আদিম দেবতারা ও সন্ততিরা
আধুনিক কবিতার উদ্ভব-বিজয়-প্রতিষ্ঠা বিশশতকি বাঙলা সাহিত্যের বৃহত্তম ঘটনা। আধুনিক কবিতার চেয়ে উজ্জ্বল ও মূল্যবান কিছু ঘটে নি এ-শতকে : এমন রঙিন ও রঙরিক্ত, দ্রোহী ও আনত, সুখকর ও সুখহর, সমকালমগ্ন ও মহাকাললুব্ধ, ব্যক্তিগত ও নৈর্ব্যক্তিক, বিশ্বমুখি ও স্বদেশলগ্ন, এবং জ্ঞানী ও মেধাবী আর কিছু জন্মে নি বিশশতকি বাঙলা সাহিত্যে। আধুনিক কবিতাই সে-বিশালব্যাপক রাস্তা, যে-পথে বিংশ শতাব্দী প্রবেশ করে বাঙলায়। আধুনিক কবিতাপূর্ব বাঙলা সাহিত্য, গদ্যেপদ্যে, উনিশশতকের বিলম্বিত উপহার। অনুন্নত ও পশ্চাৎপ্রবণ বাঙলাদেশ সময়ের সহযাত্রী নয়, পিছিয়ে পড়া তার স্বভাব; এবং বিভিন্ন কালকে একই সময়ে লালন করা শাদা সাম্রাজ্যবাদীদের আগমন-উত্তর বাঙলার চরিত্র। বাঙলার বিশ শতাব্দীও সর্বাঙ্গে বিংশ শতাব্দী নয়; এর বড়ো এক অংশ মধ্যযুগ, বিরাট এক অংশ উনিশশতক, এবং ক্ষুদ্র এক অংশ বিশশতক- জীবনে, জীবনযাপনে, রাষ্ট্রব্যবস্থায়, চিন্তায় ও শিল্পসাহিত্যে। বিংশশতাব্দীই আধুনিকতা; তবে সে-ধারণা কালগত নয়, চেতনাগত। এ-শতকের তৃতীয় দশকের দ্বিতীয়াংশে কয়েকজন তরুণের দ্রোহী ও প্রতিভামণ্ডিত চিত্ত থেকে উৎসারিত হয় যে কবিতাপুঞ্জ, তা বিংশশতাব্দীর প্রাণনিঙড়ানো শস্য। আধুনিক কবিতার শ্রমসাধনা ছিলো নিজস্ব কালের গুণাবলি অর্জনের, এবং আবহমান সময়ের সাথে আপন কালের সন্ধিস্থাপনের। এ-সাধনা রবীন্দ্রনাথের ছিলো না; সময়ের সাথে তিনি অভিজ্ঞ ও প্রবীণ হয়েছেন, রূপান্তরিত হয়েছেন; কিন্তু বিশশতকের পাপপূণ্য অর্থাৎ চারিত্র নিজের শরীর ও আত্মায় ধারণের সাধক ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ। তাঁর অনেক কবিতাই কালোত্তর, কিন্তু অ-বিংশ শতকি;- আধার ও আধেয়ের উভয় স্তরেই। তাঁর শোভামণ্ডিত পবিত্র আগুনে আত্মাহুতি দিতে ব্যগ্র হয়েছিলেন যে-কবিকুল বিশশতকের প্রথম-দ্বিতীয় ও অন্যান্য দশকে, কোনো রকমের শ্রমসাধনা তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো না; কবিপ্রসিদ্ধ বিষয়ে ছন্দোবদ্ধ পংক্তিবিন্যাসই ছিলো তাঁদের লক্ষ্য। তিরিশি কবিতা, যার প্রিয় পরিচিত সৎ নামান্তর আধুনিক কবিতা, ছড়ায় নতুন কালের নিশ্বাস। এ-কবিতার মুখোমুখি হ’লে যে-বোধ ঢোকে আমাদের চেতনাচৈতন্যে, তা অন্য কোনো কালের, এবং রবীন্দ্রনাথের, কবিতার কাছ থেকে পাওয়া যায় না। ওই বোধ একাধিক বিশ্বযুদ্ধঅভিজ্ঞ, বহুবিশ্বাসরিক্ত বিংশশতাব্দীর, ব্যাপক নতুন নিজস্ব জটিলতাখচিত বিংশশতাব্দীর। বাঙলা সাহিত্যে বিংশ শতাব্দী ও আধুনিক কবিতা অনেকাংশে সমার্থক। পাঁচজন, যেনো অভিনব আদিম দেবতা, এলেন; এবং বদলে দিলেন বাঙলা কবিতাকে- বক্তব্যে, ব্যঞ্জনায়, চিন্তায়, শব্দে, কলাপ্রকৌশলে। শুধু তাই নয়; তাঁদের শ্রমসাধনা বদলালো বাঙালির জীবন-ও শিল্প-চেতনা। জীবনকে তাঁরা পরালেন জটিল নতুন পোশাক, শ্রান্ত সারল্যের পরিবর্তে প্রদীপ্ত জটিলতা; শিল্পকে দিলেন জটিলতর নতুনতর প্রাণ ও পোশাক-কবিতাসৃষ্টির ভূভাগ থেকে সরল অমেধাবীদের বিদায়ের দিন ঘনিয়ে এলো। প্রতিভাবান পাঁচজন– বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, ও অমিয় চক্রবর্তী– আধুনিক কবিতার পঞ্চশূর। বাঙলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথের পর যথার্থ নতুন কবিতা এ-পাঁচজনের সৃষ্টি।
রবীন্দ্রনাথের কাছে তিরিশি পাঁচজনের সবাই, কমবেশী, ঋণী। তাঁরাই প্রথম বাঙলা ভাষায় দেখালেন যে মহাপ্রতিভার অনুকরণ করাই কবিতাজগতের একমাত্র রীতি নয়, ঋণও নেয়া সম্ভব এ-জগতে; এবং সে-ঋণ ভিত্তি ক’রে গড়ে তোলা সম্ভব অগাধ ঐশ্বর্য। শুধু ঋণ নয়, অনুকরণও করেছেন তাঁরা রবীন্দ্রনাথের : বুদ্ধদেব বসুর কৈশোরিক কবিতাগ্রন্থ মর্মবাণী, অমিয় চক্রবর্তীর উপহার, সুধীন্দ্রনাথের প্রাক্তনী ও তন্বী রবীন্দ্রাচ্ছন্ন। কিন্তু যে-দিন তাঁরা বুঝলেন রবীন্দ্রনাথে মুক্তি নেই তাঁদের, ও বাঙলা কবিতার, সেদিন সূচিত হলো বিংশশতাব্দী– এক নতুন, জটিল, যুদ্ধাহত, অবিশ্বাসী, ও গাঢ় চৈতন্যময় সময়- যার কবিতাও নতুন। আধুনিক পাঁচজনের মধ্যে বিংশশতাব্দীর জটিল যুদ্ধক্ষেত্রে নায়কের ভূমিকায় নামতে চেয়েছিলেন যিনি, তিনি সুধীন্দ্রনাথ। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা, যাকে বলতে পারি এ-শতাব্দীর সারকথা, পেশ করেছেন সংবর্ত-এর ‘যযাতি’ কবিতার এ-অংশে : ‘জাতিভেদ বিবিক্ত মানুষ;/নিরঙ্কুশ একমাত্র একনায়কেরা। কিন্তু তারা/ প্রাচীর, পরিখা, রক্ষী, গুপ্তচর ঘেরা প্রাসাদেও/উনিদ্র যেহেতু, তাই ভগ্নসেতু নদীতে নদীতে,/মরু নগরে নগরে। পক্ষান্তরে অতিবেল কারা/তথা সংক্রমিত মেরু ব্যক্তির ধ্বংসাবশেষে : দ্বেষে/পুষ্ট চীন থেকে পেরু; প্রতিহিংসা মানে না সিন্ধুর মানা।…আমি বিংশ শতাব্দীর/সমানবয়সী; মজ্জমান বঙ্গোপসাগরে; বীর/নই তবু জন্মাবধি যুদ্ধে যুদ্ধে বিপ্লবে বিপ্লবে/বিনষ্টির চক্রবৃদ্ধি দেখে, মানুষ্যধর্মের স্তবে/নিরুত্তর, অভিব্যক্তিবাদে অবিশ্বাসী, প্রগতিতে/যত না পশ্চাৎপদ, ততোধিক বিমুখ অতীতে।’ এ-ভয়াবহ শতক তার হাত বাড়ালো সর্বত্র : গোত্রে গোত্রে বিভেদ বাড়ালো, বিচ্ছিন্ন হলো ব্যক্তিমানুষ, বড়ো শরীরের ক্ষুদ্র মানুষেরা তুলে নিলো স্বহস্তে শাসনব্যবস্থা, যার দীর্ঘ হিংস্র বাহুর আওতায় এলো এমনকি দূরপল্লীর রাখাল, অরণ্যের গোপন পশুপাখি। এ-সময়ের আবেগ-চিন্তা-স্বপ্ন-জীবন পৃথক, ও বিপরীত, অব্যবহিতপূর্ব সময়ের থেকে : তাই তার আত্মার উৎসারণ কবিতাও ভিন্ন। সুধীন্দ্রনাথকথিত বিংশশতাব্দী সশরীরে, ব্যাপক গভীরভাবে, এসেছিলো পাশ্চাত্যে; বাঙলায়ও পৌঁচেছিলো তার অমোঘ তাপ; আর ওই তাপ যাঁদের চিন্তা-বোধি-আবেগ-স্বপ্নে পৌঁচেছিলো, তাঁরাই জনক হয়েছিলেন, বাঙলায়, আধুনিক কবিতার।
উনিশশতক একটি সত্য বুঝেছিলো যে পশ্চিমের সাহায্য ছাড়া বাঙলা কবিতার মুক্তি অসম্ভব। মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ বাঙলা ভাষায় পাশ্চাত্যের কবি। উনিশশতকের প্রথমার্ধে যে বাঙলা ভাষার দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত গদ্যের ঢেউ উঠতে দেখি, কোনো কবি ও কবিতা দেখি না, তার কারণ তখনো এমন কোনো প্রতিভার উদ্ভব ঘটে নি, যিনি পারতেন পশ্চিম থেকে ঋণ নিতে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের পক্ষে তা সম্ভব ছিলো না; তাই পদ্যে ও সাংবাদিকতায় সারাজীন কাটালেও তিনি বাঙলা কবিতার আটকে পড়া স্রোতকে খুলে দিতে পারেন নি। মধুসূদন পাশ্চাত্য ঋণ আর শক্তি নিয়ে মুক্তি দিলেন বাঙলা কবিতাকে; কিন্তু তাঁর অনুকরণকারীদের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক ছিলো ওই মুক্তস্রোতকে পুনরায় রোধ করা; কেননা তাঁরা পশ্চিম থেকে ঋণ না ক’রে শুধুই অনুকরণ করেছিলেন মধুসূদনের। বিহারীলাল চক্রবর্তী, যাঁকে বলা যেতে পারে বাঙলা কবিতার প্রথম প্রকৃত আধুনিক, বাঙলা কবিতাকে নতুন পথে বইয়ে দিতে যে পরিপূর্ণভাবে সফল হন নি, তার কারণ ইউরোপি রোম্যান্টিসিজমের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিলো না। কিন্তু নিবিড় সম্পর্ক ছিলো রবীন্দ্রনাথের; এবং ছিলো সে-প্রতিভা, যা ঋণকে ঐশ্বর্যে পরিণত ক’রে উত্তমণর্কেও অতিক্রম ক’রে যায়। আধুনিক সময় আবার দেখেছে : প্রাণ ধারণের জন্যে যেমন সাহিত্যের সচ্ছলতার জন্যেও তেমনই অপরিহার্য পাশ্চাত্যের সাহায্য। আধুনিক কবিতার জন্মের সাথে জড়িয়ে আছে ইউরোপের বহু ভাষার কবিতা ও কাব্যান্দোলন- সুধীন্দ্রনাথ বিশ্বভিখারিরূপে দেখেছিলেন আধুনিক কবিকে, যাঁর কাজ ছিলো ছুটে যাওয়া কীটসের কাছে, ইয়েসের নিকট, গ্রিক পুরাণের প্রাচীন মন্দিরে, মালার্মের বৈঠকে, বোদলেয়ারের অশুভ নগরে, র্যাবোর নরকে, এবং আরো বহু দরোজায়। এমন নয় যে আদিম দেবতারা খুঁজেছিলেন সমকালীন ইউরোপ তাঁদের কবিতাপ্রেরণা; তাঁদের খোঁজার বিষয় ছিলো তা, যা নেই রবীন্দ্রনাথে। আদি ও মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যকে তাঁরা বিবেচনার মধ্যেই আনেন নি। রবীন্দ্রনাথের ব্যাপক রচনাপুঞ্জে যা নেই, তা-ই আধুনিক এমন একটি বোধ ছিলো তাঁদের। রবীন্দ্রনাথ যে-সমস্ত সদগুণের আধার, তাঁদের সন্ধানের বিষয় ছিলো সে-সমস্তের বিপরীত বস্তু। বিষয়বদলের সাথে অনিবার্য হয়ে উঠেছিলো ভাষা আর কলাকৌশলবদল; পুরোনো পাত্রে নতুন বিষয় পরিবেশন শিল্পলোকে অসম্ভব ও হাস্যকর। তাঁরা বাঙলা কবিতায় ঢোকালেন একটি পাশ্চাত্য বৈশিষ্ট্য : কবিতার সাথে জড়িত ক’রে দিলেন কাব্যতত্ত্ব; এবং বিভিন্ন তাত্ত্বিক কোণ থেকে রচিত হ’তে লাগলো কবিতা- প্রতীকী কবিতা মনোহরণ করলো কারো, কারো প্রেরণারূপে দেখা দিলো পরাবাস্তবতাবাদ, কারো কবিতা রচিত হয়ে উঠতে লাগলো সাম্যবাদী ইশতেহারের আজ্ঞায়। তিরিশি পাঁচজন বাঙলা সাহিত্য নামক হাজার বছরব্যাপী সমতল সমুদ্রে জাগালেন বিংশ শতাব্দীর ঢেউ ও বেগ। আধশতাব্দী ধ’রে এ-কবিতা শাসন করছে বাঙলা ভাষাকে; রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত এমন শাসক আর কেউ ছিলেন না বাঙলা সাহিত্যে।
তিরিশের আগে কবি ও পাঠক, উভয় সম্প্রদায়ই, কবিতাকে গণ্য করতেন চিত্তবিনোদনের রমণীয় উপাচাররূপে; যেনো মেধাহীনের অশিক্ষিত ইন্দ্রিয়চর্চার লাস্যময়ী সঙ্গিনী হওয়াই কবিতার লক্ষ্য ও সার্থকতা। কবিতা যে বিনোদনসামগ্রী নয়, এমনকি সুখদাত্রী সহচরীও নয়, এ-বোধ শেখায় আধুনিক কবিতা;– তাই কবিতাভোগ থেকে স’রে পড়তে থাকে মেধাশূন্য ভোগীরা। এ-কবিতা দাবি করে জ্ঞান ও জ্ঞানী ইন্দ্রিয়, অভিনিবেশ ব্যতীত এর আবেগ-সৌন্দর্য-কামনাও পাঠকচিত্তে ঢুকতে রাজি নয়। আগে প্রতিটি কবিতার ছিলো দুটি স্তর : প্রথমে কোনো রচনাকে হ’তে হতো পদ্য;- ছন্দ-মিল-উপমারূপকখচিত হয়ে, এবং প্রথম স্তরের সাফল্যের পরই তা ঢুকতে চেষ্টা করতো কবিতাস্তরে। অধিকাংশ রচনাই পৌঁছোতো না কবিতাস্তরে, নিঃশেষিত হতো প্রথম- পদ্য-স্তরেই। আধুনিক কবিতার উদ্ভবের আগে একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ছাড়া তাঁর সময়ের সব কবিই পদ্যরচয়িতা; তাঁদের রচনারাজি দ্বিতীয় স্তরে খুব কম সময়ই উঠতে পেরেছে। কিন্তু তাতে কোনো আপত্তি ছিলো না পাঠকশ্রেণীর ও কবিমণ্ডলির, কেননা পদ্যের ঝাঁজালোমধুর মদ্য মেটাতো উভয়েরই পিপাসা। আধুনিক কবিতা অস্বীকার করলো পদ্যের স্তর ভেঙে কবিতার শিখরে উঠতে; তার অনন্য লক্ষ্য হলো কবিতা, যেখানে পৌঁছোতে হবে কোনো সিঁড়ি না ভেঙে। এমন উচ্চাকাঙ্খা সব সময় সাফল্য আয় করতে পারে না; তাই রচিত হ’তে লাগলো কবিতা, এবং কবিতা-না-হয়ে-ওঠা রচনাপুঞ্জ; কিন্তু এর মধ্যে কবিতার প্রতিভাস জাগানো পদ্যের কোনো স্থান রইলো না। আধুনিকতার অনুকারীদের হাতে রচিত হয়েছে বিপুল পরিমাণ কবিতা-না-হয়ে-ওঠা রচনা, যাকে আধুনিকতার শত্রুপক্ষ বারবার কাজে লাগায় নিস্তেজ অস্ত্ররূপে।
বিংশশতাব্দী শুধু পাপ আর পতনের কাল নয়; এ-শতাব্দীকে পূর্ববর্তী সময় থেকে অসুস্থতর বা সুস্থতর ভাবারও কোনো কারণ নেই। এ-শতকের বৈশিষ্ট্য নির্মোহতা; অন্ধ স্তবের বদলে এ সমস্ত ক্ষণ জাগিয়ে রাখে দৃষ্টি। আধুনিক কবিতাও কেবল পাপপতনের স্তোত্র নয়, আপাদশির পঙ্কপ্রোথিত হয়েও এর লক্ষ্য পদ্মত্ব। আধুনিক কবিতা পঙ্কজ পুষ্প, যা পঙ্ককে অস্বীকার করে না, স্বীকার করে হৃদয়ে-মেধায়, এবং পুষ্পরূপ লাভেও অনিচ্ছুক নয়, বরং কায়মনে পুষ্পেরই প্রার্থনা করে। তিরিশপূর্ব কবিতায় বিপরীতকে এক সূত্রে গাঁথার কোনো চেষ্টা লক্ষ্যে আসে না;- বীন্দ্রনাথে পাই অসীম সৌন্দর্য ও কল্যাণস্রোত, আর তাঁর অনুকারীদের মধ্যে পৌনপুনিকভাবে রটিত হয় জীবনে অননুভূত কাব্যিক সৌন্দর্যকল্যাণবন্দনা। সৌন্দর্যকল্যাণের শত্রু নয় কেউ; ওই কবিতাবলিতে সৌন্দর্যকল্যাপ্রেম স্তবকেস্তবকে ছড়িয়ে আছে ব’লেই ওই কবিতাবলি অনাধুনিক এমন নয়;- ওই কবিতাপুঞ্জে তা সত্যরূপে উপস্থিত হয় নি ব’লেই ব্যর্থ হয়েছে শতো শতো ছন্দমিলবিন্যস্ত রচনা। তাঁরা, রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত, অভিজ্ঞতাহীনতার উদাহরণ, এবং নিদর্শন কাব্যচেতনাশূন্যতার।
প্রধান কবি ও কবিরা, একক অথবা সম্মিলিতভাবে, পরিস্রুত করেন গোত্র ও জাতির ভাষা-আবেগ-চৈতন্য-সংবেদনশীলতা। এমন পরিস্রুতি পেলে ময়লাধরা ভাষা ঝকঝক ক’রে ওঠে নতুন মুদ্রার মতো; আবেগের ক্ষয়ে যাওয়া ধার তীক্ষ্ণশাণিত হয়; জন্ম নেয় নতুন চৈতন্য-সংবেদনশীলতা, যা মানুষকে সাহায্য করে এমন কিছু বুঝতে, অনুভব ও হৃদয়ঙ্গম করতে, যা তার কল্পনা-মেধায় আগে কখনো ঢোকে নি। বুদ্ধদেব, সুধীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে ও অমিয় চক্রবর্তী সম্মিলিতভাবে, রবীন্দ্রনাথের পর পুনর্বার, পরিস্রুত করেন তাঁদের জাতির ভাষা-আবেগ-চৈতন্য-সংবেদনশীলতা। প্রথম পরিস্রুতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন মধুসূদন, সাফল্য পরিমাপযোগ্য; দ্বিতীয় পরিস্রুতিসাধক রবীন্দ্রনাথ, সাফল্য অপরিসীম; এবং তৃতীয়, ও শেষ, পরিস্রুতি ঘটে তিরিশি পাঁচজনের শ্রমেসাধনায়;- সাফল্য রবীন্দ্রতুল্য। বাঙলা ভাষার বিস্তৃতি ঘটেছে অভাবিতরূপে আধুনিক কবিতায় : জীবনানন্দ বাঙলাকে ক’রে তুলেছেন স্বপ্ন-ভাষা, সুধীন্দ্রনাথ তাকে দিয়েছেন স্পন্দিত ধাতবতা; বুদ্ধদেবের কাছে বাঙলা ভাষা পেলো জটিল সৌন্দর্য; বিষ্ণু দে বাঙলাকে দিলেন দর্প, আর অমিয় চক্রবর্তী দিলেন শুভ্রতা। এ-কবিতায় প্রথম যে-অভিনবত্বের মুখোমুখি হ’তে হয়, তা ভাষা; এবং ওই ভাষা বারবার মনে করায় যে এ-কবিগোত্র যেনো আবিষ্কার করেছেন বাঙলা ভাষার এক নতুন অভিধান, যা আগে জানা ছিলো না। কবিতার কলাপ্রকৌশলেও সঞ্চারিত হলো নতুন বিপ্লবের নতুন আবিষ্কাররাশি, পুরোনো ও অব্যবহার্য হয়ে উঠলো কবিতার প্রাক্তন কলা ও প্রকৌশল- ছন্দের লীলালাস্যের বদলে দেখা দিলো মহিমা, উপমারূপকের শিশুসারল্যের স্থান দখল করলো মনস্বী জটিলতা, কথ্য কণ্ঠস্বর বেজে উঠলো প্রত্যেক উচ্চারণে; এমনকি সুদূর, অপরিচিত, সাধু শব্দপ্রয়োগেও। কিন্তু এর চেয়েও বড়ো বিপ্লব ঘটে আবেগ-চৈতন্য-সংবেদনশীলতার জগতে : রবীন্দ্রনাথ, ও তাঁর অনুকারীদের কবিতা যে-আবেগে উছলে পড়ার পাঠ দিয়েছিলো, যে-সমস্ত উদ্দীপকের ক্রিয়ায় সাড়া দিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম আমরা, এ-কবিতা তার থেকে অনেক পৃথক, ও বিপরীত, আবেগ ও উদ্দীপক উপস্থিত করলো; এবং তাতে সাড়া দিতে বাধ্য হলাম আমরা। আধুনিক কবিতা বাঙালিকে দিলো নতুন আবেগ, চৈতন্য, সংবেদনশীলতা; যার সাহায্যে বুঝতে পারলাম যে তিরিশিপূর্ব কবিতার অধিকাংশ আবেগই বানানো ও পানসে। আধুনিকেরা কবিতার বিষয়বস্তুতে সঞ্চার করলেন যে চিন্তা-চেতনা-আবেগ, তা পূর্ববর্তী কবিমগুলির চিন্তা-চেতনা-আবেগ থেকে অন্তত এক শতাব্দী অগ্রসর। বিংশশতাব্দীতে বিশ্ববাসের অভিজ্ঞতাসার ছড়ানো এ-কবিতারাশিতে।
সুধীন্দ্রনাথের কবিতার আত্মা হচ্ছে চিন্তা, যা তীব্রস্রোত আবেগে রূপান্তরিত হয়ে কবিতারূপ পেয়েছে। জীবনানন্দ তাঁর চিন্তারাশিকে পরিণত করেছেন সৌগন্ধে সৌন্দর্যে; বুদ্ধদেব রচনা করেছেন আবেগের দর্শন। বিষ্ণু দে চিন্তাকে, অনেকাংশে, রূপান্তরিত করেছেন সঙ্গীতে, আর অমিয় চক্রবর্তী জ্ঞানকে দিয়েছেন কবিতারূপ। তাঁদের একের সাথে আরেকের বাহ্যিক মিল নেই;- সুধীন্দ্রনাথ থেকে বহু দূরে অবস্থান অমিয় চক্রবর্তীর, বিষ্ণু দের পৃথিবী থেকে অনেক ভিন্ন জীবনানন্দের বিশ্ব, বুদ্ধদেব অন্য চার সমকালীন থেকে বহুদূরবর্তী। কিন্তু মিল আছে তাঁদের অন্তর্লোকে; তাঁরা সবাই বিংশশতাব্দীর ধ্যানী। এ-আদিম আধুনিকেরাই সর্বাধুনিক; তাঁদের পরে যাঁরা প্রবেশ করেন বাঙলা কাব্যমণ্ডলে, তাঁদের পক্ষে রক্ষা করা সম্ভব হ য়নি আধুনিকতার স্রষ্টাদের উচ্চতা ব্যাপকতা গভীরতা। তাঁরা যা সংগ্রহ ও সৃষ্টি করেছিলেন বিশ্ব ও ইতিহাসব্যাপী মানসপর্যটন ক’রে, তার তুল্য কিছু সংগ্রহ ও সৃষ্টি সম্ভব হয় নি সন্ততিদের পক্ষে। প্রতিভাদৈন্য তো রয়েছেই এর মূলে; তা ছাড়া আছে শ্রম-নিষ্ঠা- সাধনার পার্থক্য। তিরিশোত্তরগণ অগ্রণীদের নিষ্ঠারিক্ত; তিরিশিদের কাব্যসৃষ্টির প্রেরণা ও উৎস ছিলো সমগ্র বিশ্ব ও সমগ্র বিশ্বের সাহিত্যসম্পদ; আর পরবর্তীদের উৎস ও প্রেরণা হলেন তিরিশিরা। সন্ততিরা আধুনিকতার চেতনা সংগ্রহ করলেন পিতৃপুরুষের রচনাবলি থেকে, এবং তিরিশের চেতনাচৈতন্য তরলিত রূপে কবিতারূপ পেলো পরবর্তী দশকসমূহে। সাম্প্রতিক বাঙলা কবিতা তিরিশি কবিতারই সম্প্রসারণ। তিরিশি পঞ্চশূরের পর আর কোনো কবি বা কবিমণ্ডলির আবির্ভাব ঘটে নি, যাঁকে বা যাঁদের বিবেচনা করা যায় পিতৃপুরুষদের প্রতিদ্বন্দ্বী ব’লে। অসামান্য সাফল্যের পরেই আসে সীমিত সাফল্য, অথবা ব্যর্থতা- সাহিত্যজগতে এমন ঘটনা বারবার ঘটেছে; তিরিশি পাঁচজনের পরে তা আরেকবার ঘটে বাঙলা কবিতায়। ওই পাঁচ আধুনিক অসামান্য প্রতিভাবান ছিলেন, হয়তো পেয়েছিলেন কালের দাক্ষিণ্য, তাই সমর্থ হয়েছিলেন অসাধারণ উচ্চ কবিতা সৃষ্টি করতে; এবং একদশকেই আবির্ভূত হয়েছিলেন এমন পাঁচজন, যাঁরা হাজার বছরের বাঙলা কবিতার শ্রেষ্ঠ দশজনের অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা কবিতার যে-উচ্চ মান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা যে চিরস্থায়ী হবে, এমন কামনা কারো থাকতে পারে না; উচ্চ মানের পরে মান-অবনতিই স্বাভাবিক। এমন ঘটেছে ইংরেজি কবিতায়ও; পাউন্ড-এলিয়টের উচ্চকবিতার পর আসে দীনতর কবিতার দশকপরম্পরা।
১৯৪৭-এ বাঙলাদেশ ও সাহিত্য দ্বি-খণ্ডে ও-স্রোতে ভাগ হয়। অস্থায়ী পাকিস্তান রাষ্ট্রটি নিজস্ব স্বাক্ষর আঁকে যেমন এক ব্যাপক ভূখণ্ডের ওপর, তেমনি চিন্তা-কল্পনা- কবিতার ওপরও। সাতচল্লিশোত্তর বাঙলা সাহিত্য দুস্থানকেন্দ্রিক : ঢাকা এক কেন্দ্র, অপর কেন্দ্র কলকাতা। ঢাকাকেন্দ্রিক কবিতার সাথে কলকাতাকেন্দ্রিক কবিতার পার্থক্য স্পষ্ট, যদিও তারা উভয়ই তিরিশি কবিতার উত্তরাধিকারী। একটি দীর্ঘ নদী, হাজার বছর আগে উৎসারিত, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাখা জন্ম দিতে দিতে সাতচল্লিশে এসে ভাগ হয় স্পষ্ট দু-স্রোতে। মুসলমান তরুণেরা তিরিশি, আধুনিক, কবিতার সাথে যুক্ত হলেন কখন? আধুনিক কাব্যচেতনা তাঁদের চিত্ত ও মেধায় প্রবেশ করে কোন শুভ মুহূর্তে? মধ্যযুগ থেকে বিশশতকের প্রথম দশক পর্যন্ত সংখ্যাহীন কবিযশোপ্রার্থী মুসলমান বাঙলা কবিতার সাধনা করেছেন, যুক্ত হ’তে চেয়েছেন বাঙলা ভাষার সাথে অচ্ছেদ্য সম্পর্কে, তবু নজরুল ইসলামই প্রথম মুসলমান বাঙলা ভাষার কবি। নজরুলপূর্ব মুসলমানদের বাঙলা কাব্যসাধনা ঐতিহাসিক ও সমাজতত্ত্ববিদদের গবেষণাস্বর্গ, কিন্তু উন্নত কাব্যভোগীর জন্যে এক অন্ধকার এলাকা। নজরুল ইসলামও সর্বদা কবি নন; এক মহাপদ্যকার তিনি, যাঁর বিপুল সৃষ্টির সামান্য অংশই উৎকৃষ্ট কবিতা। তিনি বাঙালি মুসলমানকে সংযুক্ত করেছিলেন বাঙলা কবিতার সাথে, কিন্তু আধুনিকতার সাথে নয়। আদিম দেবতাদের সামান্য পূর্ববর্তী তিনি, তাঁদের প্রভাবিতও করেছিলেন তিনি প্রাথমিক পর্যায়ে; কিন্তু ওই পাঁচজনের বুকে বিশশতকী যে-বোধ আসন পেতেছিলো, নজরুল সে-বোধের কাছাকাছি যান নি কখনো। কবিতাত্রাণের চেয়ে সমাজ ও স্বজাতিত্রাণের ঝোঁক ছিলো তাঁর অধিক; আর এ-কাজে তাঁর উচ্চভাষী, উদ্দীপনামণ্ডিত, আন্দোলিত পদ্যপুঞ্জ যতোখানি সফল হ’তে পারতো, শিল্পকলার আর কোনো কৌশল ততো সাফল্য আয় করতে পারতো না। আদি-আধুনিকেরা নজরুলের মতো সমাজত্রাণের সরল উপায় কল্পনায় আনেন নি; তাঁদের বিশ্বাস-শিল্পকলা যদিও কখনো কখনো পরোক্ষভাবে সমাজের ত্রাণ সাধন করে, কিন্তু তার প্রত্যক্ষ লক্ষ্য ভিন্ন। আমাদের অভিজ্ঞতাও তাই বলে : একটি মহৎ কবিতা সমাজের সামান্য আবর্জনাও পরিষ্কার করতে পারে না, তা শুধু পারে স্বপ্নবিদ্ধের অর্ন্তদৃষ্টির সামনে অনন্ত বিভা জ্বেলে দিতে। নজরুল গিয়েছিলেন অন্য পথে, আলোড়ন জেগেছিলো পথের ঘাসে-কাঁকরে, এবং তীব্র কাঁপন লেগেছিলো মুসলমান তরুণদের রক্তে।
নজরুল আধুনিক ছিলেন না, কিন্তু বৃত হয়েছিলেন প্রচণ্ডভাবে; এবং তাঁর উদ্দীপক ও মধ্যপ্রাচ্যভরপুর কবিতাপুঞ্জ মুসলমান তরুণদের আধুনিকতা থেকে দূরে থাকতে উৎসাহ দিয়েছে কয়েক দশকব্যাপী। হাস্যকর উদ্দীপনা ও মধ্যপ্রাচ্যব্যাধি কী-রকম জীর্ণ ক’রে ফেলেছিলো মুসলমান তরুণদের, তার পরিচয় লিখিত হয়ে আছে নজরুল-উত্তর মুসলমান তরুণ কবিদের রচনায়। আধুনিক কবিতার স্রষ্টারা নজরুলের মতো নগদ পুরস্কার পান নি, তাঁদের অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় আধশতাব্দী। নজরুল নিদর্শন ছিলেন মুসলমান তরুণদের সামনে, তাই নজরুলের অনুকরণ ব্যতীত অন্য পথ তাঁদের দৃষ্টিতে ছিলো হেলার বস্তু। আধুনিক কবিতা-চেতনা আয়ত্তের জন্যে দরকার ছিলো বিশ্বপরিব্রাজকতা, অধ্যয়ন, অনুশীলন; তার চেয়ে অনেক বেশি সহজ ছিলো নজরুলের মতো উচ্চকণ্ঠ উচ্চারণ ও মধ্যপ্রাচ্যের স্তোত্র। অধীত বিদ্যায় প্রসঙ্গটি এখানে ওঠে, যদিও আমরা এ-প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যেতেই পছন্দ করি; যেহেতু আমাদের চৈতন্যে গেঁথে যাওয়া বিশ্বাস হচ্ছে যে কবিমাত্রই স্বভাবকবি, তাঁদের অধীত জ্ঞানের কোনো দরকার পড়ে না। আধুনিকেরাই প্রথম, মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথকে স্মরণে রেখেও বলা যায়, শিক্ষিত কবিগোষ্ঠিরূপে দেখা দেন; এবং তাঁদের পরে কবিতারচনার জন্যে শিক্ষা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু মুসলমান যে-তরুণেরা কবিতারচনায় উৎসাহী ছিলেন, রচনা করেছিলেন কবিতাধর্মী রচনা, তাঁরা আধুনিক চেতনা আয়ত্তের উপযুক্ত শিক্ষা ও অধীত জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন না। তাই তাঁদের পক্ষে স্বাভাবিক ছিলো নজরুলের স্বতস্ফূর্ত উচ্চকণ্ঠ পদ্যের দিকে আকৃষ্ট হওয়া; এবং আধুনিকতার থেকে দূরে স’রে থাকা। অবশ্য সে-সময়ে রবীন্দ্রানুসারী না হয়ে শুধুই নজরুল-অনুকারী হওয়া অসম্ভব ছিলো; তাই অনেকেই রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন-সৌন্দর্যের নকল করেছেন বিভ্রান্তের মতো। কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখযোগ্য : শাহাদাৎ হোসেন, সুফিয়া কামাল, আবদুল কাদির, জসীমউদ্দীন, গোলাম মোস্তফা, মঈনুদ্দীন, মহিউদ্দীন, বে-নজীর আহমদ। এঁদের মধ্যে শাহাদাৎ হোসেন নজরুলের কিঞ্চিৎপূর্ব ও সমকালীন, গোলাম মোস্তফা সমকালীন, ও অন্যেরা নজরুল-উত্তর। এঁদের ওপর রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ইসলাম যুগপৎ ক্রিয়া করেছেন। শাহাদাৎ হোসেন ছিলেন স্বপ্ন ও সৌন্দর্য-মুগ্ধ, যে-স্বপ্নসৌন্দর্য তিনি পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। তিনি নিজেকে স্বপ্নলোকের অস্থায়ী অধিবাসী ব’লেই মনে করেছেন;- স্বপ্নলোকচ্যুত হয়ে বাস্তবের রূঢ়তার মধ্যে প্রবেশের পরেও তাঁর মধ্যে জেগে থেকেছে স্বপ্নলোকস্মৃতি। কিন্তু তাঁর মধ্যেও পরবর্তীকালে ঢুকে পড়ে মধ্যপ্রাচ্য; নজরুলের মতো কোলাহল তাঁর পদ্যেও ধ্বনিত হয়ে উঠতে চায়। কিন্তু তিনি মর্মমূলে রবীন্দ্রানুসারী, আর তাঁর পথ ধরেই প্রবেশ করেন আবদুল কাদির। সুফিয়া কামালের ভাষা যদিও শাহাদাৎ হোসেন-আবদুল কাদিরের ভাষার মতো পেশি অর্জন করে নি, তবু তাঁরা তিনজন একই মণ্ডলের অধিবাসী। তাঁদের রচনারাজিতে স্বপ্ন ও সৌন্দর্যের জন্যে যে-কাতরতা ছড়িয়ে আছে, তা শিখেছেন তাঁরা রবীন্দ্রনাথের নিকট; তাঁদের নিজস্ব কোনো স্বপ্ন ও সৌন্দর্যদৃষ্টি ছিলো না। যে-আবেগে তাঁরা উচ্ছ্বসিত হয়েছেন, হাহাকার করেছেন যে-অভাবে, স্বপ্ন দেখেছেন যে-মানসসুন্দরের, তা তাঁদের নিজেদের নয়;-রবীন্দ্রনাথের। স্বপ্ন, সৌন্দর্য, কল্পনা, পুষ্প প্রভৃতি কাব্যিক প্রসিদ্ধ বিষয় তাঁদের ছন্দোবদ্ধ স্তবকে পুনরাবৃত্ত হয়েছে; কিন্তু কখনো সত্য হয়ে ওঠে নি। ‘কুসুমপ্রিয় যারা/তারা পচা ফুলে ব’সে করে বসন্তের স্তব’- শামসুর রাহমানের এ-পংক্তিটি নির্ভুলভাবে প্রযোজ্য এঁদের রচনা সম্পর্কে। শাহাদাৎ হোসেনের সৌন্দর্য- ও স্বপ্ন-কাতর কিছু পংক্তি নিম্নরূপ : ‘লোকান্তের কল্পকুঞ্জে মন্দার-শয়নে/আধ-ঘুমে আধ-জাগরণে/লক্ষ যুগ যুগান্তর ধরি’/আপনা পাসরি’/মগ্ন ছিনু যবে আমি চিত্রার স্বপনে;-লীলায়িত অনুভঙ্গে চঞ্চল চরণে/নৃত্যরঙ্গে সুরনটী অপাঙ্গ-লীলায়/ইঙ্গিতে ডেকেছে মোরে কেলিকুঞ্জে রঙ্গ-মণিকায়;/কল্পবালা কলকণ্ঠে রচিয়াছে সুরের স্বপন/আবেশ কম্পন-/জাগিয়াছে বিচিত্রার অন্তহীন রঞ্জিত মায়ায়;/চিত্রালোক ঝিলিমিলি কল্পতরুচ্ছায়/ঊর্মিনাটে মন্দাকিনী/তটিনী নটিনী/অশ্রান্ত নর্তনে মোরে জানায়েছে অন্তরের গোপন কামনা/চিত্রার স্বপনে তবু মুগ্ধ আমি আছিনু উম্মনা’ [‘অবতরণিকা’, রূপচ্ছন্দা]। তরল স্বপ্নস্রোত ব’য়ে যাচ্ছে স্তবকটির ওপর দিয়ে, একটি প্রথাসিদ্ধ কাব্যিক আবেশঘোর সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে কাব্যিক অনুষঙ্গ ও শব্দের ব্যবহারে; কিন্তু তা আলোড়ন জাগায় না, কেননা এর সমস্তটা বানানো ও অন্যের থেকে শেখা। শাহাদাৎ হোসেন ও তাঁর মতো অজস্র রবীন্দ্রানুকারীর হাজার হাজার সৌন্দর্যস্বপ্নআবেগখচিত স্তবক কবিতার দুটি রোম্যান্টিক সংজ্ঞাকে- ‘তীব্র অনুভূতির স্বতস্ফূর্ত উৎসারণ’, ও ‘সুন্দরতম শব্দের সুন্দরতম সংস্থান’- অর্থশূন্য ক’রে তুলেছে। এ-রকম অজস্র স্তবকসমষ্টি পদ্যস্তরেই নিঃশেষিত, যদিও তাতে প্রথাসিদ্ধ সৌন্দর্যের আকাল নেই, আবেগও তীব্র, শব্দগুলো প্রথাসম্মতভাবে সুন্দর, সংস্থানও ভালো।
রবীন্দ্রানুকরণ আরো স্পষ্ট আবদুল কাদিরের রচনায়; তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতার ছায়াবলম্বনে রচনা করেছেন ছন্দমিলন্যস্ত পদ্য। তাঁর রচনাও শেখা স্বপ্ন ও সৌন্দর্য বিন্যাস। তাঁর দিলরূবার [১৩৪০] যে-কবিতাগুলো জন্মেছে রবীন্দ্রনাথের কোনো-না- কোনো কবিতার ভাববীজ থেকে, সে-গুলো নির্দেশ করে যে তাঁর কোনো নিজস্ব কামনা-বাসনা-স্বপ্ন-আবেগ নেই; সবই তিনি সংগ্রহ করেছেন রবীন্দ্রনাথ থেকে। আবদুল কাদিরের রবীন্দ্রাচ্ছন্ন দুটি স্তবক : ‘দেহের প্রদীপে জ্বলে রূপক্ষরা যৌবনের শিখা;/ তোমার প্রতীক্ষা করি’ পাঠায়েছি পুষ্পের লিপিকা,-/হে সুন্দরী প্রিয়া, প্রিয়তমা!/আজি মোর গীতরাগে/অশোক-মঞ্জরী জাগে,/পলাশের ওষ্ঠপুটে লাগিয়াছে তাম্বুল-সুষমা।/ঘুমন্ত বনের ভালে জ্বলিছে শ্যামল বহ্নিশিখা,/উন্মুক্ত বায়ুর নৃত্যে কাঁপি’ কাঁপি’ মেলিছে মল্লিকা/গোপন কলিকা॥/আমার বেদনা দাহে রোমাঞ্চিয়া ওঠে তৃণদল,/রক্তের নর্তন-ভঙ্গে সিন্ধুবুকে তরঙ্গচঞ্চল/হে প্রেয়সী, প্রতীক্ষা তোমার। পথে ওড়ে পুষ্প ধুলি,/ঝড়ে দ্বার গেছে খুলি’,/উন্মুক্ত মন্দির মম যাচে তব মুগ্ধ অভিসার।’–[‘দিলরূবা’, দিলরূবা]। এ-পংক্তিবিন্যাস কবিতা হ’য়ে ওঠার জন্যে আকুল, কিন্তু শরীর আত্মায় বাঁধা প’ড়ে আছে নিম্ন-পদ্যস্তরে। শাহাদাৎ হোসেন, গোলাম মোস্তফা, আবদুল কাদির, সুফিয়া কামাল, মহিউদ্দীন, মঈনুদ্দীন, জসীমউদ্দীন, বে-নজীর আহমদ ও তাঁদের সমকালীন আরো অনেকের রচনা আধুনিকতার স্পর্শহীন। এঁদের মধ্যে অবশ্য সামান্য স্বাতন্ত্র্য ঝলকে ওঠে মহিউদ্দীন ও বে-নজীর আহমদের রচনায়; এবং জসীমউদ্দীন আধুনিকতা থেকে বেশ দূরে থেকে গ’ড়ে তোলেন আপন কবিতাজগত। এঁরা, একমাত্র জসীমউদ্দীন বাদে, কবি হিশেবে এতো গৌণ যে স্মরণীয় শুধু ঐতিহাসিক কারণে। এঁদের অভাবে বাঙলা কবিতার উজ্জ্বলতা একটুও কমতো না।
চল্লিশের দশকে, যখন আধুনিক কবিতার প্রতিষ্ঠা পাকা হয়ে গেছে, তখন যাঁরা বাঙলা কবিতার সঙ্গনে আসেন, তাঁদের এক গোত্র : ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, সিকান্দার আবু জাফর, আবুল হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান, গোলাম কুদ্দুস, মতিউল ইসলাম, আজিজুর রহমান, তালিম হোসেন। যদিও এঁদের একটি বড়ো অংশ শোচনীয়তার নিদর্শন, তবু এঁদেরই কারো কারো মধ্যে আধুনিক চেতনা ও কাব্যচেতনার আদি-উন্মেষ ঘটে। এঁদের মধ্যে মনোযোগ আকর্ষণ করেন মাত্র চারজন : ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, ও সৈয়দ আলী আহসান। ফররুখ আহমদের সাত সাগরের মাঝি[১৯৪৪] কতিপয় স্মরণীয় কবিতাখচিত হওয়া সত্ত্বেও আধুনিক চেতনার শস্য নয়। উচ্চকণ্ঠ এ-কবি নজরুল ইসলামের পরিশীলিত উত্তরাধিকারী;- জীবনবোধ, কাব্যভাবনা, আঙ্গিকচেতনা ও সংবেদনশীলতায় তাঁর কবিতা আধুনিকতার স্পর্শরহিত। তিনি তিরিশ-উত্তরকালে পুথিসাহিত্য ও নজরুলের উত্তরাধিকারী হয়ে রইলেন। আবুল হোসেনের নববসন্ত [১৯৪০], ও বিরস সংলাপ-এর [১৯৬৯] চল্লিশ-দশকে রচিত কবিতাগুচ্ছ সাক্ষ্য দেয় যে এ-কবির বুকে, অগভীর ও অব্যাপকভাবে হ’লেও, আধুনিক জীবন ও কবিতাচেতনা স্থান পেয়েছিলো। যদিও তাঁর হাতে একটিও তৃপ্তিকর গভীর সম্পূর্ণ কবিতা রচিত হয় নি, তবু তিনি উপমারূপকচিত্রকল্প রচনার আধুনিক কৌশল আয়ত্ত করেছিলেন কিছু পরিমাণে; কিন্তু তিনি নিঃশেষিত হন অল্পতেই। আহসান হাবীবের প্রথম কাব্যগ্রন্থ রাত্রিশেষ বেরোয় ১৯৪৭-এ; এবং এ-কাব্যেই সর্বপ্রথম একজন মুসলমান কবি ব্যাপক বিংশশতকি চেতনাসহ আত্মপ্রকাশ করেন। তিরিশি কবিরা যে-সব চিত্রকল্প তৈরি করেছিলেন স্বকালের বন্ধ্যাত্ব, শূন্যতা, ঊষরতা, অস্থিরতা জ্ঞাপনের জন্যে, সে-সব পুনরাবৃত্ত হলো তাঁর কবিতায় : ‘বন্ধ্যা মাটি’, ‘ঝরাপালকের ভস্মস্তূপ’-ধর্মী চিত্রকল্পের সাহায্যে তিনি চেষ্টা করলেন আপন বিশ্বরচনার। সুধীন্দ্রনাথ-বিষ্ণু দে-জীবনানন্দের শূন্যতা-নৈরাশ্য ঢুকলো তাঁর স্বপ্নে-মর্মে; এবং স্পষ্টভাবে অনুসরণ করলেন তিনি, অনেক ক্ষেত্রে, সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে। আহসান হাবীবের রাত্রিশেষ-অন্তর্গত ‘দ্বীপান্তর’ কবিতার খণ্ডাংশ এমন : ‘অতঃপর সচকিত আকস্মিক বিমূঢ় বিরতি/নিরাতঙ্ক পদতলে এ-মৃত্তিকা বিশ্বাসঘাতক!/উড়ন্ত পাখায় আজ নেমে এল অবাঞ্ছিত যতি,/অরণ্য স্বপনহীন, সে বন্ধু আকাশ পলাতক!/… দিনগুলি তারপর দুর্বোধ্য, ধোঁয়াটে, ধূসর,/সনির্বেদ, নিরালম্ব- অন্ধকার অচেনা বন্দরে!’ এর পংক্তিতে পংক্তিতে সুধীন্দ্রনাথ প্রতিধ্বনিত; শুধু তাই নয়, সুধীন্দ্রনাথের বহু চাবিশব্দ উপস্থিত এখানে। আহসান হাবীব তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থে সুধীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য আধুনিকের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, অনুসরণ করেছিলেন তাঁদের, এটা তাঁর গৌরব;- এ-প্রভাব-অনুসরণ নির্দেশ করে যে তিনি নতুন সংবেদনশীলতা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু ওই সংবেদনশীলতা তাঁর মধ্যে সুফলবান হয় নি; তিনি যুগবন্ধ্যাত্ব- সচেতন হ’লেও যুগের অন্তঃসার মূর্তি পায় নি তাঁর চৈতন্যে ও কবিতায়। তিনি একজন সরল রোম্যান্টিক, যিনি স্বপ্ন দেখেন বাস্তবের দৈন্যও; কখনো আশা জাগে চিত্তে, কখনো হতাশা, এবং কখনো অতীক্ষ্ণ বিদ্রূপশর নিক্ষেপে উৎসাহ পান। রাতিশেষ আধুনিক কবিতার অগ্রসরতার উদাহরণ নয়, অনুপ্রাণিতও করে নি পরবর্তীদের; এবং এ-কাব্যের চেতনা গভীর বিস্তৃতি পায় নি তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থরাজিতে। তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থসমূহ- ছায়াহরিণ[১৯৬২], সারা দুপুর[১৯৬৪], আশায় বসতি [১৯৭৫], মেঘ বলে চৈত্রে যাবো [১৯৭৬], দু’হাতে দুই আদিম পাথর [১৯৮০]- গভীর জীবন ও শিল্প-চেতনার উৎসারণ নয়। কালের উজ্জ্বল সহযাত্রী হ’তে পারেন নি তিনি,- মূল্যবান স্বপ্নকল্পনাবোধ যেমন দুর্লক্ষ্য তাঁর কবিতায়, তেমনি অনর্জিত থেকে গেছে কলা- প্রকৌশলগত সিদ্ধি। আহসান হাবীবের গৌরব তিনি সে-সকল মুসলমান কবিযশো- প্রার্থীদের একজন, যাঁদের বুকে আধুনিক চেতনা, স্বল্প পরিমাণে হ’লেও, সর্বাগ্রে জ্বলেছিলো।
সৈয়দ আলী আহসান তাঁর তরুণ জীবনের অন্তত দেড় দশক অপব্যয় করেছেন। প্রথম জীবনে তিনিও ইসলাম ও পুথিসাহিত্যকে প্রেরণারূপে ব্যবহারের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর সাফল্যের প্রধান অন্তরায় ছিলেন মৌলবাদী ফররুখ আহমদ, যিনি ওই এলাকায় আয় ক’রে নিয়েছিলেন সাফল্য। আধুনিকতার সাথে অনেক দেশে জড়িত হয়ে পড়ে রাজনীতিক প্রতিক্রিয়াশীলতা,–সৈয়দ আলী আহসান আধুনিকতাকে সুবিধাবাদী প্রতিক্রিয়াশীলতার সাথে জড়িত ক’রে দেন। চল্লিশ-দশকের শুরুর দিকে তিনি ইসলামি ঐতিহ্যকে এলিয়টের অনুকরণে উপস্থাপনের চেষ্টার পাশাপাশি সাম্যবাদবিরোধী কবিতাও রচনা করেন আধুনিক ভঙ্গিতে। তাঁর এ-সময়ের কবিতাসমূহের ব্যর্থতা ধরা পড়ে তাঁর নিজেরও কাছে, তাই কাব্যসংগ্রহ-এর [১৯৭৪] ভূমিকায় তিনি এসব রচনাকে অস্বীকার করেন। সৈয়দ আলী আহসানের আধুনিকায়ন এক বিলম্বিত ঘটনা : তাঁর আধুনিক চেতনামণ্ডিত প্রথম কাব্য অনেক আকাশ[১৩৬৬], যে-নামটি গৃহীত জীবনানন্দ থেকে, প্রকাশিত হয় পঞ্চাশের দশকের শেষাংশে। এ-কাব্যে আধুনিক সৈয়দ আলী আহসানের উদ্ভব; আর বিকাশ ঘটে পরবর্তী কাব্যগ্রন্থসমূহে-একক সন্ধ্যায় বসন্ত [১৩৬৯], সহসা সচকিত[১৩৭৩], উচ্চারণ[১৯৭৮], ও আমার প্রতিদিনের শব্দ-এ [১৩৮১]। সৈয়দ আলী আহসান বস্তুবাস্তরতাময় পৃথিবীকে, নিসর্গ ছাড়া, গ্রহণ করেন না কবিতায়। শব্দের বহুবিকিরণ সংগ্রহ করা তাঁর লক্ষ্য, এবং কবিতাকে তিনি পরিণত করেন পঞ্চেন্দ্রিয়ের লীলালাস্য ও বিমূর্ততার লীলাভূমিতে। আধুনিকতার একটি লক্ষণকেই তিনি বড়ো ক’রে তোলার চেষ্টা করেছেন তাঁর কবিতায়; শব্দের ওপর তিনি আরোপ করেন অপরিসীম গুরুত্ব। তাই তাঁর আধুনিকতা যতোটা আধারগত, ততোটা আধেয়গত নয়।
১৯৫০-এ আশরাফ সিদ্দিকী ও আবদুর রশীদ খানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় নতুন কবিতা নামী একটি ক্ষুদ্র কাব্যসংকলন, যাকে সম্পাদকদ্বয় দাবি করেছেন ‘সাহিত্যপথের নতুন যাত্রীদের কাব্যসৃষ্টির খতিয়ান’ ব’লে। নতুন কবিতার বিভাহীন ভূমিকাটি কোনো কাব্যান্দোলনের ইঙ্গিত দেয় না। নতুন কবিতা আজ স্মরণীয় ঐতিহাসিক কারণে। সংকলনটিতে স্থান পেয়েছিলেন তেরোজন ‘কবি’, তিরিশ বছর বয়স্ক তরুণ থেকে চোদ্দ বছর বয়স্ক কিশোর, যাঁদের ব্যাপক ব্যর্থতা ও সামান্য সাফল্যের সংগ্রহ এটি। সংগৃহীত কবিযশোপ্রার্থীদের অনেকে লুপ্ত হন অত্যল্প সময়ের মধ্যে, কেউ কেউ পৌঁছোন দীনতাব্যর্থতার সীমান্তে। এগিয়ে যান মাত্র দুজন- শামসুর রাহমান ও হাসান হাফিজুর রহমান। সংকলনটিতে একটিও উল্লেখযোগ্য পরিপূর্ণ কবিতা স্থান পায় নি, এবং অধিকাংশেরই শব্দ-বাক্য-বিষয় দ্যুতিহীন। শামসুর রাহমানই নতুন কবিতা-অন্তর্ভুক্ত একমাত্র কবি, যাঁর কবিতার স্বপ্নকল্পনাবোধ উজ্জ্বল। স্বপ্নবিহার ও প্রতিবেশচেতনা ঢুকেছে তাঁর কবিতায়, জীবনানন্দ দখল করেছেন তাঁর কল্পনা; এবং চোখে প্রবেশ করেছে অচিরস্থায়ী মরুস্বপ্ন। ‘অনেক চোখের রাত’ নামী কবিতাটির মরুস্বপ্নভরা কয়েকটি পংক্তি এমন : ‘এমন অনেক রাত হয়তো নেমেছে/বাদাকশানের পথে…/এমন অনেক রাত হয়তো নেমেছে সাত সাগরের ঢেউয়ে/হয়তোবা বিবসনা শা’জাদীর গজল-মুখর/কোনো দূর ঝরোকোয়;/এমন অনেক রাত হয়তো নেমেছে/বেদুইন কুমারীর চোখের পাতায়।’ এ-রোম্যান্টিক স্বপ্নের ওপর প্রভাব ফেলেছেন হয়তো তিরিশের অব্যবহিতপূর্ব মরুস্বপ্নচারীরা, এমনকি ফররুখ আহমদ; কিন্তু নতুন কবিতা–অন্তর্ভুক্ত শামসুর রাহমানের ছটি কবিতায় যাঁর ছাপ রক্তমাংসস্বপ্নে আঁকা হয়ে গেছে উজ্জ্বল রেখায়, তিনি জীবনানন্দ দাশ। স্বপ্নভারাতুরতা, সৌন্দর্যস্পৃহা, প্রতিবেশপৃথিবীবোধ, আত্মকেন্দ্রিকপরিক্রমা, যা শামসুর রাহমানের বৈশিষ্ট্য, এ-কবিতাগুলো তার উন্মেষচিহ্নখচিত। নতুন কবিতা-ভুক্ত সকলেরই কবিতায় লক্ষণীয় হচ্ছে ভাব ও ভাষার দ্বন্দ্ব, যে-দ্বন্দ্বের কালো রক্ত ছড়িয়ে আছে প্রায় সর্বত্র; আর এ-কালো রক্তের ছোপ সবচেয়ে কম লেগেছে শামসুর রাহমানের কবিতায়। তিনি একমাত্র কবি এ-সংকলনের, যিনি ভাবনার শরীর অনুসারে বানাতে শিখেছেন ভাষাপোশাক। তাই তাঁর উক্তি অন্যদের চেয়ে অনেক আন্তরিক ও বিশ্বাসযোগ্য : ‘চাঁদ ফুল পাখি মেঘ নক্ষত্র শিশির আর নারীর প্রণয়/আজো মিথ্যা নয়…/নতুন ধানের স্বপ্ন মিথ্যা কভু’ [‘একটি কবিতা’]। এ-উক্তি অভিনব অসাধারণ নয়; কিন্তু এর মধ্যে বিদ্যমান আপন ভাবনাবেদনা উপস্থাপনের সে-শক্তি, যা শব্দসজ্জাকে কবিতায় পরিণত করে। শব্দকে কবিতায় পরিণতিদানে শামসুর রাহমান, নতুন কবিতা ভুক্তদের মধ্যে, সার্থকতম। হাসান হাফিজুর রহমান আধুনিক চেতনাঋদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও ভাষাভাবনার পারস্পরিক দ্বন্দ্বে বিক্ষত নতুন কবিতা ভুক্ত কবিতাগুচ্ছে। এ-কবিতাগুচ্ছে ফ’লে উঠেছে তাঁর নিজস্ব গদ্যরীতি, যা তাঁর পরবর্তী কবিতায়, সফলতায় বিফলতায়, বহন করে হাসান হাফিজুর রহমানের আঙুলের ছাপ
বিভিন্ন নতুন কবির কাব্যগ্রন্থপ্রকাশ, তৎকালীন বাঙলায় প্রথম, শুরু হয় পঞ্চাশের দশকে। বাঙলাদেশের উদ্ভবের অব্যবহিত আগে যেমন সৃষ্টিশীলতামুখর হয়ে উঠেছিলেন তরুণ কবিরা, এবং স্বাধীনতার পরে একের পর এক প্রকাশিত হ’তে থাকে তাঁদের কাব্যগ্রন্থ, পাকিস্তানি স্বাধীনতা তেমন সৃষ্টিশীল প্রেরণাদীপ্র ছিলোনা। তাই চল্লিশ দশকের শেষাংশ নতুন কাব্যগ্রন্থহীন থেকে যায়, পুরোনো পদ্যলেখকেরা পাকিস্তান ও তার পিতার স্তোত্ররচনায় নষ্ট হ’তে থাকেন। পঞ্চাশ-দশকের সূচনা হ’লে প্রকাশ শুরু হয় নির্গ্রন্থ কবিদের কাব্যগ্রন্থপ্রকাশ;তবে অজস্র নতুন বেরোনো কাব্যগ্রন্থের ঝলমলে রঙে রঞ্জিত নয় ওই দশক;-পঞ্চাশ-দশকের প্রথমার্ধে নির্গ্রন্থ কোনো কবির কাব্যগ্রন্থ বেরোয় সম্ভবত একটি, এবং দ্বিতীয়ার্ধে বেরোয় বেশ কয়েকটি। শামসুর রাহমানের প্রথম, ও বিলম্বিত, কাব্যগ্রন্থ প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে [১৩৬৬] বেরোয় ১৯৬০-এর শুরুতে- ইঙ্গিতময় ফাল্গুনে। প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগের প্রকাশ, বাঙলাদেশের কাব্যমণ্ডলের, প্রথম সুবর্ণমণ্ডিত ঘটনা : চল্লিশের দশক থেকে আধুনিকতা ও আধুনিক কবিতার সাথে যুক্ত হওয়ার জন্যে স্খলনপতনভরা যে-শ্রমসাধনা ক’রে আসছিলেন বাঙালি মুসলমান কবিমগুলি, তা ব্যাপক সাফল্য আয় করে প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে তে। এ-গ্রন্থে গ্রথিত কবিতারাশি আগেই প্রকাশিত হয়েছিলো পত্রপত্রিকায়, সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল কবি ও আধুনিক হিশেবে চিহ্নিত হচ্ছিলেন তিনি; এবং ১৯৬০-এ যখন ওই কবিতারাশি গ্রন্থিত হয়ে প্রকাশ পায়, তখন তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করে। প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে যে-বোধটিকে প্রধান ক’রে সকলের সামনে উপস্থিত করে, তা আধুনিকতা, যা আয়ত্তের জন্যে দু-দশক ধরে ব্যর্থতা থেকে ব্যর্থতায় স্খলিত হয়েছেন মুসলমান কবিসম্প্রদায়। ১৯৬০ বাঙালি মুসলমানের আধুনিক হয়ে ওঠার বছর; তাঁদের কবিতার আধুনিকতা আয়ত্তের বছর। তিরিশি কবিতাস্রোতের সাথে প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগের সাহায্যে বাঙলাদেশকে দৃঢ় সংযুক্ত করেন শামসুর রাহমান;- আধুনিক জীবন-ও কাব্য-চেতনার এমন ব্যাপক প্রবল গভীর প্রকাশ গোচরে আসে না শামসুর রাহমানপূর্ব কোনো বাঙলাদেশীয় কবির কবিতায়। শামসুর রাহমানই সে-শক্তিমান ও ভাগ্যবান আধুনিক, এবং সর্বাংশে আধুনিক, যাঁর কবিতা আধুনিক চেতনাচৈতন্য সংবেদনশীলতার উন্মেষচিহ্নখচিত নয় শুধু, বরং সমৃদ্ধ আধুনিক চেতনার উজ্জ্বল উৎসারণ। আহসান হাবীব ও আবুল হোসেন-এ দেখি যার ক্ষীণ উন্মেষ, সৈয়দ আলী আহসান-এ জ্ব’লে উঠেছে যার একমাত্রিক দীপ্তি, হাবীবুর রহমান, আবদুল গণি হাজারী, মোহাম্মদ মামুন, আবদুর রশীদ খান-এ পাই যার তমসাগ্রস্ত গরিব আভাস, শামসুর রাহমান-এ তা জ্ব’লে উঠেছে ঝাড়লণ্ঠনের বর্ণাঢ্য শোভাপ্রদীপ্তিসহ। প্ৰথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে বাঙলাদেশীয় কবিতার ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল উচ্চ স্তম্ভ। বইটির নামই বিকিরণ করে নতুন চেতনা, এবং কল্পনাকে সরল রোম্যান্টিক আশাউচ্ছ্বাস থেকে বিরত ক’রে এক জটিল গভীর নিঃসীম আলোড়নের মধ্যে প্রবিষ্ট ক’রে দেয়। নামটি ইঙ্গিত করে যে কবির, এবং সকলের, মানসমৃত্যু ঘটে গেছে, এখন আছে শুধু প্রথাসম্মত দ্বিতীয় মৃত্যু। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ রৌদ্র করোটিতে[১৯৬৩] পরিয়ে দেয় তাঁকে বাঙলাদেশের অস্বীকৃত প্রধান, আধুনিক, কবির শিরোপা। স্বপ্ন-সৌন্দর্য-কল্পনামণ্ডিত মনোবিশ্ব ও জীবনখচিত প্রতিবেশপৃথিবী সাদরে গৃহীত হয় রৌদ্র করোটিতের কবিতাসমূহে : এক ভয়াবহ সময় ও বিশ্বে বসবাসের অভিজ্ঞতা জড়ো হয় এর কবিতাপুঞ্জে। তিরিশি কবিতার বড়ো অংশ মনোবিশ্বের শস্য; শামসুর রাহমান তার সাথে গেঁথে দেন বস্তুবাস্তবতা ও অব্যবহিত প্রতিবেশপৃথিবী। বাঙলাদেশীয় কবিতা, তাঁর নিকট থেকে, পায় বিস্তৃতি ও বৈচিত্র্য, জীবন ও স্বপ্ন, বাস্তব ও অবাস্তব, প্রতিবেশ ও অধরা নীলিমা। শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্য দুটি গোপন ও প্রকাশ্য প্রভাব বিস্তার করেছে বাঙলাদেশের কবিতার আলোতেবাতাসে; বিষয় ও ভাষায় তিনি যে-চেতনা সঞ্চার করেছেন তাঁর কবিতায়, তা সংক্রামিত হয় অন্যদের ও তরুণতরদের মধ্যে; এবং শামসুর রাহমানোত্তর বাঙলায় অনাধুনিক চেতনা লালন করাই হয়ে ওঠে কষ্টকর। আজ বাঙলার নবীনতম কবির ব্যর্থতম রচনাও কোনো-না-কোনোভাবে আধুনিক চৈতন্যের উপাসক। শক্তি সৃষ্টি সাফল্যে, তাঁর সাম্প্রতিক ধূসরতা সত্ত্বেও, ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলে প্রতিদ্বন্দ্বীরহিত তিনি, এবং সম্ভবত শামসুর রাহমানই বাঙলাদেশের একমাত্র ‘প্রধান কবি’।
একজন কবি কখন হয়ে ওঠেন প্রধান কবি?- তিনি কি এ-কারণেই প্রধান যে তিনি তাঁর কালে সক্রিয় অন্য কবিদের থেকে উৎকৃষ্ট;- ভাব-ভাষার বিন্যাসে উৎকৃষ্টতম? প্রধান কবি তাঁর কালের উৎকৃষ্টতম, বা অন্যতম উৎকৃষ্ট কবি, সন্দেহ নেই; কিন্তু কোনো কালের উৎকৃষ্টতম কবিমাত্রই যে প্রধান বা মুখ্য কবি, তা নয়। এমন অনেক সময় আসতে পারে যখন আবির্ভূত হ’তে পারেন নিম্ন, মাঝারি, ভালো কবিরা; কিন্তু অনুপস্থিত থাকতে পারেন কোনো প্রধান কবি। প্রধান কবি নতুন সংবেদনশীলতার জন্ম দেন তাঁর গোত্রের অন্তরে, পরিস্রুত করেন ভাষা, এবং অধিকার করেন জীবন ও অভিজ্ঞতার এমন এলাকা, যা তাঁর আগে অধিকারে আসে নি অন্য কারো। তিনি তাঁর জীবন ও অভিজ্ঞতার এলাকাকে এমনভাবে উপস্থিত করেন সমকাল ও মহাকালের সামনে যে তাঁর সমকালের মানুষেরা তাঁর অভিজ্ঞতাকেই নিজেদের অভিজ্ঞতা হিশেবে গ্রহণ করে। যেহেতু তিনি কবি, তাই তিনি তাঁর আপন ভাষার কবিতাকে উন্নীত করেন নতুন স্তরে; আবিষ্কার করেন কবিতার নতুন ব্যাকরণ, যা হয়ে উঠবে আগামীকালের ঐতিহ্য; এবং তিনি নিজে তাঁর কালের অন্য কবিদের অতিক্রম ক’রে তাঁর ভাষার সমস্ত কালের প্রধান কবিদের পংক্তিতে আপন স্থান ক’রে নেন। বাঙলাদেশের কবিদের মধ্যে শামসুর রাহমানই শুধু অর্জন করেছেন উল্লিখিত গুণাবলি সম্পূর্ণরূপে না হ’লেও অনেকাংশে; সুতরাং একজন প্রধান কবির মর্যাদা, বাঙলাদেশে, একমাত্র তাঁরই প্রাপ্য। শামসুর রাহমানের উৎকর্ষ ও শ্রেষ্ঠত্ব এখন অবিসংবাদিত; তিনি যে জীবন ও অভিজ্ঞতা উপস্থিত করেছেন তাঁর কবিতাবলিতে, তা দু-দশক ধরে প্রধান্য বিস্তার ক’রে আছে। কবিতার কলাকৌশলে তিনি সৃষ্টি করেছেন নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ অভিনবত্ব : এমন কিছু উপমা উৎপ্রেক্ষা চিত্রকল্প রচিত হয়েছে তাঁর কবিতায়, যাদের অবিনাশী ব’লে স্বীকার করা যায়। শামসুর রাহমান শুধু বাঙলাদেশের প্রধান ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবি নন, তিরিশি পাঁচজনের পর সমগ্র বাঙলা কবিতার বিস্তৃত ক্ষেত্রেও তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবি। আদিম দেবতাদের পরে চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকে উদ্ভুত হন যে-কবিরা, সুভাষ মুখোপাধ্যায় থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও পরবর্তীদের পর্যন্ত, কেউ শামসুর রাহমানের মতো ব্যাপকগভীর বিস্তৃত নন, যদিও কেউ কেউ কোনো কোনো ক্ষেত্রে চমৎকার। তাঁর কবিতার একটি বড়ো অংশ হয়তো আগামী দু-তিন দশকের বাতাসে নেভে যাবে, একটি বৃহৎ অংশ হয়তো আনন্দ যোগাবে ভবিষ্যতের গবেষকদের চিত্তে- কার কবিতা জোগায় না?- কিন্তু তাঁর প্রচুর কবিতা বাঙলা ভাষার সঙ্গী হয়ে পাঠকচিত্তে শিহরণ জাগাবে। বিশ শতকের দ্বিতীয়াংশ হবে যার কাছে ধূসর-অতীত সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা-গবেষণাগ্রন্থ- ইতিহাসপুস্তক, সে এ-সময়ের কবিতার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে শামসুর রাহমানের কবিতায় এসে অনুভব করবে যে তার মেধা আর চিত্ত বলছে : এই তো একজন প্রধান কবির ছোঁয়া পাচ্ছি!