স্নেহস্মৃতি

            সেই চাঁপা , সেই বেলফুল , 
কে তোরা আজি এ প্রাতে     এনে দিলি মোর হাতে — 
         জল আসে আঁখিপাতে , হৃদয় আকুল । 
             সেই চাঁপা! সেই বেলফুল! 
  
  
কত দিন , কত সুখ ,        কত হাসি , স্নেহমুখ , 
        কত কী পড়িল মনে প্রভাতবাতাসে — 
স্নিগ্ধ প্রাণ সুধাভরা        শ্যামল সুন্দর ধরা , 
        তরুণ অরুণরেখা নির্মল আকাশে । 
সকলি জড়িত হয়ে          অন্তরে যেতেছে বয়ে , 
        ডুবে যায় অশ্রুজলে হৃদয়ের কূল — 
মনে পড়ে তারি সাথে         জীবনের কত প্রাতে 
          সেই চাঁপা! সেই বেলফুল! 
  
  
বড়ো বেসেছিনু ভালো           এই শোভা , এই আলো , 
        এ আকাশ , এ বাতাস , এই ধরাতল । 
কতদিন বসি তীরে        শুনেছি নদীর নীরে 
        নিশীথের সমীরণে সংগীত তরল । 
কতদিন পরিয়াছি           সন্ধ্যাবেলা মালাগাছি 
        স্নেহের হস্তের গাঁথা বকুলমুকুল — 
বড়ো ভালো লেগেছিল             যেদিন এ হাতে দিল 
          সেই চাঁপা! সেই বেলফুল! 
  
  
কত শুনিয়াছি বাঁশি ,            কত দেখিয়াছি হাসি , 
        কত উৎসবের দিনে কত যে কৌতুক । 
কত বরষার বেলা        সঘন আনন্দ-মেলা , 
        কত গানে জাগিয়াছে সুনিবিড় সুখ । 
  এ প্রাণ বীণার মতো             ঝংকারি উঠেছে কত 
        আসিয়াছে শুভক্ষণ কত অনুকূল — 
মনে পড়ে তারি সাথে        কতদিন কত প্রাতে 
         সেই চাঁপা! সেই বেলফুল! 
  
  
সেই-সব এই-সব ,        তেমনি পাখির রব , 
        তেমনি চলেছে হেসে জাগ্রত সংসার । 
দক্ষিণ-বাতাসে-মেশা        ফুলের গন্ধের নেশা 
        দিকে দিকে ব্যাকুলতা করিছে সঞ্চার । 
অবোধ অন্তরে তাই        চারি দিক -পানে চাই , 
        অকস্মাৎ আনমনে জেগে উঠে ভুল — 
বুঝি সেই স্নেহসনে           ফিরে এল এ জীবনে 
            সেই চাঁপা! সেই বেলফুল! 
  
  
আনন্দপাথেয় যত             সকলি হয়েছে গত , 
       দুটি রিক্তহস্তে মোর আজি কিছু নাই । 
তবু সম্মুখের পানে        চলেছি কঠিন প্রাণে , 
      যেতে হবে গম্যস্থানে , ফিরে না তাকাই । 
দাঁড়ায়ো না , চলো চলো ,          কী আছে কে জানে বলো 
       ধূলিময় শুষ্কপথ , সংশয় বিপুল — 
শুধু জানিয়াছি সার                 কভু ফুটিবে না আর 
           সেই চাঁপা! সেই বেলফুল! 
  
  
আমি কিছু নাহি চাই ,          যাহা দিবে লব তাই 
       চিরসুখ এ জগতে কে পেয়েছে কবে । 
প্রাণে লয়ে উপবাস          কাটে কত বর্ষমাস , 
       তৃষিত তাপিত চিত্ত কত আছে ভবে । 
শুধু এক ভিক্ষা আছে ,      যেদিন আসিবে কাছে 
       জীবনের পথশেষে মরণ অকূল 
সেদিন স্নেহের সাথে         তুলে দিয়ো এই হাতে 
        সেই চাঁপা! সেই বেলফুল! 
  
  
হয়তো মৃত্যুর পারে            ঢাকা সব অন্ধকারে , 
       স্বপ্নহীন চিরসুপ্তি চক্ষে চেপে রহে , 
গীতগান হেথাকার           সেথা নাহি বাজে আর , 
     হেথাকার বনগন্ধ সেথা নাহি বহে । 
কে জানে সকল স্মৃতি           জীবনের সব প্রীতি 
       জীবনের অবসানে হবে কি উন্‌মূল ? 
জানি নে গো এই হাতে নিয়ে যাব কিনা সাথে 
         সেই চাঁপা! সেই বেলফুল! 
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *