কোথা গেল সেই মহান শান্ত নব নির্মল শ্যামলকান্ত উজ্জ্বলনীলবসনপ্রান্ত সুন্দর শুভ ধরণী । আকাশ আলোকপুলকপুঞ্জ , ছায়াসুশীতল নিভৃত কুঞ্জ , কোথা সে গভীর ভ্রমরগুঞ্জ , কোথা নিয়ে এল তরণী । ওই রে নগরী — জনতারণ্য , শত রাজপথ , গৃহ অগণ্য , কতই বিপণি , কতই পণ্য কত কোলাহলকাকলি । কত-না অর্থ কত অনর্থ আবিল করিছে স্বর্গমর্ত , তপনতপ্ত ধূলি-আবর্ত উঠিছে শূন্য আকুলি । সকলি ক্ষণিক , খণ্ড , ছিন্ন — পশ্চাতে কিছু রাখে না চিহ্ন , পলকে মিলিছে পলকে ভিন্ন ছুটিছে মৃত্যু-পাথারে । করুণ রোদন কঠিন হাস্য , প্রভূত দম্ভ বিনীত দাস্য , ব্যাকুল প্রয়াস , নিষ্ঠুর ভাষ্য , চলিছে কাতারে কাতারে । স্থির নহে কিছু নিমেষমাত্র , চাহে নাকো কিছু প্রবাসযাত্র , বিরামবিহীন দিবসরাত্র চলিছে আঁধারে আলোকে । কোন্ মায়ামৃগ কোথায় নিত্য স্বর্ণঝলকে করিছে নৃত্য তাহারে বাঁধিতে লোলুপচিত্ত ছুটিছে বৃদ্ধবালকে । এ যেন বিপুল যজ্ঞকুণ্ড , আকাশে আলোড়ি শিখার শুণ্ড হোমের অগ্নি মেলিছে তুণ্ড ক্ষুধার দহন জ্বালিয়া । নরনারী সবে আনিয়া তূর্ণ প্রাণের পাত্র করিয়া চূর্ণ বহ্নির মুখে দিতেছে পূর্ণ জীবন-আহুতি ঢালিয়া । চারি দিকে ঘিরি যতেক ভক্ত স্বর্ণবরনমরণাসক্ত দিতেছে অস্থি , দিতেছে রক্ত , সকল শক্তিসাধনা । জ্বলি উঠে শিখা ভীষণ মন্দ্রে , ধূমায়ে শূন্য রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুপ্ত করিছে সূর্যচন্দ্রে বিশ্বব্যাপিনী দাহনা । বায়ুদলবল হইয়া ক্ষিপ্ত ঘিরি ঘিরি সেই অনল দীপ্ত কাঁদিয়া ফিরিছে অপরিতৃপ্ত , ফুঁসিয়া উষ্ণ শ্বসনে । যেন প্রসারিয়া কাতর পক্ষ কেঁদে উড়ে আসে লক্ষ লক্ষ পক্ষীজননী , করিয়া লক্ষ্য খাণ্ডব-হুত-অশনে । বিপ্র ক্ষত্র বৈশ্য শূদ্র মিলিয়া সকলে মহৎ ক্ষুদ্র খুলেছে জীবনযজ্ঞ রুদ্র আবালবৃদ্ধরমণী । হেরি এ বিপুল দহনরঙ্গ আকুল হৃদয় যেন পতঙ্গ ঢালিবারে চাহে আপন অঙ্গ , কাটিবারে চাহে ধমনী । হে নগরী , তব ফেনিল মদ্য উছসি উছলি পড়িছে সদ্য , আমি তাহা পান করিব অদ্য , বিস্মৃত হব আপনা । অয়ি মানবের পাষাণী ধাত্রী , আমি হব তব মেলার যাত্রী সুপ্তিবিহীন মত্ত রাত্রি জাগরণে করি যাপনা । ঘূর্ণচক্র জনতাসংঘ , বন্ধনহীন মহা- আসঙ্গ , তারি মাঝে আমি করিব ভঙ্গ আপন গোপন স্বপনে । ক্ষুদ্র শান্তি করিব তুচ্ছ , পড়িব নিম্নে , চড়িব উচ্চ , ধরিব ধূম্রকেতুর পুচ্ছ , বাহু বাড়াইব তপনে । নব নব খেলা খেলে অদৃষ্ট কখনো ইষ্ট কভু অনিষ্ট , কখনো তিক্ত কখনো মিষ্ট , যখন যা দেয় তুলিয়া — সুখের দুখের চক্রমধ্যে কখনো উঠিব উধাও পদ্যে , কখনো লুটিব গভীর গদ্যে , নাগরদোলায় দুলিয়া । হাতে তুলি লব বিজয়বাদ্য আমি অশান্ত , আমি অবাধ্য যাহা-কিছু আছে অতি অসাধ্য তাহারে ধরিব সবলে । আমি নির্মম আমি নৃশংস সবেতে বসাব নিজের অংশ , পরমুখ হতে করিয়া ভ্রংশ তুলিব আপন কবলে । মনেতে জানিব সকল পৃথ্বী আমারি চরণ-আসনভিত্তি , রাজার রাজ্য দস্যুবৃত্তি কোনো ভেদ নাহি উভয়ে । ধনসম্পদ করিব নস্য , লুণ্ঠন করি আনিব শস্য , অশ্বমেধের মুক্ত অশ্ব ছুটাব বিশ্বে অভয়ে । নব নব ক্ষুধা , নূতন তৃষ্ণা , নিত্যনূতন কর্মনিষ্ঠা , জীবনগ্রন্থে নূতন পৃষ্ঠা উলটিয়া যাব ত্বরিতে । জটিল কুটিল চলেছে পন্থ নাহি তার আদি নাহিকো অন্ত , উদ্দামবেগে ধাই তুরন্ত সিন্ধু-শৈল-সরিতে । শুধু সম্মুখে চলেছি লক্ষি আমি নীড়হারা নিশার পক্ষী , তুমিও ছুটিছ চপলা লক্ষ্মী , আলেয়া-হাস্যে ধাঁধিয়া । পূজা দিয়া পদে করি না ভিক্ষা , বসিয়া করি না তব প্রতীক্ষা , কে কারে জিনিবে হবে পরীক্ষা — আনিব তোমারে বাঁধিয়া । মানবজন্ম নহে তো নিত্য , ধনজনমান খ্যাতি ও বিত্ত নহে তারা কারো অধীন ভৃত্য — কাল-নদী ধায় অধীরা । তবে দাও ঢালি — কেবলমাত্র দু-চারি দিবস , দু-চারি রাত্র , পূর্ণ করিয়া জীবনপাত্র জনসংঘাতমদিরা ।