বইয়ের বিরুদ্ধে

বইয়ের বিরুদ্ধে

যদি এমন হয় যে মানুষ ও মানুষের সভ্যতা মুখোমুখি হয়েছে বিনাশের, কিন্তু অনুমতি পেয়েছে মাত্র একটি স্মারক রেখে যাওয়ার, তখন কী রেখে যাবে মানুষ? কী রেখে গেলে প্রলয়ের ভেতর থেকে কোটি বছর পর জেগে ওঠা অভিনব মানুষ বা অন্য কোনো গ্রহের আকস্মিক আগন্তুক পাবে মানুষ ও তার সভ্যতার প্রকৃত পরিচয়? মানুষ কি স্মারক হিশেবে রেখে যাবে মোটরগাড়ি, দূরদর্শনযন্ত্র, নভোযান, বা আর কোনো আবিষ্কার, যা নির্ভুল পরিচয় দেবে মানুষের? এসবের কিছুই প্রকৃত পরিচয় দেবে না মানুষের। অমন অভাবিত মুহূর্তে নিজের স্মারকরূপে মানুষকে রেখে যেতে হবে একটি বই। বহুপরিচয়ের ফলে বই আজ বিস্ময় সৃষ্টি করে না, বইকে বেশ সাধারণ বস্তু ব’লে মনে হয়। কিন্তু বইয়ের মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানুষের প্রকৃত পরিচয়; তাই বই মানুষের শ্রেষ্ঠ স্মারক। মানুষ বই সৃষ্টি করেছে, আর বই সৃষ্টি করছে মানুষকে; মানুষের সভ্যতা সৃষ্টি করেছে বই, এবং বই সৃষ্টি করেছে মানুষের সভ্যতা। মানুষসত্তার পরম উৎসারণ বই, বা মানুষ ও বই একই সত্তার দুই রূপ। মানুষ এক আশ্চর্য স্রষ্টা, বই তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। বর্ণমালা উদ্ভাবন ক’রে মানুষ পৃথিবী জুড়ে পাতায়, বাকলে, চামড়ায়, মাটিতে ধাতুতে, কাগজে লিপিবদ্ধ করেছে মহাজগতের থেকেও ব্যাপ্ত নিজেকে, আপন সত্তাকে। বই মানুষসত্তার লিপিবদ্ধ রূপ। বইয়ে মানুষ লিপিবদ্ধ করেছে তার আবেগ ও আবিষ্কার, ইন্দ্রিয়ের আলোড়ন, প্রাকৃতিক সত্য, তার বাস্তব, স্বপ্ন ও বিশ্বাস, অর্থাৎ বইয়ে মানুষ ধরে রেখেছে নিজেকে। তাই মনে হয় মানুষই বই, আর বইই মানুষ। বইকে কখনো কখনো আয়নার সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। এটি ভুল উপমা। বই শুধু প্রতিবিম্বিত করে না, প্রকাশ ও ধারণ করে; বই প্রকাশ ও ধারণ করে মূর্ত-অমূর্ত, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য-ইন্দ্ৰিয়াতীত সব কিছু। বইয়ের পাশে আয়না জড় বস্তুমাত্র। বই শুধু অবয়বকে নয়, অন্তর্লোককেও প্রকাশ করে, ধারণ করে; এবং অন্তর্লোককে প্রকাশ কর ব’লেই বইয়ের মূল্য। বইকে বস্তু মনে হ’লেও বই বস্তু নয়; বই এক অনন্য সজীব সত্তা। তার প্রাণ আছে, কিন্তু মৃত্যু নেই।

বই মানুষ ও তার বিশ্বলোকের মতোই বিচিত্র। বইয়ের শরীরটি বই নয়, প্রচ্ছদ ও পাতাগুলো বই নয়; পাতাগুলোতে মুদ্রিত বাণীই বই। ওই বাণী অশেষ। বই অসলে অমূর্ত বস্তু। বই মানুষের পরাক্রান্ত আবেগের প্রকাশ, তার অনুভূতিমালার সংকলন; বই মানুষের স্থিরচিত্র, বই মানুষের চারদিকে ছড়ানো রহস্যময় বাস্তব ও ঐন্দ্রজালিক অবাস্তবের ভাষ্য। কোনো বই মানুষের বিশ্বাসের সার, কোনো বই মানুষের অপবিশ্বাসের অসারতা; কোনো বই সত্যের মতো অকরুণ, কোনো বই অস্চিারিতা। বই মানুষের বিকাশের ইতিহাস, তার চারপাশের মুখোশপরা প্রাকৃতিক সত্যের মুখোশ-উন্মোচন। কোনো বই বন্দী করে মানুষকে, কোনো বই মানুষকে দেয় মুক্তির মন্ত্র। কোনো বই বিদ্যা, কোনো বই অবিদ্যা; কোনো বই জ্ঞান, কোনো বই নিজ্ঞান। সাহিত্যে ঘটে মানুষের বস্তু ও স্বপ্নলোকের রূপময় উপস্থাপন; সেখানে পাওয়া যায় মানবপ্রজাতিটির অশেষ বৈচিত্র্য ও সৃষ্টিশীলতার পরিচয়। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধে মানুষ বিকাশ ঘটিয়ে চলছে তার অনন্ততার। মহাধ্বংসের মুহূর্ত পর্যন্ত মানুষ নিজেকে পরিবেশন ক’রে যাবে সাহিত্যের বিভিন্ন পাত্রে, তবুও তার আন্তর নির্ঝরধারা নিঃশেষ হবে না। দর্শন বইয়ে পাওয়া যায় সত্য উদঘাটন ও সৃষ্টির সাধনা; বিজ্ঞান বইয়ে উদঘাটিত দেখি বিচিত্র অদৃশ্য সূত্র। বিচিত্র বই বিচিত্রভাবে ধ’রে আছে মানুষকে। বইয়ের বাঙলা শব্দটি, গ্রন্থ শব্দটি, আক্ষরিকার্থে গ্রন্থিত পৃষ্ঠার ভাব জ্ঞাপন করে; কিন্তু এটি ব্যঞ্জনা করে যে বইয়ে মানুষ গেঁথে চলেছে মানুষের বিচিত্র সত্তাকে।

বই অরণ্যে ফোঁটা ফুল নয়; সকলের অগোচরে আরণ্য নির্জনতায় পরিমল বিলোনোর জন্যে বই লেখা হয় না। বই লেখা হয় অনেকের অন্তরে নিজেকে সংক্রামিত করার উদ্দেশ্যে। বই পড়ার জন্যে। মানুষ বই লেখে, আর মানুষ বই পড়ে। লেখকের কিছু বক্তব্য রয়েছে ব’লে তিনি বই লেখেন; তাঁর শিল্পসৃষ্টির প্রতিভা রয়েছে, তাই তিনি লেখেন বই। তিনি কিছু সত্য বের করেছেন, তা তিনি লিপিবদ্ধ করেন বইয়ে, লেখক কিছু বিশ্বাস ও অবিশ্বাস পোষণ ও প্রচার করতে চান, তাই তিনি লেখেন বই। বই বিচিত্র, তাই বই লেখার পেছনের প্রেরণাও বিচিত্র। কেউ আত্মপ্রকাশের জন্যে, কেউ সত্য প্রকাশের জন্যে বই লেখেন; কেউ খ্যাতিলাভের জন্যে, কেউ পুঁজি আয়ের জন্যে বই লেখেন; কেউ জ্ঞান দেয়ার উদ্দেশ্যে বই লেখেন, কেউ জ্ঞানহরণের জন্যে বই লেখেন। মানুষ বই পড়ে কেনো? বেকন নির্দেশ করেছেন বই পড়ার তিনটি কারণ। তাঁর মতে বই পড়া উচিত আনন্দ, অলঙ্কার, ও সামার্থ্য বা শক্তিলাভের জন্যে। আনন্দ ব্যক্তিগত ব্যাপার, তাই বেকন আনন্দের জন্যে বইপড়াকে গণ্য করেছেন কুঁড়েমি ব’লে। অলঙ্কার বা ভূষণ হিশেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বইপড়াকেও তিনি বিশেষ মূল্য দেন নি। বই পড়লে অনেক চকার কথা জানা যায়, ঠিক সময়ে উদ্ধৃত করা যায় ভালো ভালো অর্থাৎ অলঙ্কৃত করা যায় নিজের বক্তব্যকে। এটা বেকন ও আমাদের কাছে সমান মূল্যহীন। তিনি সামর্থ্য বা শক্তিলাভের ব্যাপারটিকেই বইপড়ার প্রধান লক্ষ্য ব’লে গ্রহণ করেছেন। বই পড়লে জ্ঞান জন্মে; ওই জ্ঞান প্রয়োগ করা যায় নানা কাজে। বইপড়ার ফলিত দিকটাকেই সর্বোচ্চ মূল্য দিয়েছেন তিনি। বেকন ও তার মানুষ শক্তিপুজোরী। তাই শক্তিসামর্থ্যকেই তিনি আরাধ্য গণ্য করেছেন। বই তাঁর কাছে শক্তিদেবতার মন্দির। বই জ্ঞান দেয়, এবং জ্ঞান শক্তি, এটা সত্য; কিন্তু তা আন্তর শক্তি, বাহ্যশক্তি নয়। পৃথিবীর বাহ্যশক্তিমানেরা বইকে বিশেষ পছন্দ করে না, বরং সন্দেহের চোখে দেখে; কারণ বই থেকে স্থুল পার্থিব শক্তি বেশি অর্জন করা যায় না, বরং পার্থিব দুর্বলতাই বেশি অর্জিত হয়। বইকে যারা ছুঁড়ে ফেলে, তারাই শক্তিমান হয়ে ওঠে। অলঙ্কার হিশেবে বই পড়া সত্যিই কাজের কথা নয়। আনন্দ, যদি গ্রহণ করি শব্দটির গভীর অর্থকে, তাহলে প্রধানত আনন্দের জন্যেই বই পড়া উচিত। এ-আনন্দ ইন্দ্রিয়বিলাস বা ইন্দ্ৰিয়মন্থন নয়; এ-আনন্দ উপলব্ধি, বোধি ও প্রাজ্ঞতার আনন্দ। আনন্দ শব্দটির শরীরে কিছুটা কালিমা লেগেছে, ওই কালিমাটুকু বাদ দিলে এর যা তাৎপর্য, তা হচ্ছে বই পড়া সুখ দেয়।

বই থেকে মানুষ আনন্দ আহরণ করে বললে মনে হ’তে পারে যে বই বলতে শুধু সাহিত্য বইকেই বোঝাচ্ছি। শুধু সাহিত্য নয়, বই বলতে সব ধরণের বইকেই আমি বোঝাতে চাই। এটা সত্য যে সাহিত্য আনন্দ দেয়। এ-আনন্দ মোটা সুখ নয়; সাহিত্য বিশেষ কোনো ইন্দ্রিয়ের ক্ষুধাতৃষ্ণা মেটায় না। সাহিত্য জটিল বহুস্তরিক আনন্দ দেয় মানুষকে। মনে করা যাক একটি কবিতা পড়ছি। কবিতাটি আমার চেতনাকে ঋদ্ধ করলো এমনভাবে, যা আমি কোনো দিন পুরোপুরি বুঝে উঠবো না; আমাকে পৌঁছে দিলো এমন উপলব্ধিলোকে, যেখানে এর আগে কখনো উপনীত হওয়ার অভিজ্ঞতা হয় নি; কবিতাটির ভাষায়, ছন্দে, মিলে ও অমিলে এমন কিছু রয়েছে, যা আমার ভেতরে একটি নতুন ভূখণ্ড সৃষ্টি করলো; কবিতাটির কিছু উপমা ও চিত্রকল্প আমার ইন্দ্রিয়কে নতুন সৌন্দর্যে আলোড়িত করলো। কবিতাটি আমার মনুষ্যত্বকে বিকশিত করলো। উৎকৃষ্ট সাহিত্য পড়ার আনন্দ হচ্ছে নিজের বিকাশ-সুখ উপলব্ধির আনন্দ। তবে পৃথিবীর অধিকাংশ বইই সাহিত্য নয়; এবং সেগুলো কোনোরকম আনন্দ দেয়ার উদ্দেশ্যে রচিত হয় না। দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান, সমাজ, অর্থনীতি ও আরো হাজারো বিষয়ে লেখা হয় বই; এবং এসব বিষয়েই বই লেখা হয় বেশি। এগুলো জ্ঞান দেয়, পাঠককে ক’রে তোলে জ্ঞানী। এসব বিষয়ে শুধু বই যে বেশি লেখা হয়, তাই নয়, সম্ভবত এসব বইই বেশি পড়া হয়। একটি বিশেষ বয়স পেরিয়ে যাওয়ার পর অধিকাংশ পাঠক আর সাহিত্যে আকর্ষণ বোধ করে না, এসব বইয়ের দিকেই আকর্ষণ বোধ করে বেশি। এসব বই যে-জ্ঞান দেয়, তাও একধরনের গভীর আনন্দ। যে-দর্শনগ্রন্থটি পড়ছি, সেটি আমাকে নানা বিষয়ে জ্ঞানী ক’রে তুলছে, ওসব আমার কিছুই জানা ছিলো না। ওই বই থেকে পাওয়া জ্ঞান যে আমি বাস্তব শক্তি হিশেবে ব্যবহার করবো, তা নায়। বইটি থেকে যা পাচ্ছি, তা আমার সত্তাকে পূর্ণতর ক’রে তুলছে। বইপড়ার উদ্দেশ্য প্রাজ্ঞ আনন্দ পাওয়া; ওই আনন্দ মানুষকে পরিণত করে পূর্ণতর মানুষে। অলঙ্কাররূপে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে যে বই পড়ে, সে হাস্যকর মানুষ; শক্তির জন্যে যে বই পড়ে, সে অমানুষ; আর প্রাজ্ঞ আনন্দের জন্যে যে বই পড়ে, সে সম্পূর্ণ মানুষ।

বাই মানুষকে মুক্তি দেয় ও তার বিকাশ ঘটায়; আবার বই মানুষকে বন্দী করে ও তার বিকাশ রোধ করে। যে-বই এক সময় মুক্তি দিয়েছিলো মানুষকে, কিছুকাল পর দেখা যায় সে-বইই বন্দী ক’রে ফেলেছে মানুষকে। অধিকাংশ মানুষ ওই বইয়ের শেকলে আটকে থেকেই ধন্য বোধ করে, এবং অন্যদের আটকানোর জন্যে উদগ্রীব থাকে। যুগে যুগে বইয়ের থাবায় ধরা পড়েছে সমাজ, রাষ্ট্র, বিজ্ঞান, সাহিত্য ও মানুষ। আরিস্ততল ব’লে গেছেন নাটক এ-রকম, তাই অন্যরকম আর কিছুই নাটক নয়; কেউ ব’লে গেছেন রাষ্ট্র চলবে এভাবে, তাই আর কোনোভাবেই চলতে পারবে না রাষ্ট্র। বই বলেছে পৃথিবী স্থির, তাই অস্থির পৃথিবীকেও স্থির ব’লে মানতে হবে; বই বলেছে সমাজ চারবর্ণে বিভক্ত, তাই মেনে নিতে হবে ওই অমানবিক বিভাজন। বই প্রথা সৃষ্টি করে, আবার প্রথা ভাঙে। প্রথা সৃষ্টি করার সময় বই মানুষের রক্তে মাটি রাঙায়, আবার প্রথা ভাঙার সময়ও মাটি রাঙায়। তাই বইকে বিশ্বাস করতে হবে, আবার অবিশ্বাস করতে হবে। পড়তে হবে বহু বই; এবং এক-বইয়ের পাঠক সম্পর্কে সাবধান থাকতে হবে সব সময়। বই পুজোর জন্যে নয়, শিরোধার্য করার জন্যে নয়। নিজস্ব চিন্তা ছাড়া বই পড়া বই না-পড়ার চেয়ে খারাপ।

বই মানুষেরই সৃষ্টি; কিন্তু মানুষ বইকে দেখে থাকে রহস্যরূপে। বর্ণমালাই তাদের কাছে রহস্য, তাই ওই রহস্যে খচিত বই তাদের কাছে প্রতিভাত হয় মহারহস্যরূপে। সব সমাজেই লেখাকে বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়। লেখা কোনো কিছু ভুল হ’তে পারে না, মিথ্যে হ’তে পারে না, খারাপ হ’তে পারে না ব’লে নিরক্ষরেরা বিশ্বাস ক’রে থাকে; মুদ্রিত বস্তু সম্পর্কে অমন ধারণা পোষে সাক্ষরদেরও অনেকে। বিশেষ ধরনের লিপির প্রতিও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বিভিন্ন আবেগে ভোগে। তাই বই সম্পর্কে সবাই ভোগে অতিবাস্তব আতঙ্কে ও মোহে। কিন্তু বই মানবিক অন্যান্য ক্রিয়াকর্ম থেকে অধিক পবিত্র নয়। পৃথিবীর অধিকাংশ পাপ জড়ো হয়ে আছে বইয়ে, তাই বইয়ের প্রতি অতিবাস্তব ভীতি বা মোহ থাকা অসমীচীন। তবু মানুষ এ-ভীতি ও মোহ কাটিয়ে উঠতে হয়তো পারবে না কখনো। একগুচ্ছ কাগজকে নষ্ট করতে অনেকেই দ্বিধা করবে না, কিন্তু ওই কাগজগুচ্ছ যখন বই হয়ে বেরিয়ে আসে, তখন বিশেষ মহিমা তাকে ঘিরে ধরে। মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে তার প্রতি। প্রতি মাসে আমি সংবাদপত্রগুলোকে ঘর থেকে বের ক’রে দিই, গৃহপরিচারিকা দ্বিধাহীনভাবে সংবাদপত্র দিয়ে আগুন জ্বালায়; কিন্তু ওই সংবাদপত্রের থেকে অনেক তুচ্ছ জিনিশ মলাটে বাঁধাই হয়ে সজ্জিত হয়ে আছে বইয়ের আলমারিতে, কেনো যেনো ওগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারছি না।

বইকে যেমন মানুষ পুজো করে তেমনি তাকে ভয়ও করে। যে-বই প্রথা সৃষ্টি করেছে, বিশেষ দেয়ালের ভেতর আটকে ফেলেছে মানুষকে, তার বিকাশ থামিয়ে দিয়েছে, মানুষ সে-বইকে পুজো করে; আর যে-বই প্রথা ভেঙে ফেলতে চায়, মানুষকে নিয়ে যেতে চায় দেয়ালের বাইরে, বিকাশ ঘটাতে চায় তার, সে-বইকে মানুষ ভয় করে। পুজো ও ভয় দুটোই শ্রেণীস্বার্থে। শ্রেণীস্বার্থে কতো বই খড়ের মতো জ্বলেছে, পাড়ার পেশল যুবকেরা বহু বই টেনে ফেলেছে পাঠাগারের আলমারি থেকে। কিন্তু প্রতিটি দগ্ধ বই সভ্যতাকে নতুন আলো দিয়েছে। সামন্ত সমাজ সহ্য করে নি বুর্জোয়াভাবের বইকে, বুর্জোয়াসমাজ সহ্য করে না সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার বই; এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সহ্য করে না বিরোধী ভাবধারার বই। প্রতিটি মৌলিক বই দগ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নিয়েই রচিত হয়। বই যেমন বিশেষ সমাজ গ’ড়ে তোলে, তেমনই ধ্বংসও করে, এবং স্থাপন করে নতুন সমাজের ভিত্তি। পৃথিবীতে বহু বই দগ্ধ হয়েছে, কিন্তু পরে আলোকশিখা ব’লে গণ্য হয়েছে; ভবিষ্যতেও বহু বই আগুনের থেকেও লেলিহান মানুষের ক্রোধে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, কিন্তু তার মধ্যে যদি কোনো সত্য থাকে, তবে তা ফিনিক্সের মতো ছাইয়ের ভেতর থেকে নতুন সত্তা নিয়ে জেগে উঠবে। তার ভেতর সত্য না থাকলে উপেক্ষায়ই সেটি আগুনের থেকেও বেশি ভস্মীভূত হবে।

সব বইই কি বই? ধূসর অতীত থেকে আজকের মুখর মুদ্রাযন্ত্রের পর্ব পর্যন্ত রচিত, মুদ্রিত, প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য বই; কিন্তু তার প্রতিটিই বই নয়। অধিকাংশ বইয়ের মলাটই উৎকৃষ্ট অংশ, অনেক বই পড়ার চেয়ে না পড়া বেশি উপকারী। মানুষের সভ্যতা উৎপাদন ক’রে চলছে অমিত আবর্জনা, বইয়ের আবর্জনায়ও অত্যন্ত দূষিত মানুষের সভ্যতা। অস্কার ওয়াইল্ড বলেছেন, আগে জ্ঞানীরা বই লিখতেন, পড়তো সাধারণেরা; এখন বই লেখে সাধারণেরা, এবং কেউ পড়ে না। কেউ পড়ে না, একথাটি ঠিক নয়; বরং এখন সাধারণের লেখা বইই সম্ভবত পড়া হয় বেশি। বইয়ের প্রাচুর্য, ভলতেয়ারের কথানুযায়ী, মানুষকে মূর্খ ক’রে তুলছে। পৃথিবীতে বইয়ের মতো দেখতে যতো বস্তু রয়েছে, তার নব্বই অংশই লিপিবদ্ধ নির্বুদ্ধিতা। মূর্খ মুদ্রাযন্ত্র পাগলের মতো উৎপাদন ক’রে চলছে বই; পৃথিবী ভ’রে ছাপাখানার গর্ভ থেকে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছে চোখঝলসানো আবর্জনা। পুঁজিবাদের পণ্যরাশির মধ্যে বইয়ের স্থান প্রথম দিকেই। বইপণ্য এখন যেতোটা আবেদন সৃষ্টি করে, তার চেয়ে প্রলুব্ধ করে বেশি। পশ্চিমে এখন দেখা দিচ্ছে বইপড়া অশিক্ষিতরা। যে-সব বইয়ের প্রলোভনে প’ড়ে তারা বই কিনছে, পড়ছে, ছুঁড়ে ফেলছে ময়লাফেলার পাত্রে, সে-সব বই মানুষকে শিক্ষিত নিরক্ষরে পরিণত করে। তাই বইমাত্রই পড়ার উপযুক্ত নয়, তবে এখন পড়ার অযোগ্য বইয়ের পাঠকই বেশি। এমন বই প্রতিদিন একটি ক’রে পড়লেও কোনো উপকার হয় না, তবে অপকার হ’তে পারে; আর সারা জীবনে একটিও না পড়লে কোনো ক্ষতি হয় না, তবে উপকার হ’তে পারে।

বই সজীব বীজ;–বই সৃষ্টি করে বই, বই থেকে জন্ম নেয় বই। যে-পৃথিবী মানুষের চারদিকে বইয়ের মতো খোলা, তাকে মানুষ প্রতিনিয়তই পড়ছে, ঋদ্ধ হচ্ছে অভিজ্ঞতায়; তার সংস্পর্শে এসে গ’ড়ে তুলছে নিজের অনুভূতি, আবেগ, উপলব্ধি। কিন্তু তাতে মানুষ পূর্ণ হয়ে ওঠে না। বইও আরেক পৃথিবী, যা বাস্তব পৃথিবীর চেয়েও বড়ো, ও প্রেরণা- দায়ক। বইয়ে সরাসরি সম্পর্ক পাতানো যায় মানুষের শ্রেষ্ঠ ও প্রধান প্রতিনিধিদের সাথে। আমরা অধিকাংশই সামান্য মানুষ, এবং যাদের সহবাসী ও প্রতিবেশী হিশেবে পাই, যাদের প্রীতি ও বৈরিতা আমাদের দ্বিতীয় রক্ত হিশেবে কাজ করে, তারাও সামান্য মানুষ। ঘর থেকে বেরিয়েই আমি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ ক’রে আসতে পারি না; উদ্যানে পাশাপাশি হাঁটতে পারি না শেক্সপিয়রের সাথে, প্লাতোর সাথে আলাপ ক’রে কয়েকটি দীর্ঘজীবী বিতর্কের নিরসন ঘটাতে পারি না; বা মধুসূদনের সাথে ভাববিনিময় করতে পারি না মদ্য ও মেঘনাদবধ ও মানুষ বিষয়ে। কিন্তু বই খুলে ধরলে তাঁদের সাথে ভাববিনিময় সহজ হয়ে ওঠে। বই কালের প্রবাহকে প্রতিরোধ ক’রে বিভিন্ন কালের মানুষকে মুখোমুখি বসিয়ে দেয়। নিজের নিকৃষ্ট কালে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সঙ্গ পাওয়ার জন্যে রয়েছে বই; আর সমকালের নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গ পাওয়ার জন্যে রয়েছে সংবাদপত্র। তবে ভাববিনিময় বড়ো কথা নয়; বড়ো কথা হচ্ছে বই বীজ হিশেবে কাজ করে আরেক ও অনেক বইয়ের। বাস্তব বিশ্ব যতো বইয়ের প্রেরণারূপে কাজ করেছে, তার চেয়ে বই অনেক বেশি কাজ করছে অন্য বইয়ের অনুপ্রেরণারূপে। কোনো বইতে হয়তো উন্মেষ ঘটছে একটি ভাবনা, ধারণা বা বক্তব্যের, আর অজস্র বই বিকাশ ঘটিয়েছে সে-ভাবনা, ধারণা বক্তব্যের। বইয়ের সাথে মতৈক্য ও মতানৈক্যের ফলে জন্মেছে অজস্র বই। কারো একটি পংক্তিতে পেতে পারি একটি মহৎ ভাবনার বীজ কারো একটি পাদটীকায় লুকিয়ে থাকতে পারে কোনো সত্যের সূত্র। সুদূরে প্রকাশিত কারো আবেগ আমার ভেতরে জাগিয়ে তুলতে পারে নতুন আবেগ। আধুনিক বাঙলা সাহিত্যের কথা ধরা যাক। এর প্রতিটি শাখার ভালো বইগুলোর প্রেরণা হিশেবে কাজ করেছে পশ্চিমের কোনো-না-কোনো বই। হোমার-মিল্টনের বই ছাড়া বাঙলায় জন্ম নিতো না মধুসূদনের বই, স্কটের বই ছাড়া উদ্ভব ঘটতো না বঙ্কিমের, শেলি-টেনিসন ছাড়া রচিত হতো না রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা; এবং পশ্চিমে কিছু কবিতা রচিত না হ’লে এ-শতকের আধুনিক বাঙলা কবিতার রূপ এমন হতো না। তাই বই অন্য বইয়ের জননী; বাস্তব পৃথিবীর থেকে অধিক প্রেরণাদায়ক।

বাঙলা বই মানুষের অন্তর ও বাহ্যিক বৈচিত্র্যের প্রকাশ হিশেবে খুবই গরিব। পশ্চিমের বিভিন্ন ভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে লেখা হয়েছে ও হচ্ছে অসংখ্য বই, বাঙলা ভাষায় অমন বই খুবই কম। অনেক বিষয়ে কোনো বইই লেখা হয় নি বাঙলায়। জ্ঞান বা প্রাজ্ঞতায় বাঙালি দরিদ্র; বিশ্বজ্ঞানের কোনো শাখায়ই বাঙালির কোনো মৌলিক দান নেই। বাঙালি কোনো মৌল সূত্র উদঘাটন করে নি; কোনো নতুন তত্ত্ব সৃষ্টি করে নি, সূত্রপাত করে নি শিল্পকলার কোনো নতুন ধারার। কোনো এলাকায়ই বাঙালি মৌলিক স্রষ্টা বা আবিষ্কারক নয়, উদভাবক নয়। বাঙলা জ্ঞানমনস্ক বইগুলো অন্যের সৃষ্টি জ্ঞানের মলিন বিবৃতিমাত্র; এবং অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। পশ্চিমের একজন সাধারণ মননশীল লেখকও মননশীলতার যে-পরিচয় দেন, সাধনা করেন যে-মৌলিকতার, বাঙলার প্রধান মননশীল লেখকদের লেখায়ও তার পরিচয় দুর্লভ। বাঙলার প্রধান ও গৌণ মননশীল লেখকদের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে প্রধান মননশীল লেখকেরা পশ্চিমের লেখা থেকে প্রচুর ঋণ নেন, আর গৌণ মননশীল লেখকেরা বিচরণ করেন নিজেদের মৌলিক মূর্খতার মধ্যে। বাঙলার অধিকাংশ মননশীল বই তথ্যের জন্যে উল্লেখযোগ্য, তত্ত্ব বা বিশ্লেষণের জন্য নয়। বাঙলায় লেখা ভালো বই মাত্রই সাহিত্য-বই। আমাদের জীবন, আবেগ, স্বপ্নের প্রকাশরূপে এর কোনো কোনোটি অসামান্য হয়ে উঠেছে, তবে বাঙলা সাহিত্যও বিশ্বের প্রধান সাহিত্যগুলোর তুলনায় সীমাবদ্ধ ও দরিদ্র। পশ্চিমের কবিতা, উপন্যাস, নাটকে যে-বৈচিত্র্য, ব্যাপকতা, পরীক্ষানিরীক্ষা ও অসম্ভবের সাধনা দেখা যায়, বাঙলা সাহিত্যের তা দুর্লভ। যদি শুধু বাঙলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ বইগুলোর সাথে কেউ পরিচিত থাকে, তাহলে বলা যায় সে পৃথিবীর দ্বিতীয়-তৃতীয় মানের কিছু বইয়ের সাথে পরিচিত।

সমগ্র বাঙলা সাহিত্যের যেখানে এমন অবস্থা, সেখানে বাঙলাদেশের সাহিত্যের শোচনীয়তা ব্যাখ্যা ক’রে বোঝানোর প্রয়োজন পড়ে না। শুধু সাহিত্য নয়, বইয়ের পুরো এলাকাটিই বিবেচিত হ’তে পারে; এবং দেখতে পারি কী শোকাবহ তার অবস্থা। এখানে বেরোয় কিছু সাহিত্য-বই, কিছু পাঠ্যবই। যাকে বলা যেতে পারে জ্ঞানবিজ্ঞানের বই, তেমন কিছু এখানে প্রকাশিত হ’তে দেখি না। বিজ্ঞানের কোনো এলাকাতেই কোনো গুরুত্বপূর্ণ বই লেখা হয় নি বাঙলাদেশে; এবং জ্ঞানের কোনো শাখায়ই বেরোয় নি কোনো গুরুত্বপূর্ণ বই। পৃথিবীর প্রধান ভাষাগুলোতে মৌলিক জ্ঞানের বই, এবং সেগুলোর জনপ্রিয় ভাষ্যই বেরিয়ে থাকে বেশি। দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, সাহিত্যতত্ত্ব, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, জীববিজ্ঞান, বা অন্য যে-কোনো শাখারই নাম করি না কেনো, বাঙলাদেশে এমন কোনো বই বেরোয় নি, যা পশ্চিমের প্রধান বইয়ের কাছাকাছি আসতে পেরেছে। বাঙালির অনেক মাথা, কিন্তু মস্তিষ্কলোক বেশ শূন্য। কিছু বই লেখা হয়েছে, এবং প্রতি বছরই লেখা হয়, সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে। এ- বইগুলোতে যতোটা আবেগ রয়েছে, ততোটা তথ্য নেই; যতোটা তথ্য রয়েছে, ততোটা প্রাজ্ঞতা নেই। ‘আইডিয়া’ বা বিমূর্ত চিন্তাভাবনায় কোনো উৎসাহ নেই আমাদের; তাই এখানকার কোনো বই চিন্তাভাবনাজাত নয়, এবং চিন্তাভাবনার উদ্রেক করে না। যেটুকু মগজ রয়েছে আমাদের, তা শ্রান্ত হয়ে পড়ছে দুস্থ পরাক্রান্তঅশীল সমাজ ও রাজনীতি চর্চায়। আমাদের বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে; রয়েছে ছাত্ররা, তাদের জন্যে প্রকাশিত হয় পাঠ্যবই। বাঙলায় লেখা অধিকাংশ পাঠ্যবইই বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্যে। এ-পাঠ্যবইগুলো সাধারণত অপাঠ্য; এগুলো প’ড়ে ছাত্ররা যে কিছু শেখে তাই বড়ো বিস্ময়। রয়েছে আমাদের সংকীর্ণ সাহিত্য। যে-সাহিত্য রচনা করছি আমরা, তা নিয়ে যে আমরা তৃপ্ত ও গৌরবান্বিত, এতেই বোঝা যায় আমাদের দারিদ্র্য শুধু পার্থিব সম্পদের নয়, মনোসম্পদেরও।

পাঠ্যবইয়ের বিষয়টিই প্রথমে বিবেচনা করতে চাই, কারণ পাঠ্যবইই শিক্ষিত মানুষের ভিত্তি। পাঠ্যবইকে সাধারণত উপেক্ষা করা হয়, মর্যাদা দেয়া হয় না; কিন্তু পাঠ্যবই উপেক্ষার জিনিশ নয়, বিশেষ মর্যাদা তার প্রাপ্য। অধিকাংশ মানুষ সারাজীবনে অভিনিবেশের সাথে পড়ে শুধু পাঠ্যবই, বাল্যকাল থেকে তার পাঠজীবনের সমাপ্তি পর্যন্ত পাঠ্যবই ছাড়া আর কিছু পড়ে না। পাঠ্যবই ভিত্তির কাজ করে : পাঠ্যবই তার জ্ঞান, বিশ্বাস, অপবিশ্বাস, শিল্পবোধ, রুচি, প্রবণতা অর্থাৎ সারাজীবনের ভিত্তি। তাই তা দৃঢ় হওয়া দরকার, বিস্তৃত ও গম্ভীর হওয়া প্রয়োজন, যাতে সে শেকড় চালিয়ে সংগ্রহ করতে পারে পর্যাপ্ত জীবনরস। পাঠ্যবই সুলিখিত হওয়া দরকার; তার পেছনে থাকা উচিত মহৎ আদর্শ, সত্যনিষ্ঠা, প্রজ্ঞা। কোনো মিথ্যার স্থান থাকা উচিত নয় পাঠ্যপুস্তকে, থাকা উচিত নয় কোনো ভ্রান্তি, থাকা উচিত নয় কোনো অপবিশ্বাস, কুসংস্কার। তার অবয়বটিও হওয়া উচিত সুন্দর সুখকর। কয়েক দশক আগেও উন্নত ছিলো বিদ্যালয়পাঠ্য বইগুলোর মান, ছিলো সুরুচি ও সৌন্দর্যের সযত্ন ছোঁয়া; কিন্তু এখন ওগুলো পরিণত হয়েছে মুদ্রিত বিভীষিকায়। এগুলোর পেছনে কোনো আদর্শ, প্রজ্ঞা তো নেইই; এমনকি ন্যূনতম শিক্ষার স্পর্শও নেই। এগুলো এখন ভুল ভাষায় ভুল বিষয়ের সমষ্টি। এগুলো প’ড়ে জ্ঞান লাভ অসম্ভব; মোটামুটি শিক্ষা লাভই কঠিন। এগুলো একরাশ মুদ্রিত আবর্জনা। এগুলোকে সম্পূর্ণ নষ্ট ক’রে ফেললে কোনো ক্ষতি হয় না; বরং তাতেই উপকারের সম্ভাবনা বেশি। অন্যান্য বইয়ের কথা ছেড়ে দিচ্ছি; বাঙলা পাঠ্যবইয়ের কথাই ধরি। শ্রেণীতে শ্রেণীতে গদ্য ও পদ্য নামে পাঠ্য হচ্ছে এমন সব রচনা, যেগুলোর অধিকাংশই শোচনীয় নিম্নমানের। শিশুরা, কিশোররা কেনো এগুলো প’ড়ে জীবনের ভিত্তিটাকেই নষ্ট করবে? যে-বয়সে দেয়া দরকার শ্রেষ্ঠ খাদ্য, বিকাশের সুন্দর সে-বয়সে তাদের সামনে নোংরা কাগজে তুলে দেয়া হচ্ছে বিষাক্ত খাদ্য। আমাদের অনেকেরই সাহিত্যপাঠের অভিজ্ঞতা বাঙলা পাঠ্যপুস্তকেই সীমাবদ্ধ। বিখ্যাত অনেককেই একটি কবিতার পংক্তি বলতে বললে তিনি ফিরে যান বাল্যকালে, এবং বাল্যের অখ্যাত বালকটি সাহায্য করে বুড়ো বয়সের বিখ্যাত ব্যক্তিটিকে। তাই পাঠ্যবইতে থাকা উচিত বাঙলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলো, যা ওই বয়সের পুষ্টি যোগাবে উদারভাবে। তার বদলে নিকৃষ্ট লেখক ও সম্পাদকেরা নিকৃষ্ট রচনা সাজিয়ে প্রস্তুত করছেন পাঠ্যবই। এগুলো অন্য কোনো পণ্য হ’লে অবিক্রিত থেকে যেতো, কিন্তু পাঠ্যবই ব’লে সাদরে গৃহীত হয়। এগুলোকে পোড়ালে কিছুটা আলো পাওয়া যায়, কিন্তু এগুলো পড়লে এগুলোর ভেতর থেকে শিশুকিশোরের মনে কোনো আলো প্রবেশ করে না। আমাদের সমগ্র পাঠ্যপুস্তকের এলাকাটিই এমন; এটি অরুচি, অশিক্ষা ও আদর্শহীনতার এক অন্ধকার এলাকা।

বাঙলা মননশীলতার এলাকাটি কেমন? স্বাধীনতা একটি জাতির জীবনে নিয়ে আসে সৃষ্টিশীলতা ও মননশীলতা; কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা যেনো নিয়ে এসেছে বন্ধ্যাত্ব। মেধা এখানে খুবই দুর্লভ। আমাদের মননশীলেরা কোনো তত্ত্বে উৎসাহী নন, কোনো বিমূর্ত ভাবনা তাঁদের তাড়িত করে না; কোনো বিমূর্ত প্রশ্ন তাঁদের মনে উত্তর খোঁজে না। মননের সব এলাকায়ই বড়ো বড়ো প্রশ্ন পশ্চিমের মস্তিষ্ককে আলোড়িত ক’রে চলছে; এবং তাঁরা তার উত্তর খুঁজছেন। কোনো এলাকায়ই শেষ কথা বলা হয় নি, প্রতিটি এলাকায়ই আরো অভিনব কথা বলার সুযোগ রয়েছে; কিন্তু সে-সবে আমাদের উৎসাহ নেই। এখানে আমরা যেগুলোকে মননশীল রচনা বা বই বলি, সেগুলো সাধারণত সমাজ, রাষ্ট্র, জীবন সম্পর্কে কিছু তথ্য ও মতের সমষ্টি। মহৎ ঘটনাকে কতোটা সামান্য ক’রে তোলা সম্ভব, তা দেখাতে আমরাই সমর্থ হয়েছি। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সৃষ্টিশীল ও মননশীল প্রচুর রচনা লিখেছি আমরা, কিন্তু ওই লেখা মহৎ বই হয়ে ওঠে নি। ঘটনা দুটিকে দেখেছি আমরা ব্যক্তিগত আবেগের আয়নায়, অপব্যবহার করেছি ঘটনা দুটির, এবং নানা নিম্নমানের বই লিখেছি। জাতির আবেগের সাথে জড়িত ব’লে ওই সমস্ত বই আদৃত হয়, কিন্তু মননশীলতার মানদণ্ডে বিচার করলে বুঝি অধিকাংশ বইই তুচ্ছ। এমনকি বহুখণ্ডে মুক্তিযুদ্ধের যে-ইতিহাস বেরিয়েছে, যার মহিমা আবেগগত কারণে রটিত হয়েছে ব্যাপকভাবে যে-গ্রন্থসমষ্টিকে আমরা প্রায় পবিত্র বলে গণ্য করতে যাচ্ছি, সেগুলোও মননের দিক থেকে সামান্য বই। জাতি মননশীল হয়ে ওঠে ভাবনাচর্চায়, তথ্যবর্ণনা জাতিকে মননশীল করে না। আমরা জীবন নিয়ে এতো পর্যুদস্ত, জীবনের রুজ্জুতে এতো বাঁধা যে মননের বিমূর্তলোকে ওঠা অসম্ভব আমাদের পক্ষে। এসব বই প’ড়ে কিছু তথ্য পাই, কিছু ব্যক্তিগত বা দলীয় প্রবণতা পাই, কিছু বিশ্বাস ও অপবিশ্বাস পাই, কিছু আবেগ ও ভাবাবেগ পাই, পাই না মননের জ্যোতি।

এজন ভালো পাঠক, যিনি ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন ধরনের বই পড়ছেন, এবং পশ্চিমের গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো পড়েছেন, তিনি চল্লিশ বছর বয়স্ক হওয়ার আগেই বোধ করবেন যে বাঙলায় লেখা মননশীল লেখাগুলো/বইগুলো তাঁর কাছে আর পড়ার যোগ্য মনে হচ্ছে না। কারণ তিনি যতোটা পড়েছেন, মননশীল লেখকেরাও ততোটা পড়েন নি। তিনি বিভিন্ন বইয়ে ফিরে ফিরে পাবেন পুনরাবৃত্তি, পশ্চিমের কোনো-না-কোনো লেখা থেকে সরাসরি গ্রহণ, একই তথ্যের বারবার পরিবেশন, একই উদ্ধৃতি একই ভাষ্য; যে-লেখকের পড়াশুনোর পরিমাণ তাঁর নিজের লেখার পরিমাণের থেকে কম, তাঁর সাথে কথা বলতে রাজি হন নি স্যামুয়েল জনসন। এখন এখানে থাকলে জনসন কথা বলার মতো কাউকে পেতেন না; মননশীলদের লেখা প’ড়ে তিনি সহজেই বুঝতেন তাঁদের লেখার পরিমাণ পড়ার পরিমাণের থেকে অনেক বেশি। আমাদের মননমূলক বইগুলো ছাত্রপাঠ্য বইগুলোর মতোই নিস্প্রভ, তা চেতনাকে নাড়া দেয় না; নতুন জিজ্ঞাসা জাগায় না। সংকীর্ণ দেশের সংকীর্ণ সাংস্কৃতিক অবস্থা বোধ হয় এর চেয়ে উৎকৃষ্ট কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। জীবন ও সমাজ নিয়ে বড়ো বেশি জড়িয়ে পড়া এর কারণ। জীবন এতো বেশি খোঁচা দেয় যে বিশুদ্ধ ভাবনাচিন্তার অবকাশ পাওয়া যায় না। তবে এসব বই সম্বন্ধে নির্মোহ ধারণা থাকা দরকার। বই হিশেবে এগুলোর অধিকাংশই সামান্য।

বাঙলা সাহিত্যের মতো বাঙলাদেশের ভালো বইগুলোও সাহিত্য-বই। কিন্তু মোহহীনভাবে বিচার করা দরকার আমরা যে-সাহিত্য, পাকিস্তান ও বাঙলাদেশপর্বে, সৃষ্টি করেছি, তা কতোটা মূল্যবান? আমরা কি এমন বই লিখতে পেরেছি, যা সমগ্র বাঙলা সাহিত্যের পটভূমিতে বড়ো সৃষ্টি ব’লে গণ্য হ’তে পারে; বা লিখতে পেরেছি এমন বই, যা বিশশতকের বিশ্বসাহিত্যের একটি প্রধান সৃষ্টি? আমরা কি সাহিত্যকে, সাহিত্যের বিভিন্ন আঙ্গিককে, বইয়ে দিতে পেরেছি নতুন ধারায়; সৃষ্টি করতে পেরেছি ভাষার নতুন সৌন্দর্য, বা এমন কোনো নিরীক্ষা করেছি, যা উপহার দিতে পারি পৃথিবীকে? এমন কিছুই করি নি; বরং যা করার প্রতিভা থাকার কথা, তাও করি নি। পাকিস্তানি স্বাধীনতা নিস্ফলা ছিলো; এবং মর্মাহত হয়ে বোধ করতে হয় যে বাঙলাদেশি স্বাধীনতা তার চেয়েও নিস্ফলা। পাকিস্তানি স্বাধীনতা কয়েক বছরের মধ্যেই একটি মহান আন্দোলন সৃষ্টি ক’রে খুলে দিয়েছিলো বাঙালি মুসলমানের মনের বন্ধ দরোজাটি; এক যুগের মধ্যে, নিরালোক সামরিক শাসনের মধ্যে, সূচনা করেছিলো এক উজ্জ্বল সাহিত্যস্রোতের। ষাটের দশকে কবিতা ও উপন্যাসের যে-বিকাশ ঘটে, যে-শীর্ষ ছোঁয়ার অভিলাষ দেখি, একাত্তরের পর তা আর দেখি না। কবিতায় ষাটের দশকে তিরিশের কবিতাস্রোতের সাথে সংযোগ গ’ড়ে ওঠে; কবিতা হয়ে ওঠে আধুনিক। বাঙালি মুসলমানের বুক থেকে এই প্রথম আধুনিক চেতনা উৎসারিত হয়। উপন্যাসে লক্ষ্য করি ব্যাপক জটিলতা ধারণের প্রয়াস। স্বাধীনতার পর দেখি সৃষ্টিশীলতার শোচনীয় পরিণতি।

স্মৃতিচারণ ব্যাধিটি এখন খুব ব্যাপক হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। বাঙালি জাতি হিশেবে বেশ স্মৃতিহীন, তার স্মৃতি বিশেষ বিশ্বাসযোগ্য নয়; কিন্তু স্মৃতিচারণায় আমাদের মননশীলগণ সম্প্রতি ক্লান্তিহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন। এটা স্মরণশক্তির প্রখরতার বদলে মগজের পচনশীলতার পরিচয় বেশি দেয়। স্মৃতিচারণ বিকলমস্তিষ্ক বৃদ্ধের লক্ষণ। মস্তিষ্ক কাজ করছে না, কোনো ব্যাখ্যা বা ভাষ্য দেয়া সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে, তাই তার আশ্রয় স্মৃতি। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনবিষয়ক বই এখন হয়ে উঠেছে পীড়াদায়ক; বিভিন্ন বিরক্তিকর ‘ভাষা-সৈনিক’ বিষয়টিকে নষ্ট ক’রে ফেলেছেন। মুক্তিযুদ্ধও এখন স্মৃতির বিষয়। এ-দুটি মহান ঘটনা আমাদের মেধা ও সৃষ্টিশীলতাকে বিকশিত না ক’রে বন্ধ্যা ক’রে তুলেছে। এসব বিষয়ে লেখা হচ্ছে যে-সব বই, তার বড়ো অংশ‍ই অপাঠ্য। কিছু প্রবন্ধের বই বেরোয় এখানে; সেগুলোতেও দেখা যায় মননের বদলে আবেগের ও বিনোদনপ্রবণতার পরিচয়। এসব বই প’ড়ে প্রাজ্ঞতার সামান্য ছোঁয়াও বোধ করি না। কেনো পড়বো এসব বই? এসব বইয়ে ফিরে ফিরে পাই স্থুল যাপিত জীবনেরই বিভিন্ন আবেগ; কিন্তু পাই না বিশুদ্ধ জ্ঞান বা মনন। কোনো দার্শনিক প্রশ্ন নিয়ে কোনো ভাবনার পরিচয় পাই না, নান্দনিক সমস্যাও কারো বিচারের বিষয় নয়, বৈজ্ঞানিক চিন্তা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তাই আমাদের মেধার সৃষ্টি যে-সব বই, সেগুলো আমাদের মননদারিদ্র্যেরই প্রকাশ। এসব বই পুরোপুরি বর্জন করলে কোনো ক্ষতি হয় না। মননের এলাকায় আমরা ব্যর্থ।

সৃষ্টিশীলতার এলাকায়ও গৌরব করার মতো বই লিখে উঠতে আমরা পারি নি। উপন্যাস আঙ্গিকটি থেকে গেছে আমাদের আয়ত্তের বাইরেই; জীবনের যে-ব্যাপ্তি ধরা পড়ার কথা উপন্যাসে, তা ধরা পড়ে নি; নতুন নতুন তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকেও জীবনকে উপস্থাপিত করার উদ্যোগ নেয়া হয় নি। ফলে আমাদের উপন্যাস সাধারণত বিভিন্ন তুচ্ছ ঘটনার সংকলন। গত চল্লিশ বছরে যতো উপন্যাসরূপী বই বেরিয়েছে, তার মধ্যে চার পাঁচটির বেশি বই উল্লেখযোগ্যতা দাবি করতে পারে না। তাও বাঙলা সাহিত্যেরই পটভূমিতে, সমগ্র বিশশতকের বিশ্বউপন্যাসের প্রেক্ষিতে সেগুলোর মূল্য আরো কম। এখন তো উপন্যাসের স্থান দখল করেছে উপসংস্কৃতি ও বিনোদনব্যবসার অর্ন্তভুক্ত ‘অপন্যাস’, যেগুলোর কোনো সাহিত্য মূল্য নেই। এসব বই যেমন পরিচয় দেয় না লেখকের সৃষ্টিশীলতার, তেমনি পাঠকের সৃষ্টিশীলতাকেও আলোড়িত করে না; বরং নষ্ট করে পাঠককে। সাহিত্যে জনপ্রিয়তা খুবই সন্দেহজনক ব্যাপার। জনপ্রিয় সাহিত্যমাত্রই নিম্নমানের সাহিত্য, এটা প্রথমেই ধ’রে নেয়া যায়। অধিকাংশ, প্রায় সমস্ত, জনপ্রিয় সাহিত্যের সাফল্য নির্ভর করে লেখক ও পাঠকের বোধ, ভাবনা, আবেগের নিম্নতার ঐক্যবশত। লেখকের কোনো প্রগাঢ় উপলব্ধি নেই, পাঠকেরও নেই; লেখক পরিবেশন করেন অপবোধ, ভাবনা, আবেগ আর পাঠকও তাতেই পরিতৃপ্তি বোধ করেন; এমন অবস্থায়ই রচিত হয় জনপ্রিয় বই। জনপ্রিয় সাহিত্য অসাহিত্য; জনপ্রিয় উপন্যাস শস্তা গল্প– অপন্যাস। টেলিভিশন যেমন নষ্ট করে মানুষের সময় ও সৃষ্টিশীলতা, অপন্যাসও তাই করে। প্রতি বছর যদি শতো শতো অপন্যাস বেরোয় এবং সেগুলোর অজস্র সংস্করণ হয়, তাহলেও সাহিত্য বিন্দুমাত্র উন্নত হয় না; আর একটিও প্রকাশিত না হ’লে কোনো ক্ষতি হয় না সাহিত্যের।

কবিতা আমাদের সাহিত্যের উজ্জ্বলতম এলাকা। বাঙলাদেশের কবিতার যেটুকু মূল্যবান, তার সবটাই পঞ্চাশ ও ষাটের কবিদের প্রতিভাজাত। অর্থাৎ স্বাধীনতা কোনো উল্লেখ্য কবি বা কবিগোত্রের জন্ম দেয় নি। এটা শোচনীয় ঘটনা। আমাদের কবিতা প্রধানত বাহ্যজীবনের কবিতা; জীবনের আঘাতই নানা ঢেউরূপে বিন্যস্ত হয় বাঙলাদেশের কবিতায়। তাই এ-কবিতায় দার্শনিক উপলব্ধি, বৃক্তিগত কোনো আশ্চর্য জগত, অনাবিষ্কৃত কোনো স্বপ্ন ও সৌন্দর্য উদঘাটিত হয় না; জীবনই বিভিন্ন চিৎকার হয়ে ধরা দেয় কবিতায়। কবিতায় জীবন অবশ্যই উপস্থাপিত হবে, কিন্তু যদি শুধু জীবনকে, পরিপার্শ্বকেই পাই কবিতায়, তবে সে-কবিতার দুর্বলতা গোপন থাকে না। কবিতায় জীবনের পরিমিত উপস্থাপন সুখকর শিল্প, অপরিমিত উপস্থাপন ক্লান্তিকর অশিল্প। আমাদের অপরাজনীতিও কবিতাকে অপকবিতা ক’রে তুলছে। এখন বাঙলাদেশে বঙ্কিমচন্দ্র কথিত ‘খাঁটি’ কবিরা আবার জন্ম নিচ্ছেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন বাঙলা যদি আবার পতনের দিকে না যায় তাহলে আর ‘খাঁটি বাঙালি’ কবি জন্মাবে না, জন্মে কাজ নেই। এ-কবিরা বাঙালি জাতি ও বাঙলা কবিতা উভয়েরই পতনের সংকেতচিহ্ন। জনপ্রিয় মেলা ও মঞ্চের কবিতা থেকে উদ্ধার করতে হবে কবিতাকে। অকবিদের আক্রমণে কবিতা এখন বিপন্ন।

পাঠককে সচেতন থাকতে হবে বইরূপী সে-সব বই সম্পর্কে, যেগুলো বই নয়। ওই বই উপস্থিত হ’তে পারে মননমনস্ক বইয়ের মুখোশ প’রে, দেখা দিতে পারে সৃষ্টিশীল সাহিত্যরূপে। চিন্তা ছাড়া বইপড়া বইপড়া নয়; তা বই না-পড়ার থেকেও ক্ষতিকর। এখনকার মূর্খ মুদ্রাযন্ত্র ও বিজ্ঞাপনের যুগে প্রতিমুহূর্তে সাবধান থাকা দরকার প্রতিটি ব্যক্তিকে, কারণ চারপাশ তাকে আক্রমণ করার জন্যে খুবই ব্যগ্র। ওই আক্রমণ রাজনীতিরূপে আসে, টেলিভিশনরূপে আসে, সংবাদপত্ররূপে আসে, বইরূপে আসে। আসে জ্ঞানের ছদ্মবেশে, আসে সাহিত্যের পোশাক প’রে। সচেতন পাঠক মুখোশ খুলে চিনতে পারে আসল চেহারাটি; কিন্তু অসচেতনেরা মুখোশের শোভার কাছেই আত্মসমর্পণ ক’রে তার খাদ্যে পরিণত হয়। আমাদের দেশে প্রধান সংস্কৃতির ধারাটি শক্তিশালী নয়; উপসংস্কৃতির ধারাটিই প্রবল। যাঁরা প্রধান সংস্কৃতির ধারাটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তাঁরাও উপসংস্কৃতিরই অংশ; তাই তাঁরাও বইরূপী অবই সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম, বা বিশেষ স্বার্থে নিশ্চুপ থাকতে পছন্দ করেন। মূল্যায়নের অভাবে এখানে তুচ্ছ বই মূল্য পায়, ভালো বই পায় না প্রাপ্যমূল্য। যাঁরা মৌখিকভাবে, বিভিন্ন মঞ্চে, মূল্যায়ন করেন বিভিন্ন ধরনের বই, তাঁদের অসততা সর্ববিদিত; এবং তাঁরা নিম্নরুচিরই প্রচার দিয়ে থাকেন। মূল্যায়ন এখানে নিম্নমুখি নয়; ঊর্ধ্বমুখি; অর্থাৎ একজন বা কতিপয় রুচিশীল সমালোচকের মূল্যায়ন অন্যরা, সাধারণেরা, গ্রহণ করে না; বরং সাধারণের মূল্যায়নকেই মেনে নিতে হয় সমালোচককে। এমন অবস্থায় অপবই বা অবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক; এবং ভালো বই পাবে না গুরুত্ব। অপলেখক বা অলেখক মর্যাদা পাবেন নন্দিত লেখকের, গুরুত্বপূর্ণ লেখক অবহেলিত থাকবেন। অবই, বা অপবই প্রতিটি সামাজে থাকবে, কিন্তু তা হবে উপসংস্কৃতির অংশ, প্রধান সংস্কৃতির নয়। এ-সম্পর্কে সচেতন হ’তে হবে পাঠককে, সমালোচককে, সমাজকে; এবং অপবইয়ের বিরুদ্ধে থাকতে হবে সাংস্কৃতিকভাবে সক্রিয়। বই মানুষ, সমাজ, সভ্যতাকে সৃষ্টি করে; আর অপবই বা অবই নষ্ট করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *