নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা

নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা

নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার বিকাশ গত আড়াই দশকের সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার এলাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নারীবাদীরা যেমন আক্রমণ করেছেন ও বদলে দিতে চেয়েছেন পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক-ও রাজনীতিক কাঠামো, তেমনি আক্রমণ করেছেন ও বদলে দিতে চেয়েছেন পুরুষতান্ত্রিক সমস্ত লিঙ্গবাদী চিন্তাধারা। পিতৃতান্ত্রিক চিন্তা, আবেগ, উপলব্ধি, ও প্রচারের এক প্রধান এলাকা সাহিত্য। গত কয়েক হাজার বছরের বিশ্বসাহিত্য পুরুষতান্ত্রিকতার বিশ্ব; পুরুষ সৃষ্টি করেছে ওই সাহিত্য, তৈরি করেছে তার তত্ত্ব, করেছে মূল্যায়ন। সাহিত্য সৃষ্টি ও ব্যাখ্যার সমগ্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে; সেখান থেকে নারী শুধু বাদই পড়ে নি, তাতে তৈরি করা হয়েছে নারীর মিথ্যে ভাবমূর্তি, নিন্দিত হয়েছে নারী। পুরুষ আশা করে নি যে নারী সৃষ্টি করবে সাহিত্য, তবু নারী সাহিত্য সৃষ্টি করেছে, তবে তা মূল্য পায় নি পুরুষের কাছে, বা পুরুষ তার অপব্যাখ্যা করেছে। বিশ্বসংস্কৃতির অজস্র পুরাণে পুরুষকেই দেখানো হয়েছে সৃষ্টিশীল ব’লে; সৃষ্টিশীলতার সব এলাকায়- ধৰ্ম, শিল্পকলা, বিজ্ঞান প্রভৃতিতে স্বীকৃতি পেয়েছে শুধু পুরুষের সৃষ্টিশীলতা। সব ধর্মেই বিধাতা পুরুষ, যে শূন্যতা থেকে সৃষ্টি করেছে বিশ্ব। শেলি, কোলরিজ, কি, রাসকিন লেখককে দেখেছেন পুরোহিত, ধর্মপ্রবর্তক, যোদ্ধা, বিধানপ্রণেতা, বা সম্রাটরূপে; অর্থাৎ পুরুষের চোখে পুরুষই সৃষ্টিশীল। পুরুষের চোখে নারীও পুরুষেরই সৃষ্টি। ওই নারীর, পিগম্যালিঅনের আইভরি তরুণীর মতো, কোনো নাম বা সত্তা বা কণ্ঠস্বর নেই। নারী বস্তু, নারী অপর। নারী শুধু বস্তু নয়, পুরুষের চোখে নারী শিল্পকর্ম; নারী মর্মর মূর্তি, বা পুতুল, বা কবিতা, নারী কখনো ভাস্কর বা কবি নয়। শেক্সপিয়রের ওথেলো (৪:২) দেসদিমোনার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে : ‘এই শুভ্র কাগজ, এই উৎকৃষ্টতম বইটি,/কি তৈরি হয়েছিলো এতে ‘বেশ্যা’ লেখার জন্যে?’ নারী লেখে না, লিখিত হয়, নারী কবিতাকল্পনালতা; নারী আঁকে না, অঙ্কিত হয়; নারী ভাস্কর হয় না, ভাস্কৰ্য হয়।

হেনরি জেমসের এক মহিলার ছবিতে শুদ্ধ এক তরুণীকে বর্ণনা করা হয়েছে ‘কাগজের একটি শূন্য পৃষ্ঠা’ রূপে; সে ‘এতো সুন্দর ও মসৃণ পৃষ্ঠা যে তাকে এক সময় ভ’রে তুলতে হবে মানসিক উন্নতিসাধক পাঠে।’ জেমসের চোখে অভিজ্ঞ নারী এমন কাগজ, ‘যার ওপর নানান হাত লিখেছে নানান পাঠ।’ কনরাডের বিজয়-এ অ্যালমা ‘এক অপরিচিত ভাষার লিপির মতো’, বা ‘নিরক্ষরের কাছে যে-কোনো লিপির মতো। সমালোচকেরাও সাহিত্যপাঠকে বর্ণনা করেন লৈঙ্গিক ভাষায়। দেরিদা কলমকে শিশ্নের সাথে, আর যোনিচ্ছদকে কাগজের সাথে অভিন্ন ক’রে দেখেছেন। কলম-শিশ্ন লিখে চলে কুমারী পৃষ্ঠার ওপর, এ-বোধের ঐতিহ্য বেশ দীর্ঘ। এ-বোধ অনুসারে লেখক পুরুষ, ও প্রধান; নারী তার অক্রিয় সৃষ্টি, গৌণ বস্তু, যার নেই কোনো স্বায়ত্তশাসিত সত্তা, যার কখনোবা স্ববিরোধী অর্থ রয়েছে কিন্তু কোনো অভিপ্রায় নেই। এ-ধারা সংস্কৃতিসৃষ্টির প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেয় নারীকে, এবং গণ্য করে শিল্পকর্মরূপে। উনিশশতকে অনেক নারী লেখক হ’তে গিয়ে সমস্যায় পড়েন, কেননা কলম তাঁদের জন্যে নয়; কলম ধরা তাঁদের কাছে মনে হয় দানবিক কাজ, তাই তাঁরা নেন নানা কৌশল। এ-কৌশলগুলো সান্ড্রা এম গিলবার্ট ও সুজান গুবার বর্ণনা করেছেন দি ম্যাড ওম্যান ইন দি অ্যাটিক : দি ওম্যান রাইটার অ্যান্ড দি নাইনটিথ্-সেঞ্চুরি লিটেরেরি ইমাজিনেশন (১৯৭৯) বা চিলেকোঠার পাগলীতে। সুজান গুবার আইসাক ডিনেসেনের ‘শূন্যপৃষ্ঠা’ নামের একটি গল্প ব্যাখ্যা ক’রে দেখিয়েছেন পুরুষতান্ত্রিক ঐতিহ্য বিশ্বাস করে যে নারীর পক্ষে শিল্পী হওয়া অসম্ভব, তবে সে নিজেকে রূপান্তরিত করতে পারে শিল্পকর্মে। তিনি আরো দেখিয়েছেন অনেক নারী বোধ করে যে শরীরই তাদের শিল্পসৃষ্টির একমাত্র মাধ্যম। এর ফলে নারী শিল্পী ও তার শিল্পকর্মের মধ্যে কোনো দূরত্ব থাকে না। নারীদেহ যে-সব রূপক সরবরাহ করে, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে রক্তের রূপক, তাই নারীর শিল্পসৃষ্টি হয়ে ওঠে একধরনের যন্ত্রণাকর ক্ষত। প্রসবে ও লেখায় নারীর নিয়তি যন্ত্রণা।

নারীবাদীরা পুরুষের সৃষ্টিশীলতাতত্ত্ব মানেন নি, এবং পুরুষের সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনারীতিকে সংশোধন করার জন্যে গ’ড়ে তোলেন নিজেদের সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনারীতি। এ-ক্ষেত্রে গত আড়াই দশকে সবচেয়ে বিপ্লবাত্মক কাজ করেছেন তাঁরাই, যদিও পুরুষতান্ত্রিক সমালোচকেরা আজো দ্বিধা করেন তা স্বীকার করতে। অনেকে শুধু দ্বিধা নয় ক্ষুব্ধ বোধ করেন। তাঁদের মতে নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনার কাজ ‘মহৎ পুরুষ লেখকদের ধ্বংস করা’; এটা ‘সমালোচনার মুখোশ প’রে নারীবাদী অপপ্রচার’। নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার লক্ষ্য সব সময়ই রাজনীতিক; এর প্রচেষ্টা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার ত্রুটি বের করা। নারীবাদী সমালোচনার একটি ধারা দেখা দিয়েছিলো মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের ভিন্ডিকেশন অফ দি রাইট্স্ অফ ওম্যান-এই (১৭৯২), যেখানে তিনি পুনর্বিচার ও তিরষ্কার করেন রুশো ও পুরুষতন্ত্রের নানা মহাপুরুষকে; তবে এর ধারাবাহিক বিকাশ ঘটে নি। তাই উনিশশতকে নারীবাদী সমালোচনা, স্ট্যান্টনের নারীর বাইবেল (১৮৯৫) ছাড়া, বিশেষ চোখে পড়ে না। এ-শতকেও ১৯৬৯-এর মধ্যে নারীবাদী সমালোচনার বই বেরোয় গুটিকয় : ভার্জিনিয়া উল্ফের এ রুম অফ ওআন্স অৌন : কারো নিজের ঘর (১৯২৭), সিমোন দ্য বোভোয়ারের দ্বিতীয় লিঙ্গ (১৯৪৯), ক্যাথরিন এম রজার্সের দি ট্রাবলসাম হেল্পমেট : বিরক্তিকর সহধর্মিণী (১৯৬৬), মেরি এলমানের থিকিং অ্যাবাউট উইমেন : নারীদের সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা (১৯৬৮), এবং কেইট মিলেটের সেক্সুয়াল পলিটিক্স : লৈঙ্গিক রাজনীতি (১৯৬৯)। নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার বিকাশ ঘটে নারীবাদী সংগ্রামের এক শক্তিশালী অঙ্গরূপে। নারীবাদী সংগ্রাম চায় পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস বা রূপান্তরিত করতে; সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা করতে চায় একই কাজ, ভিন্নভাবে ভিন্ন এলাকায়। তাই তত্ত্ব ও সমালোচনায় নারীবাদীদের মিলন ঘটাতে হয়েছে রাজনীতি ও সমালোচনার। প্রথাগত পুরুষি সমালোচনার মানদণ্ডে চলতে পারে না নারীবাদী সমালোচকের, তাঁদের খুঁজতে হয়েছে ভিন্ন মানদণ্ড। নারীবাদী সমালোচনা ভালো লাগার কথা নয় প্রথাগত পুরুষ সমালোচক ও পুরুষি প্রতিষ্ঠানগুলোর। নারীবাদী সমালোচকদের সামনে খোলা ছিলো দুটি পথ : প্রচলিত মানদণ্ডের সাথে সন্ধি করে পুরুষের স্বীকৃতি আদায় করা, অথবা প্রতিষ্ঠিত মানদণ্ডগুলোকে ঘৃণাভরে বর্জন ক’রে নিজেদের নতুন মানদণ্ড তৈরি করা। নারীবাদীরা বেছে নেন দ্বিতীয় পথ। নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার দুটি ধারা রয়েছে : একটি ইঙ্গমার্কিন, অন্যটি ফরাশি। এর মাঝে ইঙ্গমার্কিন ধারাটিই অর্জন করেছে প্রাধান্য।

বিশশতকের ষাটের দশকের শেষ থেকে, আন্তর্জাতিক নারীবাদের এক প্রবল শাখারূপে, বিপ্লবাত্মক বিকাশ শুরু হয় নারীবাদী সমালোচনা ও সাহিত্যতত্ত্বের, এবং অনেকখানি বদলে দেয় সাহিত্য মূল্যায়নের প্রথাগত রীতি। বিশ্ব জুড়ে এতোকাল ধ’রে নেয়া হয়েছে যে পুরুষই লেখক, পাঠক, সমালোচক; নারীবাদীরা দেখান নারী সমালোচক ও পাঠক সাহিত্য উপলব্ধি করেন ভিন্নভাবে, ও সাহিত্যের কাছে তাঁদের প্রত্যাশা ভিন্ন। তাঁরা আরো দেখান যে বিশ্ব জুড়েই নারীরা সৃষ্টি করেছেন গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য। পুরুষের সভ্যতা জুড়ে কয়েক হাজার বছর ধ’রে সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা থেকেছে পুরুষের অধিকারে, নারীবাদীরা ঢোকেন সেখানে, পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ নেন পূর্ববর্তী সমগ্র সাহিত্য। নারীবাদী সমালোচনার প্রধান মানদণ্ড লিঙ্গ। নারীবাদীরা বিকাশ ঘটান সাহিত্য সৃষ্টি, পাঠ, ও সমালোচনার লৈঙ্গিক স্বাতন্ত্র্যের তত্ত্ব। তাঁদের তত্ত্ব ও সমালোচনারীতি কোনো একক উৎস থেকে জন্মে নি, তাঁদের নেই কোনো পুণ্য বা ঐশী গ্রন্থ বা মহামাতা। যেমন রয়েছেন মার্ক্সীয়দের মার্ক্স, সাংগঠনিকদের সোস্যুর, মনোবিজ্ঞানবাদীদের ফ্রয়েড বা লাকঁ, বিসংগঠনবাদীদের দেরিদা, নারীদের নেই তেমন কেউ। নারীরা নিরীশ্বর। একাধিক উৎসকে কাজে লাগিয়েছেন তাঁরা। তাঁরা নারীসাহিত্য পড়েছেন, জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-ইতিহাস, মনোবিজ্ঞান, নৃতত্ত্বে গবেষণারত নারীবাদীদের সাথে ভাববিনিময় করেছেন, প্রচলিত সাহিত্যতত্ত্বের পুনর্মূল্যায়ন করেছেন, কৌশল ধার করেছেন মার্ক্সবাদ, ভাষাবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, বিসংগঠনবাদ থেকে, এবং গ’ড়ে তুলেছেন নিজেদের তত্ত্ব ও রীতি। যদিও আজো কোনো সমন্বিত সাহিত্যতত্ত্ব তাঁরা গ’ড়ে তুলতে পারেন নি- অনেকে তা চানও না, তবু সমন্বিত সাহিত্যতত্ত্বের দিকে তাঁরা এগিয়েছেন অনেকখানি। নারীবাদী সাহিত্যতাত্ত্বিক বা সমালোচককে যে নারীই হ’তে হবে, তা নয়; তবে নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার বিকাশ ঘটান নারীরাই; তাঁরাই লড়াই করেন এর জন্যে, কখনো কখনো বিপদগ্রস্তও হন। তাঁরা চেষ্টা করেন তত্ত্ব ও ব্যক্তিতার সমন্বয় ঘটাতে। তাঁরা খোঁজেন নিজেদের একান্ত ভাষা, আঙ্গিক, কণ্ঠস্বর, সংগঠন, যা নিয়ে তাঁরা ঢুকতে পারেন পুরুষাধীন একটি এলাকায়। নারীবাদী সাহিত্যতাত্ত্বিক ও সমালোচকেরা কখনো ক্রুদ্ধ আর তিরষ্কারমুখর, কখনো আবেগাতুর ও গীতিময়; আর তাঁদের তত্ত্ব ও সমালোচনায় মূর্ত তাঁদের নারীমুক্তির রাজনীতি। নারীবাদ নারীদের মহাজাগরণ, সাহিত্য সমালোচনায় ঘটে ওই মহাজাগরণেরই প্রকাশ। নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা এক বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব, যাতে রয়েছে প্রতিষ্ঠিত কাঠামো ভাঙার উত্তেজনা ও নতুন দৃষ্টি আবিষ্কারের সাধনা। তাঁরা প্রকাশ করেছেন নানা নারীবাদী পত্রিকা, যাতে নিয়মিতভাবে বেরোয় নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা বিষয়ক প্রবন্ধ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্যামেরা অ্যাস্কিউয়্যারা : লস অ্যাঞ্জেলেস, কোন্ডিশন্স : ব্রুকলিন, কানেকশন্স : অকল্যান্ড, ক্রিটিক্যল ইনক্যোয়ারি : শিকাগো, ডায়াক্রিটিক্স : ইথাকা, ফেমিনিস্ট রিভিউ : লন্ডন, হেকেট : কুইন্সল্যান্ড, হেরাসিজ : নিউ ইঅর্ক, এম/এফ : লন্ডন, সেইজ : আটলান্টা, সিনিস্টার উইজডম : রকল্যান্ড প্রভৃতি।

নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনার উন্মেষের বছরগুলোতে জোর দেয়া হয় পুরুষের লেখা সাহিত্যে লিঙ্গবাদ ও নারীবিদ্বেষের স্বরূপ উদঘাটনের ওপর। তাঁরা দেখান পুরুষ তৈরি করেছে ছকবাঁধা নারীভাবমূর্তি, সৃষ্টি করেছে দেবী ও দানবী; দেখান ধর্মগ্রন্থে, ধ্রুপদী ও জনপ্রিয় সাহিত্যে নারীকে পীড়ন ও অপব্যবহার করা হয়েছে নানাভাবে, আর নারীকে বাদ দেয়া হয়েছে সাহিত্যের ইতিহাস থেকে। সমাজে যেমন চলে নারীপীড়ন, নারী যেমন হয় ধর্ষণের শিকার, তেমনি যুগেযুগে সাহিত্যে পীড়িতধর্ষিত হয়েছে নারী। তাঁরা পুরুষের ‘মহৎ’ সাহিত্য ঘেঁটে দেখান যে তাতে নারীবিদ্বেষ পুরুষের নিশ্বাসের মতো। প্রচুর মহৎ সাহিত্বের মহিমা তাঁরা হরণ করেন। এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ কেইট মিলেট। মিলেটের লৈঙ্গিক রাজনীতি (১৯৬৯) আধুনিক নারীবাদের সবচেয়ে সাড়াজাগানো বই, পিএইচডি অভিসন্দর্ভ, যাতে মিলন ঘটে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সমালোচনার; আর কাজ করে ধ্বংসাত্মক বোমার মতো। এটি শুধু সাহিত্য সমালোচনা নয়; এর রয়েছে তিনটি ভাগ : ‘লৈঙ্গিক রাজনীতি’, ‘ঐতিহাসিক পটভূমি’, এবং ‘সাহিত্যিক প্রতিফলন’। প্রথম ভাগে মিলেট দেখান নারীপুরুষের লৈঙ্গিক রাজনীতির স্বরূপ, দ্বিতীয় ভাগে লেখেন উনিশবিশশতকের নারীমুক্তি আন্দোলনের নিয়তির ইতিহাস, তৃতীয় ভাগে উদঘাটন করেন ডি এইচ লরেন্স, হেনরি মিলার, নরমান মেইলার, ও জাঁ জোনের লেখায় লৈঙ্গিক রাজনীতির রূপ। টোরিল মোই (১৯৮৫), যিনি অন্যায়ভাবেই কঠোর সমালোচনা করেছেন মিলেটের, তিনিও স্বীকার করেছেন, ‘এটি সৃষ্টি করে যে-অভিঘাত, তাতে এটি হয়ে ওঠে পরবর্তী ইঙ্গমার্কিন নারীবাদী সমালোচনামূলক সমস্ত গ্রন্থের জননী ও অগ্রদূত, এবং ১৯৭০ ও ১৯৮০র নারীবাদীরা কখনোই মিলেটের পথিকৃৎ প্রবন্ধটির কাছে ঋণ স্বীকার বা তার সাথে দ্বিমত পোষণ করতে অস্বীকার করেন নি।’ মিলেট বেরিয়ে আসেন সে-সময়ের মার্কিন নবসমালোচনার রীতি থেকে; নবসমালোচনা রীতির বিরোধিতা ক’রে তিনি যুক্তি দেন যে ঠিক মতো সাহিত্য বুঝতে হ’লে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিবেশকে। মিলেটের সমালোচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য অসম্ভব অভাবিত প্রতিভাদীপ্ত সাহস। ১৯৬৯-এ যখন ‘মহৎ’ লেখকদের কাছে বিনীত থাকাই ছিলো সাহিত্য সমালোচনার আদব, তখন লরেন্স, মিলার, মেইলার, জাঁ জোনের সাথে প্রচণ্ড বেয়াদবি করেন মিলেট। তাঁর আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন এ-আধুনিকেরা। মিলেট লেখককে বিধাতা হিশেবে মানেন নি; তিনি পাঠককে ক’রে তোলেন লেখকের প্রতিদ্বন্দ্বী, এবং প্রশ্ন করেন পংক্তিতে পংক্তিতে। মিলেট সমালোচক-পাঠক হিশেবে বিনীত বা ভদ্রমহিলাসুলভ নন; তিনি লেখকের মুখোমুখি দাঁড়ান উদ্ধত বালকের মতো, প্রতি মুহূর্তে বিরোধিতা করেন লেখকের আধিপত্যের। তিনি মূর্তিভগ্নকারী; তাঁর সমালোচনা পড়ার পর ওই আধুনিক প্রধানদের ভাবমূর্তি আর আগের মতো থাকে না; তাঁরা ধ’সে পড়েন। মিলেটের রীতির একটু নমুনা দিচ্ছি। মিলেট (১৯৬৯) লরেন্স সম্পর্কে আলোচনার শুরুতে লেডি চ্যাটার্লির প্রেমিক (১৯২৮) থেকে উদ্ধৃত করেন প্রচণ্ড লিঙ্গবাদী এ-অংশটুকু :

“তোমাকে আমি দেখতে চাই!”
সে [মেলর্স] তার শার্ট খুলে ফেললো এবং লেডি জেইনের [যোনির অপভাষা] দিকে তাকিয়ে স্থিরভাবে দাঁড়ালো। নিচু জানালা দিয়ে সূর্যরশ্মি ঢুকে তার উরু আর কৃশ উদরকে, এবং জ্বলজ্বলে স্বর্ণ-লাল কেশের ছোটো মেঘের ভেতর থেকে জেগে ওঠা কৃষ্ণাভ ও তপ্ত চেহারার দাঁড়ানো শিশুকে আলোকিত ক’রে তুললো।
“কী অদ্ভুত!” সে ধীরে ধীরে বললো। “কী অদ্ভুতভাবে সে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে! কী বিশাল! এবং কী কৃষ্ণাভ এবং সুনিশ্চিত! সে কি তার মতো?”
পুরুষটি তার পাতলা শাদা শরীরের সম্মুখভাগের নিচের দিকে তাকিয়ে হাসলো। ছোট্ট বুকের মাঝখানে কেশের রঙ কৃষ্ণাভ, প্রায় কৃষ্ণ। কিন্তু উদরের মূলদেশে, যেখান থেকে শিশ্নটি মোটা ও ধনুকাকৃতি খিলানের মতো উঠে এসেছে, সেখানকার কেশ সোনা-লাল, ছোটো মেঘের মতো জ্বলজ্বলে।
“কী গর্বিত!” সে গুনগুন করলো, অস্বস্তি। “এবং কী প্রভুসুলভ! এখন বুঝতে পারছি কেনো পুরুষেরা এতো কর্তৃত্বপরায়ণ। কিন্তু সে [শিশ্ন] সত্যিই সুন্দর। আরেকটি মানুষের মতো! একটু ভীতিকর! তবে সত্যিই সুন্দর! এবং সে আমার দিকে আসছে!–” সে ভয়ে ও উত্তেজনায় অধর কামড়ে ধরলো। পুরুষটি নীরবে নিচে তার শক্ত শিশ্নের দিকে তাকালো। ওটির কোনো বদল ঘটে নি।
“ভোদা, তুই যা চাচ তা অইল ভোদা। ক তুই লেডি জেইনরে চাচ। জন টমাস [শিশ্নের অপভাষা লেডি জেইনরে চায়!–
“আহা, তাকে ক্ষেপিয়ো না,” বিছানায় হাঁটু ভর ক’রে তার দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে এগোতে কোনি বললো। সে দু-হাতে তার কৃশ কটি ধ’রে তাকে নিজের দিকে টানলো যাতে তার ঝুলন্ত আন্দোলিত স্তনদুটি স্পর্শ করলো উত্তেজিত, উত্থিত শিশ্নের শীর্ষ, এবং তাতে লাগলো তরল পদার্থের ফোঁটা। সে পুরুষটিকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরলো।
“শোও!” সে বললো। “শোও। আমাকে হ’তে দাও!”
সে এখন খুবই তাড়ার মধ্যে।

মিলেট বলেন লেডি চাটার্লির প্রেমিক একটি আপাত-ধর্মীয় রচনা, যাতে এক আধুনিক নারীর আত্মার মুক্তি ঘটানো হয়েছে লেখকের নিজস্ব ধর্মমত ‘শিশ্নের রহস্যে’র সাহায্যে। এখানে আবির্ভাব ঘটেছে শিশুদেবতার। অলিভার মেলর্স হচ্ছে চূড়ান্ত লরেন্সীয় পুরুষ, মনুষ্যদেব, সে মারাত্মক যৌনপীড়নে সক্ষম, তবে এ-উপন্যাসে কোনো যৌনপীড়ন নেই। এতে কনস্ট্যান্স চাটার্লিকে দেয়া হয়েছে ঈশ্বরদর্শনের অনুমতি। এ-বইটি অলিভার মেলর্সের শিশ্নের পূজানুষ্ঠান; এতে পুরুষের মহিমাকে উন্নীত করা হয়েছে এক অতীন্দ্রিয় ধর্মে। এটা লৈঙ্গিক রাজনীতির সবচেয়ে কর্তৃত্বপরায়ণ রূপ। লৈঙ্গিক রাজনীতিকদের মধ্যে লরেন্স সবচেয়ে প্রতিভাবান ও একাগ্র; তিনি সবচেয়ে নিপুণও, কেননা তিনি লৈঙ্গিক বার্তা জ্ঞাপন করেন নারীর চেতনার মাধ্যমে। নারীটিই আমাদের জানায় যে সোনালি যৌনকেশের জ্যোতিশ্চক্রের ভেতর থেকে জেগে ওঠা দাঁড়ানো শিশুটি সত্যিই ‘গর্বিত’, আর ‘প্রভুসুলভ’, এবং সর্বোপরি, ‘সুন্দর’। সেটি ‘কৃষ্ণাভ এবং সুনিশ্চিত’, আর ‘ভীতিকর’ ও ‘অদ্ভুত’, যা নারীকে যেমন ‘ভীত’ করে তেমনি করে ‘উত্তেজিত’। শিশ্নের দাঁড়ানো নারীকে দীক্ষিত করে এ-ধর্মে যে পুরুষাধিপত্য শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত কোনি চমৎকার শিষ্যের মতো সাড়া দেয়, ‘এখন বুঝতে পারছি কেনো পুরুষেরা এতো কর্তৃত্বপরায়ণ।’ এ-বইয়ের সঙ্গমদৃশ্যগুলো লেখা হয়েছে ফ্রয়েডীয় বিধিমতে যে ‘নারী অক্রিয়, পুরুষ সক্রিয়।’ এতে শিশুই সব, কোনি হচ্ছে ‘ভোদা’, যে-বস্তুর ওপর ক্রিয়া করা হয়। এভাবে বিশ্লেষণ ক’রে মিলেট লরেন্সকে মহিমাহীন ক’রে তুলেছেন।

মিলেটের মতো তীব্রভাবে না হলে একই কাজ করেন মেরি এলমান থিকিং অ্যাবাউট উইমেন : নারীদের সম্পর্কে ভাবনাচিন্তায় (১৯৬৮)। তাঁর বইটি বেরোয় মিলেটের লৈঙ্গিক রাজনীতির এক বছর আগে, কিন্তু এটা, একান্তভাবেই সাহিত্যকেন্দ্রিক বই ব’লে, ততোটা সাড়া জাগায় নি। এলমান পিতৃতন্ত্রকে সামাজিক ও রাজনীতিকভাবে আক্রমণ করেন নি, তিনি আক্রমণ করেন সাহিত্যে রূপায়িত পুরুষতান্ত্রিক লিঙ্গবাদকে। মিলেটের লৈঙ্গিক রাজনীতি ও তাঁর নারীদের সম্পর্কে ভাবনাচিন্তায় জন্মে নারীবাদী সমালোচনার একটি ধারা, যা নারীভাবমূর্তি সমালোচনা নামে পরিচিত। পুরুষদের লেখায় নারীর ছক খোঁজেন এলমান, দেখান যে পুরুষ সমালোচকেরা নারীর লেখা বই আলোচনার সময়ও ব্যবহার করেন লৈঙ্গিক ধারণা। তাঁর মতে পশ্চিমি সংস্কৃতির বড়ো বৈশিষ্ট্য ‘লৈঙ্গিক সাদৃশ্যমূলক চিন্তা’, অর্থাৎ যে-কোনো চিন্তায়ই নারী বা পুরুষ ধারণাটি জেগে ওঠে, আর প্রধান হয়ে ওঠে পুরুষ ধারণাটি। পশ্চিম বা দু-গোলার্ধেরই সমস্ত চিন্তার মূলে আছে লিঙ্গভিন্নতার বোধ। সাহিত্য সমালোচনায়ও, তিনি দেখান, অত্যন্ত প্রবল লৈঙ্গিক চিন্তা; তিনি এর নাম দেন ‘ফ্যালিক ক্রিটিসিজম’ বা ‘শৈশিক সমালোচনা’। তাঁর মতে পুরুষ সমালোচকদের কাছে নারীর লেখা বইও নারী, সম্ভোগের সামগ্রী; ওই বই সমালোচনার নামে তাঁরা মাপামাপি করেন বইয়ের বক্ষ ও নিতম্ব। পুরুষ লেখক-সমালোচকদের লেখায় তিনি খুঁজে পান নারী ও নারীত্বের এগারোটি ছক; সেগুলো হচ্ছে নিরবয়বতা, অক্রিয়তা, অস্থিরতা, বন্দীত্ব, ধার্মিকতা, বস্তুজ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা, অযৌক্তিকতা, পরের ইচ্ছাপূরণে সম্মতি, দানবী ও মুখরা স্ত্রী।

নারীবাদী সমালোচনার এক উর্বর ধারা নারীভাবমূর্তিমূলক সমালোচনা। এ-ধারার অজস্র নিবন্ধ ও বই বেরিয়েছে। ১৯৭২-এ সুজান কোপেলম্যান কোরনিলনের সম্পাদনায় বেরোয় নারীভাবমূর্তিমূলক সমালোচনাসংগ্রহ ইমেজেজ অফ উইমেন ইন ফিকশন : ফেমিনিস্ট পারস্পেকটিভস্ :: কথাসাহিত্যে নারীভাবমূর্তি : নারীবাদী প্রেক্ষিত। এ-বইতে উনিশবিশশতকের বেশ কয়েকজন নারী ও পুরুষ ঔপন্যাসিকের আঁকা নারীর ভাবমূর্তি তুলে ধরে প্রচণ্ড সমালোচনা করা হয় ওই সব অবাস্তব নারীচরিত্রের। অবাস্তব নারী সৃষ্টির জন্যে শুধু পুরুষেরাই অভিযুক্ত হয় নি এ-প্রবন্ধগুচ্ছে, বরং দেখানো হয় যে এ-কাজে পুরুষদের থেকে অনেক নিকৃষ্ট নারী লেখকেরা। অবাস্তব নারী সৃষ্টি ক’রে নারী লেখকেরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন নিজেদের লিঙ্গের সাথে। এ ধরনের সমালোচনায় মিলিয়ে দেখা হয় লেখকের ও পাঠকের অভিজ্ঞতাকে; আর পাঠকের অভিজ্ঞতার সাথে যদি না মেলে লেখকের অভিজ্ঞতা, তাহলে অভিযোগ তোলা হয় লেখকের বিরুদ্ধে। নারীভাবমূর্তি সমালোচকেরা আত্মজীবনীকে ব্যবহার করেন সমালোচনার মানদণ্ডরূপে; তাঁরা মনে করেন কোনো সমালোচনাই মুক্ত নয় নিজের মূল্যবোধ থেকে। প্রতিটি মানুষ, এবং লেখকও, কথা বলেন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনীতিক, ও ব্যক্তিগত ব্যাপারে গ’ড়ে ওঠা বিশেষ অবস্থান থেকে। এ-পরিপ্রেক্ষিত সীমাবদ্ধ, একে সৰ্বজনীন ব’লে চালানো খুবই আধিপত্যমূলক কাজ। নারীভাবমূর্তি সমালোচনার কাজ সাহিত্যে রূপায়িত মিথ্যে নারীভাবমূর্তির স্বরূপ বের করা। ওই মিথ্যে ভাবমূর্তি যেমন পুরুষ লেখকেরা তৈরি করেছেন, তেমনি করেছেন নারী লেখকেরাও। এতে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতার ওপর; মনে করা হয় বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতা উপস্থাপনই সাহিত্যের লক্ষ্য। তাই এ-সমালোচনা আধুনিকতাবিরোধী, সব ধরনের আধুনিক রীতিকেই আক্রমণ করা এর স্বভাব। তাঁদের মানদণ্ডে সে-সাহিত্যের মূল্য কম, যা তাঁদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়; তাকেই তাঁরা বাতিল করেন যা তাঁদের অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়ে না।

লিঙ্গবাদ ও নারীভাবমূর্তি বের করার পর, ১৯৭৫ থেকে, নারীবাদী সমালোচনার বিষয় হন নারী লেখকেরা; নারীবাদী সমালোচনা হয়ে ওঠে নারীকেন্দ্রিক। নারীবাদীরা আবিষ্কার করেন যে নারী লেখকদের ছিলো নিজেদের এক ধরনের সাহিত্য, যে-সাহিত্যের ঐতিহাসিক ও বিষয়গত সামঞ্জস্য, আর শৈল্পিক গুরুত্ব স্বীকৃতি পায় নি পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের কাছে। তাঁরা বলেন নারীকল্পনাপ্রতিভার কথা। ১৯৭১-এ শোঅল্টার দাবি করেন নারী লেখকদের রয়েছে এক বিশেষ ইতিহাস, যা গুরুত্বের সাথে বিবেচনাযোগ্য। নারীরা আলোচনা করেন নারীরচিত সাহিত্য, এটা হয়ে ওঠে ইঙ্গমার্কিন নারীবাদী সমালোচনার প্রধান প্রবণতা। সত্তর দশকের শেষের দিকে বেরোয় এ-ধারার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই; যেমন এলেন মোয়ের্সের লিটেরেরি উইমেন : সাহিত্যিক নারী (১৯৭৬), ইলেইন শোঅল্টারের এ লিটেরেচার অফ দেয়ার অৌন : তাঁদের নিজেদের সাহিত্য (১৯৭৭), শিরিল এল ব্রাউন ও কারেন ওলসন সম্পাদিত ফেমিনিস্ট ক্রিটিসিজম : এসেইজ অন থিয়োরি, পোয়েট্রি অ্যান্ড প্রোউজ :: নারীবাদী সমালোচনা : তত্ত্ব, কবিতা ও গদ্য বিষয়ক প্রবন্ধ (১৯৭৮), এবং সান্ড্রা গিলবার্ট ও সুজান গুবারের দি ম্যাডওম্যান ইন দি অ্যাটিক : চিলেকোঠার পাগলী (১৯৭৯)। এ-বইগুলোতে শনাক্ত করা হয় সাহিত্যে নারী-ঐতিহ্যের পৃথক ধারা; দেখানো হয় নারীর লিঙ্গ নয়, সমাজই স্থির ক’রে দেয় নারীর বিশ্বদৃষ্টি ও সাহিত্যে তার উপস্থাপন। এলেন মোয়ের্স সাহিত্যিক নারীতে সবার আগে উদ্যোগ নেন নারীসাহিত্যের ইতিহাস লেখার। তাঁর মতে পুরুষ-ঐতিহ্যের তলে বা পাশাপাশি নারীসাহিত্য এক গতিশীল ও শক্তিমান অন্তঃস্রোত। বইটিতে কোনো তত্ত্ব প্রস্তাব না ক’রেই তিনি দেখান যে পুরুষের পাশাপাশি দেখা দিয়েছিলেন মহৎ নারী লেখকেরাও, কিন্তু তাঁরা মূল্য পান নি। ইলেইন শোঅল্টার তাঁদের নিজেদের সাহিত্য-এ বর্ণনা করেন ব্রোন্টিদের থেকে বর্তমান পর্যন্ত লেখা ইংরেজি উপন্যাসের ইতিহাস; দেখান এ-ধারার বিকাশের রীতি সাহিত্যিক উপসংস্কৃতি বিকাশের রীতির মতো। তিনি নির্দেশ করেন এ-ধারা বিকাশের তিনটি পর্ব। প্রথম পর্বটি হয় বেশ দীর্ঘ; এ-পর্বে অনুকরণ করা হয় আধিপত্যশীল ঐতিহ্যকে, এবং অন্তরীকরণ করা হয় শিল্পকলার মান ও সামাজিক ভূমিকা; দ্বিতীয় পর্বে দেখা দেয় এসব ধারণা ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, দাবি করা হয় স্বায়ত্তশাসন; সব শেষে দেখা দেয় আত্ম-আবিষ্কার-এর পর্ব। এ-পর্ব তিনটির নাম তিনি দেন ফেমিনিন, ফেমিনিস্ট এবং ফিমেল। তাঁর মতে ইংরেজি সাহিত্যে ফেমিনিন পর্ব শুরু হয় ১৮৪০-এর দশকে, যখন নারী লেখকেরা দেখা দেন পুরুষছদ্মনামে। এ-পর্ব সমাপ্ত হয় ১৮৮০ সালে জর্জ এলিঅটের মৃত্যুতে। ফেমিনিস্ট পর্বের কাল ১৮৮০ থেকে ১৯২০; এবং ফিমেল পর্ব ১৯২০-এ শুরু হয়ে এখনো চলছে। সাহিত্যের ইতিহাস ও নারীবাদী সমালোচনায় শোঅল্টারের বড়ো কৃতিত্ব বিস্মৃত ও উপেক্ষিত নারী লেখকদের পুনরাবিষ্কার।

সান্ড্রা এম গিলবার্ট ও সুজান গুবারের চিলেকোঠার পাগলী বিশাল বই। এতে আলোচিত হন জেইন অস্টিন, মেরি শেলি, ব্রোন্টি বোনেরা, জর্জ এলিঅট, এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং, ক্রিস্টিনা রসেটি, এবং এমিলি ডিকিনসন। তাঁরা তুলে ধরেন উনিশশতকের ‘সুস্পষ্টভাবে পৃথক নারীসাহিত্যধারার প্রকৃতি, এবং প্রস্তাব করেন নারীর সাহিত্য-সৃষ্টিশীলতা সম্পর্কে এক অভিনব তত্ত্ব। তাঁরা দেখান উনিশশতকে পিতৃতান্ত্রিক ভাবাদর্শ এমন বিশ্বাস সৃষ্টি করে যে শৈল্পিক সৃষ্টিশীলতা একান্ত পুরুষের গুণ। লেখক রচনার ‘জনক’, বিধাতার আদলে তিনি স্রষ্টা বা প্রণেতা বা গ্রন্থকার। সৃষ্টিশীলতার এ-শিশুতান্ত্রিক উপকথার মধ্যে নারী লেখকদের দাঁড়াতে হয় কঠিন অবস্থার মুখোমুখি। সৃষ্টিশীলতাকে পিতৃতন্ত্র যেহেতু গণ্য করে পুরুষালি কাজ বলে, তাই নারীভাবমূর্তিও তৈরি হয়েছে পুরুষের কল্পনায়। নারী অধিকার পায় নি নারী বা নারীত্ব সম্পর্কে ভাবমূর্তি সৃষ্টির, তাদের বাধ্য করা হয়েছে পুরুষের কল্পিত ভাবাদর্শের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে। গিলবার্ট ও গুবার বিশ্লেষণ করেন পিতৃতন্ত্রে নারীশিল্পীর অবস্থান। তাঁরা দেখান পিতৃতন্ত্রের তৈরি নারীধারণা নারী ও নারীশিল্পীর মধ্যে বাধা সৃষ্টি করে, নারী ও নারীশিল্পীর মধ্যে তৈরি করে জটিলতা। এর ফলে নারী লেখক হ’তে গিয়ে ভোগে তীব্র উদ্বেগে, কেননা তার অধিকার নেই লেখক হওয়ার। পিতৃতন্ত্রে লেখক অবধারিতভাবে পুরুষ, আর নারী পুরুষের দাসী; তাই নারী কীভাবে ধরবে কলম, হবে লেখক? নারী লেখকেরা এ-সংকট থেকে মুক্তির জন্যে নেন এক কৌশল : তাঁরা তাঁদের সাহিত্যের বাহ্যসংগঠন ও আন্তর তাৎপর্যের মধ্যে রাখেন দূরত্ব। বাইরে তাঁরা মেনে নেন পিতৃতন্ত্রের বিধান, কিন্তু ভেতরে গোপন ক’রে রাখেন ধ্বংসাত্মক তাৎপর্য, কাজ করেন পিতৃতান্ত্রিক বিধানের বিরুদ্ধে। এমিলি ডিকিনসন বলেছিলেন, ‘সত্য বলো, তবে তির্যকভাবে বলো’; তাঁরা নেন ওই তির্যক ভঙ্গি। তাঁদের মতে নারীর কণ্ঠস্বর ছলনাময়, তবে সত্য। তাঁরা যে-চিলেকোঠার পাগলীর কথা বলেছেন, সে কে? ওই পাগলীটি আর কেউ নয়, সে নারী লেখকের ‘ডবল’, নারী লেখকের উদ্বেগ ও ক্রোধের উন্মাদিনী রূপ। পিতৃতন্ত্রের চাপে উনিশশতকের নারী লেখকদের প্রায় প্রত্যেকে সৃষ্টি করেন একেকটি পাগলী, যে তাঁরই আরেক সত্তা। এ-পাগলী সৃষ্টি ছিলো তাঁদের এক সাহিত্যিক কৌশল, যা উনিশশতকের নারীদের লেখা উপন্যাসকে দিয়েছে বিপ্লবাত্মক প্রকৃতি।

নারীবাদীরা নারীসাহিত্যের ওপর যে-গুরুত্ব আরোপ করেন, তাতে দেশে দেশে পুনরাবিষ্কৃত হয় বিপুল পরিমাণে নারীসাহিত্য। সেগুলোকে নতুনভাবে পড়েন তাঁরা। তাঁরা পুনরাবিষ্কার করেন বহু বিস্মৃত নারী লেখককে, প্রকাশ করেন তাঁদের চিঠিপত্র ও দিনপঞ্জি, এবং দেখান যে নারীসাহিত্যের রয়েছে এক বিশেষ স্বভাব। নারীবাদী সমালোচনার প্রথম সুফল পান আঠারোউনিশশতকের নারী লেখকেরা, যাঁদের বই শিকার হয়েছিলো উপেক্ষা আর বিস্মৃতির। নারীবাদী প্রকাশনা থেকে ১৯৭২-এ পুনঃপ্রকাশিত হয় রেবেকা হার্ডিং ড্যাভিসের উপন্যাস লাইফ ইন দি আয়রন মিলস (১৮৬১), ১৯৭৩-এ পুনঃপ্রকাশিত হয় শার্লোট পার্কিন্স গিলম্যানের ছোটগল্প ‘দি ইয়েলো ওয়ালপেপার’ (১৮৯২), বেরোয় বিস্মৃত নারী লেখকদের নানা রচনাসংগ্রহ। এসব লেখায় পাওয়া যায় নীরব বিদ্রোহ, এমনকি আমূলবাদী মনোভাব; এবং নারীবাদীরা খুঁজতে শুরু করেন কেনো এসব লেখা বাদ পড়েছিলো ‘প্রধান রচনা’র পংক্তি থেকে? ১৯৭৮-এ বরোয় নিনা বায়ামের ওম্যানস ফিকশন : এ গাইড টু নোভেলস বাই অ্যান্ড অ্যাবাউট উইমেন ইন আমেরিকা, ১৮২০-১৮৭০। এতে দেখানো হয় যে উনিশশতকের অধিকাংশ জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকই ছিলেন নারী, তাঁরা ‘বেস্ট-সেলার’ লিখেছিলেন, কিন্তু বাদ প’ড়ে গেছেন সাহিত্যের প্রধান পংক্তি থেকে। বেস্ট-সেলার উৎকৃষ্ট সাহিত্য হয় না ঠিকই, কিন্তু নারীবাদীরা মনে করেন ওই নারী লেখকদের কেউ কেউ স্বীকৃতি পেতে পারতেন।

১৯৭০ থেকে নারীবাদীরা বিকাশ ঘটাতে থাকেন নারীর নন্দনতত্ত্ব ব’লে একটি ধারণার, তাঁরা বলতে থাকেন নারীর বিশেষ সাহিত্যচৈতন্য-এর কথা। অ্যাড্রিয়েন রিচ, মার্জে পিয়ের্সি, জুডি শিকাগো, সুজান গ্রিফিন, অ্যালিস ওয়াকার প্রমুখের রচনায় দেখা দেয় নারীর নন্দনতত্ত্বের ধারণা; তাঁরা দাবি করেন নারীসংস্কৃতি ব’লে এক বিশেষ সংস্কৃতি। তবে নারীর নন্দনতত্ত্বের ধারণা নিয়ে বিতর্ক বেধেছে; অনেকে একে নারীসমকামবাদী চৈতন্য, ও নারীসমকামবাদী স্বাতন্ত্র্যবাদের সাথে এক ক’রে দেখেন। অ্যাড্রিয়েন রিচ লিখেছেন :

প্রত্যেক নারীর মধ্যে রয়েছে একটি নারীসমকামী, সে অভিভূত হয় নারীশক্তি দিয়ে, সে আকর্ষণ বোধ করে শক্তিশালী নারীর প্রতি, সে খোঁজে এমন সাহিত্য যাতে প্রকাশ পায় ওই শক্তি ও জোর। আমাদের আন্তর নারীসমকামীটিই আমাদের চালায় কল্পনাদীপ্ত অনুভবের দিকে, আর ভাষায় প্রকাশ করে নারীর সাথে নারীর পূর্ণ সম্পর্ক। আমাদের আন্তর নারীসমকামীটিই শুধু সৃষ্টিশীল, কেননা পিতাদের দায়িত্বশীল কন্যারা ভাড়াটে লেখকমাত্ৰ।

অনেকে অবশ্য মেনে নিতে রাজি হন নি যে নারীসত্তা শুধু একটি বিশেষ সাহিত্যশৈলীর মধ্যেই প্রকাশ পায়, বা নারীর সৃষ্টিশীলতা প্রকাশ পায় নারীসমকামে। ১৯৮০ থেকে নারীসমকামবাদী নন্দনতত্ত্ব ভিন্ন হয়ে যায় নারীনন্দনতত্ত্ব থেকে।

নারীবাদী সমালোচকেরা নিজেরা পুনর্বিচার করে দেখতে চান সাহিত্যের সব কিছু, তাঁরা রাজি নন পুরুষের মূল্যায়ন বিনীতভাবে মেনে নিতে। তাঁদের বিরুদ্ধে পুরুষের অভিযোগ হচ্ছে তাঁরা ছুঁড়ে ফেলে দিতে চান হাজার বছরের পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। নারীবাদী সমালোচকদের একটি চাবিশব্দ ‘পুনঃ’ বা ‘আবার’। ‘ইতিহাস পুনর্লিখনের’ কথা বলেছেন ভার্জিনিয়া উল্ফ, অ্যাড্রিয়েন রিচ বলেছেন নারীর লেখা শুরু হ’তে হবে অতীতকে পুনরাবলোকন বা সংশোধন ক’রে, নারীত্ব পুনরাবিষ্কারের কথা বলেছেন ক্যারোলিন হিলবার্ন, জোন কেলি বলেছেন, ‘নারীদের পুনরুদ্ধার করতে হবে ইতিহাসে, এবং ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করতে হবে নারীর কাছে’। পুরুষ এতোদিন যেভাবে সাহিত্য পড়েছে, সেভাবে নয়, পড়তে হবে নারীর, নারীবাদীর চোখে; তখন ওই সাহিত্য ভ’রে ছড়ানো দেখা যাবে লিঙ্গের পীড়ন। ওই পীড়নে বিকৃতরূপে গ’ড়ে উঠেছে নারী সান্ড্রা গিলবার্ট ‘নারীবাদী সমালোচকেরা কী চান? অগ্নিগিরি থেকে পোস্টকার্ড’ (১৯৮০) প্রবন্ধে বলেন, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি পুরুষ লেখকদের ভাণ্ডার, পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া পুরুষ লেখকদের সম্পত্তি। ওই সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রায় নেই। তাঁর মতে, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির স্রষ্টা গম্ভীর পণ্ডিত, সংরক্ত কবি, আর চিন্তাক্লিষ্ট দার্শনিকেরা সবাই পুরুষ, মহাজগত তাঁদেরই উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত সম্পত্তি। তাঁর মতে পুরুষের সব শক্তি ছিলো, ছিলো বাকশক্তিও, কিন্তু নারীদের পালন করতে হয়েছে নীরবতা; পুরুষ তাদের দিয়েছে যে-ভাষা, তা হচ্ছে নীরবতা। যে-নারীরা নীরবতাব্রত পালনে রাজি হন নি, তাঁদের কী হয়েছে? তাঁরা হারিয়ে গেছেন অন্ধকারে, বা তাঁদের ভুল বোঝা আর অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। নারীদের রচনা হয়তো মহৎ সাহিত্য হয় নি, তা হয়তো খুবই বশমানা; তবে ওই লেখার ভেতরে রয়ে গেছে বিপজ্জনক বস্তু, যা অনেক সময় অগ্নিগিরির মতো, এবং গভীরভাবে রিভিশনারি- সংশোধনপন্থী।

অ্যানেট কোলোডনিও (১৯৮০) বলেন একই কথা; বলেন যে নারী সাহিত্য সৃষ্টি করতে গিয়ে দেখে তার কোনো ঐতিহ্য নেই। সাহিত্যের মহৎ ঐতিহ্য ব’লে যা গৃহীত, নারী লেখকেরা একাত্ম বোধ করতে পারেন নি তার সাথে, ওই ঐতিহ্যকে মনে করতে পারেন নি নিজেদের ব’লে। পুরুষ যেমন লিখতে ব’সেই মনে করে একটা মহৎ বস্তু সে উপহার দিচ্ছে মানবজাতিকে, নারী লেখকেরা তা মনে করতে পারেন নি; মহৎ কিছু বা শিল্পকলা সৃষ্টি করছেন, এমন ভাবাও সম্ভব হয় নি তাঁদের পক্ষে; তাঁরা, অধিকাংশ সময়, নিজেদের বিচ্ছিন্ন ক’রে রেখেছেন ‘লেখকদের’ থেকে। তাঁরা বারবার জানিয়েছেন পণ্ডিতদের জন্যে তাঁরা গল্প লিখছেন না, লিখছেন সাধারণদের জন্যে, যারা ‘সাহিত্য’ থেকে দূরবর্তী। নিনা বায়াম বলেছেন, সবাই আশা করতো যে নারী লেখকেরা লিখবেন নারীদের জন্যে, তাঁরা সাহিত্যের মহৎ ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত হবেন না। তাঁরাও কখনো নিজেদের মিল্টন বা স্পেন্সারের উত্তরসূরী ব’লে মনে করেন নি। ১৮৯৯-এ কেইট শপিনের দি অ্যাওকেনিং উপন্যাসটি প্রকাশের পর পাঠকেরা বেশ বিব্রত বোধ করে; উপন্যাসটিতে তিনি বিবাহবহির্ভূত যৌনতার যে-বিবরণ দেন, তা কোনো নারী ঔপন্যাসিকের কাছে পাঠক প্রত্যাশা করে নি। নারীর কাছে চাওয়া হয় ‘ভদ্র উপন্যাস’। বায়াম (১৯৮১) দেখান মার্কিন সাহিত্য পাঠ ও সমালোচনায় সক্রিয় যে-তত্ত্ব, তা নারী লেখকদের মহৎ সাহিত্যের পংক্তি, ক্যান্যন, থেকে বাদ দেয়। তিনি দেখান ১৭৭৪-১৭৯৯ কালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আটতিরিশটি উপন্যাস বেরোয়। এগুলোর নটির লেখকের নাম আজো অজানা, হয়তো সেগুলো লিখেছিলেন নারীরাই; বাকি ঊনতিরিশটি লেখেন আঠারোজন লেখক, যাঁদের চারজন নারী। তাঁদের একজন, সুজানা রোওসন, একাই লেখেন ছটি উপন্যাস। তাঁর উপন্যাস শার্লোট প্রথম প্রকাশের দশকে তিনবার, ১৮০০-১৮১০ সালের মধ্যে উনিশবার, উনিশশতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে আশিবার ছাপা হয়। হ্যাঁনা মুরের দি ককেট উনিশশতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে তিরিশবার ছাপা হয়। নারী ঔপন্যাসিক হ্যারিয়েট বিশার স্টোর আংকেল টম্‌স্‌ কেবিন মার্কিন সাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত উপন্যাস। উনিশশতকে আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি পঠিত ঔপন্যাসিক ছিলেন ই ডি ই এন সাউথওয়ার্থ, একজন নারী। এসব সত্ত্বেও তাঁরা মার্কিন সাহিত্যের ঐতিহাসিক ও সমালোচকদের কাছে মূল্য পান নি; তাঁরা বাইরে থাকেন সাহিত্যের মহৎ ধারার। কেনো এমন হয়েছে? এর এক কারণ, বায়ামের মতে, পক্ষপাত; সমালোচকেরা পছন্দ করেন না নারীদের লেখক হিশেবে দেখতে, তাঁরা বিশ্বাস করেন না যে নারীরা লেখক হ’তে পারে; তাই চোখের সামনের নারী লেখকদেরও দেখতে পান না তাঁরা। আরেকটি কারণ হয়তো নারী লেখকেরা মহৎ কিছু লিখে উঠতে পারেন নি। পারেন নি এটা অনেকখানি সত্য, তবে না পারার রয়েছে সামাজিক কারণ। এটা ভুলে গিয়ে পুরুষ সমালোচকেরা নারী লেখকদের উপেক্ষা করেন প্রধানত লৈঙ্গিক কারণে; তাঁরা সাহিত্যকে মনে করেন মূলত পুরুষের কাজ ব’লে।

লিলিআন রবিনসনও (১৯৮৩) আক্রমণ করেছেন সাহিত্য মূল্যায়নের প্রতিষ্ঠিত ক্যান্যন বা মানদণ্ড ও রুচিকে। তাঁর মতে প্রধান/অপ্রধান ব্যাপারগুলো ভদ্রলোকের চুক্তি। ওই ভদ্রলোকেরা সুবিধাভোগী শ্রেণী ও পুংলিঙ্গের অর্ন্তভুক্ত। সাহিত্যের যে-ক্যান্যন স্বীকৃত, তা সম্পূর্ণরূপে ভদ্রলোকদের সৃষ্টি; তাই তাদের রুচির বাইরের কোনো কিছুই মহৎ ব’লে গণ্য হয় না। পশ্চিমের মহৎ বইগুলো সবই পুরুষের লেখা, সেখানে কোনো নারীর বই নেই; কখনো তাতে অস্টিন, ব্রোন্টি বোনেরা, জর্জ এলিঅট, বা এমিলি ডিকিনসনের স্থান হয়, কিন্তু তাঁরাও থাকেন বেশ নিচে। এ-অবস্থা কাটানোর জন্যে লিলিআন রবিনসন নারীবাদী সমালোচনার দুটি দায়িত্ব নির্দেশ করেন : নতুনভাবে পড়তে হবে সমগ্র ঐতিহ্যকে, পুনর্ব্যাখ্যা করতে হবে নারীচরিত্রগুলো, শনাক্ত করতে হবে লিঙ্গবাদী ভাবাদর্শ, এবং দাঁড়াতে হবে তার মুখোমুখি। আর প্রয়াস চালাতে হবে নারী লেখকদের ক্যান্যনভুক্ত করার। মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্ট, কেইট মিলেট, ইভা ফিজেস, এলিজাবেথ জেনওয়ে, জারমেইন গ্রিয়ার, ক্যারোলিন হিব্রুন করেছেন তাই; তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন মহৎ বইগুলোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। মহৎ সাহিত্য পুনর্মূল্যায়ন করলে কি দেখা যাবে নারীর লেখা অনেক মহৎ সাহিত্য বাদ প’ড়ে গেছে সাহিত্যের মহৎ ঐতিহ্য থেকে? তাঁরা কি কোনো হ্যামলেট, যুদ্ধ ও শান্তি, বা গীতাঞ্জলি লিখেছেন, যা স্বীকৃতি পায় নি পুরুষের? নিনা বায়াম স্বীকার করেছেন অমন কোনো ঘটনা ঘটে নি। ১৮২০-১৮৭০ সালের মধ্যে লেখা মার্কিন নারী ঔপন্যাসিকদের উপন্যাস সম্পর্কে তিনি বলেছেন ওগুলোতে নান্দনিক, মননগত, নৈতিক জটিলতা ও শিল্পিতার অভাব রয়েছে, যা আমরা প্রত্যাশা করি মহৎ সাহিত্যের কাছে। ওই সময়ের নারী ঔপন্যাসিকদের রচনা নানাভাবে আকর্ষণীয়, কিন্তু কোনো বিস্মৃত জেন অস্টিন বা জর্জ এলিঅট আবিষ্কার করা যায় না তাঁদের মধ্যে, বা এমন কোনো উপন্যাস খুঁজে পাওয়া যায় না, যা দি স্কারলেট লেটার-এর মানের। তবু তিনি মনে করেন সাহিত্য মূল্যায়নের যে-মানদণ্ড আমেরিকায় ব্যবহৃত হয়, তা পুরুষের কাজের প্রতি পক্ষপাতপূর্ণ। ওই মানদণ্ডে শেলাইয়ের থেকে তিমি শিকার অনেক বেশি মহৎ কাজ ব’লে গণ্য হয়, তাই নারী বাদ পড়ে। এক নতুন ধরনের উপন্যাস দেখা দিয়েছে সম্প্রতি, যেগুলোকে বলা হয় নারীবাদী উপন্যাস। ব্যবসায়িকভাবে এগুলো অত্যন্ত সফল। এ-ধরনের উপন্যাস নারীবাদী প্রকাশনাসংস্থা, এমনকি ব্যবসায়িক প্রকাশনাসংস্থা থেকেও বেরোচ্ছে। তবে এগুলোর সবই কি নারীবাদী উপন্যাস? এগুলো কি উপকারে আসছে নারীবাদী আন্দোলনের, নাকি শুধুই প্রথাগত বিনোদন সামগ্রীর কাজ করছে এগুলো? ঔপন্যাসিক নারী হ’লেই নারীবাদী হন, তিনি যা লেখেন তাই কি হয় নারীবাদী উপন্যাস? কিছু উপন্যাস নারীকেন্দ্রিক, তবে নারীকেন্দ্রিক উপন্যাসমাত্রই নারীবাদী উপন্যাস নয়। নারীকেন্দ্রিক উপন্যাস নতুন ব্যাপার নয়; অনেক আগে থেকেই নারীরা নারীদের জন্যে নারীকেন্দ্রিক উপন্যাস লিখে আসছেন, যেমন ঘটেছে রোম্যান্টিক উপন্যাসে। ওই সব উপন্যাসের চেতনা, সেগুলোতে চিত্রিত লিঙ্গ, জাতি, ও শ্রেণী-আনুগত্যের ব্যাপারগুলো নারীবাদবিরোধী। তাই নারীকেন্দ্রিক উপন্যাসমাত্রই নারীবাদী উপন্যাস নয়, তা চরিত্রগতভাবে ভিন্ন।

ইলেইন শোঅল্টার (১৯৭৯) দুটি রীতিতে ভাগ করেছেন নারীবাদী সমালোচনাকে। প্রথম রীতিতে নারীবাদী সমালোচক হচ্ছেন পাঠক হিশেবে নারী; তিনি পুরুষ লেখকদের সাহিত্য প’ড়ে তার লৈঙ্গিক ইঙ্গিতগুলো খুঁজে বের করেন। শোঅল্টার এ-রীতির সমালোচনাকে বলেন নারীবাদী সমালোচনা। এ-রীতিতে বিচার করা হয় ভাবাদর্শগুলো, বের করা হয় নারীভাবমূর্তি ও নারীছক, খোঁজা হয় কোথায় প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে নারী লেখককে, আর রটনা করা হয়েছে নারী সম্পর্কে কুৎসা। দ্বিতীয় রীতির সমালোচনার বিষয় লেখক হিশেবে নারী; এতে বিচার করা হয় নারীসাহিত্য, নারীসাহিত্যের ইতিহাস, বিষয়, শ্রেণী, ও সংগঠন। এতে আলোচিত হয় নারীর সৃষ্টিশীলতার প্রকৃতি, ভাষাবিজ্ঞান, নারীর ভাষার সমস্যা, ও বিশেষ বিশেষ নারী লেখক। শোঅল্টার এ-রীতির সমালোচনাকে বলেছেন গাইনোক্রিটিক বা গাইনোক্রিটিসিজম। তাঁর মতে নারীবাদী সমালোচনা রাজনীতিক ও বিতর্কমূলক, যা বহু কিছু নিয়েছে মার্ক্সীয় সমাজবিজ্ঞান ও নন্দনতত্ত্ব থেকে; আর তাঁর প্রস্তাবিত গাইনোক্রিটিক স্বয়ংসম্পূর্ণ ও নিরীক্ষাধর্মী। শোঅল্টারকথিত নারীবাদী সমালোচনা অনেকটা আদি টেস্টামেন্টের মতো, যার কাজ ‘অতীতের পাপ ও ভুলভ্রান্তি খোঁজা’, আর গাইনোক্রিটিক অনেকটা নতুন টেস্টামেন্টের মতো, যার কাজ ‘কল্পনাপ্রতিভার শোভা’ খোঁজা। প্রথম রীতিটি ন্যায়পরায়ণ, রাগী, ও ভর্ৎসনাপূর্ণ; দ্বিতীয় রীতিটি নিরাসক্ত। দুটি রীতিই দরকারী; কেননা আদর্শের জেরিমাইঅ্যারাই শুধু ‘দাসত্বের মিশর থেকে নারীদের মুক্তি দিয়ে পৌঁছে দিতে পারেন মানবতাবাদের প্রতিশ্রুত ভূখণ্ডে।

নারীবাদীরা কতোখানি আগ্রহী সাহিত্য ও সমালোচনাতত্ত্বে? তত্ত্ব জিনিশটি পুরুষের সম্পত্তি; সব তত্ত্বের তারাই স্রষ্টা, নারীর তাতে কোনো অংশ নেই, যদিও নারী ধারাবাহিকভাবে হয়েছে তত্ত্বের শিকার। এখন নারীবাদীরা মনে করেন সেখানে তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়েও নারীবাদী সমালোচনার কোনো তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিলো না; ১৯৭৫-এ শোঅল্টার বলেছিলেন কোনো তত্ত্বই নারীবাদী ভাবাদর্শ ও পদ্ধতি ধারণের জন্যে যথেষ্ট নয়। কোলোড্‌নি বলেন, নারীবাদী সমালোচনা দেখা দিয়েছে ‘কোনো সমঞ্জস ধারা বা সমন্বিত লক্ষ্যের বদলে একরাশ পরস্পরবদলসম্ভব কৌশল হিশেবে।’ এর পরও সমন্বিত তত্ত্ব গ’ড়ে ওঠে নি। কৃষ্ণনারীবাদীরা অভিযোগ করেন যে নারীবাদী সমালোচনা কৃষ্ণ ও তৃতীয় বিশ্বের নারী লেখকদের সম্পর্কে পালন করে ‘প্রকাণ্ড নীরবতা’; তাঁরা চান কৃষ্ণনারীবাদী সমালোচনা, যা বিবেচনার মধ্যে নেবে জাতিক ও লৈঙ্গিক উভয় ব্যাপার; মার্ক্সীয় নারীবাদীরা গুরুত্ব দেন শ্রেণী ও লিঙ্গ দুয়েরই ওপর; নারীবাদী সাহিত্য-ঐতিহাসিকেরা পুনরুদ্ধার করতে চান এক লুপ্ত ঐতিহ্য; বিসংগঠনবাদীরা চান এমন সমালোচনা, যা একই সঙ্গে পাঠগত ও নারীবাদী। প্রথম দিকে অনেক নারীবাদীই কোনো তাত্ত্বিক কাঠামো তৈরি করতে চান নি নারীবাদী সমালোচনার; তাঁরা মনে করেছিলেন তত্ত্ব নারীবাদের মতো গতিশীল ব্যাপারকে সীমাবদ্ধ ক’রে ফেলবে। তাঁরা চেয়েছিলেন নারীবাদী সমালোচনাকে খোলা রাখতে। সত্তরের দশকে সাংগঠনিক, উত্তরসাংগঠনিক, বিসাংগঠনিক ইত্যাদি যে-সমস্ত বিতর্ক দেখা দেয়, নারীবাদীদের কাছে সেগুলোকে মনে হয় উষর ও ছদ্মবস্তুনিষ্ঠ। ওই সমস্ত ক্ষতিকর পুরুষতান্ত্রিক রচনার কবল থেকে তাঁরা মুক্ত থাকতে চান। ভার্জিনিয়া উফ্ থেকে শুরু ক’রে মেরি ড্যালি, অ্যাড্রিয়েন রিচ, মার্গারেট ডুরাস, ও আরো অনেকে উপহাস করেন ‘পুংপাণ্ডিত্যের নপুংসক আত্মপ্রেম’কে, এবং মুক্ত থাকতে চান পিতৃতান্ত্রিক পদ্ধতিপুজো থেকে। তবে নারীবাদীরা আজ আর তত্ত্ববিমুখ নন। স্যান্ড্রা গিলবার্ট (১৯৮০) বলেন, ‘যে-সব ছদ্মপ্রশ্ন ও উত্তর, পাঠ ও যৌনতা, আঙ্গিক ও লিঙ্গ, মনোলৈঙ্গিক সত্তা ও সাংস্কৃতিক সত্তার সম্পর্ককে ছায়াবৃত ক’রে রেখেছে’ নারীবাদী সমালোচনা ‘সে-সবের পাঠোদ্ধার ও রহস্য উন্মোচন’ করতে চায়। সংশোধনপন্থী নারীবাদী সমালোচনা অনেকটা গ’ড়ে উঠেছে চলতি সমালোচনা কাঠামো ভিত্তি ক’রেই। তবু নারীবাদীরা লেগে আছেন পুরুষের সমালোচনা রীতি সংশোধন ও তাকে মানবিক ক’রে তুলতে, এবং তাকে নিরন্তর আক্রমণ ক’রে চলছেন। পুরুষের সমালোচনাতত্ত্ব হচ্ছে সৃষ্টিশীলতা, সাহিত্যের ইতিহাস বা সাহিত্য ব্যাখ্যার সে-তত্ত্ব, যার ভিত্তি পুরুষের অভিজ্ঞতা, তবে তা পেশ করা হয় সর্বজনীন ব’লে। শোঅল্টারের (১৯৮১) মতে নারীবাদীরা যতোদিন পুরুষকেন্দ্রিক সমালোচনাকাঠামো ভিত্তি হিশেবে ব্যবহার করবে, এমনকি তা সংশোধন ক’রে যোগ করবে কিছুটা নতুনত্ব, ততোদিন নারীরা নতুন কিছুই শিখবে না। তাঁর মতে পুরুষের ধারণা দিয়ে চলবে না নারীদের; লাকঁ, দেরিদায় নারীর চলবে না; কেননা এতে নারী মেনে চলে পুরুষ প্রভুদেরই। তিনি চান একটি একান্ত নারীবাদী সমালোচনারীতি, যা হবে নারীকেন্দ্রিক, স্বাধীন, ও মননগতভাবে সুসমঞ্জস। তাঁর মতে নারীবাদী সমালোচনাকে ‘বের করতে হবে নিজ বিষয়, নিজ পদ্ধতি, নিজ তত্ত্ব, এবং নিজ কণ্ঠস্বর।’

এলেন সিজো বলেছেন, ‘আরো দেহ, তাই আরো লেখা।’ নারীবাদীদের কেউ কেউ জৈব বা দেহবাদী সমালোচনারও প্রস্তাব করেছেন। এতে দেহই হয়ে ওঠে রচনা বা বই। দেহকে সমালোচনার মানদণ্ড করা বিপজ্জনক, কেননা সব জাতিই বিশ্বাস করে যে নারী দৈহিকভাবে দুর্বল, তার মস্তিষ্কও দুর্বল। জৈব নারীবাদী সমালোচকেরা অবশ্য দৈহিক হীনতা স্বীকার করেন না, কিন্তু মনে করেন নারীর শরীর তার লেখাকেও স্বতন্ত্র ক’রে তোলে। পিতৃতন্ত্রের বিশ্বাস হচ্ছে লেখক জনক, যার কলম অনেকটা শিশ্নের মতোই জন্মদানের হাতিয়ার। গিলবার্ট ও গুবার প্রশ্ন করেছেন, ‘যদি কলম হয়ে ওঠে একটি রূপক-শিশ্ন, তাহলে কোন অঙ্গ থেকে নারী উৎপাদন করবে পাঠ বা রচনা?’ উত্তরে শোঅল্টার (১৯৮১, ২৫০) বলেছেন, নারী পাঠ বা রচনা জন্ম দেয় মস্তিষ্ক থেকে, বা ওয়ার্ড-প্রসেসর থেকে, যা একটি রূপক-জরায়ু। সাহিত্যিক পিতৃত্বের রূপক নারীদের পীড়ন করছে আবহমান কাল ধ’রে; তবে আঠারোউনিশশতকে সাহিত্যিক মাতৃত্বের রূপকও বেশ বড়ো হয়ে উঠেছিলো, যাতে সাহিত্যসৃষ্টি হয়ে ওঠে গর্ভধারণ ও প্রসবের মতো ব্যাপার। বিশেষ ক’রে ফ্রান্সে ও আমেরিকায় কোনো কোনো আমূল নারীবাদী মনে করেন এসব রূপককে নিতে হবে গুরুত্বের সাথে, নারীপুরুষের জৈব পার্থক্যকে দেখতে হবে নতুনভাবে, এবং খুঁজতে হবে দেহের সাথে লেখার সম্পর্ক। তাঁরা মনে করেন নারীর লেখা বেরোয় দেহ থেকে, তাদের দৈহিক পার্থক্য তাদের লেখার উৎসও। অ্যাড্রিয়েন রিচ বলেন:

আমরা এখনো যতোটা বুঝতে পেরেছি, নারীদেহের রয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি আমূল তাৎপর্য। পিতৃতান্ত্রিক চিন্তা তার সংকীর্ণ নির্দেশ অনুসারে নারীদেহকে সীমাবদ্ধ ক’রে ফেলেছে। এ-কারণে নারীবাদী দৃষ্টি স’রে এসেছে নারীর জৈবসংগঠন থেকে; আমি বিশ্বাস করি তা একদিন আমাদের দেহকে নিয়তি মনে না ক’রে সম্পদ ব’লেই গণ্য করবে। পরিপূর্ণ মানবিক জীবন যাপনের জন্যে আমাদের দেহকে নিয়ন্ত্রণ করাই শুধু আমাদের জন্যে জরুরি নয়, আমাদের স্পর্শ করতে হবে আমাদের দেহের ঐক্য ও অনুনাদকে, যা আমাদের মননের দৈহিক ভিত্তি।

নারীবাদী জৈব সমালোচনায় খোঁজা হয় কীভাবে দেহ ব্যবহৃত হয় চিত্রকল্পের উৎসরূপে; আর নারীবাদী জৈব সমালোচনা, যা উৎসারিত করা হয় সমালোচকের দেহ থেকে, হয়ে থাকে অন্তরঙ্গ, স্বীকারোক্তিমূলক, ও আঙ্গিকগতভাবে অভিনব। তবে নারীসত্তার খোঁজে বেরিয়ে দেহকেই তার কেন্দ্র ব’লে গণ্য করা ভয়ঙ্কর কাজ, কেননা দেহকেই পুরুষতন্ত্র ব্যবহার করেছে নারীশোষণের প্রধান যুক্তিরূপে। নারীর দেহেই খুঁজতে হবে নারীর সৃষ্টিশীলতা? এর চমৎকার উত্তর দিয়েছেন ন্যান্সি মিলার; তিনি বলেছেন নারীর সাহিত্যিক স্বাতন্ত্র্য খুঁজতে হবে ‘তার দেহের লেখায় নয়, বরং তার লেখার দেহে’।

বোনি জিমারম্যান (১৯৮১) ‘যা কখনো ছিলো না’ নামক একটি তীব্র প্রবন্ধে তুলে ধরেন এমন এক বিষয়, যা পিতৃতন্ত্রের বিধানে নিষিদ্ধ, আর নারীবাদীরাও চান চেপে রাখতে। তিনি আলোচনা করেন নারীসমকামবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনারীতি। নারীসমকামবাদকে উপেক্ষার বিরুদ্ধে তিনি জানান প্রবল প্রতিবাদ। নারীসমকাম নিষিদ্ধ ব্যাপার, তা যে ছিলো আর আছে, তা-ই কেউ স্বীকার করতে চায় নি ও চায় না; কিন্তু সত্য হচ্ছে তা ছিলো, এবং আছে। নারীসমকামবাদী সাহিত্যতত্ত্ব প্রস্তাবের সূচনায়ই প্রশ্ন ওঠে যে নারীর যৌন ও প্রীতির সম্পর্ক কতোখানি প্রভাব ফেলে তার লেখা, পড়া, ও চিন্তার ওপর? নারীসমকামবাদী নন্দনতত্ত্ব কি পৃথক হবে নারীবাদী নন্দনতত্ত্ব থেকে? কী হবে নারীসমকামবাদী সমালোচকের কাজ? সম্ভব কি কোনো নারীসমকামবাদী মানদণ্ড বা বিধান প্রতিষ্ঠা করা? নারীসমকামবাদীরা কি বিকাশ ঘটাতে পারেন এমন কোনো অন্তর্দৃষ্টির, যা ঋদ্ধ করবে সমগ্র সমালোচনাশাস্ত্রকে? নারীসমকামবাদী সমালোচনার কিছু বিষয় সম্পর্কে প্রায় সব নারীসমকামবাদীই একমত। তাঁরা মনে করেন এমন নয় যে নারীসত্তা স্থির করতে হবে শুধু পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কিত ক’রেই, নারীসাহিত্যকেও যে পুরুষসাহিত্যের সাথে সম্পর্কিত ক’রে দেখতে হবে, তাও নয়; তাঁদের মতে নারীর সাথে নারীর তীব্র সম্পর্কও নারীর জীবনের বড়ো ব্যাপার, এবং নারীর যৌন ও আবেগগত প্রবণতা গভীরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তার চেতনা ও সৃষ্টিশীলতাকে। পিতৃতন্ত্র স্বীকার করে শুধু বিষমকামকে; নারীসমকামবাদীদের মতে বিষমকামই একমাত্র স্বাভাবিক যৌন ও আবেগগত সম্পর্ক নয়। বিষমকামকেই শুধু স্বাভাবিক ভাবা পিতৃতন্ত্রের শিক্ষামাত্র। জিমারম্যান দেখান যে নারীবাদীরাও দীক্ষিত পিতৃতন্ত্রের বিষমকামবাদে; তাই নারীবাদী সংগ্রহ থেকে বাদ পড়েন নারীসমকামী রেনি ভিভিয়েন ও র‍্যাডক্লিফ হল, বা সংকলিত হয় ক্যাথেরিন ফিলিপ্‌স্‌, ও অ্যাড্রিয়েন রিচের বিষমকামী বা নিষ্কাম রচনা, যদিও তাঁরা বিখ্যাত নারীসমকামী লেখার জন্যে। জিমারম্যান (১৯৮১) বলেন :

যখন পরিকল্পিতভাবে বিন্যস্ত কোনো সংগ্রহে থাকে স্ত্রী, মাতা, যৌনসামগ্রী, তরুণী, বৃদ্ধা, এবং মুক্ত নারী প্রভৃতি বিভাগ, কিন্তু থাকে না নারীসমকামী- তখন তা বিষমকামবাদ। নারীবাদী সংগ্রহে বিষমকামবাদ- পুংকেন্দ্রিক সংগ্রহে লিঙ্গবাদের মতো– মুছে ফেলে নারীসমকামবাদী অস্তিত্ব এবং লালন করে এ-মিথ্যেটি যে নারী শুধু পুরুষের মধ্যেই খোঁজে কাম ও আবেগের তৃপ্তি, বা একেবারেই খোঁজে না।

নারীসমকামবাদীরা অভিযোগ করেন নারীবাদী পত্রিকা- ফেমিনিস্ট স্টাডিজ, উইমেন্স স্টাডিজ, উইমেন অ্যান্ড লিটেরেচার প্রভৃতিতে যে নারীসমকামবাদী রচনা বেরোয় না, তার মূলে রয়েছে বিষমকামবাদ, বা পরিকল্পিত উদ্দেশ্য। অধিকাংশ নারীসমকামবাদী লেখা প্রথম বেরোয় বিকল্প, অপ্রাতিষ্ঠানিক নারীসমকামবাদী পত্রিকা সিনিস্টার উইজডম, কোন্ডিশন্স প্রভৃতিতে। বিষমকামবাদের প্রতাপ দেখা যায় নারীবাদী সমালোচনার গুরুত্বপূর্ণ সব সংগ্রহে; যেমন দি অথোরিটি অফ এক্সপেরিএন্স বা শেক্সপিয়রস সিস্টারস-এ নেই কোনো নারীসমকামবাদী প্রবন্ধ। নারীবাদী সমালোচকেরা চেপে গেছেন নারীসমকামবাদকে; তাই নারীসমকামবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার ভিত্তি স্থাপন করতে এগিয়ে আসেন নারীসমকামবাদীরাই। ১৯৫৬তে বেরোয় জেনেট ফস্টারের সেক্স ভ্যারিয়েন্ট উইমেন ইন লিটেরেচার, ১৯৬৭তে জেন ড্যামন (ছদ্মনাম), জ্যান ওয়াটসন, ও রবিন জর্ডানের দি লেসবিয়ান ইন লিটেরেচার : এ বিবলিওগ্রাফি।

নারীসমকামবাদী সমালোচনার মূলে, নারীবাদী সমালোচনার মতোই, রয়েছে রাজনীতিক ভাবাদর্শ। তাঁদের মতে নারীসমকাম এক সুস্থ জীবনপদ্ধতি, নারীরা যা যাপন করেছে ও করছে সব দেশে ও কালে। তাই তাঁরা দূর করতে চান এর ওপর চাপানো নিষেধ। এতে সফল হওয়ার এক উপায় নারীদের পুরুষের মূল্যবোধ থেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নিয়ে একান্তভাবে নারীসমাজভুক্ত করা। এক ধরনের নারীস্থান গ’ড়ে তোলা। র‍্যাডিক্যলেসবিয়ান বা আমূলনারীসমকামবাদীরা মনে করেন যে নারীর কাছে নারীই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, নারীরা মিলে গ’ড়ে তুলবে এক নতুন চৈতন্য, তারা নিজেদের কেন্দ্র খুঁজবে নিজেদের ভেতরে। তাঁদের মতে বিষমকামবাদ এক রাজনীতিক সংস্থা, তা ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার নয়। নারীসমকামবাদীরা বিকাশ ঘটাতে চান একান্ত নারীসমকামী নারীবাদী প্রেক্ষিত; তাই তাঁদের প্রশ্ন : কখন কোনো রচনা হয়ে ওঠে, বা তার লেখক হন নারীসমকামবাদী? এটা নির্ভর করে নারীসমকামী বলতে কী বোঝায়, তার ওপর। নারীসমকামী বলতে কি বোঝাবে শুধু সে-নারীদেরই অন্য নারীর সাথে যাঁদের যৌন অভিজ্ঞতার প্রমাণ রয়েছে? এটা অসম্ভব কাজ। অনেকেই তো তার কোনো প্রমাণ রেখে যান নি। তাছাড়া এতে নারীসমকাম হয়ে ওঠে শুধুই যৌন ব্যাপার। অ্যাড্রিয়েন রিচের মতে নারীসমকামবাদ শুধু অন্য নারীর সাথে যৌনসংসর্গ নয়, তা নারীর সংসর্গে নারীর অভিজ্ঞতা, নারীর সাথে নারীর আন্তর জীবনের ঐক্য, রাজনীতিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নারীদের ঐক্য। তবে নারীদের সব ধরনের সম্পর্ককেই যদি নারীসমকামী সম্পর্ক বলা হয়, তাতে অসুবিধা দেখা দেয়; নারীদের মধ্যে নারীসমকামী ও অসমকামী সম্পর্কের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। অনেকে নারীসমকামবাদের রাজনীতিক সংজ্ঞাও দিয়েছেন; বলেছেন নারীসমকাম হচ্ছে শক্তি, স্বাধীনতা, ও পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। লিলিআন ফ্যাডারম্যান সারপাসিং দি লাভ অফ ম্যান : রোম্যান্টিক ফ্রেন্ডশিপ অ্যান্ড লাভ বিটুইন উইমেন ফ্রম দি রেনেসাঁস টু দি প্রিসেন্ট (১৯৮১) বইতে দিয়েছেন নারীসমকামবাদের মাঝপথি সংজ্ঞা :

‘নারীসমকামী’ বলতে বোঝায় সে-সম্পর্ক, যাতে দুটি নারীর তীব্রতম আবেগ ও প্রীতি ধাবিত হয় পরস্পরের দিকে। এ-সম্পর্কে থাকতে পারে কম বা বেশি যৌন সংসর্গ, এমনকি একেবারে নাও থাকতে পারে। এতে দুটি নারী পছন্দ করে তাদের অধিকাংশ সময় একসাথে কাটাতে এবং জীবনের অধিকাংশ ব্যাপার তারা যাপন করে পরস্পরের সাথে।

নারীসমকামবাদী সমালোচকের একটি দায়িত্ব নারীসমকামবাদের ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করা, যাতে তা হয়ে উঠতে পারে শ্রদ্ধেয়। জেন রুল লেসবিয়ান ইমেজেজ : নারীসমকামবাদী ভাবমূর্তিতে (১৯৭৩) প্রথম নারীসমকামবাদের ঐতিহ্য আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। এটি নারীসমকামবাদী সমালোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বই। এর পর ডোলোরেস ক্লাইস ওম্যান প্লাস ওম্যান : নারী যোগ নারী (১৯৭৪), লুইসে বারনিকোও দি ওয়ার্ল্ড ট্ িওপেন : ফালি ক’রে খোলা পৃথিবী (১৯৭৪) বইতে প্রতিষ্ঠা করেন নারীসমকামবাদের এক মহৎ ঐতিহ্য। তাঁরা স্যাফো থেকে শুরু ক’রে তাঁদের ধারায় পান মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্‌ট্, এমিলি ডিকিন্‌সন, ভার্জিনিয়া উল্ফ, ভিটা স্যাকভিল- ওয়েস্ট, এথেল স্মাইথি, জারট্রুড স্টেইন, র‍্যাডক্লিফ হল, নাটালি বার্নি, কোলেৎ, রেনি ভিভিয়েন, রোমেইন ব্রু, ও আরো অনেককে। নারীসমকামবাদী সমালোচনার এক বৈশিষ্ট্য ঐতিহ্য আবিষ্কার হলেও এই এর একমাত্র লক্ষ্য নয়; নারীসমকামবাদীরা খুঁজেছেন উপন্যাসে নারীসমকামীর ভাবমূর্তি, ছক প্রভৃতি। বার্থা হ্যারিস দেখিয়েছেন উপন্যাসে নারীসমকামী চিত্রিত হয় দানবীরূপে, যে ভেঙেচুরে ফেলে নারীর আনুগত্য, অক্রিয়তা, সতীত্বের প্রথাগত ধারণা। তাঁরা রচনাশৈলী ও সাহিত্যতত্ত্ব বিষেয়েও কিছু কাজ করেছেন। নারীসমকামবাদীদের কাছে ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা শতাব্দী পরম্পরায় তাদের মুখ খুলতে দেয়া হয় নি, তাদের ভাষা কেড়ে নেয়া হয়েছিলো। এক সময় তাঁরা সাংকেতিক ভাষায় কথা বলেছেন, এখন চালাচ্ছেন নানা নিরীক্ষা। তাঁদের ব্যাকরণ অপ্রথাগত, কথা বলেন তাঁরা ঘটমান বর্তমান কালে, নিয়মিতভাবে তৈরি করেন নতুন শব্দ।

নারীবাদ, এবং নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার এক গুরুত্বপূর্ণ ধারার বিকাশ ঘটে ফরাশিদেশে। একে বলা হয় ফরাশি নারীবাদ। ফরাশি ও বিশ্বনারীবাদের মহত্তম তাত্ত্বিক সিমোন দ্য বোভোয়ার। তাঁর কাছে, অন্যদের মতো, ফরাশি নবনারীবাদীরা ঋণী, ও ঋণস্বীকারে অকুণ্ঠ। তিনি নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনারও সূত্রপাত করেছিলেন দ্বিতীয় লিঙ্গ-এ, লিঙ্গবাদের রূপ দেখিয়েছিলেন পাঁচজন– মঁথেরাঁ, ডি এইচ লরেন্স, ক্লদেল, ব্রেতোঁ, স্তাঁদাল– লেখকের উপন্যাস ও কবিতায়। তবে ১৯৬৮র ছাত্রবিদ্রোহ থেকে উদ্ভূত ফরাশি নবনারীবাদীরা সাহিত্য সমালোচনায় তাঁকে অনুসরণ করেন নি। ১৯৭০ থেকে ফরাশি নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্বের উৎস হয় দেরিদীয় বিসংগঠন ও লাকর ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞানের সাংগঠনিক ভাষ্য। তাঁরা পুরুষ প্রভুদের ধারণা নিয়েই করেন নারীবাদী কাজ। ১৯৭৪-এর মধ্যে ফরাশি নারীবাদীরা তাঁদের ভয়াবহ মননশীল নারীবাদীতত্ত্বের অনেকটা রচনা ক’রে ফেলেন; কিন্তু অতিমননশীলতাভারাক্রান্ত ওই তত্ত্ব বাইরে গৃহীত হ’তে সময় নেয়। মার্ক্স, নিটশে, হাইডেগার, দেরিদা, লাকঁর চিন্তায় তাঁদের তত্ত্ব পরিপূর্ণ, যা অফরাশি পাঠকের কাছে বিপন্নকরভাবে দুরূহ। এলেন সিজোর দুরূহজটিল ভাষারীতি, ল্যুস ইরিগারের গ্রিক বর্ণমালামোহ, জুলিয়া ক্রিস্তেভার এক বাক্যে পাঁচসাতজন তাত্ত্বিককে উল্লেখ করার প্রবণতা পাঠকের মনে ভয় জাগায়। ইঙ্গমার্কিন নারীবাদীরা যেমন সৃষ্টি করেন বিপুল পরিমাণ নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনা, ঠিক সে ধরনের সমালোচনা ফরাশি নারীবাদীরা লিখেছেন কম : তাঁরা লিখেছেন পাঠগত, ভাষাতাত্ত্বিক, সাংকেতিক বা মনোবিশ্লেষণাত্মক তত্ত্বের সমস্যা সম্পর্কে, এবং লিখেছেন এমন রচনা, যাতে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে কবিতা ও তত্ত্ব। তাঁরা ইঙ্গমার্কিন নারীবাদীদের মতো প্রশ্ন তোলেন নি ‘মহৎ’ সাহিত্যের মহত্ত্ব সম্বন্ধে, তাঁরা তা মেনে নিয়েছেন; তাই তাঁরা ইঙ্গমার্কিন নারীবাদীদের মতো সফলভাবে রুখে দাঁড়াতে পারেন নি পুরুষতান্ত্রিক সাহিত্যের পীড়নমূলক সামাজিক ও রাজনীতিক চক্রান্তের মুখোমুখি। পুরুষেরা যে-সমস্ত বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে ফরাশিদেশে, তাঁরাও ব্যস্ত থেকেছেন তা নিয়েই; তবে তা বিশ্লেষণ করেছেন নারীবাদী দৃষ্টিতে। ফরাশি নারীবাদীদের কাছে ভাষা প্রধান গুরুত্বের বস্তু। ফরাশি নবনারীবাদের তিন প্রধান এলেন সিজো, ল্যুস ইরিগারে, ও জুলিয়া ক্রিস্তেভা।

এলেন সিজো ১৯৭৫-১৯৭৭ সময়ের মধ্যে লেখেন একরাশ তাত্ত্বিক রচনা, যাতে খোঁজা হয় নারী, নারীত্ব, নারীবাদ, ও লেখার সম্পর্ক। তাঁর লেখার মধ্যে রয়েছে ল্য জ্যন নে (ক্যাথেরিন ক্লেমঁওর সাথে, ১৯৭৫), ‘মেদুসার হাস্য’ (১৯৭৫), নপুংসকীকরণ না শিরচ্ছেদীকরণ?’ (১৯৭৬), ল্য ভ্যন্যু লেক্রিত্যুর : লেখায় আসা (১৯৭৭)। তাঁর লেখায় কিছু কেন্দ্রীয় ধারণা ও চিত্রকল্প ফিরে ফিরে আসে, আর তাঁর লেখা হয়ে ওঠে এমন যেনো তা সরলরৈখিকভাবে পড়ার জন্যে নয়। তাঁর লেখা কাব্যিক, রূপকভরা, চিত্রকল্পের বিশ্লেষণঅসম্ভব জালের মতো। দেরিদার মতে পশ্চিমি পরাবিদ্যা আলোচনার ভিত্তি পুরুষ, পুরুষের একটি অতিশায়িত আদর্শায়িত রূপ গঠন ক’রে সমস্ত চিন্তার কেন্দ্রে বসানো হয়েছে পুরুষকে। দর্শনের সূচনাকাল থেকে পুরুষ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এমন এক জ্ঞানতত্ত্বের কেন্দ্রে, যা গড়ে উঠেছে ক্রমস্তরিকভাবে বিন্যস্ত একরাশ দ্বিমুখি ধারণায়। তাতে পুরুষ সব সময় অধিকার ক’রে আছে সুবিধাজনক স্থান : সত্তা/অপর, কর্তা/কর্ম, উপস্থিতি/অনুপস্থিতি, বিধি বা শৃঙ্খলা/বিশৃঙ্খলা, পুরুষ/নারী প্রভৃতি দ্বিমুখি ধারণায় পুরুষই মূল ধারণা। ফরাশি নারীবাদীরা দেখান পুরুষ নারীকে এই ক্রমস্তরিক বিন্যাসের ঋণাত্মক প্রান্তের দিকে ঠেলে দিয়েছে, এবং নারীকে জড়িয়ে দিয়েছে সে-সব ধারণার সাথে যেগুলো বোঝায় ‘মানুষ-নয়’। পুরুষ এভাবে অধিকার করেছে কেন্দ্রিকতা ও ক্ষমতা। তাঁরা পুরুষাধিপত্যবাদী পরাবিদ্যাকে বুঝিয়ে থাকেন একটি শব্দে, শব্দটি ‘ফ্যালোসেন্ট্রিজম’ বা ‘শিশুকেন্দ্রিকতা’, যাতে শিশুই কেন্দ্র, পুরুষই সব। পিতৃতন্ত্রে নারীপুরুষের মূল্য কী, তা দেখানোর জন্যে সিজো পেশ করেছেন তাঁর পিতৃতান্ত্রিক দ্বিমুখি বৈপরীত্য’-এর তালিকা : সক্রিয়/অক্রিয়, সূর্য/চন্দ্র, সংস্কৃতি/প্রকৃতি, দিন/রাত, পিতা/মাতা, মস্তিষ্ক/আবেগ, বোধগম্য/ভাবাবেগপরায়ণ প্রভৃতি; এবং দেখিয়েছেন এ-তালিকার ধনাত্মক বৈশিষ্ট্যগুলো সবই পুরুষের, ঋণাত্মক বৈশিষ্ট্যগুলো নারীর। এ-ধরনের চিন্তায় সিজো সক্রিয় দেখেছেন মৃত্যুকে। তাঁর মতে দ্বিমুখি বৈপরীত্যের একটি ধারণাকে অর্থপূর্ণ হওয়ার জন্যে দরকার অপরটির বিনাশ; তাই আধিপত্যের জন্যে লড়াই ক’রে চলছে ধারণাগুলো। এতে বিজয় = সক্রিয়তা, আর পরাজয় = অক্রিয়তা। পিতৃতন্ত্রে পুরুষই সব সময় বিজয়ী। তাই নারী অভিন্ন মৃত্যুর সাথে। সিজো সৃষ্টি করতে চেয়েছেন এক্রিত্যুর ফেমিনিন বা নারীর লেখা ব’লে একটি ধারণা। তাঁর মতে নারীর লেখার অভিমুখ ভিন্নতার দিকে, যার লক্ষ্য শিশুবাক্যকেন্দ্রিক- ফ্যালোগোসেন্ট্রিক-যুক্তি উপেক্ষা করা। তিনি নির্দেশ করেছেন লেখারও লিঙ্গ; তবে ওই লিঙ্গ লেখকের লিঙ্গের ওপর নির্ভরশীল নয়। তাঁর মতে অনেক নারীই এমন লেখা লিখেছেন, যা আসলে পুংলিঙ্গ। তবে তিনি লিঙ্গ ধারণাই ত্যাগ করতে চান।

ল্যুস ইরিগারের প্রথম বই চিত্তভ্রংশতার ভাষা (১৯৭৩) বেশ সুদূর নারীবাদী লক্ষ্য থেকে, কিন্তু দ্বিতীয় বই অপর নারীর অবতল দর্পণ-এ (১৯৭৪) তিনি নারীবাদের জন্যে পেশ করেন গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব, এবং এ-বইয়ের জন্যে তিনি বহিষ্কৃত হন লাকর ফ্রয়েডীয় ইস্কুল থেকে। বইটি অতিবিতর্কিত। ১৯৭৭-এ বেরোয় এই লিঙ্গ যা একটি নয়, এর পর বরোয় এবং একজন অপরজনকে ছাড়া আলোড়িত হয় না (১৯৭৯), ফ্রিডরিখ নিটশের জলীয় প্রেমিক (১৯৮০), মায়ের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ (১৯৮১), প্রাথমিক সংরাগ (১৯৮২)। তাঁর অবতল দর্পণ-এর প্রথম ভাগে রয়েছে ফ্রয়েডের নারীমনোবিজ্ঞানের কঠোর সমালোচনা, তবে তিনি মিলেটের মতো মনোবিজ্ঞানকে সহজাতভাবে প্রতিক্রিয়াশীল ব’লে বাদ দেন নি। বইটি তিনি ফ্রয়েডকে দিয়ে শুরু এবং প্লাতোকে দিয়ে শেষ ক’রে নষ্ট ক’রে দেন স্বাভাবিক কালানুক্রম। এ-বইয়ের গঠনের সাথে মিল রয়েছে স্ত্রীরোগবিদদের ব্যবহৃত অবতল দর্পণের, যা দিয়ে তারা নারীদেহের নানা রন্ধ্র পর্যবেক্ষণ করে। তাঁর রচনাপদ্ধতি বিসাংগঠনিক। জুলিয়া ক্রিস্তেভা বুলগেরীয়, ১৯৬৬তে আসেন প্যারিসে। রোল বার্ত তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, ‘জুলিয়া ক্রিস্তেভা বস্তুর স্থান বদলে দেন; তিনি ধ্বংস করেন অতিসাম্প্রতিক পূর্বধারণা…তিনি ধ্বংস করেন কর্তৃত্ব, একযৌক্তিক বিজ্ঞানের কর্তৃত্ব’। তাঁর বইয়ের মধ্যে রয়েছে কাব্যভাষার বিপ্লব (১৯৭৪), ভাষায় কামনাবাসনা (১৯৮০), বিভীষিকার ক্ষমতা (১৯৮০) প্রভৃতি। ক্রিস্তেভার প্রধান প্রবণতা ভাষার সমস্যা বিশ্লেষণ। তাঁর মতে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের ভাবাদর্শগত ও দার্শনিক ভিত্তিটি কর্তৃত্বপরায়ণ ও পীড়নবাদী। ক্রিস্তেভা, রুশ ভাষাবিজ্ঞানী ভোলোসিনোভের মতো, ভেঙে দিতে চান ভাষাবিজ্ঞান, অলঙ্কারশাস্ত্র ও কাব্যতত্ত্বের মধ্যবর্তী দেয়াল, এবং তৈরি করতে চান একটি নতুন ক্ষেত্র, যার নাম পাঠগত তত্ত্ব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *