সিন্ধুপারে
লাক্ষা দ্বীপ নিয়ে বড্ড বেশি তুলকালাম করার কোনওই প্রয়োজন থাকত না, যদি না তার সঙ্গে ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস বিজড়িত থাকত।
প্রথম প্রশ্ন : পশ্চিমদিকে ভারতীয়রা কতখানি রাজত্ব বিস্তার করেছিল? কোন কোন জায়গায় তারা কলোনি নির্মাণ করেছিল?
আমার সীমাবদ্ধ ইতিহাস ভূগোল জ্ঞান বলে, পশ্চিম দিকে, ভারতের দক্ষিণতম প্রান্ত কন্যাকুমারী থেকে প্রায় দু হাজার মাইল দূরে, আদন বন্দরের প্রায় ছ শো মাইল পুব দিকে সোকোত্রা দ্বীপে। ম্যাপ খুললেই দেখা যায়, এ-দ্বীপ যার অধিকারে থাকে সে তাবৎ লোহিত সাগর, আরব সমুদ্র এবং পার্সিয়ান গালফের ওপরও আধিপত্য করতে পারে।
এই সোকোত্রা দ্বীপের গ্রিক নাম দিয়োকরিদে এবং পণ্ডিতেরা বলেন এ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত দ্বীপ-সুখাধার থেকে। মনে হয়, ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্ত থেকে নৌকোয় বেরিয়ে, দু হাজার মাইল ঝড়ঝার সঙ্গে লড়াই করতে করতে যে কোনও জায়গায় পৌঁছলেই মানুষ সেটাকে সুখাধার বলবেই বলবে। কিন্তু এ-দ্বীপের পরিষ্কার ইতিহাস জানবার তো উপায় নেই। প্রাচীন গ্রিক ভৌগোলিকেরা বলছেন, এ দ্বীপে বাস করত ভারতীয়, গ্রিক ও আরব বণিকরা। পরবর্তী যুগের ঐতিহাসিকরা বলছেন, এটা তখন ভারতীয় বম্বেটেদের থানা। তারা তখন আরব ব্যবসায়ী জাহাজ লুটপাট করত।
মনে বড় আনন্দ হল। এদানির অহিংসা অহিংসা শুনে শুনে প্রাণ অতিষ্ঠ। আমরাও যে একদা বম্বেটে ছিলুম সেটা শুনে চিত্তে পুলক জাগল। বম্বেটেগিরি হয়তো পুণ্যপন্থা নয়, কিন্তু এ-কথা তো সত্য যেদিন থেকে আমরা সমুদ্রযাত্রা বন্ধ করে দিলুম সেইদিন থেকেই ভারতের দুঃখ দৈন্য, অভাব দারিদ্র্য আরম্ভ হল।
সোকোত্রা দ্বীপকে মিশরিরা নাম দিয়েছিল সুগন্ধের সারিভূমি–অর্থাৎ সারি কেটে কেটে যেখানে সুগন্ধ দ্রব্যের চাষ হয়। এবং এখন সেখানে ঘৃতকুমারী (মুসব্বর), মস্তকি (MyTh), গুগগুল এবং আরও কী একটা উৎপাদিত হয়। মামি তৈরি করার জন্য মিশরীয়দের অনেক কিছুর প্রয়োজন হত। এবং খুশবাইয়ের প্রতি ওদের এখনও খুবই শখ। খ্রিস্টপূর্ব হাজার বছর আগে রচিত রাজা সুলেমানের গীতে বিস্তর সুগন্ধের উল্লেখ আছে। এদের অধিকাংশই যেত ভারত, সিংহল, ইন্দোনেশিয়া এবং সোকোত্রা থেকে। এবং এই সোকোত্রাই ছিল ভারত ও আরব বণিকদের পণ্যদ্রব্য বিনিময়ের মিলনভূমি। আরবদের মারফতে সেসব গন্ধদ্রব্য বিলেত পর্যন্ত পৌঁছত। তাই শেকসপিয়র ভেবেছিলেন এসব গন্ধদ্রব্য বুঝি আরব দেশেই জন্মায়– লেডি মেকবেথ বলছেন, অল দি পারফিউমজ অব আরাবিয়া উইল নট সুইটেন দিস লিটিল হ্যান্ড। এই গন্ধের ব্যবসা তখন খুবই লাভজনক ছিল। এবং কাঠিয়াওয়াড়ের গন্ধবণিকরা এর একটা বড় হিস্যা পেতেন। মহাত্মা গান্ধীর জন্মবার্ষিকীতে এই সুবাদে স্মরণ যেতে পারে যে তিনি জাতে গন্ধবণিক– সেই গন্ধ থেকে তাঁর পরিবারের নাম গাঁধী।
ভারতীয় বণিকরা লাক্ষাদ্বীপ বা মালদ্বীপ থেকে তাদের শেষ রসদ এবং সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস জল নিয়ে এখান থেকে পাগের নৌকায় করে দু হাজার মাইলের পাড়ি দিতেন।
***
সচরাচর বলা হয়, আরব নাবিকরাই প্রথম মৌসুমি বায়ু আবিষ্কার করে। আমি কিন্তু ভিন্ন মত পোষণ করি। আমার ধারণা, ভারতীয়রাই প্রথম লক্ষ করে যে শীতকালে বাতাস পশ্চিমবাগে বয়। তারই সুবিধে নিয়ে পাল তুলে দিয়ে পণ্যসম্ভার নিয়ে তারা যেত সোকোত্রা। ফিরে আসত গ্রীস্মারম্ভে যখন সোকোত্রা থেকে পুব বাগে বাতাস বয়। ভারতীয় নাবিক যদি কোস্টাল সেলিংই (পাড় ঘেঁষে ঘেঁষে) করবে তবে তো তারা সিন্ধুদেশ, বেলুচিস্তান, ইরানের পাড় ঘেঁষে ঘেঁষে দক্ষিণ আরবিস্তানে পৌঁছে যেত। অর্থাৎ আদন বন্দরের কাছাকাছি। সেখান থেকে আবার ছ শো মাইল পুব বাগে সোকোত্ৰা আসবে কেন?
তার পর কর্তারা সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ করে দিলেন।
সে-কথা আরেকদিন হবে।