নারী, তেত্রিশ বছরের মেরি পান প্রগতিশীলদের অভিনন্দন ও প্রশংসা, কিন্তু নিন্দাই জোটে বেশি। নিন্দাই ছিলো তাঁর স্বাভাবিক প্রাপ্য, তখন পৃথিবী জুড়েই ছিলো তাঁর শত্রুরা, আজো তারা আছে; তাই ওই বই লিখে সকলের চোখের মণি হয়ে উঠবেন তিনি, তা আশা করতে পারি না, মেরিও করেন নি। তিনি পান তাঁর পুরস্কার : রক্ষণশীল পুরুষতন্ত্র ক্ষেপে ওঠে, তাঁর নাম অভিন্ন হয়ে ওঠে অনাচারের সাথে; রক্ষণশীলদের কাছে মেরি হয়ে ওঠেন নিষিদ্ধ ঘৃণ্য নাম। তবে তিনি ঘৃণাই শুধু পান নি, পেয়েছেন অনুরাগও। টমাস কুপার উল্লসিত হয়ে বলেছিলেন, ‘এবার পুরুষতন্ত্রের সমর্থকদের বলো (যদি পারে) নারী-অধিকার-এর উত্তর দিতে।’ মেতে ওঠে রক্ষণশীলেরা, অশ্লীল গালাগালিতে ভ’রে ফেলে চারপাশ; হোরেস ওয়ালপোল মেরিকে বলেন ‘পেটিকোটপরা হায়েনা’; আরেকজন বলে ‘দার্শনিকতাকারিণী সর্পিণী’ ইত্যাদি। মেরি তাদের চোখে হয়ে ওঠেন অশুভর নারীমূর্তি। তাঁর নিন্দুকেরা শুধু তখনই ছিলো না, ছিলো উনিশশতকে, বিশশতকের অর্ধেক ভ’রে তারা ছিলো, আছে আজো। ফ্রয়েডীয়দের চোখে মেরি এক খোঁজাগূঢ়ৈষারুগ্ন শিশাসূয়াগ্রস্ত নারী, যে নারীবাদ নামের নষ্টের মূলে। কিছু দিন আগে পর্যন্ত নারীবাদীরাও সংকোচ করতো তাঁর নাম নিতে, ভয়ে কুঁকড়ে যেতো একথা ভেবে যে মেরির নাম নিলে পুরুষতন্ত্র ক্ষেপে উঠবে, তাঁদের কোনো দাবি পূরণ হবে না। মেরি সমস্ত ‘সদগুণে’র বিনাশকারিণী, তাঁর নাম নিলে হানি ঘটবে সতীত্বের। কিন্তু জয় হয়েছে মেরিরই, যিনি বত্রিশ বছরে লিখেছিলেন একটি বিপজ্জনক বই, এবং অশ্রুর মতো মিলিয়ে গিয়েছিলেন মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে। মেরি আবার ফিরে এসেছেন, তাঁর নাম এখন পাচ্ছে নারীবাদী সন্তের মহিমা; মার্ক্স যেমন সমাজতন্ত্রের মেরি তেমনই নারীবাদের। তাঁর সমাধিতে মৃত্যুর একশো একষট্টি বছর পর দ্বিশতজন্মবার্ষিকীতে অর্পিত হয়েছে পুষ্পার্ঘ্য।
নারীবাদের প্রথম মহান নারী মেরি ছিলেন অগ্নি ও অশুর সমবায়; তাঁর জীবন ছিলো যেমন লেলিহান, তেমনই কোমলকাতর; তাঁর সমাপ্তি ঘটেছিলো বিষণ্ণ আর্ত চিৎকারে। তিনি বেঁচে ছিলেন অন্যদের সময়ে, বেশি দিন বাঁচেন নি; কিন্তু তাঁর বই পড়লে, মধুর মুখচ্ছবিটির দিকে তাকালে মনে হয় মেরি বেঁচে আছেন; এবং রক্ষণশীলদের সাথে ক’রে চলছেন নিরন্তর বোঝাপড়া। ১৭৫৯-এ লন্ডনের বাইরে এপিং বনের কাছাকাছি এক গরিব চাষী পরিবারে জন্ম হয় মেরির। মেরি ছিলেন প্রথম সন্তান। তাঁর বাবা অ্যাডওয়ার্ড ওলস্টোনক্র্যাফ্ট তখন অপচয় ক’রে ক’রে নিঃস্ব, সংসারও চালাতে পারছিলো না। মেরির পরে ওই পরিবারে জন্মে আরো তিনটি ছেলে ও দুটি মেয়ে। তাঁর বাবা জীবিকার সন্ধানে সপরিবার ঘোরে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের নানা স্থানে, কিন্তু কখনো সচ্ছলতা পায় নি। তাঁর বাবা ছিলো রাগী, অত্যাচারী; মা ছিলো ভীরু। মেরি বাল্যকাল থেকেই বেড়ে ওঠেন দায়িত্বশীল মেয়েরূপে, এবং মেনে নিতে পারেন নি বাবার স্বৈরাচার। বাবা তাঁর মাকে মারতো মাঝেমাঝেই, আর মেরি মাকে বাঁচানোর জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়তেন বাবামা দুজনের মাঝখানে। মেরি বলেছেন, তাঁর বাবা ছিলো স্বৈরাচারী, মা স্বৈরাচারের স্বেচ্ছাশিকার। তাঁর মায়ের চরিত্রে প্রতিবাদের এক কণাও ছিলো না; এবং তাঁর মা মেয়েদের তুচ্ছ গণ্য ক’রে মনে করতো একদিন বড়ো ছেলেটিই উদ্ধার করবে তাকে। পরে দেখা যায় ছেলে মায়ের দিকে তাকায়ও নি, মেরিই সাহায্য করেছেন মাকে।
গরিব চাষীপরিবারের মেয়ে মেরি বেড়ে ওঠেন খামারে খামারে; মধ্যবিত্ত মেয়েদের সুবিধা যেমন পান নি তিনি, তেমনই পান নি তাদের সীমাবদ্ধতাগুলো। মেরি খেলাধুলো করতেন ভাইদের সাথে, যা তাকে ভিন্নভাবে বিকশিত করেছিলো; মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের নিরর্থক ‘অর্জন’গুলো তাঁকে আয়ত্ত করতে হয় নি। বাসায় লেখাপড়ার সুযোগ ছিলো না, তবু তিনি লেখাপড়া শেখেন নিজের চেষ্টায়। বাল্য থেকেই তাঁর সাধনা ছিলো স্বাধীন স্বাবলম্বী হওয়ার, মেয়েমানুষের পুরুষনির্ধারিত ভূমিকায় তিনি বন্দী থাকতে চান নি। উনিশ বছর বয়সে, ১৭৭৮-এ, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন মেরি স্বাধীন জীবিকার খোঁজে, যা সে-সময় ছিলো দুঃসাধ্য। নানা পেশা গ্রহণ করেন তিনি, যার কোনোটিই খুব ভালো ছিলো না। প্রথম তিনি নেন এক ধনী বিধবার সহচরীর কাজ, বইতে শুরু করেন পরিবারের দায়িত্ব। তিনি ভার নেন ভাইবোনদের শিক্ষার, পালন করেন অভিভাবকের দায়িত্ব। ১৭৮৩তে তিনি আর্থস্বায়ত্তশাসনের জন্যে নেন একটি বিশেষ উদ্যোগ; বান্ধবী ফ্যানি ব্লাড ও বোনদের নিয়ে লন্ডনের নিউইংটন গ্রিনে স্থাপন করেন বিদ্যালয়। তখন নিউইংটন ছিলো ডিসেন্টার, উদারনীতিক বুদ্ধিজীবী ও যাজকদের আবাসিক এলাকা; তাই সেটি ছিলো মেরির মতো স্বাধীনচেতা নারীর উপযুক্ত বাসস্থল। ওই এলাকায় বাস করতেন সংসদসংস্কারপন্থী জেমস বার্গ, বিপ্লববাদী যাজক রিচার্ড প্রাইস। মেরি আর্থিক স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা করছিলেন ব’লে তাঁরা সবাই উৎসাহ দিতেন মেরিকে।
মেরি বাল্যকাল থেকে বিরোধী ছিলেন পিতার স্বেচ্ছাচারিতার, নিউইংটনে উদারনীতিক বুদ্ধিজীবীদের সংস্পর্শে তিনি বিরোধী হয়ে ওঠেন সব ধরনের স্বেচ্ছাচারী শক্তির। তাঁর বিদ্যালয় সফল হয় নি; এবং নানা সংকটে জীবন ভ’রে ওঠে মেরির নিউইংটনেই একজন তাঁকে পরামর্শ দেয় লিখে জীবিকা অর্জনের চেষ্টা করার, যা সে-সময়ে কোনো নারীর জন্যে ছিলো অসাধ্য পেশা। কিন্তু মেরির কাছে অসাধ্য ব’লে কিছূ ছিলো না। কী নিয়ে লিখবেন তিনি? তিনি বিদ্যালয় খুলেছিলেন বালিকাদের জন্যে, তাই শিক্ষা সম্পর্কে লেখাই ছিলো তাঁর জন্যে সবচেয়ে সহজ। ১৭৮৭তে মেরি লেখেন প্রথম বই কন্যাদের শিক্ষা সম্পর্কে চিন্তা। এ-বইতে তিনি প্রথার বিরুদ্ধে যান নি, খ্রিস্টানরা নারীদের জন্যে যে-ভূমিকা ও অবস্থান ঠিক ক’রে রেখেছিলো, তাই মেনে নেন তিনি; কিন্তু ভিন্ডিকেশন-এ আর মানেন নি। এ-বই থেকে আয় হয় দশ গিনি। তখন তাঁর নিজের অর্থাভাবের শেষ ছিলো না, তবু ওই টাকাটা তিনি দিয়ে দেন মৃত বান্ধবীর পরিবারকে, কেননা তাদের খুব দরকার। কিছুতেই আর্থস্বনির্ভরতা অর্জন করতে না পেরে ১৭৮৬তে মেরি নেন একটি হীন চাকুরি। তিনি নেন আয়ারল্যান্ডের লেডি কিংসবরোর গভর্নেসের কাজ। এখানেই পরিচিত হন তিনি উচ্চবিত্ত শ্রেণীর বিলাসবহুল অবসরভরপুর অকর্মণ্য জীবনের সাথে, যে-জীবনকে মেরি ঘেন্না করেছেন অন্তর থেকে। তিনি দেখেন উচ্চবিত্ত নারীদের জীবন কাটে কী অসার বিলাসের মধ্যে, কীভাবে নষ্ট হয়ে যায় তাদের চরিত্রের বিকাশ। পরে মেরি এদের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় কথা বলেছেন, উদ্ধারঅযোগ্য ব’লে ঘোষণা ক’রে বিলোপ কামনা করেছেন এদের। সুখের বিষয় গভর্নেসের কাজে মেরির বেশি দিন থাকতে হয় নি।
মেরি যোগাযোগ করেন তাঁর উদারনীতিক প্রকাশক জোসেফ জনসনের সাথে, জানান নিজের পরিকল্পনা। জনসন মেরিকে ফিরে আসতে বলেন লন্ডনে; তাঁর বই প্রকাশ করবেন ব’লেও প্রতিশ্রুতি দেন। মেরি ১৭৮৭তে ফেরেন লন্ডনে; লেখেন তাঁর প্রথম উপন্যাস : মেরি (১৭৮৮)। মেরি বেশ ভাবাবেগপূর্ণ উপন্যাস, যাতে স্থান পায় তাঁরই দুঃখকষ্টপূর্ণ জীবন। এটি এমন এক তরুণীর কাহিনী, যে প্রতিবেশের চাপ অগ্রাহ্য ক’রে করছে নানা ভালো কাজ। লন্ডনে ফিরে মেরি মুক্তি পান আয়ারল্যান্ডের অভিজাত পরিবারের অন্তঃসারশূন্যতা থেকে, এবং পান নিজেকে বিকশিত করার মতো চমৎকার মননশীল পরিবেশ। প্রকাশক জনসনের দোকানের ওপরের তলায় তখন মিলিত হতেন চিত্রকর হেনরি ফুঁসেলি, জোসেফ প্রিস্টলি, উইলিয়ম গডউইন, উইলিয়ম ব্লেক, টমাস পেইন প্রমুখ উদারনীতিক বুদ্ধিজীবী। মেরি পান তাঁদের সঙ্গ। তিনি নেন লেখকের জীবিকা, নিজেকে বলেন ‘এক নতুন প্রজাতির প্রথম’; কেননা তখনো লেখা কোনো নারীর জীবিকা হয়ে ওঠে নি। মেরিই প্রথম নারী, যিনি লেখাকে করেন জীবিকা।
এ-অভিনব পেশা গ্রহণের পর মেরির জীবন হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ কর্মের ও লক্ষ্যের; তবে মেরি ছিলেন এমন তরুণী, যাঁর মস্তিষ্কটি ছিলো মেধাবী, হৃদয়টি রোম্যান্টিক | তিনি মন দেন লেখায় এবং লেখায়, খুব দ্রুত লেখায়। তিনি কতোটা দ্রুত লিখতে পারতেন, তার পরিচয় বহন করছে ভিন্ডিকেশন, যা লিখতে আজ যে-কেউ বছরখানের সময় নেবে, তিনি নিয়েছিলেন মাত্র ছ-সপ্তাহে। রূপসী ছিলেন মেরি, কিন্তু সাজগোজ পছন্দ করতেন না; তাঁর বাসায় বিশেষ আসবাবপত্রও ছিলো না। ফরাশি নেতা ট্যালিরাঁদ তাঁর বাসায় এলে তিনি তাঁকে ভাঙা পেয়ালায় চা খেতে দিয়েছিলেন। টাকা তাঁর সহজ আয়ের জিনিশ ছিলো না, তাই অপচয়ের জিনিশও ছিলো না। মেরি লিখতে আর অনুবাদ করতে থাকেন জনসনের অ্যানালিটিকেল রিভিউর জন্যে, ক্রমশ বিশ্বাস অর্জন করতে থাকেন নিজের সামাজিক রাজনীতিক নান্দনিক বোধ সম্পর্কে। তিনি পুস্তক সমালোচনা লিখে লিখে তৈরি করতে থাকেন নিজের দৃঢ় ভিত্তি। তখনকার লন্ডনের রক্ষণশীল বুদ্ধিজীবীদের প্রধান বার্ক দু-হাতে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছিলেন সব বিপ্লব ও সামাজিক পরিবর্তন। ফরাশি বিপ্লবের বিরুদ্ধে তিনি লেখেন রিফ্লেকশনস অন দি ফ্রেঞ্চ রেভোলিউশন। মেরি এর উত্তরে লেখেন এ ভিন্ডিকেশন অফ দি রাইট্স অফ মেন (১৭৯০); নারী-অধিকার প্রতিপাদনের আগে মেরি প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেন মানুষের অধিকার। এ-বইতে মেরি আক্রমণ করেন রক্ষণশীলতাকে, ব্যক্ত করেন মানুষ, সমাজব্যবস্থা প্রভৃতি সম্পর্কে তাঁর প্রগতিশীল বক্তব্য; দাবি করেন যে নাগরিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা মানুষের জন্মাধিকার, শুধু স্বৈরাচারই মানুষকে বঞ্চিত করে এসব অধিকার থেকে। বার্ক যাদের সেবক, সে-অভিজাতদের তিনি বলেন ‘উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত নপুংসকতা দ্বারা খাসি করা পদাধিকারী উড়নচণ্ডী লম্পট’। মেরি চরম প্রতিপক্ষ ছিলেন উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত শক্তিমান ও ধনবানদের।
মানুষের অধিকার দাবির এক বছর পর, ১৭৯১-এ, মেরি দাবি করেন নারীর অধিকার; লেখেন ভিন্ডিকেশন। জোসেফ জনসন বইটি প্রকাশ করেন ১৭৯২-এ। প্রথম সংস্করণে মুদ্রণত্রুটি ছিলো অনেক, তাই মেরি ওই বছরই বের করেন দ্বিতীয় সংশোধিত সংস্করণ, এবং এটিই গৃহীত বইটির শুদ্ধ সংস্করণরূপে। মেরির বইটিই অকাট্য নীতিপ্রণালিভিত্তিক নারীমুক্তির প্রথম সুপরিকল্পিত প্রস্তাব, ইশতেহার, ঘোষণা; নারীবাদের আদিগ্রন্থ। বিপ্লবকে কাছে থেকে দেখার জন্যে ১৭৯২-এ মেরি যান ফ্রান্সে। এর মাঝে বেরিয়েছে বইটির ফরাশি সংস্করণ, তাই মেরি সেখানে হয়ে উঠেছেন খ্যাতিমান। তিনি সেখানে গৃহীত হন সাহিত্যিক ও রাজনীতিক লেখকদের এক আন্তর্জাতিক সংঘে, যাতে ছিলেন হেলেন মারিয়া উইলিয়ম্স, জোয়েল বারলো, ফরাশি বিপ্লবী ব্রিসো, এবং মানুষের মুক্তির মহাপ্রবক্তা টমাস পেইন। বইটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন ফরাশি নেতা ট্যালিরাঁদের নামে, আশা করেছিলেন নারীশিক্ষা সম্পর্কে আইনপ্রণয়নে ট্যালিরাঁদ প্রভাবিত করবেন সংসদকে! তাঁর আশা পর্যবসিত হয় হতাশায়। বিপ্লবীরাও বিশ্বাস করে নারী-অধীনতায়। ব্যর্থ হয়ে যায় ফরাশি বিপ্লব, খুশি হয় বার্কেরা; তবু মেরি লেখেন অ্যান হিস্ট্রিকেল অ্যান্ড মোরাল ভিউ অফ দি অরিজিন অ্যান্ড প্রোগ্রেস অফ দি ফ্রেঞ্চ রেভোলিউশন (১৭৯৪)। তিনি হতাশ হন, তবু জনগণের ওপর বিশ্বাস হারান না।
প্যারিসে মেরির পরিচয় হয় গিলবার্ট এমলের সাথে। সে মার্কিন, একটি ভাবালু উপন্যাসের লেখক, তবে ব্যবসায়ী। তার সাথে পরিচয়ই মেরির জীবনের প্রধান দুর্ঘটনা। মেরি তার প্রেমে পড়েন, কিন্তু এমলে আকর্ষণ বোধ করে মেরির দেহের প্রতি। তাঁরা তিন বছর একত্র বাস করেন, বিয়েতে বিশ্বাসহীন মেরি বিয়ে করতে চাইলেও বিয়ে তাঁদের হয় নি। তাঁদের একটি মেয়ে (মে ১৭৯৪) হয়, নাম ফ্যানি এমলে। এর পর এমলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে মেরির কাছে থেকে; আর মেরি মেয়ে নিয়ে ছোটেন এমলের পেছনে পেছনে, প্যারিস থেকে লা হাভারে, লন্ডনে, আবার প্যারিসে। এমলে ছুটতে থাকে টাকা আর অন্য নারীর পেছনে। ১৭৯৫-এ মেরি মেয়ে আর একটি পরিচারিকা নিয়ে যান স্ক্যান্ডিনেভিয়ায়। সেখানে পালন করেন এক অদ্ভুত দায়িত্ব, করেন এমলের ব্যবসাপ্রতিনিধির কাজ। সেখানে থাকার সময় মেরি এক কল্পিত অনুপস্থিত প্রেমিকের উদ্দেশে পত্রাকারে লেখেন জর্নাল; কয়েক মাস পরে তা বেরোয় লেটার্স রিটেন ডিউরিং এ শর্ট রেসিডেন্স ইন সুইডেন, নরওয়ে অ্যান্ড ডেনমার্ক (১৭৯৬) নামে। জীবনের চরম সংকটকালে লেখা এ-চিঠিগুলো বিস্ময়করভাবে প্রশান্ত, কাব্যিক, ও সমাজসমালোচনা- মুখর। লন্ডনে ফিরে মেরি দেখেন এমলে বাস করতে শুরু করেছে একটি অভিনেত্রীর সাথে। ক্লান্ত কাতর মেরির কাছে জীবন হয়ে ওঠে দুর্বহ; একরাতে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন টেমস নদীতে। কিন্তু ব্যর্থ হন আত্মহত্যায়। যে-প্রেমের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন মেরি ভিন্ডিকেশন-এ, তার প্ররোচনায়ই নারীবাদের মহাদেবী বেছে নেন আত্মহত্যা।
কিন্তু জীবন তখনো অপেক্ষা করে ছিলো তাঁর জন্যে; মৃত্যু থেকে উঠে এসে মেরি ঢোকেন জীবনে : এনকোয়ারি কনসারনিং পলিটিকেল জাস্টিস-এর (১৭৯৩) আলোড়নজাগানো লেখক দার্শনিক উইলিয়ম গডউইনের সাথে গ’ড়ে ওঠে তাঁর হৃদয়সম্পর্ক। গডউইনের সাথে সম্পর্কের সময়টা মেরির জীবনের সবচেয়ে সুখের সময়; ওই দার্শনিক ভালোবেসেছিলেন মেরিকে, ও মেরির লেখাকে। মেরির মৃত্যুর পর তিনিই লিখেছিলেন মেরির অকপট জীবনী, ও সম্পাদনা করেছিলেন মেরির রচনাবলি। মেরি ও গডউইন কেউই বিশ্বাস করতেন না বিয়েতে; তাঁদের কাছে বিয়ে ছিলো কৃত্রিম চুক্তি, যা সৎমানুষের জন্যে অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু তাঁরা, মেরি গর্ভবতী হয়ে পড়লে, বিয়ে করেন। সন্তান প্রসবের জন্যে যখন অপেক্ষা করছিলেন মেরি, তখন তিনি লিখে চলছিলেন রংস অফ উইমেন (১৭৯৮) নামে একটি উপন্যাস। মেরি যখন সুখী, তখনই পরিহাসের মতো এগিয়ে আসে মৃত্যু। নারীবাদের মহানারী, বিয়েতে অবিশ্বাসী কিন্তু বিবাহিত, মেরি মৃত্যু বরণ করেন নারীদেরই এক পুরোনো শাস্তিতে : সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মৃত্যু হয় মেরির ১৭৯৭-এর আগস্টে, আটত্রিশ বছর বয়সে। তিনি উপহার দিয়ে যান একটি মেয়ে, যার নাম মেরি গডউইন শেলি : পৃথিবীর বিখ্যাততম গথিক উপন্যাস ফ্র্যাংকেনস্টাইন-এর লেখিকা, কবি শেলির দ্বিতীয় স্ত্রী।
মেরি ভিন্ডিকেশন লিখেছিলেন এমন এক সময়ে, যখন পশ্চিমে চলছিলো প্রচণ্ড সামাজিক রাজনীতিক ভাঙাগড়া, যখন বিপ্লব ছিলো অধিকাংশের স্বপ্ন। ফ্রান্সে তখন বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ঘোষণা করা হচ্ছিলো সাধারণ মানুষের অধিকার, বিলেতে আমূলবাদীদের ভয়ে শংকিত হয়ে পড়ছিলো অভিজাততন্ত্র। ওই আমূলবাদেরই এক উৎসারণ মেরির ভিন্ডিকেশন। তাঁরা তখন প্রশ্ন তুলছিলেন সমস্ত প্রচলিত সামাজিক রাজনীতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে; অনুপ্রাণিত ছিলেন লক ও রুশোর মত দিয়ে যে রাজা বা অভিজাততন্ত্র ক্ষমতার অধিকারী নয়, সাধারণ মানুষই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। বিলেতে তখন অধিকাংশ মানুষেরই ছিলো না সাধারণ নাগরিক অধিকার, সব অধিকার ছিলো অভিজাতমগুলির। সেটা টম পেইনের রাইট্স অফ ম্যান-এর কাল। যে-বোধ থেকে পেইন লিখেছিলেন রাইট্স অফ ম্যান, সে-বোধেই মেরি লিখেছিলেন রাইট্স অফ ওম্যান। মেরির আগেও কেউ কেউ বলেছেন নারীর ভূমিকা ও অধিকারের কথা, তবে মেরি তাঁদের মতো ক’রে বলেন নি; মেরি বলেছেন নিজের বিপ্লবী রীতিতে। তিনি কোনো পুরোনো ধারার উত্তরাধিকারী নন, তিনিই স্রষ্টা এক নতুন ধারার, যাকে এক সময় বলা হতো নারীমুক্তি আন্দোলন, এখন বলা হয় নারীবাদ। মেরি নারীর অধিকারের কথা বলতে গিয়ে তুলে ধরেন সমগ্র রাজনীতিক ও সামাজিক সংশ্রয়কে, যা নারীপুরুষের জীবনের সাফল্য সম্পর্কে তৈরি করেছে দ্বৈত মানদণ্ড, নারীকে ঠেলে দিয়েছে নিকৃষ্ট অবস্থানে, করেছে পুরুষাধীন। বিলেতে তখন নারী ছিলো পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই শোচনীয় অবস্থায় : ধর্ম, সমাজ, আইন সব কিছুই নারীকে ক’রে রেখেছিলো মনুষ্যেতর। গরিব নারীদের শেষ ছিলো না দুর্দশার, আর অভিজাত নারীরা জীবন যাপন করছিলো বিলাসী পশুর জীবন। মেরির আগে যাঁরা নারীর অবস্থাবদলের কথা বলেছেন, তাঁরা কেউ নারীর মুক্তির কথা বলেন নি; তাঁরা বলেছেন পুরুষাধীন থেকে নারীর আরেকটুকু ভালো থাকার কথা। তাঁরা সবাই প্রচার করেছেন যে পুরুষের কাছে মোহনীয়, রমণীয় হওয়াই নারীর সার্থকতা। সে-সময়ে যে-নারীরা কিছুটা ‘মুক্তি’ পেয়েছিলেন, যাঁরা ‘নীলমুজো’ নামে বদনাম অর্জন করেছিলেন, তাঁরাও প্রথাগত ধারণা থেকে দূরে যান নি; তাঁরাও বিশ্বাস করতেন নারীর সহজাত নিকৃষ্টতায়।
এ ভিন্ডিকেশন অফ দি রাইট্স্ অফ ওম্যান সুশীল ভদ্রবই বা কোনো সুশীলা ভদ্রবালার লেখা বই নয়, এটি বিপ্লবীর লেখা বিপ্লবী বই। মেরি চিত্তবিনোদন করতে বা ঘুম পাড়াতে চান নি, চেয়েছেন জাগিয়ে তুলতে। তিনি লিখতে চেয়েছেন উপকারী বই, বলেছেন, ‘আমার লক্ষ্য উপকারে আসা।’ বইটির প্রতি অনুচ্ছেদে ছড়িয়ে আছে মেরির তীব্র ব্যক্তিত্ব, তাঁর কৌতুক ও ক্রোধ জ্ব’লে উঠেছে বার বার। মেরি নারীর অধিকারের কথা বলেছেন, তবে বলেছেন প্রধানত মধ্যবিত্ত নারীর কথা। উচ্চবিত্ত নারীদের তিনি ঘেন্না ও করুণা করতেন, বিশ্বাস করতেন যে উচ্চবিত্ত শ্রেণীটি লুপ্ত হয়ে যাবে। দারিদ্র্য তাঁর চোখে মহান ছিলো না, দারিদ্র্যের নির্মমতার সাথে খুব ভালোভাবেই পরিচিত ছিলেন মেরি; তাই নিম্নবিত্তদের জন্যে তাঁর দরদের অভাব না থাকলেও কীভাবে তাদের সমস্যার সমাধান হবে, তা তিনি বলেন নি। তিনি বলেছেন মধ্যবিত্ত নারীদের কথা, কেননা তারাই রয়েছে ‘স্বাভাবিক অবস্থায়’। মেরি তাঁর বইয়ের শুরুতে, প্রথম তিন পরিচ্ছেদে, প্রতিষ্ঠা করেছেন মৌল নীতিগুলো, যার ওপর ভিত্তি ক’রে তিনি দাবি করেছেন নারীর অধিকার। তারপর তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে প্রতিবেশের প্রভাবে বিকৃত হয়েছে নারীরা; দেখিয়েছেন আঠারোশতকের নারীবিরোধী ধারার কয়েকজনের, বিশেষ ক’রে রুশোর লেখার প্রতিক্রিয়াশীলতা ও ভ্রান্তি। শেষে আলোচনা করেছেন নারীর অবস্থান, শিশুশিক্ষা, পরিবার প্রভৃতি সম্পর্কে।
মেরির লক্ষ্য ছিলো সুস্পষ্ট, বইটির প্রতি পাতায় তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে নারীপুরুষের অসাম্য মানুষের তৈরি ব্যাপার। বইয়ের শুরুতে, ভূমিকার প্রথম বাক্যেই মেরি বলেছেন :
ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে, এবং চারপাশের জগতের দিকে উদ্বিগ্ন উৎকণ্ঠায় তাকিয়ে আমার চেতনা পীড়িত হয়েছে বেদনার্ত ক্ষোভের সবচেয়ে বিষণ্ণ আবেগে, এবং আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি একথা স্বীকার ক’রে যে হয়তো প্রকৃতিই পুরুষ ও নারীর মধ্যে সৃষ্টি করেছে বড়ো বিভেদ, নয়তো পৃথিবীতে এ-পর্যন্ত যে-সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে, তা খুবই পক্ষপাতপূর্ণ।
নারীপুরুষের প্রাকৃতিক বিভেদের কথাটা তাঁর নয়, প্রথাগতদের; তিনি বিশ্বাস করেন যে সভ্যতা একদেশদর্শী, বিভেদ মানুষেরই সৃষ্টি। তিনি বেছে নিয়েছেন মধ্যবিত্ত নারীদের, বলেছেন, ‘আমি বিশেষ মনোযোগ দেবো মধ্যবিত্তদের প্রতি, কেননা তারাই সবচেয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় আছে ব’লে মনে হয়।’ তিনি তাঁর সময়ের নারীদের জানতেন ভালোভাবে, যারা পুরুষতন্ত্রের সমস্ত বাজে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলো মন দিয়ে; তিনি চান তাদের বিপরীত দৃষ্টিকোণ দেখতে, ও ভিন্ন মানুষে পরিণত করতে। মেরি বলেছেন [ভূমিকা] :
আমার লিঙ্গশ্রেণীয়রা, আশা করি, আমাকে ক্ষমা করবেন, যদি আমি তাদের রমণীয় রূপের তোষামোদ করার বদলে তাদের গণ্য করি বুদ্ধিমান প্রাণীরূপে, এবং যদি আমি মনে না করি যে তাঁরা রয়ে গেছেন চিরশৈশবে, যাঁরা নিজেরা দাঁড়াতে পারেন না।
তাঁর লিঙ্গশ্রেণীয়রা দুর্বল সব দিকে, তিনি তাদের উদ্দীপ্ত করতে চেয়েছেন, ‘যাতে তাঁরা শরীর ও মন উভয়েরই শক্তি অর্জনের চেষ্টা করেন।’ নারীর যে-অবস্থা তিনি দেখেছেন :
একমাত্র উপায়ে নারীরা পৃথিবীতে দাঁড়াতে পারে-বিয়ে ব’সে। এ-কামনা তাদের পশুতে পরিণত করে, যখন তাদের বিয়ে হয় তখন তারা এমন আচরণ করে যা শুধু শিশুদের কাছেই আশা করা যায়-তারা সাজগোজ করে, তারা রঙ মাখে।
মেরি তাঁর বইটি উৎসর্গ করেছিলেন ফরাশি রাজনীতিক নেতা ট্যালিরাঁদের নামে। পাঁচ পাতার উৎসর্গবক্তব্যে তিনি কতকগুলো দাবি জানান, বলেন, ‘আমি আমার লিঙ্গের পক্ষে দাবি করছি, নিজের জন্যে নয়।’ ফরাশি বিপ্লবের বাণী ছিলো তাঁর সমস্ত চেতনা জুড়ে, তা তিনি প্রকাশ করেছেন স্পষ্ট ভাষায় [উৎসর্গ
স্বাধীনতাকে আমি দীর্ঘ কাল ধ’রে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ধন, সব গুণের ভিত্তি ব’লে গণ্য ক’রে আসছি; আমার সব চাওয়া সংকুচিত ক’রে হ’লেও আমি নিশ্চিত করবো আমার স্বাধীনতাকে, যদি আমাকে উষর প্রান্তরে বাস করতে হয় তবুও।
একটি মৌলিক প্রশ্ন করেছেন মেরি : ‘চরম বিচারক ক’রে কে তৈরি করেছে পুরুষদের?’ তিনি দাবি করেছেন নারীপুরুষের সাম্য, যার মূলে রয়েছে তাঁর নৈতিকবোধ ও বিশ্বাস যে পীড়ন অশুভ পীড়নকারী ও পীড়িত দুয়ের জন্যেই। তিনি বলেছেন, ‘তারা সুবিধাজনক দাসী হ’তে পারে, তবে দাসত্বের বিক্রিয়া ঘটে সব সময়, তা পতিত করে প্রভুকে এবং তার শোচনীয় আশ্রিতকে।
ভিন্ডিকেশন-এর প্রথম দু-পরিচ্ছেদের নাম ‘মানুষের অধিকার ও দায়িত্ব বিবেচনা’ ও লৈঙ্গিক চরিত্র সম্পর্কে প্রচলিত মতামত বিবেচনা’। মেরি এ-দু-পরিচ্ছেদে নারী ও তার ভূমিকা সম্পর্কে প্রচলিত মত আলোচনা ক’রে দেখিয়েছেন সেগুলোর ভ্রান্তি, এবং বর্জন করেছেন সেগুলো। শতাব্দীপরম্পরায় স্বাই বলেছে ও লিখেছে বিধাতাই নারীকে তৈরি করেছে পুরুষের থেকে হীন ক’রে, নারী সহজাতভাবেই নিকৃষ্ট; একে তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন ‘বাজে কথা’ ব’লে। তাঁর কাছে মানুষের বৈশিষ্ট্য বুদ্ধি বা যুক্তিশীলতা; তিনি স্বীকার করতে রাজি নন যে বিধাতা নারীকে মানুষ হিশেবে তৈরি ক’রে তারপর কেড়ে নিয়েছে তার বুদ্ধিবিবেচনা। মেরির মতে মানুষ ও সভ্যতার অগ্রগতির বড়ো বাধা স্বেচ্ছাচারী অবৈধ ক্ষমতা, এবং ক্ষমতাসংঘগুলো ব্যক্তি ও সমাজকে পীড়ন ক’রে দূষিত ক’রে ফেলেছে। মেরি স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার চরম প্রতিপক্ষ, তিনি ঘৃণা করেন উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত ক্ষমতাকে; ভিন্ডিকেশন-এ বার বার মেরি প্রকাশ করেছেন তাঁর ঘেন্না। তিনি বলেছেন, যে-সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অন্যদের ওপর আধিপত্য করে উত্তরাধিকার- লব্ধ ধন ও ক্ষমতার মতো কৃত্রিম অধিকার দিয়ে, তারা হয়ে ওঠে তোষামোদপরায়ণ, অলস, অগ্রগতির প্রতিবন্ধক। প্রচণ্ড আক্রমণ করেছেন মেরি অভিজাততন্ত্র, সেনাবাহিনী, ও গির্জাকে, কেননা এগুলো স্বেচ্ছাচারী শক্তিসংঘ। মেরি বলেছেন, “উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত মর্যাদা, ধন, রাজত্ব থেকে উৎসারিত হয়েছে’ অশেষ দুর্দশা; এবং ‘সব ধরনের ক্ষমতাই দুর্বল মানুষদের মাতাল ক’রে তোলে; এবং এর অপব্যবহার প্রমাণ করে যে মানুষের মাঝে যতো বেশি সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজে ততো বেশি বিরাজ করবে নৈতিক উৎকর্ষ ও সুখ’।
মেরি রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, সেনাবাহিনী, পুরোহিততন্ত্রের করেছেন প্রবল সমালোচনা, কেননা এগুলো টিকে আছে উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাচারী শক্তির ওপর ভর করে। তিনি বলেছেন এসব সংস্থা যতোদিন আছে, ততোদিন অসম্ভব পরিবর্তন, তাই দরকার এসব সংস্থার বিলোপসাধন। মেরি নারীর অবস্থার একটু-আধটু উন্নতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না; নারীর অবস্থা একটু ভালো করা হ’লে, বা একদল অভিজাত নারীকে একটু ওপরে উঠোনো হ’লে সমস্যার সমাধান হবে না, তাই তিনি চেয়েছেন সার্বিক বদল। তিনি বলেছেন, সামাজিক ও আর্থ ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বদল ছাড়া সমাজের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বদল ঘটবে না। উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত ধন, ক্ষমতা সবই যুক্তি ও পরিবর্তনের প্রতিবন্ধক। সমাজের সম্পূর্ণ বদলের কথা না বলে শুধু নারীর অবস্থাবদলের কথা তাঁর কাছে ছিলো নিরর্থক, কেননা যে-স্বেচ্ছাচারী শক্তি পীড়ন করছে নারীকে, সে-শক্তিই আধিপত্য করছে সমাজের অধিকাংশ পুরুষের ওপর। মেরি বার বার চমৎকার আক্রমণ করেছেন উত্তরাধিকাপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতাকে, দেখিয়েছেন ওগুলো কীভাবে রোধ করছে মানুষের মুক্তি। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে মেরি দেখিয়েছেন পুরুষতন্ত্র নিজেদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখার জন্যে কীভাবে ভিন্ন ক’রে দিয়েছে নারীদের ভূমিকা, নারীকে দিয়েছে সাফল্যের ভিন্ন আদর্শ, ‘নিষ্পাপতা’র নামে রেখে দিয়েছে ‘অজ্ঞানতা’র মধ্যে। নারীকে কী শিক্ষা দেয়া হয়? মেরি বলেছেন :
বাল্যকাল থেকেই নারীদের বলা হয়, এবং তাদের মাদের উদাহরণ দেখিয়ে শিক্ষা দেয়া হয়, যে পুরুষের দুর্বলতা সম্বন্ধে কিছুটা জ্ঞান, যাকে ঠিকভাবে বলতে হয় চতুরতা, নম্র মেজাজ, দেখানো আনুগত্য, বালসুলভ শোভনতার প্রতি সতর্ক মনোযোগের সাহায্যেই তারা পাবে পুরুষের রক্ষণাবেক্ষণ; আর যদি রূপসী হয়, তাহলে তাদের জীবনের কমপক্ষে বিশ বছরের জন্যে আর কিছুর দরকার নেই।
এভাবেই নষ্ট ক’রে দেয়া হয়েছে নারীকে। পুরুষ নারীর মধ্যে চেয়েছে ‘নম্রতা ও মধুর আবেদনময়ী সৌন্দর্য’, নারীকে ক’রে রাখতে চেয়েছে ‘চিরশিশু’, দেয় নি তাকে বিকশিত হ’তে। নারীকে যে-শিক্ষা দেয়া হয়েছে, তা শুধু নিরর্থকই নয়, ক্ষতিকরও। মেরি বলেছেন :
আমাকে দুর্বিনীত বলতে পারেন; তবু আমি যা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি তা আমাকে বলতে হবে যে রুশো থেকে ডঃ গ্রেগরি পর্যন্ত যাঁরা নারীশিক্ষা ও ভদ্রতা সম্পর্কে লিখেছেন, তাঁরা সবাই নারীকে সাহায্য করেছেন আরো কৃত্রিম, দুর্বল চরিত্রের হয়ে উঠতে, এবং পরিণামে তাদের ক’রে তুলেছেন সমাজের আরো বেশি অপদার্থ সদস্য।
তিনি দেখিয়েছেন নারীদের দেয়া হয়েছে যে-শিক্ষা, তা তাদের পরিণত করেছে পুরুষের ভোগ্যবস্তুতে। নারীকে তার বুদ্ধির বিকাশ ঘটাতে দেয়া হয় নি, তাকে উৎসাহিত করা হয়েছে ইন্দ্রিয়ের বিকাশ ঘটাতে। মস্তিষ্কহীন নারী ও সেপাইয়ের তুলনা ক’রে মেরি বলেছেন, ‘তাদের শেখানো হয়েছে অন্যদের সন্তোষ বিধান করতে, এবং তারা বেঁচে আছে শুধু সন্তোষবিধানের জন্যে।’ রুশো ছিলেন মেরির প্রিয়, কিন্তু মেরি রুশোর নারীতত্ত্ব বাতিল ক’রে দিয়েছেন যুক্তিসম্মতভাবে। রুশো শিক্ষা দিয়েছেন নারী মুহূর্তের জন্যেও নিজেকে স্বাধীন ভাববে না, পুরুষের কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় ক’রে তোলার জন্যে নারী হবে আবেদনময়ী ছেনাল, নারী হবে পুরুষের অবসর বিনোদনের মধুর সহচরী। মেরি একে বলেছেন, ‘হোয়াট ননসেন্স!’ নারীকে যে প্রেমের কথা বেশি ক’রে শোনানো হয়, তারও বিরুদ্ধতা করেছেন মেরি, কেননা তা নারীকে দুর্বল ক’রে তোলে। নারীকে সমাজ একরাশ বাজে শিক্ষা দিয়ে যে অদ্ভুত প্রাণীতে পরিণত করেছে, মেরি তা আলোচনা ক’রে বাতিল করে দিয়েছেন। পুরুষ সম্পর্কে মেরি বলেছেন :
পুরুষকে আমি ভালোবাসি আমার সমকক্ষ সঙ্গী হিশেবে; তবে তার রাজদণ্ড, সত্য বা আরোপিত, যেনো আমার দিকে প্রসারিত না হয়, যদি না কোনো ব্যক্তির যুক্তিবুদ্ধি দাবি করে আমার শ্রদ্ধানুগত্য; এমনকি তখনো আমার আনুগত্য হবে তার বুদ্ধির কাছে, পুরুষটির কাছে নয়।
নারী এতোদিন ধ’রে পুরুষের অধীন রয়েছে ব’লেই যে নারী পুরুষের থেকে নিকৃষ্ট এটা মেরির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তারা সমান, তাই তারা পালন করবে একই মানবিক দায়িত্ব। মেরি বলেছেন, ‘আমি মেনে নিচ্ছি যে নারীর রয়েছে ভিন্ন দায়িত্ব পালনের ভার; তবে সেগুলো হবে মানবিক দায়িত্ব, এবং আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি যে সে-সব পালনের নীতিও হবে অভিন্ন।’
ভিন্ডিকেশন-এর চতুর্থ পরিচ্ছেদ ‘বিভিন্ন কারণে নারী যে-অধঃপতিত অবস্থায় পৌচেছে, সে-সম্পর্কে মন্তব্য’। মেরি বলেছেন, নারী প্রাকৃতিকভাবেই দুর্বল, না পরিস্থিতির প্রভাবে দুর্বল এটা স্পষ্ট; এবং তিনি স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন যে নারী পরিস্থিতির শিকার। মেরির মতে নারী বর্তমানকে উপভোগ করতে গিয়ে, ভবিষ্যতের কথা না ভেবে নষ্ট করেছে নিজেকে। মেরি মনে করেন ‘নারীকে শুধু পুরুষের বিনোদের জন্যে সৃষ্টি করা হয় নি, এবং তার লৈঙ্গিকতা নষ্ট ক’রে দেবে তার মানবিকতা, তা হ’তে পারে না।’ পুরুষ নারীকে ক’রে রাখতে চেয়েছে লৈঙ্গিক প্রাণী, নারীকেও শিখিয়েছে যে লৈঙ্গিক প্রাণী হওয়াই তার জন্যে ভালো। নারীকে করতে দেয়া হয় নি বুদ্ধির চর্চা, তার প্রবৃত্তিকে ক’রে তোলা হয়েছে প্রধান। মেরি বলেছেন, বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ থেকে সাধারণ সূত্র তৈরি করার শক্তিই জ্ঞান, কিন্তু নারীকে দেয়া হয় নি তার সুযোগ। পুরুষ নারীকে এ-শক্তিলাভের সুযোগ তো দেয়ই নি, বরং প্রচার করেছে যে নারীর লৈঙ্গিক স্বভাবের সাথে জ্ঞান সামঞ্জস্যহীন। মেরির মতে বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার সুযোগ না পেয়েই পতন ঘটেছে নারীর; তারা মেতে উঠেছে বা তাদের মাতিয়ে তোলা হয়েছে স্থূল ইন্দ্রিয়চর্চায়। নারীর পেশা হয়েছে বিনোদন করা, নারী ‘রূপের সার্বভৌমত্ব’কে মেনে নিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে তার স্বাধীনতাকে, এবং বোধ করেছে ‘হীনতার গৌরব’। নারীকে শেখানো হয়েছে তুচ্ছ সব ব্যাপারে গৌরব বোধ করতে। মেরি দেখিয়েছেন উপন্যাস, সঙ্গীত, কবিতা নারীকে ক’রে তুলেছে ইন্দ্রিয়াতুর প্রাণী; তারা সব কিছু অর্জন করতে চায় রূপ ও দুর্বলতা দিয়ে। তারা ভঙ্গুর হয়ে উঠেছে, তাই সব কিছুতে নির্ভর করে পুরুষের ওপর।
ভিন্ডিকেশন-এর পঞ্চম পরিচ্ছেদ ‘কয়েকজন লেখক, যাঁরা নারীকে পরিণত করেছেন করুণার পাত্রে, যা প্রায় মানহানির কাছাকাছি, তাঁদের সমালোচনা’। অসামান্য, এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী, পরিচ্ছেদ এটি; এটি নারীবাদীদের অনুপ্রাণিত ক’রে চলছে দু-শো বছর ধ’রে। এটির প্রেরণায় আধুনিক নারীবাদীরা বাতিল ক’রে দিয়েছেন সাম্প্রতিক অনেক মহাপুরুষকে, যেমন মেরি বাতিল করেছিলেন রুশো ও অন্যদের। মেরি অনুরাগী ছিলেন রুশোর, বিশ্বাসী ছিলেন তাঁর রাজনীতিক আদর্শে; কিন্তু রুশোর নারীদর্শন তাঁর কাছে মনে হয়েছে অত্যন্ত আপত্তিকর, কেননা তা নারীকে পুরুষাধীন রাখার দর্শন। উদ্ধৃতির পর উদ্ধৃতি দিয়ে মেরি বাতিল করেছেন রুশোকে, দেখিয়েছেন রুশোর প্রতিক্রিয়াশীলতা। মেরির আলোচনার পর রুশো আর রুশো থাকেন না, হয়ে ওঠেন এক বিভ্রান্ত দার্শনিক, যাঁর নারীতত্ত্ব গ্রহণ করলে মানুষের মুক্তির কথা হয়ে ওঠে হাস্যকর প্রলাপ। মেরি দেখিয়েছেন রুশো তাঁর নিজের দর্শনের করুণ শিকার; তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন উদারনীতিক আদর্শের সাথে। মেরি বলেছেন, রুশোর যেখানে দেখা উচিত ছিলো যুক্তি দিয়ে, সেখানে তিনি দেখেছেন আবেগ দিয়ে; এবং নারীকে নষ্ট করেছেন। নারী সম্পর্কে রুশোর তত্ত্বকে মেরি বলেছেন ‘পুংস্বৈরাচার’। রুশোর আদর্শ নায়িকা সোফি মেরির কাম্য নারীর সম্পূর্ণ বিপরীত। রুশো চান পুরুষনির্ভর রূপসী ছেনাল; মেরি চান স্বাধীন, চরিত্রসম্পন্ন নারী, যে আর্থিকভাবে আত্মনির্ভর। রুশোর কাছে যা রমণীয়, মেরির কাছে তা অনৈতিক ও বিপজ্জনক। রুশোর আদর্শ নারী একই সাথে নির্বোধ ছেনাল ও শোচনীয় সতী। রুশো নারীকে শিখিয়েছেন স্বামী স্ত্রীকে অন্যায়ভাবে অসতীও বললে নারী তার প্রতিবাদ করবে না; সে অভিযোগ মেনে নিয়ে থাকবে স্বামীর অনুগত। মেরির মতে এটা নারীকে সম্পূর্ণ নষ্ট করার কুশিক্ষা। মেরি রুশোকে যেমন বাতিল করেছেন তেমনই বাতিল করেছেন জেমস ফোরডাইস ও ডঃ গ্রেগরিকে। তখন খুব প্রভাবশালী ছিলো ফোরডাইসের সারমস্ টু ইয়াং উইমেন (১৭৬৫), দি ক্যারেক্টার অ্যান্ড কন্ডাক্ট অফ দি ফিমেল সেক্স (১৭৭৬), ও গ্রেগরির লেগ্যাসি টু হিজ ডটার। মেরি দেখান এঁদের ভ্রান্তি। এ ছাড়া মাদাম গেনলিসের লেটার্স অন এডুকেশন, লর্ড চেস্টারফিল্ডের লেটার্সও আলোচনা ক’রে দেখান এগুলোর অপশিক্ষা। এ-পরিচ্ছেদে মেরি পরিষ্কার করেন বিপুল আবর্জনা, যা এতোদিন চলছিলো দর্শন ও প্রাজ্ঞতার নামে।
মেরির ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ ‘চরিত্রের ওপর আবাল্যজড়িত ভাবাদর্শের প্রভাব’। মেরি প্রয়োগ করেন জন লকের মনোবিজ্ঞান, শূন্য শ্লেটতত্ত্ব, এবং দেখান নারীর চরিত্রের ওপর প্রতিবেশের প্রভাব অশেষ। রক্ষণশীলদের মতে নারী বিধির বিধানেই অধম, মেরি দেখান প্রতিবেশই নারীকে করেছে এমন। নারীর নিকৃষ্টতার মূলে নক্ষত্র নেই, তার শরীরও নেই, আছে সর্বনাশা প্রতিবেশ। বাল্যকাল থেকেই, মেরি দেখান, মাবাবা ও অভিভাবকেরা বালিকাকে শেখায় যে তাকে হ’তে হবে আদর্শ নারী; তাকে ঢালাই করা হয় শোচনীয় আদর্শ নারীর ছাঁচে। মেয়েরা দেখে তাদের সুখ নির্ভর করে তারা কতোটা পুরুষের কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে, তার ওপর। সামাজিকীকরণের ফলে তারা হয়ে ওঠে শারীরিক মানসিকভাবে দুর্বল, নির্বোধ, অন্তঃসারশূন্য, মূর্খ, চতুর, রূপসচেতন, ভাবালুতাপূর্ণ, অর্থাৎ অপদার্থ। প্রথম তারা এসব শেখে মায়ের কাছে থেকে, তারপর সারা সমাজ থেকে। তিনি মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক দু-রকম শক্তি অর্জনের কথাই বলেছেন। মেরি বলেন, ঘরকন্নাও নষ্ট করে নারীদের; ঘরকন্না তাদের এমন বিপর্যস্ত করে যে তাদের পক্ষে চিন্তা করার শক্তি ও সুযোগ থাকে না। মেয়েরা কী পড়ে? মেরি বলেছেন, সুযোগ পেলে তারা ইতিহাস, দর্শন পড়ে না, পড়ে সাধারণত উপন্যাস। না পড়ার থেকে যা-কিছু পড়াই মেরির কাছে ভালো, তবে উপন্যাস পড়া তাঁর কাছে কোনো শিক্ষাই নয়। তিনি ভাবালুতাপূর্ণ উপন্যাসের কথাই বলেছেন; ওই উপন্যাস মেয়েদের উদ্ভট কল্পরাজ্যে নিয়ে যায়, বাস্তবের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় না। ভিন্ডিকেশন-এ মেরি নারীর ভূমিকা, শিক্ষা, শিশুপালন, অর্থনীতি, কাজ, ভূমিকা- সম্প্রসারণ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন বিস্তৃতভাবে। অর্থনীতিটা ছিলো তাঁর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; তাঁর মতে জীবিকা অর্জনের সামর্থ্যই মানুষকে দেয় স্বাধীনতা, তাই যতোদি নারী আর্থ স্বাধীনতা অর্জন করবে না, ততোদিন কোনো স্বাধীনতাই অর্জন করবে না। তিনি বার বার বলেছেন নারীর আর্থস্বাধীনতার কথা।
মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের ভিন্ডিকেশন নারীমুক্তির সার্বিক প্রস্তাব; এটি থেকেই জন্ম নিয়েছে পরবর্তী বিভিন্ন ধারার নারীবাদ। তাঁর প্রস্তাব সম্পূর্ণ বিপ্লবাত্মক, এবং তিনি ছিলেন ব্যক্তিগত ও রাজনীতিকভাবে তাঁর অধিকাংশ উত্তরাধিকারীর থেকে অনেক বেশি আধুনিক, ও প্রগতিশীল। তবে মৃত্যুর পর তাঁর প্রস্তাবের থেকে তাঁর প্রথাবিরোধী জীবনই সাধারণত বিষয় হয় আলোচনা ও বিতর্কের। তিনি প্রথাগত নৈতিকতা অস্বীকার ক’রে অবিবাহিত বাস করেছেন এক পুরুষের সাথে, জন্ম দিয়েছেন তথাকথিত অবৈধ সন্তান, এটাই বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছিলো কপট রক্ষণশীলদের কাছে। মেরি সম্পূর্ণ সৎ ছিলেন, অনেক বেশি সৎ ছিলেন প্রথাগত সৎদের থেকে; এবং এখন পশ্চিম মেনে নিয়েছে মেরির জীবনরীতিকেই। উনিশশতকের নারীবাদীরা পুরুষতন্ত্রের সাথে সন্ধি ক’রেই পেতে চেয়েছিলেন অধিকার, এবং তাঁরা মেরির মতো সার্বিক পরিবর্তনে বিশ্বাস করেন নি। তাঁরা পেতে চেয়েছিলেন একটু-আধটু সুবিধা, আর ভোটাধিকার। পুরুষতন্ত্রের সাথে সন্ধিপাতানো নারীবাদীরা আচরণ করেছেন অবলা সতীসাধ্বীর মতো; যাতে পুরুষেরা রেগে উঠতে পারে, তা থেকেই সুশীলা কুলবালার মতো সরিয়ে নিয়েছিলেন নিজেদের। তাঁরা জোসেফিন বাটলারকে অস্বীকার করেন, যখন তিনি পতিতাদের পক্ষে কথা বলেন (১৮৬৪); তাঁরা এলিজাবেথ স্ট্যান্টনকে অস্বীকার করেন, যখন তিনি নারীর বাইবেল (১৮৯৫, ১৮৯৮) লেখেন; তাঁরা অ্যানি বেসান্টকে অস্বীকার করেন, যখন তিনি জন্মনিয়ন্ত্রণের কথা বলেন। তবে সুশীলা নারীবাদীরা পুরুষতন্ত্রের কাছ থেকে বিশেষ কিছু আদায় করতে পারে নি, ভোটাধিকারও নয়; তখনই পুরুষতন্ত্র নারীবাদীদের দাবি মেনেছে যখন দেখা দিয়েছেন কোনো অশীল নারীবাদী। মেরিকে ও তাঁরা অস্বীকার ক’রে চলতে চেয়েছেন, তবে মেরি তাঁদের চেতনায় থেকেছেন সব সময়ই, এবং তাঁর বইটির বেরিয়েছে নানা সংস্করণ। মেরি পুরুষবিদ্বেষী ছিলেন না, পুরুষ তাঁর ছিলো খুবই পছন্দ; তিনি চেয়েছিলেন সমানাধিকার। তিনি অবাধ কামেও বিশ্বাসী ছিলেন না, তিনি যে-দুটি পুরুষের সাথে শারীরিকভাবে মিলেছেন, তাঁদের তিনি ভালোবেসেছিলেন। মেরি, নারীবাদের জননী, ছিলেন আদর্শ জননী; অগ্নিশিখা ও অশ্রুবিন্দুর সমবায়, যিনি আজো তীব্র, জীবন্ত, এবং প্রেরণার অশেষ উৎস।