মধ্যাহ্নের অলস গায়ক : রোম্যান্টিক বহিরস্থিত রবীন্দ্রনাথ
সৃষ্টিছাড়া সৃষ্টি-মাঝে বহুকাল করিয়াছি বাস
সঙ্গীহীন রাত্রিদিন; তাই মোর অপরূপ বেশ,
আচার নূতনতর; তাই মোর চক্ষে স্বপ্নাবেশ,
বক্ষে জ্বলে ক্ষুধানল।– যেদিন জগতে চলে আসি,
কোন্ মা আমারে দিলি শুধু এই খেলাবার বাঁশি।
‘এবার ফিরাও মোরে’, চিত্রা
একজন কবির জন্য সমাজ /রাষ্ট্র বরাদ্দ করে কোন স্থান? সামাজিক স্তরক্রমের কোন স্থানটি নির্ধারিত থাকে সে-সব মানুষের জন্য, যাঁদের দেয়া হয় ‘কবি’ অভিধা? বিভিন্ন ব্যক্তির বিচিত্র বিন্যাসে গ’ড়ে ওঠে সমাজসংগঠন, যাতে প্রত্যেকে কাজ করে থাকে অপরিহার্য উপাদানের মতো। সমাজ হচ্ছে বিভিন্ন ব্যক্তি-এককের সমবায়ে গ’ড়ে-ওঠা সংগঠন। ওই সংগঠনে কেউ হ’তে পারে সামান্য, কেউ অসামান্য; কিন্তু তারা সবাই অপরিহার্য। তাই শাসক থেকে দাস পর্যন্ত প্রত্যেকের জন্যে স্পষ্ট স্থান ও ভূমিকা স্থির ক’রে রাখে সমাজ। সামাজিক স্তরক্রমের নির্দিষ্ট স্থলে তারা বিন্যস্ত হয়, পালন করে নির্ধারিত দায়িত্ব, আর ওই দায়িত্ব পালনের জন্যে সমাজ প্রতিপালন করে তাদের। কিন্তু সে-সব মানুষ, স্বপ্ন-আবেগ-উপলব্ধি ও আরো অজস্র ব্যাপার শব্দে বিন্যস্ত ক’রে যাঁরা ‘কবি’ নাম পান, তাঁদের জন্য সমাজ বরাদ্দ করে কোন স্থান? তাঁদের ওপর অর্পণ করে কোন দায়িত্ব?
মানুষ-প্রজাতিটির বিকাশ ঘটতে ঘটতে যে-দিন এতোটা বিকাশ ঘটে যে তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বপ্ন আবেগ উপলব্ধি শব্দে ন্যস্ত করতে শুরু করে-লৌকিক প্রতিবেশে দেখা দিতে থাকে অলৌকিক অনুপ্রাণিত কবি-সে-দিন জন্ম নেয় একটি দুর্মর সমস্যা : সমাজ় ও এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে স্থাপিত হয় এক অস্বস্তিকর সম্পর্ক। ওই মানুষেরা কবি। সমাজ কোন স্থানে বিন্যস্ত করবে তাঁদের, দেবে কোন ভূমিকা পালনের দায়িত্ব- কবি কি অপরিহার্য সমাজের জন্যে, যেমন অপরিহার্য একজন আমলা বা অধ্যাপক বা চিকিৎসক বা কৃষক? কবিকে কি দেয়া সম্ভব এমন কোনো দায়িত্ব, যা শুধু তিনিই পালন করতে পারেন, এবং তিনি পালন না করলে অচল হয়ে পড়বে সমাজ? এ-সব প্রশ্নের স্পষ্ট সদুত্তর দিতে সাধারণত বিব্রত বোধ করে মানবসমাজ। সোজাসুজি ব’লে দিতে পারে না যে সমাজে কবি সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়, আবার এও স্বীকার করতে পারে না যে সামাজিক স্তরক্রমে কবির জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট জায়গা এবং নির্ধারিত রয়েছে নির্দিষ্ট দায়িত্ব। তাই শুরু থেকেই-কবি ও কবিতার উন্মেষকাল থেকেই কবিরা সমাজের মধ্যে রয়েছেন সামাজিক স্তরক্রমে বিন্যস্ত না হয়েই। তাঁরা যেনো সেই নিয়তি ও সমাজদণ্ডিত মানবগোত্র সমাজে বাস ক’রেও যাঁদের সমাজের ভেতরে প্রবেশাধিকার নেই। সমাজে বাস ক’রেও তাঁরা যেনো সমাজবহিরস্থিত।
প্রথম যখন দেখা দিয়েছিলেন কবিরা, গান গেয়ে ফিরছিলেন মুগ্ধ শ্রোতাদের মধ্যে, তখন সমাজ তাঁদের কোনো বাস্তব দায়িত্ব দিতে পারে নি। কিন্তু তাঁদের কথা ও সুর মধুর ব’লে মনে হয়েছিলো অনেকের কাছে, তাই সমাজ তাঁদের মেনে নিয়েছিলো চিত্তবিনোদনকারী চারণ রূপে। ক্রমশ তাঁদের মহিমা বাড়তে থাকে, তাঁদের কণ্ঠ থেকে উৎসারিত হ’তে থাকে এমন সব বাণী, যা শুধু চিত্তবিনোদন ক’রেই নিঃশেষ হয়ে যায় না, বরং মানুষকে দিতে থাকে বিভিন্ন রকম শিক্ষা। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ধর্মগ্রন্থগুলো রচিত হওয়ার আগে কবিরাই গণ্য হন সমাজের নীতিশিক্ষকরূপে। তবে কবিদের নীতি কারো কারো কাছে দুর্নীতিরূপেই গণ্য হয়, এবং আদর্শ রাষ্ট্র থেকে বহিষ্কৃত হ’তেও তাঁদের বিশেষ সময় লাগে নি। তবুও কালে কালে কবিদের শির ঘিরে মহিমার জ্যোতিশ্চক্র পরিয়ে দিতে কবিরা ও অনুরাগীরা কোনো দ্বিধা করে নি। উনিশ শতকেও শূন্যতায়-ডানা-ঝাঁপটানো ব্যর্থ রোম্যান্টিক দেবদূত’ শেলি দাবি করেছিলেন যে কবিরা মানবজাতির অস্বীকৃত বিধানকর্তা। এসব সত্ত্বেও একটি সত্য অটল থেকে গেছে যে কবিরা সামাজিক স্তরক্রমে বিন্যস্ত নন। তাঁদের নেই কোনো নির্দিষ্ট ভূমিকা পালনের দায়িত্ব; অর্থাৎ তাঁদের স্থান সমাজসংগঠনের অভ্যন্তরে নয়, তাঁরা বহিরস্থিত।
তাই শুরু থেকেই কবিরা সমাজে থেকেছেন প্রবাসীর মতো;-সমাজে বাস করেছেন, কোনো-না-কোনো সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন; কিন্তু কবি হিশেবে সামাজিক স্তরক্রমে গৃহীত হন নি। বহু কবি অবশ্য বন্দনা ক’রে গেছেন সে-সমাজকাঠামোর, যাতে বাস করেছেন তাঁরা, তবে একটু ভালোভাবে তাকালে চোখে পড়ে একজন আমলা, বা সমাজ-গৃহীত-ব্যক্তির থেকে ওই কবিও অনেক পৃথক-সমাজের সাথে খাপ-খাওয়ার মাত্রায়। আর বহু কবি-দেশে দেশে ও কালে কালে-যাপন ক’রে গেছেন সমাজচ্যুতের, নির্বাসিতের, দণ্ডিতের জীবন; তবে রোম্যান্টিসিজমের উদ্ভবের আগে কবি ও সমাজের সম্পর্কটি কখনো প্রচণ্ডভাবে অস্বস্তিকর ও সংকটপূর্ণ হয়ে ওঠে নি। ইউরোপে যখন রোম্যান্টিক ঝড় বইতে শুরু করে, তখন দেখা যায় যে কবি ও সমাজের মধ্যে এতোদিন যে-সম্পর্ক ছিলো অস্বস্তিকর, তা হয়ে উঠেছে সংকটপূর্ণ ও বিপজ্জনক। রোম্যান্টিসিজম চেতনালোকে ঘটিয়ে দেয় এক বড়ো রকমের বদল, তা ইউরোপীয় প্রথাগত চিন্তাধারার মেরুদণ্ডেই ধরিয়ে দেয় চিরকালের জন্য এক মস্ত ফাটল। যুক্তিই ছিলো আঠারোশতকের শেষ ভাগ পর্যন্ত ইউরোপীয় চিন্তাপ্রণালির শিরদাঁড়া। ওই চিন্তাপ্রণালির এমন একটা বিশ্বাস ছিলো যে সব কিছু চমৎকারভাবে বোঝা সম্ভব যুক্তিশৃঙ্খলার সাহায্যে। তাদের কাছে সব কিছুই ছিলো নিউটনীয় সৌরলোকের মতো সুশৃঙ্খল, যেখানে কোনোক্রমেই ব্যত্যয় ঘটে না একটিও সূত্রের। রোম্যান্টিকেরা কড়া প্রশ্ন তোলেন এ-সম্পর্কে; এবং তাকে ত্যাগ ক’রে গ্রহণ করেন নতুন মানদণ্ড ও মূল্যবোধ, এবং সূচিত হয়ে যায় ইউরোপীয় চৈতন্যের মহাসংকট।
দুটি বৈশিষ্ট্যকে প্রধান ক’রে তোলেন রোম্যান্টিকেরা;- একটি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, অন্যটি কল্পনাপ্রতিভা। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মূল হচ্ছে অহংবোধ;-এমন এক বোধ যাতে ব্যক্তিই হয়ে ওঠে তার বিশ্বের কেন্দ্র। রোম্যান্টিক কবি তাঁর সৌরলোকে সূর্যের মতো- তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হয় সব কিছু। আর কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ শুধু তিনি নিজে। রোম্যান্টিক কবির সৌরলোক ভ’রে বিরাজ করে এক মহা ‘আমি’- সব কিছু ওই আমিরই বিচ্ছুরণ। তাই রোম্যান্টিক কবির চোখে পান্নার কোনো রঙ নেই, কোনো রঙ নেই চুনির, শুধু তাঁরই চেতনার রঙে পান্না সবুজ আর চুনি রাঙা হয়ে ওঠে। গোলাপ সুন্দর হয়ে ওঠে তাঁরই কথায়। ব্যক্তির ওপর এতোটা গুরুত্ব আরোপ পালাবদলের সূচনা করে সমাজ ও শিল্পকলার ইতিহাসে। মধ্যযুগে সামন্তবাদী সমাজে প্রতিটি মানুষের লক্ষ্য ছিলো সমাজসংগঠনের সাথে খাপ খাওয়ানোর। তারা আত্মসমর্পণ করতো সমাজের অভিলাষের কাছে। এ-আত্মসমর্পণের পুরস্কারস্বরূপ তারা গৃহীত হতো সমাজে;–তা যতো নিম্নস্তরেই হোক-না-কেনো। গৃহীত হওয়ার মধ্যেই স্বস্তি। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সমাজের সাথে খাপ-খাওয়ার প্রথাগত আদর্শের বিরোধী, কেননা এতে, সমাজ নয়, ব্যক্তিই প্রধান। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তিকে দেয় স্বাধীনতা, তবে এ-স্বাধীনতা অনেক দামে কেনা। বিশেষ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত থাকার মধ্যে আছে যে-স্বস্তি ও নিশ্চয়তা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী বাতিল ক’রে দেয় তাকে; অর্থাৎ সে স্বস্তি-নিরাপত্তা-নিশ্চয়তার মূল্যে কেনে তার স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা। একবার মানুষ যখন ছেড়ে দেয় প্রতিষ্ঠিত স্থির আশ্রয়স্থল, তখন সে নিশ্চয়তা ও আশ্রয় খোঁজে নিজেরই অভ্যন্তরে। রোম্যান্টিক কবি সেই মানুষ, যিনি পরিত্যাগ করেন নিশ্চিত আশ্রয়ভূমি, প্রতিষ্ঠিত সমাজকাঠামো, এবং হয়ে ওঠেন নিরাশ্রয়, নিরবলম্ব। তাই রোম্যান্টিক কবি বাহ্যজগতে আশ্রয় না খুঁজে, যুক্তিশৃঙ্খলার শরণ না নিয়ে আশ্রয় খোঁজেন নিজেরই মনোবিশ্ব ও কল্পনাপ্রতিভার মধ্যে। অস্থিরতা তাঁকে সারাক্ষণ কাঁপায়, এক অদৃশ্য আগুন তাঁকে সারাক্ষণ পোড়ায় ৷ রোম্যান্টিক কবি ও নায়ক আকাশের চাতকের চেয়েও অস্থির;- এক গোপন যন্ত্রণা কুরেকুরে খায় তাদের আনন্দ ও যৌবন।
১৭৭৪ অব্দে বেরোয় গ্যেটের উপন্যাস তরুণ বের্টেরের দুঃখ। এ-গ্রন্থে জন্ম নেয় এক হতভাগ্য, আপন-অহমিকা-বন্দী, সমাজবিলগ্ন রোম্যান্টিক নায়ক, যে হয়ে ওঠে রোম্যান্টিক নায়কদের আদিপুরুষ ও প্রতিভূ। এরপর, গত দু-শো বছর ধ’রে, জন্মেছে তার অজস্র উত্তরাধিকারী, যারা নানাভাবে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে সমাজ থেকে, বন্দী থেকেছে নিজেদের মনোবিশ্বে, এবং হয়ে উঠেছে সমাজের সাথে খাপ-না-খাওয়া মানুষের উদাহরণ। এরা প্রায় সবাই, গ্যেটের বের্টেরের মতো, উৎকৃষ্টতম জীবন যাপনের জন্যে সর্বাংশে উপযুক্ত ছিলো, কিন্তু তারা সে-পথে যায় নি, বরং বেছে নিয়েছে যন্ত্রণা, এমনকি মৃত্যু। বের্টেরের নানা গুণ ছিলো, সেগুলো কাজে খাটালে সে যাপন করতে পারতো চমৎকার সামাজিক জীবন, কিন্তু তার স্বভাব তাকে ওইগুলোর সদ্ব্যবহার থেকে বিরত রাখে। সে বান্ধবদের থেকে ও প্রতিবেশ থেকে আত্মকেন্দ্রের দিকে গুটিয়ে নিতে থাকে নিজেকে, এবং বোধ করতে থাকে যে বাস্তব জগত তাকে প্ৰত্যাখ্যান করেছে। এমন বোধের পরিণতি আত্মহত্যা-বের্টের আশ্রয় নেয় আত্মহত্যারই। বের্টের প্রথম রোম্যান্টিক বহিরস্থিত- সমাজের সাথে খাপ-না-খাওয়া মানুষ। সে ও তার উত্তরাধিকারীরা নিজেদের অন্তরেই বহন করে খাপ-না-খাওয়ার বীজ, আর সমাজ ওই বীজকে নানারকমভাবে লালন ক’রে পরিণত করে বিষবৃক্ষে। বের্টেরের পথ ধ’রে এসেছে আরো অনেক রোম্যান্টিক নায়ক- বহিরস্থিত, খাপ-না-খাওয়া, আপন অন্তর্লোকে কারারুদ্ধ। দেখা দেয় শাতোব্রিয়ার রেনে, ম্যুসসের অকটেভ, বায়রনের ম্যানফ্রেড, নোভালিসের অফটারডিংগেন, শেলির আলাস্টর, যারা স্বেচ্ছায় নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিলো সমাজ থেকে। তারা সবাই সমাজে শীতল আগন্তুক- আউটসাইডার- বহিরস্থিত। এ-নায়কদের মতো তাদের স্রষ্টারাও মর্মমূলে বহিরস্থিত।
রোম্যান্টিক কবিরা বাস্তব সত্যের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক’রে তোলেন কল্পনাপ্রতিভাকে; রামের জন্মভূমির চেয়ে বহুগুণে সত্য হয়ে ওঠে তাঁদের কাছে নিজেদের মনোভূমি। এ-কল্পনাপ্রতিভার সাহায্যেই তাঁরা সৃষ্টি করেন আপন বিশ্বলোক। তাঁরা যে-বিশ্বলোক সৃষ্টি করেন, তার ভিত্তি হচ্ছে অহমিকা, সেখানে মূল্যবান শুধু ওই ব্যক্তি-অহমের আবেগ-অনুভূতি-বোধি। অন্যরা যেখানে পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্যে বস্তুগতভাবে অনুধাবন করে সব কিছু, রোম্যান্টিক কবিরা সেখানে সব কিছু উপলব্ধি করেন নিজেদের কল্পনাপ্রতিভার সাহায্যে। কারণ, রোম্যান্টিকদের কাছে বস্তু তাঁদের অহমিকার চেয়ে অনেক কম মূল্যবান; তাই তাঁরা সব কিছুকে কল্পনাপ্রতিভার সাহায্যে সৃষ্টি ক’রে নেন নতুন রূপে। তাঁরা, বস্তুজগতকে অনেকটা বর্জন ক’রে, অধিবাসী হয়ে ওঠেন তাঁদের কল্পনাপ্রতিভার সৃষ্ট কল্পজগতের। বাস্তব ও কল্পজগতের মধ্যে রচিত হয় যে-বৈপরীত্য, তাতে তারা নেন কল্পজগতেরই পক্ষ। অহমিকা তাঁদের সরিয়ে নেয় বাস্তব থেকে, কল্পনাপ্রতিভা তাদের সুদূরে নিয়ে যায় বাহ্য প্রতিবেশপৃথিবী থেকে, এবং রোম্যান্টিক কবির সমাজ-বহিরস্থিততা পরিগ্রহ করে চরম রূপ। তবে রোম্যান্টিক কবিরা শুধু সমাজ থেকে স’রে যাওয়া মানুষই নন, তাঁদের অনেকই সমাজদ্রোহী। প্রথাগত প্রতিষ্ঠিত সমাজকে আমূল বদলে দেয়ার স্বপ্ন তাঁরা অনেকেই দেখেছেন। সমাজের সাথে খাপ-না-খাওয়ার ব্যাপারটি আরো এগিয়ে নিয়ে যান রোম্যান্টিকদেরই উত্তরসূরী প্রতীকী কবিরা। প্রতীকীরা ঠাণ্ডাভাবে নীরবে নিঃশব্দে নিজেদের গুটিয়ে নেন জীবন ও সমাজ থেকে, চারপাশের স্থুল ঘৃণ্য জীবনজগতের বিরুদ্ধে কোনো ক্ষোভ প্রকাশ না ক’রে তাকে ঠাণ্ডা অবহেলায় অস্বীকার ক’রে তাঁরা ঢোকেন নিজেদের অন্তর্লোকে। সমাজ-বহিরস্থিত প্রতীকী নায়কের প্রতিভূ ভিলিয়ের দ্য লিজল্-আঁদের নায়ক অ্যাকজেল। অ্যাকজেল স্বেচ্ছায় নিজেকে সমাজ থেকে সরিয়ে নিয়ে বাস করে অরণ্যের মধ্যে এক পুরানো প্রাসাদে। সে যে-জীবন যাপন করে, তা বিশুদ্ধরূপে ধ্যান ও কল্পনার, যাতে স্কুল জীবনের কোনো ছোঁয়া নেই। যে-মুহূর্তে সে প্রেমে পড়ে, সে-মুহূর্তেই তার জীবন কানায়কানায় ভ’রে ওঠে, এবং জীবনের সমস্ত দরকার নিঃশেষ হয়ে যায়। তার সব কিছুই ছিলো-যৌবন, প্রেম, সামাজিক প্রতিষ্ঠা, শক্তি ও সাড়ে তিনশো মিলিয়ন মুদ্রা, যা দিয়ে সে জীবন সম্ভোগ করতে পারতো দু-হাতে ছেনে। কিন্তু সে তা চায় না; প্রেমের চরম মুহূর্তে সে চায় মৃত্যু; কেননা চরম মুহূর্ত কেটে গেলে জীবন হবে এক স্থূল ক্লান্তির নামান্তর। সে তাই জীবন যাপনের দায়িত্ব অর্পণ করে, অন্যান্য নোংরা দায়িত্বের মতো, তার গৃহভৃত্যদের ওপর। প্রতীকী নায়কেরা চরম স্বাপ্নিক ও চরম সমাজ-বহিরস্থিত। লাফর্গের লোহেগ্রিন বাসররাতেই নববধূর দিকে পিঠ ফিরিয়ে বুকে বালিশ চেপে ধ’রে স্বপ্ন দেখে তার সালোমের। মালার্মের ইগতুর নাটকের নায়ক, যে নাটকের একমাত্র চরিত্র, কোনো কাজ করে না, শুধু স্বগতোক্তি করে, আর উসম্যর দ্য এসিয়েন্তে এমন এক জীবন যাপন করে, যা বাহ্যজগতের সাথে সম্পূর্ণ সম্পর্করহিত : সে দিনের বেলা ঘুমোয় আর রাতে জেগে থেকে পড়ে দুরূহ গ্রন্থ। রোম্যান্টিকেরা যে-বহিরস্থিত জীবনযাপনের সূচনা করেছিলেন, প্রতীকীরা তাকে চূড়ান্তে নিয়ে যান। অর্থাৎ কবি- রোম্যান্টিক ও প্রতীকী– হয়ে ওঠেন খাপ-না-খাওয়া মানুষ;– বহিরস্থিত।
কবি ও কবিতার আবির্ভাবকাল থেকেই সমাজের সাথে কবির যে-অস্বস্তিকর সম্পর্ক চ’লে এসেছে, তাই রোম্যান্টিসিজমের উদ্ভবের ফলে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কবি সমর্থ হন সমাজকে পরিচ্ছন্নরূপে অস্বীকার করতে, অবহেলা করতে, এবং পরিত্যাগ করতে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের বিকাশ ঘটা ছাড়া এমন অস্বীকার ও পরিত্যাগ সম্ভব হতো না। কবিরা চিরকালই বোধ ক’রে এসেছেন যে বাস্তবনিষ্ঠ সামাজিকদের কাছে তাঁদের সৃষ্টির মূল্য খুবই সামান্য; কিন্তু সামন্তবাদী, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য-স্বীকার-না-করা সমাজে সামাজিকদের পৃষ্ঠপোষকতা, করুণা, স্নেহকেই সম্বল ক’রে চলতে হয়েছে তাঁদের। রোম্যান্টিসিজমের উদ্ভববিকাশের সময় ইউরোপে সংঘটিত হয় শিল্পবিপ্লব, এবং উদ্ভববিকাশ ঘটে পুঁজিবাদী বুর্জোয়াদের। বুর্জোয়ারা সমাজসংগঠনকে এক ধাপ এগিয়ে দেয়, স্বীকার ক’রে নেয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, কিন্তু সব কিছুকেই তারা পরিণত করে পণ্যে। সব কিছু মূল্যায়নের জন্যে তারা স্থির ক’রে দেয় একটি মানদণ্ড, তা হচ্ছে উজ্জ্বল ঝলমলে মুদ্রা। আর ওই মুদ্রাকেই সবচেয়ে ঘৃণা করেন রোম্যান্টিকেরা। মুদ্রানিয়ন্ত্রিত সমাজকাঠামোতে, রোম্যান্টিকেরা বুঝতে পারেন- যা আরো ভালো ক’রে বোঝেন প্রতীকী কবিরা যে তাঁদের, ও তাঁদের সৃষ্টির কোনো দাম নেই। পুঁজিবাদী বুর্জোয়া সব কিছুকেই পুঁজি ক’রে তোলে- শিশির আর সূর্যাস্ত, প্রিয়ার মুখ আর ওষ্ঠও তার কাছে পুঁজি। তার আরাধ্য দেবতার নাম মুদ্রা। তার চোখে মুদ্রার চেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই। কিন্তু রোম্যান্টিক কবি এ-মানদণ্ড ও মূল্যবোধের সম্পূর্ণ বিরোধী; তাঁর আরাধ্য হচ্ছে সৌন্দর্য। যা কিছু মুদ্রা দিয়ে আয়ত্ত করতে হয়, তাই ঘৃণার বস্তু তাঁর কাছে। কিন্তু তিনি লক্ষ্য করেন পুঁজিবাদী সমাজে একখণ্ড লোকোত্তর গীতাঞ্জলির চেয়ে অনেক দামি এক জোড়া চটিজুতো। তবে বুর্জোয়া সমাজকাঠামোতেই, যেখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য স্বীকৃত, তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় সমাজকে অস্বীকার ক’রে আন্তর বিশ্বলোক সৃষ্টি। সমাজ যারা চালায়, তাদের সাথে মেলা কি সম্ভব ছিলো ওই অতিসংবেদনশীল, সৌন্দর্যআলোড়িত, স্বপ্নচালিত কবিদের? তা সম্ভব ছিলো না। চিরকালই সমাজ শাসন ক’রে আসছে তৃতীয় মানের প্রায়-বর্বর, সংবেদনাশূন্য, স্থূল মানুষেরা। তাই তাদের সাথে মেলার কোনো পথ ছিলো না। একদিকে সংবেদনশীল স্বাপ্নিক, আরেক দিকে স্থুল, গুধু সমাজনিয়ন্ত্রক;- তাদের মিলনের কোনো উপায় ছিলো না। তাই তাঁরা স্থূল, শক্তিমান, গৃধুদের হাতে বাস্তব ও সমাজকে ছেড়ে দিয়ে নিজেদের জন্য বেছে নেন স্বপ্নকে, অবাস্তবকে, সৌন্দর্যকে। সমাজে থেকেও থাকেন সমাজ-বহিরস্থিত।
রোম্যান্টিক বহিরস্থিতদের কথা মনে হ’লে বাইবেলের জোসেফকে মনে পড়ে : জোসেফ হ্যাড এ কোট অফ মেনি কালারস, অ্যান্ড হি ওয়াজ এ ড্রিমার অফ ড্রিমস। রোম্যান্টিক বহিরস্থিতদের পরিধেয় বস্ত্রও বহু রঙের, আর তাঁরা ড্রিমার অফ ড্রিমস : স্বপ্নের স্বাপ্নিক। প্রিরাফায়েলাইট উইলিয়ম মরিস তাঁর পার্থিব স্বর্গ (১৮৬৮-১৮৭০) কাব্যের ‘প্রস্তাবনা’য় এ-রোম্যানটিক বহিরস্থিতদের চরিত্র তুলে ধরেছিলেন চম ৎকারভাবে। তাঁরা ‘স্বপ্নের স্বাপ্নিক, যথাসময়ের আগেই জন্ম হয়ে গেছে তাঁদের।’ মরিস ‘প্রস্তাবনা’য় চারণের মতো গেয়েছেন এমন গান : ‘স্বর্গ ও নরকের গান গাওয়ার কোনো শক্তি আমার নেই, আমি মুছিয়ে দিতে পারি না তোমাদের চোখের জল, অথবা দ্রুত আসন্ন মৃত্যুকে থামিয়ে দিতে পারি না আমি; বা পারি না ফিরিয়ে আনতে ফেলে-আসা নানান রঙের দিনগুলোর প্রমোদ।’ এ-স্বাপ্নিক এসব অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন না; কারণ তিনি রোম্যান্টিক বহিরস্থিত-শূন্য দিনের অলস গায়ক’-’দি আইডল সিঙ্গার অফ অ্যান এম্পটি ডে।’ তাঁরা সঙ্গীতনির্মাতা। এ-প্রসঙ্গে মরিসেরই সহযাত্রী ও শনেসির একটি স্তবক স্মরণযোগ্য : ‘We are the music makers, / And we are the dreamers of dreams,/Wandering by lone sea-breakers,/And sitting by desolate streams;_/World-losers and world-forsakers,/On whom the pale moon gleams:/Yet we are the movers and shakers / Of the world for ever, it seems.’ [প্রবন্ধটি লিখিত, পঠিত ও প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার বছর খানেক পর অন্যমনে রবীন্দ্রনাথের The Religion of Man উল্টাতে গিয়ে চমকে উঠি, দেখি এর অষ্টম অধ্যায়ের নাম ‘The Music Maker’। সন্দেহ থাকে না যে কবিতাটির অংশ বিশেষ তিনি উদ্ধৃত করবেন এ-অধ্যায়ে, এবং দেখতে পাই পরিচ্ছেদের মধ্যভাগে তিনি উদ্ধৃত করেছেন কবিতাটির দুটি পংক্তি। তিনি বলেন, ‘কবি মানুষের শ্রেষ্ঠ সংজ্ঞা দেন, যখন তিনি বলেন : We are the music makers / we are the dreamers of dreams.’ তাই রবীন্দ্রদৃষ্টিতে শুধু কবি নয়; মানুষ মাত্রই স্বপ্নের স্বাপ্নিক। নাকি মানুষ মাত্রই কবি?
তাঁরা সঙ্গীতনির্মাতা আর স্বপ্নের স্বাপ্নিক, নির্জন সমুদ্র ও বিজন স্রোতস্বিনীতীরে ভ্রমণচারী। তাঁরা পৃথিবীকে হারিয়েছেন, আর পৃথিবী হারিয়েছে তাঁদের। তাঁদের ওপর আলো ঢালে আকাশের ম্লান চাঁদ। ‘স্বপ্ন’ ও ‘কল্পনা’ শব্দ দুটি ধ্রুবপদের মতো ব্যবহার করেন রোম্যান্টিক বহিরস্থিতরা, এবং গ’ড়ে তোলেন এমন এক বিশ্ব, যা বিষণ্ণ, অশ্রুময়, প্রকৃতির শ্বাসপ্রশ্বাসে স্নিগ্ধ, স্বপ্নরঞ্জিত ও সৌন্দর্যভারাতুর। তাঁদের জগতে ঢুকলে সুখ পাওয়া যায়, বুক ভ’রে নিশ্বাস নেয়া যায়। বিশশতকে যে-অস্তিত্ববাদী বহিরস্থিতরা দেখা দেয়, তাদের জগত রোম্যান্টিক বহিরস্থিতদের জগতের সম্পূর্ণ বিপরীত। অস্তিত্ববাদী বহিরস্থিতদের জগত শ্বাসরুদ্ধকর, তা বিবমিষা জাগায়, ওই জগতে বিরাজ করে না কোনো মূল্যবোধ। জীবনানন্দের ভাষা ধার ক’রে বলা যায়, অস্তিত্ববাদী বহিরস্থিতদের জগতে সব মূল্যবোধ প’চে প’চে শুয়োরের মাংস হয়ে যায়। রোম্যান্টিকদের জগত তেমন নয়; সেখানে বিরাজ করে মানবিকতা। তাই দেখা যায় রোম্যান্টিক বহিরস্থিত সাধারণত জীবন ও সমাজের চাপে ক্রমশ এগিয়ে যায় আত্মহত্যা বা মৃত্যুর দিকে-খুন করে নিজেকে, আর অস্তিত্ববাদী বহিরস্থিত খুন করে অন্যকে। রোম্যান্টিক বহিরস্থিতরা সম্পূর্ণরূপে নিষ্ক্রিয়; কেননা তাঁরা স্বভাবতই স্বাপ্নিক।
বাঙলা কবিতার সূচনা করেছিলেন সমাজ-বহিষ্কৃত একগোত্র কবি। কঠোরভাবে শ্রেণীবিন্যস্ত সমাজ বহিষ্কার করেছিলো তাঁদের, আর ওই তান্ত্রিক কবিরা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সমাজকে। তাই বাঙলা কবিতার শুরু থেকেই লেগে আছে কবি ও সমাজের কলহ, ও পারস্পরিক সংঘর্ষ। তারপর শতাব্দীপরম্পরায় বাঙলা ভাষার বহু কবি সমাজচ্যুত থেকেছেন, বহিরস্থিতের জীবন যাপন করেছেন, কিন্তু বাঙলা ভাষার প্রথম রোম্যান্টিক বহিরস্থিত কবির আবির্ভাব ঘটে উনিশশতকের ষাটের দশকে। বাঙলা ভাষার প্রথম রোম্যান্টিক ও প্রথম আধুনিক কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী; আর তিনিই বাঙলা ভাষার প্রথম রোম্যান্টিক বহিরস্থিত। ইউরোপে যে-চেতনাবদল ঘটেছিলো, নতুন সংবেদনশীলতা দেখা দিয়েছিলো আঠারোশতকের দ্বিতীয়ার্ধে, তা বাঙলাদেশে- বাঙলা ভাষায়– দেখা দেয় উনিশশতকের দ্বিতীয় ভাগে। ওই চেতনাবদল ঘটিয়েছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তী। তিনিই বাঙলা ভাষায় প্রথম আপাদমস্তক স্বপ্নের হাতে ধরা দেন, ব্যর্থ হন প্রতিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে, বড়ো ক’রে তোলেন স্বপ্ন-কল্পনা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে; গড়ে তোলেন একান্ত ব্যক্তিগত, ভূগোলহীন ও স্বপ্নরঞ্জিত, এক মনোবিশ্ব। তাঁর কবিতা পড়ার সময় মনে হয় বাস্তবকে তিনি রূপান্তরিত করেছিলেন স্বপ্নলোকে, এবং তাঁর ভেতর দিয়ে চলেছিলেন স্বপ্নচালিতের মতো। ইউরোপীয় অর্থে তখন কোনো শিল্পবিপ্লব দেখা দেয় নি বাঙলায়; উত্থানও ঘটে নি ইউরোপীয় ধরনের বুর্জোয়াদের; কিন্তু রোম্যান্টিসিজমের আবির্ভাব, চৈতন্যের সংকট ও চেতনাবদল, অবধারিত ছিলো ব’লে শতবর্ষ বিলম্বে বাঙলায় দেখা দেয় এ-নতুন সংবেদনশীলতা। দেখা দেন রোম্যান্টিক বহিরস্থিত- “বিজনবাসী ভাবনিমগ্ন কবি’- বিহারীলাল চক্রবর্তী শুরু থেকেই তাঁর কবিতায় বিকশিত হয় ধনের সাথে বিরোধ ও কল্পনার সাথে সন্ধি, আর মানুষ ও প্রতিবেশের সাথে খাপ-না-খাওয়ার প্রবণতা। বারবার বলেন তিনি, ‘ভুলিব না কমলার কাম-রূপ দেখে,’ বা ‘কমলার ধন-মানে নহি অভিলাষী’, এবং ‘যাও লক্ষ্মী অলকায়/যাও লক্ষ্মী অমরায়/এস না এ যোগিজন-তপোবনে আর’ ব’লে প্রত্যাখ্যান করেন বুর্জোয়াদের আরাধ্য দেবীকে। প্রচণ্ড অস্বস্তি বোধ করেন তিনি জনতার মাঝে, কেননা জনতার ভিড় ধ্যান ভেঙে দেয় তাঁর;–‘জনতার কলকল’, বা ‘কলরবপূর্ণ মানবসমাজ’ তাঁকে পীড়িত করে স্বপ্নলোক থেকে টেনে এনে। মনুষ্যসমাজে তিনি হয়ে ওঠেন স্বপ্নস্বর্গলোকচ্যুত দেবদূত বা বোদলেয়ারের আলবাট্রসের মতো, নিজের মহান কল্পনাডানার ভারে পদে পদে যার গতি রুদ্ধ হয়ে আসে। স্পষ্ট বলেছেন বিহারীলাল : ‘যে অবধি স্বপনের মায়াময়ী পুরী,/ছেড়ে এসে পড়েছি যথার্থ লোকালয়ে,/সে অবধি আমার সন্তোষ গেছে চুরি,/সদা এক তীক্ষ্ণ জ্বালা জ্বলিছে হৃদয়ে।’ রোম্যান্টিকদের বড়ো সম্পদ ও সমস্যা তাঁদের হৃদয়। বিহারীলালও চিৎকার ক’রে উঠেছেন, সুদুর্ভর হৃদয় বহিয়ে,/কত যুগ রহিব বাঁচিয়ে।’ ওই হৃদয়লোকে সারাক্ষণ ঝড়ঝঞ্ঝা, অসন্তোষ, ও বিষাদ। বঙ্গসুন্দরীর প্রথম স্তবকেই হাহাকার বেজে উঠেছে তাঁর বুক থেকে : ‘সর্বদাই হুহু করে মন,/বিশ্ব যেন মরুর মতন।’ সমাজসংগঠনের সাথে সুন্দরভাবে খাপ খেয়ে জীবনকে প্রথাগতভাবে সার্থক ক’রে তোলা অসম্ভব তাঁর পক্ষে। তাই হয়ে উঠলেন তিনি রোম্যান্টিক বহিরস্থিত, ‘শূন্যময় নির্জন শ্মশান’ বা ‘নিস্তব্ধ গম্ভীর গোরস্থান’ তাঁকে তৃপ্তি দেয়; তিনি ছুটে যেতে চান কোনো বহুকাল-আগে-বিধ্বস্ত লোকালয়ে, যার ওপর দিয়ে বয়ে যায় বিষাদ বায়ু। তাই বাস্তবকে প্রত্যাখ্যান ক’রে শরণ নেন তিনি স্বপ্নকল্পনার। ‘হোগ্গে এ বসুমতী যার খুশী তার’ ব’লে তুচ্ছ বস্তুর মতো ছুঁড়ে ফেলে দেন সমাজকাঠামো, ও তার সমস্ত প্রতিযোগিতাকে। বলেন, ‘তপোবনে ধ্যানে থাকি এ নগর-কোলাহলে’ এবং পরিব্রাজক হয়ে ওঠেন স্বপ্নলোকের- ‘ভ্রমিব স্বপন-নগরে- /চিরজীবন ভ্রমিব স্বপন-নগরে।’ তাঁর আগে বাঙলায় দেখা দেয় নি এমন কোনো স্বপ্নগ্রস্ত বহিরস্থিত; তাই বিহারীলালই আমাদের প্রথম রোম্যান্টিক বহিরস্থিত।
রবীন্দ্রনাথের যে-ভাবমূর্তি গ’ড়ে উঠেছে গত কয়েক দশকে, তাতে তাঁর কবিসত্তাটি গৌণ হয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে অন্যান্য সত্তা; এবং তাঁকে খাপ-না-খাওয়া মানুষ বা রোম্যান্টিক বহিরস্থিত মনে তো হয়ই না, বরং সমকালীন সভ্যতা-সমাজ- জীবনের একজন প্রধান নিয়ন্ত্রক ব’লেই মনে হয়। এটা মিথ্যে নয় যে নিজেকে নানাভাবে সংস্কৃত সংশোধিত রূপান্তরিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ; বয়স্ক হওয়ার সাথে সাথে ঢুকেছিলেন ও খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিলেন বাস্তব ও সমাজের সাথে, কিন্তু আশি বছর বয়স্ক অবস্থায়ও তাঁর মধ্যে এমন কিছু ছিলো, যা স্মরণ করিয়ে দেয় যে রবীন্দ্রনাথ কবি- রোম্যান্টিক কবি, যিনি চারপাশের সাথে মিলতে গিয়েও বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেন। গান্ধির সাথে তুলনা করলেই বোঝা যায় ওই রাজনীতিক, বাস্তবকে দখল করা যাঁর লক্ষ্য, তাঁর পায়ের নিচে ব্যাপক শক্ত মাটি; কিন্তু কবি রবীন্দ্রনাথ, ওই রাজনীতিকের চেয়ে বহুগুণে মহত্তর হওয়া সত্ত্বেও, বারবার বোধ করেন যে তাঁর পায়ের নিচের মাটি থরথর ক’রে কাঁপছে। এ-বাস্তব বিশ্বে একজন তৃতীয় মানের রাজনীতিক অনেক শক্তিশালী ও প্রতিষ্ঠিত একজন অমর প্রথম শ্রেণীর কবির থেকে। কবিদের নিয়তি এই। কবি রবীন্দ্রনাথের জীবন শুরু হয়েছিলো এক তীব্র প্রবল রোম্যান্টিক বহিরস্থিতরূপে, এবং দীর্ঘ জীবনব্যাপী তিনি যে অজস্র কবিতা রচনা ক’রে গেছেন, তার একটি বড়ো অংশকেই বলতে পারি ‘মধ্যাহ্নের অলস সঙ্গীত’। উইলিয়ম মরিস পার্থিব স্বর্গ-এ নিজেকে চিহ্নিত করেছিলেন শূন্য দিনের অলস গায়ক’ অভিধায়, আর রবীন্দ্রনাথ নিজেকে দেখেছিলেন- চিত্রার ‘এবার ফিরাও মোরে’ নামী কবিতায়- ‘ছিন্নবাঁধা পলাতক বালকের’ রূপকে, ‘মধ্যাহ্নে মাঠের মাঝে একাকী বিষণ্ন তরুচ্ছায়ে/দূরবনগন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তপ্ত বায়ে’ যে সারাদিন বাঁশি বাজায়। একজনের গায়ক ও আরেকজনের বাঁশরিয়া প্রকৃতিতে অভিন্ন;- দু-জনই বহিরস্থিত। রবীন্দ্রনাথ আবাল্য স্বপ্নের স্বাপ্নিক ও সঙ্গীতনির্মাতা, যে-স্বপ্ন ও সঙ্গীত বাস্তব মানুষের কাছে আলস্যের নামান্তর। উল্লেখযোগ্য যে পৃথিবীর অধিকাংশ উৎকৃষ্ট কবিতাই স্বপ্ন ও অলস সঙ্গীত-সক্রিয় পদ্যের চেয়ে সেগুলোর আবেদন অনেক ব্যাপক ও গভীর। রবীন্দ্রনাথের কবিজীবন শুরু হয়েছিলো প্রবল আবেগ-স্বপ্ন-কল্পনার আধিপত্যের মধ্যে, আর এ-তিন রোম্যান্টিক বৈশিষ্ট্য তাঁকে সমাজসংসার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলো মধ্যযৌবন পর্যন্ত। জীবনস্মৃতিতে তিনি জীবনের ওই সময়টির দিকে তাকিয়েছেন একরকম অপরাধবোধে আক্রান্ত হয়ে; মৃদু তিরস্কার করেছেন বাল্য-কৈশোর-যৌবনের স্বপ্নাচ্ছন্ন সময়কে। ‘ভগ্নহৃদয়’ পরিচ্ছেদে বলেছেন, ‘আমার পনেরো-ষোলো হইতে আরম্ভ করিয়া বাইশ-তেইশ বছর পর্যন্ত এই যে একটা সময় গিয়াছে, ইহা একটা অত্যন্ত অব্যবস্থার কাল ছিল।…অপরিণত মনের প্রদোষালোকে আবেগগুলো সেইরূপ পরিমাণ বহির্ভূত অদ্ভুতমূর্তি ধারণ করিয়া একটা নামহীন, পথহীন, অন্তহীন অরণ্যের ছায়ায় ঘুরিয়া বেড়াইত।’ এ-’নামহীন পথহীন অন্তহীন অরণ্যের ছায়া’টি রোম্যান্টিক বহিরস্থিতের বিশ্ব। তিনি বলেছেন, ‘তখন আমারই বয়স আঠারো ছিল তা নয়- আমার আশপাশের সকলের বয়স যেন আঠারো ছিল। আমরা সকলে মিলেই একটা বস্তুহীন ভিত্তিহীন কল্পনালোকে বাস করতেম। সেই কল্পনালোকের খুব তীব্র সুখদুঃখও স্বপ্নের সুখদুঃখের মতো।’ ওই সময়ে তাঁর মনে যে-আবেগ জেগে উঠেছিলো, বাহ্যপৃথিবীর সাথে তার কোনো সম্পর্ক রচিত হয় নি; তাই তা ছিলো ব্যাধির মতো পীড়াদায়ক। যদিও রবীন্দ্রনাথ এক প্রবল বিশাল বিস্তৃত হৃদয়াবেগের নাম, তবুও জীবনস্মৃতি রচনার কালে তিনি ওই হৃদয়াবেগকে তিরস্কার করেছেন। এতে বোঝা যায় কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন সামাজিকদের সাথে তখন তিনি অনেকখানি খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন। এ-বোধ থেকেই সম্ভবত তিনি তাঁর ওই সময়ের রচনাবলিকে অস্বীকার করেন, বর্জন করেন রবীন্দ্র-রচনাবলী থেকে। এখন এই রচনাবলী স্থান পায় শুধু ‘অচলিত সংগ্রহ’-এ।
তাঁর প্রথম পর্যায়ের কয়েকটি কাব্যগ্রন্থে পাওয়া যায় যে-রবীন্দ্রনাথকে, তিনি আবেগ-স্বপ্ন-কল্পনাতুর এক বহিরস্থিত, বাস্তব ও সমাজ থেকে সুদূরে অবস্থিত, স্বরচিত এক মনোবিশ্বের অধিবাসী। কবি-কাহিনী (প্রপ্র ১৮৭৮), বন-ফুল (প্রপ্র ১৮৮০), ভগ্নহৃদয় (প্রপ্র ১৮৮১), রুদ্রচণ্ড (প্রপ্র ১৮৮১), শৈশবসঙ্গীত (প্রপ্র ১৮৮৪), বাল্মীকিপ্রতিভা (প্রপ্র ১৮৮১) প্রভৃতি প্রথম পর্যায়ের কাব্য ও কাব্যনাট্যে স্তবকে স্তবকে পাওয়া যায় এ-রবীন্দ্রনাথকে, এবং এর পরবর্তী কড়ি ও কোমল (প্রপ্র ১২৯৩), ও মানসীতে (প্রপ্র ১২৯৭) ধারাবাহিকভাবে নয়, কিন্তু মাঝেমাঝেই দেখা দিয়েছে তাঁর অন্তরবাসী বহিরস্থিত সত্তাটি। এ-সত্তার শেষ, স্পষ্ট, বিখ্যাত পরিচয় পাওয়া যায় চিত্রায়- ‘এবার ফিরাও মোরে’ (১৩০০), ও ‘আবেদন’ (১৩০২) কবিতায়। বন-ফুল রচনার সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স পনেরো-ষোলো; কবি-কাহিনী রচনার সময় ষোলো-সতেরো; আর ভগ্নহৃদয় রচনার সময় আঠারো। ‘এবার ফিরাও মোরে’ রচিত হয় বত্রিশ বছর বয়সে, আর ‘আবেদন’ চৌত্রিশ বছর বয়সে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের পনেরো থেকে তেইশ বছর পর্যন্ত সময়কে ‘অব্যবস্থার কাল’ আখ্যা দিয়েছেন। এ-সময়টা তাঁর চরম রোম্যান্টিক বহিরস্থিতোর কাল; কিন্তু তাঁর এ-প্রবণতাটি এ-বয়সেই লোপ পায় নি। চৌত্রিশ বছর পর্যন্ত তা ছিলো তীব্রভাবেই, যদিও ধারাবাহিকভাবে নয়, এবং একটু সাহসী হ’লেই বলা যায়, এ-প্রবণতাটি ছিলো তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত;- সংগোপনে, অবচেতনে।
কবির অস্তিত্বের ব্যাপারটি জীবনের শুরুতেই ভাবিয়েছিলো রবীন্দ্রনাথকে;-নিৰ্ণয় ক’রে নিতে চেয়েছিলেন তিনি কবির স্বরূপ ও ভূমিকা, সমাজের ও স্বপ্নের সাথে কবির সম্পর্কের মাত্রা। তাই শুরু থেকে তিনি শুধু কবিতা লিখে কবি হয়ে ওঠেন নি, তিনি লিখেছেন কবিরই কথা। তাঁর প্রথম পর্যায়ের কাব্য ও নাটকগুলো কাহিনীকাব্য, এবং প্রায় প্রতিটিতেই মূল চরিত্র রূপে রয়েছে একজন কবি। কবি-কাহিনী চার সর্গে এক কবির কাহিনী; বন-ফুল-এর নায়ক নীরদ কবি; ভগ্নহৃদয়-এর প্রধান চরিত্রটি কবি; রুদ্রচণ্ড-এর অন্যতম প্রধান চরিত্র চাঁদ একজন কবি; শৈশবসঙ্গীত ভ’রে আছে কবির উল্লেখ, আর বাল্মীকিপ্রতিভা ভারতীয় আদি মহাকবির কবিপ্রতিভা লাভের উপাখ্যান। কেনো কাব্যপরম্পরায় ফিরেফিরে আসে কবিচরিত্র? একি নিজেকেই সৃষ্টি করা, নির্ণয় করা নিজেরই ভূমিকা? বাল্যেই সম্ভবত সচেতন হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ যে কবি সুবিন্যস্ত নয় সমাজসংগঠনে, বরং অনেকটা বহিরস্থিত; কিন্তু তাঁর নিয়তি ওই কবিই হয়ে ওঠা। কবি হয়ে উঠছিলেন তিনি কৈশোরেই এবং এমন কবি হয়ে উঠছিলেন, যাঁর সম্পর্ক ছিলো না প্রতিবেশ ও সমাজের সাথে। স্বপ্ন আর কল্পনায় গড়ে তুলছিলেন এক মনোবিশ্ব- সুদূর, বিজন, আবেগকাতর ও বিষাদভারাতুর। বিহারীলাল চক্রবর্তীর সাথে একটি বিষয়ে তাঁর বেশ পার্থক্য; বিহারীলালের কবিতায় বারবার ঘোষিত হয় বাস্তব সমাজপ্রতিবেশের সাথে কবির সংঘর্ষের ও স্বপ্নলোকে আশ্রয় নেয়ার কথা, কিন্তু কিশোর-যুবক কবি রবীন্দ্রনাথ সমাজপ্রতিবেশকে সম্পূর্ণ অস্বীকার ক’রে যান, যেনো সমাজ প্রতিবেশের কোনো অস্তিত্বই নেই, আছে শুধু এক কল্পবিশ্ব। এর কারণ তখনো তাঁর কোনো সামাজিক অভিজ্ঞতাই হয় নি, তখন পর্যন্ত তাঁর সমস্ত অভিজ্ঞতাই স্বাপ্নিক কিন্তু যেই তিনি সামাজিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হ’তে শুরু করেন মানসীর কবিতাগুচ্ছ রচনার কালে, তখন সংঘর্ষ শুরু হয় বাস্তবের সাথে, এবং বুঝতে পারেন যে তিনি পৃথক পয়ে প’ড়ে আছেন অন্যদের থেকে।
কবি-কাহিনীর শুরুতেই পাওয়া যায় এক রোম্যান্টিক বহিরস্থিত কবি ও তাঁর বিজন ভুবনকে : ‘শুন কল্পনা বালা, ছিল কোন কবি/বিজন কুটীর-তলে। ছেলেবেলা হোতে/ তোমার অমৃত-পানে আছিল মজিয়া।/তোমার বাণীর ধ্বনি ঘুমায়ে ঘুমায়ে শুনিত, দেখিত কত সুখের স্বপন।’ কবি-কাহনী এ-বিজনবাসী ভাবনিমগ্ন কবির কাহিনী। বাস্তব জীবনের সাথে কোনো সম্পর্ক ঘটে নি তার। বিহারীলাল যে-’সুদুর্ভর হৃদয়’ভার বহনের যন্ত্রণার কথা বলেছেন, এ-কবি তার ভারে ও যন্ত্রণায় জর্জরিত। তার বাল্য কেটেছে ‘সুখময় ঘুমঘোর স্বপনের মত’, আর যৌবনে ‘প্রকৃতি আছিল তার সঙ্গিনীর মত।’ তার কাছে ‘নিশাই কবিতা আর দিবাই বিজ্ঞান।’ সে দিবা নয় রাত্রিরই প্রেমিক, কারণ রাত্রি তার চোখের সামনে মেলে দেয় রহস্য, আর ‘সমস্ত জগৎ যেন স্বপ্নের মতন’ মনে হয় ৷ কিন্তু তাকে পীড়িত করার জন্যে রয়েছে তার ‘সিন্ধু-হৃদয়’, যেখানে তার অন্তরের আর্তির মতো দিনরাত বাতাস বয়ে যায়। রোম্যান্টিক বহিরস্থিতকে আকাশের চাতকের চেয়েও চঞ্চল আর আগুনের চেয়ে ভয়ংকরভাবে দগ্ধ করে তার হৃদয়। ওই হৃদয় কোনো শান্তি জানে না, তৃপ্তি জানে না- এ-কবির সমস্যাও হার্দিক : ‘আমার এ হৃদয়ের মাঝে/অনন্ত-অতৃপ্তি-তৃষ্ণা জ্বলিছে সদাই,/তাই দেবি পৃথিবীর পরিমিত কিছু পারে না গো জুড়াইতে হৃদয় আমার।’ তার কল্পনা তাকে যতো ওপরে উঠোয় তার শরীর ততোটা আরোহণ করতে না পারলেও মাঝে মাঝেই সে এক ‘তুষারমণ্ডিত সমুচ্চ পৰ্ব্বতশিরে’ একলা আরোহণ করে। কিন্তু তার হৃদয় ও স্বপ্নের যৌথ চক্রান্তে বাতিল হয়ে যায় তৃপ্তি, শান্তি, এবং সে বারবার চিৎকার হাহাকার ক’রে ওঠে–’এত কাল হে প্রকৃতি করিনু তোমার সেবা,/তবু কেন এ হৃদয় পুরিল না দেবি’, বা ‘মনের অন্তর-তলে কি যে কি করিছে হুহু’, বা ‘রাক্ষসী স্বপ্নের তরে ঘুমালেও শান্তি নাই।’ তার দেখা হয় নলিনীর সাথে, যে দেখা মাত্রই তার প্রেমে পড়ে। তবে ওই প্রকৃতি আর নলিনীর প্রেম মোচন করতে পারে না রোম্যান্টিক বহিরস্থিতের প্রাণের শূন্যতা। তার মনে হয়, ‘স্বাধীন বিহঙ্গ-সম, কবিদের তরে দেবি/পৃথিবীর কারাগার যোগ্য নহে কভু।’ একটিই হয়ে ওঠে তার সমস্যা, কিছুতেই ঘোচে না তার প্রাণের শূন্যতা। হাহাকার করতে থাকে সে- ‘প্রাণের শূন্যতা কেন ঘুচিল না বালা’, ‘এখনও পুরিল না প্রাণের শূন্যতা’, ‘প্রাণের শূন্যতা তবু ঘুচিল না কেন?’ প্রকৃতির যতো অতুল সৌন্দর্য, প্রণয়ের যতো সুধা আর কল্পনার যতো তরল স্বর্গীয় গীতি আছে, সবই সে হৃদয়ে ঢেলে দিয়েছে, তবু দুর্ভর হৃদয়ের শূন্যতা ঘোচে নি। কিন্তু তার মন যতোই মরুভূমি হোক-না-কেনো, সে তার হৃদয়কে হত্যা করবে না, যেমন টেনিসন ধ্বংস করতে চান নি তাঁর ‘প্যালেস অফ আর্ট’। তারপর কবি, প্রেমিকার সব আবেদন উপেক্ষা ক’রে, বেরিয়ে পড়ে পৃথিবী পর্যটনে– ‘কত দেশ দেশান্তরে ভ্রমিল সে কবি!’ তুষারস্তম্ভিত পর্বত, কণ্টকময় অরণ্য পেরিয়ে গেলো, কিন্তু কিছুই তার হৃদয়কে জুড়োতে পারে নি। সে নিঃসঙ্গ থেকে নিঃসঙ্গতর হয়ে বৃদ্ধ হয়, এবং ‘একদিন হিমাদ্রির নিশীথ বায়ুতে/কবির অন্তিম শ্বাস গেল মিশাইয়া।’ বিজন কবি বিজনেই ঝ’রে যায় ৷
বন-ফুল-এর বিজন বনফুলের নাম কমলা, যে জানে না ‘সংসার, মানুষ কাহারে বলে।’ কমলাকে বিজন অরণ্য থেকে সমাজ-সংসারে নিয়ে আসে বিজয়, এবং মানুষের সংস্পর্শে এসেই সে টের পায় নিজের হৃদয় ও তার অনির্বাণ দহনকে। বন-ফুল এ-কমলারই ঝ’রে যাওয়ার উপাখ্যান, তবে সংসারলোকে আসার পর যার সাথে জড়িত হয়ে চিত্তকে যে বিশেষভাবে দগ্ধ করতে সমর্থ হয়, তার নাম নীরদ, যে ‘আপনার ভাবে আপনি কবি/রাত দিন আহা রয়েছে ভোর!’ নীরদও রোম্যান্টিক বহিরস্থিত-মোহিনী কল্পনার মোহিনী বীণার ধ্বনি শুনে কাটে তার দিনরাত্রি। হৃদয়ের আগুন ও বিষাদ ঘিরে আছে তাকে। ওই আগুন ও বিষাদ থেকে সে মুক্তি পায় প্রতিহিংসাপরায়ণ বন্ধুর ছুরিকাঘাতে- মৃত্যুতে।
ভগ্ন-হৃদয়-এর প্রধান চরিত্রটি কবি;-সেও দগ্ধ কবি-কাহিনী ও বন-ফুল-এর কবি দুজনের মতো। তারও সমস্যা তার বিশাল হৃদয়ের ভার। কল্পনা ও স্বপ্ন দ্বারা সেও বিশদভাবে আবৃত। ‘জীবন্ত স্বপ্নের মতো’ সে একা একা বেড়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন অরণ্যে, একমনে শোনে ‘স্তদ্ধতার মুখ হোতে কথা কত শত!’ তার অন্তর এক ‘অশান্তি আলয়’, তার হৃদয় নবজাত গরুড়ের মতো অস্থির, বিশ্রামহীন ও ক্লান্ত। কল্পনার বিষ সে প্রাণ ভ’রে পান করেছে, তাই তার মন অবসন্ন। সে হাহাকার ক’রে ওঠে– ‘আর কত দিন সুখহীন শান্তিহীন/হাহা কোরে বেড়াইব নিরাশ্রয় মন লোয়ে!/ পারি নে, পারি নে আর- পাষাণ মনের ভার/বহিয়া পড়েছি, সখি, অতি শান্ত ক্লান্ত হোয়ে।’ তার জীবন মরুভূমির মতো, বুকের ভেতর নিরাশার বিষশ্বাস। একলা বিজনে ব’সে সে কাঁদে। ভগ্নহৃদয়-এর কবির সমস্যা তার হৃদয়ের সমস্যা- কাউকে সে ভালোবাসতে পারছে না। কারণ, তার মনের মধ্যে যে-আদর্শ সৌন্দর্য জেগে আছে, পৃথিবীতে তা দুর্লভ। দীর্ঘ কাব্যের শেষে রোম্যান্টিক বহিরস্থিত এ-কবি যার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়, সে মৃত্যুপথযাত্রী;- বিবাহের সাথে সাথেই সে পৃথিবীকে বিদায় জানায়। তাই রোম্যান্টিক বহিরস্থিত কবি বিবাহিত হয় যেন মৃত্যুর সাথেই।
রুদ্রচণ্ড-এও আছে এক কবি, যার নাম চাঁদ কবি। রবীন্দ্রনাথের কবি-চরিত্রদের মধ্যে সে-ই একমাত্র সক্রিয় চরিত্র। অন্যরা নিষ্ক্রিয়, অপর জগতের স্বাপ্নিক, কিন্তু সে সক্রিয়, আর বাস্তবকে নিয়ন্ত্রণ করে অনেকখানি। যুদ্ধের মতো ব্যাপারকেও সে ভয় পায় না, বরং তাতে পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু পৃথ্বীরাজের পতনের পর সেও স্থির করে–ভ্রমিব সন্ন্যাসী বেশে শ্মশানে শ্মশানে। তারও হৃদয়ের অসম্পূর্ণ কথা অকথিতই থেকে যায়। বাল্মীকিপ্রতিভায় যে-আদিকবির আবির্ভাব ঘটে, আকস্মিক অনুপ্রেরণায় যে-দস্যু কবি হয়ে ওঠে, সেও হয়ে ওঠে এক রোম্যান্টিক বহিরস্থিত। সেও শূন্য মনে অস্থিরভাবে বিচরণ করে বনে বনে : ব্যাকুল হয়ে বনে বনে/ভ্রমি একেলা শূন্য মনে!/কে পুরাবে মোর শূন্য এ হিয়া,/জুড়াবে প্রাণ সুধাবরিষণে!’ সুদুর্ভর হৃদয়ভার পীড়িত করে তাঁকেও : ‘শূন্য হৃদয় আর বহিতে যে পারি না,/পারি না গো পারি না আর।’ এমন এক সময়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা থেকে জন্ম নেয় বাল্মীকি, যখন অসম্ভব ছিলো প্রাচীন কবির ধ্রুপদী বৈশিষ্ট্য রক্ষা করা, তাই ধ্রুপদী বাল্মীকির মধ্যে রোম্যান্টিক বহিরস্থিত রবীন্দ্রনাথ সংক্রামিত করে দেন নিজেকেই। তাই এ-গীতিনাট্যের গোপন নাম হ’তে পারে রবীন্দ্রপ্রতিভা। এ-নাটকেই রবীন্দ্রনাথ প্রথম সংঘর্ষে আসেন লক্ষ্মীনিয়ন্ত্রিত সমাজের সাথে, এবং বিহারীলাল চক্রবর্তীর পংক্তি ঋণ ক’রে প্রত্যাখ্যান করেন লক্ষ্মীকে : ‘যাও লক্ষ্মী অলকায়, যাও লক্ষ্মী অমরায়,/এ বনে এস না, এস না, এস না এ দীনজন-কুটীরে!”
এর মাঝে তাঁর জীবনের দু-দশক কেটে গেছে, এবং নানা বাস্তব চাপে ঘোর কেটে যেতে শুরু করেছে স্বপ্নের, স্পষ্ট সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ‘আকাশকুসুমবনে স্বপন চয়ন’ ব্যাহত হওয়ার। এতোদিন ধ’রে তিনি যে প্রতিবেশ ও বাস্তবকে সম্পূর্ণ ভুলে স্বপ্ন-ও মনো-বিশ্বকেই নিজের বিশ্ব ক’রে নিয়েছিলেন, তা যেনো প্রতিবেশের আক্রমণে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। কড়ি ও কোমল-এ তাই দেখা দেয় স্বপ্ন ও বাস্তবের সংঘর্ষ। সংঘর্ষ সব সময়ই পীড়াদায়ক, এবং সে-পীড়া ভোগ করতে শুরু করেছেন রোম্যান্টিক কবি। দেখতে পাচ্ছেন তিনি ‘দূর হতে আসিছে ঝটিকা’, যাতে ‘স্বপ্নরাজ্য ভেসে যাবে খর অশ্রুজলে।’ এ-কাব্যের প্রথম কবিতায়ই তিনি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে বেঁচে থাকার তীব্র অভিলাষ ব্যক্ত করেন আর ‘মরীচিকা’ কবিতায় মানুষের সাথে সুখেদুঃখে মিলেমিশে জীবনযাপনের উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। কিন্তু তা কি সম্ভব স্বপ্নান্ধের পক্ষে, যে বাস্তবের সাথে বিনিময় ক’রে নিয়েছে রহস্যলোককে? ‘স্বপ্নরুদ্ধ’ কবিতায় তাই ওই উদ্যোগের ব্যর্থতা ঘোষিত হয় স্বীকারোক্তিতে : ‘নিষ্ফল হয়েছি আমি সংসারের কাজে,/লোকমাঝে আঁখি তুলে পারি না চাহিতে।’ নিজের স্বপ্নঘোরাচ্ছন্ন অবস্থা মূর্ত করে তুলেছেন এক অসামান্য চিত্রকল্পে : ‘আমি গাঁথি আপনার চারি দিক ঘিরে/সূক্ষ্ম রেশমের জাল কীটের মতন।/মগ্ন থাকি আপনার মধুর তিমিরে,/দেখি না জগতের প্রকাণ্ড জীবন।’ আপন বহিরস্থিতো বুঝতে শুরু করেছেন তিনি এ-সময়ে, মুক্তিও চান তিনি ওই অবস্থা থেকে, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে বারবার গ্লানি-নির্বেদে দগ্ধ হ’তে থাকেন এ-সময়ে। দু-মুখো সংকটও দেখা দেয় তীব্রভাবে;- নিজের ‘অভিশপ্ত প্রেতের পিপাসা’ থেকে যেমন বেরিয়ে আসতে পারছেন না, আবার বেরিয়ে কোনো মতে মনুষ্যমগুলিতে পৌঁছোলে ‘সহস্রের কোলাহলে হয় পথহারা।’ বাস্তব-ঘোড়ার লাগাম ধরার বাসনা তাঁর তাই বারবার ভেঙে যায়, এবং খুঁজে ফেরেন নিজের বিজন স্বপ্নলোককেই। মানসীর ‘কবির প্রতি নিবেদন’-এ বাস্তববিতৃষ্ণ হয়ে আন্তর কবিকে প্রশ্ন করেছেন, ‘হেথা কেন দাঁড়ায়েছ, কবি,/যেন কাষ্ঠপুত্তলছবি?/…কোথা তব বিজন ভবন/কোথা তব মানসভুবন?’ বাস্তবতা তাঁর কাছে হয়ে উঠলো বিদেশ, যার ‘ধূলি আর কলরোল-মাঝে’ কবিকে মানায় না।
এ যে স্বপ্ন-কল্পনা-সৌন্দর্য-বিষাদ-ঘেরা জগত- বহিরস্থিত জগত ও জীবন-বহিরস্থিত জীবন, তার দিকে রবীন্দ্রনাথ মধ্যযৌবন থেকেই বস্তুগত দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন বারবার। আত্মকেন্দ্রিক ওই জগত-জীবন কখনো দেখা দিয়েছে রেশম-কীটের রূপকে, কখনো ‘সুখরৌদ্রমরীচিকা’ রূপে। রোম্যান্টিক বহিরস্থিত কবি অবিস্মরণীয় হয়ে আছে দুটি আকর্ষণীয় রূপকে- চিত্রার ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় ‘ছিন্নবাধা পলাতক বালক’-এর রূপকে, যে ‘মধ্যাহ্নে মাঠের মাঝে একাকী বিষণ্ণ তরুচ্ছায়ে/দূরবনগন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তপ্ত বায়ে’ সারাদিন বাঁশি বাজায়; আর ‘আবেদন’-এ কর্মভীরু অলস মালাকররূপে। ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় কবি হয়ে উঠেছেন পলাতক রাখাল বাঁশরিয়া, যাঁর চারদিকে আলস্য-বিষণ্ণতা ও সুরগুঞ্জন। এ-জগত বহিরস্থিতের, আর সেখান থেকে স’রে যেতে চান কবি, প্রবেশ করতে চান সে-বাস্তবে, যেখানে সবাই সারাক্ষণ শতকর্মে রত। এ-কবিতাটিতে স্বপ্নলোক ও বস্তুলোকের বৈপরীত্য আঁকা হয়েছে ব্যাপকভাবে। স্বপ্নলোকের যে-ছবি পাওয়া যায়, তা নিম্নরূপ : সেখানে বিষণ্ণ তরুচ্ছায়ে দূর বনের গন্ধভরা ক্লান্ত তপ্ত বাতাস বয়ে যায় ধীর গতিতে, রঙ্গময়ী কল্পনা কবিকে ‘সমীরে সমীরে তরঙ্গে তরঙ্গে’ দুলিয়ে মোহিনী মায়ায় ভুলিয়ে রাখে, আর বসিয়ে রাখে “বিজন বিষাদঘন অন্তরের নিকুঞ্জচ্ছায়ায়’। সেখানে সন্ধ্যায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বন কেঁদে ওঠে। এ-স্বপ্নলোককে ‘সৃষ্টিছাড়া সৃষ্টি’ ব’লে তিরস্কার করেছেন তিনি, কেননা সেখানে একাকী সঙ্গীহীন থাকতে হয়, এবং সেখানে থেকেছেন তিনি বহুকাল। তাই তাঁর বেশ অপরূপ, আচার ভিন্ন, চোখে স্বপ্নাবেশ আর বুকে ক্ষুধার আগুন। জন্মের মুহূর্তেই তাঁর হাতে উঠে আসে একটি বাঁশি, যা ‘বাজাতে বাজাতে তাই মুগ্ধ হয়ে আপনার সুরে/দীর্ঘদিন দীর্ঘরাত্রি চলে গেনু একান্ত সুদূরে/ছাড়ায়ে সংসারসীমা। এ-অদ্ভুত কল্পবিশ্বের বিপরীতে আছে বাস্তবলোক, যাকে তিনি বলেন ‘সংসার’। ওই সংসার কি আকর্ষণীয়? ওই সংসারকে যে-সমস্ত রূপকে বর্ণনা করেছেন, তাতে তা হয়ে উঠেছে ভয়াবহ : ‘আগুন লেগেছে কোথা। কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি/জাগাতে জগ ৎ-জনে! কোথা হতে ধ্বনিছে ক্রন্দনে/শূন্যতল!’ আগুন, আর শঙ্খ আর ক্রন্দন এবং আরো এমন অজস্র বাস্তবতার মধ্যে কি ফিরে যেতে পারে রোম্যান্টিক বহিরস্থিত? এর উত্তর একটি বিশাল ‘না’। তাই দেখা যায় ‘এবার ফিরাও মোরে’র অপরিচিত, যে জনতাকে ডেকে বলে–’আমি নহি পরিচিত, মোর পানে ফিরিয়া তাকাও’, সে আবার অপরিচিতলোকেই ফিরে যায়। তবে এবার আর রোম্যান্টিকের সৌন্দর্য-কল্পনা-স্বপ্নময় বিশ্বে নয়, এবার যায় মিস্টিকের জগতে এমন এক সত্যের সন্ধানে, যে-সত্য এক বিরাট মিথ্যা।
‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় তবু একটি বড়ো অংশ জুড়ে আছে দ্বন্দ্ব-অস্বস্তি, কিন্তু ‘আবেদন’-এ লোপ পেয়েছে সব দ্বন্দ্ব ও অস্বস্তি; রোম্যান্টিক বহিরস্থিত শান্ত শোণিতে ফিরে গেছে তার নিষ্ক্রিয় সৌন্দর্য ও হৃদয়ের জগতে। ‘আবেদন’ রবীন্দ্রনাথের ‘অবসরের গান’, রাজ্য- জয়- সাম্রাজ্যের কথা ভুলে একদা-কর্মী এ-কবিতায় হয়ে ওঠে ‘খ্যাতিহীন, কর্মহীন স্বেচ্ছাবন্দী দাস’- মালঞ্চের মালাকর। রাণীকে সে জানায় : ‘অবসর/লব সব কাজে। যুদ্ধ-অস্ত্র ধনুঃশর/ফেলিনু ভূতলে, এ উষ্ণীষ রাজসাজ/রাখিনু চরণে তব– যত উচ্চ কাজ/সব ফিরে লও দেবী।’ সব সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থেকে অবসর নিয়ে স্থান ক’রে নিতে চায় রূপবতী কুমারী রানীর বিজন বিরল বাতায়নতলের মালঞ্চে, হয়ে উঠতে চায়, রাণীর ভাষায়, ‘কর্মভীরু অলস কিঙ্কর’। এ-ভৃত্য নিশ্চয়ই এতোদিন রানীর সাম্রাজ্যের সীমা ও গৌরব বাড়িয়েছে, সাধন করেছে বীর্যময় অনেক রাজকীয় কর্ম, এবং এখন নিতে চায় ‘অকাজের কাজ যত,/আলস্যের সহস্রসঞ্চয়’-এর মতো নিষ্ক্রিয় দায়িত্ব। রানী তাকে বরণ ক’রে নেয় খ্যাতিহীন কর্মহীন স্বেচ্ছাবন্দী দাসরূপে। এ-কবিতার আবেদনকারী বহিরস্থিত, কিন্তু প্রশান্ত, তৃপ্ত, যেনো অনেক কীর্তির পর বুঝতে পেরেছে কীর্তিতে শান্তি নেই, সুখ নেই যশের গৌরবে; বরং জীবন সোনায় ভ’রে ওঠে এমন কারো স্পর্শে, এমন কাউকে স্পর্শ ক’রে যাকে আলিঙ্গনে পাওয়া যাবে না কখনো। ‘আবেদন’-এ পাই রোম্যান্টিক বহিরস্থিত রবীন্দ্রনাথকে, যিনি আর হৃদয়ভার-কল্পনা-স্বপ্নের দ্বারা পীড়িত নন, বাস্তবের সাথে দ্বন্দ্বরত নন, বরং বাস্তবকে জয় ক’রে তাকে তুচ্ছ ব’লে পরিহার করতে পারেন, এবং স্বপ্ন-কল্পনা-হৃদয়কে নিয়ন্ত্ৰণ করেন অধিপতির মতো। এ-বহিরস্থিত অতৃপ্ত, অশান্ত, চঞ্চল নয়, বরং পরিতৃপ্ত, প্রশান্ত, সুস্থির।
স্থূল বাস্তবতা-ও জীবন-বাদী শিল্পকলাবিরোধীদের কাছে রোম্যান্টিক বহিরস্থিত শুধু সমস্যা নয়, শত্রু, এবং তাঁর সৃষ্টি তিরস্কৃত। কিন্তু পলায়নের ও নিষ্ক্রিয়তার কবিতাও অসামান্য হ’তে পারে, এবং সাধারণত সক্রিয় ক্রুদ্ধ কবিতার চেয়ে নিষ্ক্রিয়, আলস্যের কবিতাই শিল্পগুণে উৎকৃষ্টতর হয়। বহিরস্থিতরা তিরস্কারযোগ্য নয়, বরং তারা আমাদের চোখের সামনে রহস্যময় মানুষের অনেক রহস্য মেলে ধরে। রবীন্দ্রনাথ চৌত্রিশ বছর পর্যন্ত ছিলেন স্পষ্টত বহিরস্থিত, তারপর হয়ে ওঠেন প্রচ্ছন্ন বহিরস্থিত-কোলাহলপূর্ণ সংসারকে নানাভাবে আয়ত্তে আনেন, নিয়ন্ত্রণ করেন, কিন্তু অন্তরে থেকে যান সে-রোম্যানটিক কবি, বাস্তব যাঁর কাছে বিদেশ, আর স্বপ্ন-রহস্য-কল্পনা স্বদেশ।