সন্ধ্যা

ক্ষান্ত হও , ধীরে কও কথা । ওরে মন , 
নত করো শির । দিবা হল সমাপন , 
সন্ধ্যা আসে শান্তিময়ী । তিমিরের তীরে 
অসংখ্য-প্রদীপ-জ্বালা এ বিশ্বমন্দিরে 
এল আরতির বেলা । ওই শুন বাজে 
নিঃশব্দ গম্ভীর মন্দ্রে অনন্তের মাঝে 
শঙ্খঘণ্টাধ্বনি । ধীরে নামাইয়া আনো 
বিদ্রোহের উচ্চ কণ্ঠ পূরবীর ম্লান- 
মন্দ স্বরে । রাখো রাখো অভিযোগ তব , 
মৌন করো বাসনার নিত্য নব নব 
নিষ্ফল বিলাপ । হেরো মৌন নভস্তল , 
ছায়াচ্ছন্ন মৌন বন , মৌন জলস্থল 
স্তম্ভিত বিষাদে নম্র । নির্বাক্‌ নীরব 
দাঁড়াইয়া সন্ধ্যাসতী — নয়নপল্লব 
নত হয়ে ঢাকে তার নয়নযুগল , 
অনন্ত আকাশপূর্ণ অশ্রু-ছলছল 
করিয়া গোপন । বিষাদের মহাশান্তি 
ক্লান্ত ভুবনের ভালে করিছে একান্তে 
সান্ত্বনা-পরশ । আজি এই শুভক্ষণে , 
শান্ত মনে , সন্ধি করো অনন্তের সনে 
সন্ধ্যার আলোকে । বিন্দু দুই অশ্রুজলে 
দাও উপহার — অসীমের পদতলে 
জীবনের স্মৃতি । অন্তরের যত কথা 
শান্ত হয়ে গিয়ে , মর্মান্তিক নীরবতা 
করুক বিস্তার । 
  
  
               হেরো ক্ষুদ্র নদীতীরে 
সুপ্তপ্রায় গ্রাম । পক্ষীরা গিয়েছে নীড়ে , 
শিশুরা খেলে না ; শূন্য মাঠ জনহীন ; 
ঘরে-ফেরা শ্রান্ত গাভী গুটি দুই-তিন 
কুটির-অঙ্গনে বাঁধা , ছবির মতন 
স্তব্ধপ্রায় । গৃহকার্য হল সমাপন — 
কে ওই গ্রামের বধূ ধরি বেড়াখানি 
সম্মুখে দেখিছে চাহি , ভাবিছে কী জানি 
ধূসর সন্ধ্যায় । 
  
  
                অমনি নিস্তব্ধপ্রাণে 
বসুন্ধরা , দিবসের কর্ম-অবসানে , 
দিনান্তের বেড়াটি ধরিয়া আছে চাহি 
দিগন্তের পানে । ধীরে যেতেছে প্রবাহি 
সম্মুখে আলোকস্রোত অনন্ত অম্বরে 
নিঃশব্দ চরণে ; আকাশের দূরান্তরে 
একে একে অন্ধকারে হতেছে বাহির 
একেকটি দীপ্ত তারা , সুদূর পল্লীর 
প্রদীপের মতো । ধীরে যেন উঠে ভেসে 
ম্লানচ্ছবি ধরণীর নয়ননিমেষে 
কত যুগ-যুগান্তের অতীত আভাস , 
কত জীবজীবনের জীর্ণ ইতিহাস । 
যেন মনে পড়ে সেই বাল্যনীহারিকা ; 
তার পরে প্রজ্বলন্ত যৌবনের শিখা ; 
তার পরে স্নিগ্ধশ্যাম অন্নপূর্ণালয়ে 
জীবধাত্রী জননীর কাজ বক্ষে লয়ে 
লক্ষ কোটি জীব — কত দুঃখ , কত ক্লেশ , 
কত যুদ্ধ , কত মৃত্যু , নাহি তার শেষ । 
  
  
ক্রমে ঘনতর হয়ে নামে অন্ধকার , 
গাঢ়তর নীরবতা — বিশ্বপরিবার 
সুপ্ত নিশ্চেতন । নিঃসঙ্গিনী ধরণীর 
বিশাল অন্তর হতে উঠে সুগম্ভীর 
একটি ব্যথিত প্রশ্ন , ক্লিষ্ট ক্লান্ত সুর , 
শূন্যপানে — “ আরো কোথা ? আরো কত দূর ?” 
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *