শহীদ মিনার : কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু
রক্ত আর অশ্রুর ফোঁটা অবিনশ্বর নয়, তা জীবনের মতোই করুণ কোমল নশ্বর। হৃৎপিণ্ডের একবিন্দু রক্ত ধুলোয় ঝরলে মাটি তা শুষে নেয়, টলমল করা অশ্রুর ফোঁটা চোখের কোণ থেকে গড়িয়ে মিশে যায় অনন্তে। রক্ত আর অশ্রু ধাতুতে গঠিত নয়; মহাকালের বিরুদ্ধে উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না অশ্রু আর রক্ত। শিশিরের মতো ক্ষণায়ু তারা, কিন্তু মন চায় তাদের চিরায়ু দিতে। প্রিয় রক্ত আর অশ্রুকে কে কবে ভুলেছে? এক ফোঁটা রক্ত অবিস্মরণীয় হয়ে উঠতে পারে মহাযুদ্ধের চেয়ে, আঁখিপাতে টলোমলো একবিন্দু অশ্রু হয়ে উঠতে পারে মহাসাগরের চেয়ে বিশাল গভীর। রক্ত আর অশ্রুর ভূভাগের নাম বাঙলাদেশ। এর পলিমাটিতে মিশে গেছে অজস্র হৃৎপিণ্ডের রক্ত। তাই এতো লাল ফুল ফোটে এদেশে; আর তার কপোলে টলমল করে অশ্রু। শহীদ মিনারখচিত বাঙলায় কতো শহীদ মিনার আছে পথের ধারে, বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে, বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে, ঘাসের আস্তরণের নিচে, কেউ তা জানে না। যখন আমি কোনো শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়াই, মনে হয় দাঁড়িয়ে আছি অশ্রুবিন্দুর পদতলে, টলমল করছে ওই অশ্রুবিন্দু যদিও তা গঠিত ধাতুতে। একেকটি শহীদ মিনার আমাদের প্রিয় অশ্রুবিন্দু, যাকে পরিয়ে দিয়েছি কাফন। আমাদের শোক হয়ে তা টলমল করছে সারাক্ষণ। অশ্রু টিকে থাকতে পারে না, কিন্তু বায়ান্নো থেকে বাঙালি তার অশ্রুকে অবিনশ্বর করতে শিখেছে : শিখেছে এক নতুন স্থাপত্যকলা, যাতে অশ্রু রূপান্তরিত হয় শহীদ মিনারে। শহীদ মিনারে চিরায়ু লাভ করে আমাদের অশ্রু; স্থির দাঁড়িয়ে থাকে পথপ্রান্তে, বিদ্যালয়েরপ্রাঙ্গণে, বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে। বাঙলাদেশের পথেপ্রান্তে আছে অজস্র ধাতুতে গঠিত অশ্রুবিন্দু, যা আমাদের করুণ চোখের জলের অবিনাশী রূপান্তর।
এমন শোকাকুল দেশ আর কোথায় পাওয়া যাবে? কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে এতো বড়ো রক্তের ফোঁটা আর আশ্রুবিন্দু? আমাদের ইতিহাস ঘাতক আর শহীদদের ইতিহাস; ইতিহাসের প্রতিটি যুগেই ঝ’রে পড়েছে বাঙালির বুকের রক্ত, বাঙলার মাটি শুষে নিয়েছে সন্তানের রক্ত। শুকিয়ে গেছে মায়ের বোনের চোখের কোণে অশ্রু, কিন্তু বায়ান্নোর রক্ত শুকোতে দেয় নি বাঙালি, মিশে যেতে দেয় নি অশ্রুকে। তারপরও রক্ত ও অশ্রুর অভাব ঘটে নি; লুপ্ত হয় নি ঘাতকেরা, অভাব ঘটে নি শহীদের। উঠেছে মিনারের পর মিনার। টলমল করছে অশ্রুবিন্দুর পর অশ্রুবিন্দু, শোকে ছেয়ে গেছে বাঙলাদেশ। আমি চোখ বুজলেই অজস্র শহীদ মিনার, টলোমলো অশ্রুবিন্দু, দেখতে পাই : অশ্ৰু দুলছে চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের পাশে, টলমল করছে অশ্রুমিনার বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম, সিলেটে; গ্রামগঞ্জে, পথের প্রান্তে। ফুল ফুটছে, ফুলে ভরে উঠছে বেদি। মিছিল চলছে আলপনাআঁকা পথ দিয়ে অশ্রুবিন্দুর দিকে, শোক বেজে উঠেছে মানুষ আর প্রকৃতির আত্মার অভ্যন্তর থেকে। দাঁড়িয়ে আছে শহীদ মিনার; কাফনে মোড়া অক্ষয় অশ্রুবিন্দু।
শহীদ মিনার বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত স্থাপত্যকলা। শোকে যেমন দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অজ্ঞাতে, উদগত হয় অশ্রুরেখা, ঠিক তেমনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে মথিত বুকের গীতিকার মতো উৎসারিত হয়েছে একেকটি শহীদ মিনার। কোনো পূর্বপরিকল্পনার প্রয়োজন পড়ে নি, অনেক ভেবে বের করতে হয় নি তাদের অবয়বকাঠামো। মাথা জীর্ণ ক’রে উদ্ভাবন করতে হয় নি তাদের রূপকার্থ। একটি ইঁট ছুঁড়ে দিলেই হয়েছে শহীদ মিনার। এক টুকরো জমির ওপর এক ধাপ মাটি জড়ো করলেই তা রূপ ধরেছে শহীদ মিনারের। একগুচ্ছ ফুল জড়ো করলেই রচিত হয়েছে একটি শহীদ মিনার। প্রত্যেকটিতে জড়ো হয়েছে শোক বেদনা দীর্ঘশ্বাস; প্রতিটিই বহন করেছে দ্যুতিময় রূপকার্থ। এমন অবলীলায় কোনো বস্তু বা উপাদানকে এতো অর্থদ্যূতিময় করতে পারে নি কোনো শিল্পী; কিন্তু শহীদ মিনার- বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে, রাস্তার পাশে, ছাত্রাবাসের সম্মুখে, মাঠের প্রান্তে- যাঁরা গ’ড়ে তুলেছেন বাঙলাদেশ ভ’রে, তাঁরা অবলীলায় বস্তুকে পরিণত করেছেন অবিনাশী রূপকপ্রতাঁকে। যার মাটি নেই, সে আকাশে মনে মনে এক টুকরো মেঘকে জড়ো করে বানাতে পারে শহীদ মিনার। পথের পাশে কয়েকটি তৃণগুল্মলতা জড়িয়ে রচনা করা সম্ভব প্রদীপ্ত শহীদ মিনার। প্রতিটিই টলমল করতে থাকে অশ্রুবিন্দুর মতো, প্রতিটিই দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে অতল অভ্যন্তর থেকে।
বায়ান্নোর তেইশে ফেব্রুয়ারির রাতেই ঘাতকদের চোখ এড়িয়ে টলমল ক’রে উদগত হয়েছিলো বাঙলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার; এবং সেটি ছিলো অশ্রুবিন্দুর মতোই অচিরস্থায়ী আর সমুজ্জ্বল। ঘাতকেরা শুধু প্রাণ নিয়েই তৃপ্তি পায় না, তারা হরণ করতে ভালোবাসে শোক আর অশ্রু : তাই ওই প্রথম শহীদ মিনার ঘাতকদের আক্রমণে গ’লে গিয়েছিলো। দু-দিন বয়স্ক হ’তে না হ’তেই নুরুল আমিন ওই অশ্রুবিন্দু মুছে দিয়েছিলো রোমশ আঙুলে। সে-প্রথম কোমল অশ্রু আমি দেখি নি; অনেকে দেখে নি তার টলোমলো বেদনা। কিন্তু তার ছবির দিকে তাকালে মন ছলছল ক’রে ওঠে। খুব বেশি ভাবনার সময় ছিলো না তার রূপ সম্পর্কে, ঘাতকদের মধ্যে অবস্থান ক’রে তাকে বিশাল করা ছিলো অসম্ভব। প্রয়োজনও ছিলো না। কে কবে বুকের দুঃখকে ভাবনা চিন্তা ক’রে পরিণত করে অশ্রুতে? বেদনা নির্ভর করে না অশ্রুবিন্দুর বিশালতার ওপর। চরম দুঃখে গোপন বেদনার মতোই অশ্রুরূপে টলমল ক’রে উঠছিলো প্রথম শহীদ মিনার, এবং মুছে গিয়েছিলো পশুর রোমশ থাবায়। একটি বেদির ওপর কয়েক ফুট উঁচু চারকোণা আরেকটি বেদি, তার ওপর দুটি স্তর, তার ওপর দু-তিন ফুট উঁচু একটি মিনার, এই তো প্রথম শহীদ মিনার। উদ্ধত নয়, জমকালো নয়; কিন্তু তার ছবির দিকে তাকালেই সে-আবেগ জাগে, যা জাগে মায়ের চোখের অশ্রুরেখার দিকে তাকালে।
ওই যে অশ্রুবিন্দু প্রথম শহীদ মিনাররূপে দেখা দিয়ে ঝ’রে গেলো, তাই শেষ নয়। রোদনকে কেউ রুদ্ধ ক’রে রাখতে পারে না, বন্দুক দেখিয়ে রোধ করা যায় না শতধারায় উৎসারিত অশ্রু। পীড়নকারীরা পীড়িতের প্রতিরোধকে যতোটা ভয় পায়, তার চেয়ে অনেক বেশি ভয় পায় রোদন ও অশ্রুকে। ওই রোদন, ওই অশ্রু সাময়িক প্রতিরোধের চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ, তা জ্বেলে দেয় অক্ষয় অব্যয় অবিনাশী অশ্রুর আগুন। তাই বায়ান্নোর পর শহীদ মিনার মাথা তুলতে পারে নি, যেখানেই তুলতে চেয়েছে সেখানেই এগিয়ে এসেছে ঘাতকের রোমশ আঙুল। উনিশ শো তিপ্পান্নোতে ইডেন মহাবিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে টলমল ক’রে উঠতে চেয়েছিলো একফোঁটা অশ্রু; কয়েকটি ইঁটের গাঁথুনিতে প্রতাঁকের দ্যূতিভরা স্তম্ভ। কিন্তু উঠতে পারে নি। একটি ছবি আছে তার–কয়েকটি ইঁটের ওপর, ইঁট না কি ফুল, বসাচ্ছে এক তরুণী, এবং তার মতো হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আরো কয়েকটি তরুণী। দুজন স্যুট-টাই-পরা ভদ্রলোক, হয়তো তারা ঘাতকদের সুশ্রী প্রতিনিধি, কঠোরভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ভয়ংকরভাবে ফেটে পড়েছে অধ্যক্ষা- ঘাতকদের রোমশ বাহু। ওই অশ্রু রোমশ আঙুলের ঘর্ষণে শুকিয়ে গিয়েছিলো। শুধু তাই নয়, বহিষ্কৃত হয়েছিলো কয়েকজন ছাত্র ও ছাত্রী, ঢাকা ও ইডেন কলেজ থেকে, অশ্রুকে বাস্তব প্রতীকী রূপ দেয়ার অপরাধে। বায়ান্নো থেকে তিপ্পান্নো- এ এক বছর হলো রোমশ হাতে অশ্রু মোছার কাল : যেখানেই মাথা তুলেছে শহীদ মিনার সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে পাকিস্তানি ঘাতকেরা।
কিন্তু উনিশ শো তিপ্পান্নো থেকে দুর্দমনীয় ভঙ্গিতে মাথা তুলতে থাকে শহীদ মিনার। মেডিক্যল ছাত্রাবাসের সামনে দেখা দেয় প্রতীকী স্তম্ভ, ঢাকা হলে ওঠে একটি ছোটো মিনার, এবং সারা দেশে একই চোখের পাতায় জমা অশ্রুরেখার মতো টলমল ক’রে ওঠে শহীদ মিনারগণ। এসব মিনার ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত। একাত্তরের পর এদের সাথে যুক্ত হয় স্বাধীনতার শহীদদের মিনার, এবং এখন বাঙলাদেশের পরোতে পরোতে ছড়িয়ে আছে তারা। ঢাকা শহরে প্রতি এক মাইলে পাওয়া যাবে এমন একেকটি অশ্রুবিন্দু। মায়ের নিঃসঙ্গ অশ্রুর মতো তারা টলমল করে সারা বছর, এবং ফেব্রুয়ারি এলে তাদের ঘিরে গীত হয় শোকগাথা, ঝ’রে পড়ে ফুলদল। অনেক তাদের রূপ, বিস্তার তাদের বিভিন্ন রকম, উচ্চতা নানা মাপের, কিন্তু অর্থ অভিন্ন। দূর থেকে যে-কোনোটিকে দেখলেই ছলাৎ ক’রে ওঠে অন্তর। তাদের দিকে তাকালে কখনো মনে হয় না তাদের বানানো উচিত ছিলো আরো সুপরিকল্পিতভাবে, প্রয়োজন ছিলো শিল্পিতার; মনে হয় যা হয়েছে তাই পরম, অশ্রুবিন্দুর কোনো সুপরিকল্পিত শিল্পিত রূপ কেউ আশা করে না। আমি অজস্র ছোটো বড়ো মাঝারি অশ্রুবিন্দু দেখেছি, প্রতিটিই অভিন্নভাবে ব্যাকুল করেছে আমাকে। ওদের কাছে এলেই শিথিল হয়ে আসে গতি, কলকল ক’রে ওঠে বুক, মাথা নত হয়ে আসে, বুকের ভেতর ফুল ফুটতে আর ঝরতে থাকে। বাঙলাদেশে এতো পবিত্রতা, এতো মর্মস্পর্শিতা অর্জন করতে পারে নি আর কোনো বস্তুতেগড়া কাঠামো।
অজস্র শহীদ মিনার রয়েছে বাঙলাদেশে, মিলেমিশে গেছে একুশ আর একাত্তরের শহীদ মিনার। দুকালে ঘটে দুটি আপাতপৃথক ঘটনা, কিন্তু মৰ্মত অভিন্ন এরা। বায়ান্নো আর একাত্তর একই বছর, ঘটে একই ঘটনা। একুশই আমাদের অঘোষিত অস্বীকৃত স্বাধীনতা দিবস; একুশ না ঘটলে একাত্তর ঘটতো না। তাই দু-কালের শহীদ মিনারে নেই কোনো অবয়ব ও আর্থপার্থক্য, যদিও বাহ্যিক পার্থক্য রয়েছে মিনারের সাথে মিনারের। সলিমুল্লাহ হলের মিনারটি গোল থামের মতো উঠে গেছে ওপর দিকে, বেশি ওপরে ওঠে নি, কিন্তু যেনো ভেদ করেছে আকাশ। একটি বালক বিদ্যালয়ে অপ্রশস্ত ভিত্তির ওপর সূর্যের তিনটি রেখার মতো স্থির হয়ে আছে শহীদ মিনার। মতিঝিল কলোনিতে আছে বেদির ওপর দুটি অমসৃণ দেয়াল, কিন্তু তা শোক প্রকাশে অব্যর্থ। শান্তিনগরের মোড়ে ছ-স্তর বেদির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তিনটি স্তম্ভ, জসীমউদদীন সড়কে শহীদ মিনার দাঁড়িয়ে আছে একটি তরুণের মূর্তিতে, জগন্নাথ হলে সূর্য বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শহীদ মিনার। এগুলোর অধিকাংশই একাত্তরের, কিন্তু এরা বায়ান্নোরই। বাঙলাদেশ ভ’রে টলমল করছে এ-অশ্রুবিন্দুমালা।
সব মিনারের মূল আর কেন্দ্র কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, যা বাঙলাদেশের প্রতীকী কেন্দ্রবিন্দু। আমি এ-বিশাল অশ্রুবিন্দুকে, রোদন আর দীর্ঘশ্বাসের অনশ্বর রূপকে, দেখে আসছি উনিশ শো তেষট্টি থেকে। চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের পাশে যেখানে ঝ’রে পড়েছিলো একুশের শহীদদের রক্ত, সেখানে টলমল করছে শোকের কাফন পরা এ-অশ্রুবিন্দু। এখানে আসে চিরন্তন বাঙালি আর তার সন্তান, ফুল দেয়, হৃৎপিণ্ড দেয়। এখানে আসে শাসকেরাও; তাদের আসতে হয় শক্তিতে থাকার লোভে, না এলে টলমল ক’রে উঠবে সিংহাসন, তাই তারা আসে। শাসকসম্প্রদায় সব সময়ই অনান্তরিক, এক ক্ষেত্রেই শুধু আন্তরিক তারা- ক্ষমতায় অবস্থানের ক্ষেত্রে। তাদের বুকে কোনো ফুল ফোটে না ব’লে তারা সরকারি মালি দিয়ে বানিয়ে আনে কৃত্রিম ফুলের তোড়া। শহীদ মিনারে ওই একটি, আর ক্ষমতালুব্ধ আরো কয়েকটি তোড়া পড়ে, যেগুলোর হৃৎপিণ্ড নেই, অশ্রু নেই; আছে শুধু ক্ষুধা আর লিপ্সা। তারা আসে কখনো লোক সরিয়ে দিয়ে, কখনো তাড়া খেতে খেতে। কিন্তু তাদের আসতে হয়, ওই ক্ষমতাসীনদের অনেকেই মনে মনে ঘেন্না করে এ-অশ্রুবিন্দুকে, কিন্তু ফুল নিয়ে না এসে পারে না। যারা আসে না বিনাশ হয়ে ওঠে তাদের আশুনিয়তি। মন ভ’রে ফুল ফুটিয়ে আসে অন্যরা, শক্তি যাদের পদতলে নয়, শক্তি যাদের লক্ষ্য নয়; তারা কিছু বাস্তব ফুল রাখে বেদিমূলে, কিন্তু মনে মনে রাখে পৃথিবী ভ’রে দেয়ার মতো রক্তগোলাপ
এ-অশ্রুবিন্দু এক দিনে এক বছরে ওঠে নি। পঞ্চান্নোর একুশে রচিত হয় এর ভিত্তি, তেষট্টিতে এটি পায় পরিচিত আকার। একাত্তরে এ-অশ্রুবিন্দু লক্ষ্য ক’রে গর্জে ওঠে পাকিস্তানি কামান; ডানাভাঙা পাখির মতো শহীদ মিনারকে প’ড়ে থাকতে দেখেছি আমি একাত্তরে। বাহাত্তর কাটে আহত অবস্থায়, আবার তিয়াত্তরে ফিরে পায় রূপ। কয়েকদিন আগে বেশ দূর থেকে আমি তাকিয়ে দেখছিলাম তার রূপ; মনে হলো পাখির ডানা থেকে খ’সে পড়া একটি নরম পালক। বিশাল প্রাঙ্গণে পাখির পালকের মতো প’ড়ে আছে শহীদ মিনার। আমি এ-মিনার দেখে আসছি তেষট্টি থেকে, এর পাশ দিয়ে আমাকে কয়েক বছর ক্লাশে যেতে আর ছাত্রাবাসে ফিরতে হয়েছে। তার নিচের পথটি ছিলো আমার নিত্য পথ। তাকে দেখেছি আমি তেষট্টিতে, একাত্তরে, তিরাশিতে, দেখেছি প্রায় প্রত্যেক দিন। ঢাকা শহরে এই একটি মাত্র কাঠামো আছে, যার পাশ দিয়ে গেলে কাঁপন লাগে মনে আর শরীরে; শিশির জমে মনের ঘাসে ঘাসে। আমি কতো দিন একে আমার মনের ভেতরে স্থাপন ক’রে পথ হেঁটেছি, তার করুণ কোমলতায় নিজকে করুণ করেছি। পৃথিবীর বহু কিছু সম্পর্কে আমার কড়া আপত্তি আছে, এমনকি আপত্তি আছে পৃথিবী সম্পর্কেও, কিন্তু ওই অশ্রুবিন্দু সম্পর্কে কোনো আপত্তি কখনো বোধ করি নি। একাত্তরের জুলাই মাসে পাশের রিকশায়, শহীদ মিনারের রাস্তায়, ‘আমার সোনার বাঙলা’ গান শুনে আমি প্রায় কেঁদে ফেলেছিলাম। যে যাচ্ছিলো ওই রিকশায়? শহীদ মিনারের কাছে এসে মন কেনো চেপে রাখতে পারে নি সে? সে কি এখন জীবিত? শহীদ মিনারের কাঠামোকে আমি নানা কোণ থেকে নানাভাবে দেখেছি; নানা তাৎপর্য বের করার চেষ্টা করেছি। তার লাবণ্য চোখে পড়েছে সব সময়ই, শান্ত মহিমা বিকিরিত দেখেছি সব সময়; কিন্তু ওই কাঠামো স্বস্তি দিতে পারে নি আমার স্বপ্নকে। তেষট্টিতে শহীদ মিনারের চারপাশে এতো বড়ো সব দালান ছিলো না, তাই তাকে বেশ বিশালই মনে হয়েছিলো। কিন্তু বছরের পর বছর চারদিকে উঠতে থাকে বড়ো বড়ো কাঠামো, আর আমার ওই অশ্রুবিন্দুকে ক্রমশ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর দেখাতে থাকে। ট্রাক এসে গোঁ গোঁ করে তার পদতলে, লাফিয়ে পড়ে ব্যস্ততাপরায়ণ বাস, কেঁপে ওঠে শহীদ মিনার। কয়েক বছর আগে দূর থেকে শহীদ মিনারকে একটি ছোটো দেশলাই বাক্সের মতো মনে হয় আমার। চারদিকে যখন উঠছে উদ্ধত সব গলাবাড়ানো কাঠামো, ঢেকে দিচ্ছে আকাশ ও ঢাকা শহরের বৃক্ষমালা, তখন ছোট্ট শিশির বিন্দুর মতো প’ড়ে আছে শহীদ মিনার। কয়েক বছর ধ’রেই একটু দূরে উঠছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, এমনভাবে বানানো হচ্ছে যেনো মহাকাল আর পারমাণবিক বোমা সেটিকে কাবু করতে না পারে। একটি তুলনা হৃদয়ের দাঁত ব্যথার মতো কামড় দেয় : তিনজন মানুষের, যারা জীবনে সুখ আর ক্ষমতা ভোগ করেছে বিপুল, বারবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছে জনগণের সাথে, তাদের স্মৃতিস্তম্ভ এতো উদ্ধত বিশাল; আর বাঙলার সমস্ত মানুষের শোকের প্রতীক এতো করুণ কোমল ক্ষুদ্র?
কোন স্থপতিসংঘ পরিকল্পনা করেছিলো শহীদ মিনারের, আমার জানা নেই। যখন আমি শহীদ মিনারের কথা ভাবি, তার দিকে চেয়ে দেখি, মনে হয় তাঁদের কল্পনায় মহত্ত্ব, বিশালতা, অবিনাশত্ব সম্পর্কে ধারণা ছিলো সামান্য। তাঁরা বেদনাটুকু বুঝে ছিলেন, একটি প্রিয় রূপকও বের করেছিলেন, কিন্তু মহত্ত্ব বিশালতা দ্বারা আলোড়িত হন নি। তাই শহীদ মিনার হয়ে আছে বেদনার গীতিকা, এক ফোঁটা অশ্রু; তা মহাকাব্যিক মহত্ত্ব ও মহিমামণ্ডিত নয়। শহীদ মিনারের পাঁচটি স্তম্ভ মা ও তার চার সন্তানের প্রতীক বলে ব্যাখ্যা করা হয়। কিন্তু ওই কাঠামো খুবই ক্ষীণ। এ-বছর শহীদ মিনারের প্রাঙ্গণ সম্প্রসারিত হয়েছে, ডানে বাঁয়ে সবুজ ঘাসের শোভা রচনা করা হয়েছে। রাস্তা দূরে স’রে গেছে, অনেক গাছ উপড়ে ফেলা হয়েছে। এ-সম্প্রসারিত প্রাঙ্গণ থাকা উচিত ছিলো শুরু থেকেই। হঠাৎ প্রাঙ্গণের বিস্তারের ফলে শহীদ মিনারের কাঠামো হয়ে পড়েছে প্রায় অদৃশ্য, হারিয়ে যাওয়া পালকের মতো, তাকে খুঁজতে হয়, এবং অনেক দূর দেখা যায় টলমল করছে শহীদ মিনার। বাঙালির বেদনাশ্রুবিন্দু কি এতো ছোটো, এতো ম্রিয়মাণ তার দুর্দম রক্তের দ্রোহ? তা হ’তেই পারে না। শহীদ মিনারকে আমি দেখতে চাই দীর্ঘশ্বাসের চেয়েও কোমল, অশ্রুবিন্দুর চেয়েও টলোমলো, আর বাঙালি জাতির বহু শতাব্দীর অগ্নিজ্বলা বিদ্রোহের মতো মহান। এ-কাঠামো শুধু হয়ে রইবে না গীতিময় অশ্রুবিন্দু, তা হয়ে থাকবে আমাদের মহাকাব্যিক বিজয়গাথা।
ফাল্গুন-ফেব্রুয়ারিতে বাঙলার সব কিছুই তো শহীদ মিনার : ওই মেঘ, বাতাসে কেঁপে ওঠা ঘাসের আস্তরণ, পাতার আড়ালে বসে থাকা দোয়েল, বোনের খোঁপা, ফোঁটা আর না-ফোঁটা ফুল, বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণ, চোখের কোণে জমে ওঠা অশ্রু;– সবই শহীদ মিনার। বাঙলার ফাল্গুন খুবই দুঃখী মাস, যখন তার সাজার কথা বাসন্তি শাড়িতে তখন তার শরীরে শোকের কালো পাড়; যখন তার হৃৎপিণ্ড কেঁপে কেঁপে ওঠার কথা চঞ্চল মধুর আবেগে, তখন তার বুকভরা আর্তনাদ; যখন তার চোখে থাকার কথা উল্লাস, তখন সেখানে টলমল করে অশ্রু। কেমন করুণ সুরে কাঁদে মাঘনিশীথ আর ফাল্গুনদুপুরের কোকিল। ফুল, তুমি ফোটো; লাল, নীল, সবুজ হয়ে ঝ’রে পড়ো শহীদ মিনারের বেদিমূলে। সুর, তুমি বাজো বাঙলার সমস্ত শহীদ মিনারে। এ-দুঃখের মাস ঢাকা থাক দুঃখের কালো কাফনে, ভেতরে তার টলমল করুক চিরজীবী অশ্রুবিন্দু।
সংখ্যাহীন শহীদের মাংস মিশে গেছে বাঙলার মাটিতে, নাম মুছে গেছে অসংখ্য সম্ভাব্য শহীদের। মুছে যাবে আরো অসংখ্য সম্ভাব্য শহীদের নামপরিচয়, অন্ধকারের শক্তিরা যতোদিন থাকবে। তাদের ভাগ্যে জুটবে না একটি শাদা কাফন, যেমন জোটে নি অনেকের। শুধু টলমল ক’রে উঠবে মায়ের চোখ, বোনের কালো নয়ন, পিতার অক্ষিকোটর, ভাইয়ের বুক। যে-ভাইকে কাফন পরাতে পারি নি, যার লাশ সামনে নিয়ে পাঠ করতে পারি নি শেষ শ্লোক, তার জন্যে শুধু ভেতর থেকে অনন্ত ঝরনার উৎসারণের মতো উচ্ছ্বসিত হবে অশ্রু। সে-অশ্রুবিন্দুকে পরিয়ে দেবো শাদা কাফন কালো কাফন লাল কাফন শোকের কাফন দীর্ঘশ্বাসের কাফন। তার সামনে দাঁড়াবো ফুল নিয়ে, ভালোবাসা নিয়ে; দেখবো আমাদের অশ্রু রূপান্তরিত হয়ে গেছে কোমল করুণ শহীদ মিনারে; টলমল করছে বাঙলার প্রাঙ্গণে, সড়কের ধারে, বনের প্রান্তে, পৌরসভার কঠোর বক্ষস্থলে। টলমল করছে, করবে চিরকাল ওই কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু–শোকভারাতুর শহীদ মিনার।