রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান কবিতা : অবতরণিকা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান কবিতা : অবতরণিকা

প্রস্তুত হচ্ছি যখন পঞ্চাশ হওয়ার জন্যে, এবং খুব সুখী বোধ করতে পারছি না, তখন ঘটলো এ-অসামান্য অভিজ্ঞতাটি। ধীরশান্তভাবে প’ড়ে উঠলাম তাঁর চার হাজারের মতো কবিতা ও গান; মনে হলো ধন্য হচ্ছে আমার ভোর, দুপুর, সন্ধ্যা, রাত্রিগুলো; আমার মেঘ, শিউলি, জ্যোৎস্না, অন্ধকার; আমার প্রত্যেক মুহূর্ত, প্রতিটি তুচ্ছ বস্তু। পড়ছিলাম ও অনুভব করছিলাম ঢুকছি এমন এক বিশ্বে, বিশ্বের বদলে যাকে ভুবন বলতেই ভালো লাগে, যেখান থেকে আমি দূরে রয়েছি তিন দশক। বোধ করছিলাম এক বায়ুমণ্ডল থেকে আরেক বায়ুমণ্ডলে নামার চাপও; আমার শরীর ও হৃদয় অনুভব করছিলো নেমে আসছি আমি নিঃসঙ্গ শিখর থেকে আদিগন্ত ছড়ানো সমভূমিতে, যেখানে বাস করে এক বিস্ময়কর প্রাণী, মানুষ, যেখানে ঋতুর পর ঋতু আসে, ফুল ফোটে রঙিন ও সুগন্ধি হয়ে, পাতা সবুজ হয়, এক সময় ঝ’রে পড়ে, যেখানে নদী বয়, আকাশ জুড়ে মেঘ ঘনিয়ে আসে। তাঁর কবিতা পড়ছিলাম, এবং ঢুকছিলাম এক অসীম মানবিক বায়ুমণ্ডলে। আধুনিকতা ও আধুনিক কবিতার প্রতি আমার অনুরাগ অশেষ। আধুনিক বাঙলা ও বিশ্বকবিতার মধ্যে তিন দশক আমি বাস করেছি; তার অসামান্যতায় আমি মুগ্ধ। কিন্তু ওই কবিতা এক বিমানবিক বিশ্বের কবিতা; সেখানে লীলা নেই বসন্তশরতের, সেখানে আকাশ কালো হয়ে আসে না মেঘে মেঘে, বাজে না বৃষ্টির শব্দ, শিউলি প’ড়ে থাকে না ঘাসে, সেখানে মানুষও প্রায়-অনুপস্থিত। ওই কবিতা উপভোগ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা; মানবিক অম্লজানের বদলে সেখানে নিশ্বাস নিতে হয় শৈল্পিক অম্লজান; বাস করতে হয় শিখর বা বদ্ধ মিনারের অপূর্ব নিঃসঙ্গতায়। যতোই পড়ছিলাম তাঁর কবিতা, সহজ হয়ে উঠছিলো আমার নিশ্বাস, সজীব হয়ে উঠছিলো ইন্দ্রিয়গুলো। তিনি কোনো ‘সংবর্ত’ বা ‘অর্কেস্ট্রা’ বা ‘যযাতি’ বা ‘উটপাখি’ বা ‘বোধ’ বা ‘অন্ধকার’ বা ‘আট বছর আগের একদিন’ বা ‘আদিম দেবতারা’ লেখেন নি; লিখেছেন ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’, ‘বধূ’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘মানসসুন্দরী’, ‘এবার ফিরাও মোরে’, ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’, ‘স্বপ্ন’, ‘পুরস্কার’, ‘বিদায়-অভিশাপ’, ‘শেষ বসন্ত’। তাঁর কবিতা পড়ছিলাম সুখে; কিছুই বুঝে নেয়ার জন্যে চেষ্টা করতে হচ্ছিলো না, যেমন শিউলি বা বৃষ্টি বা হাহাকার বুঝে নেয়ার জন্যে চেষ্টা করি না আমরা, ওগুলো বোঝার অনেক আগেই হৃদয়ে সংক্রামিত হয়; আলোড়িত হচ্ছিলাম, আমার অনুভূতিকোষে ঝ’রে পড়ছিলো প্রকৃতি ও প্রেমিকের আবেগ। পঞ্চাশের পূর্বাহ্নে তিনি মনে করিয়ে দিলেন আজো পারি আমি কাতর হ’তে, দীর্ঘশ্বাস আজো বেরিয়ে আসতে পারে আমার বুক থেকে, এমনকি চোখের পাতায় ও জ’মে উঠতে পারে একফোঁটা অতল জল। ভালো লাগছিলো যে সারল্যে মুগ্ধ হওয়ার মতো একটি মন আজো আমার বেঁচে আছে। তাঁর কবিতা ও গানগুলো প’ড়ে বারবার মনে পড়ছিলো তাঁরই কয়েকটি পংক্তি। পৌরাণিক এক পুরুষকে মনে রেখে তিনি একবার প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কে পেয়েছে সবচেয়ে, কে দিয়েছে তাহার অধিক?’ তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে আমার মনে হ’তে থাকে ওই পুরুষ কোনো পৌরাণিক পুরুষ নন, রাজা নন; তিনি কবি, কবিদের রাজা, তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ। তাঁর মতো আর কেউ পায় নি, তাঁর মতো আর কেউ দেয় নি।

তাঁর কবিতায় যে-সংবেদনশীলতা উৎসারিত, যাতে নিরন্তর আলোড়িত আমরা, তার নাম রোম্যান্টিসিজম। রোম্যান্টিসিজম ও রোম্যান্টিক শব্দ দুটি আজ বিব্রত করে অনেককে, আজ আমরা কেউ রোম্যান্টিক হ’তে চাই না; কিন্তু ভুলে যেতে পারি না যে রোম্যান্টিসিজম মানবজাতির মহত্তম সৃষ্টিশীলতার নাম; আর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সম্পূর্ণ রোম্যান্টিক, সম্ভবত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রোম্যান্টিক। আঠারোশতকের শেষ দিকে ইউরোপে দেখা দিয়েছিলো এই সংবেদনশীলতা, এবং মানবজাতি নিয়েছিলো এক বড়ো বাঁক। সেই থেকে মানুষের সভ্যতা হয়ে ওঠে রোম্যান্টিক, মানুষের পক্ষে আর সম্পূর্ণরূপে অরোম্যান্টিক থাকা হয়ে ওঠে অসম্ভব। বিশশতকের শিল্পকলা এড়িয়ে যেতে চেয়েছে একে, কিন্তু পারে নি। রোম্যান্টিসিজমকে বলা হয়েছে ইউরোপি চৈতন্যের সংকট; তবে এটা এমন সংকট, যা মানুষকে পৌঁছে দেয় এক অভিনব স্তরে। রোম্যান্টিসিজম মানবচেতনার এক মহাবদল, যা ভাঙন ধরিয়ে দেয় দেয় বিশ্বচিন্তাধারার মেরুদণ্ডে। এ-চিন্তাধারার মেরুদণ্ড ছিলো যুক্তি, বিশ্বাস ছিলো যে যুক্তির সাহায্যেই বোঝা যাবে মহাজগতকে; কিন্তু রোম্যান্টিকেরা এ-বিশ্বাসে ফাটল ধরিয়ে দেন। কবিতালোকে তাঁরা সৃষ্টি করেন অভিনব কবিতা; বলতে পারি যে প্রকৃত কবিতার সূচনাই করেন রোম্যান্টিকেরা। আগে কবিতা সাধারণত ছিলো ছন্দোবদ্ধ গদ্য, যা রচিত হতো প্রথাগত যুক্তি, নিয়মকানুন, সুষমা মেনে; তাঁরা বাদ দেন এসব। তাঁরা সৃষ্টি করেন নতুন আদর্শ, জোর দেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, কল্পনাপ্রতিভা, স্বতস্ফূর্ততা, ও আবেগের ওপর। কবিতা লেখার বিধিবদ্ধ নিয়মগুলো ভেঙে ফেলেন তাঁরা; তাঁরা আর কবিতা লেখেন না, রচনা করেন না, নির্মাণ করেন না, তাঁরা সৃষ্টি করেন কবিতা। ত্যাগ করেন তাঁরা আরিস্তলীয় অনুকরণবাদ; তাঁরা দর্পণ হ’তে চান না, হয়ে ওঠেন প্রদীপশিখা, যা আলোকিত করে অন্ধকারকে। আগের প্রথামানা সুরুচিকর সুশৃঙ্খল পদ্য বানানো ছেড়ে তাঁরা বইয়ে দেন নিজেদের মৌলিক প্রতিভার অবারিত সৃষ্টিশীলতা; আগের পরিশীলিত সৌন্দর্যকে লণ্ডভণ্ড ক’রে ঘটান আবেগের তীব্র গতিশীল উৎসারণ। এর ফলে যা ঘটে, তার নাম রোম্যান্টিক বিপ্লব। জোর দেন তাঁরা মৌলিকত্ব আর প্রতিভার ওপর। মৌলিকত্ব তাঁদের কাছে ছিলো উদ্ভিদস্বভাবের, যা স্বতস্ফূর্তভাবে জন্ম নেয় প্রতিভার মূলে। এটা জন্মে, তৈরি হয় না। প্রতিভা তাঁদের কাছে যাদুকর, স্থপতি নয়; স্থপতির মতো সে নানা কৌশলে কাঠামো নির্মাণ করে না, সে সৃষ্টি করে যাদুকরের মতো অদৃশ্য উপায়ে। রোম্যান্টিকেরা কবিতার পুরোনো আদর্শগুলো ছেড়ে দিয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, কল্পনাপ্রতিভা, মৌলিকত্ব, আবেগঅনুভূতি, অনুপ্রেরণার ওপর জোর দিয়ে সূচনা করেন কবিতার নতুন সময়; সৃষ্টি করেন এমন কবিতা, যা আগে কখনো ছিলো না, এবং যার মহাপ্লাবনে সুখকররূপে প্লাবিত হয় বিশ্ব।

তাঁদের এক মূলমন্ত্র ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ একদিকে বেশ ভয়ঙ্কর। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ হচ্ছে নিজেকে বিশ্বে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ মনে করা; এ হচ্ছে অহমিকাবাদ। সামাজিক এলাকায় অবশ্য ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ খুবই চমৎকার, গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র লুকিয়ে আছে এর ভেতরেই; সামাজিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সমাজ ও রাষ্ট্রের থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়া ব্যক্তির অধিকারকে। ব্যক্তির অধিকারবাদ থেকেই এসেছিলো স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব, সাম্যের ধারণা, যার ফলে ঘটেছিলো ফরাশি বিপ্লব। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের চরম রূপটি গ্রহণ করেন রোম্যান্টিক কবিরা, তাঁরা সমাজে তাঁদের অবস্থান বাতিল ক’রে দিয়ে নিজেদের মধ্যেই খোঁজেন আশ্রয়। তাই তাঁরা সাধারণত খাপ-না-খাওয়া মানুষ। রোম্যান্টিক কবির সৌরজগতের সূর্য তিনি নিজে, সব কিছুই আবর্তিত হয় তাঁকে ঘিরে; মহাজগত তাঁরই সত্তার প্রকাশ। রোম্যান্টিক সংবেদনশীলতায় ব্যক্তিই সবচেয়ে আকর্ষণীয়। রোম্যান্টিক কবি বাহ্যজগতকে দেখেন নিজের অহংবোধের ভেতর দিয়ে; তিনি মন্ময়, আমিময়; তিনি বস্তুগত দৃষ্টিতে জগতকে দেখেন না। কোনো কিছু কেমন, তার স্বরূপ কী, তা মূল্যবান নয় রোম্যান্টিকের কাছে; তাঁর কাছে মূল্যবান হচ্ছে বস্তুটি তাঁর কেমন মনে হয়। রোম্যান্টিকের আমিময়তার চরম ঘোষণা পাই রবীন্দ্রনাথেই : ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,/ চুনি উঠল রাঙা হয়ে।/ আমি চোখ মেললুম আকাশে–/জ্বলে উঠল আলো/ পুবে পশ্চিমে।/ গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর’- /সুন্দর হল সে।’ কথাগুলো সুন্দর, কিন্তু এরই মধ্যে লুকিয়ে আছে রোম্যান্টিকের ভয়ঙ্কর আমিময়তা বা অহমিকা। তিনি কোনো কিছুকেই বস্তুগতভাবে মেনে নিচ্ছেন না, স্বীকার করছেন না কারো নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকেই; সব কিছুতে তিনি সঞ্চারিত ক’রে দিচ্ছেন নিজেকে। পান্নাচুনির নিজস্ব রঙ যেমন স্বীকার করছেন না, তেমনি স্বীকার করছেন না সূর্যকে ও গোলাপের সৌন্দর্যকে; তাঁর কাছে এসবই তাঁর নিজের সত্তার সম্প্রসারণ। রোম্যান্টিকের মহাবিশ্ব উৎসারিত তারই অহম থেকে।

এখানেই আসে কল্পনাপ্রতিভা; রোম্যান্টিক কবি বস্তুগতভাবে নয়, কল্পনাপ্রতিভার সাহায্যে উপলব্ধি করেন বিশ্বজগত। অহম তাঁর মহাজগতের কেন্দ্র। রোম্যান্টিক কবি বলেন, শোনো শুধু নিজেকে, চারপাশ থেকে ফিরিয়ে নাও দৃষ্টি, দেখো তোমার অভ্যন্তরকে, তোমার বাইরের কিছুই মূল্যবান নয়, মূল্যবান শুধু তুমি নিজে। আপন আন্তর সত্তাকে মুখ্য ক’রে রোম্যান্টিসিজম হয়ে ওঠে অহমিকাবাদ বা আত্মকেন্দ্রিকতাবাদ। তবে কোনো কোনো রোম্যান্টিক প্রচণ্ড অহমিকাপরায়ণ হ’লেও তাঁদের অনেকেই বিনয়ী ও গণতন্ত্রবাদী; এবং চারপাশের দিকে সব সময়ই মেলে রেখেছেন মুগ্ধ চোখ। বিলেতি রোম্যান্টিকেরা নিজেদের সাধারণ মানুষই মনে করতেন; কিন্তু যে-সব দেশে নিয়ন্ত্রণ বেশি ছিলো, যেমন, জর্মনি ও ফরাশিদেশে, সেখানকার রোম্যান্টিকেরা হন প্রচণ্ড, নিজেদের মনে করেন সাধারণ মানুষ থেকে ভিন্ন ও উন্নত। তাঁরা নিজেদের মনে করেন ঈশ্বর বা ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী। শ্লেগেল বলেছিলেন মানুষ অন্য প্রাণীদের কাছে যেমন, শিল্পী অন্য মানুষদের কাছে তেমন। তাঁদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রভাব পড়ে কবিতার সমস্ত দিকে। আগে শিল্পকলা গণ্য হতো একধরনের দক্ষতা, কিছু নিয়মকানুন প্রয়োগের কৌশলরূপে; কিন্তু এখন তা হয়ে ওঠে রহস্যময়, কেননা তা উদ্ভূত হয় সংবেদনশীলতা থেকে, কবি অনুপ্রাণিত হয়ে সৃষ্টি করেন কবিতা। বদলে যায় কবির ভূমিকা; কবি আর জ্ঞানপ্রচারক ও কর্মী থাকেন না, কবি হয়ে ওঠেন কবি। তাঁদের আরাধ্য হয় স্বতস্ফূর্ততা; এবং তাঁরা গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন প্রকৃতির সাথে। রোম্যান্টিক কবিতা হচ্ছে প্রকৃতির কবিতা, এমন ধারণা বড়ো হয়ে উঠেছিলো এক সময়। মিথ্যে নয় যে তাঁরাই প্রথম প্রকৃতিকে দেখেন প্রকৃতিরূপে, এবং উপস্থাপিত করেন জীবন্তভাবে। এর আগে প্রকৃতিকে মনে করা হতো যন্ত্র, যা পূর্বনির্ধারিত নিয়মে যান্ত্রিকভাবে চলছে। রোম্যান্টিকরা এই যান্ত্রিক প্রকৃতিধারণা বাদ দিয়ে নেন এক সজীব গতিময় প্রকৃতির ধারণা। তবে তাঁদের অনেকেই প্রকৃতিকে প্রকৃতি হিশেবে নেন নি, নিয়েছেন নিজেরই সত্তার সম্প্রসারণরূপে, শেলির ‘পশ্চিমা বায়ুর প্রতি’, বা রবীন্দ্রনাথের ‘বর্ষশেষ’ যার ভালো উদাহরণ।

রোম্যান্টিক কবির মূলশক্তি কল্পনাপ্রতিভা, যা দিয়ে তিনি দেখেন ও পুনরসৃষ্টি করেন বিশ্বজগত। তিনি যেহেতু তাঁর সৌরলোকের সূর্য, আর অহম তাঁর কেন্দ্র, তাই তাঁর জীবনে মূল্যবান হচ্ছে ওই অহমের বোধ, প্রতিক্রিয়া ও অনুভূতিরাশি। তাঁর অহম সব কিছু উপলব্ধি করে কল্পনাপ্রতিভার সাহায্যে; তিনি অভিজ্ঞতাবাদীর মতো পাঁচ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বিশ্বকে বোধ করেন না, করেন কল্পনাপ্রতিভার সাহায্যে। বাইরের চোখ দিয়ে তিনি দেখেন না, দেখেন আন্তর চোখ দিয়ে; যেমন ব্লেইক বলেছেন যে তিনি চোখ দিয়ে দেখেন চোখ দ্বারা দেখেন না; বা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘কবি, তব মনোভূমি, / রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’ যা আছে তা সত্য নয় তাঁর কাছে, কল্পনাপ্রতিভা যাকে সত্য মনে করে তাঁর কাছে তাই সত্য। কল্পনাপ্রতিভাকে মূল্য দিয়ে একটি বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন তাঁরা। আগে কল্পনার কাজ ছিলো স্মরণ করা বা কবিতায় কারুকার্য করা, এখন তা হয়ে ওঠে শিল্পসৃষ্টির প্রাণ। প্লাতো থেকে আঠারোশতক পর্যন্ত মনকে মনে করা হতো আয়না, যার কাজ বাইরের জগতকে প্রতিফলিত করা; সেখানে রোম্যান্টিকেরা মন বা হৃদয়কে মনে করেন প্রদীপশিখা, যা উদ্ভাসিত করে মহাজাগতিক অন্ধকারকে। তাঁরা আরিস্ততলীয় অনুকরণ বাদ দিয়ে গ্রহণ করেন উদ্ভাসনকে, শিল্পকলার ইতিহাসে যা এক বিশাল ঘটনা। কল্পনাপ্রতিভার কী কাজ? রবীন্দ্রনাথ যা বিশ্বাস করতেন, এবং পশ্চিমের রোম্যান্টিকেরা যা ব্যাখ্যা করেছেন, তা হচ্ছে কল্পনাপ্ৰতিভা বিশৃঙ্খল উপাদানরাশিকে দেয় এক সমন্বিত রূপ। এর এক কাজ লৌকিক ও অলৌকিক জগতের মধ্যে সম্পর্ক পাতানো। কল্পনাপ্রতিভাকে তাঁরা পূর্ববর্তীদের মতো কারুকার্যরচনার কৌশল হিশেবে ব্যবহার করতে চান নি। তাঁরা শিল্পকলাকে এক পবিত্র কাজে পরিণত করেন, যার কাজ এক পরম সত্তার সাথে যোগাযোগসাধন। এ-বিশ্বাস দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথেও। তাঁরা দেখতে চেয়েছিলেন দৃশ্যমান বস্তুরাশির অন্তরালের অদৃশ্য বিন্যাস, তাই জোর দিয়েছিলেন প্রবৃত্তি ও বোধির ওপর। শেলি মনে করতেন কবির কাজ সত্য ও সুন্দরকে উপলব্ধি করা, যা বিশ্বাস করতেন রবীন্দ্রনাথও।

তাঁদের সঙ্গে জড়িত একটি ধারণা হচ্ছে অনুভূতি। ‘রোম্যান্টিক’ শব্দটি এখন অনেকটা ভাবালুতা বুঝিয়ে থাকলেও (তা হবেই, দুশো বছর ধ’রে বিভিন্ন মাধ্যম ভাবালুতাকে বড়ো পণ্য হিশেবে বিক্রি ক’রে লাভবান হচ্ছে), রোম্যান্টিকরাই প্রথম অনুভূতি বা ভাবাবেগ বা ভাবালুতাকে পরম মূল্য দিয়েছিলেন। তাঁরাই প্রথম দামি মনে করেছিলেন মানবিক আবেগানুভূতিকে, এর আগে যার বিশেষ মর্যাদা ছিলো না। তবে অনুভুতি রোম্যান্টিসিজমে গৌণ ব্যাপার। বিলেতে রোম্যান্টিসিজমের আগে দেখা দিয়েছিলো এক ভাবালুতার যুগ, যাতে বড়ো হয়ে উঠেছিলো হৃদয়ের যুক্তি। তাঁরাও তা গ্রহণ করেন, সতেরোআঠারো শতকের মননশীল যান্ত্রিকতার বদলে হৃদয়ের কাতরতাই তাদের বেশি টানে। অনুভূতির প্রবল প্রকাশ তাঁরা শুরু করেন নি, যদিও এর প্রশংসা ও নিন্দা আজো তাঁদের ভোগ করতে হচ্ছে। আঠারোশতকের মাঝামাঝি সময়ে চোখ থেকে দরদর ক’রে অশ্রু গড়িয়ে প’ড়ে বালিশভেজানো উপন্যাস বহু লেখা হয়, তবে রোম্যান্টিক অনুভূতি ও ভাবালুতার যুগের অনুভূতির মধ্যে অনেক অমিল। বালিশভেজানো উপন্যাসে মেলে ছকবাঁধা অশ্রু, আর রোম্যানিক অশ্রু উদ্গত হয় একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে। তাঁরা প্রথাগত পৌরাণিক বীণাটিকে বাদ দিয়ে বাজান তাঁদের হৃদয়তন্ত্রি। হৃদয় তাঁদের এক বড়ো সম্পত্তি; হৃদয়কে তাঁরা ক’রে তোলেন বিশ্বখোলার চাবি। হৃদয় তাঁদের কাছে শুধু সুখদুঃখের উৎস হয়ে থাকে না, হৃদয় হয়ে ওঠে তাঁদের জ্ঞানের প্রত্যঙ্গ। আগে হৃদয় ছিলো না, ছিলো মন; মনকেই মনে করা হতো মানুষের নিয়ন্ত্রক; তাঁরা মনের জায়গায় স্থান দেন হৃদয়কে। তাঁদের হৃদয় থেকে স্বতস্ফূর্ত উঠে আসে আবেগানুভূতি, যাতে ভ’রে আছে তাঁদের কবিতা। ওয়র্ডসওঅর্থ কবিতার এক সংজ্ঞা দিয়েছিলেন যে কবিতা হচ্ছে তীব্র অনুভূতির স্বতস্ফূর্ত উদ্বেলন, যদিও নিজে এর চর্চা করেন নি; বরং তিনি মেনে চলতেন তাঁর আরেক সংজ্ঞা যে কবিতা হচ্ছে আবেগের প্রশান্ত পুনশ্চয়ন। আবেগ তীব্র ও স্বতস্ফূর্তভাবে উদ্বেলিত হবে, এটা সবচেয়ে বেশি মেনেছেন শেলি, যাঁর স্কাইলার্ক এমন এক সঙ্গীতমুখর কবি, যে নিজের পরিপূর্ণ হৃদয় ঢেলে দেয় অপূর্বপরিকল্পিত শিল্পকলা বা কবিতারূপে।

বিশ্বের মহত্তম রোম্যান্টিকদের একজন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর মধ্যে পাই রোম্যান্টিসিজমের বৈশিষ্ট্যগুলোর শ্রেষ্ঠ প্রকাশ, যা পাই না পুবপশ্চিমের আর কারো মধ্যে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা অহমিকা, মৌলিকত্ব, কল্পনাপ্রতিভা, স্বতস্ফূর্ততা, আবেগানুভূতি ও আরো অজস্র ব্যাপার যেমন ব্যাপক, গভীর, তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতা ও গানে, তা আর কোথাও হয় নি। তীব্রতায় তিনি অদ্বিতীয়, শেলির থেকেও অনেক বেশি তীব্র। বিলেতের পাঁচ রোম্যান্টিক- ওয়র্ডসওঅর্থ, কোলরিজ, শেলি, কীটস, বায়রন– মিলে যা ক’রে গেছেন, বাঙলায় একলা তিনি করেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি। এক বহিরস্থিত, খাপ-না-খাওয়া, রোম্যান্টিকরূপে শুরু হয়েছিলো তাঁর, যিনি কেউ নন সমাজরাষ্ট্রের; তাঁর বুড়ো বয়সের ছবিগুলো ও নানা নিরর্থক কর্মকাণ্ড যদিও আমাদের একথা ভুলে থাকতে বাধ্য করে, তবু বুঝি কতোটা বহিরস্থিত ছিলেন, রবীন্দ্রনাথ। কোনো কবির পক্ষেই সম্ভব নয় সমাজ ও রাষ্ট্রে শেকড় ছড়ানো। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর অভিমানক্ষুব্ধ হয়ে তিনি যে বলেছিলেন, ‘যাঁরা জনসাধারণের নেতা, যাঁরা কর্মবীর সর্ব্বসাধারণের সম্মান তাঁদেরই প্রাপ্য এবং জনপরিচালনার কাজে সেই সম্মানে তাঁদের প্রয়োজনও আছে। যাঁরা লক্ষ্মীকে উদ্ধার করবার জন্যে বিধাতার মন্থনদণ্ডস্বরূপ হয়ে মন্দার পর্ব্বতের মত জনসমুদ্র মন্থন করেন, জনতাতরঙ্গ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে তাঁদের ললাটকে সম্মানধারায় অভিষিক্ত করবে, এইটেই সত্য, এইটেই স্বাভাবিক। কিন্তু কবির সে ভাগ্য নয়। মানুষের হৃদয়ক্ষেত্রেই কবির কাজ।’,- তাঁর বেদনাহত এ-ক্ষোভ থেকেই বুঝি কতো বহিরস্থিত তিনি মনে করতেন নিজেকে তুচ্ছ রাজনীতিবিদদের সাথে নিজেকে তুলনা ক’রে। কিন্তু তিনি সুস্থ করতে চেয়েছিলেন অসুস্থ বিশ্বকে, উন্নত করতে চেয়েছিলেন সমাজকে, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়, এসবই পণ্ডশ্রম; তাঁর যা মূল্যবান কাজ, তা তাঁর শিল্পসৃষ্টি;-কবিতা, গান, নাটক, ছোটগল্প, উপন্যাস। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছেন তিনি, তাঁর এই আপাতমহৎ কাজটিকে হাস্যকর লাগে আমার; বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন কবির কাজ নয়, অজস্র বিশ্বভারতীর থেকে অনেক মূল্যবান একটি ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’। বিশ্ববিদ্যালয় যাঁরা চালান, আমি নিশ্চিত, তাঁদের কাছে ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা নিরর্থক, বা তাঁদের কাছে খুবই আপত্তিকর কড়ি ও কোমল-এর কবিতার পর কবিতা। ওই মহাচালকগণ সমাজস্থিত, শিল্পবিরহিত সমাজপতি; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, কবিদের রাজা, কবিদের মতোই, বহিরস্থিত। এক বাঁশিঅলারূপে নিজেকে দেখেছেন তিনি চিরকাল, বারবার বলেছেন বাঁশি বাজানোর কথা, মধ্যাহ্নের অলস গায়কের মতো বাঁশি বাজানোই যাঁর আনন্দ, যে সমাজের নয়, সব সময়ই ‘আগন্তুক’; যার ঢোকা হয় নি প্রথাগত সমাজে। চিত্রার ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় বলেছেন যে সৃষ্টিছাড়া সৃষ্টি-মাঝে বহুকাল সঙ্গীহীন রাত্রিদিন বাস করেছেন, যাঁর চোখে স্বপ্নাবেশ আর শরীরে অপরূপ বেশ, আর জগতে আসার দিন ‘কোন্ মা’ তাঁকে দিয়েছে ‘শুধু খেলাবার বাঁশি।’ এটা শুধু কাব্যিকতা নয়, এ-বোধ তাঁর আমৃত্যু ছিলো। কিশোর বয়সের যে-কাব্যগুলোকে তিনি বাতিল করেছেন, সেই কবিকাহিনী, বনফুল, ভগ্নহৃদয়, বাল্মীকিপ্রতিভা ভ’রেই পাই এক সমাজবহিরস্থিত কবিকে, যিনি পরে বিব্রত বোধ করেছেন নিজের কৈশোরের বহিরস্থিততায়, কিন্তু অন্তরে শেষ দিনও তিনি থেকে গিয়েছিলেন আগন্তুক, বহিরস্থিত। কবির এই নিয়তি।

যেদিন স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিলো নির্ঝরের, সেটা ছিলো, শুধু বাঙালির জন্যেই নয়, মানুষের জন্যেই এক মহাশুভদিন। ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি তাঁর ইশতেহারের মতো; এতে তিনি চরণে চরণে যা কিছু ঘোষণা করেছেন, সারাজীবন বাস্তবায়িত ক’রে গেছেন তাই। গুহার আঁধারে রবির কর আর প্রভাতপাখির গান পৌঁছোনোর পর ওই যে প্রাণ জেগে উঠলো, থর থর ক’রে কাঁপতে শুরু করলো ভূধর, তা আর থামে নি; সারাজীবন তিনি ঢেলে চললেন করুণাধারা, ভেঙে চললেন পাষাণকারা, জগৎ প্লাবিয়া গেয়ে চললেন গান, ঢেলে দিতে লাগলেন প্রাণ, আর দিকে দিকে ভ’রে উঠতে লাগলো বাঙলা কবিতা। তাঁর কবিতা এক বিশাল বা অসীম মানবিক ভুবন, যা তীব্রতম আবেগে আলোড়িত। কবিতার কোনো বিশেষ সংজ্ঞায় সীমাবদ্ধ ছিলেন না তিনি; অবলীলায় যেমন তিনি লিখেছেন অজস্র বিশুদ্ধ কবিতা, তেমনি লিখেছেন প্রচুর ছন্দোবদ্ধ রচনা; যেমন লিখেছেন তীব্রতম হাহাকার, তেমনি লিখেছেন আটপৌরে কাহিনী; লিখেছেন ব্যঙ্গ কবিতা, নীতিকথা, পৌরাণিক উপাখ্যান, ছোটোদের জন্যে কবিতা, এবং কী নয়। বহু রোম্যান্টিকের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন যে কবির মহান কাজ লৌকিকের সাথে অলৌকিক পরম সত্তার সম্বন্ধ পাতানো। তিনি সেই সম্বন্ধ পাতানোর সাধনা করেছেন আমৃত্যু; তাই তাঁর কবিতা দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বাসের ভিত্তির ওপর। যারা অবিশ্বাসী কোনো পরম সত্তায়, যাদের কাছে হাস্যকর ওই ভাবালুতা, তারাও উপভোগ করে তাঁর কবিতা, কেননা তাঁর কবিতা মানবিক ও প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ, তীব্র আবেগে কম্পিত, এবং অসামান্য উপমারূপকচিত্রকল্পের সৌন্দর্যে শোভিত। তাঁর কবিতার বৈচিত্র্য ও মানবিকতার মূলে রয়েছে আরেকটি জিনিশ; তা হচ্ছে বিচিত্র ধরনের কথকের উপস্থিতি। কবিতার থাকে অন্তত একজন কথক, কবি নানা মুখোশ প’রে আবির্ভূত হন কথকরূপে; রবীন্দ্রনাথ অজস্র মুখোশ প’রে আবির্ভূত হয়েছেন। আধুনিক কবিতার সমস্যা হচ্ছে কবিরা সাধারণত নিজেরাই কথক, কিন্তু কবিতায় তিনি কখনো নির্ঝর, কখনো চাষী, অজস্রবার ব্যথিতা নারী, এবং আরো বহু কিছু। তাই তাঁর কবিতায় পাই বিচিত্র জীবন ও তার আবেগ। জীবনের শেষ দিকে তিনি রোম্যান্টিকতা থেকে স’রে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কর্কশ গদ্যে সাধনা করেছিলেন অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি প্রকাশের, তবে তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা রচিত হয়েছে তখনই, যখন তিনি রোম্যান্টিক।

জীবন, শিল্প, ও কবিতার চিরপ্রধান বিষয় প্রেম- হৃদয়শরীরের সেই অবর্ণনীয় আলোড়ন। তাঁর কবিতায়ও প্রধান প্রেম; শুধু তাই নয়, এমন তীব্র কাতর নিরন্তর অহমিকাহীন নিবেদিত প্রেমিক বাঙলায় আর জন্মে নি। রোম্যান্টিকদের প্রধান সম্পদ ও সমস্যা হৃদয়; তাঁরা পীড়িত মহাজগতের থেকেও বৃহৎ হৃদয়ের ভারে, তাঁদের হৃদয় কোনো সুখ জানে না। তাঁর কিশোর বেলার কাব্যগুলোতে যেমন পাই হৃদয়ভারপীড়িত এক কিশোর কবিকে, তেমনি তাকে পাই যৌবনে ও বার্ধক্যে, যদিও সে আর ততো পীড়িত নয়। তিনি প্রথম প্রধান প্রেমের কবিতাটি লেখেন একুশ বছর বয়সে, যার নাম ‘রাহুর প্রেম’। ওই কবিতাটি তাঁর একমাত্র অরাবীন্দ্রিক প্রেমের কবিতা, যাতে নির্মম প্রেমিক দিবসরজনী নিজের মুখ দেখতে চায় প্রেমিকার আঁখিনীরে। তবে ধীরেধীরে তিনি সংযত ক’রে নেন নির্মম প্রেমিককে, তাকে সংশোধন করেন ‘সুরদাসের প্রার্থনা’য়, এবং তাকে চূড়ান্ত রোম্যান্টিক রাবীন্দ্রিক রূপ দেন ‘অনন্ত প্রেম’-এ। কড়ি ও কোমল-এ পাই প্রেমের তীব্র শরীরী কামনা, এবং এ থেকেও উঠে আসেন তিনি। তবু তাঁর প্রেমের কবিতা কখনো নিষ্কাম নয়; প্রেমিকা, প্রেমিক (নারীর ভূমিকায় তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন বারবার), এমনকি জীবনদেবতার সাথে যে-সম্পর্কের পরিচয় পাই, তাতে তাঁর প্রেমের কবিতাকে মনে হয় অন্তহীন অতৃপ্ত শৃঙ্গার। কিন্তু যতোই বয়স বেড়েছে, ততোই তিনি এর ওপর বিছিয়ে দিয়েছেন হৃদয়ের আবরণ। এক বিস্ময়কররূপে তাঁকে পাই গানে; সেখানে পুজো হয়ে ওঠে প্রেম, প্রেম হয়ে ওঠে পুজো; আর মনে হয় পুজোই তাঁর শ্রেষ্ঠ আবেগ। সব মিলে তিনি এমন মহান কবি, যিনি তাঁর সীমাবদ্ধ জাতিকে দিয়ে গেছেন অসীমাবদ্ধতার স্বাদ। তাঁর সমগ্র জাতি হৃদয় দিয়ে যা ধরতে পারে নি, তিনি একা তা ধারণ ক’রে রেখে গেছেন, যাতে তাঁর জাতি সব সময়ই খুঁজে পাবে আন্তর সম্পদ। তিনি তাঁর জাতির জন্যে রেখে গেছেন স্বপ্ন, কল্পনা, প্রেম, সুর, মহত্ত্ব, অজানা ফুলের গন্ধ, এবং কী নয়। আর সৃষ্টি ক’রে গেছেন এক অভিনব বাঙলা ভাষা, তার শব্দ ও বাক্যকে করেছেন জ্যোতির্ময়; তাকে নাচিয়েছেন ছন্দে, শিউরে দিয়েছেন মিলে; সাজিয়েছেন অপূর্ব অলঙ্কারে। তিনি মহাকবি, তাঁর মতো আর কেউ নেই।

রবীন্দ্রনাথের কবিতার দুটি সংকলন রয়েছে– চয়নিকা (১৯০৯) ও সঞ্চয়িতা (১৯৩১); এর মধ্যে প্রথমটি বিলুপ্ত, দ্বিতীয়টি সুপরিচিত। সঞ্চয়িতা যদি পরিতৃপ্ত করতো আমাকে, তাহলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান কবিতা সম্পাদনার দরকার হতো না। সঞ্চয়িতা রবীন্দ্রনাথের কবিতার ভালো সংকলন, তবে এটি রবীন্দ্রপ্রতিভাকে ঠিকমতো ধারণ করে না। এটিতে বাদ পড়েছে বহু উৎকৃষ্ট কবিতা, এবং সংকলিত হয়েছে বহু সাধারণ কবিতা। তাই আমি তৈরি করতে চেয়েছি এমন একটি সংকলন, যা হবে সঞ্চয়িতার বিকল্প, যাতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের উৎকৃষ্ট নিদর্শনগুলো সব পাওয়া যাবে সহজে। এর নাম প্রধান কবিতা রেখেছি, শ্রেষ্ঠ কবিতা রাখি নি; কেননা শ্রেষ্ঠ কবিতা গুটিকয় হ’তে পারে, কিন্তু প্রধান কবিতা প্রচুর। প্রধান কবিতা বলতে বোঝাতে চেয়েছি তাঁর সে-সব কবিতাকে, যেগুলোতে তাঁর প্রতিভার উৎকৃষ্ট বিকাশ ঘটেছে। গানও বাদ দিই নি, কেননা কবিতা হিশেবে তাঁর গান অসামান্য। রবীন্দ্রনাথ বিব্রত ছিলেন তাঁর প্রথম দিকের কবিতা নিয়ে, কড়ি ও কোমলকেই তিনি স্বীকার করেছিলেন প্রথম প্রকৃত কাব্য হিশেবে। কিন্তু তিনি এর আগের চারটি কাব্য থেকে সাতটি কবিতা নিয়েছিলেন সঞ্চয়িতায়; আমি নিয়েছি আগের তিনটি কাব্য থেকে পাঁচটি, সন্ধ্যাসংগীত থেকে কোনো কবিতা নিই নি। এ-সংকলন শুরু হয়েছে, আমি সুখী, প্রভাতসংগীত-এর ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ দিয়ে। তার পরের কাব্যগুলো থেকে নেয়া হয়েছে বিপুল পরিমাণে কবিতা, বিচিত্রিতায় এসে সংখ্যা কমেছে, কিন্তু শেষ দিকে আবার বেড়েছে। লিপিকার গদ্য রচনাগুলোকে কবিতা হিশেবে প্রশংসা করা আমাদের অনেক দিনের স্বভাব, কিন্তু তাঁর কাব্যসংকলনে এর থেকে কবিতা নেয়া হয় না; আমি নিয়েছি তিনটি কবিতা, যদিও এগুলো গদ্যের মতো বিন্যস্ত; এবং শিশুদের জন্য লেখা কবিতাকেও আমি উপেক্ষা করি নি। পরের দিকের ছড়ার ছবি থেকে কোনো কবিতা নিই নি। রবীন্দ্রনাথ কিছু কবিতার গানরূপ দিয়েছেন একটু বদল ক’রে; এমন দুটি কবিতাকে (বলাকার ‘আমার গান’ ও গানরূপ ‘গানগুলি মোর শৈবালেরই দল’; এবং সানাই-এর ‘বাদল দিনের প্রথম কদমফুল’ ও গানরূপ বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান’) কবিতা ও গান দুরূপেই নিয়েছি, কেননা দুটি রূপই অপরিহার্য। তিনি অনেক কাব্যগ্রন্থে (যেমন- গীতাঞ্জলি, নৈবেদ্য প্রভৃতি) কবিতার নাম দেন নি, এসব ক্ষেত্রে কবিতার প্রথম বা অন্য কোনো পংক্তি বা পংক্তির অংশ দিয়ে কবিতার নাম রাখা হয়েছে, এবং নাম তির্যক অক্ষরে ছাপা হয়েছে। গানের বেলাও তাই করেছি, সংখ্যা দিয়ে গানগুলো নির্দেশ করতে আমার ভালো লাগে নি ব’লে।

কবিতা সংকলন করেছি আমি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলী (কবিতা, ৩ খণ্ড, ১৯৮০-১৯৮৩) থেকে, এবং এর কাব্যক্রমই মেনে চলেছি। এ-রচনাবলীটি উপকারী, কিন্তু এর রয়েছে এক বড়ো ত্রুটি। রবীন্দ্ররচনায় [অ্যা]-ধ্বনির জন্যে শব্দের শুরুতে মাত্রাযুক্ত এ-কার (t) ব্যবহারের রীতি রয়েছে, কিন্তু এ-রচনাবলীতে নির্বিচারে ব্যবহৃত হয়েছে মাত্রাযুক্ত এ-কার (ট)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান কবিতায় [অ্যা]-ধ্বনির জন্যে শব্দের শুরুতে মাত্রাযুক্ত এ-কার (?) ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্বভারতীর ও পশ্চিম বঙ্গ সরকারের রবীন্দ্ররচনাবলীর কবিতার পাঠের সাথে নানা অমিল রয়েছে সঞ্চয়িতার কবিতার পাঠের। রবীন্দ্রনাথ সঞ্চয়িতায় কবিতা বদল করেছেন, স্তবকবিন্যাস বদলিয়েছেন, অজস্র ক্ষেত্রে যতিচিহ্ন বদল করেছেন; এবং প্রতি স্তবকের শেষে ব্যবহার করেছেন দু-দাঁড়ি (u)। রবীন্দ্ররচনাবলীর কবিতার পাঠের থেকে নানাভাবেই সঞ্চয়িতার পাঠ উৎকৃষ্ট। এ-সংকলনের যেসব কবিতা সঞ্চয়িতায় রয়েছে, সেগুলোতে আমি সঞ্চয়িতার পাঠই গ্রহণ করেছি। যে-সব কবিতার স্তবকশেষে দু-দাঁড়ি (1) দেখা যাবে, বুঝতে হবে সেগুলো সঞ্চয়িতা (এবং গীতবিতান) থেকে নেয়া। রবীন্দ্ররচনাবলীর কবিতার স্তবকবিন্যাস হাতেলেখা পাণ্ডুলিপির স্তবকবিন্যাস, যতিচিহ্নও বিশৃঙ্খল; আর সঞ্চয়িতার স্তবকবিন্যাস মুদ্রিত গ্রন্থের, যতিবিন্যাস সুশৃঙ্খল। রবীন্দ্রনাথ যদি তাঁর সমস্ত কবিতা এভাবে পরিমার্জিত ক’রে যেতেন, খুব ভালো হতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *