আমার পাখিরা
যা কিছু সুন্দর ও স্মরণীয় ও স্বপ্নের মতো, তার সবই আমি দেখেছি ছেলেবেলায়, যখন আমি মেঘ-মাছ-পাখি-ঘেরা গ্রামে ছিলাম। তারপর যেই শহরে এলাম, চারপাশে দেখতে শুরু করলাম ছাইপাশ; তিন দশক ধ’রে যা দেখে দেখে চোখ দুটি একেবারে প’চে গেছে। এখন আর কিছুই দেখতে ইচ্ছে করে না। তাকালেই দেখি শয়তান ও ভাঁড়ের মুখ। আমার চোখ বোঝাই হয়ে গেছে আবর্জনায়; কেতুরের মতো দু-চোখ ভ’রে জ’মে উঠছে নগর, নেতা ও অভিনেত্রী। এসবে একেবারে অন্ধই হয়ে যেতাম, যদি না চোখে অদৃশ্য আঁখিতারার মতো জ্বলতো ছেলেবেলায় দেখা একরাশ অমর দৃশ্য : পাখি, নদী, মাছ, ধানের গুচ্ছ, মেঘ, কুমড়ো ফুল, গাভী, ঘাস, ঢেউ…। এসব এখন আর আমি দেখি না; কিন্তু চোখ বুজলেই দেখতে পাই পাখি উড়ছে, নদী বইছে, কুমড়ো ফুল হলদে হয়ে উঠছে নতুন বউর করতলের মতো। পাখিদের বেশ মনে পড়ে; কিন্তু আমার জগতে কোনো বিখ্যাত পাখি নেই। আমার পাখিরা আমার ছেলেবেলার মতোই অখ্যাত ও অন্তরঙ্গ; কিন্তু কী যে মনোরম! ওই সব পাখিদের আমি অনেক বছর দেখি না, কিন্তু দেখতে খুবই ইচ্ছে হয়, তাই চোখ বুজে অতীত দেখার একটি অভ্যাস হয়ে গেছে আমার। যখন আমার চারপাশের বাস্তবকে দেখতে ঘেন্না লাগে, লাগে মাঝেমাঝেই, তখনি আমি চোখ বুজি, এবং রহস্যের মতো দেখতে পাই ছেলেবেলার স্বর্গের টুকরোগুলো।
প্রথমেই দেখতে পাই ছোট্ট টুনটুনি দুটিকে। ওদের গলার আওয়াজের মতোই ছোটো পাখি দুটি আমাদের উঠোনের কোণার শাদা বেগুনের ডালে একবার বসছে, উড়ে গিয়ে বসছে আরেকটি ডালে; আবার উড়ছে, বসছে, ঠোকর দিচ্ছে, আর শব্দ ক’রে চলেছে টুন টুন টুন টুন। শিশুর মুঠোর মতো ছোট্টো, আর মিষ্টি পাখি : ঘোলাটে রঙ ডানায়, বুক শাদাটে। ওরা কি বিবাহিত? বেগুন গাছটি কেনো এতো পছন্দ ওদের? ডানায় জোর নেই ব’লে উড়ে গিয়ে বসতে পারে না উদ্ধত খেজুরগাছটিতে, বা আমের ডালে? একটি নিঃসঙ্গ পাখিকে দেখতাম আমাদের বাড়ির উত্তর ধারের নতুন আম গাছটিতে। পাখিটাকে আমরা বলতাম দইকুলি, বুকটা কী ফরশা, আর পিঠটি কী মসৃণ কালো! কালো তো? আমার এখনো চোখে ওই কালোই ভাসে; ওর বুক এতো শাদা যে অন্য যে-কোনো রঙকেই তার পাশে কালো মনে হবে। আমি অনেক বছর জানি নি যে ওটাকেই বলা হয় দোয়েল। দোয়েলের থেকে দইকুলি নামটি আমার অনেক বেশি পছন্দ। পাখিটাকে দেখলেই মনে হতো ও যেনো স্বপ্ন দেখছে। ওর ডানায় চঞ্চলতা কম, কোমল ঘন সৌন্দর্যের মতো পাখিটা। বেশি চাঞ্চল্যে সৌন্দর্য ঝ’রে যেতে পারে, তাই ঘনীভূত রূপসীর মতো স্থির থেকে দূরের দিকে তাকিয়ে ও শুধু স্বপ্ন দেখে। ওই পাখিটাকে ছোঁয়ার জন্যে আমার হাতের ত্বক ব্যাকুল হয়ে উঠতো, আঙুল কাঁপতে থাকতো, কিন্তু আমি কোনো দিন ওই পাখিটিকে ছুঁতে পারি নি, যেমন পারি নি আমার স্বপ্নে দেখা সুন্দরকে স্পর্শ করতে।
আমাদের বাড়ির পশ্চিমের পুকুরটি ফাগুন মাসেই শুকিয়ে আসততা, তার এপার থেকে ওপার পর্যন্ত জাজিমের মতো বিছিয়ে থাকতো সবুজ কচুরিপানা। তার ওপর দিয়ে দ্রুত চঞ্চল পায়ে হাঁটতো অতীন্দ্রিয় ডাহুকেরা। পুকুরের পাড়েই ছিলো ঝোঁপঝাড়, তাতে থাকতো লম্বা গলার লম্বা পায়ের ডাহুকেরা। দুপুরে বা রাতে তারা ডাকতো মত্ত বাউল লালন ফকিরের মতো; অদ্ভূত তাদের গলার আওয়াজ। কচুরিপানার ওপর দিয়ে তাদের হাঁটার ভঙ্গিটা ছিলো দেখার মতো। কাউকে যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না ওই পাখি, ভয় পাচ্ছে এখনই হয়তো কারো জাল ছড়িয়ে পড়বে তার ওপর। তবে জাল দিয়ে নয়, ফাঁদ পেতে আমরা অনেকেই ডাহুক ধরার সাধনায় থাকতাম। ওই ফাঁদের নাম ছিলো মারলি। বাঁশ কেটে গম্বুজের মতো মারলি বানাতাম, তাতে ঢোকার জন্যে থাকতো কয়েকটি দরোজা। দরোজায় থাকতো সরু সূতোর ফাঁদ, মারলির মাঝখানে ঝুলতো ধানের গুচ্ছ। খুবই সতর্ক পাখি ডাহুক; তবু লোভ কাকে না আচ্ছন্ন করে? ধান খাওয়ার জন্যে মারলির ভেতরে ঢুকলেই ফাঁদে আটকে পড়তো ডাহুক। আমি দু-তিন বছর মারলি পেতে একবার একটি ডাহুক ধরতে পেরেছিলাম। একটা রহস্যময় পাখি শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে ডাকতো ধান খেতে। চারদিকে সবুজ ধানখেত, নিচে দশহাত পানি, নিরাক পড়েছে দশদিক জুড়ে। নৌকো নিয়ে আমরা ধানখেতে ঢুকতাম। শুনতাম সেই পাখিটার থেকে থেকে ‘ডুব, ডুব’ গভীর আওয়াজ। মনে হতো নীরবতা ডেকে উঠছে থেকে থেকে। আমাদের কাজের ছেলেটি বলতো, পাখিটা পানির নিচে থাকে। তাই ওর শব্দ পানির শব্দের মতো গম্ভীর। ওরা পাখিটাকে বলতো কোরা। পরে বুঝেছি পাখিটার নাম পানকৌড়ি। হয়তো ভুলই বুঝেছি, যদি ভুল বুঝে থাকি সেটাই ভালো লাগবে আমার ওর দেখা পাওয়াই ছিলো কঠিন। থাকতো ঘন ঘাসের মধ্যে, কীভাবে মিশে থাকতো কে জানে! আমি সম্ভবত এক কি দুবার দেখেছিলাম পাখিটাকে উড়ে যেতে। বেশ লম্বা গলার পাখি, পানির সঙ্গেই যার ছিলো ভালোবাসা।
চিল ছিলো অনেক, তবে দু কি তিন রকমের। লালচে ডানার চিলই বেশি ছিলো। বসততা হিজল গাছে, পুকুরের পাড়ের বউন্যা গাছে, বা কচুরিপানার স্তূপের ওপর। শুধু মাছ ছিলো তার স্বপ্ন। ট্যা ট্যা ক’রে ডেকে উঠতো, ঝাঁপিয়ে পড়তো পানিতে, নখে গেঁথে থাকতো ছোটোখাটো মাছ। ওই চিলের পা থেকে মাছ ছিনিয়ে এনেছি আমরা ছোটোরা অনেকবার। বেশ বড়ো মাছ ধরলেই ওই চিল বিপদে পড়তো। উড়তে কষ্ট হতো, আর আমরা পিছু নিতাম তার। এক সময় পা থেকে খসে পড়তো কাতল, ভেটকি বা ছোটো রুই। বড়ো চিলের নাম ছিলো কোড়ল। দেখতেও অনেকটা অন্য রকম, পাখির মধ্যে বাঘের মতো। কোড়ল ছোটো মাছের দিকে থাবা বাড়াতো না, বজ্রের মতো ঝাঁপিয়ে প’ড়ে পানির নিচে বড়ো বড়ো নখ ডুবিয়ে ঘাড়ে ধ’রে তুলে আনতো কাতলার মতো বড়ো মাছ ৷ ধ’রেই গিয়ে বসততা সবচেয়ে উঁচু গাছের ডালে। ওর মহিমায় আমরা মুগ্ধ হতাম। খুব ভালো লাগতো অঘ্রান-পৌষের বিলের সেই মিষ্টি চিলগুলোকে। কী নাম ছিলো ওগুলোর? শাদা রঙ, তার ওপর কালোর ফোঁটা। বেশ শান্ত। বেশি উড়তো না; বসতে ভালোবাসততা বোরোখেতের পাশে স্তূপ ক’রে রাখা ঘাসের ওপর। সবাই বলতো, ওই চিলগুলো যেখানে বসে তার নিচে রয়েছে গুপ্তধন। আমরা সেই চিলের পেছনে পেছনে কতো ছুটেছি ছোটোবেলায়, আর যেখানেই বসেছে ওই চিল তার নিচটা খুঁজেছি তন্ন তন্ন ক’রে। কোনো ‘পাওয়া’, গুপ্তধনের নাম ছিলো ‘পাওয়া’, আমরা কেউ পাই নি। অনেক মাটির নিচে কি ছিলো সেই গভীর গুপ্তধন, মোহরভরা সোনার কলসি? ওই চিলের নামই কি শঙ্খচিল? সেই চিল কি নিজেই খুঁজতো নিজের হারানো ধন, যার শোকে তার বুক থেকে বেজে উঠতো তীক্ষ্ণ কান্না?
শাদা বক দাঁড়িয়ে থাকতো এক পা তুলে মাছের আশায় আমাদের উত্তরের পুকুরে চোতবোশেখ মাসে। এক সময় কি ওই বকগুলোরই মাথায় গজিয়ে উঠতো লম্বা ঝুঁটি? খুবই চালাক বক, মাছের ধ্যানে থাকলেও চারপাশের বাস্তবতাকে ভুলতো না একবারও আরেক রকম বক ছিলো আমাদের পুকুরে, উত্তরের আড়িয়ল বিলে- একটু ছোটো, পাখা ধূসর রঙের। দেখতে একটু গরিব। সন্ধ্যে হ’লে আমাদের বাড়ির গাছগুলোর মাথায় এসে ঝাঁকেঝাঁকে বসততা বকেরা। কেউ কেউ আস্তে ধীরে উঠতো বক ধরার জন্যে, কিন্তু ধরা অসম্ভব। শাদা বকগুলো ঠোকর দিতে ছিলো খুবই দক্ষ। একবার আমাদের গ্রামে একদল লোক বক শিকার করেছিলো। ডানাভাঙা একটি বক এক ঠোকরে তুলে নিয়েছিলো আমারই এক বন্ধুর ডান চোখ। সে থেকে আমরা সাবধান ছিলাম, বকের কাছেও ঘেঁষতাম না। বক মানুষের চোখেই ঠোকর দিতে ভালোবাসে। চোখ কি দেখতে মাছের মতো? একটু সন্ধ্যা হ’লে ওয়াক এসে বসততা আমাদের বাড়ির পশ্চিম ধারের বিশাল তেঁতুলগাছে। শিকারীদের প্রিয় পাখি ছিলো ওয়াক। দিনের বেলা ওরা যে কোথায় চ’লে যেতো জানতাম না; সন্ধ্যে হ’লেই আবার ফিরে আসততা। কিন্তু আমার ছেলেবেলায়ই এক সন্ধ্যেয় দেখলাম ওয়াকেরা আর ফিরে এলো না। তারপর আমাদের গ্রামের কোনো গাছ আর ওয়াকের শরীরের গন্ধ পায় নি। পাখিরা বুঝে গিয়েছিলো পৃথিবীতে বন্দুকের উৎপাদন বেড়ে গেছে।
আমি কোনোদিন বন্দুক ধরি নি, তবে একবার আড়িয়ল বিলে পাখি শিকারে গিয়েছিলাম। হয়তো সেটা ছিলো পৌষ মাস, আড়িয়ল বিলের পানি ঠাণ্ডা আর কোমর পর্যন্ত। এখানে সেখানে ঘন বোরো খেত। আমার বয়স বারো তেরো, আর যারা শিকার করবে, তাদের বয়স বাইশ তেইশ। কাদার ওপর দিয়ে আর ভেতর দিয়ে অনেক উত্তরে এসে দেখি পাখি আর পাখি। বালিহাঁস ভাসছিলো। কিন্তু গুলি করার আগেই তারা উড়ে চ’লে যায় দিগন্তে। আমরা পেয়েছিলাম কতোগুলো ছোটোছোটো পাখি। নাম নাকি ভুরভুরা পাখি। এক ছটাকও ওজন হবে না, দেখতেও ভালো নয়। বন্দুকে ছিলো ছররাগুলি- গুলি করলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তো অনেক জায়গা জুড়ে। ভুরভুরা এতো ছোটো পাখি যে মারা গেলেও ঘাসের ভেতরে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমার মনে আছে তরুণ শিকারীরা খুবই হতাশ হয়েছিলো। তারা গিয়েছিলো বালিহাঁসের মাংসের লোভে, কিন্তু জুটলো এমনি পাখি একটা ছররা লাগলেও যার শরীর ছিঁড়েফেড়ে একটু তুলোর মতো পালক ছাড়া আর কিছুই থাকে না।
একবার একটা মস্ত পাখি কোথা থেকে যেনো উড়ে এসে পড়েছিলো আমাদের পাশের গ্রামে। বিরাট পাখি। পাঁচ-ছজন ছাড়া তাকে ধ’রেই তোলা যায় না। আগে নাবি ওই পাখি আমাদের এলাকার কেউ দেখে নি। একটা উড়ন্ত উটের মতো পাখি, দেখতে কুৎসিত, কিন্তু তার বিরাটত্বই তার গৌরব। কেউ কেউ বললো ওটার নাম ধুপনি ৷ ওই নামে কি কোনো পাখি আছে? আমাদের গ্রামে বা পাশের গ্রামে যেমন হিমালয় পর্বত থাকার কথা নয়, ঠিক তেমনি ওই পাখিও থাকার কথা নয়। থাকা কেনো, নামারও কথা নয়। কিন্তু ওটি কোনো আততায়ীর হাত এড়িয়ে চ’লে আসতে পেরেছিলো, কিন্তু তার বুলেটের হিংস্রতাকে এড়াতে পারে নি। একটা পা ভেঙে গিয়েছিলো তার, একটা ডানাও হয়তো বিকল হয়ে পড়েছিলো। হয়তো কয়েক হাজার মাইল সে উড়েছিলো ওই ভাঙা পা আর বিকল ডানা নিয়ে, এবং এসে পড়েছিলো আমাদের পাশের গ্রামে। আমার খুব দুঃখ হয়েছিলো ওর জন্যে। কেনো ওই আকাশের সম্রাট এসে পড়লো গৌরবহীন বালাশুরে? ওর মৃত্যুর যোগ্য স্থান তো ছিলো কোনো পর্বত বা মানস সরোবর। অথচ ওই মহান পাখি রান্না হয়ে ঢুকলো তাদের জঠরে, যারা তার নামও জানে না। পাখিদের জীবনেও রয়েছে নিয়তির নির্মম পরিহাস?
কোকিল আর ঘুঘুর কথা আমার একই সাথে মনে পড়ে। কোকিল তো খুব বিখ্যাত আর শস্তা কবির মতো জনপ্রিয় পাখি,- এমন কি আহাম্মকেরাও কান পেতে একবার কোকিলের ডাক শোনে, আর বধিরেরাও প্রশংসা করে তার সুরের। হাইনের মতো আমারও কোনো কোনো সময় মনে হয় কোকিলের গান মুখস্থ গান মাত্র, তাতে আন্তরিকতার ছিটেটুকুও নেই। তবে কোকিল আমি পছন্দ করি, এক আধবার শ্রুতিও ধার দিই তাকে। কিন্তু বুক দিতে হয় ঘুঘুকে। চোত মাসে যখন চারদিক খা খা করতো, আর পশ্চিমের ছাড়াবাড়িটাতে বুক ভ’রে কাঁদতে শুরু করতো ধূসর ঘুঘুটি, আমার বুকে হাহাকার শুরু হতো। কামারগাঁয়ে ঘুঘুর কান্না ছিলো আরো করুণ। চোত-বোশেখের রোদে কামারগাঁয়ের বাঁশবন ঝা ঝা করতো, উদাস শব্দ উঠতে থাকতো ডালপালার মর্মর থেকে; আর তখন কেঁদে উঠতো শোকাকুল ঘুঘু। ‘ঘুঘু.. ঘু’ যেনো চোতের বিষণ্ন সুর। একটা গল্প শুনেছিলাম ছোটোবেলায়;- ঘুঘু নাকি কেঁদে কেঁদে নিজের পুত্রের মৃত্যুর কাহিনী বলে। বিলাপ করে। ঘুঘু ছিলো রূপসী সতী- ঝড় আর প্লাবন থেকে বাঁচার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলে নদীতে। বুকে নিয়েছিলো নিজের প্রিয় সন্তানকে, আর পিঠে নিয়েছিলো সতীনের সন্তানকে। নিজের সন্তানকে তো বুকে নেবেই সবাই, কিন্তু ওই নারী জানতো না বানের স্রোতে ভেসে যাবে বুকের সন্তান, আর বেঁচে থাকবে পিঠে-ভর-করা সতীনের সন্তান। শোকভারাতুর নারী জন্মায় ঘুঘু হয়ে, কিন্তু জন্মজন্মান্তর ধ’রে বুকে পুষে রাখে তুষের আগুনের মতো শোক। ঘুঘু কেঁদে কেঁদে বিলাপ করে। তার ধূসর রঙ, চোতের হাহাকার, বাতাসের বিলাপ সব মিলে ঘুঘু বুকের বেদনার মতো পাখি হয়ে আছে।
কাক বেশ চমৎকার পাখি, এবং আমার বেশ পছন্দ। অন্য পাখিদের দিকে তাকালে মনে হয় ওরা নিজেদের ছাড়া আর কিছু বোঝে না; ওরা মনে করে পৃথিবীটা ওদেরই জন্যে বানানো হয়েছে। কিন্তু কাক দেখলে তা মনে হয় না। কাকই একমাত্র পাখি যেটি মানুষের সাথে সক্রিয় সম্পর্কে জড়িত। কাক জানে পৃথিবীটা মানুষের অধিকারে। আর কোন পাখি এসে দরোজায় দাঁড়ায়, মানুষের সঙ্গে একটু খাবার ভাগাভাগি ক’রে নিতে চায়? এ-শহরে যদি উড়ন্ত কোনো প্রাণ দেখতে চাই, সে-সুখ কাক ছাড়া আর কে দেয়? আর সব পাখিরই রয়েছে একটু অন্যমনস্কতা, একটু বন্যতা, আর কাকের রয়েছে পুরোপুরি মনুষ্যত্ব বা বাঙালিত্ব, আর রাজনীতি। যেভাবে হঠাৎ এসে থালা থেকে ভাজা মাছ নিয়ে যেতো কাক, মুড়ি ছুঁড়ে দিলে মাটিতে পড়ার আগেই টপ ক’রে ঠোঁটে ধ’রে ফেলতো, তা আর কোন পাখি পারে? শীতকালে তো কাক হয়ে ওঠে মসৃণ সুন্দর। কাকের বাসাও চমৎকার, ডিমও সুন্দর নীল। চমৎকার তাদের সমাজতান্ত্রিক মনোভাব। কাকের বাসা থেকে ডিম পেড়ে, বা কাকের ছা নিয়ে এসে শান্তিতে থাকার উপায় ছিলো না। দলে দলে কাক এসে হাজির হতো, মাথায় ঠোকর দিতো ধারালো ঠোঁট দিয়ে। কাকের ন্যায়সঙ্গত প্রতিশোধস্পৃহাকে শ্রদ্ধা না ক’রে পারা যায় না। কাক শূদ্ৰ হ’তে পারে, কিন্তু দাঁড়কাক ছিলো একেবারে ব্রাহ্মণ। বেশ বড়ো, চোখে বা ডানায় চাঞ্চল্য নেই; গম্ভীর গলায় ডাকে ‘কা, কা’। বেশি দেখতেও পাওয়া যেতো না। আমার এক হিন্দুবন্ধুর বাবা মারা গিয়েছিলো; একদিন দেখি সে ধুতি প’রে চুল কামিয়ে একটা পেতলের বাটিতে দুধ আর শবরি কলা নিয়ে এসে বসলো আমাদের বাড়ির পশ্চিমের বুনোবাড়িটির বড়ো আমগাছটির নিচে। সে-গাছের ডালে একটি দাঁড়কাক স্থির শান্তভাবে ব’সে তার নিজস্ব বৈদিকে আবৃত্তি ক’রে চলছিলো ধীরগম্ভীর বেদমন্ত্র। তার খেয়াল নেই নিচের বাস্তবতার দিকে; সে পৃথিবীটাকে কিছু দুরূহ গভীর বাণী শুনিয়ে যাচ্ছিলো। নিচে উৎকণ্ঠ হয়ে অপেক্ষা করছিলো আমার বন্ধুটি– কখন ওই পক্ষীব্রাহ্মণের চোখ পড়বে শবরি কলা আর ঘন দুধের দিকে। তারপর থেকেই দাঁড়কাক দেখলেই পাখিটিকে খুব মহান ব’লে মনে হতো আমার, মনে জন্ম নিতো অপার্থিব মহত্ত্বের বোধ। অ্যালান পোর ডানাঝাঁপটানো দাঁড়কাক নয়, শান্ত গম্ভীর দাঁড়কাক ছিলো আমার ছোটোবেলায়। এখন কি আছে ওই মহৎ পাখি, না কি বিদায় নিয়েছে গ্রাম থেকে?
শকুনও খুব খারাপ লাগতো না ছেলোবেলায়। বড়ো হয়ে এশিয়ার আকাশে আকাশে উড়িতেছে শকুনেরা ধরনের রূপকের সাথে পরিচয়ের পর মানসিক ঘেন্না ধ’রে গেছে শকুন সম্বদ্ধে; কিন্তু ছোটোবেলায় এমন কোনো ঘেন্না ছিলো না পাখিটির প্রতি, যদিও কুৎসিত পাখিটিকে দেখলে শরীরটা কেমন কেমন করতো। আমাদের খেলার মাঠের ধারেই ছিলো একটা ভাগাড়। গরুও বেশ মরতো- শুকনো কালে প্রায়ই ছালতোলা মরা গরু প’ড়ে থাকতো ওই ভাগাড়ে। ছাল তুলতে আসততা ঋষিরা। মানুষের মধ্যে তখন ঋষিদের যেমন মনে হতো- খুব গরিব, গরু মরলেই দৌড়ে আসে, কারো সাথে কথা বলে না, কেউ কথা বলে না তাদের সাথে- শকুনকেও মনে হতো পাখিদের মধ্যে ঋষি ব’লে। ঝাঁকে ঝাঁকে আসততা, বসততা গরু ঘিরে। আমরা ঢিল ছুঁড়ে মারতাম, ডানা ধ’রে টেনে মাটির ওপর দিয়ে হেঁচড়াতাম। ভয়ংকর ছিলো না শকুনেরা, কামড় দিতো না; বরং ভীতু ছিলো একটু বেশি– আমাদের দেখলেই হেলেদুলে সরে যেতো। তবে ওই দলে ছিলো গিন্নি বা গৃধনী ব’লে এক রকম শকুন। গলায় কোনো লোম থাকতো না ওগুলোর, কান দুটিও ঢলঢল করতো। ওগুলো রাগী ছিলো, কাছে ঘেঁষতে পারতাম না। বড়ো গরিব ব’লেই মনে হতো আমার শকুনদের; এবং মায়াও লাগতো ওদের জন্যে। পাখি বা কোনো জন্তুকে খারাপের রূপক হিশেবে দেখলে আমার খারাপ লাগে। যেমন, শকুনকে সাম্রাজ্যবাদ বা শোষকের রূপক হিশেবে দেখতে অশ্বস্তি লাগে আমার; কারণ ওই পাখি সাম্রাজ্যবাদ বা শোষকদের মতো কুটিল নয়। পাখিরা, জন্তুরা মানুষ ও মানুষের ক্রিয়াকলাপের মতো শোচনীয় জঘন্য অমানবিক খারাপ কখনো হয় না। জন্তুরাই বেশি মানবিক।
মাছরাঙা ছিলো রঙিন খেলনার মতো। মনে হতো ওটা আমাদের উড়ন্ত খেলনা; কোনো মেলা থেকে উড়ে চ’লে এসেছে আমাদের পুকুরের মাঝখানের আকাশে। সবুজ রঙটাই চোখে ঢুকতো বেশি। আজ মাছরাঙার সবুজ রঙের বিভাই জ্বলছে আমার চোখে, এবং তার ওই দীর্ঘ ঠোঁট। পুকুরে পোঁতা কোনো বাঁশের ওপর ব’সে থাকতো, এক সময় সবুজ লাটিমের মতো স্থির হয়ে উড়তে থাকতো; তারপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। তুলে নিয়ে আসততা পাবদা, বা পুঁটি, এবং বসততা গিয়ে বাঁশের মাথায়। ছোটো মাছরাঙাগুলো ছিলো চঞ্চল, যতো ঝাঁপাতো ততো মাছ জুটতো না; কিন্তু বড়োগুলোকে কখনো বেহিশেবি লাফ দিতে দেখি নি। মাছরাঙা পাখিরা কতোটা নিচ পর্যন্ত দেখতে পায়? ওরা কি ক’রে হেলিকপ্টারের মতো উড়তে পারে একই জায়গায়?
ছেলেবেলায় আমার আরো কতো পাখি ছিলো। যখন আমি ট্রাকের শব্দে বধির হই, নগরের মুখ দেখে দেখে অন্ধ হই, তখন কান পেতে রই বাল্যকালের দিকে, চোখ মেলে ধরি ছেলেবেলার দিকে। পাখিদের ডানার রঙে, আর তাদের কলরবে আমার চোখ ঠাণ্ডা হয়, কান তৃপ্ত হয়। শুনতে পাই পাখি সব করে রব, শুনতে পাই পাখি সব করে রব; আমার কাননে কুসুমকলি ফোটে।