প্রথম শীতের মাসে শিশির লাগিল ঘাসে , হুহু করে হাওয়া আসে , হিহি করে কাঁপে গাত্র । আমি ভাবিলাম মনে এবার মাতিব রণে , বৃথা কাজে অকারণে কেটে গেছে দিনরাত্র । লাগিব দেশের হিতে গরমে বাদলে শীতে , কবিতা নাটকে গীতে করিব না অনাসৃষ্টি । লেখা হবে সারবান অতিশয় ধারবান , খাড়া রব দ্বারবান দশ দিকে রাখি দৃষ্টি । এত বলি গৃহকোণে বসিলাম দৃঢ়মনে লেখকের যোগাসনে , পাশে লয়ে মসীপাত্র । নিশিদিন রুধি দ্বার স্বদেশের শুধি ধার , নাহি হাঁফ ছাড়িবার অবসর তিলমাত্র । রাশি রাশি লিখে লিখে একেবারে দিকে দিকে মাসিকে ও সাপ্তাহিকে করিলাম লেখাবৃষ্টি । ঘরেতে জ্বলে না চুলো , শরীরে উড়িছে ধুলো , আঙুলের ডগাগুলো হয়ে গেল কালিকৃষ্টি । খুঁটিয়া তারিখ মাস করিলাম রাশ রাশ গাঁথিলাম ইতিহাস , রচিলাম পুরাতত্ত্ব । গালি দিয়া মহারাগে দেখালেম দাগে দাগে যে যাহা বলেছে আগে কিছু তার নহে সত্য । পুরানে বিজ্ঞানে গোটা করিয়াছি সিদ্ধি-ঘোঁটা , যাহা-কিছু ছিল মোটা হয়ে গেছে অতি সূক্ষ্ম । করেছি সমালোচনা আছে তাহে গুণপনা , কেহ তাহা বুঝিল না মনে রয়ে গেল দুঃখ । মেঘদূত — লোকে যাহা কাব্যভ্রমে বলে “ আহা ” — আমি দেখায়েছি তাহা দর্শনের নব সূত্র । নৈষধের কবিতাটি ডারুয়িন-তত্ত্ব খাঁটি , মোর আগে এ কথাটি বলো কে বলেছে কুত্র । কাব্য কহিবার ভানে নীতি বলি কানে কানে সে কথা কেহ না জানে , না বুঝে হতেছে ইষ্ট । নভেল লেখার ছলে শিখায়েছি সুকৌশলে সাদাটিরে সাদা বলে , কালো যাহা তাই কৃষ্ট । কত মাস এইমতো একে একে হল গত , আমি দেশহিতে রত সব দ্বার করি বন্ধ । হাসি-গীত-গল্পগুলি ধূলিতে হইল ধূলি , বেঁধে দিয়ে চোখে ঠুলি কল্পনারে করি অন্ধ । নাহি জানি চারি পাশে কী ঘটিছে কোন্ মাসে , কোন্ ঋতু কবে আসে , কোন্ রাতে উঠে চন্দ্র । আমি জানি রুশিয়ান কত দূরে আগুয়ান , বজেটের খতিয়ান কোথা তার আছে রন্ধ্র । আমি জানি কোন্ দিন পাস হল কী আইন , কুইনের বেহাইন বিধবা হইল কল্য — জানি সব আটঘাট , গেজেটে করেছি পাঠ আমাদের ছোটোলাট কোথা হতে কোথা চলল । একদিন বসে বসে লিখিয়া যেতেছি কষে এ দেশেতে কার দোষে ক্রমে কমে আসে শস্য , কেনই বা অপঘাতে মরে লোক দিবারাতে , কেন ব্রাহ্মণের পাতে নাহি পড়ে চ ব্য চোষ্য । হেন কালে দুদ্দাড় খুলে গেল সব দ্বার — চারি দিকে তোলপাড় বেধে গেছে মহাকাণ্ড । নদীজলে বনে গাছে কেহ গাহে কেহ নাচে , উলটিয়া পড়িয়াছে দেবতার সুধাভাণ্ড । উতলা পাগল-বেশে দক্ষিণে বাতাস এসে কোথা হতে হাহা হেসে প ' ল যেন মদমত্ত । লেখাপত্র কেড়েকুড়ে — কোথা কী যে গেল উড়ে , ওই রে আকাশ জুড়ে ছড়ায় ‘ সমাজতত্ত্ব ' । ‘ রুশিয়ার অভিপ্রায় ' ওই কোথা উড়ে যায় , গেল বুঝি হায় হায় ‘ আমিরের ষড়যন্ত্র ' । ‘ প্রাচীন ভারত ' বুঝি আর পাইব না খুঁজি , কোথা গিয়ে হল পুঁজি ‘ জাপানের রাজতন্ত্র ' । গেল গেল , ও কী কর — আরে আরে , ধরো ধরো । হাসে বন মরমর , হাসে বায়ু কলহাস্যে । উঠে হাসি নদীজলে ছলছল কলকলে , ভাসায়ে লইয়া চলে ‘ মনুর নূতন ভাষ্যে ' । বাদ-প্রতিবাদ যত শুকনো পাতার মতো কোথা হল অপগত — কেহ তাহে নহে ক্ষুণ্ন । ফুলগুলি অনায়াসে মুচকি মুচকি হাসে , সুগভীর পরিহাসে হাসিতেছে নীল শূন্য । দেখিতে দেখিতে মোর লাগিল নেশার ঘোর , কোথা হতে মন-চোর পশিল আমার বক্ষে । যেমনি সমুখে চাওয়া অমনি সে ভূতে-পাওয়া লাগিল হাসির হাওয়া , আর বুঝি নাহি রক্ষে । প্রথমে প্রাণের কূলে শিহরি শিহরি দুলে , ক্রমে সে মরমমূলে লহরী উঠিল চিত্তে । তার পরে মহা হাসি উছসিল রাশি রাশি , হৃদয় বাহিরে আসি মাতিল জগৎ-নৃত্যে । এসো এসো , বঁধু , এসো — আধেক আঁচরে বোসো , অবাক অধরে হাসো ভুলাও সকল তত্ত্ব । তুমি শুধু চাহ ফিরে — ডুবে যাক ধীরে ধীরে সুধাসাগরের নীরে যত মিছা যত সত্য । আনো গো যৌবনগীতি , দূরে চলে যাক নীতি , আনো পরানের প্রীতি , থাক্ প্রবীণের ভাষ্য । এসো হে আপনহারা প্রভাতসন্ধ্যার তারা বিষাদের আঁখিধারা , প্রমোদের মধুহাস্য । আনো বাসনার ব্যথা , অকারণ চঞ্চলতা , আনো কানে কানে কথা , চোখে চোখে লাজদৃষ্টি । অসম্ভব , আশাতীত , অনাবশ্য , অনাদৃত , এনে দাও অযাচিত যত-কিছু অনাসৃষ্টি । হৃদয়নিকুঞ্জমাঝ এসো আজি ঋতুরাজ , ভেঙে দাও সব কাজ প্রেমের মোহনমন্ত্রে । হিতাহিত হোক দূর — গাব গীত সুমধুর , ধরো তুমি ধরো সুর সুধাময়ী বীণা-যন্ত্রে ।