বাঙলা ভাষাতত্ত্ব
ভূমিকা।। বাঙলা ভাষা এক হাজার বছরেরও বেশি বয়স্ক, কিন্তু বাঙলা ভাষাতত্ত্বের বয়স মাত্র দু-শো চল্লিশ বছর (১৭৪৩-১৯৮৩)। ভাষাতত্ত্বের অসামান্য বিকাশ ঘটেছিলো ধ্রুপদী ভারতে, তবে ওই ভাষাতাত্ত্বিক ঐতিহ্য কোনো সহায়তা করে নি বাঙলা ভাষাতত্ত্বের উন্মেষে; বরং, মনে হয়, সংস্কৃতনিষ্ঠ ভারতীয় ভাষাতাত্ত্বিক ঐতিহ্য অনেকটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো বাঙলা ভাষাতত্ত্বের উদ্ভবে। পাণিনির পরে সংস্কৃত ভাষাতাত্ত্বিকদের নতুন কিছু করার ছিলো না;- তখন তাঁদের নিয়তি হ’য়ে ওঠে ধ্রুপদী ব্যাকরণগ্রন্থের ভাষ্য আর উপভাষ্য রচনা, ও লোকান্তরিত সংস্কৃতের ঠাণ্ডাশীতল সূত্র পর্যালোচনা। আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলোর উদ্ভবের পরেও যে-ব্যাকরণবিদ-সম্প্রদায় নিষ্ঠার সাথে পুনরাবৃত্তি ক’রে চলেছিলেন প্রাচীন ভারতীয় ব্যাকরণ, তাঁদের চোখে শ্রদ্ধেয় ছিলো না ওই অশীল প্রাকৃতটি, যার নাম বাঙলা। ওই ভাষা অসংস্কৃত প্রাকৃত মানুষের, তাতে লিপিবদ্ধ হয় নি কোনো পুণ্যশ্লোক; তাই ওই ভাষা আকৃষ্ট করতে পারে না কোনো ব্রাহ্মণ বৈয়াকরণকে। বাঙলা ভাষাতত্ত্বের সূচনা ঘটে বাঙলা ভাষার উন্মেষের আটশো বছর পর; আর ওই সূচনাকারী কোনো বাঙালি বা ভারতীয় নন। বাঙলা ভাষাতত্ত্বের সূচনাকারী একজন বিদেশি, পর্তুগিজ, ধর্মযাজক : মানোএল দা আস্সুম্পসাঁউ। তিনি বাঙালি সহকারীদের সাহায্য, উপাত্তসংগ্রহে, পেয়েছিলেন ও নিয়েছিলেন প্রচুর; কিন্তু তাতে তাঁর মহিমা ম্লান হয় না সামান্যও। পাদ্রি মানোএল দা আস্সুম্পসাঁউ বাঙলা ভাষাতত্ত্বের প্রথম পুরুষ- এ-গৌরবের তিনি উজ্জ্বল অধিকারী। ঢাকার ভাওয়ালে, ১৭৩৪ খ্রিস্টীয় অব্দে, তিনি রচনা করেন বাঙলা ভাষার প্রথম শব্দকোষ ও খণ্ডিত ব্যাকরণ, যা ভোকাবুলারিও এম ইদিওমা বেনগল্লা, ই পোর্তুগিজ : দিভিদিদো এম দুয়াস পার্তেস নামে লিসবন থেকে বেরোয় ১৭৪৩ অব্দে। বইটি নানা কারণে উল্লেখযোগ্য ও অবিস্মরণীয় : এটি বাঙলা ভাষাতত্ত্বের সূচনাগ্রন্থ, রচিত হয়েছিলো পর্তুগিজ ও বাঙলা ভাষায়, বাঙলা এতে লিপিবদ্ধ হয়েছিলো রোমান বর্ণমালায়, এটি থেকে গেছে নিঃসঙ্গ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো– এগুলো এর উল্লেখযোগ্যতা অবিস্মরণীয়তার বড়ো কারণ নিঃসন্দেহে; তবে এটি গুরুত্বপূর্ণ আরো একটি তা ৎপর্যমণ্ডিত কারণে যে আসুম্পসাঁউ ব্যাকরণ রচনা ক’রে সূচনা করেন নি বাঙলা ভাষাতত্ত্বের, যদিও একটি খণ্ডিত ব্যাকরণ তিনি জড়িয়ে দিয়েছেন এর সাথে;-তিনি বাঙলা ভাষাতত্ত্বের সূচনা করেছিলেন অভিধান সংকলনের মাধ্যমে। অর্থাৎ বাঙলা ভাষার ধ্বনির বা শব্দের বা বাক্যের- আভ্যন্তর সূত্র উদ্ঘাটনের প্রয়াস থেকে জন্মে নি বাঙলা ভাষাতত্ত্ব; জন্ম নিয়েছে বাঙলা ভাষার শব্দরাশির অর্থকে বশ করার বাসনা থেকে। বাঙলা ভাষার পূর্ণরূপ আয়ত্তের কোনো অভিলাষ বা দুরঅভিলাষ পোষেণ নি বাঙলা ভাষার প্রথম ভাষ্যকার, ও তাঁর অব্যবহিত-পরবর্তীরা; তাই দেখা যায় উনিশ শতকে যখন বাঙলা ভাষাতত্ত্বের চর্চা পুরোদমে শুরু হ’য়ে যায়, তখন সংকলিত প্রকাশিত হ’তে থাকে, দশকেদশকে, অভিধানের পর অভিধান।
আঠারোশতকের চল্লিশের দশকে আসুম্পসাঁউর শব্দকোষ ও ব্যাকরণ বেরোলেও তা থেকে গিয়েছিলো এক ধর্মগোত্রের গ্রন্থরূপে। বাঙালি জীবনে ও সমাজে তার প্রবেশ ঘটে নি; আঠারো শতকের কোনো বাঙালি এর জন্যে যে কোনো আগ্রহ প্রকাশ করে নি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটি একটি বন্ধ্যাগ্রন্থ- এর থেকে উৎসারিত হয় নি অন্য কোনো গ্রন্থ, বা এটি সৃষ্টি করে নি বাঙলা ভাষাবিশ্লেষণের কোনো ধারা– এটি থেকে গেছে বিদেশিদের ভেতরে, এক ধর্মগোত্রের অভ্যন্তরে, ভাষাতত্ত্ব-চর্যাপদরূপে। আস্সুম্পসাঁউর শব্দকোষ ও ব্যাকরণ প্রকাশের তিন দশক পর, ১৭৭৮-এ, হুগলি থেকে প্রকাশিত হয় ন্যাথনিয়েল ব্র্যাসি হালহেডের বিশেষ-কারণে-বিখ্যাত ব্যাকরণ এ গ্রামার অফ দি বেংগল ল্যাংগুয়েজ। এ-ব্যাকরণ বইটি বিখ্যাত হয়ে আছে এক অব্যাকরণিক কারণে : এ-বইয়ের জন্যেই প্রথম ধাতুতে ঢালাই করা হয়েছিলো বাঙলা বর্ণমালা, যাতে মুদ্রিত হয়েছিলো বাঙলা উদাহরণগুচ্ছ। ১৭৮৮তে লণ্ডনে মুদ্রিত হয় নাম-না-জানা কোনো এক সংকলকের দি ইন্ডিডয়ান ভোকাবুলারি;- এতে সংগৃহীত হয়েছিলো দেড় হাজারের মতো বাঙলা শব্দ। ১৭৯৩-এ আপজন মুদ্রাকর ও প্রকাশকরূপে প্রকাশ করেন ইঙ্গরাজি ও বাঙ্গালি বোকেবিলরি নামক এক শব্দকোষ। ১৭৯৯ অব্দে প্রকাশিত হয় হেনরি পিস্ ফরস্টারের এ ভোকাবুলারি, ইন টু পার্টস, ইংলিশ অ্যাণ্ড বোংগালি অ্যাণ্ড ভাইস ভার্সা নামক বিশাল অভিধানের প্রথম খণ্ড। আঠারোশতকের বাঙলা ভাষাতত্ত্ব সম্পূর্ণ এ-পাঁচটি গ্রন্থে : ধর্মীয় ও ভাষিক আগ্রহে পাঁচজন বিদেশি বিচ্ছিন্নভাবে চর্চা করেন বাঙলা ভাষাতত্ত্বের, যাঁদের তিনজন রুদ্ধ স্রোতের মতো থেকে যান আঠারোশতকেই; আর দু-জন- হালহেড ও ফরস্টার- সৃষ্টি করেন বাঙলা ভাষাতত্ত্বের এক বহমান ধারা, যা ব’য়ে চলে উনিশ থেকে বিশশতকে। পিস্ ফরস্টার ব্যক্তিগতভাবে সাঁকো বেঁধে দিয়েছিলেন আঠারো ও উনিশশতকের মধ্যে– খ্রিস্টীয় ১৮০২ অব্দে তাঁর অভিধানের দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ ক’রে। হালহেডের ব্যাকরণও বন্ধ্যা ছিলো না; এটি উৎসাহিত করে পরবর্তীদের, যাঁরা এ-ব্যাকরণ থেকে আহরণ করেছেন প্রেরণা-উপাত্ত-ব্যাখ্যা। হালহেডের ব্যাকরণ ও ফরস্টারের অভিধান আঠারোশতকি বাঙলা ভাষাতত্ত্বের ছিন্নবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টাকে একটি মিলিত স্রোতরূপে বইয়ে দেয় উনিশশতকে-রচিত হ’তে থাকে ব্যাকরণপুস্তক, সংকলিত হ’তে থাকে অভিধান, শব্দকোষ এবং রূপ নিতে ও সুস্থিত হতে থাকে এক মান বাঙলা ভাষা।
উনিশশতকের শুরুতে আবির্ভাব ঘটে সুপরিকল্পিত-সচেতন বাঙলা গদ্যের;- কর্মী উনিশশতকের প্রথমার্ধে চতুর্দিকে সক্রিয় হ’য়ে ওঠে কর্মী গদ্য; আর বাঙলা ভাষা একটি আঞ্চলিক বা বহু-আঞ্চলিক ভাষা থেকে পরিণত হ’তে থাকে একটি প্রধান ভারতীয় ভাষায়- স্থির-সুস্থিত হ’তে থাকে তার লেখ্য ও কথ্য মানরূপ। পাঠ্যপুস্তকে, বিতর্কে, সাময়িকপত্রে বিকশিত হ’তে থাকে বাঙলা ভাষা ও তার গদ্যরূপ; বিভিন্ন লেখকের বহুমুখি প্রতিভা বিভিন্ন আঞ্চলিক, কথ্য ও লিখিত রূপের ভেতর থেকে ছেঁকে তুলতে থাকে তার মানরূপ। এর সাথে ঘনিষ্ঠ জড়িত থেকে বিকশিত হ’তে থাকে বাঙলা ভাষাতত্ত্ব। সংকলিত হ’তে থাকে দ্বিভাষিক, বহুভাষিক, ও একভাষিক অভিধান; রচিত হ’তে থাকে বাঙলা ভাষার ব্যাকরণ- কখনো প্রথাগত ইংরেজি ব্যাকরণের অনুকরণে কখনো সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রায়-অবিকল কাঠামোতে; গ্রন্থেগ্রন্থে ও পত্রপত্রিকায় আবির্ভূত হ’তে থাকে অভিনব ও অভূতপূর্ব শব্দ, ও রচিত হ’তে থাকে আধুনিক জ্ঞানচর্চার ভাষা ও পরিভাষা, এবং বাঙলা বাক্যকাঠামো একবার এদিকে আরেকবার সেদিকে বেঁকে আয়ত্ত করতে থাকে তার নিজস্ব সংগঠন। আঠারোশতকি বাঙলা ভাষাতত্ত্ব একান্তভাবেই বিদেশিদের শাস্ত্র; উনিশশতকে বিদেশিদের সাথে যোগ দেন বাঙলা ভাষা-উৎসাহী বাঙালি অভিধানপ্রণেতা ও ব্যাকরণরচয়িতাগণ; এবং বাঙলা ভাষা বর্ণিত-বিশ্লেষিত হ’তে থাকে দেশি ও বিদেশি বোধি ও প্রথা অনুসারে। বাঙলা ভাষার আদি ভাষাতাত্ত্বিকেরা অবশ্য কোনো সচেতন ও সুপরিকল্পিত তত্ত্ব অবলম্বন ক’রে বাঙলা বর্ণনা-ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণে উদ্যোগী হন নি; নিজেদের দশকের প্রয়োজন মেটানোর জন্যেই তাঁরা সংকলন করেন অভিধান, রচনা করেন ব্যাকরণপুস্তক। প্রথম পর্যায়ের বাঙলা ভাষাতাত্ত্বিকদের উদ্দেশ্য ছিলো বিদেশি শাসকদের বাঙলা শেখানো- তাদের সামনে অভিধানপ্রণেতা ও ব্যাকরণরচয়িতা উপস্থিত করেছেন নানারকম শব্দ ও বিচিত্র ব্যাকরণিক সূত্র;- বাঙলা ভাষার বিজ্ঞানসন্মত বর্ণনার ওপর গুরুত্ব দেয়ার কথা ভাবার সুযোগই হয় নি তাঁদের। অভিধানপ্রণেতারা তখন সংকলন করেন বিচিত্র ধরনের শব্দ, যার একটি বড়ো অংশ সম্ভবত কোনোদিন কারো প্রয়োজনে পড়ে নি; আর ব্যাকরণরচয়িতারা পাতায় পাতায় বিপদগ্রস্ত হন ‘বিশৃঙ্খল’ বাঙলা ভাষাকে শাসন ও সুশৃঙ্খল করতে যেয়ে। উনিশশতকী বাঙলা ভাষাতাত্ত্বিকেরা, দশম দশকের মধ্যভাগে সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত, সব এলাকাতেই ছিলেন প্রথাগত ও আনুশাসনিক : অভিধান-ব্যাকরণ প্রণয়নের সময় তাঁরা মেনে চলেছেন সংস্কৃত, ইংরেজি এমনকি লাতিন অভিধান-ব্যাকরণের আদর্শ, এবং বিভিন্ন রকম অনুশাসনে সমৃদ্ধ করেছেন গ্রন্থ। ইউরোপে উনিশশতকে উদ্ভব ঘটে তুলনামূলক-কালানুক্রমিক ভাষাতত্ত্বের; কিন্তু ওই ভাষাতত্ত্বের তত্ত্বপ্রণালিপদ্ধতির প্রভাব পড়ে নি বাঙলা ভাষাতাত্ত্বিকদের ওপর। উনিশশতকের শেষ দশকে তুলনামূলক- কালানুক্রমিক পদ্ধতির কিছুটা প্রয়োগ দেখা যায় সবার আগে রবীন্দ্রনাথের বাঙলা ভাষাবিষয়ক রচনায়। উনিশশতকের প্রথম ন-দশক ভ’রে বাঙলা ভাষাতাত্ত্বিকেরা প্রধানত রচনা করেন প্রথাগত-আনুশাসনিক অভিধান ও ব্যাকরণ; এবং গৌণত লিপ্ত হন বিশুদ্ধ বাঙলার শুদ্ধরূপবিষয়ক কলহে, সাধু-চলতির বিতর্কে; কিন্তু মোটামোটিভাবে এগোতে থাকেন তাঁরা প্রথাসম্মত পথ ধ’রেই যতোদিন না প্রকাশিত হয় বঙ্গীয়-সাহিত্য- পরিষদের অদ্বিতীয় গবেষণাপত্রিকা বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা (১৩০১ : ১৮৯৪)। উনিশশতকের প্রথম ন-দশকের অভিধানপ্রণেতাদের মধ্যে আছেন পীতাম্বর মুখোপাধ্যায় (১৮০৯), মোহনপ্রসাদ ঠাকুর (১৮১০), উইলিয়ম কেরি (১৮১৫), জন মেন্ডিস (১৮২২), তারাচাঁদ চক্রবর্তী (১৮২৭), জন মার্শম্যান (১৮২৭), উইলিয়ম মর্টন (১৮২৮), গ্রেভস চেম্বার্স হটন (১৮৩৩), রামকমল সেন (১৮৩৪), জগন্নাথপ্রসাদ মল্লিক (১২৩৮), জয়গোপাল তর্কালঙ্কার (১২৪৫), তারাচন্দ্র শর্মা (১২৪৫), নীলকমল মুস্তোফী (১২৪৫), জগন্নারায়ণ মুখোপাধ্যায় (১৮৩৮), হলধর ন্যায়রত্ন (১২৪৬), কাশীনাথ ভট্টাচার্য (১২৬২), কেশবচন্দ্র রায় (১২৬৮), গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন (১২৬৮), দিগম্বর ভট্টাচার্য (১৮৫২), মথুরানাথ তর্করত্ন (১৮৬২), বেণীমাধব দেবদাস (১৮৬৪), রামকমল বিদ্যালঙ্কার (১৮৬৬), শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায় (১২৭১); এবং ব্যাকরণরচয়িতাদের মধ্যে আছেন উইলিয়ম কেরি (১৮০১), গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য (১৮১৬), উইলিয়ম ইয়েটস (১৮২০), গ্রেভস চেম্বার্স হটন (১৮২১), রামমোহন রায় (১৮২৬, ১৮৩৩) দেবীপ্রসাদ রায় (১৮৪১), সিটন কার (১৮৪৯), শ্যামাচরণ সরকার (১৮৫০), রাজেন্দ্রলাল মিত্র (১৮৬২) জন বীম্স্ (১৮৭২), কেদারনাথ তর্করত্ন (১৮৭৮), নিত্যানন্দ চক্রবর্তী (১৮৭৮), নীলমণি মুখোপাধ্যায় (১৮৭৮), প্রসন্নচন্দ্ৰ বিদ্যারত্ন (১৮৮৪)।
উনিশশতকের দশম দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত প্রথাগত-আনুশাসনিক রীতিতেই রচিত হ’তে থাকে বাঙলা অভিধান ও ব্যাকরণ; এবং শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগের শুরু থেকে বিতর্ক শুরু হয় বাঙলা ভাষায় সংস্কৃত ও খাঁটি বাঙলা শব্দের প্রয়োগের আনুপাতিক হার সম্পর্কে। তখনো বাঙলা অনেকের কাছে প্রাকৃত ভাষা মাত্র; কারো কাছে এটি সংস্কৃতেরই একটি বিকারগ্রস্ত রূপ; এবং ভবিষ্যৎমুখি একগোত্রের কাছে এটি একটি নতুন, স্বাধীন, স্বায়ত্ত- শাসিত ভাষা, যার শারীর উপাদান যেমন ভিন্ন সংস্কৃত থেকে, তেমনি ভিন্ন তার আন্তর প্রকৃতিও আভ্যন্তর সূত্র। তবু নতুন দৃষ্টিতে কেউ বাঙলা ভাষা বর্ণনাবিশ্লেষণের উদ্যোগ নেন নি উনিশশতকের শেষ দশকের শেষাংশের আগে। ১৩০১ বাঙলা অব্দে প্রকাশিত হয় বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা; এবং বাঙলা ভাষাতত্ত্বচর্চার ঘটে যুগান্তর। বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদের উদ্যোগে বাঙলা ভাষা-উৎসাহীরা, যাঁদের কেউই বিশুদ্ধ ভাষাতাত্ত্বিক নন কিন্তু আন্তরিকভাবে ভাষানুরাগী, পরিণত হন ভাষাতাত্ত্বিকে; এবং তাঁদের হাতে রচিত হ’তে থাকে বাঙলা ভাষার বহুমুখি ও অভিনব বর্ণনাবিশ্লেষণব্যাখ্যা। ১৩০১ থেকে নিয়মিতভাবে বেরোতে থাকে সাহিত্য-পরিষদ-পত্রিকা, আর এটি আশ্রয় ক’রে গ’ড়ে ওঠে বাঙলা ভাষাতাত্ত্বিকদের এক নব্যগোত্র। জর্মান তুলনামূলক- কালানুক্রমিক ভাষাতত্ত্বে যেমন উদ্ভূত হয়েছিলেন ‘ইয়ুংগ্রাম্মাতিকার’ বা ‘নবব্যাকরণ- বিদগণ’, তেমন কোনো গোত্র পাওয়া যাবে না প্রায় আড়াই শো বছর বয়স্ক বাঙলা ভাষাতত্ত্বের ইতিহাসে; কিন্তু সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা কেন্দ্র ক’রে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন নতুন দৃষ্টিঋদ্ধ এমন একগোত্র বাঙলা ভাষাতাত্ত্বিক, যাঁদের ‘নবব্যাকরণবিদ’ অভিধা দিলে অতিশয়োক্তি করা হয় না। সাহিত্য-পরিষদের মুখপত্রটি একান্তভাবে ভাষাতাত্ত্বিক পত্রিকা ছিলো না, কিন্তু বাঙলা ভাষা বর্ণনাবিশ্লেষণে এটি দিয়েছিলো ব্যাপক-গভীর-আন্তরিক মনোযোগ। বাঙলা ভাষার ধ্বনি, রূপ, বাঙলা ব্যাকরণকাঠামো, পরিভাষা, আঞ্চলিক উপভাষা প্রভৃতি বিষয়ে এটিতে প্রকাশিত হয়েছিলো প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ রচনা। বঙ্গীয়-সাহিত্য- পরিষদের উৎসাহ ছিলো ‘খাঁটি বাঙলা’ ভাষার ব্যাকরণ রচনার; তাই সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকায় বেরোয় এমন সব অভিনব রচনা, যাতে বাঙলা ভাষাকে নিশ্চিতভাবে স্বীকার ক’রে নেয়া হয় এক স্বতন্ত্র-স্বাধীন-স্বায়ত্তশাসিত ভাষারূপে; এবং তাকে বর্ণনার জন্যে দাবি কারা হয় সংস্কৃত থেকে স্বতন্ত্র এক ব্যাকরণ-কাঠামো। তবে এ-সময়ে সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ভারতী ও অন্যান্য পত্রিকায় চোখে পড়ে পুরোনোপন্থীদের একটি লঘু গোত্রও, যাঁদের চোখে বাঙলা স্বতন্ত্র ভাষা নয়, ‘সংস্কৃতেরই কথিতাকার’ মাত্র। বাঙলা তাঁদের কাছে সতী সংস্কৃতের অসতী আত্মজা;– তাঁরা বাঙলাকে সৎ পথে ফিরিয়ে আনার জন্যে বাঙলার ওপর আরোপ করতে চান সংস্কৃত ব্যাকরণের বিপুল বিধিবিধান। তাই উনিশশতকের শেষ দশকের দ্বিতীয়াংশে ও বিশশতকের প্রথম দশকে পাই বাঙলা ভাষাতাত্ত্বিক বা ব্যাকরণবিদদের দুটি গোত্র : একটি বাঙলা ভাষা ও ব্যাকরণের স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাসী, অপরটি বিশ্বাসী সংস্কৃতের আধিপত্যে। প্রথম বা বাঙলাপন্থী গোত্রে ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বিধুশেখর ভট্টাচার্য, যোগেশচন্দ্র রায়; আর দ্বিতীয় বা সংস্কৃতপন্থী গোত্রে ছিলেন শরচ্চন্দ্র শাস্ত্রী, সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ, শ্রীনাথ সেন ও অন্যান্য। ১৩০১-১৩৩০ সময়ের মধ্যে না-অতি আধুনিক না-প্রথাগত রীতিতে বাঙলা ভাষা সম্পর্কে যতো প্রবন্ধ বেরোয়, তার অধিকাংশই বেরোয় সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা য়। এ-সময়ের আরো কিছু পত্রপত্রিকা- ভারতী, সাহিত্য, ও প্রবাসী তে বেরিয়েছে বাঙলা ভাষার শৃঙ্খলাবিষয়ক নানারকম নিবন্ধ।
বিশশতকের তৃতীয় দশকের মধ্যভাগ থেকে ষষ্ঠ দশকের শেষ বছর পর্যন্ত সময়কে বলতে পারি ‘কালানুক্রমিক ভাষাতত্ত্বের কাল’। উনিশশতকের শেষ দশকে, সাহিত্য- পরিষৎ-পত্রিকা অবলম্বন করে, যে-বর্ণনামূলক বাঙলা ভাষাতত্ত্বের উদ্ভব ঘটে, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর যে-ভাবে বিশ্লেষণ করেন বাঙলা উপসর্গ, যে-ভাবে বাঙলা শব্দতত্ত্ব বর্ণনাবিশ্লেষণ করেন রবীন্দ্রনাথ, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী যে-বর্ণনামূলক দৃষ্টি আয়ত্ত করেন বাঙলা কারকব্যাখ্যায়, ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যে-ভাবে উদঘটান করতে চেষ্টা করেন বাঙলা শব্দগঠনের অ-সংস্কৃত সূত্র, তা বিস্ময়করভাবে স্তব্ধ হ’য়ে পড়ে। বিশশতকের প্রথম-দ্বিতীয় দশকে আবিষ্কৃত প্রকাশিত হয় হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা (১৩২৩ : ১৯১৬) ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন (১৩২৩ : ১৯১৬); এবং বাঙালি ভাষাবিদেরা বাঙলা ভাষার সমকালীন অবস্থা থেকে চোখ সরিয়ে সমস্ত দৃষ্টি ও মনোযোগ নিবদ্ধ করেন বিলুপ্ত অতীতের ওপর। তৃতীয় দশকে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৯২৬), ও মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৯২৮) লণ্ডন-প্যারিস থেকে আয়ত্ত ক’রে আসেন কালানুক্রমিক-তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব, উদ্ধার করেন বাঙলা ভাষার লুপ্ত অতীতের অনেক অংশ, এবং বাঙলা ভাষার ইতিহাস রচনা ও বিভিন্ন শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয়ে কেটে যায় কয়েক দশক। সুনীতিকুমার, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ও সুকুমার সেন বাঙলা ভাষা ও শব্দের ইতিহাস অনেকটা আলোকিত করেন; এবং এমন একটি ধারণার সৃষ্টি হয় বাঙলা ভাষা-অঞ্চলে যে ভাষার বিবর্তন বর্ণনাই ভাষাতত্ত্ব। এ-সময়ে বাঙলা ভাষা সম্পর্কে বর্ণনামূলক কাজ বিশেষ হয় নি, যা হয়েছে তার ওপরও অপ্রতিরোধ্য প্রভাব ফেলেছে ইতিহাস। আমাদের কালানুক্রমিক ভাষাতাত্ত্বিকেরা যখন বাঙলা ভাষার ব্যাকরণ লিখেছেন, তখন তাঁরা স’রে যেতে পারেন নি প্রথাগত পথ থেকে : তাঁরা অনুসরণ করেছেন প্রথাগত ইংরেজি ও সংস্কৃত ব্যাকরণপ্রণেতাদের; এবং কালানুক্রমিক উপাত্তের সাহায্য নিয়েছেন সমকালীন বাঙলা ভাষা ব্যাখ্যা-বর্ণনায়।
বিশশতকের দ্বিতীয়দশকে পশ্চিমে উদ্ভব ঘটে সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানের (দ্র বোয়াস (১৯১১), সোস্যুর (১৯১৫), স্যাপির (১৯২১), ব্লুমফিল্ড (১৯৩৩), হ্যারিস (১৯৫১))। মেমোআর স্যুর ল্য সিস্তেম প্রিমিতিফ দে ভোআইএল দঁও লে লঁগ অ্যাদো-এওরোপেআন (১৮৭৯) নামক কালানুক্রমিক ভাষাতত্ত্বের একটি স্তম্ভগ্রন্থের রচয়িতা ফেদিন দ্য সোস্যুর ক্রমশ স’রে আসেন কালানুক্রমিক-তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব থেকে, গুরুত্ব আরোপ করেন ভাষার সমকালীন অবস্থার বর্ণনার ওপর, এবং দাবি করেন যে কালানুক্রমিক ভাষাতত্ত্ব পরিহার ক’রে গ্রহণ করতে হবে কালকেন্দ্রিক ভাষাতত্ত্ব- বিশেষ ভাষার বিশেষ কালের বিশেষ অবস্থার বর্ণনাকে। তাঁর তত্ত্ব থেকে উৎসারিত হয়- আমেরিকায় ও ইউরোপে- ভাষাতত্ত্বের কয়েকটি ধারা : মার্কিন ধারা [স্যাপির, ব্লুমফিল্ড, হ্যারিস] (খ) প্রাগ ধারা [ত্রবেস্কয়, ইয়াকবসন], (গ) কোপেনহেগেন ধারা [হিএলমশ্লেভ], (ঘ) জেনেভা ধারা [বালি, ফ্রেই], (ঙ) মস্কো ধারা [আভানেসভ, কুজনেকভ, সিদোরোভ], ও (চ) লণ্ডন ধারা [ফার্থ, হ্যাঁলিডে]। এ-ধারাগুলোর মধ্যে তাত্ত্বিক ও প্রণালিগত ভিন্নতা রয়েছে অনেক, কিন্তু প্রতিটি ধারাই জোর দিয়েছে ভাষার বিশেষ অবস্থার নিরাসক্ত রৌপ বর্ণনার ওপর। বিশশতকের প্রথমার্ধ, পাশ্চাত্যে, সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানের কাল; কিন্তু আমাদের দেশে ওই সময়টি কাটে কালানুক্রমিক ভাষাতত্ত্বের চর্চায়। বাঙলাদেশে বিজ্ঞানমনস্ক ভাষাতত্ত্বের চর্চা শুরু হয় পঞ্চাশ-দশকের দ্বিতীয়াংশে– প্রধানত মুহম্মদ আবদুল হাই সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা (প্রথম প্রকাশ : ১৯৫৭), ও বাংলা একাডেমী পত্রিকা (প্রথম প্রকাশ : ১৯৫৭) অবলম্বন ক’রে। লণ্ডন ধারার বর্ণনামূলক ধ্বনিতত্ত্বে শিক্ষিত মুহম্মদ আবদুল হাই তাঁর বাঙলা ধ্বনিতত্ত্ববিষয়ক প্রবন্ধাবলির সাহায্যে বাঙলাদেশে সূচনা করেন বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের; এবং এমন একটি ধারণা সৃষ্টি করতে সমর্থ হন যে ধ্বনিবিজ্ঞানই ভাষাবিজ্ঞান। তিনি তরুণতরদের উৎসাহীও ক’রে তুলেছিলেন ধ্বনিবিজ্ঞান আয়ত্ত করতে; তাই দেখা যায় ষাট দশকে যাঁরাই ভাষাশাস্ত্র অধ্যয়নে বিদেশে যান, তাঁরাই ধ্বনিতাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন ক’রে ফিরে আসেন। কিন্তু মুহম্মদ আবদুল হাই ব্যতীত আর কেউ বাঙলা ধ্বনিবর্ণনায় ব্যাপক ও নিরন্তর উৎসাহ দেখান নি।
বাঙলা ভাষাতাত্ত্বিক রচনাবলি রচিত হয়েছে, প্রধানত, দুটি ভাষায়- বাঙলা ও ইংরেজিতে। আসুম্পসাঁউর শব্দকোষ-ব্যাকরণ রচিত হয়েছিলো পর্তুগিজ ভাষায়; এ ছাড়া রুশ, জর্মান, ফরাশি ভাষায়ও রচিত হয়েছে কিছু রচনা;- কিন্তু সেগুলো বিচ্ছিন্ন র’য়ে গেছে মূল বাঙলা ভাষাতত্ত্ব ধারা থেকে। বাঙলা ভাষাতত্ত্বের সূচনায়ই ব্যবহৃত হয়েছিলো বিদেশি ভাষা– পর্তুগিজ; এরপর ইংরেজ অভিধান-ও ব্যাকরণ-প্রণেতাগণ বাঙলা ভাষা বর্ণনাবিশ্লেষণ করেন ইংরেজিতেই। উনিশশতকে বাঙালি ব্যাকরণপ্রণেতারা বিদেশিদের জন্যে ইংরেজিতে, আর বাঙালিদের জন্যে বাঙলায় রচনা করেন বাঙলা ব্যাকরণ-অভিধান। উনিশশতকের শেষ ও বিশশতকের প্রথম দশকের নবব্যাকরণবিদেরা বাঙলা ভাষাকেই গ্রহণ করেছিলেন বাঙলা বর্ণনা ব্যাখ্যার ভাষারূপে– ইংরেজিতে বাঙলা গবেষণার উৎসাহ ও দরকার তাঁদের ছিলো না। কিন্তু বিশশতকে শুরু হ’য়ে যায় পেশাগত গবেষণার শতাব্দী:- অন্যান্য শাস্ত্রীদের মতো ভাষাশাস্ত্রীরাও শুরু করেন বিদেশযাত্রা এবং বাঙলা ভাষাতত্ত্বের মুখ্য ভাষা হ’য়ে ওঠে ইংরেজি। বাঙলা ভাষাবিষয়ক গবেষণাগ্রন্থমাত্রই রচিত ইংরেজিতে, যেহেতু আমাদের ভাষাবিজ্ঞানীদের গবেষণাস্থল ইউরোপ-আমেরিকা, যদিও উপাত্ত বাঙলা ভাষা। বাঙলা ভাষাবিজ্ঞানীরা বিদেশে রচিত গবেষণাগ্রন্থে যতোটা পরিশ্রমী আন্তরিক সনিষ্ঠ, পরবর্তী রচনায় সাধারণত ততোটা নন; তাই বাঙলা ভাষাবিষয়ক অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থই, ইংরেজিতে রচিত-অপ্রকাশিত ব’লে, দূরে থেকে গেছে আমাদের থেকে। এ-গ্রন্থগুলো যদি রচিত হতো বাঙলা ভাষায়, তবে গ’ড়ে উঠতে পারতো বেশ শক্তিশালী বাঙলা ভাষাতাত্ত্বিক ধারা:- তা হয় নি ব’লে বাঙলা ভাষাতত্ত্ব বেশ দুর্বল- প্রধানত প্রথাগত প্রবন্ধ ও ব্যাকরণের সমষ্টি। বাঙলা ভাষাতাত্ত্বিকেরা তত্ত্বপ্রণালিপদ্ধতিতেও বিশেষ উৎসাহী নন। যাঁরা বিদেশে গবেষণা করেছেন, তাঁদের অবশ্যই আয়ত্ত করতে হয়েছে ভাষাবিশ্লেষণের নানা তত্ত্বপ্রণালিপদ্ধতি, কিন্তু তাঁরা তা বাঙলা ভাষায় পেশ করার প্রয়োজন বোধ করেন নি। তুলনামূলক- কালানুক্রমিক ভাষাতত্ত্ব, ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব, আঞ্চলিক ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক কোনো গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যগ্রন্থ রচিত হয় নি বাঙলা ভাষায়। তাই বাঙলা ভাষাতাত্ত্বিক রচনাপুঞ্জ প’ড়ে বাঙলা ভাষার নানা শৃঙ্খলা সম্পর্কে কিছু পরিমাণে জ্ঞানী হওয়া সম্ভব, কিন্তু সম্ভব নয় ভাষাবিশ্লেষণের তত্ত্ব ও প্রণালিপদ্ধতি আয়ত্ত করা।
দু-শো চল্লিশ বছরে (১৭৪৩-১৯৮৩) রচিত বাঙলা ভাষাতাত্ত্বিক রচনাপুঞ্জকে বিন্যস্ত করা সম্ভব নিম্নশ্রেণীসমূহে : (ক) অভিধান, (খ) প্রথাগত ব্যাকরণ, ও ব্যাকরণ কাঠামো, (গ) ধ্বনিতত্ত্ব, (ঘ) রূপতত্ত্ব, (ঙ) বাক্যতত্ত্ব, (চ) বর্ণমালা ও বানান সংস্কার, (ছ) উপভাষাতত্ত্ব, (জ) কালানুক্রমিক-তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব, (ঝ) ভাষা- পরিকল্পনা, (ঞ) ভাষা-বিতর্ক ও-আন্দোলন, (ট) পরিভাষা, ও (ঠ) বিবিধ। ওপরের শ্রেণীসমূহ যে সুস্পষ্টভাবে পৃথক পরস্পরের থেকে, তা নয়; বিভিন্ন এলাকার ওপর গুরুত্ব আরোপের জন্যেই এ-শ্রেণীবিভাগ। নইলে একাধিক শ্রেণীকে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব বৃহৎ কোনো শ্রেণীতে;–যেমন ‘ব্যাকরণ’ শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যায় ‘ধ্বনিতত্ত্ব’, ‘রূপতত্ত্ব’, ‘বাক্যতত্ত্ব’কে; আবার ‘ভাষা-পরিকল্পনা’ শ্রেণীতে গ্রহণ করা যায় ‘বর্ণমালা ও বানান সংস্কার’, ‘ভাষা-বিতর্ক ও-আন্দোলন’, ‘পরিভাষা’ প্রভৃতিকে। উল্লিখিত বারোটি শ্রেণী নির্দেশ করে বাঙলা ভাষার বিভিন্ন এলাকা ও স্তরের প্রতি বাঙলা ভাষাতাত্ত্বিকদের উৎসাহ; কিন্তু তা ব্যাপকতা-গভীরতা-অনুপুঙ্খতা নির্দেশ করে না। বাঙলা ভাষার কোনো এলাকা ও স্তরই ব্যাপক গভীরঅনুপুঙ্খভাবে বর্ণিতবিশ্লেষিত হয় নি। বাঙলা ভাষাতাত্ত্বিকদের প্রধান আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে অভিধানসংকলনে ও বিদ্যালয়পাঠ্য প্রথাগত ব্যাকরণপুস্তক রচনায়, এবং বাঙলা ভাষার– প্রধানত শব্দের- বিবর্তন বর্ণনায়। অনেক এলাকা স্পর্শও করেন নি তাঁরা– যেমন ‘অর্থতত্ত্ব’, যদি না অভিধানসংকলনকেই অৰ্থতাত্ত্বিক কাজ ব’লে গণ্য করি। বাক্যবর্ণনায়ও বিশেষ মনোযোগ দেন নি তাঁরা। বর্ণমালা সংস্কার সম্পর্কে যদিও বহু প্রবন্ধ রচিত হয়েছে, তবু বর্ণমালাবিন্যাস ও বর্ণমালার উদ্ভববিকাশ সম্পর্কে বাঙলা রচনা বা গ্রন্থ দুর্লভ। বিশশতকের দ্বিতীয়ার্ধের ভাষাতাত্ত্বিকেরা প্রধানত ধ্বনি ও আঞ্চলিক উপভাষা সম্পর্কে কাজ করেছেন, কিন্তু রূপতত্ত্বস্তর থেকে গেছে অবিশ্লেষিত। সাম্প্রতিক বাঙলাদেশে বাক্যতত্ত্ব ও সমাজভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা গুরুত্ব পাচ্ছে। সব মিলে দু-শো চল্লিশ বছরে গ’ড়ে উঠেছে বাঙলা ভাষাতত্ত্বের এমন এক ধারা, যা প্রথা ও আধুনিকত্বের মিশ্রণ, এবং সফলতা-বিফলতায় বাঙলার সমাজ ও জীবনেরই সমান্তরাল।
অভিধানতত্ত্ব।। শিক্ষিত সমাজে যে-ঐহিক গ্রন্থটি প্রত্যেক পারিবারিক পাঠাগারে স্থান পায়-বিস্তৃত জায়গা জুড়ে থাকে পুস্তকাসনের-সেটি অভিধান : বর্ণনাক্রমিকভাবে মুদ্রিত শব্দতালিকা, যাতে প্রতিটি শব্দের বানান, উচ্চারণ (বাঙলা অভিধানে সাধারণত উচ্চারণ নির্দেশিত হয় না), ব্যুৎপত্তি, ও এক বা একাধিক অর্থ নির্দেশিত হয়। অভিধানের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে শব্দের অর্থ-এক বা একাধিক-নির্দেশ করা; কিন্তু অভিধান ব্যবহারকারীরা শব্দের নির্ভুল বানান, উচ্চারণ, এবং অনেক সময় ব্যুৎপত্তি জানার জন্যেও ব্যবহার করে অভিধান। অনেকের কাছে অভিধান একটি অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় গ্রন্থ-ভাষিক বা শাব্দ শুদ্ধতার শেষ কথা যেনো লিখিত হ’য়ে আছে অভিধানে; কোনো সন্দেহ বা অশুদ্ধি নিরসনের জন্যে ওই গ্রন্থটির ঠিক পৃষ্ঠাটি খুললেই যেনো মিলবে শুদ্ধতার পরম রূপের পরিচয়। অর্থাৎ অভিধান-ব্যবহারকারীরা ও-প্রণেতারা অভিধানকে দেখেন একটি আনুশাসনিক গ্রন্থ হিশেবে। পশ্চিমে অভিধানের উদ্ভবও ঘটে আনুশাসনিক শাস্ত্র হিশেবে : ভাষার বিশৃঙ্খল শব্দরাশির মানরূপ সুস্থিত করার উদ্দেশ্যেই রচিত হয় অভিধান;– কোনো কোনো দেশে, যেমন ইতালি ও ফরাশিদেশে, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে, এবং কোনোকোনো দেশে, যেমন ইংল্যাণ্ডে, একক ব্যক্তির শ্রমে। বিশ্বের আধুনিক ভাষাগুলো যখন দৈনন্দিন ও কিছুটা সাহিত্যিক প্রয়োজন মিটিয়ে আরো ব্যাপক দায়িত্বের ভার গ্রহণে উদ্যোগী হয়, যখন ওই ভাষা-অঞ্চলের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষারূপ থেকে উৎসারিত হ’তে থাকে এক-একটি মানভাষা, তখন সচেতনভাবে মান- ভাষারূপ স্থির করার জন্যে সংকলিত হয় আনুশাসনিক অভিধান-যার লক্ষ্য ভাষার বিশুদ্ধ অবিচল রূপ নির্দেশ, ও ভাষাকে অনিবার্য বিনাশ থেকে রক্ষা করা। তাই আধুনিক কালে সচেতন ভাষাপরিকল্পনায় যাঁরা প্রথম অংশ নেন, তাঁরা অভিধানপ্রণেতা। অভিধানপ্রণয়নের মাধ্যমে ভাষার স্থির শুদ্ধ মানরূপ শনাক্তির প্রথম পদক্ষেপ নেয় ইতালি, দ্বিতীয় পদক্ষেপ নেয় ফরাশিদেশ। ১৫৮২ অব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ইতালির ‘আকাঁদেমিয়া দেল্লা ক্রুস্কা’, যার মূল লক্ষ্য ছিলো বিশুদ্ধ ইতালীয় ভাষার রূপনির্ণয়। এ-উদ্দেশ্যে সংকলিত হয় আকাঁদেমির বিখ্যাত অভিধান ভোকাবোলারিও দেইলি আকাঁদেমিচি দেল্লা ক্রুস্কা (১৬১২)। ১৬৩৫ অব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ল্য আকাঁদেমি ফ্রঁসেজ’ বা ফরাশি একাডেমি। ফরাশি একাডেমির উদ্দেশ্য : ‘এ-একাডেমির প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে সম্ভাব্য সকল রকম যত্নে ও শ্রমে আমাদের ভাষা সুনির্দিষ্ট সূত্র রচনা করা, এবং একে এমন বিশুদ্ধ, বাকদক্ষ ও উপযুক্ত রূপ দেয়া যাতে এর মাধ্যমে সম্ভব হয় কলা ও বিজ্ঞানচর্চা।’ ফরাশি একাডেমির কাম্য ছিলো এক পরিসুত বিশুদ্ধ সুশৃঙ্খল ফরাশি ভাষা, যা ব্যবহৃত হবে প্রাত্যহিক জীবনে, শোভন পরিস্থিতিতে, সাহিত্যে ও অন্যত্র। এ-উদ্দেশ্যে ফরাশি একাডেমি নেয় এক আনুশাসনিক অভিধান রচনার প্রকল্প; এবং একাডেমি প্রতিষ্ঠার উনষাট বছর পর, ১৬৯৪ অব্দে, প্রকাশিত হয় ফরাশি একাডেমির বিখ্যাত ফরাশি ভাষার অভিধান। ইতালীয় ও ফরাশি একাডেমির অভিধান ইতালীয় ও ফরাশি ভাষার মানরূপ সুস্থিতিতে, শব্দের মানরূপ প্রতিষ্ঠায়, পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
আঠারোশতকের ইংল্যাণ্ডে, জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে, দেখা দেয় এক নতুন প্রবণতা, যাকে বলতে পারি শৃঙ্খলা ও বিধিবিধানকাঙ্খা। আগের শতকগুলোতে ইংরেজ জাতি মেনে নিয়েছিলো ব্যক্তি বহুদ্যুতিময় স্বাতন্ত্র্য; কিন্তু আঠারোশতকে তারা সব কিছুকে পরিয়ে দিতে চায় নিয়মশৃঙ্খলার সূত্র, সবকিছুকে দেখতে চায় নিউটনীয় সৌরলোকের মতো শৃঙ্খলাশাসিত। আঠারোশতকের শৃঙ্খলা ও বিধিপ্রবণ ইংরেজজাতি যখন তাকায় আপন ভাষার দিকে, ও ধ্রুব-অবিচল-মৃত লাতিনের দিকে, তখন তাদের কাছে প্রতিভাত হয় যে ইংরেজি একটি বিশৃঙ্খল ভাষা : তার নেই কোনো ধ্রুব ব্যাকরণ, তার সূত্রগুলো অস্থির- যতোটা পালিত হয় তার থেকে অনেক বেশি থাকে অপ্রতিপালিত। লাতিনে সব কিছুই বিধিবদ্ধ ও সুস্থির- কী শুদ্ধ আর কী অশুদ্ধ তা প্রিসকিআনের পরামর্শ নিলেই বোঝা যায়; কিন্তু ইংরেজিতে সব কিছুই অনিশ্চিত। সুশৃঙ্খল নিউটনীয় সৌরলোক তখন তাঁদের কাছে ছিলো পরম ধ্রুব ব্যাপার; তাই আঠারোশতকে ইংরেজ তার বিশৃঙ্খল, ব্যাকরণহীন, মানরূপশূন্য ভাষাকে দিতে চায় মানরূপ, উদ্যোগী হয় তার পরিশুদ্ধি সাধনে ও স্থির অবিচল রূপ নির্ণয়ে। আঠারো শতকের ইংরেজ ভাষা- উৎসাহীরা ও ভাষাবিদেরা তিনটি লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করতে থাকেন : তাঁরা শনাক্ত করতে চান ইংরেজি ভাষার সূত্র ও শুদ্ধ প্রয়োগের মানরূপ, করতে চান পরিশুদ্ধিসাধন, অর্থাৎ ভাষার তথাকথিত ত্রুটিদোষগুলো ত্যাগ ক’রে তার বিকল্পে নির্দেশ করেন শুদ্ধ প্রয়োগ; ও স্থির করতে চান তার মান ধ্রুব অবিনাশী রূপ। ইংরেজি ভাষার শুদ্ধ স্থির মানরূপ লাভের জন্যে আঠারোশতকে শুরু হয় বিতর্ক, পেশ করা হয় নানা প্রস্তাব। এতে অংশ নেন সুইফট, ড্রাইডেন, জনসন প্রমুখ; এবং অনেকেই কামনা করেন ফরাশি একাডেমির মতো একটি ইংরেজি একাডেমি, যার প্রধান কাজ হবে ইংরেজি ভাষার একটি উন্নত আনুশাসনিক অভিধান প্রকাশ করা। ১৬৯৭ অব্দে ডিফো একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছিলেন, আর ১৭১২তে সুইফট তাঁর ইংরেজি ভাষার বিশুদ্ধিকরণ, উন্নয়নবিধান, ও স্থিরকরণবিষয়ক প্রস্তাব-এ ইংরেজি ভাষার দোষত্রুটি, অশুদ্ধতা, অবক্ষয়ের প্রকৃতি ব্যাখ্যা ক’রে একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। ইংরেজির মানরূপ নির্ণয় ও শব্দের বিশুদ্ধ রূপ শনাক্তির জন্যে প্রথমে একাডেমি প্রতিষ্ঠার তীব্র উৎসাহ দেখা গেলেও ক্রমে তা প্রশমিত হ’য়ে আসে, এমনকি প্রতিরোধেরও মুখোমুখি হয়। স্যামুয়েল জনসন ১৭৪৭-এ প্রকাশ করেন তাঁর অভিধান রচনার পরিকল্পনা; এবং দাবি করেন যে তিনি এমন ‘অভিধান প্রণয়ন করবেন, যা স্থির-অবিচল রূপ দেবে ইংরেজি উচ্চারণের, এবং রক্ষা করবে ইংরেজি ভাষার বিশুদ্ধতা, নির্দেশ করবে তার সুনিশ্চিত ব্যবহারবিধি, যার ফলে ইংরেজি হ’য়ে উঠবে দীর্ঘায়ু’। ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে বেরোয় জনসনের বিখ্যাত অভিধান এ ডিকশনারি অফ দি ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ, যাকে ইংরেজ জাতি গ্রহণ করে এক মহৎ কীর্তিরূপে : ফরাশিরা যা সম্পন্ন করেছে একাডেমির সাহায্যে ইংরেজ তা করেছে এক ব্যক্তির শ্রমে-মেধায়- এ-তৃপ্তি পাওয়ার সাথে সাথে ভাষার মানরূপ শনাক্তির জন্যে একাডেমি প্রতিষ্ঠার সমস্ত স্বপ্ন ত্যাগ করে ইংরেজ
জনসনের এ ডিকশনারি অফ দি ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ আনুশাসনিক অভিধানের মহৎ নিদর্শন, যদিও ওই অভিধানে বানান-উচ্চারণ-অর্থনির্দেশে ত্রুটির অভাব নেই, আর শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্দেশে জনসনের ব্যর্থতা তো শোচনীয়। জনসনের অভিধান সৃষ্টি করে আনুশাসনিক অভিধানের ধারা- যাতে অভিধানপ্রণেতা হ’য়ে ওঠেন ভাষার একনায়ক বা বিধানকর্তা। জনসন বিশ্বাস করতেন যে ‘প্রত্যেক ভাষারই রয়েছে নিজস্ব অশুদ্ধতা ও অসামঞ্জস্য, যা শোধন অথবা নিষিদ্ধকরণ হচ্ছে অভিধানপ্রণেতার দায়িত্ব’। তিনি দেখা দিয়েছিলেন শব্দের বিধানকর্তারূপে;- ভাগ্যবান তিনি, অনেকটা শব্দসৌরলোকের নিউটন– ইংরেজ জাতি মেনে নিয়েছিলো তাঁকে, এবং ইংরেজি ভাষা পালন করেছে তাঁর অজস্র শাব্দ অনুশাসন। জনসন অভিধান সংকলন করেছিলেন ইংরেজি শব্দের বানান উচ্চারণ অর্থের অজর অমর শাশ্বত রূপ দেয়ার উদ্দেশ্যে, কিন্তু অভিধান প্রণয়ন শেষ ক’রে তিনি বুঝতে পারেন যে তাঁর অভিলাষ মানুষের অমৃতকাঙ্খার মতোই দুরভিলাষমাত্র। ভাষা বড়ো দুর্বিনীত, তা কোনো একনায়ক বা বিধানকর্তার নির্দেশ মানে না;- ফরাশি একাডেমি ও তার অভিধানের পরেও বদলে গেছে ফরাশি ভাষার উদ্বায়ী ধ্বনিরাশি, বদলে গেছে রূপান্তরপ্রবণ শব্দের অবয়ব, আর নানাভাবে বিকশিত হয়েছে রহস্যময় অর্থ। ঠিক তেমনি জনসনের অভিধানের পরও ওই মহাগ্রন্থকে উপেক্ষা ক’রে স্তরেস্তরে পরিবর্তিত হয়েছে ইংরেজি ভাষা। কিন্তু জনসনের অভিধান একটি কাজ করে চমৎকারভাবে– প্রতিষ্ঠিত ক’রে দিয়ে যায় আনুশাসনিক অভিধানের প্রতাপান্বিত অবিনাশী ধারা; এবং ব্যবহারকারীরা অভিধানপ্রণেতাকে মেনে নেয় ভাষাবিধাতারূপে, ও তাঁর গ্রন্থ হ’য়ে ওঠে একরকম শাব্দ ধর্মগ্রন্থ, যাতে লিপিবদ্ধ হ’য়ে আছে শব্দের বানান উচ্চারণ ব্যুৎপত্তি অর্থ সম্পর্কে চরম বাণী! পাঠকদের এ-বোধ বেশ সুচারুরূপে জিইয়ে রাখে অভিধানপ্রকাশক ও ব্যবসায়ীরা;- দাবি করে যে তাদের অভিধানপ্রণেতাই ভাষাবিষয়ে পরম বিশেষজ্ঞ, ও চরম কথা বলার শেষ অধিকারী।
জনসনের অভিধানের একশো উনতিরিশ বছর পর ১৮৮৪ অব্দে, প্রকাশিত হয় এক নতুন– বর্ণনামূলক ধারার অভিধানের প্রথম খণ্ড, এবং শেষ খণ্ড বেরোয় ১৯২৮-এ। এ-অভিধানের আদিনাম এ নিউ ইংলিশ ডিকশনারি অন হিস্টরিক্যল প্রিনসিপলস, যা তখন বিশ্রুত দি অকসফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি নামে। এ-অভিধানে প্রতিষ্ঠিত হয় অভিধানপ্রণয়নের এক নতুন ধারা, যা বর্ণনামূলক ও ঐতিহাসিক। এ-অভিধানের সংকলক নিজেকে বিধানকর্তা বা অনুশাসক হিশেবে দেখেন না নিজেকে, বরং ভূমিকা পালন করেন নিরাসক্ত, নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনাকারীর। অকসফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির লক্ষ্য নিম্নরূপ : ‘এ-অভিধানের লক্ষ্য হচ্ছে সে-সমস্ত শব্দ বর্ণানুক্রমিকভাবে উপস্থাপিত করা, যেগুলো আদিতম কাল থেকে আজ পর্যন্ত লিপিবদ্ধ হ’য়ে ইংরেজি শব্দভাণ্ডার সৃষ্টি করেছে। এতে পরিবেশিত হবে শব্দসমূহের রূপ, অর্থ-ইতিহাস, উচ্চারণ, ও ব্যুৎপত্তির সমস্ত প্রাসঙ্গিক তথ্য। এতে শুধু মান কথ্য ও সাহিত্যিক ভাষাই গৃহীত হবে না- তা এখন প্রচলিত বা অপ্রচলিত যাই হোক, বা হোক প্রাচীন-এতে প্রধান কৌশলিক শব্দাবলি, ও ব্যাপক পরিমাণ ঔপভাষিক ও অপভাষিক প্রয়োগও গৃহীত হবে।’ ওপরে যে-লক্ষ্য ব্যক্ত হয়েছে অভিধানপ্রণয়নের, তাতে নেই কোনো আনুশাসনিক উদ্দেশ্য– ভাষার মানরূপ, শুদ্ধরূপ নির্দেশের, বা ভাষার অবিচল শাশ্বত ধ্রুব রূপ প্রতিষ্ঠার। এ-অভিধান বর্ণনামূলক : এতে সম্মানিত স্থান পায় ভাষায় ব্যবহৃত সমস্ত শব্দ কোনোরকম মূল্যায়ন ছাড়া। অকসফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি তে গৃহীত হয়েছে আদিতম লিপিবদ্ধ শব্দ থেকে প্রকাশকাল পর্যন্ত সমস্ত শব্দ, নির্দেশিত হয়েছে কোন শব্দটি কখন প্রথম ব্যবহৃত বা লিপিবদ্ধ হয় ইংরেজিতে, বর্ণনা করা হয়েছে প্রতিটি শব্দের কালেকালে অর্থবদলের ইতিহাস, এবং অপ্রচলিত শব্দের ক্ষেত্রে দেখানো হয়েছে, শব্দটি কোন বছর শেষবারের মতো লিপিবদ্ধ হয়েছে। অর্থাৎ এ-অভিধানে পাওয়া যায় ইংরেজি ভাষার প্রতিটি শব্দের জীবনী-তার উদ্ভব, বিকাশ ও লোকান্তরের সমস্ত তথ্য। অকসফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি অভিধানতত্ত্বের দিক দিয়ে নতুন-আধুনিক ধারার প্রবর্তক; এবং অভিধানপ্রণয়নে চূড়ান্ত মনীষার নিদর্শন। কিন্তু পৃথিবীব্যাপী এখনো আনুশাসনিক অভিধানই প্রাধান্য বিস্তার ক’রে আছে, বর্ণনামূলক অভিধান প্রণীত হয়েছে খুবই কম।
তৃতীয় একটি ধারার অভিধানের স্বপ্ন দেখছেন রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণবিদেরা। ওই অভিধানের রূপের খসড়া খণ্ডিত আকারে, বিভিন্ন প্রবন্ধে-গ্রন্থে, প্রকাশিত হ’লেও রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল অভিধান এখনো অরচিত, অদূর ভবিষ্যতে রচিত হওয়ারও সম্ভাবনা কম। রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল অভিধানতত্ত্বের উন্মেষ ঘটে চোমস্কির রচনায়। তিনি আস্পেকটস কাঠামোর ব্যাকরণের ভিত্তিকক্ষের একটি উপকক্ষরূপে পরিকল্পনা করেন এক আভিধানিক উপকক্ষ; এবং নির্দেশ করেন আভিধানিক উপকক্ষে বা ‘শব্দকোষ’-এ প্রতিটি শব্দ-ভুক্তির রীতিও (দ্র বেইনরাইখ (১৯৬৬), বোথা (১৯৬৮), ফিলমোর (১৯৬৯, ১৯৭১), স্টকওয়েল ও অন্যান্য (১৯৭৩))। চোমস্কির মতে ‘অভিধান (বা শব্দকোষ) হচ্ছে একরাশ শব্দভুক্তি, যাতে প্রতিটি শব্দ-ভুক্তি হচ্ছে (ধ্ব, ব)-র যুগল, যেখানে ‘ধ্ব’ হচ্ছে শব্দটির ধ্বনিরূপ নির্দেশক স্বাতন্ত্র্যিক বৈশিষ্ট্যের ম্যাট্রিক্স, আর ‘ব’ হচ্ছে একগুচ্ছ বাক্যিক বৈশিষ্টের সমষ্টি (অর্থাৎ একটি মিশ্রপ্রতীক)।’ চোমস্কি অভিধানে গৃহীত প্রতিটি শব্দের তাৎপর্যপূর্ণ ধ্বনিক- আর্থ-বাক্যিক বৈশিষ্ট্য নির্দেশের পক্ষপাতী; অর্থাৎ এতে অভিধান শুধু অভিধান থাকে না, তা হ’য়ে ওঠে ভাষার ব্যাকরণও। এ-অভিধান রচনার আগে ভাষার প্রতিটি শব্দের ধ্বনিবৈশিষ্ট্য বিজ্ঞানসম্মতভাবে নির্ণয় করা দরকার, স্থির করা দরকার তার রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, উদঘাটন করা প্রয়োজন তার সমস্ত অর্থ, এবং বিবেচনা করা দরকার ভাষার সে-সমস্ত বাক্য, যার কোনো-না- কোনো প্রতিবেশে বসতে পারে গৃহীত শব্দটি। এ-তত্ত্বানুসারে অভিধান হ’য়ে ওঠে ভাষার পুঙ্খানুপুঙ্খ সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ। এ-অভিধান এতো উচ্চাভিলাষী যে অদূর ভবিষ্যতে কোনো ভাষারই ব্যাপক সৃষ্টিশীল অভিধান রচিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই!
বাঙলা অভিধান।। বাঙলা ভাষাতত্ত্বের উদ্ভব ঘটেছিলো অভিধানসংকলনের মাধ্যমে; ওই অভিধানসংকলনে প্রেরণা হিশেবে কাজ করেছিলো ধর্ম। বাঙলা ভাষাতত্ত্বের প্রথম পুরুষ ও প্রথম অভিধানসংকলক মানোএল দা আসুম্পসাঁউ- ধর্মযাজক ও প্রচারক- জানতেন ‘যে প্রচারক তার ধর্মগোষ্ঠীর ভাষা জানে না সে প্রচারক হওয়ার উপযুক্ত নয়’। বাঙলায় জেসাসের ধর্ম প্রচারের জন্যে তাঁর জানা দরকার ছিলো বাঙলা ভাষা। এ-উদ্দেশ্যে তিনি, ১৭৩৪ অব্দে, দেশি সহকারীদের সহযোগিতায় সংকলন করেন ভোকাবুলারিও এম ইদিওমা বেনগল্লা, ই পোর্তুগিজ : দিভিদিদো এম দুয়াস পাসে। লিসবন থেকে অভিধানটি, পর্তুগিজ ও বাঙলায় রচিত, প্রকাশিত হয় ১৭৪৩-এ। অভিধানটির শুরুতে আসসুম্পসাঁউ যুক্ত করেন চল্লিশ পৃষ্ঠার এক বাঙলা ব্যাকরণ; এবং ৪১-৫৯২ পৃষ্ঠায় দু-ভাগে সংকলন করেন বাঙলা-পর্তুগিজ ও পর্তুগিজ-বাঙলা শব্দ। অভিধানটির বাঙলা-পর্তুগিজ অংশকেই মনে করা যেতে পারে মূল অভিধান ব’লে, কেননা পর্তুগিজ-বাঙলা অংশে প্রথম ভাগের শব্দগুলোই বিন্যস্ত হয়েছে পর্তুগিজ-বাঙলা শব্দকোষরূপে। এ-অভিধানে বাঙলা ও পর্তুগিজ উভয় ভাষাই লিপিবদ্ধ রোমান অক্ষরে। কোনো ভাষিক তত্ত্বকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে বা বাঙলা ভাষার একটি প্রভাবশালী আনুশাসনিক অভিধানপ্রণয়নের উদ্দেশ্যে তিনি অভিধান সংকলন করেন নি। তাঁর অভিধানের লক্ষ্য ছিলো পর্তুগিজ ধর্মপ্রচারকগণ, যারা সে-সময়ে এ-দেশে ক্রাইস্টের ধর্ম প্রচারে লিপ্ত ছিলো বা লিপ্ত হ’তে পারতো ভবিষ্যতে। তাই তিনি সংকলন করেছিলেন তাঁর এলাকার– ঢাকার ভাওয়ালের– জনসাধারণের প্রাত্যহিক শব্দাবলি : শব্দসংকলনের জন্যে তিনি কোনো অমরকোষ বা বাঙলা কাব্যের দ্বারে যান নি, গিয়েছিলেন নিরক্ষর দরিদ্র মানুষের দরোজায়, যেখানে বিরাজ করে মর্মস্পর্শী দারিদ্র ও করুণাময় ঈশ্বর! বাঙলা অভিধান- সংকলনের প্রথম শতকেই উন্মেষ ঘটে অভিধানসংকলনের দুটি প্রবণতা : (ক) দৈনিন্দিন অষ্টপ্রাহরিক শব্দসংকলনপ্রবণতা, ও (খ) সংস্কৃত ও সংস্কৃতজাত মার্জিত, জীবনচ্যুত শব্দসংকলনপ্রবণতা। প্রথম প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় আস্সুম্পসাঁউ অভিধানে, এবং বিদেশিদের সংকলিত বাঙলা অভিধানে; আর দ্বিতীয় প্রবণতাটি লক্ষণীয় প্রধানত দেশি সংকলকদের অভিধানে। আসুম্পসাঁউ সংকলন করেছিলেন এমন অনেক শব্দ, যার একটি বড়ো অংশ এখনো অগৃহীত মান বাঙলা অভিধানসমূহে। ‘আকল’, ‘বাদাম’, ‘গতর’, ‘মাকুন্দা’, ‘আব’, ‘আকুশ’, ‘আলিয়া’, ‘আলগুছি’, ‘আমুহা’, ‘চামচারা’র মতো অনেক শব্দ আছে তাঁর অভিধানে, যেগুলো টিকে আছে ঢাকা জেলার পল্লীতে, কিন্তু স্থান পায় নি অভিজাত অভিধানে। এটি আঞ্চলিক শব্দসংগ্ৰহ ব’লে আসুম্পসাঁউর অভিধানকে মেনে নিতে পারি বাঙলা উপভাষাতত্ত্বের প্রথম বই ব’লেও।
বাঙলা ভাষাতত্ত্বের প্রথম শতককে বলা যায় অভিধানের শতক। আসসুম্পসাঁউর দ্বিভাষিক অভিধানটি বিচ্ছিন্ন থেকে যায়; কিন্তু ১৭৯৩-এ প্রকাশিত আপজনের (প্রকাশক) ইঙ্গরাজি ও বাঙ্গালি বোকেবিলরি, ও হেনরি পিস্ ফরস্টারের এ ভোকাবুলারি, ইন টু পার্টস, ইংলিশ অ্যাণ্ড বোংগালি র প্রথম (ইংরেজি-বাঙলা : ১৭৯৯) ও দ্বিতীয় খণ্ড (বাঙলা-ইংরেজি : ১৮০২) প্রকাশিত হ’য়ে সৃষ্টি করে এক অভিধানস্রোত; এবং এরপর প্রায় প্রত্যেক দশকে এক বা একাধিক বড়ো মাঝারি ছোটো অভিধান (সাধারণত দ্বিভাষিক) বেরিয়ে উনিশশতককে অজস্র উপচিকীর্ষু অভিধানে ভ’রে দেয়। অভিধানরাশির অধিকাংশই দ্বিভাষিক– ইংরেজি-বাঙলা; তবে একভাষিক (বাঙলা- বাঙলা) ও বহুভাষিক অভিধানও দুর্লভ নয়। অভিধানপ্রণয়নে প্রথম ও প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন বিদেশিরা; কিন্তু ক্রমশ এ-শাস্ত্রে যোগ দেন দেশি সংকলকেরা। বাঙালিদের মধ্যে প্রথম অভিধান প্রণয়ন করেন মোহনপ্রসাদ ঠাকুর (?১৯০৫), ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের সহকারী গ্রন্থাগারিক, এ ভোকাবুলারি, বেংগলি অ্যাণ্ড ইংলিশ, ফর দি ইউস অফ স্টুডেণ্ডস (১৮১০) নামে। কিন্তু ফরস্টারের বিশাল পদক্ষেপের পর অভিধানপ্রণয়নে বিশালতর পদক্ষেপ নেন উইলিয়ম কেরি। তাঁর অভিধানের নাম এ ডিকশনারি অফ দি বেংগলি ল্যাংগুয়েজ, ইন হুইচ দি ওয়র্ডস আর ট্রেসড টু দেয়ার অরিজিন, অ্যাণ্ড দেয়ার ভেরিয়াস মিনিংস গিভেন (প্রথম খণ্ড : ১৮১৫; প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় সংস্করণ : ১৮১৮; দ্বিতীয় খণ্ড (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ) : ১৮২৫)। কেরির অভিধানের বিশালত্ব অনেক গুণের সাথে ধরে আছে বহু ত্রুটি; কিন্তু এটিতে স্পষ্ট লক্ষ্য করি অভিধানপ্রণেতার একটি বিশ্বাস যে বাঙলা ভাষা অচিরেই একটি প্রধান ভাষা হ’য়ে উঠবে। ১৮৩৩-এ প্রকাশিত হয় জি সি হটনের মহিমামণ্ডিত এ ডিকশনারি, বেংগলি অ্যাণ্ড স্যানসক্রিট/ অ্যাকসপ্লেইনড ইন ইংলিশ, যার পৃষ্ঠাসংখ্যা প্রায় তিন হাজারের কাছাকাছি। উনিশ শতকে আর যাঁরা অভিধান রচনা করেন, তাঁদের মধ্যে আছেন পীতাম্বর মুখোপাধ্যায় (১৮০৯), রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ (১৮১৭), ইয়েটস (১৮২০), রামকৃষ্ণ সেন (১৮২১), জন মেনডিস (১৮২২), তারাচাঁদ চক্রবর্তী (১৮২৭), মার্শম্যান (১৮২৭), উইলিয়ম মর্টন (১৮২৮), পিয়ার্সন (১৮২৯), জগন্নাথপ্রসাদ মল্লিক (১৮৩১), রামকমল সেন (১৮৩৪), ডি’রোজারিও (১৮৩৭), জয়গোপাল তর্কালঙ্কার (১৮৩৮), হলধর ন্যায়রত্ন (১২৪৬), দেবীপ্রসাদ রায় (১৮৪১), কেশবচন্দ্র রায় (১৮৬১), মথুরানাথ তর্করত্ন (১৮৬৩), নন্দকুমার কবিরত্ন (১৮৬৪), শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায় (১২৭১), রামকমল বিদ্যালঙ্কার (১৮৬৬) প্রমুখ। বিশশতকের দুটি ব্যাপক বাঙলা অভিধান হচ্ছে জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধান (১৩২৩), ও হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ (১৩৪০-৫৩); এবং উপকারী ব্যবহারিক অভিধান হচ্ছে রাজশেখর বসুর চলন্তিকা (দ্বিস ১৩৪০) ও শৈলেন্দ্র বিশ্বাসের সংসদ বাঙ্গালা অভিধান (১৯৫৫)।
বাঙলা অভিধানের উদ্ভবে ও রূপ গঠনে পাশ্চাত্য- বিশেষত ইংরেজি– অভিধান ও বিদেশিরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে; সংস্কৃত অভিধান ভূমিকা নেয় অভিধান বিকাশের সময়। সংস্কৃতে পাওয়া যায় তিন ধরনের অভিধানগ্রন্থ : ‘পর্যায়’, ‘নানার্থ’, ও ‘লিঙ্গ’। ‘পর্যায়’ শ্রেণীর গ্রন্থে বিন্যস্ত হয় একই বস্তু বা ধারণার বিভিন্ন নাম; ‘নানার্থ’-এ প্রদত্ত হয় একই শব্দের বিভিন্ন অর্থ; আর ‘লিঙ্গ’ শ্রেণীর গ্রন্থ নির্দেশ করে সংস্কৃত শব্দরাশির ব্যাকরণিক লিঙ্গ। ‘পর্যায়’ শ্রেণীর গ্রন্থের মধ্যে অমর সিংহের অমরকোষ অমরত্ব লাভ করেছে। সংস্কৃত অভিধানশ্রেণী ছন্দোবদ্ধ পদ্যে রচিত শব্দের তালিকা, যা ব্যবহারকারীকে মুখস্থ ক’রে রাখতে হতো, কেননা তাতে শব্দাবলি বর্ণানুক্রমিকভাবে বিন্যস্ত নয়। আধুনিক অভিধানে বর্ণানুক্রমই অভিধানের প্রথম পরিচয়। অভিধানকে ব্যবহারোপযোগী হ’তে হ’লে বর্ণানুক্রমিকভাবে বিন্যস্ত হ’তেই হবে, কেননা অভিধানের কাজ স্মৃতিকে সহায়তা করা, পীড়িত করা নয়। আসুম্পসাঁউর অভিধান বাদ দিলে, ১৮৯৩-এ প্রকাশিত আপজনের অভিধান ও ১৭৯৯ ও ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ফরস্টারের অভিধান থেকে ইংরেজি-বাঙলা, বাঙলা-ইংরেজি, ও বাঙলা-বাঙলা অভিধানের যে ধারা গ’ড়ে ওঠে, তা ইংরেজি অভিধানের, বিশেষ ক’রে জনসনের অভিধানের, কাঠামোতে রচিত, ও প্রকৃতিতে আনুশাসনিক। বাঙলা ভাষার অভিধানরাশির মধ্যে একমাত্র আস্সুম্পসাঁউর অভিধানই অনানুশাসনিক বা বর্ণনামূলক; আর সমস্ত মান বাঙলা ভাষার অভিধানই আনুশাসনিক, যদিও তাদের মধ্যে বিদ্যমান অনুশাসনের মাত্রাভেদ।
আঠারোশতকের ইংল্যাণ্ডে যেমন উৎসাহ-উদ্বেগ দেখা দিয়েছিলো ইংরেজি ভাষার স্থির অবিচল মানরূপ বিধিবদ্ধকরণের, তেমন কিছু ঘটে নি আঠারোউনিশ এমনকি বিশশতকের বাঙলায়; কিন্তু ফরস্টার থেকে প্রায় সমস্ত অভিধানপ্রণেতা পালন করেন বাঙলা ভাষা-পরিকল্পনাকারীর দায়িত্ব। ফরস্টার অভিধান প্রণয়ন করেছিলেন বাঙলা ভাষার সমৃদ্ধি সাধনের জন্যে, এমন এক সময়ে যখন বাঙালি আপন ভাষা-সচেতনই ছিলো না। তিনি বাঙলা থেকে আরবি-ফারসির প্রভাব কমিয়ে বাঙলাকে পরিণত করতে চেয়েছিলেন এক সংস্কৃতলগ্ন বিশুদ্ধ ভাষায়। এ-প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়, এবং এক বিশুদ্ধ বাঙলা সৃষ্টির জন্যে শুরু হয় বাঙলা ভাষার সংস্কৃতায়নপ্রক্রিয়া। কেরি (১৮১৫) তাঁর অভিধানের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘বাঙলার মানুষেরা যদিও বেশ ঘোরানোপেঁচানো ভাষায় কথা বলে, তবু তারা ব্যাকরণের সূত্র খুব বেশি লংঘন করে না। তারা অবশ্য ভাবপ্রকাশের বহু মার্জিত রীতি সম্পর্কে অজ্ঞ, ও কথোপকথনে বেশ গ্রাম্য; তবে তারা অন্যান্য অনেক জাতির চেয়ে শুদ্ধ। তবে স্বীকার করতেই হবে যে লেখনপ্রণালিতে তারা শোকাবহভাবে অশুদ্ধ, আর তাদের বানান ভুল এতো বেশি যে লেখক কোন শব্দটি লিখতে চেয়েছেন, তা স্থির করাই অনেক সময় অসম্ভব। সরকার ও ব্যবসায়ীরা কখনো পণ্ডিতন্মন্যতাবশত কখনো অজ্ঞতাবশত এ-অপকর্মে পালন করেছে পূর্ণ ভূমিকা। বাঙলাভাষাকে ঋদ্ধ করার জন্যেই অভিধান– প্রণেতারা ও উনিশশতকের প্রথম পর্যায়ের গদ্যরচয়িতারা শুরু করেন সংস্কৃতায়নপ্রক্রিয়া। অনেক অভিধানপ্রণেতা বাঙলা অভিধান প্রণয়নে বসে রচনা করেন সংস্কৃত অভিধান। আসুম্পসাঁউর অভিধানে যেখানে তদ্ভব ও দেশি শব্দের প্রধান্য- ‘আচার’, ‘বাও’, ‘বাসন’, ‘বস্তা’, ‘ভাও’ জাতীয় শব্দ যেখানে স্তম্ভপরস্পরায় বিন্যস্ত, আর দুরূহতম সংস্কৃত শব্দের নমুনা যেখানে ‘আত্মা’, ‘ব্যাধি’, ‘ব্যাখ্যা’, সেখানে ফরস্টারে পাওয়া যায় মার্জিত সংস্কৃত শব্দের প্রাচুর্য, উইলিয়ম কেরির অভিধানে মুখোমুখি হ’তে হয় ‘আমাশয়মূর্দ্ধক্তরক্তাবাহকনাড়ী’, ‘ইতিকৰ্ত্তব্যতাকলাপ’, ‘পাদবৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠনমনকারিদীর্ঘ’, ‘অতিথ্যুপাসনাকাঙ্খী’, ‘এৎপরাভব- নিমিত্তক’ প্রকৃতির শব্দ। অবশ্য এসব থেকে সরল শব্দ যে একেবারে পরিত্যক্ত, তা নয়; কেরির অভিধানে ওসব ভীতিকর শব্দের পাশে ‘অক্ষয়’, ‘অদক্ষ’, ‘অশ্রু’র মতো সংস্কৃত-বাঙলা শব্দ যেমন মেলে, তেমনই মেলে ‘ওষ’ (কুয়াশা), ‘ওটা’ (গোয়ালের উঁচু স্থান) প্রভৃতির মতো শব্দ, যেগুলো এখন সাধারণত আঞ্চলিক ব’লে মান বাঙলা অভিধান থেকে পরিত্যক্ত। অভিধানপ্রণেতাদের ও গদ্যরচয়িতাদের সংস্কৃতায়নপ্রক্রিয়া উনিশশতকের দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই তিরস্কারের বিষয় হ’য়ে উঠেছে, এবং অনেকে একে বিবেচনা করেন চক্রান্ত ব’লেও; কিন্তু এ-প্রক্রিয়া নিন্দাযোগ্য নয়, প্রশংসাই তাঁদের প্রাপ্য। এসব অভিধান যখন প্রণীত হয়, তখন বাঙলা ছিলো নিতান্তই একটি আঞ্চলিক গরিব ভাষা; তাতে যে-সমস্ত শব্দ ব্যবহৃত হতো প্রাত্যহিক জীবনে, শুধু তা আশ্রয় ক’রে থাকলে বাঙলা ভাষার বিকাশ ঘটা অসম্ভব ছিলো। এসব অভিধানের অনেক শব্দই কোনোদিন ব্যবহৃত হয় নি- লেখায় ও কথোপকথনে; কিন্তু তাদের একটি বড়ো অংশ বাঙলা ভাষায় ব্যবহৃত-ব্যবহৃত হ’য়ে গ’ড়ে তুলেছে আধুনিক মান বাঙলা ভাষা। তাই বাঙলা ভাষার প্রথম ভাষা-পরিকল্পনাকারীর গৌরব, ও উপাধি, উনিশশতকের অভিধানপ্রণেতাদের প্রাপ্য।
বাঙলা ভাষার অধিকাংশ অভিধানই দ্বিভাষিক ও একভাষিক;- দ্বিভাষিক অভিধানের মধ্যে ইংরেজি-বাঙলা, ও বাঙলা-ইংরেজি অভিধানেরই প্রাধান্য। দ্বিভাষিক (ইংরেজি– বাঙলা, বাঙলা-ইংরেজি) অভিধানগুলোর মধ্যে আছে ফরস্টার (১৭৯৯, ১৮০২), মোহনপ্রসাদ (১৮১০), কেরি (১৮১৫, ১৮১৮, ১৮২৫), ইয়েটস (১৮২০), মেন্ডিস (১৮২২), মর্টন (১৮২৮), হটন (১৮৩৩), রামকমল (১৮৩৪) প্রভৃতি; এবং একভাষিক (বাঙলা-বাঙলা) অভিধানসমূহের মধ্যে আছে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ (১৮১৭), জগন্নাথ- প্রসাদ (১৮৩১), হলধর ন্যায়রত্ন (১২৪৬), কাশীনাথ (১২৬২), মথুরানাথ তর্করত্ন (১৮৬৩), ও বিশশতকের জ্ঞানেন্দ্রমোহন (১৩২৩), হরিচরণ (১৩৪০-৫৩)। বহুভাষিক অভিধানও রচিত হয়েছিলো কয়েকটি : রামকৃষ্ণ সেনের ইংরেজি-লাতিন-বাঙলা শব্দকোষ (১৮২১), ডি’রোজারিওর ইংরেজি-বাঙলা-হিন্দোস্থানি অভিধান (১৮৩৭), অজ্ঞাতনাম সংকলকের ইংরেজি-বাঙলা-মণিপুরী অভিধান (১৮৩৭), ও দেবীপ্রসাদ রায়ের পাঁচ ভাষার অভিধান পলিগ্লট মুনশি (১৮৪১)। ফারসি-বাঙলা অভিধানও রচিত হয়েছিলো কয়েকটি; যেমন জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের ফারসি-বাঙলা অভিধান (১৮৩৮), যার নাম পারসীক অভিধান, নীলকমল মুস্তোফীর পারস্য ও বঙ্গীয় ভাষাভিধান (১২৪৫), বিপ্রশ্রীমান মহেশের পারস্য ভাষানুকল্পাভিধান (১৮৩৯); এবং এ-ধারায়ই বিশশতকে রচিত হয়েছে গোল্ডস্যাকের এ মুসলমানি বেংগলি-ইংলিশ ডিকশনারি (১৯২৩), ও হরেন্দ্রচন্দ্র পাল (১৯৬৭), শেখ গোলাম মাকসুদ হিলালীর (১৯৬৭) গ্রন্থ। একটি ব্যতিক্রমী দ্বিভাষিক অভিধান রচনা ক’রে ছিলেন পাদ্রি রামখে (১৮৮৭) বাঙ্গালা-গারো অভিধান নামে। এ-ছাড়া সংকলিত হয় আঞ্চলিক বাঙলা ভাষার অভিধান, যার প্রধান নিদর্শন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (সম্পাদক : ১৯৬৫)।
মান বাঙলা ভাষার সমস্ত অভিধানই আনুশাসনিক, যদিও বাঙলা অভিধানের কোনো স্যামুয়েল জনসন নেই। ১৭৯৯ থেকেই অভিধানপ্রণেতারা আনুশাসনিক দৃষ্টিতে শব্দসংকলন করতে থাকেন, কিন্তু কোনো অভিধানই জনসনীয় অভিধানের মহিমাপ্রতাপ অর্জন করতে পারে নি। তাঁরা বাঙলা শব্দভাণ্ডারকে ব্যাপক ক’রে তুলেছিলেন সংস্কৃত অভিধান থেকে ঋণ ক’রে, কিন্তু কখনো, এমনকি আজো, ঠিক মতো শনাক্ত করতে পারেন নি বাঙলা ভাষার প্রকৃত শব্দভাণ্ডার। তাই উনিশশতকের মধ্যভাগ থেকেই বাঙলা ভাষার নিজস্ব শব্দ নির্ধারণের তর্ক শুরু হয়। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে জন বীমস ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সমাজ’ নামক অনুষ্ঠান পত্রে বাঙলা ভাষার সমৃদ্ধি সাধনের জন্যে একটি একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন, ও মত প্রকাশ করেন যে ‘অভিধান প্রস্তুত করাই সভার মূল কৰ্ম্ম।’ বীসের প্রস্তাবে যে-একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দি বেংগলি একাডেমি অফ লিটেরেচর’ বা বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ নামে, তার ১৮৯৩-এর এক সভায় লিওটার্ড বাঙলা ভাষার অভিধান সংকলনের প্রস্তাব দেন। এর ফলে বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ, বীসের পরামর্শে, অকসফোর্ড-অভিধানের ধরনে বাঙলা ভাষার অভিধান প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু আজো তা বাস্তবায়িত হয় নি। বিশশতকের অভিধানপ্রণেতারা উনিশশতকের অভিধানপ্রণেতাদের সংস্কৃত শব্দমুখিতার জন্যে সাধারণত তিরস্কার করেন। যেমন যোগেশচন্দ্র রায় তাঁর অভিধানের ভূমিকায় বলেছেন, ‘প্রচারিত অধিকাংশ বাঙ্গালা-অভিধান মুখ্যত: সংস্কৃত-অভিধান বলা যাইতে পারে’; এবং জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস বাঙ্গালা ভাষার অভিধান–এর দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় ওই সমস্ত অভিধানকে ‘বিভক্তি-বিহীন সংস্কৃত-শব্দবাহুল্যে’ সংস্কৃতের ছাঁচে ঢালা ব’লে অভিযুক্ত করেন। তবু স্বীকার করতেই হবে যে এ-সমস্ত অভিধান বাঙলা শব্দভাণ্ডারের ব্যাপ্তিসাধনে পালন করেছে মহান ভূমিকা।
প্রথাগত ব্যাকরণ ও বাঙলা ব্যাকরণকাঠামো॥ “ব্যাকরণ’ শব্দের মূল অর্থ ‘শুদ্ধশব্দ- নির্মাণবিদ্যা’; গ্রিক ধাতুজ ‘গ্রামার’ শব্দের অর্থ ‘শুদ্ধবর্ণবিন্যাসবিদ্যা’; তবে উভয় শব্দেরই মূল অর্থ বদলে গেছে। এখন ‘ব্যাকরণ’ বা ‘গ্রামার’ বলতে বোঝায় এক শ্রেণীর ভাষাবিশ্লেষণাত্মক পুস্তক, যাতে সন্নিবিষ্ট হয় বিশেষ বিশেষ ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগের সূত্রাবলি। এ-ধরনের পুস্তকের অর্থাৎ ব্যাকরণের আদি উদ্ভব ঘটে পুরোনোভারতে, ও গ্রিসে; এবং কালক্রমে ওই ব্যাকরণকাঠামো ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন ভাষা বর্ণনা-ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণে। গ্রিক ব্যাকরণকাঠামো প্রথমে গৃহীত হয় লাতিন ভাষা ব্যাখ্যায়; এবং লাতিনের লোকান্তরের পর গ্রিক-ল্যাটিনের মিশ্র ব্যাকরণকাঠামো বিভিন্ন ইউরোপী ভাষা ব্যাখ্যার ব্যবহৃত হয়। এ-ব্যাকরণকাঠামোর অভিধা ‘প্রথাগত ব্যাকরণ’। সংস্কৃত ব্যাকরণকাঠামোতে বর্ণিত হয় সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষা। পরবর্তীকালে আধুনিক ভারতীয় ভাষাসমূহ সংস্কৃত ও ইংরেজি ব্যাকরণের মিশ্র কাঠামোতে ব্যাখ্যাত হয়। ‘প্রথাগত ব্যাকরণ’ অভিধায় নির্দেশ করা যায় সে-সমস্ত ব্যাকরণকে, যেগুলো রচিত গ্রিক-লাতিন ও সংস্কৃত ব্যাকরণের আদলে। প্রথাগত ব্যাকরণ আনুশাসনিক : ভাষার সমস্ত শৃঙ্খলা বস্তুগতভাবে বর্ণনার বদলে তা নির্দেশ করে শ্রদ্ধ প্রয়োগের বিধিনিষেধ; অর্থাৎ ভাষায় কি শুদ্ধ আর কি অশুদ্ধ, তা নির্দেশ করাই প্রথাগত ব্যাকরণের প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রথাগত ব্যাকরণবিদেরা সাধারণত কোনো ‘উন্নত বিশুদ্ধ ধ্রুপদী’ ভাষাকে শুদ্ধতার মান রূপে মেনে নিয়ে ওই ভাষার সমস্ত বিধিনিষেধ আরোপ করেন বর্ণিতব্য ভাষার ওপর। বর্ণিতব্য ভাষা যদি তথাকথিত উন্নত ভাষার বিধি মানতে না চায়, তবে তার অনেক প্রয়োগকে ‘অশুদ্ধ’ আখ্যা দিয়ে ব্যাকরণপ্রণেতারা উন্নত ভাষার নিয়ম জোরে চাপিয়ে দেন বর্ণিতব্য ভাষার ওপর। প্রথাগত ব্যাকরণ আর্থ;-তার সমস্ত ক্যাটেগরি শনাক্তির মানদণ্ড অর্থনির্ভর। তবে প্রথাগত ব্যাকরণবিদেরা গুরুত্ব দেন শব্দরূপ বর্ণনার ওপর; তাঁদের বিশ্বাস অনেকটা এমন যে পাঠকেরা যদি শুদ্ধ শব্দ গঠনের শৃঙ্খলা আয়ত্ত করতে পারে, তবে সেগুলোকে শুদ্ধ বাক্যে প্রয়োগ করতে তাদের কোনো কষ্ট হবে না।
সংস্কৃত ব্যাকরণের উদ্ভব ঘটেছিলো বেদাঙ্গরূপে;- বেদের শুদ্ধ উচ্চারণ, শুদ্ধ শব্দবিশ্লেষণ, ও শুদ্ধ অর্থনির্ণয়ের জন্যে রচিত হয়েছিলো যথাক্রমে ‘শিক্ষা’, ‘ব্যাকরণ’, ও ‘নিরুক্ত’ নামক বেদসহায়ক শাস্ত্র বা বেদাঙ্গ। ‘শিক্ষা’ হচ্ছে সংস্কৃত ধ্বনিতত্ত্ব, ‘নিরুক্ত’ হচ্ছে সংস্কৃত অর্থতত্ত্ব, আর ‘ব্যাকরণ’ হচ্ছে সংস্কৃত শব্দ-বা রূপ-তত্ত্ব। সংস্কৃত রূপতত্ত্ব শাস্ত্রের নাম ব্যাকরণ; এবং এ-নামই পরবর্তীকালে নাম হ’য়ে ওঠে ভাষা বিশ্লেষণ শাস্ত্রের ‘ব্যাকরণ’ শব্দের বদলে পতঞ্জলি ব্যবহার করেছিলেন ‘শব্দানুশাসন’ অভিধাটি; কিন্তু প্রাকপাণিনীয় ‘ব্যাকরণ’ অভিধাই বাঙলা ভাষাশাস্ত্রে গৃহীত হয়। সংস্কৃত ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণনা পাওয়া যায় ‘প্রাতিশাখ্য’ ও ‘শিক্ষা’- যেমন ঋক-প্রাতিশাখ্য, অথব প্রাতিশাখ্য, সর্বসম্মতশিক্ষা প্রভৃতি- নামক রচনায়; যাঙ্কের নিরুক্ত হচ্ছে সংস্কৃত অর্থতত্ত্বের এক আদিগ্রন্থ; আর পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী সংস্কৃত রূপতত্ত্ব বা ব্যাকরণের চরম নিদর্শন। পাশ্চাত্যের প্রথম ব্যাকরণ হচ্ছে দিওনীসিউস থ্রাস্-এর গ্রিক ভাষার ব্যাকরণ গ্রাম্মাতিকি তেক্নি– বর্ণকলা। পঁচিশটি ক্ষুদ্র অনুচ্ছেদে বিভক্ত এ-ব্যাকরণে উদ্ভূত হয় পাশ্চাত্য প্রথাগত-আনুশাসনিক ব্যাকরণকাঠামো, যা দু-হাজার বছর ধ’রে আধিপত্য করে ইউরোপী ভাষাসমূহের ব্যাকরণের ওপর। থ্রা যে-সব ক্যাটেগরি শনাক্ত করেছিলেন গ্রিক ভাষার, ও ওই শনাক্তিতে ব্যবহার করেছিলেন যে-কৌশল, তার প্রায় সবটাই গৃহীত হয় অন্যান্য ভাষার ব্যাকরণে। লাতিনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্যাকরণ লিখেছিলেন, খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে, প্রিসকিআন;- তাঁর ব্যাকরণে পাওয়া যায় দুই গ্রিক ব্যাকরণরচয়িতা- থ্রাস্ ও দিস্কোলুস-এর প্রভাব। আঠারো শতকে ইংল্যাণ্ডে তর্ক বিতর্ক আন্দোলন দেখা দেয় ইংরেজি ভাষাকে স্থির সুশৃঙ্খল বিধিবদ্ধ করার। ওই আন্দোলনের সময় ইংরেজ ভাষাবিদদের মনে সব সময়ই জেগেছে সুশৃঙ্খল স্থির গ্রিক লাতিন ভাষার কথা, ও থ্রাস্-প্রিসকিআনের নাম। আঠারো শতকের ইংরেজি ব্যাকরণবিদদের লক্ষ্য ছিলো তিনটি : ইংরেজি নিয়মকানুনশৃঙ্খলা বিধিবদ্ধ করে সেগুলোকে দিতে চেয়েছিলেন অবিচল সূত্ররূপ; অশুদ্ধ প্রয়োগসমূহ শনাক্ত ক’রে নির্দেশ করতে চেয়েছিলেন সেগুলোর শুদ্ধ প্রয়োগ; এবং বিতর্কিত ব্যাপারগুলোকে বিচার ক’রে নির্দেশ করতে চেয়েছিলেন তার সমাধান। অর্থাৎ অনুশাসন- সিদ্ধ-ও নিষিদ্ধ-করণই ছিলো তাঁদের লক্ষ্য। বিধানপ্রণয়নে তাঁরা যুক্তি, ব্যুৎপত্তি, ও গ্রিক-ল্যাটিন আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন নিয়ামকরূপে। এ-ইংরেজি ব্যাকরণরচয়িতাদের হাতেই রচিত হয় আধুনিক প্রথাগত আনুশাসনিক ব্যাকরণ, যা ইংরেজি সাম্রাজ্যবাদ আম্রয় ক’রে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।
বাঙলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণপ্রণেতারা বিদেশি। আসুম্পসাঁউ তাঁর অভিধানে জড়িত ক’রে দেন একটি খণ্ডিত বাঙলা ব্যাকরণ, যা রচিত গ্রিক-ল্যাটিন-পর্তুগিজ ব্যাকরণের আদর্শে। বাঙলা ভাষার প্রথম ও অখণ্ডিত ব্যাকরণ হচ্ছে নাথানিয়েল ব্র্যাসি হালহেডের এ গ্রামার অফ দি বেংগল ল্যাংগুয়েজ (১৭৭৮), যাকে লেখক আখ্যায়িত করেন ‘বোধপ্রকাশং শব্দশাস্ত্রং অভিধায়। হালহেড বাঙলা ব্যাকরণ লিখেছিলেন ‘ফিরিঙ্গিনামুপকারার্থং’, অর্থাৎ ইংরেজের হিতসাধনের উদ্দেশ্যে। যাতে ইংরেজেরা বাঙলা ভাষা সহজে আয়ত্ত করতে পারে, তাই তিনি রচনা করেছিলেন তাঁর চমৎকার গ্রন্থটি। উনিশশতকে সৃষ্টি হয়, ইংরেজি ও বাঙলা ভাষায়, বাঙলা ব্যাকরণপুস্তকের এক অবিরাম ধারা- এং একই বইয়ে উভয় ভাষায়- বয়স্ক বিদেশি ও কিশোর দেশি ছাত্রদের বাঙলা শেখানোর লক্ষ্যে। বিশশতকের শুরুর বছরে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৩০৮) দাবি করেন যে ‘বাঙ্গালা ভাষায় কিছু কম আড়াই শত বাঙ্গালা ব্যাকরণ লিখিত হইয়াছে; কিন্তু তার একদশক পরে যোগেশচন্দ্র রায় (১৩১৯) বলেন যে তিনি তাঁর বাঙ্গালা ভাষা নামক ব্যাকরণ রচনার সময় দেখেছেন মাত্র চারটি ব্যাকরণপুস্তক- রামমোহন রায়ের গৌড়ীয় ব্যাকরণ (১৮৩৩), শ্যামাচরণ শর্মার বাঙ্গালা ব্যাকরণ (১২৫৯), নকুলেশ্বর বিদ্যাভূষণের ভাষাবোধ বাঙ্গালা ব্যাকরণ (১৩০৫ : চতুর্দশ মুদ্রণ) লোহারাম শিরোরত্নের বাঙ্গালা ব্যাকরণ (সংবৎ ১৯৩৬)। তবে বাঙলা ব্যাকরণবিদসম্প্রদায় আড়াই শো ব্যাকরণপুস্তক রচনার মতো উর্বর, বা মাত্র চারখানি ব্যাকরণপুস্তক রচনার মতো বন্ধ্যা নন। উনিশশতকে ইংরেজিতে বাঙলা ব্যাকরণপ্রণেতাদের মধ্যে আছেন কেরি (১৮০১), গঙ্গাকিশোর (১৮১৬), কিথ (১৮২০), হটন (১৯২১), রামমোহন রায় (১৮২৬), শ্যামাচরণ সরকার (১৮৫০), বীম্স্ (১৮৭২), শ্যামাচরণ গাঙ্গুলি (১৮৭৭), যদুনাথ ভট্টাচার্য (১৮৭৯), কে পি ব্যানার্জি (১৮৯৩)। বাঙলায় বাঙলা ব্যাকরণ- প্রণেতাদের মধ্যে আছেন রামমোহন রায় (১৮৩৩), শ্যামাচরণ সরকার (১৮৫২), ব্রজনাথ বিদ্যালঙ্কার (১৮৭৮), নিত্যানন্দ চক্রবর্তী (১৮৭৮), নীলমণি মুখোপাধ্যায় (১৮৭৮), কেদারনাথ তর্করত্ন (১৮৭৮), চিন্তামণি গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৮১), প্ৰসন্নচন্দ্ৰ বিদ্যারত্ন (১৮৮৪), বীরেশ্বর পাঁড়ে (১৮৯১ : দ্বিতীয় সংস্করণ), নকুলেশ্বর বিদ্যাভূষণ (১৩০৫ : চতুর্দশ মুদ্রণ)। বাঙলা ব্যাকরণ মাত্রই আনুশাসনিক ও শব্দকেন্দ্ৰিক। দু-শো বছরে প্রথাগত বাঙলা ব্যাকরণের যে-ধারা গ’ড়ে উঠেছে, তা তিন রকম ব্যাকরণের মিশ্রণে গঠিত : লাতিন, ইংরেজি, ও সংস্কৃত ব্যাকরণের অসুখী-অস্বস্তিকর মিলনে জন্মেছে বাঙলা ব্যাকরণপুস্তকপুঞ্জ। বাঙলা ব্যাকরণের আদিপ্রণেতারা বিদেশি ও বিভাষী; তাঁরা লাতিন ও ইংরেজি ব্যাকরণের ক্যাটেগরি আবিষ্কারের চেষ্টা করেন বাঙলা ভাষায়। পরে আসেন সংস্কৃত পণ্ডিতেরা, যাঁরা বাঙলাকে বিকৃত সংস্কৃত ভেবে সংস্কৃত ব্যাকরণের ক্যাটেগরিরাশি আরোপ করেন বাঙলার ওপর। বাঙলা ব্যাকরণ রচনায় উদ্যোগী হ’য়ে সংস্কৃত পণ্ডিতেরা সংস্কৃত থেকে নিয়ে আসেন অজস্র সংস্কৃত সূত্র, এবং সৃষ্টি করেন এক দুর্বল আনুশাসনিক শাস্ত্র, যা বাঙলা ভাষাকে একটি স্বাধীন-স্বায়ত্তশাসিত ভাষারূপে ব্যাখ্যা-বর্ণনা-বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হয়। এ-ব্যাকরণসমূহকে লক্ষ্য ক’রেই রবীন্দ্রনাথ (১২৯২, ৩৪২) মন্তব্য করেছিলেন, ‘প্রকৃত বাঙলা ব্যাকরণ একখানিও প্রকাশিত হয় নাই। সংস্কৃত ব্যাকরণের একটু ইতস্তত করিয়া তাহাকে বাঙলা ব্যাকরণ নাম দেওয়া হয়।’ প্রথাগত বাঙলা ব্যাকরণের এ-ধারা উনিশশতকের শেষ দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত চলতে থাকে, যতোদিন না সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা কেন্দ্র ক’রে বাঙলা ভাষার ‘নবব্যাকরণবিদেরা’ আত্মপ্রকাশ করেন। কিন্তু তাঁরা কেউ ব্যাকরণরচয়িতা ছিলেন না;- এক দশকের মতো সময় ধ’রে তাঁরা বাঙলা ভাষা বর্ণনার জন্যে নতুন কাঠামো খুঁজে যে-যাঁর নিজ এলাকায় ফিরে যান, এবং প্রথাগত বাঙলা ব্যাকরণের ধারা বইতে থাকে প্রথাগত খাতেই। বিশশতকে রচিত বাঙলা ব্যাকরণ পুস্তকগুলো প্রকৃতিপ্রণালিতে উনিশশতকি ব্যাকরণই, যদিও কোনোকোনোটি বেশ ব্যাপক।
বাঙলা ব্যাকরণকাঠামো ও ‘নবব্যাকরণবিদ’গণ। উনিশশতকের শেষ দশকের শেষাংশ পর্যন্ত বাঙলা ভাষাতত্ত্ব সীমাবদ্ধ থাকে সাধারণত অভিধানে ও প্রথাগত ব্যাকরণে। মাঝেমাঝে বাঙলা শব্দসম্ভার, বাঙলা ভাষার চারিত্র, বর্ণমালা প্রভৃতি সম্পর্কে প্রকাশিত হয় কিছু বিচ্ছিন্ন প্রবন্ধ (দ্র বঙ্কিমচন্দ্র (১২৮৫), গ্রাডুএট (১২৮৮), রাজেন্দ্রলাল (১৮৬৬, ১৮৭৭), শ্যামাচরণ (১৮৭৭))। তখনো অনেকেই মেনে নিতে পারেন নি যে বাঙলা (‘বাঙ্গালা’, বা ‘বাঙ্গলা’) একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত ভাষা; এবং স্বতন্ত্ৰ সংস্কৃত থেকে; তাই তার ব্যাকরণকাঠামোও অনিবার্যভাবে স্বতন্ত্র হবে সংস্কৃত ব্যাকরণকাঠামো থেকে। বাঙলা ভাষার স্বাতন্ত্র্য ও স্বায়ত্তশাসন, এবং বাঙলা ব্যাকরণকাঠামোর স্বাধিকার প্রথম, ও অনেকটা পরোক্ষভাবে, দাবি করা হয় বালক, ও সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত তরুণ রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি প্রবন্ধে- ‘বাংলা উচ্চারণ’ (১২৯২), ‘স্বরবর্ণ অ’ (১২৯৯), ‘স্বরবর্ণ এ’ (১২৯৯), ও ‘টা টো টে’ (১২৯৯)-তে। ১৩০১-এ (১৮৯৪) প্রকাশিত হয় “সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা”, যার চতুর্থ ও পঞ্চম বর্ষের দু-সংখ্যায় প্রকাশিত হয় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘উপসর্গের অর্থবিচার’ (১৩০৪, ১৩০৫)। ‘উপসর্গের অর্থবিচার’ নামক দীর্ঘ ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন প্রবন্ধটিতেই সুস্পষ্টভাবে বিকশিত হয় নবব্যাকরণ- দৃষ্টি, যার লক্ষ্য বাঙলা ভাষাকে বাঙলা ভাষা হিশেবেই ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ করা। প্রবন্ধটি সংস্কৃতপন্থীদের আতঙ্কিত, ও নব্যপন্থীদের অনুপ্রাণিত করেছিলো। দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রবন্ধের প্রতিবাদে রাজেন্দ্রচন্দ্র শাস্ত্রী রচনা করেন ‘উপসর্গের অর্থবিচার নামক প্রবন্ধের সমালোচনা’ (১৩০৫), এবং তাঁর প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ লিখেন ‘উপসর্গ-সমালোচনা’ (১৩০৬)। এ-প্রবন্ধ কেন্দ্র ক’রেই বাঙলা ভাষাবিদ সম্প্রদায় বিভক্ত হ’য়ে যান দু-দলে : একদলকে বলতে পারি ‘নবব্যাকরণবিদ’ বা বাঙলাপন্থী, ও অন্যদলকে বলতে পারি ‘পুরোনো ব্যাকরণবিদ’ বা সংস্কৃতপন্থী। দ্বিজেন্দ্রনাথ যে-আন্দোলনের সূচনা করেন, তাকে এগিয়ে নিয়ে যান রবীন্দ্রনাথ, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তাঁদের বিরোধীগোত্রে সক্রিয়ভাবে অবস্থান করেন শরচ্চন্দ্র শাস্ত্রী, সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ, শ্ৰীনাথ সেন প্রমুখ। রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলা শব্দদ্বৈত’ (১৩০৭), ‘ধ্বন্যাত্মক শব্দ’ (১৩০৮), ‘বাংলা কৃৎ ও তদ্ধিত’ (১৩০৮) প্রতিষ্ঠিত করে তাঁকে নবব্যাকরণবিদসম্প্রদায়ের পুরোধারূপে। এ-আন্দোলনকে তীব্র-ব্যাপক ক’রে তোলে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ (১৩০৮) ও রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ‘বাঙ্গলা ব্যাকরণ’ (১৩০৮), ‘বাঙ্গালা কারক-প্রকরণ’ (১৩১২), ও ‘ধ্বনি-বিচার’ (১৩১৪) প্রবন্ধ। এ-আন্দোলনকে প্রতিরোধের চেষ্টা করা হয় শরচ্চন্দ্র শাস্ত্রীর ‘নূতন বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ (১৩০৮), ‘ব্যাকরণ ও বাঙ্গালা ভাষা’ (১৩০৮), সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণের ‘ভাষার সহিত ব্যাকরণের সম্বন্ধ’ (১৩০৮), ‘বাঙ্গালা ভাষার ব্যাকরণ’ (১৩১১), শ্রীনাথ সেনের ‘প্রাকৃত ব্যাকরণ ও অভিধান’ (১৩১৬) প্রবন্ধে। নবব্যাকরণবিদদের মুখপত্র ছিলো সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, সংস্কৃতপন্থীদের মুখপত্র ছিলো প্রধানত ভারতী। নব্য ও পুরোনোপন্থীদের বিতর্কের ছিলো দুটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়- বাঙলা ভাষা ও ব্যাকরণকাঠামোর স্বাধিকার বনাম সংস্কৃত-অধীনতা।
নবব্যাকরণবিদ অর্থাৎ বাঙলাপন্থীরা নিশ্চিত ধরে নিয়েছিলেন যে বাঙলা একটি স্বতন্ত্র স্বায়ত্তশাসিত ভাষা;- সংস্কৃতের সাথে তার সম্পর্ক সুদূর। তখনকার প্রথাগত ধারণা- বাঙলা সংস্কৃতের কন্যা–তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলো না, বরং তাঁরা বিশ্বাসী ছিলেন প্রাকৃতের সাথেই বাঙলা ভাষার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে। তাঁরা দেখেছেন ধ্বনিতে, শব্দে, বাক্যে, অর্থে সংস্কৃতের সাথে দুস্তর ব্যবধান বাঙলার। যদিও বাঙলা ভাষা আত্মস্থ ক’রেছে বিপুল পরিমাণ সংস্কৃত শব্দ, তবুও বাঙলা হ’য়ে উঠেছে একটি পৃথক ভাষা, যার ব্যাকরণ হবে পৃথক। কিন্তু বিরোধীপক্ষ বাঙলা ভাষার স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাসী ছিলেন না; বাঙলা তাঁদের কাছে সংস্কৃতেরই একরকম কথ্য বিকৃত প্রাকৃতরূপ, যাকে সংস্কার ক’রে পুনরায় সংস্কৃত ক’রে তোলা সম্ভব। শরচ্চন্দ্র শাস্ত্রীর (১৩০৮) মতে বাঙলা ভাষা ‘সাক্ষাৎ সম্বন্ধে সংস্কৃত ভাষা হইতে উৎপন্ন’; আর ‘ইহার গতি, স্থিতি সমুদয়ই সংস্কৃতের অনুরূপ।’ তিনি এমন মতও প্রকাশ করেন যে বাঙলা ‘একপ্রকার কালান্তর প্রচলিত সংস্কৃত ভাষা”। শ্রীনাথ সেন, শরচ্চন্দ্র শাস্ত্রীর মতোই, বিশ্বাস করেন যে ‘বঙ্গভাষা সংস্কৃতের একপ্রকার কথিতাকার’, এবং ‘সংস্কৃত আমাদের সাহিত্যের ভাষা, বাঙ্গালা তাহার কথিত আকার’। তিনি বাঙলাকে বলেন ‘বর্ত্তমান প্রাকৃত’। রবীন্দ্রনাথ ‘প্রাকৃত ও সংস্কৃত’ (১৩০৮) প্রবন্ধে এ-মত খণ্ডন করেন এভাবে : ‘বিশেষ সময়ের ও বিশেষ দেশের চলিত ভাষা অভিধানে প্রাকৃত শব্দে বিশেষরূপে নির্দিষ্ট হইয়া গেছে; অন্য দেশকালের প্রাকৃতকে ‘প্ৰাকৃত’ বলিতে গেলে কেঁচোকেও উদ্ভিদ বলা যাইতে পারে।