ম্লান হয়ে এল কণ্ঠে মন্দারমালিকা , হে মহেন্দ্র , নির্বাপিত জ্যোতির্ময় টিকা মলিন ললাটে । পুণ্যবল হল ক্ষীণ , আজি মোর স্বর্গ হতে বিদায়ের দিন , হে দেব , হে দেবীগণ । বর্ষ লক্ষশত যাপন করেছি হর্ষে দেবতার মতো দেবলোকে । আজি শেষ বিচ্ছেদের ক্ষণে লেশমাত্র অশ্রুরেখা স্বর্গের নয়নে দেখে যাব এই আশা ছিল । শোকহীন হৃদিহীন সুখস্বর্গভূমি , উদাসীন চেয়ে আছে । লক্ষ লক্ষ বর্ষ তার চক্ষের পলক নহে ; অশ্বত্থশাখার প্রান্ত হতে খসি গেলে জীর্ণতম পাতা যতটুকু বাজে তার , ততটুকু ব্যথা স্বর্গে নাহি লাগে , যবে মোরা শত শত গৃহচ্যুত হতজ্যোতি নক্ষত্রের মতো মুহূর্তে খসিয়া পড়ি দেবলোক হতে ধরিত্রীর অন্তহীন জন্মমৃত্যুস্রোতে । সে বেদনা বাজিত যদ্যপি , বিরহের ছায়ারেখা দিত দেখা , তবে স্বরগের চিরজ্যোতি ম্লান হত মর্তের মতন কোমল শিশিরবাষ্পে — নন্দনকানন মর্মরিয়া উঠিত নিশ্বসি , মন্দাকিনী কূলে কূলে গেয়ে যেত করুণ কাহিনী কলকণ্ঠে , সন্ধ্যা আসি দিবা-অবসানে নির্জন প্রান্তর-পারে দিগন্তের পানে চলে যেত উদাসিনী , নিস্তব্ধ নিশীথ ঝিল্লিমন্ত্রে শুনাইত বৈরাগ্যসংগীত নক্ষত্রসভায় । মাঝে মাঝে সুরপুরে নৃত্যপরা মেনকার কনকনূপুরে তালভঙ্গ হত । হেলি উর্বশীর স্তনে স্বর্ণবীণা থেকে থেকে যেন অন্যমনে অকস্মাৎ ঝংকারিত কঠিন পীড়নে নিদারুণ করুণ মূর্ছনা । দিত দেখা দেবতার অশ্রুহীন চোখে জলরেখা নিষ্কারণে । পতিপাশে বসি একাসনে সহসা চাহিত শচী ইন্দ্রের নয়নে যেন খুঁজি পিপাসার বারি । ধরা হতে মাঝে মাঝে উচ্ছ্বসি আসিত বায়ুস্রোতে ধরণীর সুদীর্ঘ নিশ্বাস — খসি ঝরি পড়িত নন্দনবনে কুসুমমঞ্জরী । থাকো স্বর্গ হাস্যমুখে , করো সুধাপান দেবগণ । স্বর্গ তোমাদেরি সুখস্থান — মোরা পরবাসী । মর্তভূমি স্বর্গ নহে , সে যে মাতৃভূমি — তাই তার চক্ষে বহে অশ্রুজলধারা , যদি দু দিনের পরে কেহ তারে ছেড়ে যায় দু দণ্ডের তরে । যত ক্ষুদ্র , যত ক্ষীণ , যত অভাজন , যত পাপীতাপী , মেলি ব্যগ্র আলিঙ্গন সবারে কোমল বক্ষে বাঁধিবারে চায় — ধূলিমাখা তনুস্পর্শে হৃদয় জুড়ায় জননীর । স্বর্গে তব বহুক অমৃত , মর্তে থাক্ সুখে দুঃখে অনন্তমিশ্রিত প্রেমধারা — অশ্রুজলে চিরশ্যাম করি ভূতলের স্বর্গখণ্ডগুলি । হে অপ্সরী , তোমার নয়নজ্যোতি প্রেমবেদনায় কভু না হউক ম্লান — লইনু বিদায় । তুমি কারে কর না প্রার্থনা , কারো তরে নাহি শোক । ধরাতলে দীনতম ঘরে যদি জন্মে প্রেয়সী আমার , নদীতীরে কোনো-এক গ্রামপ্রান্তে প্রচ্ছন্ন কুটিরে অশ্বত্থছায়ায় , সে বালিকা বক্ষে তার রাখিবে সঞ্চয় করি সুধার ভাণ্ডার আমারি লাগিয়া সযতনে । শিশুকালে নদীকূলে শিবমূর্তি গড়িয়া সকালে আমারে মাগিয়া লবে বর । সন্ধ্যা হলে জ্বলন্ত প্রদীপখানি ভাসাইয়া জলে শঙ্কিত কম্পিত বক্ষে চাহি একমনা করিবে সে আপনার সৌভাগ্যগণনা একাকী দাঁড়ায়ে ঘাটে । একদা সুক্ষণে আসিবে আমার ঘরে সন্নত নয়নে চন্দনচর্চিত ভালে রক্তপট্টাম্বরে , উৎসবের বাঁশরীসংগীতে । তার পরে সুদিনে দুর্দিনে , কল্যাণকঙ্কণ করে , সীমন্তসীমায় মঙ্গলসিন্দূরবিন্দু , গৃহলক্ষ্মী দুঃখে সুখে , পূর্ণিমার ইন্দু সংসারের সমুদ্রশিয়রে । দেবগণ , মাঝে মাঝে এই স্বর্গ হইবে স্মরণ দূরস্বপ্নসম , যবে কোনো অর্ধরাতে সহসা হেরিব জাগি নির্মল শয্যাতে পড়েছে চন্দ্রের আলো , নিদ্রিতা প্রেয়সী লুণ্ঠিত শিথিল বাহু , পড়িয়াছে খসি গ্রন্থি শরমের — মৃদু সোহাগচুম্বনে সচকিতে জাগি উঠি গাঢ় আলিঙ্গনে লতাইবে বক্ষে মোর — দক্ষিণ অনিল আনিবে ফুলের গন্ধ , জাগ্রত কোকিল গাহিবে সুদূর শাখে । অয়ি দীনহীনা , অশ্রু-আঁখি দুঃখাতুর জননী মলিনা , অয়ি মর্ত্যভূমি । আজি বহুদিন পরে কাঁদিয়া উঠেছে মোর চিত্ত তোর তরে । যেমনি বিদায়দুঃখে শুষ্ক দুই চোখ অশ্রুতে পুরিল , অমনি এ স্বর্গলোক অলস কল্পনাপ্রায় কোথায় মিলালো ছায়াচ্ছবি । তব নীলাকাশ , তব আলো , তব জনপূর্ণ লোকালয় , সিন্ধুতীরে সুদীর্ঘ বালুকাতট , নীল গিরিশিরে শুভ্র হিমরেখা , তরুশ্রেণীর মাঝারে নিঃশব্দ অরুণোদয় , শূন্য নদীপারে অবনতমুখী সন্ধ্যা — বিন্দু-অশ্রুজলে যত প্রতিবিম্ব যেন দর্পণের তলে পড়েছে অসিয়া । হে জননী পুত্রহারা , শেষ বিচ্ছেদের দিনে যে শোকাশ্রুধারা চক্ষু হতে ঝরি পড়ি তব মাতৃস্তন করেছিল অভিষিক্ত , আজি এতক্ষণ সে অশ্রু শুকায়ে গেছে । তবু জানি মনে যখনি ফিরিব পুন তব নিকেতনে তখনি দুখানি বাহু ধরিবে আমায় , বাজিবে মঙ্গলশঙ্খ , স্নেহের ছায়ায় দুঃখে-সুখে-ভয়ে-ভরা প্রেমের সংসারে তব গেহে , তব পুত্রকন্যার মাঝারে আমারে লইবে চিরপরিচিতসম — তার পরদিন হতে শিয়রেতে মম সারাক্ষণ জাগি রবে কম্পমান প্রাণে , শঙ্কিত অন্তরে , ঊর্ধ্বে দেবতার পানে মেলিয়া করুণ দৃষ্টি , চিন্তিত সদাই যাহারে পেয়েছি তারে কখন হারাই ।