আজিকে হয়েছে শান্তি , জীবনের ভুলভ্রান্তি সব গেছে চুকে । রাত্রিদিন ধুক্ধুক্ তরঙ্গিত দুঃখসুখ থামিয়াছে বুকে । যত কিছু ভালোমন্দ যত কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব কিছু আর নাই । বলো শান্তি , বলো শান্তি , দেহ-সাথে সব ক্লান্তি হয়ে যাক ছাই । গুঞ্জরি করুক তান ধীরে ধীরে করো গান বসিয়া শিয়রে । যদি কোথা থাকে লেশ জীবনস্বপ্নের শেষ তাও যাক মরে । তুলিয়া অঞ্চলখানি মুখ- ' পরে দাও টানি , ঢেকে দাও দেহ । করুণ মরণ যথা ঢাকিয়াছে সব ব্যথা সকল সন্দেহ । বিশ্বের আলোক যত দিগ্বিদিকে অবিরত যাইতেছে বয়ে , শুধু ওই আঁখি- ' পরে নামে তাহা স্নেহভরে অন্ধকার হয়ে । জগতের তন্ত্রীরাজি দিনে উচ্চে উঠে বাজি , রাত্রে চুপে চুপে সে শব্দ তাহার ‘ পরে চুম্বনের মতো পড়ে নীরবতারূপে । মিছে আনিয়াছ আজি বসন্তকুসুমরাজি দিতে উপহার । নীরবে আকুল চোখে ফেলিতেছ বৃথা শোকে নয়নাশ্রুধার । ছিলে যারা রোষভরে বৃথা এতদিন পরে করিছ মার্জনা । অসীম নিস্তব্ধ দেশে চিররাত্রি পেয়েছে সে অনন্ত সান্ত্বনা । গিয়েছে কি আছে বসে জাগিল কি ঘুমাল সে কে দিবে উত্তর । পৃথিবীর শ্রান্তি তারে ত্যজিল কি একেবারে জীবনের জ্বর! এখনি কি দুঃখসুখে কর্মপথ-অভিমুখে চলেছে আবার । অস্তিত্বের চক্রতলে একবার বাঁধা প ' লে পায় কি নিস্তার । বসিয়া আপন দ্বারে ভালোমন্দ বলো তারে যাহা ইচ্ছা তাই । অনন্ত জনমমাঝে গেছে সে অনন্ত কাজে , সে আর সে নাই । আর পরিচিত মুখে তোমাদের দুখে সুখে আসিবে না ফিরে । তবে তার কথা থাক্ , যে গেছে সে চলে যাক বিস্মৃতির তীরে । জানি না কিসের তরে যে যাহার কাজ করে সংসারে আসিয়া , ভালোমন্দ শেষ করি যায় জীর্ণ জন্মতরী কোথায় ভাসিয়া । দিয়ে যায় যত যাহা রাখো তাহা ফেলো তাহা যা ইচ্ছা তোমার । সে তো নহে বেচাকেনা — ফিরিবে না , ফেরাবে না জন্ম-উপহার । কেন এই আনাগোনা , কেন মিছে দেখাশোনা দু-দিনের তরে , কেন বুকভরা আশা , কেন এত ভালোবাসা অন্তরে অন্তরে , আয়ু যার এতটুক , এত দুঃখ এত সুখ কেন তার মাঝে , অকস্মাৎ এ সংসারে কে বাঁধিয়া দিল তারে শত লক্ষ কাজে — হেথায় যে অসম্পূর্ণ , সহস্র আঘাতে চূর্ণ বিদীর্ণ বিকৃত , কোথাও কি একবার সম্পূর্ণতা আছে তার জীবিত কি মৃত , জীবনে যা প্রতিদিন ছিল মিথ্যা অর্থহীন ছিন্ন ছড়াছড়ি মৃত্যু কি ভরিয়া সাজি তারে গাঁথিয়াছে আজি অর্থপূর্ণ করি — হেথা যারে মনে হয় শুধু বিফলতাময় অনিত্য চঞ্চল সেথায় কি চুপে চুপে অপূর্ব নূতন রূপে হয় সে সফল — চিরকাল এই-সব রহস্য আছে নীরব রুদ্ধ-ওষ্ঠাধর । জন্মান্তের নবপ্রাতে সে হয়তো আপনাতে পেয়েছে উত্তর । সে হয়তো দেখিয়াছে পড়ে যাহা ছিল পাছে আজি তাহা আগে , ছোটো যাহা চিরদিন ছিল অন্ধকারে লীন বড়ো হয়ে জাগে । যেথায় ঘৃণার সাথে মানুষ আপন হাতে লেপিয়াছে কালি নূতন নিয়মে সেথা জ্যোতির্ময় উজ্জ্বলতা কে দিয়াছে জ্বালি । কত শিক্ষা পৃথিবীর খসে পড়ে জীর্ণচীর জীবনের সনে , সংসারের লজ্জাভয় নিমেষেতে দগ্ধ হয় চিতাহুতাশনে । সকল অভ্যাস-ছাড়া সর্ব-আবরণ-হারা সদ্যশিশুসম নগ্নমূর্তি মরণের নিষ্কলঙ্ক চরণের সম্মুখে প্রণমো । আপন মনের মতো সংকীর্ণ বিচার যত রেখে দাও আজ । ভুলে যাও কিছুক্ষণ প্রত্যহের আয়োজন , সংসারের কাজ । আজি ক্ষণেকের তরে বসি বাতায়ন- ' পরে বাহিরেতে চাহো । অসীম আকাশ হতে বহিয়া আসুক স্রোতে বৃহৎ প্রবাহ । উঠিছে ঝিল্লির গান , তরুর মর্মরতান , নদীকলস্বর — প্রহরের আনাগোনা যেন রাত্রে যায় শোনা আকাশের'পর । উঠিতেছে চরাচরে অনাদি অনন্ত স্বরে সংগীত উদার — সে নিত্য-গানের সনে মিশাইয়া লহো মনে জীবন তাহার । ব্যাপিয়া সমস্ত বিশ্বে দেখো তারে সর্বদৃশ্যে বৃহৎ করিয়া । জীবনের ধূলি ধুয়ে দেখো তারে দূরে থুয়ে সম্মুখে ধরিয়া । পলে পলে দণ্ডে দণ্ডে ভাগ করি খণ্ডে খণ্ডে মাপিয়ো না তারে । থাক্ তব ক্ষুদ্র মাপ ক্ষুদ্র পুণ্য ক্ষুদ্র পাপ সংসারের পারে । আজ বাদে কাল যারে ভুলে যাবে একেবারে পরের মতন তারে লয়ে আজি কেন বিচার-বিরোধ হেন , এত আলাপন । যে বিশ্ব কোলের'পরে চিরদিবসের তরে তুলে নিল তারে তার মুখে শব্দ নাহি , প্রশান্ত সে আছে চাহি ঢাকি আপনারে । বৃথা তারে প্রশ্ন করি , বৃথা তার পায়ে ধরি , বৃথা মরি কেঁদে , খুঁজে ফিরি অশ্রুজলে — কোন্ অঞ্চলের তলে নিয়েছে সে বেঁধে । ছুটিয়া মৃত্যুর পিছে , ফিরে নিতে চাহি মিছে , সে কি আমাদের ? পলেক বিচ্ছেদে হায় তখনি তো বুঝা যায় সে যে অনন্তের । চক্ষের আড়ালে তাই কত ভয় সংখ্যা নাই , সহস্র ভাবনা । মুহূর্ত মিলন হলে টেনে নিই বুকে কোলে , অতৃপ্ত কামনা । পার্শ্বে বসে ধরি মুঠি , শব্দমাত্রে কেঁপে উঠি , চাহি চারিভিতে , অনন্তের ধনটিরে আপনার বুক চিরে চাহি লুকাইতে । হায় রে নির্বোধ নর , কোথা তোর আছে ঘর , কোথা তোর স্থান । শুধু তোর ওইটুকু অতিশয় ক্ষুদ্র বুক ভয়ে কম্পমান । ঊর্ধ্বে ওই দেখ্ চেয়ে সমস্ত আকাশ ছেয়ে অনন্তের দেশ — সে যখন এক ধারে লুকায়ে রাখিবে তারে পাবি কি উদ্দেশ ? ওই হেরো সীমাহারা গগনেতে গ্রহতারা অসংখ্য জগৎ , ওরি মাঝে পরিভ্রান্ত হয়তো সে একা পান্থ খুঁজিতেছে পথ । ওই দূর-দূরান্তরে অজ্ঞাত ভুবন- ' পরে কভু কোনোখানে আর কি গো দেখা হবে , আর কি সে কথা কবে , কেহ নাহি জানে । যা হবার তাই হোক , ঘুচে যাক সর্ব শোক , সর্ব মরীচিকা । নিবে যাক চিরদিন পরিশ্রান্ত পরিক্ষীণ মর্তজন্মশিখা । সব তর্ক হোক শেষ , সব রাগ সব দ্বেষ , সকল বালাই । বলো শান্তি , বলো শান্তি , দেহ-সাথে সব ক্লান্তি পুড়ে হোক ছাই ।