ভৃত্য । জয় হোক মহারানী । রাজরাজেশ্বরী , দীন ভৃত্যে করো দয়া । রানী । সভা ভঙ্গ করি সকলেই গেল চলি যথাযোগ্য কাজে আমার সেবকবৃন্দ বিশ্বরাজ্যমাঝে , মোর আজ্ঞা মোর মান লয়ে শীর্ষদেশে জয়শঙ্খ সগর্বে বাজায়ে । সভাশেষে তুমি এলে নিশান্তের শশাঙ্ক-সমান ভক্ত ভৃত্য মোর । কী প্রার্থনা ? ভৃত্য । মোর স্থান সর্বশেষে , আমি তব সর্বাধম দাস মহোত্তমে । একে একে পরিতৃপ্ত-আশ সবাই আনন্দে যবে ঘরে ফিরে যায় সেইক্ষণে আমি আসি নির্জন সভায় , একাকী আসীনা তব চরণতলের প্রান্তে বসে ভিক্ষা মাগি শুধু সকলের সর্ব-অবশেষটুকু । রানী । অবোধ ভিক্ষুক , অসময়ে কী তোরে মিলিবে । ভৃত্য । হাসিমুখ দেখে চলে যাব । আছে দেবী , আরো আছে — নানা কর্ম নানা পদ নিল তোর কাছে নানা জনে ; এক কর্ম কেহ চাহে নাই , ভৃত্য- ' পরে দয়া করে দেহো মোরে তাই — আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর । রানী । মালাকর ? ভৃত্য । ক্ষুদ্র মালাকর । অবসর লব সব কাজে । যুদ্ধ-অস্ত্র ধনুঃশর ফেলিনু ভূতলে , এ উষ্ণীষ রাজসাজ রাখিনু চরণে তব — যত উচ্চকাজ সব ফিরে লও দেবী । তব দূত করি মোরে আর পাঠায়ো না , তব স্বর্ণতরী দেশে দেশান্তরে লয়ে । জয়ধ্বজা তব দিগ্দিগন্তে করিয়া প্রচার , নব নব দিগ্বিজয়ে পাঠায়ো না মোরে । পরপারে তব রাজ্য কর্মযশধনজনভারে অসীমবিস্তৃত — কত নগরনগরী , কত লোকালয় , বন্দরেতে কত তরী , বিপণিতে কত পণ্য — ওই দেখো দূরে মন্দিরশিখরে আর কত হর্ম্যচূড়ে দিগন্তেরে করিছে দংশন , কলোচ্ছ্বাস শ্বসিয়া উঠিছে শূন্যে করিবারে গ্রাস নক্ষত্রের নিত্যনীরবতা । বহু ভৃত্য আছে হোথা , বহু সৈন্য তব ; জাগে নিত্য কতই প্রহরী । এ পারে নির্জন তীরে একাকী উঠেছে ঊর্ধ্বে উচ্চ গিরিশিরে রঞ্জিত মেঘের মাঝে তুষারধবল তোমার প্রাসাদসৌধ , অনিন্দ্যনির্মল চন্দ্রকান্তমণিময় । বিজনে বিরলে হেথা তব দক্ষিণের বাতায়নতলে মঞ্জরিত-ইন্দুমল্লী-বল্লরীবিতানে , ঘনচ্ছায়ে , নিভৃত কপোতকলগানে একান্তে কাটিবে বেলা ; স্ফটিকপ্রাঙ্গণে জলযন্ত্রে উৎসধারা কল্লোলক্রন্দনে উচ্ছ্বসিবে দীর্ঘদিন ছলছলছল — মধ্যাহ্নেরে করি দিবে বেদনাবিহ্বল করুণাকাতর । অদূরে অলিন্দ- ' পরে পুঞ্জ পুচ্ছ বিস্ফারিয়া স্ফীত গর্বভরে নাচিবে ভবনশিখী , রাজহংসদল চরিবে শৈবালবনে করি কোলাহল বাঁকায়ে ধবল গ্রীবা , পাটলা হরিণী ফিরিবে শ্যামল ছায়ে । অয়ি একাকিনী , আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর । রানী । ওরে তুই কর্মভীরু অলস কিংকর , কী কাজে লাগিবি ? ভৃত্য। অকাজের কাজ যত , আলস্যের সহস্র সঞ্চয় । শত শত আনন্দের আয়োজন । যে অরণ্যপথে কর তুমি সঞ্চরণ বসন্তে শরতে প্রত্যুষে অরুণোদয়ে , শ্লথ অঙ্গ হতে তপ্ত নিদ্রালসখানি স্নিগ্ধ বায়ুস্রোতে করি দিয়া বিসর্জন , সে বনবীথিকা রাখিব নবীন করি । পুষ্পাক্ষরে লিখা তব চরণের স্তুতি প্রত্যহ উষায় বিকশি উঠিবে তব পরশতৃষায় পুলকিত তৃণপুঞ্জতলে । সন্ধ্যাকালে যে মঞ্জু মালিকাখানি জড়াইবে ভালে কবরী বেষ্টন করি , আমি নিজ করে রচি সে বিচিত্র মালা সান্ধ্য যূথীস্তরে , সাজায়ে সুবর্ণ-পাত্রে তোমার সম্মুখে নিঃশব্দে ধরিব আসি অবনতমুখে — যেথায় নিভৃত কক্ষে ঘন কেশপাশ তিমিরনির্ঝরসম উন্মুক্ত-উচ্ছ্বাস তরঙ্গকুটিল এলাইয়া পৃষ্ঠ- ' পরে , কনকমুকুর অঙ্কে , শুভ্রপদ্মকরে বিনাইবে বেণী । কুমুদসরসীকূলে বসিবে যখন সপ্তপর্ণতরুমূলে মালতী-দোলায় — পত্রচ্ছেদ-অবকাশে পড়িবে ললাটে চক্ষে বক্ষে বেশবাসে কৌতূহলী চন্দ্রমার সহস্র চুম্বন , আনন্দিত তনুখানি করিয়া বেষ্টন উঠিবে বনের গন্ধ বাসনা-বিভোল নিশ্বাসের প্রায় , মৃদু ছন্দে দিব দোল মৃদুমন্দ সমীরের মতো । অনিমেষে যে প্রদীপ জ্বলে তব শয্যাশিরোদেশে সারা সুপ্তনিশি , সুরনরস্বপ্নাতীত নিদ্রিত শ্রীঅঙ্গপানে স্থির অকম্পিত নিদ্রাহীন আঁখি মেলি — সে প্রদীপখানি আমি জ্বালাইয়া দিব গন্ধতৈল আনি । শেফালির বৃন্ত দিয়া রাঙাইব , রানী , বসন বাসন্তী রঙে । পাদপীঠখানি নব ভাবে নব রূপে শুভ-আলিম্পনে প্রত্যহ রাখিব অঙ্কি কুঙ্কুমে চন্দনে কল্পনার লেখা । নিকুঞ্জের অনুচর , আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর । রানী । কী লইবে পুরস্কার । ভৃত্য । প্রত্যহ প্রভাতে ফুলের কঙ্কণ গড়ি কমলের পাতে আনিব যখন , পদ্মের কলিকাসম ক্ষুদ্র তব মুষ্টিখানি করে ধরি মম আপনি পরায়ে দিব , এই পুরস্কার । আশোকের কিশলয়ে গাঁথি দিব হার প্রতি সন্ধ্যাবেলা , অশোকের রক্তকান্তে চিত্রি পদতল চরণ-অঙ্গুলিপ্রান্তে লেশমাত্র রেণু চুম্বিয়া মুছিয়া লব , এই পুরস্কার । রানী । ভৃত্য , আবেদন তব করিনু গ্রহণ । আছে মোর বহু মন্ত্রী , বহু সৈন্য , বহু সেনাপতি — বহু যন্ত্রী কর্মযন্ত্রে রত — তুই থাক্ চিরদিন স্বেচ্ছাবন্দী দাস , খ্যাতিহীন , কর্মহীন । রাজসভা-বহিঃপ্রান্তে রবে তোর ঘর — তুই মোর মালঞ্চের হবি মালাকর ।